প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

চতুর্থ অধ্যায় : হযরত আলী আসাদুল্লাহ (রা) (৬৫৬-৬৬১ খ্রি.)

চতুর্থ অধ্যায় – হযরত আলী আসাদুল্লাহ (রা) [৬৫৬-৬৬১ খ্রি. ]

হযরত আলী (রা)-এর প্রথম জীবন

ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশের হাশিম গোত্রে রাসূলুল্লাহর নবুয়তের দশ বছর পূর্বে অর্থাৎ ৬০০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ছিল আবু তোরাব ও আবুল হাসান এবং তিনি ছিলেন রাসূলে করীমের চাচা আবু তালেবের পুত্র। আবু তালেবের স্নেহ ও যত্নে মহানবী (স) লালিত-পালিত হন। আবু তালেবের অসচ্ছল অবস্থার জন্য রাসূলে করীম (রা) হযরত আলীর তত্ত্বাবধানের সমস্ত দায়িত্ব নিজ হস্তে গ্রহণ করেন। স্বগোত্রীয় ছাড়াও হযরত আলী রাসূলে করীমের সংসারে লালিত-পালিত হলে তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান।

রাসূলে করীম (স) নবুয়ত লাভের পর ধর্মপ্রচার শুরু করলে যুবকদের মধ্যে হযরত আলীই সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সর্বপ্রথম বিবি খাদিজা ইসলামের বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে হযরত আবুবকর প্রথম রাসূলের প্রচারে মুগ্ধ হয়ে তৌহিদবাদে বিশ্বাসী হন। নিকট আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ইসলাম ধর্মগ্রহণের হযরত আলী (রা)-এর স্থান বিবি খাদিজার পরেই। হযরত আবুবকর (রা) এবং হযরত ওমর (রা)-এর মত অবস্থাপন্ন ও বিত্তশালী না হলেও হযরত আলী দশ বছর বয়সে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েই আরব দেশে নব-প্রবর্তীত ধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় আত্মোৎসর্গ করেন। অর্থ দিয়ে না হলেও তিনি অসি ও মসি দিয়ে ইসলামের সেবা করেন। মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, “দীক্ষাকালে তরুণ বয়স্ক হলেও হযরত আলী ধর্মপ্রচারে অভূতপূর্ব উদ্দীপনা প্রকাশ করেন।” তিনি বর্বর কুরাইশদের অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেন এবং রাসূলে করীম (স) মদিনায় হিজরত করলে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে রাসূলের শয্যায় শায়িত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ রাত্রিতে নিরাপদে মক্কা ত্যাগ করলে শত্রুগণ পরদিন প্রত্যুষে হযরত আলীকে তাঁর শয্যায় দেখতে পেয়ে যুগপৎ বিস্মিত ও হতাশ হয়। বিধর্মীদের উদ্দেশ্য ব্যাহত করে তিনি পরে মদিনায় গিয়ে মহানবীর সঙ্গে মিলিত হন।

হযরত আলী (রা) হিজরতের প্রথম অথবা দ্বিতীয় বর্ষে (৬২৪ খ্রিস্টাব্দে) রাসূলে করীমের দুহিতা বিবি ফাতেমাকে বিবাহ করেন। এতে হযরত আলীর সঙ্গে মহানবীর সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়; তিনি একাধারে চাচাত ভাই এবং জামাতা। হাসান, হুসাইন ও মুহসীন নামে তাঁদের তিন পুত্র সন্তান এবং জয়নাব ও উম্মে কুলসুম নামে দুটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহন করেন। মুহসীন বাল্যকালে ইন্তেকাল করেন। হাসান ও হুসাইনের বংশধরগণ ‘সৈয়দ’ অথবা নেতা নামে পরিচিত। বিবি ফাতেমার মৃত্যুর পর হযরত আলী অন্যত্র বিবাহ করেন এবং তাঁদের আরও কয়েকটি সন্তান-সন্তুতি জন্মগ্রহণ করেন।

হযরত আলী (রা) একজন বীর পুরুষ ছিলেন। তাঁর তেজস্বিতা, অসীম সাহসিকতা, শৌর্য-বীর্য সর্বজনবিদিত ছিল। তিনি প্রকৃতপক্ষে ইসলামের প্রথম যুগে অন্যতম একটি স্তম্ভ ছিলেন এবং বিধর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় প্রত্যেকটি অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। বদরে যুদ্ধে এবং প্রায় সমস্ত যুদ্ধে তাঁর কৃতিত্ব ও মর্যাদাসম্পন্ন কাজ ছিল রাসূলের পতাকাকে উড্ডীন রাখা। বদরের যুদ্ধে দ্বৈত সংঘর্ষে তিনি কুরাইশ বীরকে পরাজিত ও নিহত করে অসীম সামরিক মর্যাদা লাভ করেন। তাঁর বীরত্বে ও রণনৈপুণ্যে সন্তুষ্ট হয়ে মহানবী (স) তাঁকে তাঁর ‘জুলফিকার’ তরবারি প্রদান করেন। বলা হয়ে থাকে যে, “জুলফিকারের সমতুল্য কোন তরবারিই নেই এবং আলীর সাথে অপর কোন তরুণ যোদ্ধার তুলনা হতে পারে না।” উহুদের যুদ্ধে মুসলিম পতাকাবাহী মুসাব ইবন উমাইর নিহত হলে হযরত আলী পতাকা নিজ হস্তে তুলে ধরে শত্রুর পতাকাবাহীকে হত্যাকরেন। হযরত আলীর সাহসিকতা ও নির্ভীকতা মুসলিম যোদ্ধাদের মধ্যে নতুন প্রেরণার সঞ্চার করে। খন্দকের যুদ্ধে তিনি গর্বিত যোদ্ধা আমর-ইবন-আবু জুদকে দ্বৈত সংঘর্ষে হত্যা করেন। খাইবারের যুদ্ধে তিনি ইহুদীদের পক্ষ অবলম্বনকারী বনু সা’দ গোত্রকে পরাজিত করেন। হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর বীরত্ব ও শৌর্যবীর্যে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘আসাদুল্লাহ’ (আল্লাহর সিংহ) উপাধিতে ভূষিত করেন। হুদায়বিয়ার চুক্তিপত্র তিনি লিপিবদ্ধ করেন। হুনাইনের যুদ্ধেও তিনি সক্রিয় অংশগ্রহন করেন; কিন্তু তাবুক অভিযানে রাসূল করীম তাঁকে মদিনায় অবস্থানের নির্দেশ দেন। হযরত আলীর সামরিক কৃতিত্বের মধ্যে খাইবারের সুরক্ষিত দুর্ঘ কামুস দখল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলে করীম যখন দশ হাজার অনুচরসহ মক্কা নগরে প্রবেশ করেন তখন হযরত আলী সা’দের হাত থেকে ইসলামী পতাকা গ্রহণ করেন। সূরা তওবা নাজিল হলে হজ্বের সময় এই সংবাদ ইসলামবিরোধীদের জানাবার দায়িত্ব রাসূলে করীম (স) হযরত আলীর উপর প্রদান করেন। হিজরীর দশম সালে হযরত আলী ইয়েমেনে ইসলাম প্রচারে প্রেরিত হন এবং সেখানে ধর্মপ্রচারে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন। এক দিনেই হামদান গোত্রের সকলেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ওফাতের পর হযরত আবুবকর খলিফা নির্বাচিত হলে তিনি তাঁর প্রতি নিঃসঙ্কোচে আনুগত্য প্রকাশ করেন। রিদ্দা যুদ্ধের ভয়াবহতা যখন নব- প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রকে গ্রাস করতে চেষ্টা করে তখন তিনি ইসলামের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য আত্মনিয়োগ করেন। হযরত আবুবকর ও হযরত ওমরের খিলাফতে তিনি প্রধান উপদেষ্টা ও মজলিস-উল-শূরার বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। তাঁর পরামর্শ ও নির্দেশ ইসলামী শাসন-ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করে। হযরত ওমরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য স্বীয় কন্যা বিবি কুলসুমকে তাঁর সাথে বিবাহ দেন। স্বীয় স্বার্থের কথা বিস্মৃত হয়ে হযরত ওসমানের পক্ষে ভোট প্রদান করে তিনি তাঁর নির্বাচনে সাহায্য করেন। হযরত ওসমানের খিলাফতের শেষের দিকে গৃহযুদ্ধ দেখা দিলে বিদ্রোহীগণ মদিনায় আগমন করে খলিফাকে গৃহবেষ্টিত করলে হযরত আলী তাঁর পুত্র হাসান ও হুসাইনকে দ্বাররক্ষী নিযুক্ত করেন। এরূপে খলিফা হবার পূর্বে হযরত আলী ইসলামের সেবা করে এর বুনিয়াদকে দৃঢ় করেন।

হযরত আলীর নির্বাচন

হযরত ওসমান (রা) বিদ্রোহীদের হতে নির্মমভাবে নিহত হবার পর সমগ্র ইসলামী রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই সন্ত্রাসের রাজ্যে কোন যোগ্য ব্যক্তিই স্বতঃস্ফূর্তভাবে খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করতে স্বীকৃত হলেন না। তিনটি বিদ্রোহী দলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিল মিসরীয় গোষ্ঠী। ইবন-সা’বার নেতৃত্বে এই গোষ্ঠী হযরত আলী (রা)- কে সমর্থন করে। অপরদিকে কুফাবাসীরা যুবাইরকে এবং বসরাবাসীরা তালহাকে সমর্থন করতে থাকে। মৃত খলিফার সাহায্যার্থে প্রেরিত মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনী মধ্যপথ হতে সিরিয়ার দিকে প্রত্যাবর্তন করে। মদিনার কতিপয় চরমপন্থী রাজনৈতিক সুবিধাবাদী হযরত ওসমানের রক্তমাখা পোশাক ও তাঁর স্ত্রী নাইলার কর্তিত আঙ্গুল দামেস্কে মুয়াবিয়ার নিকট প্রেরণ করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বনু হাশিম ও বনু উমাইয়াদের মধ্যে কোন্দল এবং বৈষম্য সৃষ্টি হয়। মিসরীয় গোষ্ঠীর নেতা ইবন-সা’বা হযরত ওসমানের হত্যার পঞ্চম দিবসে হযরত আলীকে ন্যায্য উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রস্তাব করেন। কুফা ও বসরার বিদ্রোহীগণও এই প্রস্তাব সমর্থন করে। এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করবার জন্য এবং মদিনার বিশিষ্ট নাগরিকদের অনুরোধে হযরত আলী ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন ইসলামী রাষ্ট্রের চতুর্থ খলিফার পদে অধিষ্ঠিত হন।

নির্বাচনের সমালোচনা

মৌলানা মুহাম্মদ আলীর মতে, “বিদ্রোহীদের দ্বারা হযরত আলী ৩৫ হিজরীর ২৩শে জুন হজ্বের তারিখে খলিফা নির্বাচিত হলে জনগণ তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে। সমস্ত মদিনাবাসী বিনা দ্বিধায় তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করল।” একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, খলিফা নির্বাচনে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি। অবাধ নির্বাচনের তখন কোন সুযোগ ছিল না, কারণ শহরটি বিদ্রোহীদের হস্তগত ছিল। একথাও সমভাবে সত্য যে, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে হযরত আলী উপযুক্ত ব্যক্তিরূপে নির্বাচিত হতেন। হযরত ওসমানের নির্বাচনকালে খিলাফতের জন্য কেবল দুইজন প্রার্থী ছিলেন— ওসমান ও হযরত আলী। হযরত ওসমান হযরত আলীকে এবং হযরত আলী হযরত ওসমানকে যোগ্য ব্যক্তি হিসাবে সমর্থন দান করেন। অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে, হযরত আলী ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে হযরত আবুবকরের আনুগত্য স্বীকারে ছয় মাস বিলম্ব করেন। কিন্তু তাঁর যদি খিলাফতের প্রতি সামান্যতম দুর্বলতা থাকত তা হলে দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের নির্বাচনকে তিনি সমর্থন দান করতেন না এবং স্বীয় কন্যা উম্মে কুলসুমের সঙ্গে হযরত ওমরের বিবাহও দিতেন না। অনুরূপভাবে খলিফা পদের জন্য হযরত আলী হযরত ওসমানকে ভোট প্রদান করে উদারতার পরিচয় প্রদান করেন। পরবর্তী ঘটনা হতে প্রতীয়মান হবে যে, রাসূলে করীমের ঘনিষ্ঠ অনুগামী তালহা ও যুবাইর বিদ্রোহীদের চাপে হযরত আলীর বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তাদের আপত্তির কারণ ছিল এই যে, খলিফা দায়িত্বভার গ্রহণ করবার পূর্বে হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। অবশ্য তালহা, যুবাইর ও মুয়াবিয়া হযরত আলীর খলিফা নির্বাচনে কোন বাধার সৃষ্টি করেন নি। হযরত আলীর চারিত্রিক গুণাবলি ও ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে তাঁদের কোন আপত্তি ছিল না এবং তাঁরা নিঃসন্দেহে তাঁকে উপযুক্ত খলিফা বলে বিবেচনা করেন।

প্রশাসনিক অসুবিধাসমূহ

স্পুলার বলেন, “এটি (খলিফা ওসমানের হত্যা) একটি অচিন্তনীয় ঘটনা। সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যের ন্যায়সঙ্গত শাসকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ দেখা দিল এবং মুসলমানগণ স্বজাতির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। এটি গৃহযুদ্ধের সূচনা করে, যা পরবর্তী যুগে নব- প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় এবং যেহেতু এতে সাংবিধানিক ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ইসলামী পদ্ধতি জড়িত ছিল সেহেতু এটি (গৃহযুদ্ধ) বিশ্বাসীদের মধ্যে স্থায়ীভাবে বিভেদ সৃষ্টি করে।” আমীর আলী বলেন, “বিবি ফাতেমার স্বামী হযরত আলী এক্ষণে তাঁর বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতার সাথে নির্বাচনে শুভযোগ সংযোজিত করলেন।” হাশিম এবং উমাইয়া গোত্রের দ্বন্দ্ব প্রসারিত হয়ে মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এবং ইসলামের ঐক্য বিনষ্ট হয়ে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে—সুন্নী ও শিয়া।

হযরত আলী খিলাফত লাভ করে যে সংকটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হন হযরত আবুবকরকে ধর্মত্যাগীদের বিদ্রোহে এরূপ হতে হয় নি। প্রথম দুই খলিফার শাসনামলে ইসলামের প্রকৃত সেবক ও সাহাবীদের মধ্যে কোন প্রকার মতানৈক্য দেখা দেয় নি। হযরত ওসমানের সময়ে এর ব্যতিক্রম প্রথম পরিলক্ষিত হয়- এর মূলে ছিল প্রাচীন মক্কার অভিজাতবর্গের (Old Meccan aristocracy) সঙ্গে নব্য ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধের সংঘাত। ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বত্র হযরত ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তীব্র দাবি উত্থাপিত হলে খলিফা হযরত আলী হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তালহা, যুবাইর ও বিবি আয়েশাও প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চাপ দিতে থাকেন। হযরত আলী প্রথমে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেন কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাঁর পক্ষে তৎক্ষণাৎ কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হয় নি। তাঁর মতে, “আমিও এই বিষয়ে কম আগ্রহান্বিত নই, কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমি তা করতে পারি না। এখন খুবই সংকটজনক মুহূর্ত, এখন যদি শান্তি ভঙ্গ হয় তবে বেদুঈনগণ এবং বিদেশীগণ বিদ্রোহী হবে এবং আরবদেশ পুনরায় অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে পরিণত হবে। এই মানুষগুলো (হত্যাকারী) আমার আওতার বাইরে নহে। যতদিন সংকটজনক অবস্থা হতে আল্লাহ আমাকে কোন উপায় না দেখান ততদিন আপনারা অপেক্ষা করুন।” প্রথমত, হযরত ওসমান (রা)-এর হত্যা খলিফা ওমরের হত্যার অনুরূপ ছিল না। খলিফা ওমর ব্যক্তিগত কারণে গুপ্তঘাতক কর্তৃক নিহত হন কিন্তু খলিফা ওসমানের হত্যাকে প্রকৃত অর্থে একটি রাজনৈতিক হত্যা (Political murder) বলা যেতে পারে। এর মূলে কারণও ছিল বিবিধ। দ্বিতীয়ত, এই রাজনৈতিক হত্যার সাথে কুফা, বসরা ও ফুসতাতের কোন ব্যক্তি জড়িত ছিল না; বরং এই তিন শহরের চক্রান্তকারীদের একটি সংঘবদ্ধ দল এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। অসংখ্য লোক এই হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে সহসা কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি। তৃতীয়ত, ইতোমধ্যে চক্রান্তকারীদের অনেকে বিশেষ করে আসতার এবং আম্মার খলিফার সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন। এর ফলে অসংখ্য বিদ্রোহী- হন্তাদের মধ্যে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের অল্প সময়ের মধ্যে খুঁজে বের করা সহজসাধ্য ছিল না। চতুর্থত, এই চক্রান্তকারীদের অনেকেই বিশেষ করে আবদুল্লাহ ইবন-সা’বা খলিফা হযরত আলীর একজন একনিষ্ঠ সমর্থক হওয়াতে তাঁর পক্ষে সহসা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চমত, খলিফা স্বয়ং এরূপ আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, হত্যাকারীদের শাস্তি বিধান করলে বেদুঈন আরব এবং অনারব মুসলমানগণ গোলযোগের সৃষ্টি করে প্রশাসনিক অচলাবস্থার সৃষ্টি করবে। বস্তুত, তাঁর এই আশঙ্কা সত্য প্রমানিত হয়েছিল, নতুবা উষ্ট্র ও সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হত না। ষষ্ঠত, হযরত আবুবকরের খিলাফতে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি থাকায় তাঁর পক্ষে ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল; উপরন্তু, এটি ছিল দ্বীন ও মুরুয়ার সংঘর্ষ। কিন্তু হযরত ওসমানের হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল স্বার্থান্বেষী অনারব মুসলিম গোষ্ঠী এবং এদের দমন করবার জন্য হযরত আলী দ্বিধাবিভক্ত আরব মুসলমানদের পুর্ণ সমর্থন লাভ করেন নি। রাসূলে করীমের স্ত্রী বিবি আয়েশা এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবী তালহা ও যুবাইর যদি হযরত আলীর বিরোধিতা না করতেন তা হলে খলিফার পক্ষে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই কঠিন ছিল না। সম্ভবত খলিফা ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া সোচ্চার হন এবং খলিফা হযরত আলীর আমলে প্রাপ্ত খলিফা ওসমানের রক্তাক্ত বস্ত্র ও তাঁর স্ত্রী নাইলার কর্তিত আঙ্গুল প্রদর্শন করে সিরিয়ায় উত্তেজনার সৃষ্টি করেন। নাইলা ব্যতীত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কোন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না। নাইলা মুহাম্মদ বিন আবুবকরকে হত্যাকারী বলে সনাক্ত করতে অস্বীকার করেন। এই সমস্ত কারণে ইসলামী রাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে মনে করে তিনি আপাতত বিদ্রোহী-হন্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ হতে বিরত থাকেন।

প্রাদেশিক প্রশাসনে রদবদল

হযরত ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি প্রদানের সমস্যা স্থগিত থাকার জন্য সমগ্র ইসলামী রাষ্ট্রে যে রাজনৈতিক অসন্তোষ ও অরাজকতার সূচনা হয় তা প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের রদবদলের ফলে আরও তীব্র আকার ধারণ করে। অবশ্য খলিফা হযরত আলীর দৃঢ়-বিশ্বাস ছিল যে, প্রদেশে বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্র নির্মূল করতে হলে উপযুক্ত শাসকের প্রয়োজন। হযরত আলী (রা)-এর বন্ধুবর্গ এবং প্রধান হিতাকাঙ্ক্ষী ইবন-উল- আব্বাস আল-মুগীরা খলিফাকে পরামর্শ দেন যে, দেশে যতক্ষণ পর্যন্ত শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি যেন প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের পরিবর্তন না করেন। তাঁকে আরও পরামর্শ দেওয়া হয় যে, বিচক্ষণ, দূরদর্শী, উচ্চকাঙ্ক্ষী ও শক্তিশালী সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়াকে যেন তাঁর পদ হতে অপসারণ করা না হয়; কারণ, তিনি হযরত ওমর (রা)-এর খিলাফতে নিযুক্ত হন। কিন্তু হযরত আলী বিদ্রোহীভাবাপন্ন ও বিদ্রোহ দমনে অপারগ কুফা, বসরা, মিসর ও সিরিয়ার শাসনকর্তাদের পদত্যাগের নির্দেশ দেন। খলিফা মনে করেন যে, তাঁদের পদচ্যুতিতে বিদ্রোহীগণ সন্তুষ্ট হবে এবং নতুন প্রশাসক প্রদেশসমূহে পূর্ণ শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি হিতে বিপরীত হল।

খলিফার নির্দেশে বসরার শাসনকর্তা আবদুল্লাহ ইবন-আমীর পদচ্যুত হলেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন ওসমান-বিন-হানিফ। তিনি বসরায় বিনা বাধায় প্রবেশ করলেও সেখানকার লোকেরা হযরত ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ দাবি করে। মিসরের নব- নিযুক্ত শাসনকর্তা কায়েস-বিন-সা’দ পারদর্শী ও দক্ষ প্রশাসক হলেও সেখানকার লোকেরা খলিফা ওসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাঁর শাসন মানতে অস্বীকার করে। ইয়েমেনে নতুন শাসনকর্তা প্রেরিত হলেন কিন্তু পূর্বের শাসনকর্তা সরকারের তহবিল হতে অর্থ আত্মসাৎ করে মক্কায় পলায়ন করেন। কুফার শাসনকর্তা খলিফার নির্দেশে পদত্যাগ করতে রাজী হলেন; কিন্তু সিরিয়ার প্রভাবশালী শাসনকর্তা মুয়াবিয়া হযরত আলী (রা)-এর নির্দেশ অমান্য করেন। উদ্ধত, ক্ষমতালোভী, কুচক্রী মুয়াবিয়ার এই প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। বন্ধু এবং আত্মীয়-স্বজনের নিষেধ সত্ত্বেও হযরত আলী (রা) মুয়াবিয়াকে পদত্যাগ করতে বলে নিতান্তই অদূরদর্শিতা ও কূটনৈতিক অজ্ঞতার পরিচয় দেন। খলিফা হযরত আলী বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ হলে তিনি সিরিয়াবাসীদিগকে খলিফা ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের হস্তগত করতে পারতেন এবং পক্ষান্তরে তাদেরকে আরব বেদুঈণদের বিরুদ্ধে নিযুক্ত করতে পারতেন।

খলিফা হযরত আলীর নির্দেশ অমান্য করে মুয়াবিয়া হযরত ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ নিবার জন্য নিহত খলিফার রক্তরঞ্জিত বস্ত্রাদি এবং তাঁর স্ত্রী নাইলার কর্তিত আঙ্গুল দামেস্কের মসজিদে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করে হযরত আলীর বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও উত্তেজনার সৃষ্টি করতে থাকেন। লক্ষণীয় যে, হযরত ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ ছিল একটি উপলক্ষ্য (cloak) মাত্র। প্রতিশোধের শ্লোগান (bogey) দ্বারা তিনি তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করতে চেষ্টা করেন। হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে বিরোধের অনেকগুলো কারণ ছিল; প্রথমত, সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া খলিফা ওমর (রা) কর্তৃক নিযুক্ত হন এবং প্রশাসক হিসেবে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করেন। দ্বিতীয়ত, সিরিয়ায় মুয়াবিয়া স্বীয় ক্ষমতাবলে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলে হযরত আলী (রা) শঙ্কিত হয়ে উঠেন; কারণ এটি কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে পারে। তৃতীয়ত, মুয়াবিয়ার ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি উপলব্ধি করে খলিফা আলীকে তাঁর বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন এমনকি তাঁর পুত্র ইমাম হাসানও পদচ্যুত করতে নিষেধ করেন। এতে মুয়াবিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিশোধ গ্রহণকারীদের তিনি নেতৃত্ব দান করতে থাকেন। চতুর্থত, খলিফা আলী মুয়াবিয়াকে শুধু শাসনকর্তার পদ হতে অপসারণ করতে চান নি; বরং উমাইয়াদের দ্বারা অন্যায়ভাবে দখলকৃত জায়গীর ও ভূ- সম্পত্তি সরকারকে প্রত্যর্পণের নির্দেশ দেন। হযরত ওসমান যেভাবে হযরত ওমরের রাজস্ব-নীতি পরিবর্তন করেন খিলাফত লাভ করে হযরত আলী সেভাবে হযরত ওসমানের রাজস্ব-নীতির পরিবর্তন সাধিত করেন। আমীর আলী বলেন, “ন্যায় ও সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এবং সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে পরামর্শ উপেক্ষা করে খিলাফত লাভের পরেই তিনি ওসমান কর্তৃক নিযুক্ত দুর্নীতিপরায়ণ শাসনকর্তাদের পদচ্যুতির আদেশ প্রদান করেন। জনগণের ক্ষতিসাধন করে বৃদ্ধ খলিফা (ওসমান) তাঁর প্রধান গুণগ্রাহীদের যে সমস্ত জায়গীর ও ভূ-সম্পত্তি দান করেন তার প্রত্যর্পণ এবং হযরত ওমরের পদ্ধতি অনুযায়ী রাজস্ব বণ্টনের আদেশ প্রদান করেন।” পঞ্চমত, হযরত আলীর সাথে মুয়াবিয়ার বিরোধকে বনু হাশিমের সাথে বনু উমাইয়ার বংশানুক্রমিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বলে অভিহিত করা হয়। মুয়াবিয়া ছিলেন ক্ষমতালোভী, কুচক্রী, বিশ্বাসঘাতক ও বিবেকবর্জিত ও ষড়যন্ত্রকারী এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত খোলাফায়ে রাশেদূনের বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধারণ করতে দ্বিধা করেন নি। তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কুচক্রী পন্থায় জনসাধারণের মনে এরূপ বিশ্বাস স্থাপন করেন যে, হযরত আলী উদ্দেশ্যমূলকভাবে হযরত ওসমানের হত্যাকারীদের গোপনে সমর্থন করেছেন। এভাবে জনমতকে বিভ্রান্ত, জনগণকে উত্তেজিত এবং ধীরে ধীরে শক্তি বৃদ্ধি করে হযরত আলীর বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

গৃহযুদ্ধসমূহ

জোসেফ হেল বলেন, “ওসমানের হত্যা ছিল গৃহযুদ্ধের বিপদসংকেত স্বরূপ।” হযরত ওসমানের হত্যা ইসলামের ইতিহাসে একটি সুপরিকল্পিত ঘটনার মর্মান্তিক পরিণতি। তাঁর রাজত্বে রাজনৈতিক কোন্দল, ব্যক্তিস্বার্থের সংঘাত, গোত্রীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রভৃতি কারণে মুসরমানদের মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় তা কেবল খলিফা ওসমানের হত্যায় পরিসমাপ্তি ঘটে নি, এর জের খলিফা আলী (রা)-এর শাসনামলে চলতে থাকে এবং গৃহযুদ্ধের সূচনা দ্বারা খোলাফায়ে রাশেদূনের পতনকে ত্বরান্বিত করে। জনৈক ফরাসি ঐতিহাসিক বলেন, “সকলেই এই পবিত্র ও মহান গৌরবের অধিকারী (হযরত আলী) আনুগত্য স্বীকার করবে এরূপ ধারণা করাই স্বাভাবিক ছিল।” দুর্ভাগ্যবশত হযরত আলীর পাঁচ বছরের খিলাফত রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের ইতিহাস মাত্র। পর পর তিনটি গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে ইসলামের ঐক্য, সংহতি, নিরাপত্তা ও গৌরবের ইতিহাসকে ম্লান করে দেয়। এইগুলো ছিল (ক) উষ্ট্রের যুদ্ধ, (খ) সিফফিনের যুদ্ধ ও (গ) নাহরাওয়ানের যুদ্ধ।

(ক) উষ্ট্রের যুদ্ধ (৬৫৬ খ্রি.)

কারণ : খলিফা হযরত আলী শাসনভার গ্রহণ করে একটি সঙ্কটময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। হযরত আলীর নির্বাচনে প্রভাবশালী সাহাবীদ্বয় তালহা ও যুবাইর আনুগত্য স্বীকার করেন কিন্তু তাঁদের দাবি ছিল এই যে, শাসনভার গ্রহণ করে খলিফা আলী হযরত ওসমানের হত্যাকারীদের সর্বপ্রথম শাস্তি প্রদানের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার দরুন খলিফার পক্ষে কোন প্রকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভবপর হয় নি। কারণ প্রকৃত হত্যাকারীদের সনাক্ত করা যায় নি। একথা সত্য নয় যে, তালহা ও যুবাইর খিলাফত লাভের আশায় হযরত আলীর বিরুদ্ধাচারণ করেন; বরং তাঁরা স্বেচ্ছায় হযরত আলীর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। রাসূলে করীম (স)-এর ঘনিষ্ঠ এই দুই সাহাবীর অসন্তোষ ও বিদ্বেষের মূলে কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমত, হযরত আলী হত্যাকারীদেরকে শাস্তি প্রদানে অক্ষমতা প্রকাশ করলে তাঁরা খলিফার প্রতি নির্লিপ্ততা ও ঔদাসীন্য প্রদর্শন করতে থাকেন; দ্বিতীয়ত, খলিফা আলী (রা) হযরত ওসমানের অনুসৃত রাজস্ব-নীতি পরিবর্তন করলে তাঁরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন; তৃতীয়ত, হযরত ওসমানের আমলে নিযুক্ত শাসকবর্গের অক্ষমতা ও দুর্নীতিপরায়ণতার জন্য অপসারণ করবার আদেশে তাঁরা সন্তুষ্ট হতে পারেন নি, বিশেষ করে এতে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধাচরণ তীব্রতর হবে তা তাঁরা বুঝতে পারেন। চতুর্থত, সৈয়দ আমীর আলীর মতে, “কুরাইশ বংশের দুজন খ্যাতনামা সদস্য তালহা এবং যুবাইরকে কুফা ও বসরার শাসনভার অর্পণে তাঁরা (খলিফার) অস্বীকৃতি তাঁদের নিশ্চিত বন্ধুত্বকে ঘোরতর শত্রুতায় পরিণত করে।”

মহানবীর স্ত্রী ও হযরত আবুবকরের কন্যা বিবি আয়েশা তালহা ও যুবাইয়ের সঙ্গে একমত হয়ে খলিফা ওসমান (রা)-এর হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য হযরত আলীকে অনুরোধ করেন। প্রতিকূল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা সম্ভব না হওয়ায় হযরত আয়েশা সিদ্দিকা খলিফার অনুসৃত নীতির প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন। তালহা ও যুবাইর বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে মক্কা হতে বসরার দিকে অগ্রসর হবার পথে বিবি আয়েশার সাথে তাঁদের সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁরা একত্রে হযরত আলীর বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বিবি আয়েশা উষ্ট্রপৃষ্ঠে মক্কা হতে হজ্ব পালন করে ফিরছিলেন। তিনি খলিফা ওসমানের নৃশংস হত্যার কথা শুনে তৎক্ষণাৎ এর প্রতিকার দাবি করেন এবং তালহা ও যুবাইরের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে খলিফা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের দাবি জানান। হযরত আলীর নির্লিপ্ততায় তাঁরা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেন। হযরত আয়েশার বিরুদ্ধাচরণের জন্য নানা অভিমত প্রকাশ করা হয়। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, “হযরত আবুবকরের দুহিতা হযরত আয়েশা হযরত আলীর বিরুদ্ধে অভাবনীয় বিদ্বেষ পোষণ করতেন বলে তিনিই অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলেন।” আমীর আলী হযরত আলীর প্রতি বিবি আয়েশার যে বিদ্বেষের কথা উল্লেখ করেন তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এর সপক্ষে বলা যায় যে, খলিফা আলীর বিরুদ্ধে বিবি আয়েশার ব্যক্তিগত কোন অভিযোগ ছিল না; যদিও তাঁর সাথে হযরত আলীর একবার ভুল বুঝাবুঝি (misunderstanding) হয়। উল্লেখ করা যায় যে, বিবি আয়েশা একবার রাসূলে করীমের কাফেলার পশ্চাতে অবস্থান করায় বিধর্মীগণ তাঁর পুত পবিত্র চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ করে এবং এ বিষয়ে হযরত আলীর নির্লিপ্ততায় তিনি বিরক্ত হন। আল্লাহ সূরা নূরের (২৪ : ১১-২০) মাধ্যমে এই ভ্রান্তি দূর করে বিবি আয়েশার নিষ্কলুষ চরিত্রের কথা বলেন। সুতরাং হিট্টির ভাষায়, “তিনি (বিবি আয়েশা) তাঁর আঘাতপ্রাপ্ত সমস্ত তিক্ততার সাথে তাঁকে (হযরত আলীকে) ঘৃণা করতেন।” ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এটি সম্পূর্ণ অবাস্তব, ভিত্তিহীন ও কল্পনাপ্রসূত। উষ্ট্রের যুদ্ধে বিপর্যয়ের পর হযরত আলী বিবি আয়েশাকে সসম্মানে মদিনায় প্রত্যাগমনের ব্যবস্থা করেন। এ থেকে প্রমানিত হয় যে, উভয়ের মধ্যে কোন বিদ্বেষ ছিল না। দ্বিতীয়ত, হযরত আয়েশা (রা) খিলাফতের প্রত্যাশী ছিলেন না; শুধু ন্যায় ও সততার ভিত্তিতে তিনি অধর্ম ও অনাচারের প্রতিকার দাবি করেন। মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, “মুসলমানদের এটি প্রথম এবং অবশ্য কর্তব্য ছিল, ইসলামের বৃদ্ধ এবং নিরীহ খলিফাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করবার দরুন দুষ্কৃতকারীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা।” তৃতীয়ত, বিবি আয়েশা খলিফা হযরত আলীর অনসৃত নীতি পছন্দ করতেন না। হযরত ওসমানের আমলে নিযুক্ত উমাইয়া গোত্রীয় শাসকদের অপসারণ এবং রাজস্ব-ব্যবস্থায় পরিবর্তন বনু উমাইয়া গোত্রের প্রতি বনু হাশেম গোত্রের আক্রোশ বলে মনে করা হয়। চতুর্থত, বিবি আয়েশা (রা) যদি হযরত আলীর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হতেন তা হলে তিনি নিজে সৈন্যবাহিনী গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। পক্ষান্তরে, তিনি শুধু অবস্থার চাপে এবং খলিফার নিষ্ক্রিয় ও নির্লিপ্ত মনোভাবের জন্য বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন এবং পরবর্তীকালে তালহা ও যুবাইরের প্ররোচনায় তাদের দলে যোগদান করেন।

ঘটনাবলি : হযরত ওসমানের হত্যা একটি ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের পরিণতি; কিন্তু এক্ষেত্রে হযরত আলী মুসলিম রাষ্ট্রের সংহতি হানিকর ভাইয়ের দ্বারা ভাইয়ের রক্তপাত ঘটাতে চাহেন নি। কিন্তু তালহা ও যুবাইর সর্বপ্রথম মুসলমান হয়ে ইসলামের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী মুসলমানদের এবং খোলাফায়ে রাশেদূনের বিরুদ্দে গৃহযুদ্ধ পরিচালনা করেন। হযরত আলীর প্রতি আনুগত্যের শপথ বিস্মৃত হয়ে এবং হযরত আয়েশাকে তাদের দলে যোগদানে প্ররোচিত করে তালহা ও যুবাইর ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে মক্কা ও মদিনা হতে ৩০০০ সৈন্যসহ বসরায় আগমন করে শহরটি দখল করেন। বিবি আয়েশার উপস্থিতিতে অধিকাংশ বসরাবাসী বিদ্রোহীদের দলে যোগদান করে এবং বসরার শাসনকর্তা ওসমান-বিন-হানিফকে পরাজিত করে বন্দী করেন। তালহা, যুবাইর ও বিবি আয়েশা খলিফা ওসমানের হত্যার সঙ্গে জড়িত দুষ্কৃতকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, তারা প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইনকানুন উপেক্ষা করে নিজ হস্তে খলিফার হত্যাকারীদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরূপ বিরুদ্ধাচরণ রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমতুল্য মনে করে হযরত আলী সিরিয়ার শাসনকর্তা কুচক্রী মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে গঠিত এক বিশাল বাহিনী সিরিয়ার পরিবর্তে কুফার পথে বসরায় প্রেরণ করেন। কুফার শাসনকর্তা আবু মুসা-আল-আসারী খলিফাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করলে তাকে পদচ্যুত করা হয়। কুফাবাসিগণ হযরত আলীর বাহিনীতে যোগদান করে বসরায় উপস্থিত হলেন এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা উপশম ও সমস্যার সমাধান দ্বারা শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেন। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বিদ্রোহ ও অসন্তোষ দমন করে হযরত ওসমানের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা হবে এবং কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।

শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনের আশঙ্কায় কুফা, বসরা ও মিসরীয় বিদ্রোহীগণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে; কারণ, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের নাশকতামূলক কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যাবে এবং তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এ কারণে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে বিঘ্নিত করবার জন্য ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর তারিখে বিদ্রোহীরা খলিফার অজ্ঞাসারে আশতার, নাখয়ী ও ইবন সাওদার নেতৃত্বে রাত্রির অন্ধকারে বসরার উপকণ্ঠে কারবালা নামক স্থানে অবস্থিত উভয় পক্ষের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। উভয় পক্ষ মনে করে যে, এটি কোন তৃতীয় পক্ষের কারসাজি। অবস্থার অবনতি হতে দেখে হযরত আলী তাঁর লোকদিগকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। কিন্তু অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে এবং মুসলমানগণ স্বজাতির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে প্রথম গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। তালহা, যুবাইর ও বিবি আয়েশার বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হলেন। হযরত আলী অশ্বপৃষ্ঠে এবং হযরত আয়েশা উষ্ট্রপৃষ্ঠে যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি স্থাপনের জন্য আহ্বান জানান। বিবি আয়েশা উষ্ট্রপৃষ্ঠে চেপে যুদ্ধ পরিচালনা করেন বলে একে উষ্ট্রের অথবা জামালের যুদ্ধ (Battle of the Camel) বলা হয়। ইত্যবসরে দুর্ভাগ্যক্রমে বসরা হতে মক্কার পথে গমনের সময় ইবন-সা’বার অনুচরগণ কর্তৃক তালহা ও যুবাইর নিহত হন। এই দুই বীর যোদ্ধা নিহত হলে বিদ্রোহীদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল বিবি আয়েশাকে আক্রমণ করা। বিদ্রোহীদের হাত হতে বহু কষ্টে উদ্ধার করে হযরত আলী বিবি আয়েশাকে সসম্মানে তাঁর ভ্রাতা মুহাম্মদ বিন-আবুবকরের পাহারাধীনে চল্লিশ জন মহিলাসহ মদিনায় পাঠিয়ে দেন। তালহা ও যুবাইরের মৃত্যু এবং বিবি আয়েশার বিপর্যয়ে উষ্ট্রের যুদ্ধের সমাপ্তি হয় এবং খলিফা হযরত আলী বিজয় লাভ করলেও এই মর্মস্পর্শী ঘটনায় তিনি খুবই ব্যথিত হন।

ফলাফল : উষ্ট্রের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে মুসলমানগণ একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে রক্তপাতের সূচনা করে। মূইর যথার্থই বলেন, “এই যুদ্ধে মুসলমানগণ সর্বপ্রথম একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে।” যুগ যুগ ধরে স্বার্থ-সংঘাত, গোত্রীয় দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক লিপ্সা প্রভৃতি কারণে এটি চালিত থাকে। এই যুদ্ধকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম বলা যায়। কারণ, হযরত আয়েশা বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তাঁর নিরাপত্তার জন্য কমপক্ষে ৪,৭৩০ জন সৈন্য আত্মাহুতি দেয়। বিবি আয়েশার উষ্ট্রও নিহত হয়। তাঁর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে এই ঘটনা ঘটে। হযরত আলী এবং বিবি আয়েশার মতানৈক্য ও ভুল বুঝাবুঝির জন্য এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং প্রায় দশ হাজার মুসলমান নিহত হয়। যুদ্ধে জয়লাভ করে খলিফা হযরত আলী তালহা, যুবাইর এবং অন্যান্য সাহাবীর মৃত্যু ইসলামের পক্ষে ক্ষতিস্বরূপ বলে ঘোষণা করেন। প্রকৃতপক্ষে হযরত আলীর এই বিজয় হত্যাকারীদের বিজয়। কারণ, তাদের উস্কানি ও প্ররোচনায় হযরত আলী ও হযরত আয়েশার মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হয়। উষ্ট্রের যুদ্ধের অন্যতম ফলাফল ছিল এই যে, এর ফলে মক্কা, বসরা ও কুফার মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধের অবসান হয়। হযরত আলী (রা) বিদ্রোহ সমূলে উৎপাটিত করবার জন্য প্রশাসনিক পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। কায়েস ইবনে-সা’দ, সুহাইল ইবন-হানিফ এবং আবদুল্লাহ ইবনে-আব্বাসকে যথাক্রমে মিসর, হিজাজ ও বসরার শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত করেন। খলিফা আলীর অন্যতম প্রশাসনিক পদক্ষেপ ছিল মদিনা হতে কুফার রাজধানী স্থানান্তর। ইরাকীদের সমর্থনে, প্রতিশ্রুতিতে এবং বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যস্থলে রাজধানী প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে খলিফা ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে কুফাকে রাজধানীর মর্যাদা দান করেন। রাজধানী স্থানান্তরিত হলে ধর্মীয় কেন্দ্রস্থল হিসেবে মদিনার গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং এতে রাসূলে করীম (স) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মদিনা অপেক্ষা অনারব অঞ্চলের কুফা ও বসরা প্রাধান্য লাভ করে। এতে মদিনার জীবিত সাহাবীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এবং তাঁরা খিলাফতে সক্রিয় অংশগ্রহণ হতে বঞ্চিত হন। অপরদিকে কুফায় রাজধানী স্থাপন করে হযরত আলীর উদ্দেশ্য সফল হয়নি; কারণ অস্থিরমতি, দুর্বল, প্রতারক, ষড়যন্ত্রকারী কুফাবাসীদের উপর তিনি অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়লে খোলাফায়ে রাশেদূনের ধ্বংস আনবার্য হয়ে পড়ে।

(খ) সিফ্‌ফিনের যুদ্ধ (৬৫৭ খ্রি.)

কারণ : উষ্ট্রের যুদ্ধ সংঘটিত হবার পূর্বে হযরত আলীর সাথে মুয়াবিয়ার দ্বন্দ্ব ও তিক্ততা চলতেছিল। কুফায় রাজধানী স্থানান্তরিত করে প্রশাসনিক রদবদল দ্বারা খলিফা স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন এবং বিদ্রোহী শাসনকর্তাকে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে নির্দেশ দেন। একটি পত্রে খলিফা মুয়াবিয়াকে ইসলামের স্বার্থে তাঁর আনুগত্য স্বীকারের আহ্বান জানান; কিন্তু চক্রান্তকারী ও উচ্চাভিলাসী সিরিয়ার শাসনকর্তা খলিফাকে অবমাননা করার জন্য ঠিকানাযুক্ত পত্রবিহীন একটি খাম প্রেরণ করেন। মুয়াবিয়া নিহত খলিফা ওসমানের রক্তে রঞ্জিত পোশাক ও তাঁর স্ত্রী নাইলার কর্তিত আঙ্গুল দেখিয়ে সিরিয়াবাসীদের খলিফা আলীর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে থাকেন। মুয়াবিয়া এ কথাও জানান যে, খলিফা ওসমানের হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা না হলে তিনি আনুগত্য স্বীকার করবেন না। এভাবে প্রতিষ্ঠিত খোলাফায়ে রাশেদূনের সরকারের বিরুদ্ধে তিনি প্রায় ৬০,০০০ সিরীয় সৈন্য গঠন করে হত্যার প্রতিশোধ নেবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেন। এর ফলেই ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

হযরত আলীর সাথে মুয়াবিয়ার সংঘর্ষের প্রধান কারণ ছিল মুয়াবিয়ার ক্ষমতালিপ্সা ও উচ্চাভিলাস। সুযোগ্য ও দক্ষ শাসক, সংগঠক ও যোদ্ধা হিসেবে মুয়াবিয়া কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। উত্তর আফ্রিকা, ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, মধ্য এশিয়া ও এশিয়া মাইনরের বহু স্থানে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করে তিনি শুধু ইসলামী রাষ্ট্রের আয়তনই বৃদ্ধি করেন নি; বরং স্বীয় ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও প্রভাব এই সমস্ত অঞ্চলে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। প্রাদেশিক রাজধানী দামেস্কে তিনি স্বীয় ক্ষমতা কুক্ষিতগত ও কেন্দ্রীভূত করে খিলাফতের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গঠন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন।

ক্ষমতালোভী ও উচ্চাভিলাসী মুয়াবিয়া হযরত ওসমানের হত্যাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৎপর হয়ে উঠেন। একথা অনস্বীকার্য যে, হযরত ওসমানের হত্যা একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যা। এটি অসংলগ্ন, একক এবং আকস্মিক ঘটনা হলে হযরত আলী মুষ্টিমেয় হত্যাকারীকে শাস্তি প্রদান করতে পারতেন। কিন্তু কুফা, বসরা ও মিসরের মত তিনটি প্রদেশের অধিবাসীরা এর সঙ্গে জড়িত ছিল এবং এদের মধ্য হতে প্রকৃত ঘাতকদের চিহ্নিত করে দণ্ড প্রদান খলিফার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল। হযরত আলীর নিষ্ক্রিয়তা, উষ্ট্রের যুদ্ধে তাঁর বিজয়, প্রশাসনিক রদবদল ও কুফায় রাজধানী স্থানান্তরে মুয়াবিয়া বিচলিত হয়ে উঠেন এবং খলিফার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকেন। মুয়াবিয়া খলিফা হযরত ওসমানের হত্যার সঙ্গে হযরত আলীকেও জড়িত করতে দ্বিধা করেন নি এবং তিনি প্রচারনা করেন যে খিলাফত লাভের আশায় হযরত আলী এই হত্যার কোন প্রতিকার করেন নি। প্রকৃতপক্ষে খিলাফতকে কেন্দ্র করেই মুয়াবিয়া ও হযরত আলী (রা)-এর মধ্যে একটি তীব্র সংঘর্ষ ও অভাবনীয় তিক্ততার সৃষ্টি হয়। উচ্চাভিলাসী মুয়াবিয়ার যে খিলাফতের প্রতি দুর্বলতা ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার সাথে মিসর বিজয়ী আমর ইবন-আল- আসের গোপন চুক্তিতে। প্রথম দিকে শত্রুতা থাকলেও আমরের সাথে মুয়াবিয়া গোপন চুক্তি সম্পাদন করেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, যদি আমর মুয়াবিয়ার সাথে যোগ দেন এবং মুয়াবিয়া হযরত আলীকে পরাজিত করতে পারেন তবে তাকে পুনরায় মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হবে। এ দুই ধূর্ত ও চতুর ষড়যন্ত্রকারীর মধ্যে যোগাযোগ নিঃসন্দেহে হযরত আলীর শক্তিকে ক্ষীণ করে। দু’মার মীমাংসাই এর প্রমাণ।

কুরাইশ বংশের বনু হাশেম ও বনু উমাইয়াদের দ্বন্দ্ব প্রাক-ইসলামিক যুগ হতে চলে আসছিল। আবু সুফিয়ান ইসলামের ঘোরতর শত্রু ছিলেন এবং তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনকে বিপন্ন করে তোলেন। সুতরাং তাঁরই পুত্র মুয়াবিয়া বনু উমাইয়া গোত্রের হয়ে বনু হাশেমের প্রতি অনুরক্ত হবে এই কথা বিশ্বাস করা যায় না। হযরত ওসমানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং প্রভাবশালী উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়া হযরত আলীর খিলাফত লাভে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। স্বভাবত আলী তাঁকে পদত্যাগ করবার নির্দেশ প্রদান করলে তিনি তা অস্বীকার করে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। বনু হাশেম ও বনু উমাইয়াদের দ্বন্দ্ব ও বৈরীভাবকে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করে মুয়াবিয়া ক্ষমতা লাভ করেন। বনু হাশেমের প্রতি তাঁর বিদ্বেষের অনেকগুলো কারণ ছিল। প্রথমত, হযরত ওমর কর্তৃক নিযুক্ত হলে মুয়াবিয়া হযরত আলীর পদত্যাগের নির্দেশকে উমাইয়া গোত্রের প্রতি অন্যায় আচরণ বলে মনে করেন। দ্বিতীয়ত, খলিফা ওসমানের মৃত্যুতে সকল প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে পদচ্যুত করে হযরত আলী অদূরদর্শিতার পরিচয় প্রদান করেন। এ কারণেই বসরা, কুফা ও মিসরের বাহিনী মদিনা আক্রমণ করে। সিরিয়া হতে কোন বিদ্রোহী দল মদিনায় আগমন করে নি। সুতরাং, মুগীরা-ইবন-আব্বাস এবং স্বীয় পুত্র ইমাম হাসানের পরামর্শকে উপেক্ষা করে হযরত আলী সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়াকে পদত্যাগ করতে না বললে পরিস্থিতি জটিল আকার ধালন করত না। তৃতীয়ত, মুয়াবিয়ার সুযোগ্য শাসনে সিরিয়ায় শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় ছিল এবং তাঁর বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ ছিল না। পদত্যাগের নির্দেশকে মুয়াবিয়া হযরত আলীর ব্যক্তিগত আক্রোশ বলে মনে করেন। চতুর্থত, হযরত ওসমানের রাজস্ব ব্যবস্থা বাতিল করে হযরত ওমর কর্তৃক প্রবর্তিত ব্যবস্থাদি খলিফা আলী প্রচলন করবার চেষ্টা করলে হযরত ওসমানের খিলাফতকালে সুযোগ-সুবিধা ভোগকারীরা ভূ-সম্পত্তি ও জমিদারী ত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। হযরত ওসমানের আমল থেকে মুয়াবিয়া এবং অন্যান্য উমাইয়াগণ যে সমস্ত সরকারি ভূ-সম্পত্তি (আল-ফে) ভোগ করছিলেন খিলাফত লাভ করে হযরত আলী সেগুলো সরকারকে প্রত্যার্পন করবার নির্দেশ দেন। এতে মুয়াবিয়ার স্বার্থহানি ঘটে। পঞ্চমত, প্রশাসনিক পুনর্গঠনে হযরত আলী হাশেমী ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে চাইলে উমাইয়াদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় মুয়াবিয়া বিরোধিতা করেন। ষষ্ঠত, হযরত আলীর খিলাফতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং এর সুযোগে স্বার্থান্বেষী চক্র ইসলামের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে কণ্ঠরোধ করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করে। মুয়াবিয়া এককালীন বায়জানটাইন প্রদেশের রাজধানী দামেস্কে দীর্ঘ বিশ বছর যাবৎ শাসনকার্য পরিচালনা করে রাজতন্ত্র ও একনায়কত্বের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এ কারণেই তাকে বলা হয় ‘মুসলিম সীজার’। মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, “অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, মুয়াবিয়া উচ্চ আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে হযরত ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ দাবি করেন নি।” রাজনৈতিক অসাধুতা ও চক্রান্তমূলক কার্যকলাপ দ্বারা তিনি প্রচার করলেন যে, সুযোগ্য মিসরীয় শাসক কায়েস-বিন-সাদ মিসরের বিদ্রোহীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। ফলে, কায়েসের স্থলে আয়েশার ভ্রাতা মুহাম্মদ-বিন-সাদ মিসরের বিদ্রোহীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। ফলে, কায়েসের স্থলে আয়েশার ভ্রাতা মুহাম্মদ-বিন-আবুবকরকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। উষ্ট্রের যুদ্ধে বিদ্রোহী ভাবাপন্ন কয়েকজন যোদ্ধা হযরত আলীর সৈন্যদলে যোগদান করলে মুয়াবিয়া অভিযোগ করেন যে, খলিফার সাথে হযরত ওসমানের হত্যাকারীদের যোগাযোগ রয়েছে। সন্দেহ, বিদ্বেষ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এরূপ বিষাক্ত করে তুলেছিল যে, হযরত আলীর পক্ষে সুষ্ঠু পন্থা অবলম্বন করা সম্ভবপর হয় নি।

ঘটনা : মুয়াবিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা, ধৃষ্টতা, উদ্ধত স্বভাব, কুচক্রী মনোভাব ও রাষ্ট্রদ্রোহিতায় হযরত আলী বিচলিত হয়ে পড়েন এবং ইসলামের ঐক্য ও সংহতি অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য উষ্ট্রের যুদ্ধের পর সিরিয়ার অযোগ্য ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত শাসনকর্তাকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আনুগত্য প্রকাশে অনীহা, খলিফার চিঠির অবমাননা, সৈন্য সংগ্রহ, হযরত ওসমানের হত্যার প্রতিশোধকে মূলধন করে উত্তেজনা ও অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টায় বাধ্য হয়ে হযরত আলী ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে ৫০,০০০ সৈন্যসহ কুফা হতে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দিকে অগ্রসর হলেন। আলী অগ্রগতির সংবাদে মুয়াবিয়া কালবিলম্ব না করে ৬০,০০০ সৈন্য নিয়ে ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিম তীরে সিফন নামক স্থানে উপস্থিত হলেন। মুসলমানদের অহেতুক রক্তপাত বদ্ধ করবার জন্য হযরত আলী রণক্ষেত্রে মুয়াবিয়ার নিকট আনুগত্যের আহ্বান ও শান্তির প্রস্তাব নিয়ে একজন দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার ঔদ্ধত্য ও জঙ্গী মনোভাবের ফলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হয়। মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনী আক্রমণ করলে খলিফা আলীর সৈন্যবাহিনী সুযোগ্য সেনাপতি মালিক-আল-আসতারের নেতৃত্বে বীর বিক্রমে শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুয়াবিয়ার পক্ষে সিফফিনের যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে এবং পরাজয়ের অনিবার্যতার বিহ্বল হয়ে তিনি তার প্রধান সেনাপতি ও উপদেষ্টা, কূটনীতিবিদ আমর ইবন-আল-আসের পরামর্শে যুদ্ধ স্থগিত রাখবার একটি অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন। আমরের পরামর্শে অগ্রবর্তী সৈন্যদল তাদের পতাকাশীর্ষে ও বর্শাগ্রে কুরআন শরীফের পবিত্র পাতা বিদ্ধ করে চীৎকার করে উঠল, “এখানে আল্লাহর কিতাব—এটি আমাদের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করে দিবে।” এই অভাবনীয় পরিস্থিতিতে হযরত আলী (রা)-এর সৈন্যদলের কুরআনে হাফিজগণ কুরআনের মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষার্থে যুদ্ধ বন্ধ করবার জন্য খলিফাকে অনুরোধ করেন। আমরের ধূর্ততা ও শঠতার ফলে সহসা যুদ্ধ স্থগিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, মুয়াবিয়ার সৈন্যদল নিরাপত্তা ও আশ্রয় লাভের আশায় বর্শাগ্রে কুরআনের পাতা বিদ্ধ করতে চাহে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি একটি রাজনৈতিক ভোজবাজী (Political ruse) বলা যেতে পারে। অবশ্য যুদ্ধের পরাজয় মুয়াবিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ধুলিসাৎ করে দিবে বুঝতে পেরে শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় গ্রহণ করে আকস্মিক যুদ্ধ বদ্ধ করা হয়। হযরত আলী মুয়াবিয়ার শঠতা ও ধূর্ততা উপলব্ধি করে যুদ্ধ স্থগিত রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। এমনকি তাঁর সেনাপতি আসতার মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনী কুরআনের আশ্রয় গ্রহণ করলেও যুদ্ধ পরিচালিত করতে থাকেন। হযরত আলী তাঁকে যুদ্ধ বন্ধ করবার আদেশ দিলে আসতার সংবাদ পাঠান যে, যুদ্ধজয় অবশ্যম্ভাবী (The victory was quite at hand ); এমতাবস্থায় তিনি যুদ্ধ স্থগিত রাখার পক্ষপাতী না। সুতরাং একথা অনস্বীকার্য যে, অসাধুতা, শঠতা ও ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করে যুদ্ধ স্থগিত রাখা না হলে মুয়াবিয়া হযরত আলীর নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হতেন। খলিফা অনিচ্ছাসত্ত্বেও যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হন। পবিত্র কুরআন শরীফের অবমাননাকে তিনি কখনই বরদাস্ত করতে পারেন নি। এভাবে খলিফা একটি নিরঙ্কুশ ও চূড়ান্ত বিজয় হতে বঞ্চিত হয়ে স্বীয় জীবন এবং পক্ষান্তরে খোলাফায়ে রাশেদূনকে বিপন্ন করেন। অবশেষে সেনাপতি আসতারকে মুয়াবিয়ার নিকট প্রেরণ করা হলে মুয়াবিয়া যা বললেন, তা এইরূপ—”আমরা প্রত্যেকে একজন সালিসি বা মধ্যস্থ ব্যক্তি নিযুক্ত করব এবং তাঁরা কুরআনের নির্দেশিত আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী আমাদের বিরোধ মীমাংসা করবেন। “

দুমার মীমাংসা (জানুয়ারি, ৬৫৯ খ্রি.)

হযরত আলীর সাথে মুয়াবিয়ার সংঘর্ষের পরিসমাপ্তির জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, তাঁরা উভয়ে মধ্যস্থ ব্যক্তি নিযুক্ত করে বিরোধ মিটাবার চেষ্টা করবেন। খলিফা আলী আবু মুসা আল-আসারী ও মুয়াবিয়া আমর বিন-আল-আসকে সালিস নিস্পত্তি করবার জন্য স্ব স্ব পক্ষের মধ্যস্থ ব্যক্তি (Mediator) নিযুক্ত করলেন। স্থির হল যে, উভয় সালিসের প্রত্যেকে চারশত লোক সঙ্গে নিয়ে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থলে মিলিত হবেন এবং কুরআন শরীফের নির্দেশানুসারে বিরোধ মীমাংসা করবেন। যদি তারা কোন স্থির ও অবিচল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারেন, তা হলে এই মীমাংসার ভার আটশত লোকের উপর পড়বে এবং তাদের ভোটাধিকারের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী দুমাতুল-জন্দল নামক স্থানে সালিসি মজলিশ বসে। ৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত এই মজলিশে যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তা ইসলামের ইতিহাসের পটভূমিকে দ্রুত পরিবর্তন করে। সভার কাজ শুরু হবার পূর্বে ধূর্ত ও কপট আমর সরলমতি আবু মুসাকে বুঝালেন যে, ইসলামের শান্ত ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য মুয়াবিয়া এবং হযরত আলীকে খিলাফতের দাবি ত্যাগ করতে হবে এবং তদস্থলে তৃতীয় ব্যক্তিকে খলিফা নির্বাচিত করতে হবে। উল্লেখযোগ্য যে, এ দুজন মধ্যস্থ ব্যক্তির খলিফা নিযুক্ত করবার কোন অধিকার ছিল না এবং কেবল মুসলমানদের একটি সাধারণ কাউন্সিলের সর্বসম্মতিক্রমে খলিফা নিযুক্ত করবার অধিকার ছিল। যাহোক, স্থির হল আবু মুসা প্রথমে হযরত আলীর পদচ্যুতি সর্বসমক্ষে ঘোষণা করবেন এবং পরে আমর মুয়াবিয়ার পদচ্যুতি ঘোষণা করবেন। প্রস্তাব অনুযায়ী অকপট ও সরলমতি আবু মুসা আমরের ধূর্ততা উপলব্ধি করতে না পেরে জনসমক্ষে ঘোষণা করলেন, “হে জনগণ! আমরা বিষয়টি ভালভাবে অনুধাবন করেছি। হযরত আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কে খিলাফতের দাবি হতে বঞ্চিত করা ছাড়া অন্য কোন পথ দেখি না। সুতরাং, আমি হযরত আলীকে খিলাফত হতে পদচ্যুত করলাম।” এর কিছুক্ষণ পর আমর সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি হযরত আলীর পদচ্যুতি অনুমোদন করলাম এবং তদস্থলে মুয়াবিয়ার মনোনয়ন সমর্থন করলাম।”

দুমাতুল-জন্দলের সালিসী ইসলামের ইতিহাসে একটি দুঃখজনক, অচিন্তনীয় ও ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা। এই ঐতিহাসিক বিচার মজলিসে আমর ও আবু মুসার মধ্যে আপোষ মীমাংসা সম্পর্কিত কি আলোচনা হয়েছিল তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা দুরূহ। বিভিন্ন আরবি সূত্র হতে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করা হয়েছে। সাধারণভাবে গৃহীত মতামত হচ্ছে যে, এই দুই মধ্যস্থতাকারী তাঁদের প্রভুদের উভয়কেই পদচ্যুত করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কিন্তু বয়ঃজ্যেষ্ঠ আবু মুসা হযরত আলীকে পদচ্যুত করবার পর আমর আবু মুসার ঘোষণামত আলীর পদচ্যুতি মেনে নিয়ে তদস্থলে তাঁর প্রভু মুয়াবিয়ার দাবিকে সমর্থন করেন। অপর একটি মতামত হচ্ছে এই যে, আবু মুসা ও আমর উভয়ে উভয়ের প্রভুকে পদচ্যুত করেন এবং এর ফলে হযরত আলী খিলাফত হতে বঞ্চিত হন। দুমাতুল- জন্দলের সালিসী বিচার করলে প্রতীয়মান হবে যে, এর ফলে হযরত আলী শুধু খিলাফত হতেই বঞ্চিত হলেন না বরং তাঁর দল ত্যাগকারী একদল বিদ্রোহী ‘খারিজী’ নাম ধারণ করে গোলযোগের সৃষ্টি করতে থাকে। খারিজীদের অভিমত ছিল যে, কুরআনের বাণীকে শপথ করে সিফফিনের যুদ্ধ স্থগিত করা হয় কিন্তু এর অমোঘ বাণীর উপর ভিত্তি করে দুমাতুল-জন্দলে মীমাংসা করা হয় নি। তারা বলত, “মীমাংসা একমাত্র আল্লাহর হাতে” (লা হুকমাহ ইল্লাহলিল্লাহ)। খারিজী বিদ্রোহ দমন করবার জন্য হযরত আলীকে পরবর্তীকালে নাহরাওয়ানের যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়।

দুমাতুল-জন্দলের রায় বিচার করলে দেখা যাবে যে, এটি ছিল সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ভোজবাজি ও নিকৃষ্টতম শঠতা। এ ঘটনা কিভাবে হযরত আলীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে এবং মুয়াবিয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে তা সমালোচনা করলেই প্রতীয়মান হবে।

প্রথমত, আবু মুসা বয়ঃজ্যেষ্ঠ হলেও আমরের তুলনায় ছিলেন সৎ, সরল, অকপট, নীতি-জ্ঞানসম্পন্ন; অপরদিকে আমর ছিলেন দূর্ত, হঠকারী, বিশ্বাসঘাতক, ফন্দিবাজ ও কপট। এর ফলে আবু মুসা আমরের চক্রান্তের শিকার হন। কারণ, আমরই তার নিকট উভয়কে পদচ্যুত করবার প্রস্তাব দেন এবং বয়ঃজ্যেষ্ঠতার দোহাই দিয়ে আমর আবু মুসাকে প্রথমে এই ঘোষণা করতে বলেন। আবু মুসা প্রথমে ঘোষণা করলে হযরত আলী খিলাফত হতে বঞ্চিত হন।

দ্বিতীয়ত, হযরত আলী আবু মুসাকে তাঁর মধ্যস্থ ব্যক্তি নিযুক্ত করতে দ্বিধা করেন; কারণ, তিনি আবু মুসাকে কুফার শাসনকর্তার পদ হতে রাষ্ট্রের স্বার্থে অপসারণ করেন; এতে আবু মুসা খলিফার উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে হিট্টির মতে, “আবু মুসা- আল-আসারী ছিলেন একজন প্রকৃত ধর্মভীরু কিন্তু আলীর স্বার্থের প্রতি দুর্বল আনুগত্যসম্পন্ন ব্যক্তি।” সৈন্যদের চাপে তিনি তাকে নিযুক্ত করতে বাধ্য হন। অপরদিকে মুয়াবিয়ার সাথে প্রথমদিকে আমরের সম্পর্ক ভাল না থাকলেও নিজ স্বার্থে আলীর সাথে যুদ্ধে জয়লাভে মিসরের শাসনভার অর্পণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সাথে একটি গোপন চুক্তি করেন। হিট্টি আমরকে আরবদের মধ্যে একজন “রাজনৈতিক মেধা বলে অভিহিত করেন।

তৃতীয়ত, আবু মুসা খলিফাকে পদচ্যুত করলে হযরত আলীর মর্যাদাহানি হয় কিন্তু এতে মুয়াবিয়ার শক্তি হ্রাস পায় নি; কারণ, মুয়াবিয়া প্রাদেশিক শাসনকর্তা থাকায় তাঁকে খিলাফত হতে অপসারিত করবার কোন প্রশ্নই আসে না। উপরন্তু, তাঁকে সিরিয়ার শাসনকর্তার পদ হতে বঞ্চিত করা হবে, এরূপ কোন প্রস্তাব অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয় নি। সুতরাং হযরত আলীর পক্ষে দুমার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিল একটি কূটনৈতিক পরাজয়। হিট্টি বলেন, “উভয় মধ্যস্থ ব্যক্তি তাঁদের প্রভুদের পদচ্যুত করলে আলী ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। মুয়াবিয়ার পদচ্যুতির জন্য কোন খিলাফত ছিল না। বস্তুত সালিসী তাঁকে আলীর সমকক্ষ করে তোলে এবং হযরত আলীকে একজন মিথ্যা দাবিদারের পর্যায়ে নামিয়ে ফেলে।” সুতরাং, খলিফা আলীকে একজন অধীনস্থ প্রাদেশিক শাসনকর্তার সাথে খিলাফত ভাগের প্রশ্ন শুধু অবাস্তবই নহে, সম্পূর্ণ অযোক্তিক ও অবৈধ।

চতুর্থত, আমর ও আবু মুসা একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, তাঁরা তাঁদের প্রভুদের পদচ্যুত করবেন এবং পরবর্তী খলিফা মুসলমানদের একটি সাধারণ পরিষদ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন। সুতরাং এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পুনরায় প্রার্থী হতে পারেন না। কিন্তু আমরের ছলচাতুরির ফলে মুসলমানদের একটি সাধারণ পরিষদ কর্তৃক নির্বাচন ছাড়াই খিলাফতে মুয়াবিয়ার কাল্পনিক দাবি প্রতিষ্ঠিত সম্পূর্ণ নীতি-বহির্ভূত।

পঞ্চমত, মুয়াবিয়া হযরত ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ এবং খিলাফত লাভ— এই দুটি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার প্রয়াস পান। এর প্রমাণ পাওয়া যাবে মুয়াবিয়ার সাথে আমরের গোপন চুক্তিতে এবং সিফফিনের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বিফল হওয়ার সম্ভাবনার হঠকারিতার মাধ্যমে যুদ্ধ স্থগিত রাখার মধ্যে।

ষষ্ঠত, ইমামুদ্দিনের মতে, “দুমাতুল-জন্দলে আবু মুসা ও আমরের মধ্যে আলোচনার পর স্থির হয় যে, তাদের সিদ্ধান্ত ছয় মাসের মধ্যে প্রকাশিত হবে। এই সিদ্ধান্তের জন্যই রণক্ষেত্র হত মুয়াবিয়া দামেস্কে এবং খলিফা কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ছিল ‘একটি ভ্রান্তিপূর্ণ চুক্তি’ (A hollow truce)।

স্পষ্টত কুরআনের পাতাগুলো শরবিদ্ধ করে যুদ্ধ ক্ষান্ত করা হয় সত্য কিন্তু দুমাতুল- জন্দলে আল্লাহর কুরআনকে শপথ ও অনুসরণ করে বিরোধ মীমাংসা করা হয় নি। এই কারণে খলিফা আলী (রা) ইসলামের সাথে বিদ্রোহী শাসনকর্তার শঠতা ও কপটতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে এর সিদ্ধান্ত মানতে পারেন নি। তিনি ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খলিফার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তাঁর নৃশংস হত্যার পর মুয়াবিয়া নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করেন। ক্ষমতালোভী না হলে মুয়াবিয়া ৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে মিসর দখল করে চুক্তি মোতাবেক খলিফা আলীর জীবদ্দশায় আমরকে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করতেন না। ইসলামী রাষ্ট্রের স্বার্থ ও সংহতি রক্ষার্থে হযরত আলী (রা) তাঁর অধীনস্থ কর্মচারী মুয়াবিয়ার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে দ্বিধা করেন নি। এতে মুয়াবিয়ার শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।

খারিজী সম্প্রদায় : দুমাতুল-জন্দলে খিলাফতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য আবু মুসা ও আমরের মধ্যে সালিস-মীমাংসা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে ১২ হাজার সৈন্যবিশিষ্ট একটি শক্তিশালী দল হযরত আলীর সৈন্যবাহিনী ত্যাগ (খারিজ) করে হারুরা নামক একটি গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। দলত্যাগী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও গোলযোগ সৃষ্টিকারীরা খলিফার দল হতে খারিজ হয়ে অস্ত্রধারণ করলে তাদেরকে ‘খারিজী সম্প্রদায়’ (The Kharijites) বলা হয়। হারুরায় বসবাস করতে থাকায় তারা হারুরী (Harurites) নামে পরিচিত। তারা ঘোষণা করে যে, “কুরআনকে সাক্ষী করে সিফ্ফিনের যুদ্ধ স্থগিত করা হয় এবং কুরআন ব্যতীত অপর কোন উৎস দ্বারা খিলাফতের সমস্যা সমাধান করা যাবে না। তারা মানুষের বিচার মানতে অস্বীকার করে এবং বলে যে, “আল্লাহর আইন ছাড়া কোন আইন নাই (লা হুকমাহ ইল্লাহ লিল্লাহ)।” খারিজী (Seceders) সম্প্রদায় ইসলামে সর্বপ্রথম ধর্মীয় রাজনৈতিক দল বলে পরিচিত।

মতবাদ : হারুরায় খারিজী সম্প্রদায় সমবেত হয়ে একটি পরিষদ গঠন করে এবং আবদুল্লাহ ইবন-ওয়াহাবের (Abdullah Ibn – Wahab) নেতৃত্বে ৪,০০০ সৈন্য নিয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করে। খারিজিগণ আল্লাহর আদেশ (হুকমাল্লাহ) ব্যতীত অপর কোন বিধান মানতে অস্বীকার করে এবং এ কারণে তারা হযরত আবুবকর এবং হযরত ওমরকে কেবল আইনগত খলিফা বলে স্বীকার করে এবং অপর সকলকে বলপূর্বক খিলাফত দখলকারী বলে অভিহিত করে। হযরত ওসমান ও হযরত আলী ইসলামের শত্রুদের সাথে আপোষ-মীমাংসার চেষ্টা করেন। সেজন্য খারিজীরা তাদের বিরোধিতা করে। তারা উমাইয়াদের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং আব্বাসীয়দেরও তারা সমর্থন করে নি। খারিজীদের মতে, সর্বজনীন ভোটের মাধ্যমে গোত্র ও বংশ নির্বিশেষে মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধানকে নির্বাচন করতে হবে। তারা বলে যে, যে-কোন যোগ্য ও চরিত্রবান ব্যক্তিরই খলিফা হবার অধিকার আছে; এমনকি একজন নিগ্রোও খলিফা হতে পারেন। সুতরাং, কেবল কুরাইশ বংশসম্ভূত ব্যক্তিগণই খলিফা হবার অধিকারী হবে-একথা তারা অস্বীকার করে। উগ্রপন্থী খারিজিগণের মহিলা খলিফা নির্বাচনেও কোন আপত্তি ছিল না।

খারিজী সম্প্রদায় ‘শুদ্ধচারী’ (Puritans) নামে খ্যাতি অর্জন করে। তাদের ধর্মীয় মতবাদ অপরাপর ধর্মীয় রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের তুলনায় ছিল ভিন্নতর। পার্থিব সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য তারা পছন্দ করত না এবং আবুজর আল-গিফারীর সমাজতান্ত্রিক মতবাদে তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। ইসলামের সামাজিক ও রাজনৈতিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করবার জন্য তারা ধর্মের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। তাদের মতে, যদি কোন মুসলমান “কবিরা’ গোনাহ করে তবে সে কাফের হয়ে যাবে। এমনকি যে সমস্ত মুসলমান ইসলামের পাঁচটি অবশ্য কর্তব্য— ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত পালন না করে তারাও কাফের বলে গণ্য হবে। পৃথিবীতে তারা আল্লাহর রাজত্ব কায়েম করবার চেষ্টা করে এবং প্রয়োজন হলে তারা জেহাদ ঘোষণা করে আল্লাহর রাজত্ব (Theocracy) প্রতিষ্ঠা করবার প্রয়াস পায়। এই কারণে শাহারাস্তানী ১২,০০০ দলত্যাগী সৈন্যদের ‘রোজা ও নামাজ আদায়কারী দল’ (People of fasting and prayer) বলে অভিহিত করেন। ওয়েলহাউসেন বলেন, “খারিজী সম্পদ্রায় মুসলিম ধর্মতত্ত্বের ক্রমবিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।” প্রকৃত অর্থে তারা সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ছিল। খোদাবক্সের ভাষায়, “খারিজিগণ ইসলামের এমন একটি শুদ্ধাচারী ও চরমপন্থী দল যারা ধর্মে গোঁড়া এবং রাজনীতিতে গণতন্ত্রমনা ছিল।”

(গ) নাহরাওয়ানের যুদ্ধ (৬৫৯ খ্রি.)

হযরত আলীর দলত্যাগ করে খারিজিগণ ব্যাপক অপপ্রচার এবং বিক্ষোভ শুরু করে। ইরাক ও ইরানে তারা জটিল পরিস্থিতির সূচনা করে আবদুল্লাহ ইবন-ওয়াহাবের নেতৃত্বে বাগদাদের নিকটবর্তী নাহরাওয়ানে সমবেত হয়। তারা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করলে খলিফা আলী মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে সিরিয়ায় প্রেরিত সৈন্য-বাহিনীকে খারিজীদের ধ্বংস করবার উদ্দেশ্যে নাহরাওয়ানে প্রেরণ করেন। ৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে খলিফা আলী (রা) তাদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। কিছু সংখ্যক খারিজী অনুতপ্ত হয়ে খলিফা আলীর পক্ষে যোগদান করেন সত্য কিন্তু এতে তাঁর শক্তি বৃদ্ধি হয় নি। অপরদিকে খারিজীরা বাহরাইন, আল-আহসা প্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং এভাবে সমগ্র মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার বিরুদ্ধাচরণ করে। উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খিলাফতে খারিজী বিদ্রোহ খুবই সচরাচর ঘটনা ছিল। হযরত আলী খারিজীদের দমন করে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হতে চাইলে সৈন্যগণ পূর্বপ্রস্তুতি না থাকার অজুহাতে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। এর ফলে বাধ্য হয়ে খলিফা আলী সৈন্যদল নিয়ে কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন।

মুয়াবিয়ার ক্ষমতালাভ

মুয়াবিয়া সিফফিন যুদ্ধের পরেই নিজেকে আমীরুল মুমেনীন বলে ঘোষণা না করলেও ধীরে ধীরে ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকেন। বিদ্রোহীদের দমন না করায় মিসরের গভর্নর কায়েসকে পদচ্যুত করে হযরত আলী মুহাম্মদ বিন আবুবকরকে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। মিসরের শাসনব্যবস্থার পুনর্গঠনে মুহাম্মদ বিন আবুবকর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এতে মিসরবাসী বিদ্রোহী হয়ে উঠে। এ সুযোগে মিসর দখলের পরিকল্পনা করে মুয়াবিয়া আমরকে প্রলোভন দেখিয়ে মিসরে অভিযানে প্রেরণ করেন। খলিফা আল-আসতারকে মুহাম্মদের সাহায্যে প্রেরণ করলে পথিমধ্যে তিনি দুর্বৃত্তের হস্তে নিহত হন। আমর মুহাম্মদকে পরাজিত করে মিসর দখল করলে মুয়াবিয়ার রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করে এবং তার ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। মুয়াবিয়ার মক্কা ও মদিনা দখলের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে খলিফা আলী সমগ্র আরব ভূখণ্ডে ও ইরাকে তাঁর প্রভুত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হন। ইসলামী রাষ্ট্রে বিরাজমান বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। মুয়াবিয়ার খিলাফত দাবি, খারিজীদের বিদ্রোহ, মুহাম্মদের মৃত্যু এবং রাষ্ট্র হতে মিসরের বিচ্ছিন্নতা প্রভৃতি আলীকে বিচলিত করে তোলে। বসরার শাসনকর্তা খলিফার সঙ্গে পরামর্শ করতে গেলে বসরাবাসী বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইবন আব্বাসের সহকারী রিয়াদ এই বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করেন। অনুরূপ অসন্তোষ, অরাজকতা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এর পর আহওয়াজ ও কিরমানে বিদ্রোহ দেখা দিলে খলিফা সেই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন।

হযরত আলীর শাহদাতবরণ (৬৬১ খ্রি.)

রাষ্ট্রের সর্বত্র বিদ্রোহ, অসন্তোষ, বিক্ষোভ ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়লে হযরত আলী প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাহীন হতে থাকেন। ৬৬০ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়া বুসর-বিন-আবি- আবতাত-এর নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্য মক্কা, মদিনা ও ইয়েমেন প্রেরণ করলে খলিফা আলী তা প্রতিহত করতে সক্ষম হন। কিন্তু অশান্তি ও অরাজকতা বন্ধের অভিপ্রায়ে হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হয়। এই সন্ধির শর্ত অনুযাযী বিশাল ইসলামী রাষ্ট্র দুটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে- মুয়াবিয়া সিরিয়া ও মিসরের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হন এবং অবশিষ্টাংশে আলীর খিলাফত অব্যাহত থাকে। এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, মুয়াবিয়া খলিফা আলীর হত্যার পূর্বে খলিফা উপাধি ধারণ করেন নি, যদিও ইমামুদ্দিন ও রেজাই করীম তাঁদের পুস্তকে এর উল্লেখ করেন। মুহাম্মদ আলীর মতে, “৪০ হিজরীতে হযরত আলীর মৃত্যুর পূর্বে মুয়াবিয়া যে আমীর-উল-মুমেনীন উপাধি ধারণ করেন নি তা স্বীকার করতে হবে।” মুয়াবিয়াকে ‘আমীর’ বা নেতা বলা হয়েছে-খলিফা উপাধিতে তখন তাঁকে ভূষিত করা হয় নি।

ইসলামে সর্বপ্রথম বিচ্ছিন্নতাবাদী খারিজী সম্প্রদায় ইসলামের ঐক্য, সংহতি ও আদর্শকে অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, মুসলিম সমাজের শত্রু হযরত আলী, আমীর মুয়াবিয়া ও আমর ইবন-আল-আসকে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে হত্যা করা হবে এবং আবদুর রহমান ইবনে মুলজাম, বারেক ইবনে আবদুল্লাহ ও আমরু ইবনে আস নামক তিনজন খারিজী হজ্বের সময়ে কা’বাগৃহে উপস্থিত হয়ে প্রতিজ্ঞা করে যে, পরবর্তী ১৫ই রমজান শুক্রবার তারা যথাক্রমে আলী, মুয়াবিয়া ও আমর ইবন-আল- আসকে হত্যা করে ইসলাম জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। সৌভাগ্যক্রমে আমর নির্দিষ্ট দিনে মসজিদে উপস্থিত হন নি; মুয়াবিয়া সামান্য আহত হলেও রক্ষা পেলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত খলিফা আলী আবদুর রহমান ইবন-মুলজামের বিষাক্ত ছুরির অব্যর্থ আঘাতে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে জানুয়ারি শাহাদাত বরণ করেন। হযরত আলীর মৃত্যুতে খোলাফায়ে রাশেদূনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

হযরত আলীর ব্যর্থতা ও মুয়াবিয়ার সাফল্যের কারণ

ভনক্রেমার বলেন, “যদি খলিফা আলী এবং মুয়াবিয়ার মধ্যে কোন সংঘর্ষ না বাধত এবং ইসলামের পরবর্তী যুগ গোলযোগবিহীন হত তা হলে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ আরও সুখময় এবং অধিকতর সাফল্যমণ্ডিত হত।” খলিফা আলী ও প্রাদেশিক শাসনকর্তা মুয়াবিয়ার মধ্যে যে সংঘর্ষ হয় তার ফলেই ইসলামের ইতিহাসে একটি বিষাদপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়। সুসংঘবদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয়ে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক অঞ্চলে বিভক্ত হয়। ইসলামের মৌলিক ও অকৃত্রিম আদর্শগুলো- সাম্যবাদ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ধ্বংস হয়; ব্যক্তিস্বার্থ রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান পায়; নতুন রাজনৈতিক ধর্মীয় গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। শিয়া ও খারিজী সম্প্রদায় কর্তৃক খোলাফায়ে রাশেদূনের পরিবর্তে আরব দেশে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বনু হাশেমের প্রভুত্ব লোপ পেয়ে উমাইয়া প্রাধান্য কায়েম করা হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সংঘর্ষে খলিফার ব্যর্থতা এবং মুয়াবিয়ার সাফল্যের বিভিন্ন কারণ ছিল।

প্রথমত, হযরত আলীর খিলাফতের ব্যর্থতার জন্য খলিফা আলী স্বয়ং কতটুকু দায়ী তা ঐতিহাসিক পর্যালোচনা দ্বারা নির্ধারণ করা সম্ভবপর। একথাও সত্য হতে পারে যে, ব্যক্তিগত দুর্বলতার জন্য হলেও হযরত ওসমানের খিলাফত প্রতিকূল পরিস্থিতির দরুন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে তার জের হযরত আলীর খিলাফতে চলতে থাকে। সৈয়দ আমীর আলীর ভাষায়, “হযরত ওমর দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা আরবজাতিকে সংঘবদ্ধ করত, সাহায্য করত এবং ইসলামের ধ্বংসকারী ভয়াবহ গৃহযুদ্ধগুলোকে ব্যাহত করত।”

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজস্ব-ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস হযরত আলী, হযরত ওমরকে অনুসরণ করেন; কারণ, বিশুদ্ধ আরব জাতীয়তাবাদী নীতির পরিপূরক হিসেবে হযরত ওমর যে ধরনের রাজস্ব-ব্যবস্থা প্রচলন করেন তা আরব ঐক্য ও সংহতি বজায় রেখেছিল। কিন্তু হযরত ওসমানের খিলাফতে জায়গীরদার প্রথার উদ্ভব হয় এবং এর সাথে শ্রেণী-বৈষম্য, বিলাস-বাসন, আড়ম্বর ও জাঁকজমক, অমিতব্যয়িতা, পুঁজিপতি ও স্বৈরাচারী শ্রেণীর সৃষ্টি করে। হযরত ওমর কর্তৃক নিযুক্ত হলেও মুয়াবিয়া বিশ বছর প্রাদেশিক শাসনকর্তারূপে সিরিয়ায় স্বীয় প্রভাব ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে উমাইয়া বংশীয়দের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। হযরত ওসমানের তীব্র সমালোচক হিসেবে হযরত আলী চিহ্নিত হন এবং এই কারণে ভূ-সম্পত্তি সরকারকে প্রত্যর্পণ করতে মুয়াবিয়া অস্বীকার করেন।

তৃতীয়ত, হযরত আলী যে সময় খিলাফত লাভ করেন তা ইসলামের ইতিহাসের একটি সংকটময় যুগ। রক্তপাতের সূচনাতেই তিনি খিলাফতে অধিষ্ঠিত হন এবং রক্তপাতেই এর অবসান হয়। হযরত ওসমানের হত্যার প্রতিশোধকে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিতে (Political ruse) রূপান্তরিত করে বিদ্রোহীগণ যে জটিল ও ভীতিপ্রদ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তা হযরত আলীর পক্ষে বিবিধ কারণে দমন করা সম্ভভপর হয় নি। উল্লেখযোগ্য যে, তিনি বিদ্রোহী নেতা ইবনে-সাবার সমর্থনে খিলাফত লাভ করেন। অবশ্য পরে মুসলিম জনগণ তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেন। মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেন যে, রাজধানী (মদিনা) বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ থাকায় অবাধ নির্বাচন করা সম্ভবপর হয় নি এবং তালহা, যুবাইর অথবা মুয়াবিয়া আলীর নির্বাচনের বিরোধিতা করেন নি। পরবর্তীকালে এই তিন ব্যক্তি খলিফা হত্যার প্রতিশোধকে কেন্দ্র করে হযরত আলীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে দ্বিধা করেন নি। বিবেকহীন, নীতিজ্ঞানশূন্য, স্বার্থান্বেষী তালহা, যুবাইর ও মুয়াবিয়া বিশ্বাসঘাতকতা ও বর্বরতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ইসলামকে তথা খলিফা আলীর জীবনকে বিপন্ন করেন।

চতুর্থত, উষ্ট্রের যুদ্ধে সর্বপ্রথম একটি মুসলিম বাহিনী অপর একটি বিদ্রোহী মুসলিম সৈন্যদলকে আক্রমণ করে রক্তাক্ত সংঘর্ষের সূচনা করে। এই অভাবনীয় ঘটনায় হযরত আলীর সাথে রাসূলে করীমের দুজন ঘনিষ্ঠ সাহাবী তালহা ও যুবাইর এবং মহানবীর পত্নী ও প্রথম খলিফা হযরত আবুবকরের দুহিতা বিবি আয়েশার মধ্যে অনাবশ্যক তিক্ততার সৃষ্টি হয়। উপরন্তু, সন্ধি স্থাপিত হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবার পর বিদ্রোহীদের দ্বারা তালহা এবং যুবাইর নিহত হলে খলিফার শক্তি হ্রাস প্রায় এবং মুয়াবিয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তালহা ও যুবাইর নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন এবং তাঁরা জীবিত থাকলে নিশ্চয়ই তাঁদের বিচক্ষণতা, অকৃত্রিম বন্ধুত্ব ও সহৃদয়তায় হযরত আলী বিপদে কখনই বিহ্বল হতেন না। উপরন্তু, বিবি আয়েশা উষ্ট্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে খলিফা তাঁর প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করে তাঁকে মদিনায় প্রেরণ করেন। কিন্তু এই ঘটনার পর মক্কা ও মদিনায় ধর্মভীরু গোষ্ঠী খলিফাকে সাহায্য ও সহানুভূতি প্রদর্শন করেন নি।

পঞ্চমত, হযরত আলী শৌর্য ও বীর্যের জন্য ‘আসাদুল্লাহ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর সিংহ’ উপাধি লাভ করেন সত্য কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার চাপে তিনি মুয়াবিয়ার মত চক্রান্তকারী, কপট ও ধূর্ত শাসকের সঙ্গে কূটনীতি, রাজনীতি ও সমরনীতিতে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেন নি। একথা অনস্বীকার্য যে, যোদ্ধা ও বিদ্বান হিসেবে হযরত আলী মুয়াবিয়া অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু মূইরের ভাষায়, “আলী অপেক্ষা মুয়াবিয়ার কর্তৃত্ব অধিকতর দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। মনোভাব কঠিন ও প্রত্যয়পূর্ণ এবং প্রকৃত অবস্থা অধিকতর স্থির ও সংহত।” মুয়াবিয়ার ক্ষমতার উৎস ছিল সিরিয়াবাসী জনগণ এবং এদের আনুগত্য ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে তাঁর পক্ষে উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর হয়। মুয়াবিয়ার শক্তি বৃদ্ধিতেও খলিফা কোনরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। এমনকি মুয়াবিয়া পদত্যাগ করতে অস্বীকার করলেও তৎক্ষণাৎ কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি।

ষষ্ঠত, মদিনা হতে রাজধানী কুফায় স্থানান্তরিত করে খলিফা আলী অদূরদর্শিতার পরিচয় দেন। এর ফলে একদিকে তিনি যেমন মৌলিক ইসলামী আদর্শের কেন্দ্র মক্কা ও মদিনার কুরাইশ বংশের আস্থা হারান, অপরদিকে তেমনি কুরাইশ আভিজাত্য ও প্রাধান্যে ঈর্ষান্বিত কুফাবাসীদের তিনি সাহায্য ও সমর্থন লাভ করতে পারেন নি। আরব ভূখণ্ড হতে অনারব ভূখণ্ডে রাজধানী স্থানান্তরিত করলে অনৈসলামিক প্রভাব প্রকট আকারে দেখা দেয় এবং মুয়াবিয়ার প্রাদেশিক রাজধানী দামেস্কের সাথে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।

সপ্তমত, হযরত আলী ছিলেন সরল এবং অকপট। তিনি মুয়াবিয়া এবং কুফাবাসীদের ধূর্ততা, শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে সহজে বিশ্বাস করেন নি। মুয়াবিয়ার সিরিয়াবাসী সমর্থকগণ ছিল তাঁর একান্ত অনুগত ভক্ত ও বিশ্বাসী। অপরদিকে যে উদ্দেশ্যে খলিফা কুফার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন তাঁর সে উদ্দেশ্য সফল হয় নি। এর প্রধান কারণ তিনি অস্থিরমতি, অশান্তচিত্ত ও আবেগপ্রবণ কুফাবাসীদের নিকট হতে আশানুরূপ সাহায্য-সহানুভূতি লাভ করতে পারেন নি। মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিরোধ গঠনে অনিচ্ছা, সিফফিনের যুদ্ধে আকস্মিকভাবে যুদ্ধ স্থগিত, খারিজী আন্দোলন, মুহাম্মদ-বিন-আবুবকরের সাহায্যে মিসর গমনে অনীহা প্রভৃতি কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতারই পরিচায়ক। পরবর্তীকালে কারবালার প্রান্তরে কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাকতায় ইমাম হুসাইন শাহাদত বরণ করেন। “তারা (কুফাবাসীরা) দিন হতে দিনান্তরে (রাত) নিজেদের অন্তরের সন্ধান রাখত না। কোন ব্যক্তিবিশেষ অথবা উদ্দেশ্যের সমর্থনে তারা এক মুহূর্তে জ্বলন্ত অগ্নিবৎ উত্তেজিত হয়ে উঠত, আবার পরক্ষণেই বরফের মত শীতল ও মৃত ব্যক্তির ন্যায় নিস্পৃহ হয়ে পড়ত।”

অষ্টমত, হযরত আলীর সমর্থকদের অপেক্ষা মুয়াবিয়ার সমর্থকদের অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা, বিচক্ষণতা, ধূর্ততা ও কপটতা অধিক ছিল। হযরত আলীর যোদ্ধা ও শাসক আবু মুসা-আল-আসয়ারী, ইব্রাহিম আল-আসতার এবং মুহাম্মদ ইবন-আবুবকরের তুলনায় মুয়াবিয়ার পক্ষের অনুগামী আমর ইবন-আল-আস, মুগীরা ইবন-সাবা এবং জিয়াদ ইবন-আবিহ অনেক শ্রেষ্ঠ ছিলেন। হিট্টি আমরকে ‘আরব কূটনৈতিক মেধা’ বলে অভিহিত করেন। অপরদিকে তিনি বলেন যে, আলীর প্রতি আবু মুসা-আল- আসয়ারীর পূর্ণ আনুগত্য ও সমর্থন ছিল না। অবশ্য একথা সত্য যে, তাঁকে কুফার শাসনকর্তার পদ হতে অপসারণ করা হলেও দুমার মীমাংসা বৈঠকে তিনি হযরত আলীর প্রতিনিধি নিযুক্ত হন।

নবমত, সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলীর জয় পরাজয়েরই নামান্তর ছিল। কারণ যুদ্ধ জয়ের পূর্ব মুহূর্তে মুয়াবিয়ার সৈন্যদল বর্শাগ্রে কুরআনের পবিত্র পাতা বিদ্ধ করে যুদ্ধ স্থগিতের আকূল আবেদন জানায়। এই দূর্ত, শঠতাপূর্ণ, দুরভিসন্ধিমূলক ও অবাঞ্ছিত পন্থার উদ্ভাবক ছিলেন কপট আমর-বিন-আল-আস। হযরত আলী এটিকে একটি ফন্দিবাজি চক্রান্ত (hoax) বুঝতে পেরেও রক্তপাত বন্ধের জন্য যুদ্ধে ক্ষান্ত দিলেন। এতে তাঁর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, “কথিত আছে যে, হযরত আলী সংঘর্ষ বন্ধের পক্ষপাতী ছিলেন না এবং তাঁর যোদ্ধাদের বলেন যে, এটি মুয়াবিয়ার একটি ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নহে।”

দশমত, মূইর বলেন, “সমঝোতা এবং দীর্ঘসূত্রতা তাঁর পতনের অনিবার্য কারণ হয়ে দাঁড়ায়।” কর্নেল ওসবর্নের মতে, “খলিফা ওমরের মত কঠোর প্রকৃতির লোক হলে হযরত আলী (রা) অনায়াসে দুর্ধর্ষ ও শৃঙ্খলাহীন আরবদিগকে সার্থকভাবে শাসন করতে সমর্থ হতেন। তাঁর সহনশীলতা, মহানুভবতা এবং মানবতাবোধ এবং সত্যের প্রতি অনুরাগই শত্রুপক্ষকে সুযোগ দান করে। বিদ্রোহ দমনে ও হযরত ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণকারীদের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বনে অপরাগতা, মুয়াবিয়া কর্তৃক চিঠিবিহীন খাম প্রেরণের দ্বারা খলিফার অবমাননা এবং পদত্যাগ করতে অস্বীকার করায় তাঁর বিরুদ্ধে চরম পন্থা গ্রহণে তিনি যে দীর্ঘসূত্রতা প্রদর্শন করেন তাতে হযরত আলীর শত্রুপক্ষের শক্তি বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে বিদ্রোহী তালহা ও যুবাইরের সঙ্গে সন্ধি-চুক্তি, দুমার মীমাংসা বৈঠকে যোগদান ও এর শর্ত গ্রহণ এবং পরিশেষে মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি- চুক্তি সম্পাদন তাঁর সমঝোতা ও দুর্বলতাকে প্রমাণ করে।”

একাদশত, হযরত আলী খিলাফত লাভ করে প্রশাসনিক রদবদলপূর্ব রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার নিশ্চয়তা বিধানের চেষ্টা করেন। তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের পদচ্যুত করে নতুন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। কিন্তু ইবন আব্বাস, মুগীরা এমনকি স্বীয় পুত্র ঈমাম হাসানের পরামর্শ সত্ত্বেও হযরত আলী সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়াকে পদচ্যুত করে মারাত্মক ভুল করেন। হযরত ওমরের খিলাফত হতে সিরিয়ায় শাসনকার্য পরিচালনা করে মুয়াবিয়া অসীম প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হন। হযরত আলী তাঁর অধীনস্থ কর্মচারী মুয়াবিয়ার মত কূটনীতিবিদ এবং যুদ্ধ-কৌশলে পারদর্শী ছিলেন না। খলিফা যদি মুয়াবিয়াকে পদত্যাগের আদেশ দিয়ে শত্রু শিবিরে ঠেলে না দিয়ে নিজ স্বার্থে তার সহযোগিতা কামনা করতেন তা হলে খোলাফায়ে রাশেদূন সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হত না এবং খলিফার জীবনও বিপন্ন হত না। এ প্রসঙ্গে মূইর বলেন, “হযরত ওসমানের ঘাতকের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ক্রোধোন্মত্ত সিরীয়দিগকে ব্যবহার করে আরব গোষ্ঠীসমূহের বিদ্রোহ নির্মূল করলেই তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিতেন কিন্তু তৎপরিবর্তে সরল পথ ধরে তিনি যে রাজনৈতিক ভুল করেন তার মাসুলস্বরূপ তাঁর খিলাফত ও নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়।”

দ্বাদশত, হযরত আলীর খিলাফতের ব্যর্থতার মূলে আরও কতকগুলো কারণ ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি তাঁর আত্মীয়দিগকে ইয়েমেন, মক্কা এবং মদিনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তাঁর চাচাত ভাই আবদুল্লাহ বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। বসরা হতে আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে হযরত আলী আবদুল্লাহকে কারণ দর্শাতে বলেন। এতে তিনি রাগান্বিত হয়ে কোষাগার হতে অর্থ নিয়ে মক্কায় চলে যান। এই সময় তাঁর ভ্রাতা আকীলও মুয়াবিয়ার সাথে যোগদান করেন। খারিজী আন্দোলন হযরত আলীকে খুবই বিচলিত করে। কারণ এর ফলে ইসলামের দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক ধর্মীয় দলের সৃষ্টি হয়- শিয়া ও খারিজী সম্প্রদায়। খারিজী গোলযোগ মিসরে সম্প্রসারিত হলে মিসরের শাসনকর্তা কায়েস পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেন নি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে খলিফা আলী তাঁকে অপসারণ করেন এবং তাঁর স্থলে আবুবকরের পুত্র মুহাম্মদ শাসনকর্তা নিযুক্ত হলে মুয়াবিয়া আমরের সহায়তায় মিসরে তার প্রভুত্ব কায়েম করতে সক্ষম হন। কায়েসের অপসারণে এবং মুয়াবিয়ার প্রাধান্য মিসরে বিস্তৃতি লাভ করায় খলিফার ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। মিসর হতে বঞ্চিত হলে খলিফার আধিপত্য সঙ্কুচিত হয়ে ইরাক ও আরব-ভূখণ্ডে সীমিত হয়ে পড়ে। অপরদিকে হযরত ওসমানের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধের দাবিতে যারা বিদ্রোহ করে তাদের অনেকেই হযরত আলীর সৈন্যদলভুক্ত হলে মুয়াবিয়া খলিফার পক্ষপাতিত্ব ও নিষ্ক্রিয় নীতির জন্য তাঁকে দোষারোপ করেন। সুহরাবিল-বিন-সিমত- আল-কিনদি সমগ্র সিরিয়ায় উমাইয়া আধিপত্য বিস্তারের এবং হযরত আলীর জনপ্রিয়তা হ্রাসের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বসরা, পারস্য ও মিসরের বিদ্রোহ খিলাফতকে বিপন্ন করে তোলে। বনু হাশেম ও বনু উমাইয়াদের দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ প্রকট আকার ধারণ করে। দুর্ভাগ্যক্রমে কেবল উমাইয়াগণই মুয়াবিয়াকে সমর্থন করেন নি, খলিফার অদূরদর্শিতা, অরাজনৈতিকসুলভ মনোভাব ও শান্তিপ্রিয়তার জন্য তাঁর নিকট-আত্মীয় এমনকি হযরত আবুবকর ও হযরত ওমরের পুত্রগণও তাঁকে সমর্থন করেন নি। হযরত ওসমানের ঘাতকদের চক্রান্ত ও ইবনে-সা’বার অনুসারীদের কূটকৌশল হযরত আলীর খিলাফতকে ব্যর্থতার পর্যবসিত করে। জোসেফ হেল সত্যই বলেন, “মুয়াবিয়ার সঙ্গে প্রাচীন আরব স্পৃহা ও আদর্শ বস্তুত মক্কার আদর্শ জয়লাভ করে এবং সমগ্র ইসলামের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে।” এরূপ সংকটময় পরিস্থিতিতে মুয়াবিয়ার সঙ্গে হযরত আলী সন্ধি-চুক্তি স্বাক্ষরিত করতে বাধ্য হন এবং সার্বভৌমত্বের বিভক্তিতে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অবসান হয়ে রাজতন্ত্রের সূচনা করে।

হযরত আলীর চরিত্র এবং কৃতিত্ব

খোলাফায়ে রাশেদূনের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী-বিন-আবু তালেব মাসুদীর বর্ণনানুসারে, রক্তিম বর্ণবিশিষ্ট, দীর্ঘশ্মশ্রু, নাতিদীর্ঘ ও দৃঢ়কায়, কোমল, কপোতাভ চক্ষুবিশিষ্ট, ঘন ভ্রূ, উজ্জ্বল টাকবিশিষ্ট মধ্যম আকৃতির দেহের অধিকারী ছিলেন।

হযরত আলীর জীবনযাপন প্রণালী ছিল সরল ও অনাড়ম্বর। সরলতা ও আত্মত্যাগের মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। মুসলিম জাহানের খলিফা হয়েও তিনি স্বহস্তে কাজ করতেন। তাঁর পত্নী বিবি ফাতেমাকেও স্বহস্তে কাজ করতে হত। দাসদাসী তাঁর গৃহে কোনদিই ছিল না। তিনি মাত্র দশ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ইসলামে দীক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর স্থান বিবি খাদিজার পরেই। ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশে ইয়েমেনে গমন করেন এবং সেখানে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেন। বিধর্মীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রায় সমস্ত যুদ্ধে হযরত আলী অংশগ্রহণ করেন। প্রতিটি যুদ্ধে তিনি অসীম বীরত্ব ও অপূর্ব রণ-কৌশল প্রদর্শন করেন। মহানবী তাঁর শৌর্য-বীর্যে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘আসাদুল্লাহ’ (আল্লাহর সিংহ) উপাধিতে ভূষিত করেন। একক যুদ্ধে (Single combat) তিনি বহু শত্রুকে ধরাশায়ী ও নিহত করেন। তাঁর দৈহিক বল ও যুদ্ধস্পৃহা ছিল অপরিসীম। কথিত আছে, খাইবার যুদ্ধে সুরক্ষিত আল-কামুস দুর্গের লৌহদ্বার তিনি এক ধাক্কায় উৎপাটিত করেন এবং সেই কপাট পরে সংযোজিত করতে ৭০ জন যুবকের প্রয়োজন হয়েছিল। হুনাইনের যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন কিন্তু তাবুক অভিযানে মহানবী (স) তাঁকে মদিনায় অবস্থান করতে নির্দেশ দিলে তিনি অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। এতে রাসূলে করীম বলেন, “হারুনের সাথে মুসার যেমন সম্পর্ক ঠিক তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক, শুধু পার্থক্য এই যে, আমার পরে কোন নবী নেই।” তিনি শুধু মহানবীর জামাতা ও চাচাত ভাই হিসেবেই পরিচিত নহেন, তিনি ছিলেন রাসূলের অন্তরঙ্গ সুহৃদ, বিশ্বস্ত সঙ্গী, অনুগত সহচর। নিজের জীবনকে বিপন্ন করে তিনি রাসূলের মদিনায় হিজরত করবার সময় তাঁর শয্যায় শায়িত হয়ে ক্ষিপ্ত কুরাইশদের হুমকির মোকাবিলা করেন। তিনি শান্ত, পরোপকারী, ন্যায় ও সত্যের প্রতীক ছিলেন। ওসবর্ন বলেন, “সর্বকালের মুসলমানদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মবিশিষ্ট মুসলমান। “

হযরত আলী অসাধারণ পাণ্ডিত্য, স্মৃতি-শক্তি, জ্ঞান-গরিমার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। হিট্টি বলেন, “যুদ্ধে সাহসী, পরামর্শদানে বিজ্ঞ, বক্তৃতায় স্বচ্ছ-সাবলীল, বন্ধুদের প্রতি অকপট এবং শত্রুদের প্রতি দয়াশীল ছিলেন। আলী মাহাত্ম ও শৌর্য-বীর্যের নিদর্শনস্বরূপ ছিলেন।” তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, বৈয়াকরণ ও ন্যায়শাস্ত্রবিদ। কুরআন, হাদিস, দর্শন, আইনশাস্ত্র প্রভৃতিতে তিনি প্রগাঢ় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। সুষ্ঠু জ্ঞানের অধিকারী হযরত আলী (রা) কুরআন শরীফ লিপিবদ্ধ করে তার ব্যাখ্যা দান করে অক্ষয় কীর্তি অর্জন করেন। হাদিস সংগ্রহকারী হিসেবেও তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দীওয়ানে আলী’ আরবি সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। তাঁরই তত্ত্বাবধানে আবুল আসওয়াদ সর্বপ্রথম আরবি ব্যাকরণ সংকলন করেন। এ সমস্ত কারণে রাসূলে করীম (স) বলেন, “আমি জ্ঞানের নগরী ও আলী তার দ্বারস্বরূপ।” হযরত আলীর গুণাবলি মুগ্ধ হয়ে মাসুদীও বলেন, “আল্লাহ তাঁকে যে গুণাবলি দ্বারা ভূষিত করেন তা তাঁরা পূর্ববর্তী (একমাত্র রাসূলে করীম ব্যতীত) ও পরবর্তী অন্য কারও মধ্যে আমরা খুঁজে পাব না।”

হযরত আলী যোদ্ধা হিসেবে নির্মম হলেও মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন দয়ালু, সহিষ্ণু, পরোপকারী ও আত্মভোলা। কুসুমের মত কোমল হৃদয়ের অধিকারী খলিফা আলী (রা) শত্রুদের ক্ষমা করে নিজের দুর্ভাগ্যকে ত্বরান্বিত করেন। তাঁর চারিত্রিক সরলতা ও সহিষ্ণুতার সুযোগ নিয়ে তাঁর শত্রুরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেও তিনি কঠোর ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন না। তাঁর ক্ষমাশীলতা তাঁর দুর্বলতার সমকক্ষ ছিল (Forbearing to the verge of weakness)। সৈয়দ আমীর আলী বলেন, “তাঁর চরিত্রে যদি হযরত ওমরের কঠোরতা থাকত তবে তিনি আরবদের মত দুর্দান্ত জাতিকে আরও সাফল্যের সাথে শাসন করতে সমর্থ হতেন; কিন্তু তাঁর ক্ষমাশীলতা ও উদারতাকে ভুল বুঝা হল এবং তাঁর সদাশয়তা ও সত্যপ্রিয়তাকে শত্রুগণ নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করল।” হযরত আলীর মৃত্যুতে আল্লাহ ও রাসূলের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত (Patriarchal epoch) ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পরিসমাপ্তি ঘটে। মূইর বলেন, “তাঁর উচ্চক্ষমতা, স্পৃহা এবং সংকল্প দ্বারা তিনি বিচ্ছিন্ন তাকে দূর করতে পারতেন, যা কোন এক সময়ে ইসলামের অস্তিত্বের প্রতি আঘাত হানে এবং পরবর্তীকালে একে শক্তিশালী করতে থাকে।”

ইমাম হাসান (৬৬১–৬৬৯ খ্রি)

হযরত আলীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইমাম হাসান কুফাবাসীদের দ্বারা খলিফা নির্বাচিত হন। পিতার আওতাভুক্ত অঞ্চলে খলিফা নির্বাচিত হলে মক্কা ও মদিনার অধিবাসিগণ তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। অপরদিকে সিরিয়া ও মিসরের অধিপতি মুয়াবিয়ার সাথে বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। ধূর্ত, কপট, উচ্চাভিলাসী ও ষড়যন্ত্রকারী মুয়াবিয়া যে চক্রান্তের বশে খলিফা আলীকে সমস্ত মুসলিম জাহানের আধিপত্য হতে বঞ্চিত করেন ঠিক সেই একই উপায়ে তিনি কোমলমতি, সদাশয়, দুর্বলচিত্ত ইমাম হাসানকেও খিলাফত হতে বঞ্চিত করবার অসৎ পরিকল্পনা করতে থাকেন।

খলিফা আলীর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারী ইমাম হাসানের বিরুদ্ধে কালবিলম্ব না করে মুয়াবিয়া রাজধানী কুফায় একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। ইমাম হাসান পিতার নিকট হতে ৪০,০০০ সুশৃঙ্খল সৈন্য পেলেও তিনি সামরিক বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন না। মুয়াবিয়ার সিরীয় বাহিনীর গতিরোধের জন্য সেনাপতি কায়েসের নেতৃত্বে ১২,০০০ সৈন্যসহ একটি বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন এবং প্রধান সৈন্যদলসহ তিনি মা’দাইনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কায়েস বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে শত্রুপক্ষের অনেককে হতাহত করেন। এমন সময় ধূর্ত মুয়াবিয়া কপটতার আশ্রয় নিয়ে গুজব ছড়ায় যে, কায়েস যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত ও নিহত হয়েছেন। এর ফলে কুফার সৈন্যদলের মনোবল ভেঙ্গে গিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ইমাম হাসানের সৈন্যবাহিনী বিদ্রোহী হয়ে লুটতরাজ আরম্ভ করলে জয়লাভ সুদূরপরাহত হয়। চপলমতি কুফাবাসীদের হঠকারিতা ও বিশ্বাসঘাতকতায় ইমাম হাসান খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন এবং ভগ্নহৃদয়ে কুফা ত্যাগ করে পারস্যের রাজধানীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

মুয়াবিয়ার সুসংঘবদ্ধ বাহিনীর মোকাবিলা করতে অসমর্থ এবং অবিশ্বাসী ও চঞ্চলমতি কুফাবাসীদের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইমাম হাসান আপোষ-মীমাংসার জন্য মুয়াবিয়ার নিকট পত্র প্রেরণ করে সন্ধির প্রস্তাব দেন। ইমাম হাসান আনুগত্য প্রকাশ করে সন্ধি স্বাক্ষরিত করতে রাজি হন। সন্ধির শর্তানুযায়ী ইমাম হাসান মুয়াবিয়াকে তাঁর জীবদ্দশায় খলিফা বলে মেনে নিতে স্বীকৃত হন। অবশ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর হযরত আলীর দ্বিতীয় পুত্র ইমাম হুসাইন খিলাফত পাবেন। মুয়াবিয়া নামাজের খুতবায় হযরত আলীর প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণ বন্ধ করতে রাজি হলেন। এ ছাড়া আরও স্থির হয় যে, ইমাম হাসান আপাতত কুফার রাজকোষ হতে এককালীন পঞ্চাশ লক্ষ দিরহাম (প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা) পারিবারিক ভরণপোষণের জন্য লাভ করবেন। মুয়াবিয়ার শর্তাবলি মেনে নিয়ে ইমাম হাসান সপরিবারে মদিনায় গিয়ে বসবাস করতে লাগলেন।

মুয়াবিয়া বিজয়দর্পে কুফায় প্রবেশ করে নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করেন। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ হতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া খিলাফত সিরিয়ার দামেস্কে রাজধানী স্থাপন করে রাজত্ব করতে থাকে। এদিকে ইমাম হাসান মদিনায় এসে বেশি দিন নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতে পারেন নি। আট বছর পরে ৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদের নির্দেশে মায়মুনার প্ররোচনায় তাঁর স্ত্রী জায়েদা কর্তৃক বিষ প্রয়োগে ইমাম হাসানের অকাল মৃত্যু ঘটে।

ইমাম হাসানের বিপর্যয়ের কারণগুলো আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, তিনি মুয়াবিয়ার তুলনায় সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক দিক দিয়ে অযোগ্য ছিলেন। নম্র, কোমল প্রাণ, ধর্মভীরু ইমাম হাসানের কোন সামরিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ছিল না। রাজনীতি ও কূটনীতি ছিল তাঁর নিকট দুর্বোধ্য। অপরদিকে মুয়াবিয়ার দৌরাত্ম্য ও প্রতাপ সমগ্র মুসলিম জাহানে প্রাধান্য বিস্তার করলে ইমাম হাসান সত্যই বিপদগ্রস্থ হলেন। ধর্মীয় নেতা হিসেবে তিনি যে খ্যাতি অর্জন করেন রাষ্ট্র পরিচালকরূপে তা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। সরল, দুর্বলচিত্ত, আত্মভোলা ইমাম হাসান অস্থিরমতি, হঠকারী ও ষড়যন্ত্রকারী কুফাবাসীদের উপর নির্ভর করে মারাত্মক ভুল করেন। এই চক্রান্তকারীরা মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে পরিশেষে নিজেদের তাঁবুতে লুণ্ঠনবৃত্তি শুরু করে। এর ফলেই বনু হাশেম গোত্র হতে খিলাফত বনু উমাইয়া গোত্রের হস্তগত হয় এবং পরিশেষে ইমাম হাসানের জীবনুসান ঘটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *