অষ্টম অধ্যায় – ঐতিহাসিক কাব্য
সংস্কৃত সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে ইতিহাস রচনার যথাযথ ধারা পরিলক্ষিত হয় না। সাহিত্যের পাশাপাশি ব্যাকরণ-ছন্দ-অলঙ্কার-জ্যোতিষ-অর্থশাস্ত্র ইত্যাদি রচনার প্রতি প্রাচীন ভারতীয় কবিগণের যত বেশী আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে ঠিক ততখানিই অনাগ্রহ বা অনীহা প্রকাশ পেয়েছে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনা প্রসঙ্গে।’ যার ফলস্বরূপ কেবলমাত্র কতকগুলি কিংবদন্তির উপরে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত, এমন কি বিখ্যাত মহাকবিদের জীবন-বৃত্তাত্তও আমাদের সম্পূর্ণ অজানা। একমাত্র বাণভট্টই এর ব্যতিক্রম। সেই হেতু বলা হয়েছে- “His tory is the one weak point in sanskrit literature.”
প্রাচীন ভারতের আদর্শগত যে দিক্টি তার সকল চিন্তায় ও সর্বকর্মে পরিব্যপ্ত হয়ে আছে তা হল ধর্ম ও দর্শন চেতনা। সেই ধর্মীয় বাতাবরণে এমনই এক উদার. দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে যা নাকি প্রাচীন ভারতীযগণের ইহ সর্বস্বতাকে অগ্রাহ্য করতে শিখিয়েছে। ঐহিক ও জাগতিক বিষয়ের প্রতি অনীহাই কোনরূপ বর্তমান ঘটনাকে বা ব্যক্তিবিশেষের মর্যাদাকে লিপিবদ্ধ করে রাখতে উৎসাহ প্রদান করেনি। ঐহিক আদর্শ অপেক্ষা পারত্রিক মঙ্গল কামনায় নিয়োজিত থাকায় ভোগ অপেক্ষা ত্যাগের মহিমাই সেখানে প্রকট হয়ে উঠেছে। সত্যদ্রষ্টা মুনি ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন এবং প্রচার করেছিলেন – ‘ব্রহ্মসত্যং জগন্মিথ্যা।’ তারই ফল স্বরূপ বস্তুনিষ্ঠ ও ব্যক্তিনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার ধারা গড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে। ‘তেন ত্যাক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’ অতএব তাদের প্রচারিত বাণী ভারতবাসীকে চিরকাল পরলোক চিন্তায় উদ্ধুদ্ধ করেছে। ব্যক্তি বিশেষের গৌরবের ইতিহাস কোনদিনই তাঁদের কাছে বড়ছিল না।
সংহিতার যুগ থেকে শুরু হয়েছিল যে ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের ধারা তা প্রায় সুক্ত সাহিত্য অবধি চলেছিল। ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক রচিত এই সাহিত্যের মধ্যে তৎকালীন প্রাকৃতিক অবস্থাকে নিজ বশে আনার একটা প্রবল প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। ফলে সেই সব সাহিত্য মূলতঃ প্রতিকূল অবস্থাকে অনুকূলে বা নিয়ন্ত্রণে আনা এবং সর্বোপরি যজ্ঞের নানাবিধ বিধি নিষেধই লিপিবদ্ধ হত। এককথায় প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে বেঁচে থাকাই ছিল ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের যুগে মুখ্য উদ্দেশ্য। সেরূপ পরিস্থিতিতে নিজ গৌরবের প্রচার কাহিনী লিপিবদ্ধ করার কোনরূপ প্রয়াস সঙ্গত ছিল না। সে যুগের সাহিত্যে ঐতিহাসিক তথ্যের অভাব ছিল নিঃসন্দেহে কিন্তু ইতিহাস ছিল না এরূপ বলা চলে না। সেখানে কোনরূপ ঘটনার বিবরণ শেষে ‘ইতি-হ-আস’, এইরূপ বলা হত অর্থাৎ ‘এইরূপই ছিল।’
প্রাচীন ভারতীয়গণের জাতীয়তাবোধেরও যথেষ্ট অভাব ছিল। এই জাতীয়তাবোধের অভাবের সুযোগ নিয়েই একের পর এক বৈদেশিক হানা ভারতের সুস্থ সংস্কৃতিকে তথা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আমরা জানি যথাযথ জাতীয়তাবোধ না-থাকলে কখনই স্পষ্ট ভাবে জাতির ইতিহাসও গড়ে উঠতে পারে না। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের পটভূমিতে অন্তর্কলহ ও গৃহবিবাদ ছিল জাতির উন্নতির অন্যতম পরিপন্থী। সংস্কৃত সাহিত্যের ঐতিহাসিক কাব্যের অভাবের কারণ স্বরূপ কেবল যে স্রষ্টার অভাব বা অক্ষমতাই ছিল তা নয়, প্রকৃত নির্ভুল তথ্যের অভাবও ঐতিহাসিককাব্য রচনার পক্ষে বাধা স্বরূপ ছিল।
ব্রাহ্মণ্যধর্মের থেকে মুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে জাতির ইতিহাস রচনায় প্রাচীন ভারতীয় গণের প্রবেশ দেখা যায় পুরাণ সাহিত্যে। পুরাণের লক্ষণের মধ্যেই সেই ইঙ্গিত নিহিত রয়েছে। রাজরাজাদের বংশ পরিচয়ের তালিকার পাশাপাশি তৎকালীন সমাজের সকলস্তরের মানুষের একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় এই সমস্ত পুরাণ পাঠে। এই সবই ছিল ভারতীয় ঐতিহাসিকদের নিকট বিশেষ মূল্যবান গ্রন্থ। যথার্থ ইতিহাস বা History বলতে যা বুঝায় অর্থাৎ অতীতদিনের ঘটনার বিবরণ বা পুরাবৃত্ত তা পুরাণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পুরাণ হল দেবকুল ও প্রাচীন মানুষের ঘটনার বিবরণ, যথার্থ ঐতিহাসিক কেবলমাত্র ঘটনার বিবরণই দেন না, ঘটনার কার্য- কারণ সম্পর্ক নির্ণয় ও পৌর্বাপর্য নির্ধারণও করে থাকেন। অতএব পৌরাণিক ঘটনার পাশাপাশি সমাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি ও রাজনীতির আলোচনাও সেখানে স্থান পেয়েছে।
বাল্মীকি ও বেদব্যাস রচিত রামায়ণ, মহাভারত ভারতের সে যুগের বহু ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান দিতে সমর্থ হয়েছে। শুধুমাত্র রাজকাহিনী ও রাজবংশের কথাই নয়। সেই সাথে সে যুগের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, ও সামাজিক অবস্থার কথাও আমরা জানতে পারি। রামায়ণ, মহাভারতকে প্রাচীন হিন্দু-ক্ষত্রিয় জাতির অন্যতম ইতিহাস বলে অনেক সমালোচকই আখ্যা দিয়েছেন। ইতিহাস রক্ষার বিষয়ে বৌদ্ধগণ তৎপর হলেও তাঁদের রচনাসমূহ যেমন মহাবংশ, মহানামন্, প্রভৃতি ও জৈন গণের অবদান- সাহিত্য’ ও ‘পট্টাবলী’ এই সবই ধর্মীয় আদর্শের বাতাবরণে রচিত। ফলে সেখানে ধর্মীয় প্রচারই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্যের যাথার্থতা সন্দেহের মুখোমুখি হয়েছে। নানাবিধ লিপিসাহিত্য, শিলালেখ, তাম্রলেখ, প্রশস্তি, প্রত্নলেখ, মুদ্রারও ঐতিহাসিক মূল্য কম নয়। অশোকের শিলালেখ, সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি, গোয়ালিয়র প্রশস্তি উল্লেখযোগ্য। ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক, ও ধর্মীয় ইতিহাসের অসংখ্য মূল্যবান তথ্য তথা ঐতিহাসিক উপাদানের গুরুত্বও সমধিক।
হর্ষচরিত :–সংস্কৃত কাব্য সাহিত্যের যুগে ইতিহাসের পটভূমিকায় বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থও রচিত হয়েছে। বাণভট্টের হর্ষচরিত এমনই এক ঐতিহাসিককাব্য রচনা। বাণভট্ট তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজা হর্ষবর্ধনের বংশচরিত ও জীবনচরিত রচনা করেছেন। কাব্যের প্রথম আড়াই উচ্ছ্বাসে বাণভট্ট নিজের পরিচয় দিয়েছেন। নিজ বংশাবলীর যে পরিচয় তাঁর হর্ষচরিত ও কাদম্বরীতে পাওয়া যায় তা আমরা গদ্য সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছি। হর্ষবর্ধনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করাই হর্ষচরিতের একমাত্র লক্ষ্য ছিল না। বাণভট্ট তাঁর রচিত কাব্যের মূল চরিত্রে রাজা হর্ষবর্ধনকে উপস্থাপিত করেছিলেন। হর্ষচরিত পাঠ করে সেই সময়ের বহু ঐতিহাসিক সত্য উদ্ঘটিত হয়। যদিও গুপ্ত লেখগুলি ও হিউ-এন-সাঙ্-এর বিবরণ থেকেও সে যুগের ইতিহাস সম্বন্ধে আমরা অবহিত হই। হর্ষচরিত আখ্যায়িকা শ্রেণির গদ্যকাব্য। এর রচনাশৈলী যথেষ্ট আড়ম্বড়পূর্ণ, দীর্ঘসমাসবহুল রচনাটি যমক ও অনুপ্রাসের ভারে খানিক ন্যুব্জ হলেও সরল ও স্বচ্ছন্দ গদ্যভঙ্গী হর্ষচরিতকে পাঠকসমাজে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
গৌড়বহ :—১২০৯টি শ্লোকে মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃতে রচিত বাক্পতিরাজের গৌড়বহ আর একটি অন্যতম ঐতিহাসিক গ্রন্থ। কবি কণৌজের রাজা যশোবর্মনের পৃষ্ঠ পোষকতাও লাভ করেছিলেন। সেই সময়ে যশোবর্মনের সাথে গৌড়েশ্বরের বিরোধ ও সংঘর্ষ বাঁধে, গৌড়েশ্বর পরাজিত হন। যশোবর্মন পরবর্তীকালে কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য কর্তৃক সিংহাসনচ্যূত ও অবশেষে নিহত হন। এই হল কাব্যের প্রতিপাদ্য বিষয়। আশ্চর্য হতে হয় যে যাকে নিয়ে কাহিনী সেই গৌড়েশ্বরের নাম কাব্যে অনুচ্চারিত। খ্রিষ্টীয় ৮ম শতকের প্রথমার্ধে রচিত গৌড়বহ ঐতিহাসিক কাব্য হিসাবে উল্লেখযোগ্য।
নবসাহসাঙ্ক চরিত :—১০০৫ খ্রিস্টাব্দের নবসাহসাঙ্ক চরিত রচিত হয় পদ্মগুপ্তত কর্তৃক। নবসাহসাঙ্ক ছিল ধারা নগরীর পরমার রাজবংশীয় নরপতি মুন্মত্তরের অপর এক নাম। কবি পদ্মগুপ্ত ছিলেন এই নবসাহসাঙ্কের সভাকবি। নবসাহসাঙ্কের জীবনচরিত রচনা করেছেন কবি, কিন্তু কাব্যের মূল আখ্যান ভাগে ইতিহাস অপেক্ষা কবি কল্পিত কাহিনীই বেশী গুরুত্ব পেয়েছে। অর্থাৎ একে ঐতিহাসিক কাব্য না বলে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রচিত কাব্য বলাই শ্রেয়।
কাব্যের উপসংহারে কবি বলেছেন—নবসাহসাঙ্কের অনুরোধ ক্রমেই তিনি এই কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, কবিত্বের অহঙ্কারে নয়। ১৮টি সর্গে সম্পূর্ণ এই কাব্যে নাগরাজকুমারী শশীপ্রভার সাথে সাঙ্কের প্রণয় কাহিনী বিবৃত হয়েছে। মৃগয়া করতে গিয়ে রাজা শশীপ্রভার অতীবপ্রিয় হরিণটিকে তীরবিদ্ধ করলেন, যার গণ্ডদেশে স্বর্ণশৃঙ্খল ছিল। শশীপ্রভা তীরবিদ্ধ হরিণটিকে দেখে যন্ত্রণায় কাতর হলেন এবং তীরের ফলায় রাজার নাম দেখে তার পরিচয় পেলেন। এদিকে রাজা সেই তীরবিদ্ধ হরিণের সন্ধানে এক সরোবরের তীরে এসে উপস্থিত হলেন, সেখানে এক মরালের গলে দোদুল্যমান মুক্তাহার দেখে শশীপ্রভার পরিচয় পেলেন। মুক্তাহারের সন্ধানে এসে রাজার সাথে তার সাক্ষাৎ হল। এইরূপে উভয়ে উভয়ের পরিচয় পেয়ে প্রণয়াসক্ত হলেন।
অতঃপর রাজা শশীপ্রভাকে লাভের নিমিত্ত নাগলোকে গমন করলেন। নাগরাজ্য আক্রমণ ও জয়ের মধ্য দিয়ে শশীপ্রভার পানিগ্রহণ করলেন। কাব্যের মধ্য দিয়ে কবিপ্রতিভার যথেষ্ট স্ফুরণ ঘটেছে।
কুমারপাল চরিত :—জৈন আচার্য হেমচন্দ্ৰ ১০৮৮ খ্রিষ্টাব্দে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকে তিনি এক জৈনভিক্ষুর নিকট লালিত পালিত হন, ফলে জৈনধর্মে দীক্ষিত হন। তার বিদ্যা বুদ্ধি ও পাণ্ডিত্য সর্বজনবিদিত। তিনি সংস্কৃত ও প্রাকৃত ব্যাকরণেও রীতিমত পণ্ডিত ছিলেন। সাহিত্য, ব্যাকরণ, ছন্দ, জ্যোতিষ, দর্শন, অভিধান সকল শাস্ত্রে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁকে সর্বজ্ঞ আজ্ঞায় ভূষিত করা হয়। গুজরাটের আহিবিদের রাজা জয়সিংহ ও তাঁর উত্তরাধিকারী কুমারপালের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কবি হেমচন্দ্র। কবি কর্তৃক কুমারপালের জীবনী বর্ণিত হয়েছে। কুমারপালের রাজ্যাভিষেক, সস্ত্রীক অরণ্যযাত্রা, যুদ্ধ, জলকেলি, শত্ৰু জয় এবং অহিংসার আদর্শ প্রচারক হিসাবেও তিনি আলোচিত হয়েছেন। মোট ২৮টি সর্গ রয়েছে, তন্মধ্যে প্রথম ২০টি সর্গ সংস্কৃতে এবং শেষ ৮টি সর্গ প্রাকৃত ভাষায় রচিত। আলোচ্য কাব্যের প্রথম সাতটি অষ্টাধ্যায়ীর এবং অষ্টমসর্গে প্রাকৃত ব্যাকরণের বিধান ব্যাখ্যা উল্লেখযোগ্য। কবি যেহেতু জৈনধর্মাবলম্বী ছিলেন সেইহেতু জৈনধর্ম প্রচারের ভূমিকাও কাব্যের মধ্য দিয়ে তিনি পালন করেছেন। দুটি ভাষাকে আশ্রয় করে লেখা হয়েছে বলে এটি দ্বাশ্রয় কাব্য নামেও পরিচিত। সর্বোপরি বলা যায় কবি তাঁর কাব্যে ইতিহাসকে যত না বেশী আশ্রয় করেছেন তার থেকে ধর্মীয় আদর্শের অনুপ্রেরণাকেই বেশী আশ্রয় করেছেন। কারও কারও মতে প্রাকৃত—ব্যাকরণের সূত্র সমূহকে বোঝানোই ছিল এই কাব্যের উদ্দেশ্য।
বিক্রমাঙ্কদেব চরিত :—বিক্রমাঙ্কদেব চরিত গ্রন্থের অন্তিম পর্যায়ে কবি আত্মপরিচয় প্রদান করেছেন। সেখান থেকে জানা যায় তিনি গোপাদিত্য নামক জনৈক কাশ্মীররাজার উত্তর সূরী। পিতা জ্যেষ্ঠকলশ ও মাতা নাগাদেবী। কৌশিক গোত্রীয় বংশে খোনমুখ নামক গ্রামে তাঁর জন্ম। কবি স্বয়ং বলেছেন তিনি বেদ বেদান্ত থেকে শুরু করে ব্যাকরণ অলঙ্কার প্রভৃতি শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। কবির পিতা এবং দুই ভ্রাতাও বিশেষ বিদ্বান ছিলেন। একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রচিত এই কাহিনীর কেন্দ্রিয় চরিত্র হলেন চালুক্যরাজ ষষ্ঠ-বিক্রমাদিত্য। সেইহেতু চালুক্য রাজবংশীয় বর্ণনার পাশাপাশি রাজার দিগ্বিজয়, দ্বিতীয় সোমেশ্বরের সিংহাসন চ্যুতি, বিক্রমাদিত্যের সাথে চোলদিগের যুদ্ধ এহেন ঐতিহাসিক ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ কাব্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এ-কথা বলা বাহুল্য বিহুন কেবলমাত্র ঐতিহাসিকই নন তার পাশাপাশি নিজেকে কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতেও তিনি যথেষ্ট সমর্থ হয়েছিলেন। অষ্টাদশ সর্গে রচিত এই ঐতিহাসিক কাব্যে বহু কাল্পনিক চিত্র ও অলৌকিকতার সন্নিবেশ লক্ষ্য করা যায়। পঞ্চম অঙ্কের আহবমল্লের মৃত্যুদৃশ্যের বর্ণনা কাব্যমধ্যে সত্যই উৎকৃষ্ট।
রাজতরঙ্গিণী :—ঐতিহাসিক কাব্যের ভূমিকাতে আলোচিত হয়েছে যে ঐতিহাসিকের কাজ শুধু ইতিহাসের বর্ণনা করাই নয়, সেই সাথে ইতিহাসের পৌর্বাপর্য নির্ণয় করা ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে কার্য কারণ সম্বন্ধ খোঁজাও ঐতিহাসিকের মূল কাজ সেই জায়গায় রাজতরঙ্গিণীর রচয়িতা কল্হনই (কহুন) সার্থক একথা নির্দিধায় বলা যায়। নিরপেক্ষ উদার দৃষ্টি ভঙ্গী, বাস্তব-বিচার বুদ্ধির প্রয়োগ ও সেই সাথে পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধে উঠে কবি তাঁর কাব্যকে সংস্কৃত ঐতিহাসিক শ্রেষ্ঠ কাব্য রূপে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। সেই যুগের যে সমস্ত কবিরা ঐতিহাসিক কাব্য রচনা করেছেন তাঁরা মূলতঃ কোন না কোন রাজার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং সেইহেতু তাঁদের স্তবস্তুতি করে গেছেন কাব্যের মধ্য দিয়ে। তা বহুলাংশে সত্যকে অতিক্রম করে আতিরঞ্জিত ও অতিশয়োক্তি দোষে দুষ্ট হয়ে পড়েছে। নিঃসন্দেহে কহুন ঐতিহাসিকের দায়িত্ব নিঁখুত দক্ষতার সাথে পালন করেছেন।
কহ্লন তাঁর রাজতরঙ্গিণীতে ঐতিহাসিক কাব্য রচনার পথিকৃৎ বিহুনের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন তাঁর মত সত্যদ্রষ্টা, সর্বভাষাবিদ এবং দেশান্তরেও সমান সম্মানিত কবি জগতে বিরল। কহুন কাশ্মীরে এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা চন্পক কাশ্মীরের হর্ষের (১০৮৯-১১০১ খ্রিঃ) অতি বিশ্বস্ত মন্ত্রী ছিলেন। কবি নিজে রাজা জয়সিংহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। ১১৪৮ খ্রিঃ— ১১৫০ খ্রিঃ পর্যন্ত তিনি এই কাব্য রচনা করেছিলেন। কবি শৈব ছিলেন, কিন্তু তাঁর উদার ধর্মনীতি, সর্বশাস্ত্রে পারদর্শিতা, সাহিত্যানুরাগ সর্বোপরি ইতিহাসের গবেষণা তাঁকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের তথা ঐতিহাসিকের মর্যাদা দান করেছিল। তাঁর কঠিন পরিশ্রম আমাদেরকে কেবল কাশ্মীরের রাজবংশের ইতিহাসই নয় সেই সাথে সমকালীন ইতিহাস, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ভূগোল ও সাহিত্যের বিস্তৃত জ্ঞানও বিতরণ করেছে। কবির অন্তর্দৃষ্টি ও ঐতিহাসিকের সদাজাগ্রত বাস্তব চেতনার মেল বন্ধনে রাজতরঙ্গিণী সার্থক ঐতিহাসিক কাব্য।
রামপাল চরিত :—বাঙলার খ্যাতিমান কবি সন্ধ্যাকর নন্দী বিরচিত রামচরিত বা রামপাল চরিত অপর এক উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক কাব্য। প্রজাপতি নন্দীর পুত্র তিনি, জন্ম বরেন্দ্রভূমির পুণ্ড্রবর্ধনের বৃহদটু গ্রামে। সন্ধ্যাকরের পিতা ছিলেন রামপালের প্রথমসারির রাজকর্মচারী। চারটি পরিচ্ছেদে মোট ২২০টি দ্ব্যর্থবোধক শ্লোকে আর্যা ছন্দে রচিত এই কাব্যে রামায়ণের নায়ক রামচন্দ্রের পাশাপাশি পালবংশীয় রাজা রামপাল ও তাঁর বংশাবলীর কীর্তি কলাপ বর্ণিত হয়েছে। যদিও রামপালের কীর্তি বর্ণনাই কবির আসল উদ্দেশ্য ছিল, রামায়ণ কাহিনী এস্থলে গৌণ। তবে পালবংশীয় নানা উত্থানপতনের কাহিনী কাব্যের মধ্য দিয়ে পরিবেশিত হয়েছে। কাবিপ্রশস্তি প্রসঙ্গে তিনি নিজেকে নিপুণ কবি ও মহাপণ্ডিত রূপে দাবী করেছেন। তিনি নিজেকে বাল্মীকির সাথে তুলনা, করে ‘কলি কাল বাল্মীকি’ ও তার কাব্যকে ‘কলিযুগ—রামায়ণ’ বলে দাবী করেছেন।
এতদ্ব্যতীত সোমেশ্বরদত্তের কীর্তিকৌমুদী, শম্ভুর রাজেন্দ্র কর্ণপুর। নয়নচন্দ্র সূরির হাম্মীর কাব্য, কবীন্দ্র পরমানন্দের শিবভারতী, চন্দ্রশেখর কর্তৃক রচিত শর্জনচরিত, রুদ্রকবির রাষ্ট্রৌঢ়বংশকাব্য, অচ্যুতরায়ের অচ্যুতরায়াভ্যুদয, প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ইতিহাসের ধারা সম্পর্কে আমরা জ্ঞানলাভ করতে সমর্থ। ঐতিহাসিক কাব্য কাননে দুজন মহিলা কবি হলেন— রামভদ্রাম্বা ও গঙ্গাদেবী। রঘুনাথের স্ত্রী রামভদ্রাম্বা তাঁর স্বামীর বিজয়কাহিনী অবলম্বনে রঘুনাথাভ্যুদয় নামক কাব্য এবং গঙ্গাদেবী তাঁর স্বামী অচ্যুতরায়ের মাদুরাবিজয় অবলম্বনে মথুরাবিজয় কাব্য রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। স্বচক্ষে দেখা ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত কাব্যদ্বয়ে অতিশয়োক্তি থাকলেও কিছু সত্য ঐতিহাসিক নিদর্শন থাকাও সঙ্গত, যার গুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না।
ঐতিহাসিক কাব্য ব্যতীত কিছু ইতিহাসাশ্রয়ী প্রবন্ধ যেমন বল্লালের— ভোজ প্রবন্ধ; মেরুতুঙ্গের প্রবন্ধ চিন্তামণি, রাজশেখরের প্রবন্ধ কোষ প্রভাকরের প্রভাকর চরিত নামক প্রবন্ধগুলি আমাদের যথার্থ ইতিহাসের ক্ষুধা মেটাতে সক্ষম না হলেও ইতিহাস আশ্রিত রচনার কলেবর বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়েছে।
ঐতিহাসিক কাব্য – পাদটীকা
১. অধ্যাপক Keith দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন- In the whole of the great period of sanskrit litereture there is not one writer who can be seriously regarded as a critical historian.
২. “সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ বংশোমন্বন্তরাণি চ।
বংশানুচরিতংচৈব পুরাণং পঞ্চলক্ষণম্ ॥”
৩. নামান্তরে—পরিমল কালিদাস।
৪. অবদানং রঘুপরিবৃঢ়-গৌড়াধিপ-রামদেবয়োরেতৎ।
কলিযুগ-রামায়ণমিহ কবিরপি কলিকাল-বাল্মীকিঃ।।
রামচরিত (কবি প্রশস্তি) ১১.