সপ্তম অধ্যায় – গীতিকাব্য

সপ্তম অধ্যায় – গীতিকাব্য

সুদূর অতীতে প্রাচীন সাহিত্যের পুরোভাগেই, ঋগ্বেদের উষাসূক্তে; অতঃপর রামায়ণের রাম ও সীতার দাম্পত্য জীবনের কারুণ্যের ও বেদনার অভিব্যক্তিতে মুক্তির আকুলতায় যেরূপ ছন্দবদ্ধ ভাবে কবি হৃদয়ের ঐকান্তিক ভাবের প্রকাশ ঘটেছে তাকেই বিদগ্ধ জনেরা গীতিকাব্যের মর্যাদা দিয়েছেন। প্রাচীন ভারতীয় আলঙ্কারিকের বিবেচনায় গীতিকাব্যের কোন সুস্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও মহাকাব্যের তুলনায় ক্ষুদ্রায়তন খণ্ডকাব্য বিশেষের উল্লেখ লক্ষ্যণীয়। সাহিত্য দর্পণকার বলেছেন- খণ্ডকাব্যং ভবেৎ কাৰ্যস্যৈকদেশানুসারিচ। অর্থাৎ মহাকাব্যের ন্যায় বিষয়বস্তুর সমারোহে বর্ণনার ঘনঘটায় সুসজ্জিত না হলেও কবি হৃদয়ের নিজস্ব ভাবনায় ও কল্পনার রঙে সজ্জিত সুষমা মণ্ডিত একটিমাত্র মূলভাবের স্বল্প পরিসরের যে কাব্য প্রকাশ তাই হল খণ্ডকাব্য। খণ্ডকাব্য কবির অমৃতময়, মধুময় হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্তঃ প্রকাশ। সাহিত্যদর্পণকারের এই ‘খণ্ডকাব্য’-ই পরবর্তী আধুনিক আলঙ্কারিকদের মতে ‘গীতি- কাব্য’। ইংরাজী সাহিত্যের লিরিক (Lyric) কথাটি এই গীতিকাব্যের দ্যোতক। ইংরাজী Lyre শব্দের অর্থ বীণারূপ বাদ্যযন্ত্র। এই বীণার ঝংকারে সুর তুলে যে গান করা হত, তার মধ্য দিয়ে শিল্পীর আনন্দ, বেদনা বিমিশ্র জীবনের উচ্ছ্বাস ফুটে উঠতো। সেই মন্ময় প্রকাশ গান না হয়েও যেন গান হয়ে উঠতো। সেইরূপ সংস্কৃত সাহিত্যের গীতিকবিতা গান না হয়েও গানের মতই ছন্দবদ্ধ, হৃদয়াবেগে আপ্লুত কবি কল্পনা প্রসূত এক অপূর্ব সুরমূর্ছনা। কালক্রমে গীতি না হয়েও ছন্দবদ্ধ কবিতাই গীতিকবিতা বা গীতিকাব্য বলে পরিচিত হতে থাকলো। গান যেমন সুরের মাদকতায় শ্রোতার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে এই জাতীয় কাব্যও পাঠক বা শ্রোতার মনকে এমন ভাবে অভিভূত করে তোলে যা তখন গান না হয়েও গীতিময় হয়ে ধরা দেয়। ব্যক্তি বিশেষের বা কবির নিজস্ব হৃদয়াবেগ, শিল্পিত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে যেন সকল শ্রোতার চেতনায় অনুরণিত হয়, এই হল সংস্কৃত সাহিত্যের খণ্ডকাব্য বা গীতিকাব্যের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য।

ইংরাজী Lyric অপেক্ষা সংস্কৃত গীতিকাব্যের বোধ, ভাব ও বিষয়ের পরিধি অনেক বেশী। মানব-মানবীর দেহজ প্রেমেই সীমাবদ্ধ না থেকে সে যা কিছু সুন্দর, যা-কিছু প্রিয়, যা-কিছু কাম্য এই সকল বিষয়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে। তাই সংস্কৃত গীতিকাব্য চতুর্বর্গের কামনা থেকে শুরু করে প্রকৃতি ও পুরুষের নানাবিধ তুচ্ছাতিতুচ্ছ উপাদানের মধ্যে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে।

গীতিকাব্যের প্রসঙ্গে ভূমিকার প্রারম্ভেই আমরা ঋগ্বেদের উষাসূক্তের উল্লেখ করেছি। সেখানে প্রকৃতি প্রেমিক ঋষি কবির কল্পনায় বারংবার ধরা পড়েছে অপূর্ব কাব্য সৌন্দর্য বোধ। Winternitz-এর মতে যমযমী-সংবাদ, পুরুরবা-উর্বশী সংবাদ ইত্যাদি সবই হল গীতি-কাব্যের এক একটি নিটোল মুক্তা। ‘Pearls of lyric poetry. এছাড়া রামায়ণের যুগ পার হয়ে অশ্বঘোষের সৌন্দরনন্দ, গণ্ডীস্তোত্রগাথায় কবি কল্পনা ও হৃদয়াবেগের পরিচয়ে গীতিকাব্যেরই লক্ষ্মণ সুস্পষ্ট। প্রাকৃত সাহিত্যের ইতিহাসে সাতবাহন রচিত গাথা সপ্তশতীও গীতি কাব্যের অন্যতম উদাহরণ বলা যায়। আরও পরবর্তীকালে কালিদাসের মেঘদূত ও ঋতুসংহারের মত সাহিত্যে গীতিকাব্যের দৃঢ়পদচারণা লক্ষ্য করা যায়। কবি জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দতে গীতিকাব্যের পরিপূর্ণ স্ফুরণ লক্ষ্য করা যায়। এতদ্ব্যতীত ভক্তি ও ধৰ্মমূলক কিছু lyric ও-দৃষ্ট হয়। ভর্তৃহরির শতক সমূহ, বাণ, ময়ুরের কাব্য, কতিপয় বৌদ্ধ রচনাও এই পর্যায়ভুক্ত। প্রেমিক প্রিমিকার অনিবার্য হৃদয়াবেগ স্বাভাবিক গতিতে উদ্বেলিত হয়ে তা কবির ভাষায় ছন্দময় গীতি কবিতা রূপে আত্মপ্রকাশ করে, সেক্ষেত্রে রচনা পরিপাট্য লক্ষ্যণীয় নয়, কবির প্রেমিক হৃদয়ের স্বরূপই লক্ষ্যণীয়। প্রথমদিকে এইরূপ রচনার প্রতিই কবিদের আগ্রহ প্রকাশ পেতে দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে কাব্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়ে যে সমস্ত কবিগণ ভাব, ভাষা, ও ছন্দের পাণ্ডিত্য প্রদর্শনে যত্নবান হয়েছেন তাদের গীতিকবিতায় ভাবের স্বতঃস্ফূর্ততা গেছে হারিয়ে।

কালিদাস বিরচিত ও অনবদ্য গীতিকাব্যদ্বয় :—

ঋতুসংহাব ও মেঘদূত।

ঋতুসংহার :মহাকবি কালিদাস সরল, সহজ ভাষায় ছয়টি ঋতুসম্বলিত বঙ্গের প্রকৃতি রাজ্যের অনন্য সাধারণ শোভার বর্ণনা করেছেন ‘ঋতুসংহার’ নামক গীতিকাব্যে। ‘সংহার’ এখানে সংক্ষেপ অর্থে। অর্থাৎ ঋতু বৈচিত্র্যের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে বলে এইরূপ নামকরণ। তবে কেবলমাত্র প্রকৃতিরাজ্যের বর্ণনা করেই কবি ক্ষান্ত হন নি। সেই সাথে প্রাণিজগতের লীলাবিলাস। তাঁদের হৃদয়ের হাসি- কান্না, আনন্দ-বেদনার সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিও তাঁর এই কাব্যের অন্যতম বিষয়। সর্বোপরি প্রকৃতির পট পরিবর্তনের সাথে সাথে মানব মনে যে পরিবর্তন লক্ষিত হয়, অর্থাৎ মানব মনে ও দেহে নানারূপ বাহ্য ও আর্ন্তবৈচিত্র্যও কবির কাব্যে ধরা পড়েছে। প্রকৃতির সাথে মানবের এই অদ্ভূত মেলবন্ধন কালিদাসের ঋতুসংহারকে এক উন্নত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছে।

গ্রীষ্ম থেকে বসন্ত এই ছয়টি ঋতু ক্রমান্বয়ে ছয়সর্গে মোট ১৫২টি শ্লোকে বিন্যস্ত। ঋতুসংহারের তরুণ কবি প্রকৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ বশতঃ প্রকৃতির সাথে মনোরাজ্যের মিলিত ভাবাবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে নিজ অনুভূতির কথা মানসী প্রিয়াকে ব্যক্ত করেছেন। গ্রীষ্মের দাবদাহে ধরণী শুষ্ক-রুক্ষ, একফোঁটা জলের জন্য প্রাণীকূল হাহাকার করে ওঠে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে প্রকৃতি যেমন তৃষিত ঠিক অনুরূপ ভাবে মানব-মানবীর মিলন পিয়াসী মনও বিরহ যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে থাকে। গ্রীষ্মের পরেই আসে বর্ষা। নব মেঘের উদয়ে আশার সঞ্চার হয় বিরহীর মনে। বর্ষার জলধারায় ধরণী সিক্ত হলে প্রাণীকূলও যেন প্রাণ ফিরে পায়, মিলন পিয়াসী মানব মানবীর অন্তরেও মিলনের আশা জেগে ওঠে। ময়ুর আনন্দে পেখম মেলে নৃত্য করে, ভ্রমরের পদ্মমধু পান, চাতক—চাতকীর আনন্দ-মুখরতা এই সবই বর্ষার আবির্ভাবে সম্ভব হয়। শরতের শিশির স্নাত প্রভাতের নির্মল রূপে প্রকৃতিধন্য হয়। মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ, বনে বনে কাশগুচ্ছ, আঙিনায় শ্বেতশুভ্র শেফালিকার মৃদু পদচারণা, সন্ধ্যায় চাদের শ্বেত শুভ্র আলো এবং সেই সাথে সুরভিত শীতল সমীরন কোন্ প্ৰেমিক প্রেমিকার মনকে না অকুল করে তোলে। হেমন্তের কুয়াশাচ্ছন্ন ঘোমটা টানা রূপের আঁড়ালে হেমন্তলক্ষ্মী তাঁর অকৃপণ দানে প্রতিটি গৃহস্থের মুখে হাসি ফোটায়। মাঠে মাঠে সোনার বরণ পাকা ধান। ধরণীতে বয়ে আনে নবজীবনের আশ্বাস। কন্কনে উত্তুরে বাতাস বয়ে আনে প্রচণ্ড শীত। গাছের পাতা ঝরিয়ে হাঁড় কাপানো শীত আসে বঙ্গে। কিন্তু মূলতঃ শৃঙ্গার রসের কবি এই শীতল দিনে কামনার সম্ভোগকেই বড় করে দেখেছেন। অবশেষে রঙ্গমঞ্চে ঋতুরাজ বসন্তের আবির্ভাব ঘটে। জীব, জড় সর্বত্রই এক গভীর আনন্দানুভূতি জেগে ওঠে। শীতের রিক্ততাকে পরিপূর্ণ করে রাজরাণীর বেশে আসে বসন্ত। শাখে শাখে নবকিশলয়, অশোক, পলাশ, শিমুলে রাঙা হয়ে ওঠে চারিদিক। কোকিলের কুহুতানে, ভ্রমরের গুঞ্জনে প্রকৃতি মুখর হয়ে ওঠে। প্রেমিক প্রেমিকার অন্তরে বসন্তের স্নিগ্ধ পদচারণা কবির কলমে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে ‘ঋতুসংহার’ শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ঋতুবৈচিত্র্যের বিবরণ নয়। এ হল প্রকৃতির সাথে সাথে প্রণয়-প্রণয়ী, প্রেমিক-প্রেমিকার মানস লোকের দেহজ কামসম্ভোগের এক অপূর্ব অভিব্যক্তি। এইখানেই ঋতুসংহারের সার্থকতা। বৈদিকযুগে ঋতুরঙ্গশালার বর্ণনার কোন আভাস আমরা পাই না। কিন্তু আদিকবি বাল্মীকি রামায়ণে যথাক্রমে অরণ্যকাণ্ডে—হেমবর্ণনা, কিষ্কিদ্ধাকাণ্ডে বর্ষা, শরৎ ও বসন্তের সুনিপুণ বর্ণনা রয়েছে। কালিদাস আদিকবি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন নিঃসন্দেহে তথাপি ঋতুবর্ণনার পাশাপাশি মানবমনের কামনা প্রবণ হৃদয়াবেগের বর্ণনায় রচনার মৌলিকতা লক্ষ্যণীয়। নানান অলঙ্কার যেমন উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, বিরোধাভাস, অর্থান্তর ন্যাস, ভ্রান্তিমান, শ্লেষ ইত্যাদি প্রয়োগের পাশাপাশি উপজাতি, বংশস্থবিল, উপেন্দ্রবজ্রা, মালিনী, বসপ্ততিলক, শার্দূল বিক্রীড়িত, প্রভৃতি ছন্দ প্রয়োগে ঋতুসংহার কাব্য রচিত হয়েছে। কবির পরিণত বয়সের রচনা, কুমার সম্ভব, রঘুবংশ ও অভিজ্ঞানশকুন্তলমে দেহজ কামসম্ভোগকে যে এক উন্নত আদর্শ প্রেমে উন্নীত হতে দেখা যায় ঋতুসংহারে তা অনুপস্থিত হলেও এই অপরিণত বয়সের রচনার মধ্যেই তাঁর পরিণত বয়সের কাব্য প্রতিভা বা কবিপ্রতিষ্ঠার বীজউপ্ত হয়েছিল বলা যায়।

যেহেতু মল্লিনাথ এই গ্রন্থের টীকা রচনা করেন নি এবং কোন বিখ্যাত আলঙ্কারিক ঋতুসংহার থেকে উদ্ধৃতি গ্রহণ করেননি সেহেতু কোন কোন পণ্ডিত, সাহিত্য সমালোচক ঋতুসংহারকে কালিদাসের রচনা বলে মেনে নিতে নারাজ ছিলেন। তাঁদের মতে ঋতুসংহারের রচনাশৈলী কালিদাসের অন্যান্য রচনার তুলনায় হীন। আবার ‘অক্তিকশ্চিদ বাগবিশেষঃ এই বাক্যাংশ কালিদাসের অন্যান্য রচনার প্রারম্ভে দেখা গেলেও ‘ঋতুসংহারে’ তা অনুপস্থিত। অতএব স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে আসে ঋতুসংহার কালিদাসের রচনা কি না? অধ্যাপক keith এই সমস্ত যুক্তির প্রতিবাদে বলেন— কোন কবির পরিণত বয়সের লেখা ও প্রথম বা তরুণ বয়সের লেখার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকাই স্বাভাবিক। বহু প্রতিষ্ঠিত কবির রচনাতেই এইরূপ প্রভেদ সুস্পষ্ট। অত্যন্ত সহজ, সরল, সাবলীল ভাষায় লেখা ঋতুসংহার পাঠক মাত্রেরই বোধগম্য, এই চিন্তা করেই মল্লিনাথ হয়ত-এর টীকা প্রণয়নে প্রবৃত্ত হন নি। সর্বোপরি তিনি মনে করেন ‘ঋতুসংহার’ কে যদি কালিদাসের রচনা তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় তাহলে কালিদাসের যশ অনেক খানিই ম্লান হয়ে পড়বে।

‘মেঘদূতম’ :–’মেঘদূত’ কালিদাসকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। এমন মৌলিক রচনার মধ্য দিয়েই বোধ করি কবি ও কাব্যের উৎকর্ষতা যাচাই করা সম্ভব। মেঘদূতের উৎস হিসাবে বাল্মীকির রামায়নের অংশ বিশেষকে চিহ্নিত করা যায়। সেখানে শ্রীরামচন্দ্র মহাবীর হনুমানকে দূতরূপে প্রেরণ করেছিলেন লংকায়, সীতাদেবীর নিকটে। অভিজ্ঞান স্বরূপ রামচন্দ্র প্রেরিত অঙ্গুরীয়ক প্রদান পূর্বক আশোককাননে বন্দিনী সীতার সাথে হনুমানের মিলন হয়। উৎস ‘রামায়ণ’ হলেও কবির কল্পনায় ও উপস্থাপনার অভিনবত্বে ‘মেঘদূত’ এক অনন্য সাধারণ কাব্য হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।

মেঘদূত ‘দ্যুত কাব্য’। দণ্ডীর অনুসারীগণ একে মহাকাব্য বললেও সাহিত্য দর্শনকারের বিভাগ অনুযায়ী মেঘদূত হল ‘খণ্ডকাব্য’ আধুনিক আলঙ্কারিকেরা মেঘদুতকে ‘গীতিকাব্য’ আখ্যা দিয়েছেন।

পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ এই দুই পর্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে’ কবি কালিদাসের প্রেমিক হৃদয়ের অপরূপ অভিব্যক্তি। কর্তব্যের অনবধানতায় প্রভু কুবেরের অভিশাপে অভিশপ্ত যক্ষ সুদূর রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত হয়েছেন। যে আশ্রমে রামসীতার স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। বর্ষার আগমনে— ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ বিরহী যক্ষের প্রাণ কেঁদে উঠছে অলকায় তার প্রিয়ার সাথে মিলনের আকাঙ্খায়। তাই তিনি প্রিয়ার নিকট প্রেম নিবেদনের উদ্দেশ্যে মেঘকে দূত হিসাবে প্রেরণ করেন। মেঘ বার্তা বয়ে নিয়ে যাবে যে পথ দিয়ে সে পথ যে কত মনোহারী তার অনবদ্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে কবি পূর্বমেঘের পর্যায় সম্পন্ন করেছেন। যক্ষ এখানে উপলক্ষ্য মাত্র। কবির অনুভূতিতে ঋতুচক্রের আবর্তনের সাথে সাথে মানব মনের প্রেমসম্ভোগের চিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে। ৬৪ নং শ্লোকপর্যন্ত পূর্বমেঘের বর্ণনা। পথে দূত যাবে বিরহীযক্ষের বার্তা নিয়ে অলকায় যক্ষপ্রিয়া মিলনে। সেই পথ কেবল জড় নয়, সেখানে প্রকৃতি মৌন নয়, পরন্তু মুখর। নদী পাহাড়-পর্বত-অরণ্যানীর সর্বত্র অনুভূত হয়েছে প্রাণের স্পন্দন। নদ-নদী সবই যেন কল্লোলিনী, স্রোতস্বিনী, প্রেমের রসে সতেজ প্রাণচঞ্চল। অতএব মেঘের যাত্রাপথে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র প্রাণবন্ত দৃশ্যাবলী, প্রেমের ফল্গুধারা বয়ে চলেছে বিরামহীন ভাবে। নব-পত্র পুষ্পে সুসজ্জিত সেই যাত্রাপথের সৌন্দর্যসুধায় অবগাহন করতঃ কবি মেঘকে অলকার উদ্দেশ্যে নিয়ে চলেছেন। যক্ষের বিরহ বেদনা গ্রীষ্মের প্রখর তাপে দগ্ধ হয়ে এখন আষাঢ়ের ধারায় স্নাত সিক্ত। প্রণয়ের অতৃপ্তি চিরকালই বিরহকে মহত্ব দান করেছে। অনেকে একে ‘অবদমিত প্রেমের কাব্য’ রূপেও আখ্যা দিয়েছেন। অতঃপর ‘উত্তরমেঘ’ পর্যায়ে কবি অলকাপুরীর বর্ণনা, বিরহিনী যক্ষপ্রিয়ার কামনা প্রবণ সাজসজ্জা, অনন্ত ঐশ্বর্য ও অসাধারণ রূপ যৌবনে সমৃদ্ধা প্রিয়ার অনুপম সাজসজ্জা, অপরূপ রূপলাবণ্যের বর্ণনা যেন গীতিকাব্যটিকে অসাধারণ করে তুলেছে। সেখানে প্রতিটি হংস শোভিত সরোবরে প্রস্ফুটিত পদ্ম পুষ্প, বণিতাদের হস্তে লীলাকমল শোভা পায়, খোপায় নব প্রস্ফুটিত কুন্দ-কুসুম, শ্বেতশুভ্র আনতমুখ মণ্ডল, কর্ণে শিরীষ ফুলের ঝুমকা, সিঁথিতে শোভা পাচ্ছে কদমফুল। ফুলে ভ্রমরের দল গুঞ্জন করে বেড়ায়, জ্যোৎস্নাস্নাত রজনী যেন মোহজাল বিস্তার করেছে। কিন্তু এহেন মনোরম পরিবেশও যক্ষের বিরহে ম্লান, বিষাদের কালোছায়ায় যেন যক্ষেরই বিরহ বেদনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। গবাক্ষ পথে গভীর উৎকণ্ঠায় অধোবদনা বিরহিনী যক্ষের একবেণী ধরা বিরহী প্রিয়াকে মেঘ যেন তার বার্তা পৌঁছে দেয়। দয়িতের সাথে প্রিয় মিলনের বার্তা পেয়ে সে প্রাণ ফিরে পাবে। তাদেরও একদিন বিরহের অবসানে মিলনের ক্ষণ উপস্থিত হবে এই আশ্বাস দিয়ে যেন তার প্রিয়াকে মেঘ বাঁচিয়ে রাখে। মানুষের চিরকাল সমান যায় না। অতএব দুঃখের অবসানে অবশ্যই মিলনের সুখ ভোগ সম্ভব হবে। সেইদিন মেঘমুক্ত নির্মল আকাশে চন্দ্রালোকে শুভ মিলন সমস্ত দুঃখ দূর করবে।

‘কস্যাত্যন্তং সুখমুপনতং দুঃখমেকান্ততো বা
নীচৈর্গচ্ছত্যুপরি চ দশা চক্রণেমিক্ৰমেন।’ (উত্তরমেঘ. ৪৮)

কাম্ভার বিরহ বেদনা যক্ষ আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছে। সেইহেতু যক্ষ আজ বিরহ বেদনার গভীর উপলব্ধি থেকে মনে মনে প্রার্থনা করেছে মেঘের যেন সেই দশা না হয়, তাকে যেন বিদ্যুৎ থেকে কখনো বিচ্ছেদ সহ্য করতে না হয়। “বিদ্যুৎ বিচ্ছেদ জীবনে না ঘটুক,” বন্ধু। বন্ধুর আশিস লও।’ (সত্যেন্দ্রনাথ দত্তঃ কালিদাসের মেঘদূত থেকে) এইভাবে যক্ষকে আশ্রয় করে কবির প্রেমিক মনের আকুলতা বক্ত হয়েছে সম্পূর্ণ মেঘদূতকে অবলম্বন করে।

গোড়াতেই আলোচনা করা হয়েছে যে রামায়ণ থেকে বিষয় গৃহীত হলেও মেঘদূত কিন্তু কবির মৌলিক রচনা। মেঘদূত কাব্যের মধ্য দিয়ে কেবলমাত্র যক্ষের বিরহ বেদনাই নয় সেই সাথে যেন সর্বকালের সকল নর-নারীর বিরহ-বেদনা ও প্রিয় মিলনের আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছে। বিরহেই মিলনের আনন্দ অনুভব করা যায়, কবি যেন সমস্ত নরনারীর আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, কামনা, বাসনা, আনন্দ বেদনাকে সাবলীল ভাব, ভাষা ও ছন্দের মধ্য দিয়ে পরিবেশন করেছেন। তাঁর কাব্যে একদিকে যেমন আছে তীব্র ভোগ সম্ভোগের আকাঙক্ষা তেমনি অন্য দিকে রয়েছে দুঃখ, বিরহ, বেদনা, তিতিক্ষা, ক্ষমা ও সংযম। তাই কালিদাসের ‘মেঘদূত’ জীবনদর্শনের সম্পূর্ণ পরিচয়। পূর্বমেঘ পাঠে ধরা পড়ে যে ভারতবর্ষের বাস্তব রূপের সাথে কবির কিরূপ সম্যক পরিচয় ছিল। কাব্যের খাতিরে তা কেবল প্রাণবন্ত ও রসগ্রাহী হয়ে উঠেছে। কারণ মেঘদূতের বর্ণনার সাথে মন্দাক্রান্তা ছন্দ যেন সত্যই অপূর্ব।

হৃদয়ের তন্ময়তা ও উদ্বেলিত আবেগই রোমান্টিক কবির রচনার মেঘদূতকে গীতিকাব্যের মর্যাদা দিয়েছে। সামালোচকের দৃষ্টিতে মেঘদূত একাধারে খণ্ডকাব্য, গীতিকাব্য, আবার দূতকাব্য। ‘মেঘদূত’ এমনই সার্থক রচনা যে তার অনুকরণে পঞ্চাশটিরও অধিক দূতকাব্য রচিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ঘটকর্পর রচিত ঘটকপব কাব্যের নাম করা যায়। ‘যমক’ রচনার উজ্জ্বল নিদর্শন এই কাব্য। তিনি একটি শ্লোকে বলেছিলেন যিনি আমাকে ‘যমক’ রচনায় পরাস্ত করবেন তাঁকে আমি ঘটে করে পা ধোয়ার জল এনে দেব। ধোয়ীর পবনদূত, ব্রজনাথের মনোদূত, কৃষ্ণানন্দের দেবদূত, এছাড়াও হংস সন্দেশ, উদ্ভব সন্দেশ, ভ্রমরদূত, কোকিলদূত, হংসদূত, কাকদূত, চকোরদূত, ইত্যাদি বহু দূতকাব্য সংস্কৃত দূতকাব্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। এমনকি জার্মান কবি শিলার (Sehiller) এর মেরিয়া স্টুয়ার্টও মেঘদূতের অনুকরণে রচিত।

মেঘদূতের টীকাকার মল্লিনাথ যথার্থই বলেছেন ‘মাঘে মেঘে গতং বয়ঃ’। অর্থাৎ মাঘের শিশুপালবধ ও কালিদাসের মেঘদূত এর টীকারচনা করতেই অনেক বয়স অতিক্রান্ত হয়ে গেল। মল্লিনাথ ব্যতীত বল্লভদেব, দক্ষিণাবর্তনাথ, স্থিরদেব, প্রভৃতি টীকাকার মেঘদূতের টীকা রচনা করেছেন। মেঘদূতের পঞ্চাশটিরও অধিক সংখ্যক টীকা ও বহু সংস্করণ তার জনপ্রিয়তারই পরিচয় বহন করে। এমন কি তীব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মাচার্যগণ এই প্রেমকাহিনীর অনুবাদ করে গেছেন। এর অনুকরণে বহু জৈন ধর্মাবলম্বীগণও তাদের মহাপুরুষদের জীবনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করেছেন।

অমরুশতক :—কালিদাসের পরে অমর কবির অমরুশতক গীতিকাব্যের এক অতি উজ্জ্বল নিদর্শন। সংস্কৃত সাহিত্যকাশে মুক্তক শ্লোক ও তন্নিবদ্ধ বহু শতক কাব্য শোভা পায়। মুক্তক হল পাঠকের মনোহারী ভাব সমৃদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ একক চতুষ্পদী কবিতা। অমরুশতক এর প্রতিটি শ্লোক যেন স্বয়ং সম্পূর্ণ। একে অপরের অপেক্ষ রাখে না। আলঙ্কারিকদের মতে—’মুক্তকং—শ্লোক এবৈকশ্চমৎকারক্ষমঃ সত্যম্।’ টীকাকার বাচস্পতি মিশ্র মনে করেন— ‘অন্যনিরপেক্ষ সুভাষিতই হল মুক্তক’।

এই স্বয়ংম্পূর্ণ মুক্তক শ্লোক বা শ্লোক সমষ্টিকে আধুনিক পণ্ডিতেরা সংস্কৃত সাহিত্যের ক্ষেত্রে গীতিকবিতা শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আলোচ্য মুক্তকের আঙ্গি কে নিরবিচ্ছিন্ন প্রেমকে উপজীব্য করে অমরুশতকের সৃষ্টি। কথিত আছে মণ্ডন মিশ্রের পত্নী ছিলেন ভারতী। তাঁর কাছে শঙ্করাচার্য রতিশাস্ত্র সংক্রান্ত বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় ছল করে অমরু নামক জনৈক রাজার মৃতদেহ আশ্রয় করে অন্তঃপুরে প্রবেশ করে রানীদের সাথে দীর্ঘায়িত রতিসুখ সম্ভোগের পরে একশত শ্লোকে এই অমরুশতক রচনা করেন। অতএব কাব্যে নিঃসন্দেহে শৃঙ্গার রসের প্রাবল্য থাকা স্বাভাবিক। শৃঙ্গার রসকে অবলম্বন করে পূর্বরাগ, মিলন, বিরহ, প্রিয়াসম্ভোগ মান, অভিমান ও প্রিয় প্রিয়ার নানান সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে ললিত পদবিন্যাসে, ভাষার তন্ময়তায়, অপূর্ব ভঙ্গিমায়।

অমরুকবি প্রথাগত উপাদান ও আঙ্গিকের ব্যবহার করলেও তাঁর রচনায় তিনি এমন এক জ্ঞানের দীপ্তি দান করলেন যার পরিণামে পরবর্তীকালে শতক কাব্যগুলি অনেক বেশী মাধুর্য মণ্ডিত ও পরম আস্বাদনীয় হয়ে উঠল। অমরু কবির রচনায় কোথাও কোথাও দীর্ঘসমাসবদ্ধ পদ চোখে পড়লেও তা কখনই তাঁর রচনাকে আড়ষ্ট করে তোলেনি। অন্ধরা, বসপ্ততিলক, দ্রুতবিলম্বিত, শিখরিণী প্রভৃতি ছন্দের সার্থক প্রয়োগে অমরুশতক পাঠকের চিত্ত জয় করেছে। শৃঙ্গারের এমন অনায়াস পরিবেশন যেন পাঠককে নিয়ে যায় তরুন বয়সের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা বিমিশ্র জীবনের অমৃতলোকে।

শৃঙ্গাররসাত্মক কাব্যে সিদ্ধহস্ত কবি অমরুর প্রশংসা করে অর্জুনবর্মদেব বলেছেন-

‘অমরুককবিত্বডমরু কণাদেন বিনিতা ন সঞ্চরতি।
শৃঙ্গার ভণিতিরণ্যা ধণ্যানং শ্রবণবিবরেষু।’

অর্থাৎ অমরুকবির কবিত্বে ডমরুনাদ এমনই যাতে করে বধির ভাগ্যবানদের শ্রবণেন্দ্রিয়ে অন্য কোন কবিগণের শৃঙ্গার রসাত্মক বাক্য প্রবেশে বাধা পায়।

দুঃখের বিষয় এই যে কবির জীবনবৃত্তান্ত আমাদের অজ্ঞাত, ধ্বন্যালোক নামক অলঙ্কার গ্রন্থে নবমশতকে ও তৎ পরবর্ত্তী বহু গ্রন্থে তাঁর শ্লোকগুলি দৃষ্ট হয়। এবং বামন ও আনন্দবর্ধনের গ্রন্থে তাঁর কবিতা ও নাম উল্লেখ প্রমাণ করে যে তিনি ৮ম শতকের পূর্ববর্তী সময়ে অর্থাৎ সপ্তম শতকের শেষ ভাগে বিদ্যমান ছিলেন।

শতকত্রয় :—

শতক কাব্য রচনায় ভর্তৃহরিও জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। তাঁর রচিত শতক-ত্রয় যথাক্রমে—শৃঙ্গারশতক, নীতিশতক, ও বৈরাগ্যশতক নামে পরিচিত। তবে ভর্তৃহরির পরিচয় ও আবির্ভাব কালও-অমরু কবির ন্যায় অজানা। সঠিক পরিচয় ও কাল নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়ে তাঁর অনুরাগীগণ নানান কিংবদন্তী ও অনুমানের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এমন কি তাঁর রচনাসমূহ নিয়েও বহু মতান্তর দৃষ্ট হয়। Maxmullar এর মতে ‘বাক্যপদীয়’ নামক ব্যাকরণগ্রন্থের রচয়িতাই শতক—ায়ের রচয়িতা।’ আবার আলোচ্য ভর্তৃহরিই যে ভট্টিকাব্যের রচয়িতা এই মতও অনেকে পোষণ করেন। মেরুতুঙ্গের ‘প্রবন্ধচিত্তামণি’ অনুযায়ী রাজা বিক্রমাদিত্য ও কবি দুই ভাই ছিলেন। চীনা পরিব্রাজক ইৎসিং-তার বিবরণে ষষ্ঠশতকে বৈয়াকরণ ভর্তৃহরির মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু নিশ্চিত প্রমাণের অভাবে এই সমস্ত তথ্যই অনুমান নির্ভর। ভর্তৃহরি ছিলেন একাধারে বৈয়াকরণ, দার্শনিক ও সফল কবি। ষষ্ঠ শতকের শেষে হয়ত তিনি বিদ্যমান ছিলেন। কিংবদন্তী আছে কবি তাঁর পত্নীর ব্যবহারে মর্মাহত হয়ে সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে সংসার ত্যাগ করে বৌদ্ধ সন্ন্যাস অবলম্বন করে চলে যান। পরবর্তী কালে সংসারে প্রত্যাগমন করেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর রচিত শতকত্রয়ে কবির বাস্তবজীবনের ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে। অমরু কবি ও ভর্তৃহরি দুই কবিই শৃঙ্গার রসাত্মক কাব্য রচনা করেছেন কিন্তু অমরু কবির কবিতায় জীবনের রসবোধ ও বৈচিত্র্যের মধ্যে শৃঙ্গারের বিচিত্র বিচরণ প্রকাশ পায়। তিনি দেখিয়েছেন প্রেমেই প্রেমের আসল পরিচয়। প্রেম নিজের মধ্যেই নিজে প্রকাশিত, বিকশিত, সম্পূর্ণ। কিন্তু ভর্তৃহরি শৃঙ্গারকে জীবনের নানাবিধ উপাদানের একটি বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর রচনায় পদে পদে তাঁর বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে। ফলে প্রেমের মধুরতার পাশাপাশি জীবনের রুক্ষতা, কঠোরতাও যে কোন অংশে কম নয়, তাকেও যে অস্বীকার করা যায় না, তাই তিনি তাঁর কাব্যের মধ্যে দেখিয়েছেন। ভর্তৃহরি শৃঙ্গারের পাশাপাশি নারীর বহুমুখী চরিত্রের চিত্র উন্মোচন করেছেন। কাম হল রতির মূলে অবস্থিত, রক্ত মাংসের দেহকে কেন্দ্র করেই সেই কামের প্রকাশ। কবি বিশ্বাস করতেন সমগ্র ইন্দ্রিয়ের দ্বারা কাম দেহে প্রবেশ করে এবং এমনই এক বিশুদ্ধ প্রেমে উত্তীর্ণ হয়। এই যৌন সম্পর্কের ভিত্তিতেই সমাজচেতনায় নারী হল সম্ভোগের বিষয়। সেই নারীকে তিনি নানান দৃষ্টি কোন্ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। নারীকে তিনি জীবনের সমস্ত আনন্দ, বেদনা, ভোগ, কামনা বাসনার সার বিষয় বলেছেন। তাঁর বিচারে নারী হল মোহময়ী, নারীর ছলাকলায় পুরুষ আকৃষ্ট হয়, বিভ্রান্ত হয়, সেই অর্থে নারীর হাসি কান্না, সুখ-দুঃখ ভাব-ভাবনা সবই হল পুরুষের বন্ধন। স্বয়ং ব্রহ্মাও রমনীর ছলাকলায় বিভ্রান্ত। নারীর পরস্পর বিরোধী এই রূপ – সোহাগে সে হয় সুধাসরসী, আবার বিরাগে বিষ বল্লরী। তাই কবি বলেছেন-

সম্মোহয়ক্তি মদয়ক্তি বিড়ম্বয়ক্তি
নির্ভৎসয়ত্তি রময়ত্তি বিষাদয়ত্তি।
এতাঃ প্রবিশ্য হৃদয়ং সদয়ং নরাণাং
কিং নাম বামনয়না ন সমাচরস্তি।। শ.এ.পৃ:—২১

অর্থাৎ নারী মুগ্ধ করে, আকর্ষণ করে, বিড়ম্বনা করে, ভর্ৎসনা করে, নারী আনন্দদায়িনী আবার দুঃখদায়িণীও বটে

কেবলমাত্র দেহজ কামকেই তিনি রচনার উপাদান করেননি। তিনি নারী হৃদয়ের মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের দিকেও আলোকপাত করেছেন। জীবনের বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে তিনি প্রেমের মাধুর্যের পাশাপাশি প্রেমের জটিলতাকেও প্রকাশ করেছেন।

বৈরাগ্য শতক :—ইন্দ্রিয়সুখের অসাড়তা, সকলপ্রকার ভোগের অসাড়তা, ষড়রিপুর দোষ, জাগতিক বিষয়ের ক্ষণিকতা ও সেই সাথে তত্ত্বজ্ঞান ও পারমার্থিক চিন্তা ও চেতনার কথাই পরিবেশিত হয়েছে এই বৈরাগ্যশতকে। শৃঙ্গারশতকের কবি এখানে বলছেন—সংসারের প্রতি মোহ কিরূপ মিথ্যা, অমূলক, অস্থায়ী। বৈরাগ্যের দৃষ্টিতে নর নারীর রূপ যৌবন সকলই অন্তঃসারশূন্য, বৃথাই মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। জীবন ও যৌবন সবই তো ক্ষণস্থায়ী, অতএব কালক্ষেপ না করে পরম শিবের প্রতি চিত্ত আকৃষ্ট করতে পারলে তবেই মন শান্ত ও সমাহিত হবে, মনে আধ্যাত্ত্ববোধের উদয় হবে। চিত্ত নির্বেদ হলে সেই নির্বেদ থেকেই বৈরাগ্যের উদয় হবে। এবং আধ্যাত্ম- প্রভাবের ফলে এক দিব্য জ্ঞান ও দিব্য ভাবে চিত্ত চমৎকৃত হবে। মানুষের আয়ু স্বল্প এবং অনিশ্চিতও বটে, অতএব জীবন যৌবন-ধন-সম্পত্তি-বিষয়-বাসনা এ সবই বিদ্যুতের মতই ক্ষণস্থায়ী, সেই ক্ষণস্থায়ী জাগতিক বিষয়ের প্রতি নিজেকে আবদ্ধ না রেখে বৈরাগ্য সাধনের মধ্য দিয়েই জীবনে শিবের মহিমাগানের সাথে সাথে মুক্তি লাভের জন্য সচেস্ট হওয়া উচিৎ।

নীতশতক :–ন্যায় নীতির জয় ও অন্যায় দূর্নীতির পরাজয় কবির এই অভিপ্ৰায়ই ছিল নীতিশতকের মূলে। এক্ষেত্রেও কবি ভোগের অসাড়তা বর্ণনা করে ত্যাগের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন। সেই সাথে সত্য ভাষণ, সদাচার, প্রভৃতি সৎগুণের পাশাপাশি মানুষকে সাহসী, উদ্যমী-ও পরোপকারী হতে উপদেশ দিয়েছেন।

অতিশয় সৎব্যাক্তির চরিত্র কিভাবে গৌরবান্বিত হয়ে থাকে সেই প্রসঙ্গে কবি বলেছেন-

ঐশ্বর্যস্য বিভূষণং সুজনতা শৌর্যস্য বা সংযমো
জ্ঞানয্যোপশঃ শ্রুতস্য বিনয়ো বিত্তস্য পাত্রে ব্যয়ঃ॥

অক্রোধস্তুপসঃ ক্ষমা প্রভবিতুর্ধর্মস্য নির্ব্যাজতা
সর্বেষামপি সর্বকারণমিদং শীলং পরং ভূষণম্।।

কবি ভর্তৃহরির মতে সৎসঙ্গ হল সর্বপ্রকার গুণের আকর স্বরূপ, সেইহেতু সৎসংসর্গের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বলেছেন-

জাড্যং ধিয়োহরতি, সিঞ্চতি বাচিসত্যং
মানোন্নতিং দিশতি পাপমপাকরোতি
চেতঃ প্রসাদয়তি দিক্ষু তনোতি কীর্তিং
সৎসঙ্গতিঃ কথয় কিং ন করোতি পুংসাম্॥ শ.এ.পৃ.-৮১

বৈরাগ্য শতক ও নীতিশতক পাঠের মধ্যদিয়ে পাঠক সমাজ জীবন সম্বন্ধে বহু উপদেশ লাভ করতে পারেন ও জীবনকে সঠিক পথে পরিচলনার মধ্যে সুখ ও শান্তি লাভে সমর্থ হন। বিদেশী পণ্ডিত keith এর মতে অমরুর রচনায় কাব্যের শিল্পিত রূপের পরিবেশন চোখে পড়ার মত। কিন্তু ভর্তৃহরি-তার রচনায় ভাবের গভীরতা ও বাস্তবমুখীতার পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।

ভর্তৃহরির শতকের প্রায় ১২টির ও অধিক টীকা রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে রামচন্দ্র, ইন্দ্রজিৎ, রামশ্রী ও গুণ বিনয়ের টীকা প্রসিদ্ধ। নীতিশতকের টীকা লিখেছেন মহাদেব। পরবর্তী কালে বহুকবি এই শতক কাব্যের অনুপ্রেণায় ও অনুকরণে শতককাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। তন্মেধ্যে বৈরাগ্যশতকের অনুকরণে রচিত কবি সিণ এর শান্তিশতক। কাশ্মীরীয় কবি ভল্লট এর অনধিক শতশ্লোকে ভল্লটশতক। যদিও তাঁর রচনা অন্যোক্তি কাব্যের বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। ভন্নটের রচনা নিজস্ব ভাব-ভাবনা কে কেন্দ্র করে ভাষার গাম্ভির্যে, অলঙ্কার ও ছন্দের মাধুর্যে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। ধ্বনিকার আচার্য আনন্দ বর্ধন তাঁর ধ্বন্যালোক গ্রন্থে ভন্নটের রচনা থেকে উদ্ধৃতি গ্রহণ করেছেন।[১০]

এতদ্ব্যতীত শৃঙ্গারকে কেন্দ্র করে বহু শৃঙ্গারশতক যেমন জনার্দন ভট্টের শৃঙ্গার শতক। নরহরির শৃঙ্গারশতক, রামচন্দ্র কবির রোমাবলীশতক, রুদ্রকবির শৃঙ্গারতিলক। তবে সোমপ্রভাচার্যের শৃঙ্গার বৈরাগ্য তরঙ্গিণী ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাতাবরণে রচিত। আদিরসাত্মক একখানি ক্ষুদ্রাকার কাব্য অর্থাৎ ছন্দেরচিত শৃঙ্গারসাষ্টক : লিদাসের রচনা বলে প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কবি আদিরসের ভাব-ভাব বিরহীর দুঃখ যন্ত্রণাকাতর মূর্ত্তীকে ফুটিয়ে তুলেছেন। একাধিক টীকা ও বহুসংখ্যক শ ঠককাব্যই ভর্তৃহরির সাফল্যকে সূচিত করে।

চৌরপঞ্চাশিকা :—কবি বিল্‌হন্ রচিত চৌর পঞ্চাশিকা অপর এক আদিরসাত্মক কাব্য। এই কাব্যের অপর নাম চৌরীসুরত পঞ্চাশিকা। কল্যাণরাজ বিক্রমাদিত্য ত্রিভুবন মল্লের রাজসভা অলঙ্কৃত করে ছিলেন (১০৭৬-১১২৭খ্রি.)। কবি নানাদেশ ভ্রমণ করে বেড়াতেন। একদা গুজরাটের রাজা বৈরিসিংহের কন্যা রাজকুমারী চন্দ্রলেখা গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত হলেন। শিক্ষক ও ছাত্রী পরস্পরের রূপে আকৃষ্ট হয়ে প্রণয়াসক্ত হয়েছেন জেনে চন্দ্রলেখার পিতা শিক্ষককে মৃত্যুর আদেশ দেন। এমত অবস্থায় বধ্যভূমিতে আনীত হয়ে কবি তার প্রণয়ী চন্দ্রলেখার উদ্দেশ্যে মুখে মুখে পঞ্চাশটি শ্লোক রচনা করেন। ঘাতকগণের মুখে সেই সংবাদ শোনামাত্র রাজা স্যোৎসাহে কন্যাকে তাঁর হাতে সমর্পণ করেন। প্রতিটি শ্লোকের শুরুতে অদ্যাপি তাং’ এবং শেষে ‘চিন্ত্যয়ামি’ ‘স্মরামি’ ইত্যাদি শব্দ বিদ্যমান।” তরুণ কবিকে প্রেমের অপূর্ণতা যখন গ্রাস করছে, অতৃপ্ত কামনা-বাসনায় ভর করে বধ্য ভূমিতে উপস্থিত। সেই মুহূর্তে কবির প্রেমিক হৃদয়ের একান্ত প্রার্থনা—যেন জন্মজন্মান্তরে তার এই প্রেম বেঁচে থাকে, যেন তার বাসনা চরিতার্থ হয়, ‘জন্মস্তরেঽপি মম সৈব গতিধা স্যাৎ।’ যদি মৃত্যুও বরণ করতে হয়। তবে সে মৃত্যু হবে স্বর্গের সমান।

রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি অলঙ্কারে সুসজ্জিত কাব্যটি কখনই দীর্ঘসমাস অথবা ব্যাকরণের আড়ম্বরে আড়ষ্ট নয়। উপরন্তু বর্ণনা নৈপুণ্য, ভাষার প্রাঞ্জল্য সুধী, পাঠক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

লক্ষ্মণসেনের সভাকবি নীলাম্বর সোমযাজীর পুত্র গোবর্ধন সাতশত শ্লোকে প্রাকৃত ভাষায় আর্যাসপ্তশতী রচনা করেছিলেন। হালের সপ্তশতীর অনুকরণে আর্যাছন্দে ময়ূরভট্টের সূর্য শতক, বীরেশ্বর রচিত অন্যোক্তি শতকও এই শ্রেণির রচনা। এই প্রসঙ্গে মহাকবি বাণভট্ট রচিত চণ্ডীশতকও উল্লেখের দাবীরাখে। চণ্ডীর স্তুতি এখানে মুখ্য বিষয় হলেও গীতিময়তার প্রভাবে তা গীতিকাব্যের মর্যাদা পেয়েছে।

গীতগোবিন্দ :—দ্বাদশ শতাব্দীতে গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণের রাজসভায় ধোয়ী, গোবৰ্দ্ধন, শরণ, উমাপতি ও জয়দেব বিদ্যমান ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমজেলার অন্তর্গত কেন্দুবিশ্ব গ্রামে কবি জয়দেব জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মাতা বামাদেবী ও পিতা ছিলেন ভোজদেব। পত্নী পদ্মাবতী। অজয় নদী তীরস্থ কেন্দুবিশ্ব গ্রাম আজও কবির মহিমায় ও মাহাত্ম্যে উজ্জ্বল। ভাগবতের দ্বাদশ স্কন্ধের অনুকরণে দ্বাদশ সর্গে এবং গায়ত্রীর চতুর্বিংশ অক্ষরের অনুকরণে চতুর্বিংশ অষ্টাপদীতে রাধাকৃষ্ণের চিরন্তন প্রেমলীলাকে উপজীব্য করে গীতগোবিন্দ রচিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার প্রেমলীলাকে উপজীব্য করে ললিত পদ বিন্যাসে কাম্ভকোমল পদে কবি জয়দেব সমগ্র ভারতবাসীকে যা উপহার দিয়েছেন তা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভাবের গাম্ভীর্যে ভাষার প্রাঞ্জলতায় ও সর্বোপরি রচনা পরিপাট্যে গীতিকবিতাটি যেন প্রতিটি নরনারীর পরম আদরণীয় হয়ে উঠেছে। বৈষ্ণবগণ গীতগোবিন্দকে সাধারণ কাব্য ভাবতে নারাজ। তাদের মতে এইটি হল দার্শনিক মহাকাব্য। এই কাব্যে ৮০টি শ্লোক ও ২৪টি গান রয়েছে। সমগ্র কাব্যটি দ্বাদশসর্গে বিভক্ত। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা, ক্রমশঃ বিরহ- বেদনা, মান-অভিমান, মানভঞ্জন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে—অগ্রসর হয়ে শেষে হর্ষোল্লাসের মধ্য দিয়ে রাধা কৃষ্ণের, মিলন বিলাস বর্ণিত হয়েছে। কবির রচনায় সাৰ্থক পদচয়ন ও পদবিন্যাস যেন পাঠককে মোহিত করে তোলে। বিশেষতঃ বাংলা ভাষারই ন্যায় সহজ সরল শব্দ বন্ধন এবং ছন্দের মিল তথা অন্তঃমিল লক্ষ্যণীয়। সরস বসন্ত বর্ণনায় কবি বলছেন—

ললিতলবঙ্গলতা পরিশীলন কোমলমলয়সমীরে।
মধুকরনিকর করন্বিত কোকিল-কূজিত কুঞ্জকুটীরে।
বিহরতি হরিরিহ সরস সঙ্গে।
নৃত্যতি যুবতি জানন সমংসখি বিরহীজনস্যদূরত্বে।

ভাবের মাধুর্যে ও গভীর অভিব্যক্তির ব্যাঞ্জনায় কবি যে কতদূর সার্থক ছিলেন তা ধরা পড়ে আলোচ্য উক্তিসমূহের মধ্য দিয়ে-’ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মমজীবনং ত্বমসি মম ভবজলধিরত্নম্। অর্থাৎ স্মর গরল খণ্ডণং মম শিরসি মণ্ডনং দেহি পদপল্লব মুদারম্’।

কাব্যের আধ্যাত্মিক, ও দার্শনিক আবেদন ব্যতীত কেবলমাত্র কাব্যের শৈল্পিক আবেদনও কম নয়। গীতগোবিন্দের পাঠক মাত্রেই পঞ্চইন্দ্রিয়ের অর্থাৎ বহিরঙ্গের রূপলাবণ্যের রসাস্বাদনের সাথে সাথে অন্তরঙ্গের—ভাবরূপ পানেও সমর্থ হন। এখানেই কবির সার্থকতা। রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়কে নিয়ন্ত্রিত করলেও সমগ্র কাব্যটিকে কবি তার বাস্তব অনুভূতি দিয়ে-নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছেন। জয়দেবের এই অসাধারণ ক্ষমতাই তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দান করেছে। কালিদাসের মেঘদূতের পরেই এই গীতিকাব্যের স্থান বলা যায়। এর রচনা নৈপুণ্য এমনই বিশেষ যে এর অনুবাদ বা অনুকরণ কোনটিই খুব সাফল্য পায়নি। পুরুষোত্তমদেবের ‘অভিনব গীতগোবিন্দ’ তেমন সারা জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। বহু বিদেশী কবি গীতগোবিন্দের অনুবাদও করেছেন। কিন্তু অনুবাদে প্রকৃতকাব্যের সেই আকুতি কিভাবে সম্ভব? গীতগোবিন্দের প্রায় চল্লিশটি টীকার মধ্যে একমাত্র রানাকুম্ভে ‘রসিক?ি” নামক টীকাই উল্লেখের দাবী রাখে। ১২২০ খ্রিঃ কবি তাঁর স্বগ্রামেই পরলোক গম? করেন। কবির জনপ্রিয়তা তাঁকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রতি বৎসর পৌষ সংক্রান্তিতে কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিশাল জনসমাবেশ দেখা যায়। দূরদূরান্ত থেকে বহু কবি, সাহিত্যিক ও রসিকজনের সমাগম ঘটে। বিদেশীরাও এসে ভীড় করেন সেই মেলায়। মনের মানুষের সন্ধানে আউল-বাউল-সহজিয়া-কর্তভজা প্রভৃতির সমাগমে জয়দেব-পদ্মাবতীর স্মৃতি বিজড়িত কেন্দুবিশ্বগ্রাম যেন প্রকৃতপক্ষেই তীর্থক্ষেত্ৰ। সেইহেতু বাংলার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যথার্থই বলেছেন-

“বাংলার রবি জয়দেব কবি কান্তকোমল পদে
করেছে সুরভি সংস্কৃতের কাঞ্চন কোকনদে”।।

পাদটীকা – গীতিকাব্য

১. ঋতুবৈচিত্রের বর্ণনার কবি কালিদাস লিখেছেন-

‘প্রচণ্ডসূর্যঃ স্পৃহণীয় চন্দ্ৰমাঃ সদাবগাহক্ষম বারিসঞ্চয়।
দিনান্তরস্যোঽভ্যু পশাক্ত মন্মথো নিদাঘকালোহয়মুপা-গতঃ প্ৰিয়ে’॥১।১
বিপত্রপুষ্পাং নলিনীং সমুৎসুকা বিহার ভৃঙ্গাঃ শ্রুতিহারি-নিস্বণাঃ।
পতন্তি মূঢ়াঃ শিখিনাং প্রনৃত্যতাং কলাপচক্রেষু নবোৎপলাশয়া। ২।১৪
হারৈঃ সচন্দসরসৈঃ স্তনমণ্ডলানি শ্রোণীতটং সুবিপুলংরসনা কলাপৈঃ।
পাদান্বুজানি কলনূপুর শেখরৈশ্চ নার্যঃ প্রহৃষ্টমনসোঽদ্য বিভূষয়ত্তি ॥ ৩।২০
ন চন্দনং চন্দ্রমরীচিশীতলং ন হর্ম্যপৃষ্ঠং শরদিন্দু নির্মলং।
ন বায়বঃ সান্দ্রতুষারশীতলা জনস্য চিত্তংরময়ন্তি সাম্প্রতম্।। ৫।৩

২. মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে— In Meghduta he describes the rainy season, in sakuntala the summer, in vikramorvasi the winter, in Malavikagnimitra the spring in a royal garden and in Raghuvansa almost all seasons….But the germs of all these magnificient deseriptions are to be found in the Ritusamhara.’ অধ্যাপক Macdonell তাঁর Sanskrit Literature গ্রন্থে ঋতুসংহার সম্বন্ধে বলেছেন— ‘Perhaps no other work of kalidasa’s manifests so strikingly the poet’s deep sympathy with nature, his keen powers of observation, and his skill in depicting an Indian landscape in vivid colours.”

৩. “In point of fact, the Ritusamhara is farfrom unworthy of kalidasa, and if the poem is denied him, his reputation would suffer peal loss.“

-keith : History of sanskit Literature.

৪. মেঘদূতের ত্রয়োদশ শ্লোকে কবি বলেছেন-

“মার্গং তাবচ্ছ কথয়তত্ত্বৎ প্রয়াণানুরূপং
সন্দেশং মে তদনু জলদ শ্রোষ্যসি শ্রোত্রপেয়ম্।
ঘিন্নঃ ঘিন্নঃ শিখরিষু পদং ন্যস্য গভাসি যত্র
ক্ষীণঃ ক্ষীণঃ পরিলঘুপয়ঃ স্রোতসাঞ্চোপযুজ্য।।” ১৩.

৫. ‘আলম্বা বাম্বু তৃষিতঃ করকোশপেয়ং।
ভাবানুরক্ত বণিতাসুরতৈঃ শপেয়ম্।
জীয়েয় যেন কবিনা যমকৈঃ পরেণ,
ভস্মৈ বহেয়মুদকং ঘটকর্পরেণ।।

৬. সম্ভোগ শৃঙ্গারের বর্ণনার নিদর্শন—

গাঢ়ালিঙ্গন-বামনীকৃত-কুচ-প্রোদ্ভিন্ন-রোমোত্তমো
সান্দ্রস্নেহ-রসাতিরেক-বিগলৎ-কাঞ্চী -প্রদেশম্বরা
মা মা মানদ মতি মামলামিতি ক্ষামাক্ষরোল্লাপিণী
সুপ্তা কিংনু মৃতা নু কিং মনসি মে লীনা বিলীনানু কিম্॥ অ. শ. ৩৫

৭. India P. ৩৪৭.

৮. তৃণে বা ত্রৈণে বা মম সমদৃশো যাস্তুদিবসাঃ,
ক্বচিৎ পুণ্যারণ্যে শিবশিব শৈবেতি প্রলপতঃ’।।

৯. “….it differs from the work of Bhartrihari in that, while Bhartrihari deals rather with general aspects of love and women as factors of in life, Amaru paints the relation of lovers, and takes, no thought of other aspects of life!”
Keith : History of Sanskrit literature. p. ১৮৪.

১০. পরার্থে যঃ পীড়ামনুভবতি ভঙ্গেঽপি মধুরো
যদীয়াঃ সর্বেষামিহ খলু বিকারোঽপ্যভিমতঃ
ন সম্প্রাপ্তো বৃদ্ধিং স ভূশমক্ষেত্র পতিতঃ
কিমিক্ষোর্দো যোয়ং ন পুনরগুণায়া মরু ভূবঃ।

ভ. শ. (কাব্যমালা) ৫৬

১১. প্রথম শ্লোকটি ছিল নিম্নরূপ :—

“অদ্যাপি তাং কনক-চম্পক-দাম গৌরীম্
ফুল্লারবিন্দবদনাং তনুলোমরাজীম্
সুপ্তোত্থিতাং মদনবিহ্বলালসাঙ্গী
বিদ্যাং প্রমাদগুণিতামিব চিত্তয়ামি।।”

১২. “গোবৰ্দ্ধনশ্চ শরণো জয়দেব উমাপতিঃ।
কবিরাজশ্চ রত্নানি সমিতৌ লক্ষ্মণস্য চ”।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *