প্রথম অধ্যায় – আর্য মহাকাব্যদ্বয় : রামায়ণ ও মহাভারত

প্রথম অধ্যায় – আর্য মহাকাব্যদ্বয় : রামায়ণ ও মহাভারত

ভূমিকা :—

সুদূর অতীতে বৈদিক সাহিত্য এবং লৌকিক সাহিত্যের মধ্যবর্তী সময়কে মহাকাব্যদ্বয়ের জন্মলগ্ন বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে রামায়ণ ও মহাভারত এই দুই মহাকাব্যের বীজ নিহিত ছিল আমাদের সুপ্রাচীন বৈদিক সাহিত্যের গর্ভে। বৈদিক সাহিত্যে যে আখ্যান, ইতিহাস, গাথা, ও নারাশংসী জাতীয় উপাখ্যান দেখতে পাওয়া যায় তাই হল মহাকাব্যের আকর। বৃহদ্দেবতা গ্রন্থে আচার্য শৌণক কর্তৃক বিভক্ত ঋকবেদীয় সূক্তগুলি যথাক্রমে সংবাদসূক্ত, আখ্যানসূক্ত, দানস্তুতি ও নারাশংসী। এই চারশ্রেণীর মন্ত্রের সাথে অথর্ববেদের কুত্তাপসূক্ত সমূহই মহাকাব্যের জননী স্বরূপা একথা বললে অত্যুক্তি হয় না। বৈদিক সাহিত্য যখন যজ্ঞের কঠোর অনুশাসনে আবদ্ধ, তখন সেই সমস্ত যজ্ঞানুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দেবদেবীর মাহাত্ম্য কীর্তন, বীরগণের শৌর্যবীর্যের কথা ও মহৎ আদর্শের কথাই কাহিনীর রূপ নিত। পরবর্তীকালে এই বীরগাথা ও লৌকিক কাহিনীগুলিই নতুন এক সাহিত্যের রূপ পরিগ্রহ করল।

তৎকালে ক্ষত্রিয় পিতা ও ব্রাহ্মণী মাতার সন্তানগণ সূতজাতি বলে এবং বৈশ্যপিতা ও ক্ষত্রিয়া-মাতার সন্তানেরা মাগধী জাতি বলে পরিচিত ছিল। সুতগণের বৃত্তিই ছিল রাজাদের সারথি নিযুক্ত হওয়া এবং সেই সাথে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করে বিভিন্ন রাজরাজাদের যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনী মুখে মুখে রচনা করা। এই সূত বা সারথীগণ কর্তৃক রাজন্যবর্গের বংশতালিকাও সংরক্ষিত হত। সূতগণ কর্তৃক এই বীর্যগাথাগুলি সংরক্ষিত হতো এবং আরও পরে ‘কুশীলব’ নামে সমাজে যাঁরা পরিচিত হতেন তারা এই সমস্ত বীর্য- গাথাগুলি সঙ্গীতাকারে প্রচার করে বেড়াতেন। অতএব অবশ্যম্ভাবীরূপেই মুখে মুখে প্রচারিত হওয়া কাহিনীগুলি পরিবর্তিত, সংযোজিত ও পরিবর্ধিত হয়ে এক নতুনধারার সাহিত্যকীর্তির জন্মদেয়।

বিদগ্ধজনেদের অনুমান ঐ সুত সম্প্রদায় কর্তৃক প্রচারিত মহাভারতীয় যুদ্ধের কাহিনীই ব্যাসদেবের হাতে সাহিত্যের রূপ পরিগ্রহ করে। তারও বহু পরে কালের যাত্রায় ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য ও নানারূপ ধর্মীয় সাহিত্যের বিকাশে নানাবিধ বিচিত্ৰ্যপূৰ্ণ আখ্যান, উপাখ্যান, সংযোজিত হয়ে সুপ্রাচীন ক্ষত্রিয় রাজন্যবর্গের বীরত্বের কাহিনী সম্বলিত বর্তমান মহাভারতের আকার প্রাপ্ত হয়েছে। বৈদিকযুগের শেষভাগে রচিত সুপর্ণাখ্যান কদ্রু ও বিনতার প্রাচীন কাহিনী নিয়ে রচিত এবং এই কাহিনীই ছিল মহাকাব্যের প্রথম রূপায়ন।’

ঋকবেদের ১।১২৬।৪ মন্ত্রে রাজা দশরথের নাম (চত্বারংশদ্দশরথস্য), এবং ১০।৬০।৪ মন্ত্রে ইক্ষ্বাকু বংশের রাজার নাম (যস্যেক্ষ্বাকুরূপ) দৃষ্ট হয়। অতএব আদিকাব্য রামায়ণ বৃক্ষের বীজ ঋকবেদেই উপ্ত হয়েছিল। একথাও অমূলক নয়।

বৈদিক সাহিত্যের শেষ ভাগে দেখা যায় দেবতাদের সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে ইতিহাস ও পুরাণ পাঠ করার ধারণা সমাজে পোষণ করা হত। ইতিহাস ও পুরাণকে ‘পঞ্চমবেদ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।’ ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ্ সাহিত্যেও পুরাণের উল্লেখ রয়েছে।

অতএব যদিও রাময়াণ-মহাভারতকেই আমরা মহাকাব্যের আকারে পেয়েছি তথাপি যে ধরনের গাথা, আখ্যান ও উপাখ্যান থেকে মহাকাব্যের সৃষ্টি সেই সকল কাহিনীর অভাব কোন কালেই ছিল না।

রামায়ণ কবি পরিচয় :—

আদিকবি বাল্মীকির আদিকাব্য রামায়ণ। বাল্মীকি যথার্থই ইতিহাস প্রসিদ্ধ অথবা কিংবদন্তী পুরুষ কি না? অথবা প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী (দীর্ঘ তপস্যার ফলে উই ঢিবিতে (বল্মীকে) আবৃত হয়ে বাল্মীকি নাম, হয়েছিল কিনা ) সে বিতর্ক আজ নিষ্প্রয়োজন। ‘বাল্মীকি’ নামক কবিই যে সুপ্রাচীন অতিজনপ্রিয় ‘রামকথার’ অনুসরণে রামায়ণ নামক মহাকাব্যের জন্মদাতা এই বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের নানা স্থানে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত বহু উল্লেখ পাওয়া যায় কবি বাল্মীকির পরিচয় প্রসঙ্গে। মহাভারতের স্থানে স্থানে রামায়ণের বহু উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু রামায়ণে কোথাও মহাভারতের কোন ঘটনা বা চরিত্রের ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। ‘আদিকাব্যমিদং চার্যং পুরা বাল্মীকিনা কৃতম্। (যুদ্ধ কাণ্ড, ১৩০, ১০৫) এই উক্তিই রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকিকে আদিকবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে।

স্বয়ং কবি বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে, প্রচেতার দশম পুত্র বলে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। বিষ্ণুপুরাণে ও মার্কণ্ডেয় পুরাণে ভৃগুর বংশধর হেতু বাল্মীকি কে ‘ভার্গব’ বলা হয়েছে। বাল্মীকির পিতা চ্যবন এবং ভৃগু হলেন চ্যবন ঋষির পিতা। মহাভারতের শান্তি পর্বে রামকাহিনীকে ‘ভার্গব-গীত’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এছাড়া দ্রোণ পর্বে ‘মা নিষাদ’ শ্লোকের উল্লেখে রামায়ণকার বাল্মীকির কথা উল্লিখিত হয়েছে। পরবর্তীকালে কালিদাসের রঘুবংশে, অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিতে ‘বাল্মীকি’ নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। রামায়ণের মূল গ্রন্থের প্রতি কাণ্ডের পুষ্পিকায় ‘বাল্মীকি-মুনি কর্তৃক রচিত আদিকাব্য শ্রীমৎ রামায়ণ’ এরূপ উল্লেখ আছে। *

অধ্যাত্মরামায়ণে বাল্মীকি নিজ জীবনের ইতিহাস নিজে বলেছেন। কোন এক সময়ে তমসা নদী তীরে ছিল বাল্মীকি মুনির আশ্রম। নদী তীরে ব্যাধ কর্তৃক কামমোহিত ক্রৌঞ্চ-মিথুনের একটি নিহত হলে সেই নিহত রক্তাক্ত ক্রৌঞ্চকে ঘিরে ক্রৌঞ্চীর করুণ আর্তরব শুনে, শোকার্ত ক্রৌঞ্চীর দুঃখে বিহ্বল হয়ে নিষ্ঠুর ব্যাধকে লক্ষ্য করে কবির উদ্বেলিত শোক শ্লোকাকারে ধ্বনিত হয়েছিল।

“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শ্বাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চ মিথুনাদেকমবধী কামমোহিতম্।।” (বালকাণ্ড ( ২।১৪)

হৃদয়ের শোক থেকে জন্ম বলেই একে শ্লোক বলা হয়।

শোক : শ্লোকত্বমাগতঃ।’ সেই সময় দেবর্ষি নারদের অনুরোধে ও স্বয়ং ব্রহ্মার আদেশে আদি কবি বাল্মীকি অনুষ্টুপ ছন্দে জগৎবাসীকে রামচন্দ্রের জীবন কথা কাব্যের আকারে উপহার দেন। এবং তাঁর বিবরণ অনুযায়ী আরো বলা যায় যে তিনি তাঁর কাব্যকে ‘রামচরিত’, ‘সীতাচরিত’, ‘রঘুবীরচরিত’, ‘রঘুবংশচরিত’, ‘পৌলস্ত বধ’, ইত্যাদি নামেও ভূষিত করেন। তথাপি ‘রামায়ণ’ নামই পরবর্তীকালে অধিক সমাদর লাভ করে বা জনপ্রিয় হয়। রামায়ণে পাওয়া কবির বিবরণ থেকেই আরো বলা যায় যে কবির জীবদ্দশাতেই রাময়ণের ঘটনা ঘটেছিল। তমসা নদীর তীরে মুনির আশ্রমের নিকট লক্ষ্মণ রামের নির্দেশে সীতাকে ছেড়ে চলে গেলে বাল্মীকি কন্যাস্নেহে তাঁকে লালন পালন করেন ও সীতার গর্ভে লব ও কুশের জন্ম হলে তাঁরাও ঐ আশ্রমে মুনিকর্তৃক লালিত পালিত হতে থাকে।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যগণ চিরকালই ব্যক্তিগত যশ, প্রতিষ্ঠা, অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, ইত্যাদি বিষয়ে উদাসীন ছিলেন। নিজ জীবনের ঘটনা ব্যাপক আকারে লিপিবদ্ধ করার প্রতি দৃষ্টি দিতেন না, সেই কারণেই বাল্মীকি সম্বন্ধে এর চাইতে অধিক তথ্য পাওয়া দুস্কর। আদিকবির নশ্বরজীবন কোন্ সুদূর অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে তথাপি তাঁর কাব্য প্রতিভা তাঁকে সমগ্র বিশ্ববাসীর নিকট অমর করে রেখেছে।

রামায়ণের ভাষা ও কবি প্রতিভা :—ধৰ্ম্মমূলক বৈদিক সাহিত্যের জন্য ‘শিষ্টসম্মত’ একটি ভাষার প্রচলন ছিল, এবং সেই ‘শিষ্টসম্মত’ ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টাও ঋষিগণ প্রণিত ব্যাকরণের মাধ্যমে দৃষ্ট হয়। এবং পরবর্তী কালে পাণিনি অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে তার পূর্ণ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যের ভাষাই কালক্রমে মহাকাব্যের ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে এমন ধারণা বা বিশ্বাসের কোন দৃঢ় ভিত্তি নাই। উপরন্তু গবেষণার ফলে এ কথাই প্রতিপন্ন হয় যে ব্যাকরণ সম্মত সংস্কৃত ভাষা ব্যতীত সর্বসাধারণের উপযোগী একটি কথ্যভাষার প্রচলনও ছিল। পরবর্তীকালে ঐ কথ্য ভাষাই আর্যভাষা নামে পরিচিতি লাভ করে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের মতানুযায়ী মূল রামায়ণ, মহাভারত ও প্রাচীন পুরাণসমূহ এই আর্যভাষায় রচিত হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীযুগে ব্যাকরণসম্মত বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে প্রভাবাম্বিত হয়ে ঐ সমস্ত মহাকাব্য এবং পুরাণের স্থানে স্থানে পরিমার্জন করা হলেও বহু আর্যভাষার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।

ঋকবেদের ন্যায় রামায়ণ, মহাভারতও ছন্দকেই আশ্রয় করে রচিত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুষ্টুপ্‌ছন্দে রচিত এই কাব্যের ভাষা প্রাঞ্জল, প্রসাদগুণযুক্ত, সরস অথচ গাম্ভীর্যপূর্ণ। পদ লালিত্যে ও মাধুর্যে পরিপূর্ণ এই সাহিত্যে উপমা, রূপক ও অলঙ্কার প্রয়োগও বাল্মীকির সার্থকতার পরিচয় বহন করে। আলঙ্কারিক নির্দেশিত মহাকাব্যের লক্ষণগুলি পূর্ণমাত্রায় রামায়ণে বিদ্যমান। বৈদভীরীতির প্রয়োগে সাবলীলতায়, স্বমহিমায় উজ্জ্বল এই মহাকাব্যে কবির পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের কোন ঝোঁক চোখে পড়ে না। তথাপি মহর্ষির মতে রামায়ণ হলো ধর্ম, অর্থ কাম ও মোক্ষের আধার এবং তা যেন—অনন্তকোটি রত্নরাজি পরিপূর্ণ মহা সমুদ্রের ন্যায় গম্ভীর ও শ্রুতিমধুর।

কামার্থগুণসংযুক্তং ধর্মার্থগুণবিস্তরম্।
সমুদ্রমিব রত্নাঢ্যং সর্বশ্রুতি মনোহরম্।। (বাল, ৩।৮)

রামায়ণে প্রাপ্ত মনোহারী বর্ণনা সমুহে, প্রাকৃতিক শোভার চিত্রাঙ্কণে, এবং অসংখ্য সৎ চরিত্র চিত্রণে মহাকবি ঋষি বাল্মীকি অনন্য, অসাধারণ। দাক্ষিণাত্যের অরণ্যানী, চিত্রকূট পর্বত, দণ্ডকারণ্য, তাপসাশ্রম, সদাতরঙ্গায়িত জলরাশি, সকলই কবির মানসলোককে অতিক্রম করে তাঁর প্রতিভার বর্ণময়ছটায় প্রকাশিত, বিকশিত, উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। ভাষার সরলতায় কবি নিজের তুলনা তিনি নিজেই। নানারূপ বীররসাশ্রিত ঘটনায় সমৃদ্ধ রামায়ণ আবার করুণ রসের ধারায় স্নাত। ক্রৌঞ্চ মিথুনের করুণ কাহিনী যেন রামায়ণের মূল ভাবেরই রূপক স্বরূপ। আলঙ্কারিক মীমাংসক আনন্দবর্ধনের মতে আদিকাব্য রামায়ণ করুণ রসের মহাকাব্য। করুণরসই তার মূল উপজীব্য। রচনা প্রণালী সম্বন্ধে মহাকবি বাল্মীকি স্বয়ং বলেছেন-

উদারবৃত্তার্থ পদৈর্মনোরমৈ—
স্তদাস্য রামস্য চ কার কীৰ্ত্তিমান্
সমাক্ষরে শ্লোকশতৈর্যশস্বিণো
যশস্করং কাব্যমুদারদর্শনঃ ॥৪২
তদুপগত সমাসসন্ধিযোগ
সমমধুরোপনতীর্থবাক্য বদ্ধম্।
রঘুবর চরিতং, মুনি প্ৰনীতম্
দশশিরসশ্চ বধং নিশাময়ধ্বম্।।৪৩

[ বালকাণ্ড-২য় সর্গ। ]

রামায়ণের কাহিনী :—

সমগ্র রামায়ণ সাতটি কাণ্ডে বিভক্ত। যথাক্রমে বালকাণ্ড, অযোধ্যাকাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধাকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, যুদ্ধকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড।

বালকাণ্ড :—বালকাণ্ডে বা আদিকাণ্ডে রামায়ণ রচনার সূচনা। কোশলের রাজধানী অযোধ্যায় অযোধ্যাধিপতি ত্রিলোকবিজয়ী ইক্ষ্বাকুবংশীয় মহারাজ দশরথ রাজত্ব করতেন। রাজাদশরথের তিন রাণী যথাক্রমে—কৈকেয়ী, কৌশল্যা, ও সুমিত্রা, তিন রাণীই অনুঢ়া, এমন সময় রাজা দশরথ পুত্র লাভের কামনায় কুলগুরু বশিষ্ঠের সুপরামর্শে ঋষ্যশৃঙ্গমুনির তত্ত্বাবধানে এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। এবং দেবতার বরে তাঁর তিনরাণীর গর্ভে মোট চারটি পুত্র সন্তান হয়। রাজাদশরথের সুখে স্বচ্ছন্দে দিন কাটতে লাগলো অল্পকাল মধ্যেই পুত্রগণ সকল প্রকার শাস্ত্র ও শস্ত্র বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শীতা লাভ করে। এমন সময় যজ্ঞবিঘ্নকারী রাক্ষসদিগকে বধ করার নিমিত্ত মুনি বিশ্বামিত্র রাম ও লক্ষেণের সাহায্য প্রার্থনা করেন রাজা দশরথের নিকট। আপত্তি থাকা সত্ত্বেও দশরথ তাঁর দুই পুত্রকে মুনির সাথে আশ্রমে পাঠালেন। সেখানে তাড়কা, সুবাহু ইত্যাদি রাক্ষসদের বধ করে তারা বিশ্বামিত্র মুনির সাথে জনকরাজার রাজধানী মিথিলায় যান। সেখানে তখন তাঁর পালিতা কন্যা সীতার স্বয়ংবরের আয়োজন চলছে। স্বয়ংবর সভায় হরধনুভঙ্গ করে-রামচন্দ্র সীতাকে বিবাহ করেন বিশ্বামিত্র এবং দশরথের উপস্থিতিতে, এবং সেই সাথে লক্ষ্মণ এর সাথে ঊর্মিলা, ভরত এর সাথে মাণ্ডবী এবং শত্রুঘ্ন-এর সাথে শ্রুতকীর্তির বিবাহ সম্পন্ন হয়। সীতা ও ঊর্মিলা জনকরাজার দুহিতা এবং মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি জনকের ভ্রাতা কুশধ্বজের কন্যা। মহা সমারোহের সাথে মহানন্দে রাজা দশরথ চারপুত্র ও পুত্রবধূদের সঙ্গে নিয়ে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করলেন। সেথায় দীর্ঘ বার বৎসর অত্যন্ত আনন্দের সাথেই অতিবাহিত হলো।

অযোধ্যা কাণ্ড :—অযোধ্যাকাণ্ডে দেখতে পাই রাজা দশরথ যুবরাজ রামচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষেকের আয়েজন করছেন। এমন সময় দ্বিতীয়া মহিষী কৈকেয়ী তাঁর দাসী মন্থরার কু-পরামর্শক্রমে মহারাজের নিকট পূর্ব প্রতিশ্রুত দুটি বর প্রার্থনা করলেন। প্রথম বরে শ্রীরামচন্দ্রকে চৌদ্দবৎসর বনবাসে যেতে হবে এবং দ্বিতীয় বরে তাঁর ছেলে ভরত অযোধ্যার সিংহাসনে অভিষিক্ত হবে। প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে রাজা দশরথ অসহায় অবস্থায় এই নির্মম প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হলেন। পিতৃসত্য পালনের নিমিত্ত রামচন্দ্র বনগমনে প্রস্তুত হলে পতিব্রতা স্ত্রী সীতা এবং একান্ত অনুগামী ভ্রাতা লক্ষ্মণও তাঁর সাথে বনে গমন করলেন। পথে নিষাদরাজ গুহকের সাথে সাক্ষাৎ হলে গঙ্গাতীরে সারথি সুমন্ত্রকে বিদায় দিয়ে তাঁরা মহর্ষি ভরদ্বাজের আশ্রমে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। অতঃপর সেখান থেকে রওনা হয়ে চিত্রকূট পর্বতে পৌঁছে এক সুন্দর পর্ণশালা নির্মাণ করে পরম সুখে নির্বিঘ্নে বসবাস করতে থাকেন।

এদিকে বৃদ্ধ রাজা দশরথ শোকে দুঃখে প্রাণ ত্যাগ করেছেন; এমন সময় মাতুলালয় থেকে ফিরে ভরত এই সমস্ত ঘটনার নিমিত্ত মাতা কৈকেয়ীকে যার পর নাই ভর্ৎসনা করলেন। ভরত অনুচরবর্গ সঙ্গে করে চিত্রকূট পর্বতের দিকে এগোলেন এবং রামচন্দ্রের দেখা পেয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করার পরেও যখন রামচন্দ্র ফিরে আসতে নারাজ, রামচন্দ্র যখন চৌদ্দ বৎসর বনবাসে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তখন অগত্যা ভরত রামের পাদুকা যুগল সিংহাসনে স্থাপন করে পাদুকার উপর ছত্র ধারণ করে অনুগত ভৃত্যের ন্যায় রাজ্যশাসন করতে লাগলেন।

অরণ্যকাণ্ড : অরণ্যকাণ্ডেবিবৃত ঘটনা অনুযায়ী রামচন্দ্র লক্ষ্মণ ও সীতাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে অত্রিমুণির আশ্রম পরিদর্শন করে দণ্ডকারণ্যে প্রবেশ করলেন। সেখানে অগস্ত্য, সুতীক্ষ্ণ প্রভৃতি মুনিগণের অনুরোধে রামচন্দ্র বহু রাক্ষস বধ করে বনের পরিবেশে শান্তি আনয়ন করলেন। এবং পঞ্চবটী বনে এসে পর্ণকুটির নির্মাণ করে বসবাস করতে থাকলেন। এই সময়ে লক্ষ্মণ কর্তৃক রাক্ষসরাজ লঙ্কাধিপতি রাবণের ভগ্নি শূর্পণখার নাসাকর্ণ ছেদনের ঘটনায় রাবণ প্রচণ্ড ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। এবং এই সময় থেকে রামের সাথে তার শত্রুতার সূত্রপাত হল বলা যায়। রাবণ কৌশলে সীতাহরণের পরিকল্পনা করলেন। রাক্ষস মারীচের সাহায্যে মায়াজাল সৃষ্টি করার ফলে রাম ও লক্ষ্মণ প্রতারিত হলো এবং পরে রাবণ স্বয়ং ছদ্মবেশে (ব্রাহ্মণ অতিথির) পঞ্চবটী থেকে সীতাকে অপহরণ করেন। সীতাশূন্য কুটীরে ফিরে এসে রাম, লক্ষ্মণ, শোকে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। সমস্ত পঞ্চবটীর গাছপালা যেন শোকে বিহ্বল। গিরি, নদী, বন সর্বত্র ব্যাকুলভাবে খুঁজেও যখন দুইভাই সীতাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছেন না এমন সময় মুমূর্ষু জটায়ু রাবণ কর্তৃক সীতাহরণের কথা তাদেরকে জানায়। পক্ষীরাজ জটায়ু রাবণকে বাধা দিয়েছিল বলে রাবণের হাতে তার মৃত্যু হয়েছে।

কিষ্কিন্ধাকাণ্ড :—এই পর্বে শোকাহত রাম লক্ষ্মণ ঋষ্যমুক পর্বত অভিমুখে গমন করলে অবশেষে পম্পা সরোবরের তীরে এসে হনুমানের সাথে সাক্ষাৎ হয়। হনুমানের নির্দেশে কপিরাজ সুগ্রীবের সাথে রামের সখ্যতা স্থাপিত হয়। সুগ্রীবের অগ্রজ বালী সুগ্রীবকে প্রতারণা করে কিষ্কিন্ধায় রাজত্ব করছে জেনে রামচন্দ্র সেই সমস্যার মীমাংসা স্বরূপ বালীকে হত্যা করে সুগ্রীবকে সিংহাসনে ফিরিয়ে দেন। সুগ্রীবও সেই বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে সীতা উদ্ধারের নিমিত্ত রামচন্দ্রকে প্রতিশ্রুতি দেন। সুগ্রীব আপন সৈন্য দলকে একত্রিত করে সীতা উদ্ধারের কাজে চর পাঠালেন।

সুন্দরকাণ্ড :—বানর সেনাপতি মহাবীর হনুমান সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কায় অশোককাননে প্রবেশ করে দেখলেন সীতা রাক্ষসীদের পাহাড়ায় বন্দী হয়ে আছে। সীতার সাথে কৌশলে দেখা করে সীতার অভিজ্ঞান সঙ্গে নিয়ে রামের কাছে কিষ্কিন্ধায় ফিরে এল। এই পর্বেই হনুমান রাবণরাজকে রামচন্দ্রের বীর্যবত্তার কথা জানিয়ে সীতা প্রত্যার্পণের অনুরোধও করেন কিন্তু অহঙ্কারী রাবণ এর ফলে দ্বিগুণ ক্রোধান্বিত হয়ে জ্বলে ওঠেন। হনুমান ফিরে এসে লঙ্কাপুরীর ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধির যে বর্ণনা দেয় তা অপূর্ব, অনবদ্য। চিত্রকল্পের ন্যায় সুন্দর। অনেকে মনে করেন এই কারণেই কাণ্ডের নাম ‘সুন্দরকাণ্ড’।

যুদ্ধকাণ্ড :—এই পর্বে লঙ্কা অভিযানের নিমিত্ত রামের পরামর্শে সুগ্রীব সমুদ্রের উপর সেতু বন্ধন করলেন। রাবণ-রাজার ভাই বিভীষণ রাবণকে এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়া সত্ত্বেও তিনি পিছপা হলেন না। তখন বিভীষণ রামের পক্ষে যোগ দিলে সুগ্রীব ও বিভীষণ সহ সৈন্যসামন্ত নিয়ে রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করলেন। সেই ভীষ: রামরাবণের যুদ্ধে রাবণের শোচনীয়ভাবে পরাজয় ঘটলে বিভীষণকে লঙ্কার সিংহাসনে অভিষিক্ত করে বন্দিনী সীতাকে উদ্ধার করলেন। কিন্তু এমতাবস্থায় সীতার চরিত্র সম্বন্ধে অপবাদের আশঙ্কায় সীতাকে অগ্নিপরীক্ষাও দিতে হয়েছিল। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ-সীতাকে সাথে নিয়ে পুষ্পকরথে চড়ে রাম লক্ষ্মণ অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করলেন। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হল। রামরাজ্য ছিল ধর্মরাজ্যেরই নামান্তর। এর সাথে রামায়ণ পাঠের ফলশ্রুতি বর্ণিত হয়েছে।

উত্তরকাণ্ড :—উত্তরকাণ্ডের প্রথমাংশে বহু প্রাচীন গল্প গাথা বর্ণিত হয়েছে। অযোধ্যায় রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে কিছু কাল মধ্যেই প্রজাবর্গের অসন্তোষ প্রকাশ পায় সীতাদেবীর চরিত্র বিষয়ে। সীতা বুদ্ধিমতী, সৎ চরিত্রবতী জেনেও প্ৰজা-হিতৈষী রামচন্দ্র প্রজাদের প্রতি কর্তব্যের খাতিরে সীতাকে ত্যাগ করেন। কারণ রামচন্দ্রের মতে রাজার আচার আচরণ হবে প্রজাদের সকল সন্দেহের, সকল অপবাদের উর্দ্ধে। রামের নির্দেশে লক্ষ্মণ অন্তঃসত্ত্বা সীতাকে মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রমে পরিত্যাগ করে আসেন। সেখানে সীতার যমজপুত্র লব ও কুশ জন্ম নেয়। মহর্ষি বাল্মীকির স্নেহচ্ছায়ায় তারা লালিত-পালিত হয়। তাদের বাল্য শিক্ষাও সেখানেই চলতে থাকে। মহর্ষি লব-কুশকে রামায়ণ শিক্ষাদেন। এমন সময় রামচন্দ্র অযোধ্যায় অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। বাল্মীকি তথায় লব-কুশকে রামায়ণ গান গাওয়ার জন্য নিয়ে যায়। তাদের প্রকৃত পরিচয় লাভ করে রাম সীতাকে আনার জন্য লোক পাঠান। সেখানে পুনরায় বিশুদ্ধির পরীক্ষা দিতে গিয়ে চির দুঃখিনী সীতাদেবীর অনুরোধে পৃথিবী দ্বিধা বিভক্ত হলে ধরিত্রীর কন্যা ধরিত্রীর অঙ্কশায়িনী হলেন। চারিদিকে নিদারুণ হাহাকার শোনা গেল। শোক অনুতাপে মুহ্যমান রামচন্দ্র আত্মহারা হয়ে পড়লেন। স্বর্ণসীতা নির্মাণ করে বহু যজ্ঞানুষ্ঠান করলেন। রামরাজ্যে প্রজারা সুখে শান্তিতে কালাতিপাত করতে থাকলেন। কিছুকাল মধ্যেই রামচন্দ্র ভরত ও ভরতের পুত্রদ্বয়কে সঙ্গী করে সিন্ধুনদের তীরে গান্ধর্ব রাজ্য জয় করেন। লক্ষ্মণের পুত্রদ্বয়কে কারাপথ- দেশের রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। লব ও কুশকে রামচন্দ্র দক্ষিণ ও উত্তর কোশল রাজ্যে অভিষিক্ত করে সরযূতীরে গেলেন এবং তথায় স্নান পূর্বক বিষ্ণুরূপে স্বর্গে গমন করলেন। রামচন্দ্র স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার, যেন নররূপী নারায়ণ।

রামায়ণের বিভিন্ন সংস্করণ :—

রামায়ণের প্রায় দু’ হাজারেরও অধিক হস্তলিখিত পুঁথি পাওয়া যায়। এবং-সেই সমস্ত পুঁথির পাঠ ভেদে পুঁথিগুলির প্রধানত : তিনটি প্রাদেশিক সংস্করণ দেখা যায়। (১) বঙ্গীয় পাঠ’, (২) উত্তর পশ্চিম প্রদেশীয় পাঠ’, এবং (৩) বোম্বাই প্রদেশীয়” (মহারাষ্ট্রীয়) পাঠ। দীর্ঘকালের যাত্রায় রামায়ণের মূল অংশের সাথে বহু প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কাহিনীর সংযোজন যে অসম্ভব নয় একথা সকল সমালোচকই মনে করেন। বার্লিন লাইব্রেরীর সংগ্রহে আরো একটি রামায়ণের প্রাচীন পুঁথির সংগ্রহ আছে বলে জানা যায়। প্রচলিত রামায়ণে ৭টি কাণ্ড ও ২৪,০০০ শ্লোক রয়েছে। বিভিন্ন প্রাদেশিক পাঠে মোট প্রায় ৮০০০ শ্লোকে গরমিল লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে বোম্বাই প্রদেশীয় পাঠই সর্বোৎকৃষ্ট ও প্রাচীন সংস্করণ। বাকী দুই পাঠে বাংলায় গৌড়ি রীতির প্রাধান্য ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে বৈদভী রীতির প্রচলন হেতু পণ্ডিতসমাজ ও গায়কগণ তাদের রুচি ও ইচ্ছানুযায়ী স্থানে স্থানে বহু পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংযোজন করেছেন বলে মনে করা হয়ে থাকে। অতএব পাঠভেদ হওয়া স্বাভাবিক।

পরন্তু রামায়ণের বর্তমানরূপ থেকে বাল্মীকির মূল রচনা আবিষ্কার করার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন সর্গের তুলনামূলক আলোচনা ও অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য উভয় দেশের পণ্ডিতগণই রামায়ণের মূল অংশ ও প্রক্ষিপ্ত অংশ নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন।

রামায়ণের মূল অংশ ও প্রক্ষিপ্ত অংশ বিষয়ক আলোচনা :—

“চতুৰ্বিংশত সহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবান্ ঋষিঃ।

তথা সর্গশতান্ পঞ্চষাণ্ডানি তথোত্তরম্।। (বাল.৪/২) স. শ্লো বাল্মীকি রচিত রামায়ণ মহাকাব্য চতুর্বিংশতি সাহস্ৰী শ্লোকে (২৪০০০) রচিত এবং পাঁচটি কাণ্ডে বিভক্ত ছিল বলেই শ্লোকে নির্দেশ আছে। কিন্তু বর্তমানের প্রচলিত রামায়ণ মহাকাব্যে ৭টি কাণ্ড, ৫০০টি অধ্যায় ও ২৪০০০টি শ্লোক দৃষ্ট হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতগণের গবেষণা লব্ধ সিদ্ধান্ত এই যে, প্রথমত :—২য় থেকে ৬ষ্ঠ কাণ্ড পর্যন্তই বাল্মীকির মূল রামায়ণ এবং দ্বিতীয়তঃ—প্রথম কাণ্ডের শেষ অংশ এবং উত্তরকাণ্ডের কিছু কিছু অংশ বিশেষ মূল রামায়ণের অন্তর্ভুক্ত। অধ্যাপক Jacobi-র মতে বালকাণ্ডের ৫মসর্গই মূল প্রাচীন রামায়ণের প্রারম্ভবাক্য। অযোধ্যাকাণ্ড থেকেই রামায়ণ আরম্ভ। অযোধ্যা কাণ্ডের কিছু অংশ সহ আরও নতুন কিছু সর্গ যোগ করে বালকাণ্ড রচিত হয়েছে। তিনি আরো বলেন যে বালকাণ্ডের প্রথম সর্গের প্রথম শ্লোকই” ছিল মূল রামায়নের প্রারম্ভিক শ্লোক।

রামায়ণের প্রথম কাণ্ডের প্রথমসর্গ ও তৃতীয় সর্গে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সূচীপত্র লক্ষ্য করা যায়। প্রথম কাণ্ডের সূচী অনুযায়ী সপ্তমকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু বালকাণ্ডের তৃতীয় সর্গের ৩৮ নংশ্লোকের বিষয়সূচী অনুযায়ী বৈদেহী বিসর্জনের কাহিনীর আভাস স্পষ্ট।

“রামাভিষেকাভ্যুদয়ং সৰ্ব্বসৈন্যবিসর্জ্জনম্।
স্বরাষ্ট্রজ্ঞণঞ্চৈব বৈদেহ্যাশ্চ বিসৰ্জ্জনম্”৩৮

প্রথম সূচীপত্রে এই কাহিনীর উল্লেখ না থাকায় এবং দ্বিতীয় সূচীপত্রে থাকায় সহজেই অনুমিত হয় যে উত্তরকাণ্ড পরে সংযোজিত হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী দ্বিতীয় সূচীপত্র সংযোজিত হয়েছে। চতুর্থ সর্গের দ্বিতীয় শ্লোক অনুযায়ী সর্গ ও শ্লোক সংখ্যা বর্তমান রামায়ণে অধিক দৃষ্ট হওয়ায় সহজেই প্রমাণিত হয় যে ৭ম কাণ্ডটি পরে সংযোজিত হয়েছে।

এছাড়া বলা যায় প্রথম ও সপ্তমকাণ্ডের রচনার গুণগতমান ভাব ও ভাষা অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট মানের। এই দুই কাণ্ডে পুরাণের ভঙ্গিতে নানান আখ্যান-উপখ্যান পরিলক্ষিত হয়, ফলে মূল ঘটনা প্রবাহের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। বাল্মীকি যে রামচরিত বর্ণনা করেছিলেন সেখানে রামচন্দ্র অসীমশক্তিশালী ও সর্বগুণসম্পন্ন একজন মানুষ। কিন্তু প্রথম ও সপ্তমকাণ্ডে রামচন্দ্র যেন নররূপী নারায়ণে পরিণত হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ মানবের গৌরবকে আতিক্রম করে সাক্ষাৎ বিষ্ণুর অবতার রূপে বর্ণিত হয়েছেন। যুদ্ধ কাণ্ডের শেষে রামায়ণ পাঠের ফলশ্রুতির কথাও উল্লিখিত হয়েছে। অনেকের ধারণা ঐস্থানেই রামায়ণের মূল রচনার সমাপ্তি ঘটেছিল। পরবর্তী অংশ প্রক্ষিপ্ত। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে তথাগতবুদ্ধের নাম পাওয়া যায়। এই অংশটিকে প্রক্ষিপ্ত মনে করা হয় কারণ রামায়ণের মূল অংশ বুদ্ধের আবির্ভাবের পূর্বেই রচিত হয়েছে। আলঙ্কারিক আনন্দবর্ধন তার ধ্বণ্যালোক গ্রন্থের পঞ্চম পরিচ্ছেদে সীতা বিয়োগ পর্যন্ত এবং কুন্দমালা নাটকে নাট্যকার সীতা পরিত্যাগ পর্যন্ত্য কাহিনীকেই বাল্মীকির মূল রামায়ণ বলে স্বীকার করেছেন। বলিদ্বীপে প্রাপ্ত কবির ভাষায় রচিত রামায়ণেও উত্তরকাণ্ড দৃষ্ট হয় না। পালিজাতকে বর্ণিত রামকথার সঙ্গে উত্তরকাণ্ডের শ্লোকের সামঞ্জস্য বর্তমান। অতএব অনুমান করা যায় যে মূল রামায়ণ রচনার কিছুকালের মধ্যেই উত্তরকাণ্ডের সংযোজন ঘটেছিল। যখন রামায়ণ রচিত হয় নি, তখনও সূতগণই ছিল রামায়নের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মূল হোতা। এবং লিখিতরূপে রামায়ণ পাওয়ার পরেও তাতে বহু প্রক্ষিপ্ত অংশ প্রবেশ করেছে।

রামায়ণের রচনাকাল :—

মহর্ষি বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণের রচনাকাল নির্ধারণ নিঃসন্দেহে কষ্টসাধ্য এবং বহু তর্ক বিতর্কের সম্মুখীন। তথাপি কিছু কিছু তথ্যের ভিত্তিতে পণ্ডিতগণ কর্তৃক অনুমিত রামায়ণ রচনাকাল প্রসঙ্গে সম্ভাব্য সময় হিসাবে, মূল রামায়ণের ক্ষেত্রে খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের পূর্বকালকে এবং বর্তমান সাতকাণ্ড রামায়ণের ক্ষেত্রে ২য় খ্রিঃ শতকের পূর্বকালকে চিহ্নিত করা যায়। এই মতের সমর্থনে Weber-এর যুক্তিগুলি নিম্নরূপ- প্রথমতঃ—রামায়ণে কোশলের রাজধানীর নাম ‘অযোধ্যা’ কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈন-যুগে এই স্থানের ‘সাকেত’ নামকরণ, করা হয়। দ্বিতীয়তঃ—রামায়ণে ‘মিথিলা’ ও ‘বিশালা’ নামে দুটি পৃথক নগরীর উল্লেখ দৃষ্ট হয়। বুদ্ধের সময়ে এই দুই পৃথক নগরী এক শাসনতন্ত্রের অধীনে আসায় বৈশালী নাম ধারণ করে। তৃতীয়তঃ—রামায়ণে বুদ্ধ, বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধসাহিত্যের কোন রূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে জাবালির নাস্তিক মতের ভর্ৎসনায় রামচন্দ্র যে বুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছেন— ‘যথাহি চোরঃ স তথা হি বুদ্ধস্তথাগত্যং নাস্তিকমাত্রবিদ্ধি’—এই অংশকে প্রক্ষিপ্ত মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। চতুর্থতঃ—বৌদ্ধজাতক কাহিনীগুলিতে রামায়ণের সুস্পষ্ট প্রমাণ পরিলক্ষিত হয়।

দশরথজাতকে রামায়ণ থেকে হুবুহু শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। ‘সদ্ধর্মমৃত্যুপস্থান’ নামক বৌদ্ধসাহিত্যে জম্বুদ্বীপের নিখুঁত সুন্দর বর্ণনা রামায়ণের দ্বারা প্রভাবান্বিত বলেও অধ্যাপক সিলবাঁলেভী (Sylvan Levi) মনে করেন। পঞ্চমতঃ—বালকাণ্ড অনুযায়ী রামচন্দ্র ও মুনি বিশ্বামিত্রের আলোচনায় শোন নদের তীরে যে নগর ও দেশের পরিচয় পাওয়া যায় সেখানে পাটলিপুত্রের (পাটনা) কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু গঙ্গা ও শোন নদের মিলনস্থলে পাটলী পুত্র অবস্থিত। অতি সমৃদ্ধ এই নগরটি অজাত শত্রু কর্তৃক (৫০০ খ্রিঃ পূর্বে) স্থাপিত হয়। কিন্তু রামায়ণে এ-হেন বিশিষ্ট নগরীর উল্লেখ না থাকায় মূল রামায়ণ যে ৫০০খ্রিষ্ট পূর্বে রচিত তা সহজেই অনুমেয়। ষষ্ঠতঃ—রামায়ণে ‘যবন’ শব্দের প্রয়োগ দেখে Weber মনে করেন যে গ্রীক আক্রমণের পরে রামায়ণ রচিত হয়েছে। এইরূপ মতের বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে Jacobi বলেন যে—–যবন শব্দটি রামায়ণে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে খ্রিষ্ট ৩০০ অব্দের পরবর্তী কালে। অথবা গ্রীক আক্রমণের পূর্বেও-বহু বৈদেশিক আক্রমণ হওয়ায় ঐ সব বিদেশীয়দেরও ‘যবন’ নামে অভিহিত করা কোন অমূলক নয়। Weber আরো মনে করেন যে—হোমারের ইলিয়ড ও ওডিসি মহাকাব্যদ্বয়ের প্রভাবে প্রবাবান্বিত হয়েই রামায়ণের রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ এবং রামের লঙ্কা অবরোধ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু Williams, Jacobi প্রভৃতি পণ্ডিতগণ এর বিরুদ্ধে সমালোচনা করে রামায়ণকে সম্পূর্ণভাবে গ্রীক প্রভাব মুক্ত রচনা বলেই স্বীকৃতি দিয়েছেন।” সপ্তমতঃ-বাল্মীকির ভাষা পাণিনির শিষ্টসম্মত বিশুদ্ধ ব্যাকরণ সম্মত সংস্কৃত ভাষা নয়। রামায়ণের বহু প্রয়োগ পাণিনির ব্যাকরণে দৃষ্ট হয় না। অতএব পাণিনির বহু পূর্বে মূল রামায়ণ রচিত হয়েছিল। পণ্ডিতদের অনুমান অনুযায়ী পাণিনি অবশ্যই বুদ্ধের আবির্ভাবের পূর্বে জন্মে ছিলেন, কারণ তাঁর অষ্টাধ্যায়ীতে বৌদ্ধমত বা বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক কোন শব্দই স্থান পায়নি। তবে খৃঃ পূঃ ৪০০ অব্দের মধ্যেই পাণিনিকে স্থাপন করার পক্ষে আধিকাংশ পণ্ডিতরা মত পোষণ করেন। অতএব ওপরিউক্ত যুক্তির বলে মূল রামায়ণ যে বুদ্ধের জন্মের বহু পূর্বেই রচিত একথা প্রমাণিত হয়।

রামায়ণের রূপক কল্পনা এবং রামায়ণ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও চেতনা :

রামায়ণ যে যুগে রচিত হয়েছিল সেই যুগের আর্যজাতি গোষ্ঠির প্রধান জীবিকাই ছিল কৃষিকাজ। আর্য সভ্যতা ছিল একান্তই কৃষি সভ্যতা। পূর্বে ভারতে বসবাসকারী দ্রাবিড় জাতির আর্য-ভাষা গোষ্ঠির মানুষের উপর ক্রমশঃ আধিপত্য বিস্তার করতে থাকলে উভয়ের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়, ফলস্বরূপ তারা আর্যদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত, কারণে অকারণে যজ্ঞ বিনষ্ট করত। আশ্রমের শান্ত জীবনকে অশান্ত করে তুলত। কৃষি কার্যেও বিঘ্ন ঘটাতো। মহাকাব্যের যুগে ইন্দ্রছিলেন প্রধান দেবতা। সূত্র সাহিত্যে ‘সীতা’ ইন্দ্রের পত্নী হিসাবে বর্ণিত। বৈদিক সাহিত্যে ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করে বৃত্র কর্তৃক নিরুদ্ধ জলরাশিকে উন্মুক্ত করেছিলেন। রামায়ণেও রাম রাবণকে বধ করে রাবণ কর্তৃক অপহৃতা সীতাকে উদ্ধার করেছিলেন। স্বভাবতই ধারণা হয় যে রামায়ণের রামচন্দ্র যেন ইন্দ্রেরই ছায়াস্বরূপ। অপরদিকে ‘সীতা’ কথার অর্থ হল ‘লাঙ্গল-পদ্ধতি’ (field-furrow) এবং বলরামের আর এক নাম হল ‘হলভৃৎ’ (যিনি হল চাষ করেন)। Weber এর মতে রাম ও বলরাম একই ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীকালে দু’জনকে পৃথকরূপে কল্পনা করা হয়েছে। “ Jacobi & Weber- এরূপ মতের সমর্থনে বলেছেন— “Her Husband Rama would be no other than Indra, and his conflict with Ravana would represent the Indra- vritra myth of the Rigveda.”-Das Ramayana. Bonn-১৮৯৩. Jacobi আরও মনে করেন যে—রাবণের পুত্রের নাম-ইন্দ্রজিৎ বা ‘ইন্দ্রশত্রু’, বেদে বৃত্রের নাম ‘ইন্দ্রশত্রু’-বৃত্রের সাথে যুদ্ধে বৈদিক দেবতা ইন্দ্রের প্রধান সহায় ছিল মরুগণ, অপরদিকে রাবণের সাথে যুদ্ধে রামের প্রধান সহায় ছিল হনুমান (মরুতের পুত্র অর্থে ‘মারুতি’)। এই সমস্ত আলোচনা থেকে সহজেই অনুমিত হয় যে বৈদিক ইন্দ্ৰ- বৃত্র উপাখ্যান এরই প্রতিচ্ছায়া স্বরূপ এই রামায়ণ কাহিনী। শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও প্রজাহিতৈষি রাজা। বুদ্ধি বলে তিনি আদিম অধিবাসীদের কাছে টেনে নেন, এবং কপি সৈন্যবাহিনী গঠন করে ক্রমশঃ আর্য ও অনার্যদের’ মধ্যে একটা সুসম্পর্ক তৈরী করতে সক্ষম হন। তৎপরবর্তী কালে রামচন্দ্র যেন স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার এবং নররূপী নারায়ণ রূপে প্রতিভাত হন। এর থেকেই অধ্যাত্ম রামায়ণ, আত্মবোধ রামায়ণ ইত্যাদি গ্রন্থ রচিত হলে তথায় রাম সীতা যথাক্রমে নারায়ণ ও লক্ষ্মীরূপে বিবেচিত হন। Jacabi এবং weber এর মত Wheeler, Lassen প্রমুখ পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণও রামায়ণকে কল্পকাহিনী বলেছেন এবং রামায়ণের মধ্যে তার মৌলিক তাৎপর্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মতে শুধু ইন্দ্ৰবৃত্র কাহিনীর ছায়াই নয় সীতাকে উদ্ধার করতে গিয়ে দক্ষিণ ভারত ও সিংহলে কৃষিভিত্তিক আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসারও ছিল রামায়ণ কাহিনীর অন্যতম তাৎপর্য। এর মধ্য দিয়ে অনার্যদের মধ্যে কৃষির প্রসার ঘটানো, উন্নত জীবন যাবনে অভ্যস্ত করা এককথায় আর্য অনার্যদের সংস্কৃতির সংঘর্ষই রাম-সীতা-রাবণের কাহিনীর মধ্য দিয়ে রূপক হিসাবে ফুটে উঠেছে। Wheeler আরও মনে করেন যে-রামরাবণের যুদ্ধ যেন ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির দ্বন্দ্বেরই ইঙ্গিত করে।

এতো গেল পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ধারণা। আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও রামায়ণ কাহিনীর মধ্যে রূপকের সন্ধান করেছেন। তাঁর মতে রামায়ণের দুটি মূল দিক। এক কৃষি, অপরটি স্বর্ণ। রামচন্দ্র যদি হন কৃষির প্রতীক তবে রাবণরাজা হলেন স্বর্ণ বা ঐশ্বর্যের প্রতীক স্বরূপ। তিনি আরও বলেন, রামের রমণীয়তা, কমনীয়তা যদি আমাদিগকে মুগ্ধ করে তবে লক্ষ্মণ হলেন সম্পদ ও সৌন্দর্যের প্রতীক, সীতা হলেন স্বয়ং হল-কর্ষণের প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন রাবণরাজার ছিল দৈহিক বল এবং বাইরের ঐশ্বর্য, কিন্তু রামচন্দ্র ছিলেন আত্মার ঐশ্বর্যে মহান্। তাঁর মতে কৃষিকাজ খুবই পরিশ্রমসাধ্য কাজ। তাই সকল রাজার পক্ষে এই বিদ্যায় পারদর্শীতা লাভ করা সম্ভব ছিল না, যেমন সম্ভব ছিল না হরধনু ভঙ্গ করা। রামচন্দ্রই সেই ব্যক্তি যিনি হরধনু ভঙ্গ করে সীতাকে বিবাহ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনাকে রামচন্দ্রের কৃষিবিদ্যাগ্রহণের সাথে তুলনা করেছেন। তাঁর ছোঁয়ায় পৃথিবী শস্য-শ্যামলা হল, তিনি হলেন নবদূর্বাদলশ্যাম। অপরদিকে স্বর্ণলঙ্কেশ্বর রাবণ ধনমদে মত্ত হয়ে কৃষিজীবিদের কারণে অকারণে উত্তক্ত করতেন। কিন্তু কবির কল্পনায় যখনই ধনের দ্বারা ধান্য পীড়িত হয়েছে তখনই অকল্যাণ ঘটেছে। সেই হেতু রাবণ কর্তৃক সীতা হরণই রাবণের ধ্বংসের কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়।

পরবর্তীকালে সর্বক্ষেত্রে রামায়ণের প্রভাব :–

আদিকবি বাল্মীকির অমর কাব্য প্রতিভা পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর সৃষ্ট রামায়ণ নামক মহাকাব্যের মধ্য দিয়ে। রামায়ণ বাল্মীকির হৃদয় নিঃসৃত মাধুর্যের প্রতিকৃতি। রামায়ণ মহর্ষি বাল্মীকির মনো জগৎ- এর উৎকৃষ্ট ফসল, যার দ্বারা তৎপরবর্তীকালের সকল জগৎবাসী উপকৃত, তৃপ্ত, আহ্লাদিত। আমরা জানি যে সব সাহিত্য জাতির সকল প্রকার অভিব্যক্তির ধারক- বাহক ও প্রচারক। সাহিত্য সেই যুগের সংস্কৃতির অন্যতম পরিচায়ক। কিন্তু বাল্মীকি রচিত রামায়ণ এমনই এক অনন্যসাধারণ সাহিত্য যা দেশ কালকে অতিক্রম করে বিশ্বসাহিত্যে কালজয়ী রচনার দাবীদার। সেই হেতু রামায়ণের আবেদন সর্বকালে সমান পরিব্যপ্ত। কাব্যমাত্রেই তা পাঠক চিত্তকে আকৃষ্ট করে থাকে। কিন্তু সকল কাব্য একইরূপ সমাদর লাভে সমর্থ হয় না, সেই দিক থেকে বিচার করতে গেলে রামায়ণ ভারতীয় হিন্দু নরনারীর জাতীয় সম্পদে পরিগণিত হয়েছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের নয়, সকল ভারতীয়—আর্য নরনারীর হৃদয়ের সম্পদ হল এই রামায়ণ। সেইহেতু এর সুখ-দুঃখ, আশা আকাঙক্ষা, কর্তব্যপরায়ণতা, ত্যাগ এবং তিতিক্ষা এই সকল অভিব্যক্তিই যেন কোন বিশেষ চরিত্রের অনুভূতি নয়, এ যেন সাৰ্ব্বজনীন চারিত্রিক বৈশিষ্টেরই প্রতিফলন স্বরূপ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উক্তি অনুযায়ী—”এক শ্রেণির কবি আছে, যাহার রচনার ভিতর দিয়া একটি সমগ্র দেশ, একটি সমগ্র যুগ, আপনার হৃদয়কে, আপনার অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করিয়া তাহাকে মানবের চিরন্তন সামগ্রী করিয়া তোলে।” রামায়ণ-মহাভারত সেই জাতীয় মহাকাব্য।

রামায়ণ যে পরবর্তীকালে ভারতীয় হিন্দু-নরনারীর হৃদয়ে কতদুর প্রভাব বিস্তার করেছে তার প্রমাণ সর্বকালে, সর্বদেশে, সর্ব কর্মে ও সকল চিন্তায় ব্যপ্ত, হয়ে আছে। প্রায় সকল প্রাদেশিক ভাষাতেই ‘রামায়ণ কথা’ লেখা হয়েছে। স্বয়ং ব্রহ্মার আশীর্বচন পরবর্তীকালে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে।

“যাবৎ স্থাস্যস্তি গিরয়ঃ শরিতশ্চ মহীতলে,
তাবদ্রামায়ণী কথা লোকেষু প্রচরিষ্যতি”।।

অর্থাৎ যতদিন পর্যন্ত অভ্রভেদী হিমালয় পর্বত ও পুণ্যতোয়া ভাগীরথী থাকবে ততদিন পর্যন্ত রামায়ণের অমৃতময়বাণী পৃথিবীতে প্রচারিত হতে থাকবে। বিশ্বকবি সেই সুরে সুর মিলিয়ে বললেন “আজিও সে গীত মহাসঙ্গীতে বাজে মানবের কানে।”

ধর্মীয় জীবনে রামায়ণের প্রভাব :—

ভারতীয় ঐতিহ্যের মূলে রাবণের বিরুদ্ধে রামের যুদ্ধজয় যেন অর্ধমের বিরুদ্ধে ধর্মেরই জয়।” অর্থাৎ ধর্মের জয়, অধর্মের পরাজয় এই হলো রামায়ণের চিরন্তন আবেদন। যা নাকি প্রতিটি ভারতবাসীর মর্মবাণী স্বরূপ। অধর্মকে আশ্রয় করে জীবনে কখনও উন্নতির শিখরে আরোহন করা যায় না। অধার্মিক সমূলে বিনষ্ট হয়। সেই হেতু দেখি–

“অধর্মেনৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।
ততঃ সপত্নান জয়তি সমূলস্ত বিনশ্যতি ॥

রামায়ণ কাহিনী যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তদনুযায়ী ‘অতিদর্পে হতালঙ্কা’ এই প্রবচনও অনুরূপ তাৎপর্যই বহন করে। ধর্মকে লঙ্ঘন করে মহৎ কিছু লাভ করা যায় না, এই আদর্শই প্রতিটি নরনারীকে প্রভাবান্বিত করেছে।

রামচন্দ্রের জীবনাদর্শে যে সকল গুণাবলী লক্ষ্য করা যায় সেই সমস্ত গুণগুলিই তাঁকে যেন মানবজীবন অতিক্রম করে দেবত্ব দান করেছে। পুত্ররূপে, ভ্রাতারূপে, পতিরূপে, বন্ধুরূপে, ব্রাহ্মণ্যধর্মের পূজারি হিসাবে সর্বোপরি প্রজারক্ষক রাজা হিসাবে রামচন্দ্র যেন ভারতবর্ষের আদর্শ স্বরূপ। তাই সুন্দর কাণ্ডে বলা হয়েছে—

রক্ষিতা স্বস্য বৃত্তস্য স্বজনস্য চ রক্ষিতা।
রক্ষিতা জীবলোকস্য ধর্মস্য চ পরান্তপঃ ॥

এহেন পবিত্র জীবনাদর্শের গুণাবলী সম্বন্ধে রামায়ণে বলা হয়েছে।

“সত্যং চ ধর্মং চ পরাক্রমং চ ভূতানুকম্পাংপ্রিয়বাদিতাং চ।
দ্বিজাতিদেবাতিথি পূজনং চ পান্থানুমাহুস্ত্রিদিবস্যমার্গ : ॥”

অরণ্যকাণ্ডে বলা হয়েছে ধর্মই মানুষের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ এবং অর্থাদি ত্রিবর্গ ধর্মভিত্তিক ও ধর্মবিরোধী হয়ে আপনিই মানুষের করতলগত হয়।—

ধর্মাদর্থঃ প্রভবতি ধর্মাৎ প্রভবতে সুখম্।

রামায়ণ ভারতীয় আর্য নর নারীর জীবনে এমনই ধর্মভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে যে রামায়ণ পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসাবে সর্বত্র শ্রদ্ধার সহিত পঠিত ও পূজিত হয়ে আসছে। শ্রাদ্ধাদি নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও রামায়ণ পাঠ করা হয়ে থাকে। হনুমানের প্রভুভক্তি আমাদের মুগ্ধ করে সেইহেতু রামচন্দ্রের ছায়াসঙ্গী হনুমানও হিন্দুদের মন্দিরে স্থান করে নিয়েছে। ধর্মসাধনার অন্যতম হাতিয়ার রামাবতার। শুধুমাত্র হিন্দুধর্মই নয় বৌদ্ধ ও জৈন এই দুই সম্প্রদায়ও নিজ নিজ ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে রামায়ণকেই মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে রামায়ণের প্রভাব :—রামায়ণে মূলতঃ আর্য ও অনার্য এই দুই সভ্যতার সংঘর্ষের প্রতিফলন ঘটেছে। রাম ও তাঁর প্রতিনিধিরা আর্য সমাজের প্রতিনিধি। সত্য ও ন্যায়ের আদর্শ, অপরপক্ষে রাবণ রাজা ও রাক্ষস সভ্যতা অনার্যদের প্রতীক।

“ধর্মেন লভতে সর্বং ধর্মসারমিদং জগৎ”

এই আর্য-অনার্য সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় জীবন ছাড়াও পরবর্তী কালীন যুগের সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রজীবনকে বাল্মীকি তাঁর অসামান্য তুলির টানে এক অনন্য সাধারণ মাত্রা দিয়েছেন। শুধুমাত্র রামচন্দ্রের গুণবত্তাই আমাদের আদর্শনীয় নয়, উপরন্তু সমস্ত রামায়ণ জুড়ে রয়েছে লক্ষ্মণের ভাতৃভক্তি, ভরতের ত্যাগ, সীতার পাতিব্রত্য এবং হনুমানের প্রভুভক্তি যা নাকি ভারতীয় সমাজজীবনকে বহুলাংশে প্রভাবিত করে। সীতার সতীত্ব ও পতিভক্তি যুগে যুগে ভারতীয় নারীর লক্ষ্মীশ্রীকে পবিত্রতা অনুসরণের পথ দেখিয়েছে। সতীত্বের আদর্শ তুলে ধরে বাল্মীকি বলেছেন-

“পতিৰ্হিদেবতা নাৰ্য্যাঃ পতিবন্ধঃ পতিগুরু।
প্রাণৈরপি প্রিয়ং তস্মাদভৰ্ত্তঃ কার্য্যং বিশেষতঃ”।।

ভারতীয় গৃহধর্মকে আজও পবিত্র করে রেখেছে। শুধুমাত্র সীতার পতিভক্তির আদর্শই নয় সমগ্র নারীজাতির আদর্শ কী হওয়া উচিৎ সে সম্বন্ধেও বাল্মীকি বহু কথা লিখেছেন। কৈকেয়ীর দুর্ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ দশরথ কটূক্তি করলে পরমূহূর্তে তা সংশোধন করে নিয়ে বলেন—

ধিগস্তু ঘোষিতো নাম শঠাঃ স্বার্থপরাঃ সদা।
ন ব্রবীমি স্ত্রিয়ঃ সর্বা ভরতস্যৈব মাতরম্।

আরো বলা হয়েছে—

অযোধ্যা- ১২.১০৩

ভর্তা তু খলু নারীনাং গুণবান্ নিৰ্গুণোঽপিবা।
ধর্মং বিমৃশমনানাং প্রত্যক্ষং দেবি দৈবতম্।।

অযোধ্যা-৬২.৮

অর্থাৎ পতি গুণবানই হোন বা নির্গুণই হোন না কেন, স্ত্রীলোকের তিনিই পরমদেবতা। হিন্দু নরনারীর এ-হেন শিক্ষা পরবর্তীকালের সমাজজীবনে স্পষ্টই প্রতিফলিত হয়।

রামায়ণের উচ্চ আদর্শগুলি আমাদের সমাজজীবনের ধ্রুবতারাস্বরূপ। যৌথ পারিবারিক শান্তির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল রামায়ণের গৃহ পরিবেশের আদর্শকে অনুসরণ করে। গৃহের কল্যাণময়ী রূপটিই যেন আমাদিগকে সমাজকল্যাণ তথা রাষ্ট্রকল্যাণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—”রামায়ণের প্রধান বিশেষত্ব এই যে তাহা ঘরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখিয়াছে।” পিতা- পুত্রে, ভ্রাতায়-ভ্রাতায়, স্বামী-স্ত্রীতে যে ধর্মীয় বন্ধন, প্রীতি ও ভক্তির বন্ধন সর্বোপরি পিতার প্রতি পুত্রের বশ্যতা, ভ্রাতার জন্য ভ্রাতার আত্মত্যাগ, প্রজাবর্গের প্রতি রাজার কর্তব্য যে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে রামায়ণ তাই দেখিয়েছে। রামায়ণে যেরূপে পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধন ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাই হল ভারতবর্ষের সমাজ জীবনের চিরকালীন ঐতিহ্য। যুগে যুগে, কালে কালে এই চিরন্তন আদর্শকেই ভারতীয় সমাজ জীবন নির্বিবাদে ধারণ করে আসছে। অযোধ্যাকাণ্ডের শততম অধ্যায়ে রামচন্দ্র ভ্রাতা ভরতের উদ্দেশ্যে যে সমস্ত প্রশ্ন করেছিলেন ভারতের রাজনীতি ও শাসনতন্ত্রের বিষয়ে অদ্যাবধি তা আদর্শস্থানীয়, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়। ভারতের রাষ্ট্রনায়কেরাও স্বাধীন ভারতে রামরাজ্যের অনুসরণেই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। প্রজারঞ্জনকারী রাজা রামচন্দ্রের প্রতি আবেগবশতঃ মহাত্মাগান্ধী প্রার্থনা সঙ্গীত গেয়েছিলেন ‘রঘুপতি রাঘব রাজারাম’—রাম-রাজত্ব বললে আমাদের পাঠক চিত্তে এমন এক রাজ্যের ছবি ভেসে ওঠে যেখানে প্রজাগণ মহাসুখে ও অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে পারস্পরিক কল্যাণ কামনায়। শষ্য শালিনী এক পৃথিবী আমাদের মানসপটে উঁকি মারে। সেখানে থাকে না কোন দস্যুভয়। মহর্ষি বাল্মীকি তাঁর রামায়ণে যেমন নিসর্গ প্রকৃতি ও সৌন্দর্য পিপাসাকে কল্পনার রসে জারিয়ে নিঁখুতভাবে পরিবেশন করেছেন ঠিক তেমনই তাঁর পাশাপাশি কঠিন বাস্তববোধ ও দৃঢ় সমাজ সচেতন দৃষ্টি ভঙ্গির পরিচয় দিয়ে প্রাচীন ও আধুনিক কালের মধ্যে এক মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছেন বলা যায়।

পরবর্তীকালের সাহিত্যে রামায়ণের প্রভাব :—ভবিষ্যৎ কালের কবি মানসের প্রধান উপজীব্য হবে মহর্ষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণ। এই ভবিষ্যদ্বানী স্বয়ং বাল্মীকি তাঁর বালকাণ্ডে বলেছেন— ‘পরং কবীনা শারম্।’ পরবর্তীকালে এমন কয়জন কবি আছেন যাঁরা রামায়ণকে কেন্দ্র করে সাহিত্য রচনা করেননি তা গুনে বলা দুস্কর। সেই হেতু ভারতীয় সাহিত্য পূর্ণমাত্রায় রামায়ণের প্রভাবে প্রভাবিত। রামায়ণের অমৃতবাণী, অমর কাহিনী ও রচনাশৈলী এই সবই পরবর্তী কবিগণকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে।

মহাকবি ব্যাসদেব রচিত মহাভারত অনেকাংশেই রামায়ণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। রামায়ণের মূল কাহিনীকে উপজীব্য করে ধর্মীয় ও দার্শনিক তত্ত্বপ্রধান বহু রামায়ণ রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে অদ্ভুত রামায়ণ, অধ্যাত্ম-রামায়ণ, যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ, আনন্দ রামায়ণ, তত্ত্বসংগ্রহ রামায়ণ, ভূশুন্ডি রামায়ণ, মন্ত্র রামায়ণ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। পুরাণ সাহিত্যও বহুলাংশে রামায়ণের দ্বারা প্রভাবিত। পদ্মপুরাণ, অগ্নিপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থেও রামায়ণের কথাই সাদরে গৃহীত হয়েছে।

সংস্কৃত মহাকবি ও নাট্যকারেরাও রামায়ণকে উপজীব্য করেই যশঃপ্রার্থী হয়েছেন। সংস্কৃত সাহিত্যের জগতে একচ্ছত্র সম্রাট কবিবর কালিদাস রামায়ণকে তাঁর কাব্য প্রতিভার আকরগ্রন্থ হিসাবে প্রার্থনা করে বিখ্যাত হয়ে আছেন—

“অথবা কৃতবাগারে বংশেঽস্মিন্ পূর্বসুরীভিঃ।
মনৌবজ্রসমুকীর্ণে সূত্রস্যেবাক্তি মে গতিঃ।। (রঘু ১/৪)

কেবল তাই নয়, বাল্মীকির রামায়ণকে কালিদাস ‘কবি প্রথম পদ্ধতি’ বলে বর্ণনা করেছেন। কালিদাসের রঘুবংশ নামক মহাকাব্যে বাল্মীকির প্রযুক্ত উপমা, প্রকৃতির বর্ণনা, শব্দের প্রয়োগ অবিকল গৃহীত হতে দেখা যায়। কিষ্কিন্ধা কাণ্ডের বসন্ত বর্ণনা কুমারসম্ভবের তৃতীয়সর্গের বসন্ত বর্ণনার সাথে হুবুহু মেলে। আবার অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‌ নাটকের অঙ্গুরীয় বৃত্তান্ত রামায়ণের সুন্দরকাণ্ডের হনুমানের মাধ্যমে সীতাকে প্রেরিত অঙ্গুরীয়ের কাহিনিকেই মনে করিয়ে দেয়। বিক্রমোর্বশীয় নাটকের চতুর্থ অঙ্কে পুরূরবার বিরহ বর্ণনায় রামচন্দ্রের সীতার নিমিত্ত বিলাপেরই প্রতিচ্ছবি পরিলক্ষিত হয়। মেঘদূত কাব্যেও কালিদাস বাল্মীকিকে পুরোপুরি অনুসরণ করেছেন বলা যায়।

কালিদাস পূর্ব যুগেও ভাসের প্রতিমা নাটক ও অভিষেক নাটকে রামায়নের কাহিনী স্পষ্টই লক্ষিত হয়। কালিদাসোত্তর যুগের বিখ্যাত নাট্যকার কবি ভবভূতির মহাবীর চরিত ও উত্তর রামচরিত নাটকের বিষয়বস্তুও রামায়ণ থেকে গৃহীত। তদ্ব্যতিরেকে ভর্তৃহরির ভট্টিকাব্য বা রাবণবধ, কুমারদাসের জানকীহরণ, মুরারির অনর্ঘরাঘব, ক্ষেমেন্দ্রের রামায়ণ মঞ্জুরী, রাজশেখর রচিত বালরামায়ণ নাটক, জয়দেবের প্রসন্নরাখব, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, ভোজরাজের চম্পুরামায়ণ এই সব সাহিত্য শোনামাত্রই রামায়ণের স্পষ্ট প্রতীতি জন্মে।

ভারতীয় বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষা সাহিত্যেও রামায়নের যথেষ্ট প্রভাব লক্ষিত হয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাংলার ঘরে ঘরে পঠিত ও পূজিত হয়ে আসছে। কবি মধুসুদনদত্তের লেখা ‘মেঘনাথ বধ’ কাব্যটি রামায়ণের কাছে বহুভাবে ঋণী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও রামায়ণকে অবলম্বন করে বহু কাব্য, নাটক রচনা করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বহুকবি যেমন দীনেশচন্দ্র সেন, রাজশেখর বসু, রাজকৃষ্ণ রায়, কালিপ্রসন্ন সিংহ, কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমুখ কখনও রামায়ণ থেকে বিষয় নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। আবার কখনও অনুবাদ সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করেছেন। এতো গেল বাংলা ভাষাভাষি মানুষের বা বঙ্গসংস্কৃতির প্রসঙ্গ, এছাড়াও রয়েছে ওড়িয়া, গুজরাতী, অসমিয়া, মারাঠী, হিন্দী, পাঞ্জাবী, তামিল ভাষায় ‘কম্বরামায়ণ’। নেপালী ভাষায় ভানুভক্তের নেপালী রামায়ণও প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। সর্বোপরি হিন্দীর তুলসীদাসের ‘রামচরিত মানস’ তো অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। রামায়ণ যাই হোক না কেন তা যুগে যুগে ভারতীয় গণের জীবন ও বিশ্বাসকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে, পৃথিবীর আর কোন সাহিত্য, আর কোনও জাতির উপর এমন প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়নি।১৬

বৌদ্ধ ও জৈন এই দুই সম্প্রদায়ের সাহিত্যের ধারাও একই ভাবে প্রবাহিত। পালিজাতকের জাতকখবন্ননা এবং সুত্তপিটকের খুনিকায় গ্রন্থের রামকথার সংক্ষিপ্ত রূপ দৃষ্ট হয়। জৈন সাহিত্যে সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় রচিত কয়েকটি বৃহৎ রচনা দৃষ্ট হয় যেগুলি এই রামকথার আধারেই রচিত। বিমলসুরির পউমচরিঅ, হেমচন্দ্রের ত্রিষষ্টিশলাকা পুরাণ নামক গ্রন্থ জৈনরামায়ণ নামে খ্যাতি লাভ করেছে। কারও কারও মতে বাল্মীকির রামায়ণই জৈন রামকথার প্রধান উৎস। আবার কেউ বা বলেন বৌদ্ধ ও জৈন রামকাহিনীগুলি বাল্মীকি রামায়ণের বিকৃতরূপ মাত্র। যেন ধর্মীয় উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আবার অন্যমতে বাল্মীকি রামায়ণ ছাড়া রামকথার অন্যান্য ধারাই বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। এরূপ ধারণা করা হয়।

শুধুমাত্র ভিন্ন সম্প্রদায়ই নয় ভারতকে অতিক্রম করে সমগ্র এশিয়ায় এই প্রাচীন ঐতিহ্য বহনকারী রামকথা প্রসারলাভ করেছে। চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, খোটান, ভারতের দীপপুঞ্জ সমূহ, তিব্বত, ব্রহ্মদেশ, ইন্দোচীন, সর্বত্রই লোকসাহিত্যের আঙ্গিকে রামকথার উপাখ্যান দৃষ্ট হয়। মালয়ী রচনা ‘চরিতরামায়নে’ বাল্মীকি রামায়নের প্রভাব দেখা গেলেও কিল দেশের সাহিত্যে কিন্তু তা অনুসৃত হয়নি। এরূপ বৈসাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও সমগ্র রামকথার মূল উৎস যে এক এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। এশিয়ায় বসবাসকারী বিভিন্ন ভাষাভাষি জাতীর প্রাচীন সাহিত্যে একমাত্র ‘রামকথাই’ সার্বজনীনত্বের দাবী রাখে। এক ও অদ্বিতীয় সাহিত্যকীর্তি হিসাবে রামকথা ‘এশিয়ার মহাকাব্য’ হয়ে সমগ্র এশিয়া ভূখণ্ডে সাহিত্য, লোকসাহিত্য, ধর্মীয় সাহিত্য এমনকি শিল্পকলা, স্থাপত্য, নৃত্য, গীত ও নাট্য সর্বক্ষেত্রেই অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছে।

রামায়ণের টীকা :—

প্রায় তিরিশটিরও অধিক সংখ্যক রামায়ণের টাঁকা রচিত হয়েছে। সবগুলিই যে গুণগত বিচারে উৎকৃষ্ট মানের এমন বলা যায় না, তবে কয়েকটি টীকা বেশ উল্লেখযোগ্য। কিছু টীকা অদ্যাবধি পুস্তক আকারে প্রকাশিত না হওয়ায় বিভিন্ন লাইব্রেরিতে পুঁথি হিসাবে সংরক্ষিত আছে। এই সমস্ত টীকাগুলির বেশিরভাগই ১২শ শতক থেকে ১৮শ শতকের মধ্যবর্তীকালে রচিত হয়েছিল। তন্মধ্যে যোগী মহেশ্বর তীর্থের রামায়ণ—তত্ত্বদীপিকা (নামান্তরে তীৰ্থায়) টীকা। রামানুজের রামানুজ টীকা। গোবিন্দরাজ কর্তৃক রচিত রামায়ণ ভূষণ। মাধবযোগীর রামায়ণকর্তব্য নামক টীকাটি ‘বেনারস ক্যুইন্স’ কলেজ লাইব্রেরিতে ও তাঞ্জোর লাইবেরিতে পুঁথি আকারে সংরক্ষিত রয়েছে। গোবিন্দরাজকৃত শৃঙ্গার তিলক নামক টীকাও বহু প্রাচীন। এ্যম্বকমুখীর ধর্মাকৃট বিখ্যাত। তিলটীকা শ্রেষ্ঠটীকা গুলির অন্যতম, যদিও এর রচনাকার কে? এই বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। ১৮শ শতকের শেষভাগে রচিত এই টীকা বিদগ্ধ ও প্রামান্য রচনা। এছাড়াও বহুটীকার নাম পাওয়া যায়। এই সব টীকার মধ্য দিয়ে রামায়ণের সারগর্ভ আলোচনা, চুলচেরা বিচার এর পাশাপাশি সর্বোপরি পাঠকগণের বোধগম্য হওয়ার পক্ষে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এসেছে।

পাদটীকা – রামায়ণ

১. মহাভারতের আস্তিকপর্বের মূল হল এই সুপর্ণাখ্যান।

২. কাং চ পঞ্চমং বেদ্য যন্মহাভারতং স্মৃতম্-ভবিষ্যপুরাণ ‘ইতিহাসং পুরাণং পঞ্চমং বেদানাম্ বেদম্‌-ছা.উ.৭.১.২.

৩. রামায়ণ ৭।৮৫। ১৯; ৭।১৩২৮ (অতিরিক্ত পাঠ); ৭।৮৭।১৭

৪. শান্তি পর্ব (৫৩।৫৪)

৫. বাল্মীকিরাদৌ চ সসর্জ পদ্যং জগ্রন্থ যন্ন চ্যবনো মহর্ষিঃ। চিকিৎসিতং যচ্চ চকার নাত্রিঃ পশ্চাত্তদাত্রেয় ঋষিজগাদ। বুদ্ধচরিত ১।৪৩

৬. ইত্যার্ষে শ্রীমদ্-রামায়ণে বাল্মীকিয়ে আদিকাব্যে। রামায়ণ পুষ্পিকা।

৭. বালকাণ্ড। ২৪০।

৮. কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ ও প্যারিস সংস্করণ।

৯. দয়ানন্দ মহাবিদ্যালয়, লাহোর সংস্করণ।

১০. নির্ণয় সাগর প্রেস, বোম্বাই এবং গুজরাটি প্রিন্টিং প্রেস, বোম্বাই সংস্করণ। ১১. “সর্বাপূর্বামিয়ং যেষামাসীৎ কৃৎস্না বসুন্ধরা। প্রজাপতিমুপাদায় নৃপানা জয়শালিনাম্”।। (বাল, ১)

১২. বালকাণ্ডের প্রথমসর্গের ৮৯, ৯০ নং শ্লোক অনুযায়ী।

১৩. A. F. weber, on the Ramayana, P.II.R.T.Telang, was Ramayana copied from Homer? M.M.Williams, Indian wis dom P. ৩১৬ দ্রষ্টব্য।

১৪. ‘সীতা’ও ‘হলভৃৎ’ এই দুই নামের সাদৃশ্য দেখেই Weber অনুমান করেছেন – ‘She accordingly represents Aryan husbandry, which has to be protected by Rama-whom I regard-as originality identical with Balaram, ‘halabhrit, “the plough-bearer”, though the two were after wards separated-against the attacks of the predatory aborigines.”-on the Ramayana (Boyd’s transla- tion, Indian Antiquary. I.-১২০ff).

১৫. “It has become the property of the whole Indian people, and as fearcely and other poem in Literature of the world, has influ- enced the thought and poetry of a great nation for centuries.

১৬. সাহিত্যদর্পণে বলা হয়েছে—’রামাদিবৎ প্রবর্তিতব্যং, ন রাবণাদিবৎ, ইত্যাদি— কৃত্যাকৃত্য-প্রবৃত্তি-নিবৃত্ত্যুপদেশ দ্বারেণ সুপ্রতীতৈব।’

মহাভারত

মহাভারতের গৌরব :—

রামায়ণ ও মহাভারতের ভূমিকা প্রসঙ্গে আমরা এই দুই মহাকাব্যের আবির্ভাব ও তার উৎস সন্ধান করেছি। প্রসঙ্গক্রমে আমরা দেখেছি যেহেতু যুগে যুগে বীর্য গাথাগুলি সর্বসাধারণের সম্পদ স্বরূপ সেহেতু তার সংযোজন পরিধবন ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোন বাধা ছিল না। মহাভারতও সেইরূপ ত্রুটিমুক্ত নহে। বিশালকায় এই মহাকাব্য বিষয়বস্তুর গুরুভারে সত্যই যেন মহান্

‘যদি হাস্তি তদন্যএ যন্নেহাস্তি ন তৎ ক্বচিৎ।’ (আদিপর্ব, ৬২, ৩৫) ‘যাহা নাই ভারতে, তাহা নাই ভারতে।’ এই উক্তিটি নিঃসন্দেহে, সার্থক। মহাভারতের পরিচয় প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘ভারত সংহিতা’ রূপ পঞ্চমবেদ-ই হল মহাভারত। কারণ বৈশম্পায়ণ যথার্থই বলেছিলেন—’ধর্মে চার্থে চ কামে চ মোক্ষে চ ভরতর্ষভ’। অর্থাৎ ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের সর্বপ্রকারতত্ত্ব, সামাজিক ন্যায়নীতি, বিধি-বিধান, ইতিহাস- পুরাণ, কিংবদন্তী, আখ্যান, উপাখ্যান, লোকবিদ্যা, প্রবাদ-প্রবচন, সর্বাঙ্গিন চিন্তাধারা ও সর্বকালের মননের এক বিচিত্র সমাবেশ ঘটেছে এই মহাভারতে। তাই এ হল আমাদের পঞ্চমবেদ। এই বেদে স্ত্রী, পুরুষ কেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে “নকলের অবাধ প্রবেশ। বিশেষতঃ সকল উপনিষদের সারমর্ম্ম ও সকলদর্শনের সামঞ্জস্য কেবল মাত্র গীতাধ্যায়ে সন্নিবেশিত হওয়ায় মহাভারত একাধারে সকল, সাহিত্যের আধার। Winternitz বলেছেন- ‘a whole literature-একটি সামাগ্রিক সাহিত্য।” মহর্ষি বেদব্যাস বলেছেন-

“অর্থ শাস্ত্রমিদং প্রোক্তং ধৰ্ম্মশাস্ত্রমিদং মহৎ।
কামশাস্ত্রমিদং প্রোক্তং ব্যাসেনামিতবুদ্ধিনা।। ১।২।৩৮

মহাভারতকে বাদ দিয়ে ভারতবর্ষকে সঠিকরূপে কল্পনা করা যায় না। ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, ও মোক্ষ শাস্ত্রের অতএব সকল শাস্ত্রেরই যেন সমন্বয় দেখতে পাওয়া যায় এই মহাভারতে। মহাভারতকে যদি দর্পণ বলে কল্পনা করা হয় তবে সমগ্র ভারতবর্ষের সভ্যতা সংস্কৃতিই যেন সেই দর্পণে প্রতিফলিত হয়। মহাভারতের জয় কেবলমাত্র রাজ্য জয় ও নৃপতিগণের যুদ্ধ জয়েই সীমাবদ্ধ নয়। এই জয় হল পূণ্যের জয়, পাপের ক্ষয়। যেখানে ধর্ম রক্ষিত হয়েছে সেখানেই জয় বা কল্যাণ সূচিত হয়েছে। অর্থাৎ ‘যথাধর্মস্তথা জয়ঃ’। ভারতবর্ষ চিরকালই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই তার বক্ষে স্থান দিয়েছে। ফলে নানা বৈচিত্র্য, নানান বিভেদ ও অনৈক্য থাকা স্বাভাবিক কিন্তু এত বৈচিত্র্যের মধ্যেও যে মিলনের সুর বাজে, ঐক্যের সুর বাজে তাই হল ভারতের চিরন্তন সাধনা। বিভেদের মাঝে ঐক্য। বিবিধের মাঝে মহামিলন এই হলো মহাভারতের বাণী, তার শিক্ষা। একথা ভুলে গেলে চলবে না।

‘মহত্ত্বাদ ভারবত্ত্বাচ্চ মহাভারতমুচ্যতে।’ (আদিপর্ব, ১, ১৭৪)। একাধারে মহত্ত্ব ও ভারবত্ত্বে অপৌরুষেয় সমগ্র বৈদিক সাহিত্যের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর বলেই মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত এই লক্ষশ্লোকাত্মক আর্য মহাকাব্যটি মহাভারত নামে প্রসিদ্ধ। জীবনের রহস্য কি? জীবনের পরিণতিই বা কি? এই প্রশ্নের উত্তর যুগে যুগে ভারতীয় ঋষিগণ তাঁদের মননের মধ্য দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কখনও দর্শনের মধ্য দিয়ে, কখনও বেদের সারমর্মে কখনও বা সাহিত্যের হাত ধরে মহর্ষিগণ সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রয়াসী হয়েছেন। মহাভারত হল ভারতীয়দের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার অতুলনীয় আকর গ্রন্থ স্বরূপ, Annie Besant বলেছেন- “The Mahabharata is the greatest poem in the whole world. There is no other poem so splendid as this, so full us to study. “ যুগে যুগে মহাভারতের এ-হেন গৌরব সমগ্র ভারতবাসীকে গৌরবান্বিত করেছে নানাভাবে এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই।

মহাভারতের রচনাকার :——মহাভারত’ নামক মহাকাব্যের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। বেদের মন্ত্র সমূহের সংকলক, ও বেদের বিভাজন কর্তা বলে তাঁর নাম হয়েছিল ‘বেদব্যাস’।” দেহ কৃষ্ণবর্ণ ছিল বলে কৃষ্ণ। পুরাবৃত্ত অনুযায়ী তিনি পরাশর মুনি ও সত্যবতীর সন্তান। যমুনার দ্বীপে জন্ম হেতু ‘দ্বৈপায়ন।’ মহাভারতের আদিপর্ব অনুযায়ী মহর্ষি বেদব্যাস তিন বৎসর যাবৎ কঠোর পরিশ্রম করে এই মহাভারত লিখেছিলেন। এবং তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে সম্পূর্ণ মহাভারতের কাহিনী শুনিয়েছিলেন। রামায়ণ রচনাকার বাল্মীকি যেরূপ নিজেই এক বিশেষ চরিত্র এবং মূল ঘটনার সাথে জড়িত, তেমনি মহাভারত রচনাকার ব্যাসও ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের পিতা। তাঁর জীবন চরিত সেইভাবে জানা যায় না। বরঞ্চ বলা যায় তিনিও-বাল্মীকির মতই এক রহস্যময় অজ্ঞাতপুরুষ ছিলেন।

মহাভারতের পর্বভাগ ও সংস্করণ :—ভিনসেন্ট স্মিথের মত অনুযায়ী পাণিনি খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে বিদ্যমান ছিলেন। এবং পাণিনি ব্যাকরনের পূর্ব্বেই মহাভারতের মূল অংশ রচিত হয় বলে অসন্দিগ্ধ প্রমাণ রয়েছে। মহাভারতের মূল অংশ বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পূর্বে রচিত হলে কাল-ক্রমে তা পরিবর্তন ও পরিবর্দ্ধনের কারণে বর্তমান আকার ধারণ করেছে। সেইহেতু মহাভারতের তিনটি পৃথকস্তর রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। বর্তমানে আমাদের হাতে যে মহাভারত রয়েছে তাতে লক্ষাধিক শ্লোক পাওয়া যায়। কিন্তু আদিপর্বে স্পষ্টই উল্লিখিত রয়েছে যে মহাভারতে মোট ৮৮০০ শ্লোক ছিল।

অষ্টৌশ্লোকসহস্রাণি অষ্টৌ শ্লোকশতানি চ।
অহং বেস্মি শুকো বেত্তি সঞ্জয়ো বেত্তি বা ন বা।। ১।১।৮১

দ্বিতীয় স্তরে ২৪০০ শ্লোক ছিল। এর সাপেক্ষে বলা যায়-

“উপাখ্যাণৈঃ সহজ্ঞেয়মাদ্যং ভারতমুত্তমম্।
চতুর্বিংশতি সাহস্ৰীং চক্রে ভারতসংহিতাম্॥ ১।১।১০২

সর্বশেষ স্তর অনুযায়ী বর্তমান মহাভারতে এক লক্ষ শ্লোক প্রাপ্ত হয়। “একশত সহস্ৰস্তু মানুষেষু প্রতিষ্ঠিতম্ ১।১।১০৭ আদি পর্বের ভূমিকায় উক্ত হয়েছে যে প্রথমে বদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারতের কাহিনী শোনান। অতঃপর বৈশম্পায়ন জনমেজয়ের নাগযজ্ঞে জনমেজয়কে পূৰ্বশ্ৰুত কাহিনী শোনান। এবং শেষ লোমহর্ষের পুত্র সৌতি শৌনকাদি ঋষিগণকে সেই কাহিনী শোনান। এবং সেই তৃতীয়বারে বিবৃত কাহিনীই লোকসমাজে প্রচলিত হয়। অনেকের মতে আবার এই স্তর ভেদ অমূলক। তাঁরা মনে করেন ৮৮০০ শ্লোক কূট শ্লোক বা ব্যাসকূট বলে পরিচিত ছিল। বাকি ২৪০০০ শ্লোকে মূল কাহিনী বিবৃত হয়েছে। ভূমিকা থেকে একথাও জানা যায় যে—বেদব্যাস স্বয়ং তাঁর পাঁচজন শিষ্য যথাক্রমে সুমন্ত, জৈমিনি, পৈল, বৈশম্পায়ন ও পুত্র শুককে মহাভারত পাঠ ও আবৃত্তি শিক্ষা করালে শিক্ষা শেষে তাঁরা সকলেই পৃথক পৃথক মহাভারত রচনা করেন। অতএব নানাভাবে মূল মহাভারতের সাথে প্রক্ষিপ্ত অংশ যুক্ত হয়ে বর্তমান মহাভারত আমাদের হাতে এসেছে।

রামায়ণের মতো মহাভারতেরও প্রাদেশিক পাঠ ও সংস্করণ বর্তমান। বঙ্গীয় পাঠের সাথে বোম্বাই প্রদেশের পাঠের বিশেষ কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। তবে বোম্বাই প্রাদেশিক পাঠই শুদ্ধ বলে অধিক গৃহীত। দাক্ষিণাত্যের তেলেগু পাঠের সাথে এর যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে তবে মূল বিষয় বস্তুর সামঞ্জস্য অবশ্যই বিদ্যমান। মহাভারতে উল্লিখিত শ্লোক সংখ্যার থেকে বোম্বাই সংস্করণে বেশ কিছু শ্লোক বেশী দৃষ্ট হয়। মহাভারতে উল্লিখিত রয়েছে মোট আঠারটি পর্ব এবং খিল (হরিবংশ) মিলিয়ে মোট ১৯২৩টি অধ্যায় এবং শ্লোকসংখ্যা ৯৬,৮৫৩টি কিন্তু বোম্বাই সংস্করণে পাওয়া যায় ২১১১টি অধ্যায়ে মোট ১১০, ৯০৬টি শ্লোক। মহাভারতের মোট ১৮টি পর্ব যথাক্রমে—(১) আদিপর্ব, (২) সভাপর্ব, (৩) বনপর্ব, (৪) বিরাটপর্ব, (৫) উদ্যোগপর্ব, (৬) ভীষ্মপর্ব, (৭) দ্রোণপর্ব, (৮) কর্ণপর্ব, (৯) শল্যপর্ব (১০) সৌপ্তিকপর্ব (১১) স্ত্রীপর্ব, (১২) শান্তিপর্ব, (১৩) অনুশাসনপর্ব, (১৪) অশ্বমেধপর্ব, (১৫) আশ্রমিকপর্ব, (১৬) মৌষলপর্ব, (১৭) মহাপ্রস্থানিকপর্ব, (১৮) স্বর্গারোহণপর্ব।

মহাভারতের কাহিনী সংক্ষেপ :—মহাভারতের মূল কাহিনীটি হলো—পাণ্ডব ও কৌরবদের পারস্পরিক কলহ এবং কুরুক্ষেত্র প্রাঙ্গণে দূর্ধর্ষ সংগ্রাম। এই পারিবারিক যুদ্ধ কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে প্রাচীন ভারতের পুরাবৃত্ত, রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস, সাহিত্য, ধর্ম ও দর্শনের বিষয়।

আদিপর্বে মহাভারত রচনার প্রাসঙ্গিকতা, কৌরব ও পাণ্ডব বংশের ইতিহাস। কৌরব ও পাণ্ডবদের বাল্য শিক্ষা থেকে শুরু করে খাণ্ডবদাহন পর্যন্ত। ভরতবংশীয় শান্তনু নামে এক রাজা ছিলেন। শান্তনু গঙ্গাকে বিবাহ করেন। এই গঙ্গার গর্ভে দেবব্রত নামে এক পুত্র সন্তান জন্মে, পরবর্তী কালে তার নাম হয় ভীষ্ম। সত্যবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে শান্তনু তাকে বিবাহ করলেন এবং তার গর্ভে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়। এদিকে অনুঢ়া অবস্থায় ঋষি পরাশর-এর দ্বারা সত্যবতীর গর্ভে ব্যাসের জন্ম হয়। অল্পকাল মধ্যেই চিত্রাঙ্গদের মৃত্যু হয়। এবং ভীষ্ম হস্তিনাপুরের সিংহাসনের দাবী ত্যাগ করে চিরকাল অবিবাহিত থাকার প্রতিজ্ঞা করেন। ভীষ্ম তখন বিচিত্রবীর্যকেই রাজা করলেন। বিচিত্রবীর্যের ছিল দুই স্ত্রী, অম্বিকা ও অম্বালিকা। বিচিত্রবীর্য অপুত্রক বা নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে সত্যবতী ও ভীষ্মের পরামর্শে দুই রাণীর গর্ভে ব্যাসের ঔরসে জন্ম নিল দুই পুত্র, অম্বিকার পুত্র ধৃতরাষ্ট্র ও অম্বালিকার পুত্র পাণ্ডু এবং অম্বিকার দাসীর গর্ভে জন্ম নেয়-মহামতী বিদুর।

ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন বলে পাণ্ডু রাজ সিংহাসনে বসে হস্তিনাপুরের রাজা হলেন। ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধার রাজের কন্যা গান্ধারী তিনি ছিলেন শতপুত্রের জননী যেমন দুর্যোধন ও দুঃশাসন এবং দুঃশলা নামে এক কন্যা। পাণ্ডুর ছিল দুই পত্নী, যাদববংশীয় কন্যা কুম্ভী ও মদ্রদেশের রাজকুমারী মাদ্রী, রাজা হয়ে পাণ্ডু নানাদেশ জয় করে প্রচুর ধনসম্পদ লাভ করেন এবং দুই পত্নীসহ বানপ্রস্থে যাত্রা করেন। তথায় কুন্তীর গর্ভে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন এবং মাদ্রীর যমজ পুত্র নকুল ও সহদেব।” কুমারী অবস্থায় সূর্যের দ্বারা কুন্তীর আরেক সন্তান হয়। জন্মাবোধী দাতা কর্ণ মাতাকর্তৃক পরিত্যক্ত ছিলেন।

পাণ্ডুর আকস্মিক মৃত্যু হলে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রই তখন রাজ্য শাসন করতে থাকেন। পাণ্ডুর সাথে মাদ্রীরও সহমরণ হয়। কুম্ভী তখন পঞ্চপাণ্ডবকে সঙ্গে নিয়ে হস্তীনাপুরে আসেন। দুর্যোধনেদের সাথে পাণ্ডু পুত্র গণও শিক্ষাদীক্ষা ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন। তাদের সাথে সাথে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থমা ও সুতপুত্র কর্ণও যোগ দিল।

অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র অগ্রজ যুধিষ্ঠিরের হাতেই রাজ্যভার তুলে দিলেন। পঞ্চপাণ্ডবদের কৃতিত্ব দেখে নিজ সন্তানদের ভবিষ্যৎ আশঙ্কায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন। দূর্যোধন তার মামা শকুনি ও কর্ণের পরামর্শে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদেরকে জব্দ করার জন্যে বারণাবতে পাঠালেন। সেখানে জতুগৃহ তৈরী করে পাণ্ডবদের অগ্নিদগ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু কৌরবদের এই জঘন্য অভিসন্ধির কথা পূর্বে বিদূর পাণ্ডবদের জানিয়ে দিলে পাণ্ডবেরা বুদ্ধি করে আত্মরক্ষা করলেন। নিজেরাই সেই প্রাসাদে অগ্নিসংযোগ করে পাঁচভাই মাতা কুন্তীকে নিয়ে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন এবং দুঃখ কষ্টে দিন কাটাতে লাগলেন। এদিকে কৌরবরা ভাবলেন পাণ্ডবেরা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে। ধৃতরাষ্ট্র গভীর শোকে নিমজ্জিত হলেন এমন কি মৃত আত্মাদের শান্তি কামনায় শ্রাদ্ধাদিও করা হল।

বনবাসে থাকা কালীন ভীম হিড়িম্বাকে বিবাহ করে। পাণ্ডবেরা ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পাঞ্চাল রাজ্যে প্রবেশ করলে সেখানে তখন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ তাঁর কন্যা দ্রৌপদী কৃষ্ণার স্বয়ংবর সভার আয়োজন করেছেন। কর্ণ সেখানে উপস্থিত হয়ে লক্ষ্যভেদ করতে উদ্যত হলে সূত পুত্র বলে লাঞ্ছিত হন। অতঃপর ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে জয় করেন। দ্রৌপদীকে সাথে নিয়ে পাঞ্চপাণ্ডব কুটীরে প্রবেশ করলে মাতা কুন্তীর নির্দেশ অনুযায়ী পাঁচ ভাইয়ের সাথে পাঞ্চালীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু ছদ্মবেশী পঞ্চপাণ্ডবকে চিনে ফেলেন এবং এই সমস্ত ঘটনার ফলে সকলেই অবগত হলেন যে পঞ্চপাণ্ডব ও মাতা কুম্ভী জীবিত আছেন।

পঞ্চপাণ্ডবদের সাথে দ্রুপদ, যাদব ও পাঞ্চালদের সুসম্পর্ক দুর্যোধনকে ভাবিয়ে তুলল। পুনরায় নানা কূটকৌশল করে পাণ্ডবদের প্রতারণা করতে উদ্যত হলে ভীষ্ম বাদ সাধলেন। তাঁর মতে তাঁদের প্রাপ্য রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে তাঁদের সাথে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণের দ্বারা হৃত ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হোক। ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য ভাগ করে দিলে খাণ্ডবপ্রস্থ নির্দিষ্ট হল পাণ্ডবদের জন্য। সেই একান্ত অনুর্বর খাণ্ডব প্রস্থই পাণ্ডবদের পবিত্রতায় শষ্যশ্যামলা হয়ে উঠল। রাজধানী হল ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ। অর্জুন নানা দেশ জয় করে প্রচুর ধনরত্ন ও সম্পদের অধিকারী হলেন। রাজসূয় যজ্ঞ করে যুধিষ্ঠির সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক মানণীয় রাজারূপে গণ্য হলেন। পাণ্ডবদের এহেন গৌরবই কাল হল।

সভাপর্বে দেখি দুর্যোধন তাদের উন্নতি সহ্য করতে না পেরে মাতুল শকুনির কুপরামর্শে পাশা খেলায় যুধিষ্ঠিরকে আহ্বান জানালেন। যুধিষ্ঠির সমগ্র রাজ্য সহ ভাইদের সাথে দ্রৌপদীকে পাশা খেলায় পণ রাখলেন এবং শকুনির কপট পাশায় পরাজিত হয়ে সর্বস্বান্ত হলেন। দুঃশাসন কুলবধূ দ্রৌপদীকে সভামধ্যে টেনে এনে যার পর নাই অপমানিত ও লাঞ্ছিত করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সেবারের মত রাজ্য ফিরে পেল পাণ্ডবেরা। দ্বিতীয়বার দ্যূতক্রীড়ার আয়োজন হলে পণ রইল বিজিতদের বারো বৎসরের জন্য বনবাসে যেতে হবে এবং একবৎসর অজ্ঞাতবাসে থাকতে হবে। পুনরায় পাণ্ডবদের পরাজয় ঘটল এবং পূর্বশর্তানুসারে দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে বনবাসে যেতে হল। কুম্ভী থাকলেন বিদূরের কাছে।

পাণ্ডবেরা এদিকে কাম্যক ও দ্বৈতবনে বারো বৎসর অতিবাহিত করে বিরাটরাজার সভায় ছদ্মবেশে অজ্ঞাত-বাসে কাটালেন। বনপর্বে বনবাসের বিবরণ এবং অর্জুনের দিব্যাস্ত্র সংগ্রহের কাহিনী উল্লিখিত হয়েছে। এবং বিরাট রাজার রাজ্যে ছদ্মবেশে থাকাকালীন কৌরবগণ গোধন হরণ করার ছল করে বিরাট রাজ্য আক্রমণ করেন। যুদ্ধে পাণ্ডবেরা বিরাট রাজার পক্ষ নেয় এবং কৌরবরা পরাজিত হয়। পাণ্ডবগণের পরিচয় তখন আর কারুর অবিদিত নয়। এই কাহিনীই মহাভারতের বিরাট পর্ব। ইতি মধ্যে বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের সাথে পরামর্শ করে দূর্যোধনকে অনুরোধ করেছিলেন পাণ্ডবদের ফিরিয়ে এনে শান্তিরক্ষা করতে কিন্তু দুর্যোধন তাতে কর্ণপাতও করেননি। এই তেরো বৎসর বনবাসে ও অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন পাণ্ডবেরা প্রভূত শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন। শৌর্যে-বীর্যে বলীয়ান হয়ে দেশে ফিরে তারা রাজ্য ফিরে পেতে চাইলে কৃষ্ণ যদিও পাঁচ ভাইকে মাত্র পাঁচ খানা গ্রাম দিতে চাইলেন। দূর্যোধন বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীও দিতে রাজী হলেন না। অতএব যুদ্ধ অনিবার্য। উভয়পক্ষের যুদ্ধের যে আয়োজন তাই হল উদ্যোগ পর্ব।

কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গণে আয়োজন সম্পূর্ণ হলে ভীষণ যুদ্ধের গগনভেদী দামামা বেজে উঠল। ভারতের রাজন্যবর্গ সকলেই কোন না কোন পক্ষে যোগ দিলেন। পাণ্ডবদের সোনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং কৌরবদের সেনাপতি স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম। দীর্ঘ আঠারো দিনব্যাপী—এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সকলে প্রত্যক্ষ করে ছিল। ভীষ্মের নেতৃত্বে যুদ্ধ ভীষ্মপর্ব। ভীষ্ম দশ দিন যুদ্ধ করে অতঃপর শরশয্যায় ইচ্ছা মৃত্যু বরণ করলেন এবং মৃত্যুর পূর্ব মূহর্তে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার অনুরোধ জানালে দূর্যোধন তা নাকচ করেছেন। অতঃপর দ্রোণাচার্যের নেতৃত্বে যুদ্ধ আরম্ভ হলো, তাই দ্রোণপর্ব নামে পরিচিত।

অর্জুন পুত্র অভিমন্যু কৌরবদের হাতে নিহত হলেন। ভীষ্মপুত্র ঘটোৎকচ কর্ণের দ্বারা নিহত হলেন। পঞ্চদশ দিবসে দ্রুপদ ও বিরাট নিহত হলেন দ্রোণের শরাঘাতে। দূর্যোধন অন্যত্র পলায়ন করলে ভীম তাকে খুঁজে বার করে গদাযুদ্ধে ভূপতিত করেন। পুত্রের মৃত্যুসংবাদ রটনার সাথে সাথে দ্রোণাচার্য শোকে বিহ্বল হয়ে অস্ত্রত্যাগ করেন ও মৃত্যুমুখে পতিত হন। অতঃপর কর্ণের নেতৃত্বে যুদ্ধ চলে তাই কর্ণ পর্বের কাহিনী। কর্ণের রথের চাকা বিকল হয়ে পড়ায় তাঁরও মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে। এইভাবে শল্যপর্বে দেখি অষ্টাদশ দিবসে যুধিষ্ঠিরের হাতে শল্যও নিহত হলে এবং ভীমের হাতে গদাযুদ্ধে ঊরুভঙ্গ বশতঃ দূর্যোধন নিহত হলে যুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধ শেষে কৌরবরা ঘোরতর ভাবে পরাজিত হয় পাণ্ডবদের নিকট। কৌরবপক্ষের মাত্র তিনজন যোদ্ধা ছাড়া সকলেই নিহত। সর্বত্র শোকের কালোছায়া যেন সকলকে গ্রাস করছে। সঞ্জয় ও বিদুর উভয়ে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। এমন সময় ব্যাস উপস্থিত হলে তিনিও শোকাতুর বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে বহু সান্ত্বনা বাক্য বললেন। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে সান্ত্বনা দিতে যুধিষ্ঠির পূর্বেই কৃষ্ণকে হস্তিনাপুরে পাঠিয়েছিলেন। মৃতদেহ সৎকারের সকল ব্যবস্থাই হল যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে।

এদিকে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থমা পাণ্ডবদের শিবিরে প্রবেশ করে পিতৃহন্তা ধৃষ্টদ্যুম্নকে ও ভুলক্রমে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রকে হত্যা করেন। এই ঘটনার ফলস্বরূপ তিনি পাণ্ডব-কর্তৃক নিগৃহীত হলেন। এইভাবে সৌপ্তিকপর্ব শেষ হল।

সৌপ্তিকপর্বের শেষে স্ত্রীপর্ব কুরুক্ষেত্র সমরাঙ্গণে একে একে নিহত সকল পুত্ৰ ও আত্মীয় পরিজনের প্রতি গান্ধারীর বিলাপ বর্ণিত হয়েছে। গান্ধারী কৌরবদের স্ত্রীদেরকে সাথে করে শ্মশানভূমিতে আসেন। শোকসন্তপ্ত সকলের-করুণ হাহাকারে শ্মশানভূমির আকাশ বাতাস আন্দোলিত হয়ে উঠল।

শোক সন্তপ্ত যুধিষ্ঠিরের সান্ত্বনার জন্য ব্যাসদেবের উপস্থিতিতে ভীষ্মের শরশয্যা- কালীন উপদেশের কথা শোনান হয় এই শান্তি পর্বে। এই প্রসঙ্গে রাজধর্মের বিবিধ আলোচনা দৃষ্ট হয়। অনুশাসন পর্বে ভীষ্মকর্তৃক যুধিষ্ঠিরকে প্রদত্ত রাজধর্ম, আপদ্‌ধর্ম, ধর্মশাস্ত্রের নীতি ও মোক্ষ-ধর্মের উপদেশ বর্ণিত হয়েছে।

জ্ঞাতি যুদ্ধের ভয়ঙ্কর ও শোচনীয় পরিনামে যখন যুধিষ্ঠির বিষাদাচ্ছন্ন অবস্থায়, তখন তিনি সন্ন্যাস গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এবং কৃষ্ণ ও অন্যান্য ভাইদের পরামর্শে তিনি রাজ সিংহাসন গ্রহণ করতে রাজী না হওয়ায় ব্যাসের মধ্যস্থতায় অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করা হল। এই আশ্বমেধিক পর্বে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের বিবরণ ছাড়াও উত্তরার গর্ভে অর্জুনের পৌত্র পরীক্ষিতের জন্ম বৃত্তান্ত রয়েছে। অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব নিয়ে অর্জুন বার হলেন দিগ্বিজয়ে। বহু রাজাই তার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। প্রচুর রাজ্যজয় করে বহু ধনসম্পদ নিয়ে তিনি ফিরে আসেন। যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের পরামর্শ অনুযায়ী দীর্ঘ পনের বৎসর সুখে শান্তিতে রাজত্ব চালাতে থাকলেন। যুধিষ্ঠির ও পুত্রহারা বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর শেষ জীবনে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে সেবা যত্ন করেছিলেন।

অতঃপর ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, সঞ্জয় ও বিদুর সন্ন্যাসী হয়ে বনবাসে গমন করলেন। এবং বছর দুই পরে পাণ্ডবদের কাছে খবর আসে যে তারা বনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এই ঘটনাই আশ্রমবাসিক পর্বের বিষয়বস্তু।

মৌষলপর্বে আত্মঘাতীযুদ্ধে মুষল দ্বারা যদুবংশের ধ্বংস এবং শ্রীকৃষ্ণের আকস্মিক মৃত্যুর কথা বর্ণিত হয়েছে।

কুরুক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দুঃখশোক কোনভাবেই পাণ্ডবদের মন থেকে অপসৃত না হওয়ায় তারা সুখে শান্তিতে রাজত্ব করতে পারছেন না, সেইহেতু মহাপ্রস্থানের আয়োজন করা হল। পরীক্ষিতের হাতে রাজ্যভার সমর্পণ করে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী হিমালয়ের অভিমুখে রওনা হলেন। আর সঙ্গী ছিল একটি কুকুর। মহাপ্রস্থানিক পর্বে মহাপ্রস্থানের পথে যেতে যেতে একে একে দ্রৌপদী, সহদেব, নকুল, ভীম ও অর্জুন পতিত হলে একা যুধিষ্ঠির কুকুরটিকে সঙ্গী করে এগিয়ে চললেন।

সঙ্গী-কুকুরটি স্বয়ং ধর্মরূপে আত্মপ্রকাশ করলে ইন্দ্রের উপস্থিতিতে ও সহায়তায় যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহন হল। কিন্তু ইন্দ্রের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্বর্গে গিয়ে স্ত্রী ও ভাইদের না দেখতে পেয়ে যুধিষ্ঠির পুনরায় নরকে ফিরে এলেন। সেখানে অন্যান্য বহুলোকের সাথে স্ত্রী ও ভ্রাতাদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট আর্তনাদ শুনে তাঁর মন বিচলিত হয়ে উঠল। তখন তাঁর মন থেকে স্বর্গ বাসের আকাঙ্খা লোপ পেল। তিনি তাদের সাথে একত্রে নরকে বাস করতে থাকলে দেব কৃপায় পুত্র ও ভ্রাতাগণ সহ তাঁর স্বর্গের পথ প্রশস্ত হয়। স্বর্গারোহন পর্বে এইরূপ ঘটনা বিবৃত হয়েছে। এইরূপই মহাভারতের মূল ঘটনার সংক্ষিপ্ত পরিচয়।

অন্যান্য কাহিনী — হিমালয় থেকে নির্গত হয়ে যেরূপ অসংখ্য নদ-নদী সমুদ্রে গিয়ে মিলেছে, তদনুরূপই মহাভারতরূপ মহাসমুদ্রের মূল ঘটনা প্রবাহে কত শত গল্প, গাথা, কাহিনী, আখ্যান, উপাখ্যান, অতিকথা, লোকবৃত্ত, ধর্মীয় সাহিত্য ও দার্শনিক তত্ত্ব যে বয়ে চলেছে তার হিসাব করা দুরূহ। আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি তৎকালীন সূতজাতির কাজই ছিল প্রাচীন ভারতীয় রাজরাজাদের বীরত্বের কথা প্রচার করা, বংশ তালিকা প্রণয়ন করা। ব্রাহ্মণ্য প্রভাবিত অংশগুলি প্রধানতঃ ধর্মীয় সাহিত্য। রামায়ণ ও মহাভারত উভয় মহাকাব্যই সেযুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রচারের পথে বাহন স্বরূপ ছিল। কেবল ব্রাহ্মণ্যই নয় শ্রমণ, ভিক্ষু, আরণ্যক, বৌদ্ধ, জৈন ও মতি প্রভৃতিরা এই দুই মহাকাব্যকে তাদের জনপ্রিয়তা হেতুই নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার রূপে গ্রহণ করেছিলেন। এই কারণে মহাভারত-আকার আকৃতিতে বৃহত্তম সাহিত্য কীর্তি। শুধুমাত্র ধর্মপ্রচারই নয়, ত্যাগ, মৈত্রী, শান্তি, অহিংসা জাগতিক অনাসক্তি ও ধর্ম নীতিও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবেই মূল ঘটনা স্রোতে মিশে গিয়েছে।

মহাভারত মূলতঃ তিন প্রকার রচনার সংমিশ্রণে সমৃদ্ধ। Bard poetry (স্রৌতরচনা। Brahmanic Poetry (ব্রাহ্মণ্য রচনা) ও Ascetic Poetry. (যতি, ভিক্ষু ও শ্রমণ গণের রচনা)। সূতগণ কর্তৃক রাজন্যবর্গের বংশতালিকা জাতীয় রচনার নাম ‘অনুবংশশ্লোক’, এই জাতীয় রচনা মহাভারতের আদিপর্বের অন্তর্গত ‘সম্ভবপর্বে’ দেখতে পাওয়া যায়। যে সকল স্থানে কোন বিশিষ্ট রাজরাজাদের বীরত্ব কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে তাকে বলা হয় Heroic Poetry বা বীর্যগাথা। Annie Besant মনে করেন এই সকল heroic Poetry-র মধ্য দিয়েই দর্শনের মূলতত্ত্ব সমূহ প্রচারিত হয়েছে।

দুষ্যম্ভ-শকুন্তলার উপাখ্যান এমনই একটি চিত্তাকর্ষক বীর কাহিনী। মূল আখ্যান অনুযায়ী দুষ্যক্ত ও শকুন্তলার কথোপকথনের মধ্যে উভয়ের মুখ দিয়েই ব্রাহ্মণগণ পতি-পত্নীর সম্পর্ক, মানুষের জীবনে পত্নী ও পুত্রের স্থান, বিবাহ বিধি, সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিধি ইত্যাদি প্রচার করেছেন। মহাকবি কালিদাস এই আখ্যানকে উপজীব্য করে কালজয়ী নাটক লিখলেন অভিজ্ঞান শকুন্তলম্। যদিও সেখানে কবি দূর্বাশার অভিশাপ, শকুন্তলার আংটি হারান, দুষ্যম্ভ কর্তৃক শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি নানান ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়েছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে, এই রূপ ঘটনাসমূহের মূল আখ্যান ভাগের সাথে কোন সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। মহাভারতের দুষ্যম্ভ কিন্তু শকুন্তলাকে চিনতে পেরেছিলেন অথচ না চেনার ভান করেছিলেন মাত্র।

অপর একটি বীর্যগাথা হল রাজা যযাতির উপাখ্যান। আলোচ্য উপাখ্যানটি তৎকালে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল। পতঞ্জলি ‘যযাতিক’ শব্দের ব্যখ্যায় বলেছেন যিনি যযাতির কাহিনী জানেন তিনিই যযাতিক। এই কাহিনীতে রাজা যযাতির অধিক ভোগ বাসনাই তার পতনের মূলে ছিল। অবশেষে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বিষয়ভোগের দ্বারা বিষয় বাসনার নিবৃত্তি হয় না। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলে অগ্নি উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে জ্বলতে থাকে। এইরূপ কথা শিক্ষামূলক না হলেও পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ দিগের হস্তক্ষেপের ফলে শিক্ষামূলক কাহিনীতে পরিণত হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। শ্রমণ ও ভিক্ষু সম্প্রদায়ও এইরূপ গল্পের বিষয়কে অনাসক্তি নীতি প্রচারের কাজে নিযুক্ত করেছেন।

নল-দময়ন্তীর উপাখ্যানে কাব্যের উৎকর্ষ প্রকাশ পেয়েছে। পাণ্ডবরা যখন বনবাসে কাটাচ্ছেন সেই সময় মহর্ষি বৃহদশ্ব এই কাহিনীটি যুধিষ্ঠিরের নিকট বিবৃত করেন। অতি প্রাচীন কাহিনীকে অবলম্বন করে রচিত এই উপাখ্যানে কিভাবে মহারাজ নল ভ্রাতা পুষ্করের নিকট পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে সতী-সাধ্বী পত্নী দময়ন্তীর সাথে নির্বাসন বরণ করেন, কিভাবে অন্ধ অবস্থায় বনমধ্যে পত্নীকে পরিত্যাগ করেছিলেন, কত দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ বিরহ যাপন করে পুনরায় দাম্পত্য মিলনে সমর্থ হয়েছিলেন তাই বর্ণিত হয়েছে। এই উপাখ্যান ব্রাহ্মণ্য প্রভাব মুক্ত শুদ্ধ সৌতরচনা। এই কাহিনী যুগে যুগে অতিশয় জনপ্রিয় ও চিত্তাকর্ষক হয়ে আছে। একে অবলম্বন করে পরবর্তীকালে মহাকবি শ্রীহর্ষ-’নৈষধীয়চরিতম্’ নামে তাঁর বিখ্যাত মহাকাব্য রচনা করেন।

রামোপাখ্যান হল আর একটি সুবৃহৎ কাহিনী। রামায়ণের বীজ এই অংশে নিহিত ছিল। মুখেমুখে রচিত বিক্ষিপ্ত সৌত রচনাবলী একত্রে সংকলিত হয়ে রামোপাখ্যানের জন্ম দিয়েছে। দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় মর্মাহত ও নানা ভাবে গভীর শোকে নিমজ্জিত যুধিষ্ঠিরকে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই রামোপাখ্যান শুনিয়েছিলেন। ভাগ্য বিড়ম্বিত যুধিষ্ঠিরের নিকট রামচরিত যেন ন্যায়ধর্ম ও সহনশীলতার আদর্শ কাহিনী স্বরূপ।

‘বিদুলার পুত্রানুশাসন’ বীর জননী বিদুলার উপাখ্যান। মাতা কুন্তী পুত্রদিগকে বলেন তারা যেন কখনই বীরের কর্তব্য বিস্মৃত না হয়। তিনি পুত্র সঞ্জয়কে কাপুরুষতা পরিহার করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে উত্তেজিত করেছিলেন যে ভাবে তা চিরদিন আদর্শ মাতার নির্দেশ হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছে। এযেন প্রকৃতপক্ষেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদ মুখর বাণী। সৌতগণ রাজন্যবর্গের স্তবস্তুতি করতঃ এই সমস্ত বীর গাথা গুলি রচনা করেছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন বীর রাজরাজাগণ বড় বড় যজ্ঞে ব্রাহ্মণদিগকে প্রচুর ধনসম্পত্তি দান করতেন। ব্রাহ্মণগণ সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের স্তবস্তুতি করে নানা কাহিনী প্রচার করতেন। যদি এইরূপই হয় তবে সেগুলি ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য।

পূর্বে আলোচিত আখ্যান গুলির মধ্যে নলোপাখ্যান, রামোপাখ্যান এবং বিদুলা পুত্রানুশাসন আকার আকৃতিতে এতই বড় যে এক একটি স্বতন্ত্র মহাকাব্যের দাবী রাখে। প্রাণবন্ত কাহিনী গুলি স্বতন্ত্র আখ্যানরূপেই প্রচলিত ছিল। এই প্রসঙ্গে Winternitz “Some of the poems which have found ad- mission in the Mahabharata are of such proportions, and form a complete whole to such an extent that we can-speak of them as epics within the epic. ২০

এছাড়াও কতকগুলি কাহিনী মূল মহাভারতের সাথে যুক্ত হয়ে বয়েছে যার সাথে সূতগণের কোনভাবেই যোগ ছিল না। সম্পূর্ণভাবে সৌত প্রভাব মুক্ত কাহিনীগুলিকে ব্রাহ্মণ্য-গল্প-উপাখ্যান বলা হয়ে থাকে। এইগুলি ব্রাহ্মণদের রচনা। জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞ’ এ গনি একটি আখ্যান। জন্মেজয়ের পিতা পরীক্ষিৎ সর্পাঘাতে মৃত্যু বরণ করলে পুত্রে তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এক সর্পযজ্ঞের আয়োজন করেন। মন্ত্রের এমনই প্রভাব যে সমস্ত সর্প নানা দিক থেকে ছুটে এসে সেই যজ্ঞের অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দেয়। এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণের মন্ত্রোচ্চারণ যে কত যাদু শক্তি সম্পন্ন তা প্রমাণ করাই বোধ হয় এই আখ্যানের উদ্দেশ্য।

এইরূপ কদ্রু ও বিনতার উপাখ্যান, দেবাসুরের সমুদ্র মন্থন, রুরুর কাহিনী, রুরুর পিতা চ্যবনের কাহিনী—এই সবই মহাভারতে দৃষ্ট হয়। প্রাকৃতিক অথবা অপ্রাকৃতিকই হোক্ না কেন সকলপ্রকার শক্তির উপর প্রাধান্য সৃষ্টি করাই ছিল ব্রাহ্মণগণের লক্ষ্য। যেমন মহাভারতে ইন্দ্র ও অগ্নিকে নিয়ে যে সমস্ত আখ্যান রচিত সেখানে ঋক্- বেদের প্রাধান্যকে খর্ব করে ব্রাহ্মণ্য শক্তির ক্ষমতা ও গৌরবকে প্রতিষ্ঠা করারই প্রয়াস লক্ষ করা যায়। মনু-মৎস্য কথার প্লাবন কাহিনীটি প্রাচীন সেমীয় সাহিত্যের অন্যতম অতিকথা। সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনী Winternitz এর মতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কাহিনী এবং এর রচয়িতা ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় যিনিই হোন না কেন তাঁকে সর্বকালের মহাকবি বলতেও তিনি দ্বিধা করেন নি। সাবিত্রীর অসাধারণ রূপের বর্ণনা দৃষ্ট হয়, সেই সাথে সতীসাধ্বী পতিব্রতা পত্নীর আলেখ্য হিসাবে যথেষ্ট সমাদৃত। কাব্যপ্রতিভা ভাবের গাম্ভীর্যে যেন অধিকতর মাধুর্য্য লাভ করেছে। অদৃষ্টের বিরুদ্ধে প্রেম, নিষ্ঠা, জ্ঞান ও সর্বোপরি ধর্মের জয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কাহিনীর মধ্য দিয়ে। এ যেন দেব ও পুরুষকারের দ্বন্দ্বের ছবি। সামাজিক আদর্শের মাধ্যমে ধর্মের মহিমা প্রচার করাই ছিল এইরূপ আখ্যানের উদ্দেশ্য। ব্রাহ্মণ্য মহিমা প্রচার করা হয়েছে বিশ্বামিত্র উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে। এরূপ আরো অসংখ্য কাহিনী মহাভারতে স্থান করে নিয়েছে যা নাকি কাব্য সৌন্দর্যহীন, একান্তই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও মাহাত্ম প্রচারের প্রতিনিধিস্বরূপ। ঋষ্যশৃঙ্গের উপাখ্যান ও উল্লেখযোগ্য। ঋষি লোমশ পাণ্ডব গণের সাথে তীর্থ ভ্রমণ কালে প্রতি তীর্থে একটি করে গল্প শুনিয়েছিলেন। এমনই এক গল্প হল অগস্ত্যের সমুদ্র শোষণ কাহিনী। অগস্ত্যের সমুদ্র শোষণ প্রকৃতিকে পুরোপুরি পরাজিত করে ব্রাহ্মণ্য শক্তিকে প্রতিষ্ঠার কাহিনী।

তৎকালীন ব্রাহ্মণ্য ও ক্ষাত্র শক্তির যে কিরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলত তার পরিচয় পাওয়া যায় বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রকে কেন্দ্র করে রচিত উপাখ্যান গুলিতে। আরুণি উপাখ্যানে গুরুর আদেশে জমির আল বাঁধার জন্য যখন কোন ভাবেই জলস্রোতকে রোধ করা গেল না, তখন নিরুপায় হয়ে নিজের জমির উপর শয্যা গ্রহণ করলেন এবং জল আটকালেন। অর্থাৎ গুরুর আদেশ পালনার্থে আরুণির এই অমানুষিক প্রচেষ্টা তৎকালীন সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তির কথাই ঘোষণা করে। অর্থাৎ মহাভারতকে কেন্দ্র করে তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যসমাজ নানাভাবে তাঁদের মাহাত্ম্যকে প্রচার করেছেন একথা প্রমাণিত।

সৌত ও ব্রাহ্মণদের রচনা ভিন্ন তৃতীয় শ্রেণির যে রচনা দৃষ্ট হয় তা শ্ৰমণ, যতি ও ভিক্ষুগণ কর্তৃক লিখিত। ব্রাহ্মণদের ন্যায় তাঁরা কিন্তু নিজধর্ম, নিজ মাহাত্ম্য প্রচারের পক্ষে ছিল না। তাঁদের রচিত কাহিনী জীবে দয়া, বিষয়ে অনাসক্তি, অহিংসা, ব্রহ্মচর্য, অস্ত্যেয় প্রভৃতি সর্ব সাধারণের যে মানবিক বোধ, নীতি ও ধর্মজিজ্ঞাসাকেই তুলে ধরতে চেষ্টা করেছিল। এই ধরনের রচনাতে কোন বিশেষ দেবতার মাহাত্ম্য লক্ষ্য করা যায় না। এরূপ রচনা উপনিষদেও ছিল দেখা যায় আবার পুরাণ ও বৌদ্ধ সাহিত্যেও লক্ষ্য করা যায়। এই শ্রেণির রচনাকে Fables, Parables ও Moral narratives এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়।

বিদ্বান, সর্বজ্ঞ ও অত্যন্ত ধর্ম্মনিষ্ঠ বিদুর নানানিধ গল্পের মাধ্যমে বহু নীতি কথা ও উপদেশাবলী অন্যকে দিতেন। সেগুলি Fables নামে পরিচিত। যেমন কোন একজন রাজা স্বর্ণপ্রসূ পক্ষী হত্যা করেন, অধিকতর লোভের বশবর্তী হয়ে, ফলে রাজা স্বর্ণ ও পক্ষী উভয়ই হারান। গল্পটি তিনি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন যাতে তিনি পাণ্ডবদের সাথে এ-হেন স্বার্থপূর্ণ ব্যবহার না করেন। আবার ব্যাধ ও পক্ষীসকলের কথার মধ্য দিয়ে একতাই যে বল এবং অপরপক্ষে পরস্পর কলহ যে সকলেরই বিপদ ডেকে আনে এইরূপ শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই জাতীয় রচনা সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রচিত হয় না। তাই এখানে কাব্য সৌন্দর্য্যের লেশমাত্র নাই, আছে আপামর জনসাধারণের উদ্দেশ্যে শিক্ষামূলক উপদেশ।

Parable জাতীয় গল্পের মধ্যে সমুদ্র ও নদীর কথোপকথোন, কৃপপতিত মানবের গল্প বিখ্যাত। বৃহৎ শক্তির নিকট মাথা নত করলে বিপদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এই শিক্ষা দিয়ে বলা হয়েছে সমুদ্র নদীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা নদী তুমি বড় বড় গাছ সব ভাসিয়ে নিয়ে আসো অথচ ছোট গাছ তো বয়ে আনতে দেখিনা? “ তখন গঙ্গা উত্তর দিচ্ছে—বড় বড় বৃক্ষগুলি নদীর স্রোতকে বাধা দেয় তাই বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নদীর স্রোত সেইসব গাছকে উপরে নিয়ে আসে, কিন্তু ছোট গাছ, লতাগুল্ম তো আমার স্রোতের সম্মুখে অবনত হয়, তাই সেগুলি সস্থানেই থেকে যায়, উৎ- পাটিত হয় না।

Fables ও Parables ছাড়াও কতকগুলি নীতি মূলক উপাখ্যান মহাভারতে সন্নিবেশিত হয়েছে দেখা যায়। জীবে দয়া করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। জীব সেবাই শি সেবা এই মহান ধর্মের আধারে রচিত হয়েছিল রাজা শিবির উপাখ্যান। আবার প্রেম ও মৈত্রীর বন্ধন যে শত্রু মিত্র নির্বিশেষে সকলের প্রতিই দেখান যেতে পারে এইরূপ আদর্শের কথা প্রচারিত হয়েছিল ব্যাধ ও কপোতের কাহিনীর মধ্য দিয়ে। কপোত-কপোতীর ঘরে ব্যাধ অতিথি হয়ে আসলে, তখন তাকে আহার কানোর মত কিছুই নেই দেখে কপোত জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিলে, তাই দেখে বেদনাহত কপোতীও সেই আগুনে ঝাঁপ দিল, এইভাবে অতিথির সেবা করতে দেখে ব্যাধের চৈতন্য হল, তখন সে তার বৃত্তি ছেড়ে সন্ন্যাস হয়ে গেল। এছাড়াও জন্মান্তরবাদ, কর্মফল ইত্যাদি বিবিধ বিষয় শিক্ষা দেওয়া হত ছোট ছোট গল্প, আখ্যান উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে। দৈনন্দিন জীবনে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক, উচিৎ, অনুচিৎ সকলপ্রকার নীতিবোধ ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে মহাভারতের জুড়ি মেলা ভার।

মহাভারতের প্রক্ষিপ্ত অংশ :—পূর্বে আমরা মহাভারতের স্তর ভেদের কথা আলোচনা করেছি। মূল মহাভারত থেকে বর্তমান মহাভারতের শ্লোক সংখ্যাই এইরূপ চিন্তার মূল কারণ। মহাভারতের ভূমিকায় বলা হয়েছে যে তিনবার পৃথক্‌ পৃথক্‌ ভাবে তিনজন ব্যক্তি মহাভারতের কাহিনী শোনান। এই ঘটনা থেকে সহজেই অনুমেয় যে ব্যাস রচিত মূল মহাভারতে পরবর্তীকালে বহু প্রক্ষিপ্ত অংশ স্থান পেয়েছে। টীকাকার মধ্ব এর মতে কোথাও মূল পরিবর্তিত হয়েছে স্বেচ্ছায় অথবা ভুলবশতঃ আবার কোন অংশে মূল সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হতে দেখা যায়।

Macdonell এর মতে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাই মহাভারতের মূল অংশ। মহাভারতের প্রথা ও দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে সুচীপত্র দৃষ্ট হয় তার সাথে বর্তমান মহাভারতের কোন মিল দেখা যায় না। মহাভারতেই বলা আছে মূল মহাভারতের শ্লোক সংখ্যা ৮, ৮০০টি। আঠারোটি পর্ব তো দূরের কথা মূল উপাখ্যান তার অর্ধেকও নয়। ভাষা, ছন্দ রচনাশৈলী ইত্যাদির বিষয়ে যথেষ্ট গরমিল-ই ভাবতে বাধ্য করে যে মহাভারত একই ব্যক্তির দ্বারা রচিত নয় অথবা একই সময়ে সম্পূর্ণ হয় নি।

মহাভারতে আমরা পরস্পর বিপরীত ধর্মী বহু ঘটনার সন্নিবেশ লক্ষ্য করে থাকি। পাণ্ডবদেরকে সাধু, সৎ, ধার্মিক ও সাহসী যোদ্ধা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, এবং কৌরবদেরকে বিশ্বাসঘাতক, ঠক্, প্রতারক, হিংসা মনোভাবাপন্ন বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আবার অন্যত্র বলতে দেখা যায় পাণ্ডবদের বিশ্বাসঘাতকতা ও দুর্ব্যবহারই কৌরবদের পরাজয় ও পতনের মূলে। যে কৃষ্ণকে আমরা জেনেছি পাণ্ডবদের সখা বলে বিশেষতঃ সকলপ্রকার কূট শিক্ষার গুরু হিসাবে, সেই কৃষ্ণকেই বিষ্ণুর অবতার, ধর্মের রক্ষক ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দেবতা রাজে বর্ণিত হতে দেখা যায়। অতএব এই পরস্পর বিরোধী কাহিনীই মূল অংশের থেকে প্রক্ষিপ্ত অংশকে সহজেই আলাদা ভাবে চিহ্নিত করে।

Winternitz এর মতে একসময়ে, উত্তর পশ্চিম ভারতে এক রাজশক্তির পতন ও সেই স্থানে অন্য রাজশক্তির উত্থানের ঐতিহাসিক ঘটনাই মহাভারতের মূলে। আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি যে সূতগণই হলেন মহাভারত রচনার মূল হোতা। কৌরব রাজবংশকে নিয়ে নানা বীর্যগাথা তাঁরা রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে কৌরবদের পতন হলে পাণ্ডবদের পক্ষ গ্রহণ করে সেই সুতগণই তাদের গুণগান ও কৃতিত্ব বর্ণনা করলেন। মহাভারতের বক্তা সুত সঞ্জয়। তিনি যেহেতু কৌরবপক্ষা- বলম্বী ছিলেন সেইহেতু কৌরবদের গুণগান করাই স্বাভাবিক। আবার দ্বিতীয়বার যখন জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে রামায়ণ পাঠ করা হয় তখন জন্মেজয় যেহেতু পাণ্ডবপক্ষীয় সেহেতু সেই অংশে পাণ্ডবদিগের সমর্থনে কিছু বলাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

কৃষ্ণের চরিত্র মহাভারতে নানাভাবে চিত্রিত হতে দেখা যায়। বিচক্ষণ, রাজনীতিজ্ঞ, কূটনীতিজ্ঞ, বিষ্ণু অবতার ইত্যাদি নানা রূপে কৃষ্ণ। মূল মহাভারতে যে কৃষ্ণ তাঁকে আমরা যোদ্ধা, বীর ও বিচক্ষণ ব্যক্তি এমন কি রাজনীতি বিষয়েও যথেষ্ট পারদর্শী বলেই জানি কিন্তু সেই কৃষ্ণই পরবর্তীকালে দেবতা রূপে প্রতীয়মান হলেন। পাণ্ডবসখা কৃষ্ণ ও ভাগবদ্গীতার কৃষ্ণের মধ্যে দুস্তর ব্যবধানই এই দুই কৃষ্ণ একই ব্যক্তি বলে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। মহাভারতের বিভিন্ন ছোটখাট, খুঁটিনাটি ঘটনার বৈপরীত্যও প্রমাণ করে যে মহাভারত একই ব্যক্তির রচনা নয়, রাজনৈতিক সামাজিক ও ধর্মের ক্ষেত্রে মহাভারতের যে পরিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করা যায় তা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে কালে কালে বিভিন্নজনের বিভিন্ন আখ্যান উপাখ্যান সংযোজিত হয়ে তবেই বর্তমান মহাভারত তার রূপ পরিগ্রহ করেছে।

পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে মহাভারত মূলতঃ তিন শ্রেণির রচনায় সমৃদ্ধ। সৌতিগনের রচনাকে যদি মূল মহাভারত হিসাবে ধরা হয়, তাহলে ব্রাহ্মণ্য রচনা এবং ভিক্ষু ও শ্রমণগণের রচনা অবশ্যই পরবর্তী কালের প্রক্ষিপ্ত অংশ, হরিবংশ পরবর্তীকালের রচনা। এছাড়া যে যে স্থানে নীতি, শাস্ত্র, ধর্ম ও মোক্ষ বিষয়ক আলোচনা দেখা যায় যেমন শান্তি পর্ব, অনুশাসন পর্ব এবং আরও অন্যান্য নীতি মূলক প্রসঙ্গ সবই পরবর্তীকালের প্রক্ষেপ বা সংযোজন।

মহাভারতের রচনাকাল :— দীর্ঘকাল যাবৎ লোকমুখে প্রচারিত হতে থাকা কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধের কাহিনী ও রাজবংশের বীর্যগাথা সমূহ কোন এক বিশেষ ব্যক্তি কর্তৃক সুসংবদ্ধ অবস্থায় কাব্যের রূপ পরিগ্রহ করে। পণ্ডিতেরা এইরূপ অনুমান করে থাকেন। আলোচ্য সময়ের মূল মহাভারতে দেবতাগণের মধ্যে ব্রহ্মার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদিত হত। পালি সাহিত্য অনুসারে বুদ্ধের সময়েই ব্রহ্মা প্রধান দেবতার মর্যাদা পেতেন। সেদিক থেকে বিচার করলে এরূপ ধারণা হয় যে মূল মহাভারত খ্রিঃ পূঃ পঞ্চম শতকের মধ্যেই রচিত হয়েছিল। আবার আশ্বলায়নের (৫ম খ্রিঃ পূঃ শঃ) গৃহ্য-সূত্রে (৩।৪।৪) বৌধায়ন ধর্মসূত্রে (২১২১২৬ ও ২১২২১৯)মহাভারতের শ্লোকাংশের উদ্ধৃতিই উপরিউক্ত সিদ্ধান্তের সমর্থন করে। এছাড়া ৫মশতাব্দীতে জাভা ও বালীদ্বীপে মহাভারতের ৮টি পর্বের অনুবাদ ও মুলশ্লোকের আংশিক উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। সূতগণের মুখে মুখে মহাভারত প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে মূল মহাভারতের কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে। যখন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে মহাভারত ২০,০০০ শ্লোকে এসে দাঁড়ায় সেই স্তরে কৌরবগণের পরিবর্তে পাণ্ডবগণের অনুকূলে মহাভারত রচনার ধারা বইতে থাকে। ব্রহ্মার সাথে সাথে শিব ও বিষ্ণুর মাহাত্ম্য কীর্তিত হতে থাকে। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি যে খ্রিঃ পূঃ তৃতীয় শতকেই শিব ও বিষ্ণু-হিন্দুসমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তখন থেকেই শৈব ও বৈষ্ণব এই দুই সম্প্রদায়ই বিদ্যমান ছিলেন। অতএব মহাভারতের এই স্তর খ্রিঃ পূঃ ৩য় শতকের পূর্বেই সম্পন্ন হয়েছিল এইরূপ মনে করা অযৌক্তিক নয়। মহাভারত রচনার তিনটি স্তর যথাক্রমে—জয়, ভারত এবং মহাভারত নামে পরিচিত।

কুমারিল ভট্ট (৭মশঃ) আচার্য শঙ্কর (৮ম শঃ) মহাভারতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তিনি ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত ভগবদ্ গীতার ভাষ্য রচনা করেন এবং মহাভারতকে স্মৃতি বলে গ্রহণ করেন। বাণভট্ট ও সুবন্ধুর (৬০০-৬৫০ খ্রিঃ) রচনায় মহাভারতের উল্লেখ রয়েছে। বাণের কাদম্বরী রচনায় রানী বিলাসবতী উজ্জয়িনীর মন্দিরে মহাভারত পাঠের সময় স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন বলা হয়েছে। অশ্বঘোষের বজ্রসূচী গ্রন্থে হরিবংশ থেকে শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে দেখা যায়। মহাকবি ভাস একাধিক কাব্য রচনা করেছেন মহাভারতকে কেন্দ্র করে। ৪৫৫-খ্রিস্টাব্দের গুপ্ত শিলালেখতে শতসাহস্ৰী সংহিতা মহাভারতের উল্লেখ রয়েছে। রামায়ণের মতই মহাভারতও বৌদ্ধ প্রভাব-মুক্ত। কিন্তু যবন ও বৌদ্ধগণের উল্লেখ থেকে এই সিদ্ধান্তের প্রতিতী জন্মে যে বৌদ্ধধর্মের প্রচারের পর এবং আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের পর পর্যন্ত্যও মহাভারত রচিত হয়ে চলেছিল।

Winternitz এর মতে মহাভারত সুদীর্ঘ খ্রিঃ পূঃ চতুর্থশতক থেকে খ্রিঃ চতুর্থশতক পর্যন্ত্য চলেছিল। Jacabi-র মতে রামায়ণ মহাভারতের পূর্ববর্তী। রামায়ণের দ্বারাই মহাভারত মহা-কাব্যরূপে প্রতিভাত হয়। মহাভারতের কাল নির্ণয় প্রসঙ্গে Winternitz এর যুক্তিগুলি সূত্রাকারে নিম্নরূপ—

(i) Single myths, Legends and poems which are included in

the Mahabharata, reach back to the time of the veda.

(ii) An epic “Bharata” or “Mahabharata” did not exist in the vedic period.

(iii) Many moral narratives and sayings which our Mahabharata contains, belong to the ascetic poetry, which was drawn upon, from the ৬th century B.C. onwards, also by Buddhist and Jains.

(iv) If an epic Mahabharata already existed between the ৬th and ৪th centuries B. C. then it was but little know a in the native land of Buddhism.

(v) There is no certain testimony for an epic Mahabharata before the ৪th century B.C.

(vi) Between the ৪th century B.C. and the ৪th century A.D. the transformation of the epic Mahabharata into our present compilation took place, probably gradually.

(vii) In the ৪th century A.D. the work already had, on the whole, its present extent. contents and character.

(viii) Small alterations and Additions still continued to be made, however, even in later centuries.

(ix) One date of the Mahabharata does not exist at all, but the date of every part must be determined on its own account.

পরিশেষে বলতে বাধা নেই যে—কোন এক নির্দিষ্ট সময়কে মহাভারতের কাল হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। যুগ যুগ ধরে এই মহাকাব্য ধীরে ধীরে পরিণতি লাভ করেছে। পৃথিবীর বয়স নির্ধারণের মতই মহাভারতের কাল নির্ণয় করা দুরূহ।

মহাভারতের টীকা :—মহাভারতের টীকা অনেকেই রচনা করেছেন। তন্মধ্যে কেহ বা পরপর শ্লোকের ব্যাখ্যা করেছেন, আবার কেহ বা সম্পূর্ণ কাহিনীর ব্যাখ্যা করেছেন। আবার ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুবর্গের ব্যাখ্যা-মূলক তত্ত্বও পাওয়া যায়। কারও মতে প্রাচীনতম টীকা হিসাবে পরিব্রাজকাচার্য দেববোধ (দেবস্বামী) প্রণীত পূর্ণাঙ্গটীকা (১১ শঃ প্রথমার্ধে) জ্ঞান দীপিকা।” আবার কারও মতে-সর্বজ্ঞনারায়ণের ভারতার্থ প্রকাশ টীকাহ সর্বাধিক প্রাচীন। আনুমানিক ১১৩০-১৩০০ খ্রিঃ ইহা রচিত হয়। অনুমান করা হয় যে এই টীকা পূর্ণাঙ্গই ছিল। বিমল বোধের (১২শ শঃ) বিষমশ্লোকী সম্পূর্ণ ১৮ পর্বের টীকা। সমগ্র মহাভারত এর উপরে না পাওয়া গেলেও বহু টীকা আংশিক মহাভারতের উপরে আলোকপাত করেছে। যেমন বৈশম্পায়নের টীকাখানি কেবল শান্তিপর্বের মোক্ষধর্মের উপর রচিত। চতুর্ভূজ মিশ্রের ভারতোপায় প্রকাশ কেবলমাত্র বিরাট পর্বের উপরে ১৩শ শতকে রচিত। ১৪শ শতাব্দীতে অদ্বেতবাদী আনন্দপূর্ণ বিদ্যাসাগর বিরচিত আদিপর্বের জয়কৌমুদী এবং সভা-ভীষ্ম- শান্তি-অনুশাসন পর্বের রত্নাবলী টীকা পাওয়া যায়। ভারতাচার্য অর্জুনমিশ্র ১৪শশতাব্দীতে বিরাট ও উদ্যোগপর্বের উপর টীকা লেখেন ভারতার্থ দীপিকা ও ভারতসংগ্রহ দীপিকা নামে। তিনি পূর্বের টীকাকারগনের নাম উল্লেখ করেছেন। নারায়ণ রচিত নিগূঢ়ার্থ পদবোধিনী দক্ষিণ ভারতীয় বাদিরাজ প্রণীত লক্ষাভরণ ইত্যাদি টীকা দৃষ্ট হয়। তবে বলা যায়-সর্বাধিক জনপ্রিয় টীকা হল মহারাষ্ট্র প্রদেশস্থ কূপরবাসী ব্রাহ্মণ নীলকণ্ঠ ১৬শ শতাব্দীতে মহাভারতের ভারতভাবদীপ নামক টীকা রচনা করেন। নীলকণ্ঠের মন্ত্রনারায়ণ ও মন্ত্রভাগবত এই দুই গ্রন্থে যথাক্রমে—রামায়ণ ও ভাগবতের শ্লোক ও তার অনুকল্পে ঋক্‌বেদের শ্লোক উদ্ধৃত ও ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বহুদেশীয় পাঠ ও বহু কোষ বিবেচনাও করেছেন।

বহু সমাহৃত্য বিভিন্ন দেশ্যাম্‌-
কোষাণ বিনিশ্চিত্য চ পাঠমগ্র্যম্।
প্রাচ্যং গুরূণামনুসৃত্য বাচম্‌
আরভ্যতে ভারতভাবদীপঃ।।

এছাড়া দেববোধ ও রত্নগর্ভ দ্বারা রচিত টীকা দু’খানি ছাপার অক্ষরে পাওয়া যায় না। মহাভারতকে নানান দৃষ্টি কোন্ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নির্ণয় করেছেন বদররাজ, ব্যাসতীর্থ ও জ্ঞানদানন্দভট্ট প্রমুখ। ভারত তাৎপর্য নির্ণয়, ভারতযুদ্ধ বিবাদ, জৈমিনি ভারত প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সংক্ষিপ্তাকারে মহাভারত যেমন—বালভারত, মহাভারত সংগ্রহ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে।

শ্রীমদ্ভাগবদ্ গীতা :—মহাভারতে দার্শনিক তত্ত্বসমূহের আলোচনা বহুলাংশে দৃষ্ট হয়। আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি সমাজের সর্বস্তরে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে তাঁরা শান্তি পর্ব, অনুশাসন পর্ব, বন পর্ব, উদ্যোগ পর্ব, ভীষ্ম পর্ব ও শল্য পর্বের মধ্য দিয়ে বহু উপদেশাত্মক বাণীও প্রচার করেছেন। তন্মধ্যে শ্রীমদ্ভাগবদ্ গীতাই সর্ব-শ্রেষ্ঠ। ভীষ্মপর্বে শ্রীকৃষ্ণের কণ্ঠে অভিনব বাণী সঙ্গীতাকারে গীত হয়। এখানে ভারতীয় বিবিধ দার্শনিক মতবাদের এক অদ্ভুত সমন্বয় সাধিত হয়েছে। কুরুপাণ্ডবদের যুদ্ধের প্রাক্কালে কুরুক্ষেত্র সমরাঙ্গণে অর্জুন দেখলেন সম্মুখে ভীষ্ম, দ্রোণ, জ্ঞাতি ভ্রাতা দূর্যোধনাদিকে, তৎক্ষণাৎ আত্মীয় স্বজন, গুরু দিগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চিন্তা করেই তাঁর শরীর যেন অবশ হয়ে এল, হাত, পা কাঁপতে থাকল, জিহ্বা শুকিয়ে এল, হাত থেকে গাণ্ডীব খসে পড়ল, তিনি রথের উপর বসে পড়লেন। ক্ষত্রিয় বীরের এইরূপ ক্লীবতা পায় না। পার্থসারথি শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে মৃদু তিরস্কার করে গীতার শ্লোক সমূহ উপদেশ দিলেন। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম কি? আত্মতত্ত্ব প্রভৃতি নানা বিষয়ে যে উপদেশ দিলেন তাই গীতার সার-বিষয়। এইভাবে গীতার উদ্ভব। জ্ঞান যোগ, কর্ম যোগ, ও ভক্তি যোগ এই তিনের সমন্বয়ে গীতা। ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র সমূহের মধ্যে মোক্ষ বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে অসামঞ্জস্য থাকলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতার মধ্য দিয়ে সকল দর্শন-শাস্ত্রের সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করেছেন। শাস্ত্ৰ- সমুহ মন্থনকরে গীতামৃতের জন্ম সেই হেতু বলা হয়—”গীতা সুগীশ কর্তব্যা কিমন্যৈ শাস্ত্রবিস্তরৈঃ।” গীতাকে একাধারে যোগশাস্ত্র, উপনিষদ্ ইত্যাদি বলা হয়। ‘যোগঃ কর্মকুশলম’—সর্বভাবে প্রযত্ন পূর্বক দক্ষতা অর্জনই যোগের এর কথা। শ্রীকৃষ্ণ প্রতিটি মানুষকেই কর্মের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছেন। কর্ম করে যাও ফলের আশা করো না। নিস্কাম কর্মের দ্বারাই কর্মের বন্ধন দূর হয়। ফলাসক্তিই সকল অনর্থের মূলে। নিস্কামকর্মের দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ কর এবং সেই কর্মফল দ্বারাই ভক্তি-ভাব জাগরিত হয়। এইভাবেই কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয় সাধিত হয়। গীতার তত্ত্ব ও উপদেশাবলী ১৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এই আঠারটি অধ্যায়ের সার কথা হল—’সর্বধর্মান্-পরিত্যজ্যমামেকং শরণং ব্রজ’ (১৮, ৬৬)।

স্বভাবতই মনে সন্দেহ জাগে যে-কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে এই সুদীর্ঘ উপদেশাত্মক ভাষণ শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে কী দেওয়া সম্ভব হয়েছিল? সেইহেতু অনুমান করা হয় ঐ

পদেশ ছিল নাতি-দীর্ঘ, কিন্তু সেই উপদেশের সারমর্ম অনুসরণে পরে ১৮টি অধ্যায়ে গীতা রচিত হয়। তবে যাই হোক্ না কেন গীতার-রচয়িতা নিঃসন্দেহে একাধারে কবি ও দার্শনিক। ইংরাজী ও ল্যাটিন ভাষায় গীতা অনুদিত। পণ্ডিতগণের অনুমান খ্রিঃ পূর্ব ৫ম—৪র্থ শতকে গীতা সম্পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করে। গীতা বৌদ্ধ প্রভাব মুক্ত। নবম শতকে বাণভট্ট গীতার বিষয় জানতেন সুতরাং এর বহু পূর্বেই গীতার রচনা সমাপ্ত হয়েছিল।

গীতার অসংখ্য ভাষ্য, টীকা রচিত হয়েছে। দার্শনিক শঙ্কর, রামানুজ, মধ, মধুসূধন, শ্রীধরস্বামী, দৈবজ্ঞ পণ্ডিত, সদানন্দ, আনন্দগিরি প্রমুখের টীকা ও ভাষ্য বিখ্যাত। আধুনিক সংস্কৃত পণ্ডিতেরা এই সমস্ত প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় দার্শনিকগণের টীকার বাংলা অনুবাদ করে বিখ্যাত হয়েছেন। পরবর্তী কালে গীতার অনুসরণে নানান ধর্ম সম্প্রদায়ের কবিরা বহু গীতা রচনা করেন। রামগীতা, শিবগীতা, শক্তিগীতা, ভক্তিগীতা গুরুগীতা, পঞ্চদশী গীতা ইত্যাদি। ভারতবর্ষের ধর্মের ইতিহাসে গীতার প্রভাব সুদূর প্রসারী। সারাবিশ্বেই গীতার প্রচার ও সমাদর বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গীতা কোন সম্প্রদায় বিশেষের গ্রন্থ নয়। এ-হল সমস্ত বিশ্বের আপামর জনসাধারণের আধ্যাত্মিক অনুভূতির অখণ্ড ফল। ভারতের ঔপনিষদিক ভাবধারার বাঙ্ময় প্রকাশ— “সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ। পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ”।

হরিবংশ :—হরিবংশ বা হরিবংশ পুরাণ মহাভারতের ‘খিল’ নামে পরিচিত। হরিবংশের বক্তা ব্যাসদেব। হরিবংশ নামকরণ হয়েছে তার কারণ এই অংশে ‘হরি’ অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বংশ বৃষ্ণিবংশ এর সম্যক পরিচয় দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে কৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত থেকে শুরু করে তাঁর সারা জীবনের সামগ্রিক বৃত্তান্ত এই হরিবংশ পাঠ করলে বোঝা যায়। বিষ্ণুর মহিমা কীর্তন করাও হরিবংশের অন্যতম উদ্দেশ্য। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের তেমন বংশ পরিচয় ও জীবন চরিত জানা যায় না সেই হেতুই এই হরিবংশের সৃষ্টি। হরিবংশের সূচনাতে উল্লেখ করা হয়েছে-যে রাজা জনমেজয় বৈশম্পায়নের কাছে বৃষ্ণি বংশের ইতিহাস জানতে চাইলে বৈশম্পায়ন পুরাণের কায়দায় একে একে বংশ, মন্বন্তর ইত্যাদি বিভাগ অনুযায়ী প্রধানত কৃষ্ণের বংশ অর্থাৎ যদুবংশ ও কৃষ্ণ চরিত বর্ণনা করেন। যদিও হরিবংশ মহাভারতের পরিশিষ্টাংশ তথাপি হরিবংশের রচনাশৈলী ও বিষয়বস্তুর আঙ্গিকে একে পুরাণ বলাই সঙ্গত। মোট ১৬,৩৭৪টি শ্লোক সম্বলিত এই হরিবংশ মহাভারতের বহু পরে রচিত হয়। মহাভারতের অষ্টাদশ পর্বের শ্লোক সংখ্যাছিল ৮৪০০০, অথচ-মহাভারত লক্ষশ্লোকাত্মক তাই এই সংযোজন। আদিপর্বে হরিবংশের শ্লোকসংখ্যা ১২,০০০ উল্লিখিত।

দশশ্লোক সহস্ৰানি বিংশৎশ্লোক শতানি চ।
খিলেষু হরিবংশে চ সংখ্যাতানি মহর্ষিনা॥ ১।২।৩৭৯

সেইহেতু অনুমান করা যায় বাকি শ্লোক সমূহ পরে হরিবংশে প্রক্ষিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক। ‘খিল’ পর্ব বলার সম্ভাব্য কারণ অনুমান করা হয় যে এই পৰ্বই শেষ বা চূড়ান্ত, এর পরে মহাভারতে আর কোনরূপ সংযোজন, পরিবর্তন বা প্রক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয়।

হরিবংশের শুরুতে ও শেষে মহাভারতের প্রশংসা ও মহাভারত পাঠের পূণ্যফল বর্ণিত। মূলতঃ তিনটি পর্বে বিভক্ত যথা—হরিবংশ পর্ব, বিষ্ণুপর্ব, ও ভবিষ্যপর্ব।

প্রথমপর্বে পুরাণের আঙ্গিকে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের বর্ণনা এবং সেই প্রসঙ্গে বেণ, পৃথু, ধ্রুব, বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের নানা আখ্যান, উপাখ্যান দৃষ্ট হয়।

দ্বিতীয় পর্বে অর্থাৎ বিষ্ণুপর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবন ইতিহাস বর্ণিত। তৃতীয় বা ভবিষ্যপর্বে ভবিষ্যৎ কালের কথা ব্যাখ্যাত। কিছু অবান্তর বিষয়সমূহও এখানে স্থান পেয়েছে। ভবিষ্যৎ মন্বন্তর, মন্বন্তর কালবিভাগ, পিতৃশ্রাদ্ধের মাহাত্ম্য, শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকলাপ, হরিভক্তি মাহাত্ম্য, ভূদান প্রশংসা, অঙ্গদান, গোদান প্রভৃতি, ও বিভিন্ন দেবদেবীর মাহাত্ম্য কীর্ত্তন, শ্রীকৃষ্ম লীলাবৃত্তান্ত-ও নানান পুরাবৃত্ত কাহিনী

হরিবংশ এর টীকা-কারগণের মধ্যে নীলকণ্ঠের (১৬৫০-৯০খ্রিঃ) টীকা প্রসিদ্ধ।

পরবর্তীকালের সাহিত্যে মহাভারতের প্রভাব :—আদিকাব্য রামায়ণের ন্যায় মহাভারত পরবর্তীকালের সাহিত্যে গভীর ও সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করে আছে। মহাভারতেই সৌতি ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন—

সর্বেষাং কবিমুখ্যানামুপজীব্যো ভবিষ্যতি।
পর্জন্য ইব ভূতানামক্ষয়ো ভারতদ্রুমঃ। আদি ১/৯২

মহাভারতের অমৃতবাণী চিরকাল ভারতীয় কবিগণের মুখ্য উপজীব্য হবে। মেঘ যেমন বারিবর্ষণের দ্বারা শস্যোৎপাদনের মাধ্যমে জীবজগতের অবলম্বন, এই অক্ষয় ভারতবৃক্ষ তেমনি পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ কবিগণের পরমাশ্রয় হবে। খ্রিঃপূর্ব যুগ থেকে খ্রিস্টীয় ১৬শ-১৭শ শতক পর্যন্ত অসংখ্য কাব্য নাটক, মহাকাব্য, চম্পু প্রভৃতির রচনা উল্লেখযোগ্য। ভাস, কালিদাস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকল ভারতীয় কবিদেরই রচনার মূল অবলম্বন ছিল মহাভারতের বিষয়।

কালিদাস পূর্ব যুগের মহাকবি ভাস তাঁর নব আবিষ্কৃত ত্রয়োদশ নাটকের মধ্যে কর্ণভার, উরুভঙ্গ, দূতবাক্য, দূতঘটোৎকচ, মধ্যমব্যয়োগ, পঞ্চরাত্র, বালচরিত এই সকলই মহাভারতের বিষয় অবলম্বনে রচিত। মহাকবি কালিদাস তাঁর অসামান্য নাট্য প্রতিভার সাক্ষ্য রেখে গেছেন ‘মহাভারত’ অবলম্বনে। ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ নাটকের মধ্য দিয়ে। ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নাটকেরও মূল বিষয় মহাভারত থেকে সংগৃহীত হয়েছে। মহাকবি ভারবির অষ্টাদশ সর্গে রচিত কিরাতার্জনীয় (৬ষ্ঠ শঃ) মহাকবি মাঘের বিংশতি সর্গে রচিত শিশুপালবধম (৭ম শতকে) ভট্টনারায়ণের (৯ম শতকে) বেণীসংহাব, কুলশেখরের তপতী সংবরণ ও সুভদ্রা ধনঞ্জয়। ক্ষেমেন্দ্রের মহাভারতমঞ্জরী (১০৩৭ খ্রিঃ), নীতিবর্মার কীচকধ (১১শ শতকে)। প্রহ্লাপনদেবের পার্থপরাক্রম (২২শ শতকে), কুমার পালের দ্রৌপদী-স্বয়ংবর (১২শ শতকে), বিশ্বনাথের সৌগন্ধিকাহরণ (১৩শ শতকে) নীলকণ্ঠের কল্যাণসৌগন্ধিকা প্রভৃতি নাটক বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। মহাকবি শ্রীহর্ষের দ্বাবিংশ সর্গে রচিত নৈষধচরিতম মহাভারতের বিষয় অনুসরণে মহাকাব্য।

এছাড়াও মহাভারতের নল-দময়ন্তী কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছে ছোট বড় নানা ধরনের মহাকাব্য, নাটক এবং চম্পু। ত্রিবিক্রমভট্টের নলচম্পু বিখ্যাত। কেবলমাত্র সংস্কৃত সাহিত্যেই মহাভারতের প্রভাব সীমাবদ্ধ নয়, বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যও মহাভারতের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। পালি জাতকেও নীতি আদর্শ প্রচারের কাছে মহাভারতের আখ্যান উপাখ্যান ব্যবহৃত। বিধুর পণ্ডিত জাতকে (৫৪৫ সংখ্যক) অঙ্কিত বিধূর চরিত্রটি মহাভারতের খ্যাতনামা মহাত্মা বিদুরের আদর্শে অনুপ্রাণিত। ঘটজাতকে (৩৫৫ সংখ্যক) কৃষ্ণের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। কুনালজাতকে (২৩৯ সংখ্যক) সম্ভবতঃ বৌদ্ধগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে একনারীর একাধিক পতির কাহিনীকে ব্যাখ্যা করে দ্রৌপদীর অসৎ চরিত্রের কথাই বলা হয়েছে। এরূপ বহু জাতকে নীতি ও আদর্শের কথা প্রচারিত হয়েছে।

জৈনসাহিত্যও বহুলাংশে ‘মহাভারত’ এর বিশিষ্ট কাহিনী দ্বারা সমৃদ্ধ। ‘জৈন সাহিত্যে’ মহাভারত মূলতঃ হরিবংশ নামে প্রসিদ্ধ। জৈন ধর্মে কৃষ্ণের উপাসনা অতি প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্যনীয়। পঞ্চ পাণ্ডব ও কৌরবগণ সকলেই জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। জিন সেন রচিত হরিবংশ পুরাণ (৭৮৩ খ্রিঃ) ৬৬টি পরিছেদ বিভক্ত। গুণভদ্র প্রণীত উত্তর পুরাণ (৯ম শতক) অসগরচিত পাণ্ডব চরিত (১১শ শতকে) এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। আবার দেবপ্রভসুরির পাণ্ডবচরিত (১২শ শতকে নামক ১৮ সর্গের মহাকাব্যে মহাভারতের সামগ্রিক কাহিনী বর্ণিত। সুভাষচন্দ্রের জৈন মহাভারত বা পাণ্ডব পুরাণ। এসবক্ষেত্রে জৈনধর্মের আদর্শকে অনুসরণ করেই মহাভারত পরিবেশিত হয়েছে। আর রয়েছে জৈনচরিতকাব্য, কথানক কাব্য ইত্যাদি। কথাকোষ নামক গল্প সংগ্রহ নামকগ্রন্থের শেষ পরিচ্ছেদে দময়ন্তী কাহিনী নল-দময়ন্তী আখ্যানেরই অনুসরণে লিখিত।

নানাদেশের অনুবাদ সাহিত্যেও মহাভারত স্বমহিমায় উজ্জ্বল। সুদূর কাম্বোডিয়া, যবদ্বীপ ইত্যাদি পৃথিবীর নানা ভাষায় মহাভারতের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। বহু পাশ্চাত্য ভাষাতেও মহাভারতের অংশ বিশেষ অনুদিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে কাশীরাম দাসের মহাভারত বাংলার ঘরে ঘরে পূজিত ও পঠিত হয়। কাশীদাসী মহাভারত আক্ষরিক অনুবাদ নয়, স্থানে স্থানে মূল মহাভারতের রস অক্ষুন্ন রয়েছে দেখা যায়। মধুসূদনের ভাষায়-

মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
হে কাশী কবীশদলে তুমি পূণ্যবান।।

মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’, ‘শর্মিষ্ঠা, হেমচন্দ্রের ‘বৃত্রসংহার’। গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘পাণ্ডব গৌরব,’ ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’, বিখ্যাত। কবীন্দ্র পরমেশ্বরের ‘পাণ্ডববিজয়’, ‘জনা’ মহাভারতের বিষয় অবলম্বনে লেখা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্রাঙ্গদা’ গান্ধারীর আবেদন, কর্ণকুন্তী সংবাদ, বিদায় অভিশাপ, নরকবাস প্রভৃতির মধ্য দিয়ে অসাধারণ কাব্য প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন। এছাড়াও বুদ্ধদেব বসুর ‘মহাভারত’ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ির মহাভারত কথা প্রভৃতি বাংলা ভাষার গৌরবকে নিঃসন্দেহে মহিমান্বিত করেছে।

ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে মহাভারতের প্রভাব :—

“যথা সমুদ্রোভগবান্ যথা হি হিমবান্ গিরিঃ।
উভৌখ্যাতেই রত্ননিধি তথা ভারতমুচ্যতে”।।

যেমন দেবতাত্মা হিমালয়, যেমন ভারত মহাসাগর, তেমনি ভারতআত্মা মহাভারত। মহাভারত যেন ভারতের জীবনবেদ। ভারত আত্মার মর্মবাণীই হল ‘মহাভারত’, এ যেন প্রতিটি ভারতবাসীর হৃদয়ের সামগ্রী, জাহ্নবী, যমুনার মতই মহাভারতের স্রোত ভারতবর্ষে কখনো শুষ্ক হবে না। মহাভারত সমগ্র ভারতের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় জীবনের এক পূর্ণাঙ্গ দলিল, ভারতবর্ষের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের ইতিহাস।

ধর্মশাস্ত্ররূপে ভারতীয় নর-নারীর হৃদয়ে মহাভারতের আসন পাতা রয়েছে। মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ নিছক জ্ঞাতিযুদ্ধের সংগ্রাম নয়, এ হলো ধর্মযুদ্ধ, কুরুক্ষেত্র যেন ধর্মক্ষেত্র বলে প্রতিভাত হয়। আচার্য শঙ্কর মহাভারতকে ধর্মশাস্ত্র বলেই ব্যাখা করেছেন। যিনি সকলের নিত্য সুহৃৎ, যিনি কায়মনোবাক্যে সর্বভূতের হিতসাধনে রত, তিনি ধর্ম জানেন। ‘নহি সত্যাৎ পরোধর্ম’:—সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর নাই। সত্য ও অহিংসাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। কারণ এইগুলি সর্বভূতের হিতকর। সত্য ও অহিংসা যে স্থলে সর্বভূতের হিতকর না হয়, অনিষ্টকর হয়, সেই স্থলে তা ধর্ম না হয়ে অধর্ম হয়। অতএব যা কিছু সর্বভূতের হিতকর, তাই হল মহাভারতের ধর্ম, ভারতের প্রকৃত হিন্দুধর্ম।

ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবন মহাভারতের মহৎ চরিত্রগুলি দ্বারা ও মহান ঘটনাবলী দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত। ভারতীয় নরনারীর জীবনের সকলচিন্তা, কৰ্ম ও মননের প্রেরণাস্বরূপ সেই সমস্ত চরিত্র যেন তাদের আদর্শস্বরূপ। মহাভারত যেন একটি বিচিত্র চরিত্রশালা। এমন কোন মনুষ্য চরিত্র নাই, সে ভাল অথবা মন্দই হোক যা নাকি মহাভারতে নাই। চরিত্রগুলি সহজ, সরল, জীবন্ত ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। সকল চরিত্রই যেন স্ব স্ব মহিমায় উজ্জ্বল। প্রাচীন রীতি-নীতি আচার ব্যবহারের শিক্ষা এই মহাভারত থেকে পাওয়া যায়। সাক্ষাৎ ধর্ম থেকে যুধিষ্ঠিরের জন্ম। যিনি যুদ্ধে স্থির তিনি যুধিষ্ঠির। তাঁর দেহ-মন-ইন্দ্রিয় বুদ্ধি সকলই ধর্মময়। যুধিষ্ঠিরের ধর্ম যেন ভারতের তথা ভারতীয়গণের ধর্ম। যা নাকি সমস্ত জনগণকে ধারণ করে, সমস্ত মনুষ্যকর্মের শুভাশুভ বা মঙ্গলকে ধারণ করে। অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা তথা কর্মবীর সৌম্যকান্তি যুধিষ্ঠির যেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিমূৰ্ত্তি।

কর্মবীর অর্জুন তার পৌরুষ গর্বে গর্বিত। দূর্যোধনকে নিধন করতে গেলে অর্জুনের মত ক্ষাত্রশক্তির প্রয়োজন। বক-কীচক বিধ্বংসী ভীমের অজেয় বাহুবল ও ক্ষাত্রতেজের কী অপরিসীম নিদর্শন, এই সমস্ত সত্ত্বেও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন আমাদের মুগ্ধ করে। বাস্তবিক অর্থে ভীমও অর্জুনের মত ভ্রাতা ছিল বলেই যুধিষ্ঠির ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। মহাভারতের একটি চরিত্র হলো দূর্যোধন। যাকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তার অপরিমিত রাজ্যলাভের বাসনা তাকে চিরকাল ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। নানা অপকর্ম তিনি করেছেন দুঃশাসনকে সাথে নিয়ে। তার অতিরিক্ত মান তাঁর পতনের মূলে। তিনি বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী দিতেও সম্মত ছিলেন না। এই দূর্যোধনাদি শতপুত্রের জননী ছিলেন গান্ধার রাজকন্যা ধর্মশীলা গান্ধারী। তিনি ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী ছিলেন। অন্ধ স্বামীর যোগ্য স্ত্রী সারাজীবন চোখে কাপড় বেঁধে থাকলেন। গান্ধারীর মনস্বিতা আমাদিগকে অনুপ্রাণিত করে। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র পুত্র স্নেহে যেন ধর্মান্ধ, সমস্ত জীবন ধরে তিনি ন্যায় ও নীতির চর্চা করে গেছেন। তাঁর মত সর্বগুণ সম্পন্না, মহিয়সী ধর্মপরায়ণা নারী সত্যিই দুর্লভ, দ্রুপদ রাজকন্যা দ্রৌপদী ধর্মজ্ঞা, অথচ তেজদীপ্তা, ক্ষাত্র ধর্মরতা এবং ভীম, অর্জুনের ন্যায় নিজ ব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল। দাতা কর্ণ একাধারে বীর, বেদজ্ঞ, পণ্ডিত, অস্ত্র ও শস্ত্রবিদ্যায় নিপুণ। তাঁর মত ন্যায়, বীর ও কর্তব্যনিষ্ঠ আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি জগতে দুর্লভ। ভীষ্মের সত্য পালন বা প্রতিজ্ঞাপালন আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে। মহামতি ধার্মিক বিদূরও একটি সৎ ও মহৎ চরিত্র।

সর্বোপরি ভগবান রূপী শ্রীকৃষ্ণের কর্মযোগ আমাদের কর্ম ও ভাব জীবনকে যেন নিমেষে পরিবর্তিত করে দেয়। শ্রীকৃষ্ণের বহুমুখী চরিত্র আমাদেরকে মুগ্ধ করে। কেবলমাত্র সমাজ জীবনেই নয় আমাদের সংস্কৃতিরও অনন্ত প্রেরণা স্বরূপ এই মহাভারত। মহাভারতের তত্ত্ব, তথ্য, ভাষা, ও নানাবিধ বৈশিষ্ট্য আমাদের সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি সংক্রান্ত উচ্চচিন্তার নানান পরিচয় বহন করে চলেছে। বিদুর খুদের সৌরভ, সূচ্যগ্র মেদিনী, দাতাকর্ণ, সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, বকধার্মিক, শকুনিমামা, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, ইত্যাদি যেন প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে। মহাভারতের অমোঘ প্রভাব অনন্তকাল ধরে আমাদের সামগ্রিক জীবনকে প্রভাবিত করবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

রামায়ণ ও মহাভারতের পৌর্বাপর্য ও তুলনামূলক আলোচনা :—যদিও কালের নিরীখে রামায়ণ ও মহাভারতের পৌর্বাপর্য নির্ণয় করা কষ্টসাধ্য কাজ তবুও রামায়ণকে মহাভারত অপেক্ষা প্রাচীন বলাই সমীচীন। মূল রামায়ণই শুধু নয়, প্রক্ষিপ্ত অংশ সহ বর্তমান সাতকাণ্ড যে রাময়ণ তা মহাভারত রচনার বহু পূর্বেই রচিত হয়েছিল। সেই সূত্রে আদিকবি বাল্মীকি, আদিকাব্য রামায়ণ। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে ত্রেতাযুগে রামায়ণ রচিত হলে, দ্বাপর যুগে মহাভারত রচিত হয়েছিল। Jocobi- র মতে রামায়ণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই মহাভারত মহাকাব্যরূপে স্বীকৃত, অতএব রামায়ণ মহাভারতের পূর্ববর্তী। কিন্তু কাব্যরীতির বিশেষত্ব বিচার করে Winternitz বলেন মহাভারতের বর্ণনা করার যে ভঙ্গী তা প্রাচীনত্বের দাবী রাখে। ‘যুধিষ্ঠির উবাচ’ ‘সঞ্জয় উবাচ’ ইত্যাদি রূপে এক এক চরিত্রের প্রকাশ কাব্যরীতির শিষ্ট প্রয়োগ নয়। রামায়ণে কিন্তু এরূপ দৃষ্ট হয় না। সেখানে চরিত্রগুলি ছন্দের মধ্য দিয়ে আপনিই এসে ধরা দিয়েছে প্রায় আধুনিক কাব্যরীতির বৈশিষ্ট্যে একথা বললে অত্যুক্তি হয় না।

মহাভারত অপেক্ষা রামায়ণ যে প্রাচীন সে কথা নানাভাবে শুধু অনুমিতই নয় প্রমাণিত। বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে কৃষ্ণ অবতারের পূর্বেই রাম অবতার। রামায়ণে সতীদাহের মতন সামাজিক প্রথার উল্লেখ নাই কিন্তু মহাভারতে সতীদাহের উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতের বনপর্ব, দ্রোণপর্ব, শান্তিপর্ব ও হরিবংশে রামোপাখ্যানের সংক্ষেপে উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতে (সপ্তম পর্বে-১৪৩.৬৭) রামায়ণের ষষ্ঠ কাণ্ডের (৮১.২৮) মূল অংশ থেকে একটি শ্লোক অবিকল উদ্ধৃত হতে দেখা যায়। রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে একটা অলৌকিক ছাপ দেখা যায়। যেমন বাণরসৈন্য দ্বারা সেতুবন্ধন, হনুমানের লঙ্কাদহন, দশানন রাবণের কল্পনা এই সমস্ত অবিশ্বাস্য ঘটনা মেনে না নিলে রামায়ণের সার্থকতা ক্ষুণ্ণ হয়, কিন্তু মহাভারতে এরূপ অবাস্তব চিন্তাভাবনা বা অলৌকিক চরিত্রের উপস্থিতি দেখা যায় না। মহাভারতের চরিত্রগুলি পুরোমাত্রায় মানুষ, একথাই প্রমাণ করে যে মহাভারত অপেক্ষা রামায়ণ প্রাচীন। মহাভারতে মহাকবি বাল্মীকির নাম একাধিকবার উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু রামায়ণে কোথাও ব্যাসদেবের নাম দেখা যায় না। রামায়ণে যে সভ্যতা প্রতিফলিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে মহাভারত অপেক্ষা প্রাচীন। রামায়ণের সমাজ জীবন ছিল সহজ, সরল, জটিলতা বর্জিত। কিন্তু পরবর্তীকালে মহাভারতের যুগে রাজনীতি, ধর্মনীতি, যুদ্ধ নীতি, কূট নীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র ও সমাজনীতিতে বহু জটিলতা প্রবেশ করে। রামায়ণ ও মহাভারত এই দুই আর্য মহাকাব্য তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তুলনা-মূলক আলোচনায় উভয় রচনার মধ্যেই কিছু সাদৃশ্য ও কিছু বৈসাদৃশ্য বর্তমান। রামায়ণে রাম রাবণের যুদ্ধ হলে মহাভারতে হল কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ। রামায়ণের রামচন্দ্র বিষ্ণুর অবতার, মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ।

পারিবারিক চক্রান্তের জেরে রামকে ১৪ বৎসর বনবাসে যেতে হয়েছিল, মহভারতেও জ্ঞাতিশত্রুতার ফলে পাণ্ডবগণকে চোদ্দবৎসর বনবাসে ও একবৎসর অজ্ঞাতবাসে থাকতে হয়েছিল। রামচন্দ্র রাবণকে নিহত করে, সীতাকে উদ্ধার পূর্বক অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেইরূপ পাণ্ডবগণ শত্রু পক্ষকে ধ্বংস করে দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ নেন। এবং অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। রাম হরধনু ভঙ্গ করে জনকরাজার মেয়ে সীতাকে বরণ করেন, মহাভারতে অর্জুন লক্ষ্য বস্তু ভেদ করে স্বয়ংবর সভায় কষ্ণাকে লাভ করেছিলেন। এইরূপ ঘটনা প্রবাহে নানা খুঁটি নাটি মিল লক্ষ্য করা যায় তবে এসকল বহিরঙ্গের বর্ণনা। উভয় মহাকাব্যের অন্তনির্হিত যে সাদৃশ্য অথবা বৈসাদৃশ্য তা আলোচনা করা প্রয়োজন।

রামায়ণের কাহিনী একমুখী, নিটোল, সুসংগত কিন্তু মহাভারতের কাহিনী বিচিত্র, বিপুল, ও বহুমুখী। রামায়ণে আরণ্যক জীবনযাত্রা ও প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশের চিত্র ফুটে উঠেছে। কিন্তু মহাভারতে নগরমুখী জীবনযাত্রার ছাপ সুস্পষ্ট। নৈতিক তার দিক দিয়ে রামায়ণের আদর্শ অভ্যন্ত কঠিন কিন্তু মহাভারতে নৈতিক আদর্শের বহুমুখী ধারা সুস্পষ্ট। রামায়ণের চরিত্রগুলি ত্যাগ, নিষ্ঠা ও তিতিক্ষায় সংযত, শান্ত কিন্তু মহাভারতের চরিত্রগুলিতে ত্যাগ-ভোগ, রাগ-বিরাগ, ক্রদ্ধ—শান্ত পাশাপাশি অবস্থান বশতঃ রীতিমত দ্বন্দ্বমুখর। দাম্পত্য প্রেমের আদর্শেও পার্থক্য সুস্পষ্ট। রাম এক বিবাহের আদর্শে বিশ্বাসী কিন্তু, অর্জুন আপন শৌর্যে—বীর্যে একাধিক রাজকন্যার পাণিগ্রহণ করেছেন। রামায়ণের নারীচরিত্রের কোমলতা ও সহনশীলতা তাদের উদাসীনতা শিক্ষা দিয়েছে, মহাভারতের নারীগণ কিন্তু প্রয়োজন মত রূঢ়, স্পষ্ট— ভাষী ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দ্রৌপদী, কুম্ভী, গান্ধারী যেন সত্যিই ক্ষত্রিয়া রমণী, তাঁরা যুদ্ধনীতি, রাজনীতি সম্বন্ধে অভিজ্ঞ। প্রয়োজনে অন্যায়ের প্রতিকার দাবী করতে জানেন। পুরুষের প্রতিটি ক্রিয়াকলাপের সমালোচনায় তাঁরা মুখর। অনেকের অনুমান রামায়ণ পূর্বভারতীয় এবং মহাভারত পশ্চিম ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। বাল্মীকি ও ব্যাসদেব এই দুই মহাকবির রচনায় যথেষ্ট মৌলিকতা লক্ষ্য করা গেলেও, পৃথক পৃথক হলেও এই দুই মহাকাব্যই পরবর্তীকালে তাদের সাহিত্য কৃতিকে অতিক্রম করে ধর্মশাস্ত্রের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে।

পাদটীকা – মহাভারত

১৭. “It is only in a very restricted sense that we may speak of the Mahabharata as epic and a poem. Indeed in a certain sense the Mahabharata is not one poetic production at all but rather a whole Literature.

১৮. বিব্যাস বেদান্ যস্মাৎ স তস্মাদ্ ব্যাস ইতিস্মৃতঃ। ম. ১।৬০।৫

১৯. পুরাবৃত্ত অনুযায়ী পাণ্ডুর অভিশাপ ছিল যে স্ত্রী সঙ্গম করলে তার মৃত্যু হবে। তাই কুন্তী দেবতাদের মাধ্যমে সন্তান লাভ করে। ধর্মের ঔরসে যুধিষ্ঠির, বায়ুর ঔরসে ভীম, ইন্দ্রের ঔরসে অর্জুন ও অশ্বিনী কুমারদ্বয়ের ঔরসে যথাক্রমে নকুল ও সহদেব জন্ম নেয়।

২০. Winternitz : History of Indian Literature vol. I. P. ৩৮৭

২১. BORI থেকে সভা ও ভীষ্ম পর্ব প্রকাশিত। ভারতীয় বিদ্যাভবন (বোম্বাই) থেকে উদ্যোগ পৰ্ব প্রকাশিত।

২২. (হরিবংশ ১/৭–১৩)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *