ঊনবিংশ অধ্যায় – স্থাপত্যবেদ বা বাস্তুতন্ত্র
সংস্কৃত পুরাণগুলি হল ভারতীয় সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতির আকর গ্রন্থস্বরূপ। ভাগবত পুরাণে উক্ত আছে যে চতুর্বেদ যেরূপ পূর্ব থেকেই চলে আসছে, সেরূপ চারটি উপবেদ রয়েছে সেগুলি যথাক্রমে—গান্ধর্ববেদ বা সংঙ্গীত বিদ্যা, আয়ুর্বেদ বা চিকিৎসা বিজ্ঞান, ধনুর্বেদ এবং স্থাপত্যবেদ বা বাস্তুতন্ত্র। এক্ষণে স্থাপত্যবেদ বা বাস্তুতন্ত্র হল শিল্পশাস্ত্রের একটি প্রধান বিষয়। শিল্পশাস্ত্র বললে বাস্তুতন্ত্র, মূৰ্ত্তিগঠন ও চিত্র শাস্ত্রের পাশাপাশি ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকে বুঝায়। ব্রহ্মার মানসপুত্র স্বয়ং বিশ্বকর্মাই স্থাপত্যবেদের রচয়িতা। দেবতাদের প্রধান বাস্তুকার বিশ্বকর্মা এবং অসুরদিগের বাস্তুকার ময়দানবকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সুদূর বৈদিকযুগ থেকেই বাস্তুবিদ্যার প্রচলন ছিল। সে যুগেও আর্যরা সুপরিকল্পিত উপায়েই গৃহনির্মাণ করে বসবাস করতেন। ঋকবেদের যুগে নগর সভ্যতা ছিল কিনা এই নিয়ে মতভেদ থাকলেও আর্যদের ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশের সাথে সাথে যে এক উন্নততর নগর সভ্যতার নিদর্শন মেলে একথা বলতে কোন দ্বিধা নেই। অট্টালিকা, প্রাসাদ, হর্ম্য গড়ে উঠেছিল, বেশির ভাগ লৌহনির্মিত এবং দুর্ভেদ্য দুর্গেরও নিদর্শন মেলে। ঋকবেদে নগর ধ্বংসেরও বর্ণনা দৃষ্ট হয়। ঋকবেদে উক্ত হয়েছে যে— স্বয়ং মিত্র ও বরুণ যেখানে বসবাস করতেন তাতে সহস্র স্তম্ভ ছিল এবং সহস্র দ্বার যুক্ত সেই অট্টালিকা। বাস্তুবিদ্যার চরম উৎকর্ষতা সে যুগেই ঘটেছিল।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং ইসলাম ধর্মের রাজন্য বর্গের পৃষ্ঠ পোষকতায় বিভিন্ন প্রকার শিল্পী ও কলাকুশলীদের চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, ও স্থাপত্যের নিদর্শন সকলকে মুগ্ধ করেছিল। প্রাচীন ভারতীয় মন্দিরের নির্মাণ প্রযুক্তিতে যেরূপ স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের পরিচয় মেলে তা অতুলনীয়। তাদের কল্পনা বিলাসী- মন এবং সৌন্দর্যবোধ যথেষ্ট উচ্চমানের শৈল্পিক জ্ঞানের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। বৌদ্ধশিল্প বিদ্যাও ভারতে ও ভারতের সন্নিকটস্থ দেশে প্রাধান্য লাভ করেছিল। বুদ্ধের ধ্যানগম্ভীর মূর্ত্তির আড়ালে ‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’-এরই ছায়া পরিস্ফুট ছিল। গুপ্তরাজত্বকালে ঐ শিল্প বিদ্যার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। প্রসঙ্গক্রমে সারনাথ ও সাঁচির শিল্পনৈপুণ্যের উল্লেখ করা যায়। সে যুগের কারিগরগণের মধ্যে বাঁধাধরা নিয়ম বহির্ভূত একটি হৃদয়স্থিত ভাবময়তা ছিল। এবং সম্ভবতঃ সেই আদর্শের জোড়েই তাঁরা পাষাণেও জীবন্তরূপ দান করতে সমর্থ হতেন।
বিশ্বকর্মাকেই স্থাপত্যবেদ বা বাস্তুতন্ত্রের অন্যতম কারিগর বলা হয়েছে। বিশ্বকর্মার নামে অন্ততঃ দশখানি পুঁথি প্রচলিত আছে। তাঁর রচিত “বাস্তুশাস্ত্রম” বা “বাস্তুবিদ্যা” অগ্রগণ্য। আলোচ্য গ্রন্থেই গৃহারম্ভের কাল নির্ণয়, দিনির্ণয়, গৃহনির্মাণের উপকরণ সংগ্রহ থেকে শুরু করে জমিপরীক্ষা, ভবন লক্ষণ ইত্যাদি বিভিন্ন পরিচ্ছেদে সুবিন্যস্ত রয়েছে। উক্ত গ্রন্থে দেবতার মন্দির নির্মাণ নিমিত্ত আট প্রকার কাঠ এবং গৃহীর গৃহনির্মাণের নিমিত্ত তেইশপ্রকার কাঠ ব্যবহারের নির্দেশ ছিল। ঘরের ভিতরকার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ভিতের গভীরতা, এমনকি জানালা-দরজার পরিমাপের কথাও বর্ণিত আছে। সুপ্রাচীন কালের এমন চিন্তা ও চেতনা সত্যিই সকলকে মুগ্ধ করে। গৃহনির্মাণই কেবল নয়, সুপরিকল্পিত উপায়ে নগর গড়ে তোলার কথাও বলা হয়েছে। পুস্করিণী খনন, নলকূপ, কৃত্রিম উপায়ে জলসেচ ব্যবস্থা, এই সবই ছিল গ্রাম পরিকল্পনা বা নগর পরিকল্পনার অঙ্গ। বিশ্বকর্মার অধিকাংশ গ্রন্থই পরবর্তীকালে মহামহোপাধ্যায় গণপতিশাস্ত্রী মহাশয় বিভিন্ন সময়ে অবিষ্কার করেছেন এবং নতুন-ভাবে মুদ্রিত করেছেন। ‘বাস্তুশাস্ত্রম্’ ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের আবিষ্কার, উক্ত গ্রন্থে শিল্পীদের দেবতারূপে বিশ্বকর্মা পূজিত হয়েছেন। অতঃপর ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে আবিস্কৃত গ্রন্থ ‘মনুষ্যালয়চন্দ্রিকা’। এই গ্রন্থে ৭টি অধ্যায়ে মনুষ্যের বাসযোগ্য বাস্তুসম্বন্ধীয় নানাবিধ উপদেশাবলী রয়েছে। ১৯২২ খ্রিঃ অপর একখানি মূল্যবান গ্রন্থেরও আবিষ্কর্তা তিনি। ‘শিল্পরত্নম’ নামক এই গ্রন্থে দুটি খণ্ড, প্রথমটিতে স্থপতি বিদ্যা ও দ্বিতীয় খণ্ডে প্রতিমা নির্মাণের আলোচনা করা হয়েছে। অতঃপর গণপতিশাস্ত্রী মহাশয়ের অপর আবিষ্কার ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘সমরাঙ্গন সূত্রধার’ নামক বাস্তুশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ, এর রচয়িতা ছিলেন ভোজরাজ। আলোচ্য গ্রন্থটিতে গৃহনির্মাণের কৌশল, বিধি নিষেধ উল্লেখ্য। এতদ্ব্যতীত ‘যন্ত্রবিধান’ বর্ণিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে গজযন্ত্র, আকাশচারী বিহঙ্গযন্ত্র, বীরপলিযন্ত্র, দারুময় বিমানযন্ত্র, প্রভৃতি স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলকে বাড়িয়ে তোলে। যদিও গৃহনির্মাণের পাশাপাশি প্রাসাদ, অট্টালিকা ও বিশেষতঃ নগর নির্মাণ পরিকল্পনাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। গৃহনির্মাণ প্রসঙ্গে চিত্র অংকন পদ্ধতিরও আলোচনা দৃষ্ট হয়। এই গ্রন্থে প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতি যথেষ্ট আলোকপাত করেছে। এতদ্ব্যতীত ‘ঈশ্বরচন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয় কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ ‘যুক্তিকল্পতরু’ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাস্তুনির্মাণের আলোচনাই গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য।
বৃহৎসংহিতাও বাস্তুবিষয়ক গ্রন্থ। ১৩১৭ সালে প্রকাশিত হয়। উক্ত গ্রন্থে বরাহমিহির প্রাসাদের লক্ষণ নির্ণয় করেছেন। এছাড়াও প্রতিমা লক্ষণও আলোচিত হয়েছে।
আর্যাবর্তে যখন বিশ্বকর্মার পরিচালনায় বাস্তুতন্ত্র বিশেষ উন্নতিলাভ করছে ঠিক সেই সময়েই ময়দানব, নগ্নজিৎ ও শুক্রাচার্যের নেতৃত্বে অনার্য ধারার প্রবর্তন হয় দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন স্থানে। প্রাচীনকাল থেকেই দাক্ষিণাত্যে ময়দানবের একাধিপত্য লক্ষ্যণীয়। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘ময়মতম’ এবং নাগরাজ হয়গ্রীবের ‘পঞ্চরাত্রম’ নামক গ্রন্থের মধ্য দিয়ে অনার্য শিল্পী সুলভ মনোভাব এবং বাস্তুনিদর্শনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। পরবর্তী কালে উভয় শিল্পের পারস্পরিক মিশ্রণ বা সাংস্কৃতিক আদান প্রদানও ঘটেছিল। মৎস্যপুরাণে নগ্নজিৎ রচিত নগ্নজিৎ চিত্রলক্ষণের উল্লেখ রয়েছে। এই গ্রন্থ তিব্বতী থেকে ক্রমে ইংরাজী ও জার্মান ভাষায় অনুদিত হয়েছিল।
বৈদিক যুগ থেকেই বিভিন্ন রূপ শিল্পের চরম উৎকর্ষতা বিশেষ লক্ষ্যণীয়। স্বর্ণশিল্প, চর্মশিল্প, লৌহশিল্প, সূচীশিল্পের সাথে সাথে অস্ত্রশস্ত্র তৈরী এমনকি পোতনিৰ্মাণ, পূর্তনির্মাণ এই সবেরও দৃষ্টান্ত উল্লেখ্য। শ্বেতমুদ্রা, সুবর্ণমুদ্রা সে যুগের অহঙ্কার ছিল। স্বর্ণ ও অন্যান্য ধাতু গলিয়ে বহুবিধ শিল্পের কারিগরি বিদ্যাও সে যুগেরই আবিষ্কার। রথ নির্মাণও বৈদিক যুগের এক অনবদ্য শিল্প নিদর্শন। পূর্বেই বলা হয়েছে প্রাচীন পুরাণগুলিতে শিল্প শাস্ত্রের যথেষ্ট আলোচনা দৃষ্ট হয়। এই প্রসঙ্গে বলা-প্রয়োজন মৎস্যপুরাণ, অগ্নিপুরাণ ভবিষ্যৎপুরাণে, শিল্প শাস্ত্রের বহু বিষয় বিশেষ ভাবে স্থান পেয়েছে। দেবদেবীর মূর্ত্তির বিবরণ সহ প্রতিমালক্ষণ, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ ও কাশ্যপ সংহিতায় আলোচিত হয়েছে। ‘চিত্রসূত্র’ নামক অধ্যায়ে চিত্রবিদ্যা সক্রান্ত আলোচনাও দৃষ্ট হয়। পরিশেষে বলা প্রয়োজন আত্রেয় রচিত ‘প্রতিমা লক্ষণ’ বিশেষ প্রশংসিত।