দশম অধ্যায় – ব্যাকরণ শাস্ত্র
মুখং ব্যাকরণং স্মৃতম। অর্থাৎ বেদরূপ পুরুষের মুখস্বরূপ হল ব্যাকরণ। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দঃ নিরুক্ত ও জ্যোতিষ এই ছয়টি বেদাঙ্গের (ষড়ঙ্গের) মধ্যে মূল বা অন্যতম হল ব্যাকরণ। ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষাই যদি ব্যাকরণ শাস্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হয় তাহলে বৈদিক যুগে ব্যাকরণের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেলেও তার কোন সুনির্দিষ্ট লিখিত রূপ ছিল না। পরবর্তীকালে ক্রমশঃ ভারতবর্ষ ব্যাকরণ শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করে। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীহ সর্বপ্রথম লিখিত মৌলিক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ। পাণিনির পূর্বে ও পরে আরো অনেক বৈয়াকরণের নাম করা যায় যেমন—যাস্ক, কাশকৃৎস্ন, শাকটায়ণ, গালব, গার্গ্য আপিশিলি, আঙ্গিরস, কাশ্যপ, বশিষ্ঠ, বৈশম্পায়ণ, জয়ন্ত, স্ফোটায়ন প্রভৃতি।’ সর্বোপরি ইন্দ্র ছিলেন বৈয়াকরণ দিগের মধ্যে অগ্রপথিক। তবে তাঁদের রচিত কোন গ্রন্থ-পাওয়া যায় না। এই বিষয়ে বহুমতানৈক্যও দেখা যায়। সেইহেতু পাণিনি ও তৎপ্রবর্তিত বৈয়াকরণ শাখাই সংস্কৃত ভাষার মেরুদণ্ড স্বরূপ। বৈদিক ব্যাকরণের কোন সুনির্দিষ্ট গ্রন্থের অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে এই বৈদিক ভাষার ব্যাকরণ সংক্রান্ত বহু তথ্য পাওয়া যায়। বৈয়াকরণদের মতে এমন কোন জ্ঞান নেই যা শব্দের সীমায় ধরাদেয় না, শব্দ ও অর্থ এই দুই তত্ত্বের সম্পূর্ণ সমন্বয় সাধিত হয় ব্যাকরণ চর্চার মাধ্যমেই।
পাণিনি :–বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত ‘শালাতুরীয’ গ্রামে দাক্ষীব গর্ভে জন্ম নেন মহামতি পাণিনি, সেইহেতু তিনি ‘শালাতুরীয ও দাক্ষীপুত্র’ বলেও পরিচিত ছিলেন। পাণিনির আবির্ভাব কাল বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে। কলহনের রাজতরঙ্গিনীতে পাণিনির উল্লেখ রয়েছে। যেহেতু পাণিনি কখনও বৌদ্ধ ধর্মবিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি সেইহেতু তাঁকে বুদ্ধের আবির্ভাবের পূর্বে স্থাপন করা হয়। Weber ও Maxmullar তাঁকে খৃঃ পূঃ ৩৫০ অব্দের বলে মনে করেন। বহু পণ্ডিতেরই অনুমান তিনি খৃঃ পূঃ ৪০০ অব্দের পূর্বেই বর্তমান ছিলেন। এবং এক কৌৎসের অধ্যাপকও নিযুক্ত ছিলেন। ‘কথাসরিৎসাগর’ অনুযায়ী, সিংহের মুখে পাণিনির মৃত্যু হয়।
পাণিনির পূর্বে বহু বৈয়াকরণের উল্লেখ করা হলেও তাঁদের কোন গ্রন্থ আমাদের হস্তগত নয়। পাণিনিই প্রথম তাঁর অষ্টাধ্যায়ীতে আটটি অধ্যায়ে প্রায় চার হাজার সূত্র লিপিবদ্ধ করেছেন। যার দ্বারা সংস্কৃত ভাষার একটা সুসংবদ্ধ নীতি নির্ধরিত হয়। সূত্রগুলি অতি সংক্ষিপ্ত, অসন্দিগ্ধ, সারবৎ ও বিশ্বতোমুখম্। সেই জন্য বলা হয়—’স্বল্পাক্ষরমাসন্দিগ্ধং সারবৎ-বিশ্বতোমুখম্’। অষ্টাধ্যায়ীর রচয়িতা পাণিনি শুধুমাত্র বৈয়াকরণই নন একজন দার্শনিকও বটে। স্পষ্ট অথচ সংক্ষিপ্ত আকারে ও দ্ব্যর্থহীন ভাবে বক্তব্য বিষয়কে তিনি উপস্থাপিত করতে জানতেন। তবে পাণিনির এই অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ এমনই এক সংক্ষিপ্ত ও জটিল পদ্ধতি যে সম্পূর্ণ পাঠ না করলে তা বিন্দুমাত্র বোধগম্য হয় না। তিনি সমগ্র বৈদিক ভাষাকে ‘ছন্দস্’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং ‘ভাষা” শব্দের দ্বারা বৈদিকোত্তর সমগ্র আর্য ভাষাকে বুঝিয়েছেন। পাণিনি পরবর্তী বৈয়াকরণগন তাদের কাজের মধ্যদিয়ে বিশেষ মৌলিকতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা মূলতঃ পাণিনির সূত্রগুলিরই বাহক ও প্রচারক হিসাবে কাজ করে গেছেন। এই মূল সূত্রগুলির পাশাপাশি ধাতুপাঠ, গণপাঠ, ঊনাদিসূত্রও পাণিনির অন্যতম অবদান। সেই সুদূর অতীতে যার পথ চলা শুরু তার তাৎপর্য ও গুরুত্ব আজও এতটুকু ক্ষুন্ন হয়নি। ভবিষ্যতেও তা অটুট থাকবে। যতদিন পর্যন্ত্য সংস্কৃত ভাষাচর্চা হবে, ততদিন পাণিনির মত বৈয়াকরণ সম্মানিত হবেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
কাত্যায়ন :—পরবর্তীকালে পাণিনির সূত্রগুলিকে অনেকাংশে ত্রুটিমুক্ত করে তাঁকে সম্পূর্ণতা দান করেন কাত্যায়ন—পাণিনি ও কাত্যায়নের মধ্যে সময়ের যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে। অতএব পরবর্তীকালে পাণিনির ব্যাকরণ ও সেই সময়কার সংস্কৃত ভাষা বহুলাংশে সরলীকৃত হয়েছে এরূপ আশা করা যায়। প্রায় ৫০০০ বার্তিকসূত্র রচনাকরেছেন এবং ১২৪৫টি সূত্রবৃত্তিও রচনা করেছেন। এই বার্ত্তিক অংশ মূলতঃ ছন্দোবদ্ধ পদ্যে রচিত হলেও অল্প কিছু অংশ গদ্যেও রচিত। কাত্যায়ন তার পূর্ববর্তী ব্যাখ্যাতৃগণ যেমন শাকটায়ন, শাকল্যের নাম সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছেন।
পতঞ্জলি :—অতঃপর মহাভাষ্য নামক অষ্টাধ্যায়ীর ব্যাখ্যা রচিত হয় মহামুনি পতঞ্জলি কর্তৃক। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি অষ্টাধায়ী ব্যাকরণের ব্যাখ্যা করেছেন, স্থানে স্থানে কাত্যায়নের বার্তিকেরও কড়া সমালোচনা করেছেন। স্থানে স্থানে কাত্যায়ন কৃত বার্ত্তিকের অসাড়তা প্রমাণ করে নতুন করে ভাষ্য রচনা করেছেন। তাঁর রচিত মহাভাষ্য মূলত ব্যাড়ির সংগ্রহ এর উপরে প্রতিষ্ঠিত। তিনি যে কেবল ব্যাকরণেই পারদর্শী ছিলেন তাই নয় তিনি তৎকালীন যুগের বহু কাব্যরচনার সাথেও পরিচিত ছিলেন। সুসংহত বাক্যবিন্যাস ছিল তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য। এক কথায় তাঁর রচনাশৈলী যথেষ্ট উন্নতমানের ছিল একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মহাভাষ্য হল একাধারে ব্যাকরণ এবং ভাষার দর্শন। আনুমানিক ১৫০ অব্দে শৃঙ্গ-বংশীয় রাজা পুষ্যমিত্রের বা গোনদীয় রাজত্বকালে পতঞ্জলি বর্তমান ছিলেন। গোর্নদ বা গোনদীয় প্রদেশে তাঁর জন্মস্থান বলে নির্ধারিত হয়।
পাণিনি-কাত্যায়ন-পতঞ্জলি এই তিন মুনির ব্যাকরণ একত্রে ‘ত্রিমুনি ব্যাকরণম’ বলে পরিচিত।
ভর্তৃহরি :—মৌলিক রচনায় অতঃপর দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ব্যাকরণ শাস্ত্রে বন্ধ্যা ছিল। অবশেষে, সেই বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে ৫ম শতকে ব্যাকরণ শাস্ত্রের জগতে আবির্ভূত হলেন ব্যাকরণদর্শনের অন্যতম ব্যাখ্যাকার ‘ভর্তৃহবি’, ভর্তৃহরির জীবনবৃত্তান্ত সম্বন্ধে বহু মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে ভট্টিকাব্যের রচয়িতা ভট্টিও এই একই ব্যাক্তি। শতকত্রয়ীর রচয়িতা ভর্তৃহরিও এই একই ব্যক্তি বলে অনেকে মনে করেন চৈনিক পরিব্রাজক ইৎ-সিং এর বিবরণে (৬৫১ খৃঃ) যে একজন জনৈক বৈয়াকরণের মৃত্যুর উল্লেখ পাওয়া যায় এই সেই বৈয়াকরণ বলে পণ্ডিতদের সিদ্ধান্ত। ভর্তৃহরি পতঞ্জলির মহাভাষ্যের উপরে মহাভাষ্য দীপ্তি নামে একটি টীকা রচনা করেন। এছাড়া তাঁর রচিত বাক্যপদীয এবং প্রকীর্ণক দুইটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বাক্যপদীয় মূলতঃ তিন কাণ্ডে বিভক্ত যথাক্রমে ব্রহ্ম বা আগম কাণ্ড, বাক্য কাণ্ড ও প্রকীর্ণ কাণ্ড অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী ভর্তৃহরি কেবল একজন বৈয়াকরণই ছিলেন না তিনি অনেক বড় মাপের দার্শনিকও ছিলেন।
জয়াদিত্য ও বামন :—খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বামন ও জয়াদিত্য নামে দুইজন বৌদ্ধ বৈয়াকরণ আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁরা পাণিনির অষ্টাধ্যয়ীর ব্যাখ্যামূলক ‘কাশিকাবৃত্তি’ নামক একখানি অতীব প্রাঞ্জল বৃত্তি রচনা করেন। কাশিকার প্রথম পাঁচটি পরিচ্ছেদ জয়াদিত্যের রচনা এবং শেষ তিনটি পরিচ্ছেদ বামন কর্তৃক রচিত। কাশিকাবৃত্তিতে ভর্তৃহরির বাক্যপদীয়ের নাম উল্লিখিত রয়েছে। ইৎসিং এর বিবরণ অনুযায়ী ৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে জয়াদিত্য পরলোক গমন করেন এবং বামন তৎপরবর্তী কালীন। অতএব কাশিকাবৃত্তি সপ্তম শতাব্দীর মধ্য ভাগে রচিত হওয়াই সম্ভব। রামচন্দ্রের প্রক্রিয়া কৌমুদী প্রকাশের পূর্বে ভারতবর্ষে এই বৃত্তির যথেষ্ট সমাদর ছিল। সপ্তম-শতাব্দীর শেষার্ধে জিনেন্দ্রবুদ্ধি পাদ কাশিকাবৃত্তির উপরে ‘কাশিকা বিবরণ পঞ্জিকা বিন্যাস’ নামক টীকা রচনা করেন। উক্ত জিনেন্দ্রবুদ্ধি পাদও বৌদ্ধ ছিলেন। তাঁর রচিত ন্যাসটীকা অতীব মান্য গ্রন্থ। হরদত্ত মিশ্র কর্তৃক রচিত পদমঞ্জুরী নামে কাশিকার অপর এক মান্য ব্যাখ্যা রয়েছে।
ভট্টোজিদীক্ষিত :—সপ্তদশ শতকে ভট্টোজি দীক্ষিতের আবির্ভাব ব্যাকরণের জগতে এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। ততদিন পর্যন্ত পতঞ্জলীর মহাভাষ্য ইত্যাদিকে নিয়ে নানা টীকা ও আলোচনামূলক গ্রন্থ ব্যাকরণ শাস্ত্রের চর্চাকে বেশ সচল রেখেছিল। ভট্টোজীদীক্ষিতের গুরু ছিলেন অপব্যয়দীক্ষিত। যার নিকট তিনি বেদান্ত শাস্ত্ৰ শিক্ষা করেন। রামচন্দ্র যে উদ্দেশ্যে প্রক্রিয়া কৌমুদী—প্রণয়ন করেছিলেন ভট্টোজী দীক্ষিতও সেই উদ্দেশ্যেই অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষার্থী গণের নিকট সহজ বোধ্য করে তোলার জন্যই অষ্টাধ্যায়ীর সূত্রগুলোকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সাজিয়ে সিদ্ধান্তকৌমুদী রচনা করেন। সেখানে অষ্টাধ্যায়ীর সূত্রগুলি বিষয়ানুক্রমিক বিন্যস্ত হয়েছে। এবং পারস্পরিক সঙ্গতি বজায় রেখে ব্যাখ্যাত। তাঁর এই উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই সিদ্ধান্তকৌমুদী তার পূর্ববর্তী সমস্ত গ্রন্থের গৌরবকে ম্লান করে দিতে সমর্থ হয়েছিল। এই গ্রন্থের উপরে স্বয়ং ভাষ্য রচনা করেন প্রৌঢ়মনোরমা নামে এবং পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীর উপর টীকা রচনা করেন ‘শব্দ কৌস্তুভ’ নামে। অষ্টাদশ শতকে সিদ্ধান্তকৌমুদীর উপরে জ্ঞানেন্দ্র সরস্বতী রচনা করেন তত্ত্ববোধিনী টীকা। এবং বাসুদেব প্রণয়ন করলেন বালমনোরমা নামে টীকা। যা বিদ্বজ্জনের নিকট অতীব প্রসিদ্ধ। কথিত আছে ভট্টোজী দীক্ষিতের সমস্ত পরিবার এবং ছাত্র সম্প্রদায় এই ব্যাকরণ চর্চায় নিযুক্ত ছিল। প্রমাণ স্বরূপ বলা যায় ভট্টোজির পুত্র ভানুজি। এবং তৎপুত্র হরি দীক্ষিত প্রৌঢ় মনোরমার উপরে শব্দরত্নমনোরমা নামক টীকা প্রণয়ন করেন। তাঁর ছাত্র বরদরাজ দীক্ষিত সিদ্ধান্ত কৌমুদীর অনুসরণেই লঘুসিদ্ধান্ত কৌমুদী, মধ্যসিদ্ধান্ত কৌমুদী এবং সারসিদ্ধান্ত কৌমুদী রচনা করেন যা পরবর্তীকালে বহুল পঠিত গ্রন্থ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পণ্ডিত নাগেশ ভট্ট রচিত সিদ্ধান্তকৌমুদীর অপর দুই টীকা শব্দেন্দুশেখর ও বৃহচ্ছব্দেন্দুশেখরও উল্লেখের দাবী রাখে। অষ্টাদশ শতকীয় সিদ্ধান্তকৌতত্ত্ববোধিনী’ টীকা প্রসিদ্ধ। আলোচ্য সিদ্ধান্ত কৌমুদীই পাণিনীয় প্রক্রিয়া গ্রন্থ সমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং গ্রহণযোগ্য। এই গ্রন্থে উনাদিসূত্র, ফিসূত্র ও লিঙ্গানুশাসন থাকায় গ্রন্থটি পূর্ণতা পেয়েছে এবং সার্থকতাও লাভ করেছিল। এবং পাণিনীয় সম্প্রদায়কে অনুসরণ করে ধাতুপাঠ, গণপাঠ, ঊনাদিপাঠ, লিঙ্গানুশাসন, পরিভাষা প্রভৃতি সম্পর্কেও আলোচনামূলক অসংখ্য পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল।
ভর্তৃহরির বাক্যপদীয় রচনার পর থেকে কৈয়ট পর্যন্ত পাণিনীয় ব্যাকরণ সম্প্রদায়ের রচনায় মন্দা চলেছিল বলা যায়। মহাভাষ্যের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ টীকা হল কৈয়টের প্রদীপ এবং নাগেশের উদ্যোত আনুমানিক একাদশ শতকে। কৈয়টের পরবর্তী কালে বৈয়াকরণগণ পাণিনীয় ব্যাকরণকে সহজবোধ্য করে তোলার কাজেই মনোনিবেশ করেছিলেন। রামচন্দ্রের প্রক্রিয়াকৌমুদী এই বিষয়ে অগ্রগণ্য আনুমানিক ১৫শ শতাব্দীর এই টীকা ছাত্রদের প্রয়োজনে অর্থাৎ তাঁদের নিকট সহজবোধ্য করে রচিত হয়েছিল। উদ্যোত টীকার রচয়িতা নাগেশ বা নাগোজিভট্ট, সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ঠ বৈয়াকরণ। তিনি কেবলমাত্র বৈয়াকরণই ছিলেন না। অলঙ্কার ও ধর্মশাস্ত্ৰ সংক্রান্ত বিষয়েও বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ব্যাকরণ বিষয়ে প্রদীপের উদ্যোতটীকা, পরিভাষেন্দুশেখর ও তার শব্দেন্দু শেখর টীকা, ব্যাকরণ সিদ্ধান্ত মঞ্জুষা বিখ্যাত। অতএব যুগান্ত সৃষ্টিকারী মহামতি পাণিনি যে ব্যাকরণ শাস্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন, সেই ব্যাকরণের গৌরবকে ম্লান করতে পারে এমন কোন মৌলিক রচনা পরবর্তীকালে আর দৃষ্ট হয় না। পাণিনি পরবর্তীকালীন কিছু সম্প্রদায়ের ব্যাকরণ স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশ করলেও তা তদনুরূপ জনপ্রিয়তা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। স্থানীয় ভাবে কিছু কিছু রচনা সমাদর লাভ করেছিল। পাণিনীয় ব্যাকরণের সাথে সাদৃশ্য থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্য বা মৌলিকতা প্রকাশ পেয়েছে। এই সমস্ত ব্যাকরণের অধিকাংশই লুপ্তপ্রায়, যে কয়টি এখনও পর্যন্ত টিকে রয়েছে তারও উপস্থিতি ম্লান। এই সমস্ত বৈয়াকরণ সম্প্রদায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :—
(১) চন্দ্রগোমিন্ প্রবর্তিত চান্দ্রসম্প্রদায় (৫ম শতকে) :—
পাণিনি প্রবর্তিত ধারাকেই তিনি সংক্ষিপ্তাকারে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর প্রণীত ব্যাকরণের সূত্র সংখ্যা প্রায় ৩১০০ হলেও তৎকৃত ৩৫টি অবশিষ্ট সূত্রগুলি অষ্টাধ্যায়ী সূত্রেরই পুনর্বিন্যাস মাত্র। এই ব্যাকরণ গ্রন্থের তিব্বতীয় ভাষায় অনুবাদ দৃষ্ট হয়। বৌদ্ধ পণ্ডিত কাশ্যপ আলোচ্য ব্যাকরণের একটি সহজ সরল সংস্কৃত রূপ দেন যা বালকবোধ নামে পরিচিত।
(২) জিনেন্দ্র প্রবর্তিত জিনেন্দ্র সম্প্রদায় (৫ম শতকে) :—
শেষ তীর্থঙ্কর জিন মহাবীরের নামে এই সম্প্রদায়ের নাম জিনেন্দ্ৰ বা জৈনেন্দ্ৰ সম্প্রদায়। এই ব্যাকরণের দুটি পাঠ সংক্ষিপ্ত পাঠ (৩০০০ সূত্র সম্বলিত) এবং বৃহৎ পাঠ (এতে সংক্ষিপ্ত পাঠ ব্যতিরেকে অতিরিক্ত ৭০০ সূত্রের উল্লেখ রয়েছে)। আলোচ্য ব্যাকরণ প্রকৃতপক্ষে পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী এবং বার্তিকের মূল রচনারই অনুসারী। অভয়নন্দী ও সোমদেব এই ব্যাকরণের টীকাকার। অভয়নন্দী (১২০৫ খ্রিঃ) “অভয়ানন্দীবৃত্তি” রচনা করেন যা সংক্ষিপ্ত পাঠের সাথে প্রচলিত এবং সোমদেব (১২৫০ খ্রিঃ) “শব্দার্নচন্দ্রিকা রচনা করেন যা বৃহৎ পাঠের সাথে প্রচলিত ছিল। গ্রন্থদ্বয় পূর্বে জৈন সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুল প্রচলিত গ্রন্থ হিসাবে বিশেষ সমাদৃত ছিল কিন্তু কালে কালে সাম্প্রদায়িকভাবের প্রভাব নষ্ট হওয়ায় বর্তমানে কেবলমাত্র দিগম্বর জৈন সম্প্রদায়ের দুই চারিজন ছাত্র মধ্যেই এই ব্যাকরণ পাঠ সীমাবদ্ধ।
(৩) অভিনব শাকটায়ন প্রণীত অভিনব শাকটায়ন সম্প্রদায় (৯ম শতকে) :—
আলোচ্য শাকটায়ন পাণিনি উল্লিখিত ব্যক্তি নন। সেইহেতু অভিনব শাকটায়ন বলা হয়ে থাকে। নবম শতকের প্রথম দিকে তাঁর রচিত গ্রন্থ শব্দানুশাসন। এই গ্রন্থরচনার ক্ষেত্রে তিনি পতঞ্জলির কাছে বিশেষ ঋণী। চার অধ্যায়ে বিভক্ত এই গ্রন্থের সূত্রসংখ্যা ৩২০০। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রকূট বংশের রাজা অমোঘবর্ষের (৮১৭- ৮৭৭ খ্রিঃ) সভাপণ্ডিত। রাজার পৃষ্ঠ-পোষকতা লাভের সাথে সাথে রাজার নামানুযায়ী- ‘অমোঘবৃত্তি’ রচিত। এই বৃত্তির উপরে “ন্যাস” নামক ব্যাখ্যাও বর্তমান। হেমচন্দ্রের শব্দানুশাসনের প্রণয়নে শাকটায়ন ব্যাকরণের প্রচার ক্ষুন্ন হয়েছিল। দয়াপাল কর্তৃক রচিত “রূপাসিদ্ধি” শাকটায়ন ব্যাকরণের অপর একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ।
(৪) হেমচন্দ্র প্রবর্তিত হেমচন্দ্র সম্প্রদায় (খৃঃ ১১ শতকে) :—
জৈন আচার্য হেমচন্দ্ৰ ছিলেন সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী, পণ্ডিত ও বৈয়াকরণ। তিনি ১৮৮৮ খ্রিঃ বোম্বাই আমেদাবাদ জেলার ধুন্দুক নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর পূর্বনাম চাদিদেব। বহু জৈন সম্প্রদায়ের মঠ তিনি পরিচালনা করেছেন। এবং ৮৪ বৎসর বয়সে তিনি কুমারপালের রাজত্বকালে পরোলোক গমন করেন। কুমার -পালের আদেশে যোগ-শাস্ত্রের গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত ব্যাকরণ সিদ্ধ হেমচন্দ্রাভিধ স্বোপজ্ঞশব্দানুশাসন, নামে প্রচলিত তবে সংক্ষেপে শব্দানুশাসনও বলা হয়ে থাকে। চার অধ্যায়ে বিভক্ত এই গ্রন্থে মোট সূত্রসংখ্যা প্রায়-৪৫০০। উক্তগ্রন্থের উপরে তৎকৃত টীকা ‘বৃহদ্বৃত্তি’ নামে পরিচিত। শব্দানুশাসনের অন্যান্য টীকা টীপ্পনীর মধ্যে দেবেন্দ্র সূরির ‘হৈমলঘুন্যাস’ এবং বিনয়বিজয় গনির হৈমলঘু প্রক্রিয়ার নাম উল্লেখ্য যোগ্য।
(৫) শববর্মা প্রবর্তিত কাতন্ত্র সম্প্রদায় প্রণীত কাতন্ত্র ব্যাকরণ বা কৌমার ব্যাকরণ :—
কুমার কার্ত্তিকেয়ের আনুকূল্যে তিনি প্রজ্ঞাপ্রাপ্ত হওয়ায় এর নাম কাতন্ত্র ব্যাকরণ। কথিত আছে রাজা সাতবাহনের আদেশানুসারে সংস্কৃত ভাষাকে সহজে এবং অল্পসময়ে আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যেই এই কাতন্ত্র্যসূত্র রচিত হয়েছিল। যার অর্থই হল সংক্ষিপ্ত বৃত্তি বা আখ্যান। পাণিনির ব্যাকরণের সাথে বহু অংশে অমিল ছিল। নবম শতকে দূর্গসিংহ কর্তৃক রচিত হয় কাতন্ত্ৰসূত্র বৃত্তি। এই গ্রন্থ বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। বঙ্গদেশে ও কাশ্মীরে এই সম্প্রদায়ের ব্যাকরণের পঠন-পাঠন ছিল। বঙ্গদেশে ১৫শ— ১৬শ শতকে এই গ্রন্থের বহু টীকাকার ছিল, তন্মধ্যে কবিরাজ, কূলচন্দ্র, গোপীনাথ, শ্রীপতি, ত্রিলোচন, প্রভৃতি উল্লেখ্য। বেশীর ভাগই বিলুপ্তির পথে, তবে ত্রিলোচন দাসের কাতন্ত্রবৃত্তি-পঞ্জিকা বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে।
(৬) বোপদেবের মুগ্ধবোধ সম্প্রদায় (খ্রিঃ- ১৩ শতকে) :-
দেবগিরির যাদববংশীয় মহাদেবের রাজত্বকালে (১২৬০-১২৭১ খ্রিঃ) বোপদেব বিদ্যমান ছিলেন। বহুগ্রন্থ প্রণেতা বোপদেবের মুগ্ধবোধ ব্যতিরেকে ‘কবি কল্পদ্রুম’, কামধেনু টীকা, মুক্তাফল ও হরিলীলাবিবরণ উল্লেখ্য। মুগ্ধবোধ ব্যাকরণে বোপদেব সংক্ষিপ্তাকারে সংস্কৃত ভাষার একটি রূপ দিতে প্রয়াস পেয়েছেন যেমন— =সবৰ্ণ, ঘ=দীর্ঘ প্রী=প্রথমা, ব্রি=বৃদ্ধি, ইত্যাদি রূপে। কিন্তু পণ্ডিতগণের মতে বৰ্ণ সংকোচ বা কষ্ট লাঘব করতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে তা দূর্বোধ্যতাকেই বাড়িয়ে তুলেছে এবং সেই সাথে ভাষার মাধুর্যও ক্ষুণ্ন হয়েছে। এবং সংক্ষিপ্ত হওয়ায় বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়ে যায়। এত সমালোচনা হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু বোপদেবের মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ বিশেষ সমাদর পেয়েছিল। সিদ্ধান্তকৌমুদীর মনোরমা টীকায় তার নিদর্শন মেলে। পরবর্তীকালে রামতর্কবাগীশ টীকা রচনা করেছেন। তাঁর টীকা মুগ্ধবোধকে আরও উজ্জ্বল করেছে। এছাড়াও রামানন্দ, কাশীশ্বর ও দেবীদাস প্রমুখ পণ্ডিতেরাও মুগ্ধবোধের টীকা রচনা করেছিলেন বঙ্গদেশে। বিশেষ করে নদীয়ায় এই ব্যাকরণের পঠন-পাঠন বহুল লক্ষিত।
(৭) অনুভূতি স্বরূপাচার্য কর্তৃক সারস্বত সম্প্রদায় (খ্রিঃ -১৪ শতকে):—
তাঁর রচনা সারস্বত প্রক্রিয়া ব্যাকরণ সংক্ষিপ্তকারে (সূত্রসংখ্যা ৭০০) লিখিত ছিল বলে অ আয়াসেই আয়ত্ত করা যেত। এই ব্যাকরণের বহু প্রাদেশিক টীকা বর্তমান তন্মধ্যে পুঞ্জরাজ, অমৃতভারতী, বাসুদেবভট্ট প্রভৃতি রয়েছেন। রামাশ্রম রচিত সিদ্ধান্ত চন্দ্রিকা নামে একটি বৃত্তি রয়েছে সারস্বত সূত্রের উপর ভিত্তি করে। উক্ত রামাশ্রম সিদ্ধান্ত কৌমুদীর ভট্টোজিদীক্ষিতের পুত্র। আবার ভট্টোজিদীক্ষিতের ছাত্র রঘুনাথ রচনা করেছেন সারস্বত ব্যাকরণের লঘুভাষ্য।
(৮) জৌমর সম্প্রদায় (খ্রিঃ ১৩ শতকে) :—
এই সম্প্রদায়ের ব্যাকরণের নাম সংক্ষিপ্তসার, জৌমর সম্প্রদায় জুমুর নন্দীর নামানুসারে হলেও—–এর মূলগ্রন্থের প্রণেতা কিন্তু তিনি নন, এই গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন ক্রমদীশ্বব। ভর্তৃহরির মহাভাষ্য দীপিকার অনুসারী এই গ্রন্থে অধিকাংশ উদাহরণ ভট্টিকাব্য থেকে গৃহীত। উক্ত গ্রন্থে বিষয় সংক্ষেপ উল্লেখ্য, সেই হেতু এইরূপ নামকরণ করা হয়েছে। মোট আটটি অধ্যায়ে বিধৃত। তবে অষ্টম অধ্যায়ে প্রাকৃত ভাষার ব্যাকরণ দৃষ্ট হয়। অনুমান করা হয় এইটি পরে সংযোজিত হয়েছে। জুমুর নন্দী গ্রন্থের বৃত্তি রচনা করেছেন ‘রসবতী’। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের বহু চতুস্পাঠীতে সংক্ষিপ্তসার পড়ান হয়ে থাকে।
(৯) পদ্মানাভের সৌপদ্ম সম্প্রদায় (খ্রিঃ ১৪ শতকে) :—
মৈথিল ব্রাহ্মণ দামোদর দত্তের পুত্র পদ্মনাভ দত্ত সুপদ্মব্যাকরণের প্রণেতা। তিনি মূলতঃ পাণিনির অনুসারীই ছিলেন। ৭টি অধ্যায় সম্বলিত এই গ্রন্থে সংজ্ঞা, সন্ধি, কারক, আখ্যাত, কৃৎ, উনাদি ও তদ্ধিত বর্তমান। গ্রন্থকার স্বয়ং এর বৃত্তি এবং সুপদ্মপঞ্জিকা নামক ব্যাখ্যা রচনা করেন। সুপদ্মমকরন্দ নামক ব্যাখ্যা লিখেছেন পণ্ডিত বিষ্ণুমিশ্র। এছাড়াও বহু টীকা ও পরিভাষা রচিত হয়েছে পরবর্তীকালে। বাংলাদেশের যশোর, খুলনা প্রভৃতি জেলায় এবং পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনার ভাটপাড়া ও বরানগরে আলোচ্য গ্রন্থ চতুষ্পাঠীতে পঠনপাঠন দৃষ্ট হয়।
(১০) গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় (খ্রিঃ – ১৬ শতকে) :—
১৬শ শতকে রূপ-গোস্বামীব হরিনামামৃত সম্পূর্ণ নূতন আঙ্গিকে রচিত ব্যাকরণ গ্রন্থ। গ্রন্থের পারিভাষিক শব্দের ক্ষেত্রে রাধা ও কৃষ্ণের নাম ও তাঁদের বিবিধ কার্যকলাপ স্থান পেয়েছে। অপর গ্রন্থ জীব গোস্বামীকৃত হরিনামামৃত দৃষ্ট হয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুল পঠিত এই ব্যাকরণের প্রভাব অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। শৈব সম্প্রদায়ের বালরাম পঞ্চানন প্রণীত প্রবোধ প্রকাশ এমনই একটি গ্রন্থ। পাশ্চাত্য পণ্ডিত কোলব্রুকের বিবৃতি অনুযায়ী এই জাতীয় অপর একটি গ্রন্থ চৈতন্যামৃত। এই সমস্ত গ্রন্থ ধর্মীয় পটভূমিতে আলোচিত বলে এগুলিকে ধর্মীয় ব্যাকরণ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
পাদটীকা – ব্যাকরণ
১. বোপদেব তার মুগ্ধবোধ ব্যাকরণে আটজন শাব্দিক আচার্য বা বৈয়াকরণের নাম উল্লেখ করেছেন—
“ইন্দ্ৰশ্চন্দ্রঃ কাশকৃৎস্নাপিশালী শাকটায়নঃ।
পাণিন্যমরজৈনেন্দ্রা জয়ন্ত্যষ্টাদি শাব্দিকাঃ।।”
২. “বোপদেব মহাগ্রাহগ্রস্তো বামনদিগ্গজঃ
কীৰ্ত্তিরেব প্রসঙ্গেন মাধবেন বিমোচিতঃ।”