প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

পঞ্চম অধ্যায় : সম্প্রসারিত দিগন্ত

সম্প্রসারিত দিগন্ত

১. হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সঙ্কট

৬১৯ খ্রিস্টাব্দে অবরোধ ও সমাজচ্যুতির পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর নবী হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর নব-দীক্ষিত উম্মতদের শারীরিক কষ্ট লাঘব হলেও নবীর জন্য পারিবারিক বিপর্যয় শুরু হয়। এ বছর স্ত্রী খাদিজা যিনি দুঃসময়ে নবীকে সাহস ও উৎসাহ দেন, ইন্তেকাল করেন। এছাড়া নবীর চাচা আবু তালিব, যিনি পৌত্তলিক কুরাইশদের অত্যাচার থেকে হযরত মুহাম্মদ (স)-কে রক্ষা করেন, এ বছরই মৃত্যুবরণ করেন। একই বছরে পরপর এ দুজন পরম আত্মীয়ের মুত্যুতে তিনি এত শোকাভিভূত হয়ে পড়েন যে, এ বছরটি আজও ‘আমুল হুযন’ (বিপদের বছর) নামে পরিচিত। খাদিজার জীবদ্দশায় হযরত মুহাম্মদ (স) দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। কিন্তু প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি সাউদা বিনতে জা’মা বিন কায়েসকে বিয়ে করেন। সাউদা পূর্বে সাকরান বিন আমরকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সাকরান মারা যাওয়ার পরে তিনি বেশ কিছু দিন বৈধব্য জীবন কাটান। ৬২০ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে সাউদার বিয়ে সম্পন্ন হয়। স্বীয় চাচা ও প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুতে নবী (স) যে মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন সাউদার সাথে বিয়ের পর তা কিছুটা লাঘব হয়। ওয়াট বলেন যে, এই বিয়ে ছিল আধ্যাত্মিক সাহচর্যের (Spiritual companionship)। এর পর সাউদা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না, এর অন্যতম কারণ এই যে, তিনি ‘উম্মাহাতুল মু’মেনীন’ বা মু’মীনদের মাতা হিসেবে নবীর পরিবারে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। পরমাত্মীয়ের মৃত্যুর শোক লাঘবের জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর পালিত পুত্র যায়েদকে নিয়ে তায়েফে যান। পাষণ্ড তায়েফবাসী পাথর নিক্ষেপ করে তাকে শহর থেকে তাড়িয়ে দেন। অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েও নবী তায়েফবাসীদের অভিশাপ দেন নি। তায়েফ থেকে তিনি নাখলা হয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। উল্লেখ্য, নাখলায় আল-উজ্জা দেবীর মন্দির ছিল। মক্কা যেমন পৌত্তলিকতার একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল, অনুরূপ তায়েফে ছিল আল-লাত দেবীর মন্দির। কুরআনের পৌত্তলিকতাবিরোধী সতর্কতা বাণী সত্ত্বেও ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পূর্বে পৌত্তলিকতা আরবদেশ থেকে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয় নি।

আবু তালিবের মৃত্যুর রাজনৈতিক প্রতিফলন হয়েছিল মারাত্মক। বিশেষ করে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চাচা বিধর্মী হলেও তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে গোত্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। আবু তালিবের মৃত্যুতে হাশিম গোত্রের প্রধান দায়িত্ব লাভ করেন তাঁর অন্য চাচা আবু লাহাব, যিনি আবদুল মুত্তালিবের পুত্র ছিলেন। কুরাইশগণ যখন নবীর পরিবারকে সমাজচ্যুত করে ‘আবু তালিবের’ উপত্যকায় বসবাসে বাধ্য করেন তখন আবু লাহাব এই ব্যবস্থার সমর্থন দেন; কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কোন অনিষ্ট হোক তা চাইতেন না; বরং তিনি গোত্রপতি হয়েও তাঁর ভাই আবু তালিবের মত তিনিও নবীকে নিরাপত্তা দান করেন। এর প্রধান কারণ-গোত্রীয় সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা।

বিশ্বাসঘাতকে আবু লাহাব হঠাৎ করে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ওপর থেকে তাঁর নিরাপত্তার অহংকার প্রত্যাহার করেন। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, ইসলাম কবুল না করায় তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব দোজখে যাবেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর এ ধরনের মন্তব্য যাচাই করার জন্য উকবা বিন আবি মুয়াইত এবং আবু জেহেল আবু লাহাবকে চাপ দেন। ওয়াট নিজেই বলছেন যে, আরবী গ্রন্থসূত্রে যে ধরনের তথ্য এ প্রসঙ্গে পাওয়া যায় তা খুবই দুর্বল। কিন্তু এটি প্রমাণ করে যে, হাশিম পরিবার রাসূলের প্রতি ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। এর মূল কারণ ধর্মপ্রচারে অসামান্য সফলতা এবং নবর ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার। নবীর শত্রুরা আবু লাহাবকে বুঝাবার চেষ্টা করে একথা বলে যে, যেহেতু তিনি তার পূর্বপুরুষ আব্দুল মুত্তালিব সম্বন্ধে অশোভন মন্তব্য করেছেন, সেহেতু আবু লাহাব কোন প্রকার মান-সম্মান না হারিয়ে নবীকে প্রদত্ত গোত্রীয় নিরাপত্তা বাতিল করতে পারেন।

৬১৯ থেকে ৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নবীর জীবনে কয়েকটি ঘটনা ঘটে। প্রথমটি হচ্ছে মে’রাজ বা ঊর্ধ্বগমন। প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়ে পড়লে তাঁকে সান্ত্বনা ও প্রেরণা প্রদানের জন্য আল্লাহ রাসূলকে মে’রাজে আহবান করেন। বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর দিদার লাভের জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কা থেকে প্রথমে জেরুজালেম এবং পরে বুরাকের পিঠে চড়ে সাত আসমান ভেদ করে রাত্রিকালীন ভ্রমণ (ইসরা) করেন। প্রত্যেক ভক্ত মুসলমান এই চমকপ্রদ অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাসী।

গোত্রীয় নিরাপত্তা হারিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স) শুধু মহাসঙ্কটেই পড়লেন না বরং ইসলাম প্রচার মারাত্মক বিঘ্নিত হয়। এ সময় ধর্মান্তরিতও চলতে থাকে খুব ধীরগতিতে। এ সময় ওমর ইবন খাত্তাব ছাড়া তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি। নিরাপত্তা লাভে ব্যর্থ হওয়ায় নবীর ধর্মপ্রচার বাধাগ্রস্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে প্রতীয়মান হয় যে, মক্কায় ধর্মপ্রচার করার পরিবেশ নেই এবং ইসলাম ধর্মের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন নতুন সুযোগ-সুবিধা, স্থান ও অনুকূল পরিবেশ। কুরাইশদের অসহযোগিতা ও অমানবিক আচরণে নবীর বদ্ধমূল ধারণা হল যে, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে তাঁর সাফল্য অর্জন করতে হলে নতুন স্থান পরিবর্তন বিশেষ প্রয়োজন। নবীকে কেবলমাত্র কুরাইশ গোত্রের হেদায়েতের জন্য পাঠানো হয় নি। যদিও মক্কার পৌত্তলিকদের সম্পর্কে কুরআনে অধিক বলা হয়েছে। একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তিনি শুধু মক্কায় নয়, সমগ্র আরব ভূখণ্ডে তাঁকে তাওহীদ প্রচারের জন্য পাঠানো হয়, কালক্রমে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মদিনায় হিজরত করার (৬২২ খ্রি.) পূর্বে মক্কায় শেষ তিন বছর ইসলাম ধর্ম প্রচারে তেমন অগ্রগতি হয় নি। হাজ্জ মৌসুমে তিনি হাজীদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করতেন এবং অনেককে দীক্ষিত করেন। তাদের মধ্যে মদিনা বা ইয়াসরিবের আউস ও খাযরাজ গোত্রের সদস্যরা ছিল। এছাড়া, তায়েফ থেকে আগত লোকদের মধ্যে তিনি আল্লাহর বাণী প্রচার করেন।

২. তায়েফে ধর্মপ্রচার

মক্কার ৭৫ মাইল দক্ষিণে গ্রীষ্মের অবসরকালীন শহর তায়েফ অবস্থিত। মক্কার সাথে তায়েফের সাদৃশ্য রয়েছে। কারণ উভয় শহরই ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র এবং দক্ষিণে ইয়েমেন যেতে হলে মক্কা থেকে তায়েফ হয়ে যেতে হত। মক্কার সাথে তায়েফের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। মক্কার কুরাইশগণ তায়েফে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসত। মক্কার সাথে তায়েফের পরিবেশগত কিছুটা পার্থক্য ছিল। মক্কার রুক্ষ পাহাড়ী পরিবেশ আর তায়েফে ছিল উপত্যকার মোলায়েম ঠাণ্ডা পরিবেশ। উপরন্তু, কৃষি উপযোগী জমি থাকায় তায়েফে নানা ধরনের ফসল উৎপাদিত হত। আরবদেশের অন্যান্য অঞ্চলের লোকেরা যেখানে দুধ এবং খেজুরের ওপর অধিক নির্ভরশীর ছিল সেখানে তায়েফের লোকেরা শস্য উৎপাদন করে আহার করত। ধনাঢ্য মক্কাবাসীদের তায়েফে জমিজমা ছিল এবং গ্রীষ্মাবাস হিসেবে তায়েফকে ব্যবহার করত। বিশেষভাবে হাশিম ও আবদ শামস গোত্রের সদস্যদের তায়েফবাসীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। মাখযুম গো তায়েফে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করে। অবশ্য তায়েফের ছাকিফ গো মক্কারকুরাইশ গোত্রের মত ক্ষমতাশালী ছিল না। ফিজারের যুদ্ধের পর তায়েফের প্রভাব হ্রাস পায়। অবশ্য একতরফাভাবে একথা বলা যাবে না যে, তায়েফের লোকজন একেবারে ক্ষমতাহীন ছিল। কারণ আল-আখনাস বিন শারিক নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি মক্কার জুহরা গোত্রের প্রধান ছিলেন।

তায়েফে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক সংগঠন ছিল- বনু মালিক এবং আহলাফ। আহলাফ গোত্র খুবই প্রাচীন ও ক্ষমতাশালী ছিল। কারণ তারাই আল-লাত মন্দিরের পৌরহীত্য করত। তাদেরকে অতি সাধারণ ও নগণ্য (প্লেবিয়ান) লোক বলা যাবে না। বনু মালিক বনু আহলাফের সাথে সামাজিক, ধর্মীয় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সব সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। বনু মালিকের সাথে সুবৃহৎ হাওয়াজিন গোত্রের সম্পর্ক ছিল। অন্যদিকে নিজেদের প্রভাব-বরয় বৃদ্ধির জন্য আহলাফ গোত্র মক্কার কুরাইশদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করে। তায়েফের অন্য গোত্র ছাকিফ ক্ষমাতহীন ছিল এবং এ কারণে তারা কুরাইশদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে।

মক্কার বাইরে তায়েফেই প্রথম হযরত মুহাম্মদ (স) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য যান। কারণ তিনি উপলব্ধি করেন যে, ধর্ম প্রচারের নতুন স্থানে পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন। চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর পর নতুন গোত্র প্রধান আপন চাচা আবু লাহাব নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করলে ধর্মপ্রচারে নবী এক মহাসঙ্কটে পড়েন। তাঁর সাহাবীরা অমানুষিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লে ধর্ম প্রচার ও ধর্মান্তরিত প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। এই পরিস্থিতিতে মক্কা থেকে ৭৫ মাইল দক্ষিণে গ্রীষ্মাবাস তায়েফে গিয়ে তিনি ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তাছাড়া, হযরত মুহাম্মদ (স) তায়েফে বনু আহলাফের কাছে নিরাপত্তা লাভের জন্য যান। পরবর্তী পর্যায়ে মদিনায় হিজরত করে হযরত মুহাম্মদ (স) যেমন ধর্মপ্রচারের সাথে সাথে সেখানে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন সেরূপ তৎপরতার জন্য সম্ভবত তায়েফে গিয়েছিলেন। কিন্তু তায়েফবাসীদের বৈরী মনোভাব ও অমানুষিক আচরণে তা ব্যর্থ হয়। উপরন্তু, তাঁর তায়েফ গমনের অন্য একটি কারণ সম্ভবত এই ছিল যে, গোত্রীয় নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হয়ে তিনি যে ধর্মপ্রচারে সঙ্কটের সম্মুখীন হন তার শাস্তিস্বরূপ সম্ভব পৌত্তলিক-কুরাইশদের ওপর গজব আসবে। ওয়াটের এ ধরনের মন্তব্যের যথার্থতা উপলব্ধি করা যায় না। কারণ তিনি তাঁর ভৃত্য যায়েদকে নিয়ে যখন সেখানে ধর্ম প্রচারে যান তখন অন্যান্য সমস্ত সাহাবী মক্কায় অবস্থান করছিলেন। তায়েফে ধর্মপ্রচারে যাত্রার মূল উদ্দেশ্য কি ছিল। তা সঠিকভাবে বলা যায় না? কারণ, এটি ছিল তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত। তায়েফে গিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স) যাদের সাথে যোগাযোগ করেন তারা হচ্ছেন আবদুল ইয়ালিল এবং তার ভ্রাতাগণ। তারা আহলাফের উপ-গোত্র আমর বিন উমাইর- এর সদস্য ছিলেন। এরা পক্ষান্তরে কুরাইশদের সমর্থক ছিলেন। এ ধরনের পদক্ষেপের অন্তরালে হযরত মুহাম্মদ (স) সম্ভবত আহলাফ গোত্রকে মাখযুমদের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।

তায়েফে হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা বিড়ম্বনার সম্মুখীনই হন নি, রীতিমত অপদস্থ ও লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। সরল মনে এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে মক্কা থেকে তায়েফে গিয়ে তিনি বনু আমর বিন উমাইর উপ-গোত্রের কোপানলে পড়েন। এর ফলে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, এই হিংস্রপরায়ণ গোত্র তায়েফের বিভ্রান্ত বণিকদের হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রতি পাথর ছুঁড়ার জন্য উস্কানি দেয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তিনি জীবনরক্ষার জন্য তার চীরশত্রু মক্কার আবদ শামস গোত্রের ভ্রাতাদ্বয়ের বাগানে আশ্রয় নেন।

ভগ্নহৃদয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে তায়েফ ত্যাগ করে হযরত মুহাম্মদ (স) পথে নাখলায় রাত কাটান। নাখলায় উজ্জাদেবীর মন্দির ছিল। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, রাতে নাখলায় ইবাদত করার সময় তার কাছে কয়েকজন জ্বিন আসে এবং তাঁর প্রচারিত তাওহীদের বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করে।

তায়েফ থেকে হযরত মুহাম্মদ (স) সরাসরি মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন নি। তিনি মক্কার উপকণ্ঠে হেরা নামক স্থানে কিছুদিন অবস্থান করেন। এর কারণ ছিল দুটি- প্রথমত, তিনি সেখানে অবস্থান করে সেখানকার এক গোত্রপ্রধানের সাথে নিরপত্তার (যিওয়ার জন্য কথাবার্তা বলেন। দ্বিতীয়ত, আবু লাহাব গোত্রীয় নিরাপত্তা প্রত্যাহার করায় তিনি মক্কায় ফিরে যেতে ইতস্তত করছিলেন। বস্তুত মানুষের নিরাপত্তা লাভে ব্যর্থ হয়ে নবী (স) আল্লাহর হেফাজত কামনা করেন। অন্যদিকে নবীর প্রতি কুচক্রী তায়েফবাসীদের উৎপীড়ন এবং ধর্মপ্রচারের ব্যর্থতায় পৌত্তলিক মক্কাবাসীরা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তিনি মক্কার গোত্রীয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হন। কারণ, বনু জুহুরা গোত্রের আল আখনাস বিন শারিখ এবং বনু আমির গোত্রের সোহায়েল বিন আমর নবীর প্রস্তাব ও অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। অবশেষে ক্ষুদ্র নওফেল গোত্রের প্রধান আল মুতিম বিন আদি হযরত মুহাম্মদ (স)-কে নিরাপত্তা দিতে রাজি হন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, এ সময় মক্কায় এমন কোন ক্ষমতাশালী মুসলমান ছিলেন না যিনি নবীকে মক্কায় নিরাপত্তা বিধান করতে পারেন। এমন কি ওমর ইবন খাত্তাবও পারেন নি।

৩. বেদুঈন গোত্রে ধর্মপ্রচার

তায়েফ ও মক্কায় পৌত্তলিকদের বিরোধিতার কারণে ইসলাম প্রচার বিঘ্নিত হলে নবী করিম (স) যাযাবর বেদুঈন গোত্রে ধর্মপ্রচার শুরু করেন। তিনি উকাযসহ বিভিন্ন মেলা উপলক্ষে আগত মানুষদের মধ্যে তাওহীদের বাণী প্রচার করতে থাকেন। যে সমস্ত গোত্রের কাছে তিনি ধর্মপ্রচার করেন, তারা হচ্ছেন বনু কিনদা, বনু কালব, বনু হানিফা এবং বনু আমির বিন সাসার। এদের মধ্যে কোন গোত্রই ইসলামের ছায়াতলে আসে নি। ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম ও ইবনে সাদ কেবল এই তিন বেদুঈন গোত্রের কথা উল্লেখ করেন-যদিও সমগ্র আরব ভূখণ্ডে অসংখ্য বেদুঈন গোত্র ছিল। মরুভূমির যাযাবরদের মধ্যে ইসলামে দীক্ষালাভ ছিল খুবই কঠিন। কারণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন ছিল না বললেই চলে এবং মক্কা পর্যায়ে নবী কোন প্রতিনিধি দল পাঠাননি। যাহোক, বনু আমির বিন সাসারের কয়েকজন সদস্য আল্লাহর বাণীতে অনুপ্রাণিত হয়। এর সত্যতা চতুর্থ হিজরীতে মায়মূনার ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হয়। নবী যে তিনটি বেদুঈন গোত্রের-বনু কিনদা, বনু কালাব এবং বনু হানিফা-সাথে যোগাযোগ করেন তারা ছিলেন খ্রিস্টান। একারণে তাদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হবার প্রশ্ন আসে না। বেদুঈন গোত্রসমূহ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল কিনা-তা বলা যায় না; তবে মক্কা ও তায়েফের তিক্ত অভিজ্ঞতায় দৃঢ় মনোবল নিয়ে তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করেন। তখনও একেশ্বরবাদের বহুল প্রচার হয় নি। কিন্তু একথা বলা যায় যে, হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর সম্প্রসারিত দিগন্তে তার ধর্মীয় কার্যকলাপ বিস্তারের চেষ্টা করেন।

৪. মদিনাবাসীদের সাথে যোগাযোগ

ক. মদিনার পরিস্থিতি : সাধারণভাবে মদিনা নামে পরিচিত নগরটি প্রকৃত অর্থে ‘মদিনাত-আল-নবী’ অর্থাৎ নবীর শহর। ‘আরবী’ ভাষায় মদিনার অর্থ ন্যায়-বিচারের শহর। হিজরতের পূর্বে এটি ইয়াসরিব নামে পরিচিত ছিল। মদিনাকে শহর বললে ভুল হবে। কারণ প্রকৃতপক্ষে এটি কতকগুলো ছোট ছোট গ্রাম, খামার এবং দুর্গের সমষ্টি, যা বিশ মাইলব্যাপী এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। মদিনা কৃষিপ্রধান অঞ্চল ও এটি বাগানের শহর; কিন্তু এর চারপাশে ছোট ছোট পাহাড় দিয়ে ঘেরা।

মদিনা বা ইয়াসরিবের জনগোষ্ঠীর মেধ্য প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে বনু কালব। পরবর্তীকালে হিজরতের পরে তারা আনসার নামে পরিচিত হন। আনসার অর্থ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাহায্যকারী। আনসারগণ মূলত দুটি গোত্র থেকে উদ্ভূত। যথা- আউস ও খাযরাজ। আউস ও খাযরাজ গোত্র দুটি কয়েকটি উপগোত্রে বিভক্ত। ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, আউস ও খাযরাজ গোত্র দক্ষিণ আরব থেকে ইয়াসরিবে এসে বসবাস শুরু করে। তারা সেখানকার অধিবাসীদের অধীনে বহুদিন বসবাস করার পর সংখ্যায় তারা বাড়তে থাকে এবং কালক্রমে মদিনার মরূদ্যানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রাধান্য বিস্তার করে। এ ঘটনা ঘটেছিল খ্রিস্টান ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে অথবা তার একটু পরে।

মদিনার আদি বাসিন্দাদের মধ্যে আউস ও খাযরাজ ব্যতীত বনু কোরাইযা এবং বনু নাজির নামে দুটি শক্তিশালী ও ধনাঢ্য ইহুদী পরিবার বাস করত। আরব গোত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলেও এ দুই গোষ্ঠী ইহুদী হওয়ায় তারা নিজস্ব ধর্ম আচার অনুষ্ঠান পালন করত। সঠিকভাবে বলা যায় না যে, এ দুই গোষ্ঠী আদিতে হিব্রু জাতিভুক্ত ছিল না পরবর্তীকালে ধর্মান্তরিত হয়ে আরব ইহুদীতে পরিণত হয়েছে। সম্ভবত তারা মূলত আরব জাতিভুক্ত; যারা হিব্রু ধর্ম গ্রহণ করে ইহুদী হয়েছিল। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সময়ে অপর যে ইহুদী গোষ্ঠী মদিনায় বসবাস করতো তারা বনু কায়নুকা গোষ্ঠীভুক্ত। আউস, খাযরাজ এবং ইহুদী গোষ্ঠীগুলো ছাড়াও মদিনা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরব গোত্রের বসবাস ছিল, যারা ইহুদী সম্প্রদায়ের পূর্বে এখানে বসতি স্থাপন করে।

হিজরতের পূর্বে (খ্রি. ৬২২), মদিনায় আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে রক্ষক্ষয়ী গোত্রীয় সংঘর্ষ অনুষ্ঠিত হয়, যা ‘হরব আল-হাতিব’ এবং পরবর্তী পর্যায়ে ‘হরব আল- বুয়াস’ নামে পরিচিত। খুব সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৬১৭ অব্দে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। গোত্রীয় কোন্দল ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক ছিল।

এ সমস্ত ঘটনা থেকে ধারণা করা যায় যে, মক্কার মত মদিনাতেও নানা ধরনের সামাজিক, গোত্রীয় ও অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল। কিন্তু মক্কার নগরবাসী ও মক্কাবাসী আরবদের মধ্যে সব সময় বৈষম্য দেখা দিত। এই বৈষম্যের মূলে ছিল শহরবাসীদের প্রাচুর্য এবং মরুবাসী বেদুঈনদের দারিদ্র্য। খাদ্যাভাব এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, বেদুঈনদের বাঁচার জন্য লুটতরাজ করতে হয়। এর ফলে গোত্রে গোত্রে লুটপাট, কোন্দল ও সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। ইয়াসরিববাসীগণ এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে এবং স্বাভাবিকভাবেই বিজেতারা পরাজিত শত্রুর সম্পদ দখল করত। হিজরতের পূর্বে সংঘটিত বুয়াসের যুদ্ধ রাতদিন চলেছিল, তা জানা যায় না এবং বুয়াসের যুদ্ধের পর কোন সন্ধি চুক্তি সম্পাদিত হয় নি, যার ফলে আউস ও খাযরাজ গোষ্ঠী সবসময় যুদ্ধাবস্থায় থাকত। এ কারণে উভয় গোষ্ঠীর লোকেরা সবসময় সতর্ক থাকত এবং নিজ নিজ এলাকা পাহারা দিত। যদিও খেজুর গাছের পরিচর্যা লাগে না, অন্যান্য কৃষিপণ্যের তুলনায়; তবুও অযত্নে থাকায় খেজুর গাছের ফলন বেশি হত না, এর ফলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। উপরন্তু, আউস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে সদ্ভাব না থাকায় তাদের কৃষি উৎপাদনও ব্যাহত হতে থাকে। খামার ও কৃষিক্ষেত্রে অবহেলিত হতে থাকে। মরুভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মেষ পালন যতটা সহজ মরূদ্যানের স্বল্প পরিমাণ জমিতে অযত্নের ফলে কৃষি উৎপাদন সীমিত হয়ে পড়ে নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য।

মরুভূমিতে যে সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল ইয়াসরিবে তাই বলবৎ ছিল। গোত্রপ্রথা অনুযায়ী প্রত্যেক গোত্র তার সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতো। অর্থাৎ রক্তের পরিবর্তে রক্ত অথবা খুনের ক্ষতিপূরণ (দিয়াত) প্রচলিত ছিল। যেহেতু প্রতিটি গোত্রের সদস্য স্বীয় প্রাণ দিয়ে তার সম্পত্তি রক্ষা করে সেহেতু গোত্র সংহতি বজায় থাকে এবং গোত্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কিন্তু মরুভূমিতে বিক্ষিপ্তভাবে বেদুঈনদের বসবাসের ফলে গোত্র ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা সম্ভব হয় না, ফলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এর স্থায়ীভাবে বসবাসকারী গোত্রীয় সদস্যগণ একটি কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় থাকেন। এর ফলে ব্যক্তির সাথে গোষ্ঠীর কোন কোন্দল দেখা দিলে সেটা সহজেই মিটানো সম্ভব। এ ধরনের কাজ মরুভূমিতে বসবাসকারী যাযাবরদের মধ্যে সম্ভবপর নয়। দুরত্বের জন্য শারীরিকভাবেই দূরত্ব। কারণ বেদুঈনগণ মরুভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করে।

মক্কায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠী একত্রিত হয় এবং এভাবে কুরাইশদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি হয়। অপরদিকে মদিনায় এ ধরনের কোন ঐক্য ও সংহতি দেখা যাবে না। কারণ পরিবারগুলো বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করে। এক একটি চাষী পরিবার নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে বসবাস করে। অন্যদিকে, মক্কায় বাণিজ্যিক পরিবেশে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিশেষ কার্যকরী হয় না। ব্যবসা-বাণিজ্য যেভাবে অর্থকরী কর্মকাণ্ডকে সুদূরপ্রসারী করে, যেমন মক্কায় কুরাইশগণ করেছিল; মরুপ্রধান আরবদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি তেমন করতে পারে না।

ইবনে সা’দ বিধর্মী কুরাইশদের বিরুদ্ধে বদরের যুদ্ধে (৬২৪ খ্রি.) যে সমস্ত মুসলিম মুজাহিদদের তালিকা দেন তার মধ্যে কুরাইশদের পনেরোটি গোত্র এবং আনসারদের (আউস ও খাযরাজ) মধ্যে তেত্রিশটি গোত্র, উপ-গোত্রের সদস্য ছিল। আউস ও খাযরাজদের এই গোত্র-উপগোত্র থেকে ধারণা করা যায় যে, কৃষিকাজের অস্বাভাবিক বিভাজন ছিল। মদিনার গোত্রগুলোর মধ্যে বিভাজন তাদের কুষ্ঠী বা বংশানুক্রমিক তালিকা থেকে উপলব্ধি করা যায়। এই তালিকা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, বদরের যুদ্ধে মোহাজেরদের তুলনায় আনসারদের সংখ্যা অধিক ছিল। পক্ষান্তরে, গোত্রগুলোর বিভাজন মদিনার মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ইঙ্গিত দেয়।

একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, হিজরতের পূর্বে মদিনা ছিল শতধাবিভক্ত। গোত্রকলহ, দ্বন্দ্ব ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ মদিনার অধিবাসীদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বিঘ্নিত করে। অপরদিকে তারা এমন একজন ব্যক্তিত্বের সন্ধানে ছিলেন যিনি তাদের রক্তপাত বন্ধ করে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবেন। যে কারণে মক্কায় হযরত মুহাম্মদ (স)-কে পৌত্তলিক কুরাইশদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়, ঠিক একই কারণে ইয়াসরিববাসী তাকে মদিনায় সাদরে অভ্যর্থনা জানায়। মক্কার তুলনায় মদিনায় ধর্মপ্রচারের পরিবেশ অনুকূল ছিল। ইহুদী সম্প্রদায় নবীর আগমন সম্বন্ধে জানত তাওরাত থেকে। উপরন্তু, মনমানসিকতার দিক থেকে মক্কাবাসীদের তুলনায় মদিনাবাসী ছিল উদার ও নম্রপ্রকৃতির। সূরা ইউনুসের (১০) ৪৭ আয়াতে বলা হয়েছে,

“প্রত্যেক জাতির জন্য আছে একজন রাসূল এবং যখন তাদের রাসূল এসেছে তখন ন্যায় বিচারের সাথে তাদের মীমাংসা হয়েছে এবং তাদের প্রতি জুলুম হয় নি।”

মদিনায় বিবদমান গোষ্ঠীদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা এক মহান কাজ। উপরোক্ত সূরায় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত রয়েছে। স্বীয় কুরাইশগোত্র থেকে বিতাড়িত ও পিতৃভূমি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে নবী স্বেচ্ছায় নির্বাসন গ্রহণ করেন মদিনায়। কৌলিন্যের ওপর ভিত্তি করে তিনি মদিনায় স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন নি, বরং ধর্মের ভিত্তিতে এবং কলহরত মদিনাবাসী তাকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গ্রহণ করে। আসারদের ধারণা হল যে, ইহুদী-খ্রিস্টানদের ধর্মমতে যে পরিত্রাণকর্তা (Messiah) আসার কথা, সম্ভবত তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)। এ কথা বিশ্বাস করেই তারা তাঁর সাথে সখ্যতা স্থাপন করে। যদি এ ধারণা বধ্যমূল হয়, তাহলে পরিত্রাণকর্তার আবির্ভাব বিবদমান আনসারদের (আউস ও খাযরাজ) মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং তাঁর মাধ্যমে এমন এক সম্প্রদায় সমাজ গঠনের চিন্তাভাবনা করে যিনি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।

আনসারদের হযরত মুহাম্মদ (স)-কে নবী হিসেবে গ্রহণ করার যথেষ্ট কারণ ছিল এবং এই কারণে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ইয়াসরিববাসী বিরাজমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও গোত্রীয় কোন্দল ও অস্থিরতা নিরসনের জন্য এমন এক ধর্মীয় ব্যক্তিকে খুঁজছিল, যিনি রক্তপাত বন্ধ করে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করতে পারবেন। আউস ও খাযরাজ গোত্রের মরুবাসী বেদুঈনদের মনমানসিকতায় উদ্বুদ্ধ জীবনের মান নির্ভর করে গোত্রীয় সম্মান ও ক্ষমতার ওপর। এই উদ্দেশ্য তখনই সফল হয় যখন গোত্র বা উপগোত্ৰ আকারে ছোট হয়। গোত্র বড় হলে, এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় না। এর কারণ, গোত্রীয় সদস্যদের বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ থাকে না। বেদুঈনদের জীবনে গোত্রের আকার যদি ছোট হয় তাহলেও নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করা সহজতর। ইয়াসরিবে ছোট খাট খুন-খারাবি চলতে থাকে। বনু খাযরাজের প্রভাবশালী সদস্য আবদুল্লাহ বিন উবাই বুয়াসের যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকেন, যাতে গোত্র কলহের প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ পায়। তিনি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। (আবদুল্লাহ বিন উবাই ছিলেন প্রভাবশালী পৌত্তলিক। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মদিনায় হিজরতের আগে তার মদিনার শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হবার কথা ছিল। কিন্তু ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার কারণে তার সে বাসনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পরবর্তীকালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেও রাসূলের বিরুদ্ধে তিনি ষড়যন্ত্র শুরু করে মোনাফেক দল গঠন করেন। বদরের যুদ্ধে ইহুদী- পৌত্তলিকদের সাথে যোগ-সাজসে তিনি ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হন।) ইয়াসরিবের এই সঙ্কটময় সামাজিক পরিস্থিতিতে ইসলামের বিধান ও বিশ্বাস ফলদায়ক হয়েছিল। ইসলামের রোজ কিয়ামতের ধারণা-যাতে পাপ-পূণ্য, শাস্তি পুরস্কারের কথা রয়েছে— আনসারদের মধ্যে বিশেষ প্রভাব ফেলে। এই মূলমন্ত্র মানুষকে ভাল হতে অনুপ্রেরণা দেয়। অর্থাৎ আদর্শ পাপমুক্ত জীবনযাপনে ইসলাম যে অনুপ্রেরণা দেয় তাতে অনেক আনসার প্রভাবান্বিত হন। অবশ্য অধিকাংশ আনসার পৌত্তলিকতার স্থলে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করে দীক্ষা লাভ করে। তারা হযরত মুহাম্মদ (স)-কেও আল্লাহর রাসূল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মনে করে আরব জাতিকে সৎ ও সত্যবাদিতার পথে পরিচালনার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) প্রেরিত হয়েছেন।

খ. আকাবার শপথ : ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, বুয়াসের যুদ্ধের পূর্বে গোত্রীয় কলহে আউস গোত্রের যে দুজনকে হত্যা করা হয় তারা মুসলমান ছিলেন। অর্থাৎ ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরতের পূর্বে এ দুজন নব-দীক্ষিত মুসলমান মৃত্যুবরণ করেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আনসারগণ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে পূর্ব থেকেই যোগাযোগ করেছেন। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে যে, হাজ্জ মৌসুমে ৬২০ খ্রিস্টাব্দে ইয়াসরিব থেকে আগত মক্কায় ছয় জন খাযরাজ গোত্রের সদস্য ইসলাম কবুল করেন। পরবর্তী বছর ৬২১ খ্রিস্টাব্দে হাজ্জ মৌসুমে দশ জন খাযরাজ ও দুজন আউস গোত্রের সদস্য নিয়ে মক্কায় আগমন করে ইসলাম কবুল করেন। তারা একেশ্বরবাদে বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং হযরত মুহাম্মদ (স)-কে রাসূল হিসেবে স্বীকৃতি দেন। মক্কা এবং মিনার মধ্যবর্তী আকাবা নামক স্থানে ৬২১ খ্রিস্টাব্দে নবী করিমের সাথে এক চুক্তি বা শপথ করে, যা ইতিহাসে যায় আত আল-আকাবা বা আকাবার প্রথম শপথ নামে পরিচিত। ওয়াট এটিকে ‘বায়াত আন-নিসা’ বা ‘মহিলাদের শপথ’ বলেছেন। তিনি এটিকে ‘বায়াত আন-নিসা’ কেন বলেছেন তা বোধগম্য নয়। এই বারজন ইয়াসরিবে ফিরে তাওহীদ প্রচারের অঙ্গীকার করে। হযরত মুহাম্মদ (স) ধর্মপ্রচারের সহায়তার জন্য মুসাব বিন উমাইর নামে তার এক ভক্ত সাহাবী ও ধার্মিক মুসলমানকে ইয়াসরিববাসীদের সাথে ইয়াসরিবে পাঠালেন। তারা ইয়াসরিবে পৌছে ধর্মপ্রচার শুরু করেন এবং আউস ও খাযরাজ গোত্রের মধ্যে যারা আল-মানাত দেবীর-যার মন্দির মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল-পূজা করত তাদের ব্যতীত আউস ও খাযরাজ গোত্রের অসংখ্য বিধর্মীকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় হাজ্জ উপলক্ষে ইয়াসরিব থেকে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা মুসলমান হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে রাতে গোপনীয়ভাবে সাক্ষাৎ করে ইয়াসরিবে হিজরত করার সাদর আমন্ত্রণ জানান। তারা শপথ গ্রহণ করে যে, আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন উপাস্য নেই, তারা হযরত মুহাম্মদ (স)-কে রাসূল হিসেবে মেনে চলবে। ইসলামের হুকুম-আহকাম নিয়মিত পালন করবে, শুধু তাই নয়-তারা প্রতিজ্ঞা করে যে, জীবন দিয়ে হলেও তারা হযরত মুহাম্মদ (স)-কে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করবে। এ কারণে আকাবার দ্বিতীয় শপথকে ‘বায়াত-আল-হারব’ বা যুদ্ধের শপথও বলা হয়। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চাচা আব্বাস এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাক্ষী হিসেবে। তিনি নিশ্চিত হন যে হাশিম গোত্রের নিরাপত্তা প্রদানের যে দায়িত্ব আবু তালিব পালন করেন তা আউস ও খাযরাজ গোত্রে যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে। ‘আকাবার শপথের ফলে ইতিহাসের ধারা পরিবর্তিত হল। ইসলামের যুগসন্ধিক্ষণে ইয়াসরিববাসীদের বজ্রকঠোর শপথ ইসলামের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

হযরত মুহাম্মদ (স) আউস ও খাযরাজ গোত্র থেকে বার জন প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন এবং তারা রাসূলের মদিনায় যাবার পূর্ব পর্যন্ত সেখানে তার প্রতিনিধিত্ব করেন। এই প্রতিনিধিদের বলা হত ‘নাকাবা’। গোপনীয়ভাবে শপথ সম্পাদিত হলেও বিধর্মী কুরাইশগণ আউস ও খাযরাজ গোত্রের নবদীক্ষিত মুসলমানদের সাথে নবীর সাক্ষাতের সংবাদ পায়। তারা বিধর্মী ইয়াসরিববাসীদের কাছ থেকে আকাবার শপথের সত্যতা যাচাই করে। তারা বলেন, যে সংবাদ সত্য নয়। যাহোক, পৌত্তলিক মক্কাবাসী হযরত মুহাম্মদ (স) এবং সাহাবীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর অনুসারীদের মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় যাবার পরামর্শ দেন। আবু সালমা নামে এক সাহাবী আকাবার শপথ সম্পাদিত হবার পূর্বেই ইয়াসরিবে হিজরত করেন। এভাবে হযরত মুহাম্মদ (স) সহ সত্তর জন মুসলমান মক্কা থেকে ইয়াসরিবে হিজরত করেন। ‘হিজরত’ অর্থ একস্থান থেকে অন্য স্থানে গমন, অভিবাসন। প্রকৃত শব্দ হচ্ছে ‘হেজিরা’ কিন্তু ভুলক্রমে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয় ‘পলায়ন’। পরবর্তীকালে হযরত ওমর ইবন খাত্তাব যখন দ্বিতীয় খলিফা হন তখন ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই থেকে প্রথম হিজরী সন হিসেবে প্রচলন করেন। এই তারিখ থেকে ইসলামের হিজরী সন গণনা শুরু হয়।

হিজরত প্রসঙ্গে চিরাচরিত যে বর্ণনা ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায় তার সাথে তাবারী প্রদত্ত উরওয়া বিন আজ-জুবাইয়েরের বিবরনের কতটুকু মিল আছে তা নিচের উদ্ধৃতি থেকে পরখ করা যায়।

“আবিসিনিয়া থেকে অনেক মুসলমান মক্কায় ফিরে আসার পর এবং মদিনায় হিজরতের অব্যবহিত পূর্বে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। মদিনার আনসারগণ হিজরতের পূর্বেই ধর্মান্তরিত হন। হিজরতের পূর্বেই মদিনায় ইসলাম প্রচার হয়। ইয়াসরিবের অধিবাসীগণ মক্কায় রাসূলের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন এবং ইসলাম কবুল করেন। এ সমস্ত ঘটনায় পৌত্তলিক কুরাইশগণ বিচলিত হয় এবং নব-দীক্ষিত মুসলমানদের ওপর পূর্ব-পুরুষের ধর্মে ফিরে যাবার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। কখনো কখনো পাপিষ্ঠ কুরাইশগণ মুসলমানদের বলপূর্বক হরণ করে তাদেরকে ইসলাম ধর্ম ত্যাগে চাপ দিতে থাকে। এভাবে নব-দীক্ষিত মুসলমানগণ (৬১৯- ৬২২ খ্রি.) অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়। এটি ফিতনার শেষ পর্যায় এবং এই ফিতনা দু’ভাবে এসেছিল। প্রথমত, নির্যাতন যখন চরমে উঠে তখন নবী (স) নব-দীক্ষিত মুসলমানদের আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বলেন জীবন রক্ষার জন্য। দ্বিতীয়ত, আবিসিনিয়া থেকে সরাসরি মদিনায় হিজরত (অবশ্য অনেকে আবিসিনিয়া থেকে মক্কায় ফিরে আসেন এবং অনেক পরে মদিনায় যান) করতে বলে। যাহোক, মক্কায় অবস্থানকালে, মদিনা থেকে ৭০ জন প্রতিনিধি যারা তাদের গোত্রের প্রধান ছিলেন, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। হাজ্জ মৌসুমে তারা রাসূলের সাথে আকাবার শপথ গ্রহণ করেন। তারা তাঁকে বলেন, “আমরা আপনার জন্য এবং আপনিও আমাদের জন্য। যদি আপনার কোন সাহাবী আমাদের কাছে (মদিনায়) আসেন তাহলে আমরা অবশ্যই তাকে রক্ষা করব। আমাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি থাকবে না। এরপর কুরাইশগণ উৎপীড়ন বৃদ্ধি করলে নবী তাঁর সঙ্গীদের মদিনায় হিজরত করার পরামর্শ দেন। তিনি নিজেও সেখানে যান। এ প্রসঙ্গে সূরা বাকারার ১৯৩ আয়াতে বলা হয়েছে—

“তোমরা তাদের (বিধর্মী) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে যতক্ষণ ফিতনা দূরীভূত না হয় এবং আল্লাহর দ্বীন-প্রতিষ্ঠিত না হয়।”

উরওয়ার বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি হযরত মুহাম্মদ (স) ও তাঁর উম্মতদের প্রতি কুরাইশদের অকথ্য নির্যাতনের উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, তিনি উমাইয়া বংশের বিরোধী গোত্র আল জুহায়েরের সদস্য ছিলেন। এ কারণে, তিনি নির্যাতনের বিশদ বিবরণ দেন এবং এর প্রভাব সম্বন্ধে বলেন। ওয়াট বলেন যে, উরওয়া নিরপেক্ষভাবে বর্ণনা দেন নি এবং ‘ফিতনা’ সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তাও মদিনার শেষ পর্বে অবতীর্ণ। এ কারণে, তার মতে, এই সূরার (বাকারার, ১৯৩ আয়াত) সাথে হিজরতের সম্পর্ক নেই। সম্ভবত ফিতনা শব্দটি অন্য কোন প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে। যাহোক, একথা বলা যায় যে, উরওয়ার বর্ণনার সাথে ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম ও ইবনে সা’দের বর্ণনায় যথেষ্ট মিল রয়েছে।

পশ্চিমা ঐতিহাসিকগণ (বেল, নলডেকে, বুহল) মনে করেন যে যেহেতু সর্বপ্রাচীন সূত্র, উরওয়ার বর্ণনা, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে ইয়াসরিববাসীর কোথায় ও কখন সাক্ষাৎ হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলেন নি সেহেতু দুটি সাক্ষাৎ (আকাবার শপথ) হয়েছিল কিনা, তাতে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবে তারা প্রথমটি, যা ‘বায়ত-আন নিসা’ (যার ব্যাখ্যা দেওয়া হয় নি) নামে অভিহিত এবং যার উল্লেখ কুরআনে রয়েছে (সূরা মুমতাহানা-৬০, ১২ নম্বর আয়াত) তা সঠিক বলে মনে করেন। শপথ যে হয়েছিল তা অবিশ্বাস করার উপায় নেই। তবে ওয়াট বিশ্বাস করেন যে, ইয়াসরিববাসীদের সাথে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সভা হয়েছিল। তিনি বলেন যে, আলাপ আলোচনা ও যোগাযোগ হয়েছিল। কিন্তু যোগাযোগ বা আলাপ আলোচনা একটি বিশেষ স্থানে যে হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই, স্থানটি ‘আকাবা’। প্রথম আকাবার শপথের পর ইয়াসরিববাসীদের সাথে নবী মুসাবকে পাঠান তার প্রতিনিধি হিসেবেই নয় বরং ধর্মশিক্ষক হিসেবে তাকে পাঠানো হয়। মুসআবের আর একটি দাযিত্ব ছিল, ইয়াসরিবের প্রকৃত পরিস্থিতি যাচাই করে রিপোর্ট করা। ওয়াট নিজেই স্বীকার করেন যে, প্রথম আকাবার শপথে ছয় জন খাযরাজ গোত্রের সদস্য হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে দেখা করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী আউস গোত্রের সদস্যের সাথেও কথা বলতে চান। এজন্য ৬২১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় আকাবার শপথ অনুষ্ঠানে আউস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা সমবেত হয়ে তাকে মদিনায় হিজরত করতে এবং সম্মানিত অতিথি হিসেবে সেখানে যেতে অনুরোধ করেন। একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ইয়াসরিববাসী আল্লাহর একত্ব, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুওয়াত ও ইসলাম ধর্ম কবুল করার পরেই নবী তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দেন। ওয়াট বলেন যে, হুদায়বিয়ার সন্ধির (খ্রি. ৬২৮) পর হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর নবুওয়াতের সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেন।

দ্বিতীয় আকাবার শপথ অনুষ্ঠান ইয়াসরিববাসী এবং হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মধ্যে চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবার পর হযরত মুহাম্মদ (স) স্বয়ং মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন। ৬২১ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত এই চুক্তির সময় বনু হাশামের তরফ থেকে রাসূলের চাচা আব্বাসের উপস্থিতি প্রসঙ্গে ওয়াট সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, আবু তালেবের মৃত্যুর পর আবু লাহাব হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রতি যে অসম্মানজনক ব্যবহার করেন তাতে বনু হাশিমের মানমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। আব্বাস সম্ভবত এ কারণে দ্বিতীয় আকাবার শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। যাহোক, নিজের বংশ বনু হাশিমের গোত্রীয় নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হলেও তায়েক থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পর নবী (স) বনু নওফেলের গোত্রীয় নিরাপত্তা লাভ করেন। ইবন আব্বাস প্রসঙ্গে ওয়াট অনেক যুক্তি দিয়ে বলতে চান যে, দ্বিতীয় আকাবার শপথ অনুষ্ঠানে আব্বাসের উপস্থিতি যিনি নবীর চাচা ছিলেন, পরবর্তীকালে আব্বাসীয় প্রচারণার ফল। যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে সে সময়ে আব্বাস পৌত্তলিক, না মুসলমান ছিলেন- সে সম্বন্ধে সন্দেহ রয়েছে। যদি পৌত্তলিক হয়ে থাকেন তাহলে বনু হাশিমের গোত্রীয় নিরাপত্তা না থাকায় তার উপস্থিতি অবান্তর। এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন যে, পৌত্তলিকতার চেয়ে গোত্রীয় মর্যাদা ও সম্মান অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে, হয়ত হিশাম গোত্রের তরফ থেকে আব্বাস আকাবার দ্বিতীয় শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্যাপিরাসে সংরক্ষিত ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিরের বর্ণনা অনুযায়ী ইবন আব্বাস আকাবায় যোগদান করেন। তার তথ্য অনুযায়ী সভায় আব্বাস হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। এরপর হযরত মুহাম্মদ (স) ইয়াসরিববাসীদের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধিকে তাদের বক্তব্য পেশ করতে বলেন। প্রতিনিধি বলেন যে আব্বাস (যিনি তখনও সম্ভবত পৌত্তলিক ছিলেন) অপেক্ষা তারা হযরত মুহাম্মদ (স)-কে অধিক শ্রদ্ধা ও সম্মান করেন। এ ধরনের মন্তব্য আব্বাসীয় স্বার্থবিরোধী বলে বিবেচিত হয়। ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিব পরিবেশিত তথ্য সঠিক নয়। পরবর্তীকালে আব্বাসীয় খিলাফতের সমর্থনে প্রচারিত তথ্য মিথ্যা প্রচারণা।

দ্বিতীয় আকাবার শপথের পর হযরত মুহাম্মদ (স) বারজন প্রতিনিধি ‘নুকাবা’ নিযুক্ত করে ইয়াসরিববাসীদের মধ্যে থেকে। এ ধরনের মন্তব্য ঐতিহাসিকভাবে কতটুকু সত্য, তা বলা যায় না। কারণ, ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, ইবনে সা’দ ও তাবারী তাদের তালিকা দেন নি। উপরন্তু, তারা ইয়াসরিব যাবার পর তাদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। পশ্চিমা দেশীয় ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, মুসা ও ঈসার যেমন প্রতিনিধি ছিল (হারুন, পল, পিটার), তেমনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মীয় কাজে সাহায্যকারী বা প্রতিনিধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়াহাব বলেন যে, দ্বিতীয় আকাবার শপথ অনুষ্ঠানে ইয়াসরিববাসীদের মধ্য থেকে নবীকে যেভাবে আশ্বস্ত করা হয় ঠিক অনুরূপভাবে ইসরাঈলী গোষ্ঠী মুসাকে আশ্বস্ত করেছিল। খ্রিস্টানদের মধ্যে হাওয়ারিউন গোত্রও ঈসা বিন মরিয়ামকেও একইভাবে সাহায্য ও সমর্থনের কথা বলে। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, বনু নাজ্জারের প্রতিনিধির মৃত্যু হলে নবী (স) স্বয়ং ‘নুকাবা’ বা প্রতিনিধির কাজ করেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিনিধিত্ব প্রথা তখনও চালু হয় নি (অনেক পরে ৬৩০-৬৩১ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় অবস্থানকালে বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মপ্রচারের জন্য প্রতিনিধি পাঠানো হয়; যার জন্য এই বছরকে প্রতিনিধির বছর বলা হয়েছে)। মক্কায় থাকাকালীন সময়ে মুসাব ছাড়া আর কোন প্রতিনিধি ইয়াসরিবে পাঠানো হয় নি।

দ্বিতীয় আকাবার শপথকে ‘বায়াত আল-হারব’ বা যুদ্ধের শপথ বলা হয়েছে। এই শপথ কতটুকু কার্যকরী ছিল তা বলা যায়। ওয়াটের সন্দেহ অমূলক। কারণ, পৌত্তলিক মক্কাবাসী কুরাইশদের সাথে বদর, উহুদ, খন্দকের যুদ্ধে নব-দীক্ষিত মদিনাবাসী যুদ্ধ করেন। মদিনাবাসী হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর সাহাবীদের শর্ত সাপেক্ষে মদিনায় আমন্ত্রণ এবং সাদরে অভ্যর্থনা জানান। মদিনাবাসী মক্কার ব্যাপক প্রভাব ও ক্ষমতার কথা জানতেন এবং সম্ভবত তা সীমিত করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স)-কে হিজরতের আহ্বান জানান। তারা জানতেন যে, গোত্র নিরাপত্তা হারিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কার অবাঞ্ছিত ব্যক্তিতে (Persona non grata) পরিণত হয়েছেন। সুতরাং মদিনায় আসলে তার মাধ্যমে মক্কার প্রভাব মদিনায় প্রসারিত হবে না। পক্ষান্তরে, হযরত মুহাম্মদ (স)- কে সমর্থন, সহযোগিতা, এমন কি তার পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইয়াসরিব বা মদিনাবাসী মক্কার ধনাঢ্য পৌত্তলিক কুরাইশদের প্রতি কি এক প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল?

উপরোক্ত প্রশ্নের জবাবে অনেক কথা চলে আসে। যেমন হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর সাহাবীদের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে বলার পিছনে কি কোন পরিকল্পনা ছিল, তারা মদিনায় গিয়ে কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে? তিনি কি তাদের স্থায়ীভাবে মদিনায় বসবাস করার জন্য বলেন, না সাময়িকভাবে? তারা কি সেখানে কৃষিকাজ করবেন? তারা কিভাবে জীবিকা অর্জন করবেন? বণিক হিসেবে, না কাফেলায় আক্রমণ করে লুটতরাজ করে? (এসব প্রশ্ন অবান্তর)। যাই হোক না কেন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হযরত মুহাম্মদ (স) উপলব্ধি করেন যে, ইসলাম বা একেশ্বরবাদের সাথে পৌত্তলিকতায় যে বিরোধ রয়েছে এবং পাপিষ্ঠ কুরাইশদের বৈরিতার মাত্রা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে- তা একদিন বিস্ফোরিত হয়ে সংঘর্ষে পরিনত হবে। মক্কাবাসীরা নবীর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বিশেষত ধর্মীয় ক্ষেত্রে অসামান্য প্রভাব বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে উঠে এবং মদিনা নতুন কর্মক্ষেত্রে পরিণত হলে তা আরও চরম আকার ধারণ করবে। কারণ, মুহাজির ও আনসারগণ একত্রিত হয়ে এক নতুন শক্তি বলয়ের সৃষ্টি করবে।

ক্যাটানীর ভাষ্য যে, মদিনাবাসী হযরত মুহাম্মদ (স)-কে নবী নয়, একজন ভবিষ্যদ্বক্তা ‘কাহিন’ হিসেবে আহ্বান জানিয়েছিল, তা সঠিক নয়। তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, ক্যাটানীর মতে, বিবদমান আউস ও খাযরাজ গোত্র দুটির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। তারা কুরআনের শিক্ষার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। ক্যাটানীর মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়, যদিও মুষ্টিমেয় কয়েকজন আউস ও খাযরাজ গোত্রের সদস্য শপথ অনুষ্ঠানে যোগদান করেন এবং তারা যে বৃহৎ গোষ্ঠী দুটির প্রতিনিধিত্ব করছেন এমন কোন প্রমাণ না থাকলেও পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে, পৌত্তলিক ইয়াসরিববাসী শুধু ধর্মান্তরিতই হয় নি, বরং তারা ইসলামকে রক্ষার জন্য শাহাদাত বরণ করেন। ওয়াট এক্ষেত্রে যথার্থই বলেন যে, পার্থিব ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যই প্রেরণা দেয় এবং এ দুটি উদ্দেশ্য পরস্পরবিরোধী নয় বরং সমর্থনসূচক। এমনও হতে পারে যে, হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর সাহাবীদের মদিনায় হিজরত প্রসঙ্গে মদিনাবাসীরা দু’দলে বিভক্ত হয়েছিল। একদল তাকে সমর্থন দেয় এবং অন্যদল তার বিরোধিতা করে। কোন কোন মদিনাবাসী, যেখানে ইহুদীদেরও বসবাস ছিল, কুরআনের ইহুদী, খ্রিস্টান মতবাদ, যেমন— একেশ্বর, নবুওয়াত ও শেষ বিচার তাদের পৌত্তলিক মনোভাবের আলোকে বিচার করে। ক্যাটানীর এ ধরনের মন্তব্য অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। এর কারণ, মদিনায় হিজরতের পর আনসার ও মুহাজিরদের নিয়ে তিনি মদিনা রাষ্ট্র গঠন করেন। শুধু তাই নয়, তিনি মদিনা সনদও প্রণয়ন করেন। ওয়াট যথার্থই বলেন যে, মদিনার অধিকাংশ লোক আল্লাহ ও রাসূলকে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক, শেষ বিচারের দিনের মালিক ও বিচারক। হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর প্রেরিত পুরুষ ও আল্লাহর একেশ্বরবাদের একনিষ্ঠ প্রচারক। একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে মক্কায় যা সম্ভব হয় নি মদিনায় তা বাস্তবায়িত হয়েছিল। অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহর গঠন হিজরতের পরেই সম্ভব হয়েছিল যারা তাওহীদের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ ছিল। মদিনার খুব কম অধিবাসী ধর্মীয় ব্যাপারে অতি উৎসাহী ছিল না, তবে তারা ধর্মভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, যা প্রাক-ইসলামী যুগে গোত্র-প্রীতি (আসহাবিয়া) গোত্র কৌলিন্যের ওপর ভিত্তি করে গঠিত ছিল।

৫. হিজরত

ইয়াসরিববাসীদের সমর্থন লাভ করে হযরত মুহাম্মদ (স) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আকাবার শপথের কথা সম্পূর্ণভাবে গোপন রাখা হয়, যাতে পৌত্তলিকেরা তাদের পাপাচারের মাত্রা বাড়াতে না পারে। তিনি তার সাহাবীদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মক্কা ছেড়ে মদিনায় যাবার আহ্বান জানান। ইবনে ইসহাক যথার্থই বলেন যে, মক্কা অপেক্ষা মদিনায় ধর্ম প্রচারের নতুন উৎসাহ ও উদ্দীপনা লাভের জন্যই নবী (স) তাঁর সাহাবীদের নিয়ে জন্মস্থান ত্যাগ করেন। উরওয়ার ভাষ্য যে, অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) হিরজত করেন। এ কথাটি আংশিক সত্য। কারণ, পূর্বের মত বিধর্মী মক্কাবাসী মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করে নি; বিশেষ করে হিজরতের পূর্বে। অবশ্য আবু সালামা নবী (স) ও তার উম্মতদের ওপর অপমানকর কটূক্তি করে। কিন্তু আকাবার শপথের গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে গেলে মক্কাবাসীরা নতুনভাবে নির্যাতন আরম্ভ করে। ওয়াট বলেন যে, নব-দীক্ষিত মুসলমানদের মদিনায় হিজরতের জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) কোন নির্দেশ বা হুকুম দেন নি; তিনি তাদের এবং ইসলামের স্বার্থে মদিনায় যাবার অনুপ্রেরণা দেন। তাঁর আহ্বানে মুসলমানগণ দলে দলে মদিনায় যেতে থাকে কিন্তু নুয়াইম আল-নাহাম নামে এক নব- দীক্ষিত মুসলিম মক্কা ত্যাগ করেন নি এবং যারা রাসূলের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেন তাদের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতার (apostasy) অভিযোগ আনা হয় নি। প্রথম দলে ৭০ জন মুসলমান হিজরত করেন এবং বিধর্মী কুরাইশদের কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই নির্বিঘ্নে মদিনায় পৌঁছান। মুহাজির হিসেবে তারা মদিনায় আনসারদের আর্থিত্য গ্রহণ করেন।

আরব ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ (স), আলী (রা) এবং আবু বকর (রা) মক্কায় অবস্থান করেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিলম্বের কারণ ছিল এই যে, তিনি চাচ্ছিলেন যে, তাঁর আগে তাঁর সাহাবীগণ মদিনায় গিয়ে বসতি স্থাপন করুক, যাতে তিনি সেখানে পৌঁছলে, মুহাজের ও আনসারদের সমভাবে সহযোগিতা লাভ করতে পারেন। তাছাড়া, তিনি নিশ্চিত হতে চান যে, প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ইয়াসরিববাসী নব-দীক্ষিত মুসলমানদের সাহায্য-সহযোগিতা করছে কিনা। তিনি আরও নিশ্চিত হতে চান যে, তাঁর পরামর্শে তাঁর উম্মতেরা মদিনায় হিজরত করছে। বিধর্মী কুরাইশগণ যখন দেখল যে দলে দলে মুসলমানগণ মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যাচ্ছেন তখন তারা বুঝতে পারল যে, হযরত মুহাম্মদ (স) কোন নতুন পরিকল্পনা নিয়েছেন। তারা গুপ্তচর নিয়োগ করে নিশ্চিত হল যে, মক্কার মুসলমনেরা রাসূলের আহ্বানে স্বদেশভূমি ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করছে। এ কারণে তারা একটি সভার আয়োজন করল এবং পাপিষ্ঠ আবু জেহেলের পরামর্শ মত প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন যুবক নিয়ে একটি ঘাতক বাহিনী গঠন করল। স্থির হল যে, এই যুবকের প্রত্যেকে তাদের তরবারির আঘাতে হযরত মুহাম্মদ (স)-কে হত্যা করবে একসাথে, যাতে হত্যার দায়িত্ব কোন একটি গোত্রের উপর না পড়ে এবং প্রকৃত ঘাতক ধরা না যায়। এই কাউন্সিলের সভায় যে নওফেল গোত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-কে গোত্রীয় নিরাপত্তা বিধান করেছিল তার সদস্যও উপস্থিত ছিল। গোত্র প্রধান এ সময় জীবিত ছিল, না মৃত তা বলা যায় না। এই সভায় গোত্র প্রধানের ভাই মুতয়িম বিন আদি এবং তার ছেলে জুবাইর বিন মুতয়িম যোগদান করেন। তাছাড়া, অন্যান্য যে সমস্ত বিধর্মী গোত্র থেকে ঘাতক যুবকদের সংগ্রহ করা হয়েছিল তা হচ্ছে আবদ শামস, আবদ দার, আসাদ, মাখযূম, শাহম এবং জুমা। ইবন ইসহাকের মতে, এ সমস্ত কুচক্রী যুবকরা রাসূলকে হত্যার পরিকল্পনা করে এই অজুহাতে যে, তিনি বিধর্মী কুরাইশদের ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছেন। পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করে যে, পৌত্তলিকদের ধ্বংসের কোন পরিকল্পনাই করছেন। পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করে যে, পৌত্তলিকদের ধ্বংসের কোন পরিকল্পনাই ছিল না। যাহোক, হযরত মুহাম্মদ (স) যখন বুঝতে পারলেন যে, কুরাইশগণ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে তখন অবিলম্বে মক্কা ত্যাগের আয়োজন করলেন।

কি ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন নবী (স)-বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে তা সঠিক জানা যায় না। তবে ঘাতক দলের পরিকল্পনা ইবন ইসহাক ব্যাখ্যা করেন। হযরত মুহাম্মদ (স) বুঝতে পারলেন যে, প্রকাশ্য দিবালোকে তিনি মক্কা ত্যাগ করলে বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন। এ কারণে তিনি আলী (রা)-কে তাঁর বিছানায় শায়িত করে আবু বকর (রা)-কে নিয়ে রাত্রে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। বিধর্মী যুবকেরা নবীর বাড়িতে এসে তার শয্যায় আলীকে দেখে অবাক ও হতাশ হল। তাঁকে না পেয়ে ঘাতকদল সারা শহরে খুঁজতে শুরু করল। ইত্যবসরে হযরত মুহাম্মদ (স) এবং আবু বকর (রা) মক্কার অদূরে সাওর নামে এক পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করেন। সেখানে তারা তিন দিন কাটান এবং এ সময়ে আবু বকরের ছেলে আবদুল্লাহ এবং মেয়ে আসমা তাঁদের খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করে। যখন আবু বকরের ছেলে আবদুল্লাহ সংবাদ দেয় যে, ঘাতকদল চলে গেছে, তখন নবী করিম আবু বকর (রা)-কে সঙ্গে নিয়ে দুটি পৃথক উটে চড়ে মদিনার পথে রওয়ানা হলেন। সঙ্গে ছিলেন আবু বকরের মুক্ত দাস আমির বিন ফুহাইরা এবং আদ-দুয়াইল বিন বকর গোত্রের আবদুল্লাহ বিন আরকাত নামে এক বেদুঈন গাইড। মক্কা থেকে মদিনার প্রচলিত পথে না গিয়ে ভিন্ন পথে অনেক দূর যাওয়ার পর তারা মদিনার সহজ ও নির্ধারিত পথে মদিনার উপকণ্ঠে পৌঁছলেন। স্থানটির নাম কুবা। তারা ১লা হিজরীর ১২ই রবিউল আওয়াল অর্থাৎ ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর তারিখে কুবায় পৌঁছান।

কুরআনের সূরা তাওবা (৯) ৪০ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে :

“যদি তোমরা (বিশ্বাসীগণ) তাকে (রাসূল) সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তো তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীগণ তাকে বহিষ্কার করেছিল (মক্কা থেকে) এবং সে ছিল দুই জনের (মুহাম্মদ এবং আবু বকর) একজন। যখন তারা গুহার (সত্তর) মধ্যে ছিল; সে (মুহাম্মদ) তার সঙ্গীকে বলেছিল, ‘বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ তো আমাদের সঙ্গে আছেন।

পৌত্তলিক কুরাইশদের ষড়যন্ত্রের কথা মদিনায় অবতীর্ণ সূরা আনফালের (৮) ৩০ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।

৬. মক্কায় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কৃতিত্ব

হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কর্মজীবনের মক্কা পর্বে প্রধান কৃতিত্ব হচ্ছে-এক নতুন ধর্ম প্রচার করা, যা ইসলাম নামে পরিচিতি লাভ করে। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, হিজরতের পূর্বে ধর্ম হিসেবে ইসলাম পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। যদিও সমগ্র আরবদেশে সম্প্রসারিত হয় নি। এমন কি ইসলামি অনুশাসন, রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠানাদি প্রাথমিক অবস্থাতেই রয়ে যায়। নামাজ, রোজা, হাজ্জ, যাকাত ইসলামের আরকান বা স্তম্ভ হিসেবে পূর্ণাঙ্গরূপে গ্রহণ না করলেও একেশ্বরবাদ, নবুওয়াত, পরকাল, বেহেস্ত ও দোজখ প্রভৃতি সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। মক্কায় অবতীর্ণ সূরা মুয্যাম্মিলের (৭৩) ২ থেকে ৪ নম্বর আয়াতে রাত্রিকালীন নামাজের ফজিলত সম্বন্ধে বলা হয়েছে :

“(ইবাদতের জন্য) রাত্রি জাগরণ কর, রাত্রির কিছু অংশ বাদ দিয়ে অর্ধরাত্রি (জেগে থাকতে পার) কিংবা তদপেক্ষা অল্প অথবা তদপেক্ষা বেশি।”

নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলাম ধর্ম যেহেতু পশ্চিম আরবের শহরবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচারিত হয় সেহেতু সামাজিক বিবর্তন হয়েছিল খুব দ্রুত। মক্কা ও মদিনায় যাযাবর মন- মানসিকতা কার্যকরী হয় নি। মক্কায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ঐক্য স্থাপনে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। অপর দিকে মদিনায় নৈতিক, আইন সংক্রান্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ঐক্য স্থাপনে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। অপর দিকে মদিনায় নৈতিক, আইন সংক্রান্ত সামাজিক কাঠামোর (মদিনা সনদ) প্রয়োজন ছিল। এক কথায় বলতে গেলে, ইসলাম যাযাবর বেদুঈন নৈতিকতাকে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জন্য উপযোগী করে তুলে, এর সাফল্যের কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা, যা দিয়ে তিনি আরব সমাজে বিবর্তন আনেন। প্রাক-ইসলামি যুগের কৌলিন্য প্রথা এবং রক্তের পবিত্রতার যে ধ্যান-ধারণা ছিল তা ধর্মের অনুশাসনে পরিবর্তিত হয়। কারণ, গোত্রপ্রথা রক্তপাত বন্ধ করতে পারে না। যেমন— একই বংশোদ্ভূত আউস ও খাযরাজ (বুয়াসের যুদ্ধ)। গোত্রীয় ঐক্যের সাথে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের (বেদুঈন) সংঘাত বাধে।

এমতাবস্থায় গোত্রীয় ঐক্য ও সংহতি স্থাপনের জন্য প্রয়োজন হয় একজন ধর্মীয় নেতা, আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ, যিনি সমাজের সংঘাত বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ একই ‘উম্মাহ’ সৃষ্টি করতে পারবেন। ইসলাম প্রচারের ফলে গোত্রগুলো ইসলামের ছায়াতলে একই জাতিতে (উম্মাহ) পরিণত হল। রক্তের কৌলিন্যের স্থলে ধর্মীয় বন্ধন অধিক কার্যকরী হল। উম্মাহর সদস্যগণ জাতি (কাওম) বা গোত্রপ্রথা ভুলে গিয়ে এক আল্লাহ, এক রাসূল (শেষ নবী), রোজ কিয়ামত, পাপ-পুণ্য এবং বেহেস্ত ও দোজখে বিশ্বাস করতে থাকে। মদিনা সনদে (খ্রি. ৬২৪) প্রথম শর্তে উল্লেখ আছে, “মদিনা সনদের স্বাক্ষরদানকারী ইহুদী, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক, মুসলমান সম্প্রদায়সমূহ সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি সাধারণ জাতি (উম্মাহ) গঠন করবে।”

জাতি গঠনের ধ্যান-ধারণা অনেক পরে মদিনায় বাস্তবায়িত হয়। তবে ধারণা করা যায় যে, হযরত মুহাম্মদ (স) যখন মক্কায় ইয়াসরিববাসীদের সাথে যোগাযোগ (আকাবা ) করছিলেন তখন থেকেই তিনি এ ধরনের চিন্তাভাবনা করছিলেন। প্রাথমিক হলেও হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মানসপটে এমন এক ধ্যান-ধারণার উদ্ভব হয়, যা পরবর্তীকালে আরব সম্প্রসারণের বৃহত্তর আন্দোলনের ভিত্তিরূপে পরিগণিত হয়। মক্কা পর্যায়ে তাঁর দূরদর্শিতার বিশালতা এবং সমযোপযোগিতায় প্রমাণ পাওয়া যায়—এই ধ্যান-ধারণায়, যা তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের পরিচায়ক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *