প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

ষষ্ঠ অধ্যায় : বুয়াইয়া (৯৪৫-১০৫৫ খ্রি.) এবং সেলজুক বংশ (১০৫৫-১১৯৪ খ্রি.)

ষষ্ঠ অধ্যায় – বুয়াইয়া এবং সেলজুক বংশ 

বুয়াইয়া বংশ [৯৪৫-১০৫৫ খ্রি.] 

অভ্যুত্থান 

আব্বাসীয় খিলাফতের সর্বাপেক্ষা দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়ের সূচনা হয় শিয়া মতাবলম্বী বুয়াইয়া আমীরদের অভ্যুত্থানে। দশম শতাব্দীতে আবু সুজা কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ তীরে পার্বত্য অঞ্চল দাইলামের উপজাতিদের নেতৃত্ব দান করেন। সাসানীয় রাজবংশের অধীনে আবু সুজা চাকরি গ্রহণ করেন। প্রাচীন সাসানীয় বংশের উত্তরাধিকারিত্ব দাবি করে আবু সুজা ‘বুয়াইয়া’ উপাধি ধারণ করে স্বীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকেন। আবু সুজার তিন পুত্র ছিল- আহমদ, আলী ও হাসান। দক্ষিণ দিকে অভিযান পরিচালিত করে তাঁরা ৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে সিরাজ, ইস্পাহান এবং পরবর্তীকালে কিরমান, খুজীস্তান প্রভৃতি শহর অধিকার করেন। অধিকৃত অঞ্চলের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয় সিরাজে। আহমদ- ইবন-আবু-সুজা-বুয়াইয়া অতঃপর ৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ অভিযান করলে তুর্কী প্রহরীরা পলায়ন করে। তৎকালীন দুর্বল এবং বিলাসপ্রিয় আব্বাসীয় খলিফা মুসতাকফী (৯৪৪- ৪৬ খ্রি.) তুর্কী-বাহিনীর ঔদ্ধত্য এবং দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে আহমদকে রাজধানীতে আহ্বান করেন। আহমদ ৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে প্রবেশ করে খলিফাকে শক্তিহীন ক্রীড়নকে পরিণত করে পিতা বুয়াইয়ার নামানুসারে বংশের নাম দিলেন বুয়াইয়া বংশ। 

মুইজ-উদ-দৌলাহ (৯৪৫-৯৬৭ খ্রি.) 

বুয়াইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ খলিফা কর্তৃক প্রদত্ত মুইজ-উদ-দৌলাহ্ উপাধিতে ভূষিত হয়ে আমীর-উল-উমরাহ পদে অধিষ্ঠিত হন। আহমদের আক্রমণে দুর্ধর্ষ তুর্কী বাহিনী পলায়ন করলে খলিফা তুর্কীদের নাগপাশ হতে মুক্ত হলেন বটে কিন্তু বুয়াইয়াদের প্রভাবাধীনে ( Tutelage) থেকে প্রকৃত ক্ষমতা হতে বঞ্চিত হলেন। উপরন্তু শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত পারসিক বুয়াইয়াগণ আরব আব্বাসীয় সুন্নী সম্প্রদায়ের উপর কর্তৃত্ব এবং প্রভুত্ব করতে থাকে। খলিফার দুর্বলতা ও অকর্মণ্যতার সুযোগে মুইজ-উদ-দৌলাহ্ রাজধানীতে অবস্থান করে সমস্ত ক্ষমতা কেবল গ্রাসই করলেন না; বরং খলিফার সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে তিনি সুলতান উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি মুদ্রায় নিজের নাম অংকিত করেন এবং খুৎবায় তাঁর নামের উল্লেখ করতে বাধ্য করেন। ক্ষমতালোভী, হৃদয়হীন এবং বিশ্বাসঘাতক আহমদ স্বীয় প্রভুত্ব সম্প্রসারিত করবার জন্য খলিফা মুসতাকফীকে ৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে অন্ধ করে মুকতাদিরের অপর পুত্রকে ‘আল-মুতী’ (৯৪৬- ‘৭৪ খ্রি.) উপাধি প্রদান করে সিংহাসনে উপবেশন করালেন। এভাবে প্রকৃত ক্ষমতা হস্তগত করে তিনি সুন্নী প্রাধান্য খর্ব করে শিয়া প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। শিয়া সম্প্রদায়ের সহানুভূতির লাভের আশায় তিনি ১০ই মহররমকে শিয়াদের জাতীয় বাৎসরিক শোক দিবসে পরিণত করেন। হিট্টির মতে, “শিয়া সম্প্রদায়ের হাতে খিলাফতের হীন ও জঘন্য অধ্যায়ের সূচনা হল এবং ক্ষমাতলিপ্সু বুয়াইয়াগণ শত বৎসরব্যাপী স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালিত করে আব্বাসীয় খলিফাকে সাক্ষীগোপালে (Puppet) পরিণত করে।” খলিফা তাঁর আমীর-উল-উমরাহর নিকট হতে দৈনিক ৫০০০ দিনার বৃত্তি লাভ করে তাদের আশ্রিত হয়ে থাকেন। মুইজ-উদ- দৌলার শাসনামলে বাগদাদ নগরীর হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করা হয়। সিরাজ, গজনী, কায়রো, কর্ডোভা প্রভৃতি নগরীও মুসলিম শাসনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। 

৯৪৫ হতে ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বুয়াইয়া আমীরগণ ক্ষমতার অধিকারী থেকে স্বৈরাচারী নীতি এবং বংশীয় স্বার্থে খেয়াল-খুশীমত খলিফাকে অধিষ্ঠিত এবং অপসারিত করতে থাকেন। বাগদাদে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করে তারা বিভিন্ন সুষমামণ্ডিত রাজপ্রাসাদে বসবাস করতে থাকেন। এদের নাম ছিল দার-আল-মামলাকা (Dar-al- Mamlakah) অথবা ( Abode of the Kingdom)। নিষ্ঠুর এবং বিশ্বাসঘাতক হলেও মুইজ-উদ-দৌলাহ বিদ্যানুরাগী ছিলেন এবং শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। 

ইজ্জুদৌলাহ (৯৬৭ খ্রি.) 

মুইজ-উদ-দৌলাহর মৃত্যুর পর ৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র বখতিয়ার ‘ইজ্জুদৌলাহ্” উপাধি গ্রহণকরে আমীর-উল-উমরাহ্ পদে অধিষ্ঠিত হন। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতী (৯৪৬-৯৭৪ খ্রি.) প্রায় ত্রিশ বছর বুয়াইয়াদের কর্তৃত্বাধীনে থেকে রোগগ্রস্ত হয়ে তাঁর পুত্র আল-তাইকে (৯৭৪-৯৯১ খ্রি.) খিলাফত প্রদান করেন। ইজ্জদৌলাহ আল-মুতীর খিলাফতকালে ইরাকে একদল তুর্কী কর্তৃক বিপদগ্রস্ত হলে তার পিতৃব্য-পুত্র আজদু-উদ-দৌলাহ সাহসিকতার সাথে তাঁকে উদ্ধার করেন। পিতা রুকন-উদ-দৌলাহ্র সনির্বন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি ইজ্জুদৌলাকে পদচ্যুত করে হত্যা করেন এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। 

আজদু-উদ-দৌলাহ (৯৬৭-৯৮৩ খ্রি.) 

হিট্টি বলেন, “আজদু-উদ-দৌলাহর সময়েই বুয়াইয়া শক্তি সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হয়। তিনি ইস্পাহানে জন্মগ্রহণ করেন। স্বীয় অধ্যবসায়, কর্মদক্ষতা এবং বিচক্ষণতায় আজদু-উল-দৌলাহ কেবল শ্রেষ্ঠ বুয়াইয়া আমীরই ছিলেন না, সেই সময়কালের অন্যতম বিখ্যাত শাসকও ছিলেন।” বুয়াইয়া আমীরগণ কর্তৃক স্থাপিত ইরাক ও পারস্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যকে তিনি সংঘবদ্ধ করে খলিফা হারুনের সাম্রাজ্যের ন্যায় একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। উচ্চাভিলাসী শাসক আজদু-উদ-দৌলাহ ‘সুলতান’ এবং ‘শাহানশাহ’ উভয় উপাধি গ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম বুয়াইয়া সুলতান যিনি শাহানশাহ উপাধিতে ভূষিত হন। বুয়াইয়া রাজপুত্রকে আব্বাসীয় সিংহাসনে অধিষ্টিত করবার উদ্দেশ্যে আজদু-উদ-দৌলাহ নিজ কন্যার সাথে খলিফা আত-তাইয়ের বিবাহ দেন। তিনি নিজেও খলিফার এক কন্যার পাণি গ্রহণ করেন। আরনল্ড বলেন, “বুয়াইয়া রাজ্য গৌরবের সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হল। ৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্বে তিনি কাম্পিয়ান সাগর হতে পারস্য উপসাগর এবং ইস্পাহান থেকে সিরিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ডের অধিপতি হন। ক্রমশ তিনি ইরাকে প্রাধান্য কায়েম করলেন এবং বাগদাদের খলিফার প্রভু হলেন।” ক্ষমতালোভী সুলতান মুসলিম সাম্রাজ্যের আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব বিষয়ের সর্বসময় ক্ষমতাধিকারী খলিফাকে অবমাননা করতে কুণ্ঠিত হন নি। খিলাত, মণিমুক্তাখচিত মুকুট, রাজুবন্ধ, তরবারি, দুটি রাষ্ট্রীয় পতাকা প্রভৃতি প্রদানের জন্য তিনি খলিফাকে বাধ্য করেন। উপরন্তু, খলিফার রাজপ্রাসাদের ফটকে সকাল-সন্ধ্যা এবং রাত্রিকালে যেভাবে নহবত বাজান হতো, অনুরূপভাবে মহিমা প্রকাশের জন্য সুলতানের প্রাসাদেও নহবত বাজান হত। এ ছাড়া খুৎবায় তাঁর নাম পাঠের ব্যবস্থা করা হয়। এতে খলিফা চুড়ান্ত অপমানিত হন এবং এটি তাঁর সার্বভৌমত্বে আঘাত হানে। খুৎবায় নাম পাঠের প্রথা প্রচলিত হবার পর তিনি শিয়া সম্পদ্রায়ভুক্ত কায়রোর ফাতেমী খলিফার নিকট হতে একজন রাষ্ট্রদূতকে অভ্যর্থনা জানান। 

আজদু-উদ-দৌলাহর রাজত্বকালে বহু জনহিতকর কার্যকলাপ, শিল্প, সাহিত্যচর্চা, শিক্ষা-দীক্ষার সম্প্রসারণ এবং মুসলিম কৃষ্টির উৎকর্ষ সাধিত হয়। তিনি জনসাধারণের সুবিধার্থে বহু খাল খনন করেন। এই সময় মসজিদ, হাসপাতাল প্রভৃতি নির্মিত হয়। হযরত আলীর কবরস্থান বলে কথিত নাজফ নামক স্থানে তিনি একটি অপূর্ব সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন। তিনি বাগদাদের সর্বশ্রেষ্ঠ হাসপাতাল আল-বিমারিস্তান আল-আজাদী স্থাপন করে চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করেন। প্রায় এক লক্ষ দিনার ব্যয়ে নির্মিত এই হাসপাতালে দু জন চিকিৎসক নিযুক্ত করা হয়। তিনি দাতা ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। শিক্ষিত, মার্জিত রুচিসম্পন্ন এবং জ্ঞানী আজদু-উদ-দৌলাহর পৃষ্ঠপোষকতায় বহু প্ৰখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও মনীষী তাঁর সভা অলঙ্কৃত করেন। মুতনব্বী প্রমুখ কবিগণ তাঁর যশোগাথা রচনা করেন। আবু-আলী-আল-ফরিসী তাঁর সম্মানার্থে ‘কিতাব-উল- ইজাহ’ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। বিশ্ববিখ্যাত চিন্তাবিদ ইখওয়া-নুস-সাফাহ সম্প্রদায় এই আমলেই জ্ঞানসাধনা করে প্রসিদ্ধি অর্জন করে। এ সময় আব্বাসীয় সভ্যতার উন্মেষের প্রধান সহায়ক ছিলেন ঐতিহাসিক মাসুদী, দার্শনিক আবু নাসর, ফারাবী, কবি মুতনব্বী, ‘কিতাবুল আঘানীর’ রচয়িতা আবুল ফরাজ প্রমুখ মনীষিগণ। তাঁর খ্রিস্টান উজির নসর-ইবন-হারুন খলিফার অনুমতি নিয়ে রাজ্যে অনেক গীর্জা ও মঠ নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিক মিসকাওয়ার মতে, “যদিও আজদু-উদ-দৌলাহ্র দরবার সিরাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তথাপি বাগদাদ নগরীতে অনেক সুরম্য হর্ম্যরাজি নির্মিত হলে তার সৌন্দর্য শতগুণে বৃদ্ধি পায়।” 

পরবর্তী বুয়াইয়াগণ 

৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে আজদু-উল-দৌলার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সামস-উদ-দৌলাহ উত্তরাধিকার সূত্রে আমীর-উল-উমরাহ হন। তিনি শামস-উল-মিল্লাত বা ‘ধর্মের সূর্য’ উপাধি গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি তাঁর ভ্রাতা শরাফ-উদ-দৌলাহ্ কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হন। শরাফ-উদ-দৌলাহ্ ৯৮৩ হতে ৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্টিত ছিলেন। তিনি জ্ঞানী এবং বিদ্যোৎসাহী ছিলেন এবং মৃত্যুর এক বছর পূর্বে খলিফা আল-মামুনের ন্যায় একটি মানমন্দির (Observatory) নির্মাণ করেন। বাগদাদ সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়; বহু শিক্ষাবিদ, গণিতবিদ ও জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইবন-উস-সালাম, আবদুর রহমান সুফী এবং আবুল ওয়াফা। পরবর্তী আমীর আজদু-উদ-দৌলা অপর পুত্র আবু নসর-বাহা-উদ-দৌলাহ্ (৯৮৯-১০১২ খ্রি.) ‘রাজ্যের আলো’ উপাধি ধারণ করে ভ্রাতা শরাফের স্থলাভিষিক্ত হন। ৯৯১ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা আত-তাইকে পদচ্যুত করে বাহা- উদ-দৌলাহ্ তাঁর ভ্রাতা আবুল আব্বাস আহম্মদকে ‘আল-কাদির বিল্লাহ্ আল্লাহ’ উপাধি প্রদান করে বাগদাদের সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন। বাহা-উদ-দৌলাহ্ ছিলেন ধর্মপ্রাণ, দয়ালু, ধী-শক্তিসম্পন্ন। তাঁর শাসনামলে আব্বাসীয়দের আধ্যাত্মিক প্রতিপত্তি ও সম্মান সুপ্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। তিনি মুতাজিলা মতবাদের বিরোধী ছিলেন। তাঁর প্রখ্যাত পারস্যবাসী মন্ত্রী সাবুর-ইবন-আরদাশীর বাগদাদে ৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ১০,০০০ পুস্তক সম্বলিত একটি পাঠাগারসহ আকর্ষণীয় একাডেমী নির্মাণ করেন। বিখ্যাত সিরীয় কবি আবুল আ’লা আল-মা’রী ছাত্রাবস্থায় উক্ত পাঠাগারে অধ্যয়ন করেন। বুয়াইয়া আমলে প্রখ্যাত পারস্য দার্শনিক আবু সীনা, ঐতিহাসিক মিসকাউই, ভূগোল বিশারদ ইস্তাখারী, অঙ্কশাস্ত্রবিদ না’সাউদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত অবদান রেখে যান। এই সময়ের পর হতেই বুয়াইয়াদের অধঃপতন শুরু হয়। ফাতেমীয় খলিফা আল-আজীজ এমেসা, হামা, আলেপ্পো এবং মেসোপটেমিয়া দখল করলেন। দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় খলিফা এবং স্বাধীন ও কাপট পরবর্তী বুয়াইয়া আমীরগণ ফাতেমীয়দের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন নি। সুলতান-উদ-দৌলাহ্ ১০১২ হতে ১০২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, ইমাদ- উদ-দৌলাহ্ ১০২৪ হতে ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আমীর-উল-উমরাহ্ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা অযোগ্য এবং অলসপ্রিয় আমীর ছিলেন। ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক বংশের তুঘ্রীল বেগ বাগদাদ দখল করে সর্বশেষ বুয়াইয়া আমীর মালিক আর-রহিমকে (১০৪৮-৫৫ খ্রি.) বন্দী করলে বুয়াইয়াদের প্রভুত্ব ধুলিসাৎ হয়ে পড়ে। 

বুয়াইয়াদের পতনের কারণ 

বিভিন্ন কারণে বুয়াইয়া বংশের পতন হয় : প্রথমত, বুয়াইয়াদের পতনের প্রধান কারণ শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব। বলা বাহুল্য যে, শত বছরব্যাপী শাসনকালে বুয়াইয়া আমীরগণ তাদের ইচ্ছানুযায়ী খলিফাকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ও ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং পার্থিব ও ধর্মীয়ক্ষেত্রে তাঁর সম্মান ও প্রতিপত্তিকে সম্পূর্ণরূপে খর্ব করেন। সুন্নী ইসলামের নেতা আমীর-উল-মুমেনীন শিয়া মতাবলম্বী আমীর-উল-উমরাহের নিকট বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। মুদ্রায় তাঁদের নাম অঙ্কন এবং খুৎবায় নাম পাঠ ব্যতীত বিভিন্ন উপায়ে খলিফাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। খলিফার মত পোশাক-পরিচ্ছদ, মুকুট, বাজুবন্ধ, পতাকা এবং তরবারি ব্যবহার করায় সুন্নী সম্প্রদায় অপমাণিত বোধ করে। উপরন্তু, আজদু-উদ-দৌলাহ্ রাজকীয় জাঁকজমক প্রকাশে দ্বিধাবোধ করেন নি; রাজপ্রাসাদের ফটকে যেরূপ নহবত বাজত সুলতানের প্রাসাদে অনুরূপ দৈনিক তিনবার নবহত বাজত। ঐতিহাসিক আরনল্ডের ভাষায়, “এটা খলিফার রাজকীয় অধিকারে আরও একটি আঘাতস্বরূপ ছিল।” এতে সুন্নী আব্বাসীয়গণ শিয়া প্রবণতার (Shiate proclivities) তীব্র বিরোধিতা করতে থাকে। সুন্নী সম্প্রদায়কে নেতৃত্বদান করেন হাম্বলী গোষ্ঠী। মুইজ-উদ-দৌলাহ ১০ই মহররমকে শিয়া সম্প্রদায়ের বাৎসরিক শোক দিবসে পরিণত করেন। এতে তাঁর শিয়া-প্রবণতা প্ৰকাশ পায় এবং ১০১৫ খ্রিস্টাব্দে হাম্বলীগণ ইমাম হুসাইনের সমাধিতে অগ্নি সংযোগ করে। ফলে, আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। 

দ্বিতীয়ত, বুয়াইয়া বংশের অভ্যুত্থানকে সাধারণভাবে আরবদের উপর পারসিকদের প্রভুত্ব বলা যেতে পারে। আব্বাসীয় রাজধানী বাগদাদের সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও বুয়াইয়া আমীরগণ সিরাজে তাদের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। এই কারণে আব্বাসীয় শাসনকালে আরবদের তুলনায় পারসিকগণ অধিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এমনকি বাহা-উদ্-দৌলাহ্ সাবুর-ইবন-আরদাশির নামে একজন পারসিককে উজির হিসেবে নিয়োগ দেন। আব্বাসীয় খিলাফতে বার্মেকী বংশের পতনের পর পুনরায় বুয়াইয়া বংশ পারস্য প্রভাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। বাগদাদের সমকক্ষ হিসেবে পারস্যের সিরাজ, ইস্পাহান, কিরমান, আহওয়াজ প্রভৃতি শহরগুলোকে গড়ে তোলা হয়। আরবগণ আব্বাসীয় বুয়াইয়া আমীরদের পক্ষপাতিত্ব নীতিকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত। 

তৃতীয়ত, বুয়াইয়া আমীরদের নিষ্ঠুরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, স্বার্থান্বেষী অভিসন্ধি, হিংসা, দ্বেষ, গোত্রীয়-কলহ তাদের অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করে। ক্ষমতালোভী ও বিবেকশূন্য মুইজ-উদ্-দৌলাহ্ খলিফা মুসতাকফীকে অন্ধ করতেও দ্বিধা করেন নি। খলিফাদের ক্রীড়নক (Puppet) করে বুয়াইয়াগণ রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতা গ্রাস করে। আমীর আলী বলেন, “ফ্রান্সের মোরাভিঞ্চিয়ান নৃপতিগণের শাসনামলে চার্লস মার্টিলের যেরূপ মর্যাদা ছিল, তাঁর (মুইজ) মর্যাদাও সেরূপ ছিল; কারণ তিনিই প্রকৃত ক্ষমতাসীন ছিলেন। খলিফা ছিলেন তাঁর আশ্রিত মাত্র এবং তিনি রাজকোষ হতে দৈনিক ৫০০০ দিনার বৃত্তিরূপে লাভ করতেন।” 

চতুর্থত, তুর্কীদের প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সুন্নী সেলজুক বংশ বাগদাদ অভিযান করে এবং শিয়া বুয়াইয়াদের ক্ষমতাচ্যুত করে। সেলজুক নেতা তুঘ্রীল বেগ বুয়াইয়া বংশীয় আমীরদের কোন্দল, আত্মকলহ ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের সুযোগে বাগদাদ দখল করতে সক্ষম হন। দুর্বল এবং অযোগ্য বুয়াইয়া আমীরদের শাসনামলে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১০২৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের পূর্বাঞ্চল গজনভী বংশ কর্তৃক অধিকৃত হয় এবং অবশিষ্টাংশ ১০২৯ হতে ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেলজুকদের দ্বারা বিজিত হয়। এভাবে এক শত বছরের বুয়াইয়া আমীরদের শাসনের অবসান হয়। 

সেলজুক বংশ [১০৫৫-১১৯৪ খ্রি.] 

অভ্যুত্থান

হিট্টি বলেন, “ইসলামের ইতিহাসে এবং খিলাফতে সেলজুক তুর্কীদের অভ্যুত্থান একটি নতুন এবং বিস্ময়কর অধ্যায়ের সূচনা করে।” সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর গজনী রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে মধ্যএশিয়ার বিখ্যাত সেলজুকগণ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। তুর্কী গোত্রীয় ওঘুজ (Oghuz) বংশোদ্ভূত জাতির নেতৃত্ব দান করেন সেলজুক। তাঁর নামানুসারে এই বংশ সেলজুক নামে খ্যাতি লাভ করে। ৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক তুর্কীস্তানের কিরঘিজ উপত্যকা হতে দক্ষিণ ট্রান্সঅক্সিয়ানার বুখারা অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। সেলজুক জাতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্বে ছিল অসভ্য, নিরক্ষর এবং হিংস্র প্রকৃতির। দুর্ধর্ষ সেলজুক জাতি সুন্নী ইসলাম গ্রহণ করে ধীরে ধীরে তাদের প্রভুত্ব গজনী রাজ্যের বহুলাংশে প্রতিষ্ঠা করতে থাকে। 

সুলতান মাহমুদ সেলজুক তুর্কীদের অভ্যুত্থানে খুবই শঙ্কিত ছিলেন এবং ১০৩৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর দুর্বল পুত্র এবং উত্তরাধিকারী মাসুদের রাজত্বে গজনী বংশের দ্রুত অবনতি এবং সেলজুকদের অভ্যুত্থানের সূচনা হয়। সেলজুকের বংশধরেরা গজনীর অধঃপতনে ইলখান এবং সামানী রাজ্যের অঞ্চলসমূহ দখল করে গজনী রাজ্যে হানা দিতে থাকে; খোরাসানে আধিপত্য বিস্তার করে তারা দুর্বল গজনী নৃপতি মাসুদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে হিরাটের নিকট সংঘটিত যুদ্ধে জয়লাভ করে। ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত যুদ্ধে সেলজুকদের জয়লাভ তাদের আধিপত্য বিস্তারে সহায়তা করে। অতঃপর তুর্কীগণ আদি সেলজুক নেতার পৌত্র তুঘ্রীল বেগকে দলপতি নির্বাচন করে। 

তুঘ্রীল বেগ (১০৫৫-১০৬৩ খ্রি.) 

সেলজুকের পৌত্র তুঘ্রীল বেগকে সেলজুক বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে। সেলজুক তুর্কীদের দলপতি নিযুক্ত হয়ে তুঘ্রীল বেগ তাঁর ভ্রাতার সহযোগিতায় ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে ২৪শে মার্চ গজনবী সুলতানকে (১০৩১-৪১ খ্রি.) মার্ভের নিকট পরাজিত করে নিশাপুর এবং মার্ভ দখল করেন। এর পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে তুঘ্রীল তাবারিস্তান, হামাদান, রায়, ইস্পাহান প্রভৃতি স্থানে তাঁর প্রভুত্ব কায়েম করেন। ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে দুর্বল এবং ক্রীড়নক আব্বাসীয় খলিফা আল-কাইম বিল্লাহ বুয়াইয়া আমীরের প্রতাপ এবং প্রতিপত্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে সেলজুক তুঘ্রীল বেগের সাহায্য প্রার্থনা করেন। খলিফার আমন্ত্রণে তুঘ্রীল তাঁর দুর্ধর্ষ তুর্কীবাহিনী নিয়ে বাগদাদ অভিমুখে রওয়ানা হন। ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ই ডিসেম্বর তুঘ্রীল বেগ বাগদাদ নগরীতে প্রবেশ করলে বুয়াইয়া আমীর মালিক-আর-রহিম পলায়ন করেন। বৃদ্ধ এবং ক্ষমতাহীন খলিফা আল-কাইম তুঘ্রীলকে পরিত্রাণ কর্তা হিসেবে রাজদরবারে সাদর আমন্ত্রণ জানান। 

তুঘ্রীল বাগদাদ আগমনের পূর্বেই আল-বাসাসিরী নামে একজন তুর্কী নেতা বুয়াইয়া আমীর আর-রহিমকে ক্ষমতাচ্যুত করে আব্বাসীয় খলিফা আল-কাইমের আমলে নিজেকে আমীর-উল-উমরাহ বলে ঘোষণা করেন, কিন্তু তুঘ্রীলের বাগদাদ দখলের পর আল- বাসাসিরী রাজধানী হতে পলায়ন করেন। তুঘ্রীল বাগদাদে সেলজুক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করে পারস্য অঞ্চলে বিদ্রোহ দমনে গমন করেন। ইত্যবসরে আল-বাসাসিরি বাগদাদ প্রত্যাবর্তন করে আব্বাসীয় খলিফার স্থলে ফাতেমীয় বংশের খলিফা মুসতানসির বিল্লাহকে বাগদাদে ইসলামের ধর্মীয় নেতা হিসেবে ঘোষণা করেন। এই সংবাদ লাভ করে তুঘ্রীল দ্রুতগতিতে বাগদাদে ফিরে আসেন এবং আল-বাসাসিরীকে পরাজিত ও নিহত করেন। খলিফা আল- কাইম বাগদাদের সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ তিনি তুঘ্রীলকে সমগ্র মুসলিম সাম্রাজের কর্তৃত্ব দান করেন। তাঁকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সুলতান (King of the East and the West) উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তুঘ্রীল একজন প্রতিভাশালী ও সুদক্ষ শাসনকর্তা ছিলেন। সুলতান হিসেবে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেও তিনি খলিফা আল-কাইমকে শ্রদ্ধা করতেন। তিনি তাঁর প্রধান কার্যালয় বাগদাদের পরিবর্তে মার্ভে স্থাপন করেন। আমীর আলী বলেন, “তুঘ্রীলের আমলে সেলজুকগণ এশিয়ায় একটি প্রতাপশালী জাতিতে পরিণত হয়। সমসাময়িক জাতিদের তুলনায় তারা ছিল অনেক উন্নত। তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে এর একনিষ্ঠ সেবকরূপে পরিচিত হয়।” তুঘ্রীল বেগ শুধু আব্বাসীয় খলিফার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করেই ক্ষান্ত হন নি; বরং দেশের পর দেশ জয় করে তিনি বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের সীমান্তে উপনীত হন এবং বায়জানটাইন সম্রাটকে কর প্রদান করতে নির্দেশ দেন। ১০৬০ খ্রিস্টাব্দে তুঘ্রীল ডোসিয়া ও ফিজিয়া হতে বায়জানটাইনদের বিতাড়িত করেন। ঐতিহাসিক ইবন-আসীর তাঁকে ধৈর্যশীল, জ্ঞানী, দানশীল, ধার্মিক, অনাড়ম্বর এবং বিদ্যানুরাগী বলে অভিহিত করেন। ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সগৌরবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। সেলজুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা তুঘ্রীলের প্রধান কৃতিত্ব ছিল শিয়া দাইলামী সম্প্রদায়ের বুয়াইয়া প্রভুত্বকে ধ্বংস করে সুন্নী আব্বাসীয়দের প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং খলিফার মর্যাদা বৃদ্ধি করা। 

আলপ-আরসালান (১০৬৩-১০৭৩ খ্রি.) 

হিট্টি বলেন, “তুঘ্রীল (১০৩৭-১০৬৩ খ্রি.) তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আল্‌প আরসালান (১০৬৩-১০৭৩) এবং মালিক শাহের (১০৭২ খ্রি.) শাসনকাল মুসলিম প্রাচ্যে সেলজুক অভ্যুত্থানের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে।” ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে তুঘ্রীলের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আল্প আরসালান সেলজুক বংশের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন এবং খলিফার নিকট হতে ‘সুলতান’ উপাধি লাভ করে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। তাঁর সময়ে তুর্কী উপজাতিগণ দলে দলে মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করলে তাঁর পক্ষে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল পুনর্দখল করে একটি সংঘবদ্ধ রাজ্যে পরিণত করা সম্ভব হয় এবং এতে মুসলিম সৈন্যবাহিনীর মর্যাদা এবং গৌরব বৃদ্ধি পায়। 

আলপ-আরসালানের রাজত্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল বায়জানটাইনদের সঙ্গে সংঘর্ষ। জর্জিয়া এবং আর্মেনিয়া অধিকার করবার পর আপ- আরসালান খয়ে (Khoi) অবস্থান করছিলেন। বায়জানটাইন সম্রাট ডায়োজিনিস রোমানাস (Diogenes Romanus) এতে ক্রুদ্ধ হয়ে বাগদাদ নগরী ধ্বংসকল্পে দুই লক্ষ সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করেন। এই দুঃসংবাদে বিচলিত না হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবার জন্য আল্‌প আরসালান ৪০ হাজার সৈন্যসহ বায়জানটাইন আক্রমণ প্রতিহত করবার জন্য আর্মেনিয়ার দিকে অগ্রসর হন। ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে মানজিকার্দের যুদ্ধে (Battle of Manzikard) আল্প আরসালান বিশাল বায়জানটাইন বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং সম্রাট রোমানসকে বন্দী করেন। বায়জানটাইনদের বিপর্যয়ে মুসলমানগণ সেলজুকদের নেতৃত্বাধীন সর্বপ্রথম রোমীয় সম্রাটের অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয় এবং এশিয়া মাইনরকে তুর্কীকরণের প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রোমানস আল্প আরসালানের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন এবং সন্ধির শর্তানুযায়ী সম্রাট তাঁর কন্যাদিগকে আরসালানের পুত্রদের সাথে বিবাহ দেন। বন্দীদশা হতে অব্যাহতি পাবার জন্য দশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা এবং যুদ্ধের যাবতীয় ক্ষতিপূরণসহ বার্ষিক রাজস্ব স্বরূপ ৩ লক্ষ ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা প্রদানে সম্রাট রোমানস স্বীকৃত হন। সন্ধিশর্তে স্বীকৃত হলে রোমানাস মুক্তি লাভ করেন এবং অনুমতি গ্রহণ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। পথিমধ্যে তিনি সংবাদ পেলেন যে, প্রজাগণ তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। মহানুভব সুলতান রোমানদের বিপদের আশঙ্কায় সাহায্য করতে চাইলেন কিন্তু কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তিনি জানতে পারলেন যে, বিদ্রোহিগণ বায়জানটাইন সম্রাটকে বন্দী করেছে। বিদ্রোহীরা নিষ্ঠুরতার সাথে সম্রাটের চক্ষু উৎপাটিত করে তাঁকে হত্যা করে। 

ইসলামের ইতিহাসে মানজিকার্দের যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এশিয়া মাইনরে বায়জানটাইন প্রভুত্ব লোপ পেয়ে সেলজুক তুর্কীদের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। আরসালান যুদ্ধজয়ের পর অধিকৃত অঞ্চলের শাসনভার পিতৃব্য পুত্র সুলায়মান-ইবন-কতলুমিশের হস্তে অর্পণ করেন। বিচক্ষণ এবং দক্ষ শাসনকর্তা সুলায়মান তাঁর রাজ্যসীমা উত্তরে হেলেসপন্ট (Hellespont) এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। তিনি বায়জানটাইন সম্রাটকে কর প্রদানে বাধ্য করেন এবং বিথিনিয়ার নাইসিয়া নগরীতে রাজধানী স্থাপন করেন। কিন্তু ক্রসেডের যুদ্ধে ইহা অধিকৃত হলে ১০৮৪ খ্রিস্টাব্দে আইকোনিয়াস বা রোমে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। মানজিকার্দের যুদ্ধে মুসলিম বিজয় খ্রিস্টান প্রভুত্ব ধ্বংস করে ইসলামের প্রভাব সমগ্র এশিয়া মাইনরে বিস্তৃতিতে সাহায্য করে। এশিয়া মাইনরের তুর্কীকরণ ইসলামের রাজ্য এবং ধর্ম বিস্তারে শুধু সহায়কই ছিল না; বরং পরবর্তীকালে অটোমান তুর্কীদের আবির্ভাব সুনিশ্চিত হয় এবং বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল জয়ের প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়। ধীরে ধীরে সমগ্র এশিয়া মাইনরে সেলজুক আধিপত্য বিস্তার লাভ করে এবং এশিয়ায় বায়জানটাইন ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। 

আলপ-আরসালান সেলজুক বংশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে রাজ্য সম্প্রসারণের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যান। ঐতিহাসিক ইবন-আল-আসীর বলেন যে, আরসালান উদার, মহানুভব, জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ, ধার্মিক, দয়ালু ও পরোপকারী ছিলেন। তিনি মার্ভ থেকে ইস্পাহানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। রোমান সম্রাটের প্রতি সদয় ব্যবহারে তাঁর মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায়। সুলায়মান এবং তার উত্তরাধিকারিগণ এশিয়া মাইনরে দক্ষতার সাথে রাজ্য শাসন করতে থাকেন এবং তারা রোমের সুলতান বলে পরিচিত ছিলেন। মসনভী গ্রন্থের প্রণেতা মৌলানা জালালুদ্দিন রুমী পরবর্তী সুলতান আলাউদ্দিনের পৃষ্ঠপোষকতায় আধ্যাত্মিক চর্চায় মনোনিবেশ করেন। আলপ-আরসালান খাজা হাসান নামক জনৈক মনীষীকে ‘নিজাম-উল-মূলক’ উপাধি দান করে তাঁর উজীর নিযুক্ত করেন। ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দে ইউসুফ নামক বিদ্রোহীর অতর্কিত আক্রমণে আরসালান নিহত হন। 

মালিক শাহ (১০৭৩-১০৯২ খ্রি.) 

আপ-আলসালানের মৃত্যুর পর ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র মালিক শাহ জালাল- উদ-দৌলাহ্ উপাধি ধারণ করে সেলজুক সুলতানরূপে সমাদৃত হন। হিট্টি বলেন, “মালিক শাহের শাসনামলে সেলজুক বংশ ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হল।” মালিক শাহ সেলজুক সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠই ছিলেন না; তৎকালীন নৃপতিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। আব্বাসীয় খলিফাগণ নামে মাত্র ইমাম ছিলেন কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন মালিক শাহ্। তাঁর রাজত্বকালে মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা পূর্বে কাশ্মীর থেকে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত, উত্তরে জর্জিয়া হতে দক্ষিণে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। সম্প্রসারণ অপেক্ষা শান্তিপূর্ণভাবে শাসনকার্য নির্বাহ করে সুখ এবং সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য তিনি আত্মনিয়োগ করেন। এ সময়ে আব্বাসীয় খলিফা কাইমের মৃত্যু হলে তাঁর দৌহিত্র আবুল কাসেম আবদুল্লাহ ‘মুকতাদিরবিল্লাহ’ উপাধি ধারণ করে খলিফা হন। মুকতাদির ধার্মিক, পুণ্যবান ও কর্মঠ ছিলেন এবং তাঁকে ‘মহানুভব’ এবং আব্বাসীয় বংশের অন্যতম মহান খলিফা বলে উল্লেখ করা হয়। নৈতিক চরিত্রের উন্নতি বিধানকল্পে তিনি দুশ্চরিত্র লোকদের বিতাড়িত করেন। জনগণের মঙ্গলার্থে নানাবিধ কার্য করেন এবং হাম্বলী ও হানাফীদের (আসারীয়) মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান করতে চেষ্টা করেন। 

নিজাম-উল-মূলক : সুলতান মালিক শাহের রাজত্বকাল সম্প্রসারণ অপেক্ষা শাসন-সংস্কারের জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ। তাঁর শাসনের প্রারম্ভে কয়েকটি বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করেন। এমনকি তাঁর ভ্রাতা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তিনি ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে ও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেলজুক রাজত্বের শাসন সংস্কার, সমৃদ্ধি এবং প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য বিশেষভাবে মালিক শাহের সুযোগ্য এবং ব্যুৎপত্তি জ্ঞানসম্পন্ন উজির খাজা হাসানের অবদান ছিল অপরিসীম। আল্প আরসালান এবং মালিক শাহের উজির হিসেবে খাজা হাসান ‘নিজাম-উল-মূলক’ (রাজ্যের সংগঠক) সেলজুক বংশ তথা আব্বাসীয় সুন্নী খিলাফতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। নিজাম-উল- মূলকের বিচক্ষণতা, কর্মনৈপুণ্য, দূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার জন্যই মালিক শাহের রাজত্বকাল মহিমান্বিত ও চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ইবন খাল্লিকান বলেন, “মালিক শাহের বিশ বছরের রাজত্বকালে (১০৭৩-৯২) নিজাম-উল-মূলক স্বীয় হস্তে সমস্ত ক্ষমতা এরূপে কেন্দ্রীভূত করেন যে, সুলতানের সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকা অথবা মৃগয়ায় যাওয়া ব্যতীত আর কোন কাজ ছিল না।” নিজামের একনিষ্ঠ সেবা, আত্মত্যাগ, বিচক্ষণ এবং জনমঙ্গলকর শাসনে প্রীত হয়ে সুলতান তাঁকে ‘আতা-বেগ’ (আমীরের শাসনকর্তা) উপাধিতে ভূষিত করেন। হিট্টি বলেন, “ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি অলংকারস্বরূপ। 

নিজাম-উল-মূলক বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সিয়াসত- নামা’ (Siyasat-Nama) রাজা শাসন প্রণালীর উপর লিখিত একটি গবেষণাধর্মী রচনা বলে মনে করা হয়। সুলতান মালিক শাহের অনুরোধে এই গ্রন্থ ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত হয়। আরনল্ড বলেন, “রাজনৈতিক নীতিমালা সংবলিত এটি দার্শনিক নিবন্ধই ছিল না; বরং এতে শাসনপ্রণালী, দরবার, বিচারকার্য, সামরিক বিচার এবং অর্থনৈতিক কার্যাবলির উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ প্রভৃতি বিষয়ে ব্যবহারিক উপদেশ প্রদান করা হয়। এতে তিনি রাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা দান করেন। “ 

বিদ্যোৎসাহী নিজাম শিক্ষা সম্প্রসারণকল্পে বাগদাদে ১০৬৫-৬৭ খ্রিস্টাব্দে নিজামিয়া মাদ্রাসা নামে ইসলামের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। জ্ঞানবৃদ্ধ তাপস নিজাম কায়রোতে প্রতিষ্ঠিত ঈসমাইলী শিক্ষায়তনে আল-আজহারের প্রতিদ্বন্দ্বী বাগদাদে ধর্মীয় শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে সাফেয়ী এবং আশয়ারী মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। স্পুলার বলেন যে, তিনি পূর্বাঞ্চলের বৌদ্ধ বিহারের অনুকরণে নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাঁর এই উক্তির তর্কসাপেক্ষ। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য মাদ্রাসা স্থাপিত হয় কিন্তু নিজামিয়ার মর্যাদা এবং প্রভাব সর্বাধিক ছিল। এর কারণ ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মতাত্ত্বিক (Theologian) এবং চিন্তাবিদ গাজ্জালী (১০৫৮- 

৫৯৮ 

আব্বাসীয় সাম্রাজ্য [৭৫০-১২৫৮ খ্রি.] 

১১১১ খ্রি.) এই শিক্ষায়তনে অধ্যাপনা করেন। উপরন্তু, মহাকবি শেখ সাদী এই মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। নিজামের পৃষ্ঠপোষকতায় গাজ্জালী শিয়া মতবাদের সমালোচনা করে সুন্নী ইসলামের প্রভুত্ব কায়েম করেন। 

নিজাম-উল-মূলকের পরামর্শে মালিক শাহ ১০৭৫ খ্রিস্টাব্দে নিশাপুরে একটি জ্যোতির্বিদ সম্মেলন আহ্বান করেন এবং এই সম্মেলনে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণীত হয়। নিশাপুরে একটি মানমন্দির নির্মিত হয়। প্রখ্যাত দার্শনিক, কবি, জ্যোতির্বিদ এবং অঙ্কশাস্ত্র বিশারদ ওমর খৈয়ামের নেতৃত্বে জ্যোতির্বিদ ও বিজ্ঞানীগণ পারস্য বিজ্ঞান সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। তাঁরা চান্দ্রমাসের পরিবর্তে সৌরমাস অনুযায়ী গণনার প্রথা প্রচারিত করেন। প্রচলিত গণনা পদ্ধতির যাবতীয় ভ্রম সংশোধন করে একটি নতুন পঞ্জিকা তৈরি করা হয়। মালিক শাহ জালাল-উদ্-দৌলা নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘জালালী পঞ্জিকা’ (Jalali Calendar)। জালালী পঞ্জিকা বর্তমানে প্রচলিত পঞ্জিকা পদ্ধতি অপেক্ষা বেশি সূক্ষ্ম ও নির্ভুল ছিল। গীবন বলেন, “এটি জুলিয়ানের পঞ্জিকা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং গ্রেগরীর পঞ্জিকার নির্ভুলতার সমকক্ষতা দাবি করে।” 

উগ্র ঈসমাইলী পন্থী হাসান সাব্বাহ অথবা ‘পর্বতের বৃদ্ধ লোক’ (Old Man of the Mountain) নিজামের সহপাঠী ছিলেন। কিন্তু নিজামের প্রভাব ও প্রতিপত্তি এবং বিশেষ করে তাঁর সুন্নী প্রবণতায় হাসান ঈর্ষান্বিত হয়ে গুপ্তঘাতকের দ্বারা নিজামকে হত্যা করেন। ১০৯১ খ্রিস্টাব্দে নিজামের আকস্মিক মৃত্যু সেলজুক বংশের স্থায়িত্বে আঘাত হানে। ইবন আল-আসীর বলেন, “তিনি তাঁর সদগুণাবলি ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য উচ্চ- নীচ নির্বিশেষে সর্বজনের সমাদৃত ছিলেন।” তাঁর মুয়াই-ঈদুল-মূলক, ফখরুল-মূলক ও ইজ্জ্বল-মূলক নামে তিন পুত্র মালিক শাহের উত্তরাধিকারীদের রাজত্বে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। সৈয়দ আমীর আলী বলেন, “এশিয়া যে কয়জন সুদক্ষ উজির ও শাসকের জন্মদান করে তন্মধ্যে সম্ভবত ইয়াহিয়া বার্মেকীর পর নিজাম-উল-মূলকই শ্রেষ্ঠ।” 

জনহিতকর কার্যাবলি : মালিক শাহ প্রজাবৎসল সুলতান ছিলেন। শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য তিনি রাজ্যের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পরিভ্রমণ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতেন। হারুন-আর-রশীদ এবং মামুনের মত তিনি বণিক, হজ্বযাত্রী এবং পরিব্রাজদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রহরার ব্যবস্থা এবং আরাম- আয়েশের জন্য বিশ্রামগার বা সরাইখানা নির্মাণ করেন। তিনি অনেক মাদ্রাসাও নিৰ্মাণ করেন। মৃগয়ায় তাঁর আসক্তি ছিল সত্য কিন্তু নির্যাতন অথবা উৎপীড়ন করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। এ সময়ে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। পারস্য ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে পারস্য উজীর নিজাম-উল-মূলক এরূপ একটি শাসন-ব্যবস্থা প্রচলিত করেন যার ফলে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিক উন্নতির মূলে ছিল নিজামের দূরদর্শিতা। নিজাম সুষ্ঠ কর ব্যবস্থা প্রচলনের জন্য সামন্ততন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন এবং সৈন্যদের মধ্যে ভূমি বণ্টন করে তাদের নিকট হতে নিয়মিত কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন। স্থাপত্যশিল্পের দিক হতে বিচার করলে মালিক শাহের রাজত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইস্পাহানের জামে মসজিদ নির্মাণে সেলজুক স্থাপত্যরীতি নিজাম-উল-মূলক প্রথম প্রবর্তন করেন। সেলজুক আমলে ইরানে নির্মিত অসংখ্য ইমারতের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একাদশ শতাব্দীতে স্থাপিত সংবস্ত, দামগান, সাভা, ইস্পাহান, বিসতাম প্রভৃতি স্থানের মসজিদ ও মিনারসমূহ।[১] 

[১. গ্রন্থকার ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ইরানে এই সমস্ত মিনার এবং মসজিদ পর্যবেক্ষণ করেন।]

গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় : সুলতান মালিক শাহের রাজত্বের শেষভাগে নিকৃষ্ট গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ইসলামের ইতিহাসে একটি রক্তলোলুপ অধ্যায়ের সূচনা হয়। নিজাম-উল-মূলকের সহপাঠী আল-হাসান-আল-সাব্বাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই গুপ্তঘাতক ভ্রাতৃ-সংঘ ইরানের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আলামূত পর্বত শিখরে একটি সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। “পর্বতের বৃদ্ধ লোক” (Shaikh-al-Jibal : Old Man of the Mountain) নামে পরিচিত এই আল-হাসান পারস্যের তুস অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন; কিন্তু বংশ-মর্যাদা লাভের জন্য তিনি নিজেকে দক্ষিণ আরবের হিমারীয় রাজবংশোদ্ভূত বলে দাবি করেন। রায়ে (Ray) তিনি বাতেনী মতবাদে (Batini system) দীক্ষিত হয়ে মিসরে ফাতেমীয়দের আশ্রয়ে দেড় বছর অতিবাহিত করেন। অতঃপর ফাতেমীয়দের প্রচারক এবং সমর্থক হিসেবে তিনি ইরানে ঘাঁটি স্থাপন করেন। আল্প-আরসালানের সময়ে তিনি তাঁর ষষ্টিবাহক (Mace-bearer) নিযুক্ত হন। মালিক শাহের অধীনেও তিনি চাকরী করেন কিন্তু সহপাঠী নিজামের সমকক্ষ চাকরী ও প্রভাব অর্জনে অসমর্থ হয়ে ঈর্ষা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য তিনি সেলজুক রাজ্যে সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেন! একথা অবশ্য সত্য যে, তিনি ফাতেমীয়দের পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়ে গুপ্তঘাতক-সংঘ গঠন করে হিংসাত্মক এবং জিঘাংসামূলক কার্যকলাপ করতে থাকেন। ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে আল-হাসান সমুদ্রের উপরিভাগ হতে ১০,২০০ ফুট উচ্চ আলামুত পর্বতে ঘাঁটি স্থাপন করেন। এটিকে ‘ইগলের বাসা’ (Eagle’s nest) বলা হত। তার সৃষ্ট ‘ফিদাই’ (Fidais) লুঠতরাজ, লুণ্ঠন ও নৃশংস হত্যা দ্বারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে মালিক শাহ দুবার অভিযান পরিচালিত করেন। কিন্তু সুলতান সাফল্য অর্জন করবার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে সুফীর ছদ্মবেশে একজন ফিদাই নিজাম-উল-মূলককে হত্যা করে। গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় এরূপে সুরক্ষিত দুর্গে অবস্থান করে যে, ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খান ব্যতীত অপর কোন সুলতানের পক্ষে তাদের ধ্বংস করা সম্ভবপর হয় নি। একুশ বছর সগৌরবে রাজত্ব করে মালিক শাহ ৩৯ বছর বয়সে ১০৯২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। 

পরবর্তী সেলজুকগণ : মালিক শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পত্নী তুরখানের অনুরোধক্রমে খলিফা তাঁর শিশুপুত্র মাহমুদকে (১০৯২-৯৪ খ্রি.) ‘নাসির-উদ-দুনিয়া-ওয়া-দীন’ উপাধি দান করে সুলতান পদে অধিষ্ঠিত করেন। কিন্তু তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বরকিয়ারুক তাঁকে পদচ্যুত করেন এবং রুকুনুদ্দিন উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিছুদিন পরে তাঁর সাথে ভ্রাতা মুহম্মদের গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং মুহম্মদ ক্ষমতালাভ করেন। তাঁরপর সিনজার সুলতান পদে অধিষ্ঠিত হন। মালিক শাহের মৃত্যুর পর গৃহযুদ্ধ সেলজুক বংশের অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করে। ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেলজুক বংশ খলিফার প্রতিনিধিত্ব করে এবং এরপর সেলজুক সালতানাৎ পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। 

সেলজুকদের অবদান : গ্রুনিবাম বলেন, “সংঘবদ্ধ সেলজুক রাষ্ট্র চল্লিশ বছর যাবৎ রাজত্ব করে এবং প্রকৃতপক্ষে এটি পারস্য এবং ইরাকে সীমাবদ্ধ ছিল। সেলজুক রাজত্বে শাসন-ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। এই রাজত্ব সুন্নী ইসলামকে সুসংহত করবার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। শিক্ষা-দীক্ষার উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নিজাম-উল-মূলক খলিফা, এমনকি সেলজুক সুলতানের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রায় ৩০ বছর যাবৎ শাসনকার্য সুদৃঢ়রূপে পরিচালিত করেন।” ইসলামের ইতিহাসে সেলজুক বংশ যে অসামান্য অবদান রেখে গেছে তা মোটামুটিভাবে ছয়টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়; যথা- রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক। 

বুয়াইয়া আমীরদের স্বৈরাচার এবং স্বেচ্ছাচারিতা হতে সেলজুক তুর্কিগণ আব্বাসীয় খিলাফতকে মুক্ত করে স্বীয় প্রাধান্য বিস্তার করে। বুয়াইয়া অত্যাচার (Buwaihid tyranny) আব্বাসীয় খিলাফতকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলে এবং বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে আব্বাসীয় সাম্রাজ্য সঙ্কুচিত হতে থাকে। সেলজুক তুর্কিগণ বুয়াইয়াদের ধ্বংস করে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের অধঃপতনকে রোধ করতে এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুদের নির্মূল করে সাম্রাজ্যকে সুসংবদ্ধ এবং সুসংহত করতে সক্ষম হয়। তুঘ্রীলের রণকৌশল ব্যতীত ইসলামী সাম্রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারত না। আল্‌প আরসালান মানজিকার্দের যুদ্ধে বায়জানটাইন সম্রাটকে পরাজিত এবং বন্দী করলে সেলজুকদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং সুসংবদ্ধ রাষ্ট্র (Consolidated Empire) প্রতিষ্ঠায় আর কোন অন্তরায় রইল না। সুতরাং সেলজুক সালতানাতের আবির্ভাব আব্বাসীয় সাম্রাজ্যসমূহ ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা পায়। 

সামাজিক দৃষ্টিকোণ হতে বিচার করলে দেখা যাবে যে, সমগ্র আব্বাসীয় খিলাফতে পারস্য রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প, স্থাপত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারতার সঙ্গে সঙ্গে আরবীয় সমাজকে পারসিকীকরণ (Persianized) করা হয়। বাগদাদের মর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পারস্যের রায়, হামাদান, ইস্পাহান প্রভৃতি শহর কৃষ্টি ও সভ্যতার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে স্থিতিশীল সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এতে সেলজুকদের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। 

সেলজুকদের অভ্যুত্থানকে শিয়াদের উপর সুন্নী প্রাধান্যের সূচনা বলা যেতে পারে। বুয়াইয়া আমীরগণ শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন এবং তাঁরা দুর্বল আব্বাসীয় খলিফাদের ধর্মীয় এবং পার্থিব ক্ষমতা হ্রাস করে তাঁদের সর্বপ্রকার অবমাননা করতে দ্বিধা করতেন না। বুয়াইয়া আমীরগণ বিজাতীয় মনোভাব সহকারে নিজেদের নাম খুৎবাতে পাঠ এবং মুদ্রায় অঙ্কিত করেন এবং কখনও কখনও মনিমুক্তা খচিত মুকুট ব্যবহার করতেন। তারা রাষ্ট্রদূতদের অভ্যর্থনা করতেন। আজদু-উদ-দৌল্লাহ ‘সুলতান’ এর পরিবর্তে ‘শাহানশাহ ‘ উপাধি গ্রহণ করেন। এই সমস্ত কার্যকলাপ খলিফার সার্বভৌমত্বে আঘাতস্বরূপ ছিল। সেলজুক তুর্কীদের ক্ষমতালাভে সুন্নী ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়; কোন প্রকার অনৈসলামিক কার্যকলাপ বরদাস্ত করা হত না। সেলজুকদের আমলে প্রকৃতপক্ষে ইসলামকে সংশোধিত করা হয় (purged)। খলিফাগণ তাদের প্রীতি ও শ্রদ্ধা অর্জন করেন এবং সুলতান তুঘ্রীল কখনই প্রকাশ্যে খলিফার সিংহাসনের পার্শ্বে উপবিষ্ট হতেন না। শিয়া মতাবলম্বী আল-বাসাসিরী তুঘ্রীল কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হন। নিজাম-উল-মূলক বাগদাদে নিজামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে সুন্নী মতবাদকে সার্বজনীন রূপদানের চেষ্টা করেন। ইমাম গাজ্জালী নিজামিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক নিযুক্ত হয়ে ইসমাইলী এবং শিয়া মতবাদের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি সুন্নী আশারীয়া মতবাদ এবং ইসলামী সুফীবাদ প্রতিষ্ঠা করে অমর হয়ে রয়েছেন। 

সেলজুক ‘আতা-বেগ’ নিজাম-উল-মূলক প্রশাসনিক সংস্কার দ্বারা শাসন-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। স্পুলার বলেন, “সেলজুকগণ তাদের অধিকৃত অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে সক্ষম হন। সমস্ত গৃহযুদ্ধেরই মূলোৎপাটিত হয়; জনগণের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়; শাসন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করা হয়। কর প্রথার সুষ্ঠু সমন্বয় করা হয় এবং সর্বোপরি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত উৎকর্ষ সাধিত হয়। এ সমস্ত নীতি এবং কার্য পদ্ধতির বাস্তবায়নে প্রাচ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নজির হিসেবে তিনি ‘সিয়াসত- নামা’ (Model Statesman’s Manual) রচনা করেন। জায়গীর প্রথা প্রবর্তন করে রাজ্যের আয় বৃদ্ধি নিজামের অন্যতম কৃতিত্ব। 

নিজাম-উল-মূলকের জ্ঞান-সাধনা এবং বিদ্যোৎসাহিত্য মামুনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। নিজামিয়া মাদ্রাসা তাঁর বিদ্যানুরাগের শ্রেষ্ঠ স্বাক্ষর বহন করে এবং এর অনুকরণে পরবর্তীকালে ‘মুসতানসারিয়া’ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। সুন্নী মতবাদ প্রচারে এই প্রতিষ্ঠানের অবদান অবিস্মরণীয়। মালিক শাহের রাজত্বে পারস্যের অতিন্দ্রীয়বাদী কবি (Mystic poet) ফরিদ-উদ-দিন আত্তার, জ্যোতির্বিদ ও কবি ওমর খৈয়াম, কবি ও পরিব্রাজক নাসির-ই-খসরু, সাহিত্যিক নিজামী, ধর্ম-তাত্ত্বিক ও দার্শনিক গাজ্জালী প্রমুখ মনীষী মুসলিম কৃষ্টি ও সভ্যতা বিকাশে অশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। সেলজুক স্থাপত্য-শিল্প, পোড়া মাটির ইট এবং কারুকার্য খচিত মসজিদ, মিনার ও মাদ্রাসায় মূর্ত হয়ে রয়েছে। পোপ বলেন, “তাঁর ধর্মীয় অনুরাগ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা পারস্য হতে উদ্ভূত মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার অনুপ্রাণিত করে এবং তা সমগ্র ইসলামী সাম্রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।” সেলজুক রাজত্বের অতুলনীয় স্থাপত্য কীর্তির মধ্যে অন্যতম ছিল রায়ের তুঘ্রীলের সমাধি (১১৩৯), ইস্পাহানের জামে মসজিদ (১০৭৫) এবং এর অনুকরণে আরদিস্তান (১০৮০), জাওয়ারা (১১৫৩), গুলপাইগানের (১১২০-৩৫) জামে মসজিদগুলো নির্মিত হয়। সর্বশেষ শ্রেষ্ঠ সুলতান সানজারের (১১৫৭-৬০) সমাধি মার্ভে নির্মিত হয়। 

সুন্নী ইসলামের রক্ষক এবং প্রচারক সেলজুক বংশ এশিয়া মাইনরে বায়জানটাইনদের আধিপত্য ধ্বংসপূর্বক মুসলিম প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করে একদিকে যেমন অটোমান সালতানাতের আবির্ভাব ত্বরান্বিত করে, অপরদিকে খ্রিস্টানদের পরাভূত করে ধর্মযুদ্ধের প্রেরণা লাভ করতে সহায়তা করে। গ্রুনিবাম বলেন, এশিয়া মাইনরে অভিযান এবং প্রথম ক্রুসেডে তারা জড়িত হবার ফলে পাশ্বাত্যে সেলজুকদের সুষ্ঠুরূপে স্মরণ করা হয়। সুন্নী ইসলামের পুনর্জীবন (Re-animation of Sunnite Islam) কালে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে মুসলমানগণ প্রেরণা লাভ করল। অপরদিকে সেলজুকগণ একটি সংঘবদ্ধ সুন্নী রাষ্ট্র কায়েম করায় পার্শ্ববর্তী ফাতেমীয় শিয়া মতবাদ ও প্রভাব আব্বাসীয় খিলাফতে অনুপ্রবেশ করতে পারে নি। বলা বাহুল্য যে, সেলজুকদের পতনের ইসলামের ইতিহাসে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেয় এবং অর্ধ-শতাব্দীর মধ্যেই আব্বাসীয় খিলাফতের পতন হয়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *