চতুর্থ অধ্যায় – দৃশ্যকাব্য

চতুর্থ অধ্যায় – দৃশ্যকাব্য

সমগ্র সাহিত্যকে দুটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। দৃশ্য ও শ্রব্য। সংস্কৃত সাহিত্যের এই দৃশ্যকাব্যই বর্তমান নাটক (Drama) বা রূপক, অথবা নাট্য বলে পরিচিত। নাট্য বা রূপকগুলির মৌল নিহিত রয়েছে দৃশ্যময়তা বা রূপময়তার মধ্যে। নাট্যের প্রধান বিষয়ই হলো অভিনয়, যে কারণে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের কাছেই নাটক অতি প্রিয়। মানুষের সকলপ্রকার ভাব ও কর্ম যাকে লোকবৃত্ত অভিধায় ব্যক্ত করা হয়ে থাকে, আলঙ্কা। কদের মতে সেই লোকবৃত্তের অনুকরণই হল নাটক।’ নাট্য এর বিষয়বস্তু মঞ্চ প্রয়োগ ব্যতীত দৃশ্য হয় না বলেই এর নাম অভিনয়। এককথায় মানুষের সকল প্রকার ক্রিয়াকর্ম, ভাব, ভঙ্গিই নাটকের অনুকরণযোগ্য। আঙ্গিক, বাচিক, আহার্য ও সাত্ত্বিক এই চারপ্রকার অভিনয়ের দ্বারা লোকবৃত্তের বিষয়গুলি অনুকরণের দ্বারা নাটকের মধ্য দিয়ে নতুন ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। নাটক হলো এমনই এক সার্থক সাহিত্যোপকরণ যা নাকি ভিন্ন ভিন্ন রুচিসম্পন্ন মানুষের একত্র মনোরঞ্জনের অন্যতম চাবিকাঠি। সর্বজনগ্রাহ্যতা হেতুই নাটক হল পঞ্চমবেদ স্বরূপ। শ্রব্যকাব্য সর্বদা সর্বস্তরের পাঠকের উপযোগী নাও হতে পারে কিন্তু নাটকের সর্বজনীন প্রভাব বশতঃ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল থেকে তবেই একজন নাট্যকার নাটকের ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা করে থাকে।

নাট্যাশাস্ত্রের উদ্ভব :—সুদুর অতীতের ইতিহাস নানাভাবে রোমন্থন করেও ঠিক কোন সময়ে ও কিভাবে যে সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যের উৎপত্তি হয়েছিল, তার কোন সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। তথাপি প্রাচীন নাট্যতাত্ত্বিকগণ ও আধুনিক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পণ্ডিতগণের নাট্যশাস্ত্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে অনুমান, তত্ত্ব ও তথ্যাদি আলোচনা সাপেক্ষ। প্রত্যেকটি মতামতেরই আংশিক সত্যতা বা আংশিক গ্রহণ- যোগ্যতা থাকলেও কোন একটি মতকেও সত্য ও সর্বজনগ্রাহ্য বলা যায় না। অন্যান্য শিল্পকলার মত নাট্যকলার সৃষ্টিতত্ত্বের ইতিহাসও ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের তত্ত্বকে আদর্শরূপে গ্রহণ করেছে। এই সকল তত্ত্বের লৌকিক ও সামাজিকমূল্য যাই হোক না কেন সাহিত্য সৃষ্টির উষালগ্নে এইরূপ ভাব-ভাবনার শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই বিচারের অপেক্ষা রাখে। অতএব নাট্যশাস্ত্রের উৎপত্তির মূলে যে সমস্ত কাহিনী, উপাখ্যান ও মতামত পাওয়া যায় তা অবশ্যই বিশেষ মূল্যবান।

নাট্যশাস্ত্রের প্রাচীনতম সঙ্কলক ভরতমুনি তার গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে সংস্কৃত নাটকের উদ্ভব প্রসঙ্গে যে অতিকথার (myth) উল্লেখ করছেন সেই অনুযায়ী দেবরাজ ইন্দ্রের অনুরোধে স্বয়ং ব্রহ্মাই এই নাট্যবেদেরও স্রষ্টা। ইন্দ্রের পরামর্শ ক্রমে, তাঁর অনুরোধ রক্ষা করতে দৃশ্য ও শ্রব্য উভয় কাব্যের মিলনে এক আনন্দঘন অভিনব সাহিত্য সৃষ্টি হল। ইন্দ্রের মতে ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব এই চারিবেদে সকল- বর্ণের মানুষের অধিকার নেই, অতএব এমন এক সাহিত্য সৃষ্টি করা হোক যা নাকি সর্ববর্ণের মানুষের চক্ষু-কর্ণে-র আনন্দবিধান করতে সক্ষম হবে। কথিত আছে ব্ৰহ্মা ঋকবেদ থেকে বাণী, সামবেদ থেকে গীত, যজুর্বেদ থেকে অভিনয়, এবং অথর্ব বেদ থেকে অনুভূতি ও রস সংগ্রহ করে আলোচ্য পঞ্চমবেদের সৃষ্টি করেছিলেন।

জগ্রাহ পাঠ্যমৃগ্বেদাৎ/সামভ্যো গীতমেব চ। যজুর্বেদাদভিনয়ান/রসানাথবর্গাদপি।।

(নাট্যশাস্ত্র ১।১৭)

আরও বলা হয়েছে যে শিব ‘তাণ্ডব নৃত্য’, পাৰ্ব্বতী ‘লাস্য’, বিষ্ণু ‘নাট্যরীতি’ দান করলে ভরতমুনি নাট্যশাস্ত্র প্রণয়ন ও প্রচলন করেন। দেবতাদের শিল্পী হলেন বিশ্বকর্মা, অতএব তাঁর নির্দেশে নাট্যশালা, রঙ্গমঞ্চ নির্মিত হল, এক্ষণে ভরত ও তাঁর এক শতাধিক অনুগামীর অসীম চেষ্টায় উক্ত নাট্যশালার প্রথম নাটক অভিনীত হল ‘লক্ষ্মীসয়ম্বব’ নামক দেবগণের পরাভব বিষয়ক একখানি নাটক। অতঃপর ব্রহ্মা বিরচিত ভরত নির্দেশিত দুটি নাটক ‘অমৃতমন্থন ও ত্রিপুরদাহ’ অভিনীত হল। সেই নাট্য কুশলীগণ মর্ত্যে আবির্ভূত হয়ে নাট্যশাস্ত্রকে জনসমক্ষে পরিচিত করালেন। ইতিহাসকে অবলম্বন করে নাট্যবেদের মাধ্যমে সমাজে লোকশিক্ষার গুরু দায়িত্ব পালন করতেন এই নাট্যকুশলীগণ। অতএব এই উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে নাট্যসাহিত্যের উদ্ভবের ঐতিহাসিক সত্যতা যদি নাও পাওয়া যায় তথাপি নাট্যোৎপত্তির মূলে ধর্মের ভূমিকা টুকুকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা যায় না। আলোচ্য কাহিনী সত্যের রূপক মাত্র হলেও এটুকু সহজেই অনুমিত হয় যে নাট্যশাস্ত্র রচনার বহু পূর্ব থেকেই নাট্যাভিনয়ের প্রচলন ছিল।

অধ্যাপক keith মনে করেন ঋগ্বেদের ‘সংবাদ-সূক্ত’ (dialogue hymns) গুলিই সংস্কৃত-নাট্যোৎপত্তির মুলে। ঋকবেদে প্রায় কুড়িটি সংবাদসূক্ত সঙ্কলিত, যদিও অধিকাংশ সূক্তের মূল উৎস ঐতিহাসিকদেরও অজ্ঞাত। তথাপি ‘যমী’ সংবাদ (ঋ.স.১০.১০), পুরূরবা-উর্বশী (ঋ.স.১০.১৫), পণি সরমা (ঋ.স.১০,১০৮) এছাড়াও অগস্ত্য লোপামুদ্রা (৪।১৭৯), অগ্নি ও দেবগণের কথোপকথন, ইন্দ্ৰ-ইন্দ্ৰাণী উল্লেযোগ্য। সূক্তগুলি যজ্ঞের অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হলেও তাতে যথেষ্ট নাট্যরসের আবেদন ছিল এবং নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক ছিল। সাহিত্যপূর্ব যুগে এই ধরণের সংবাদসূক্তগুলি যেহেতু কথোপকথনাত্মক সেহেতু এর নাট্য কাব্য না নাট্যকবিতার সাথে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। keith এর সাথে সুর মিলিয়ে Hertel, Maxmuller প্রমুখেরাও স্বীকার করেন যে সংবাদ সূক্তগুলির মধ্যেই সংস্কৃত নাটকের বীজ উপ্ত হয়েছিল। ‘সুপর্ণাধ্যায’ নামক বৈদিক গ্রন্থটিকে Hertel পরিপূর্ণ নাটকের মর্যদাও দিয়েছেন। ঋক্ ও অথর্ববেদের কালে নৃত্যানুষ্ঠানের প্রচলন এবং সামবেদের কালে সঙ্গীতের অগ্রগতি বোধ করি কারুরই অস্বীকার করার উপায় নাই। এই সমস্ত পণ্ডিতেরা ঋকবেদের সংবাদসূক্তগুলিকে নাটকের মর্যাদা দিয়ে বলেছেন—যদি না পরবর্তীকালে যজ্ঞাশাস্ত্রকার গণেরা এইগুলিকে যজ্ঞে বিনিয়োগ করতেন তাহলে এই গুলিই বাধাহীনভাবে এক- একটি পরিপূর্ণ নাটকের রূপ পরিগ্রহ করত। এরূপ অনুমানের সাপেক্ষে বলা যায়- ‘পুরুরবা-উর্বশী’ এই সংবাদ সূক্তের অনুকরণেই মহাকবি কালিদাস ‘বিক্রমোর্বশীয়ম্’ নাটক রচনা করেছিলেন। সংলাপগুলির সাথে নৃত্য—গীত অভিনয় সংযোজনে বর্তমান নাটকের রূপ পরিগ্রহ করেছে বলা যায়।

এতদ্ অতিরিক্ত বৈদিক কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেও নাটকের ভাবময়তা লক্ষ্যনীয়। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ একে ‘Ritual Drama’ বলে অভিহিত করেছেন। বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে ‘মহাব্রত’ নামক যে অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল তাতে একখণ্ড চর্মকে কেন্দ্র করে শ্বেতকায় বৈশ্য ও কৃষ্ণকায় শূদ্রের মধ্যে চরম বিবাদ ও বিবাদান্তে ঐ চর্মখণ্ডের উপর শ্বেতকায় বৈশ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা; এই যে ঘটনা এটি নাটকের চেয়ে কোন্ অংশে কম? এইরূপ সোমরস ক্রয়-বিক্রয়কে কেন্দ্র করে ক্রেতা- বিক্রেতার মধ্যে যে দৃশ্যাভিনয় ফুটে ওঠে তা সোমযাগের অঙ্গ ছিল।

অপরপক্ষে একদল পণ্ডিতের মতে সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যের মূলে ধর্মের গুরুত্ব থাকলেও সামাজিক মানুষের বাস্তব আচার-আচরণ ও বাস্তব জীবন যাত্রাই নাট্যসাহিত্যের গোড়ার কথা। অনুকরণপ্রিয়তা মানুষের আদি ও অকৃত্রিম আচরণ. এবং রসবোধ ও আনন্দের অনুভূতিও মানুষের মনোজগতের চিরকালীন চাহিদা ও স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। অতএব এই প্রবৃত্তিগুলির বিচারে Hillebrandt ও keith প্রমুখ পণ্ডিতের উক্ত মতামত পরোক্ষে নাট্যশাস্ত্রে উল্লিখিত অতিকথারই নামান্তর মাত্র। কারণ প্রাচীন ভারতের যাত্রাপালা বা নাটকীয় অভিনয়গুলি প্রায়শই কৃষ্ণ, রাম বা অপর কোন ধর্মীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করেই অভিনীত হত।

অধ্যাপক Pischel এর মতানুযায়ী পুতুলনাচের মধ্য দিয়েই নাটকের যাত্রা শুরু। যেহেতু ‘সুত্রধার’ স্থাপক ইত্যাদি ভাষাগুলি নাটকে ব্যবহৃত। অতএব সূত্র ধরে যে পুতুলগুলিকে নাচায়, আবার স্থাপক অর্থে পুতুলগুলিকে মঞ্চস্থ করা বা মঞ্চ মধ্যে স্থাপন করাকে বুঝায়। আধুনিক নাটকে যেরূপ একজন নির্দেশক বা পরিচালককের প্রয়োজন হয়। তবে সামান্য পুতুলনাচের থেকে এমন রসধারানিঃসরণকারী নাটকের উৎপত্তি কি সম্ভব? হয়ত নাটকের অনুকরণেই পুতুল-নাচের সৃষ্টি হয়েছিল। আবার Luder এর মতে Shadow Play অর্থাৎ ছায়ানৃত্যই হল সংস্কৃত নাটকের মূল। কোন কোন পণ্ডিত মনেকরেন—বিভিন্ন ঋাতুতে প্রকৃতিতে যেমন চলে পটপরিবর্তনের খেলা অনুরূপভাবে মানবমনেও চলে ভাব পরিবর্তনের পালা। মনুষ্য জীবনটাকে যদি রঙ্গমঞ্চ বলে মনে করা হয় তবে সেই রঙ্গমঞ্চের অভিনীত নাটক যেন মানব জীবনের দুঃখ আনন্দ বিমিশ্র বহুমুখী অভিব্যক্তির পালা। বসন্তে মানবমনে প্রেমজাগে, পুলকিত চিত্তে সমবেত নাচগানেই হয়ত বা নাটকের বীজ উপ্ত হয়। বসন্তোৎসব ছাড়াও বর্ষায় বীজ বপন, ধান্য রোপন সবই পূর্বে উৎসবের রূপ নিত। নবান্নকে ঘিরেও গৃহস্থের আঙিনায় কম সমারোহ হত না। এই সমস্ত লৌকিক অকারগুলির মধ্যে যেন মঞ্চে অভিনীত নাটকেরই ভাবী সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল। শরৎ তো উৎসবেরই ঋতু, প্রকৃতি থেকে মানব মন সর্বত্রই এই উৎসবের আমেজ সকলকে মাতিয়ে তোলে। এছাড়াও প্রাচীনকালে রাজরাজাদের যুদ্ধজয়ের আনন্দ আপামর জনসাধারণের অনাবিল আনন্দে ভেসে যাওয়ার অন্যতম উপলক্ষ্য ছিল। সংস্কৃত- নাটকের অনুপ্রেরণার মূলে এই সব কারণের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল বলে বিদগ্ধজনেরা মনে করেন।

একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নাট্য উৎপত্তির কথা বলা হয়ে থাকে। ডক্টর রিয়ের মতে মৃতমানুষের পরিবারের মৃতব্যক্তির উদ্দেশ্যে যে শোক জ্ঞাপনের দৃশ্য তার থেকেই হয়ত দৃশ্যকাব্যের সূচনা হয়েছিল। আবার কোন কোন পণ্ডিত এর মতে ‘কৃষ্ণলীলা’, ‘রামলীলা’ প্রভৃতি বীররসাত্মক বীরপূজার অনুকরণ ক্রমেই মঞ্চে নাটকের অভিনয় শুরু হয়েছিল। এ-হেন বহু মতামত রয়েছে কিন্তু এ সবের ঐতিহাসিক সত্যতা বা যথার্থ প্রামাণ্য সুদৃঢ় নয়।

তবে নাটকের যাত্রাপথ যে সুদূর অতীত থেকেই আরম্ভ হয়েছিল এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বৈদিক যুগে ও রামায়ণ, মহাভারতের স্থানে স্থানে এমন কিছু শব্দের উল্লেখ দেখা যায় যা নাকি নাট্যসাহিত্যেরই অঙ্গ বিশেষ। প্রাচীন যর্জুবেদে প্রায় সমস্ত বৃত্তির উল্লেখ দৃষ্ট হয়, কিন্তু নটের উল্লেখ নাই। তৎপরিবর্তে ‘শৈলুষ’ পদের উল্লেখ রয়েছে। যার অর্থ ‘নট।’ অতএব নট-দের ভূমিকা সে যুগেও ছিল। আদি কবি বাল্মীকি তাঁর কাব্যে একাধিকবার ‘নট’, ‘নাটক’, ‘নৰ্ত্তক’ ‘নৰ্ত্তকী’ ‘ব্যামিশ্রক’ প্রভৃতি পদের ব্যবহার করেছেন। ‘ব্যামিশ্রক’ পদের দ্বারা খুব সম্ভব মিশ্র ভাষায় রচিত নাটককেই বুঝায় হরিবংশে রামায়ণ কাহিনী অভিনয়ের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। ‘কুশীলব’ এই পদটির ব্যবহার রামায়ণে গায়ক ও অভিনেতা অভিনেত্রীগণকেই বুঝিয়েছে। বিশ্বামিত্র রামপুত্র কুশ ও লবকে রামায়ণ শিক্ষা দিয়েছিলেন। এবং তাদের নাম থেকেই কুশীলব পদের সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও ‘কুশীলব’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া ‘রঙ্গাবতারী’ ও ‘রঙ্গোপজীবী’ শব্দ দু’টিও নাটকের অস্তিত্ত্বের সাক্ষ্য বহন করে। রামায়ণ ও মহাভারতেও ‘শৈলুষ’ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। মহাভারতের দ্রৌপদীকে ‘শৈলুষী’ বলে সম্বোধনও করা হয়েছে। ‘শৌভিক’ পদের ব্যবহার রয়েছে পতঞ্জলির মহাভাষ্যে। তাঁর মতে শৌভিক বা শৌভনিকগণ ‘বলিবন্ধন’ ও ‘কংসনিধন’ ইত্যাদি চিত্তাকর্ষক ও লোমহর্ষক কাহিনী সর্বসমক্ষে অভিনয় করে থাকেন। মহাভারতেও ‘শৌভিক’ পদের উল্লেখ রয়েছে। মূক অভিনয়ের বিবরণ ঘোষণা করাই ছিল সেখানে শৌভিকের কাজ। পতঞ্জলি তাঁর ব্যাখ্যায় স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণের পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝাতে গিয়েও নট ও তৎভাষার পারস্পরিক সন্ধন্ধের সাথে তুলনা দেখিয়েছেন। প্রাচীন বৌদ্ধসাহিত্যেও নটগামনি (প্রধান নট) ও নৃত্য, গীতাভিনয়ের সুস্পষ্ট পরিচয় মেলে। অতএব ঋক্ বেদের উৎসমুখে একদা যে সংস্কৃতির ধারা উৎসারিত হয়েছিল সেই ধারায় ক্রমাগত নতুন নতুন রস সঞ্চারের ফলে ধীরে ধীরে সংস্কৃত দৃশ্য কাব্য তার মহিমাকে নাট্যাভিনয় প্রাঙ্গনে বিকশিত করে তুলেছে। অতএব ভরতের নাট্যশাস্ত্র প্রণয়নের মূলে যুগব্যাপ্ত নাট্যকলার ইতিহাস অনস্বীকার্য। অতএব সুপ্রাচীন কাল থেকেই সংস্কৃত নাটকের ধারণা পাওয়া গেলেও ঠিক কোন্ সময় থেকে প্রথম নাটকের উদ্ভব হয়েছিল সে-কথা পরিষ্কার ভাবে অনুমান করা যায় না।

সংস্কৃত নাটকে গ্রীক প্রভাব :—আমরা জানি কোন একটি জাতির শিক্ষ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ত পরিবর্তনশীল। অন্যসংস্কৃতির প্রভাবে অথবা মিশ্রণে সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়। সেদিক থেকে বিচার করলে গ্রীকরাজা আলেকজান্ডার এর ভারত আক্রমণের পর থেকেই ক্রমশঃ গ্রীক সভ্যতা ও সংস্কৃতির দ্বারা ভারতীয় সংস্কৃতি অল্প বিস্তর প্রভাবিত হয়েছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার সাথে ভারতের বাণিজ্যিক যোগাযোগের সাথে সাথে উভয় সংস্কৃতিরও মিলন সংঘটিত হয়েছিল। weberই এবিষয়ে প্রথমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সে যুগে সংস্কৃতির মূলধারার সাথে সাথে নাট্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পাজ্ঞাব, গুজরাট, প্রভৃতি আঞ্চলিক নৃপতিগণ গ্রীক সংস্কৃতির দ্বারা শুধু প্রভাবিতই হন নি উপরন্তু প্রচুর গ্রীক সৈন্যও সাথে করে আনতেন, যাঁরা রাজ সভায় গ্রীক নাটক মঞ্চস্থ করতেন। ফলে ভারতীয় সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যে তার সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। Weber এই বিষয়ে বদ্ধ পরিকর ছিলেন। weber এর মতকে Brandes শুধু সমর্থনই করেননি, এর স্বপক্ষে নানা যুক্তিও প্রদর্শন করেন। Pischel কিন্তু ১৮৮২ সালে Berlin এ আনুষ্ঠিত Congress of orientalists এ weber এর মতকে সম্পূর্ণ রূপে খণ্ডন করেন। Windisch- এর বিরোধিতা করে Weber এর মতকেই সমর্থন করেছেন। Windisch-এর মতে আলেকজান্দ্রিয়ার সংস্পর্শে এসেই ভারতীয় নাট্যসংস্কৃতি উন্নতি করেছিল। কারণ আলেকজান্দ্রিয়া নাগরী সে যুগে গ্রীক-শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র বলে পরিগণিত হত, উজ্জয়িনী ও আলেকজান্দ্রিয়ার সম্পর্কই ভারতীয় সংস্কৃত নাটকের উন্নতির মূলে কাজ করেছিল। আলেকজাণ্ডার নিজে একজন রাজাই ছিলেন না, তিনি যথেষ্ট নাট্যানুরাগী ও দক্ষ অভিনেতাও ছিলেন। যুদ্ধজয়ের ফলে বিজয়োল্লাস ছিল যেন অভিনয়ের মধ্যদিয়ে চিত্তবিনোদনের এক অন্যতম উপায়।

Weberএর মতে সংস্কৃত নাটকে ‘যবনী’ ও ‘যবনিকা’ বলে ব্যবহৃত শব্দ দুটি গ্রীক ‘যবন’ শব্দ থেকেই গৃহীত। ‘যবন’ অর্থাৎ গ্রীক দেশবাসী। যবনী বলা হয় সংস্কৃত নাটকে রাজার দেহ রক্ষিণীকে। Dr. keith মনে করেন ভারতীয়েরা কেবল গ্রীসদেশেরই নয় ‘যবন’ শব্দের দ্বারা পারস্য, মিশর দেশের অধিবাসীদেরও বোঝাত। হয়ত বা ভারতীয় রাজন্যবর্গের গ্রীক সুন্দরী যবনীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব বশতই গ্রীকরাজারা সুন্দরী যুবতী যবনীগণকে ভারতীয় রাজার উদ্দেশ্যে উপঢৌকন হিসাবে পাঠাতেও-সম্মত ছিলেন। ইত্যাদি বহু আলোচনা, সমালোচনাই এই প্রসঙ্গে সাহিত্যের ইতিহাসে ভীড় করে। সেসব বিষয় প্রাসঙ্গিক মনে হলেও তার যথেষ্ট ঐতিহাসিক মূল্য সর্বদা খুঁজে পাওয়া যায় না।

গ্রীক ও সংস্কৃত নাটকের মধ্যে বহু আপাত সাদৃশ্যও লক্ষ্য করা যায়। যেমন সংস্কৃত নাটকে ন্যূনতম পাঁচটি অঙ্ক, প্রতি অঙ্কের শেষে বিরতি, প্রস্তাবনা পর্বে দর্শকবৃন্দের প্রতি সবিনয় আবেদন। নাট্যকার ও নাটকের নাম ঘোষণা এবং একজন অভিনেতা দ্বারা অপর নতুন অভিনেতাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এই সবই কিন্তু গ্রীক নাট্যধারার সাথে সাযুজ্য বজায় রেখে হয়েছে বলা যায়। যেমন আখ্যান ভাগের সাদৃশ্য স্বরূপ বলা যায়— কোন অজ্ঞাত নামা রমণীর প্রেমে রাজার আসক্তি, স্বাভাবিক মিলনে বাধা প্রাপ্ত উভয়ের মধ্যে নানা ভাবান্তর, ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত। অবশেষে রমণীর সঠিক পরিচয় প্রদান ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞান স্বরূপ কোনও বিশেষ দ্রব্যই সহায়ক হয়েছে। যেমন—অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকে শকুন্তলার ‘অঙ্গুরীয়ক’, বিক্রমোবর্শীয় নাটকে আয়ু কর্তৃক ব্যবহৃত ‘শর’, রত্নাবলীর ‘কণ্ঠহার’, ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে ‘মুদ্রা’ ও মালতীমাধবের ‘মালা’ এইরূপ অভিজ্ঞানের সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু তাই বলে এ সকল সাদৃশ্য হেতু ভারতীয় সংস্কৃত নাটক গ্রীক নাটকের কাছে বহুলাংশে ঋণী একথা সঙ্গত নয়। কারণ প্রাচীন ভারতে রাজাদের বহু বিবাহ ও একধিক প্রণয় কাহিনী স্বতঃসিদ্ধ। অতএব আখ্যানগুলি সেই সমস্ত প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখেই তৈরী হয়েছিল। আরো বলা যায় যে অঙ্গুরীয় বা ঐরূপ স্মারক চিহ্নের প্রসঙ্গতো আমাদের প্রাচীন গ্রন্থ ‘রামায়ণ’ মহাভারতেও রয়েছে। যেমন রামায়ণে রাবণ কর্তৃক অপহৃতা সীতা নিজ আভরণ মাটিতে ফেলতে ফেলতে চলেছিলেন যাতে রাম ও লক্ষণ সেইগুলি দেখে তার গতিপথ চিহ্নিত করতে পারে। আবার রাম যখন হনুমান কে পাঠালেন অশোকবনে বন্দিনী সীতার সাথে সাক্ষাৎ করতে তখনও রামের অঙ্গুরীয়ক দেখিয়েই হনুমান সীতাকে নিজ পরিচয় দিলেন। অতএব গ্রীক ও সংস্কৃত উভয় নাটকের মধ্যে বহু সাদৃশ্য রয়েছে একথা যেমন সত্য সেরূপ গ্রীসের নিকট ভারতীয় বা সংস্কৃত নাটক ঋণগ্রস্ত এরূপ ধারণাও সমীচীন নয়। বরঞ্চ বলা যায় সুস্থ দুটি দেশের সংস্কৃতির পারস্পরিক বিনিময়, বিবেকানন্দ বলতেন অপরের কাছ থেকে বিশেষতঃ পাশ্চাত্যের নিকট কিছু শিক্ষা কর, গ্রহণ কর, তবে তা নিজের ছাঁচে ফেলে তাকে নিজের মতন করে গ্রহণ কর, তাই ভারতবর্ষ তাঁর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অন্যের বিষয়কে নিজ মৌলিকত্বের আবরণে মুড়িয়ে সম্পূর্ণ নতুন করে গড়ে তোলে। অতএব গ্রীক প্রভাবকে সে তার নিজের ঢঙে পরিচালিত করে মনে প্রাণে পুরোমাত্রায় ভারতীয় করে তুলেছে।

সাদৃশ্যের পাশাপাশি বৈসাদৃশ্যও বহু দৃষ্ট হয়। ভারতীয় সংস্কৃত নাটক পুরোমাত্রায় ভারতীয় জীবনবোধ ও ভাবধারায় পুষ্ট। সেহেতু নাট্যবস্তু ও নাট্য পরিবেশনও ভারতীয় সাহিত্য ও সমাজের প্রভাবে পরিচালিত। গ্রীক নাটকের দেশ-কালও ক্রিয়াগত ঐক্য- সংস্কৃত নাটকে দেখা যায় না। ভবভূতির উত্তর রামচরিত নামক গ্রন্থে বার বছরের অধিক কালব্যাপী ঘটনার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে গ্রীক নাটকের চরিত্রগুলি তাদের পদ মর্যাদা অনুযায়ী ভাষা ব্যবহার করেন, যথা—রাজা, ব্রাহ্মণ, “ ক্ষিত ও পদস্থ ব্যক্তি সকল সংস্কৃত ভাষা, আবার স্ত্রীগণ, অন্ত্যজ শ্রেনীর লোক, ভৃাপণ প্ৰাকৃত ভাষায় কথা বলবেন। যেহেতু নাটক হল মানুষের বাস্তব জীবনের অনুকারক। বিদূষক হল সংস্কৃত নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নায়কের পাশে পাশে ছায়ার মত অনুসরণকারী প্রিয় বয়স্য, ভোজনরসিক ও আমোদপ্রিয় ব্রাহ্মণ চরিত্র। বিদূষকের চিত্তাকর্ষক ও হাস্য কৌতুকপূর্ণ চরিত্র কেবল নাটকে রসের সঞ্চারই করে না, উপরন্তু দর্শকদের মনোরঞ্জনও করে থাকে। বিদূষকের ভূমিকা সংস্কৃত নাটকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নাটকে প্রায়শই Tragedy বা বিয়োগান্ত নাটক দেখা যায় কিন্তু সংস্কৃত নাটকের ক্ষেত্রে বিয়োগান্ত কম বা Tragedy নেই বললেই চলে। একমাত্র ভাসের ‘উরুভঙ্গ’ নাটকেই Tragedy দেখানো হয়েছে। বিদূষক, বিট, ‘সাকার’ ‘সুত্রধার’ প্রভৃতি শব্দগুলি গ্রীস নাটকেও ব্যবহৃত হয়। পূর্বেই আলোচনা করেছি যে পরস্পর দেশ দুটির সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে সুন্দর মেলবন্ধন তৈরী হয়েছিল। যার ফলে দু’টি দেশই উন্নত ও উপকৃত হয়েছে। তবে গ্রীসের প্রভাবে ভারতীয় সংস্কৃত নাটক অল্পবিস্তর প্রভাবিত হলেও এর উৎপত্তি হয়েছিল বহু প্রাচীন যুগ থেকেই।

রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণের পরবর্তীকালীন যে সংস্কৃত সাহিত্য তাকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা চলে। অসীম প্রতিভাধর কিংবদন্তী পুরুষ কালিদাসকে যদি মধ্যমণি বলে গণ্য করা হয় তবে সেই নিরিখে কালিদাস পূর্ব যুগ, কালিদাসীয় যুগ ও কালিদাসোত্তর যুগ এইরূপ যুগবিভাগ অনুসারে এক্ষণে আমরা নাট্যকার ও নাটকের আলোচনা করব।

ভাস

কালিদাস পূর্ব যুগের প্রাচীন কবিগণের মধ্যে ভাস অন্যতম। কালিদাস তাঁর ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নামক নাটকে প্রথিত যশা কবি ভাসের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কবি বাণভট্টও ভাসের নাটকচক্রের উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর হর্ষচরিতে বলেছেন—

“সূত্রধারকৃতারস্তৈর্নাটকৈবহুভূমিকৈঃ।
সপতাকৈশো লেভে ভাসো দেবকুলৈরিব।”

এই শ্লোকের যাথার্থ প্রমাণিত হয় রাজশেখরের উক্তিতে—

ভাসনাটকচক্রেঽপিচ্ছেকৈঃ ক্ষিপ্তে পরীক্ষিতুম্।
স্বপ্নবাসবদত্তস্য দাহকোঽভুন্ন পাবক”।

এইভাবে কালিদাস, বাণভট্ট, রাজশেখর, বাক্পতি প্রভৃতির প্রশংসা বাক্যে ও আলঙ্কারিকগণের কতিপয় শ্লোকে ভাসের নাম ও যশ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় টি. গণপতি শস্ত্রী মহাশয়ের পরিচালনায় সংস্কৃত সাহিত্যের অপ্রকাশিত রচনা সমুহের প্রকাশনা নিমিত্ত-একটি কমিটি গঠিত হয়। শাস্ত্রী মহাশয় সেই হেতু নানা স্থানে ঘুরে ঘুরে পুরাতন পুঁথিসংগ্রহ কালে ত্রিবান্দ্রমে পদ্মনাভপুরম এর কাছে মনলিক্কর মঠে দুটি পুঁথি তাঁর নজরে আসে। তালপাতার পুঁথিতে মালায়ালাম্ হরফে লেখা মোট ১০৫ খানি পাতায় সম্পূর্ণ। প্রতি পাতায় ১০খানি করে লাইন ছিল। বিষয়বস্তু ছিল দশখানি নাটক। এছাড়া একখানি অসমাপ্ত রূপক এবং পরে ঐরূপ আরো দু’খানি রূপক আবিষ্কৃত হওয়ায় মোট তিনখানি রূপক ও দশখানি নাটক এই ১৩খানি রচনা আবিষ্কার সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নাটকগুলি রামায়ণ, মহাভারত-এর বিষয় অবলম্বনে অথবা প্রাচীন কাহিনী অবলম্বনে রচিত নতুবা নাট্যকারের কল্প কাহিনী। নাটকগুলি যথাক্রমে- (ক) (রামায়ণ অবলম্বনে)— (১) প্রতিমানাটক, (২) অভিষেকনাটক, (খ) (মহাভারত- অবলম্বনে) (৩) মধ্যমব্যয়োগ, (৪) দূতবাক্য, (৫) দূতঘটোৎকচ, (৬) কর্ণভার, (৭) ঊরুভঙ্গ, (৮) পঞ্চরাত্র, (গ) (হরিবংশের কৃষ্ণ উপাখ্যান অনুসরণে) (৯) বালচরিত, (ঘ) (নাট্যকারের কল্পিত এবং প্রাচীন কাহিনী অবলম্বনে)। (১০) স্বপ্নবাসবদত্তা, (১১) প্রতিঞ্জাযৌগন্ধরায়ণ, (১২) অবিমারক, (১৩) চারুদত্ত তন্মধ্যে প্রথম তিন শ্রেণির রচনাগুলি ‘নাটক’ ও চতুর্থ শ্রেণির রচনাগুলি ‘প্রকরণ।’

স্বভাবতঃই মনে প্রশ্ন জাগে ঐগুলির রচয়িতা কে? নাটকগুলি যিনিই রচনা করুন না কেন, তিনি প্রথমত ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন এইরূপ প্রতীতি জন্মে! তবে কে সেই ব্যক্তি এই প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণে বহু আলোচনা ও যুক্তিতর্কের শেষে বহু গবেষণার ফলে গণপতি শাস্ত্রী মহাশয় সিদ্ধান্ত করেন যে ঐ নাটকচক্র ভাসের রচনা। কিন্তু যেহেতু কোন রচনা শেষে কবির নাম উল্লেখ নেই সেহেতু সকলে নির্বিচারে নির্বিবাদে মেনে নিতে পারলেন না। পরবর্তীকালের বহু রচনায় সেই সব নাটকের শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে দেখা গেলেও সেই সমস্ত উদ্ধৃতি কোথা থেকে করা হয়েছে তার উল্লেখ নেই। অতএব সন্দেহের নিরসন হয় না। এ-হেন নানা বাদবিতণ্ডা চলতে থাকে। উক্ত নাটক চক্রের রচয়িতা ভাস এই মতের পক্ষে ও বিপক্ষে নানাযুক্তির অবতারনা দেখা যায়। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। Bhasa-Problem (ভাস-সমস্যা) বলে খ্যাত।

এক্ষণে আমরা শাস্ত্রীমহাশয় কেন ঐ নাটক চক্রকে ভাসের রচনা বলে দাবী করেছেন তা আলোচনা করব। নাটকগুলির তুলনামূলক আলোচনা করে এবং কালিদাস, বাণভট্ট, রাজশেখর প্রভৃতি পণ্ডিতগণের ভাস সম্পর্কে মতামতের সাপেক্ষে শাস্ত্রীমহাশয় প্রমাণ করতে চাইলেন যে ঐসব নাটক একজনেরই রচনা ও রচয়িতা নিঃসন্দেহে প্রথিতযশা নাট্যকার ‘ভাস’। কারণ নাটকগুলিতে যেরূপ যশের আভাস পাওয়া যায় তা একমাত্র ভাসেরই প্রাপ্য হওয়া উচিৎ। ভাস অবশ্যই কালিদাসের পূর্ববর্তী। কারণ কালিদাসের রচনাশৈলী অপেক্ষা আলোচ্য নাটক সমূহের রচনাশৈলী প্রাচীন। এবং সব নাটকগুলি যে একই ব্যক্তির রচনা তা নাটকের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গের কতিপয় সাদৃশ্য দেখে অনুমিত হয়। নাটকগুলি একই স্থানে প্রাপ্ত। নাটকগুলি কালিদাসাদি কবিগণ অপেক্ষা অন্য ধারায় রচিত এবং নাট্যশাস্ত্রের নিয়ম সেখানে আধিকাংশ ক্ষেত্রে লঙ্ঘন করা হয়েছে। মঞ্চে যুদ্ধ, মৃত্যু ইত্যাদি দৃশ্যের অবতারণা তারই সাক্ষ্য বহন করে। এমন কি পাণিনির ব্যাকরণের নিয়মও মেনে চলা হয়নি। বহু অপাণিনীয় প্রয়োগ দৃষ্ট হয়। যেমন আপ্‌চ্ছামি, রক্ষতে, ধরম্ভে ইত্যাদি দ্রষ্টব্য। নাটকে ব্যবহৃত প্রাকৃত ভাষাও বহু প্রাচীন। এই সব তথ্যাদি নিঃসন্দেহে নাটকগুলি ও নাট্যকারের প্রাচীনত্বের দাবীদার। পরবর্তী কালের নাটকগুলিতে সর্বপ্রথমে নান্দীশ্লোক বলে তৎপরে ‘নান্দ্যন্তে সূত্রধারঃ’ এইরূপ বলা হত। কিন্তু আলোচ্য, নাটক সমূহে প্ৰথমেই ‘নান্দ্যন্তে ততঃ প্রবিশতি সূত্রধারঃ এইরূপ দৃষ্ট হয়। নান্দীশ্লোকে মুদ্রালঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। শ্লেষের দ্বারা প্রধান প্রধান চরিত্রগুলির উল্লেখ দেখা যায়। বহু নাটকের ভরতবাক্যেই একইরূপ প্রার্থনা করা হয়েছে। বহুনাটকের একই বাগধারা, একই শ্লোক, বাচনভঙ্গী, পতাকাস্থান, নাট্য কৌশল রীতির হুবহু প্রয়োগ যেন নাটকগুলিকে একই সূত্রে গ্রথিত করেছে। যেমন—’এবমাৰ্যমিশ্রান্ বিজ্ঞায়ামি। অয়ে কিং নু খলু ময়ি বিজ্ঞাপনব্যগ্রে শব্দ ইব শুয়তে, এছাড়া ‘অঙ্গ’, ‘পশ্যামি’ ইত্যাদি পদ যেন অনেকগুলি নাটকেই হুবহু মিলে যায়। বালচরিত ও চারুদত্ত উভয় নাটকেরই প্রথম অঙ্কে—রয়েছে

লিম্পতীব তমোঽঙ্গানি বৰ্ষতীবাঞ্জনং নভঃ।
অসৎ পুরুষ সেবের দৃষ্টিবিফলতাং গতা”।।

আবার স্বপ্নবাসবদত্তা নাটকে ৬ষ্ঠ অঙ্কে ও অভিষেক নাটকের চতুর্থ অঙ্কে এই শ্লোক দৃষ্ট হয়, যথা—’কিং বক্ষ্যতীতি হৃদয়ং পরিশঙ্কিতং মে”–এছাড়া একাধিক নাটকেই একচরিত্রে একই নাম ব্যবহৃত। যথা—’প্রতিমা’ ‘প্রতিমা যৌগন্ধরায়ণ’ ও ‘স্বপ্নবাসবদত্তা’ এই তিন নাটকেই প্রতিহারীর নাম বিজয়া। আবার ‘পঞ্চরাত্র’ ‘ঊরুভঙ্গ’ ও ‘প্রতিজ্ঞা যৌগন্ধরায়ণের’ কাঞ্চকীয়ের নাম ‘বাদরায়ণ’। অন্যান্য সংস্কৃত নাটকে, ‘কঞ্চুকীয়’ এর পরিবর্তে আলোচ্য নাটকগুলিতে ‘কাঞ্চকীয়’ ব্যবহৃত হয়েছে। এই সমস্ত লক্ষণ নিঃসন্দেহে নাটকগুলিকে একই ব্যক্তির রচনা বলে ভাবতে সাহায্য করে। এতদ্ব্যতীত নাট্যকৌশল, কবিকল্পনা, কবির মনস্তাত্ত্বিক প্রকাশ, সামাজিক চিত্র এই সমস্ত ক্ষেত্রের সাদৃশ্য, নাটক সমূহ যে একই ব্যক্তির রচনা সে বিষয়ে গবেষক কে নিঃসন্দিগ্ধ করে। উক্ত নাট্যকার যে ভাস ভিন্ন অন্য কেহ নন এই প্রসঙ্গে শাস্ত্রী মহাশয় বলেন—এইরূপ উচ্চমার্গের প্রকাশভঙ্গী, হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা নৈপুণ্য, অসাধারণ শব্দচয়ন, চরিত্র চিত্রণে সুদক্ষতা ভাষা ও ভাবের গাম্ভীর্যই প্রথম শ্রেণির নাট্যকারের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে। যেহেতু মহাকবি ভাসের মধ্যে এই সমস্ত গুণাবলীই বিদ্যমান ছিল, এবং ভাস নামে একজন প্রথিত যশা কবির কথা সকলেই জানতেন সেইহেতু এই ১০ খানি নাটকের নাট্যকার হিসাবে যে যুগে ভাস ব্যতীত ভিন্ন ব্যক্তির কথা ভাবা যায় না।

পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে শাস্ত্রী মহাশয়ের সিদ্ধান্তকে সকল বিবুধগণ বিনা বাক্যব্যায়ে মেনে নেন নি। কেউ কেউ পূর্ণ সমর্থন করেছেন—যেমন Keith, Thomas, Paranjape. Debdhar প্রমুখ ব্যক্তিগণ। আবার L. D. Barnett, Jhonstone, পণ্ডিত রামাবতার শর্মা, হীরানন্দ শাস্ত্রী প্রমুখেরা নবাবিষ্কৃত নাটকচক্র ভাসরচিত এইরূপ সিদ্ধান্তের বিপরীতে মত পোষণ করে নিম্নরূপ যুক্তি দেখিয়েছেন।

বিরুদ্ধবাদীদের মতে ‘নান্দী-অন্তে’-এইরূপ প্রাচীন রীতি শুদ্রকের পদ্মপ্রাভৃতক ও বিজ্জকার কৌমুদী মহোৎসবেও দৃষ্ট হয়। দক্ষিণ ভারতীয় নাটকে প্রস্তাবনার পরিবর্তে স্থাপনা শব্দটিই ব্যবহৃত হত। নবাবিষ্কৃত নাটকচক্রের থেকে পরবর্তীকালের কবিগণ উদ্ধৃতি গ্রহণ করলেও যেহেতু তার উৎস চিহ্নিত করা নেই সেহেতু নিশ্চিত করে বলা যায় না যে সেইসব উদ্ধৃতি আলোচ্য নাটকেরই অংশ। স্বপ্নবাসবদত্তা নাটকের যে অংশ পরবর্তী কালের নাটকে উদ্ধৃত হতে দেখা যায় তা নবাবিষ্কৃত স্বপ্ন-বাসবদত্তা নাটকে অনুপস্থিত। L. D. Barnett এর মতে অন্ততঃ পক্ষে ছয়জন নাট্যকার ‘স্বপ্নবাসবদত্তম্’ নামে নাটক রচনা করে ছিলেন। নাটকগুলির সংস্কৃত ও বাকৃত ভাষা বিচার করে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না যে সেগুলি কালিদাস পূর্বকালে রচিত অপাণিনীয় প্রয়োগ খুব সম্ভব লিপিকর প্রমাদের ফলস্বরূপ হয়েছে। বিরুদ্ধবাদীরা বলেন খুবসম্ভব কেরল অঞ্চলের চক্কিয়ার নামে যে ভ্রাম্যমান নাট্য সম্প্রদায় ছিল, এগুলি তাদেরই রচনা। কবি ভাসকে কেন্দ্র করে এই সমস্যার নিশ্চিত কোন সমাধান আজও খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে উভয়পক্ষের যুক্তি পর্যালোচনা করে বলা যায়- বিরুদ্ধ পক্ষের যুক্তি তুলনায় দুর্বল। সুঠঙ্কর, ভিন্টার নিৎস এ বিষয়ে মধ্য পন্থা অবলম্বন করেছেন। তাঁরা বলেন যতদিন না পর্যন্ত্য কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলে নিশ্চিৎ হওয়া যাবে যে নাটকগুলি ভাসভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তির রচনা, ততদিন যাবৎ আলোচ্য পুঁথিগুলিকে ভাসের লেখা বলে মেনে নিতে কোন বাধানেই। এবং এ বিষয়ে কালিদাস, বাণভট্ট, রাজশেখর, ভবভূতি প্রভৃতি কর্তৃক ভাসের সপ্রশংস উল্লেখ এবং নাটকগুলির অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ সাদৃশ্যও হেতু উক্ত নাটকচক্রের রচয়িতা বলে ভাসকে মেনে নেওয়াই সমীচীন।

ভাসের কালনির্ণয় :—মহাকবি ভাসের আবির্ভাবকাল সম্বন্ধেও বিবুধ মহলে নানান মত পার্থক্য বর্তমান। শাস্ত্রী মহাশয় কতক আবিষ্কৃত নাটকচক্রের রচয়িতা ভাস এ-কথা মেনে নিলে ভাসের আবির্ভাব দণ্ডী, ভামহ ও বামন অপেক্ষা পূর্বে। ভামহ গুণাঢ্যের পূর্ববর্তী। কারণ এই সমস্ত আলঙ্কারিক ভাসের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আবার T. G. Sastri মহাশয়ের মতে তিনি পাণিনির পূর্বে ছিলেন। কারণ তিনি পাণিনীয় অনুশাসন মানেন নি। ভাসের নাটকগুলি কালিদাসের যুগে যে বিশ্ববিশ্রুত হয়েছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ভাস ভরতের নাট্যশাস্ত্রের অনুশাসন না মেনে বহু ক্ষেত্রে যেমন স্বপ্নবাসবদত্তায় নিদ্রা, বালচরিতে, উরুভঙ্গে মৃত্যু মঞ্চে অভিনীত করেছেন। কিন্তু কালিদাসের যুগে ভরতের অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে মেনেই নাটক অভিনীত হত। অতএব ভরতের নাট্যশাস্ত্র প্রণয়নের বহু পূর্বে ভাস তার নাটক রচনা করেছেন। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের মতে ইনি খৃষ্টাব্দ তৃতীয় শতকের কবি। এবং তিনি বৌদ্ধকবি অশ্বঘোষের পরবর্তী। প্রমাণ স্বরূপ তাঁরা বলেন ভাসের যে প্রাকৃত ভাষা তা অশ্বঘোষ অপেক্ষা অর্বাচীন। অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিতের প্রতি লক্ষ্য রেখে ভাসের “প্রতিজ্ঞা যৌগন্ধরায়নের”-একটি শ্লোকও রচিত হয়েছে। অধ্যাপক কীথও ভাসকে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতেই স্থাপন করেছেন। যেহেতু বৌদ্ধকবি অশ্বঘোষ ও কালিদাসের মধ্যবর্তী সময় অপর কোন বিখ্যাত কবির পরিচয় অদ্যাবধি পাওয়া যায় না। সেইহেতু মহাকবি ভাসকেই মধ্যবর্তীকালীন নাট্যকার হিসাবে ঐ ১৩ খানি নাটকের রচয়িতা বলে স্বীকার করে নিলে আর কোনরূপ সমস্যা থাকে না। তদনুযায়ী খ্রিষ্টাব্দ তৃতীয় শতকের শেষে অথবা চতুর্থ শতকের প্রথমে যদি কালিদাসের আবির্ভাব ঘটে এবং অশ্বঘোষ যদি কণিষ্কের সমসাময়িক হেতু ১ম খ্রিঃ কবি হন, তাহলে ভাসকে খ্রিষ্টীয় ২য় শতকের কবি বলায় কোন বাধা থাকে না।

ভাসের নাটকচক্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয় :—

প্রতিমা নাটক :—বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণের কাহিনীর বিষয় অবলম্বনে যে সপ্তাঙ্ক নাটক রচিত তাই হল ‘প্রতিমা নাটক’। এই নাটকে দেখান হয়েছে দশরথ কর্তৃক রামের রাজ্যাভিষেকের সকল প্রকার আয়োজন যখন সম্পূর্ণ, সেই সময়ে কৈকেয়ীর প্রার্থনা পূরণার্থে ভরতের রাজ্যলাভ এবং জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রের ১৪ বৎসরের জন্য বনবাস গমন। ভরত মাতুলালয় থেকে প্রত্যাবর্তন করে সমস্ত ঘটনা অনুধাবন করে যার পর নাই মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি বহু চেষ্টা করেও রামচন্দ্রের “ন্যায্য” পদে তাকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হলেন। এদিকে বনবাসে থাকাকালীন রাবণ কর্তৃক সীতা অপহৃত হলে রাম কর্তৃক সীতা উদ্ধার হয়। অবশেষে রাবণ বধ পূর্বক লক্ষ্মণ ও সীতাসহ রামচন্দ্রের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন ও রাজ্যভার গ্রহণ পর্যন্ত ঘটনা আনুপূর্বিক নাটকায়িত হয়েছে।

মাতুলালয় থেকে অযোধ্যায় প্রত্যাগমন কালে ভরত পথমধ্যে এক দেবমন্দিরে বিশ্রাম করেন। তথায় দশরথ সহ অন্যান্য পূর্বপুরুষদের মূর্ত্তি দর্শন করেন ও পূজারির কাছে পিতার মৃত্যু সংবাদ জানতে পারেন। এমন মর্মান্তিক ও আকস্মিক ঘটনায় তার চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে, ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই অযোধ্যায় ফিরে গিয়ে মাতা কৈকেয়ীকে ভর্ৎসনা করলে কৈকৈয়ী জানালেন যে অন্ধ মুনির পুত্রকে বিনা কারণে দশরথ বধ করেছিল সেইহেতু দশরথের পুত্রশোক ছিল অনিবার্য। কিন্তু ১৪ দিন বলতে গিয়ে চিত্ত চাঞ্চল্য বশতঃ তিনি ১৪ বৎসর বলে ফেলেছেন যা তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। সেই হেতু তিনি অনুতপ্ত। ভরতের রাগ কিঞ্চিত প্রশমিত হল।

রামায়ণ থেকে কাহিনী গ্রহণ করলেও নাট্য রসের খাতিরে কবি স্থানে স্থানে যথেষ্ট মৌলিকতার ছাপ রেখেছেন। প্রতিমাগৃহের ঘটনার অবতারণা করে কবি তাঁর কল্পনা শক্তির অসামান্য পরিচয় দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে পাঠকবর্গ তাঁর উদ্ভাবনী শক্তির প্রকাশ পায়। সেই হেতু-নাটকের নামও হয়েছে প্রতিমা। চরিত্র চিত্রনে ও নাটকের সংলাপ সৃষ্টিতে কবি প্রতিভা অনবদ্য। সর্বোপরি বৈদভীরীতিতে লেখা নাটকটি সহজ, সরল প্রসাদগুণ বিশিষ্ট—ভাষায় যথাযথ অলঙ্কার প্রয়োগে কবির নাট্যকৃতিকে বিশেষ তাৎপর্য মণ্ডিত করে তুলেছে। পরবর্তীকালে বহুপণ্ডিত ব্যক্তিই এই নাটকের মূলরূপ বঙ্গানুবাদ, ইংরাজী অনুবাদ সহ, টীকা সহ সম্পাদনা করেছেন ও প্রকাশ করেছেন। নির্মলা টীকা, পীঠিকা টীকার নাম উল্লেখযোগ্য।

অভিষেক নাটক :—–মহাকবি ভাসের প্রতিমা নাটক ও অভিষেক নাটক উভয়ই রামায়ণ অবলম্বনে রচিত। এই ষষ্ঠাঙ্ক নাটক অভিষেকে রামায়ণের কিষ্কিন্ধা কাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত্য কাহিনী বিধৃত। রাবণ কর্তৃক সীতা হরণের পর সুগ্রীবের সাথে রামের বন্ধুত্ব খুবই মনগ্রাহী, রাম বালীকে বধ করলে সুগ্রীবের বানর রাজ্য লাভ হয়। হনুমান সীতার অন্বেষণে বার হল। রাবণ সীতাকে বধ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেন। হনুমান লঙ্কাপুরীকে পুড়িয়ে ছাড় খার করে দেয়। বিভীষণ রামের পক্ষে যোগ দেন, ফলে তাঁরই উদ্যোগে রামের সৈন্যবাহিনী গঠিত হয়। তবে রামকর্তৃক ইন্দ্রজিৎ নিহত হলে রাবণের মধ্যে এইরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় যে রাবণ সীতাকে হত্যার সঙ্কল্প ও পরিকল্পনা করলেন। অবশেষে, রাম-রাবণের ভীষণ যুদ্ধে রামের জয় হল এবং রামচন্দ্র সীতা উদ্ধার করলেন। কিন্তু সীতার প্রতি রামের অত্যন্ত সন্দেহ প্রকাশ পায় এবং বিরূপ আচরণ বশতঃ সীতাকে অগ্নিপরীক্ষাও দিতে হয়, তারপর রামের রাজ্যাভিষেকের মধ্য দিয়ে অভিষেক নাটক সমাপ্তি লাভ করে।

‘প্রতিমা’ নাটকের ন্যায় ‘অভিষেক’ নাটকও রামায়ণের ঘটনাকে অতিক্রম করে নাট্যকারের মৌলিকত্ব স্থাপনে সার্থকতা লাভ করেছে। প্রতিমা ও অভিষেক নাটক যেন একে অন্যের পরিপূরক। রামের রাজ্যাভিষেকই সমস্ত নাটকের কেন্দ্রে থাকলেও বালীর বানররাজ্যে ও বিভীষণের লঙ্কারাজ্যে অভিষেকের প্রসঙ্গও কবি নিখুঁত ভাবে বর্ণন। করেছেন। বরুণের চরিত্র সৃষ্টি, বালীর শ্রেষ্ঠত্বের ছবি, বিভীষণের রাম পক্ষে যোগদান, পিতা বালীর মৃত্যুতে পুত্র অঙ্গদের প্রচণ্ড বিলাপ ইত্যাদির বর্ণনায় স্বতঃস্ফূর্ত কবি এক নিজস্ব ভাবের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছেন।

কর্ণডার :—বৈচিত্র্যপূর্ণ নাট্যশাস্ত্রের বহু ভাগ, নাটক, প্রকরণ, ডিম, ভান, সমবকার, ব্যায়োগ ইত্যাদি। নাট্যের পরিভাষায় কর্ণভার ‘ব্যায়োগ’ নামে পরিচিত একাঙ্কিকা। মহাভারতের মহান ও বিখ্যাত চরিত্র কর্ণের মহানুভবতা, বদান্যতা, তথা বীরত্ব ও আত্মত্যাগের গৌরব গাথাই এখানে মুখ্য বিষয়। কর্ণ অর্জুনের বিপরীতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। এমন সময় নেপথ্যে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে দেবরাজ ইন্দ্রের কণ্ঠস্বর কর্ণের গোচরীভূত হল—’ভোঃ কর্ণ। মহত্তরং ভিক্ষাং যাচে’। দাতা কর্ণ বিগলিত হয়ে বললেন-ব্রাহ্মণ যা চাইবেন তিনি তাই দিতেই প্রস্তুত। ব্রাহ্মণ সেই সুযোগ বুঝে কর্ণের কবচ-কুণ্ডল পার্থনা করলেন। দাতা বীর কর্ণ সারথি শল্যের নিষেধ সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে নির্দ্বিধায় তা ব্রাহ্মণের হস্তে অর্পণ করলেন। তৃপ্ত ইন্দ্র কিঞ্চিৎ অনুতপ্ত বোধ করলেন এবং ‘বিমলা’ নামক অস্ত্র কর্ণকে পাঠিয়ে দেন। কর্ণ তা গ্রহণ করতে অসম্মত হলেন তথাপি ব্রাহ্মণবাক্যের অন্যথা হওয়ার নয় সেইহেতু যখনই কর্ণ স্মরণ করবেন তখনই এই অস্ত্র তিনি পেয়ে যাবেন। কর্ণ বুঝেছিলেন আজ অর্জুন তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করবেন। নিজ প্রাণ কবচকুণ্ডল দান করে কর্ণ যে মহত্ত্ব দেখিয়েছেন তার তুলনা সারা মহাভারতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে-দানের ফল অক্ষয়।

মহাকবি ভাস মহাভারতের বিষয় ও চরিত্রগুলিকে অনুসরণ করলেও তাঁর কল্পনা শক্তির বলে করুণ রসাশ্রিত এই কাহিনী যেন চিরকালের আদর্শ স্বরূপ হয়ে আছে। কারণ শল্যরাজের নিকট তাঁর প্রতারণা সম্পর্কে অবহিত হয়েও তিনি সত্য ও ত্যাগের মহিমায় যেন উজ্জ্বল হয়ে রইলেন। বীররসের সাথে করুণরসের যেন সংমিশ্রণ ঘটেছে। মহাভারতের কর্ণ হল এক ভাগ্যবিড়ম্বিত চরিত্র। তবুও দানের মহত্ত্বে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মহাকবি ভাসের উদ্ভাবনী শক্তি সেই মহত্ত্বকে মঞ্চে উপস্থিত করেছেন তাঁর এই একাঙ্কিকার মধ্য দিয়ে।

নামকরণের আলোচনা প্রসঙ্গে Dr Winternitz বলেন হয়ত ‘The difficult tusk of karna.’ এইটি বোঝাতেই ‘কর্ণভার’ নাম দেওয়া হয়েছে। অথবা কর্ণ বা কানের কবচকুণ্ডল দান করে যেন সেই ভার মুক্ত হলেন। যুদ্ধ যাত্রার পূর্বে মহাবীর কর্ণের মানসিক ভাবের প্রতিও কোন কোন পণ্ডিত অঙ্গুলী নির্দেশ করেছেন। পরিশেষে বলা যায় কর্ণের শ্রদ্ধা, দানশীলতা, ঔদার্য, আত্মত্যাগের মহিমা, সৌজন্য প্রদর্শন এই সকলই এক কথায়—’না ভূতো ন ভবিষ্যতি।’

উরুভঙ্গ :—মহাকবি ভাস বিরচিত আলোচ্য একাঙ্ক ব্যায়োগ এর বিষয়বস্তু মহাভারতের যুদ্ধপর্বের অন্তিমপর্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে। ঊরুভঙ্গ নামটির মধ্য দিয়েই ঊরু ভঙ্গের অভাস সুস্পষ্ট। অষ্টাদশ দিবস ব্যাপী ঘোর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে যখন কৌরবগণ বিধ্বস্ত এবং ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্র মধ্যে একমাত্র দূর্যোধনই জীবিত সেই সময় দ্রৌপদীর অবমাননার প্রতিশোধ নিতে মহাপরাক্রমশালী ভীম দূর্যোধনের বিরুদ্ধে গদাযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যুদ্ধে ভীম গদা দ্বারা দুর্যোধনের ঊরু ভঙ্গ করলেন। ব্যাস, যুদ্ধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্র, কৃষ্ণ, প্রভৃতি সকলের উপস্থিতিতে দুর্যোধনের শোচনীয় পরাজয় ও মৃত্যু দেখে গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্র গভীর শোকে নিমজ্জিত হলেন। বীরের মত মৃত্যুকে বরণ করে সগৌরবে দূর্যোধনের স্বার্গারোহনের দৃশ্য সত্যই মর্মান্তিক ঘটনা। অবশেষে অশ্বত্থমা কর্তৃক দূর্যোধনের পুত্র দুর্জয়ের রাজ্যাভিষেক ইত্যাদি দেখানো হয়েছে। মঞ্চে ঊরুভঙ্গের অবতারণা মহাকবি ভাসের নাট্য শৈলীর এক বিশেষ প্রতিভার পরিচয় বহন করে। বিয়োগান্ত ঘটনাই যেন নাটকের কেন্দ্রীয় আকর্ষণ স্বরূপ। সংস্কৃত সাহিত্যে ঊরুভঙ্গই একমাত্র বিয়োগান্ত দৃশ্যকাব্য।

আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি যে মহাকবি ভাস নাট্যশাস্ত্রের অনুশাসন লঙ্ঘন করে মঞ্চমধ্যে যুদ্ধ, মৃত্যু ইত্যাদি ঘটিয়েছেন। সংস্কৃত সাহিত্যে অন্যান্য সমস্ত দৃশ্যকাব্য থেকে ‘উরুভঙ্গ’ সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের স্বতন্ত্র এক সৃষ্টি।

দূতকাব্য :—’দূতকাব্য’ নামক একাঙ্ক নাটিকাটিও মহাভারতের আধারে রচিত। আলঙ্কারিক দিগের পরিভাষায় একে সংলাপকের শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। ব্যায়োগ জাতীয় এই দৃশ্যকাব্যের মূল বিষয়বস্তু হল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন আসন্ন কৌরব ও পাণ্ডবগণের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব লক্ষ্যণীয়, সেই সময়ে পাণ্ডবপক্ষের দূত হিসাবে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ উভয়পক্ষের বিবাদ মিটিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে শান্তি প্রস্তাব নিয়ে কৌরবদের সভায় উপস্থিত হলেন। মহাভারতের বিখ্যাত উক্তি দুর্যোধনের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল—’বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। অর্থাৎ শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হল। শ্রীকৃষ্ণ যার পর নাই অপমানিত হলে দূর্যোধন ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে প্রবল বাদ বিতণ্ডা চলে। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বিশ্বরূপ দর্শন করালেন, সুদর্শন চক্রের দ্বারা তাঁর মহিমা কীর্তিত হলো। দুর্যোধন কর্তৃক অপমানিত হলেও ধৃতরাষ্ট্র কর্তৃক শ্রীকৃষ্ণকে যথেষ্ট সৌজন্য ও আতিথেয়তা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে নাটকের পরিসমাপ্তি ঘোষিত হয়। যদিও কিছু কিছু দৃশ্যে যেমন-শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখে দুর্যোধন কর্তৃক দ্যূতক্রীড়া কালে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করা, এবং সর্বোপরি দূত শ্রীকৃষ্ণের সাথে দূর্যোধনের উক্তি প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে কবি তাঁর মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তথাপি নাট্যরসের পরিপন্থী কিছু বিষয় যেমন অতিরিক্ত অদ্ভুত রস সৃষ্টি, শ্লথগতি ও দীর্ঘ সংলাপ নাটকটিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেনি।

দূতঘটোৎকচ :— দূতঘটোৎকচ’ মহাভারতীয় যুদ্ধপর্বের কাহিণী অবলম্বনে রচিত একাঙ্কিকা, যার পারিভাষিক নাম হল ‘উৎসৃষ্টিকাঙ্ক’। পাণ্ডবপক্ষীয় অর্জুনপুত্র অভিমন্যু চক্রব্যূহ ভেদ করতে গিয়ে অন্যায়যুদ্ধে কৌরবগণ কর্তৃক নিহত হলে পুত্রশোকাহত অর্জুন পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হন। সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবপক্ষ থেকে দূতরূপে ভীমপুত্র ঘটোৎকচকে শাস্তি প্রস্তাব দিয়ে দূর্যোধনের রাজসভায় প্রেরণ করলেন। ঘটোৎকচ দুর্যোধন ও ধৃতরাষ্ট্রের ভাবী অমঙ্গলের কথা জানালে দূর্যোধনের সঙ্গে তুমুল বাদবিতণ্ডা শুরু হয়। যার পর নাই অপমানিত ও ক্রুদ্ধ ঘটোৎকচ ধৃতরাষ্ট্রের প্রবোধ বাক্যে সংযত হন। নাটকের নামকরণের ইঙ্গিত ঘটনার মধ্যে দিয়ে স্পষ্টই প্রতিফলিত হয়েছে। মহাভারতের চরিত্রগুলি কবি হুবহু ব্যবহার করেছেন কিন্তু কবির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মৌলিক চিন্তা ভাবনা নাটকের সংলাপ সৃষ্টিতে ও ঘটনা বিন্যাসের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে। নাটকের সমাপ্তি শ্লোকে চিরাচরিত প্রথায় ভরতবাক্য দৃষ্ট হয় না, তৎ পরিবর্তে বিশেষ তাৎপর্য পূর্ণ ঘটোৎকচের উক্তি সন্নিবিষ্ট হয়েছে।—যথা—

ধর্মংসমাচর,কুরু স্বজন-ব্যপেক্ষা
যৎ কাঙ্খিতং মনসি সর্বমিহানুতিষ্ঠ।
জাত্যোপদেশ ইব পাণ্ডবরূপধারী
সূর্যাং শুভিঃ সমমুপৈষ্যতি বঃ কৃতান্তঃ।। ১৫২

মধ্যমব্যায়োগ :—এইটিও মহাভারতীয় কাহিনী অবলম্বনে একাকিকা। আলোচ্য দৃশ্যকাব্যের নামই বুঝতে সাহায্য করে যে এইটি ব্যায়োগ শ্রেণীর দৃশ্যকাব্য। তবে ‘মধ্যম’ কথাটির ইঙ্গিত ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাবে। মহাভারত থেকে মধ্যম পাণ্ডব ভীম, ভীমপুত্র ঘটোৎকচ এবং ভীমপত্নী হিড়িম্বার চরিত্রগুলিকে কেবল মাত্র গ্রহণ করে কবি তাঁর নিজস্ব কল্পনাদ্বারা এই দৃশ্যকাব্যের ঘটনা বিন্যাস করেছেন। যখন পাণ্ডবগণ বনবাসে ছিলেন সেই সময়ে মধ্যমপাণ্ডব ভীম এর সাথে ঘটোৎকচ ও হিড়িম্বার মিলন ঘটানোই নাট্যকারের উদ্দেশ্য ছিল। তদনুযায়ী নাটকে দেখি- বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁর তিনপুত্র সহ ও পত্নীসহ ঘটোৎকচের কবলে পড়ে। ঘটোৎকচ তার মাতা রক্তপিপাসু হিড়িম্বার পিপাসা নিবারণের নিমিত্ত কাকুতি মিনতি করেও কোন ফল না হওয়ায় অবশেষে মধ্যমপুত্রকে দেওয়াই স্থির হল। সেই পুত্রটি তার শেষ পিপাসা নিবারণের নিমিত্ত বনমধ্যে জলের সন্ধানে প্রবেশ করে ফিরতে বিলম্ব করলে ঘটোৎকচ মধ্যম মধ্যম বলে ডাকতে থাকলেন। মধ্যম ডাক শুনে মধ্যমপাণ্ডব ভীম বেড়িয়ে এলেন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তখন ভীমের কাছে পুত্রের প্রাণ ভিক্ষার নিমিত্ত সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন, এদিকে ভীমের সাথে ঘটোৎকচের প্রচণ্ড-তর্ক বিতর্ক শুরু হয়, বাগযুদ্ধে দু’জনেই সমান পারদর্শিতা দেখালে ক্রমে ভীম ঘটোৎকচকে নিজ পুত্র বলে আবিষ্কার করেন। তথায় কোলাহল শুনে হিড়িম্বাও উপস্থিত হন। পুত্র বাৎসল্যে আনন্দিত হন। এদিকে বৃদ্ধব্রাহ্মণের মধ্যমপুত্রও মুক্তি পায়। একাধারে বীর ও বাৎসল্য রসের সমন্বয়ে নাটকটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এক অঙ্কের মধ্য দিয়েই কবি অসামান্য নাট্য শিল্পের পরিচয়ে দৃশ্যকাব্যটিকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ও কৌতুক পরিবেশনে আনন্দময় করে তুলেছেন।

পঞ্চরাত্র :— -’সমবকার’ জাতীয় তিন অঙ্ক সমন্বিত মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘পঞ্চরাত্র’ ভাসের অপর একটি কাব্যপ্রতিভার নিদর্শন। উল্লেখ্য যে এতক্ষণ পর্যন্ত্য মহাভারতীয় ঘটনা অবলম্বনে প্রতিটি দৃশ্যকাব্যই ছিল একাঙ্কিকা’। একমাত্র পঞ্চরাত্রই তিন অঙ্কের দৃশ্যকাব্য। মহা ভারতের বিরাটপর্বের বিষয়। কপট পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে পঞ্চপাণ্ডব যখন দ্বাদশবৎসর বনবাসে থেকে ত্রয়োদশ বৎসর অজ্ঞাতবাসে কাটাচ্ছিলেন সেই সময়ে দ্রোণাচার্য দেখলেন এইবার তো কুরু পাণ্ডবের যুদ্ধ অনিবার্য। করুপাণ্ডবের বিবাদ মিটিয়ে যাতে তাদের মিলিত করা যায় সেই প্রচেষ্টায় তিনি দুর্যোধনকে এক যজ্ঞ সম্পন্ন করার পরামর্শ দিলেন। দুর্যোধন সেই প্রস্তাবে সম্মত হয়ে যজ্ঞ সম্পাদন করলেন। পিতামহ ভীষ্ম ও গুরু দ্রোণ দুর্যোধনের এই ধর্মাচরণ দেখে খুবই আহ্লাদিত হলেন। যজ্ঞশেষে দুর্যোধন গুরুকে দক্ষিণা স্বরূপ কিছু দিতে আগ্রহী হলে সেই অবসরে দ্রোণ পাণ্ডবগণের জন্য অর্ধেক রাজ্য চাইলেন। কিন্তু শকুনি বাদ সাধলেন, তিনি একশর্ত আরোপ করলেন যে-’যদি পঞ্চরাত্রেণ পাণ্ডবাণাং প্রবৃত্তিরুপণে তব্যা, রাজ্য স্যার্দ্ধং প্রদাস্যতি কি।’ পাঁচরাত্রির মধ্যে পাণ্ডবদের সংবাদ চাই, সংবাদ এনে দিতে পারলেই অর্ধেকরাজ্য প্রদান করা হবে। এমন সময় দূত মারফৎ খবর পাওয়া গেল কীচক বধ হয়েছে সেই কারণে বিরাট রাজ দুর্যোধনের যজ্ঞানুষ্ঠানে কাজের নিমিত্ত ভীষ্মের পরামর্শানুযায়ী বিরাট রাজার গো অপহরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। বৃহন্নলারূপী অর্জুন সেই যুদ্ধে কৌরবগণকে পরাজিত করে গোধন উদ্ধার করেন। এই যুদ্ধ জয়ের ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই বিরাটরাজ প্রবল খুশী হলেন এবং নিজ কন্যা উত্তরার সাথে অর্জুন পুত্রের বিবাহ দিলেন। বিবাহবাসরে ভীষ্ম, দ্রোণ, সহ কৌরবগণ নিমন্ত্রিত হলেন এইভাবে পাণ্ডবগণের অজ্ঞাতবাসের পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ল। অতঃপর দূর্যোধন অর্ধ রাজ্য প্রদান করতে বাধ্য হলেন এই ভাবে নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে। চরিত্রগুলি মহাভারতে বর্তমান থাকলেও কবি তাঁর নিজস্ব ঢঙে চরিত্রগুলির অনেক পরিবর্তন করেছেন। পাঁচরাত্রির মধ্যে পাণ্ডবগণের সংবাদ আনার শর্ত ছিল, সেইহেতু নামকরণ সার্থক।

বালচরিত :—মহাভারতের ‘খিল’ বা হরিবংশের কাহিনী অবলম্বনে ভাসের পঞ্চাঙ্ক নাটক ‘বালচরিত’। নাটকের প্রস্তাবনায় সূত্রধার কর্তৃক চার যুগে বিষ্ণুর চার অবতারের স্তুতি বর্ণিত হয়েছে। নারদের সংলাপের মধ্য দিয়ে জানা গেল স্বয়ং বিষ্ণু দেবকীর গর্ভে কৃষ্ণরূপে জন্ম নিয়েছে কংসকে নিধনের জন্য। কারণ সেই সময়ে কংসের অত্যাচারে জীবকুলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। বসুদেব নবজাত শিশুকে নিয়ে দুর্যোগপূর্ণ রাত্রিতে বার হলেন গোকুলের উদ্দেশ্যে, গোপরাজনন্দের কাছে কৃষ্ণকে রেখে তার সদ্যজাতা কন্যাকে নিয়ে মথুরায় ফিরলেন। শিশু-পুত্রকে গ্রহণ করেই নন্দগোপ বহু অলৌকিক ঘটনার আভাস পেলেন। অপরদিকে কংস নানান অমঙ্গল ইঙ্গিতে ভীত হতে থাকলেন। তার শান্তি বিঘ্নিত হল। গোকুলে কৃষ্ণ একে একে পূতনা, শকটাসুর, ধেনুক, বেণীকালীয় প্রভৃতিকে দমন করে গোপেদের আনন্দবর্ধন করছেন। গোপেরা বালককৃষ্ণের মহিমায় চমৎকৃত। এমন সময় কংসরাজ মথুরায় ধনুমহ নামে এক মহোৎসবের আয়োজন করলে সেখানে শ্রীকৃষ্ণ সঙ্কর্ষণও নিমন্ত্রিত হয়েছেন। তথায় উপস্থিত হয়ে চানুর, মুষ্টিক প্রভৃতি দানবের সাথে কৃষ্ণ কংসকেও বধ করলেন। এবং কংসের বন্দী পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়।

বালকৃষ্ণের অলৌকিক লীলা ও বীরত্বের প্রদর্শনই নাটকের মূল ভাবনা। তাই বালচরিত নাম সার্থক। হরিবংশের ঘটনাকে অবলম্বন করলেও স্থানে স্থানে কবি তার নিজের মতন পরিবর্তন করে নিয়েছেন। তবে বালচরিত নাম হলেও নাটকটি বীররস, শান্তরস, অদ্ভুতরসে পূর্ণ, করুণরস ও ভক্তিরসেরও সমাবেশ নাটকটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তবে নাটকটিতে রাধার প্রসঙ্গ বা কোনরূপ প্ৰণয়লীলা ও শৃঙ্গাররস একেবারেই অনুপস্থিত।

অবিমারক :—অজ্ঞাতপরিচয় চণ্ডাল যুবকের সাথে জনৈক রাজকন্যার প্রণয় কাহিনী নাটকে বর্ণিত হয়েছে। ষষ্ঠাঙ্ক নাটক অবিমারকে এই অজ্ঞাত পরিচয় যুবক আসলে—সৌবীররাজ পুত্র বিষ্ণুসেন। চণ্ডভার্গব ঋষির অভিশাপে তিনি চণ্ডালত্ত্ব প্রাপ্ত হলে ধূমকেতু নামে এক অসুরকে বধ করে তিনি অবিমারক নামে পরিচিত হয়েছেন। অবি অর্থাৎ মেঘ মারক অর্থাৎ হত্যাকারী। আবার একসময়ে তিনি মত্ত হাতির কবল থেকে কুন্তী ভোজের কন্যা কুরঙ্গীকে রক্ষা করেন এবং উভয়ে প্রণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। কুরঙ্গীর পিতা যুবকের আত্মপরিচয় জানতে চাইলেন এবং নিজ কন্যাকে তার হাতে সমর্পণ করতে চাইলেন। কিন্তু অবিমারক নীচ জাতি বলে কুরঙ্গীর পিতা মত বদল করে রাজকুমারীকে কাশীর রাজপুত্র জয়বর্ম-র হাতে সমর্পণ করাই মনস্থ করলেন।

কুরঙ্গী ও অবিমারকের প্রেম ততদিনে প্রগাঢ় হওয়ায় ধাত্রী নলিনিকারের সাহায্যে রাজকুমারী ও অবিমারকের ছদ্মবেশে মিলনও সংঘটিত হয়। প্রণয়ের পথে যখন অজস্র বাধা সেই সময়ে অবিমারক এক বিদ্যাধরের সাক্ষাৎ পায়। বিদ্যাধরের প্রদত্ত আংটির অলৌকিক শক্তির বলে প্রতিরাত্রে অবিমারক রাজকুমারীর সাথে মিলিত হতে লাগলেন। অবশেষে নারদ মধ্যস্থতায় প্রকাশ্যে উভয়ের বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। সেই সাথে অবিমারকের আসল পরিচয় প্রকাশ পেলে রাজপুত্র বিষ্ণুসেনের সাথে রাজকুমারী কুরঙ্গীর মিলনের সকল বাধা দূর হয়ে যায়। Winternitz যদিও এটিকে প্রকরণ বলেছেন তথাপি নাটকের বৈশিষ্ট্যই এক্ষেত্রে স্পষ্ট। একনিষ্ঠ প্রেমের মহিমায় নায়ক অবিমারক, সকল প্রকার ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। ‘কথাসরিৎ সাগর’ থেকে বিষয় সংগ্রহ করলেও, চরিত্রগুলিকে তিনি নিজের কল্পনা দিয়ে রঞ্জিত করেছেন। বিশেষ করে নারদের চরিত্র ও বিদ্যাধরের আগমন বিদূষকের সম্পূর্ণ মৌলিক সংযোজন। আংটি প্রদানের ঘটনা নাটকটিকে অন্যমর্যাদা দিয়েছে। অনেকে নাটকটি Shakespear-এর Romeo and Juliet এর সাথে তুলনা করেছেন।

চারুদত্ত :—চারঅঙ্কের অসমাপ্ত নাটক চারুদত্ত। কারণ পুঁথিটির প্রথমঅংশ এবং শেষাংশ উদ্ধার করা যায়নি। চারুদত্ত ও ‘মৃচ্ছকটিক’ এই দুটি নাটকের পারস্পরিক মিল বিশেষজ্ঞদের সামনে অনেক প্রশ্ন তুলে ধরেছে। চারুদত্ত আগে না মৃচ্ছকটিক আগে লিখিত হয়েছে? এই দুইটি রচনাই একই ব্যক্তির কিনা? ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। উজ্জয়িনীর অভিজাত সমৃদ্ধশালী বণিক হলেন চারুদত্ত। তিনি ছিলেন উদার প্রাণ ও দানশীল ব্যক্তি; সেইহেতু তাঁর সমস্ত বৈভব ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। এইরূপ স্বভাবের যুবকের প্রতি—আকৃষ্ট হন বসন্তসেনা নাম্নী এক গণিকা। সেও জন্মসূত্রে গণিকা হলেও স্বভাব চরিত্রে অতি মহনীয়া। নগর নটী বসন্তসেনা, ধীরে ধীরে সেই বারবণিতা পথমধ্যে দুর্বৃত্তদের হাতে হেনস্থা হলে কোনক্রমে গিয়ে উপস্থিত হন চারুদত্তের গৃহে এবং সেখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। সেই সময় তাঁর গায়ের সব গহনা খুলে সে চারুদত্তের কাছে গচ্ছিত রাখেন। এদিকে সজ্জলক নামে এক চোর চারুদত্তের ঘরে সিঁধ কেটে ঢুকে সেই গহনা চুরি করলে চারুদত্ত খুব বিপদে পড়েন। লজ্জায় সেই কথা কাউকে বলতে না পেরে বুদ্ধি করে সেই গহনার পরিবর্তে তাঁর নিজ পত্নীর মুক্তাহার নিজসহচরের হাত দিয়ে বসন্ত সেনার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়। এদিকে চোর সজ্জলক তার প্রণয়ীকে খুশী করার উদ্দেশ্যে সেই গহনা উপহার দেয় প্রণয়ী মদনিকাকে। যে নাকি বসন্ত সেনার পরিচারিকা। অতএব মদনিকা ও বসন্তসেনা সেই অলঙ্কার চিনতে পেরে ও তাদের প্রণয় কাহিনী অবগত হয়ে মদনিকাকে উপযুক্ত সময় বুঝে সজ্জ লকের হাতেই সমর্পণ করেন। অতঃপর চারুদত্ত কর্তৃক প্রেরিত মুক্তাহার কণ্ঠে ধারণ করে বসন্ত সেনা চারুদত্তের অভিসারে যাওয়াই স্থির করলেন।

প্রকরণ জাতীয় চার অংকের এই দৃশ্যকাব্যটি অসমাপ্ত, সেহেতু ভরতবাক্যও অনুপস্থিত। চারু অর্থে সুন্দর। তাই নায়ক তার সুন্দর দানের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন বলেই হয়ত নায়কের চারিত্রিক লক্ষণের প্রতি লক্ষ্যরেখেই নায়কের নাম ও তদনুযায়ী নাটকের নাম হয়েছে চারুদত্ত।

প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ :—নাট্যকার ভাস তার স্থাপনায় স্বয়ং বলেছেন- ‘প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ’ প্রকরণ জাতীয় দৃশ্যকাব্য। কিন্তু এতে নাটকের লক্ষণ সুস্পস্ট। চার অংকের এই নাটিকার তিনটি প্রাচীন পুঁথি পাওয়া গেছে। ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দুটি নাম দৃষ্ট হয়—(১) প্রতিজ্ঞা যৌগন্ধরায়ণ, (২) প্রতিজ্ঞানাটিকা। যদিও দুটি নামই সার্থক এবং গ্রহণযোগ্য। নাটকটির মূল নিহিত রয়েছে গুণাত্যের ‘বৃহৎ কথা’ মধ্যে। মূল বৃহৎকথা বর্তমানে লুপ্ত, তার থেকে রচিত যে বৃহৎত্রয়ী তার মধ্যে সোমদেব রচিত ‘কথাসরিৎসাগর’। নাট্যকার ভাস মূল কাহিনীর সঙ্গে বহু সংযোজন ও বিয়োজন করেছেন। নাটকটির বিষয়বস্তু সংক্ষেপে হল-বৎসরাজ উদয়ন ছিলেন বীণা বাদনে সিদ্ধহস্ত। রাজধানী-কৌশাম্বীর রাজপ্রাসাদে উদয়নের মন্ত্রী ছিলেন যৌগন্ধরায়ণ। গল্পে উদয়নের হস্তি শিকার প্রসঙ্গে আলোচনা দৃষ্ট হয়। এদিকে অবন্তীরাজ মহাসেন কৃত্রিম হাতির ছলনায় ভুলিয়ে উদয়ন-কে বন্দী করে ফেলেন। এক্ষণে বন্দী উদয়নকে উদ্ধার করার জন্য মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ প্রতিজ্ঞা করেন। এই কারণে—নাটকের নাম সার্থক। তাঁর প্রথম প্রতিজ্ঞা—যদি শত্ৰুবলগ্রতো রাহুনা চন্দ্রমাধুব। মোচয়ামি ন রাজানং নাস্মি যৌগন্ধরায়ণঃ ॥ ১।১৬ অর্থাৎ রাহুগ্রস্ত চন্দ্রমাতুল্য শত্রুগণগ্রস্ত মহারাজকে যদি উদ্ধার করতে না পারি তবে আমার যৌগন্ধরায়ণ নামই নিষ্ফল।

ঘটনাক্রমে অবম্ভীরাজ কন্যা বাসবদত্তার বীণা বাদক শিক্ষক নিযুক্ত হন উদয়ন। সেই সুযোগে উদয়ন ও বাসবদত্তার মধ্যে প্রণয়ের সুত্রপাত ঘটে। অবন্তীরাজ মহাসেন ও তাঁর রানীর মধ্যে বিদূষী কন্যার বিবাহের আলোচনা চলে। রানীর ইচ্ছা বাসবদত্তাকে উদয়নের হস্তে সমর্পণ করে। কিন্তু রাজা বাদ সাধলেন। সেই খবর পেয়ে দুই পক্ষের মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ ও রুমন্বান নানা পরামার্শ করেন ও বিদূষক নানা ছদ্মবেশে যেমন কখনও উন্মাদ, কখনও ভিক্ষুক কখনওবা শ্রমণ সেজে বন্দী উদয়নের সাথে মিলিত হতে থাকলেন। এবং উদয়ন ও বাসবদত্তার গোপন প্রণয় ও বিবাহ বিষয়ে নানারূপ কূট কৌশল প্রয়োগ করেন। ছলে বলে কৌশলে উদয়নকে শৃঙ্খল মুক্ত করে সস্ত্রীক উদয়নের পলায়ন প্রভৃতি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। অবশেষে রাজা মহাসেন উদয়নকে জামাতারূপে স্বীকার করে নেন। তৃতীয় অঙ্কের অষ্টম ও নবম শ্লোকে মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণের বাকী দুটি প্রতিজ্ঞার কথা রয়েছে। দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞা—

“সুভদ্রামিব গাণ্ডীবী নাগঃ পদ্মলতামিব।
যদি তাং ন হরেদ রাজা নাম্মি যৌগন্ধরায়ণঃ” ৩৮

অর্থাৎ সুভদ্রাকে যেমন অর্জুন হরণ করেছিলেন। গজরাজ যেভাবে মৃণালি হরণ করে থাকে। মহারাজ উদয়ন যদি সেরূপে রাজকন্যাকে হরণ করতে ব্যর্থ হয় তবে আমার যৌগন্ধরায়ণ নাম বৃথা।

তৃতীয় প্রতিজ্ঞা :—

“যদি তাং চৈব তং চৈব তাং চৌরায় তলোচনাম্।
নাহরাজি নৃপং চৈব পদ্মি যৌগন্ধরায়ণঃ” ৩।৯

অর্থাৎ আমি যদি ঘোষবর্তী বীণা, নলাগিরি হাতী, এবং বাসবদত্তা সহ রাজাকে উদ্ধার করতে না পারি তবে আমার যৌগন্ধরায়ণ নামই নিষ্ফল।

বৃহৎ কথা প্রসিদ্ধ উদয়ন কথার বিষয় অবলম্বনে নাটকটিতে কবি তার নিজ কল্পনা প্রসূত ঘটনা বিন্যাস করেছেন। রাজনৈতিক পটভূমিকার আধারে রচিত কাহিনীতে উদয়ন ও বাসবদত্তার প্রেম কাহিনী বর্ণিত।

স্বপ্নবাসবদত্তা :—স্বপ্নবাসবদত্তাই মহাকবি ভাসরচিত সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক। কোন কোন সমালোচকের মতে প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণের উপসংহার স্বরূপ এই নাটক। কেউ বা বলেন প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই কবি ‘স্বপ্নবাসবদত্তা রচনা করেছিলেন। ছয় অঙ্কের এই নাটকে উদয়ন-বাসবদত্তা ও পদ্মাবতীর কাহিনীই প্রধান অবলম্বন। আমরা প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ নাটকে দেখেছি রাজা উদয়ন ও বাসবদত্তার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। এক্ষণে মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ এক ভবিষ্যদ্বাণী শুনলেন যে মগধ রাজকন্যা পদ্মাবতীর সাথে উদয়নের বিবাহ হলে উদয়নের ভাগ্যোদয় ঘটবে। তার হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার হবে এই বিশ্বাসের বলে মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ, অবন্তী রাজ্যের মন্ত্রী রুমম্বান ও রাজমহিষী বাসবদত্তার সাথে পরামর্শ করে অগ্নিদাহে বাসবদত্তা ও নিজে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন এইরূপ রটনা করেন। এদিকে বাসবদত্তাকে ছদ্মবেশে (আবস্তিকা নামে) পদ্মাবতীর নিকট গচ্ছিত রাখেন। অবশেষে উদয়ন ও পদ্মাবতীর বিবাহ হয়। উদয়ন বাসবদত্তাকে ভুলতে পারে না। তার স্মৃতি অহর্নিশ তার সাথে ছায়ার মত রয়েছে। ঘটনাক্রমে একদিন রাজা উদয়ন পদ্মাবতীর খোঁজে তার কক্ষে এসে দেখেন পদ্মাবতী নেই, তখনরাজা তাঁর শূন্য-বিছানায় শয়ন করে নিদ্রা যান, এদিকে বাসবদত্তা তাকে পদ্মাবতী ভেবে শয্যাপার্শ্বে এসে বসেন। যখন তিনি বুঝলেন ইনি উদয়ন, তখন উদয়ন বাসবদত্তার কথা ভাবতে ভাবতে তাঁর কথাই বলতে শুরু করেন। সেই সব কথা বাসবদত্তা নিজ কানে শুনেছেন। বাসবদত্তা দৌড়ে পালাতে গেলে উদয়ন তাকে চেষ্টা করে ধরতে পারলেন না। এমন সময় অবম্ভীরাজ মহাসেনের কাছ থেকে বাসবদত্তার ধাত্রী এলেন উদয়নের সভায়, সঙ্গে করে এনেছেন বাসবদত্তার একটি ছবি। তাই দেখে পদ্মাবতী আবম্ভিকার ছদ্মবেশ ধরতে পারলেন এমন সময় সেখানে মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ পরিব্রাজকের ছদ্মবেশে সভায় উপস্থিত হলো। উদয়নের নিকট সমস্ত ঘটনা বলে বারংবার ক্ষমা চেয়ে নিলেন, উদয়ন তখন বুঝলেন যে শত্রু আরুনিকে পরাজিত করার নিমিত্তই এই সমস্ত কৌশল করা হয়েছে। পদ্মাব- তীর সাথে বিবাহের ফলে মগধরাজের মৈত্রীও তিনি অর্জন করেছেন। উদয়ন- বাসবদত্তার পুর্ণমিলনের মধ্য দিয়ে নাটকের যবনিকা পাত হয়। স্বপ্নবাসবদত্তা ভাসের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। পঞ্চম অঙ্কে দ্রষ্টব্য স্বপ্নদৃশ্য সত্যিই চমৎকার ও রোমাঞ্চকর। স্বপ্নদৃশ্যের মধ্যে দিয়েই বাসবদত্তাকে রাজা ফিরে পেয়েছেন। তাই সেদিক থেকে নাটকের নামকরণও সার্থক হয়েছে। নাটকীয় ঘটনার মৌলিকত্ত্বে, চরিত্র চিত্রণে, সর্বোপরি রসের ধারায় নাটকটি স্নাত। আলঙ্কারিকদের উদ্ধৃতি, বিদগ্ধ-সমালোচকদের সম্রশংস বক্তব্য নাটকটিকে শুধু আকর্ষণীয়ই নয় অতীব জনপ্রিয় করে তুলেছে।

নাট্যকার ভাসের লিখন শৈলী :— কালিদাস পূর্বযুগের অন্যতম প্রতিভাধর কবি ভাস সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যাকাশের একটি উজ্জ্বল তারকা। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে এত বেশী সংখ্যক নাটক রচনা ও এত বিভিন্ন বিচিত্র স্বাদের নাটক ভাস ভিন্ন অপর কোন নাট্যকারের নেই। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, প্রচলিত কাহিনী সমূহ সর্বতোভাবে পরবর্তীকালীণ সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে এ কথা সকলেই স্বীকার করেন। ভাসও অধিকাংশ নাটকের পটভূমিকা রামায়ণ, মহাভারত, বৃহৎকথা প্রভৃতি থেকে সংগ্রহ করেছেন, সেকথা সত্য, কিন্তু নাটক রচনা করতে গিয়ে যে মৌলিক ভাবের পরিচয় দিয়েছেন তা অতুলনীয়। ‘কর্ণভার’, ‘উরুভঙ্গ’ ‘পঞ্চরাত্র’ ‘দূতঘটোৎকচ’ ‘মধ্যমব্যয়োগ’ প্রভৃতি নাটকের মূল বিষয়বস্তু অতিসংক্ষিপ্ত তথাপি ভাসের নাট্যকলার পরিপাট্যে সেইসব সংক্ষিপ্ত বিষয় যেন নানা বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়ে অভিনব-ভঙ্গিমায় আত্মপ্রকাশ করেছে। নাটকের সংলাপ একটি মুখ্য বিষয়। কালিদাস বা তৎপরবর্তী নাট্যকারগণের তুলনায় ভাসের সংলাপ সংযত, ‘মার্জিত, এককথায় বাহুল্য বর্জিত দীর্ঘ বর্ণনার দ্বারা কোথাও তাঁর রচনা শ্লথ হয়নি! Winternitz ভাসের নাটকচক্র সম্বন্ধে বলেন- “are all very dramatic full of life and action.” নাটকীয় গতি দ্রুত অথচ সাবলীল ও বলিষ্ঠ। যে কারণে তাঁর একাঙ্কিকা গুলি সত্যই প্রশংসনীয়। ভাসের একাঙ্ক নাটকগুলিকে সমালোচকেরা আধুনিক একাঙ্ক নাটকের সাথে তুলনা করেছেন। ভাসের ভাষা সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর। গদ্যই হোক অথবা পদ্যই হোক উভয়ই স্বচ্ছ স্পষ্ট ও সর্বপ্রকার ত্রুটিমুক্ত। বৈদভীরীতির কবি ভাসের রচনা প্রসাদগুণ বিশিষ্ট। দীর্ঘসমাস বর্জিত, সকল প্রকার কৃত্রিমতা বর্জিত বলেই ভাসের রচনা বাগদেবীর নির্মলহাসির সাথে তুলনীয়।

কাব্যে অলঙ্কার গুলিরও প্রয়োগ করেছেন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। পাণ্ডিত্য প্রকাশ করতে গিয়ে অলঙ্কারের আতিশয্য দেখা যায় না কোথাও। অনুপ্রাস, যমক, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, স্বভাবোক্তি প্রভৃতি অলঙ্কারের মুর্ছনা ভাসের রচনাকে সহজেই দর্শকের হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। তিনি অনুষ্টুপ্‌ছন্দের বেশী ব্যবহার করেছেন, তাছাড়াও বংশস্থবিল, পুষ্পিতাগ্রা, বসন্ততিলক, উপজাতি জাতীয় সহজ সরল ছন্দের প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। আবার কোন কোন স্থানে স্রগ্ধরা, শার্দুলবিক্রীড়িত, ছন্দের প্রয়োগ তার রচনাকে ভাবের গাম্ভীর্য দান করেছে।

নাটকের চরিত্রগুলি রামায়ণ, মহাভারত খ্যাত বিশিষ্ট চরিত্র, সে কারণে পাঠকগণের পূর্ব পরিচিত, তথাপি নাটকীয় চরিত্রচিত্রণে তিনি এতটাই মৌলিক যে চিরপরিচিত চরিত্রগুলিও যেন নিজনিজ বৈশিষ্ট্যে অভিনব ভঙ্গিমায় ধরা দেয়। প্রতিমা নাটকে ভরতের মর্মবেদনা, রামের দৈবী মহিমার পরিবর্তে মর্ত্যের মানব রূপের প্রকাশ। উরুভঙ্গ নাটকে দুর্যোধনের চরিত্র অথবা কর্ণভার নাটকে ইন্দ্রের ছলনাসত্ত্বেও কর্ণের যে মহৎ চরিত্র তিনি চিত্রিত করেছেন তা অবিস্মরণীয়। রাজার নর্মসহচর বিদূষকের চরিত্রও তাঁর হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় সংস্কৃত সাহিত্যের চিরাচরিত বিদূষক চরিত্রকে অনায়াসেই অতিক্রম করে যায়।

আমরা পূর্বেও আলোচনা করেছি যে—ভাস নাট্যশাস্ত্রের বিরোধী কিছু বিষয় নাটকে প্রদর্শন করেছেন যেমন (মঞ্চে যুদ্ধ, মৃত্যু) ইত্যাদি। কিন্তু তাই বলে নাটকের মান এতটুকুও খর্ব হয়নি। বরঞ্চ বলা হয়ে থাকে ভাসের নাটকগুলি মঞ্চে অভিনয় করার পক্ষে বেশী উপযোগী, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি এতবেশী প্রাণচঞ্চল ও সজীব, যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই মঞ্চ উপযোগী হয়ে ওঠে।

রাজশেখর একটি শ্লোকে বলেছেন যে ভাসের নাটকচক্র সমালোচনার অগ্নিতে প্রক্ষিপ্ত হলে এক মাত্র স্বপ্নবাসবদত্তাই অদগ্ধ ছিল। স্বপ্নবাসবদত্তা ভাসের অকৃত্রিম চেষ্টা ও নিষ্ঠার ফসল। সমগ্রনাটক চক্রের মধ্যে স্বপ্নবাসবদত্তা নাটকই অধিক জনপ্রিয় ও সর্বাধিক প্রশংসার দাবীদার।

বিষ্ণুর উপাসক কবি ভাস হিন্দুধর্ম, যজ্ঞানুষ্ঠান, পুরাণ প্রভৃতির উপর যথেষ্ট নিষ্ঠাবান ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। উপরন্তু ভাস বিরচিত জ্ঞানগর্ভ সুভাষিতের প্রয়োগ

আমাদের বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশের সহায়ক।

ক. হতেষু দেহেষু গুণাধরন্তে (কর্ণভার)

খ. মাতা কিল মনুষ্যানাং দৈবতানাং চ দৈবতাম্। (মধ্যমব্যয়োগ)

গ. চক্রারপঙ্ক্তিরিব ভাগ্যপঙ্ক্তি। (স্বপ্নবাসবদত্তা)

ঘ. স্বত্বা স্বত্বা যাতি দুঃখং নবত্বম্। (স্বপ্নবাসবদত্তম্)

ঙ. কর্তারঃ সুলভা লোকে বিজ্ঞাতারস্তুদূর্লভাঃ (স্বপ্নবাসবদত্তা)

এইরূপ বহু উপদেশবাক্য ভাসের রচনাকে তথা সংস্কৃত সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এবং মহাকবি ভাসকে চিরন্তন গৌরবের অধিকারী করেছে। ভাসের লিখন শৈলী মাধুর্য পূর্ণ। সুসংহত ও সর্বোপরি অনুকরণীয়। সেহেতু পরবর্তী কালের কবিগণ যেমন কালিদাস, ভবভূতি, শূদ্রক প্রভৃতি কবিরা তাঁর রচনাশৈলী দ্বারা একান্তভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।

অশ্বঘোষ

কালিদাস পূর্ব যুগের নাট্যকারগণের প্রসঙ্গে মহাকবি অশ্বঘোষের নাম উল্লেখ্য। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর রাজা কণিষ্কের সমসাময়িক এই ব্যক্তিত্ব শুধুমাত্র কবিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে পণ্ডিত, দার্শনিক ও বৌদ্ধধর্ম প্রবক্তা। আচার্য অশ্বঘোষ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা এই বইয়ের মহাকাব্য প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য। এক্ষণে আমরা নাট্যকার অশ্বঘোষের নাটক সম্বন্ধে আলোচনা করব। প্রাচীন নাট্যকাররূপে সংস্কৃতনাট্য সাহিত্যে তাঁর মৌলিক সংযোজনের একটি বিশেষ ঐতিহ্যপূর্ণ দিক বর্তমান। এশিয়ার তুর্কীস্তানের তুরফান অঞ্চলে যে তিনটি তালপাতার পুঁথি পাওয়া গেছে তার মধ্যে একটি ‘শারিপুত্র প্রকরণ’–এই দৃশ্যকাব্যের পুষ্পিকায় লেখক ‘সুবর্ণাক্ষী পুত্র অশ্বঘোষ’ বলে নিজের পরিচয় জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু অবশিষ্ট নাটক দুটিতে সেরূপ কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, তথাপি সে দুটি নাটক অশ্বঘোষের রচনা বলেই অনুমান করা হয়ে থাকে। এছাড়াও রাষ্ট্রপাল নামক অপর একটি নাটক অশ্বঘোষের রচনা বলে জানা যায়, ন্যায় বিনিশ্চয় গ্রন্থের টীকা থেকে।

শারিপুত্র প্রকরণ :—অশ্বঘোষ বিরচিত নয় অঙ্কে সম্পূর্ণ দৃশ্যকাব্যটির নাম থেকেই বোঝা যায় যে এইটি প্রকরণ জাতীয়। এই নাট্যকলার অপর নাম শারদ্বতীপুত্র প্রকরণ। ব্রাহ্মণ শারিপুত্র ও মৌদ্‌গল্যায়নের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষালাভের ঘটনাই এর মূলবিষয়বস্তু, শারিপুত্র তার প্রিয়বয়স্য বিদুষকের নিকট বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাই শুনে বিদুষক বললেন, তা কি করে সম্ভব? ব্রাহ্মণ হয়ে ক্ষত্রিয়ের নিকট দীক্ষাগ্রহণ? শুনে শারিপুত্র বললেন—নীচ জাতির নিকটও প্রাণদায়ী ঔষধ সেবন করা উচিত। অতএব এইরূপ দীক্ষাগ্রহণে বাধা কোথায়? অতঃপর মৌদ্‌গল্যায়নকে সঙ্গে নিয়ে শারিপুত্র বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হলেন।

আলোচ্য নাটকটি অশ্বঘোষের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। আমরা জানি যে হিন্দুধর্মের জাতিভেদ, রক্ষণশীলতা অপেক্ষা বৌদ্ধধর্মের উদার দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিই সেকালের সর্বস্তরের মানুষ আকৃষ্ট হয়েছিল। এই যুগসন্ধিক্ষণের কবি হিসাবে ‘শারিপুত্রপ্রকরণে’ অশ্বঘোষের যুগমানসিকতা সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। কিন্তু কবির গভীর দর্শন বোধ বা ধর্মীয় ভাবাবেগ এতটাই সংযত যে সেকারণে নাট্য-শাস্ত্রের নিয়মানুযায়ী লিখিত এই নাটক অর্বাচীন নাটকগুলির সাথেও তুলনীয়। আথবা, উপজাতি, মালিনী, বসন্ততিলক প্রভৃতি ছন্দের প্রয়োগে সহজ, সরল, স্বচ্ছন্দ ভাবে সাবলীল নাটকীয় গতি বজায় রেখে নাট্য পরিবেশন অশ্বঘোষের নাটককে জনপ্রিয় করেছিল।

শরিপুত্রপ্রকরণ ভিন্ন অপর যে অসম্পূর্ণ নাটক দু’টি পাওয়া যায় তার একটি সামাজিক অন্যটি রূপক জাতীয়। প্রথম নাটকটি ধনী বণিকপুত্র সোমদত্ত ও নায়িকা মগধবতীর গল্প। নাটকে বিদূষক, কৌমুদগন্ধ, জনৈকরাজ কুমারী ও তার পরিচারিকা, আজীবক সন্ন্যাসী, ভট্টিদানক নাগরক ধনঞ্জয় প্রভৃতি চরিত্রের সমাবেশ দেখা যায়। চরিত্রগুলির পারস্পরিক সংলাপে নাট্য-কলার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়।

অপর নাটকটি রূপকধর্মী বা প্রতীকী বলা যায়। কীর্তি, ধৃতি, বুদ্ধি প্রভৃতি মানবিক মনোজগতের বিষয়গুলিকে এখানে এক একটি চরিত্রের সাথে কাল্পনা করা হয়েছে। একমাত্র ভগবান বুদ্ধই মনুষ্য চরিত্র হিসাবে বর্তমান।

অশ্বঘোষ রচিত ‘রাষ্ট্রপাল’ নামক নাটকে রাষ্ট্রপাল বুদ্ধের নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার পিতামাতার অনুমতির প্রয়োজন দেখা দিল। কিন্তু রাষ্ট্রপালের পিতা মাতা পুত্রের সন্ন্যাস গ্রহণ কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না। এমন সময় রাষ্ট্রপাল কোন উপায় না পেয়ে অনশন আরম্ভ করলেন। এইভাবে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতিও লাভ করলেন। বহুদিন পরে একদিন রাষ্ট্রপাল পিতামাতার নিকট ফিরে এলে পিতা তাকে সনাক্ত করতে পারলেন না, পুত্র শোকাহত পিতা ততক্ষণে সমস্ত বৌদ্ধদের যার-পর-নাই নিন্দায় মুখর। ইতিমধ্যে অন্তঃপুরের পরিচারিকা রাষ্ট্রপালকে চিনতে পারলে তাকে গৃহে ফেরানোর জন্যে বহু চেষ্টা করেও তাঁর পিতা ব্যর্থ হলেন। পিতার বিপুল ঐশ্বর্যকে অনায়াসে পদদলিত করে রাষ্ট্রপাল পুনরায় গৃহত্যাগ করে চলে যান। নাটকীয় ঘাত প্রতিঘাতে চরিত্র চিত্রণে অশ্বঘোষের নাটকগুলি সজীব ও প্রাণবন্ত। পণ্ডিতদের অনুমান সেযুগে বৌদ্ধদের মধ্যে এই ধরনের ধর্মীয় নাটকগুলির যথেষ্ট গুরুত্বছিল। এবং বৌদ্ধদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের কাজে অশ্বঘোষের নাটকের পঠন-পাঠন ও অভিনয় বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

প্রাকৃত ভাষায় মঞ্চনির্দেশনা ও বিদূষক প্রভৃতির সংলাপও প্রাকৃত ভাষায় লিখিত। অর্ধমাগধী প্রাকৃতের ব্যবহার অশ্বঘোষের রচনার অন্যতম ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য বলা যায়। অশ্ব ঘোষ তাঁর নাটক ‘নান্দ্যন্তে ততঃ প্রবিশতি সূত্রধার ইত্যারভ্য…।’ এইভাবে আরম্ভ করেছেন। অশ্বঘোষের নাট্য নৈপুণ্য স্থানে স্থানে তাঁর ধর্মীয় ভাবনাকে অতিক্রম করে কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে।

কালিদাস

কালিদাস হলেন সংস্কৃত সাহিত্য জগতের শীর্ষস্থানীয় কবি। তবে কালিদাস বললে কেবলমাত্র একজন কবিকেই বুঝায় না। সেই সাথে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য জগতের এক সুবর্ণ যুগেরও প্রতীতি জন্মে। কালিদাসের প্রাসঙ্গিক আলোচনা আমরা মহাকাব্য অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে করেছি। এক্ষণে নাট্যকার কালিদাসের অনবদ্য নাটক সমূহের প্রতি আলোক পাত করা যাক।

মহাকবি কালিদাস শ্ৰব্যকাব্য ও দৃশ্যকাব্য সাহিত্যের উভয় অঙ্গনেই সমান প্রতিভার সাক্ষ্য রেখেছেন। ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ ‘বিক্রমোর্বশীয়’ ও ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলা’ নামে তিনখানি শৃঙ্গার রসাত্মক অনবদ্য নাটক রচনা করেছেন।

‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ :–কালিদাসের প্রথম জীবনের রচনা ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ পঞ্চাঙ্ক নাটক। বিক্রমোর্বশীয় ও অভিজ্ঞান শকুন্তলা অনেক পরিণত বয়সের রচনা বলেই বোধ হয়। ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নাটকের প্রস্তাবনায় বিনয় বশতঃ কবি বলেছেন—ভাস, সৌমিল্ল, কবিপুত্র প্রমুখের প্রসিদ্ধ নাট্যগ্রন্থ বিদ্যমান থাকতে আমার এই নাটকরচনা ধৃষ্টতারই নামান্তর। ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নাটকের উৎস ঐতিহাসিক কাহিনী। এই নাটকের নায়ক রাজা অগ্নিমিত্র ছিলেন শৃঙ্গবংশীয়। নাটকে অগ্নিমিত্রের পিতা পুষ্যমিত্র ও তার দ্বারা অনুষ্ঠিত অশ্বমেধ যজ্ঞের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। এই নাটকের কাহিনী রাজঅন্তঃপুরের সাধারণ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই রচিত। তারুণ্যের আবেগের সাথে, স্বভাবসিদ্ধ অনায়াস ভঙ্গীর সংমিশ্রণে, শৃঙ্গার রসপ্রধান নাটকে কবির পদার্পণ।

বিদিশাধিপতি শৃঙ্গবংশীয় অগ্নিমিত্র ও বিদর্ভরাজকন্যা রাজার অন্তঃপুর পরিচারিকা মালবিকার প্রেম কাহিনীই এই নাটকে বিধৃত হয়েছে। বর্ষীয়ান অগ্নিমিত্রের দুই পত্নী বর্তমান, ধারিণী ও ইরাবতী। পথমধ্যে দস্যু দ্বারা নিগৃহীত হলে অগ্নিমিত্রের সেনাপতির সাহায্যে মালবিকা (পরিচয়হীনা) অগ্নিমিত্রের অন্তঃপুরে রাজমহিষী ধারিণীর পরিচারিকা নিযুক্ত হয়। একদা রানীর সাথে এই অজ্ঞাত কুলশীলা রমণীর ছবি দেখে তার অপূর্ব রূপ যৌবনের প্রতি রাজা আকৃষ্ট হলেন। রানী ধারিণী এই বিষয় উপলদ্ধি করে মালবিকাকে রাজার নাগালের বাইরে রাখতে লাগলেন। রাজার অনুরাগ দেখে বিদূষক নানা কৌশল করে মালবিকার সাথে রাজার মিলনের ব্যবস্থা করতে থাকে। মালবিকা, নৃত্যগীতাদিতে সুনিপুণা ছিলেন। বিদূষক কৌশলে নাচ দেখার ব্যবস্থা করল। প্রমোদ কাননে উভয়ের সাক্ষাৎও হল। এইভাবে উভয়ের পূর্বরাগের পালা চলতে থাকলে, মহিষীদিগের নজর পড়ায় মালবিকাকে গৃহবন্দিনী করে রাখা হল। কিয়ৎকাল মধ্যে মালবিকার সত্য পরিচয় প্রকাশ পেল। বিদর্ভরাজ মাধবসেনের ভগিনী ‘মালবিকা অতএব মিলনের ক্ষেত্রে বিশেষ বাধা রইল না। ইত্যবসরে সংবাদ এল অগ্নিমিত্রের পুত্র বসুমিত্র সিন্ধু তীরবর্তী যবনদের পরাস্ত করেছেন। পুত্রের এ-হেন যুদ্ধজয়ের সাংবাদে আহ্লাদিত মাতা ধারিণী ইরাবতীর সম্মতি ক্রমে স্বামীর মনোরঞ্জনের নিমিত্ত মালাবিকাকে রাজার হস্তে সমর্পণ করলে শুভমিলনের মধ্য দিয়ে নাটকীয় ঘাতপ্রতিঘাতের সমাপ্তি ঘটে।

প্রেমচাঞ্চল্যে ভরপুর নায়ক বয়সে বৃদ্ধ হলেও তার নর্ম্যসহচর প্রিয় বয়স্য বিদূষক এর সাথে সর্বদাই প্রণয়িণীর প্রতি অনুরাগ ও মিলনের ইচ্ছা প্রকাশে ব্যস্ত। ধারিণীর চরিত্রটি আমাদের মুগ্ধ করে। ধীর, স্থির, উদার ও উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্না। এদিকে মালবিকা শুধু রূপেই নয় গুণেও দর্শকদিগকে মুগ্ধ করতে সমর্থ। গতানুগতিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে কালিদাসের বিশ্বক চরিত্র যেন অন্যমাত্রা পায়।

বিক্রমোর্বশীয় :–ঋক্‌বেদ থেকেই পুরূরবা ও উর্বশীর কাহিনী প্রচলিত। সেই অতিপরিচিত কাহিনী অবলম্বনেই কালিদাসের মনোজগতের অসাধারণ ফসল এই ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নামক পঞ্চাঙ্ক ‘নাটকটি, অতিজনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত। বেদ, মহাভারত, পুরাণ খ্যাত এই কাহিনীকে নাট্যরূপ দান করতে গিয়ে নাট্যকার স্থানে স্থানে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন। তথাপি নাটকের ধারাবাহিকতা কুত্রাপি ক্ষুণ্ণ হয় নি, বরঞ্চ দর্শকদের নিকট দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

স্বর্গের অপ্সরা ঊর্বশী সখীদের সাথে ফিরছিলেন শিবপূজা করে। পথে দস্যু কর্তৃক অপহৃত ও নিগৃহীত হলে পৃথিবী পতি পুরূরবা অপ্সরার করুণ আর্তনাদ শুনতে পান। এবং সত্বর তথায় উপস্থিত হয়ে দানবদের কবল থেকে অপ্সরাকে রক্ষা করেন। প্রথম দর্শনেই উর্বশী ও পুরূরবা উভয়ে উভয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। অতএব উর্বশী সখীদের সাথে ফিরে গেলেও তার মনে যে প্রেমের মুকুল অঙ্কুরিত হয়েছে তা প্রস্ফুটিত হওয়ার অপেক্ষায় আকুলি বিকুলি করতে থাকে। এদিকে প্রেমাসিক্ত রাজাও তার প্রিয়সখা বিদষকের কাছে গোপন প্রণয় কাহিনী ব্যক্ত করছেন প্রমোদ কাননে বিহার করতে করতে। উর্বশী তথায় অলক্ষ্যে উপস্থিত থেকে রাজার প্রেমের অভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ করে যার পর নাই প্রণয় পাশে আবদ্ধ হলেন। এমন সময় স্বর্গ থেকে দেবতাদের আহ্বান এলো উর্বশীকে যেতে হবে তথায় নাটকে অভিনয় করার জন্য। এদিকে ভুর্জপত্রে অপ্সরা কর্তৃক লিখিত প্রেমপত্র প্রমোদ কাননে মাটিতে পড়ে রইল। দূর্ভাগ্যবশতঃ সেই প্রেমপত্র পরিচারিকা মারফৎ রানীর হাতে পড়লে রাজাকে খুবই লাঞ্ছনা সহ্য করতে হল। দেবসভায় আহুত হয়ে উর্বশী গেলেন স্বর্গে, কিন্তু ভরত সম্পাদিত ‘লক্ষ্মীস্বয়ম্বর’ নাটকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় কালে অন্যমনস্কতা বশতঃ তিনি কাকে ভালবাসেন এই কথার উত্তরে পুরুষোত্তম বলতে গিয়ে ‘পুরূরবা’ বলে ফেললেন, অতএব সেইহেতু ভরতমুনি কর্তৃক তিনি অভিশপ্তা হলেন। শাপে কিন্তু যেন বর হল। ভরতের অভিশাপে তিনি মর্তবাসিনী হলেন, ইন্দ্রের অনুগ্রহে তাকে মর্তে থাকাকালীন রাজা পুরূরবার সাথে মিলিত হওয়ার বা একত্রে বসবাস করার অনুমতি দেওয়া হল, তবে একটি শর্ত আরোপ করা হল। এই যে—সন্তানের জন্ম না হওয়া পর্যন্তই বা পুত্রমুখ দর্শন না করা অবধি উর্বশী পুরূরবার সঙ্গে থাকতে পারবে। রাজরানীর অনুগ্রহে উর্বশীকে পুরূরবা গ্রহণ করলেন। উর্বশীকে সঙ্গে করে রাজা একদিন প্রমোদ ভ্রমণেরত এমন সময় রাজা অপর একসুন্দরী বিদ্যাধর কন্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে প্রচণ্ড অভিমানিনী কামাসক্তা উর্বশী অকলুষবনে প্রবেশ করায় লতায় পরিণত হয়ে গেল। রাজা উর্বশীকে দেখতে না পেয়ে উন্মাদের ন্যায় দিক দিগন্তে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। দুঃখে, হতাশায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে এক লতা বৃক্ষকে আলিঙ্গন করে কাঁদতে লাগলেন, ‘সংগমনীয়’ মনির স্পর্শে উক্ত লতাটি পুনরায় উর্বশীর রূপ ধারণ করল। অপর একদিন পুরূরবা উর্বশী বসে আছেন হঠাৎ সামনে একটি বাণবিদ্ধ পক্ষী এসে পড়ল, বাণ এর গায়ে লেখা রয়েছে উর্বশী পুরূরবার পুত্র’ ‘আয়ু’ দেখা মাত্র উর্বশী সচকিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। তিনি এতদিন তার পুত্রকে এক ঋষির আশ্রমে গোপনে পিতার অজ্ঞাতে বড় করছিলেন। এমন সময়ে একজন স্ত্রী-লোক পুত্র আয়ুকে সাথে করে তথায় উপস্থিত। পুত্রটি পাখীটির প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণতার অপরাধে পিতা মাতার নিকট প্রেরিত হয়েছে। অতএব রাজার পুত্রমুখ দর্শনহেতু আসন্ন বিচ্ছেদের আশঙ্কায় উর্বশী ব্যাকুল। এমতাবস্থায় দেব ও অসুরদিগের যুদ্ধ সমাসন্ন, স্বর্গ থেকে আহ্বান এল পুরূরবার। পুরূরবা ইন্দ্র কর্তৃক আহুত হয়ে স্বর্গে গমন করেলেন এবং যুদ্ধে জয়লাভ করে পুরস্কার স্বরূপ লাভ করলেন এমনবর, যার মধুময় ফলস্বরূপ আজীবন স্বর্গের অপ্সরা উর্বশীর সান্নিধ্য লাভে আর কোন বাধা থাকল না।

‘বিক্রমোর্বশীয়’ নাটকে নারীহৃদয়ের চিরন্তন প্রেমব্যাকুল আর্তিকে উর্বশী চরিত্রের মধ্য দিয়ে এক অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তুলেছেন। রাজার কামাসক্ত হৃদয় দেহ যেন সকল পুরুষের কামনার সাক্ষী স্বরূপ। অর্থাৎ মানবজীবনের চিরন্তন স্বাভাবিক যে আবেদন, তাকেই কবি তার কাব্যপ্রতিভার গুণে এমন ভাবে এঁকেছেন যা দেখে কোন্ দর্শকের চিত্ত না চমৎকৃত হয়?

পুরূরবা নিজ বিক্রম বলে উর্বশীকে দানবের হাত থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন অতএব ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নামকরণ সার্থক। সংস্কৃত নাট্য শাস্ত্ৰে বিয়োগান্ত পরিণতি প্রথাসিদ্ধ নয়, সেইহেতুই নাট্যকার কালিদাস কৌশলে শেষ অঙ্কে নায়ক- নায়িকার ব্যাথিত হৃদয়কে চিরকালীন শান্তির অশ্বাস দিয়েছেন। ঘটনার ঘাত— প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নাটকটি অনেক বেশী আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ :—মহাভারত খ্যাত দুষ্যন্ত শকুন্তলার প্রণয় বৃত্তান্ত সপ্ত অঙ্কে নাটকের আঙ্গিকে বিধৃত। কালিদাসের পরিণত বয়সের অসাধারণ কবি প্রতিভা ও নাট্যকলার সুসামঞ্জস্যপূর্ণ দৃশ্য কাব্য এই ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্’ সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক। অভিজ্ঞানশকুন্তলা’-র কাহিনী পদ্মপুরাণে বর্ণিত-’দুষ্যন্তশকুন্তলার’ সাথে অনেকাংশে সাদৃশ্যপূর্ণ।

নাটকের মূল কাহিনী সংক্ষেপে এইরূপ—হস্তিনাপুরাধিপতি পুরুবংশীয় রাজা দুষ্যন্ত মৃগয়া উপলক্ষে বার হয়ে এক ছুটন্ত হরিণের পশ্চাদ্ধাবন করতে করতে মালিনীনদী তীরস্থিত মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সেই সময়ে পিতা কণ্ব আশ্রমে অনুপস্থিত। গৃহে একমাত্র পালিতা কন্যা শকুন্তলার উপরে অতিথিসেবার দায়িত্ব। আশ্রমে প্রবেশের মুখেই রাজর্ষি অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা এই দুই সখী পরিবৃতা অত্যন্ত রূপ-যৌবন সম্পন্না শকুন্তলাকে বৃক্ষে জল সিঞ্চনরতা দেখে মুগ্ধ, অভিভূত হলেন। প্রথমদর্শনেই রাজা দুষ্যন্ত পঞ্চসরে বিদ্ধ হয়ে করুণ অবস্থা প্রাপ্ত হলেন। শকুন্তলাকে লাভ করার উদগ্র বাসনা তাকে তাড়া করে বেড়াতে লাগল। শকুন্তলাও রাজার পৌরুষত্বে মুগ্ধ হয়ে রাজার রূপ যৌবনের কাছে নিজেকে মনে মনে সমর্পণ করলেন। হঠাৎই এইরূপ আশ্রম বিরোধী মনোভাব শকুন্তলাকে অশান্ত করে তুলল। পরিচয় পর্বের শেষে উভয়েই আশ্বস্ত হলেন। রাক্ষসেরা আশ্রমের শান্তি বিঘ্নিত করায় কণ্বের শিষ্যদিগের অনুরোধ ক্রমে রাজা পুনরায় আশ্রমে আসলেন। রাজার প্রিয়সহচর বিদূষক সর্ববিষয়ে ছায়ার মতন তার অনুগামী। নানারূপ কৌশলে, যে কোনরূপ সঙ্কটে অথবা কেবলই অবসর যাপনে ও বিনোদনে বিদূষকের মতন বন্ধু মেলা ভার। আশ্রমের নিভৃত কুঞ্জে নায়ক—নাায়িকা গোপনে মিলিত হতে থাকলেন। উভয়ের প্রগাঢ় প্রণয় গান্ধর্ব বিবাহে পরিণতি লাভ করল। শকুন্তলা অন্তঃসত্তা; এমন সময় তপোবনের কাজ সমাধা হলে রাজার দেশে প্রত্যাগমনের সময় আসন্ন, ইত্যবসরে রাজা স্বনামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় শকুন্তলার আঙ্গুলে পরিয়ে দিয়ে তাকে রাজঅন্তঃপুরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। শকুন্তলা পতি বিরহে আনমনা হয়ে বসে আছেন, এদিকে দুর্বাসা ঋষি এসে দাঁড়িয়েছেন তপোবনের আতিথ্য গ্রহণ করতে, কিন্তু শকুন্তলা এরূপ অন্যমনস্কা যে ঋষিকে দেখতেও পেলেন না, তখন দুর্বাসা অভিশাপ দিলেন—যার কথা একমনে চিন্তাকরে তুমি আমার মত অতিথির উপস্থিতি বুঝতে পারলে না, তুমি স্মরণ করিয়ে দিলেও সে তোমাকে স্মরণ করতে পারবে না। এই কথা বলে দ্রুত প্রত্যাগমন করলেন। হতভাগিনী শকুন্তলা এসব কিছুই জানতে পারল না, সখীদ্বয় শুনতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে ঋষির পায়ে পড়ে অনেক অনুনয় বিনয় করলে অভিশাপের ভার কিঞ্চিত লাঘব করে বললেন— কোনরূপ অভিজ্ঞান বা স্মারকচিহ্ন দেখাতে পারলে শাপমুক্তি ঘটবে। তখন দুষ্যন্তের নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয়ের কথা স্মরণ করে সখীদ্বয় আশ্বস্ত হলো। কিন্তু শকুন্তলার কোমল হৃদয়ে যাতে কোনরূপ আঘাত না লাগে সেইহেতু এই অভিশাপের বৃত্তান্ত সখীদ্বয়ের মধ্যেই গোপন রইল। শকুন্তলা ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পারলেন না। অল্পকিছু দিনের মধ্যেই পিতা কণ্ব সোমতীর্থ থেকে আশ্রমে ফিরে এলেন এবং শকুন্তলার গান্ধবমতে বিবাহ ও গর্ভসঞ্চারের কথা অবগত হলেন। মহর্ষি তাঁর কন্যাকে পতিগৃহে পাঠাবার আয়োজন করলেন। শৈশব থেকে যৌবন যে শকুন্তলার এই তপোবনে অতিবাহিত হয়েছে, সেখানের তরুলতা, বৃক্ষ, পশু, পক্ষী সকলই যেন শকুন্তলার অতি চেনা- পরিচিত, এবং পরম আদরের বস্তু। সকলের প্রতি পরমস্নেহের বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে থাকা মন কিছুতেই সামনের দিকে এগোতে চায় না, তথাপি আবাল্য লীলাভূমি ছেড়ে ক্রন্দনরতা শকুন্তলাকে পতিগৃহে যাত্রা করতে হলো। বৃদ্ধা তাপসী গৌতমী; কম্বের দুই শিষ্য শাঙ্গরব ও শারদ্বত সঙ্গে গেলেন। এদিকে ঘটনা অনুযায়ী দুর্বাসার অভিশাপে রাজা শকুন্তলার স্মৃতি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। অতএব শকুন্তলাকে রাজসভায় সকলের সামনে পরস্ত্রী, ইত্যাদি বলে অপমান পূর্বক অস্বীকার করলেন শকুন্তলার হাতের রাজার নামাঙ্কিত আংটিটি পথে আসার সময় শচীতীর্থের জলে পড়ে যায়, সেইহেতু বিদায় কালে সখীদের পরামর্শ অনুযায়ী অভিজ্ঞান স্বরূপ সেই অঙ্গুরীয় দেখাতে গিয়ে শকুন্তলা আশাহত হয় এবং রাজাকর্তৃক প্রত্যাখ্যাত শকুন্তলা রাগে দুঃখে অভিমানে মরমে মরে যেতে থাকলেন। এমন সময় মাতা মেনকা জ্যোতির্ময়ী মূর্তিধারণ করে কন্যা শকুন্তলাকে নিয়ে বায়ুমার্গে অন্তর্ধান হলেন। হেমকুট পর্বতে মহর্ষি মারীচের আশ্রমে দুঃখিনী শকুন্তলা আশ্রয় পেল। তথায় পুত্র ভরতের জন্ম হয়।

এদিকে শচীতীর্থের জলে পড়ে যাওয়া অঙ্গুরীয়কটি একটি মাছের পেটে যায়, সেই মাছ কাটা হলে ধীবরের হাত থেকে অঙ্গুরীয়কটি রাজার হাতে যায়। রাজা সেটি দেখা মাত্রই তার একে একে সমস্ত পূর্ব ঘটনা মনে পড়ে যায়। শকুন্তলা প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের কথা স্মরণ করে রাজা যার পর নাই মর্মাহত হলেন। দুঃখাতুর রাজা তার রাজ্যে সমস্ত আনন্দ উৎসব বন্ধ করে দেন। এমন সময়ে স্বর্গ থেকে ইন্দ্র কর্তৃক রাজা আহুত হলেন দানব-দমনের নিমিত্ত। স্বর্গ থেকে প্রত্যাবর্তন কালে পুত্র ভরতসহ শকুন্তলার সাথে রাজা দুষ্যন্তের পুনর্মিলন সংঘটিত হয়।

নাটকটির ঘটনা বৃত্তান্তের মধ্য দিয়ে অতি সহজেই নাটকের নামকরণের রহস্যটুকু অনুধাবন করা যায়। অভিজ্ঞান স্বরূপ রাজার নিজ নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয়টি দেখা মাত্রই শাপ মুক্তি ঘটল, রাজার সমস্ত পূর্বস্মৃতি জেগে উঠল। সেই হেতু নাটকের নামকরণ সার্থক।

গভীর রস বৈশিষ্ট্যে, কাব্য সুষমায়, চরিত্রচিত্রণে, অলঙ্কার বিন্যাসে সর্বোপরি আধ্যাত্মিক ভাবের পরিমণ্ডলে শকুন্তলা কালিদাসের অনন্যসাধারণ, অনবদ্য সৃষ্টি, প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যিক, নাট্য সমালোচকদের চোখে শকুন্তলাই কালিদাসের তথা সমগ্র নাট্য সাহিত্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রচনা। সেইহেতু বলা হয়ে থাকে— ‘কালিদাসস্য সর্বস্বম্ অভিজ্ঞান শকুন্তলম’। প্রকৃতির সাথে মানব মনের অপূর্ব মেলবন্ধনে, নাটকীয় ঘাতপ্রতিঘাত, মানবপ্রেমের ঐশ্বরিক প্রেমে ক্রমপরিণতির মধ্য দিয়ে কবি দর্শক হৃদয়ে যেন এক অপূর্ব প্রশান্তি এনে দিয়েছেন। চতুর্থ অঙ্কে শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার যে দৃশ্য কবি এঁকেছেন তা বিদগ্ধ জনেদের ভাষায় শ্রেষ্ঠ অঙ্ক। সেই হেতু বলা হয়েছে—কাব্যের মধ্যে নাটক শ্রেষ্ঠ, নাটকের মধ্যে শকুন্তলা শ্রেষ্ঠ, সেই শকুন্তলা নাটকের চতুর্থ অঙ্ক সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার যেখানে শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা বর্ণিত হয়েছে।

“কাব্যেষু নাটকং রম্যং তএ রম্যা শকুন্তলা।
তত্রাপি চ চতুর্থোহঙ্ক যত্র যাতি শকুন্তলা।।”

কেবলমাত্র আশ্রমের তরুলতা, পশুপক্ষীর আকুল অব্যক্ত বেদনার ছবিই নয়, শকুন্তলার বিদায়কালে তপোবন বাসী ঋষি পিতা যে সমস্ত উপদেশগুলি দিয়েছিলেন তা প্রতিটি নরনারীর সংসার ধর্মের একান্ত উপযোগী বাণীস্বরূপ। চতুর্থ অঙ্ক শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেলেও পঞ্চম অঙ্কে কিন্তু নাট্যকুশলী কালিদাসের চরম প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। সেই হেতু বলাহয় ‘পঞ্চমোঽস্তি ততোহধিকঃ।’ এই অঙ্কে নায়ক-নায়িকার অন্তর্দ্বন্দ্ব, লাজে, ভয়ে বেদনায় বিস্ময়াপন্ন কথোপকথোনরূপ চরম দৃশ্যটিই নাটকটিকে যেন চরম পরিণতির দিকে বয়ে নিয়ে গেছে। নাটকের বেশীরভাগ চরিত্র যেমন বিদূষক, অনসূয়া, প্রিয়ংবদা, শাঙ্গরব, শারদ্বত, গৌতমী, মহর্ষি মারীচ এই সমস্ত চরিত্রগুলি কবিকল্পনার অপূর্ব সৃষ্টির নিদর্শন। মহর্ষি কণ্ঠের সোমতীর্থে গমন, দুর্বাসার অভিশাপ, অঙ্গুরীয় বৃত্তান্ত, দুষ্যন্তের স্বর্গগমন প্রমান করে যে কালিদাস কতখানি সার্থক। উপমা অলঙ্কার প্রয়োগে স্বভাবসিদ্ধ কবি কালিদাস অনন্য, অসাধারণ। শকুন্তলা নাটকের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত্য সুন্দর সুন্দর উপমা প্রয়োগ কাব্যের উৎকর্ষতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। প্রখ্যাত আলঙ্কারিক বিশ্বনাথ কবিরাজের মতে’উপমা কালিদাসস্য’…। এইরূপ উক্তি সার্থক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ শকুন্তলা নাটকের বিশ্লেষণ পূর্বক বলেছেন— শকুন্তলায় একটি পূর্বমিলন ও একটি উত্তরমিলন আছে। প্রথম অঙ্কবর্তী সেই মর্তের মিলন চঞ্চল সৌন্দর্যময় বিচিত্র পূর্ব মিলন হতে স্বর্গ তপোবনে শাশ্বত আনন্দময় উত্তরমিলনে যাত্রাই অভিজ্ঞান শকুন্তলা নাটক’। (রবীন্দ্রনাথ, প্রাচীন সাহিত্য)। ইউরোপীয় কবি গ্যায়েটের (Goethe) শকুন্তলা নাটক সম্বন্ধে অভিমতটি সত্যই খুব মর্মপর্শী ও হৃদয়গ্রাহী, তাঁর মতে ‘কেহ যদি তরুণ বৎসরের ফুল ও পরিণত বয়সের ফল, কেহ যদি মর্ত্য ও স্বর্গ একত্র দেখিতে চান তবে ‘শকুন্তলায়’ তাহা পাইবেন।

কালিদাস নাট্যকাব্যে যুগপৎ দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। অর্থাৎ তিনি তাঁর চারপাশের বর্হিজগৎকে কেবল চোখ দিয়েই দেখেন নি, হৃদয় দিয়ে অনুভব করে ছিলেন। এবং সেই সব অমূল্য অনুভূতি তাঁর অসাধারণ শৈল্পিক চেতনার রঙে যেন চিত্রপটের ন্যায় সংস্কৃত দৃশ্যকাব্যের অঙ্গনে প্রস্ফুটিত হয়ে আছে। কালিদাস বিরচিত তিনটি নাটকই মূলতঃ শৃঙ্গার রসাত্মক। তিনটি নাটকেরই আঙ্গিকগত সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়। কবির প্রথম নাটক ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’-তে যে প্রেমের, মুকুল অঙ্কুরিত হয়েছে, দ্বিতীয় নাটকে অর্থাৎ ‘বিক্রমোর্বশীয়’তে সেই প্রেম আরও প্রগাঢ়তা লাভ করেছে। পরিশেষে ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’ নাটকে সেই প্রেমই স্বর্গ সুষমা মণ্ডিত হয়েছে। বৈদভী রীতির এই কবির ‘অপূর্ব বস্তুনির্মাণ ক্ষম…’ সর্বদাই বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয়।

কালিদাসোত্তর যুগের নাট্যকারগণ

শূদ্রক

সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাচীন কবিগণের ক্ষেত্রে প্রায়শই সঠিক কাল নির্ণয়ে আমরা ব্যর্থ। অনেকাংশেই সঠিক তথ্য ও প্রমাণের অভাবে ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিতে ও বিবুধ পণ্ডিতগনের নানা আনুমানের ভিত্তিতে আলোচনা করে হয়ে থাকে মাত্র। কিন্তু এর মাধ্যমে কোন সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আমরা ব্যর্থ হই। মহাকবি শূদ্রক এর সম্বন্ধেও আমাদের জ্ঞান সঠিক তথ্যের অভাবে নানা আলোচনা সমালোচনার সম্মুখীন।

মহাকবি কালিদাস সশ্রদ্ধ চিত্তে নাট্যকার ভাসের উল্লেখ করেছেন এবং তাঁকে বহুলাংশে অনুসরণও করেছেন। কিন্তু শূদ্রকের বিখ্যাত নাটক মৃচ্ছকটিক এর কোন উল্লেখ না করায় এই নাটক কালিদাসের পরবর্তীকালে রচিত বলে অনুমিত হয়।

‘মৃচ্ছকটিক’ নাটক ভাসের ‘চারুদত্ত’ নাটকেরই বর্ধিত অংশ। ঐ একই ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শূদ্রক ‘মৃচ্ছকটিক’ রচনা করেছিলেন। পৌরাণিক কাহিনীতে নানাস্থানে শূদ্রকের আলোচনা স্থান পেয়েছে। কথাসরিৎ সাগরে, স্কন্দপুরাণে শূদ্রকের নাম দৃষ্ট হয়। বাণভট্টের হর্ষচরিত ও কাদম্বরীতে শূদ্রকের উল্লেখ রয়েছে। বেতাল পঞ্চবিংশতিতে শূদ্রক বর্ধমানের রাজা ছিলেন বলে মন্তব্য করা হয়েছে। কল্হনের রাজতরঙ্গিনীতে শূদ্রককে বিক্রমাদিত্যের কিছু পূর্ববর্তী বলা হয়েছে। বামনের কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তি গ্রন্থে শূদ্রকের প্রশংসা করে বলা হয়েছে—শূদ্রক শ্লেষ অলঙ্কার প্রয়োগে বহু বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন—

শূদ্রকাদিরচিতেষু প্রবন্ধেষু অস্য ভূয়ান্ প্রপঞ্চো-দৃশ্যতে। আলঙ্কারিক বামনও ‘মৃচ্ছকটিক’ থেকে উদ্ধৃতি গ্রহণ করেছেন।

Pischal-এর মতে শূদ্রক দণ্ডীর সমসাময়িক, sten konow এর মতে জনৈক আভীর রাজপুত্র শিবদত্তই কবি-শূদ্রক। কারণ মৃচ্ছকটিক নাটকে আর্যক নামে আভীর মুখ্য চরিত্রকে রাজশক্তির পরিবর্তনে দেখান হয়েছে। কেহ বা বলেন রাজা শূদ্রকই বিক্রমাদিত্য সংবৎ (৫৭ খ্রিঃ পূঃ) প্রচলন করেছিলেন। অধ্যাপক ফ্লীট মনে করেন আলোচ্য শূদ্রকের পুত্র ঈশ্বরসেনই ‘অন্ধ্ররাজগণকে বিতাড়িত করে চেদি অব্দ প্রতিষ্ঠা করেন (২৪৮ খ্রিঃ) ভাস বিরচিত ‘প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ’ নাটকের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বিচারে বুদ্ধদেবের কিছু কাল পরেই রাজা শূদ্রকের কাল চিহ্নিত হয়। ইত্যাদি নানা সমালোচক ও গবেষকের নানাবিধ মত প্রচলিত। এর মধ্য দিয়ে এরূপ বোধ হওয়া স্বাভাবিক যেন ঐ সময়ে একাধিক শূদ্রক নামে ব্যক্তি জীবিত ছিলেন। এমন মতও পোষণ করতে দেখা যায় যে—কোন অজ্ঞাত নামা ব্যক্তি মৃচ্ছকটিক রচনা করে তা নিজ পৃষ্ঠপোষক রাজা শূদ্রকের নামে প্রচলন করেছিলেন। তবে যাই হোক্‌ না কেন ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের রচয়িতা শূদ্রক একথা বহুল প্রচলিত এবং এইটি সংস্কৃত সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ। প্রাচীনতম এই নাটকটি কিন্তু ভাসের নাটকচক্র আবিষ্কারের পর থেকে ভাসের নাটক সমূহ অপেক্ষা অর্বাচীন বলেই বিবেচিত হয়েছে। Macdonell কবিশূদ্রকের কাল ষষ্ঠ শতক বলে মনে করেন।

চারখানি ভাণ (একাঙ্কিকা) একত্রে চতুৰ্ভাণী বলে প্রকাশিত হয় ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে। একটি শ্লোকের মধ্যে বলা হয়েছে এগুলি কালিদাসের পরবর্তী কালীন রচনা।” এরমধ্যে পদ্মপ্রাভৃতক নামক ভাগটি শূদ্রক রচিত। পদ্মপ্রাভৃতক বিষয়-বৈচিত্র, হাস্যচাটুকারিতায় ও ব্যখ্যাত্মক রচনা বৈচিত্র্যে অত্যন্ত উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। চরিত্রগুলি হাস্যরসিকতায় সজীব। পদ্মপ্রাভূতকের সাথে মৃচ্ছকটিকের রচনার বহুলাংশে সাদৃশ্য থাকায় এই দুই গ্রন্থের রচয়িতা যে একই ব্যক্তি এই বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। বিদগ্ধজনেদের অনুমান খ্রিষ্টীয় ১ম শতক থেকে খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে জনৈক কবি শূদ্রক তাঁর মৃচ্ছকটিক রচনা করে সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডারে আসাধারণ সংযোজন করেছিলেন।

‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের প্রস্তাবনায় যে কবিপরিচিতি পাওয়া যায় তা থেকে জানা যায় বিখ্যাত এই কবি অশ্মক দেশবাসী। জাতিতে ব্রাহ্মণ ও অতীব সুদর্শন। তিনি বেদ বেদান্ত প্রভৃতি বহু শাস্ত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ছিলেন। সর্বগুণ সম্পন্ন, বিদগ্ধ পণ্ডিত ও বিখ্যাত লেখক। শূদ্রক অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠানও করেছিলেন। একশত দশদিন পর্যন্ত্য বেঁচে থেকে নিজ পুত্রকে সিংহাসনে বসিয়ে স্বেচ্ছায় অগ্নিতে আত্মাহুতি দেন। কবির জীবদ্দশায় যে এই প্রস্তাবনা লিখিত হয় নি, একথা সহজেই অনুমেয়, অতএব সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক অবশ্যই প্রক্ষিপ্ত হয়েছে পরবর্তীকালে।

মৃচ্ছকটিক :—দশ অঙ্কে বিরচিত প্রকরণ জাতীয় দৃশ্যকাব্য ‘মৃচ্ছকটিক’ ভাসের ‘চারুদত্ত’ নাটকেরই পরিবর্ধিত রূপ বলা চলে। উজ্জয়িণীর একজন বিত্তশালী ব্রাহ্মণ চারুদত্ত ও গণিকা বসন্তসেনার প্রণয় কাহিনীই এই নাটকের মূল বিষয়। বণিক চারুদত্তের দানশীলতা ও পরহিতাকাঙ্খী তাকে বিত্তশালী থেকে দরিদ্রব্যক্তিতে পরিণত করেছে। সেই নগরের একজন বারবণিতা বসন্তসেনা চারুদত্তের গুণমুগ্ধা। রাজশ্যালক শকারও বসন্তসেনার প্রতি আকৃষ্ট, সেইহেতু একদিন বর্ষামুখর রাত্রে বসন্তসেনা যখন রাস্তা দিয়ে গৃহাভিমুখে প্রত্যাগমন করছেন তখন সুযোগ বুঝে শকার তাকে অনুসরণ করে, তাই বুঝে বসন্তসেনা প্রাণভয়ে দৌড়ে নিজ অজ্ঞাতেই চারুদত্তের গৃহে প্রবেশ করে এবং আশ্রয় নেয়। অতএব সেই অবসরে উভয়ের পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পর্যবসিত হয়। বসন্তসেনা সেই সময় তার গায়ের গহনাগুলি চারুদত্তের নিকট গচ্ছিত রাখে। এদিকে শালিক নামে এক দরিদ্র বাহ্মণ বসন্তসেনার পরিচারিকা মদনিকার প্রতি আকৃষ্ট হয়, প্রেমাসক্ত শালিক ব্রাহ্মণ হলেও সিঁধেল চোর, সে সিঁধ কেটে চারুদত্তের বাড়ী থেকে বসন্তসেনার গহনা চুরি করে। চারুদত্ত এমতাবস্থায় দারুণ ফ্যাসাদে পড়লেন। গচ্ছিতধন চুরি গেছে। তখন সে কোন উপায় দেখতে না পেয়ে তার স্ত্রীর দেওয়া হার বসন্তসেনার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়। শালিক মদনিকাকে খুশী করার জন্য এবং তাকে দাসীবৃত্তি থেকে মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেইসব চুরিকরা গয়না তাকে দেয়। মদনিকা দেখা মাত্রই তা সনাক্ত’ করতে পেরে শার্বিলককে গোপনে পরামর্শ দেয় যে চারুদত্তের দূত হয়ে ঐ অলঙ্কার পেটিকা সে যেন বসন্তসেনাকে গিয়ে দেয়। বসন্তসেনা তাদের এই গোপন পরামর্শ জানতে পেরে আনন্দচিত্তে সেই গয়না গ্রহণ পূর্বক পুরস্কার স্বরূপ মদনিকাকে তার প্রেমিকের হাতে অর্পণ করলেন। চারুদত্ত গচ্ছিতবস্তু চুরি যাওয়ার ঘটনায় অত্যন্ত লজ্জিত ও শঙ্কিত। এদিকে তাঁর স্ত্রীর মহামূল্যবান রত্নাবলী হারটি বসন্তসেনা নিজে গিয়ে ফেরৎ দিয়ে আসবে বলে স্থির করল। সেইমত বসন্তসেনা চারুদত্তের গৃহে গেলে তাঁকে সেই রাত্রেও প্রাকৃতিক দূর্যোগ হেতু সেখানে থাকতে হল। পরদিন তারা দু’জনে করভক উদ্যানে অভিসারে যাবে কথা হল। কথামত উপযুক্ত সময়ে গাড়ী প্রস্তুত থাকতে বলে দিয়ে চারুদত্ত আগেই চলে গেলেন পূর্বনির্ধারিত স্থানে। বসন্তসেনা অভিসারে যাওয়ার প্রাক্কালে দেখলেন চারুদত্তের পুত্র রোহসেন প্রতিবেশীর সোনার খেলনা গাড়ী দেখে তারই জন্য বায়না করছে। মাটির খেলনাগাড়ি দিয়ে তাকে ভোলানো যাচ্ছে না। তখন গনিকার মাতৃহৃদয়ের স্নেহব্যাকুলতা এমনই ভাবে প্রকাশ পেল যে সে তার সমস্ত সোনার গয়না রোহসেনের খেলনা তৈরীর জন্য দিয়ে দেয়। তারপর বসন্তসেনা ভুল করে শকার-এর গাড়ীতে চড়ে বসলেন। গাড়ি পৌঁছালে শকার বসন্তসেনাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে আহ্লাদিত হয়ে তাকে বশে আনার চেষ্টা করেও যখন বশে আনতে পারলেন না তখন বসন্তসেনাকে গলা টিপে হত্যা করতে উদ্যত হল। তাতে ভয় পেয়ে বসন্তসেনা মুর্ছিতা হয়ে পড়ে ও শকার তাকে মৃত জ্ঞান করে ফেলে রেখে চলে যায়। নিজে দোষ করা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ ঘটনার জন্য চারুদত্তকে অভিযুক্ত করে রাজদ্বারে অভিযুক্ত করলেন। বিচারে চারুদত্তের মৃত্যুদণ্ড হয়। এই দণ্ডাদেশ শুনে চারুদত্তের স্ত্রী আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত হন। এদিকে মুৰ্চ্ছিতা বসন্তসেনাকে একজন ভিক্ষুক সেবা শুশ্রূষা করে ভাল করে তোলেন। যখন চারুদত্তকে বধ্য ভূমিতে আনা হল তখন সেই সময়ে সেই ভিক্ষুক ও বসন্তসেনা উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিলেন। ফলে চারুদত্ত নির্দোষ প্রমাণিত হলেন। এবং প্রত্যক্ষদর্শীর তথা স্বয়ং বসন্তসেনার বয়ানে শকার দোষী সাব্যস্ত হলে তার মৃত্যুদণ্ড হল। কিন্তু চারুদত্ত এমনই মহানুভবতার পরিচয় দিলেন যে, শকার মুক্তি পেল। তখন পালককে হত্যা করে আর্যক রাজসিংহাসনে বসলে তার উপকারী বন্ধু চারুদত্তকে তিনি একটি রাজ্য দান করেন। এর চারুদত্তকে নিজ কর্মচারী পদে নিযুক্ত করেন।` চারুদত্ত আর্যকের অনুমতি ক্রমে বারবণিতা বসন্তসেনাকে গৃহবধূর মর্যাদা দিয়ে চিরসঙ্গিনী হিসাবে লাভ করলেন। এইভাবে মধুর মিলনের মধ্য দিয়ে নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটল।

নাটকের দশটি অঙ্কের নাম যথাক্রমে—অন্ধকার ন্যাস, দ্যুত সংবাহক, সন্ধিবিচ্ছেদ, মদনিকা—শালিক, প্রবহন-বিপর্যয়, আর্যক অপহরণ, বসন্তসেনা-মোটন, ব্যবহার ও সংহার। ভাসের ‘চারুদত্ত’ নাটকের উৎস বৃহৎকথা। চারুদত্ত নাটকে যেমন ভাসের উদ্ভাবনীশক্তি মিশ্রিত ছিল, এক্ষেত্রে মুচ্ছকটিক চারুদত্ত নাটকের অনুকরণে শুরু হলেও কবি তার নিজকল্পনাশক্তির প্রভাবে নাটকটিকে অনেকাংশে ঘটনাবহুল ও প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। মৃৎ (মৃত্তিকা) শকটিকা (ছোট শকট বা যান)। মাটির তৈরী ছোট গাড়ী গল্পে আমরা দেখেছি। চারুদত্তের পুত্র রোহসেনের সোনার খেলনা গাড়ির জন্য বায়না এবং মাটির খেলনা গাড়িতে তাকে ভোলানো যায়নি, বলে বসন্তসেনার মাতৃত্বের অভিব্যক্তি স্বরূপ নিজ স্বর্ণালঙ্কার দান, খেলনা তৈরীর নিমিত্ত। কবি এখানে নিখুঁত শৈল্পিক চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। সামান্য গণিকারও যে মাতৃহৃদয় শিশুটির জন্য কত ব্যাকুল হতে পারে এবং পুত্রস্নেহ যে স্বর্ণালঙ্কারের থেকেও অনেক উর্দ্ধে একথা প্রমাণিত হয়েছে। দরিদ্র চারুদত্তের পুত্রের বাসনা চরিতার্থ করে তার দারিদ্র্য মোচন করে যেরূপ সমাস্যার সমাধান দেখান হয়েছে তা পাঠক ও দর্শক হৃদয়ে গভীর অর্থবহন করবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মৃৎ—শকটিকার ঘটনা থেকেই নাটকের নামকরণ ‘মৃচ্ছকটিক’ সার্থক।

মহাকবি শূদ্রক রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’ সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। প্রাচীন সাহিত্যে সাধারণতঃ রাজ রাজাদের কাহিনী, অথবা বিত্তবান্ ব্যক্তির চরিত্র চিত্রণে অধিক আগ্রহ প্রকাশ পেত। কিন্তু শূদ্রক সমাজের নীচুতলার মানুষের কথা খুব সুন্দর ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিবেশন করেছেন। গণিকা বসন্তসেনার সাথে বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ সন্তানের প্রণয় কাহিনী। সিঁধেল চোর ও দাসী মদনিকার প্রেম, মিথ্যা খুনির মামলা, বিচারের নামে প্রহসন, জুয়াড়ী-বিট-সাধু-অসাধু সকল প্রকার চরিত্রের সমাবেশ, কামদেবের সেবা, আবার গণিকার মাতৃহৃদয়ের কোমল স্নেহস্পর্শ সবই কবির অসাধারণ তুলির টানে চমৎকার নাট্যকৌশলের দ্বারা দর্শক হৃদয় আপ্লুত হয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজের বহু খুঁটি নাটি ঘটনার বাস্তবচিত্র এই নাটকে স্থান চেয়েছে। বাধাধরা আদর্শ পালনের বাইরেও যে জীবনের বাস্তব সত্যতা বা ধর্মের কিছু দিক থাকে, যা অনিবার্য, এই নাটকে কবি শূদ্রক তাই দেখাতে চেয়েছেন। গণিকাকে গৃহবধূর মর্যাদা দানকরে কবি নারীর উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেছেন। সহজ, সরল, প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’ বাহুলাংশে হাসরেসেরও উদ্রেক করে। প্রসাদ গুণ বিশিষ্ট বৈদভী রীতির কবি শূদ্রক অলঙ্কার বিন্যাসে, ভাবের গাম্ভীর্যেও অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ ও বিদ্বজ্জনেরা মৃচ্ছকটিকের প্রশংসায় মুখর। ১০

শ্রীহর্ষ

ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত্য শ্রীহর্ষের কাল বলে চিহ্নত হয়। ৬০৬–৬৪৭খ্রিঃ পর্যন্ত্য স্থানেশ্বর ও কনৌজের রাজা ছিলেন এই হর্ষবর্ধন। পিতা প্রভাকর বর্ধন ও মাতা যশোবতী। তিনি রাজ্য বর্ধন এর কণিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন। কবি বাণভট্ট ছিলেন হর্ষবর্ধনের বিশেষ পৃষ্ঠ পোষক। বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’ নাটকের নায়ক ছিলেন এই কবি শ্রীহর্ষ। হর্ষবর্ধন কেবলমাত্র বীর, সাহসী যোদ্ধা হিসাবেই বিখ্যাত ছিলেন না, তিনি অসাধারণ কবি প্রতিভা ও শিল্প চেতনার অধিকারী ছিলেন। সর্বোপরি বিদ্যানুরাগী ছিলেন। সেইহেতু রাজাহর্ষের সভায় বিশিষ্ট বিদ্বজ্জনেদের যেমন—বাণভট্ট, ময়ুর ও মাতঙ্গ দিবাকর প্রমুখের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। বহুগুণী জনেরা এইরূপ ব্যক্তিদিগের পৃষ্ঠপোষকতা হেতু শ্রীহর্ষকে সাধুবাদ জনিয়েছে।১১ প্রসন্নরাখব রচয়িতা কবিজয়দেব তাঁর নাটকে কবিকে ‘কবিতা- কামিনীর-হর্ষ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। সোডঢল তাঁর উদয়সুন্দরীকথায় তাঁকে গীর্ষ অর্থাৎ কাব্যবাণীর আনন্দদায়ী বলে ব্যাখ্যা করেছেন।১২

শ্রীহর্ষ তিনখানি নাটকের রচয়িতা। নাটকগুলি যথাক্রমে রত্নাবলী, প্রিয়দর্শিকা ও নাগানন্দ। কোন কোন পণ্ডিতের মতে কবি বাণভট্ট স্বয়ং অথবা ধাবকা নামক কোন এক ব্যক্তির রচনা ঐ নাটকগুলি রাজা হর্ষবর্ধনের নামে প্রচার করা হয়েছে। অনেকের অনুমান আসল রচয়িতা হর্ষবর্ধনের কাছে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে নাটকগুলি তাঁর নামে উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু এ ধরণের অভিযোগের কোন সুদৃঢ় ভিত্তিনেই। উপরন্তু পরবর্তী কালের বহু আলঙ্কারিক পণ্ডিত, সমালোচক ও পরিব্রাজকের সপ্রশংস উল্লেখ থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে ঐ তিনটি নাটকের রচয়িতা শ্রীহর্ষ। ৭ম শতকের শেষ ভাগে চৈনিক পরিব্রাজক ইৎসিং (Itsing) এর বিবরণে হর্ষচরিতের নাগানন্দ নাটকের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। দামোদর গুপ্ত নবমশতাদীতে তাঁর কূটনীমত নামক গ্রন্থে হর্ষের রত্নাবলী নাটকের কথা বলেছেন। হর্ষরচিত তিনখানা নাটকেই শ্রীহর্ষের নাম উল্লিখিত হয়েছে এবং তাঁর কবিপ্রতিভার ভূয়সী প্রশংসাও করা হয়েছে। বাণভট্ট তাঁর হর্ষচরিত নাটকে রাজা হর্ষের জীবন চরিত ও তাঁর বংশের মহিমাকীর্তন করেছেন। দশরূপকের বিখ্যাত টীকাকার ধনিক দশম শতাব্দীতে আলোচ্য-তিনটি- নাটক থেকেই উদ্ধৃতি গ্রহণ করেছেন। পরিশেষে বলা যায় তিনটি নাটকের রচনাশৈলী, ঘটনাবিন্যাস, ভাব ও ভাষার সাদৃশ্য প্রমাণ করে যে ঐ নাটক তিনটি একই ব্যক্তির রচনা এবং তিনি রাজা হর্ষবর্ধন ব্যতীত অন্য কেহ নহে একথা অনেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন।

রত্নাবলী :—শ্রীহর্ষ বিরচিত চারঅঙ্ক সমন্বিত নাটক ‘রত্নাবলী’, বৎসরাজ উদয়ন ও বাসবদত্তার পরিচারিকা সাগরিকার প্রেমকাহিনীই যার মূল বিষয়বস্তু। এই নাটিকাতে ‘প্রিয়দর্শিকার’ অনুরূপ ঘটনাবিন্যাস পরিলক্ষিত হয়। গুণাত্যের বৃহৎকথা হল এই ঘটনার মূল উৎস।

মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ ও বাসবদত্তার অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর ঘটনা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ায় সিংহলরাজ বিক্রমবাহু তার নিজ দুহিতা রত্নাবলীকে উদয়নের হাতে সমর্পণের উদ্দেশ্যে জাহাজে করে প্রেরণ করেন। পথমধ্যে জাহাজডুবি হলে কৌশাম্বীর এক বণিক রত্নাবলীকে উদ্ধার করে এনে বাসবদত্তার অন্তঃপুরে নিয়ে হাজির করে। বাসবদত্তার পরিচারিকা নিযুক্ত হলে তার নাম হয় সাগরিকা। একদা বসন্ত উৎসবে প্রমোদ কাননে সাগরিকা ও উদয়ন পরস্পর পরস্পরকে দেখে প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ে সাগরিকা গোপনে নানাভাবে রাজা উদয়নের সাথে সাক্ষাৎ করতে থাকলে বাসবদত্তার চোখে ধরা পড়ে যায়। বাসবদত্তা তাঁকে অন্তঃপুরে বন্দী করে রাখেন। বিদূষকের প্ররোচনায় এক জাদুকরের সাহায্যে সেই বন্দীশালায় কৃত্রিমভাবে অগ্নিসংযোগ করলে রাজা উদয়ন গিয়ে সাগরিকাকে উদ্ধার করে। এমন সময় সিংহল রাজমন্ত্রী বসুভূতি তথায় উপস্থিত হন। যিনি সেই জাহাজডুবিতে প্রাণ হারিয়েছেন বলে সকলের ধারণা ছিল। মন্ত্রীর মুখে সকলে সাগরিকার আসল পরিচয় এবং সিংহল রাজের মনোবাসনা সমস্তই অবগত হলেন। অতএব রাজ কুমারীর সাথে রাজার মিলনের সব বাধাই নিমেষে দূর হয়ে গেল। বাসবদত্তার অনুমতি সাপেক্ষে সাগরিকা অর্থাৎ রত্নাবলী ও উদয়নের পরিণয়ে নাটকের মধুর পরিসমাপ্তি ঘটল।

উদয়ন কথা অতি পরিচিত ও বহুল চর্চিত। ভাস, শ্রীহর্ষ সকলেই উদয়ন কথাকে নিজ কল্পনার রঙে প্রয়োজন মত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে, নূতন নূতন ভাবে নাট্য রূপ পরিবেশনে গতানুগতিক নটকীয় বিষয়ও আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। যৌবনের প্রেমোচ্ছাস ও বিদূষকের চরিত্র সৃষ্টিতে শ্রীহর্ষ পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রাচীন নাট্য সমালোচকেরা ‘রত্নাবলী’ নাটকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ধনঞ্জয়, বিশ্বনাথ প্রমুখ আলঙ্কারিকেরা রত্নাবলী থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন।

প্রিয়দর্শিকা :—বৎসরাজ উদয়ন ও প্রিয়দর্শিকার প্রণয় কাহিনী শ্রীহর্ষ চার অঙ্কের নাটকের মধ্য দিয়ে পরিবেশন করেছেন, অঙ্গরাজ দৃঢ়বর্ম্মা মনস্থ করলেন বৎসরাজ উদয়নের হস্তে কন্যা প্রিয়দর্শিকাকে সমর্পণ করবেন। সেইরূপ প্রস্তুতি হতে থাকলে কলিঙ্গরাজ প্রিয়দর্শিকার প্রণয় প্রার্থী হলে দৃঢ়বর্ম্মা সেই প্রস্তাবে সম্মত হলেন না। ফলস্বরূপ কলিঙ্গরাজ দৃঢ়বর্ম্মাকে বন্দী করলেন। প্রিয়দর্শিকা বিন্ধ্যকেতুর আশ্রয় পেল এবং উদয়নের সেনাপতি বিজয়সেন তাকে বিন্ধ্যকেতুর কাছ থেকে উদয়নের অন্তঃপুরে এনে হাজির করলেন। তথায় আরণ্যিকা নাম নিয়ে অন্তঃপুরে বাসবদত্তার পরিচারিকা পদে নিযুক্ত হয়। একদিন উদ্যানে পদ্ম তুলতে গেলে ভ্রমর দ্বাংণ আক্রান্ত প্রিয়দর্শিকাকে উদয়ন বাঁচালেন, সেই সুযোগে উদয়ন প্রিয়দর্শিকার অনন্যসাধারণ রূপে মুগ্ধ হলেন এবং উভয়ের মধ্যে প্রণয়ের সূত্রপাত হল। উদয়ন ও বাসবদত্তার বিবাহ কাহিনী নিয়ে রচিত একখানি নাটক অভিনীত হবে স্থির হল, বাসবদত্তার ভূমিকায় প্রিয়দর্শিকা ও বৎসরাজের ভূমিকায় মনোরমা অভিনয় করবেন। কিন্তু গোপনে ষড়যন্ত্র করে মনোরমার পরিবর্তে উদয়ন নিজেই পাঠ করলেন। এইরূপ অভিসন্ধি প্রকাশ হলে বাসবদত্তা আরণ্যিকাকে কারাগারে রুদ্ধ করেন। এদিকে দৃঢ়বর্ম্মা নিজরাজ্যে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কারাগারে আরণ্যিকা বিষপান করেছে, বাসবদত্তা তাকে রাজসমীপে নিয়ে গেলেন কারণ একমাত্র উদয়নই বিষ চিকিৎসা জানতেন। উদয়ন আরণ্যিকাকে সুস্থ করে তুললেন। শীঘ্রই প্রকাশ পেল যে এই আরণ্যিকাই হল অঙ্গারাজ দুহিতা এবং বাসবদত্তার মাতুলকন্যা। তখন বাসবদত্তার সম্মতিক্রমে উদয়ন ও প্রিয়দর্শিকার বিবাহ হয়।

‘প্রিয়দর্শিকা’ নাটকেও নায়িকার নামেই নামকরণ হয়েছে। ‘রত্নাবলী’ ও ‘প্রিয়দর্শিকা’ দুখানি নাটকের আখ্যান ভাগ থেকে শুরু করে চরিত্র বিন্যাসে নাট্য পরিপাট্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য বর্তমান।

নাগানন্দ :—শ্রীহর্ষের পঞ্চাঙ্ক নাটক নাগানন্দ। কথা-সরিতসাগরের দ্বাদশ তরঙ্গে বর্ণিত জীমূতবাহনের আত্মত্যাগের ঘটনাকে অবলম্বন করে শ্রীহর্ষ নাটকের আঙ্গিকে আপন কল্পনাশক্তির প্রভাবে এই দৃশ্যকাব্যের অবতারনা করেছেন। বিদ্যাধর রাজপুত্র জীমূতবাহন বিশ্বপ্রেমিক। সেইহেতু রাজ্য ত্যাগ করে তিনি অরণ্যবাসী হন, তথায় পিতা মাতার সেবা করার নিমিত্ত মলয়পর্বতে গন্ধর্বরাজ কন্যা মলয়াবতীর সঙ্গে জীমূতবাহনের ভালবাসা জন্মে। অপরদিকে জীমূতবাহনের সাথে বন্ধুত্ব হয় সিদ্ধ রাজ পুত্র মিত্রাবসুর। মিত্রাবসু মলয়াবতীর ভ্রাতা। মলয়াবতীর সাথে জীমূতবাহনের বিবাহ সম্পন্ন হয়। একদিন জীমূতবাহন অস্থিস্তূপ দেখে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন, জানতে পারলেন যে নাগরাজ গরুড়ের সাথে এইরূপ সন্ধি করেছে যে প্রত্যহ একটি করে সর্প গরুড়ের আহার্য নিমিত্ত-বধ্যশিলায় প্রেরণ করবেন। জীমূতবাহন সৰ্পকূলকে এভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখে তাদের উদ্ধারকল্পে এক ফন্দী আটলেন। সেইদিন যে সপটি আসবে, তিনি তার প্রাণ রক্ষা করবেন। সাপটিকে সরিয়ে নিজে সেখানে অপেক্ষা করতে থাকলেন। গরুড় এসে তার অভ্যাসবশত খেতে লাগলেন। অর্ধেক ভক্ষণ করার পর গরুড়ের খেয়াল হল। নিজের ভুল বুঝতে পেরে খুব অনুতপ্ত হল এবং জীমূতবাহন তখন অহিংসা সম্বন্ধে গরুড়কে অনেক উপদেশ দিলেন। তখন জীমূতবাহনের অনুরোধে গরুড় সর্পভক্ষন ত্যাগ করল। অর্ধভক্ষ জীমূতবাহন প্রাণ ত্যাগ করলে মা দুর্গা এসে তাঁকে নতুন করে প্রাণ দান করলেন।’

শ্রীহর্ষের ‘নাগানন্দ’ অপর দুই নাটকের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। জীমূতবাহনের আত্মত্যাগ ও মহৎচরিত্র কাকে না মুগ্ধ করে? নাটকটির প্রথম তিনটি অঙ্কে মলয়াবতীর সাথে প্রণয় কাহিনী এবং পরবর্তী দুটি অঙ্কে জীবমূতবাহনের আত্মত্যাগের কথা রয়েছে। পরবর্তী দুই অধ্যায়ে মলয়াবতীর কোন ভূমিকা না থাকায় ঘটনার কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। নায়ক চরিত্রটি এখানে অতিমানবিক তাই বিদগ্ধ জনেদের বিচারে নাটকটি তেমন সার্থকতা লাভ-করেনি। নাটকে অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ রয়েছে। সহজ সরল ভাষায় বর্ণনার বৈচিত্র্যে প্রকৃতির নিপুণ ছবি অঙ্কিত হয়েছে। বিদূষকের হাস্যরসিক চরিত্রটিও হর্ষের শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় বহন করে। কালিদাসের পূর্ণচন্দ্র দ্যুতির কাছে শ্রীহর্ষ নিষ্প্রভ হতে পারে তথাপি আলোচ্য নাটকত্রয়ে শ্রীহর্ষের গুণের প্রকাশ পাওয়া যায়। তিনি যথার্থই নিপুণ কবি বলেই বোধ হয়।

ভবভূতি

কালিদাসোত্তর যুগের প্রতিথযশা কবি ও নাট্যকার হিসাবে ভবভূতি সম্মানীয় ব্যক্তি। মহাকবি ভবভূতি তিনখানি নাটক রচনা করেছেন। নাট্যকার তাঁর রচনায় কোথাও তাঁর কাল সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করেননি। তথাপি পরবর্তীকালীন কবি ও আলঙ্কারিকদিগের সশ্রদ্ধ উল্লেখ; এবং ঐতিহাসিক ঘটনা আলোচনার মধ্য দিয়ে কিছুটা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

কালিদাসোত্তর যুগের অপর প্রতিভাধর কবি ‘বাণভট্ট’ ভবভূতির নাম উল্লেখ করেননি। বাণভট্ট রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন অতএব ষষ্ঠ শতকের শেষভাগ থেকে সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যমান থাকা স্বাভাবিক। অতএব ভবভূতি সপ্তম শতাব্দীর শেষে আবির্ভূত হন। অষ্টম শতাব্দীর আলঙ্কারিক বামন ভবভূতির রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এছাড়াও সোমদেব, ধনঞ্জয়, মন্মট, প্রভৃতি বিদগ্ধ জনেরা ভবভূতির শ্লোক উদাগ ইসাবে গ্রহণ করেছেন। যাঁরা সকলেই ৭ম শতকের অথবা তৎপরবর্তী। কলহনের রাজ তরঙ্গিনীতে উল্লেখ রয়েছে কান্যকুজেশ্বর যশোবর্মন দেবের অভিযানে, ভবভূতি তাঁর সাথে ছিলেন। ৭৩৬ খ্রিঃ এই যশোবর্মন যুদ্ধে পরাজিত হন কাশ্মীররাজ মুক্তাপীড়ের নিকট। কল্হন আরও বলেন যে ভবভূতি ও বাক্‌পতি উভয়েই কনৌজেশ্বর যশোবর্মনের সভাকবি ছিলেন।১৩ ৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বাক্পতির গৌড়বহে যশোবর্মনের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে এবং ভবভূতির নিকট কবি বাক্‌পতি তার কৃতাজ্ঞতা স্বীকার কেরেছেন।” তত্ত্বসংগ্রহের মুখবঙ্গে ভবভূতির কাল বলা হয়েছে ৬৫৫-৭২৫ খ্রিষ্টাব্দ। পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় ভবভূতি ৭ম শতাব্দীর শেষ ভাগ ও অষ্টমশতাব্দীর গোড়ার দিকে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

ভবভূতি রচিত নাটকত্রয়ী যথাক্রমে মালতীমাধব, মহাবীরচরিত, উত্তররামচরিত। রচনাস্তর্গত প্রদত্ত পরিচয় থেকে জানা যায় যে মহাকবি ভবভূতির সম্পূর্ণ নাম শ্ৰীকণ্ঠ নীলকণ্ঠ। কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় শাখার কাশ্যপ গোত্রীয় উদুম্বর উপাধি ধারী ব্রাহ্মণ ছিলেন। মহাকবি ভট্টগোপালের পৌত্র এবং নীলকণ্ঠ ও জাতুকর্ণীর পুত্র। অনেকের ধারণা কবির নাম শ্রীকণ্ঠ এবং ভবভূতি তাঁর উপাধি। মালতীমাধবের পুষ্পিকায় তাঁকে কুমারিলশিষ্য বলা হয়েছে। কবি ভবভূতি বেদ, উপনিষদ্, দর্শন, অলঙ্কার ব্যাকরণ শাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। দাক্ষিণাত্যে পদ্মপুর নিবাসী ভবভূতি পরে উজ্জয়িনী ও কাণ্যকুব্জের রাজসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। কবির কিছু কিছু উক্তি থেকে এইরূপ মনে হয় যে প্রথম জীবনে কবির রচনা গুণীজনের তেমন সমাদর লাভ করেনি। কিন্তু কবির আত্মপ্রত্যয় ও মনোবল এত বেশী ছিল যে তিনি মনে করতেন, বিশাল এই পৃথিবীতে কোন এক সময়ে তাঁর রচনা হৃদয়ঙ্গম করার মত সমরুচি সম্পন্ন কোন ব্যক্তি নিশ্চয়ই আবির্ভূত হবেন, যে বা যাঁরা তাঁর রচনা পাঠ করে তৃপ্ত ও মুগ্ধ হবেন। সেই প্রগাঢ় আস্থার বলেই হয়ত তিনি পরবর্তী কালে রাজা যশোবর্মার সমাদর লাভ করেছিলেন। আজও পর্যন্ত্য সংস্কৃত সাহিত্য জগতে ভবভূতির নাম সকলে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেন।

মালতীমাধব :—’মালতীমাধব’ গতানুগতিক শৃঙ্গাররসাত্মক প্রণয়-কাহিনীর মূল উপাদান গুণাঢ্যের বৃহৎকথা থেকে সংগৃহীত। দশঅঙ্কের এই প্রকরণের গতানুগতিক বিষয় হওয়া সত্ত্বেও নাট্যকার নাট্যরূপ পরিবেশনে যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। তথাপি বলতে বাধা নেই সাহিত্য সমালোচকদের চোখে ‘মালতীমাধব’ নাটক ত্রুটিমুক্ত নয়। যদিও নাট্যকার স্বয়ং দাবী করেছেন যে মালতীমাধবের বিষয়বস্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও সেইহেতু জনপ্রিয়। উজ্জয়িনীর রাজমন্ত্রী ভুরিবসুর কন্যা ছিল মালতী, এবং বিদর্ভরাজমন্ত্রী দেবরাতের পুত্র মাধব। বাল্যে দুই মন্ত্রী সহপাঠী ছিলেন এবং বন্ধুত্ববশতঃ দুজনে স্থির করলেন উভয়ের পুত্র-কন্যার বিবাহ দেবেন। মাধব তখন উজ্জয়িনী নগরেই তরুণ শিক্ষার্থী। এদিকে ভুরিবসু মাধবের সাথে মালতীর বিবাহের প্রস্তাব দিলে তার রাজার বন্ধু নন্দন মালতীকে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করে তখন . রাজরোষের ভয়ে ভুরিবসু নিজ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নন্দনের হাতেই মালতীকে সমর্পণ করা মনস্থ করেন। এদিকে মদন উৎসব উপলক্ষ্যে মালতী ও মাধবের সাক্ষাৎ হলে, পরস্পর প্রণয়াসক্ত হয়। মালতী তাঁর পিতার মত পরিবর্তনের কথা শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হয়।

নাটকটিতে মূলকাহিনীর পাশাপাশি নন্দনের ভগিনী মদয়ন্তিকার সঙ্গে মাধবের বন্ধু মকরন্দের প্রণয় কাহিনী যুক্ত হয়ে আছে। মালতী ও মাধব গোপনে শিবমন্দিরে গেলেন আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে। সেখানে একটি ব্যাঘ্র মদয়ন্তিকাকে আক্রমণ করলে মকরন্দ তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে। এই ভাবে উভয়ের সাক্ষাৎ হয় ও পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মাধব মালতীকে পাবে না জেনে মনের দুঃখে শ্মশানে গিয়ে সময় কাটায়। কাপালিক অঘোর ঘণ্টক ও-কপালকুণ্ডলা মালতীকে চামুণ্ডা দেবীর নিকট বলি দিতে উদ্যাত হলে মালতীর চিৎকার শুনে শ্মশান থেকে মাধব ছুটে অঘোর ঘণ্টকে বধ করে মালতীকে উদ্ধার করে। নন্দন মালতীকে বিবাহ করবে স্থির হল। মালতী শিবমন্দিরে পূজা অর্চনা করতে যাবে ঠিক হলে সেখানে মকরন্দ মালতী সাজলো এবং সেই সুযোগে মালতী মাধবের সাথে পলায়ন করল। বধু-বেশে মকরন্দের সাথেই নন্দনের বিবাহ হয়ে গেল। মদয়ন্তিকা নববধূকে ভর্ৎসনা করতে এসে মকরন্দকে চিনতে পারলেন এবং তাঁর সাথে পলায়ন করলেন। মালতী যখন শিবমন্দির থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন কপালকুণ্ডলা তাকে অপহরণ করে, মাধব বহু অন্বেষণ করেও প্রণয়ীকে খুঁজে না পেয়ে অবসন্ন দেহ মনে পড়ে রইলেন। পরে বৌদ্ধ ভিক্ষুণী কামন্দকী শিষ্যা সৌদামিনী মালতীকে কপাল-কুণ্ডলার হাত থেকে রক্ষা করলে উভয়ের শুভপরিণয়ের মধ্য দিয়ে নাটকের মধুর পরিসমাপ্তি ঘটলো।

নায়ক-নায়িকার নাম অনুযায়ী নাটকের নামকরণ হয়েছে। ‘মালতীমাধব’ নাটকে ঘটনা সাধারণ হলেও কবি তার কল্পনা শক্তির পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন। নানারূপ রোমাঞ্চকর ঘটনার ঘনঘটায়, আশা নৈরাশ্যের অন্তর্ঘাতে, নাটকীয় ঘাত প্রতিঘাত সৃষ্টিতে নাট্যকার হিসাবে ভবভূতি কৃতিত্বের দাবীদার। তবে মূলকাহিনীর পাশাপাশি উপকাহিনীটি নাটকীয় ধারাবাহিকতাকে অনেকাংশে ক্ষুন্ন করেছে। মূল কাহিনী যেন উপকাহিনীর দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।

মহাবীর চরিত :—বীররসাত্মক সপ্তাঙ্ক নাটক ‘মহাবীর চরিত’। এই নাটকের শেষ দুই অঙ্কের (ষষ্ঠ ও সপ্তম) মূল রচনা পাওয়া যায় না। কথিত আছে সুব্রহ্মণ্য নামক কোন এক ব্যক্তি বাকি অংশ রচনা করে পূর্ণ করেছেন। ভবভূতির রচনা বহু পরে আবিষ্কৃত হয়। রামচন্দ্রের প্রথম জীবনের কাহিনী এই নাটকের বিষয়বস্তু। বাল্মীকি রচিত রামায়ণের বহু অংশের পরিবর্তন করে কবি তার কল্পনার রঙে সাজিয়ে ঘটনা পরিবেশন করেছেন। শ্রীরামচন্দ্রের সাথে সীতার বিবাহ থেকে রামের বনবাস। রামকর্তৃক রাবণবধ পর্যন্ত্য কাহিনী নাটকে বিন্যস্ত। মূল রামায়ণকে স্থানে স্থানে কবি নাটকের খাতিরে পরিবর্তন করেছেন। যেমন রাম, লক্ষণ সীতা ও উর্মিলাকে বিশ্বামিত্রের আশ্রমে প্রথম দর্শন করেন। লঙ্কার রাজা রাবণ সর্বদাই রামচন্দ্রের অনিষ্ট কামনা করতেন। সেই সূত্রধরে তার ভগিনী শূর্পণখাই দাসী মন্থরা সেজে কৈকেয়ীকে ঐরূপ বর দুটি সুযোগ বুঝে চেয়ে নিতে পরামর্শ দিয়েছিল। রামায়ণে রামচরিত্র কলঙ্কিত হয়েছিল গোপনে বালি বধ করায়। কিন্তু নাটকে কবি ঘটনা পরিবর্তন করে রামকে কলঙ্কমুক্ত দেখিয়েছেন। অর্থাৎ রামচন্দ্রকে মহাবীর বলাই কবির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, সেইহেতু কবি মূল ঘটনার পরিবর্তে রামের বীরত্বের খাতিরে অনেক বেশী কল্পনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। রামসীতার চরিত্রকে মানবীয় না রেখে অতিমানবীয় বা দৈবী প্রাধান্য প্রদান করেছেন। এইভাবে প্রতিটি রামায়ণ প্রসিদ্ধ অতি পরিচিত চরিত্রগুলিকেই তিনি অল্পবিস্তর পরিবর্তন করে নিয়েছেন। ফলস্বরূপ জনগনের মনে দীর্ঘ বদ্ধমূল সংস্কারগুলিতে আঘাত হেনে রামচরিত্রে এইরূপ মৌল পরিবর্তন একদিকে যেমন কবির সাহসিকতার পরিচায়ক অপরদিকে নাটকটির উৎকর্ষের পরিবর্তে অপকর্ষই সাধিত হয়েছে। হয়ত কবির জীবদ্দশায় নাটকটির জনপ্রিয়তা না থাকার এইটি একটি অন্যতম কারণ। কোথাও কোথাও দীর্ঘসমাসবদ্ধপদ, গদ্যরীতির অধিক প্রয়োগ, সুদীর্ঘ কথোপকথন, ভাষার আড়ম্বড় ইত্যাদি নাটকটিকে মঞ্চোপযোগী করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। তথাপি ভবভূতির কবিপ্রতিভা আমাদের মুগ্ধ করে, যেমন রাবণকে বধ করে বিমানে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন কালে চোদ্দ বৎসর বনবাসে থাকা কালীন যে সমস্ত অরণ্য, জনপদ, নদনদী, দণ্ডকারণ্য ইত্যাদির মনোরমদৃশ্য কবির অসাধারণ তুলির টানে মনোরম চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। রামচন্দ্রের মহান্ চরিত্র অঙ্কনে কবি যথার্থই যত্নবান ছিলেন। সেইহেতু সকলের ত্রাণকর্তা বীর রামচন্দ্রের পৃথিবীতে শুভাগমন কবি নিপুণ দক্ষতার সাথে দেখিয়েছেন। বীর রামচন্দ্রের চরিত বর্ণনা হেতু ‘মহাবীরচরিত’ নামও সার্থকতা লাভ করেছে।

উত্তররাম চরিত :– বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ড অবলম্বনে কবি ‘উত্তররামচরিত’ এই সপ্তাঙ্ক নাটক রচনা করেছেন। ‘মহাবীরচরিত’-এর শেষ অংশ বলে ‘উত্তররাম- চরিত’ নাম হয়েছে। মূলঘটনাকে পরিবর্তন করে কবি যেন সম্পূর্ণ নূতনভাবে ঘটনাকে সাজিয়েছেন। সীতাদেবীর চিত্ত বিনোদনের জন্য লক্ষ্মণ রামচন্দ্রের জীবনবৃত্তান্ত চিত্রায়িত করেছেন। তাঁরা তিনজনে বসে সেই সমস্ত চিত্ররূপের মধ্য দিয়ে অতীতদিনের স্মৃতি রোমন্থন করছেন। অপূর্ব বনরাজি। আশ্রমের শান্ত অথচ গম্ভীর ভাব, অনন্য প্ৰাকৃতিক সম্পদ তারা রাজপ্রাসাদে বসেও উপভোগ করছেন এবং আরন্যক জীবনের পূর্বস্মৃতি রোমন্থন করে সীতার প্রাণ যেন ব্যাকুল হয়ে উঠছে, সেই সব দিন ফিরে পাওয়ার জন্য। পুনরায় সেইরূপ নদীর ধারায় অবগাহনের, অরণ্যানীর গম্ভীর প্রকৃতি দেখে নয়ন ধন্য করার আবদার করলে রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে রথ প্রস্তুত করতে বললেন। চিত্র দেখতে দেখতে ও পূর্বস্মৃতি রোমন্থন পূর্বক ক্লান্ত হয়ে গর্ভভারাবনতা সীতা রামচন্দ্রের বক্ষে মস্তক রেখে শায়িতা। রামচন্দ্রও সীতার অঙ্গস্পর্শে ধন্য। সীতা তাঁর গৃহলক্ষী, ঠিক এমন সময়ে দুর্মূর্খ এসে রামচন্দ্রকে সীতাদেবীর বিরুদ্ধে লোকের দেওয়া অপবাদ নিবেদন করল। নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক সীতাদেবীর সম্পর্কে প্রজাদের এরূপ অপবাদ শুনে রামচন্দ্র দুঃখে বেদনায় ফেটে পড়লেন, রামচন্দ্র প্রজানুরঞ্জক রাজা। অতএব প্রজাদের প্রতি কর্তব্য পালনে তিনি অদ্বিতীয়। প্রজারঞ্জনের জন্য সীতাদেবীকে পরিত্যাগ করতেও তিনি প্রস্তুত। সীতা দেবীকে বনে পাঠালেন। দেখতে দেখতে বার বৎসর অতিবাহিত হয়েছে। সীতার দুই পুত্র লব-কুশ বাল্মীকির আশ্রমে পালিত হচ্ছে। রামচন্দ্র স্বর্ণসীতা রেখে অশ্বমেধ যজ্ঞ করছেন। রামচন্দ্র বজ্রঅপেক্ষাও কঠিন আবার কুসুম অপেক্ষা কোমল—

‘বজ্রাদপি কঠোরানি মৃদুনি কুসুমাদপি।
লোকাত্তরাণাং চেতাংসি কো নু বিজ্ঞাতুমহতি”।

কর্তব্যপালনে তৎপর রাজারামচন্দ্র যজ্ঞের অনধিকারী শূদ্র শঙ্কুককে উপযুক্ত শাস্তি দিতে দণ্ডকারণ্যে উপস্থিত হলেন। শঙ্কুককে বধ করে যখন রামচন্দ্র পঞ্চবটী বনে বিহার করছেন, এবং সীতাসহ এইবনে পূর্বে বসবাসকরার স্মৃতি রোমন্থনে, সীতা বিরহে কাতর, কখনও বা উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করে উঠছেন। সেই সময়ে সীতাদেবী ছায়ার মত মূর্ত্তি ধারন করে যেন রামচন্দ্রের নিরব বেদনা ও প্রেমের গভীরতা অনুভব করছেন এবং রাম তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন না কিন্তু তাঁর স্পর্শ যেন অনুভব করতে পারছেন। কারণ ভগীরথীর বরে সীতা ছিলেন অদৃশ্যা। করুণরসের সার্থক রূপকার কবি ভবভূতি এই অংশে রামচন্দ্রের হৃদয় মথিত আবেগ, প্রেমের সূক্ষ্ম অনুভূতি ও বিরহ বিধূর অন্তরের যে ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন তা অবর্ণনীয়। অতঃপর বাল্মীকি আশ্রমে লব কর্তৃক রামচন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব ধৃত হল। লক্ষ্মণের পুত্র চন্দ্রকেতুর সাথে লবের যুদ্ধের প্রস্তুতি। যুদ্ধ সংঘটিত হলে রামচন্দ্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বিরতি। রামচন্দ্র কর্তৃক লবের বীরত্বের প্রশংসা। এমন সময় সেখানে কুশ উপস্থিত, হাতে বাল্মীকি রচিত কাব্য; তার নাট্যরূপ দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। ভরতের নির্দেশে স্বর্গের অপ্সরাগণদ্বারা নাট্যাভিনয় হলো। নাটকের বিষয়বস্তু হল রাম কর্তৃক পরিত্যক্তা সীতার দুঃখদুর্দশা, সীতা মনের দুঃখে আত্মহত্যা সঙ্কল্পে ভাগীরথীর জলে ঝাঁপ দিলেন। পৃথিবী ও গঙ্গা সীতা ও তার দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে আবিভূর্ত হলেন। পৃথিবী রামের কঠোরতাকে অত্যন্ত নিন্দা করলেন। এই নাটক দেখতে দেখতে রাম কখনও ছুটে যাচ্ছেন অভিনয়ে বাধা দিতে, কখনও মূৰ্চ্ছা যাচ্ছেন। সংজ্ঞা হারালে রামচন্দ্রকে সীতাদেবী শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলে। মোহগ্রস্থ রাম প্রকৃতিস্থ হলে প্রজারাও আনন্দ সহকারে সীতাদেবীকে বরণ করে নিলেন। এইভাবে করুণ রসের ধারায় স্নাত ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটলো রাম-সীতা ও লব কুশের মিলনের মধ্য দিয়ে।

ভবভূতির নাটকত্রয়ের মধ্যে অনায়াসেই পৌর্বাপর্য্য স্থির করা যায়। মালতীমাধব প্রথমরচনা। দ্বিতীয়—’মহাবীরচরিত’ ও সর্বশেষ নাটক ‘উত্তররামচরিত।’ মৌলিকতা ও স্বকীয়তায় অনন্যসাধারণ কবিপ্রতিভার সাক্ষ্য দিয়েছেন কবি ভবভূতি। রাম-সীতার সম্পর্কের অর্ন্তদ্বন্দ্ব যেন কবি তার সমস্ত অনুভূতি দিয়ে অনুভব করতে সমর্থ হয়েছিলেন। রাম-সীতার প্রেমে রূপজ দৈহিক আবেদনই যে মুখ্য নয়, তাঁদের প্রেম ইন্দ্ৰিয়াতীত অলৌকিক আনন্দের স্বাদে পরিপূর্ণ একথা ভবভূতি উত্তররামচরিতে দেখাতে পেরেছেন। করুণরসের প্রাধান্য নাটকটিকে একটি অন্যমাত্রা দান করেছে। নিসর্গের সুন্দর অথচ স্তব্ধ গম্ভীর ভাব বর্ণনায় তিনি বাণভট্টের সমকক্ষ আবার কখনও বা দাম্পত্য প্রেমের বর্ণনায়, লীলাচঞ্চল প্রকৃতির বর্ণনায় তিনি কালিদাসের সমতুল্য। বিরহের মধ্যে যে শুধু দুঃখই থাকে না। বিরহও যে সময় সময় কত মধুর হতে পারে সেকথাও ভবভূতির গভীর অনুভূতিতে উপলব্ধ, তবে হাল্কা রসের আস্বাদন তাঁর কাব্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। সেইহেতু বিদূষক চরিত্রের প্রতি তাঁর তেমন আকষর্ণ ছিল না। মালতীমাধব ও মহাবীর চরিতে কিছু দোষ ত্রুটি থাকলেও উত্তররামচরিত নিঃসন্দেহে কবির সার্থকরচনা। উত্তররামচরিতের বহু টীকা রচিত হয়েছে—তন্মধ্যে আত্মরাম, লক্ষ্মণসূরি, ভট্টোজী শাস্ত্রী, রামচন্দ্র, বীররাঘব, নারায়ণ ভট্ট, জীবানন্দ, বিদ্যাসাগর, ঘনশ্যাম, প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ প্রমুখ টীকাকারগণের নাম অগ্রগণ্য।

কালিদাস ও ভবভূতি

সংস্কৃত নাট্য সাহিত্য তথা সমগ্র সাহিত্যে কালিদাস ও ভবভূতি শ্রেষ্ঠ কবি বলেই বিবেচিত। কবি প্রতিভার দিক দিয়ে বিচার করলে উভয়ে উভয়ের সাথে তুলনীয়। কালিদাস ও ভাবভূতি উভয়েরই অপূর্ব বস্তু নির্মাণ ক্ষম জ্ঞানের আলোয় সমগ্ৰ সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ। ভবভূতি কালিদাসের ন্যায় বৈদভীরীতির কবি নন। গৌড়ী রীতির মাধ্যমেও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর দ্যোতক লিখন শৈলী পাঠকগণকে মুগ্ধ করে। স্থানে স্থানে বৈদভী রীতির ব্যবহারও কালিদাসের তুলনায় কোন অংশে হীন বলা চলে না। ভবভূতি শব্দের গম্ভীর পদচারণায় যেন ছবি আঁকতেন, আর কালিদাসের রচনা ব্যঞ্জনাপ্রধান। কালিদাস উপমা প্রয়োগে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু কালিদাসের উপমা ছিল বস্তুগত—অর্থাৎ একটি বস্তুর সাথে অপর একটি বস্তুর তুলনা কিন্তু ভবভূতির উপমা বস্তু ও ভাবনিষ্ঠ—অর্থাৎ একটি বস্তুর সাথে একটি ভাবের তুলনা। পাশ্চাত্য কবি Shelly-র সাথে তিনি এই কারণেই তুলনীয়। আমরা একথা জানি যে কবি সাহিত্যিকগণ তাঁদের পারিপার্শ্বিক সকলপ্রকার পরিস্থিতি এবং নিজ হৃদয়ের অনুভূতিই কাব্যের মধ্য দিয়ে আমাদের উপহার দিয়ে থাকেন। সেদিক থেকে বিচার করে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে কালিদাস যে যুগে বর্তমান ছিলেন সে যুগ ছিল ভারতবর্ষের সমৃদ্ধির যুগ। এই গুপ্ত যুগেই ভারতবর্ষের সকল বিষয়ে উন্নতি ঘটেছিল। এ-হেন সুবর্ণযুগের কবি হয়ে রাজরাজাদের বিশেষ অনুগ্রহে সম্মানিত হয়ে তাঁর জীবন অতি বাহিত হয়েছিল। অতএব তাঁর কাব্যে নাটকে আমরা যে এক নির্মল শান্তিধারা, বিমল আনন্দানুভূতির প্রকাশ দেখতে পাই, তা বোধ করি উপরিউক্ত কারণেই সম্ভব ছিল। তাঁর অন্তরের সুখ ও আনন্দই তাঁর কাব্যে প্রতিফলিত। সেইহেতু তাঁর কাব্যে দুঃখ কখনও দীর্ঘস্থায়ী ছায়া ফেলেনি। দুঃখ থেকে মুক্তি পেতেই তিনি বোধ করি হাস্যরসিক বিদষকের উপর এত বেশী নির্ভর করতেন।

অপরদিকে ভবভূতি যে যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন সে যুগ ছিল ভারতের অবনতির যুগ। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কালোমেঘের ঘনঘটা। বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি নানারূপ অলৌকিক কার্যকলাপের প্রকোপ, সেই যুগে আর যাই হোক গুপ্তযুগের সমান শিল্পকলা প্রদর্শন সম্ভব ছিল না। উপরন্তু ভবভূতির জীবনের ভিত্তি ভূমি বোধ করি দুঃখের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। যে কারণে তাঁর রচনায় দুঃখ যেন সুদূর প্রসারী ছায়া বিস্তার করত। দুঃখ যেন সততই তাঁর রচনার অনুসারী। ভবভূতির নিজ ব্যক্তব্যের মধ্যেই আমরা দেখেছি তিনি জীবনে তার প্রাপ্য সম্মান ও সমাদর লাভে বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর রচনার তেমন প্রশংসাও দেখে যান নি। সেই কারণেই বোধ করি তিনি করুণরসের সার্থক রূপকার ছিলেন। তাঁর লেখনিতে আনন্দ, উৎসব, তৃপ্তি, সুখের মধ্যেও যেন কোথায় একটা বিষাদের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। উত্তররামচরিতে রাম দীর্ঘ চোদ্দবৎসর বনবাসে কাটিয়ে অযোধ্যার রাজ্যে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, অপরিমিত সুখের বন্যায় তখন ভেসে যাওয়ার কথা। কিন্তু সীতার সাথে বিশ্রাম সুখে অভিভূত থেকেও রাম বলেছেন— ‘সুখমিতি বা দুঃখমিতি বা’। আবার উত্তররাম চরিতে যখন আলেখ্যদর্শন অঙ্কে ফেলে আসা কিশোর জীবনের স্মৃতি মেদুর দিনগুলির, দুঃখময় দিনগুলির ছবি একে একে বিন্যস্ত হয়েছে, সুখের জীবনেও যেন দুঃখেরই অভিষেক। ভবভূতির এই দৃশ্যের অবতারনা সমগ্র সাহিত্যে অতুলনীয় ও অনবদ্য সৃষ্টি।

বাল্মীকির সীতা বিসর্জন পাঠ করেই ভারতীয় নরনারীর অশ্রুজল বাধা মানে না। সেখানে ভবভূতির করুণ রসের পরিবেশনে ঐ দৃশ্য যেন হৃদয়কে কেবল দুঃখাচ্ছন্নই করে না বিদীর্ন করে। কালিদাসের রঘুবংশেও দুঃখরাশি দু’কুল ছাপিয়ে প্রকাশ পায়। কিন্তু ভবভূতির ন্যায় সমুদ্রের অতলস্পর্শী হয় না। করুণরস চিত্রণে ভবভূতি নিঃসংশয়ে কালিদাসকেও অতিক্রম করে গেছেন। কালিদাসের হাতে পড়ে প্রকৃতি যেন কথা বলে, কালিদাসের বর্ণনায় প্রকৃতির মনোরম শোভা প্রকাশ পায়। কিন্তু ভবভূতির প্রকৃতি বর্ণনায় কেবল মনোরম দৃশ্যই নয় ভীষণ ও গম্ভীর দণ্ড কারণ্যের প্রকৃতির পরিচয়ও পাই। কোনও সমালোচককে এমনও বলতে শোনা যায় যে ‘কালিদাস ও অন্যান্যরা কবি কিন্তু ভবভূতি হলেন মহাকবি। ‘কবয়ঃ কালিদাসাদ্যা/ভবভূতির্মহাকবিঃ /

বিশাখদত্ত বা বিশাখদেব

বিশাখদত্ত বা বিশাখদেব ‘মুদ্রারাক্ষস’ নামক নাটকের রচয়িতা। নাটকের শুরুতেই নাট্যকার সামান্য যেটুকু আত্মপরিচয় প্রদান করেছেন, সেটুকুই তাঁর সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান। তিনি মহারাজ পৃথু নামান্তরে ভাস্করদত্তের পুত্র এবং সামন্ত বটেশ্বর দত্তের পৌত্র ছিলেন। সংস্কৃত কবি ও পণ্ডিতদের অধিকাংশ ব্যক্তিদিগের ক্ষেত্রেই যেরূপ কাল নিরূপণে সমস্যা দেখা দেয়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। সাহিত্য সমালোচকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে ও ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে কতকগুলি সূত্রের সন্ধান দিলেও, তার দ্বারা কোন সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয় নি। নাটকের ভরতবাক্যে কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও তার বিভিন্ন সংস্করণে বিভিন্ন পাঠ দৃষ্ট হয়—ফলে কঠিন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও চন্দ্রগুপ্ত, কোথাও অবক্তিবর্মা, দক্তিবর্মা বা বক্তিবর্মা ইত্যাদি বিভিন্ন পাঠ রয়েছে। এক্ষণে অবক্তিবর্মা যদি শুদ্ধ পাঠ হয় তবে মৌখরী রাজ অবক্তিবর্মাকে বুঝতে হয় যিনি ৮৫৫-৮৮৩ খ্রিঃ পর্যন্ত্য রাজত্ব করেছিলেন। এই অবন্তিবর্মার পুত্র গ্রহবর্মা ছিলেন শ্রীহর্ষের ভগ্নী রাজ্যশ্রীর স্বামী। পণ্ডিত জ্যাকোবির মতে মুদ্রারাক্ষসে যে গ্রহণের উল্লেখ রয়েছে তা ৮৬০ খ্রিঃ ২রা ডিসেম্বরের গ্রহণ অতএব সেদিক থেকে বিচার করলে অবক্তিবর্মা পাঠের অধিকমূল্য রয়েছে। আবার নবম শতাব্দীতেও একজন অবন্তি বর্মার নাম জানা যায় যিনি কাশ্মীরের রাজা ছিলেন। ৭৯৯-৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে আর একজন নৃপতি দক্তিবর্মা নামে ছিলেন। Teleng মনে করেন ৭ম খ্রিষ্টাব্দের অবন্তিবর্মার সমসাময়িক এই কবি। Macdonell এই মতকে সমর্থন করেছেন। চন্দ্রগুপ্ত পাঠ দেখে অনেকে কালিদাসের সমসাময়িক দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৭৫-৪১৩খ্রিঃ) কেই অনুমান করেন। নাটকে বর্ণিত ঘটনার স্থান কুসুমপুর বা পাটলি পুত্র। নাটকের মধ্য দিয়ে পাটলিপুত্রের সমৃদ্ধির আভাসও সুস্পষ্ট। গ্রন্থশেষে যে সমস্ত নীতিকথা আলোচিত হয়েছে তা সেযুগে বৌদ্ধ ধর্মের উন্নতির কথাই সূচিত করে। সেই হেতু কোন কোন সমালোচকের মতে ‘মুদ্রারাক্ষস’ বুঝি বা পঞ্চম খ্রিষ্টাব্দে রচিত। যদিও এই অনুমানের কোন দৃঢ়ভিত্তি নেই। যেহেতু ‘দেবীচন্দ্রগুপ্ত’ নামে একটি নাটক বিশাখদেব কর্তৃক লিখিত বলে শোনা যায়। সেই নাটকে চন্দ্রগুপ্ত ও শকদের শত্রুতার উল্লেখ রয়েছে। বিশাখদত্তের সঠিক কাল নির্ণয় করা না গেলেও তিনি যে কালিদাসোত্তর যুগের এক সফল নাট্যকার ছিলেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

মুদ্রারাক্ষস :—নাট্যকার বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নামক সপ্তাঙ্ক নাটক ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে নন্দবংশের উচ্ছেদ ও মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেই কারণে পণ্ডিতদের অনুমান বিশাখদত্ত নন্দ-ও মৌর্যবংশের ঐতিহাসিক বিবরণ ও তৎকালীন লোকশ্রুতিকে অবলম্বন করেই তাঁর ‘মুদ্রারাক্ষস’ নামক রাজনৈতিক নাটকটি রচনা করেছিলেন।

রাজা চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী হলেন কূটনীতিক চাণক্য। এবং নন্দবংশের বিশ্বাসভাজন মন্ত্রী ছিলেন রাক্ষস। কূট কুশলী চাণক্য তাঁর অসাধারণ বুদ্ধির বলে নন্দবংশের মন্ত্রী রাক্ষসকে চন্দ্রগুপ্তের পক্ষে কীভাবে এনেছিলেন। রাজ্যকে আরও সুদৃঢ় করতে, তারই বর্ণনা এই নাটকের মধ্য দিয়ে প্রতিকায়িত হয়েছে। অপরপক্ষে রাক্ষসও যথেষ্ট বুদ্ধিমান, বলবান এবং নীতিশাস্ত্রজ্ঞ মন্ত্রী। চাণক্যের সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধির বিপরীতে তিনিও নানা ছল-চাতুরী প্রয়োগ করতে লাগলেন। রাক্ষসের পক্ষে যোগ দিয়েছেন পর্বতক নামক পার্বত্য রাজার পুত্র মলয়কেতু। চাণক্য ও রাক্ষস এবং চন্দ্রগুপ্ত ও মলয়কেতু পরস্পর পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। রাক্ষসের গুপ্তচর ছিল বিরাধগুপ্ত ও শকটদাস। অপরদিকে চাণক্যর গুপ্তচর ছিল ভাগুরায়ণ ও সিদ্ধার্থক। রাক্ষসের নামাঙ্কিত মুদ্রা চিহ্নিত অঙ্গুরীয়ক হস্তগত হলে তার দ্বারা মিথ্যা ছলনায় রাক্ষস নন্দদের পক্ষ ত্যাগ করে মৌর্যবংশে যোগদান করতে বাধ্য হয়। প্রিয়বন্ধু, আত্মীয় পরিজনদের প্রাণরক্ষার্থে তাঁকে বাধ্য হয়ে এই কাজ করতে হয়েছিল। মুদ্রার ছলনা দ্বারা বিপক্ষকে পরাজিত করে নিজপক্ষে আনতে পেরেছিলেন চাণক্য। অতএব নাটকের নামকরণও সার্থকতা লাভ করেছে। সমগ্র নাটকের মধ্য দিয়ে চাণক্যের কূটনীতি কিভাবে জয়ী হল তাই দৃশ্যায়িত হয়েছে।

সংস্কৃত সাহিত্যের প্রচলিত ধারা অনুযায়ী রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ অথবা লৌকিক-অলৌকিক গল্প গাথা, আখ্যান উপখ্যান, প্ৰণয় কাহিণী এই সমস্ত উৎসকে বর্জন করে কেবলমাত্র ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক পটভূমিকে আশ্রয় করে সম্পূর্ণ নূতন আঙ্গিকে নাটকরচনা করে কবি বিশাখদত্ত যে মৌলিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তা এককথায় নজির বিহীন। সম্পূর্ণরূপে শৃঙ্গাররসবর্জিত নাটক। নায়িকা ছাড়াও যে নাটক হতে পারে একথাও তিনি তাঁর নাটকের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে এক বিশেষ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। একটি মাত্র স্ত্রী চরিত্র মঞ্চে ক্ষনিকের জন্য আবির্ভূতা, বিদূষকের মত হাস্যরসিক চরিত্রও এই নাটকে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অর্থাৎ সকল প্রকার লঘুচপল বৃত্তিগুলি নাট্যকার যত্নসহকারে পরিহার করেছেন। চাণক্য ও রাক্ষস উভয় মন্ত্রীর চরিত্রই অত্যন্ত যত্নের সাথে চিত্রিত করেছেন। তাদের ঘিরে রচিত অন্যান্য চরিত্রগুলিও স্ব স্ব মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। সমস্ত চরিত্রগুলি পরস্পর পরস্পরের প্রতিযোগী রূপে প্রতিভাত হয়েছে বলেই এত সজীব ও জীবন্ত। সব মিটীয়ে লোমহর্ষক, রহস্যজনক কাহিনীর আবর্তে দর্শকের রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। ঘটনার বাত প্রতিঘাত অতীব রোমাঞ্চকর, নাট্যকারের ওজস্বী ভাষা ও গুরুগম্ভীর ভাব বিন্যাসে সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যে মুদ্রারাক্ষস’ অসাধারণ কৃতিত্বের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ভাসের ‘প্রতিজ্ঞাযৌগন্ধরায়ণ’ নাটকটিও রাজনৈতিক কূটনীতির আবর্তে রচিত তথাপি বিশাখদত্ত এ বিষয়ে অনেক বেশী সার্থক।

ভট্টনারায়ণ

অর্বাচীন কবিকূলের মধ্যে, ‘বেণীসংহার’ নামক নাটক রচয়িতা ইতিহাসখ্যাত ‘ভট্টনারায়ণ’ একজন কৃতি নাট্যকার। কুল গ্রন্থানুযায়ী — “শান্ডিল্যগোত্রসম্ভৃতো ভট্টনারায়ণঃ কবিঃ।” মগধরাজ উপাধিধারী কবি ভট্টনারায়ণ এর আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে বলা যায়— ষ্টমশতাব্দীতে বঙ্গের রাজা ছিলেন আদিশূর।” আদিশুর কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে বঙ্গদেশে এনেছিলেন, কবিভট্টনারায়ণ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। হিউয়েন সাঙের বিবরণে অংশুবর্মার উল্লেখ দৃষ্ট হয়, সেনবংশের প্রতিষ্ঠাতা এই আদিশুরই ছিলেন অংশুবর্মার ভগ্নীপতি। যদি গৌরবঙ্গের রাজা থাকাকালীন ভট্টনারায়ণ তাঁর সভাসদ থাকেন তবে অষ্টম শতকই কবির কাল বলে চিহ্নিত হয়। Macdonell একটি তাম্রশাসনের দ্বারা অনুমান করেন ভট্টনারায়ণের আবির্ভাব ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ। ধর্মকীর্তি ও ভট্টনারায়ণ একত্রে রূপাবতার রচনা করেছেন। ধর্মকীর্তি তাঁর রূপাবতার গ্রন্থের টীকায় বাণভট্টের অনুরোধ অনুযায়ী ভট্টনারায়ণের বৌদ্ধ শিষ্যত্ব গ্রহণের কথা বলেছেন। অতএব M. Krishnamacharia অনুমান করেছেন ভট্টনারায়ণ সপ্তমশতাব্দীতে বিদ্যমান থাকা স্বাভাবিক। বামনের কাব্যালঙ্কার ও আনন্দ বর্ধনের ধ্বন্যালোক গ্রন্থে ‘বেনীসংহার’ থেকে শ্লোক উদ্ধৃত হওয়ায় ভট্টনারায়নের কাল অষ্টমশতাব্দীর পূর্বে হওয়াই স্বাভাবিক। উপরিউক্ত আলোচনা ক্রমে কবি ভট্টনারায়ণ সপ্তম শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে নবম শতাব্দীর প্রথম ভাগের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে গৌড়বঙ্গের রাজা আদিশূরের সভাসদ ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে ছয় অংক সমন্বিত ‘বেনীসংহার’ নাটক কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত, মহাভারতের সভাপর্বে কপট পাশাখেলায় যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পণ রেখে দূর্যোধনের নিকট পরাজিত হলে দূর্যোধন দ্রৌপদীকে কৌরবদের সভায় যার পর নাই লাঞ্ছিত ও অপমানিত করেন। অন্তঃপুরবাসী দ্রৌপদীকে উন্মুক্ত কেশরাশী ধরে বল প্রয়োগে টেনে আনতে দেখা যায় দুঃশাসনকে। এই দৃশ্য দেখে ভীম নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। প্রতিজ্ঞা করলেন দুঃশাসনকে হত্যা করে তার রক্ত গান করবেন, এবং দূর্যোধনের উরুভঙ্গ করে ঐ রক্তমাখা হাতে দ্রৌপদীর উন্মুক্ত কেশরাশি তিনি বন্ধন করবেন। অর্থাৎ মুক্তবেণী সংহার করবেন। অতএব নাটকের নাম ‘বেনীসংহার’। যা নাকি ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কৃষ্ণের আনা কুরুপাণ্ডবের সন্ধি প্রস্তাব ব্যর্থ হল; ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী কর্তৃক যুধিষ্ঠির ও দূর্যোধনের সন্ধির উপদেশ সবই একে একে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে অবশেষে ভীম ও অর্জুন কর্তৃক গদাযুদ্ধে দুর্যোধনের মৃত্যু হয়। ইত্যবসরে দুর্যোধনের বন্ধু রাক্ষস ছদ্মবেশ ধারণ করে যুধিষ্ঠিরকে গিয়ে ভীম ও অর্জুনের মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ দিলে শোকে দুঃখে বিহ্বল যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী আত্মহত্যা করতে উদ্যোগী এমন সময় দূর্যোধনের রক্তে দুইহাত রঞ্জিত করে ভীম এলেন দ্রৌপদীর বেণীসংহার (বন্ধন) করতে।

মহাভারতীয় উদ্যোগ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও শল্যপর্ব থেকে কাহিনী গ্রহণ করলেও স্থানে স্থানে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে নূতন ঘটনা বিন্যাসে কবি মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বেণী-সংহারের মূল বিষয় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত তথাপি ছয় অঙ্কের নাটক রচিত হয়েছে। তবে বীররসপ্রধান এই নাটকে অন্যান্য রসের পরিচয় কিঞ্চিৎ থাকলেও শৃঙ্গার রস সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কবির কাব্য প্রতিভা বিকাশের প্রতি বেশি মনোযোগ থাকায় নাট্যকলা খানিক ব্যর্থ হয়েছে। গৌড়ী রীতিতে রচিত নাটকটির ভাষা প্রাঞ্জল অথচ ঘটনাবিন্যাস ও চরিত্রচিত্রনে নাট্যকার বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তথাপি কোথাও কোথাও অকারণ দীর্ঘ জটিল সমাসবদ্ধ বাক্যের প্রয়োগ ও অতিকথন অতিকথন দোষ নাটকটিকে দুর্বল করে দিয়েছে। নাটকের শেষে, চার্বাক ও ধর্মের সংলাপ কবির অভিনব সংযোজন কিন্তু সমালোচকদের মতে নাটকের প্রয়োজন বিহীনতায় এই অংশের কোন গুরুত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। সব মিলিয়ে সমালোচক ও আলঙ্কারিকদের বিচারে ‘বেণীসংহার’ নাটকটি সার্থক দৃশ্যকাব্যের মর্যাদা পেতে ব্যর্থ হয়েছে।

লক্ষণসুরী, ঘনশ্যাম, তর্কবাচস্পতি প্রভৃতি টীকাকারগণ বেনীসংহার নাটকের টীকা, রচনা করেছেন। ‘দেবীচন্দ্রগুপ্ত’ ও অভিসারিকাবঞ্চিতক’ নামক দু’খানি নাটকও ভট্টনারায়ণের লেখা বলে বিদগ্ধ জনেরা মনে করেন। গুপ্তবংশীয় কাহিনী অবলম্বনে ‘দেবীচন্দ্রগুপ্ত’ রচিত হয়েছিল। এবং বহুল প্রচলিত উদয়নকথাকে অবলম্বন করে ‘অভিসারিকাবঞ্চিতক’ নাটক রচিত। তবে এই নাটকদুটি অধুনা দুষ্প্রাপ্য।

রাজশেখর

‘রাজশেখর’ সংস্কৃত সাহিত্যে কেবল কবি হিসাবেই পরিচিত নন, তিনি ছিলেন একাধারে মনীষী, সুপণ্ডিত, বিদগ্ধ সমালোচক ও নাট্যকার। বহু ভাষায় পারদর্শী রাজশেখর যে বংশে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তার যথেষ্ট আভিজাত্য ছিল। যাযাবর বংশের ধারা অনুযায়ী বহু সার্থক সাহিত্যিক এই বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। তাঁর নাটকের প্রস্তাবনায় এবং কাব্যমীমাংসা গ্রন্থমধ্যে কবি তাঁর আপন বংশপরিচয় সামান্য লিপিবদ্ধ করেছেন। দৌদুকি বা দুহিক হলেন রাজশেখরের পিতা এবং মাতা ছিলেন শীলাবতী। তাঁর পৌত্রিক ভিটা ছিল মহারাষ্ট্রে। কবির প্রপিতামহ অকালজল…ছিলেন মহারাষ্ট্র চূড়ামণি। রাজশেখর স্বয়ং কনৌজের দুইজন রাজা যথাক্রমে হেমচন্দ্র পাল ও মহীপালের আচার্যপদে নিযুক্ত থেকেছেন জীবনের অধিকাংশ সময়।

রাজশেখরের পত্নী চৌহানবংশীয়া ক্ষত্রিয়াকন্যা অবস্তী সুন্দরী ছিলেন কবির নিতান্তই যোগ্য সহধর্মিণী। সর্বগুণ সম্পন্না অতিশয় বিদুষী কবিপত্নীর সাহিত্য সমালোচনা দৃষ্ট হয় কাব্য মীমাংসাগ্রন্থে। কবি রাজশেখর তাঁর পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। যে কারণে তাঁর রচনার মধ্যেও নিজ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর ছিলেন। কবি নিজেকে ‘কবিরাজ’ বলে বর্ণনা করে বাল্মীকি, ভবভূতি ও ভত্ত্বমেণ্ঠ-র সাথে এক সারিতে রাখতে চেয়েছেন। এ-হেন আত্মপ্রত্যয় আপাত দৃষ্টিতে শ্রুতি মধুর না মনে হলেও বাস্তবিক অর্থেই তিনি ছিলেন বহু ভাষা ও সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের অধিকারী, প্রজ্ঞাবান ও একজন সাহিত্য সমালোচক। এককথায় সংস্কৃত সাহিত্যের অধঃগামীতায় যখন চারিদিকে কেবল অনুকরণ প্রিয়তার অনুশীলন চলছে; সাহিত্যের সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে রাজশেখর আবির্ভূত হয়ে অসাধারণ প্রতিভার বলে- অবক্ষয়িত সাহিত্যকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। সে যুগের বিচারে সত্যই তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব।

কনৌজের যে দুইজন রাজা অর্থাৎ মহেন্দ্রপাল (৮৯০-৯০৭ খ্রিঃ) এবং তাহার পুত্র মহীপাল (৯১৩-৯৪০ খ্রিঃ) এর রাজসভা অলঙ্কৃত করেছিলেন, সেই সুত্র অনুযায়ী কবিকে নবমশতকের শেষে এবং দশম শতকের প্রারম্ভে স্থাপন করা যায়।

বালরামায়ণ :—নাট্যকার রাজশেখর বাল্মীকি রামায়ণ এর সম্পূর্ণ কাহিনী অবলম্বনে রচনা করেন ‘বালরামায়ণ’। রামচন্দ্রের বাল্যজীবন থেকে শুরু করে রাবণবধ পূর্বক অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করে রাজ্যাভিষেক পর্যন্ত বর্ণিত। দশটি অঙ্কে সম্পূর্ণ রামায়ণের ঘটনা অবলম্বনে নাটকটি অতিদীর্ঘ। ধীরগতি ও বহুঘটনার ভারে ভারাক্রান্ত। এক একটি অঙ্কই যেন এক-একটি নাটকের আকার নিয়েছে। নাটকটিকে সুন্দর করার জন্যে যা কিছু প্রয়োজন ছিল, সেই নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত, ঘটনাপ্রবাহ ও সার্থক দৃশ্যকাব্যের অন্যান্য দিকগুলি বর্জন করে কবি সাহিত্য সৃষ্টিতে মনোযোগ দিয়েছিলেন। ফলে তিনি সফল নাট্যকার হতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। দীর্ঘ বালরামায়ণের টীকাকার হিসাবে লক্ষ্মণ সুরি ও জীবানন্দ বিদ্যাসাগরের নামকরা যায়।

বালভাৱত :—মহাভারতের কাহিনীকে আশ্রয় করে ‘বাল ভারত’ রচনা করেছিলেন। এই নাটকের অপর নাম প্রচণ্ড-পাণ্ডব। কিন্তু দুঃখের বিষয় নাটকটি সম্পূর্ণ প্রাপ্ত হয় না। মাত্র দুটি অঙ্কে অসমাপ্ত যে রচনা, তাতে কেবল মাত্র দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভা থেকে পাণ্ডবগনের বনগমন পর্যন্ত্য, বর্ণিত। নাট্যকার রাজশেখর ‘বালরামায়ণ’ ও ‘বালভারত’ দুটি গ্রন্থ একই উদ্দেশ্য নিয়ে রচনা করেছিলেন এবং উভয়ক্ষেত্রেই মঞ্চে অভিনয়ের উপযুক্ত না করে নাটকগুলিকে যেন মহাকাব্যের লক্ষণ অনুযায়ী রচনা করতেই বেশী মনোযোগী ছিলেন। সে ক্ষেত্রে অতি প্রাঞ্জল ভাষা ও মনের অপরূপ মাধুর্য মিশিয়ে অপূর্ব বর্ণনার ডালি সাজিয়েছেন যা পাঠকচিত্তকে অনায়াসেই মুগ্ধ করে।

কর্পূরমঞ্জরী :—কবিপত্নী অবন্তীসুন্দরীর অনুরোধ ক্রমে কবি সম্পূর্ণ প্রাকৃতভাষায় চার অঙ্কের ‘কর্পূরমঞ্জরী’ নামক নাটক রচনা করেছিলেন। সট্টকজাতীয় দৃশ্যকাব্যটিতে রাজা চন্দ্রপালের সাথে এক রাজকুমারীর প্রণয়-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাবিন্যাসে কবি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে দৃশ্যকাব্যের অন্তিম পর্যায়ে যেন সমস্ত রহস্যের উদ্ঘাটন করে নায়িকা বিজয়ের মধ্যদিয়ে কবি দর্শকগনকে বেশ চমকিত করেছেন। নায়িকার প্রকৃত নাম অনুযায়ী দৃশ্যকাব্যটির নাম হয়েছে ‘কর্পূর মঞ্জরী’। সট্রকের প্রকৃতি অনুযায়ী নাটকে প্রবেশক-বিস্কম্ভক অনুপস্থিত কিন্তু এক বিশেষ ধরণের নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মঞ্চাভিনয় অনেক বেশী আকর্ষনীয় করা হয়েছে। প্রাকৃতভাষার এই কাহিনী অল্পকাল মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল। কবি পত্নীর অনুরোধে নাটকটি প্রথম অভিনীতও হয়েছিল।

বিদ্ধশাল ভঞ্জিকা :—চার অংকে সম্পূর্ণ নাটিকা, ‘বিদ্ধ শালভঞ্জিকা’। শ্রীহর্ষের ‘রত্নাবলী’ ও ‘প্রিয়দর্শিকা’র ন্যায় রাজ অন্তঃপুরের গোপন প্রেমের মোহময়তার আবর্তে রাজশেখর তার এই নাটক রচনা করেছিলেন।

চন্দ্রবর্মনের কন্যা মৃগাঙ্কবলীর শাল ভঞ্জিকা অর্থাৎ খোদিত প্রস্তর মূর্ত্তি বিদ্যাধরমল্ল কর্তৃক প্রদর্শিত হয়। সেই কারণেই নাটকের নামকরণ হয়েছে ‘বিদ্ধশালভঞ্জিকা’। উক্ত নাটকে মন্ত্রী ও বিদষকের চরিত্রদুটি নায়ক নায়িকার মিলনের পথে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। আলোচ্য নাটক দুটিতেও যদিও রাজশেখর নাট্যকার হিসাবে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন অবদান রাখতে সক্ষম হন নি, তথাপি ‘বালরামায়ণ’ ও ‘বালভারত’ অপেক্ষা এই নাটক দুটিকে সার্থক বলা যায়। অতিকথন ও দীর্ঘবর্ণনা রাজশেখরের বিশেষ দুর্বলতা। তথাপি তাঁর রচিত কতিপয় শ্লোক পাঠকহৃদয়কে বিহ্বল করে। নাট্যকার হিসাবে তিনি সার্থকতা লাভকরতে পারনেনি ঠিকই তথাপি সমালোচকগণের দৃষ্টিতে অর্বাচীন কবিগণের মধ্যে রাজশেখর তাঁর ব্যক্তি স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল এক অনন্যসাধারণ প্রতিভা।

আলোচ্য নাটক দুটির টীকা অনেকেই রচনা করেছেন, তন্মধ্যে ধর্মদাস ও অনন্তদাস, ঘনশ্যাম, নারায়ণ দীক্ষিত, করুণাকর, বাসুদেব ও জীবানন্দ বিদ্যাসাগর প্রমুখ অগ্রগন্য।

অনঙ্গহর্ষ

৮ম শতাব্দীর কবি অনঙ্গহর্ষের রচনা ‘তাপসবৎসরাজ’ নামক নাটক। বৎসরাজ উদয়নের অতিপরিচিত কাহিনী অবলম্বনে রচিত এই নাটকে যখন উদয়ন জানালেন যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বাসবদত্তার মৃত্যু হয়েছে তখন বৎসরাজ তপস্বী হয়ে চলে যান। সেই হেতু এইরূপ নামকরণও সার্থক হয়েছে। ধ্বন্যালোক ও ধ্বন্যালোকলোচনে ‘তাপসবৎসরাজ’ এর উল্লেখ দৃষ্ট হয়।

মুরারি

নাট্যকার মুরারি কর্তৃক রামকথা অবলম্বনে রচিত নাটক ‘অনঘরাঘব’। নাট্যকারের পিতা হলেন মৌদগল্য গোত্রীয় বর্ধমাঙ্ক এবং মাতা তনুমতী। আত্মশ্লাঘা প্রকাশে তৎপর কবি নিজেকে বাল্মীকি ও ভবভূতির সমকক্ষ মনে করেন, এমনকি তিনি নিজেকে ‘বাল-বাল্মীকি’ আখ্যা দিয়েছেন। ধনঞ্জয়ের দশরূপকে তাঁর শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। কবি মুরারি রত্নাকরের পূর্বে ছিলেন। রত্নাকর কাশ্মীর রাজ অবম্ভীবর্মার রাজত্বকালে (অর্থাৎ ৮৫৫৮৮৪খ্রিঃ) বিদ্যমান ছিলেন। অতএব অষ্টমশতকের শেষে অথবা নবম শতকের প্রথমেই কবি মুরারি বর্তমান ছিলেন। সপ্তাঙ্ক এই নাটকে মোট ৫৪৩ টি শ্লোক দৃষ্ট হয়। নাটক রচনা করতে গেলে নাট্যকারের যেরূপ দক্ষতার প্রয়োজন হয়, মুরারির মধ্যে সেই সব কৌশল আদপেও ছিল না। সমালোচকগণ বলেন হয়ত কাব্য রচনায় হাত দিলে তিনি সার্থক হতে পারতেন। গ্রন্থের প্রস্তাবনায় তিনি যে আত্মগরিমা প্রকাশ করেছেন তা শুধুই হাস্যপরিহাসে পরিণত হয়েছে মাত্র। মুরারি তাঁর পূর্বসূরীদের অনুকরণ করতে গিয়ে এমন এক কৃত্রিম রচনা উপহার দিয়েছেন যা সংস্কৃত সাহিত্যের অবক্ষয়ের যুগেরই যুগোপযোগী।

মায়ুরাজ

কাচুলিরাজ কবি মায়ুরাজ ‘উদাত্তরাঘব’ নামে নাটক রচনা করেছেন। এই নাটকে রামচন্দ্রের বালিবধের ঘটনাকে গোপন না দেখিয়ে রামচরিত্রকে উদার ও নিষ্কলঙ্ক দেখিয়েছেন। উদাত্ত স্বভাবের রাঘব অর্থে নাটকের নামকরণ ‘উদাত্তরাঘব’ সার্থক।

ক্ষেমীশ্বর

ক্ষেমীশ্বর রচিত পাঁচ অঙ্কের নাটক ‘চণ্ডকৌশিক’। চণ্ডকৌশিক নামক নাটকটি কবি কানৌজের রাজা মহীপাল যিনি ৯১৪খ্রিঃ সিংহাসনে বসেন; তার উদ্দেশ্যে রচনা করেছিলেন অতএব কবি ক্ষেমীশ্বরের কাল দশম শতাব্দীর প্রথমার্ধে বলে অনুমান করা যায়। রাজা হরিশচন্দ্র ও ঋষি বিশ্বমিত্রের বহুল প্রচলিত কাহিনী অবলম্বনে চণ্ডকৌশিক নাটক রচিত হয়েছিল। এতদ্ব্যতীত কবির অপর এক নাটক ‘নৈষধানন্দ’ সাত অংকে রচিত।

দামোদর মিশ্র / মধুসুদন মিশ্র

ভোজরাজের সভাসদ দামোদর মিশ্র মহানাটক বা হুনুমন্নাটক রচনা করেছিলেন। একাদশ শতকের প্রারম্ভে তিনি বর্তমান ছিলেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী পবনপুত্র হনুমান প্রস্তর ফলকে এই নাটক রচনা করলে বাল্মীকি তা দেখে আশঙ্কিত হয়ে পড়েন, এই ভেবে যে এই নাটক প্রচারিত হলে বাল্মীকি রামায়ণ পাঠে সকলের অনীহা হতে পারে সেই কারণে তাঁর নির্দেশে ঐ প্রস্তর ফলকগুলি সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করা হল। ধীবরেরা সেই প্রস্তর ফলক পুনরায় উদ্ধার করলে তা দেখে কবি তাঁর এই মহানাটক লিখলেন। রামায়ণের কাহিনী অবলম্বনে এই বৃহদাকার নাটকটির সংস্করণ ভেদে তিন রকমের পাঠদৃষ্ট হয়। মধুসূদন পাঠে ৯টি অংকে মোট ৭৩০টি শ্লোক। একটিতে ১০টি অংক এবং দামোদর মিশ্রের পাঠে ১৪টি অংকে ৫৮১টি শ্লোক সংখ্যা দেখা যায়। উভয় পাঠের প্রায় ৩০০ শ্লোকে মিল লক্ষ্য করা যায়। সম্ভবতঃ দামোদর মিশ্রের সংস্করণটি প্রাচীনতর। এই সংস্করণে রামায়ণ, হিতোপদেশ বালরামায়ণ ও অনর্থরাঘব থেকে শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। নাটকে জানকী স্বয়ংবর, জানকী বিলাস থেকে শুরু করে রামবিজয় পর্যন্ত্য ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

এই নাটকের বৈশিষ্ট্যহল—নান্দী অতিসংক্ষিপ্ত। প্রস্তাবনা নেই। বিদূষকের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায় না। বিষ্কম্ভকও নেই। ঘটনাপ্রবাহ এত বিশালকায় যে নাটকের গতি মধ্যে মধ্যে অত্যন্ত শ্লথ হয়ে পড়েছে। প্রাকৃত ভাষার ব্যবহারও একেবারেই নেই বললেই চলে। তবে মহানাটকে নাট্যকুশলীকার কে খুঁজে পাওয়া যায় না। নাটকের বৈশিষ্ট্যগুলিকে অগ্রাহ্য করে মহাকাব্যিক লক্ষণগুলিই যেন ফুটে উঠেছে। মঞ্চে অভিনয়ের পক্ষে একান্ত অনুপযুক্ত এই নাটকে পাণ্ডিত্য প্রদর্শিত হয়েছে অনেক বেশী।

কৃষ্ণমিশ্র

সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যের ধারায় নাটক রচনায় বহুধারা লক্ষ্যণীয়। প্রতীক বা রূপক নাটকও দেখতে পাওয়া যায়। সকলের ধারণা ছিল কৃষ্ণ মিশ্র রচিত ‘প্রবোধচন্দ্রদয়’-ই প্রথম রূপক নাটক। কিন্তু ‘শারিপুত্র প্রকরণ’ ও অন্যান্য দুটি খণ্ডিত নাটক আবিষ্কারের সাথে সাথে সে ধারণা ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়। তথাপি প্রতীক বা রূপক নাটকের ক্ষেত্রে ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

চেদীরাজ কীৰ্ত্তিবর্ম্মনের সময়ে (১০৪২-১০৯৮খ্রিঃ) এই নাটক রচিত হয়। বিভিন্ন প্রত্নলেখ থেকেও প্রমাণিত হয় যে ১১ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই নাটক রচিত হয়েছিল। সাত অংকে বিন্যস্ত নাটকে মানবমনের নানান বৃত্তিগুলি অর্থাৎ বিবেক, মোহ, প্রবোধ, বিদ্যা, অহঙ্কার, ধর্ম প্রভৃতি এস্থলে নানান প্রতীক চরিত্র। চরিত্র গুলির মাধ্যমে বেদান্ত দর্শনের তত্ত্ব পরিবেশিত হয়েছে।

মনের দুই পত্নী-প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি। প্রবৃত্তির পুত্র মহামোহ, নিবৃত্তির পুত্র বিবেক, এই দুটি চরিত্র পরস্পর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। নাটকের স্বাভাবিক গতিকে বজায় রেখে অবশেষে বিবেকের সাথে উপনিষদের মিলন ঘটিয়ে বিদ্যা আবির্ভূত হলে পুরুষের মনে প্রবোধের উদয় হল। অতএব ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নামও সার্থকতা লাভ করেছে।

নাট্যকার নাটকীয় চরিত্র সৃষ্টিতে ও নাটক পরিবেশনায় একান্তভাবেই মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বেদান্ত দর্শনের তত্ত্বকে অত্যন্ত কৌশলে প্রতীক চরিত্রের মাধ্যমে পরিবেশন করে নাট্যকার অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন।

এই নাটকের অনুকরণে ‘মোহপরাজ্য’ নামে নাটক রচিত হয়েছে। জৈনকবি যশঃপাল এর রচয়িতা। পরমানন্দ দাস সেন চৈতন্যদেবের নবদ্বীপ ও পুরীর জীবনের মহিমা বর্ণনা করেছেন তার দশাঙ্ক রূপকধর্মী নাটক ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয’ এর মধ্য দিয়ে। কর্ণপুর উপাধিধারী এই কবির নাটক মঞ্চোপযোগী না হলেও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সাহিত্যরূপে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছিল।

জয়দেব

নৈয়ায়িক জয়দেব বিরচিত ‘প্রসন্নরাঘব’ নাটক সপ্ত অংক সমন্বিত। কৌণ্ডিণ্য ব্রাহ্মণ বংশে মহাদেবের ঔরসে ও সুমিত্রার গর্ভে তাঁর জন্ম হয়। ইনি ১২শ শতাব্দীর কবি ছিলেন।

‘প্রসন্নরাঘব’ রচয়িতা জয়দেব কিন্তু গীতগোবিন্দের কবি জয়দেব থেকে পৃথক ব্যক্তি। অতি জনপ্রিয় রামকথা অবলম্বনে নাটক রচনা করে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন। রামের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন পূর্বক এই রচনায় কবি জয়দেব বহু মৌল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ঘটনা বিন্যাস ও নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত ও সংলাপ রচনায় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে যেন কালিদাস, ভবভূতির পদাঙ্কই অনুসরণ করেছেন। নিসর্গ প্রকৃতির চিত্র বর্ণনায়, প্রণয়ের প্রকাশে, যুদ্ধ বিগ্রহের উত্তেজনায়, এমনকি ভাব ও ভাষার পরিপাট্যে, অলঙ্কার বিন্যাসে তিনি প্রথম শ্রেণির কবি বলেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

শক্তিভদ্র

আনুমানিক নবম শতাব্দীর কবি শক্তিভদ্র – রামায়ণ কাহিনী অবলম্বনে সপ্তাঙ্ক নাটক ‘আশ্চর্য চূড়ামণি’ রচনা করেছেন। রাম-লক্ষণ ও সীতার বনবাস থেকে কাহিনী শুরু করে দেবতাগণ কর্তৃক রামকে সীতাগ্রহণের অনুরোধ ও রামকর্তৃক সীতাকে প্রসন্ন মনে গ্রহণ পর্যন্ত্য ঘটনা নাটকে বর্ণিত। ঘটনার মধ্যে আশ্চর্য চূড়ামণির প্রভাবে রাক্ষসদের মায়াশক্তি ব্যর্থ এবং হনুমান কর্তৃক রামের কাছে সীতার সংবাদ ও চূড়ামণি দান দেখানো হয়েছে। সেইকারণে নাটকের নামকরণ হয়েছে ‘আশ্চর্য চূড়ামাণি’।

নাট্যকার হিসাবে ভবভূতির সমকক্ষ না হলেও রামকথা অনুসরণে ‘আশ্চর্যচূড়ামণি’ ও সেযুগে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। বীররসের পাশাপাশি বহু চিত্তাকর্ষক ঘটনার সমাবেশে কৌতহলদ্দীপক এই রচনা যথেষ্ট আকর্ষণীয়। কবির মৌলিকতার সাথে ভবভূতির নাট্য কৌশল ও ভাসের রচনা শৈলীর প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়। সে কারণেই শক্তি ভদ্রের ‘আশ্চর্য-চূড়ামণি’ ভবভূতির উত্তররাম চরিতের ন্যায় সমান সার্থকতার দাবী রাখে।

বামন ভট্টবাণ

চতুর্দশ শতকে ‘বামন ভট্টবাণ’ ‘পাৰ্ব্বর্তী পরিণ্য’ নামক নাটক রচনা করেছিলেন। ‘কাদম্বরী’র রচয়িতা বাণভট্ট ও আলোচ্য বামনভট্টবাণ সম্পূর্ণ পৃথক্‌ দুই ব্যক্তি।

রূপগোস্বামী

পঞ্চদশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব ধর্মের অভ্যুত্থানের সময়ে যে সমস্ত সাহিত্য রাধাকৃষ্ণের প্রেম কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছিল তার মধ্যে রূপগোস্বামী কৃত সাতটি অংকে ‘বিদগ্ধমাধব’ ও দশটি অংকে ‘মালতীমাধব’ নামক দুইখানি নাটক বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বৈষ্ণব সম্প্রদায় বিশিষ্ট ভক্তগণের নিকট অত্যন্ত প্রিয়গ্রন্থরূপে সমাদৃত। অপর একটি ভাণ তৎকর্তৃক রচিত, নাম ‘দানকেলীকৌমদী’।

সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যে এরূপ বহু অর্বাচীন নাট্যকারের নাম করা যায়। তন্মধ্যে কবি নীলকণ্ঠ দীক্ষিতের সপ্তাঙ্ক ‘নলচরিত্র’ নাটক উল্লেখযোগ্য। উদ্দান্ত কৃত ‘মল্লিকা মারুত’ নামক প্রকরণ। বিহুন কবির রচনা ‘কর্ণসুন্দরী’ নামক নাটিকা। এতদ্ব্যতীত রামচরিত অবলম্বনে, মহাভারত অবলম্বনে, কৃষ্ণকাহিনী অবলম্বনে বহুনাটক রচিত হয়েছে, তবে বহু নাটক লুপ্ত, নতুবা পুঁথি আকারেই প্রাপ্ত হয়। খুব অল্পসংখ্যকই পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত রয়েছে।

দৃশ্যকাব্য – পাদটীকা

১. নানাভাবোপসম্পন্নং/নানাবস্থান্তরাত্মকম্।
লোকবৃত্তানুকরণং/নাট্যমেতন্ময়া কৃতম্।। নাট্যশাস্ত্র (GOS) ১।১১২ অবস্থানুকৃতিনাট্যম্/রূপং দৃশ্যতয়োচ্যতে। দ. রূ-১৭

২. যস্মাৎ প্রয়োগং নয়তি/তস্মাদভিনয়ঃ স্মৃতঃ। নাট্যশাস্ত্র। ৮।৭।

৩. ‘কুশীলব’ পদটির নানারূপ ব্যাখ্যা রয়েছে। রামপুত্র ‘কুশ’ ও ‘লব’ এর নামানুসারে ‘কুশীলব’ পদটি উদ্ভূত একথা Keith মনে করেন। আবার অপর একদলের মতে কু (খারাপ) শীল— (আচার-আচরণ) থেকে ‘কুশীলব’, যাঁরা অভিনেতা বা অভিনেত্রী তাঁদের চারিত্রিক অবনতির প্রতি ইঙ্গিত করেই এই মন্তব্য।

৪. প্রথিতযশসাং ভাস সৌমিল্ল কবিপুত্রাদীনাম্—’মালবিকাগ্নিমিত্র।’

৫. নাটকগুলির বিভিন্ন প্রকার বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ সাদৃশ্য প্রসঙ্গে Winternitz যা বলেছেন তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল :— ‘It may be taken for granted that pratijnayougandharayana and Swapnavasava datta have the same author. They not only treat episodes of the same Udayana story, but the one is presupposed by the other-The two Rama dramas show many literal agree- ments, that it cannot be doubted that they are works of the same outhor…In the Dutavakya and in the valacarita the weapons of krishna appear on the stage in a similar manner…certain words or phrases occur in all or several of them…in some small details, as the names of persons of secondery importance, Several of the plays agree with one another…In several of the plays we find a predilection for certain descriptions, such as is generally found in works of one and the same poet”.-some problems of Indian Literature, pp-১১৭-১৯.

৬. Winternitz-এই প্রসঙ্গে বলেছেন—”It is the only tragedy in the whole of sanskrit literature…of all the Indian Dramas, this small piece reminds us of the greek tragedy, and infact in ends tragically with the words the Duryodhana enters in to the heaven. “

৭. Goethe :— “Wouldist thou the young year’s blossoms and the fruits of its decline, And all by which the soul is charmed, enraptured, feasted, fed wouldist thou the Earth and Heaven itfself in one sole name confeine? I name thee, o sakuntala! and all at once is said.”

৮. তুল :— “বররুচিরীশ্বরদত্তঃ শ্যামিলকঃ শূদ্রকশ্চ চত্ত্বারঃ।
এতে ভাণান্ বভণুঃ কা শক্তিঃ কালিদাসস্য।”

৯. Jayaswal, Bhanderkar প্রমুখ মৃচ্ছকটিকের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন উজ্জয়িনীরাজ প্রদ্যোতের ছিল দুই পুত্র। গোপালক ও পালক। কন্যা বাসবদত্তা। গোপালক নিজ ইচ্ছায় রাজ্যত্যাগ করলে পালক রাজ্যাভিষিক্ত হয়। গোপালকের পুত্র আর্যক পরে উদয়নের সাহায্যে পালককে হত্যা করে রাজ সিংহাসন দখল করে।

১০. তুল: The Mrechakatika is in many respects the most human of all the sanskrit plays. There is something strikingly shakespearian in the skilful drwing of characters, the energy and life of the large numer of personages in the play, and in the directness and clearness of the plot itself…The chief value at the Mrechakatika, aside from its interest as a drama, lies in the graphic picture it presents of a very interesting phase of everyday life in ancient India. The elaborate description of the heroine’s Palace in the fourth act gives us a glimps of what was considered luxury in those days. The name ‘clay cart’is taken from an episode in the sixth act, with lead to the finding of heroine’s jewels in the terra cotta cart of the hero’s little son and to their use as circumstantial evidence in a trial.-Willson.

১১. “অহো প্রভবো বাগদেব্যা/যমাতঙ্গদিবাকরঃ।
শ্রীহর্ষস্যাভবৎ সভ্যঃ/সমো বাণময়ূরয়োঃ।।”

১২. “শ্রীহর্ষ ইত্যবনিবর্তিষু পার্থিবেষু/নাম্নৈব কেবলমজায়তে বস্তুতস্ত।
গীহর্ষ এষ নিজ সংসদি যেন রাজ্ঞা/সম্পূজিতঃ কনককেটি শতেনবাণঃ।।”

১৩. কবির্বাক্ পতিরাজ শ্রীভবভূত্যাদিসেবিতঃ।
জিতো যথৌ যশোবর্মা তদ্‌গুণস্তুতি বন্দিতাম্।।—রাজতরঙ্গিনী, ৪.১৪৪

১৪. ভবভূতিজলনিধিগত—কাব্যরসকণা ইব স্ফুরতি। গৌড়বহো ৫।৭৯৯

১৫. আদিশূরের কাল নিয়ে বহু মতভেদ দৃষ্ট হয়—আবুল ফজলের-মতে আদিশুর বল্লালসেনের অধস্তন এয়োবিংশতিতম নরপতি। Weber এর মতে ৬ষ্ঠ খ্রিষ্টাব্দ আদিশূরের কাল। প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ-নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে আদিশূরের কাল ৭৩২–৭৮২ খ্রিস্টাব্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *