অষ্টাদশ অধ্যায় – অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, ও কামশাস্ত্র
সুদূর অতীতে সভ্যতার ঊষালগ্নেই আর্যদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রকাশ ঘটেছিল ঋকবেদের মধ্য দিয়ে। সেই বৈদিক যুগেই সাহিত্য, দর্শন, স্মৃতি শাস্ত্রের পাশাপাশি অর্থশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, ও নীতিশাস্ত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। রাজনীতি, দণ্ডনীতি, অর্থশাস্ত্র সবই ঋকবেদের আলোচ্য বিষয় ছিল। অতঃপর মহাভারতের যুগে এই অর্থশাস্ত্রের বহিঃপ্রকাশ আরও সুস্পষ্ট হয়। মহাভারতের শান্তিপর্বে বিভিন্ন রাজ শাস্ত্র প্রণেতা যেমন বৃহস্পতি, বিশালাক্ষ, মহেন্দ্ৰ, উশনা, সহস্রাক্ষ, প্রচেতসা, ভরদ্বাজ প্রমুখের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। মহাভারতের ভীষ্ম যুধিষ্ঠির প্রভৃতিকে রাজধর্ম সম্বন্ধে উপদেশ দান করেছেন। মহাভারতের সূত্রাধ্যায় থেকে জানা যায় যে আদিকালে রাজা, রাজ্য, দণ্ড প্রভৃতি ছিল না। তখন প্রজারাই প্রজাদিগের অর্থাৎ পরস্পর পরস্পরের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। কিন্তু ক্রমে প্রজাদের মধ্যে অসততা বৃদ্ধি পেলে তারা লোভাতুর হয়ে নানা কু-কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং সমাজে অন্যায়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ক্রমে মাৎসান্যায় বা অরাজকতা দেখা দেয়। সেইরূপ পরিস্থিতিতে প্রজাপতি ব্রহ্মা বেতাদের প্রার্থনা অনুযায়ী প্রজাদের উদ্দেশ্যে একলক্ষ শ্লোক সম্বলিত ‘পৈতামহত’ নামে এক গ্রন্থ রচনা করেন। এই সুবিশাল গ্রন্থ পঠন-পাঠনে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় ক্রমশঃ সংক্ষেপ হয়ে বৃহস্পতি রচনা করেন ‘বার্হস্পত্যত’ যা ছিল তিনহাজার অধ্যায়ে। পরবর্তী কালে শুক্রাচার্য বা উশনা এক হাজার অধ্যায়ে রচনা করলেন ‘ঔশনসতন্ত্র’। এই ঔশনসতন্ত্রই ছিল মহামান্য কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মূল ভিত্তি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র হল মূল শাস্ত্রগুলিরই সুচিন্তিত মতামত বা সারসংক্ষেপ বলা যায়। মহাভারতের শান্তিপর্বে যে সমস্ত অর্থশাস্ত্র প্রণেতাদের নাম দৃষ্ট হয়, দুঃখের বিষয় সেই সমস্ত গ্রন্থ অধুনা লুপ্ত। চারটি সম্প্রদায়ের নাম উল্লিখিত হয় যেমন—বার্হস্পত্য, মানব, ঔশনস, ও পরাশর। প্রাচীন অর্থশাস্ত্রকার হিসাবে ভরদ্বাজ, বিশালাক্ষ, পরাশর, পিশুন, কৌণপদন্ত-র নাম উল্লেখ থাকলেও নারদ, কৌটিল্য, সোমদেব, কামন্দকের অর্থশাস্ত্র বা দণ্ডনীতিই পরবর্তীকালে দৃষ্ট হয়। তন্মধ্যে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রকেই প্রাচীন এবং সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য মনে করা হয়। কৌটিল্য প্রাচীন অর্থশাস্ত্রকারগণের মতামত উল্লেখপূর্বক খণ্ডন করেছেন এবং স্বমত প্রতিষ্ঠা করেছেন। যদিও প্রাচীন অর্থনীতি বিদদের গ্রন্থ পরবর্তী কালে বিলুপ্ত হওয়ায় কিছুই পাওয়া যায় না। অর্থশাস্ত্র বা দণ্ডনীতি বলা হয়েছে, অর্থাৎ এর দ্বারা বর্তমান কালের অর্থনীতিকে বুঝলে হবে না, বরঞ্চ রাষ্ট্রনীতি বলা যেতে পারে। মনুসংহিতার ৭ম অধ্যায়ে রাজার কর্তব্য এবং সেই সাথে দণ্ডনীতি খুব সুন্দর ভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহাভারতেও এমন আলোচনা বিরল নয়। বাণভট্টের কাদম্বরীতে নারদের অর্থশাস্ত্রের নাম উল্লেখ রয়েছে। ভাসের প্রতিমা নাটকে বার্হস্পত্যের অর্থশাস্ত্রের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
কৌটিল্যীয় অর্থশাস্ত্র :—কৌটিল্যকে বহু নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তক্ষশীলার ব্রাহ্মণ বংশে তাঁর জন্ম। পিতা চণক, সেইহেতু তাঁকে চাণক্য বলা হত। তিনি বিষ্ণুগুপ্ত নামে পরিচিত ছিলেন। গ্রন্থশেষে, কবি পরিচয়ে বিষ্ণুগুপ্ত নাম পাওয়া যায়। আবার তিনি ছিলেন চন্দ্রগুপ্তমৌর্যের প্রধানমন্ত্রী চাণক্য। অসম্ভব কূটবুদ্ধির অধিকারী হেতু তিনি কৌটিল্য। আবার মহামহোপাধ্যায় গণপতি শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর ‘শ্রীমূলা’ নামক টীকায় বলেছেন যে-লেখক ‘কুটিল’ গোত্রজাত বলেই তাঁর নাম কৌটিল্য। অতএব এইরূপ সিদ্ধান্ত করা যায় যে কৌটিল্য, চাণক্য ও বিষ্ণুগুপ্ত একই ব্যক্তি। এবং কৌটিল্যের অবির্ভাব কাল নিয়েও বহু মতভেদ রয়েছে। বিশেষতঃ ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ তাঁকে খ্রিঃ পূঃ চতুর্থ শতকে স্থাপন করাই যুক্তিযুক্ত মনে করেন, কামন্দকি তাঁর নীতিসার গ্রন্থে চাণক্যকে গুরুরূপে উল্লেখ করেছেন।
চাণক্য অর্থশাস্ত্রকে এক ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করেছেন। দণ্ডনীতি বা রাজনীতি বিষয়ের আলোচনাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে সত্য, কিন্তু সমাজনীতি, অর্থনীতি বাস্তুবিদ্যা, ব্যবহারিক ব্যবস্থা, আয়ুর্বেদ, ইতিহাস, ভূগোল আম্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা, দণ্ডনীতি এইভাবে এক সর্ববিস্তার সমন্বয় ঘটেছে বলা যায়। এ যেন গ্রন্থ নয় গ্রন্থাগার। প্রাচীনকালের মুনি ঋষি গণ কেবলমাত্র ধর্মাচরণ, যাগযজ্ঞ ও মোক্ষপ্রাপ্তির হেতু বৈদিক ক্রিয়াকর্মেরই অনুসারী ছিলেন না, তাঁরা সমাজ তথা রাষ্ট্র কিভাবে সঠিক ভাবে পরিচালিত হবে সেইদিকেও যথেষ্ট সজাগ দৃষ্টি দিতেন। ধর্ম, অর্থ, ও কাম এই ত্রিবর্গ সাধনের কথা বলা হয়েছে। তন্মধ্যে অর্থই প্রধান কারণ ধর্ম ও কাম মূলতঃ অর্থের দ্বারাই পরিচালিত হয়ে থাকে। অর্থ অর্থে কৌটিল্য সম্পদকেই শুধু বোঝাননি তাঁর মতে সমস্ত পৃথিবী বা ভূমাই যদি হয় অর্থ, তবে তার রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে যে শস্ত্র বা নীতি তাই হল অর্থনীতি বা অর্থশাস্ত্র। মানুষ যাতে পৃথিবীতে স্বসম্মানে ও নিরাপদে বসবাস করতে পারে তার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা যে গ্রন্থে বর্ণিত আছে তাই হল অর্থশাস্ত্র।
মনুষ্যাণাং বৃত্তিরর্থঃ, মনুষ্যবর্তী ভূমিরিত্যর্থঃ।
তস্যা পৃথিব্যাঃ লাভ পালনোপায়ঃ শাস্ত্রমর্থশাস্ত্র মিতি।” (অর্থশাস্ত্র-১৫।১।১।) কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেছেন-
প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং চ হিতে হিতম্।
নাত্মপ্রিয়ং হিতং রাজ্ঞঃ প্রজানাং তু প্রিয়ং হিতম্।।
প্রজার সুখই রাজার সুখ, প্রজার হিতেই রাজার হিত, অতএব প্রজার হিতসাধনই রাজার প্রধান কর্তব্য। অতএব প্রজাগণকে সুখে রাখতে গেলে রাজার বহুবিধ কর্তব্য পালনীয়, সেই সমস্তই কৌটিল্য বর্ণনা করেছেন। অর্থশাস্ত্রের মূল ভিত্তি হল ‘ত’ এবং ‘আবাপ’, ‘তন্ত্র’ বলতে বুঝায় রাজা প্রজাদের যোগক্ষেমের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাজ্য পরিচালনা করবেন। যোগক্ষেম অর্থে দণ্ডনীতির দ্বারা অলব্ধ বস্তুর লাভ। লব্ধবস্তু রক্ষণ, রক্ষিত বস্তুর সুরক্ষা ও উন্নতিবিধান করা। এবং ‘আবাপ’ বলতে বুঝায়— অন্য দেশের রাজার প্রতি বা শত্রুর প্রতি ষাড় গুণ্যের যথাযথ প্রয়োগ বশতঃ যে কূটনীতি। ষাড়গুণ বলতে—যান, আসন, দ্বৈধীভাব, সংশ্রয়, সন্ধি ও বিগ্রহ।
কৌটিল্য বর্ণংসংকরকে ঘৃণা করেছেন। তাঁর মতে স্বধর্মের ও স্ববর্ণের যথাযথ পালনের মধ্য দিয়েই পার্থিব সুখ কেন, মোক্ষ পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব। বিপরীতে সবই বিনষ্ট হয়, উৎসন্নে যায়। তিনি মনে করতেন গুপ্তচর নিয়োগ করে সকল প্রজার সম্বন্ধে খবর সংগ্রহ করে তাদেরকে যোগক্ষেম, স্বধর্ম ও সবর্ণের রক্ষণ বিষয়ে সজাগ করতে হবে। বিশালকায় রাজ্যের এ-হেন গুরুভার বহন করা রাজার একার পক্ষে সম্ভব নয়, সেইহেতু মন্ত্রী, অমাত্য, মহামাত্য, কর্মচারী, হিসাবরক্ষক, কোষাধ্যক্ষ ইত্যাদি নিয়োগ করা কর্তব্য, তবে অবশ্যই রাজা নিজ দায়িত্বে বিচার বিবেচনা পূর্বক তাদের কাজে নিযুক্ত করবেন, প্রয়োজন হলে বরখাস্ত করবেন। সে যুগেও রাজকার্যের সুষ্ঠু পরিচালনার নিমিত্ত বিভিন্ন মন্ত্রকের ব্যবস্থা ছিল এবং সেই সমস্ত দপ্তরের ভার প্রাপ্ত মন্ত্রীকে রাজা প্রয়োজনবোধে বদলিও করতে পারতেন। কৌটিল্য এই প্রসঙ্গে গোপন মন্ত্রণালয়, গুপ্তচর এবং দূতের কর্তব্যও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
তাঁর মতে রাজকর্মচারীগণ নিজের জ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে অল্পমাত্রায় হলেও রাজার অর্থ আত্মস্যাৎ করবে।
কৌটিল্যের মতে জিহ্বাতলে স্থিত মধু অথবা বিষ মানুষের অনিচ্ছাবশতঃ যেমন আস্বাদিত হয়, ঠিক তদনুরূপ অর্থসংক্রান্ত কর্মে লিপ্ত থেকে তা কেহ আত্মস্যাৎ করবে না এরূপ বলা যায় না। মৎসগণ জলে থাকাকালীন কখন জলপান করবে যেমন বোঝা যায় না। ঠিক সেইভাবে রাজকর্মচারী কীভাবে রাজারধন আত্মস্যাৎ করবে তা রাজার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। সেই হেতু একই কর্মচারী বেশীদিন বহাল রাখা যাবে না। রাজকোষে অর্থাভাব দেখা দিলে বছরে একবারমাত্র প্রণয়কর সংগ্রহ করতে পারবেন। এবং বলপূর্বক কর আদায় কেবলমাত্র দুষ্ট, অধার্মিক প্রজাদের ক্ষেত্রেই সম্ভব হবে। স্ত্রী ধন সম্পর্কিত আইন ছিল, নিঃসন্তান পত্নী যদি স্বামী অনুগামিনী হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী জীবিত থাকলে স্ত্রীধন পুত্রকন্যারা ভোগ করত। পুরুষ সন্তানলাভের জন্য একাধিক বিবাহ করতে পারতেন, অপরপক্ষে স্বামী যদি নপুংসক বা ক্লীব হন, অথবা দীর্ঘ প্রবাসে যান, রাজদ্রোহী, হত্যাকারী ইত্যাদি হলেও স্ত্রী পুনরায় বিবাহ করতে পারতেন। বিবাহের বিষয়েও বহু আইন কানুন বহাল ছিল। সমাজে প্রচলিত আট প্রকার বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম, প্রাজাপত্য, দৈব ও আর্য এই চারপ্রকার বিবাহে বিচ্ছেদের রীতি ছিল না, কিন্তু গান্ধর্ব, আসুর রাক্ষস ও পৈশাচ এই চার প্রকারে স্বামী স্ত্রী পরস্পরের প্রতি বিরূপ বা বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হলে বিচ্ছেদ সম্ভব ছিল। বিধবা বিবাহ হলে সেই বিধবার পূর্ব পতির সম্পত্তিতে অধিকার ছিল না। পুরুষের ক্ষেত্রে বহু বিবাহ তখনি প্রযোজ্য হত যদি পূর্বের স্ত্রী নিঃসন্তান হতেন, অন্যথায় বহুবিবাহে পুরুষ দিগের বহু দণ্ডের বিধান থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই সেই সময়ে মধ্যবিত্ত সমাজে বহু বিবাহ বিশেষ প্রচলিত ছিল না।
রাজ্যে সকলের জন্য সুস্বাস্থ্য দাবী করে কৌটিল্য রাজাকে কিছু সৎ পরামর্শ দিয়েছেন। রোগীর চিকিৎসায় অবহেলা হলে বা রোগীর মৃত্যু হলে চিকিৎসককে দণ্ড দেওয়ারও নির্দেশ ছিল। প্রজা কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে প্রতিটি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ বর্ণিত হয়েছে। সে যুগেই কৌটিল্য ক্রেতা সুরক্ষা আইনের কথা বলেছেন। ওজনে যাতে কারচুপি না হয় সেহেতু বাটখারা তৈরীর প্রতি নজর দেওয়া হত, সঠিক জিনিষটি ক্রেতারা যাতে সঠিক দামে ক্রয় করতে সক্ষম হয় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হত।
কৌটিল্য সম্বন্ধে আলোচনার অবসরে এ কথা অবশ্য স্বীকার্য যে তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত থেকে শুরু করে ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, নীতি শাস্ত্র, দণ্ডনীতি ইত্যাদি—সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী একজন আদর্শ পুরুষ। আমাদের মানব জীবনে তাঁর অসামান্য অবদান সকল যুগেই স্বীকার্য। দণ্ড নীতি শাস্ত্রের প্রামাণ্য এবং বিজ্ঞানসম্মত গ্রন্থ হিসাবে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত। মৌর্য-সম্রাটের মন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর রাজকার্যের অমূল্যজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ফসল এবং প্রাচীন অর্থশাস্ত্রকার গণের জ্ঞানের সারসংক্ষেপই হল এই অর্থশাস্ত্র। অতএব এর ব্যবহারিক মূল্য কালে কালে আমাদের সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় জীবনকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।
কামন্দক নীতিসার :–খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের বেশ কিছু পূর্বে কামন্দক তাঁর নীতিসাব নামক অর্থশাস্ত্র প্রণয়ন করেন। রাজনৈতিক এবং দণ্ডনীতি সম্বন্ধীয় এই গ্রন্থে তিনি কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্র থেকে সারগ্রহণ করে কাব্যের লক্ষণ যুক্ত করে শ্লোকাকারে বর্ণনা করেছেন। বস্তুতঃ মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, কৌটিল্য এঁদের পরেই কামন্দকের উল্লেখ করা যায়। পূর্ববর্তী অর্থনীতি শাস্ত্রকার গণের অস্তিত্ব নিশ্চয়ই ছিল। তাঁদেরকে পরবর্তীকালের শাস্ত্রকারেরা অনুসরণও করেছেন কিন্তু তাঁদের কোন গ্রন্থ বর্তমানে উপলব্ধ না হওয়ায় এক্ষণে তাঁরা নামে পর্যবসিত হয়েছেন। আচার্য দণ্ডীর দশকুমার চরিতে, বামনের কাব্যালঙ্কার গ্রন্থে এই কামন্দকীয় নীতিসারের উল্লেখ দৃষ্ট হয়।
সোমদেব নীতিবাক্যামৃত :—যশস্তিতিলক চপ্ খ্যাত-সোমদেব এই নীতিগ্রন্থের রচয়িতা। কৌটিল্যকে অনুসরণ করে বা অবলম্বন করেই মূলতঃ এইরূপ দণ্ডনীতি মূলক নীতি শাস্ত্রের উদ্ভব। নীতিমূলক শিক্ষা এই গ্রন্থে যথেষ্ট পরিমাণে পরিবেশিত হলেও রাজনীতি বা দণ্ডনীতির আলোচনাও দৃষ্ট হয়।
পরবর্তীকালে এই পথ অনুসরণ করেই হেমচন্দ্র রচনা করেন ‘অর্থনীতি’। প্ৰাকৃত ভাষায় ছন্দে রচিত আলোচ্য গ্রন্থে অর্থশাস্ত্র বিষয়ে নীতিমূলক উপদেশাবলী বর্ণিত হয়েছে।
ভোজরাজের রচনা ‘যুক্তিকল্পতরু।” চন্ডেশ্বরের ‘নীতিরত্নাকর’। পরবর্তীকালে ‘শুক্রনীতি সার’ বলে অপর এক গ্রন্থ পাওয়া যায়। কিন্তু উক্ত গ্রন্থের লেখক অজ্ঞাত। কারণ শুক্রাচার্য্য সম্ভবতঃ এই গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন না।
কামশাস্ত্ৰ
সৃষ্টির উষালগ্নে বৈদিক যুগেই ঋকবেদে যমযমীর অর্থাৎ পরস্পর দুই যমজ ভ্রাতা ও ভগিনীর কামোন্মাদনা, পুরুরবা উর্বশীর উপাখ্যান দৃষ্ট হয়। কথিত আছে দেবতারাও কামাসক্ত হয়ে বিভিন্নরূপ অনাচারে লিপ্ত হতেন। ব্রহ্মা তাঁর কন্যা সন্ধ্যার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। জাহ্নবী জহ্নুর প্রতি আসক্ত ছিলেন। এছাড়া রম্ভা, উর্বশী প্রভৃতি বারাঙ্গনাদের কাহিনী সর্বজনবিদিত। অতএব সেই প্রাচীন যুগ থেকেই এই অপ্রতিরোধ্য কামসম্ভোগের তাড়না মানুষকে বহু অনাচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করেছে। এর ভয়াবহ পরিণামের কথা চিন্তা করেই সমাজকে কলুষমুক্ত ও সুশৃঙ্খলিত করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় আচার্যগণ কামশাস্ত্র প্রণয়নের কথা অনুভব করেছিলেন। ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্রের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা দেখিছি সেই সমস্ত শাস্ত্রের প্রয়োগ কিভাবে মানবজীবনের তথা সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের ধারাকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। ঠিক সেইভাবেই মানুষ যাতে কামতাড়িত হয়ে বিপথগামী না হয়, সেই হেতু কামশাস্ত্ৰ কারগণ সংসারী মানুষের উদ্দেশ্যে কাম-কলার বিবিধ উপায় সম্বলিত গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। কাব্যে যেহেতু কাম সম্ভোগের বহুল বর্ণনাদৃষ্ট হয়, সেইহেতু আলঙ্কারিক আচার্যবামন কবিদের কামশাস্ত্র অধ্যয়ন করার কথা বলেছেন। সেই কারণেও ভারতবর্ষে কামশাস্ত্র প্রণয়নের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
ভারতীয় চিন্তা ও চেতনায় চিরকালই মোক্ষ লাভের বিষয়টি ধরা দিয়েছে। বিভিন্ন দর্শনের আলোচনায় আমরা দেখেছি, তাদের একটাই লক্ষ্য তা হল মোক্ষ বা মুক্তি লাভ। সমাজ জীবনে ছিল চতুরাশ্রমের ধারণা, সেখানে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাসের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত হত। সেই জীবন চর্যায় ধর্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গের সাধনই ছিল মূল বিষয়, বলা হয়েছে ‘ধর্মার্থকামমোক্ষ’ অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ ও কামের সাধনার ফলস্বরূপ মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটবে। এই ত্রিবর্গের মধ্যে ধর্ম প্রধান, তারপর অর্থের স্থান এবং সবার শেষে কামের অবস্থান। যৌবনে বা সংসার ধর্মে প্রবেশ করে তবেই সঠিক ধারণা নিয়ে কাম সেবা করার কথা বলা হয়েছে। বার্ধক্যে ধর্মকর্ম করা শ্রেয়। বর্তমান জীবনকে সুখ ও সমৃদ্ধি দিতে ত্রিবর্গের সেবা করারই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেবল বাল্যাবস্থায় কামের কোন ভূমিকা থাকা উচিৎ নয়। ধর্ম, অর্থ ও কাম এই তিন বিষয়ের সেবা করতে হবে সমান ভাবে। যে সংসারী ব্যক্তি কেবল একটিতে আসক্ত, সে জঘন্য ব্যক্তি।[১]
প্রাচীন ও প্রধান কামশাস্ত্র বলতে বাৎস্যায়নের কামসূত্রই উল্লেখ্য। তাঁর রচনায় পূর্বাচার্যদের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি অবশ্যম্ভাবী রূপে বাভ্রব্য, নন্দীশ্বর, শ্বেতকেতু, কুচুমার, প্রমুখের নিকট ঋণী। কামসূত্রের বীজ নিহিত রয়েছে প্রজাপতি ব্রহ্মার প্রজাসৃষ্টির শেষে তাদের রক্ষণাবেক্ষনের নিমিত্ত রচিত একলক্ষ অধ্যায় সম্বলিত ত্রিবর্গের (ধর্ম, অর্থ, কাম) উপদেশাবলীতে। ধর্মসংক্রান্ত শাস্ত্র রচনা করলেন মহামতি মনু। বৃহস্পতি অর্থশাস্ত্রের প্রণেতা এবং মহাদেবের অনুচর নন্দী (মতান্তরে পৃথকব্যক্তি ) সহস্র অধ্যায়ে কামশাস্ত্র রচনা করেন। ঋষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু সেই কামশাস্ত্রকে সংক্ষিপ্তাকারে ৫০০ অধ্যায়ে রচনা করেন। অতঃপর পাঞ্চলদেশীয় বাভ্রব্য মাত্র ১৫০ অধ্যায় ৭টি খণ্ডে কামশাস্ত্রের নূতন রূপ দেন। সম্ভবতঃ বাৎস্যায়ন উক্ত গ্রন্থ অধ্যায়ন করে কামসূত্র রচনায় প্রবৃত্ত হন। বাভ্রব্য ও বাৎস্যায়নের মধ্যবর্তী কোন কামশাস্ত্র রচয়িতার উল্লেখ না থাকলেও দত্তক, চারায়ণ, গোণদীয়, ঘোটকমুখ, সুবর্ণাভ প্রভৃতি আচার্যগণের কামশাস্ত্র বিষয়ক খণ্ড খণ্ড রচনার অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় সম্ভবতঃ বাৎস্যায়ন সেই সমস্ত রচনারসার সংগ্রহ করে নিজগ্রন্থ প্রণয়নে প্রবৃত্ত হয়েছেন।
বাৎস্যায়ন কৃত কামসূত্র :— বাভ্রব্য রচিত কামসূত্র আকারে বৃহৎ ছিল, বাস্তবিক পূর্বের গ্রন্থগুলি পঠন পাঠনে সাধারণের অনুপযুক্ত ছিল। সেইহেতু ক্রমে সেগুলি বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমানে বাৎস্যায়ন রচিত কামসূত্রই কামবিষয়ক প্রাপ্ত গ্রন্থ। বাৎস্যায়ণের আবির্ভাবকাল বা কামসূত্রের রচনাকাল বিষয়ে বহু মতপার্থক্য রয়েছে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের মতে যেমন জার্মান অধ্যাপক স্মিথ মনে করেন—খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে, অধ্যাপক জলির মতে খ্রিস্টাব্দ চতুর্থ শতকে, ভাণ্ডারকার মনে করনে তারও পূর্বে তৃতীয় শতকে বাৎস্যায়নের আবির্ভাব কাল। কামসূত্রে বাৎস্যায়ন রাজা সাতবাহনের নাম উল্লেখ করেছেন অতএব ২৪০-২২০খ্রিঃ পূর্বাব্দের পরবর্তী সময়ে কামসূত্রের রচনা বলা যায়। কৃষ্ণমাচারির মতে খ্রিঃ পূঃ তৃতীয় বা চতুর্থ শতকই বাৎস্যায়নের কাল। পতঞ্জলি তার মহাভাষ্যে বাৎস্যায়নের নাম উল্লেখ করেছেন অতএব পতঞ্জলির সময় যদি খ্রিঃ পূঃ ১৮৪-১৪৮ হয়। তাহলে বাৎস্যায়ন অবশ্যই তারও পূর্ববর্তী একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
গ্রন্থের আরম্ভে বাৎস্যায়ন বলেছেন—”ধর্মার্থকামেভ্যো নমঃ” অর্থাৎ কাম হল ধর্ম ও অর্থের দ্বারা লব্ধ বিষয়ভোগ। কামকে হতে হবে ধর্ম ও অর্থের অবিরোধী। এই কামের অঙ্গ স্বরূপ তিনি ৬৪ প্রকার কলাকে বর্ণনা করেছেন। সম্পূর্ণ কামসূত্রটি সাতটি অধিকরণে বিভক্ত। সাধারণ, কন্যাসংপ্রযুক্ত, ভার্যাদিকারিক, পারদারিক, বৈশিক, সম্প্রযোগিক, ঔপনিষদিক এই ৭টি অধিকরণে ৩৬টি অধ্যায়ে ও ৬৪টি প্রকরণে কামসূত্রের বিষয়কে বিন্যস্ত করেছেন। তাঁর মতে সাধারণ ভাবে ইন্দ্রিয় সমূহের নিজ নিজ বিষয়ের অনুকূলে যে প্রবৃত্তিঃ তাই হল কাম। আবার বিশেষ অর্থে স্পর্শাবিশেষ বিষয়ত্বস্যাডিমানিক সুখ নিবিন্ধাফলবত্যর্থ প্রতীতিঃ প্রাধানাৎ কামঃ। পুরুষ অথবা স্ত্রীর স্পর্শ বিশেষকে অগ্রাধিকার দিয়ে আভিমানিক সুখে অনুবিদ্ধ, ফলবাণ যে বিষয়বোধ তাই কাম নামে অভিহিত। কামের দ্বারা ইন্দ্রিয় সুখের চরিতার্থতাকে স্বীকার করা হলেও কামের নামে পাশবিকতাকে স্বীকার করা হয় নি। ‘কামং চ যৌবনে’- অর্থাৎ যৌবনই কাম-কলা সম্ভোগের আদর্শ সময়। সেযুগে অষ্ট প্রকার বিবাহের উল্লেখ থাকলেও বাৎস্যায়ন গান্ধর্ব বিবাহকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন, যেহেতু সেক্ষেত্রে নর-নারীর অনুরাগ বিষয়টি প্রকট থাকে। অর্থ-শাস্ত্রের আলোচনা প্রসঙ্গে বহু বিবাহ, বিধবা বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি আলোচনা পূর্বেও করা হয়েছে। যৌবনে কাম- কলার পাশাপাশি সাজ সজ্জা শিল্পনৈপুণ্য, কাব্য-গীতাদি চর্চাও প্রাধান্য পেত। বারাঙ্গ নাগণ স্বাভাবিক মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন। কামসূত্রে কেবল যে কামের আলোচনাই স্থান পেয়েছে এমন নয়। ধর্ম ও অর্থের আলোচনাও দৃষ্ট হয়। অর্থাৎ মানব জীবনে ধর্ম-অর্থ ও কামের সুসামঞ্জস্যই বাৎস্যায়নের কামসূত্রের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
জয়মঙ্গলা নামে কামসূত্রের একখানি প্রাচীন টীকা দৃষ্ট হয় কবি জয়মঙ্গলের রচনা। ভাস্কর নরসিংহ শাস্ত্রী মহাশয় ব্রজলালের আনুকূল্যে কামসূত্রকে অবলম্বন করে রচনা করেন ‘সূত্রবৃত্তি’ টীকা। সম্ভবতঃ অষ্টাদশ শতকে ‘বাৎস্যায়ন সূত্রসাব’ নামে টীকা রচনা করেছেন কাশ্মীরী কবি ক্ষেয়েন্দ্র। ‘গুণপতাকা’ গ্রন্থ অবলম্বনে-কোক্কাচার্য রচিত গ্রন্থ রতিরহস্য কামশাস্ত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থ। লেখকের নামানুসারে রতিরহস্যকে কোকশাস্ত্র বলা হয়। অবশ্য অধুনা কামবিষয়ক শাস্ত্রকেই কোকশাস্ত্র বলা হয়। জ্যোতিমন্ন ১৩১৪খ্রিঃ রচনা করেন পঞ্চসায়ক। বীরভদ্রের কন্দর্পচূড়ামণি নামক গ্রন্থ দুটি ষোড়শ শতকের কামশাস্ত্র গ্রন্থহিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। গীতগোবিন্দের কবি জয়দেব বিরচিত ‘রতিমঞ্জরী’ এবং রুদ্রটের ‘শৃঙ্গারতিলক’ এই প্রসঙ্গে অবশ্য উল্লেখ্য।
পাদটীকা – অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র ও কামশাস্ত্র
১. “ধর্মার্থকামাঃ সমমেবসেব্যাঃ।
যোহ্যেকসক্ত : স জনোজঘন্যঃ।।