তৃতীয় অধ্যায় – মহাকাব্য

তৃতীয় অধ্যায় – মহাকাব্য

আর্যমহাকাব্যদ্বয়, পুরাণ সাহিত্য ইত্যাদি আলোচনা শেষে এক্ষণে সংস্কৃত সাহিত্যে মহাকাব্য প্রসঙ্গে আলোচনা। কিন্তু স্বভাবতঃই মনে প্রশ্ন জাগে রামায়ণ-মহাভারত- পুরাণ থেকে এই কালিদাসের কাল পর্যন্ত্য প্রায় কয়েক শত বৎসরের অর্থাৎ সুদীর্ঘ কালের সংস্কৃত সাহিত্য কী অবস্থায় ছিল? Maxmullar সাহেবের মতে এই সুদীর্ঘকাল যাবৎ সংস্কৃত সাহিত্য বন্ধ্যা ছিল। কালিদাসের যাদুস্পর্শে সংস্কৃত সাহিত্য তাঁর জীবন ফিরে পায়।’ খ্রিষ্ট পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর পর বৈদেশিক আক্রমণের ফলে ভারতবর্ষের জনগণের নিত্য নুতন সাহিত্যসৃষ্টি করার মত মানসিক স্থিরতা ছিল না। কারও মতে বা সেই সময়ে প্রাকৃত ভাষা আত্ম প্রকাশ করে এত বেশী বিকাশ লাভ করে যে সংস্কৃত ভাষা যাত্রা শুরু করলেও তাকে মূলতঃ প্রাকৃত ভাষার কাঁধে ভর দিয়েই পথ চলা শুরু করতে হয়েছিল। কিন্তু Maxmullerএর এই নবজাগৃতির সিদ্ধান্ত কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কারণ-শুষ্ক, রুক্ষ বন্ধ্যা মরুভূমিতে কখনোই রাতারাতি সোনা ফলানো যায় না। সংস্কৃত সাহিত্যের ধারা কোনকালেই অবরূদ্ধ হয়নি, তবে হ্যাঁ তার গতি অবশ্যই শ্লথ হয়ে পড়েছিল এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ সংস্কৃত ভাষাই হিন্দু সাম্রাজ্যের ভাষা ছিল। সে যুগে বহু সাহিত্য ইতিহাস রচিত হয়েছিল এ বিষয়ে আমরা নিঃসন্দিগ্ধ কিন্তু হিন্দুধর্মের ক্রমবনতি ঘটলে বুদ্ধের আবির্ভাবে বা বৌদ্ধ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে হিন্দুধর্মের অবনতির সাথে সাথে সংস্কৃত ভাষারও অবনতি ঘটে। এই কালকে সংস্কৃত সাহিত্যের অবসাদ যুগ বা অন্ধকার ময় যুগ বলা হয়। নানাভাবে বুদ্ধের বাণী প্রচারিত হতে থাকে পালি ভাষায়। ক্রমশঃ সংস্কৃতভাষার পরিবর্তে সেই সময়ে পালি ভাষাই প্রাধান্য পেতে থাকে। অতএব সেই অন্ধকার যুগে সংস্কৃত ভাষায় খুব বেশী মৌলিক সাহিত্য রচনা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাই বলে সংস্কৃত সাহিত্যের ধারা কখনই সম্পূর্ণভাবে থেমে থাকে নি। এর প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়—প্রথমতঃ—আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি যে রামায়ণ ও মহাভারতের মধ্যে মধ্যে বহু আখ্যান উপাখ্যান যুক্ত হয়ে আছে যা সাহিত্যের বিচারে অনবদ্য। এই সমগ্র রচনা সবই পরবর্তীকালের সংযোজন বা প্রক্ষেপ। অর্থাৎ পরবর্তী কালের রচনা যা কালিদাস পূর্ব যুগের সাহিত্যকীর্তির নিদর্শন স্বরূপ।

দ্বিতীয়ত :—কালিদাস স্বয়ং তার পূর্ববর্তী ভাস, কবিপুত্র, সৌমিল্ল প্রভৃতির নামোল্লেখ করেছেন।

তৃতীয়ত :—প্রাচীন বৈয়াকরণ দিগের উদ্ধৃত তথ্য থেকেই সেই যুগের সংস্কৃত সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়। কয়েকটি মুক্তক শ্লোক ও জাম্ববতী বিজয় নামে একখানি মহাকাব্যের উল্লেখও প্রণিধানযোগ্য। পাতাল বিজয় নামে আর একখানি গ্রন্থের কথাও পাওয়া যায়। পাণিনি যে কবি ছিলেন, সে বিষয়ে Aufreeht আমাদের সকলের আগে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এতদ্ব্যতীত বররুচির কাব্যসুষমা প্রসঙ্গে পতঞ্জলি এমন কিছু শ্লোকাংশ উদ্ধৃত করেছেন যা সেইযুগের কবিপ্রতিভাকে মহিমান্বিত করে। পিঙ্গল এর ছন্দসূত্র কেবল ছন্দেরই উল্লেখ করে না, সেই সমস্ত ছন্দ প্রয়োগে বোধকরি তৎকালীন বহু সাহিত্যও বর্তমান ছিল।

চতুর্থত :—সর্বোপরি Buhler, Fllet, Kielhora প্রভৃতি পণ্ডিতগণ Maxmullar সাহেবের মত সম্পূর্ণরূপে খণ্ডন করেছেন। Buller প্রমাণ করেছেন যে হয়— ৫ম শতক পর্যন্ত্য যে সমস্ত শিলালেখ সমূহ আবিষ্কৃত হয়েছে তা উন্নত মানের সংস্কৃত সাহিত্যরই পরিচয় বহন করে। যদিও সেগুলি অধিকাংশই পদ্য ছন্দে রচিত তথাপি গদ্য সাহিত্যেরও অভাব পরিলক্ষিত হয় না। বিভিন্ন উৎকীর্ণ লিপি সমূহ কেবলমাত্র রাজ প্রশস্তি বা ঐতিহাসিক তথ্যই পরিবেশন করে নাই, উপরন্তু সেই সমস্ত অভিলেখগুলি কালিদাসপূর্ব যুগের সংস্কৃত কাব্যের ধারার বাহক ও প্রচারক বললে অত্যুক্তি হয় না। সেই সময়কার রচনার মধ্যে তন্ত্রাখ্যায়িকা, বাৎসায়নের কামসূত্র, ভাসের নাটকসমূহ, জাতক ও অবদানসাহিত্য প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য সংস্কৃত সাহিত্য কীর্তি। কামসূত্র, নাটক, জাতক ও অবদান সাহিত্য আমরা যথাস্থানে আলোচনা করব। এবং বিভিন্ন বিখ্যাত অভিলেখ সম্বন্ধেও আমরা পরবর্তী নির্দিষ্ট অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। সংস্কৃত মহাকাব্য প্রসঙ্গে কালিদাসের পুর্বে আমরা অশ্বঘোষ ছাড়া আর কোনও কবির সম্বন্ধে তেমন কোন প্রামাণ্য তথ্য পাই না। সেই হেতু অশ্বঘোষের আলোচনাই এই মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক।

অশ্বঘোষ

আমরা জানি সভ্যতা ও সংস্কৃতি দুই-ই পরিবর্তনশীল। যুগে যুগে আবশ্যকতাই চিরকাল কোন বিশেষ প্রণালী বা সংস্কারের প্রবর্ত্তক, একথা অস্বীকার করা যায় না। ইতিহাস সাক্ষ্মী যে পাটলীপুত্র, নালন্দা, বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতচর্চার বিশেষ প্রসার ঘটে। বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ সে যুগে শাস্ত্রজ্ঞ বলে বিবেচিত হতেন। তক্ষশীলার কুষানবংশীয় রাজা কণিষ্কের (খ্রিষ্টাব্দ প্রথম শতক) কালে সংস্কৃত ও হিন্দুবিদ্যার পুনরভ্যুত্থান ঘটলে তৎকালীন বৌদ্ধ-দার্শনিক ও কবি অশ্বঘোষ সংস্কৃত ভাষায় কাব্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ ও নানাবিধ কু-সংস্কারাচ্ছন্ন রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে বৌদ্ধ-ধর্মের উদারনৈতিক ধর্মাদর্শের প্রতি জনসাধারণ তখন প্রবল ভাবে আকৃষ্ট, এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে বৌদ্ধ কবি অশ্বঘোষের আবির্ভাব। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কাব্যে সাহিত্যে সে যুগের চিন্তা ও চেতনা ধরা দিয়েছে স্পষ্ট ভাবে। এক অর্থে বিচার করে দেখলে অশ্বঘোষের রচনা ত্যাগ ও বৈরাগ্যের আদর্শে ধর্মীয় সাহিত্য প্রচারেরই নামান্তর মাত্র। তাঁর রচনার সাহিত্যিক মূল্যও কোন অংশে কম নয়।

অতীত দিনের বহু কবি সাহিত্যিকের জীবনী যেমন বিস্মৃতির অতলে নিমজ্জিত ঠিক তেমনি বৌদ্ধ দার্শনিক অশ্বঘোষের জীবনবৃত্তাত্তও তেমন ভাবে কোথাও পাওয়া যায় না। তিব্বত দেশীয় জীবন চরিত প্রণেতার মতে তিনি সুগায়ক ছিলেন এবং একদল গায়ক গায়িকা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে গানের মধ্য দিয়ে জগৎ-এর অনিত্যতা প্রচার করে বেড়াতেন। কিংবদন্তী অনুসারে অশ্বঘোষ ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করেন। মধ্যভারতের বহু স্থানে স্থানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরূপে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতেন এবং পরে রাজা কণিষ্কের রাজসভা অলঙ্কৃত করেন। তাঁর পিতা ছিলেন সৌম্যগৃহ্য এবং মাতার নাম সুবর্ণাক্ষী। অশ্বঘোষ-একাধারে কবি, দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ ছিলেন। ব্যাকরণ অলঙ্কার ও অর্থশাস্ত্রেও তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের মধ্য দিয়ে দার্শনিক দৃষ্টি ভঙ্গির মোড়কে তিনি যে রূপ উচ্চাঙ্গের ধ্রুপদী সাহিত্য পরিবেশন করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে বিশেষ প্রশংসার দাবীদার।

চৈনিক পরিব্রাজক ইৎ সিং ভারত পরিভ্রমণ করে বলেছিলেন নাগার্জুন, দেব ও অশ্বঘোষের মত মানুষ এক এক যুগে দুই একজনই জন্মায়। ফরাসী পণ্ডিত সিভালেভী তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন— খ্রিষ্ট শতাব্দীর প্রারম্ভে যে সমস্ত বৃহৎ স্রোত (ভাবস্রোত) ভারতবর্ষকে সঞ্জীবিত ও পরিবর্তিত করেছে, তিনি তার উৎপত্তি স্থানে দণ্ডায়মান। ভাবের সম্পদে ও বৌচিত্র্যে তিনি মিল্টন, গেটে, কান্ট ও ভলটেয়ারের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।’ সেইহেতু ‘আচার্য’, ‘ভদণ্ড’, ‘মহাবাদিন্’, ‘মহাকবি’ প্রভৃতি নানা উপাধিতে—তাঁকে ভূষিত করা হয়েছিল। মহাকবি কালিদাস তাঁর পূর্বসূরী কবি অশ্বঘোষকে কেবল যে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করতেন তাই নয়, তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে অশ্বঘোষের নিকট বহুল পরিমানে ঋণী ছিলেন। যে দুইটি মহাকাব্যের জন্য অশ্বঘোষ সংস্কৃত সাহিত্যে কবি আখ্যায় ভূষিত সেই দুইটি যথাক্রমে-বুদ্ধচরিত ও সৌন্দরনন্দ। বুদ্ধচরিত :—চৈনিক পরিব্রাজক ইৎ-সিং এর মতে বুদ্ধচরিত ২৮টি সর্গে সম্পূর্ণ মহাকাব্য। যদিও মাত্র ১৭টি সর্গ আমাদের হস্তগত। তন্মধ্যে ১৩টি সর্গ অশ্বঘোষ রচিত মূল রচনা এবং বাকি ৪টি সর্গ অমৃতানন্দ নামক জনৈক নেপালী পণ্ডিত, সংস্কৃতজ্ঞ দ্বারা ১৮৩০ খ্রিঃ রচিত ও মূল অংশের সাথে সংযোজিত। তিব্বতীয় ও চীনা ভাষায় সম্পূর্ণ গ্রন্থের অনুবাদ পাওয়া যায়। এছাড়া ইটালী, জার্মানী, ইংরাজী, ও বঙ্গভাষায় অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত অনূদিত হয়েছে। শান্ত রসাশ্রিত এই মহাকাব্যে ভগবান বুদ্ধের জন্ম, অন্তঃপুর বিহার, উদ্বেগের উৎপত্তি, নারী প্রত্যাখ্যান, অভিনিষ্ক্রমণ, ছন্দক-বিসর্জন, তপোবন-প্রবেশ, অন্তঃপুর বিলাপ, কুমার-অন্বেষণ, বিম্বিসারের আগমন, কামনিন্দা, আরাড দর্শন, মার-বিজয়, বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি বর্ণিত হয়েছে, পরবর্তী সংযোজনের ফলে বারানসীধামে বুদ্ধকর্তৃক দীক্ষার বর্ণনায় সমাপ্ত হয়েছে।

কাহিনী সংক্ষেপ :—অতি মনোরম পরিবেশে হিমালয়ের পাদদেশস্থিত কপিলাবস্তুর রাজ দম্পতি শুদ্ধোধন ও মায়াদেবীর কোলে জন্ম নেয় বুদ্ধ। ছেলেবেলায়-তার নাম ছিল সিদ্ধার্থ। অতি যত্নে রাজসুখে লালিত পালিত হতে হতে যশোধরা নামে সুন্দরী কন্যার সাথে খুব অল্প বয়সেই তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু তাঁর ক্রমশঃ বিষয় আশয়ে অনাসক্তি সকলকে ভাবিয়ে তোলে। পুত্রের ঔদাসীন্য দূরীকরণে তৎপর পিতা কর্তৃক প্রমোদ ভ্রমণের ব্যবস্থা, রথারোহনে গমনকালে পথিমধ্যে জরা, ব্যাধি, মৃতদেহ দেখে রাজপুত্রের মনে বৈরাগ্য জন্মে। সাংসারিক সুখ-ভোগের প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্মে এবং এই সকলই নিরর্থক বলে মনে হতে থাকলে পুত্রের মনে জাগতিক সুখ- ভোগ বিলাসের ইচ্ছা উদ্রেকের নিমিত্ত প্রমোদ-উদ্যানে বারবিলাসিনী দিগের দ্বারা নানারূপ আনন্দ আয়োজনই একরূপ ব্যর্থ হল। তাঁর কাছে তখন এই সংসার অনিত্য, মায়াময় জগতের বন্ধন সকলই মিথ্যা প্রতিপন্ন হওয়ায় অবশেষে সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত। বনপথে যেতে যেতে সারথি ছন্দককে বিদায় দিলে শূণ্য রথ গৃহে ফেরা মাত্র অন্তঃপুরে পুত্রশোকে আকুল ক্রন্দনে দশ দিক হাহাকার করে উঠল। রাজা শুদ্ধোধন নিজেকে দুর্ভাগা দশরথের সাথে তুলনা করে মৃত্যু ভিক্ষা করছেন। যশোধরা সীতাসম অন্তরের জ্বালায় দগ্ধ হতে থাকলো। অপর দিকে সিদ্ধার্থ জীবের দুঃখে কাতর হয়ে জীবকূলের দুঃখ মোচনে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। রাজপুরোহিত ও মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতে ধর্মাধর্ম, সুখ-দুঃখ ইত্যাদির আলোচনায় তিনি নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। অবাড় মুনির আশ্রমে মুনির সাথে গৌতমের গভীর আধ্যাত্মিক আলোচনা হয়। সাংখ্য দর্শনের সকল নিবিড় যুক্তি তিনি একে একে সুযুক্তি—বলে খণ্ডন করেন। অবশেষে দীর্ঘ ছয় বৎসর নৈরঞ্জনা নদীতীরে তপস্যারত অবস্থায় ছিলেন। গোপকন্যা সুজাতা কর্তৃক প্রদত্ত পায়েস ভক্ষণ এবং পুনরায় অশ্বত্থতলে তপস্যাকালে মার কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হলে মারের সৈন্যদের সাথে তাঁর তুমুল সংঘর্ষ বাধে। যুদ্ধে জয় লাভ করে পুনরায় ধ্যানে অধিষ্ঠান করলে পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ করে তিনি সংসারের অসারত্ব উপলব্ধি করেন এবং জ্ঞানী হন। এইভাবে তিনি গৌতমবুদ্ধে পরিণত হলেন।

‘বুদ্ধচরিত’-এ মহাকাব্যের লক্ষণগুলি যথাযথ অনুসৃত হয়েছে। রাজৈশ্বর্যের বর্ণনায়, মনোমুদ্ধকর প্রাকৃতিক শোভা বর্ণনায়, হৃদয়গ্রাহ্য ভাব বর্ণনায়, সর্বোপরি ভাষার প্রাঞ্জলতা ও সাবলীল লিখন শৈলীই তাঁর কাব্যে উৎকর্ষ সাধন করেছে। ছন্দ ও অলঙ্কার প্রয়োগেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। অশ্বঘোষ কাব্যের বিচারে আগে কবি, পরে তাত্ত্বিক দার্শনিক। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর চিন্তাধারা কোথাও তাঁর কবি প্রতিভাকে খর্ব করেনি। অসংখ্য জ্ঞানগর্ভ উক্তি যা পরবর্তী জীবনে প্রবাদ-বাক্যের মত প্রচলিত ও অনুসরণ যোগ্য। যা নিঃসন্দেহে কাব্যের অর্থ গৌরবকে এক বিশেষ তাৎপর্য দান করে পাঠকমনে স্বভাবতই এক বিশেষ শ্রদ্ধার সঞ্চার করে।

সৌন্দরনন্দ :— অষ্টাদশ সর্গে রচিত সৌন্দরনন্দ কবি অশ্বঘোষের আর এক মহাকাব্য। বুদ্ধের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা নন্দের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণই এই মহাকাব্যের মূল বিষয়বস্তু। যথাক্রমে কপিলা বস্তুর বর্ণনা, রাজার বর্ণনা, তথাগতের বর্ণনা, নন্দের স্ত্রীর প্রার্থনা, নন্দ প্রব্রজ্যা, ভাষাবিলাপ, নন্দের বিলাপ, স্ত্রীবিঘাত, নন্দের অপবাদ, স্বর্গদর্শন, নন্দের ধ্যান, শীল ও ইন্দ্রিয়বিজয়, আদি প্রস্থান, বিতর্ক পরিহ, আর্য- সত্য ব্যাখ্যা, অমৃতপ্রাপ্তি, আজ্ঞা, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিষয় এক-একটি সর্গে প কল্পিত উপায়ে সাহিত্যের হাত ধরে পরিবেশিত হয়েছে।

কাহিনী সংক্ষেপ :—কপিলাবস্তু নগরীর প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কাব্যের সূচনা করে নগরীর সকল প্রকার সমৃদ্ধি প্রথমে বর্ণিত হয়েছে। কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোধনের প্রথমা স্ত্রীর পুত্র বুদ্ধ এবং কনিষ্ঠা পত্নীর গর্ভে জন্ম হয়েছিল পুত্র নন্দের। নন্দ- র রূপ যৌবন ছিল অতীব সুন্দর। সেইহেতু তার অপর নাম সুন্দর। বুদ্ধের সন্ন্যাস গ্রহণ ও সংসার ত্যাগও এখানে আলোচিত হয়েছে। নন্দের পরমাসুন্দরী স্ত্রীর নামও ছিল সুন্দরী। বিবাহের পর থেকে স্ত্রীর প্রতি নন্দের অধিক মাত্রায় আসক্তি লক্ষ্য করা যায়। তিনি সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে অন্তঃপুরে যারপর নাই সুখে পরম লীলাখেলায় মত্ত ছিলেন। এমন সময়ে একদিন ভিক্ষাপাত্র হাতে নগর পরিক্রমা করতে করতে বুদ্ধ এলেন ভাই নন্দের প্রাসাদে। দ্বাররক্ষীগণ তাঁর সমাদর করা তো দূরের কথা তাঁকে শূন্য হাতেই ফিরিয়ে দিলেন। এই সংবাদ যখন পরিচারিকা মারফৎ ভোগবিলাসে উন্মত্ত রাজা নন্দের কাছে পৌঁছল তখন তিনি স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে তৎক্ষণাৎ বুদ্ধের অনুসরণ করলেন, এবং সাক্ষাৎ হলে নন্দকে সাথে নিয়ে বুদ্ধ আশ্রমে গেলেন, তথায় নানাবিধ জ্ঞানগর্ভ উপদেশ পূর্বক প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে হলো। কিন্তু নন্দের মত ভোগপিপাসু ব্যক্তির পক্ষে সাংসারিক সুখ ত্যাগ করা অসম্ভব হয়ে উঠল। তখন বুদ্ধ তাঁকে নির্জন হিমালয়ে ভ্রমণের নিমিত্ত নিয়ে গেলেন। বনের পথে যেতে যেতে এক কানা বাঁদরীকে দেখিয়ে বুদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন নন্দ, তোমার স্ত্রী কি এর থেকে সুন্দরী? নন্দ রেগে বললেন ‘বাঁদরীর সাথে কখনও মানুষীর তুলনা হয়?’ অতঃপর স্বর্গে পৌঁছে নন্দনবনের অপ্সরাকে দেখিয়ে একই প্রশ্ন করলে নন্দ বললে ‘অপ্সরার সাথে কি মানবীর তুলনা হয়’? এই সমস্ত নানাবিধ বিষয়ের মধ্য দিয়ে সংসারের প্রতি অনাসক্তি ও ইন্দ্রিয় জয়ের শিক্ষাই বুদ্ধ নন্দকে দিতে থাকলেন। অতঃপর স্ত্রীর প্রতি, সংসারের প্রতি ধীরে ধীরে মোহান্ধকার অপসৃত হতে হতে ক্রমশঃ তাঁরও হৃদয়ে মুক্তির বাসনাজেগে উঠল, তিনি বুঝলেন যে সুখ ভোগ ক্ষণিকের। সেই হেতু বুদ্ধের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি নিজেকে ধ্যানে নিয়োজিত করলেন। কঠোর তপস্যায় তিনিও বোধি লাভ করলে বুদ্ধের চরণাশ্রিত হয়ে সংসারী মানুষকে মুক্তির আলো দেখিয়ে প্রব্রজ্যা দানের কাজে ব্রতী হলেন। কাব্যের শেষে দেখি নন্দ পত্নী সুন্দরীও স্বামীর নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলেন।

Keith-এর মতে ‘সৌন্দরনন্দই অশ্বঘোষের পূর্ববর্তী রচনা। সৌন্দরনন্দের কাব্যরীতি, ভাষা, সর্বোপরি সাহিত্যের আবরণে গভীর তত্ত্বের পরিবেশন সত্যই অশ্বঘোষকে মহাকবি করে তুলেছে। কবি বহুক্ষেত্রেই বাল্মীকিকে অনুসরণ করেছেন। বিশেষতঃ উপমা ও অলংকারের প্রয়োগ। তিনি যে কেবলমাত্র বৌদ্ধধর্মের প্রচারক হিসাবেই কাব্য লিখেছেন তাই নয় তাঁর রচনার মধ্যে বারবিলাসিনীদের ছলাকলা, নন্দ ও সুন্দরীর দাম্পত্য প্রেমের মনোজ্ঞ বর্ণনা, এই সব ক্ষেত্রেও তাঁর কবিত্ব শক্তি এক অসাধারণ মাত্রা পেয়েছে।

কবি ‘সৌন্দরনন্দে’র শেষাংশে দুটি শ্লোকের মধ্য দিয়ে তাঁর নিজ বক্তব্য উপস্থাপিত করেছেন।—

“ইত্যেষাব্যুপশান্তুয়ে ন রতয়ে মোক্ষার্থগর্ভাকৃতিঃ
শ্রোতৃণাং গ্রহণার্থমন্যমনসাং কাব্যোপচারাৎ কৃতা।
যন্মোক্ষাৎ কৃতমনদত্র হি ময়া তৎকাৰ্য ধৰ্মাৎকৃতং।
পাতুং তিক্তমিবৌষধং মধুযুতং হার্দ্যং কথংস্যাদিতি।”

অর্থাৎ আমি অন্যান্য রচনায় শান্তির জন্য, মঙ্গলের জন্য যে সকল কথা বলেছি এখানে সেসকল কথাই কাব্যের উপচারে পরিবেশন করেছি। মোক্ষলাভের মত দুরূহ বিষয়ে সাংসারিক মানুষের আসক্তি জন্মানো খুবই কঠিন। সেইহেতু তিক্ত ঔষধে মানুষের অনিচ্ছা জন্মালে যেমন মধু সহযোগে তা সেবনের যোগ্য করে নিতে হয়। সেরূপ ভোগন্মত্ত মানুষ যাতে তত্ত্বকথা শুনতে আগ্রহী হয় সেইজন্য সাহিত্যের হাত ধরে কাব্যচ্ছলে সেই সব জ্ঞানগর্ভ কথা পরিবেশন করেছি। সৌন্দরনন্দ পাঠ করলে একথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। প্রথিতযশা কবির প্রতিভার ঐশ্বর্যে মণ্ডিত হয়ে নিছক তত্ত্বকথা যেন হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে।

কালিদাস

সংস্কৃত সাহিত্য জগতের একচ্ছত্র সম্রাট কবিবর কালিদাস। ‘কালিদাস’ নাম উচ্চারণের সাথে সাথে শুধু একজন কবিকেই আমরা বুঝি না। এই নামের মধ্য দিয়ে সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যের, তথা একটা যুগের স্বর্ণময়ী সাংস্কৃতিক প্রতীতি জন্মায়। মহামুনি বাল্মীকি ও মনীষীকবি বেদব্যাসের মতই মহাকবি কালিদাস ভারতের হৃদয় স্পন্দনকে অনুভব করেছিলেন। সেই হেতু রামায়ণ মহাভারতের মতই তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য যুগে যুগে শুধু ভারতবর্ষকেই নয় সমগ্র পৃথিবীকে ধন্য করে, গৌরবান্বিত করে। বিশ্বসাহিত্যের দরবারে শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদালাভে সমর্থ কবি কালিদাস ভারতবর্ষের প্রাচীন কবি ও বিশিষ্ট মনীষীদের ন্যায় নিজ পরিচয় প্রদানে উদাসীন ছিলেন। সেই কারণেই তাঁর লেখা কোন রচনাতেই কবির নিজ জীবন কাহিনী, বংশপরিচয় ও সময়ের সুনির্দিষ্ট কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। সকলই কালের গর্ভে বিলীয়মান। এ মত অবস্থায় মহাকবি কালিদাসের গুণমুগ্ধ পাঠক ও অনুগামীদের প্রচেষ্টায় কিছু জনশ্রুতি গড়ে উঠেছে। সেই সমস্ত কিংবদন্তী’ আপাত মধুর শোনালেও তার কোন বিশ্বাসযোগ্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রাক্ কালিদাসীয় যুগের কাব্যসাধনার পবর্তীকালে কালিদাসের মত মহতী প্রতিভাধর কবি বোধকরি বিশ্ববাসীকে এমনই চমৎকৃত ও রোমঞ্চিত করেছিল যে তাঁর জীবন সম্বন্ধে অজ্ঞান অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থা সহ্য করতে না পেরে কবিগুণে মুগ্ধ জনেরা নানারূপ জনাশ্রুতির সৃষ্টি করেছিল, যার মূলে ছিল কালিদাসের প্রতি দেব অনুগ্রহ। অর্থাৎ এমন লোকোত্তর প্রতিভার বিকাশ কোন দেবতার অনুগ্রহ ব্যতীত সম্ভব নয়।

কালিদাসের জন্মভূমি :—কালিদাসের জন্মস্থান বিষয়ে কোন প্রামাণ্য তথ্য না থাকায় সবই অনুমান নির্ভর। বহুল প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য তথ্য হল বিক্রমাদিত্যের রাজসভাকবি ছিলেন কালিদাস। বিক্রমাদিত্যের রাজধানী উজ্জয়িনী, এই উজ্জয়িনীর মনোজ্ঞ বিবরণ কালিদাসের ‘মেঘদূতে’র লাইনে লাইনে দেখতে পাই। উজ্জয়িনীর প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও নিবিড় সান্নিধ্য হেতু কারুর মতে বা সেখানে কবি জন্মেছিলেন, অথবা মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রীর গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমান সিন্ধিয়া রাজ্যের প্রাচীন মালোব প্রদেশের মান্দাসোর নগরীতে কালিদাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং সেখান থেকেই তাঁর উজ্জয়িনীর সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। ভিনসেন্ট স্মিথও এই মতকেই সমর্থন করেছেন।

কালিদাসের কাল :—কোন্ পুণ্যক্ষণে প্রবাদ প্রতীম মহাকবি পণ্ডিত কালিদাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার কোনরূপ প্রামান্য তথ্য না থাকায় প্রত্নতত্ত্ববিদগণ নানা গবেষণার মধ্যদিয়ে কালিদাসের সম্ভাব্য কাল নির্ধারণের নিরলস চেষ্টা করেছেন। এই সমস্ত-গবেষণালব্ধ মতগুলি পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তবে সবগুলি মতের সাপেক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। মতগুলি ক্রমান্বয়ে আলোচনা করা হল—

প্রথমত :— কালিদাসের আবির্ভাব কাল উজ্জয়িনীরাজ শকারি বিক্রমাদিত্যের সময়ে অর্থাৎ খ্রিষ্ট পূর্ব প্রথম শতাব্দী (৫৭ খ্রিপূর্বাব্দ)। ভারতীয় পণ্ডিতগণের মতে বিক্রমাদিত্য খ্রিঃ পূঃ ৫৭ অব্দে বিক্রম সংবৎ বর্ষের প্রচলন করেন। কিন্তু কোন নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে নানাজনে নানারূপ অভিমত এই প্রসঙ্গে পোষণ করেন। ‘জ্যোতির্বিদ্যাভরণ’ নামক জ্যোতিষ গ্রন্থে বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার নয়জন পণ্ডিতের নাম পাওয়া যায়। শ্লোকটি নিম্নরূপ—

ধন্বম্ভরিক্ষপণকামরসিংহ শঙ্কবেতাল ভট্টঘটকর্পর-কালিদাসঃ।
খ্যাতো বরাহমিহিরো নৃপতেঃ সভায়াং রত্নানি বৈ-বররুচির্ণব বিক্রমস্য।

ধন্বন্তরি, ক্ষপণক, অমরসিংহ, শঙ্কু, বেতালভট্ট, ঘটকর্পর, কালিদাস, বরাহমিহির ও বররুচি এই নয়জন পণ্ডিত বিক্রমাদিত্যের নবরত্নসভায় বর্তমান ছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই ‘জ্যোতির্বিদ্যাভরণ’ নামক গ্রন্থটি কোন কোন গবেষকের মতে কালিদাসের লেখা নয়। এটি ১৬শ শতকের কোন এক কবির রচনা। কালিদাস তাঁর ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নামক নাটকের ভরতবাক্যে: ‘অগ্নিমিত্রে’ এইরূপ ভাবে ৭মীর প্রয়োগ দেখে কেউ কেউ বলেন ‘অগ্নিমিত্র’ তখন তাহলে জীবিত ছিলেন। পুস্পমিত্রের পুত্র অগ্নিমিত্রের কাল যদি হয় খ্রিঃ পূঃ প্রথম শতক তাহলে খ্রিঃ পূঃ প্রথমশতকের উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার অন্যতম রত্ন কালিদাসের অস্তিত্ব বিপন্নতার মুখোমুখি হয় কিভাবে? অতএব প্রথম মত অনুযায়ী কালিদাসের আবির্ভাব কাল খ্রিঃ পূর্ব প্রথম শতাব্দীর পক্ষে এই যুক্তি দেখান হয়ে থাকে।

দ্বিতীয়ত :—অপর মতটি হল খ্রিঃ চতুর্থ শতাব্দীর শেষে দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালই কালিদাসের কাল। এই মতের সাপেক্ষে বলা হয়— কালিদাস অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত মহাকাব্যের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। এছাড়া কালিদাস তাঁর রচনায় অশ্বঘোষের যশোগান করেছেন। অশ্বঘোষকে কণিষ্কের সমসাময়িক ধরা হয় অতএব প্রথম শতাব্দী যদি হয় কণিষ্কের সময়, তবে এর পরবর্তী সময়ে কালিদাসকে স্থাপন করতে হয়। আবার কালিদাস ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নাটকের ভাস, সৌমিল্ল ও কবিপুত্রের নাম উল্লেখ করেছেন। ভাস অশ্বঘোষের পরবর্তী সময়ে তৃতীয় শতাব্দীর বলে অনুমান করা হয়। অতএব ভাসের পরবর্তী সময়ে ৪র্থ-৫ম শতকে চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের ও সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালকেই কালিদাসের কাল বলা যায়। Keith মনে করেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় কালিদাস নবরত্নের এক বিশিষ্ট রত্নছিলেন। Keith আরও মনে করেন কালিদাস হয়ত ‘কুমার সম্ভব’ রচনা করেছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের, পুত্র কুমার গুপ্তের জন্মের কথা বর্ণনা করেই। কমারগুপ্তের সময় ৪১৩ খ্রিঃ—৪৫৫ খ্রিঃ। এই সময়েই গুপ্তযুগ চরম উন্নতির শিখরে উঠেছিল। সেই সময়েই কালিদাসের মত কবি প্রতিভাও সমৃদ্ধির আলোয় নব নব সাহিত্য সৃষ্টিতে মগ্ন ছিল। তৎপরবর্তীকালে অর্থাৎ (৪৬৫–৪৭০) খ্রিঃ যদি হুণ আক্রমণ হয়ে থাকে তখন নিশ্চয় কালিদাস জীবিত ছিলেন না, থাকলে এ-হেনচরম সংকটের মূহুর্তে এরূপ কাব্যসৃষ্টি সম্ভব ছিল না। অতএব হূণ আক্রমণের পূর্বেই কালিদাসের স্বর্ণময়যুগকে স্থাপন করা শ্রেয়। অতএব Keith এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খ্রিঃ চতুর্থশতকই কালিদাসের কাল।’ অন্যান্য ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ যেমন লানসেন্, কর্ণেল, উইলফোর্ড, জেমস্ প্রিন্সেপ ম্যাকডোনেল, ভিনসেন্ট স্মিথ এঁরা সকলেই Keith এর মত সমর্থন করে বলেন গুপ্তযুগের সুখ ও সমৃদ্ধির কালেই কালিদাসের কাব্য প্রতিভা—ভারতের সাংস্কৃতিক জীবনকে মহিমান্বিত করেছিল। এবং তাঁদের মতে কুমারসম্ভব, রঘুবংশ, মালবিকাগ্নিমিত্র প্রভৃতি রচনায় গুপ্তরাজবংশের প্রচ্ছন্ন প্রশস্তিও লক্ষ্য করা যায়। এলাহাবাদে আবিষ্কৃত ভীটায় (৩৫০ খ্রিঃ) যে সমস্ত দৃশ্য অঙ্কিত রয়েছে তা শকুন্তলার প্রথম অঙ্কের মৃগয়া দৃশ্যের অনুকরণে সৃষ্ট। মান্দাসোরের সূর্যমন্দিরের গায়ে যে প্রশস্তি (৪৭২-৪৭৩) তার রচনাশৈলী ভাষা ও রীতির প্রয়োগ হুবহু কালিদাসের অনুসরণে লিখিত। এমনকি মেঘদূত ও ঋতুসংহার এর অনুকরণে। অতএব একথাই প্রমাণিত হয় যে কালিদাস এই সমস্ত বিষয় অপেক্ষা পূর্বকালের। অতএব দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকাল ৪১৩ খ্রিঃ মধ্যে কালিদাসের কাল এই মতের সমর্থনে পূর্বোক্ত যুক্তি গুলির যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

তৃতীয়ত :—সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকাল খ্রিঃ ষষ্ঠ শতাব্দীকে কালিদাসের কাল বলে যাঁরা চিহ্নিত করেছেন তাঁদের গবেষণা লব্ধ যুক্তিগুলি নিম্নরূপ :—এই মতাবলম্বী পণ্ডিতেরা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভায় বিশ্বাসী। বরাহ মিহির এই নবরত্ন সভার অন্যতম একজন রত্ন। তাঁর মৃত্যু হয় ৫৮৭ খ্রিষ্টাব্দে। কালিদাস যদি বরাহমিহিরের সমসাময়িক হয় তবে কালিদাস ষষ্ঠ শতকের কবি। মল্লিনাথ পূর্বমেঘের টীকায় “নিচুল” ও “দিঙ্কাগ’ এর উল্লেখ করেছেন। এই দুই বৌদ্ধ আচার্যের কালও প্রায় ৫৬৬ খ্রিঃ-এর নিকটবর্তী। কালিদাসের প্রতিন্দ্বন্দ্বী দিাগ ও বন্ধু নিচুল। দিঙ্কাগ বসুবন্ধুর ছাত্র ছিলেন। বসুবন্ধু সমুদ্রগুপ্তের সমসাময়িক হলে ষষ্ঠ শতাব্দীতে যে বিক্রমাদিত্য উপাধিধারী রাজা ছিলেন, তিনিই নিশ্চয় সেই সময়কার উজ্জয়িনীর রাজা ছিলেন এবং তাঁরই রাজত্ব কালে কালিদাস বর্তমান ছিলেন। ম্যাক্সমুলারের মতে কালিদাস মালবরাজ যশোবর্মণের সমকালীন। ষষ্ঠ শতাব্দীতে হুণ বিতাড়ণে যশোবর্মা বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন। দ্বিতীয় পুলকেশীর Aihole inscription-এ কলিদাসের স্পষ্ট উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। লিপিটি ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে—জৈন কবি ‘রবি’ রচিত। লিপিতে লেখা রয়েছে—

‘যেনামোজিনবোম স্থিরমর্থবিধৌ বিবেকিনাজিনবেশ্বম্।
বিজয়তাং রবিকীৰ্ত্তিঃ কবিতাশ্রিতকালিদাসভারবিকীর্তিঃ।’

এছাড়া সপ্তম শতাব্দীর মীমাংসক কুমারিল ভট্ট তাঁর তন্ত্রবার্ত্তিকে কালিদাসের শ্লোকাংশ উদ্ধৃত করেছেন। দণ্ডীর কাব্যাদর্শে শকুন্তলা নাটকের শ্লোকাংশকে কবি উদাহরণ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ৮ম-৯ম শতকের পণ্ডিতদের রচনায় কালিদাসের কবিতার সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। অতএব নিঃসন্দেহে তিনি ৭ম শতকের পূর্ববর্তী।

এছাড়াও তাঁর রচনায় নানাবিধ শব্দের প্রয়োগ কবির কাল নির্ণয়ের প্রসঙ্গে বিবেচনার দাবীরাখে। আলোচ্য ও বহুমুখী অনুমান এর ভিত্তিতে, সঠিক ভাবে কাল নির্ণয় করা সত্যই দুরূহ। কারণ কারুর মতে বা কালিদাস অশ্বঘোষের পূর্ববর্তী। অশ্বঘোষ কবি কর্তৃক প্রভাবাম্বিত হয়েছিলেন অতএব অশ্বঘোষের সময় যদি প্রথম শতাব্দী হয়, তবে কালিদাস খ্রিঃ পূঃ যুগের কবি। অতএব আলোচনা ক্রমে কালিদাস কে খৃঃ পূঃ—২য় শঃ—খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে স্থাপন করাই যুক্তি সঙ্গত। তবে দ্বিতীয় মতটির গ্রহণযোগ্যতা অধিক বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ চতুর্থ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে পঞ্চমশতাব্দীর প্রথমার্ধে, দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্ত থেকে সমুদ্রগুপ্ত পর্যন্ত্য সময়ের মধ্যবর্তী সময়কেই কালিদাসের আবির্ভাব কাল বলে মনে করাই সমীচীন।

কালিদাসের ধর্মমত :–’কর্ম’ সাধন করার বস্তু হলে ‘ধর্ম’ হল ধারণ করার বস্তু। সকল মানুষই নিজ নিজ ধর্মকে ধারণ করে থাকে। অর্থাৎ ব্যক্তির আচার, ব্যবহার, জীবনচর্যা, জ্ঞানচর্চা সমস্তই ধর্মের অনুশীলনের দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু ব্যক্তির আন্তর ধর্মকে বা হৃদয়স্থিত ঈশ্বর বিশ্বাসের বিষয়কেও ধর্ম বলে বুঝতে হয়। সেই অর্থে সকল ব্যক্তিই কোন না কোন মতাবলম্বী হয়। অর্থাৎ ঈশ্বরের কোন না কোন রূপ অথবা মহিমায় বিশ্বাস বশতঃ সেই ধর্মকে হৃদয়ে ধারণ করে থাকে। সংস্কৃত-সাহিত্যে গ্রন্থপ্রারম্ভে মঙ্গলাচরণ করার রীতি প্রচলিত আছে। কেউ বিষ্ণু, কেউ ব্রহ্মা, কেউ বা মহেশ্বর-কে বন্দনা করে গ্রন্থ আরম্ভ করেছেন। সেই পথ ধরে অনুসন্ধান করলে দেখা যায় মহাকবি কালিদাস শৈব ছিলেন। তিনি শিবের উপাসনা করতেন। তাঁর রচিত ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নাটকে “স স্থানুঃ স্থির ভক্তিযোগ সুলভো নিঃশ্রেয়সায়াস্তুবঃ” এইরূপ নমস্কার বচন রয়েছে। ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ নাটকের প্রারম্ভিক শ্লোক হল—”প্রত্যক্ষাভিঃ প্রপন্নস্তনুভিরবত বস্তাভিরষ্টাভিরীশঃ”। অর্থাৎ অষ্টবিধ মূৰ্ত্তিতে সর্বতোব্যাপী যে মহেশ তাঁরই স্তুতি করা হয়েছে। হর-পার্বতীর উপস্থিতি তাঁর রচনায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রঘুবংশের মঙ্গলাচরণে; এবং কুমার সম্ভবের কাহিনী জুড়ে রয়েছে হর-গৌরী। এই সমস্ত পর্যালোচনা করে কালিদাসকে শৈব-ধর্মাবলম্বী বলে মনে করা অসংগত নয়। উপরন্তু কালিদাসের মত সর্ব-শাস্ত্রে পারদর্শী, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও উদারচেতা মনিষিকে ধর্মের দিক থেকে কোন সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে রাখাও বোধ করি সমীচীন নয়। শাস্ত্রে জ্ঞান লাভের জন্য মহেশ্বরের উপাসনার উপদেশ রয়েছে…জ্ঞানন্তু শংকরা দিচ্ছেৎ,…। অতএব সাহিত্যের হাত ধরে নিপুণ ভাবে জ্ঞান পরিবেশনের সার্থকতায় বোধ করি কালিদাস শঙ্করের বন্দনা করেছিলেন। শিবসাধনার পাশাপাশি ব্রহ্মা-ও বিষ্ণুর উপাসনাও তাঁর কাব্যে স্থান পেয়েছে। রঘু-বংশের দশমসর্গে ও কুমার সম্ভবে বিষ্ণুর স্তুতি করেছেন। আবার কুমার সম্ভবের সপ্তমসর্গে ৪৪ শ্লোকে কবি ব্রহ্মা বিষ্ণু, মহেশ্বর এই তিন দেবতাই যে একই অখণ্ড ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন প্রকার মাত্র তা ব্যক্ত করেছেন। অতএব উদারচেতা ও সহানুভূতিশীল কবি ও দার্শনিক কালিদাসের মত ব্যক্তিত্বকে সর্বধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাসী বলাই বোধকরি যুক্তিযুক্ত। তাঁর মত সার্বভৌম হৃদয়ে সম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার কোন স্থান থাকা সম্ভব নয়।

কালিদাসের কবি প্রতিভা :– বিশ্ববরেণ্য সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাধর কবি কালিদাস। লৌকিক সংস্কৃত সাহিত্যের পথে মহাকবি বাল্মীকি ও ব্যাসদেবকে বাদ দিলে পরবর্তীকালের কবিদিগের মধ্যে কালিদাস অদ্বিতীয়। যদিও তিনি শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ ছন্দ, অলঙ্কার, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, দর্শন, এমন কি সঙ্গীতকলা, চিত্রবিদ্যা, কামশাস্ত্ৰ প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন তথাপি তাঁর প্রয়োগ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। ‘অপূর্ববস্তু নির্মাণক্ষম’—ই তাঁকে নিরন্তর সাধনার প্রেরণা যুগিয়েছে এবং কবিকূল শিরোমণিতে পরিণত করেছে। এই প্রসঙ্গে নিম্নে উল্লেখিত শ্লোকটি প্রণিধানযোগ্য-

“পুরা কবিনাং গণনা প্রসঙ্গে কনিষ্ঠিকাধিষ্ঠিত কালিদাসা।
অদ্যাপি তত্ত্বল্য কবের ভাবাদনামিকা সার্থবর্তী বভূব।।”

প্রসন্নরাখব রচয়িতা জয়দেব কালিদাসকে “কবিকুলগুরু”—বলে বন্দনা করেছেন :—

“ভাসোহাসঃ কবিকুলগুরুঃ কালিদাসো বিলাসঃ”।।

সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রে ছয়টি রীতি-র কথা বলা হয়েছে। বৈদভীরীতি তন্মধ্যে একটি, সাহিত্য দর্পণকারের মতে মাধুর্য গুণ বিশিষ্ট সমাস বিহীন অথবা স্বল্প সমাসযুক্ত ললিত পদ রচনাই হল বৈদভীরীতি। বৈদভী রচনা হবে কোমল, সমস্ত গুণে ভূষিতা ও শ্রুতিনন্দন। কালিদাস এ-হেন বৈদভীরীতিতে কাব্যরচনায় ছিলেন সিদ্ধ-হস্ত। তাঁর সার্থক শব্দ চয়ন, পদবিন্যাস, ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল, সজীব ও সাবলীল। তাঁর রচনায় কোথাও কোন জড়তা বা আড়ষ্টতা প্রকাশ পায় না। এমনি মসৃণ ছিল তাঁর সাহিত্যের গতিপথ। কাব্য রচনায় ‘ছন্দের’ আছে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ‘ছন্দঃ পাদৌ তু বেদস্য।’ পা-ছাড়া যেরূপ মানুষ অচল, তেমনি ছন্দ ছাড়া বেদাদি সমস্ত কাব্যই অচলাবস্থা প্রাপ্ত হয়। উপযুক্ত ছন্দ প্রয়োগে কাব্য হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে। কালিদাস কাব্যের ভাব অনুযায়ী ছন্দ প্রয়োগ করতে জানতেন। কালিদাসের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সার্থক উপমা প্রয়োগ।

—উপমা কালিদাসস্য…। কালিদাসের বহু অলঙ্কারের মধ্যে উপমা অলঙ্কার প্রয়োগটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। বহু কবি-ই উপমা-প্রয়োগ করেন কিন্তু কালিদাসের উপমার ত এমন সাবলীল, সময়োপযোগী উপমা সত্যিই দুর্লভ। কিন্তু কালিদাসের রচনাকে উপমা অপেক্ষা অর্থান্তর ন্যাস ও রূপক অলঙ্কারও কম চমৎকারিত্ব প্রদান করে না। কালিদাসের কাব্যে যে ভাষা প্রকাশিত হয়, তা অপেক্ষা যা অনুচ্চারিত বা অপ্রকাশিত থাকে তার ব্যঞ্জনা ও মূৰ্চ্ছণা দুইই অনেক বেশী গভীর। প্রকৃতির সাথে তাঁর নিবিড় সখ্যতা প্রকাশ পায়। প্রকৃতিকে অবলম্বন করে কাব্য রচনা করেন নি এমন কবি বিরল, তথাপি কালিদাসের বর্ণনা শক্তির গুণে মানবহৃদয়ের সাথে প্রকৃতির অপূর্ব মেল বন্ধন পাঠকচিত্তকে আপ্লুত করে। জড় প্রকৃতিতে তাঁর বর্ণনা যেন প্রাণের সঞ্চার করে। কালিদাসের কবিত্বশক্তির স্ফুরণ ঘটেছে সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে। ভারতীয় জনগণের—আত্মার আত্মীয় ছিলেন তিনি। তাই তাঁর রচনায় ভারতের আধ্যাত্মিক ভাব, দর্শন ও মননের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া যায়। ভোগবিলাস, প্রেম- সম্ভোগের পাশাপাশি জীবনধর্মের ত্যাগ ও সংযমের মাধুর্য্যকে তিনি অস্বীকার করেননি। সত্য-শিব-ও সুন্দরের আদর্শকেও তিনি উপেক্ষা করেন নি। সেই হেতুই প্রতিটি ভারতবাসী কালিদাসের কাব্যকে শুধু রচনাশৈলীর মাপ-কাঠিতেই বিচার করে না, কবি-কাব্যের আধ্যাত্মিক দিকটিও পাঠক চিত্তকে আপ্লুত করে।

একাধারে আদিরস, করুণরস ও অদ্ভুত রসে সিদ্ধহস্ত কবি আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে কাব্য সৃষ্টি করে গেছেন। যা শুধু ভারতবর্ষই নয় সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। ইউরোপীয় বহু কবি, মনীষীগণ তাঁর যশোগান করে ধন্য হয়েছেন। গেটে, শিলার ম্যাক্সম্যুলার উইলিয়াম জোন্স সকলেই তাঁর কবিত্বশক্তির, পরিচয়ে অভিভূত, মুগ্ধ। কোনও কোনও পাশ্চাত্য কবি তাঁকে Indian Shakespeare বলেও বর্ণনা করেছেন। কালিদাসের বহু রচনা মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—দুইখানি মহাকাব্য—কুমারসম্ভব ও রঘুবংশ। তিনখানি নাটক—অভিজ্ঞানশকুন্তল, মালাবিকাগ্নিমিত্র ও বিক্রমোর্বশীয়। এছাড়া রয়েছে খণ্ডকাব্য বা গীতিকাব্য—ঋতুসংহাব ও মেঘদূত।

এক্ষণে আমরা মহাকাব্য আলোচনা প্রসঙ্গে ‘রঘুবংশ’ ও কুমারসম্ভব’-এর আলোচনা করব।

‘কুমারসম্ভব’ :—মেঘদূতের পরবর্তী রচনাই ‘কুমারসম্ভব’ নামক মহাকাব্য, এরূপ অনুমান করা হয়ে থাকে। ‘কুমারসম্ভব’ মহাকাব্য-১৭টি সর্গে সম্পূর্ণ। পণ্ডিতদের অনুমান অষ্টমসর্গ পর্যন্ত্যই কবির নিজস্ব রচনা। এবং পরবর্তীকালে কোন জনৈক লেখক বাকী সর্গগুলি রচনা করে সংযোজন করেছেন। এর স্বপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়—মহাকাব্যের বিচারে আকার আকৃতিতে ছোট বলেই পরবর্তীকালের কোন কবি এইরূপ করেছিলেন। কালিদাসের লিখনশৈলী আটটি সর্গে যেভাবে ধরা দিয়েছে, পরবর্তী রচনায় তার লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না।’ পরবর্তী কালের কোন টীকাকারই এই অতিরিক্ত অংশের টীকা রচনায় আগ্রহ প্রকাশ করে নি। অষ্টম সর্গ পর্যন্ত্য টীকা রচিত হয়েছে। হয়ত বা কাব্যের নামকে সার্থকতা দেওয়ার তাগিদেই বাকী অংশ যুক্ত করে তাতে কার্তিকেয়ের জন্ম দেখানোর প্রয়োজন ছিল। কুমারের সম্ভব (জন্ম) সুচিত হয়েছে বলে ‘কুমারসম্ভব’ নাম হয়েছে। কালিদাস কেন রচনাটি সম্পূর্ণ না করে মাঝপথে ছেড়ে গেছেন তা বলা দুরূহ। তিনি হয়ত হর পার্বতীর মিলনের মধ্য দিয়েই কার্তিকেয়ের জন্মের বিষয়টি প্রচ্ছন্নভাবে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। নতুবা ‘কুমারসম্ভব’ তো কবির শেষ রচনা নয় যে বাধ্য হয়ে অসমাপ্ত রেখে গেছেন বলে বুঝতে হবে।

বিষয় সংক্ষেপ :—তাড়কাসুর বধের নিমিত্ত কুমার (কার্তিকেয়ের) সম্ভব অর্থাৎ জন্মই হল কুমার সম্ভবের মূল বিষয়বস্তু। প্রথম সর্গে গিরিরাজ হিমালয়ের মনোজ্ঞ বর্ণনা পাঠকমাত্রেই অবগত আছে, সেখানে হিমালয়ের কোনরূপ ভয়াবহতা বা ভীষণতার লেশমাত্রও উক্ত হয় নি। দ্বিতীয় সর্গে তাড়কা সুরের অত্যাচারে উৎপীড়িত দেবকূল ব্রহ্মার নিকটে নিজ নিজ অসহ্য অবস্থার কথা জানালে “বিষবৃক্ষোঽপি সংবর্জ্য স্বয়ং ছেত্তুম্ অসাম্প্রতাম্।” এইরূপ বলে তাঁদেরকে অন্যপথ দেখতে বললেন। ব্রহ্মা বললেন হর-পার্বতীর মিলনে যে সন্তানের জন্ম হবে সেই তারকা বধ করতে সমর্থ হবে। এবং তপস্যারত শিবকে পূজারত পার্বতীর রূপ-যৌবনের প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। ইন্দ্রের আদেশ অনুসারে কামদেব ঋতুরাজ বসন্তের সাহায্যে মহেশের ধ্যানভঙ্গের নিমিত্ত উপস্থিত হলেন। এই দ্বিতীয় সর্গে কালিদাস যেরূপ বসন্ত স্নাত প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন তা পাঠক চিত্তকে অভিভূত করে তোলে বৃক্ষরাজি, তরুলতা, সবই যেন নবসাজে সজ্জিতা, নবপত্রে, পুষ্পে রঞ্জিতা পৃথিবী। কোকিলের কুহুরবে যেন দশদিক মুখরিত। ভ্রমর ভ্রমরী, চক্রবাক্-চক্রবাকী, মৃগ-মৃগী, মরাল-মরালী যেন নবরাগে উদ্বেলিত। সমস্ত প্রকৃতিতে যেন বসন্তের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সেই আগুনে হয়ত বা ধ্যানমগ্ন মহেশের নিকট পূজা নিবেদন করলে কামপীড়িত মহেশ কামদেবকেই নয়নবহ্নিতে দগ্ধ করে ফেললেন, তৃতীয় সর্গের শেষ ভাগে স্বাভাবিক নিয়মেই কামপত্নী রতি শোকে দিশাহারা হয়ে পড়ল। চতুর্থসর্গের সমস্ত অংশ জুড়ে রতির বিলাপ ব্যক্ত হয়েছে। এমনকি স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দিতে উদ্যত হলে দৈববাণী শোনা-গেল—হর-পার্বতীর মিলন প্রয়োজন, এই মিলনই পারবে কামদেবের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে। রতি খানিকটা নিজেকে সংবরণ করতে সমর্থ হল। পঞ্চমসগে পার্বতী তাঁর ইষ্ট দেবতাকে লাভের নিমিত্ত নিজ ভঙ্গিমায় কঠোর তপস্যায় ব্রতী হলেন। পার্বতীর কঠিন তপস্যায় মুগ্ধ হয়ে শিব তাঁর নিষ্ঠা পরীক্ষার নিমিত্ত তরুণ সন্ন্যাসীর বেশ ধারণকরে এসে স্বয়ং অপর্ণাকে স্ত্রীরূপে কামনা করলেন। ষষ্ঠসর্গে হর-পার্বতীর বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে অঙ্গিরা, অত্রি, বশিষ্ঠ প্ৰভৃতি সাত ঋষি হিমালয়ের নিকট গেলে, হিমালয় সানন্দে সেই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। সপ্তমসর্গে- হর-পার্বতী পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলেন, হিমালয়ের রাজধানী ও কৈলাস উৎসবের মেজাজে দেখা দিল। মহাদেব বিবাহের দিনে বাঘছাল পড়ে ষাঁড়ের পিঠে চড়ে কৈলাস থেকে যাত্রা করলেন, সঙ্গে অষ্টমাতৃকা, মহাকালী, সাতজন ঋষি ছিলেন পুরোহিতের ভূমিকায়, গন্ধর্বেরা হলেন গায়েন। মহাধুমধামের সাথে চারিচক্ষুর মিলনের মধ্য দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন হল। অষ্টমসর্গে নব পরিণীতা দম্পতি কৈলাসে ফিরে মহাসুখে দিন অতিবাহিত করতে থাকলেন। এই পর্বে কালিদাস হর-পার্বতী কিরূপ রতি সুখে ও বিলাস ব্যাসনে তাদের প্রথম মিলনের দিনগুলি যাপন করেছিলেন তারই নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। এই অষ্টম সর্গ পর্যন্ত্য কবির নিজস্ব রচনা বলে সকলেই নির্দিধায় মেনে নিয়েছেন। কালিদাস হয়ত ভেবেছিলেন হর-পার্বতীর মিলন সংঘটনই কুমার- সম্ভবের জন্য যথেষ্ট সেই কারণেই ঘটনাকে আর বিস্তৃত করেননি।

বাকি সর্গগুলিতে দেখান হয়েছে—একদিন হর—পার্বতী পর্বত গুহায় রতি সুখে মগ্ন এমত অবস্থায় সহসা অগ্নিদেবের আগমনে মহেশ সচকিত, ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর তেজঃ সহসা স্খলিত হলে সেই তেজ ধারণে অসমর্থ পাবর্তী সেই তেজ পুনরায় অগ্নিতে নিক্ষেপ করলেন। অগ্নিদেবতাও সেই ভয়ঙ্কর তেজ ধারণে অসমর্থ হয়ে জলে নিক্ষেপ করলেন। কৃত্তিকারা সেই জলপান করে গর্ভধারিণী হলে ছয়জন কৃত্তিকা শরবনে এক শিশুর জন্মদিল। সেইহেতু শিশুটির নাম রাখা হল কার্তিকেয়। অতঃপর সেই কুমার কার্তিকেয় দেব সেনাপতি হয়ে তাড়কাসুরকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন। সমালোচকদের মতে গুপ্তবংশীয় কুমারগুপ্তের জন্মকে উপলক্ষ্য করেই এই ‘কুমারসম্ভব’ রচনা করেছিলেন কালিদাস।

পুরাণে (মৎস্য, ব্রহ্ম, সৌর, কালিকা ও শিব) হর-পার্বতীর মূল ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। মহাভারতের বনপর্বে, অনুশাসন ও শল্য পর্বে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন মহর্ষি বেদব্যাস, পুরাণের সাথে কুমার সম্ভবের রচনার অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। সমালোচকরা কেউ বলেন পুরাণকারেরা কালিদাস কর্তৃক প্রভাবিত আবার কারো মতে বা কালিদাস পুরাণের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এ সমস্যার মীমাংসা সম্ভব হয় নি কারণ পরবর্তী কালে যে সমস্ত উপপুরাণ ও পুরাণের প্রক্ষিপ্ত অংশ রচিত হয়েছে তার সঠিক কাল নির্ণয় করা যায় না। যদিও কালিদাস প্রাচীন সাহিত্য থেকে কাব্যের মূল উপাদান সংগ্রহ করেছেন তথাপি কবির রচনাশৈলী কাব্যের সর্বত্র ধরা পড়েছে অনায়াস ভঙ্গিতে। প্রকৃতির বর্ণনা, রতি বিলাপ, হর-পার্বতীর মিলন কাহিনী এই সবই কবির নিজস্ব সৃষ্টি। মৌলিকতার দাবীতে কবি উত্তীর্ণ হয়েছেন। কুমার সম্ভবের ঘটনা দেব-দেবীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও মূলতঃ স্বর্গীয় প্রেমের আবরণে মানব-মানবীর প্রেমের কাহিণীই বর্ণিত হয়েছে। দৈবী মহিমা ও আদর্শের মোড়কে তৎকালীন গার্হস্থ্য তথা দাম্পত্য জীবনের মানোজ্ঞ অথচ সহজ, সরল, বর্ণনাই ফুটে উঠেছে এই মহাকাব্যের মধ্য দিয়ে। আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি-অষ্টমসর্গ পর্যন্ত্যই কবির নিজস্ব সৃষ্টি বলে একদল পণ্ডিতের অভিমত। এবং মল্লিনাথ, অরুণ গিরি প্রভৃতি টীকাকারগণও এই অষ্টমমর্গ পর্যন্ত্যই টীকা রচনা করেছেন। বিরোধীরা অবশ্য সমগ্র কাব্যটিকেই কবির নিজস্ব রচনা বলে যুক্তি দেখিয়েছেন।

রঘুবংশ :—কালিদাসের পরিণত বয়সে পাকাহাতের রচনা ‘রঘুবংশ’ মহাকাব্য। ১৯ সর্গে সম্পূর্ণ ‘রঘুবংশ’ কবির রচনা সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। পণ্ডিতদের মতে এই মহাকাব্য কবির শেষ রচনা। রঘুবংশ অর্থাৎ রঘুর বংশ। এর রাজন্য বর্গের চরিত বর্ণনাই আলোচ্য মহাকাব্যের বিষয়বস্তু। সূর্যবংশীয় রাজা দিলীপ থেকে শুরু করে অগ্নিবর্ন পর্যন্ত্য রাজাদের কীর্ত্তি কাহিনী বা বীর্যগাথা বর্ণিত হয়েছে। রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা দেখেছি যে যুগে যুগে বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকেরা কিভাবে আমাদের প্রাচীন সাহিত্যগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তাই এক্ষেত্রেও রামকথা বা রামায়ণ কাহিনীর নিকট কবি সম্পূর্ণভাবে ঋণী। এই রামায়ণ কাহিণী কিন্তু মহাভারত ও পুরানেও বিধৃত হয়েছে। কাব্যের সূচনাতেই কবি তাঁর পূর্বসূরীদের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করে বলেছেন।

অথবা কৃত বাগ্‌দ্বারে বংশেঽস্মিন্ পূর্ব সুরিভিঃ।
মনৌ বজ্রসমুকীর্ণে সূত্রস্যেবাস্তি মে গতিঃ।। (১৪)

রাজা দিলীপ থেকে শুরু করে অগ্নিবর্ণ পর্যন্ত মোট ২৮ জন রাজার বীর্যগাথা রচনা প্রসঙ্গে তৎকালীন ভারতের ভৌগোলিক রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় প্রদর্শনও কলিদাসের উদ্দেশ্য ছিল। দিলীপ, রঘু, অজ, দশরথ ও রামচন্দ্র এই পাঁচজন বিখ্যাত রাজার জীবন চরিত বর্ণিত হয়েছে প্রথম দশটি সর্গে। প্রথমে সূর্যবংশীয় আদি পুরুষ মনুর কথা। অতঃপর মনুর উত্তরাধিকারী দিলীপ ও সুদক্ষিণার আলোচনা। অপুএক রাজা দিলীপ ও সুদক্ষিণার পুত্র কামনায় মুনি বশিষ্ঠের আশ্রমে যাত্রা। সপত্নী দিলীপের সেবায় সন্তুষ্ট নন্দিনী কর্তৃক পুত্রলাভের বরদান। অতঃপর রঘুর জন্মবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। রাজা দিলীপ কর্তৃক অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান এবং রঘুর রাজ্যাভিষেক। রঘুর পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণে দ্বিগ্বিজয় বর্ণনা ও বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপনের বর্ণনা। বিশ্বজিৎ যজ্ঞের অনুষ্ঠান। তৎকর্তৃক রঘুর পুত্র অজ জন্মলাভ করল। ইন্দুমতীর সাথে বিবাহ হল। তাঁদের পুত্র দশরথের জন্মের কিছুকাল পরে ইন্দুমতীর আকস্মিক মৃত্যু হলে শোকাহত অজ প্রাণত্যাগ করলেন। দশরথের পুত্রেষ্টি যজ্ঞ পূর্বক রামচন্দ্র সহ চার পুত্রলাভ এই পর্যন্ত্য দশমসর্গে বিধৃত। স্বয়ং নারায়ণ রাম অবতার রূপে মর্ত্যে এলেন রাবণকে নিধন করতে। অসুর বধ করে দেবকূলের কার্যসিদ্ধি করলেন। একে একে রামের কৈশোর, যৌবন, বিবাহ, বনবাসের বিবরণ, রাম-রাবণের যুদ্ধ, লব-কুশের জন্ম, রামের সাথে সীতার পুনর্মিলন, সীতা পরিত্যাগ, সীতার অগ্নিপরীক্ষা ও পাতাল প্রবেশ এই সমস্ত ঘটনা ৫টি সর্গে অর্থাৎ ১১-১৬ সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। বাদবাকী ৪টি সর্গে অর্থাৎ ১৬-১৯ সর্গে বাকী আঠারোজন রাজার কীর্তি বর্ণিত হয়েছে। যথাক্রমে কুল, অতিথি, নিষধ, নল, নাঙ, পুণ্ডরীক, ঘোষ, শঙ্খন, ব্যুষিতাশ্ব, বিশ্বসহ, হিরণ্যনাৎ, কৌশল্যা, ব্রাহ্মণ, পুত্র, পুণ্য, ধ্রুবসন্ধি, সুদর্শন ও অগ্নিবর্ণ। রাজা অগ্নিবর্ণ ভোগসর্বস্ব, অসংযত জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন এবং তাঁর বিলাস ব্যাসন পূর্ণ জীবনে অবশ্যম্ভাবী পতন হলে অন্তঃসত্ত্বা পত্নী কর্তৃক রাজ্য শাসন এইভাবে মহাকাব্যের পরিণতি ঘটে।

কাৰ্য সমালোচনা :—মহাকাব্যটি পাঠ করলে আমরা সূর্যবংশের উত্থান পতনের ছবিটি পরিস্কার লক্ষ্য করতে সমর্থ হই। প্রথম থেকে পঞ্চদশ সর্গে দিলীপ, অজ, রঘু, ও দশরথ, রামচন্দ্র একে অপরের অপেক্ষা অধিক মর্যাদার অধিকারী ও বংশের ক্রমউন্নতি বা উত্থানের চিত্র ফুটে উঠেছে। পঞ্চদশ সর্গে রামচন্দ্র অপরিমিত শক্তিশালী-ও আদর্শের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছেন। কিন্তু ষোড়শ সর্গের পরবর্তী অংশে এমনই অবনতির ছাপ সুস্পষ্ট। সবশেষ অংশে রাজা অগ্নিবর্ণ অত্যধিক-সম্ভোগে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হলে সমূহ পড়নের মধ্য দিয়ে মহাকাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

কোন কোন অংশে পদ্মপুরাণের কাহিনীর সাথে হুবহু মিল থাকায় সমালোচকদের মতে ‘রঘুবংশ’-দ্বারা পুরাণকারেরা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। দিলীপ-সুদক্ষিণার বিশষ্ঠা শ্রমে যাত্রা, রঘুর দিগ্বিজয় বর্ণনা, ইন্দুমতীর স্বয়ংবর, অজবিলাপ, সীতা পরিত্যাগের কাহিনী, কালিদাসের নিখুঁত তুলির টানে যেন এক একটি পৃথক কাহিনীর মর্যাদা লাভ করেছে। কেউ কেউ মনে করেন ‘রঘুবংশ’ যেন কতকগুলি ছোট ছোট কাব্যের একত্র সংযোজন। আবার করো কারো মতে এটিকে মহাকাব্য না বলে ইতিহাস অথবা পুরাণ নামে অভিহিত করাই সমীচীন। কাব্য গুণ বিচারে সর্বগুণ সমন্বিত এই মহাকাব্যটিকে এহেন বহু বিরূপ‍ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যদিও এই সমস্ত আলোচনার কোন গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না।

রঘুবংশ মহাকাব্যের টীকাকারগণ যথাক্রমে হেমাদ্রি, ভরতমেন, অরুণ গিরিনাথ, নারায়ণ, ভবদেব মিশ্র, রামচন্দ্র, ভরতমল্লিক, মল্লিনাথ, গুণবিনয়গন প্রভৃতি। তবে তন্মধ্যে মল্লিনাথকৃত সঞ্জীবনী টীকাই সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ। তাঁর ভাষায় কালিদাসের বাণী আজ দুর্বাসার অভিশাপে মূর্ছিত, তাকে সঞ্জীবনী করে তোলাই আমার লক্ষ্য। অসংখ্য টীকাকারের রচিত টীকা, টিপ্পনীই রচনার জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে।

রঘুবংশ নিঃসন্দেহে সুবৃহৎ কাব্য। তথাপি কালিদাসের ব্যঞ্জনাধর্মী রচনার গুণে তার কাব্য কলেবর সংযত। অল্প কথায় অধিক বক্তব্য পরিবেশন করতে গেলে কবির শব্দচয়ন ব্যঞ্জনাধর্মী হওয়া বাঞ্ছনীয়, এই বিষয়ে কবি সার্থক। সকল ভাব, সকল রস ও সর্বোপরি সকল দর্শনের যেন সমন্বয় সাধিত হয়েছে কালিদাসের রচনায়। কেবলমাত্র ভারতবর্ষই নয়, প্রতিবেশী দেশসমূহ, পারস্য, গ্রীক আরব, হুণ ও যবনদেশের পরিচয়ও রঘুবংশে মেলে। অসীম দক্ষতার সাথে অপূর্ব ভৌগোলিক বর্ণনা কাব্যটিকে অধিক আকর্ষণীয় করে তুলেছে। প্রতিটি নরনারীর নিজস্ব একটি আবেদন রয়েছে। প্রত্যেকেই যেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। চরিত্র চিত্রণে সিদ্ধহস্ত কবি কালিদাস ধৈর্য, স্থৈর্য, বীরত্ব, ক্ষমা, প্রেম ও ত্যাগের আদর্শে চরিত্রগুলিকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। কবির প্রাণচঞ্চল ভাষা যেন মুক ও বধির প্রকৃতিতেও প্রাণের সঞ্চার করতে সক্ষম। উপমা প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত কবির বর্ণনা বৈচিত্র্যে, ছন্দ মাধুর্যে, ভাবের গাম্ভীর্যে, ভাষার সরলতায় রঘুবংশ অতুলনীয়। তথাপি আলঙ্কারিক বর্ণিত মহাকাব্যের লক্ষণগুলি কালিদাসের মহাকাব্যে অনুসৃত না হওয়ায় সমালোচকেরা এঁকে মহাকাব্যের মর্যাদা দিতে নারাজ। তবে এইসব আলঙ্কারিকেরা কালিদাসোত্তরযুগের বলে তাঁদের প্রণিত লক্ষণ কালিদাস কর্তৃক কেন অনুসৃত হয়নি এই প্রশ্ন নিতান্তই অমূলক। আনন্দের বিষয় এই যে আলঙ্কারিকগণ কালিদাস বিরচিত কুমারসম্ভব ও রঘুবংশ এই দুই মহাকাব্যকে নির্দ্বিধায় আদর্শ রূপে গ্রহণ করেছেন। কালিদাস বোধ করি তাঁর মহাকাব্যগুলিকে নিজস্ব রীতিতে রচনা করেছিলেন।

ভারবি

মহাকাব্যের আলোচনা প্রসঙ্গে কালিদাসের পরেই মহাকবি ভারবির নাম করা হয়। সংস্কৃত কবিগণ বিনয়াবশতঃ প্রায়শই নিজ নিজ পরিচয় প্রকাশের বিষয়ে উদাসীন ছিলেন। ভারবির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায় না। নানাবিধ অভিলেখ ও অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে সমালোচকেরা কিছু সিন্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছেন। এছাড়া আলঙ্কারিক আচার্য দণ্ডীর লেখা ‘অবন্তীসুন্দরী’ ও ‘অবন্তী সুন্দরী কথাসার’ এই দুই গ্রন্থে কবি ভারবির কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। দণ্ডী ছিলেন ভারবির প্রপৌত্র। মহাকবি ভারবি বর্তমান গুজরাট এর আনন্দপুর নামক গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি কৌলিক গোত্রীয়, নারায়ণ স্বামীর পুত্র ছিলেন।

ভারবির কাল :—কথিত আছে কবি একদা স্থানীয় রাজা বিষ্ণু-বর্ধনের সাথে মৃগয়া করতে বনে গিয়ে বাধ্য হয়েই মাংস ভক্ষণ করেছিলেন। তার ফলস্বরূপ তাঁকে তীর্থ করতে যেতে হল। তীর্থ যাত্রাকালে পথিমধ্যে দূর্বিনীতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তখন কোন এক সময়ে রাজা বিষ্ণুবর্ধন দুর্বিনীতের মুখে ভারবি রচিত একটি শ্লোক শুনে যার-পর-নাই আশ্চর্য হলেন ও মুগ্ধ হলেন। তৎক্ষণাৎ কবিকে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁর, জসভায় সম্মানের সাথে স্থান দিলেন। ৭৭৬খ্রিঃ দক্ষিণ ভারতের এক দানপত্রে কবি বিরচিত মহকাব্য ‘কীরাতার্জনীয়ম্’ এবং এই কাব্যের টীকাকার হিসাবে দূর্বিনীতের নামের উল্লেখ রয়েছে।” রাজা বিষ্ণুবর্ধন ছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা। দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজদরবারে কিছুকাল কবি আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। অতএব ৬৪২খ্রিঃ এর সমসাময়িক সময়ে যদি দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকাল নির্দিষ্ট হয় তাহলে ষষ্ঠ শতকে কবিকে স্থাপন করা যায়। সপ্তম শতকের মধ্যভাগে জয়াদিত্যের রচনা কাশিকাবৃত্তি, এতেও ভারবির নাম উল্লেখ রয়েছে। অতএব সপ্তম শতাব্দীর পূর্বে কবির কাল চিহ্নিত হতে কোন বাধা নেই। ৬৩৪ খ্রিঃ দ্বিতীয় পুলকেশী ও তাঁর স্তুতিমূলক Aihole inscription-এর শিলালেখতে-প্রথিত যশা কবির জয়গান করে লেখা হয়েছে

“যেনযোজিনবেশ স্থিরমর্থবিধেই বিবেকিনা জিনবেশ।
স বিজয়তাং রবিকীর্তিঃ কবিতাশ্রিতকালিদাস-ভারবিকীর্তিঃ”।।

অতএব এই সময় ঐতিহাসিক তথ্য থেকে ষষ্ঠ শতকের কোন এক সময়ে ভারবিকে স্থাপন করা যায়। ভারবি বাণভট্টের পূর্ববর্তী ছিলেন। বাণভট্টের আবির্ভাবের পূর্বেই ভারবির খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবুও মহাকাব্য রচনার দ্বিতীয় পর্বে বলা যায় কালিদাসোত্তর যুগে সাহিত্যরচনার চিরায়ত প্রথাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে ঘটনার ঘনঘটায়, শব্দচয়নে, পদবিন্যাসে, ভাবের গাম্ভীর্যে, অর্থগৌরবে ভারাক্রান্ত সাহিত্য সৃষ্টির যে নূতন ধারার প্রবর্তন হয়েছিল তার পথিকৃৎহিসাবে সাহিত্য সমালোচকেরা ভারবিকেই চিহ্নিত করলেন। তাঁরা মহাকবি ভারবিকে সম্মান জানিয়ে নতুন যুগের সূর্য বলে বর্ণনা করলেন। ‘ভারবোর্ডারবেরিব’। ভারবির রচনা থেকে দণ্ডীর কাব্যাদর্শে বহু শ্লোক উদ্ধৃত হতে দেখা যায়। ‘কালিদাস’ যেমন উপমা প্রেয়োগে সিদ্ধহস্ত ছিলেন, ‘ভারবি’র কাব্যে তেমনি ‘অর্থ-গৌরব’ লক্ষ্যণীয়।

“উপমা কালিদাসস্য ভারবেরর্থ গৌরবম্।” প্রসিদ্ধ টীকাকার মল্লিনাথ এর উক্তি এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত সংগত। তাঁর মতে ভারবির ভাষা নারিকেলের ন্যায় আপাতরুক্ষ, কিন্তু পরিণামে অতিশয় সারময় ও রমনীয়। “নারিকেল ফলসম্মিতং বচো ভারবেঃ।”২ অতএব রচনার বহিরাবরণকে ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করতে পারলে তবেই ‘ভারবি’ কাব্যের যথার্থ রসাস্বাদনে পাঠক সমাজ তৃপ্ত হবেন। এইরূপ রচনা ভারবির মতন কবির পক্ষেই সম্ভব ছিল। তিনি রাজনীতি, ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র, ছন্দঃশাস্ত্র প্রভৃতি নানাবিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। ভাবও ভাষার অপরূপ মেলবন্ধনই কবি কাব্যকে নতুন মাধুর্য দান করেছে যা কালিদাসের কাব্যে বিরল। কালিদাস স্বভাবসিদ্ধ কবি ছিলেন। কিন্তু ভারবি যেন বিশেষ যত্নপূর্বক কবিত্বশক্তি অর্জন করেছিলেন বলে সুধীজনেদের অভিমত। যদিও বলা হয়ে থাকে এই সময়ে কাব্যের উৎকর্ষ বহুগুণে হ্রাস পেয়েছে। কারণ কালিদাসের ন্যায় স্বভাবিক অনায়াস ভঙ্গিতে কাব্য রচনার দৃষ্টান্ত বিরল, তথাপি মহাকাব্যের আলোচনাক্রমে কালিদাসের সাথে ভারবির নাম একসূত্রে গাঁথা হয়ে আছে—আইহোল শিলালেখতে।

ভারবির বিখ্যাত মহাকাব্য ‘কিরাতাজুনীয়ম’ এর উৎস মহাভারত। অষ্টাদশ সর্গ সমন্বিত ‘কিরাতাজুনীয়ম্’-এর বিষয়বস্তু মহাভারতের বনপর্ব থেকে গৃহীত। অনেকে এই কাব্যের পিছনে শিবপুরাণের প্রভাবের কথা উল্লেখ করলেও এরূপ অভিমত- যুক্তযুক্ত বোধ হয় না। পরবর্তী কালে পুরাণকারই ভারবির রচনাদ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, এমনকি ‘ভারবি’ স্বয়ং ঐ পুরাণের রচয়িতা এইরূপ অভিমতও কেউ কেউ পোষণ করেন।

কাহিনী সংক্ষেপ :—মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে কপট পাশাখেলায় দুর্যোধনের নিকট শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়ে পূর্বশর্তানুযায়ী পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদী সহ দ্বাদশবৎসর বনবাস ও একবৎসর অজ্ঞাতবাসের নিমিত্ত যাত্রা করেন। পঞ্চপাণ্ডবদের বনবাসের কাহিনীই বনপর্ব। কিরাতাজুনীয়ের প্রারম্ভিক সর্গগুলিতে দ্বৈতবনে যুধিষ্ঠিরের নিকট বনচরের ছদ্মবেশে দূতের উপস্থিতি। এবং তৎ কর্তৃক দুর্যোধনের রাজ্য সুশাসনের বর্ণনা প্রদান শেষে এই অংশে পঞ্চ পাণ্ডবদের নিস্ক্রিয়তাকে কেন্দ্র করে দ্রৌপদীর ক্ষোভ ঘনীভূত হলে কৗরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পাণ্ডবগণকে উত্তেজিত করতেও দেখা যায়। এবং এই বিষয়ে দ্রৌপদীর প্রতি ভীমের (পাণ্ডবগণকে) সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল। যুধিষ্ঠির কর্তৃক ভীম প্রশংসিত হলেও উপযাজক হয়ে কৌরবদিগকে যুদ্ধে আহ্বান করার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। তৎপরবর্তী সর্গ গুলিতে (অর্থাৎ (৩য়-৪র্থ) মহর্ষি বেদব্যাসের দ্বৈতবনে আগমন। যুধিষ্ঠির কর্তৃক সম্বর্ধনা লাভ করে তিনি তাকে উপদেশ দিয়ে বললেন যে যুধিষ্ঠির যেন দ্বৈতবন পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায় এবং তথায় কঠোর তপস্যার মধ্য দিয়ে অমিত পরিমাণ শক্তি সঞ্চয় করে বীর রথী মহারথীদের সমকক্ষ হতে পারেন। ব্যাসের পরামর্শ ক্রমে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে দিব্যাস্ত্র সংগ্রহের জন্য সচেষ্ট হতে বলেন। সেই হেতু অর্জুন ইন্দ্ৰকীল পর্বতে কঠোর তপস্যার নিমিত্ত গমন করলেন। হিমালয় প্রদেশের মনোরম প্রাকৃতিক শোভার নিখুঁত বর্ণনা প্রসঙ্গে শরৎ-এর আগমনে জলে-স্থলে-আকাশে-বাতাসে প্রকৃতির বিচিত্র সমারোহে ভারবি তাঁর অসাধারণ কবিত্ব শক্তির নিঃশেষে পরিচয় দিয়েছেন। পঞ্চম সর্গে যক্ষ এসে অর্জুনকে হর-পার্বতীর অধিষ্ঠানের কথা জানালেন এবং তাঁকে তপস্যার অনুরোধ করলেন। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম সর্গে অর্জুনের তপস্যা ভঙ্গের চেষ্টায় গন্ধর্ব ও অপ্সরাদের নানারূপ ভঙ্গীমা প্রকাশ পেয়েছে। বন বিহার, জল-কেলি ইত্যাদি নানান ছলনার বিবরণ এই অংশের বিষয়। দশমসর্গ পর্যন্ত্য অপ্সরা গন্ধর্বদের মদিরা পান, অশ্লীল কামকৌতুক, উচ্ছ্বাস, প্রকৃতির বর্ণনা এবং অর্জুনকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা প্রকাশ পেয়েছে। একাদশ সর্গে অর্জুনের তপস্যায় ব্যাঘাত ঘটাতে ব্যর্থ হওয়ায় স্বয়ং ইন্দ্র ছদ্মবেশে আসেন। অর্জুনের সাথে কথোপকথন শেষে তিনি তাঁকে আশীর্বাদ পূর্বক স্বয়ং মহাদেবকে প্রসন্ন করার নিমিত্ত ভীত হয়ে ঋষিগণ মহাদেবের নিকট গমন করেন। অর্জুনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলে মহাদেব ভবিষ্যদ্বানী করেন। পরবর্তী তিনসর্গে ছদ্মবেশী একটি বরাহকে বাণবিদ্ধ করার বিষয় নিয়ে কিরাত সৈন্যগণের সাথে অর্জুনের তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে। অর্জুনের শরবর্ষণে কিরাতসৈন্য ছত্রভঙ্গ হলে কিরাত বেশী মহাদেবের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। শিবের দিব্যাস্ত্র প্রয়োগের ফলে অর্জুনের পরাভব ঘটলেও সাধারণ বৃক্ষ-প্রস্তর প্রভৃতিকে আশ্রয় করে অর্জুনের লড়াকু মানসিকতা শিবকে মুগ্ধ করে। অষ্টাদশ সর্গে বা সর্বশেষ অংশে কিরাতরূপী শিব অর্জুন সকাশে মুষ্টিযুদ্ধও করেন। শিব যখন ছদ্মবেশ খুলে ফেলে স্বমহিমায় অর্জুনের সামনে আত্মপ্রকাশ করলেন তখন অর্জুন তাঁকে সম্ভ্রমের সাথে বন্দনা করলেন। অতঃপর অর্জুনের পরাক্রমে সন্তুষ্ট ও মুগ্ধ হয়ে শিব কর্তৃক পাশুপত অস্ত্র প্রদান, এবং অন্যান্য দেবতাগণ কর্তৃক নানান অস্ত্র প্রদান আখ্যান ভাগের শেষ অংশকে মহিমান্বিত করেছে। অর্জুন তাঁর অগ্রজের মনস্কামনা পূরণ পূর্বক যুধিষ্ঠিরের নিকট বীরের ন্যায় প্রত্যাবর্তন করলেন।

কাব্যপ্রতিভা :—বীররসাশ্রিত ‘কিরাতার্জনীয়ম্’ মহাকাব্যের নায়ক হলেন—অর্জুন এবং প্রতি নায়কের ভূমিকায় স্বয়ং মহেশ্বরকে কিরাত বেশে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। কাব্যের নামকরণও বিষয়ানুগ হয়েছে। মূল কাহিণীকে অনেকাংশে কবি তাঁর সৃজনীশক্তি দ্বারা পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত করেছেন। বিশেষতঃ কাব্যে শরৎবর্ণনা, হিমালয়ের শোভা বর্ণনা প্রভাত-সন্ধ্যা ও চন্দ্রোদয়ের বর্ণনার মধ্য দিয়ে কবিত্ব শক্তির স্ফুরণ ঘটেছে পিছে। কালিদাস স্বভাবসিদ্ধ কবি হলেও ভারবির সাধনার ফসলও কিছু মাত্রায় লঘু নয়। ভারবির কিরাতার্জনীয়ম্ বৈদভী রীতিতে লেখা হলেও কালিদাসীয় বৈদভী রীতির থেকে ভিন্ন। তাঁর ওজঃগুণে সমৃদ্ধ রচনায় দুরূহ শব্দ ও অলঙ্কারের প্রয়োগ দেখে জনৈক কবি আলোচ্য কাব্যকে বকুল ফুলের মালার সাথে তুলনা করেছেন। বকুলফুলের মালা বিমর্দিত হলে যেরূপ সৌরভে চারিদিক আমোদিত হয়, প্রিয়সখার চিত্ত আনন্দিত হয়, ঠিক সেইরূপ ভারবির রচনা বারবার মনোযোগ সহকারে পাঠ পূর্বক তার ভিতরে প্রবেশ লাভ করতে পারলে তবেই কাব্য মাধুৰ্য্য উপলব্ধি করা যায়।

“বিমর্দব্যক্ত সৌরভ্যা ভারতী ভারবেঃ কবেঃ।
ধত্তে বকুলমালে বিদগ্ধানাং চমৎক্রিয়াম্ ॥”

ভারবিকে ছন্দের যাদুকরও বলা হয়ে থাকে। একটি মাত্র শব্দ কখনও বা একটিমাত্র বর্ণকে নিয়ে ছন্দরচনায় পণ্ডিত মহলে আলোড়ন সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি।

যথা——

দেখা কানিনি কাবাদে বাহিকাস্বস্বকাহিবা।
কাকারে ভরে কাকা নিস্বভবব্যভস্বনি।। কি. ১৫.২৫.

এই শ্লোকটি কবির যাদুস্পর্শে এমনইরূপ লাভ করেছে যে-যেদিক থেকেই পাঠ করা হোক না কেন একই পাঠ দৃষ্ট হয়। অর্থাৎ শ্লোকের প্রতি পাদের প্রথমার্ধের বর্ণস্থানই বিপরীতভাবে দ্বিতীয়ার্ধে সন্নিবেশিত হয়েছে। আবার একটি মাত্র অক্ষরকে নিয়ে শ্লোকরচনা করতে গিয়ে তিনি যেন অক্ষর ও শব্দ নিয়ে গবেষণা করেছেন বলে মনে হয়।

ন নোননুন্নো নুন্নোনো নানা নানা নন্য ননু।
নুন্নোহনুন্নো ন নুন্নেনো নানেনা নুন্ননন্ননুৎ ॥

যদিও এরূপ কঠিন অলঙ্কার প্রয়োগে কাব্যে নতুনত্বের কঠিন প্রয়াস ব্যক্ত হয়েছে। তবে কোন কোন সমালোচক এইরূপ রচনাকে বিরক্তিকর বলে ব্যাখ্যা করেছেন। ভারবিতেই সর্বপ্রথম এইরূপ কৃত্রিম শব্দসজ্জা দেখা যায়। বিরূদ্ধ সমালোচনা চিরকালই কাব্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। কবির একটি মাত্র উপমাগর্ভ শ্লোকের সৌন্দর্য্য তাঁকে ‘ছত্রভারবি’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। শ্লোকটি নিম্নরূপ—

উৎফুল্ল স্থল নলিনী বনাদমুম্মাদুদ্ধতঃ সরসিজসম্ভবঃ পরাগঃ।
বাত্যাভির্বিয়তি বিবর্তিতঃ সমাক্তাদাখত্তে কনকময়াত পত্ৰলক্ষ্মীম্ ॥ কি. ৫।৩৯

অর্থাৎ প্রস্ফুটিত স্থলপদ্মের বল থেকে পদ্মের পরাগ বাতাসে উত্থিত হয়ে মণ্ডলাকারে ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন কনকছত্রের শোভা ধারণ করেছে। প্রকৃতির সহিত নিবিড় আলিঙ্গণে বিমোহিত কবির পক্ষেই এমন উপমাপ্রয়োগ করা সম্ভব।

কবির প্রিয় অলঙ্কার অর্থান্তর ন্যাস। সেই হেতু তাঁর কাব্যে এ-হেন সারবত্বা প্রকাশ পায়। অর্থ গৌরব সমৃদ্ধ নীতিকথাগুলি অর্থান্তরন্যাসের হাতধরে পরিবেশিত হয়েছে। সমস্ত কাব্য জুড়ে এমন বহু বাক্য ছড়িয়ে রয়েছে যা পালনে সংসার সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে পারে। যেমন—

হিতং মনোহারি চ দূর্লভং বচঃ। ( ১।৪)
সহসা বিদধীত ন ক্রিয়ামবিবেকঃ পরমাপদাং পদম্। (১।৩০)।
বসন্ত হি প্রেমি গুণা ন বস্তুনি (৮।৩৭)।
প্রেম পশ্যতি ভয়ান্যপদেহ্যপি। (৯।৭০)

কবি কাব্যের বিখ্যাত টীকাকার মল্লিনাথ ব্যতিরেকে প্রায় তিরিশ জনেরও বেশী টীকাকার এই কাব্যের টীকা রচনা করেছেন। অতএব ‘প্রসন্ন গম্ভীর পদা সরস্বতী’ কবি যে বিরূপ উৎকর্ষতা ও জনপ্রিয়তা অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন তা তাঁর কাব্যের পঠন পাঠন ও টীকা রচনার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়। কালিদাসোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ভারবি তাঁর উত্তর-সুরীদেরকেও যথেষ্ট প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

ভর্তৃহরি

কবি পরিচিতি :—

ভট্টি বা ভর্তৃহরি বিরচিত দ্বাবিংশ সর্গ বিশিষ্ট ১৬৩১ শ্লোক সম্বলিত ভট্টিকাব্য বা ‘রাবণবধ’ মহাকাব্য কবির অসাধারণ কাব্য প্রতিভার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ‘ভর্তৃ’ শব্দের প্রাকৃত রূপ হল ‘ভট্টি’। অতএব নামের বিচারে ‘ভট্টিকাব্য’ যুক্তিযুক্ত। আলোচ্য মহাকবির নিজ রচনার অন্তিম শ্লোকে সামান্য কিছু আত্মপরিচয় পাওয়া গেলেও সেই টুকুই কবি ব্যক্তিত্বকে জন সমক্ষে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যথেষ্ট নয়। অতএব অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তায় হেঁটে কবি সম্বন্ধে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি তা সবই ঐতিহাসিক ও সমালোচকদের অনুমান ভিত্তিক অথবা কিংবদন্তী নির্ভর তথ্যকে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠিত।

ভট্টিকাব্যে বর্ণিত কবির উক্তি অনুযায়ী তিনি বল্লভীতে শ্রীধরের রাজত্বকালে কাব্য রচনা করেছেন।

“কাৰ্য্যমিদং বিহিতং ময়া বলভ্যাম্ শ্রীধরসেন নরেন্দ্র পালিতায়াম।
কীর্তিরতো ভবতাং নৃপস্য তস্য ক্ষেমকরঃ ক্ষিতিপো যতঃপ্রজানাম্ ॥ ২২।৩৫

কিন্তু বল্লভীতে শ্রীধর সেন বলে কমপক্ষে চারজন রাজা রাজত্ব করেছেন। ঠিক কোন্ রাজার সময়ে তিনি বর্তমান ছিলেন সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সেইহেতু বল্লভীতে ৪৯৫ খ্রিঃ—৬৪১ খ্রিঃ পর্যন্ত্য সেন রাজত্বের কোন এক সময়ে অর্থাৎ ষষ্ঠশতকের শেষভাগ থেকে সপ্তম শতকের প্রথম ভাগের মধ্যে ভর্তৃহরির কাল বলে ধার্য হয়। এই মত অনুসারে দ্বিতীয় শ্রীধর সেন (৫৭১ খ্রিঃ-৫-৯ খ্রিঃ) এর সময়ে ভর্তৃহরিকে স্থাপন করা চলে। এই মতের স্বপক্ষে বলা যায় দ্বিতীয় শ্রীধর সেনের সময়ে রাজ্যে শৈবধর্মের অত্যন্ত শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল। কবিও মনে প্রাণে শৈব ছিলেন। অতএব এরূপ অনুমানের দৃঢ় ভিত্তি রয়েছে। ৭ম শতাব্দীতে কবিভর্তৃহরি পাণিনীয় সূত্রের বৃত্তি রচনা করেন, নাম ‘ভাগবৃত্তি’। এবং ‘বাক্যপদীয’ নামে পাণিনীয় দর্শন গ্রন্থ রচনা করেন। এই ‘ভাগবৃত্তি’-র একস্থানে ভট্টির প্রয়োগকে প্রমোদিক ব্যাখ্যা করেছেন।[১৩] অতএব স্বভাবতঃই অনেকের মনে সন্দেহ জেগেছে ‘ভট্টি’ ও ‘ভর্তৃহরি’ একই ব্যক্তি নাকি ভিন্ন ব্যক্তি?

এই প্রসঙ্গে বলা যায় ৩য়-৪র্থ শ্রীধর সেন ‘ভাগবৃত্তি’-কার ভর্তৃহরির পরবর্তী। অতএব এই আলোচনা ক্রমেও ভর্তৃহরিকে ২য় শ্রীধর সেনের সমসাময়িক বলাই যুক্তিযুক্ত। শুধুমাত্র নামের সাম্য লক্ষ্য করে এই মত সন্দেহ করা সমীচীন নয়। অতএব খুব সম্ভব ভর্তৃহরির পূর্বে ‘ভট্টি’ নামে কোন কবি বর্তমান ছিলেন। অথবা তাঁর বৃত্তির অনুসরণে কাব্যরচয়িতা কোন ব্যক্তি বিদ্যমান ছিলেন। মান্দাসোর শিলালেখর রচয়িতা বৎসভট্টি এবং ভট্টিকাব্যের কবি ভট্টিকেও একই ব্যক্তি বলে অনেকে দাবী করেছেন। কিন্তু এরূপ সিদ্ধান্ত নিতান্তই অমূলক। ভর্তৃহরির সাথে একমাত্র কাব্য ‘রাবণবধ’ কেই যুক্ত করা চলে। অন্য কোন গ্রন্থের সাথে তাঁর কোন যোগ ছিল না। অষ্টমশতকের প্রথমভাগে আলঙ্কারিক ভামহের কাল; ভামহ ভর্তৃহরির কাব্যের সমালোচনা করেছেন। এবং ভামহের রচনায় ভর্তৃহরির প্রভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু ভামহের কোন রূপ প্রভাব ভট্টিকাব্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। অতএব ‘ভট্টিকাব্য’ নিঃসন্দেহে ভামহের পূর্বে রচিত হয়ে ছিল। অষ্টাধ্যায়ীর কাশিকাবৃত্তির রচয়িতা জয়াদিত্য ৬৬১ খ্রিঃ পরলোক গমন করেন। তাঁর রচনাতে ভট্টিকাব্যের অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায়। অতএব ভর্তৃহরি নিঃসন্দেহে ৬ষ্ঠ শতকের শেষ ভাগেই বিদ্যমান ছিলেন।

কবি সম্বন্ধে বহু জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। যদিও এই সমস্ত কাহিনী কোনরূপ দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তথাপি কালের প্রভাবে লোকমুখে সেই সব কাহিনী বেঁচে আছে। যথা—এক ব্রাহ্মণের চারবর্ণের চারজন স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের গর্ভে যথাক্রমে—বররুচি, বিক্রমার্ক, ভট্টি ও ভর্তৃহরির জন্ম হয়। পরবর্তীকালে বিক্রমার্ক রাজাহলে তাঁর প্রধান মন্ত্রী হলেন ভট্টি। অপর কাহিনীতে বলভীরাজ ভট্টারকই ভট্টি নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সভাকবি ভর্তৃহরি ভট্টিকাব্য রচনা করে রাজার নামে অর্থাৎ ভট্টিকাব্য বলে প্রচার করেন। একটি কাহিনীতে ভর্তৃহরিকেই রাজা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এক ব্রাহ্মণ রাজাকে একটি ফল উপহার স্বরূপ প্রদান করলে তিনি সেই ফল তাঁর প্রিয়তমাকে দেন। প্রিয়তমা সেই ফল তাঁর প্রণয়ীকে দান করায় ভর্তৃহরি পত্নীর প্রতি অশ্রদ্ধায় অতিশয় বিমুখ হলে সন্ন্যাস গ্রহণ পূর্বক সংসার ত্যাগ করেন। এই বৈরাগ্য থেকেই তিনি শতকত্রয় রচনা করেছেন বলে সুভাষিত পাঠে জানা যায়। [১৪]

অপর একটি বহুল প্রচলিত জনশ্রুতি হল ভর্তৃহরি যখন তাঁর শিষ্যদের ব্যাকরণ পাঠ দান করছিলেন সেই সময় ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে যে ব্যবধান সেই স্থান দিয়ে একটি হাতী পার হয়ে যায়। এইরূপ দুর্লক্ষণ দেখে কুসংস্কার বশতঃ এক বৎসর যাবৎ ব্যাকরণ পাঠ দান বন্ধ ছিল। সেই সময় কাব্যের মধ্যে দিয়ে ছাত্রদের ব্যাকরণ শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই ভট্টিকাব্যের রচনা।

মল্লিনাথের মতে ভট্টির কাব্য ‘উদাহরণ কাব্য’। অন্যান্য সকল টীকাকার ও ব্যাখ্যাতৃগণ অকপটে স্বীকার করেছেন যে ব্যাকরণ শাস্ত্র শিক্ষা দেওয়াই এই কাব্য রচনার মূলে কাজ করেছিল। এইরূপ প্রেরণা থেকে যে কাব্যের সৃষ্টি তা খুব স্বাভাবিক ভাবেই পণ্ডিত সমাজে সমাদর লাভ করেছিল। কবি স্বয়ং তাঁর কাব্যে বলেছেন— যাঁরা ব্যাকরণে পারদর্শী তাঁরাই কেবল তাঁর কাব্যের রসাস্বাদন করতে পারবেন।

দীপতুল্যঃ প্রবন্ধোহয়ং শব্দলক্ষণচক্ষুষাম্।
হস্তামর্ষ ইবান্ধানাং ভবেদ ব্যাকরণাদৃতে।। ২২।৩৩

ব্যাকরণ যাঁদের চক্ষুস্বরূপ এই কাব্য তাঁদের নিকট প্রদীপ তুল্য কিন্তু ব্যাকরণ জ্ঞানহীন পাঠকের নিকট অন্ধের হাতে দর্পণের ন্যায় নিষ্ফল। তিনি আরও বলেছেন— তাঁর বিদ্যাবত্তার জন্য তাঁর রচিত কাব্য ব্যাখ্যা ব্যতীত বোধগম্য হবে না এবং কেবল সুধীবর্গই তাতে আনন্দ পাবেন। তাদের কাছে উৎসবের মত। জড়ধীগণ অনুশোচনা করবেন মাত্র।

“ব্যাখ্যাগম্যমিদং কাব্যমুৎসব : সুধিয়ামলম্।
হতা দুর্মেধমশ্চামিন্ বিদ্বৎপ্ৰিয়তয়া ময়া।। ২২।৩৪

কাহিনীসংক্ষেপ :—

দ্বাবিংশ সর্গ সমন্বিত ভট্টিকাব্য বা রাবণবধ মূলতঃ রামায়ণের রামকাহিনীকে অবলম্বন করে রচিত। কাব্যে সূর্যবংশীয় রাজা দশরথের কাহিনী থেকে আরম্ভকরে রামের বনবাস যাপন, রামকর্তৃক রাবণবধ ও ভাই লক্ষণ ও স্ত্রী সীতা সহ অযোধ্যায় পুনরাগমন বর্ণিত হয়েছে। আলোচ্য উদাহরণ কাব্যটি চারটি কাণ্ডে বিভক্ত, যথাক্রমে- প্রকীর্ণকাণ্ড, অধিকার কাণ্ড, প্রসন্নকাণ্ড ও তিঙন্ত কাণ্ড।

প্রকীর্ণ কাণ্ড :—প্রথম থেকে পঞ্চম সর্গে ৯৬ শ্লোকে সমাপ্ত। প্রথম থেকে পঞ্চম অর্থাৎ এই পাঁচটি সর্গে প্রথমে রামের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা পূর্বক তাঁর অস্ত্র বিদ্যাশিক্ষার কথা বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বামিত্র মুনির অনুরোধে দশরথ রামসক্ষণকে আশ্রমে পাঠালেন। আশ্রম যাত্রাকালে পথের দুপাশে নিসর্গ শোভা দেখে রামলক্ষণ মুগ্ধ, অভিভূত। রাম তীক্ষ্ণ বাণে মারীচ ও অন্যান্য রাক্ষসদিগকে হত্যাকরে মুনির ইচ্ছাপূরণ করলেন। অতঃপর জনক রাজার সভায় সীতার সয়ম্বর সভায় উপস্থিত হয়ে হরধনু ভঙ্গ পূর্বক সীতার পাণিগ্রহণ করে দেশে ফিরলেন। মন্থরার প্ররোচনায় কৈকেয়ীর মতিভ্রষ্ট হলে দশরথের কাছে পূর্ব প্রতিশ্রুত বর দুটি চেয়ে নিলেন। একবরে—”রাম চোদ্দ বৎসরের জন্য বনে যাবে এবং ভরত অযোধ্যার রাজা হবে। নিরুপায় বৃদ্ধ দশরথ সত্য রক্ষার্থে এই কঠিন শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হলেন। ফলে রাম জটা-চীর ধারণ করে বনবাসে গেলেন; ভাতৃভক্ত অনুজ লক্ষ্মণ ও পতিব্রতা সীতাও তাঁর অনুগামী হলেন। এদিকে অপত্যস্নেহ বশতঃ অসহ্য পুত্রশোকে দশরথ প্রাণ হারালেন। ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত ভরত মাতুলালয় থেকে ফিরে, মায়ের কু-কীর্তির কথা জানতে পেরে এমনই মর্মাহত হলেন যে তৎক্ষণাৎ রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য বার হলেন। চিত্রকূট পর্বতে গিয়ে রামের সাথে সাক্ষাৎ হল, ও বহু অনুরোধেও রামের সিদ্ধান্ত অটল দেখে অগ্রজের পরামর্শ ক্রমে ফিরে এসে অত্যন্ত সাধারণ ভাবে জীবনযাপন করে রাজকার্য পরিচালনা করতে লাগলেন। পরবর্তী সর্গে রাম সীতার বনবাস যাপনের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। দণ্ডকবনে খর-দূষণ ও ত্রিশিরাকে বধ এবং লক্ষ্মণ কর্তৃক শর্পণখার নাসাকর্ণ ছেদন বর্ণিত হয়েছে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ত্রুদ্ধ রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ পর্যন্ত্য এই প্রথম কাণ্ডে বর্ণিত রয়েছে। আলোচ্য প্রকীর্ণ কাণ্ডে কবি ব্যাকরণের বিভিন্ন সূত্রের উদাহরণ প্রদর্শন করেছেন।

অধিকার কাণ্ড :—পঞ্চম সর্গের ৯৭ শ্লোক থেকে নবম সর্গের শেষ পর্যন্ত অধিকার কাণ্ডের ব্যাপ্তি। এই অংশে রাম লক্ষ্মণ সীতা অন্বেষণে বার হলেন। ঋষ্যমুক পর্বতে সুগ্রীবের মত হিতকারী বন্ধু লাভ এবং রামকর্তৃক বালী-বধ। সুগ্রীবের সেনা- বাহিনী সীতার সন্ধান পায় লঙ্কাপুরীতে। অতঃপর অশোককানন ধ্বংস করে হনুমান লঙ্কায় প্রবেশ করে সীতার সাক্ষাৎ পেল। ইন্দ্রজিৎ কর্তৃক হনুমান নিগ্রহণের কথা পর্যন্ত্যই এই পর্যায়ের বিষয়। ষষ্ঠ সর্গে দ্বিকর্মকধাতু, কৃৎপ্রত্যয়, সপ্তমসর্গে কৃৎপ্রত্যয়ের বিভিন্নরূপ, স্ত্রী প্রত্যয়; অষ্টমসর্গে আত্মনেপদ বিধান। কারক বিভক্তি, উপসর্গ, কর্ম প্রবচনীয় এবং নবম সর্গে ইৎ বিষয়ক সূত্র ও ষত্ব-ণত্ব বিধানের প্রয়োগ প্রদর্শিত হয়েছে।

প্রসন্ন কাণ্ড :—১০ম—১৩শ সর্গ। এই অংশে সীতা কর্তৃক প্রদত্ত অভিজ্ঞান সংগ্রহ করে হনুমান রামের নিকট তা পৌঁছে দিলে রাম সীতা উদ্ধারের আয়োজন করতে লাগলেন। লঙ্কা নগরীর প্রভাত বর্ণনা; রামের নিকট বিভীষণের আগমন এবং সমুদ্রের উপরে সেতুবন্ধনের মত চমৎকার ও চিত্তাকর্ষক বিষয়ের বর্ণনা। আলোচ্য কাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত দশমসর্গে শব্দ ও অলংকারের প্রয়োগ। একাদশসর্গে রচনার মাধুর্য কাব্যকে রসোত্তীর্ণ করেছে। দ্বাদশসর্গে কবিকল্পনা ভাবুক হৃদয়কে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। এবং ত্রয়োদশ সর্গে সার্থক শব্দচয়নে ভাষার বন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে।

তিঙন্ত কাণ্ড :—১৪শ থেকে ২২শ সর্গ। এই অংশের ঘটনায় অবশ্যম্ভাবী ভাবে দুই পক্ষের যুদ্ধ অর্থাৎ রাম-রাবণের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। যুদ্ধে রাম-লক্ষ্মণ কর্তৃক একে একে কুম্ভকর্ণ, রাবণের চার-চারজন পুত্র ও কুম্ভকর্ণের দুই পুত্র নিহত হলেন। অবশেষে রাম-কর্তৃক রাবণ বধ হলে বিভীষণ প্রচণ্ড বিলাপ করতে থাকলেন; তথাপি লঙ্কার সিংহাসনে বিভীষণের অভিষেক সম্পন্ন হলে লঙ্কার মর্মান্তিক ঐতিহাসিক যুদ্ধের অবসান হল। প্রজাদের অনুরোধে রামকর্তৃক প্রত্যাখ্যাত সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে তাঁর সতীত্ব প্রমাণ করতে হল। অবশেষে রাম লক্ষ্মণ ও সীতা সহ অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করে রাজ্যভার গ্রহণ করলেন। এই তিঙন্ত কাণ্ডের অন্তর্গত চতুৰ্দশ সর্গে লিঙ্, পঞ্চদশ সর্গ থেকে দ্বাবিংশ সর্গ পর্যন্ত যথাক্রমে লুঙ্, লুট্, লঙ্, লট্, লিঙ্, লোট ও লুটের উদাহরণ প্রদর্শিত হয়েছে। সেদিক থেকে ‘রাবণবধ’-কে উদাহরণ কাব্য আখ্যায় ভূষিত করা যথেষ্ট ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত হয়েছে।

কাব্য সমালোচনা :—অতি যত্ন পূর্বক, আয়াস সাধ্য এই কাব্য সকল যুগের পণ্ডিত সমাজকে তৃপ্ত করবে সন্দেহ নেই। কবি যে শুধুমাত্র ব্যাকরণ শাস্ত্রের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাই নয়, অলঙ্কার, ছন্দ, জ্যোতিষ, দর্শন, রাজনীতি, সমাজনীতি ধর্মীয় সকল শাস্ত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ কাব্যকে বিদগ্ধজনেদের উপভোগের উপযুক্ত করে তুলেছে। ভট্টিকাব্যে শব্দ বর্ণবৈচিত্র্যের বিপুল সম্ভার, ছন্দ-অলঙ্কারের সার্থক প্রয়োগ সর্বোপরি বিবিধশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের সাথে কবির কবিত্বশক্তির অপূর্ব মেলবন্ধন দৃষ্ট হয়। যথা-

‘ন গজা নগ-জা দয়িতা বিগতং বিগতং ললিতং-ললিতম্।
প্রমদা প্রমদা মহতা মহতা মরণং মরণং সময়াৎ সময়াৎ।। ১০।৯

আলঙ্কারিক ভামহ আলোচ্য কাব্য সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন। ‘ব্যাখ্যাগম্যানি শাস্ত্রবৎ।’ ভামহ ও ভট্টির রচনায় বহুলাংশে সাদৃশ্য দেখা যায়।” ক্ষেমেন্দ্র ভর্তৃহরিকে ‘শাস্ত্র কবি’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে দুরূহ শব্দ চয়নে সত্যিই কাব্যটি সাধারণের পাঠের অনুপযুক্ত, পণ্ডিত সমাজের প্রতি কবির আনুগত্য প্রদর্শনই কাব্যরচনার মূলে কাজ করেছিল।

ব্যাকরণের জটিল নাগপাশে বদ্ধ ভট্টিকাব্য রসশূন্য এরূপ মনে করা ভুল। এমন অনেক স্থান রয়েছে-যা অপরূপ কাব্য সৌন্দর্য্যে সুশোভিত। দ্বিতীয় সর্গের শরৎ বর্ণনা অতুলনীয়—

দত্তাবধানং মধুলেহিগীতৌ প্রশান্তচেষ্টং হরিণং জিঘাংসুঃ
আকর্ণয়ন্নুৎ সুকহংসনাদান্ লক্ষ্যে সমাধিং ন দধে মৃগাবি‍।।২।৭

মধুর শরতের আগমনে মুগ্ধ মধুকরের মধুর গুঞ্জন যেন বনের চকিত হরিণীও নিস্পন্দ হয়ে শ্রবণ করছে। হংসশ্রেণীর কলনিনাদে ব্যাধেরও লক্ষ ভ্রষ্ট হয়েছে।

রামচন্দ্রের প্রতি সমবেদনায় মূক, বধির বৃক্ষগুলিও অশ্রু বিসর্জন করেছিল। কবির কল্পনায় জড় প্রকৃতিও লাস্যময়ী লীলাচঞ্চল হয়ে উঠেছে। শরৎ এর আগমনে প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে অবশ্যম্ভাবী রূপ ধরা দিয়েছে কবির লেখনীতে—

ন তজ্জলং যন্ন সুচারু পঙ্কজং ন পঙ্কজং তদ যদলীন ষট্পদম্।
ন ষট্‌পদোহসৌ ন জুগুজ্ঞ যঃ কলং ন গুঞ্জিতং তন্ন জহার যম্ননঃ।। ২।১৯

অর্থাৎ শরতের আগমনে এমন কোন সরোবর নেই যাতে পদ্ম বিকশিত না হয়। এমন কোন পদ্ম নেই যাতে ভ্রমর না জোটে, এমন কোন ভ্রমর নেই যারা গুঞ্জন না করে, আবার এমন কোন গুঞ্জন নেই যা মানুষের মনকে না হরণ করে।

কবি দশম সর্গে বলছেন-

ন ভবতি মহিমা বিনা বিপত্তে
রবগময়ন্নিব পশ্যতঃ পয়োধিঃ।
অবিরতমভবৎ ক্ষণে ক্ষণে হসৌ
শিখরি পৃথু প্রথিত প্রশান্ত বীচিঃ॥১০।৬২

অর্থাৎ কবির মতে সকল প্রকার উন্নতিই বিপত্তির সাথে জড়িত। এই সত্যের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সমুদ্র কিভাবে তার বিশাল তরঙ্গ ভঙ্গের মধ্য দিয়ে অনবরত আসছে আবার সাথে সাথেই সংহার করে নিচ্ছে। সমুদ্র তরঙ্গের ঘাত-প্রতিঘাত মানব জীবনের বিপত্তি ও উন্নতির সাথে তুলনীয়।

আবার সীতার অলৌকিক রূপলাবণ্যের বর্ণনা প্রসঙ্গে একের পর এক উপমা প্রয়োগে তার কবিত্ব-শক্তির যথার্থ স্ফুরণ ঘটেছে। যথা—

‘হিরন্ময়ী সাললতের জঙ্গমা—
চুত্তা দিবঃ স্থানুরিবাচির প্রভা
শশাংক কাণ্ডেরধিদেবতাকৃতিঃ
সুতা দদে তস্য সুতায় মৌথিলী ॥২॥৪৭

আবার প্রভাতবেলায় কুমুদ্বতী-রেণু-পিলঙ্গ-বিগ্রহ ভ্রমরকে মৃদুমন্দ সমীরনে চলমান পদ্মের উপর বসিবসি করেও ব্যর্থকাম হতে দেখে কবি সুরত লম্পট দয়িতের প্রতি মালিনী দায়িতার অভিমান ব্যঞ্জনার যে চিত্র অঙ্কিত করেছেন তা যেন কালিদাসকেও অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছে।

অতএব পাণ্ডিত্যের গুরু ভারে রচনা যতই ন্যুব্জ হোক না কেন কবিত্বের স্বতঃস্ফূর্ত আবেদন পাঠক-চিত্তকে বিমোহিত করে। উদাহরণ কাব্য’, ‘শাস্ত্রকাব্য’ ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত হলেও ভট্টিকাব্য প্রথমে কাব্য। বাল্মীকি রামায়ণের ছায়ায় কবি তিক্ত ব্যাকরণ বটিকা কাব্যরসে জারিয়ে পাঠকগণকে সেবন করিয়েছিলেন।

ভট্টিকাব্যের টীকাকারগণের মধ্যে জয়মঙ্গল কৃত জয়মঙ্গলা। নারায়ণ রচিত ভট্টিবোধিনী, মল্লীনাথকৃত সর্বপথীন, ভরতমল্লিকের মুগ্ধবোধিনী, রামানন্দের মুগ্ধ বোধিনী, পুরুষোত্তমের ভাষাবৃত্তিব উল্লেখ করা যায়। এক সময় বিদগ্ধজনেদের নিকট ভট্টিকাব্য বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছিল ও বহুল পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে পণ্ডিত সমাজ কাব্যের ব্যাখ্যায় মনোনিবেশ করেছিলেন। পরবর্তীকালের কাব্য রচয়িতাগণ বহুলাংশে ভর্তৃহরির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এই বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ‍ই নেই। ভামহ-এর অলংকারশাস্ত্র, ভৌমকবির ‘রাণার্জুনীয’ জৌনাচার্য্য হেমেন্দ্ৰ ভট্টি-কাব্যের অনুকরণে “দ্ব্যাশ্রয়-মহাকাব্য” নামে কাব্য রচনা করেছিলেন। যদিও পণ্ডিত মহলে এই সব কাব্য তেমন সমাদর লাভ করতে সমর্থ হয় নি।

মাঘ

অষ্টম শতক থেকে পর পর কয়েক শতাব্দী কাল ধরে সংস্কৃত সাহিত্যে মহাকাব্য রচনার যে স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল; কাশ্মীর ছিল সেই সংস্কৃত চর্চার অন্যতম পীঠস্থান। অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে মাঘের কাল চিহ্নিত হলে বলা যায় মাঘ থেকে শ্রীহর্ষ পর্যন্ত্য মহাকাব্যের দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে তাঁদের পথিকৃৎ অশ্বঘোষ ও কালিদাসের মত কালোত্তীর্ণ কবির প্রভাব যেমন অস্বীকার করা যায় না সত্যই উপরন্তু ভারবি, ভট্টিকে সম্পূর্ণ রূপে অনুসরণ করতে গিয়ে এযুগের কবিদের রচনা পাণ্ডিত্য সর্বস্ব অথচ সুমধুর আবেদনে রসোত্তীর্ণ হয়েছে। আলঙ্কারিকদের বিচারে কাব্যের ভিন্ন ভিন্ন বহিরঙ্গ উপাদান, রচনাবৈচিত্র্য ধরা দিয়েছে পৃথক্ পৃথক্ আঙ্গিকে। এই দ্বিতীয় পর্বে সমস্ত কাব্যকারেরাই পূর্বসূরীদের পথ অনুসরণ করলেন কিন্তু সকলেই তো সমান প্রতিভাধর কবি নন, প্রত্যেকেরই একটা নিজস্বতা বা মৌলিকতা থাকে, অতএব তাঁরা সকলেই মহৎ মহাকাব্যকার হতে পারলেন না। মাঘ, ভারবি, শ্রীহর্ষকে কৃত্রিমভাবে অনুসরণ করতে গিয়ে তাঁরা অনেকাংশেই ব্যর্থ হলেন। ফলে কতকগুলি মৌলিকতা বর্জিত, বৈচিত্র্যবিহীন, নীরস পাণ্ডিত্যের বাঙ্ময় প্রকাশ মুষ্টিমেয় পণ্ডিতের পিপাসা নিবৃত্ত করলেও শিক্ষিত রসগ্রাহী সুধী সমাজের কাব্যরস পিপাসাকে চরিতার্থ করতে ব্যর্থ হল।

কবি পরিচয় :—

কালিদাসোত্তর যুগে কাব্য রচনা করে যাঁরা যশের মুকুট পড়েছেন মহাকবি ‘মাঘ’ নিঃসন্দেহে তন্মধ্যে অন্যতম। মাঘের ‘শিশুপালবধ’ নামক কাব্যই তাঁকে সুধীপণ্ডিত সমাজে অমর করে রেখেছে। কবি তাঁর নিজ কাব্যের শেষ পাঁচটি শ্লোকে সামান্য আত্মপরিচয় দিয়েছেন। তার অধিক তথ্য তেমন কিছু পাওয়া যায় না। কোন কোন সমালোচক বা গবেষককে সেই অংশও প্রক্ষিপ্ত কিনা, এরূপ সন্দেহ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। কবির পিতামহ ছিলেন—সুপ্রভদেব। তিনি বর্মলাটের মন্ত্রী এবং পিতা দত্তক সর্বাশ্রয় নামে খ্যাত ছিলেন। সর্বগুণাশ্রয় ও সজ্জন প্রকৃতির বলেই এইরূপ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এর চাইতে অধিক তথ্য পাওয়া যায় না। ৬২৫ খ্রিঃ বর্মলাট রাজার লেখা একটি শিলালেখ পাওয়া যায়। প্রবন্ধ চিন্তামণির লেখক মেরুতুঙ্গাচার্য- এর মতে মাঘের বাসস্থান ছিল শ্রীমাল নগর। পুষ্কিকাতেও শ্রীভিন্নমাল এর উল্লেখ রয়েছে। খুব সম্ভব শ্রীভিন্নমাল ও শ্রীমাল বর্তমান গুজরাট-মাড়বার সীমান্তের ভিন্‌মাল গ্রামকেই বুঝিয়েছে। ভোজ প্রবন্ধেও মাঘকে গুর্জর দেশবাসী বলা হয়েছে। অতএব তিনি গুজরাট বাসী ছিলেন একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।

কবির কাল :– মহাকবি মাঘের আবির্ভাব কাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্যাদি থেকে অনুমান হয় কবির সম্ভাব্য কাল এইরূপ—৬২৫ খ্রিঃ বর্মলাট কর্তৃক লিখিত একটি শিলালেখ পাওয়া যায়। অনেকের মতে ‘মাঘ’ উক্ত বর্মলাটের বিশেষ স্নেহধন্য ছিলেন। অতএব সপ্তম শতাব্দীই কবির কাল। ৮ম থেকে ১১শ শতকের আলঙ্কারিকেরা তাদের গ্রন্থে মাঘের শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। যেমন অষ্টমশতকে বামনের কাব্যালঙ্কার। নবমশতকে আনন্দবর্ধনের ধ্বন্যালোক। দশমশতকে মুকুলভট্টের অভিধাবৃত্তিমাকা এবং একাদশ শতকে ভোজের সরস্বতী কণ্ঠাভরণ গ্রন্থে মাঘের শিশুপাল বধ থেকে উদাহরণ প্রদত্ত হয়েছে। অতএব অষ্টমশতকের পূর্বে কবিকে স্থাপন করতে কোন বাধা নেই। মাঘ ভট্টিকাব্য ও জানকীহরণ কাব্য জানতেন বলে বিদগ্ধজনেরা বিশ্বাস করেন। অধ্যাপক A. B. keith মনে করেন মাঘ শিশুপাল বধের একটি শ্লোকে শ্লেষ বশতঃ বামন ও জয়াদিত্যের কাশিকাবৃত্তি ও জিনেন্দ্রবুদ্ধির ন্যাসের উল্লেখ করেছেন। শ্লোকটি নিম্নরূপ—

অনুৎসুত্রপদন্যাসা সদ্বৃত্তিঃ সন্নিবন্ধনা।
শব্দবিদ্যেব নো ভাতি রজনীতির পস্পশা॥ ২।১১২

মহাকবি ভারবিকেও তিনি বিশেষ ভাবে অনুসরণ করেছিলেন। আইহোল শিলালেখতে (৬৩৪ খ্রিঃ) কালিদাস ও ভারবির নাম উল্লিখিত রয়েছে। ইৎ-সিং এৱ মতে জয়াদিত্যের মৃত্যু হয়-৬৬১ খ্রিঃ—অতএব মাঘের সময় সপ্তম খ্রিষ্টাব্দই ধার্য হয়। ভারবির কাল যদি হয় সপ্তম শতাব্দীর শেষার্ধ তবে অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধে মহাকবি মাঘের কাল এইরূপ অনুমান সংগত। Macdonell দশমশতাব্দীতে, ঐতিহাসিক রমেশশ্চন্দ্র দত্ত দ্বাদশ শতাব্দীতে, ডাফ্ সাহেব নবমশতাব্দীতে কবির অবির্ভাব কাল বলে অনুমান করেছেন। কিন্তু ডঃ সুশীল কুমার দে’র মতে অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধের পরে কোন মতেই কবিকে স্থাপন করা চলে না। অতএব বহু মতান্তরের মধ্য দিয়েও সিদ্ধান্ত করা যায় যে সপ্তমশতাব্দীর শেষার্ধ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধের মধ্যবর্তী সময়েই মহাকবি মাঘের জীবৎকাল।

কাব্যের বিষয়বস্তু :—১৬২৫টি শ্লোক সমন্বিত মোট ২০ টিসর্গে রচিত “শিশুপাল বধ’ নামক মহাকাব্যের মূল বিষয়বস্তু ‘মহাভারত’ থেকে গৃহীত। মহাভারতের সভাপর্বে কৃষ্ণ কর্তৃক শিশুপাল বধের যে কাহিনী, সেই সংক্ষিপ্ত কাহিনীকে কবি তার সৃজনী শক্তির দ্বারা একটি পরিপূর্ণ ও সার্থক কাব্যের রূপ দান করেছেন। তিনি কৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন ঠিকই কিন্তু অন্যান্য ধর্ম সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল স্বচ্ছ ও উদার। ‘শিশুপাল বধে’ কবি কৃষ্ণকে পরম পুরুষ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কবির উপরে জৈন ও বৌদ্ধ প্রভাবও যথেষ্ট ছিল। কারণ কবি তাঁর কাব্যে কৃষ্ণকে বোধিসত্ত্বের সাথেও তুলনা করেছেন।

কাব্যের প্রারম্ভে নারদের মর্ত্যে আগমন। শ্রীকৃষ্ণ ভবনে নারদ ও শ্রীকৃষ্ণের কথোপকথন। নারদ কর্তৃক শিশুপালের অত্যাচারের বর্ণনা ও কৃষ্ণকে শিশুপাল বধে প্ররোচিত করে সম্মত করা। অতঃপর উদ্ভব ও বলরামের সাথে কৃষ্ণের পরামর্শ ও রাজনীতি, কূটনীতি ইত্যাদির গভীর আলোচনা দৃষ্ট হয়। তৃতীয় সর্গে দ্বারকা নগরীর অতিশয় মনোরম বর্ণনা রয়েছে। চতুর্থ সর্গ থেকে দ্বাদশ সর্গ পর্যন্ত্য যদুবংশীয় রাজাদের ও যুবক-যুবতীদের বন-বিহার, জলকেলি, বর্ণিত হয়েছে। সন্ধ্যা প্রভাতের নিপুণ বর্ণনা, যাদবদিগের মধুপান, প্রণয়সম্ভোগ বর্ণনা এবং এই অবসরে ষড়ঋতুর নিখুঁত বর্ণনায় কবির কবিত্বশক্তির যেন যথাযথ স্ফুরণ ঘটেছে। যমক, স্বভাবোক্তি প্রভৃতি অলঙ্কারে বর্ণনা মনোরম হয়েছে। অতঃপর ঘটনায় কৃষ্ণের চতুরঙ্গ বাহিনী সাথে যাত্রা, পাণ্ডবদের সাথে যাদব-পক্ষের মিলন ও মহা উৎসব ব্যাখ্যাত হয়েছে। চতুর্দশ সর্গে যুধিষ্ঠির আয়োজিত রাজসূয় যজ্ঞের বর্ণনা ও ভীষ্মকর্তৃক কৃষ্ণের স্তুতি দেখান হয়েছে। পঞ্চদশ সর্গে শ্রীকৃষ্ণকে যজ্ঞের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য প্রদানে শিশুপালের ক্ষোভ লক্ষ্যণীয়। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের উষ্মা প্রকাশ পায় এবং ভীয়ে উক্তিতে শিশুপাল সমর্থিত রাজাদের ক্রোধ বেড়ে উঠলে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন সম্পূর্ণ হয়। অতঃপর শিশুপালের প্রেরিত দূত কর্তৃক কৃষ্ণকে যুদ্ধে আহ্বান করা হলে সপ্তদশ সর্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি, সাজসজ্জা ও অষ্টাদশ সর্গে তুমুল যুদ্ধের বর্ণনা করা হয়েছে। এই পর্বে কবি নানারূপ অলঙ্কারে কাব্যকে সত্য সত্যই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের সজ্জায় সজ্জিত করেছেন। এক্ষেত্রে কবি তাঁর পূর্বসূরী ভারবিকে অনেকাংশে অনুসরণ করেছেন বলে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। অন্তিমসর্গে শিশুপাল ও কৃষ্ণের সরাসরি যুদ্ধে কৃষ্ণ কর্তৃক সুদর্শন চক্রের সাহায্যে শিশুপালের নিধন কবির রচনা পরিপাট্যে অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

কাব্য বিচার :—আলোচ্য কাব্যে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নায়ক এবং শিশুপাল প্রতিনায়কের ভূমিকায়। মাঘ কেবল প্রসিদ্ধ কবিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বহুশাস্ত্রে পারদর্শী। বেদ, পুরাণ ষড়দর্শন, অলঙ্কার, জ্যোতিষ ও এছাড়াও বৌদ্ধ ও জৈন আগম বিষয়েও তাঁর অনুরাগ ছিল। বিশেষতঃ মাঘ একজন বড় বৈয়াকরণও ছিলেন।” কাব্যে তাঁর ব্যাকরণের প্রয়োগ দেখে মনে হয় কবি ভর্তৃহরি কর্তৃক তিনি গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কাব্যের দ্বিতীয় সর্গে তিনি যে কত বড় রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন তারও আভাস পাওয়া যায়। উদ্ভবের মুখে সুদীর্ঘ ভাষণের মধ্য দিয়ে রাজার স্বরূপ বর্ণনা করেছেন।

বুদ্ধিশস্ত্রঃ প্রকৃত্যঙ্গো ঘন সংবৃতি কঞ্চুকঃ।
চারেক্ষণো দূতমুখঃ পুরুষঃ কোঽপি পার্থিবঃ।। শিশু-২.৮২

শিশুপালবধ প্রধানতঃ বীররসাশ্রয়ী হলেও শৃঙ্গার, রৌদ্র, হাস্য, বিভৎস প্রভৃতি রসের ধারা কাব্যকে বিদগ্ধ পণ্ডিত সমাজে রসোত্তীর্ণ করেছে। কৃষ্ণস্তুতি করতে গিয়ে কবি ভক্তিরসেও উদ্বেলিত হয়েছেন। কালিদাস ১৯টি অলঙ্কার প্রয়োগে কাব্যরচনা করেছেন। ভারবি ২৪টি ছন্দে কাজ করেছিলেন। কিন্তু মাঘ ৪১টা ছন্দের ব্যবহার করেছেন। বন্ধকাব্য রচনার প্রয়াসে তিনি একোনবিংশ সর্গে ভারবিকেও অতিক্রম করেছেন।” অলঙ্কার সংখ্যা, শব্দসংখ্যা, শব্দচয়ন, সার্থক উপমা প্রয়োগ এই সবের বাহুল্য মাঘের রচনাকে কখনই ভারাক্রান্ত করে নাই উপরন্তু তাঁর কাব্য এক অন্য মাত্রা লাভ করেছে। এইরপ রচনা পরিপাট্য সে যুগের কবিদের বৈশিষ্ট্য ছিল। একথা ভুলে গেলে চলবে না। সেহেতু মাঘ ভারবির সাথে তুলনীয় কালিদাসের সাথে নয়। যুগে যুগে মানুষের সংস্কৃতি বদলায় তাঁর রুচি অনুযায়ী।পৃথক্ পৃথক্ যুগের মানুষের পৃথক পৃথক্‌ চাহিদা মেটানো কবিমাত্রেরই কর্তব্য। তাই ভারবি, মাঘ যে যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন, সে যুগের মানুষ শুধুমাত্র আবেগ ও ভাব সম্পদের মধ্যে কাব্যকে ধরে রাখতে চান নি, তাঁরা সর্বশাস্ত্র রোমন্থন করে তাঁকে কাব্যের মধ্য দিয়ে পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। সে দিক থেকে বিচার করলে ভারবি, ভর্তৃহরি, মাঘ, কুমারদাস, শ্রীহর্ষ সকলেই তাঁদের নিজ নিজ প্রতিভাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

মহাকবি মাঘের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক প্রশংসা করে বহুজনে বহু মন্তব্য করেছেন। যেমন বলা যায়—

‘উপমা কালিদাসস্য ভারবেরর্থ গৌরবম্।
নৈষধে পদলালিত্যং মাঘে সত্তি এয়োগুণাঃ।।”

অর্থাৎ উপমা অলঙ্কার প্রয়োগে কালিদাস প্রসিদ্ধ, অর্থগৌরবে ভারবি বিখ্যাত; নৈষধ কাব্যের রচয়িতা শ্রীহর্ষ পদলালিত্যে শ্রেষ্ঠ; আর মাঘের সৃষ্টিতে এই তিন গুণেরই সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়।

মহাকবি ‘মাঘ’ ও বহু সার্থক উপমা প্রয়োগ করেছেন তাঁর কাব্যে। নিজ বৈশিষ্ট্যে- চতুর্থ সর্গের বিংশতি সংখ্যক শ্লোকে কবি বলেছেন—অস্তগমনোন্মুখ সূর্য এবং উদীয়মান চন্দ্রের মধ্যবর্তী অচলশিখরকে দুই পার্শ্বে দুটি ঘণ্টা বাঁধা হস্তির ন্যায় মনে হয়। এইরূপ উপমা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে তিনি ‘ঘণ্টা মাঘ’ বলে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তাঁর রচনা অর্থ গৌরবের বিষয়ে ভারবিকে অনুসরণ করতে গিয়ে স্থানে স্থানে অতিক্রম করে গিয়েছে। এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন নতুন নতুন শব্দ সহযোগে পদ রচনাই যেন তাঁর কাব্যরচনার প্রেরণার মূলে কাজ করেছিল। এ হেন শব্দ বৈভবের প্রশংসা পূর্বক বলা হয় যে মাঘ কাব্যের নয়টি সর্গ পাঠ করলেই অভিধানের সমস্ত শব্দ জানা হয়ে যায়। ‘নবসৰ্গৰ্গতে মাঘে নবশব্দো ন বিদ্যতে।’ অতএব সমালোচকদের মতে মাঘ তাঁর কাব্যরচনার মধ্য দিয়ে সকল কবির দর্প চূর্ণ করেছেন। কাব্যের মধ্যে মাঘের কাব্যই বিখ্যাত, কবিদের মধ্যে যেমন কালিদাস বিখ্যাত। ‘মহাকাব্যেষু মাঘঃ কবিঃ কালিদাসঃ।’ আমরা পূর্বেও আলোচনা করেছি যে ‘মাঘ’ এর রচনা উপর্যুপরি পাণ্ডিত্যের নিদর্শন। পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের নিমিত্ত স্থানে স্থানে কাব্য দুরূহ ও দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠায় সাধারণ পাঠক সমাজের কাছে তার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। সাধারণ পাঠকের নিকট সুখপাঠ্য অথবা বোধগম্য করে তুলতে ব্যাখ্যার প্রয়োজন। ভট্টি কাব্যের মতনই ‘ব্যাখ্যাগম্যমিদং কাব্যমুৎসব সুধিয়ামলম্’ বিখ্যাত টীকাকার মল্লিনাথের উক্তিটিও এই প্রসঙ্গে প্রনিধানযোগ্য—’মাঘে মেঘে বয়ো গতম্।’ অর্থাৎ মাঘ ও মেঘদূতের ব্যাখ্যা লিখতেই বয়স অতিক্রান্ত হলো।

তৎকালীন প্রায় অধিকাংশ টীকাকারই মাঘের ‘শিশুপালবধ’ কাব্যের টীকা প্রণয়ন করেছেন। প্রায় পঁচিশটিরও অধিক টীকা পাওয়া যায়। বল্লভদেব, শ্রীকণ্ঠ দেবরাজ, মল্লিনাথ, ভরতসেন, লক্ষ্মীনাথ, বৃহস্পতি, কবিবল্লভ, দিবাকর, পেড্ডভট্ট, ভগদত্ত, প্রভৃতির টীকা প্রসিদ্ধ। সে যুগের পণ্ডিত সমাজে শিশুপালবধের মত মহাকাব্যের যথেষ্ট সমাদর ছিল। যদিও একদল সমালোচক মাঘের রচনা নিয়ে এত উচ্ছ্বাসের কোন কারণ দেখতে পান না। আলঙ্কারিক মহিমভট্টের অনুগামীগণ কাব্য দোষের উদাহরণ প্রসঙ্গে মাঘের শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন।

ভারবি ও মাঘ :—ভারবির ‘কিরাতাজুণীয়ম্’ ও মাঘের ‘শিশুপালবধ’ উভয় কাব্যের সাদৃশ্য সমালোচকদের ভাবিয়ে তুলেছে। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জেগেছে মাঘ তার পূর্ববর্তী ভারবিকে অনুসরণ করেই কি কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন? শুধুমাত্র অনুসরণই নয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্মুখ সমরে প্রতিদ্বন্দীতার আহ্বানও শোনা যায়। বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত জ্যাকোবির মতে উভয় কবির কাব্য সাদৃশ্যের প্রসঙ্গে বলা যায়—প্রথমতঃ—উভয় কাব্যই মূলতঃ মহাভারতের বিষয় অবলম্বনে রচিত। দ্বিতীয়তঃ দুইটিই বীররসপ্রধান মহাকাব্য। তৃতীয়তঃ—ভারবি কাব্যের শুরুতে ‘শ্রী’ শব্দ ও প্রতি সর্গান্তে ‘লক্ষ্মী’ শব্দের প্রয়োগ করেছেন এবং মাঘ কাব্যের শুরু ও শেষ উভয় ক্ষেত্রেই ‘শ্রী’ শব্দের প্রয়োগ করে কাব্যের শ্রীবর্ধন করেছেন। চতুর্থতঃ—ভারবি নিঁখুত উপমা প্রয়োগে ‘ছত্রঃভারবি’ উপাধি পেয়েছেন এবং মাঘ এই একই কারণে ‘ঘণ্টামাঘ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। উভয় কাব্যের বিষয় উপস্থাপনাতেও বহু সাদৃশ্য বর্তমান যেমন—কিরাতার্জুনীয়ের প্রথমসর্গে দেখি বনেচর, যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীর কথোপকথন, শিশুপাল বধের প্রথমসর্গে দেবর্ষি নারদ, ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথোপকথন। কিরাতার্জনীয়মে দ্বৈতবনে মহর্ষি বেদব্যাসের আগমন। শিশুপাল-বধে তেমনি নারদের আগমন। এমন বহু মিল সমস্ত কাব্যকে অধিকার করে রয়েছে। ষষ্ঠতঃ—প্রকৃতির নিসর্গ চিত্রও ফুটে উঠেছে উভয় কবির রচনা নৈপুণ্যে। কিরাতাজুশীয়মে অর্জুনের হিমালয় গমন প্রসঙ্গে হিমালয়ের বর্ণনা এদিকে শিশুপাল বধে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা থেকে ইন্দ্র প্রস্থ গমনকালে রৈবতক পর্বতের বর্ণনা দেখা যায়। সপ্তমতঃ- একাক্ষর পাদ, দ্ব্যক্ষরপাদ, অর্ধভ্রমক, সর্বতোভদ্র প্রভৃতি শ্লোকে বন্ধগত কৌশল যেন একে অপরকে ছাপিয়ে গেছে। উভয় কবির রচনায় সাদৃশ্য প্রচুর তথাপি স্বাতন্ত্র্যকেও উপেক্ষা করে যায় না। ভারবি শিবের মহিমা কীর্তন করেছেন। কিন্তু মাঘ শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করেছেন। অলঙ্কার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাঘ নিঃসন্দেহে ভারবিকে অতিক্রম করে গেছেন। ভারবি তাঁর কাব্যে পঞ্চমসর্গে সর্বাধিক ১৬টি ছন্দ ব্যবহার করেছেন ও মাঘ তাঁর কাব্যের চতুর্থ সর্গে সর্বাধিক ২২টি ছন্দ প্রয়োগ করেছেন। মহাকাব্যের আদর্শগুলি চূড়ান্তভাবে অনুসৃত হয়েছে উভয়কাব্যেই।

সমালোচকদের মতে অর্থ গৌরবে মাঘ ভারবির সমতুল্য। কিন্তু ভারবির কাব্য অধিক কবিত্বশক্তির পরিচায়ক। তথাপি জনৈক পণ্ডিতের উক্তি অনুযায়ী যতদিন না মাঘের উদয় হয়েছে ততদিনই ভারবির দীপ্তি ছিল। ‘তাবদ্ভাভারবেভাতি যাত্মা ঘস্যনোদয়ঃ। ‘মাঘ’ ভারবিকে অনুসরণ করতে গিয়ে কোন কোন স্থানে উত্তীর্ণ হয়েছেন সত্যই তথাপি অনুকরণ প্রিয়তার কারণে কোন কোন স্থানে তাঁর মৌলিকতাও অনেকাংশে খর্ব হতে দেখা গেছে একথা অবশ্যস্বীকার্য।

কুমারদাস

কবি পরিচিতি :—কালিদাসোত্তর যুগের আর এক মহাকাব্যকার কুমারদাস। জনশ্রুতি আছে সিংহল রাজ কুমারদাসের বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন মহাকবি কালিদাস; এবং কুমারদাসের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করলে এক লোভী বারবণিতার হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও এই কিংবদন্তীর কোন দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায় না। কুমারদাস রচিত জানকীহরণ কাব্য বিদগ্ধ জনেদেরে কাছে বিশেষ সমাদৃত হয়েছিল। এই জানকীহরণের শেষ অংশে কবি স্বয়ং তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন—তাঁর পিতার নাম মানিত এবং কবি নিজে সিংহলরাজ কুমারমণির সৈন্যাধ্যক্ষ, বীরযোদ্ধা ও বিদগ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। বাল্যকালে পিতৃহারা হয়ে তাঁকে মাতুলালয়ে মানুষ হতে হয়। কবির মাতুলদ্বয় ও বীর যোদ্ধা ও পণ্ডিত ছিলেন এবং তাঁরাই কবির কাব্যচর্চার প্রেণাস্বরূপ।

কবির কাল :—সিংহলের জনশ্রুতি অনুযায়ী কুমারদাস সিংহলের রাজা ছিলেন ৫১৭-৫২৬ খ্রিঃ। কবি জয়াদিত্যের কাশিকাবৃত্তির সাথে পরিচিত ছিলেন। কাশিকাবৃত্তি সপ্তম শতাব্দীতে রচিত ছিল। আবার ৮ম শতাব্দীতে বামন জানকীহরণ কাব্যের সাথে পরিচিত ছিলেন। জল্হন রচিত সুক্তিমুক্তাবলীতে (১২৫৭ খ্রিঃ) রাজশেখর কৃত কুমার দাস বিষয়ক প্রশংসা শ্লোকটি দেখতে পাওয়া যায়। তবে কাব্যের আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে অর্থাৎ কটাহ দ্বীপের উল্লেখ ১।১৭, যবনরাজার পরাজয় ১।১৯ প্রভৃতি বিচার পূর্বক পণ্ডিতেরা পল্লবরাজ নরসিংহ বর্মার রাজত্বকালকে (৬৪০-৬৯ খ্রিঃ) কুমারদাসের সময় বলে চিহ্নিত করেছেন। নবম শতাব্দীতে কবি রাজশেখর বলেছেন যে-কুমারদাস জন্মান্ধ ছিলেন। অনেকের মতে কুমারদাসের কাল ৮ম শতকের শেষার্ধ- শতকের প্রথমার্ধ। কবি কুমারদাসের কাল সঠিকভ।বে নির্ণয় করা দুরূহ হলেও তাকে অষ্টম শতকের পরে কোন ভাবেই স্থাপন করা যুক্তিযুক্ত নয়। তিনি কালিদাসের দ্বারা গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তিনি কাব্যের খাতিরে কালিদাসকেই অনুসরণ করেছেন—তবে তিনি কখনই কালিদাসের সমসাময়িক ছিলেন না, অবশ্যই পরবর্তী যুগের কবি ছিলেন।

কুমারদাস বিরচিত ‘জানকীহরণ’ মহাকাব্যের সম্পূর্ণ রূপ পাওয়া যায় না। সিংহলে প্রাপ্ত টীকা থেকে অনুমিত হয় যে কাব্যে ২৫টি সর্গছিল। ‘জানকীহরণ’ নাম হলেও তৎপরবর্তী ঘটনা অর্থাৎ সীতা উদ্ধার, লক্ষ্মণ ও সীতা সহ অযোধ্যায় প্রতাবর্তন ও রামের রাজ্যাভিষেক অবধি অর্থাৎ ‘রামকথা’-র শেষ পর্যন্ত্য বর্ণিত ছিল।

বাল্মীকির মূল রামায়ণের সীতাহরণ কাহিনী অবলম্বনে জানকীহরণের সর্গগুলি বিন্যস্ত। কিন্তু বর্তমান মাত্র ১৫টি সর্গ পাওয়া যায়। বাকী অংশ বিলুপ্ত। বৈদভীরীতির কবি কুমারদাসের রচনা মাঘ, ভারবির ন্যায় গুরু গম্ভীর নয়, উপরন্তু ললিত পদ বিন্যাসে, কাব্যমাধুর্য্যে, সুকুমার বর্ণনাচাতুর্যে ও ছন্দ অংলকারের যথাযথ প্রয়োগে ‘জানকী হরণ’ মহাকাব্যের সরণীতে উজ্জ্বল তারকা। কুমারদাস নানা শাস্ত্রে সপণ্ডিত ছিলেন, পাণ্ডিত্যের ছটায় তাঁর রচনা উজ্জ্বল। সম্পূর্ণ কাব্য জুড়ে কালিদাসকে অনুসরণের চিত্র সুস্পষ্ট। বিশেষতঃ অযোধ্যাবর্ণনা, রাজার জলক্রীড়া, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, প্রভাত-সন্ধ্যার বর্ণনা, নবদম্পতীর প্রশংসা এই সমস্ত ক্ষেত্রে কালিদাসের রঘুবংশের অনুরূপ অনুপম ও অতিশয় হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা ফুটে উঠেছে। মাঘ, ভারবির ন্যায় কেবল শাস্ত্র ও পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের প্রতিই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল না। উপরন্তু বলা যায় তিনি কালিদাসের কাব্যরচনার অনায়াস স্বচ্ছন্দ্য ভাবটিকেই তাঁর কাব্যে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রসিদ্ধ সাহিত্য সমালোচক রাজশেখর কবি কুমারদাস ও তৎকর্তৃক রচিত ‘জানকীহরণকে’ লক্ষ্য করে বলেছিলেন—কালিদাসের রঘুবংশ বর্তমান থাকতে তাঁহার তুল্য জানকীহরণ কাব্য কে রচনা করিতে পারে? একমাত্র কুমারদাসই পারে।[১৮]

কবিরাজ

বক্রোক্তি মার্গের শ্রেষ্ঠ কবি কবিরাজ এহেন পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাব্যকলার যুগেই সংস্কৃত সাহিত্যাকাশে উদিত হয়েছিলেন। তাঁর আবির্ভাবকাল নিয়েও মতদ্বৈত আছে। অধ্যাপক Keith কবিকে দ্বাদশ শতাব্দীর কবি বলে ব্যাখ্যা করলেও একথা প্রমাণিত যে নবমশতাব্দীতে কবি রাজশেখর ‘রাঘব-পাণ্ডবীয়ে’র উল্লেখ করেছেন। কারুর মতে ৯ম শতাব্দীতে কবির আবির্ভাব। কিন্তু অধ্যাপক ম্যাকডোনালের মতে সম্ভবতঃ ৮ম শতাব্দীতে কবিরাজ বর্তমান ছিলেন।

কবিরাজ প্রণীত ‘রাঘবপাণ্ডবীয়’ নামক ত্রয়োদশ সর্গ সম্বলিত কাব্যে রামায়ণ ও মহাভারত যুগপৎ অনুসৃত হয়েছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই সংস্কৃত অতীব সমৃদ্ধ একটি উচ্চমার্গের ভাষা। সেখানে একই শব্দের নানারূপ অর্থ ফুটে ওঠে। বিশেষতঃ দীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদে ব্যবচ্ছেদের মধ্য দিয়ে, শ্লোক পাদের পদচ্ছেদ-কে কাজে লাগিয়ে দ্ব্যর্থ ভাব ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু কাব্যশিল্পের চরম বিকাশের যুগে এই সমস্ত শব্দকে নিয়ে কবিরাজ যে কী অসাধারণ ও অশ্রুতপূর্ব কাব্য রচনা করেছিলেন তা সত্যই বিস্ময়কর। একই শ্লোকের মধ্য দিয়ে একদিকে পাণ্ডবগণের ইতিবৃত্ত অপরপক্ষে রামচন্দ্রের বৃত্তান্ত যুগপৎ পরিস্ফুট করেছেন। বক্রোক্তিমার্গের কবি হিসাবে তিনি যথেষ্ট গর্ব অনুভব করতেন। সুবন্ধু, বাণভট্ট প্রভৃতির রচনায় বহু শ্লেষ লক্ষ্য করা যায়, তথাপি ঐ শ্লেষ দ্বারা যে রাঘবপাণ্ডবীয়ের মত কাব্য সৃষ্টি করা যায় তার প্রমাণ স্বয়ং কবিরাজ। তিনি সগর্বে বলেন—

সুবন্ধুবাণভট্টশ্চ কবিরাজ ইতি ত্রয়ঃ।
বক্রোক্তিমার্গনিপুণাশ্চতুর্থো বিদ্যতে ন বা। রাঘবপাণ্ডবীয় ১।৪১।।

পূর্বেই আলোচিত হয়েছে ভারবি, ভট্টি প্রভৃতিকে অনুসরণ করতে গিয়ে এ- যুগের কাব্য অনেকাংশে শাস্ত্রসম্মত ও পাণ্ডিত্য সর্বস্ব রচনা। তথাপি বলা যায় কবিরাজ যে পরিমাণ অধ্যাবসায় ও কবিত্ব শক্তির পরিচয় দিয়েছেন তাঁর রাঘব পাণ্ডবীয় কাব্যে, ঠিক সেই পরিমাণ কৃতিত্ব বা সম্মান লাভে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

ধনঞ্জয়

খ্রিষ্টীয় ৮ম শতাব্দীতে কবিরাজের পরবর্তীকালের কবি ছিলেন ধনঞ্জয, তিনি খুব সম্ভব কবিরাজকে অনুসরণ করেই রাঘবপাণ্ডবীয় (দ্বিসন্ধান)” নামক আর একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। ১১৪০খ্রিঃ গণরত্ন মহোদধিতে ঐ কাব্যের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। আলোচ্য কাব্যটিও রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে রচিত ১৮ সর্গে সমাপ্ত। বাসুদেব ও শ্রীদেবীর পুত্র ধনঞ্জয় দিগম্বর জৈন সমাজে বিশিষ্ট বিদ্বারূপে খ্যাত ছিলেন। অনেকার্থ-নামমালা নামক একটি কোষগ্রন্থও ধনঞ্জয়ের লেখা বলে পরিচিত। এই গ্রন্থটির জন্য তিনি ‘নৈঘণ্টক ধনঞ্জয়’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। যদিও এই কাব্যের বিষয়বস্তু রামায়ণ-মহাভারত থেকে গৃহীত তথাপি জৈন পণ্ডিত সমাজে এই কাব্যের যথেষ্ট সমাদর রয়েছে। পরিশেষে যে কথাটি না বললেই নয় তাহল এইরূপ কাব্য কাহিনী, ভাব, ভাষার গতির সাবলীলতা হারিয়ে কৃত্রিম শ্লেষ বন্ধের মধ্যেই যেন নিজেকে নিয়োজিত করে ফেলে। তাই অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কাব্য মহিমার বিচ্ছুরণ ঘটে না।

রত্নাকর

সর্বাপেক্ষা বিশালকায় কাব্য ‘হরবিজয়’, কবি রাজানক রত্নাকর বাগীশ্বরের রচনা। ৪৩২১টি শ্লোক সম্বলিত কাব্যটি ৫০ সর্গে বিভক্ত। আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি, যে মহাকাব্যের এই দ্বিতীয় পর্বে কাশ্মীর ছিল সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম পীঠস্থান। নবম শতাব্দীর মধ্যভাগে রত্নাকর বাগীশ্বর হলেন তার অন্যতম প্রমাণ। কাশ্মীররাজ জয়াপীড়ের রাজত্বকাল (৮২৬-৮৩৮ খ্রিঃ) এবং অবম্ভীবর্মার রাজত্বকাল (৮৫৫ খ্রিঃ—৮৮৩ খ্রিঃ) এই সময়ের মধ্যেই কবি বর্তমান ছিলেন। এই যুগটিকে কাশ্মীরের ইতিহাসে সংস্কৃত সাহিত্যের সুবর্ণযুগ বলা যায়। কবির পিতা অমৃত ভানু কাশ্মীরের চিপ্পট জয়াপীড়ের সভাকবিও ছিলেন। বাগীশ্বর উপাধিতে কবি ভূষিত হয়ে ছিলেন। এতদ্ব্যতীত উপমা প্রয়োগে তিনি ‘তালরত্নাকর’ উপাধি লাভ করেন।

মহেশ্বর কর্তৃক অন্ধক বধই এই কাব্যের মূল বিষয়। একদা পার্বতী লীলাচ্ছলে হস্ত দ্বারা শিবের ত্রিনয়ন আবৃত করলেন, কিন্তু মহেশ্বরের ত্রিনয়ন চন্দ্ৰ, সূর্য ও অগ্নি ছাড়া কিছুই নয়। ফলে ত্রিভূবন অন্ধকারে আবৃত হল এবং সেই অন্ধকার থেকে জন্ম হল ভয়ঙ্কর এক অসুরের যার নাম অন্ধক। কঠোর তপস্যার প্রভাবে দৃষ্টিশক্তি পেয়ে অন্ধক ক্রমশই দেবতা দিগের বিনাশ পূর্বক জগৎ এর সংহারে মেতে উঠল। সেই ধ্বংস থেকে দেবতাদের এবং পৃথিবীকে উদ্ধারের নিমিত্ত স্বয়ং মহেশ্বর অন্ধককে হত্যা করলেন। এবং জগৎকে রক্ষা করে শান্তি স্থাপন করলেন।

অতএব মূল বিষয়বস্তু অতি সংক্ষিপ্ত তথাপি এই সংক্ষিপ্ত কাহিনীকে কবি স্থানে স্থানে অকারণ দীর্ঘায়িত করে পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন করেছেন। কাব্যে বর্ণিত হয়েছে শিবের নগরী ও শিবের তাণ্ডবলীলা নৃত্য, প্রকৃতির বিভিন্ন ঋতুর বৈচিত্র্যপূর্ণ ছবি, রাজনীতি, সূর্যাস্ত, চন্দ্রোদয়, প্রভাত সৌন্দর্য্য, সমুদ্র— পর্বতের মনোরম বর্ণনা, কূটনৈতিক মন্ত্রনা, দূত প্রয়োগ ও অস্ত্রশাস্ত্রের বিদ্যা, স্বর্গের বর্ণনা, যুদ্ধের বর্ণনা, হর- পার্বতীর নানারূপস্তুতি ইত্যাদি।

কবির সাহিত্য ও শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য তাঁর ‘হরবিজয়’ কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি পূর্ববর্তী কবিগণকে অনুসরণ করেছেন তবে মাঘের সাথে যেন সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন। আচার্য ক্ষেমেন্দ্র তাঁর বসন্ততিলক ছন্দ প্রয়োগের প্রশংসা করেছেন। এইরূপ ললিত মধুর পদবিন্যাস, অলঙ্কারাবৃত প্রসাদগুণ বিশিষ্ট শ্লেষ যমকাদিতে ঘন সন্নিবিষ্ট যে রচনা তা স্বয়ং কবির মতে বৃহস্পতির চিত্তকেও শঙ্কিত করে তুলবে।

ললিত মধুরাঃ সালংকারাঃ প্রসাদমনোরমা
বিকট-যমক শ্লেষোদ্ধার প্রবন্ধ নিরগণাঃ।
অদৃশগতীশ্চিত্রে মার্গে মমোদগিরতো গিরো
ন খলু নৃপতেশ্চেতো বাচস্পতেরপিশঙ্কতে॥ হরবিজয় পৃঃ-৭০৭

পাণ্ডিত্যের দক্ষতায় তিনি নিঃসন্দেহে পূর্বসূরীদের অতিক্রম করে গেছেন। তথাপি বলতে দ্বিধা নেই অকারণ দীর্ঘবিস্তারী বর্ণনার প্রাচুর্য্য এবং অপ্রাসঙ্গিক উপকরণ তার রচনার স্বাভাবিকতাকে ব্যাহত করেছে। সহজ সরল হৃদয়-গ্রাহী শ্লোকের পাশাপাশি পদ্মবন্ধ, তৃণীরবন্ধ, চিত্রবন্ধ ইত্যাদির বহুল প্রয়োগ দুর্বোধ্য শব্দ চয়ন ও ছন্দ অলঙ্কারের অধিক চাতুর্য কাব্যকে আড়ষ্ট ও দূর্বোধ্য করে তুলেছে। যে কারণে স্থানে স্থানে অর্থ-ভাব-ও ভাষার বন্ধন তার সামঞ্জস্য হারিয়ে কাব্যকে সুখপাঠ্য করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।

কবির বক্রোক্তি পঞ্চালিকা ও ধ্বনি গাথা পঞ্জিকা নামে আরো দুইটি রচনা পাওয়া যায়। হরবিজয় কাব্যের বিষমপদ্যোতনী ও কৃতলঘুপঞ্জিকা নামে দুইটি টীকা যথাক্রমে রাজানক অলক (১১৫৮ খ্রিঃ) এবং রাজানক রত্নশ্রেষ্ঠ (১৬৮১ খ্রিঃ) কর্তৃক রচিত। যদিও টীকা দুইটি অসম্পূর্ণ।

শিবস্বামী

রত্নাকর বাগীশ্বরের সমসাময়িক সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন আরও এক কবি। যিনি হলেন শিবস্বামী। তিনি কাশ্মীর রাজ অবন্তী বর্মার (৮৫৮-৮৮৫ খ্রিঃ) সভাকবি ছিলেন। তাঁর ২০ সর্গ সমন্বিত ‘কফিনাভ্যুদয’ নামক মহাকাব্য ছাড়াও আরও সাতটি মহাকাব্য, কয়েকখানি নাটক, গদ্য ও শিবস্তুতি পাওয়া যায়। দুঃখের বিষয় অধিকাংশ রচনাই বর্তমানে লুপ্ত।

কাশ্মীরের ইতিহাসে শিবস্বামীর নাম সার্থক কবি হিসাবে স্বর্ণাক্ষরে লেখ রয়েছে। সে যুগের সংস্কৃত সাহিত্যের গৌরবময় অধ্যায়কে সমৃদ্ধ করতে শিবস্বামী ছিলেন অনন্য। উক্ত মহাকাব্যের পুষ্পিকায় কবির সংক্ষিপ্ত যা পরিচয় পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ—কবির পিতা ছিলেন অর্কস্বামী। কবি মনে প্রাণে শৈবধর্মাবলম্বী ছিলেন তথাপি অতীব চমৎকার ভঙ্গিতে বৌদ্ধধর্মের দ্বারা প্রবাবিত হয়ে বৌদ্ধ সাহিত্যের বিষয় অবলম্বনে এই কাব্যটি রচনা করলেন। তিনি তাঁর পূর্বসূরীদের অবশ্যই অনুসরণ করেছেন তথাপি যমকের নিখুঁত ও বহুল প্রয়োগ বশতঃ তিনি নিজেকে ‘যমককবি’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কাব্যের ভিতরে কবি নিজেই বলেছেন যে তাঁর কাব্য শ্রবণ করা মাত্র সুধী কাব্যরসিক মাত্রেরই চিত্ত চমৎকৃত হবে। ‘যদ্বানী শ্রুতি মাত্ৰকেণ সুধিয়াং চেতশ্চমৎকারিণী।’

কাব্যের বিষয়বস্তু নিম্নরূপ—ধম্মপদ, অবদান শতক প্রভৃতি থেকে বিষয় সংগ্রহ করে নিজস্ব প্রতিভায় সৃষ্ট কাব্যটি কবির অসামান্য প্রতিভার পরিচয় বহন করে। কাশ্মীররাজ ব্রহ্মদত্তই ছিলেন পূর্বজন্মের কফিন। বর্তমানে জন্মসূত্রে তিনি দাক্ষিণাত্যের অন্তর্গত লীলাবতী রাজ্যের রাজা। শ্রাবস্তীর রাজা প্রসেনজিৎ তৎকর্তৃক যুদ্ধে পরাজিত হলে অন্যান্য রাজন্যবর্গও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেন। এমতাবস্থায় রাজন্যবর্গ শঙ্কিতচিত্তে বুদ্ধের শরণাপন্ন হলে কফিণ ও বুদ্ধের ধর্মকথা ও তত্ত্বদর্শনাভিমুখে বিশেষ ভাবে অভিভূত হন। এর মধ্য দিয়ে কফিনের অন্তর বুদ্ধ প্রভাবে প্রভাবিত হলে তাঁর আন্তরিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। করুণাঘন হৃদয়ের তাড়নায় তিনিও যুদ্ধ বিগ্রহ সম্পূর্ণ পরিহার করে অনাসক্ত ধর্মাচরণে মনোনিবেশ করলেন। অতঃপর মৈত্রী, করুণা ও শান্তি অনুভব করে তা সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিতে থাকলেন।

প্রতি অঙ্কের শেষে শিব শব্দের ব্যবহার কাব্যটিকে ‘শিবাঙ্ক’ নামে পরিচিত করেছে। ভারবি, ভট্টি, মাঘ, রত্নাকরের প্রভাবে প্রভাবান্বিত কবির কাব্য স্বভাবতই কৃত্রিমতার অজস্র বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হলেও তাঁর নিজস্ব ভাবটি নিজ হৃদয়াবেগের দ্বারা অনুশাষিত হয়ে অসামান্য বুদ্ধি দীপ্ততায় ও স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। ভারবি, ভট্টির মতই শিবস্বামীর রচনা ব্যাখ্যাব্যতীত বোধগম্য হয় না। তাঁর রচনাও আয়াস করে বুঝতে হয়। তথাপি সহজ, সরল, স্বচ্ছন্দ ভাবে কবি হৃদয়ের অনুভূতির অভিব্যক্তি প্রকাশে শিবস্বামী অনবদ্য।

এতদ্ব্যতীত একাদশ শতাব্দীর কবি কাশ্মীরবাসী ক্ষেমেন্দ্র রচিত ভারতমঞ্জরী ও রামায়ণ মঞ্জুরী। একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে সন্ধ্যাকর নন্দী বিরচিত, ‘রামচরিত’ বিখ্যাত। এই রামচরিত গৌড়াধীপ রামপালের বৃত্তান্ত অবলম্বনে রচিত। এই কাব্যের মধ্য দিয়ে তাঁর অসাধারণ কবিত্ব শক্তি ফুটে উঠায় তাকে কলিকালের বাল্মীকিও বলা হয়ে থাকে। কাব্যটির ঐতিহাসিক মূল্যও যথেষ্ট। এই একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে বিস্হণ রচিত ‘বিক্রমাঙ্ক চরিত’ কাশ্মীর রাজ্যের সংস্কৃত সাহিত্য চর্চার অন্যতম নিদশন স্বরূপ বলা যায়। কাব্যে প্রদত্ত কবির আত্মপরিচয় অনুযায়ী তিনি কাশ্মীরের জয়বন নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। কৌশিক গোত্রীয় রাজকলশের ঔরসে, নাগদেবীর গর্ভে কবির জন্ম হয়। তিনি কাশ্মীর থেকে যাত্রা শুরু করে মথুরা কান্যকুব্জ, বারানসী ও প্রয়াগে ভ্রমণ করেন। শেষে বিক্রমাদিত্যের রাজধানী কল্যাণনগরে অবস্থান করেন। বিক্রমাদিত্য বা বিক্রমাঙ্কদেবের রাজত্বকাল (১০৭৬-১১২৬ খ্রিঃ)। বিদ্যাপতি উপাধিধারী বিলহণের যথেষ্ট আত্মগৌরব ছিল। ২১

কবি সম্বন্ধে কথিত রয়েছে তিনি গুজরাট রাজকন্যা শশিলেখার শিক্ষক নিযুক্ত হন এবং তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে গান্ধর্বমতে বিবাহ করলে রাজা তাকে প্রাণদণ্ডের নিমিত্ত বধ্যভূমিতে আনতে নির্দেশ দিলেন। বধ্য ভূমিতে এসে কবি একটি করে শ্লোক বলতে থাকলেন। রাজা বীরসিংহ সেই শুনে অতীব বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে কবির জীবন দান পূর্বক নিজ কন্যাকে অর্পণ করেন। যদিও এই জাতীয় কিংবদন্তীর কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নির্ণয় করা যায় না। বিক্রমাঙ্কচরিতে কল্যাণ নগর এর রাজা ত্রিভূবণ মল্লবিক্রমের চরিত্র কাহিনীই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ-হেন প্রতিভাধর কবি তাঁর কবিত্ব শক্তিকে ললিত পদবিন্যাসে বৈদভী রীতির অনুসরণে পরিস্ফুট করেছেন।

দ্বাদশ শতকের প্রথমভাগে শ্রীকণ্ঠ চরিত রচয়িতা মাংখদাসেব আবির্ভাব ঘটে। শিব কর্তৃক ত্রিপুরাসুরের বধই কাব্যের বিষয়। ২৫টি সর্গে বিরচিত ‘শ্রীকণ্ঠ চরিতে’ ১২টি সর্গে কৈলাস, কৈলাসপত্তি পুষ্পচয়ন, বসন্তবর্ণনা, সন্ধ্যা ও চন্দ্রোদয়ের বর্ণনা ইত্যাদি বিধৃত করেছেন। এবং বাদ বাকী অংশে শিবের সেনা ও যুদ্ধের বর্ণনা করেছেন। অন্তিমসর্গে কবির নিজ ভ্রাতা জয়সিংহের মন্ত্রী অলংকারের সভায় কিভাবে মন্ত্রণাসভার কার্য নিরূপিত হত তা অতি-সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণিত হয়েছে।

শ্রীহর্ষ

কবি পরিচয় :—সংস্কৃত সাহিত্যাকাশে দ্বাদশ শতকের কবি ও নৈয়ায়িক ‘শ্রীহর্ষ’ এক উজ্জ্বল তারকা। তাঁর রচিত নৈষধচরিত’ বা ‘নৈষধীয়চরিত’ নামক মহাকাব্য বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে। প্রায় তিন হাজার শ্লোক সম্বলিত ২২টি সর্গে রচিত এই মহাকাব্যের প্রতি সর্গের সমাপ্তি শ্লোকে কবি আত্মপরিচয় প্রদান করেছেন। সেইহেতু অনেকে মনে করেন যে এই শ্লোকগুলি পরবর্তী কালে প্রক্ষিপ্ত হওয়া অসম্ভব নয়। অনেকের মতে কবি আত্মপরিচয় প্রদানের বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তবে যাই হোক না কেন সেখান থেকে জানা যায় তিনি শ্রীহীর ও মামল্লদেবীর সন্তান। ভরদ্বাজ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ শ্রীহর্ষ কাব্যকার ছিলেন।২২ নাট্যকার শ্রীহর্ষ পৃথক্ ব্যক্তি ছিলেন। নাট্যকার শ্রীহর্ষ সপ্তম শতাব্দীর কবি ছিলেন। আলোচ্য শ্রীহর্ষের পিতা শ্রীহীর কান্যকুব্জরাজ বিজয়চন্দ্রের সভাপণ্ডিত ছিলেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী কবির পিতা শ্রীহীর নৈয়ায়িক উদয়নাচার্যের সাথে শাস্ত্রযুদ্ধে পরাজিত হলে যার পর নাই অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হন। অবশেষে মৃত্যুকালে পুত্রকে অনুরোধ করেন এই অপমানের উপযুক্ত জবাব দিয়ে পিতার হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে। শ্রীহর্ষ এক সন্ন্যাসীর দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে দৈবী অনুগ্রহে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। পুনরায় রাজা বিজয়চন্দ্রের সভায় উপস্থিত হলে তিনি তাঁকে সভাকবিরূপে নিযুক্ত করেন। কান্যকুব্জের জয়চন্দ্র কবিকে অত্যন্ত সমাদর পূর্বক তাম্বুল ও আসন প্রদান করেছিলেন। “তাম্বুলদ্বয়মাসনঞ্চ লভতে যঃ কান্যকুব্জেশ্বরাৎ।” অতঃপর রাজা বিজয়চন্দ্রের স্নেহচ্ছায়ায় প্রতিফলিত হয়ে তাঁর অনুরোধে একে একে নৈষধ চরিত, ন্যায়বেদান্ত দর্শনের গ্রন্থ স্বরূপ খণ্ডনখণ্ডখাদ্য নামক গ্রন্থ রচনা করে যশের মুকুট পরেন। ২৩ কবির নৈষধচরিতে খণ্ডনখন্ডখাদ্যের প্রসঙ্গ রয়েছে আবার খণ্ডনখণ্ডখাদ্যে নৈষধ চরিতের উল্লেখ দেখা যায়। অতএব কিংবদন্তী হলেও একে একেবারে অস্বীকার করাও যায় না। রাজশেখরের মতে কবি বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেই সময় তথায় রাজত্ব করতেন গোবিন্দচন্দ্রের পুত্র জয়চন্দ্র। এবং তারই নির্দেশে কবি নৈষধচরিত রচনায় প্রবৃত্ত হন। রাজা জয়চন্দ্র ১১৬৮ থেকে ১১৯৪ খ্রিঃ পর্যন্ত ছিলেন অতএব দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগই কবির কাল বলে চিহ্নিত হয়। কোন কোন পণ্ডিতের মতে শ্রীহর্ষ বাঙালী ছিলেন। তাঁর রচনার মধ্যে এমনই কিছু আচার আচরণ প্রথার নির্দেশ রয়েছে যা পরবর্তীকালের বাঙালী সমাজে অক্ষরে অক্ষরে অনুসৃত হয়। যথাক্রমে স্ত্রীগণের শাঁখা পরা, বিবাহের অনুষ্ঠানে মাছ-ভাত খাওয়ানো, উলুধ্বনি দেওয়া, বরের মাথায় টোপর, হাতে দর্পণ ধারণ, ইত্যাদি। কাব্যমধ্যে আত্মপরিচয় প্রসঙ্গে কবি তাঁর আরও কয়েকটি গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ঐ সমস্ত গ্রন্থ বর্তমানে পাওয়া যায় না।

নৈষধচরিত এর বিষয়বস্তু :—মহাভারতের নলোপাখ্যানকে কেন্দ্র করে দ্বাবিংশ সর্গে-দুই হাজার আটশত ত্রিশটি শ্লোকে শৃঙ্গার রসাত্মক ‘নৈষধীয়চরিত’ সংস্কৃত মহাকাব্যের এক অনন্য সম্পদ। মহাভারতের বন পর্বে যখন কপট পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পাণ্ডবগণ বনবাসী, সেই সময়ে মহর্ষি বৃহদ পাণ্ডবদিগের শোচনীয় পরাজয়ের প্রসঙ্গে নিষধরাজাধিপতি নলের কাহিনী ব্যক্ত করেছেন। তাই হলো নলোপাখ্যান। এই কাহিণী বিভিন্ন কথাসাহিত্য, নাটক, মহাকাব্য, চম্পু ও প্রাকৃত সাহিত্যেও নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আলোচ্য মহাকাব্যে কবি শ্রীহর্ষের উপস্থাপনায় ঘটনাটি নিম্নরূপ—বিদর্ভ রাজকুমারী হলেন দময়ন্তী, এবং নিষধরাজ নলের কাহিনী। বিদর্ভরাজ্য থেকে ফিরে এসে বন্দিচারণেরা দময়ন্তীর গুণাবলী বর্ণনা করলে নল তা শ্রবণ করে মুগ্ধ হলেন এবং দময়ন্তীর রূপে গুণে মুগ্ধ রাজা তার প্রণয় প্রার্থী হলেন। এই পর্বে নায়ক-নায়িকার পূর্বরাগ, প্রমোদ- বিহার কালে নলের সুবর্ণপক্ষ হংস ধারণ, ও হংসের মুক্তিলাভ ব্যাখ্যাত হয়েছে। নলের দূত দময়ন্তীর নিকট নলের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করলে বিদর্ভরাজ ভীম দময়ন্তীর স্বয়ংবর সভার আয়োজন করলেন। স্বয়ংবরের বর্ণনা এবং স্বয়ংবর সভায় আগমন কালে পথের বর্ণনা, করা হয়েছে। পথে দেবতাদের সাথে নলের সাক্ষাৎ হয়। দেবতাদের দূতরূপেই তিনি দময়ন্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এবং শ্রেষ্ঠ দেবতার গলায় দময়ন্তী তার বরমাল্য অর্পণ করে ধন্য হয়। নল-দময়ন্তীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই পর্বে নল-দময়ন্তীর শৃঙ্গার, প্রভাত ও সন্ধ্যার মনোরম বর্ণনা ও নল কর্তৃক দময়ন্তীর যার পর নাই প্রশংসা ব্যাখ্যাত হয়েছে।

অতঃপর নল তার নিজ ভ্রাতা পুস্করের নিকট দ্যুতক্রিড়ায় পরাজিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে বনে যেতে বাধ্য হয়। বনের মধ্যে একাকী নিদ্রামগ্ন পত্নীকে পরিহার করে নল বন ছেড়ে চলে গেলে উভয়ের জীবনে প্রচণ্ড দুঃখ দুর্দশা নেমে আসে। এ- হেন পরিস্থিতিতে অবশেষে তাদের পুনর্মিলন হয়। কিন্তু মহাভারতের নল এর অন্তিম জীবনের দুঃখকষ্টকে উপেক্ষা করে কবি তাঁর মহাকাব্যে তাঁদেরকে পুনরায় মিলিত করিয়েছেন এবং কাহিনীর মধ্য দিয়ে নলের ধর্মপরায়ণতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

মহাকবি ভারবি ও মাঘ অলঙ্কার শাস্ত্র মন্থন পূর্বক রচনাকে গুরুগম্ভীর ও দুরূহ দুর্ভেদ্য করে তুলেছিলেন। শ্রীহর্ষের নৈষধচরিত তদপেক্ষাও অধিক কৃত্রিম-পাণ্ডিত্যসর্বস্ব, অবান্তর বর্ণনা বাহুল্যে সাধারণের নিকট দুর্বোধ্য। কালিদাসোত্তর যুগের কবিগণের মধ্যে শ্রীহর্ষ যেন শেষ দূর্গস্বরূপ। ভারবি-মাঘ-ভট্টি প্রভৃতির যথার্থ উত্তরসূরী এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। শ্রীহর্ষের সমতুল্য পণ্ডিত, সকল শাস্ত্রে পারঙ্গম ও সাহিত্য প্রতিভাধর কবি সংস্কৃত সাহিত্যে বিরল।” তিনি জানতেন যে তাঁর রচনা সাধারণের অর্থাৎ অবিদ্বান ও অরসিক ব্যক্তির জ্ঞানের সীমায় ধরা দেয় না। তাঁর কাব্যরস একমাত্র বিদগ্ধ ও বিদ্বান ব্যক্তিদেরই উপভোগ্য। দণ্ডীর পদলালিত্যের সাথে শ্রীহর্ষের পদলালিত্য তুলনীয়। শ্রীহর্ষের স্তুতিকরে বলা হয়েছে—”নৈষধে পদলালিত্যং…।’ এবং ভারবি ও মাঘের সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে—উদিতে নৈষধে কাব্যে/ক্ক মাঘঃ—ক চ ভারবিঃ। প্রকৃতি প্রেমিক শ্রীহর্ষ একাধারে কবি ও দার্শনিক। তাঁর বর্ণনা পাঠে জড় প্রকৃতিও প্রাণ চঞ্চল হয়ে ওঠে পাঠকের সম্মুখে। তাঁর নিসর্গ প্রীতি, কল্পনার জাল বিস্তার ও ভাবের আতিশয্য” কাব্যকে নিঃসন্দেহে হৃদয় গ্রাহী করে তোলে। মহাভারতের একটি ক্ষুদ্র কাহিনীকে অবলম্বন করে প্রায় তিনহাজার শ্লোকে কাব্য লিখে কবি তাঁর অসাধারণ কবিত্ব শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। শ্রীহর্ষ আলঙ্কারিক প্রণিত মহাকাব্যের লক্ষণগুলি অনুসরণে যত্নবান ছিলেন।

মল্লিনাথ সহ অন্যান্য বহু টীকাকার যেমন নারায়ণ, বিদ্যাধর এর নৈষধীয় টীকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া জয়ন্তী টীকা ও প্রকাশ টীকাও বর্তমান। পরিশেষে উল্লেখ্য যে পণ্ডিতসমাজে শ্রীহর্ষের নৈষধচরিত মহাকাব্যের চরম খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা পরবর্তী কালের কবিদের বিশেষ অনুপ্রাণিত করেছিল। কত কবি যে নল-দময়ন্তী কাহিন।

অবলম্বনে কাব্যরচনা করেছেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। বহু কাব্য মধ্যে কাব্যপ্রকাশের টীকাকার মাণিক্যচন্দ্র রচিত ‘নলায়ন’, উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্র দেবের সভাকবি অগস্ত্যভট্ট বিরচিত ‘নলকীর্তি কৌমুদী’। কবি কৃষ্ণানন্দ রচিত ‘সহৃদয়ানন্দ’। দক্ষিণ ভারতীয় রাজা বেমভূপালের সভাকবি বামনভট্টবাণ প্রণীত——নলোদয়’ মহাকাব্য। তাঞ্জোরের রাজার জনৈক সভাসদ বিরচিত ‘নলাভ্যুদয়’। কৃষ্ণ দীক্ষিত রচিত ‘নৈষধ’- পারিজাত’, উল্লেখ্য।

শ্রীহর্ষের নৈষধচরিত রচনার পর থেকেই মহাকাব্যে তৃতীয় পর্বের সূচনা হয়। ভারবি-মাঘ-ভট্টি-শ্রীহর্ষের দ্বিতীয় পর্বের যে রচনাধারা অর্থাৎ পাণ্ডিত্য, বৈদগ্ধ্য ও শাস্ত্র জ্ঞানের ধ্রুপদী আড়ম্বড়তার কৃত্রিম রচনাধারাই যেন সর্বক্ষেত্রে প্রকট হয়ে উঠেছে মহাকাব্যের তৃতীয় পর্বে।

মহাকাব্যের তৃতীয় পর্বে আমরা যে কয়েকজন কবিকে পাই তন্মধ্যে ভর্তৃমেষ্ঠ রচিত ‘হয়গ্রীবধ’, নামক কাব্য। মহাদেব কর্তৃক হয়গ্রীব বধের কাহিনীই এই কাব্যের আলোচ্য বিষয়বস্তু। নায়ক মহাদেব, উপনায়ক হয়গ্রীব। জৈনকবি দেবপ্রভ সূবি কেবলমাত্র জৈনসাহিত্যই নয় রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ অবলম্বনে কাব্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সমগ্র মহাভারতের কাহিনীকে জৈনধর্মের আবর্তে গ্রহণ করে ‘পাণ্ডবচরিত’ রচনা করেছিলেন আঠারটি সর্গে। আনুমানিক ১৩শ শতকের এই কবির রচনা কাব্যের খাতিরে সাধারণ মানের হলেও যে ধর্মীয় আদর্শ প্রচারের ঐকান্তিক ইচ্ছা নিয়ে তিনি কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। সেদিক থেকে এই অভিনব প্রচেষ্টা ছিল সার্থক।

মধ্যযুগীয় কবি অভিনন্দের ‘রামচরিত’ অতি বৃহৎ এক ঐতিহ্য মণ্ডিত কাব্যকলার নিদর্শন। নবমশতকের মধ্যভাগে রচিত এই ‘রামচরিত’ এর খ্যাতি সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের কবি ও কাব্যকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।

অপর এক জৈনকবি অমর চন্দ্র সুবি রচিত ‘বালভারত’-মহাকাব্যটিও মহাভারতকে অনুসরণ করে রচিত। সংক্ষিপ্ত মহাভারত রচনার প্রয়াসেই তাঁর এই কাব্যকীর্তি। তিনি জৈনকবি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর রচনা কিন্তু ছিল সম্পূর্ণভাবে জৈনধর্মের প্রভাবমুক্ত উপরন্তু মহাভারতীয় ভাবধারার স্বচ্ছতা তিনি বজায় রেখেছেন সর্বতোভাবে। প্রতিসর্গের প্রারম্ভে বেদব্যাসের স্তুতি করতে তিনি বিস্মৃত হন নি।

অপর এক জৈন কবি স্তুপাল তিনিও মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে ‘নর- নারায়ণানন্দ” রচনা করেছেন। বস্তুপাল ছিলেন চালুক্যরাজ বীরবলের মন্ত্রী। বিশেষ বিদ্বান ও সর্ববিষয়ে আদর্শ ব্যক্তি। তিনি ছিলেন সকলের প্রশংসাধন্য।

ব্যাকরণ ও অলঙ্কার শাস্ত্রের আদর্শই যেন এই সমস্ত রচনার মূলে কাজ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে কালিদাসের সময় থেকেই রচনার স্বভাবিক গতি পথের পাশাপাশি এ হেন মণ্ডণকলার মৃদু পদচারনা লক্ষ্য করা যায়। ভারবি-মাঘ-শ্রীহর্ষে তা ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠে। মহাকবিদের রচনামধ্যে সার্থক অলঙ্কার প্রয়োগ যথার্থই কাব্য মাধুৰ্য্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে. একথা যেরূপ সত্য, তথাপি আগাগোড়া শ্লেষের দ্বারা কাব্যরচনার প্রচেষ্টায় নিতান্তই কাব্যের মর্যাদা হানি ঘটে। এই কারণেই এইরূপ কাব্য কোনও কালেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণে সমর্থ হয় নি।

পাদটীকা

১. India: what can it teach us ( ১৮৮২ ) p. p. ২৮১. ff.

২. ত্বয়াসহার্জিতং যচ্চ/যচ্চ সখ্যং পুরাতনম্।
চিরায়চেতসি পুরস্/তরুণীকৃতমদ্য মে।।

৩. ‘ছন্দোবৎ কবয়ঃ কুর্বন্তি’, ‘সা হি তস্য ধনক্রীতা প্রাণেভ্যোঽপি গরীয়সী’, ‘আ বনান্তাদ্ ওদকান্তাৎ প্রিয়ংপান্থমনুব্রজেৎ’ প্রভৃতি। জাম্ববতীবিজয়ে পাণিনি না উক্তম্…(ইত্যাষ্টদশ সর্গে)

৪. গ্রন্থশেষে অমৃতানন্দ কর্তৃক উক্ত—’বুদ্ধচরিতের লুপ্ত অংশ সর্বত্র অনুসন্ধান করেও উদ্ধার করতে পারি নি। তাই আমি অমৃতানন্দ ১৪-১৭শ সর্গ রচনা করলাম।

৫. ক. প্রচলিত আছে, তিনি বাল্যকালে নিতান্ত মূর্খ ছিলেন। গাছের ডালের আগায় বসে সেই ডালেরই গোড়া কাটতেন। কয়েক জন পণ্ডিতের ষড়যন্ত্রে তাঁর সাথে এক বিদূষী রাজকন্যার বিবাহ হলে, পত্নী তাঁর মূর্খতায় ক্রদ্ধ হয়ে যার পর নাই অপমান করেন। তখন সরস্বতীর আরাধনা করে তিনি সিদ্ধি লাভ করেন। অতঃপর দৈবী কৃপায় অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী কবি স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে বলেন—অস্তি কশ্চিদ বাগ্ বিশেষঃ’। এবং পত্নীর অনুরোধে ‘অস্তি, ‘কাশ্চিদ’, ‘বাক্’ এই পদগুলিকে কাব্যের প্রথম শ্লোকের প্রথম অক্ষর ধরে যথাক্রমে কুমার সম্ভব, মেঘদূত, ও রঘুবংশ নামে তিনখানি মহাকাব্য রচনা করেন।

খ. কথিত আছে সিংহলরাজ কবি কুমারদাসের একজন বারবণিতা ছিল। কালিদাস ছিলেন কুমারদাসের ঘনিষ্ট বন্ধু। একবার কালিদাস কুমার দাসের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করলেন। সেই গণিকার ঘরে একটি অসম্পূর্ণ শ্লোকের বাকিটুকু পূরণ করে দিলে, লোভী বারবণিতা কুমারদাসের নিকট পুরস্কার পাওয়ার লোভে কালিদাসকে খুনকরে শ্লোকটি নিজের লেখা বলে অর্থ প্রত্যাশা করলে কুমারদাস সেই গণিকার চতুরতা বুঝতে পারে এবং তাকে প্রাণদণ্ড দিয়ে কালিদাসের চিতায় আত্মাহুতি দেন। শ্লোকটি এইরূপ ছিল-

কমলে কমলোৎপত্তিঃ শ্রয়তে তু ন দৃশ্যতে।
বালে তব মুখাম্ভোজে দৃষ্ট মিন্দীবরদ্বয়ম্।।”

৬. বিক্রম সংবৎ এর সূচনাতে কেবলমাত্র সংবৎ পাওয়া যায়। ৫ম খ্রিঃ এটি মালব সংবৎ নামে প্রচলিত ছিল। নবম শতক থেকে বিক্রম সংবৎ নামে চলতে থাকে। ফার্গুনসনের মতে ৫৪৪ খ্রিঃ বিক্রম সংবৎ প্রবর্তিত হয় এবং ৬০২ বছর পূর্ব থেকে সেই সাল গণনা শুরু হয়।

৭. “Kalidasa then lived before A.D. ৪৭২, and Probably at a considerable distance, so that to place him about A.D. ৪০০ seems Completely Justified.”-keith. History of sanskrit literature.

৮. “একৈব মূৰ্ত্তিৰ্বিভেদে ত্রিধা সা সামান্যমেষাং প্রথমাবরত্বম্।
বিষ্ণোর স্তস্য হরিঃকদাচিৎ বেধাস্তুয়োস্তাবপি ধাতুরাস্তৌ”। (৭।৪৪।কুঃ)

৯. ১৭ সর্গে কাব্যের স্থানে স্থানে যতি পতন লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া কাব্যমধ্যে বলপূর্বক অর্থশূণ্য অব্যয় এই সর্গগুলিকে কবির নিজস্ব লেখা থেকে সহজেই পৃথক ভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে।

১০. কেহ কেহ মনে করেন—

”রঘুরপি কাব্যং তদপি চ পাঠ্যম্।
তস্যাপি চ টীকা সাপি চ পাঠ্যা”।।

১১. ….শ্রীমৎ কোঙ্গণ মহারাজাধিরাজস্য অবিনীতনান্নঃ পুত্রেণ কিরাতাজুনীয় পঞ্চদশসর্গ-টীকাকারেণ দূর্বিনীতনামধেয়েন।’ এই দানপত্রলেখ পৃথ্বীকোঙ্গণি নামক রাজার দ্বারা কৃত। লেখটি দক্ষিণ ভারতের মান্যপুর নগরে ৬৯৮ শকাব্দে স্থাপিত।

১২. নারিকেল ফলসম্মিতং বচো ভারবেঃ সপদি তদ্বিভজ্যতে
স্বাদয়ত্ত রসগর্ভ নির্ভরং সারমস্য রসিকা যথেসিতম্।।

১৩. আভোষমহনঃ ১।৩।২৮ “কথং তৰ্হি আজ ঘ্নে বিষম বিলোচনস্য বক্ষঃ ইতি ভারবিঃ আহধ্বাং মা রঘুত্তমম্ ইতি ভট্টিশ্চ। প্রমাদ এবায়ং ইতি ভাগবৃত্তিঃ। সিদ্ধান্ত কৌমদী—সপ্তম্যাঞ্চোপপীড়রুধকর্ষ : ৩।৪।৮৯। অত্রণমূল-বিধৌ উপসর্গ গ্রহনং পীড়েরেব বিশেষণমিতি ভাগবৃত্তৌ ভট্টিকারস্তু আতন্ত্রম্ মন্যতে যদাহ ধনুররিভিরস্যহ্যং মুষ্টিপীড়ং দধান ইতি” ধাতু বৃত্তিঃ।

১৪. শ্লোকটি নিম্নরূপ :—

সা রম্যা নগরী মহানস নৃপতিঃ সামস্তচক্রং চ তৎ
পার্শ্বে তস্য চ সা বিদগ্ধ পরিষত্তাশ্চন্দ্রবিম্বাননাঃ।।
উদ্বত্ত স চ রাজপুত্রনিবহস্তে বন্দিনস্তাঃ কথাঃ
সর্বং যস্য বলাদগাৎ স্মৃতিপথং কালায় তস্মৈ নমঃ।।

M. Suryanarayana sastri : Lives of sanskrit poets. P. ৮৫.

১৫. কাব্যান্যাপি যদীমানি ব্যাখ্যাগম্যানি শাস্ত্রবৎ
উৎসবঃ সুধিয়ামেব হস্ত দুধেসো হতাঃ।।
ভামহ ব্যাখ্যাগম্যমিদং কাব্যমুৎসবঃ সুধিয়ামলম্।
হতা দুর্মেধসশ্চাস্মিন্ বিদ্বৎপ্ৰিয়তয়াময়া।। ২২।৩৪ ভট্টি

১৬. কবির লেখা একটি পুঁথির Colophon-নিম্নরূপ :— শ্রীভিন্নমালববাস্তব্যদওকসুনোর্মহাবৈয়াকরণস্য মাঘত কৃতৌ।

১৭. তুল্য—একটি মাত্র বর্ণে,একটি চরণ।—
জজৌ জোজিজি জ্জাজী তং ততোঽতি ততাতিত্বৎ।
ভাভোঽভীভা ভিভূভাভূ রারারিররিরীরবঃ।। ১৯।৩

এক অক্ষরে সম্পূর্ণ শ্লোক :—

দাদদো দুদ্দদুদ্দামী দাদাদো দুদদীদদোঃ।
দুদ্দাদং দদতে দুদ্দে দদাদদদদোদদঃ ॥১৯।১১৪

১৮. জানকীহরণং কর্তুং/রঘুবংশে স্থিতে সতি।
কবিঃ কুমারদাসশ্চ/রাবণশ্চ যদি ক্ষমঃ।।

এই শ্লোকটির একটি গভীর ব্যঞ্জনা রয়েছে। কবি বলছেন রঘুবংশ বর্তমান থাকতে কে সীতাকে হরণ করতে পারে? রঘুবংশ মহাকাব্য বর্তমান থাকতে জানকীহরণ নামক মহাকাব্য কে হরণ করতে পারেন? রাবণ ও কুমারদাসই পারেন।

১৯. আগাগোড়া শ্লেষ অলঙ্কারে নিবন্ধ কাব্যগুলি দ্বিসন্ধান কাব্য নামে বিখ্যাত।

২০. অস্তাবলম্বির বিবিস্বতয়োদয়াদ্রি
চূড়োন্মিষৎ সকলচন্দ্রতয়া চ সায়ম্।
সন্ধ্যাপ্রনৃত্তহর হস্ত গৃহীত কাংস্য
তালদ্বয়েন সমলক্ষ্যত নাকলক্ষ্মীঃ।। হরবিজয় ৫।৪৭

২১. বিলহণ নিজ মহিমা প্রকাশে বলেন-

“সহস্রশঃ সন্তু বিশারদানাং বৈদর্ভলীলানিধয়ঃ প্ৰবন্ধাঃ।
তথাপি বৈচিত্র্য রহস্যলুব্ধাঃ শ্রদ্ধাং বিধাস্যন্তি সচেতসোছত্র।।”

২২. খণ্ডন খণ্ড খাদ্য গ্রন্থের টীকাকার চাণ্ডুপণ্ডিত লিখেছেন—

শ্রীহর্ষঃ স্বপিতুৰ্বিজেতুঃ উদয়নস্য কৃতীঃ খণ্ডনখণ্ড খাদ্য নামক গ্রন্থেণ অখণ্ডয়ৎ।

২৩. “শ্রীহর্ষং কবিরাজরাজিমুকুটালঙ্কার হীরঃ সুতং
শ্রীহীরঃ সুষুবে জিতেন্দ্রিয়চয়ং মামল্লদেবী চ যম্।”

২৪. সাহিত্যে সুকুমারবস্তুনি দৃঢ়ন্যায় গ্রহগ্রান্থিলে।
তর্কে বা ময়ি সংবিধাতরি সমং লীলায়তে ভারতী।

২৫. কাব্যের স্থানে স্থানে কবির ভাব পাঠকের চিত্তকে যেন বিমোহিত করে তথা হরণ করে—চাঁদের সারাংশ নিয়ে বিধাতা দময়ন্তীর মুখ নির্মাণ করেছেন বলে চাঁদের গায়ে গর্ত হয়েছে (২।২৫), ‘অঙ্গে দৃষ্টির নিমজ্জন’ (১০।৩৩)। ‘রূপে ডুব দেওয়া,’ (১১।২), চোখ দিয়ে আলিঙ্গন, (১৫।৮২)। বিরহী চকোর পাখীর চোখের জলের ফোঁটা হয়ে নক্ষত্র ঝড়ে পড়ে।’ ( ২২১২০) ‘চাঁদের কোলে’ হরিণ ঘুমায় (২২।২৮)’ এ হেন অসংখ্য কল্পনার জালে কাব্যকে মনোহারী করে তুলেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *