ত্রয়োদশ অধ্যায় – জ্যোতিষ শাস্ত্র ও গণিত শাস্ত্র

ত্রয়োদশ অধ্যায় – জ্যোতিষ শাস্ত্র ও গণিত শাস্ত্র

বেদ রূপ পুরুষের অন্যতম অঙ্গ অর্থাৎ বেদাঙ্গের এক ভাগ হল জ্যোতিষ। বেদে এই জ্যোতিষ পর্বে গ্রহ নক্ষত্রাদি সমস্ত জ্যোতিঃ পদার্থের সম্পর্কে নানারূপ ধারণা এবং তথ্য অনুসন্ধান করা হয়েছে। বেদে জ্যোতিষ বিভাগে সূর্য, চন্দ্র, প্রভৃতি গ্রহের অবস্থান, গতি, উত্তরায়ণ দক্ষিণায়ান বিভাগ, পূর্ণিমা, অমাবস্যা নিরূপণ, সূর্য গ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ, মাস, পক্ষ-দিন তিথি, দিবা-রাত্র বিভাগ, ঋতুর অবস্থান ইত্যাদি বিষয় নির্ণয় আলোচনা করা হয়েছে। জ্যোতির্বিদ্যা বলতে ‘গণিত জ্যোতিষ’ এবং ‘ফলিত জ্যোতিষ’ এই দুই ভাগকে বুঝায়। ‘গণিত জ্যোতিষ’ (Astronomy) শাস্ত্রে গ্রহমূহের আকার, গতিবিধি, পরস্পরের দূরত্ব নির্ণয় ইত্যাদির পাশাপাশি পাটিগণিত বীজগণিত, পরিমিতি প্রভৃতির আলোচনা করা হত। গণিতকে পৃথকভাবে চর্চা না করে জ্যোতিষের প্রসঙ্গেই আলোচনা প্রচলিত ছিল। তবে জ্যামিতিক ধারণা বেদের যজ্ঞ বেদীর নির্মাণ ও পরিমাপ থেকে শুরু হয়েছিল।’ অতএব জ্যোতিষ শাস্ত্র ছিল সম্পূর্ণরূপে গণিতশাস্ত্র সাপেক্ষ। ছান্দোগ্য উপনিষদে জ্যোতিষ ও গণিতের আলোচনা রয়েছে। এক্ষণে ‘ফলিত জ্যোতিষ’ (Astrology) শাস্ত্রে গ্রহ-নক্ষত্রাদির গতি, স্থিতি, ও সঞ্চার অনুযায়ী মানবজীবনে যে প্রভাব পরে ও তার দ্বারা অদৃষ্ট, শুভাশুভ, কার্যফল এমনকি রাষ্ট্রবিপ্লব, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে সেই সমস্ত বিষয়ই আলোচিত হয়েছে।

সুপ্রাচীন কাল থেকেই কাব্য, দর্শন, ধর্ম ইত্যাদির পাশাপাশি জ্যোতিষ ও গণিতের আলোচনাও ভারতবর্ষেই প্রথম শুরু হয়েছিল। প্রাচীনকালে ত্রিকালদর্শী মুনি ঋষিগণ যোগ বলে ও ধ্যানযোগে জ্যোতিষ্কের গতি বিধিও অবগত হয়েছিলেন। মানব জীবনের, শুভাশুভ ইত্যাদি গণিতশাস্ত্রের সাথে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার যোগে তাঁরা নির্ণয় করতে পারতেন। ফলে সেযুগে “জ্যোতিষ শাস্ত্রের” প্রভূত সমাদর ছিল। সর্বপ্রকার বৈদিক ক্রিয়াকর্মও এই জ্যোতিষ শাস্ত্রের উপর নির্ভর করত। এমনকি রাজকার্য প্রণালী থেকে শুরু করে সাধারণ মানব সমাজের কৃষিকার্য, বাণিজ্য, নৌবাণিজ্য, সমুদ্রযাত্রা এই সমস্তই জ্যোতিষ শাস্ত্রের বিষয় ছিল। এছাড়াও সামাজিক ব্রত অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি সবই জ্যোতিষ শাস্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। ফলে মানুষের জীবনকে অনিশ্চয়তার হাত থেকে অনেক নিশ্চিন্ত করেছে একথা বলা যায়।

জ্যোতিষ ও গণিত শাস্ত্রের চর্চা বৈদিক যুগ থেকে শুরু হয়েছিল ঠিকই কিন্তু পরবর্তীকালে এই চর্চা অনেক সুসংহত ও সুপরিকল্পিত হওয়ায় আলোচ্য বিষয়ে বহু মূল্যবান গ্রন্থ বিষয়টিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

বৈদিক যুগে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ নামে একটি গ্রন্থ পাওয়া যায়। এবং ঐ সময়ে আর্থবন জ্যোতিষ নামে অপর এক জ্যোতিষ গ্রন্থের উল্লেখ অথর্ববেদে দৃষ্ঠ হয়। তৎপরবর্তীকালে দীর্ঘ সময়ে কোনরূপ গ্রন্থের নিদর্শন পাওয়া যায় না। কিন্তু পরবর্তীকালের গ্রন্থকারদের গ্রন্থে উক্ত সময়ের আচার্যদের নাম পাওয়া যায়, তারা হলেন যথাক্রমে নারদ, পরাশর, গর্গ প্রমুখ। অতএব ধারণাকরা যায় যে সেই সমস্ত গ্রন্থ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালের গ্রন্থকারিকেরা তাঁদের রচনার কোন কোন অংশও উদ্ধার করেছেন। ৫ম শতকে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার জগতে আর্যভট্ট হলেন স্মরণীয় ব্যক্তি। তিনি দিন-রাত্রির আবর্তনের কারণ স্বরূপ আহ্নিকগতির তত্ত্ব প্রতিপন্ন করেন। কোপারনিকাস সেইরূপ সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠাকরে বিখ্যাত হয়েছেন। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে পরিভ্রমণ করছে একথাও তিনি প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি আর্যভটীয় আর্যাষ্টশতক, ও দশগীতিকাসূত্র রচনাকরেছিলেন। তিনি প্রাচীন পদ্ধতির সংস্কার করে বহুক্ষেত্রে নিজ সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি জ্যামিতি, পরিমিতির বহু পদ্ধতি নির্ণয় করে জ্যোতিষ ও গণিত শাস্ত্রকে অনেকাংশে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁর নাম ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁর টীকাকার গণের মধ্যে প্রথম ভাস্কর, লাটদেব ও লগ্ন বিখ্যাত।

আচার্য বরাহমিহিব ৬ষ্ঠ শতকে বর্তমান ছিলেন। পঞ্চসিদ্ধান্তিকা নামক গ্রন্থে তিনি সমসাময়িক বিবিধ সিদ্ধান্তগুলিকে এক সূত্রে গ্রথিত করেন, সূর্যসিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত প্রভৃতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ পূর্বক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনা করেছেন। তাঁর সিদ্ধান্তগুলি জ্যোতিষশাস্ত্রকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আরো দুইটি গ্রন্থের তিনি রচয়িতা সেগুলি যথাক্রমে—বৃহজ্জাতক ও লঘুজাতক। এই দুই গ্রন্থে ‘ফলিতজ্যোতিষের’ সম্যক আলোচনা দৃষ্ট হয়। লাটদেব পঞ্চসিদ্ধান্তিকার কিছু অংশের উপর টীকা রচনা করে বিখ্যাত হয়েছিলেন।

ষষ্ঠ শতকেই ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে অপর এক আচার্য ব্রহ্মগুপ্তেব নাম পাওয়া যায়। তাঁর রচিত গ্রন্থ ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত। মাত্র ৩০ বৎসর বয়সেই তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই গ্রন্থে জ্যোতিষের পাশাপাশি গণিতের দীর্ঘ আলোচনা চোখে পড়ার মত। সংখ্যা ও গণনা রীতির বহু পদ্ধতি আবিষ্কার, পুরাতন সিদ্ধান্তের সংস্কার, ইত্যাদি দক্ষতার সাথে করেছেন। মৌলিক গবেষণা ও অবিষ্কার তাকে জ্যোতিষ শাস্ত্রে স্মরণীয় করে রেখেছে। ভাস্করাচার্য ব্রহ্মগুপ্ত কে ‘গণকচক্রচূড়ামণি’ নামে অভিহিত করেন। ব্রহ্মগুপ্তের আর একটি গ্রন্থ পাওয়া যায়, নাম খণ্ড খাদ্যক।

আনুমানিক খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতে ভারতীয় গণিত শাস্ত্রে মহাবীর আচার্যের আবির্ভাব ঘটে। গণিতসারসংগ্রহ নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন যা নয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত। গ্রন্থে পাটীগণিত, বীজগণিত ও পরিমিতির আলোচনাদৃষ্ট হয়।

দশম শতকের শেষাংশে পশ্চিমবঙ্গীয় পণ্ডিত শ্রীধরাচার্য ছিলেন দার্শনিক গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ। গণিতসার নামে তাঁর লেখা গণিতের গ্রন্থ প্রায় সর্বজনগ্রাহ্য একটি মূল্যবান গ্রন্থ। শূন্য, স্বাভাবিক সংখ্যা, বর্গফল, ঘনফল, ভগ্নাংশ, ত্রৈরাশিক, পরিমিতি ইত্যাদি বিষয়ের বিশদ বিবরণ রয়েছে।

তৎপরবর্তীকালে দ্বাদশ শতকে মহেশ দৈবজ্ঞের পুত্র ভাস্করাচার্য সিদ্ধান্ত শিরোমণি নামে গ্রন্থ রচনা করেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রের উপরে এবং গণিত শাস্ত্রের আধারে রচিত উক্ত গ্রন্থ তাঁকে মৌলিক গ্রন্থকার হিসাবে চিহ্নিত করেছে। পাশ্চাত্য গণিতের বিখ্যাত পদ্ধতি Calculas তিনিই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। এছাড়াও পৃথিবীর গোলত্ব নির্ণয়, চন্দ্রের দ্রাঘিমা নির্ণয় পদ্ধতি, মাধ্যাকর্ষণশক্তির বর্ণনা, এই সবই তাঁর দীর্ঘ অনুশীলন ও গবেষণার ফসল। আলোচ্য গ্রন্থের উপর স্বরচিত বাসনা টীকা বর্তমান।

ভাস্করাচার্যের বিদূষী কন্যা লীলাবতী ছিলেন গণিত শাস্ত্রের অসামান্য দক্ষ এক নারী। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে তার আবির্ভাব। বিবাহের অল্পকাল পরে পতিবিয়োগ হলে তিনি পিতার গৃহে বিদ্যাচর্চায় মনোনিবেশ করেন। সিদ্ধান্ত শিরমণির একটি খণ্ড সম্ভবতঃ তাঁর রচনা, সেই অনুযায়ী ঐ অধ্যায়ের নাম লীলাবতী। সেই থেকেই বীজগণিত ও পাটীগণিতের সূত্রগুলির নামও লীলাবতী। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী পাটী শব্দের অর্থ ক্রম। গণিতশাস্ত্রের গণ অর্থে সমূহ। গণিত অর্থাৎ সংখ্যা বা অঙ্ক গণনার দ্বারা অর্থাৎ (যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ) দ্বারা ক্রম নির্ধারিত হত বলে তা পাটীগণিত নামকরণ হয়েছে।` গণিতের দুটি প্রধান ধারা একটি সংখ্যা গণিত (পাটিগণিত ও বীজগণিত) অপরটি আকৃতিগণিত (বা জ্যামিতি)।

অতঃপর খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকে কালিদাসের নামে জ্যোতির্বিদ্যাভরণ নামে অপর একটি গ্রন্থ পাওয়া যায়। কিন্তু পণ্ডিতদের মতে উক্তগ্রন্থ অন্য কোন ব্যক্তির রচনা, কালিদাসের নহে। এতদ্ব্যতীত মুঞ্জল রচিত লঘুমানস, মকরন্দের মকরন্দ নামে জ্যাতিষ শাস্ত্র বিখ্যাত ছিল। ভোজরাজের রাজমার্তণ্ড, রাঘবানন্দের সিদ্ধান্ত রহস্য, রঙ্গনাথ রচিত সূর্যসিদ্ধান্ত, শ্রীনিবাস রচিত গণিত চূড়ামণি, নারায়ণ পণ্ডিত রচিত গণিত কোমুদী বিশেষ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

পূর্বে জ্যোতির্বিদ্যা ও ফলিত জ্যোতিষ একই সাথে গণিতের আলোচনাসহ রচিত হত। কিন্তু পরবর্তী কালে মানবজীবনে তথা পৃথিবীর উপর গ্রহণক্ষত্রের অবস্থানের প্রভাব বিষয়ে বহু আলোচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রাচীন আচার্যগণের মধ্যে বিষ্ণুগুপ্ত দেবস্বামী, জীবশর্মা, সত্যাচার্য, পৃথ, শক্তিপূর্ব—যবনাচার্য প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বরাহ মিহিরের পঞ্চসিদ্ধান্তিকায় ফলিতজ্যোতিষের আলোচনা দৃষ্ট হয়। তৎপরবর্তীকালে রাশিগণনা ও কোষ্ঠি বিচার আরম্ভ হয় ও ক্রমে পরিচিতি লাভ করে। ফলিত জ্যোতিষের বহু গ্রন্থ ও গ্রন্থকার থাকলেও বরাহ মিহিরের বৃহৎসংহিতা, বৃহৎ বিবাহ পটল, পল্লববিবাহ পটল, বৃহজ্জাতক ও লঘু জাতক এই পাঁচটি গ্রন্থ পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

পাদটীকা – জ্যোতিষশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্ৰ

১. পাণিনীয় শিক্ষায় জ্যোতিষকে বেদপুরুষের চক্ষুরূপে জ্যোতিষাময়নং কল্পনা করা হয়েছে বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত চতুর্দশবিদ্যা যথা—

“অঙ্গানি বেদাশ্চত্বারো মীমাংসা ন্যায়বিস্তারঃ।
ধর্মশাস্ত্রং পুরাণঞ্চ বিদ্যা হ্যেতাশ্চতুৰ্দশ”।।

২. বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্গত বিবিধ শূল্বসূত্রে গাণিতিক সূত্রগুলি লক্ষ্যণীয়। তন্মধ্যে ৭টি শূল্বসূত্রে ক্ষেত্রফল বিষয়ক সূত্রমালা, বর্গক্ষেত্রকে আয়তক্ষেত্রে এবং ত্রিভূজকে বর্গক্ষেত্রে পরিণত করার পদ্ধতি, সমকোণী ত্রিভূজের অতিভূজ সম্পাৰ্কিত উপপাদ্য ইত্যাদি জ্যামিতিক বিষয়ের আলোচনা দৃষ্ট হয়।

৩. “পাটীনাং সংকলিতব্যবকলিত গুণনভজনাদীনাংক্রমঃ
তেন যুক্তং গণিতং পাটীগণিতম্।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *