প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

পঞ্চম অধ্যায় : হযরত মুহাম্মদের (স) সাথে ইহুদীদের সম্পর্ক

পঞ্চম অধ্যায় – হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর সাথে ইহুদীদের সম্পর্ক

মদিনার ইহুদী সম্প্রদায় বিধর্মীদের প্রতি হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর সদয় ও সহানুভূতিশীল ব্যবহার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মারাত্মক প্ররোচনা সত্ত্বেও তিনি যে উদারতা ও মহানুভবতা প্রদর্শন করেন তার নজির সত্যিই বিরল। মদিনায় বসবাসকারী ইহুদীদের প্রসঙ্গে মন্টেগোমারী ওয়াট বলেন যে, “তারা প্রকৃত অর্থে হিব্রুগোত্রভুক্ত ছিল কিনা সঠিকভাবে বলা যায় না, কারণ তারা উত্তরে জেরুজালেম থেকে এসেছিল, না দক্ষিণে আরবের ইহুদী রাষ্ট্র ধ্বংস হলে উত্তরে হিজরত করে মদিনায় বসবাস শুরু করে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তারা কি মূলত আরব বংশোদ্ভূত ছিল এবং পরবর্তীকালে হিব্রুধর্ম গ্রহণ করে মদিনায় স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকে তাও সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, হযরত মুহম্মদ (সঃ)- এর জন্মের পূর্বে ইহুদী সম্প্রদায় মদিনায় বসবাস করতে থাকে। এই ইহুদী সম্প্রদায় পৌত্তলিক আরবদের সাথে একত্রে বসবাস করে এবং তাদের মধ্যে অনেক আরীব রীতিনীতি ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়ে পড়ে। এমনকি ইহুদী ও পৌত্তলিক আরবদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অবশ্য ইহুদীগণ তাদের হিব্রু ধর্ম পালন করত।“

ইয়াসরিব বা মদিনাতুন নবী ছিল ইহুদীদের বাসস্থান। আউস ও খাজরাজ গোত্র দক্ষিণে ইয়েমেন থেকে উত্তরে ইয়াসরিবে এসে ইহুদী সম্প্রদায়কে বেশ প্রভাবশালী দেখতে পায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ইয়াসরিবে যেখানে তেরটি আরব মহল্লা ছিল সেখানে ইহুদীদের ঊনষাটটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। আস-সামুদী কয়েকটি ইহুদী গোত্রের নাম উল্লেখ করেন, যেমন, বনু মাবথাড, বনু মুয়াবিয়া, বনু যাদমা, বানু নাগিসা, বনু যাওরা এবং বনু খালাবা। কিন্তু ঐতিহাসিকগণ তিনটি খুবই ক্ষমতাশালী ইহুদী গোত্রের নাম করেছেন। তারা হচ্ছে বনু কুরাইযা, বনু কাইনুকা এবং বনু নাজির। ইয়াসরিবে ইহুদীদের সংখ্যা অধিক থাকলেও তারা আরব গোত্র আউস ও খাজরাজদের অধীনে বসবাস করত। তাদের মধ্যে স্বদ্ভাব ছিল। অসংখ্য বড় ও ছোট ইহুদী গোষ্ঠীদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি ছিল না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ইসলামের চরমশত্রু মোনাফেক গোষ্ঠীদের প্রধান আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইহুদীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে।

নবী করিম মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পূর্বে মুসলমানদের সাথে ইহুদীদের কোন আপোষ বা আলাপচারিতা হয়েছিল কিনা তা সঠিকভাবে বলা যায় না। অবশ্য ইয়াসরিবের আউস ও খাজরাজ গোত্রের সাথে নবী করিমের যোগাযোগ হয় হিজরতের পূর্বেই। মুসলমানদের সাথে ইহুদীদের সম্পর্ক প্রথমদিকে হিজরতের পর ভাল ছিল। তাদের মধ্যে অনেকে নবী করিমকে পয়গম্বর হিসেবে মেনে নেয়। অনেক ইহুদী ইসলাম ধর্ম কবুল করে। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ বিন সাল্লামের কথা বলা যায়। তিনি বনু কায়নুকার গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন। কিন্তু অধিকাংশ ইহুদীগণ মদিনা সনদে স্বাক্ষর দান করলেও ইসলামের বিরোধিতা করে এবং মোনাফেক দলের প্রধান আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। উল্লেখ্য যে আহল-ই-কিতাবের অন্তর্ভুক্ত ইহুদীগণ হযরত মুহম্মদ (সঃ) প্রতিশ্রুত (Promised) নবী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ইসলামের চরম বিরোধিতা করে। মদিনায় হিজরতের পর নবী করিম তাদের সাথে মদিনা সনদে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। ইহুদীদের পক্ষ থেকে কা’ব বিন আসাদ সনদে স্বাক্ষর দান করে। তারা প্রতিশ্রুতি দিলেও নবী করিমকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি, যদিও জেরুজালেম যেখানে ইহুদীদের এক সময় পবিত্র ধর্মমন্দির (Temple) ছিল, ইসলামের প্রথম কিবলা ছিল। ইসলামের উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধিতে মদিনার বনু কাইনুকা, বনু কুরাইযা এবং বনু নাজির শঙ্কিত হয়ে পড়ে। মদিনা সনদে তাদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়। নবী করিম তাদের মাত্র একটি শর্ত দিয়েছিলেন। তা হচ্ছে “তারা ইসলামের শত্রুদের কোন প্রকারে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবে না। তাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে।” আল-ওয়াকিদি বলেন যে, “বিশ্বাসঘাতকতা করে ইহুদীগণ ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য মোনাফেক গোষ্ঠীর দলপতি আবদুল্লাহ ইবন উবাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে।” বনু কাইনুকা শতশত সশস্ত্র ইহুদী যোদ্ধা দিয়ে বদরের যুদ্ধে (৬২৪ খ্রিঃ) পৌত্তলিক মোনাফেকদের সাহায্য করে। হিংসপরায়ণ ইহুদী সম্প্রদায় তাদের কাছে প্রদত্ত সনদের কপি খন্দকের যুদ্ধের পর ছিঁড়ে ফেলে। আমীর আলী বলেন যে, ইহুদী সম্প্রদায়ের প্রকাশ্য বিরোধিতার ফলে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। তিনি বলেন, “সারা মদিনা তাদের (মোনাফেক ও ইহুদী) বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতায় ভরে গিয়েছিল। মদিনা সনদের খেলাপ করে বনু নাজির গোত্র ইসলাম বিরোধী পৌত্তলিকদের চর হিসেবে কাজ করে। ইহুদী সম্প্রদায় নবী করিমের বিরুদ্ধে উহুদের যুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। শুধু তাই নয় তাঁকে খন্দকের যুদ্ধে তিনটি পৃথক শত্রুশিবিরের মোকাবেলা করতে হয়-পৌত্তলিক, ইহুদী ও মোনাফেক।

ইসলামের সাথে ইহুদীদের বিরোধের প্রসঙ্গে সৈয়দ আমীর আলী বলেন, ‘পয়গম্বরের কোন দয়া অথবা বদান্যতা ইহুদীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাদের বৈরী মনোভাব তারা কোনমতেই প্রশমিত করতে পারত না। আরব দেশকে ইহুদীদের বাসভূমিতে পরিণত করার জন্য তাঁকে (নবী করিম) ব্যবহার করতে অক্ষম হয়ে এবং তালমুদে বিশ্বাস অপেক্ষা ইসলাম সহজতর উপলব্ধি করে তারা ক্রুদ্ধ হল এবং হযরতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নব প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ধর্মের শত্রুদের সাথে একতাবদ্ধ হল। তারা কুৎসা রটনা করত এবং জিহ্বা বিকৃত করত। কুরআনের বাণী, দৈনন্দিন নামাজ ও ইসলামের মূলমন্ত্রলোকে অশুদ্ধ উচ্চারণ দ্বারা নিরর্থক, অলীক ও ধর্মদ্রোহিতার পর্যায়ে ফেলত। কতিপয় ইহুদী পুরুষ ও মহিলা কবি মুসলিম মহিলাদের উদ্দেশ্যে অশ্লীল ও বিদ্রুপাত্মক কাব্য রচনা করে আরবদের শালীনতাবোধ, সম্মান ও বীরত্বে আঘাত হানে। পবিত্র কুরআনে ইহুদীদের বৈরী মনোভাব উল্লেখ পাওয়া যায়।

সূরা ইমরানের (৩) ১৯৯ আয়াতে বলা হয়েছে, “কিতাবীদের মধ্যে অনেকে আছে যারা আল্লাহর নিকট বিনয়াবনত হয়ে তোমাদের প্রতি যা ‘অবতীর্ণ’ হয়েছে (‘তৌরাত’) তা বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর আয়াত স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করে না। এরাই তারা যাদের জন্য আল্লাহর নিকট থেকে পুরষ্কার রয়েছে। আল্লাহ হিসেব গ্রহণে তৎপর।

সূরা ইমরানের (৩) ১১৩ আয়াতে উল্লেখ আছে “তারা (নব-দীক্ষিত ইহুদীগণ) সকলে এক রকম নয়। কিতাবীদের মধ্যে অবিচল একদল আছে। তারা রাতে সিজদারত অবস্থায় আল্লাহর আয়াত আবৃত্তি করে।”

মদিনায় বসবাসকারী অধিকাংশ ইহুদী নবী করিমের প্রতি শ্রদ্ধাভাজন ছিল না। তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। নবী করিম ইহুদী সম্প্রদায়ের সাথে সখ্যতা স্থাপনের জন্য নানা প্রকার অনুশীলন করেন, যার মধ্যে জেরুজালেমকে ইসলামের প্রথম কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি দান। অবশ্য ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে মক্কা ইসলামের কিবলা নির্ধারিত হয়। এ ছাড়া আশুরা (উপবাস) ‘মধ্যান্য উপাসনা’ ইহুদী মহিলাদের সাথে মুসলমানদের বিবাহ এবং ইহুদীদের মতে জবেহ করা মাংস ভক্ষণ প্রভৃতি প্রচলন করে নবী করিম ইহুদীদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা এমনই হিংস্রপরায়ণ ছিল যে নবী করিমকে, বিশেষ করে বনু কাইনুকা, বনু কুরাইজা এবং বনু নাজিরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।

মদিনার বনু কাইনুকা উক্ত ইহুদী সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ছিল। কৃষিকাজের উপর নির্ভর না করে তারা নানাবিধ হস্তশিল্প প্রস্তুত করে সম্পদশালী হয়। বদরের যুদ্ধের অব্যবহিত পরে এই সম্প্রদায়ের একজন ইহুদী যুবক জনৈক মুসলিম তরুণীকে প্রকাশ্য বাজারে অপমান করলে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য স্থানীয় একজন মুসলমান উক্ত ইহুদী যুবককে হত্যা করে। এর ফলে সমস্ত ইহুদী মিলিত হইয়া মুসলিম যুবককে হত্যা করে। ইহুদী ও মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলে হযরত বনু কাইনুকাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ অথবা মদিনা ত্যাগ করার আদেশ দেন। মুসলিম প্রজাতন্ত্রের বিশ্বাসঘাতক এই ইহুদী সম্প্রদায় পনের দিন নজদের দুর্গে অবরুদ্ধ থাকার পর তাদেরকে মদিনা থেকে নির্বিঘ্নে বিতাড়িত করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে (তৃতীয় হিজরী) বনু কাইনুকাকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাস্বরূপ মদিনা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য করা হয়।

ইহুদীদের প্রকাশ্য বিরোধিতা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপে মদিনার মুসলমানগণ অতিষ্ট হয়ে উঠে। বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের পরাজয়ের পর মদিনা সনদের শর্ত ভঙ্গ করে বনু নাজির গোত্রের কা’ব-ইবন-আসরাফ বীরগাঁথা রচনা করে মক্কার বিধর্মীদের উৎসাহ দান করে। আবু রা’ফী সাল্লাম নামক অপর একজন নাজির গোত্রীয় ইহুদী সুলাইম ও গাতাফান প্রভৃতি আরব বেদুঈন গোত্রকে ইসলামের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে থাকে। হঠকারিতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত ইসলামের এই দুই পরম শত্রুকে হত্যা করার আদেশ প্রদান করা হয়। নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। হযরত মুহম্মদ (সঃ) বনু কাইনুকাকে যে শর্ত প্রদান করেন বনু নাজিরকেও অনুরূপ আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক বনু নাজির তাঁর আদেশ অমান্য করে এর বিরোধিতা করে। মদিনা থেকে বিতাড়িত হয়ে তারা সিরিয়া ও খাইবারে গিয়ে বাস করতে থাকে। হিজরীর চতুর্থ বৎসরে (৬২৬ খ্রিস্টাব্দে) বনু নাজির গোত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

মদিনার বিশ্বাসঘাতক ইহুদী গোত্রের সর্বশেষ সম্প্রদায় ছিল বনু কুরাইজা। খন্দকের যুদ্ধে এই ইহুদী গোত্র পৌত্তলিক কুরাইশ ও বেদুঈনদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ত্রি-শক্তি সংঘ গঠন করে এবং ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার সকল প্রকার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু ত্রি-শক্তি সংঘের শোচনীয় পরাজয়ের পর মুসলমানগণ এই বিশ্বাসঘাতক বনু কুরাইজাকে সমুচিত শাস্তি প্রদানের জন্য মদিনা ত্যাগ করতে আদেশ করেন; কিন্তু তারা সেই আদেশ অমান্য করলে তাদের দুর্গ অবরোধ করা হয়। আত্মসমর্পণ করলে হযরত ইহুদীদের ইচ্ছানুযায়ী আউস গোত্রের দলপতি সা’দ-বিন-মা’জের উপর বিশ্বাসঘাতকার অপরাধের বিচারভার ন্যস্ত করেন। তার বিচারে ইসলামের বিরোধিতাকারী ইহুদীদের প্রায় ২৫০ ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় এবং নারী ও শিশুদেরকে দাস-দাসীতে পরিণত করা হয়। ইহুদী সম্প্রদায়ের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার চরম পর্যায়ে তারা খাাইবারে আরব দুর্ধর্ষ বেদুঈন গোত্র বনু সা’দ ও বনু ঘাতাফানদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে থাকে এবং একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে খাইবারের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরোধিতা করে।

ইহুদীদের প্রতি হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কঠোর ও অন্যায় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন বলে স্প্রেঙ্গার, উইল, ওসবর্ন প্রমুখ ইউরোপীয় ঐতিহাসিক বিরূপ মন্তব্য করেন-যা ঠিক নয়।

নিগূঢ় ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ও নিরপেক্ষ সমালোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে যে, ইহুদীদের বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা তাদের জিঘাংসামূলক ব্যবহার, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার তুলনায় অতি নগণ্য। ইহুদীদের জঘন্য রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের বহু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে; যথা-

(১) মদিনা সনদের পরিপন্থী ইহুদী গোত্র মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে মুসলমানদের গুপ্ত খবর কুরাইশদের নিকট সরবরাহ করত। গুপ্তচর বৃত্তি বিশ্বাসঘাতকতার অন্যতম দৃষ্টান্ত।

(২) কা’ব-ইবন-আসরাফ বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের বিপর্যয়ে মক্কায় গমন করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিধর্মীদের প্ররোচিত করতে থাকে।

(৩) মুসলিম তরুণীর শালীনতাহানির চেষ্টা।

(৪) আবু রা’ফী সাল্লাম আরব বেদুঈন গোত্র সুলাইম ও গাতাফানকে ইসলামের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলে।

(৫) আমর-বিন-জাহস গৃহচূড়ায় আরোহণ করে হযরত (সঃ)-কে হত্যার চেষ্টা করে।

(৬) বীর-মায়মুনায় আরব বেদুঈন গোত্র কর্তৃক মুসলিম ধর্মপ্রচারকের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল বনু সুলাইম এবং এতে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র ছিল বলে মনে করা হয়।

(৭) বীর মায়মুনা হতে আত্মরক্ষা করে একজন মুসলমান ভুলক্রমে বনু আমীর গোত্রের দু’জনকে হত্যা করলে হযরত ইহুদী ও মুসলমানদের উভয়কে সনদের শর্তানুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ করেন; কিন্তু বনু নাজির গোত্র সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ প্রদানে অস্বীকার করে। হযরত স্বয়ং ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ করেন; কিন্তু বনু নাজির গোত্র সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ প্রদানে অস্বীকার করে। হযরত স্বয়ং ক্ষতিপূরণ আদায় করতে গেলে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।

(৮) খাইবার হতে বহিষ্কৃত হয়ে মদিনার উপকণ্ঠে ইহুদীরা মুসলমানদের বাড়িঘর লুণ্ঠন করত ও আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করত।

(৯) ইহুদীদের প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত খাইবারের যুদ্ধ। (১০) খাইবারের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা হযরতকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার হীন চক্রান্ত করে।

নিরপেক্ষ সমালোচকের দৃষ্টিতে বিচার করলে প্রতীয়মান হবে যে, ইহুদীরা নব- প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ধর্ম ও প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ পরিচালনা করে। তারা শুধু ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপেই লিপ্ত ছিল না, হযরতের জীবন বিনাশেরও প্রচেষ্টা করে। এতদসত্ত্বেও হযরত তাদের প্রতি মহানুভূবতা প্রদর্শন করেন। কা’ব-ইবন-আসরাফ এবং আবু রা’ফী সাল্লামকে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। বনু কাইনুকা ও বনু নাজির গোত্রকে মদিনা থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। ইহুদীদের প্রার্থনাক্রমে সাদ-বিন- মা’জের উপর বিচার-ভার ন্যস্ত হয়। বিচারে বনু কুরাইজা গোত্রের কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় কিন্তু হযরত স্বয়ং এতে জড়িত ছিলেন না। বিষ প্রয়োগে হত্যা করার জন্য শুধু জয়নবকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, সমগ্র ইহুদী সম্প্রদায়কে খাইবার থেকে নির্বাসিত করা হয়নি। অবশ্য পরবর্তীকালে ষড়যন্ত্রের দায়ে হযরত ওমর (রাঃ) সিরিয়া তথা আরব দেশ থেকে ইহুদীদের বিতাড়িত করে মুসলিম রাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করেন।

লেনপুল বলেন, “এটি অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, নগর অবরোধের সময় ঐ সমস্ত লোক (ইহুদীগণ) রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী ছিল।” কুরআন শরীফে বর্ণিত আছে, “নিশ্চয় মুখে (মুসলমানদের বিরুদ্ধে) তারা জঘন্য ঘৃণা বা হিংসা প্রকাশ করেছে এবং অন্তরে তাদের (মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা) আরও অধিক।” হিংসাত্মক ও বিদ্রোহজনক কার্যকলাপের তুলনায় ইহুদীদের প্রতি হযরত খুবই মানবোচিত শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মূইর বলেন, “যে কারণে মুহম্মদ (সঃ) ইহুদীগকে শাস্তি প্রদান করেন তা রাজনৈতিক, ধর্মীয় নয়।”

খ্রিস্টানদের সাথে সম্পর্ক

ইসলামের প্রথম যুগে খ্রিস্টানদের সাথে মুসলমানদের সদ্ভাব ছিল। হযরত খ্রিস্টান আবিসিনীয় সম্রাট নাজ্জাসীর সহৃদয়তার কথায় বিস্মৃত হননি। কারণ, তিনি তাঁর রাজ্যে দেশত্যাগী মুসলমানদের আশ্রয় দান করেন। মদিনায় হিজরত করার পর স্থানীয় খ্রিস্টানগণ হযরতের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করত ও মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলত। খ্রিস্টানদের সহৃদয়তা ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবে প্রীত হয়ে হযরত ষষ্ঠ হিজরীতে সিনাই পাহাড়ের সন্নিকটে সেন্ট ক্যাথারিন মঠের সন্ন্যাসীদের এবং অন্য খ্রিস্টানদের একটি সনদ (Charter) প্রদান করেন।

এই সনদ মোতাবেক খ্রিস্টানদের সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয় এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। সনদের শর্ত ভঙ্গকারী মুসলমানদের কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা হয়। খ্রিস্টানদের জীবন ও ধন-সম্পত্তি রক্ষার ভার হযরত স্বয়ং গ্রহণ করেন। এই সনদের মারফতে তিনি নিজে এবং মুসলিম জাতি খ্রিস্টানদের বাসস্থান, মঠ, গীর্জা এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষা ও প্রয়োজনীয় সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি দেন। অতিরিক্ত কর আদায়, স্বধর্ম ত্যাগে বাধা, ধর্মযাজকের পদ থেকে বহিষ্কার, গীর্জা ধ্বংস করে মসজিদ অথবা মুসলমানদের গৃহ নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়। নির্বিঘ্নে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। ধর্মান্তরিত না হয়েও খ্রিস্টান মহিলাদের মুসলমানকে বিবাহ করার অধিকার ছিল। আরবের বাহিরে বসবাসকারী খ্রিস্টানদের সাথে মুসলমানদের বিরোধ সংঘটিত হলে আরবের খ্রিস্টানদের উপর কোনপ্রকার অত্যাচার করা হইত না।

আমীর আলী বলেন, “খ্রিস্টানদের প্রতি হযরত মুহম্মদ (সঃ) যে উদারতা, মহানুভবতা ও সহৃদয়তার পরিচয় এই সনদে প্রদান করেন তা অসাধারণ সহিষ্ণুতার অত্যুৎকৃষ্ট কীর্তিস্তম্ভস্বরূপ।”

মন্টোগোমারী ওয়াট নবী করিমের সাথে বৈরীভাবাপন্ন ইহুদীদের সম্পর্কের কথা বলেছেন এবং মদিনা থেকে তাদের বহিষ্কারকে সমর্থন করেছেন। তিনি বলেন, “ইহুদীগণ তাদের সর্বাত্মক ক্ষমতাদ্বারা নবী করিমকে প্রচণ্ডভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল এবং যে করেছে তাদের উচ্ছেদকরা হয়। তাদের অনেকে (যারা প্রকাশ্যে) বিরোধিতা করেনি, মদিনার অলিতে-গলিতে বসবাস করতে থাকে এবং বিক্ষিপ্তভাবে এখানে সেখানে থাকতে শুরু করে। কিন্তু আরব রাজনীতিতে তাদের প্রভাব চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। শুধু তাই নয় তাদের যে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ‘কুশিদ প্রথা’ চিরতরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।“

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *