দ্বিতীয় অধ্যায় – পুরাণ সাহিত্য

দ্বিতীয় অধ্যায় – পুরাণ সাহিত্য

প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে পুরাণ অন্যতম সাহিত্য কীর্তি। পুর্বে পুরাণ- এর ন্যায্যমূল্য-দিতে আমরা নারাজ ছিলাম। পুরাণ গুলিকে নিছক রূপকথার গল্পের অধিক মর্যাদা দেওয়া হত না। একদা কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি Pargiter- ই সর্বপ্রথম আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর মতে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস জানতে হলে পুরাণ এর আলোচনা অপরিহার্য। গৌতমীয় ধর্মসূত্রে (১১।১৯) বলা হয়েছে যে-রাজকার্য পরিচালনা করতে গেলে বেদ-বেদাঙ্গ, স্মৃতির সাথে পুরাণের অনুশাসন মেনে চলা রাজার অবশ্য কর্তব্য। বৈদিক যুগের বহু কাহিনী, দার্শনিকতত্ত্ব, আখ্যান উপাখ্যান, পুরাবৃত্ত প্রভৃতি পুরাণের সাথে মিলে রয়েছে।১ বৈদিক সাহিত্য, ইতিহাস, রামায়ণ, মহাভারত, দর্শন, স্মৃতি, অর্থশাস্ত্র, কামশাস্ত্র প্রভৃতি প্রতিটি বিষয়ের উপাদানেই আমাদের পুরাণ সাহিত্য ঋদ্ধ। অধ্যাপক Goldstucker পুরাণ সম্বন্ধে অত্যন্ত হীন ধারণা পোষণ করেছেন। তাঁর মতে হিন্দুধর্মের যা কিছু অধঃপতন তাঁর মূলে রয়েছে পুরাণ সমূহ। এই মন্তব্য তাঁর অত্যন্ত অজ্ঞতার পরিচায়ক। পুরাণগুলির মুলে যে বেদ সমূহ বর্তমান একথা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। হিন্দু ধর্ম যে যুগে যুগে তার চলার পথে কত মত ও বিশ্বাসকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলেছে তার ইয়ত্তা নেই, বৈচিত্র্যময় সেই পথ, অন্যান্য ধর্মের মত যা দিয়ে শুরু করেছিল তা নিয়েই শেষ করেনি। A Living society must have both the power of continuity and power of change.২

পুরাণ কথার অর্থ হল প্রাচীন কথা। প্রাচীন পুরাণের সংজ্ঞা অনুযায়ী — “পুরা পরম্পরাং ব্যক্তিং পুরাণং তে বৈস্মৃতম্।” (পদ্মপুরাণ সৃষ্টি খণ্ড)। অর্থাৎ পুরাকাল থেকে যা লোক পরম্পরায় ব্যক্ত হয়ে আসছে তাই পুরাণ, পুরাণ হল পুরাকালের বিবরণ। ইতিহাস ও পুরাণ সেই অর্থে সমার্থকরূপে প্রতিভাত হয়। কিন্তু এই উভয় বিষয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।

ইতিহাস কথার আক্ষরিক অর্থ হল ইতি হ আস অর্থাৎ এইরূপই ছিল। ইতিহাস যদি হয় অতীতের ঘটনা তবে পুরাণ হল সুদূর অতীতের ঘটনা। পরবর্তীকালে পুরাণ হল এক পৃথক শ্রেণির ধর্মীয় সাহিত্যের সম্ভার এবং ইতিহাস হল পুরাণ সাহিত্যের প্রসিদ্ধ কাহিনীগুলির পরিশিলীতরূপ। ব্যাসদেব স্বয়ং মহাভারতকে সংহিতা, আখ্যান, উপাখ্যান, পুরাণ ও ইতিহাস বলে আখ্যা দিয়েছেন। হয়তো মহাভারতে সকল প্রকার রচনার সমন্বয় ঘটেছে। সম্ভবতঃ বীরপুরুষ গণের কার্যকলাপ অর্থাৎ যুদ্ধ বিগ্রহ, রাজ্যজয় ইত্যাদি যেখানে বলা হয় তাই হল ইতিহাস, অপরপক্ষে সৃষ্টি, আচার ব্যবহার, ধর্ম প্রভৃতি বিষয়ে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত আলোচনাই পুরাণ আখ্যা পেত। ইতিহাস ও পুরাণের আলোচনা প্রসঙ্গে Monier williams এর-উক্তিটি এইরূপ “…The two classes of works are very different. The Itihasas are the legendary histories of heroic men before they were actually deified. Where as the puranas are properly the history of the same heroes Converted into positive gods and made to occupy the highest position in the Hindu panthon.”

আখ্যানৈশ্চাপ্যুপাখ্যানৈর্গাথাভিজিসত্তমা।
পুরাণসংহিতাশ্চক্রে পুরাণার্থবিশারদঃ।।

বায়ু পুরাণে বলা হয়েছে—আখ্যান উপাখ্যান ও গাথা দ্বারা পুরাণ বিশারদ মহর্ষি ব্যাস পুরাণ রচনা করেছিলেন। যদি সেইরূপই হয় তবে ইতিহাস কখনই পুরাণের উপাদান নয়। কারণ ইতিহাস হলো অতীত দিনের ঘটনা, যে-রূপ ঘটেছিল তাই। আখ্যান, উপাখ্যান, গাথা ইতিহাসের বাহক হিসাবে চিহ্নিত হওয়া অসম্ভব কিছুই নয়, সেদিক থেকে বিচার করলে ইতিহাস ও পুরাণের মধ্যে কোন সুনির্দিষ্ট ভেদ করা কঠিন

পুরাণ রচয়িতা :— বেদ-বিভাগ কর্তা ও মহাভারত রচয়িতা স্বয়ং মহাকবি মহর্ষি বেদব্যাসই পুরাণ সমূহের রচয়িতা। এইরূপ মত প্রচলিত আছে। হিন্দুগণের বিশ্বাস বেদ-সমূহের সাথে সাথেই ব্রহ্মা কর্তৃক পুরাণ সমূহও প্রকাশিত। এই ধারণা অনুযায়ী স্বয়ং নারায়ণই ব্যাসরূপে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন। মৎস পুরাণ অনুযায়ী প্রথমে বিপুলায়তন একখানি পুরাণ ছিল। পরবর্তীকালে মানুষ তা গ্রহণে অসমর্থ হলে ভগবান ব্যাস যুগানুযায়ী সংক্ষিপ্তাকারে আঠারোটি পুরাণরূপে পৃথিবীতে প্রচার করেন। তাঁর শিষ্য লোমহর্ষণ গুরু মুখ নিঃসৃত পুরাণগুলি শ্রবণ করে অন্যসকলের নিকট বর্ণনা করেন। পুরাণ বেদের মত অপৌরুষেয় না হলেও বেদের পরিপুরক। সেই হেতু কোন কোন পুরাণে উক্ত আছে যে পুরাণ পাঠে শূদ্র, নারী নির্বিশেষে সকলেরই অবাধ অধিকার স্বীকৃত যা বেদপাঠে দৃষ্ট হয় না। চরক সংহিতার (৪।৪। ৪৪) শ্লোক অনুসারে গন্ধর্ব শ্রেণির লোক আখ্যায়িকা, ইতিহাস ও পুরাণে অভিজ্ঞ। পুরাণের বক্তা ‘সূত’ বেদ পাঠে অনধিকারী হলেও ইতিহাস ও পুরাণে ছিলেন দক্ষ। লোমহর্ষণ ছাড়া পরাসর ও লোমহর্ষণের পুত্র উগ্রশ্রবার নাম করা যেতে পারে। আধুনিক গবেষকেরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে পুরাণসমূহ আদপেও বেদব্যাসের রচনা কিনা এবং এইরূপ চারলক্ষ শ্লোকাত্মক আঠারটি মহাপুরাণ ও আঠেরটি উপপুরাণের প্রবক্তা একই ব্যক্তি কিনা? অতএব পরে পরে বিভিন্ন সময়ে নানান পুরাণজ্ঞ কবি পণ্ডিতগণের প্রক্ষেপের ফলেই যে পুরাণ সমূহ বর্তমান আকার প্রাপ্ত হয়েছে এই বিষয়ে সকলেই একমত। পুরাণ যতদিন সূতজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ততদিন পুরাণ সমূহে কোনরূপ ধর্মীয় অনুষ্ঠান যাগযজ্ঞের কথা, শ্রাদ্ধকল্প, বর্ণাশ্রম প্রথা ইত্যাদি স্থান পায় নি। কিন্তু পরবর্তীকালে অল্পশিক্ষিপ্ত ব্রাহ্মণ পুরোহিতের হাতে পরে এইসমস্ত বিষয়গুলি পুরাণে স্থান পায়। যার লক্ষণ, রচনা শৈলী ও ভাষাও খুবই দুর্বল। এইরূপ রচনা অবশ্যই পরবর্তী কালের প্রক্ষেপ।

পুরাণের রচনাকাল :—পুরাণ সমূহের রচনাকাল নির্ণয় করার প্রয়াস বহু গবেষকই করেছেন। নানাতথ্যের ভিত্তিতে তারা রামায়ণ মহাভারতের মতই পুরাণের উৎপত্তিকাল নির্ণয়ে সচেষ্ট। কিন্তু স্বয়ং ব্রহ্মা পুরাণ সমুহের রচয়িতা এইরূপ দৈবী উৎপত্তির কথা মেনে নিলে তার রচনা কালের কোন প্রশ্নই উঠত না।

আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি যে গৌতম ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে পুরাণের বিধি অনুযায়ী রা ঙ্গা রাজকার্য পরিচালনা করতেন ও আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে পুরাণের কয়েকটি শ্লোকের উদ্ধৃতিই প্রমাণ করে যে, ‘পুরাণ’ নামে কোন এক বিশেষ সাহিত্য সে যুগের পূর্বেও প্রচলিত ছিল। উল্লিখিত ধর্মসূত্র দুইটি খ্রিঃ পূঃ পঞ্চম বা চতুর্থ শতকের হলে তারও পূর্বে ‘পুরাণ’ বর্তমান ছিল। রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকির একাধিক পুরাণের সম্যকজ্ঞান ছিল। অতএব রামায়ণ রচনার পূর্বে পুরাণ সমূহ বর্তমান ছিল। মহাভারতের সাথেও পুরাণের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। মহাভারতকে পুরাণ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মহাভারতের রচনাশৈলীতে পুরাণের আভাস পাওয়া যায়, এছাড়াও স্থানে স্থানে ঘটনা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে ‘পুরাণে এইরূপ উক্ত হইয়াছে’ এইরূপ বলা হয়েছে। বাপুরাণের সাথে হরিবংশের স্থানে স্থানে হুবহু মিল লক্ষ্য করা যায়। মহাভারতে আঠারোটি পুরাণের নাম উল্লিখিত। পদ্মপুরাণ এর বিষয় অবলম্বনে মহাভারতের ঋষ্যশৃঙ্গ উপ্যাখ্যান রচিত। এই সমস্ত বিচার করে Winternitz মন্তব্য করেছেন মহাভারত সম্পূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করার বহু পূর্বেই পুরাণ সাহিত্য রচিত হয়েছিল। মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাল যদি নিরূপণ করা যেত তাহলে বহু পুরাতন ঘটনার কাল নির্ণয় সহজসাধ্য হত। দ্বিতীয় পুলকেশীর Aiholic inscription (সপ্তম খ্রিষ্টাব্দে) থেকে জানা যায় যে খ্রিঃ পূঃ ৩১০২ অব্দে জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট ঐ সময়কেই কলিযুগ বলে চিহ্নিত করেছেন। মতান্তরে খ্রিঃ পুঃ ২৪৪৯ হল মহাভারত যুদ্ধের কাল, এবং Pargiter এর মতে খ্রিঃ পূঃ ৯৫০ শতকই মহাভারত যুদ্ধের কাল। পণ্ডিতগণ এই সমস্ত বিচার বিবেচনা করে ১৪০০ শতককেই মহাভারত যুদ্ধের কাল বলে অনুমান করেন। প্রাচীন পুরাণ গুলি সপ্তম শতকের পূর্বে রচিত হয়েছিল। সেইকারণে সপ্তম শতকের পূর্বের রাজরাজাদের নাম বিভিন্ন পুরাণগুলিতে উল্লিখিত। শিশুনাগ, নন্দ, মৌর্য, শৃঙ্গ, অন্ধ্র, গুপ্ত, প্রভৃতি রাজবংশের এবং বিম্বিসার, অজাতশত্রু চন্দ্রগুপ্ত প্রভৃতি বিখ্যাত রাজার নাম পাওয়া যায় না। অতএব প্রাচীন পুরাণগুলি সপ্তম শতকের পূর্বে রচিত একথা সহজেই অনুমেয়। (খ্রিঃ ৬২৫)— এ বাণভট্ট, (খ্রিঃ ৭৫০) কুমারিলভট্ট, খ্রিঃ নবম শতকের শঙ্করাচার্য এমনকি (খ্রিঃ ১০৩০)–এর অল্‌বেরুণিও অষ্টাদশ পুরাণের কথা জানতেন অতএব পুরাণ সমূহকে আরও পরবর্তী মনে করার কোন কারণ নেই। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মনুর মনুসংহিতা পাঠে পুরাণের কথা পাওয়া যায় অতএব কৌটিল্য মনু প্রভৃতি শাস্ত্রকারগণের পূর্বেই পুরাণ সাহিত্যের অস্তিত্ব বর্তমান এ কথা নিশ্চয় করে বলা যায়।

পুরাণ সাহিত্যের লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য :—

সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ-বংশেশো মন্বন্তরাণি চ।
বংশানুচরিতং চৈব পুরাণং পঞ্চলক্ষণম্। (বায়ু ৪.১০.১১ )

পুরাণের বৈশিষ্ট্য বললেই তার এই পাঁচটি লক্ষণকেই আগে বুঝতে হয়। (ক) সর্গ (সৃষ্টি), (খ) প্রতিসর্গ (প্রলয়কালে পূর্বসৃষ্টির ধ্বংস হলে নতুন সৃষ্টির বিকাশ, (গ) বংশ (দেবতা ও ঋষিদিগের বংশ বর্ণনা), (ঘ) মন্বন্তর (মনুগণের শাসনকাল), (ঙ) বংশানুচরিত (নৃপতিগণের বংশের ইতিহাস)। Pargiter এর মতে এই পাঁচটি লক্ষণই প্রাচীন পুরাণগুলির বৈশিষ্ট্য, অমরকোষ ও অন্যান্য কোষগ্রন্থেও এই পঞ্চলক্ষণ সমন্বিত সজ্ঞাটি দৃষ্ট হয়। যথাযথ ভাবে বিচার করলে মহাপুরাণ ও উপপুরাণের মধ্যে তেমন প্রকৃতিগত কোন ভেদ নেই। পঞ্চলক্ষণ সমন্বিত পুরাণরচনার পরে ধীরে ধীরে কালের নিয়মে কিছু কিছু অনিবার্য প্রক্ষেপের ফলে জ্যোতিষ, শ্রাদ্ধতত্ত্ব, পাশুপালন, কৃষি, বাণিজ্য, বার্তা, ব্যাকরণ, ছন্দ, অলঙ্কার এমনকি বাস্তুবিদ্যা, অস্ত্রবিদ্যা, শারীরবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ের সংযোজন দেখা যায়। সকল পুরাণে এই পঞ্চলক্ষণ সংরক্ষিত হয়নি। কোন কোন পুরাণে যেমন ভাগবৎ পুরাণে দশ লক্ষণের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী এই পাঁচটি লক্ষণ কেবল উপপুরাণের জন্য প্রযোজ্য। মহাপুরাণগুলির লক্ষণ দশটি। মৎসপুরাণের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে এই পাঁচটি লক্ষণ ছাড়া ভূবনবিস্তার, দান ধর্ম বিধি, শ্ৰাদ্ধ কল্প, বর্ণাশ্রম বিভাগ, ইষ্টাপূর্ত, দেবপ্রতিষ্ঠা এই অতিরিক্ত ছয়টি লক্ষণও—পুরাণ সমূহের বৈশিষ্ট্য। পুরাণ গুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তাঁর দেব প্রাধান্য। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহশ্বের এই তিন দেবতাই প্রধান ছিলেন পৌরাণিকযুগে। পুরাণসমূহ সত্ত, রজো ও তমো গুণে বিভক্ত। এছাড়াও আর এক বিভাগ ছিল সংকীর্ণ। (১) ব্রহ্মার প্রাধান্য স্বীকার করে রাজস পুরাণগুলি হল :—ব্রহ্ম, ব্রহ্মাণ্ড, ব্রহ্ম বৈবর্ত, মার্কণ্ডেয়, ভবিষ্য ও বামন। (২) বিষ্ণুর প্রাধান্য স্বীকার করে সাত্ত্বিক পুরাণ গুলি হল—ভাগবৎ, নারদীয়, গরুড়, পদ্ম, বরাহ, বিষ্ণু। (৩) শিবের প্রাধান্য স্বীকার করে তামস পুরাণ গুলি হলো— শিব, লিঙ্গ, স্কন্দ, অগ্নি, মৎস্য, কূর্ম। যে সমস্ত পুরাণ গুলিতে সরস্বতী ও পিতৃগণের মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে তাদের সংকীর্ণ পুরাণ বলে। পুরাণের পঞ্চলক্ষণ যে সকলক্ষেত্রে মেনে চলা হয়েছে এমন নয়।

পুরাণের পাঁচটি প্রধান লক্ষণের আলোচনা :—

(১) সর্গঃ—সর্গের অর্থ সৃষ্টি। এই পৌরাণিক সৃষ্টি নয় প্রকার। যথা—মহৎসর্গ, ভূতসর্গ, ঐন্দ্রয়িকসর্গ, স্থাবর, তির্যক, উর্দ্ধস্রোতা, অর্বাকস্রোতা, অনুগ্রহ ও কৌমার সর্গ। প্রথম তিন সর্গের থেকে ব্রহ্ম ও ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি। অন্যান্য ছয়টি সর্গ ব্রহ্মার সৃষ্টি প্রক্রিয়া বিষয়ক। বিষ্ণু, ভাগবত ও মৎস প্রভৃতি পুরাণে সৃষ্টিতত্ত্ব বিশেষ ভাবে আলোচিত হয়েছে।

(২) প্রতিসর্গ :—সৃষ্টির পরে পুনরায় সৃষ্টিই প্রতিসর্গ। ব্রহ্মার সৃষ্টির পরে ঋষি, দক্ষ প্রজাপতি ও মনু প্রভৃতির যে সৃষ্টি তাই হল প্রতিসর্গ,–কোন কোন পুরাণে এই অভিমত পোষণ করা হয়েছে। প্রতিসর্গের অপর নাম বিসর্গ।

(৩) বংশ :—দেববংশ, ধর্মবংশ, ঋষিবংশের কুলপঞ্জী রক্ষা করাই হল বংশ বর্ণনা। কেবলমাত্র সুদূর অতীতেই নয় অদুর ভবিষ্যতের বংশবর্ণনাও করা হত। পরবর্তীকালের ঐতিহাসিক গণ এই বংশ বর্ণনা থেকেই অতীত দিনের ইতিহাসের বহু তথ্য সংগ্রহ করতেন।

(৪) মন্বন্তর :—প্রতি মনুর কালকে মন্বন্তর বলা হয়। চতুর্দশ মনু বর্তমান অতএব মন্বন্তরও চতুর্দশ এইরূপ বুঝতে হবে। এক এক মনুর সময় ধরা হয় – ৩০৬৭২০০০ বৎসর।

(৫) বংশানুচরিত :—শ্রীমদ্ভাগবদ পুরাণে বলা হয়েছে— “বংশানুচরিতং তেষাং বৃত্তং বংধরাশ্চ যে।” পূর্বে যে সমস্ত বংশাবলীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়াই বংশানুচরিতের বিষয়।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের ঘটনাবলীই প্রাচীন পুরাণে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে সূতগণেরই কর্তব্য ছিল রাজা মহারাজাদের বংশধারা, চরিত বর্ণনা লিখে রাখা ও মুখে মুখে প্রচার করা। প্রাচীন সত্য ঘটনাবলীর প্রচার করাই এ-হেন বিদ্বান, সৎ, বুদ্ধিমান সূতগণের কর্তব্য ছিল।

পুরাণে আলোচিত ঘটনাবলীকে প্রধানতঃ দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। মনু থেকে শুরু করে মহাভারতের যুদ্ধ পর্যন্ত প্রাচীনকাল। পরীক্ষিত থেকে শুরু করে গুপ্তবংশের রাজত্বকাল পর্যন্ত অর্বাচীনকাল। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, ও কলি নামক প্রধান চার যুগ ছাড়াও আরও অন্যান্য অপ্রধান বিভাগও আলোচিত হয়েছে।

হিন্দুধর্মের প্রধান দুই ধারা স্মৃতিসম্মত বৈদিক-সাহিত্য এবং শ্রুতি সম্মত পুরাণ সাহিত্য, এবং-বেদ ও পুরাণের অনুসারী ব্রাহ্ম, বৈষ্ণব, ভাগবত, শৈব, পাশুপত, গাণপত্য ও শাক্ত ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সামাজিক ও ঐতিহাসিক তথ্যের এমন সম্ভার অন্যত্র মেলা ভার। বৈদিক ধর্মাচরণে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও পুরাণ ধর্ম সম্প্রদায় ভেদাভেদ ভুলে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে তার রসাস্বাদনে অধিকার দিয়েছে। যে কারণে বেদের সংকীর্ণ গণ্ডীর বাইরে বেড়িয়ে আসা ক্ষাত্র প্রধান পুরাণ সাহিত্য সর্ব সাধারণের কাছে অনায়াসেই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। পৌরাণিক ধর্মমতানুযায়ী-সত্য ও অহিংসাই হল মানবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্ম। শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক চেতনায় সত্যকে সীমাবদ্ধ না রেখে কায়িক, বাচিক, ও মানসিক অনুশীলন করা কর্তব্য। পুরাণকারগণ আরো বলেছেন ক্ষমা ও শান্তি দ্বারা মনের মালিন্য দূর হবে। ত্যাগ ও বৈরাগ্য মনের শুচিতা বিধান করবে। পাপ ও মিথ্যা খুব স্বাভাবিক নিয়মেই অতি-নিন্দনীয় বলে ব্যাখ্যাত হয়েছে। কাম, ক্রোধ ইত্যাদি ষড়রিপুকে দমন করতে পারলে তবেই জীবনের সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব হবে। পুরাণ সমূহ ধর্ম ভাবনার সাথে সাথে সামাজিক জীবনে শান্তি ও মঙ্গল বিধানের কথাও নানাভাবে প্রচার করেছে। মৎস্য, অগ্নি, গরুড়, ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণকে ভারতীয় সাহিত্যের বিশ্বকোষ বললেও অত্যুক্তি হয় না। সেখানে শুধু ত্ৰ ধৰ্মীয় বিষয়ই নয় রাজন্যবর্গের বংশতালিকা ও জীবনবৃত্তান্ত থেকে শুরু করে ভূ-প্রকৃতি, সেখানকার মানুষের জীবন প্রণালি, সাহিত্য, রাজনীতি ইত্যাদির আলোচনাও স্থান করে নিয়েছে। শঙ্কর, রামানুজ, মধ্ব, শ্রীহর্ষ, বল্লভ প্রভৃতি দার্শনিক তথা ধর্ম প্রচারকদের পৌরাণিক চিন্তার প্রতিফলন প্রতিটি সাধারণ মানুষের চিন্তা ভাবনাও কর্মসাধনাতে ব্যপ্ত হয়ে রয়েছে। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে পুরাণ সমূহের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়।

পরবর্তীকালের ভারতীয় সমাজ, সভ্যতা ও সাহিত্যে পুরাণের প্রভাব :—সভ্যতা ও সংস্কৃতি এমনই এক বহমান ধারা যা কোন কালেই একস্থানে স্থির হয়ে থাকে নি। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি সেই সুদূর অতীতের ধারাবাহিকতাকে সঙ্গে নিয়ে আজও স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। ভারতবর্ষ ধর্মপ্রধান দেশ। বেদের যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান সভ্যতা ও সংস্কৃতি কিন্তু ধর্মকে আঁকড়ে ধরেই এগিয়ে চলেছে। এবং এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূলে ছিল ভারতীয় সাহিত্য। ভারতীয় সাহিত্য চিরকাল নানা কালের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে এসেছে। পুরাণ সাহিত্য এমনই এক সাহিত্য যা নাকি ভারতীয় জনজীবনের বহুমুখী প্রতিভাকে অবলম্বন করে নানা আখ্যান উপাখ্যানের রূপে উপস্থাপিত। পুরাণকারগণ বীর ও মহান ব্যক্তিদের চরিত্র চিত্রণে সিদ্ধহস্ত। সেই সমস্ত কাহিনী যাত্রা ও কথকতার ভঙ্গিতে সভায় প্রচার করা হত। এইভাবে ভারতীয় সামাজিক জনজীবনকে শুধুমাত্র প্রভাবিতই করে নি, উপরন্তু লোকশিক্ষার গুরুদায়িত্বও অনেকাংশে পুরাণের উপরে ন্যাস্ত ছিল। যাঁরা এই পুরাণের কাহিনী জনসমক্ষে প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁরা জনগণের মনোরঞ্জনের নিমিত্ত স্থানে-স্থানে আপন কল্পনার রসে জারিয়ে কাহিনীকে নবরূপদান করতেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

বৈদিক ক্রিয়াকলাপ গুলি ধর্মকে আশ্রয় করে গড়ে উঠলেও সাধারণ জনসাধারণের ধর্মাচারণের নিমিত্ত ছিল না। বৈদিক যাগযজ্ঞ সমূহ অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ হেতু তা সর্বসাধারণের সাধ্যাতীত ছিল। পুরাণ সাহিত্য সেই অভাবকে পূরণ করেছিল। পুরাণে বর্ণিত সাধারণ মূর্তিপূজা-অৰ্চনা, দান–ধ্যান শ্রাদ্ধাদি পুণ্যকর্ম এমন কি ব্ৰত ইত্যাদি পালন সবই ছিল সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে। এমনকি দেবমন্দির নির্মাণ, কূপ খনন, বৃক্ষরোপণ, সেবাসদন প্রতিষ্ঠা এই সমস্ত মহৎ কাজ পুরাণে পুণ্যকর্ম রূপে বিশেষ প্রশংসিত।

এককথায় বৈদিক ধর্ম বা বৈদিক সাহিত্যের রসাস্বাদনে সকল শ্রেণির লোকের অবগাহনের অধিকার ছিল না। তাই বলে পৌরাণিক ব্রাহ্মণেরা কখনই বৈদিক ধর্মাচারণকে অবজ্ঞা তো করেননি অধিকন্তু সেইসব ক্রিয়াকলাপই যুগোপাযোগী করে তাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলার মত গুরু দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়েছিল।

কেবলমাত্র ধর্মীয় চিন্তাভাবনাই নয়, একটা জাতির জীবনে আছে নানা দিক। জাতির উত্থান পতনে অপরিহার্য সেই সব বিষয়গুলি যেমন—প্রকাতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক পরিকাঠামো, যুদ্ধ-বিগ্রহ, পারস্পরিক ঘাত-সংঘাত। বৈদিক ধর্মাচারণ কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ্যধারার ইতিহাসের পরিচায়ক। কিন্তু পৌরাণিক ধর্মাচারণ ক্ষাত্র ধারার ও জনসাধারণের ধারার পরিচায়ক। স্থানে স্থানে বেদের ব্যাখ্যাকার হিসাবেও পুরাণ কারগণ কাজ করেছেন। ভারতীয় হিন্দুধর্মের ইতিহাস জানতে গেলে পুরাণসাহিত্যই একমাত্র উপায় কারণ বৈদিক ধর্ম মূলতঃ ব্রাহ্মণ্যধর্ম। সেখানে সার্বজনীনতা শূন্য এই বৈদিক ধর্মের হিন্দুধর্ম হওয়ার সামর্থ্য কোথায়? ব্রাহ্মণ্যধর্ম- ব্যতিরেকে আমজনতার ইতিহাসকে সংরক্ষিত করার কাজে পুরাণ সাহিত্য সম্ভার এক পূর্ণাঙ্গ দলিল। অতএব এইদিক থেকে বিচার করতে গেলে ভারতীয় জনজীবনে পুরাণের অবাদন অনস্বীকার্য।

পরবর্তীকালের সংস্কৃত ও নানান প্রাদেশিক সাহিত্যে পুরাণের অপরিসীম প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পুরাণে বর্ণিত পুরাকাহিনীই আধুনিক কবিগণের প্রতিভার ছোঁয়ায় তা নব নব রূপে নানান কাব্য, নাটক, আখ্যান, আখ্যায়িকার রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই প্রসঙ্গে মহাকবি ভবভূতি রচিত সংস্কৃত নাটক উত্তররামচরিত পদ্ম পুরাণের পাতালখণ্ড, অবলম্বনে। মহাকবি কালিদাস বিরচিত মহাকাব্য ‘রঘুবংশম্’ এবং নাটক ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ পুরাণের অংশ বিশেষ অবলম্বনেই রচিত। ‘কুমার সম্ভব’ কাব্যের মূলে রয়েছে শিবাপুরাণের কাহিনী। মহাকবি ভাস-লিখিত বালচরিত-নাটক অনন্তদেবের ‘কৃষ্ণভক্তি চন্দ্রিকা’ সর্বোপরি মহাকবি জয়দেব বিরচিত ‘গীতগোবিন্দ’ অমর হয়ে আছে আমাদের পৌরাণিক কাহিনী দ্বারা প্রভাবিত সংস্কৃত সাহিত্যে।

বাংলাসাহিত্যে কৃষ্ণদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল’, বড়চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন। এছাড়া চণ্ডীমঙ্গল, দূর্গামঙ্গল, সূর্যমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল এই সকলই পৌরাণিক ভাবধারায় পুষ্ট সাহিত্য কীর্তি। বাংলার পদাবলী সাহিত্যে অধিকাংশ স্থান জুড়ে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ তত্ত্ব সম্বলিত পদ। পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু বা প্রাণবিন্দু হল আমাদের সর্বজন গ্রাহ্য পুরাণ সমূহ।

কেবলমাত্র যে কাব্য-সাহিত্যের সম্ভার দৃষ্ট হয় তাই নয়—তার পাশাপাশি পুরাণ আমাদের সমাজকে শিখিয়েছে বহু পালা-পার্বণ, পূজা-পদ্ধতি-ইত্যাদি। বেদের কঠোর অনুশাসনে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় সাধারণ মানুষ যখন প্রাণ খুঁজে চলেছে। এমন সময়ে সামাজিক আচার, ব্যবহার, রীতি-নীতি, প্রথা-পদ্ধতি সর্বক্ষেত্রেই এক নবীকরণের ভাব লক্ষ্য করা যায়। বেদের অগ্নি, ইন্দ্র, বরুণের স্থান দখল করে নেয় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, রাধাকৃষ্ণ, হর পার্বতী। বেদের মন্ত্রে সকলের অধিকার না থাকা, তৎস্থানে নুতন মন্ত্রের ব্যবহার করেছে পুরাণ। পুরাণকারগণ মৃন্ময়ী, চিন্ময়ীরূপে এ ব-দেবীর মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করে মন্দিরে মন্দিরে পুরাণ মন্ত্রচ্চারণ পূজা অর্চনা প্রচলন করেছিল।

এই মূর্তিপূজা মানুষের মনকে এতবেশী আকর্ষণ করেছিল যে দিন দিন তা বাড়তে থাকল মাত্রাতিরিক্ত ভাবে, সেই সময়ে ভক্তবৃন্দের এরূপ অতিশয় আসক্তির রাশও টেনেছিল পুরাণই। ভাগবৎ পুরাণে বলা হয়েছে—

“অচাদাবচয়েত্তাবদীশ্বরং মাং স্বকর্মকৃৎ।
যাবন্ন বেদস্বহৃদি সর্বভূতেশ্ববস্থিতম্।।”

অর্থাৎ যে ব্যক্তি যতদিন পর্যন্ত্য না নিজ হৃদয়ে সর্বভূতস্থিত ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারে সেই ব্যক্তি ততদিন যাবৎ প্রতিমাদিতে ঈশ্বরের পুজা অর্চনা করে থাকে। কিন্তু সর্বভূতে ঈশ্বরের উপলব্ধি হলে স্বতন্ত্র মূর্তিপূজা নিরর্থক হয়ে পরে। কারণ তখন সর্বভুতেই ঈশ্বরের দর্শন ঘটে, জীব পূজাই শিব পূজা। নর-ই নারায়ণ রূপে প্রতিভাত হন। অতএব এই যে সকল ভূতে ঈশ্বরের উপলব্ধি এই বোধ পৌরাণিক ধর্মের এক উন্নততর সামাজিক শিক্ষা।

পুরাণ সমূহের ঐতিহাসিক মূল্য :— যতদিন পর্যন্ত্য সূতগণের হাতে ক্ষত্ৰিয় রাজাদের ইতিহাস সংরক্ষণের ভার ছিল ততদিন পর্যন্ত পুরাণগুলির ঐতিহাসিক সত্যতাও বজায় ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে অল্পশিক্ষিত পুরোহিতগণের হাতে পড়ে জনগণের মনোরঞ্জনের নিমিত্ত আপাত শ্রুতিমধুর করতে গিয়ে বহুস্থানে অতিরঞ্জন, কল্পনাপ্রসূত কাহিনীও সংযোজিত হয়েছে। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলি নানা ধর্মীয় আখ্যান, উপাখ্যান, ও দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনায় পরিষ্কার লক্ষ্য করা যায়। তবে আর যাই হোক না কেন প্রাচীন ঘটনা সমূহের বর্ণনা জানতে গেলে পুরাণ সাহিত্যের ঐতিহাসিক মূল্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে সেই সব ঘটনাবলী নিজেদের অজান্তেই পরিবর্তিত হয়ে পড়েছে, ফলে ঐতিহাসিক ঘটনা সমূহ অবিকৃত থাকা সম্ভব নয়। তবে Pargiter এর মতে পুরাণের বহু বক্তব্যের সত্যতার প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠিত রয়েছে বেদে। তিনি ব্যতীত আর কোন ব্যক্তিই পুরাণ সমূহের ঐতিহাসিক মূল্যকে স্বীকার করেন নি। তাঁর মতে বৈদিক সাহিত্য অপেক্ষা পুরাণ সাহিত্যই অধিক পরিমাণে ইতিহাসের বাহক ও প্রচারক। বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে অর্বাচীন কালের সুদীর্ঘ অতীতে যা ঘটেছিল তা জানতে পুরাণ সাহিত্যই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু এ-কথা বিস্মৃত হলে চলবে না যে পুরাণ রচয়িতাগণ কেহই ইতিহাস বিদ্‌ নন, অতএব তাঁদের ঘটনা বর্ণনায় স্মৃতির স্খলন হওয়া কোন অসম্ভব ব্যপার নয়।

প্রাচীনকাল থেকে পরীক্ষিতের রাজ্যলাভ পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস পুরাণ ভিন্ন অন্য কোন উপায়ে জানা যায় না। মহাভারত খ্যাত কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের সঠিক সময় যদি নির্ণয় করা যায়, তাহলে তার পূর্বেকার নানান ঘটনার বিবরণ এবং তৎকালীন রাজ- রাজাদের সম্বন্ধে বহু ইতিহাস বৈদিক ও পুরাণ সাহিত্যের মাধ্যমে জানা সম্ভব হয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাল নির্ণয় প্রসঙ্গে বহু মতামত থাকা স্বাভাবিক যেমন Aihole inscription থেকে জানা যায়—খ্রিঃ পূঃ ৩১০২ অব্দে মহাভারতের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জ্যোর্তিবিদ আর্যভট্ট এই মতের সমর্থন করে বলেন ঐ সময় থেকেই কলিযুগের সূচনা। Pargiter-এর মতে খ্রিঃ পূঃ-৯৫০ শতক। তবে বিভিন্ন মত বিবেচনা করে পণ্ডিতগণ ধারণা করেন খ্রিঃ পূঃ ১৪০০ শতকই মহাভারতের যুদ্ধের কাল। এবং এরসাথে সামঞ্জস্য রেখে মনু, যযাতি, মান্ধাতা, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ ইত্যিাদি মুখ্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির একটা কাল নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন পণ্ডিতগণ-

মনু – আনুমানিক খ্রিঃপূঃ – ৩১০০

যযাতি – আনুমানিক খ্রিঃপূঃ – ৩০০০-২৭৫০

মান্ধাতা – আনুমানিক খ্রিঃপূঃ – ২৭৫০–২৫৫০

পরশুরাম – আনুমানিক খ্রিঃপূঃ – ২৫৫০–২৩৫০

রামচন্দ্র – আনুমানিক খ্রিঃপূঃ – ২৩৫০–১৯৫০

শ্রীকৃষ্ণ – আনুমানিক খ্রিঃপূঃ – ১৯৫০-১৪০০

রাজা যথাতির কথা পুরাণেও পাওয়া যায় আবার ঋগ্বেদেও দৃষ্ট হয়। অনু, পুরু, যদু, দ্রুত্যু ইত্যাদির নামও উভয় ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। শিশুনাগ, নন্দ, মৌর্য, অন্ধ্র, শুঙ্গ, গুপ্ত প্রভৃতি বিখ্যাত রাজবংশের বর্ণনা কিন্তু পুরাণগুলিতেই মেলে। বিশেষতঃ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময় থেকে বহু ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় পুরাণ সাহিত্যে। বিভিন্ন বৈদেশিক জাতির আক্রমণ যেমন—আভীর, গদর্ভ, শক, হুন, মরণ প্রভৃতির বর্ণনাও পুরাণে মেলে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন সাঙ্ এর বর্ণনার সাথে পুরাণে বর্ণিত ঘটনার হুবহু মিল লক্ষ্য করা যায়। সেইকারণেই বলা হয়েছে পুরাণগুলির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।

পুরাণগুলির মতন উপপুরাণ গুলিরও যথেষ্ট ঐতিহাসিক গুরুত্ব বর্তমান। কালিকা- পুরাণ, দেবীভাগবত, মহাভাগবত, ধর্মপুরাণ প্রভৃতি থেকে পূর্বভারত তথা বাংলাদেশ ও কামরূপের বহু ধর্মীয় ও সামাজিক, ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যাবে। পুরাণ সমুহের স্থানে স্থানে কাল্পনিক বিষয়সমূহকে যদি বাদ দেওয়া যায় তবে অবশিষ্টাংশ থেকে তৎকালীন ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করায় কোন বাধা থাকে না।

পুরাণের নাম ও সংখ্যা :—পুরাণ মূলতঃ দুই প্রকার, প্রধান পুরাণগুলির নাম ‘মহাপুরাণ’ ও অপ্রধান পুরাণগুলি হল উপপুরাণ’। মৎস্য পুরাণে সমস্ত পুরাণের নাম, সংখ্যা, শ্লোকসংখ্যা, এমনকি পুরাণদানের ফলাফলও বর্ণিত হয়েছে। বিষ্ণুপুরাণে অষ্টাদশ মহাপুরাণের বর্ণিত নাম :—

আদ্যং সর্বপুরাণাং পুরাণং ব্রাহ্মমুচ্যতে।
অষ্টাদশ পুরাণাণি পুরাণজ্ঞাঃ প্রচক্ষতে।।
ব্রাহ্মং পাপ্পুং বৈষ্ণবং চ শৈবং ভাগবতং তথা।
অথানং নারদীয়ং চ মার্কণ্ডেয়ং চ সপ্তমম্ ॥
আগ্নেয়মষ্টমং দৈব ভবিষ্যং নবমং তথা
দশমং ব্রহ্মবৈবর্তং লৈঙ্গমেকাদশং স্মৃতম্ ॥
বারাহং দ্বাদশং চৈব স্কান্দং চাত্র ত্রয়োদশম্।
চতুর্দশং বামনং চ কৌর্মং পঞ্চদশং স্মৃতম্॥
মাৎস্যং চ গারুড়ং চৈব ব্রহ্মাণ্ডঞ্চ ততঃ পরম্। বিষ্ণু, ৩৬, ২১-২৪।

অষ্টাদশ পুরাণ যথাক্রমে—(১) ব্রহ্ম, (২) পদ্ম, (৩) বিষ্ণু, (৪) শিব বা বায়ু (৫) ভাগবত, (৬) নারদীয়, (৭) মার্কণ্ডেয়, (৮) আগ্নেয়, (৯) ভবিষ্য বা ভবিষ্যৎ, (১০) ব্রহ্মবৈবর্ত, (১১) লিঙ্গ, (১২) বরাহ, (১৩) স্কন্দ, (১৪) বামন, (১৫) কূর্ম, (১৬) মহস্য, (১৭) গরুড়, (১৮) ব্রহ্মাণ্ড।

আলবেরুনীকেও বিষ্ণুপুরাণের এই তালিকাই শোনান হয়েছিল। তাঁর দেওয়া অষ্টাদশ পুরাণের তালিকাও এর সাথে মিলে যায়। উপপুরাণগুলি এই অষ্টাদশ মহাপুরাণ থেকেই নির্গত। উপপুরাণের সংখ্যাও আঠারটি।

পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে পুরাণসমূহ সর্বতঃভাবে বেদকেই অনুসরণ করেছে। পুরাণং বেদসম্মতম্। সমস্ত বেদই পুরাণে প্রতিষ্ঠিত। পুরাণকারেরা কখনও বেদের নিন্দা করেননি। বরঞ্চ বেদের অর্থকে ইতিহাস ও পুরাণের মধ্যে নিশ্চল করে রেখেছে। পুরাণ সাহিত্যের সৃষ্টি না হলে বেদের অর্থ অনেকাংশেই দুর্বোধ্য থেকে যেত। এই অর্থে পুরাণ হল বেদের পরিপূরক। ১

ব্রহ্মপুরাণ :— পুরাণের তালিকা অনুযায়ী মহাপুরাণগুলির মধ্যে ব্রহ্মপুরাণই সর্বাগ্রে আলোচিত। ব্রহ্মার মাহাত্ম্য কীর্তন হেতু একে রাজস পুরাণের অন্তর্গত করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী সর্বাগ্রে বহ্মপুরাণ হেতু এটি আদিপুরাণ। বর্ণনা অনুযায়ী- নৈমিষ অরণ্যে ঋষিগণ যখন সমবেত হয়ে আলোচনায় ব্যস্ত এমন সময় তথায় সূত লোমহর্ষণ উপস্থিত হলে ঋষিরা তাকে পৃথিবীর বা ব্রহ্মাণ্ডের আদি থেকে অন্তপর্যন্ত সৃষ্টির রহস্যতত্ত্ব শোনানোর অনুরোধ করেন। তখন লোমহর্ষণ একে একে বিশ্বের উৎপত্তি কিভাবে হল, দেব ও মনুর বংশ, চন্দ্র ও সূর্যবংশ, পৃথিবীর ভূগোল, তীর্থক্ষেত্রের মাহাত্ম্য, বিষ্ণুর উপাসনা পদ্ধতি, শিব পার্বতীর কাহিনী, বৰ্ণাশ্ৰম ধৰ্ম— নীতিশাস্ত্র এমনকি কৃষ্ণের জীবন চরিতও বর্ণনা করেন। ব্রহ্মাণ্ডের শুধু উৎপত্তিই নয়, তার ক্রমবিকাশের সম্পূর্ণ কাহিনী একে একে বিবৃত হল। স্বর্গ-নরকের ধারণা, অর্থাৎ সেখানকার সুখ-শান্তির কথাও স্থান পেয়েছে। এইভাবে ব্রহ্মপুরাণের সৃষ্টি। তবে এর অতি সামান্য অংশই লোমহর্ষণের মৌলিকত্বের দাবী রাখে। কারণ খুব সহজেই অনুমেয় যে বহু অংশ পরবর্তীকালের সংযোজন। উড়িষ্যার মন্দির, সূর্যমন্দিরের বর্ণনা রয়েছে। এই মন্দিরের নির্মাণ কাল ১২৪১, আবার ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বে শৈবধর্ম ও বৈষ্ণবধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটে অতএব ব্রহ্মপুরাণে ঐ সমস্ত আলোচনা এয়োদশ- শতাব্দীরও পরে সংযোজন হওয়া স্বাভাবিক।

বিষ্ণুপুরাণ :—মহাত্মা বশিষ্ঠের পুত্র পরাশর কর্তৃক বিবৃত এই পুরাণও মহাপুরাণের মধ্যে অন্যতম। এই পুরাণের বৈশিষ্ট্য হল এই যে পুরাণের পঞ্চলক্ষণের যেরূপ আলোচনা করা হয়েছে তা সবই এই পুরাণে লক্ষ্য করা যায়। দার্শনিক শ্রেষ্ঠ রামানুজাচার্য বৈষ্ণব শাস্ত্রের অন্যতম প্রামাণ্য গ্রন্থ বলে উক্ত গ্রন্থটিকে নির্দেশ করেছেন। কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে কোন যাগ যজ্ঞের নির্দেশ বা মন্দির ইত্যাদির উল্লেখ দৃষ্ট হয় না। এতদ্ব্যতীত আলোচনার মধ্যে বিষয়ের ধারাবাহিকতা বা ঘটনাবলীর মধ্যে সুসামঞ্জস্য লক্ষ্যণীয়, যা অন্যান্য পুরাণগুলিতে মেলে না। Winternitz-এর মতে এই পুরাণ প্রাচীনকালের রচনা এবং অবিকৃত-রূপেই বর্তমান আছে। এই গ্রন্থে সৃষ্টি পর্বে দেবতা, অসুর, মানবকুল ছাড়াও বহু লৌকিক ও অলৌকিক কাহিনীও গ্রথিত হয়েছে। প্রহ্লাদের উপখ্যান, সমুদ্রমন্থন ও শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর মাহাত্ম্য, কীর্তিত হয়েছে। সপ্তবর্ষের অন্যতম ভারতবর্ষ, সপ্ত দ্বীপ, সপ্ত কুল-পর্বত। সূর্যলোক, চন্দ্রলোক সহ প্রাচীন ভারতের ভূখণ্ডের পরিচয় সহ বর্ণাশ্রম, ধর্মাশ্রম গার্হস্থ্য জীবনের নানা আচার-অনুষ্ঠান আলোচিত হয়েছে। রাজাদের বংশ পরিচয় প্রসঙ্গে সূর্য ও চন্দ্রবংশের ইতিহাস, প্রধান প্রধান ক্ষাত্র বংশের পরিচয় সহ নানা অলৌকিক কাহিনীও সন্নিবেশিত হয়েছে। V. A. Smith মনে করেন মৌর্য রাজবংশের (খ্রিঃ পূঃ ৩২৬—১৮৫) ইতিহাস জানার জন্য এই বিষ্ণুপুরাণ অতীব নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগের বর্ণনা, কলিযুগের অনাচার হেতু মানুষের যে দুঃখকষ্ট তার থেকে মুক্তির উপায় স্বরূপ বিষ্ণুর প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি দ্বারা মোক্ষপ্রাপ্তির আলোচনা করা হয়েছে। বিষ্ণু পুরাণে বর্ণিত বহু চিত্তাকর্ষক গল্প কাহিনী অতীব প্রসিদ্ধ। তন্মধ্যে যেমন—মনুকন্যা ইলার পুরুষে পরিবর্তন, মান্ধাতার জন্ম, ভরতমুনি ও হরিণশিশুর গল্প, পুরুরবা-ঊর্বশীর প্রণয় কাহিনী, ইত্যাদি বিখ্যাত। বৈষ্ণব পুরাণ ও উপপুরাণগুলিতে বিষ্ণুর বহুবিধ অবতারগুলি যথাক্রমে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন ও কল্কি এদের মহিমা কীর্তন, এবং সেইসাথে ভাগবত প্রেমের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। পাঞ্চরাত্র সম্প্রদায়েরও বিশেষ ভূমিকা এই প্রসঙ্গে লক্ষ্যণীয়।

পদ্ম পুরাণ :—নৈমিষারণ্যে সমবেত ঋষিদের নিকট লোমহর্ষণের পুত্র সৌতি উগ্রশ্রবা এই পুরাণ বিবৃত করেন। এই পুরাণের নাম পদ্মপুরাণ। শুরুতেই বলা হয়েছে সৃষ্টির প্রারম্ভে পদ্মের উপরে ব্রহ্মার আবির্ভাবের কাহিনী। আদি, ভূমি, ব্ৰহ্ম, পাতাল, সৃষ্টি ও উত্তর এই ছয় খণ্ডে বিভক্ত পদ্ম পুরাণ। বৈষ্ণব ধর্মের রচনাহিসাবে এই গ্রন্থ ভগবান বিষ্ণু পরমাত্মা পরব্রহ্মরূপে প্রতিষ্ঠিত। প্রায় সকল পুরাণেই অবতারের মাহাত্ম্যকীর্তনের পাশাপাশি ভৌগোলিক পরিচয়, সৃষ্টিতত্ত্ব, বংশানুচরিত প্রভৃতি আলোচিত। পদ্মপুরাণের মূল অংশ আনুমানিক ৬ষ্ঠ শতকের রচনা। তবে বহু বিষয়ের বর্ণনারীতি ও পৃথক্ পৃথক্ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলে বোঝা যায় সেগুলি পরবর্তীকালের প্রক্ষেপ হওয়া স্বাভাবিক। পদ্মপুরাণের প্রথম খণ্ডের বিষয়ের সাথে বিষ্ণু ও মৎস্যপুরাণের হুবহু মিল লক্ষ্য করা যায়। পদ্মপুরাণের দুটি পাঠ প্রচলিত। বঙ্গীয় এবং দক্ষিণী, বঙ্গীয় পাঠ দক্ষিণী অপেক্ষা প্রাচীন। মোট ৫টি পর্বে ৪৫০০০টি শ্লোকে পুরাণটি বিবৃত। উত্তরখণ্ডের শেষ পর্যায়ে ক্রিয়াযোগসার যুক্ত হয়েছে, সম্ভবতঃ এই অংশই সর্বশেষ সংযোজন বা খিল অংশ।

ভাগবত পুরাণ :—মহর্ষিবেদব্যাস নারদের নিকট পূর্ণব্রহ্ম সনাতন নরদেহ ধারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অমৃতময়ী লীলা কাহিনী বর্ণনা করেন। সর্বাধিক জনপ্রিয়তার অধিকারী এই ভাগবত পুরাণ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনুদিত ও সর্বজনগ্রাহ্য। বিষ্ণুপুরাণের সাথে এর অধিকাংশে মিল লক্ষণীয়। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভাগবত-শাখার অনুগামিনীদের নিকট ভগবান পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রামাণ্য গ্রন্থ। বৈষ্ণব দর্শনের তত্ত্ব, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রূপে স্বয়ং বিষ্ণুর মাহাত্ম্য কীর্তন ও তাঁর জীবনচরিত এই গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। সাহিত্যের বিচারেও গ্রন্থটির উৎকর্ষতা লক্ষণীয়। বিষয়ের ধারাবাহিকতা, কাব্যাংশে উৎকর্ষতা, এবং ভাষা, রীতি ও ছন্দের পরিপাট্য নিঃসন্দেহে অন্যান্য পুরাণের তুলনায় একে বিশিষ্ট করে রেখেছে। ১২টি স্কন্ধে, ৩৩৫টি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ এই গ্রন্থ প্রায় ১৮০০০টি শ্লোক রয়েছে। আলোচ্য পুরাণটিতে পুরাণের পঞ্চ লক্ষণও সুস্পষ্ট। শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন ও মথুরায় গোপীদের সঙ্গে প্রণয়-কাহিনী, ও জীবন চরিত সুচারুরূপে বিধৃত হয়েছে। বৈয়াকরণ বোপদেব এই পুরাণের কাহিনী অবলম্বনে হরিলীলা ও মুক্তাফল নামক দুইটি গ্রন্থ রচনা করেন, সেইহেতু কেউ কেউ মনে করেন ভাগবত পুরাণ বোপদেবের রচনা, কিন্তু এইরূপ মতের কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। রচনাশৈলী ও বিষয় বস্তু দেখে বিশেষজ্ঞের মতামত এই পুরাণ অর্বাচীন কালেরই রচনা এবং আনুমানিক ৯ম-১১শ শতকের মধ্যেকার রচনা। C.V.Vaidya-র মতেও শঙ্করাচার্য (খ্রিঃ নবম শতাব্দীর প্রাক্কালে) থেকে খ্রিঃ দ্বাদশ শতকের গীতগোবিন্দের রচয়িতা কবিজয়দেবের মধ্যবর্তী সময়ে ভাগবত পুরাণের রচনাকাল। Pargiterও নবম শতাব্দীতেই ভাগবত পুরাণ রচিত বলে মত প্রকাশ করেছেন। গৌড়ীয় আচার্যগণ এই ভাগবত পুরাণকে স্বীয় ধর্মের শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দান করেছেন। গ্রন্থটিকে অবলম্বন করে বহু টীকা ও ব্যাখ্যা রচিত হয়েছে। যা দেখে গ্রন্থটির জনপ্রিয়তা সহজেই অনুমেয়।

মৎস্য পুরাণ :—প্রধানতঃ বায়ু ও বিষ্ণুধর্মোত্তর ও অন্যান্য পুরাণের বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত এই পুরাণে মহস্যরূপে অবতীর্ণ ভগবান বিষ্ণু কর্তৃক মনুকে রক্ষার কাহিণীই বর্ণিত হয়েছে। সমগ্র পুরাণ ব্যাপে মনু ও মৎস্যের কথোপকথন বিধৃত রয়েছে। প্রবল বন্যায় পৃথিবী প্লাবিত হলে বিষ্ণু মৎস্যরূপ ধারণ করে নৌকাস্থিত মনুকে উদ্ধার করেন। কাহিনীতে বর্ণিত আছে যে হিমালয়ের উচ্চশৃঙ্গে নৌকা বন্ধন পূর্বক তাঁকে প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করেন। পঞ্চলক্ষণ সমন্বিত এই কাহিনী অতি প্রাচীন। মৎস্য পুরাণ মূলতঃ পাঞ্চরাত্র বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের গ্রন্থ ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে গ্রন্থে বহু শৈব উপাদান যুক্ত হয়। পুরাণের প্রসিদ্ধ পাঁচটি লক্ষণের আলোচনা ছাড়াও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান দান-ধ্যান, পূজা-পদ্ধতি, তীর্থ- মাহাত্ম্য, মূর্তিনির্মাণ ইত্যাদি বহু বিষয়েরও বর্ণনা রয়েছে। চিত্তাকর্ষক কিছু কাহিনী যুক্ত হয়ে আছে, তন্মধ্যে কচ ও দেবযানী, যযাতি, কার্তিকেয়ের তারকাধব ইত্যাদি। অন্ধ্ররাজবংশের (২য় শঃ) ইতিহাস সম্পর্কে এই পুরাণ থেকে জানা যায়।

অগ্নি পুরাণ :—তামস শ্রেণি ভুক্ত অগ্নি বা আগ্নেয় পুরাণ পৌরাণিক সাহিত্য প্রাঙ্গণে অতি প্রাচীণ বলেই বিবেচিত। কিংবদন্তী অনুযায়ী মুনি বশিষ্ঠ সর্বজ্ঞ হওয়ার অভিলাষে অগ্নিদেবকে সর্ববিদ্যার বিষয়ে উপদেশ দান করতে বলায় এই অগ্নিপুরাণের জন্ম। ১৬০০০ শ্লোকে অগ্নি সর্ববিদ্যার সংক্ষিপ্ত উপদেশ দান করেছিলেন। আলোচ্য পুরাণে বিবিধ পৌরাণিক কাহিনীর সাথে সাথে বহু শাস্ত্রের আলোচনা, রামায়ণ, মহাভারত, রাম, কৃষ্ণের চরিতবর্ণনা, বংশানুচারিত, বর্ণিত হয়েছে। এতদ্ব্যতীত কূর্ম, ভাগবত বায়ু ও মার্কণ্ডেয় পুরাণের বর্ণনাও গ্রন্থে দৃষ্ট হয়। এছাড়া রয়েছে সৃষ্টি তত্ত্ব, ভূগোল, নানা ব্যাকরণ, ও চাণক্যের রাজনীতি শাস্ত্র ইত্যাদি বহুমুখী শাস্ত্রের আলোচনা। মূলতঃ বৈষ্ণবদের শাস্ত্রের অনুসারী হলেও এই পুরাণে তান্ত্রিক উপাসনা- পূজা পদ্ধতি, লিঙ্গ পূজা, দূর্গা আরাধনা প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনাও স্থান করে নিয়েছে। এই পুরাণটিকে encyclopedia বা বিশ্বকোষ বলা যায়।

বায়ু পুরাণ :—বায়ু পুরাণকে শিব পুরাণ নামেও অভিহিত করা হয়েছে। শিবের উপাসনা নিয়ে আলোচনা বশতঃ এইরূপ নামকরণ হওয়া সম্ভব। প্রক্রিয়াপাদ, অনুষঙ্গ পাদ, উপোদঘাত পাদ ও উপসংহার পাদ এই চার খণ্ডে বিভক্ত। শৈবধর্মের অনুগত- ভগবান শিবের মাহাত্ম্য ও পাশুপত ধর্মের তত্ত্ব ব্যাখ্যা এই পুরাণের বিশেষ দিক। এতদ্ব্যতীত সব পুরাণের মতই সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশানুচরিত, ভৌগোলিক বর্ণনা, ইন্দ্ৰাদি দেবতার উৎপত্তি থেকে শুরু করে পুরাবৃত্ত কাহিনী, অন্যান্য রাজরাজাদের বংশের ইতিহাস, চারযুগ, মন্বন্তর এই সবই আলোচিত হয়েছে। বৈদিক সম্প্রদায় সমূহ চাতুর্বর্ণের নির্দিষ্ট কর্তব্যের আলোচনা, তন্ত্র আলোচনা, শাক্তধর্ম, অন্যান্য দেব-দেবীর মাহাত্ম্য এই সকলই বায়ু পুরাণের বিষয়বস্তু। জনপ্রিয় কাহিনীর মধ্যে জনকরাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞের বিবরণ, পুরুরবা-উর্বশী, পৃথুচরিত, দেবাসুরের যুদ্ধ প্রভৃতি সন্নিবেশিত হয়েছে। মহাভারতে একস্থানে বায়ুপুরাণের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। হরিবংশের স্থানে স্থানে বায়ুপুরাণের সাথে যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়, পঞ্চলক্ষ্মণ, সমন্বিত এই প্রাচীন পুরাণটি Winternitz-এর মতে-খ্রিষ্টীয় পঞ্চমশতকের পূর্বে অবশ্যই রচিত হয়েছিল।” মহাকবি বাণভট্ট বায়ুপুরাণ শ্রবণ করেছিলেন আনুমানিক ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে।

মার্কণ্ডেয় পুরাণ :—রাজস শ্রেণীর পুরাণ মার্কণ্ডেয়। জৈমিনি নামে ব্যাসের এক শিষ্য ছিলেন। তিনি একদিন মার্কণ্ডেয় মুনির নিকট বাসুদেবতত্ত্ব জানার ইচ্ছা প্রকাশ করলে মার্কণ্ডেয় সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলে তাকে বিন্ধ্যপর্বতবাসী দিব্যজ্ঞানী পক্ষীদের নিকট পাঠালেন। সেখানে জৈমিনি তার জিজ্ঞাসার উত্তর পান। পুরাণের পঞ্চ লক্ষণ ব্যতীত এখানে পাপ-পুণ্য-স্বর্গ-নরক, কর্মবিপাক, বর্ণাশ্রমধর্ম, বিবিধ আচার-আচারণ, ভক্ষ্যাভক্ষ্য ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে। মহাভারতের আখ্যান ভাগের সাথে বহু অংশে এই পুরাণের ঘটনার সাদৃশ্য বিশেষ লক্ষ্যণীয়।

শ্রীশ্রীদেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য বর্ণনাই হল এই পুরাণের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়। শ্রীমদ্ভাগবত গীতার মতই শ্রীশ্রীচণ্ডীর মাহাত্ম্য হিন্দু শাস্ত্রের একটি সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বমান্য, পরমপবিত্র গ্রন্থ। সেই থেকে দেবী দূর্গার আরাধনায় চণ্ডী অবশ্যপাঠ্য বলে স্বীকার করা হয়েছে। গীতার মতই চণ্ডীরও অসংখ্য টীকা রচিত হয়েছে। পরবর্তীকালে বাণভট্টের চণ্ডীশতক, আনন্দবর্ধনের দেবীশতক এই দেবীমাহাত্ম্য অবলম্বনেই রচিত। সকলের মঙ্গলকারিণী এই দেবীচণ্ডীর আরাধনা অশুভ শক্তিকে তাড়িয়ে শুভশক্তির আরাধনা।১২ পণ্ডিতেরা মনে করেন এই পুরাণের মূল অংশ ৪র্থ শতকের পূর্বেই রচিত হয়েছিল। দেবী-মাহাত্ম্য নামক—অংশটি পরবর্তী কালের প্রক্ষেপ।

উপপুরাণ :—সমগ্র পুরাণ সাহিত্যকে মহাপুরাণ ও উপপুরাণ এই দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা শুরু হলেও এইরূপ ভাগ কিন্তু সর্বজনগ্রাহ্য বা যুক্তিযুক্ত নয়। ‘উপ’ অর্থে নিকটে, এবং ‘অপ্রধান’ বুঝলে উপপুরাণ বলতে মহাপুরাণের তুলনায় আকার, আকৃতি ও গুণমানে অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট এমন পুরাণের ইঙ্গিত করে। কিন্তু উপপুরাণ হিসাবে যে পুরাণের তালিকা দৃষ্ট হয়, সেখানে কতিপয় পুরাণ গুণমানের দিক থেকে সাধারণ হলেও বেশীর ভাগ পুরাণেই পঞ্চ-লক্ষণ থেকে শুরু করে বিষয়ের সন্নিবেশ এবং রচনার গুণ-গতমান বিচারে সেগুলি অনেক মহাপুরাণের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। পুরাণের অপেক্ষা কতিপয় উপপুরাণের সারবান বিষয় ও যুগোপযোগী আলোচনা বিশেষ লক্ষ্যণীয়। অর্বাচীন কালে মহাপুরাণের অনুকরণে বা মহাপুরাণের বিষয় অবলম্বনে উপপুরাণগুলির রচনাকালে হয়ত আঞ্চলিক ধর্মীয় শাখার প্রভাবে লৌকিক দেব-দেবীর মাহাত্ম্য কীর্তন করতে গিয়ে নব-নব-রূপে তার কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকায় তা আর উপপুরাণ না হয়ে পুরাণের সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হল। যেমন দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ ইত্যাদি। পঞ্চলক্ষণ কেন, উপপুরাণে দশটি লক্ষণের কথাও বলেছেন পুরাণকারেরা। তবে দশটি লক্ষণ কোন একটি উপপুরাণেও দৃষ্ট হয় না, তবে সর্ব-মোট দশটি লক্ষণ হয়ত সমস্ত উপপুরাণ গুলিতে সামগ্রিক ভাবে লক্ষ্য করা যায়, এইরূপই বলা শ্রেয়। গুপ্তযুগের পূর্বকাল থেকে ভারতবর্ষের বহু ইতিহাস এই উপপুরাণ থেকে জানা সম্ভব হয়েছে। ধর্মীয় ও সামাজিক তত্ত্বের দিশারী এইসমস্ত পুরাণ একসময়ে আকরগ্রন্থ বলে বিবেচিত হত। লুপ্ত সংস্কৃত গ্রন্থসমূহের উদ্ধার কার্যেও এই উপপুরাণ গুলির গুরুত্ব সমধিক

উপপুরাণ গুলির উৎস সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে ব্যাসের নিকট অষ্টাদশ মহাপুরাণ শ্রবণ করার পর উগ্রশ্রবা এই উপপুরাণগুলি রচনা করেন। উপপুরাণকে খিল নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। সাধারণতঃ খ্রিষ্টাব্দ ৬৫০-৮০০ উপপুরাণ গুলির রচনাকাল বলে মনে করা হয়। বিভিন্নস্থানে উপপুরাণের যে তালিকা দৃষ্ট হয়, তাতে গরমিল লক্ষ্য করা যায়। অষ্টাদশ পুরাণের অনুসারী অষ্টাদশ উপপুরাণের নামই দৃষ্ট হয়। তবে ধর্মীয় সম্প্রদায় ভেদে সমস্ত উপপুরাণ গুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন—বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য ও বিবিধ। যেমন বিষ্ণুধর্ম, বিষ্ণু-ধর্মোত্তর, ক্রিয়াযোগসার প্রভৃতি বৈষ্ণব সম্প্রদায় ভুক্ত। আবার দেবীপুরাণ, চণ্ডী পুরাণ, কালিকাপুরাণ, মহাভাগবত, দেবী ভগবতী পুরাণগুলি শাক্ত সম্প্রদায় ভুক্ত। শিব সম্প্রদায় ভুক্ত উপপুরাণগুলি শিবের নামে যেমন-শিব পুরাণ, শিব-ধর্ম পুরাণ, শিবরহস্য, সৌর পুরাণ, পরাশর উপপুরাণ ইত্যাদি। এইভাবে সৌর সম্প্রদায়ভুক্ত হল শাম্ব উপপুরান। গণেশ পুরাণ ও মুদ্‌গলপুরাণ হল গাণপত্য ও বিবিধের আলোচনায় বৃহদ্ধর্ম ও ভবিষ্যোত্তর উপপুরাণের নাম দৃষ্ট হয়। এছাড়াও মোট প্রায় একশত উপপুরাণের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ রচনাই কালে কালে লুপ্ত হয়ে গেছে। প্রাচীন কালের নীলমত পুরাণ বিশেষ মর্যাদার দাবী রাখে। ঐতিহাসিক কলহন তার রাজতরঙ্গিণী— রচনায় এই পুরাণের প্রমাণ বিচার করেছেন। এছাড়া অসংখ্য পুরাণ ও উপপুরাণ সে যুগে ভারতবর্ষের ধর্মীয়, সামাজিক ও ভৌগোলিক ধারাকে যে ভাবে আলোচনার মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত গতির অনুসরণে মানব সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত করেছিল তা ভেবে দেখলে অবাক হতে হয়। পুরাণ-কারেরা শুধু জ্ঞানেই ঋদ্ধ ছিলেন না, তাঁরা মহাকবি ছিলেন। পুরাণেও রসকে কাব্যের আত্মারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কবিত্বশক্তি অর্জন করতে গেলে পুরাণকারের বক্তব্য নিম্নরূপ :—

“নরত্ব দুর্লভং লোকে বিদ্যা তত্র সুদুর্লভা।
কবিত্বং দুর্লভং তত্র শক্তিক্তত্র সুদুর্লভা।।”

অর্থাৎ পৃথিবীতে নরত্বলাভ খুবই দুর্লভ, ভাগ্যক্রমে নরত্ব লাভ হলেও বিদ্যালাভ সুদুর্লভ। আর বিদ্যালাভ যদিও বা হয় কবিত্বলাভ সুদুর্লভ, কবিত্বলাভ হলেও সকলে কবিত্ব শক্তির অধিকারী হয় না। তাঁদের মতে কবি হলেন কাব্যসংসারে প্রজাপতি স্বরূপ। কবি নিজরুচি অনুসারে তাঁর কাব্য জগৎ রচনা করেন বা নির্মাণ করেন।১৩

পাদটীকা – পুরাণ

১. ইতিহাস পুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃংহয়েৎ।
বিভেত্যল্প শ্রুতাদ্ বেদো মাময়ং প্রতরিষ্যতি।।” ম. ১।১।২০৪

২. Radhakrishnan : Religian of society. P. ১১৩.

৩. “কৃষ্ণদ্বৈপায়নং ব্যাসং বিদ্ধি নারায়ণং প্রভুম্
কোহন্যো হি ভুবি মৈত্রেয় মহাভারতদ্ ভবেৎ।” বিষ্ণুপুরাণ।

৪. মহাভারতের স্বর্গারোহণ পর্বে এবং হরিবংশে অষ্টাদশ পুরাণের উল্লেখ রয়েছে।

“অষ্টাদশ পুরাণানি ধর্ম শাস্ত্রাণি সর্বশঃ।
অষ্টাদশ পুরাণানাং কর্তৃবেদমহোদধেঃ।

অষ্টাদশ পুরাণানাং শ্রবনাদ্ যৎফলং ভবেৎ।

(মহাভারত স্বর্গারোহণ পর্ব)

৫. “From all this it appears that puranas as a species of lit erature existed long before the final redaction of the Mahabharata and that even in the puranas which have come down to us there is much that is older than our present Mahabharata.” (From History of Indian litereture.)

৬. সাত্ত্বিকেষু পুরাণেষু মাহাত্ম্যমাধিকং হরেঃ।
রাজসেষু চ মাহাত্ম্যমধিকং ব্ৰহ্মনোবিদুঃ।
তদ্বদগ্নেশ্চ মাহাত্ম্যং তামসেষু শিবস্য চ।
সংকীর্ণেষু সরস্বত্যাঃ পিতৃণাং চ নিগদ্যতে।—মৎস্য, ৫৩.৬৮-৯

৭. এই প্রসঙ্গে Monier williams মনে করেন যে-একমাত্র বিষ্ণু পুরাণের ক্ষেত্রেই পঞ্চলক্ষণ পুরোপুরি অনুসৃত হয়েছে। তাঁর মতে—”In the Bhagavata-Purana, Six original collections are especially declared to have been taught by vyasa to six sages his pupils, and these six collections may have formed the bases of the present works :— Hinduism. p. ৮৩.

৮. বেদাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ সর্বে পুরাণে নাত্র সংশয়ঃ—নারদীয়।

৯. বেদবন্নিশ্চলং মন্যে পুরাণার্থং দ্বিজোত্তমাঃ।
বেদাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ সর্বে পুরাণে নাত্র সংশয়ঃ।।
বিভেত্যল্পশ্রুতাদ্বেদো মাময়ং চালয়িষ্যতি।
ইতিহাসপুরানৈস্তু নিশ্চলোঽয়ং কৃতঃ পুরা। (স্কন্দ, প্রভাসখণ্ড)

১০. এই জন্যই বলা হয়েছে, চারি বেদ, ও সমস্ত উপনিষদ্ জেনেও যদি কেউ পুরাণজ্ঞ না হন। তবে তিনি বিচক্ষণ বলে বিবেচিত হন না।
নচেৎ পুরাণং সংবিদ্যান্নেব স স্যাদ্বিচক্ষণঃ।। পদ্ম-২.৫০-২, শিব ৫, ১-৩৫ প্রভৃতি।

১১. “There certainly existed an ancient purana under this name, and undoubtedly there is still preserved in our text much of this ancient work, which is probably not later than fifth century. A.D.”- Winternitz: History of Indian Literature, P. ৫৫৪.

১২. “সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণী নমো নমোহস্তুতে।।”

১৩. “অপারে কাব্য সংসারে কবিরেক প্রজাপতিঃ।
যথাস্মৈ রোচতে বিশ্বং তথৈব পরিবর্ততে।।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *