চতুর্দশ অধ্যায় – দর্শন শাস্ত্র

চতুর্দশ অধ্যায় – দর্শন শাস্ত্র

জড় ও জীব জগতের চিরন্তন এক সংগ্রাম আছে। যা হল অস্তিত্ত্বের লড়াই। অর্থাৎ নিজ অস্তিত্ত্বকে টিকিয়ে রাখার লড়াই। জীবজগতের মধ্যে মানুষ ও মানুষ ভিন্ন প্রাণিগণের উভয়েরই বাঁচার তাগিদা লক্ষ্যণীয়। কিন্তু মনুষ্যেতর জীবের আছে কেবল জীববৃত্তি। অর্থাৎ ভোজন, শয়ন ও রমন। এই তিনের পরিতৃপ্তিই একমাত্র চাহিদা, কিন্তু মানুষের আছে জীববৃত্তি + বুদ্ধিবৃত্তি অর্থাৎ ভোজন-শয়ন-রমনের পরেও নিজেকে জানার তীব্র আকাঙ্খা। সে প্রতিটি বিষয়কে যাচাই করে নেয়। ভালো— মন্দ উচিৎ-আনুচিৎ বোধের দ্বারা কোন কিছু গ্রহণ বা বর্জন করে থাকে। প্রাচীনযুগে ভারতবর্ষের মানুষের নিকট প্রকৃতির অকৃপণদান হেতু তাকে নিছক উদর পূর্তির কথা চিন্তা করতে হত না। নিছক জৈবিক চাহিদা-গুলির জন্য তাদের মাথা ঘামাতে হত না। ফলে স্বাভাবিক বুদ্ধির বলে তাদের চিন্তা ছিল আমি কে? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি কিভাবে হল? এই বিশ্বের স্রষ্টা কে? অতএব মানুষ তার বুদ্ধির বলে একে একে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে প্রয়াসী হল। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে শতরূপে প্রকাশিত বিশ্বনিখিলকে নিজ মানসচক্ষে প্রত্যক্ষ করে আপন বুদ্ধির বলে তাকে ব্যাখ্যা করতে প্রয়াসী হল। মানব মনের অনন্ত জিজ্ঞাসার সমাধানে তত্ত্বজ্ঞানী ও সত্যানুসন্ধানীদের নিরলস প্রয়াস ক্রমশঃ জন্ম দিল দর্শন শাস্ত্রের।

দৃশ্ + অনট্ (কর্মবাচ্যে) করলে হয় দর্শন অর্থাৎ চোখে দেখা বা ‘চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ”। আমাদের ৫টি জ্ঞানেন্দ্রিয়—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক ও মন নামক অন্তরিন্দ্রিয় বর্তমান। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সন্নিকর্ষ ঘটলে যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাই ইন্দ্ৰিয়লদ্ধ জ্ঞান বা ‘চাক্ষুষজ্ঞান’। জ্ঞানকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে—প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শাব্দ। আবার দৃশ্ ধাতুর উত্তর করণ বাচ্যে অনট্ প্রত্যয় করলে হয় দর্শন, যার দ্বারা দর্শন শাস্ত্রের কথা বোঝায়। তত্ত্বদর্শন, জগৎ ও জীবের স্বরূপ উপলব্ধি। দার্শনিকের কাজই হল বাহ্যরূপের অন্তরালে যে যথার্থ রূপটি আছে তার অনুসন্ধান করা। ভারতীয় দর্শন হল গভীর আধ্যাত্মিকতার আধারে প্রতিষ্ঠিত। দর্শন শাস্ত্র হল প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদিগের প্রজ্ঞালব্ধ জ্ঞানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। পরমতত্ত্বের উপলব্ধি এবং সেই উপলব্ধির সাধনই হল এই শাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়।

আর্যসভ্যতার মূল ভিত্তি হল বেদ। বেদকে মূলতঃ দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। বেদ বিহিত কাজ কৰ্ম্ম অর্থাৎ যাগ যজ্ঞাদি, নানাবিধি, বিচার ইত্যাদি ব্যাখ্যাত হয়েছে—কর্মকাণ্ডে আর জ্ঞানকাণ্ডে, এই বিশ্বজগতের মূলীভূত কারণ মহান স্রষ্টার তত্ত্বানুসন্ধানে পরিপূর্ণ। মুক্তি কি? মুক্তির উপায় কি? এই সব প্রশ্নের সমাধানে বলা হয়েছে জ্ঞানই মুক্তির উপায়। ভারতীয় দর্শনের সাথে ধর্মের যোগ নিবিড়। কিন্তু ধর্মশব্দে এখানে নিছক পূজা পাঠ আচার নিষ্ঠার কথা না বুঝে আধ্যাত্মিক সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি যা মানুষকে মুক্তির পথ দেখায় তাই বুঝতে হবে। তাই যুগে যুগে মানুষের মধ্যে তার শুভ বুদ্ধিকে জাগিয়ে তুলে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটিয়ে বিভিন্ন কৌতূহলের যেমন—জগতের কর্তা কে? তার সাথে জগৎ এর সম্পর্ক কি? জীবন ও মৃত্যুর রহস্য কি? সৃষ্টির আদি রহস্য কি? এবং তার অন্তিম পরিণতিই বা কি? ইত্যাদি প্রশ্নের নিরসন কল্পে সত্যদ্রষ্টা মুনি ঋষিগণ বলেছেন—’আত্মানং বিদ্ধি’—অর্থাৎ নিজেকে জান। “তেন ত্যক্তেন ভূঞ্জিথা” ত্যাগের দ্বারা ভোগ কর। এই সকল চিন্তাই পরবর্তীকালে একে একে জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের।

ভারতীয় দর্শনকে আস্তিক ও নাস্তিক এই দুই প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। এক্ষণে সাধারণ মানুষের ধারণা বা বিশ্বাস, এইরূপ যে—ঈশ্বরের অস্তিত্বে যে বিশ্বাস করে সে আস্তিক। এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বে যে বিশ্বাস করে না সে নাস্তিক। এই মত গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সাংখ্য ও কর্ম মীমাংসা প্রবল নিরীশ্বরবাদী হয়েও আস্তিক দর্শন। সুতরাং দর্শন শাস্ত্রের আস্তিক ও নাস্তিক এই ধারণার অনুসারী নয়। বৈয়াকরণ পাণিনির মতে—’অস্তিনাস্তিদিষ্টংমতিঃ।’ ভট্টোজি দীক্ষিত উক্ত সূত্রের ব্যাখ্যায় লিখলেন—’অস্তি পরলোক ইত্যেবং মাতির্যস্য, স আস্তিকঃ। নাস্তীতি মতির্যস্য স নাস্তিকঃ’। অর্থাৎ যাঁরা মৃত্যুর পরেও পরলোকে বিশ্বাসী তারা আস্তিক। এবং যারা পরলোকে বিশ্বাস করেন না তারা নাস্তিক। কিন্তু এই মতও গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ জৈন ও বৌদ্ধদর্শন মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাসী। সেই অর্থে এই দুটি সম্প্রদায়ও আস্তিক হয়ে পড়বে। আমরা জানি এরা নাস্তিক গোষ্ঠীভুক্ত। মহামান্য মনু বলেছেন- ‘নাস্তিকো বেদনিন্দকরঃ’। অর্থাৎ বেদ বিরোধী বা বেদের প্রামাণ্যে যারা বিশ্বাস করেন না তারা হলেন নাস্তিক, অপরপক্ষে বেদের প্রামাণ্যে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁরা হলেন আস্তিক। এই মত অনুযায়ী—চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন এই তিন দর্শন ঘোরতর বেদ, বিরোধী, তন্মধ্যে বৌদ্ধ ও জৈন পরলোকে বিশ্বাসী। কিন্তু চার্বাক দর্শন বেদ, ঈশ্বর, পরলোক সকল বিষয়কে অগ্রাহ্য করে প্রবল ভাবে নাস্তিক বা নাস্তিক শিরোমণি বলাই শ্রেয়ঃ, অপরপক্ষে সাংখ্য, যোগ, বেদান্ত, ন্যায় বৈশেষিক ও মীমাংসা বেদের প্রামাণ্যকে স্বীকার করে বলে আস্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত। অতএব ছয়টি আস্তিকদর্শন ও তিনটি নাস্তিক দর্শন।

বেদের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—সেখানে পরলোক ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তা ঈশ্বর পরম্পরা অনুসারে দৃঢ়ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। আস্তিক দর্শনগুলি বৈদিক পরম্পরা ও মতবাদে আস্থাশীল, প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস ও ঈশ্বর-ভাবনায় নির্ভর করেই সকল প্রশ্নের সমাধানে প্রয়াসী হয়েছেন। অপরপক্ষে চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন প্রভৃতি নাস্তিক দর্শন সমুহে বেদের ঐতিহ্য ও ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব দৃঢ়তার সাথে খণ্ডিত হয়েছে। ভারতীয় দর্শনের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল ধর্ম ও মোক্ষ। অথবা ধর্মের সোপানে মোক্ষপ্রাপ্তি এইভাবে বলাই শ্রেয়। জন্মান্তরবাদ আত্মার অবিনশ্বরতার উপরে প্রতিষ্ঠিত। আত্মার জন্মও নাই মৃত্যুও নাই। দেহকে আশ্রয় করে থাকে মাত্র। এক দেহ থেকে অন্য দেহ পরিগ্রহ করে। গীতায় বলা হয়েছে “ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।” যা ছেদন করা যায় না, দগ্ধও করা যায় না, তাই আত্মা। দেহীর মৃত্যু হলে, আত্মা কর্ম্মের ফল সমেত অন্যদেহকে আশ্রয় করে। সেই হেতু প্রাক্তন জন্মের কর্মফল ভোগ করতে হয়। বর্তমান জন্মে পূর্ব জন্মের ফল ভোগ করতে হয়। সেই সাথে এই জন্মের কর্মের ফল সঞ্চিত হয়, এইভাবে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ সম্ভবপর হয়। মানুষ কর্মে প্রবৃত্ত হয়। তার কারণ অজ্ঞান বা অবিদ্যা। আত্মার বিশুদ্ধ জ্ঞান ব্যতীত কর্ম থেকে নিবৃত্তি নেই, কামনা, বাসনা থেকেই মানুষ কর্মে প্রবৃত্ত হয়। এই কর্মস্রোত অবিরাম ধারায় চলতে থাকে। এই কর্মবন্ধন থেকে নিবৃত্তিই হল মুক্তি। আবার মুক্তির পথ প্রদর্শকই হল বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়গুলি। জীবনের দুঃখ ও আশান্তিতে বিচলিত মানুষ ক্রমশঃ চিন্তাকরতে শিখেছে এই দুঃখের মূল কোথায়? জীবনের অর্থ কি? এবং কিভাবে এই দুঃখের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই দর্শনের জন্ম। তাই বলে ভারতীয় দর্শনকে নৈরাশ্যবাদী (Pessimist) ভাবা ঠিক নয়। কারণ এগুলি দর্শন শাস্ত্রের শেষ কথা নয়। দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে। তার থেকে নিষ্কৃতি আছে এবং নিষ্কৃতি লাভের উপায় ও আছে। এই সবই দর্শনশাস্ত্রে স্বীকৃত। অতএব ভারতীয় দর্শন অবশ্যই আশাবাদী (Optimist).

পাশ্চাত্য দর্শনের বিষয় ভারতীয় দর্শন অপেক্ষা ভিন্ন। ইংরাজী Philos শব্দের অর্থ অনুরাগ এবং Sophia শব্দের অর্থ জ্ঞান বা Knowledge অতএব Philosophy শব্দের অর্থ দ্বারায় জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা Love of knowledge. কিন্তু পূর্বের আলোচনাক্রমে একথাই প্রতিপাদিত হয়েছে যে ভারতীয় দর্শন কেবলমাত্র জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ নয়। সেখানে তত্ত্বের অনুসন্ধান ও জীবনে সত্যের উপলব্ধিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

পাশ্চাত্য দর্শনের আলোচ্য বিষয়গুলি হল জ্ঞানবিদ্যা (Epistemology), অধিবিদ্যা (Metaphysics), যুক্তিবিদ্যা (Logic) নীতিবিদ্যা (Ethics), সৌন্দর্যবিদ্যা (Aes- thetics) ও সমাজবিদ্যা (Sociology)। কিন্তু ভারতীয় দর্শনে ভিন্ন ভিন্ন প্রস্থান অনুসারে কর্ম, ভক্তি, ও জ্ঞানের পথেই আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি হেতু যে পরম নিঃশ্রেয়স প্রাপ্তি, তাই মোক্ষ। এই মোক্ষ প্রাপ্তির উপায়ের সন্ধান করেছেন সকল দার্শনিক সম্প্রদায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ভঙ্গির মধ্যে পার্থক্যও বর্তমান। কেবল মতামতের পার্থক্য বা পথের ভিন্নতা হেতু পরস্পরের মধ্যে কোন বিরূপ মনোভাব বা বিদ্বেষ ছিল না। উপরন্তু একে অপরের মত ধীর স্থির ভাবে শুনে তা বিচার বিশ্লেষণ পূর্বক খণ্ডন করে তবে নিজের মত প্রকাশ করতেন। গায়ের জোরে নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করার ইতিহাস দেখা যায় না। নিজমত প্রতিষ্ঠার পূর্বে, প্রচলিত অন্যান্য মতামতকে অর্থাৎ ‘পূর্বপক্ষ’কে যথাযথ যুক্তির বলে সেই মতের নিরসন করাকে বলে ‘খণ্ডন’ এবং অতঃপর নিজমত স্থাপন করাকে বলে ‘উত্তরপক্ষ’ বা ‘সিদ্ধান্ত পক্ষ’। সেহেতু কোন একটি দর্শনাশাস্ত্র পাঠে প্রচলিত অন্যান্য দর্শনের সম্বন্ধে একটা জ্ঞান জন্মে। সর্বোপরি ভারতীয় দার্শনিকেরা যথেষ্ট উদার পন্থী ছিলেন তাদের মতে সকলেরই স্বাধীনভাবে চিন্তা করার অধিকার আছে। এবং নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠারও অধিকার রয়েছে। এইরূপ উদার ও উন্মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গীর আধারেই ভারতীয় দর্শনের আলোচন।।

সাংখ্য

মহর্ষি কপিল প্রণীত ‘সাংখ্যসূত্র’ সাংখ্য দর্শনের আদিগ্রন্থ। সাংখ্য শব্দটি সংখ্যা থেকে উদ্ভূত। যার সার অর্থ পরিসংখ্যান।` সাংখ্য শব্দের অর্থ সম্যকজ্ঞান। যে দর্শনে সম্যক্ জ্ঞানের স্বরূপ আলোচিত হয়েছে বা যে দর্শন পড়লে সম্যক জ্ঞান লাভ হয় তাকেই সাংখ্যদর্শন বলা হয়। সাংখ্য-সূত্র সংক্ষিপ্ত হওয়ায় গ্রন্থকার নিজেই তার বিস্তারিত রূপ দান করেন সাংখ্য-প্রবচনসূত্র নামে। শ্রুতি স্মৃতি, ও পুরাণ প্রভৃতির উপর সাংখ্যের প্রভাব বিশেষ লক্ষ্যণীয়। এই দর্শনের প্রবক্তা কপিলমুনি সম্পর্কে বহু মতভেদ বর্তমান। অন্যান্য দর্শন শাস্ত্রের ন্যায় সাংখ্যের কোন প্রামান্য গ্রন্থ পাওয়া যায় না। যোগদর্শনের তথ্য অনুযায়ী কপিল মুনি কৈবল্য লাভ করে কারুণ্যবশে শিষ্য আসুরির জিজ্ঞাসার নিরসনে সাংখ্যতত্ত্ব উদ্ঘাটন করেছিলেন। ক্রমে আসুরি তার শিষ্য পঞ্চশিখের নিকট প্রকাশ করলে পঞ্চশিখ সাংখ্যবিদ্যার বহুরূপে ব্যাখ্যা করেন। কালক্রমে শিষ্য পরম্পরায় তা বিস্তার লাভ করে। বিজ্ঞান ভিক্ষুও গ্রন্থটি কপিলের বলে স্বীকার করেছেন কিন্তু অনেকের মতে ইনি দ্বিতীয় কপিল। কারও মতে অন্য কোন অর্বাচীন গ্রন্থকার উক্ত গ্রন্থ রচনা করে।মহর্ষি কপিলের নামে প্রচার করেছেন। তবে আদিকপিল রূপে যাকে স্থির করা হয়েছে তাঁর সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। সাংখ্যদর্শনের প্রবক্তা এই মুনি কর্দমমুনির পুত্র। কেউ বলেন ধর্মহিংসার পুত্র, ভাগবত পুরাণ অনুসারে ইনি মগধবংশধ্বংসকারী মহর্ষি কপিল।

সাংখ্যদর্শন মূলতঃ দ্বৈতবাদী। সৃষ্টির মূলে রয়েছে পুরুষ ও প্রকৃতি। এই অভিমত পোষণ করে পুরুষ ও প্রকৃতির ব্যাখ্যায় ব্যাপৃত থেকে তারা মুক্তিলাভের উপায় প্রতিপাদন করেছেন। পুরুষ অনাদি। আত্মাকেই পুরুষ নামে অভিহিত করা হয়েছে। পুরুষ নিত্য, নির্বিকার, নির্গুণ আপনা হতেই প্রকাশমান ও চৈতন্য স্বরূপ। শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত স্বভাবের এই পুরুষ এক নয় বহু। প্রকৃতি হল পুরুষের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। সৃষ্টির মূলে সাংখ্যদর্শন প্রকৃতি ও পুরুষের সম্মিলিত শক্তির পক্ষে মত প্রকাশ করেছে। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনে যে সংক্ষোভের সৃষ্টি হয় তার ফলেই ক্রমে পঞ্চমহাভূতের সৃষ্টি সম্ভবপর হয়। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই গুণত্রয়ের সমন্বয় সাধিত হলে প্রকৃতিতে সাম্যাবস্থা আসে। তখনই প্রকৃতি ও পুরুষের মধ্যে সংক্ষোভ বা বিক্ষোভ ঘটে, যার ফল শ্রুতিই হল এই বিশ্বজগৎ। পুরুষের কোন ক্রিয়া বা পরিবর্তন নাই। পুরুষ কোন কিছুর কারণও নয়, আবার কোন কিছুর কার্যও নয়। আবার প্রকৃতির ধর্ম যেহেতু জড়ত্ব, সেইহেতু একাকী প্রকৃতি সৃষ্টির কারণও হতে পারবে না। অতএব প্রকৃতির সাথে পুরুষের সংযোগেই সৃষ্টি সম্ভব।

জীব বলতে এখানে ব্যবহারিক পুরুষকে এবং পুরুষ বলতে পারমার্থিক পুরুষকে বুঝানো হয়েছে। জীব কর্তা এবং ভোক্তা, কিন্তু পারমার্থিক পুরুষ কর্তাও নয় ভোক্তাও নয়। তাঁরা সৃষ্টির কারণ হিসাবে ঈশ্বরকে স্বীকার করেন নি। তাঁদের মতে সৃষ্টি করতে গেলে কারণের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, যেহেতু ঈশ্বর পরিবর্তন সাপেক্ষ নয়, সেহেতু তাঁকে সৃষ্টির কারণ বলা চলে না। কার্য ও কারণের সম্পর্ক নির্ণয় করতে গিয়ে দর্শনগুলির তিনটি প্রধান বিভাগ লক্ষ্যণীয়। আরম্ভবাদ, পরিনামবাদ, ও বিবৰ্ত্তবাদ। সাংখ্য ও যোগ পরিণামবাদী। এদের মতে কার্য্য কারণের রূপান্তর মাত্র। বৃষ্টি মেঘের রূপান্তর, দধি দুগ্ধের অবস্থান্তরমাত্র।

পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে মুক্তি লাভই সকল ভারতীয় দর্শনের সার কথা। সাংখ্য দর্শনে এই মুক্তিই ‘অপবগ’, ‘পুরুষার্থ’, ‘কৈবল্য’ ইত্যাদি নামে ব্যাখ্যাত হয়েছে। সকলজীবের দুঃখ কষ্ট আছে। এই দুঃখের মূল কারণ রূপে অজ্ঞান বা অবিদ্যা সর্বত্র স্বীকৃত। আধ্যাত্মিক আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক এই ত্রিবিধ দুঃখের হাত থেকে জীবন নিস্কৃতি চায়। অতএব তত্ত্বজ্ঞান দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায়স্বরূপ। সাংখ্য মতে ইহ জীবনেই তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা অপবর্গ লাভের নাম ‘জীবন্মুক্তি’, আর পরজীবনে অপবর্গ লাভের নাম ‘বিদেহমুক্তি’।

কপিলের সাংখ্য দর্শনই প্রাচীনতম দর্শন। অন্যান্য দর্শনশাস্ত্র বিশেষতঃ জৈন ও বৌদ্ধদর্শনের মধ্যে সাংখ্যের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কপিলের সাংখ্যসূত্র এবং সাংখ্য- প্রবচন সূত্র-এর পরে পঞ্চ-শিখাচার্যের পুত্র ঈশ্বরকৃষ্ণ রচিত ‘সংখ্যাকারিকা’ উল্লেখযোগ্য। এই গ্রন্থ সাংখ্য সপ্ততি বা সুবর্ণ সপ্ততি নামেও পরিচিত ছিল।

৭০টি আর্য্যা ছিল বলে ‘সপ্ততি’ বলা হত। গৌড়পাদ ভাষ্যে ঐ গ্রন্থের ভাষ্য পাওয়া যায়। নারায়ণতীর্থ রচিত সাংখ্যচন্দ্রিকা নামক টীকা পাওয়া যায় ১৭শ শতাব্দীতে, যা হল গৌড়পাদভাষ্যের উপরে রচিত। ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ নামে সাংখ্যকারিকার উল্লেখ রয়েছে। খ্রিঃ নবমশতকে পণ্ডিত বাচস্পতি মিশ্র ঐ গ্রন্থের প্রণেতা। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য প্রণীত ‘সাংখ্য কৌমুদী’ সাংখ্যদর্শনের অপর এক গ্রন্থ। তত্ত্বসমাস নামক গ্রন্থ সাংখ্য শাস্ত্রের প্রাচীন গ্রন্থ। ম্যাক্সমুলার এর মতে তত্ত্বসমাস সাংখ্য কারিকারও পূর্ববর্তী। বিজ্ঞানভিক্ষু মনে করেন সাংখ্যসূত্রকার কপিলমুনিই উক্ত গ্রন্থের রচয়িতা। তবে তত্ত্বসমাসের রচনাকাল ও গ্রন্থকার বিষয়ে মতভেদ থাকলেও গ্রন্থখানি অতিপ্রাচীন এবং সাংখ্যদর্শনের উল্লেখযোগ্য, গ্রন্থ। এতদ্ব্যতীত কবিরাজ প্রণীত ‘সাংখ্যতত্ত্ব প্রদীপ’, সীমানন্দকৃত সাংখ্যতত্ত্ববিবেচনা এবং বিজ্ঞানভিক্ষু রচিত সাংখ্যসাব উল্লেখের দাবী-রাখে। মাধবাচার্য তাঁর সর্ব্বদর্শন সংগ্রহ নামক গ্রন্থে সাংখ্যদর্শনের সংক্ষিপ্ত অথচ সারগর্ভ আলোচনা করেছেন।

যোগ দর্শন

মহর্ষি পতঞ্জলি যোগদর্শনের প্রণেতা। পতঞ্জলি প্রণীত যোগসূত্র এই দর্শনের আকর গ্রন্থ। পতঞ্জলির নামানুসারে এর অপর নাম পাতঞ্জল দর্শন। তিনি ৪র্থ শতকে বিদ্যমান ছিলেন। ন্যায়-বৈশিষিক দর্শনের মতই সাংখ্য যোগও সম্মিলিত দর্শন। সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বরের স্থান নেই। সেইহেতু সাংখ্য নিরীশ্বরবাদী কিন্তু যোগদর্শন সাংখ্যদর্শনের সাথে থাকা সত্ত্বেও ঈশ্বরতত্ত্বে বিশ্বাসী হওয়ায় সেশ্বরবাদী। অথর্ব বেদে যোগের বীজ নিহিত ছিল বলা যায়। পরবর্তীকালেও মহাভারত ও ভাগবদ্‌গীতায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত যোগের আলোচনা দৃষ্ট হয়। গৌতমবুদ্ধ স্বয়ং উক্ত শাস্ত্রের বলে তপস্যা করতেন কিন্তু বুদ্ধের সময়ে যোগের কোন গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায় না। সাংখ্যের পঞ্চবিংশতি তত্ত্বও যোগ স্বীকার করে, সাংখ্যদর্শনে তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান জাগ্রত হলে তবেই অবিদ্যা দূরীভূত হয় ও মুক্তি লাভ ঘটে। যোগ দর্শনে এই বিবেক জ্ঞান একমাত্র যোগাভ্যাসের দ্বারাই সম্ভব। যোগযুক্ত আত্মাই অবিদ্যাকে দূর করতে পারে। তাঁদের মতে চিত্তের সকলপ্রকার বৃত্তির নিরোধের নাম যোগ। চিত্তকে পার্থিব সকল বিষয় থেকে নিবৃত্ত করে সমাধিতে চিত্তের সকল বৃত্তির নীরোধ হলে তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয়। পূর্বেই বলা হয়েছে যে যোগেরও মূল লক্ষ্য মুক্তি বা জীবের দুঃখের মূলোচ্ছেদ। অতএব চিত্ত নিরোধের দ্বারাই পঞ্চক্লেশ ও কর্মের বন্ধন থেকে জীবমুক্তি লাভ করে। যোগদর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকৃত হয়েছে। ঈশ্বর অনাদি, সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ এবং নির্দোষ। কিন্তু ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টির কর্তা নন। ঈশ্বরের সাধনা করলে অবিদ্যা দূর হয় না বা জীবের মুক্তি লাভ সম্ভব নয়। ঈশ্বর সাধনা কৈবল্য প্রাপ্তির হেতু নয়। প্রকৃতি পুরুষে : বিবেকই মুক্তির কারণ।

চিত্তবৃত্তির পাঁচটি বিভিন্নস্তর রয়েছে-যেমন——–ক্ষিপ্ত, মূঢ়, বিক্ষিপ্ত, একাগ্র, নিরুদ্ধ। মিলিত ভাবে ‘চিত্তভূমি’ বলা হয়। এর মধ্যে ক্ষিপ্ত, মূঢ় ও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় যোগ সম্ভব নয় কিন্তু একাগ্র ও নিরুদ্ধ স্তরে যোগ সম্ভব হয়। যোগের আছে আটটি মার্গ— একত্রে ‘যোগাঙ্গ’ বলা হয়। যথাক্রমে— যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি। যোগাভ্যাসের দ্বারা চিত্তের মালিন্য দূর হয়, স্থির হয়, অতঃপর বিবেকজ্ঞান লাভ হয়। পাতঞ্জল দর্শনে পরিণাম দুঃখ, তাপদুঃখ ও সংস্কার দুঃখ বলে যে ত্রিবিধ দুঃখের কথা বলা হয়েছে তার কারণেই জগৎ ও জীবন দুঃখময়। সেই দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় স্বরূপ যোগ সাধনা কর্তব্য। যোগশাস্ত্রকার পতঞ্জলি নির্দেশিত আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির পথ সকল দর্শন সম্প্রদায়গুলিই শ্রদ্ধার সাথে অনুভব করেছে।

যোদর্শনের প্রামাণ্যগ্রন্থ যোগসূত্ৰেব [৭] মহর্ষি বেদব্যাস ভাষ্য রচনা করেছেন ব্যাসভাষ্য উক্ত ভাষ্যের উপরে বিজ্ঞান ভিক্ষুর যোগবার্ত্তিক এবং বাচস্পতি মিশ্রের-তত্ত্ববৈশারদী’, জ্ঞানানন্দের যোগসূত্রবৃত্তি। রাঘবানন্দকৃত ‘পাতঞ্জল রহস্য’ রামানুজের ‘যোগ সূত্রভাষ্য, ‘ রামানন্দসরস্বতীর ‘যোগমণি প্রভা’, যোগদর্শনের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

ন্যায় দর্শন

ন্যায়দর্শনের প্রবক্তা হলেন মহর্ষি গৌতম। তিনি গোতম, মেধাতিথি ও অক্ষপাদ[৮] নামেও পরিচিত ছিলেন। সেইহেতু ন্যায়দর্শনের অপর নাম অক্ষপাদ দর্শন। স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী ইনিই হলেন অহল্যাপতি গৌতমমুনি। গৌতম ও অক্ষপাদ একই ব্যক্তি কিনা এই নিয়েও প্রচুর মতভেদ রয়েছে। কারণ ন্যায়শাস্ত্রের প্রাচীন অংশ আনুমানিক ৫৫০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে গৌতমমুনির রচনা। কিন্তু এর পরবর্তী বা নূতন অংশ অক্ষপাদ রচনা করেন ১৫০ খ্রিষ্টাব্দে, সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণের এই মত অবশ্য অধ্যাপক দাসগুপ্ত প্রমুখেরা সমর্থন করেন না। এই কথা বলা যায় যে অন্যান্য দর্শনের স্রষ্টাদের মতই- সুপ্রাচীন কালের এই দার্শনিক গৌতম মুনিরও স্পষ্ট ও স্বচ্ছ পরিচয় মেলে না। যদিও বেদের যুগেই এই ন্যায়দর্শনের চর্চা বহুক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু সে সময়ে কোন সুনির্দিষ্ট গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায় না। সেদিক থেকে বিচার করতে গেলে ন্যায়শাস্ত্রের বক্তব্যকে সূত্রাকারে গ্রথিত করেন প্রথম গৌতমমুনি তাঁর ন্যায়সূত্র নামক গ্রন্থে।

‘নীয়তে অনেন ইতি ন্যায’। ন্যায় কথাটির বহু ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যুক্তি তর্কের দ্বারা বিশেষ বিচার পূর্বক অপরপক্ষকে বোঝানোর যে পদ্ধতি তাকেও ন্যায় বলা যায়। ন্যায়শাস্ত্র তর্কবিদ্যা বা বাদবিদ্যা নামেও অভিহিত। এর অপর নাম আন্বীক্ষিকী। অনু অর্থাৎ পশ্চাৎ এবং ঈক্ষণ অর্থে দর্শন। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ইত্যাদির দ্বারা যে জ্ঞান লাভ হয়, পরে তার ব্যাখ্যা বা বিচার বিশ্লেষণ করা হয় যে শাস্ত্রে তাই আন্বীক্ষিকী বিদ্যা। ন্যায়দর্শনের অপর নাম প্রমাণ শাস্ত্র, “প্রমাণৈরর্থপরীক্ষণং ন্যায়ঃ।”

বলিষ্ঠ যুক্তি ও তর্কবিদ্যার উপরে প্রতিষ্ঠিত এই শাস্ত্রে জ্ঞানের প্রমাণ হিসাবে চারটি বিষয় (হল) প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শাব্দ।[৯] পঞ্চইন্দ্রিয় বা বহিরিন্দ্রিয় যথা চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা ও ত্বক। তার সাথে অন্তরিন্দ্রিয় বা মন, সুখ দুঃখের অনুভূতি অন্তরিন্দ্রিয়ের বিষয়। আমরা জানি যে ইন্দ্রিয়ের সাথে বিষয়ের সংযোগে প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয়। অনুমান হল কোন বিশেষ লক্ষণের দ্বারা বিষয়ের জ্ঞান যেমন— ধূম দেখে সেখানে অগ্নির অনুমান করা। অর্থাৎ পূর্বের জ্ঞান আছে যে যেখানে যেখানে ধূম থাকে সেখানে সেখানে অবশ্যই অগ্নি থাকে। আবার জ্ঞাত কোন বিষয়ের সঙ্গে অজ্ঞাত কোন বিষয়ের সাদৃশ্য হেতু যে জ্ঞান জন্মে তাকে উপমান প্রমাণ বলে। যথা-গবয়ঃ গোসদৃশঃ। আত্মবাক্য বা শাস্ত্রবাক্য থেকে যে জ্ঞান জন্মায় তাকে শব্দপ্ৰমাণ বলে। যেমন দু’ভাগ হাইড্রোজেন ও একভাগ অক্সিজেন মিলে জল হয় একথা বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে শোনা। অতএব এই চার প্রকার জ্ঞান আমাদের জন্মে। নৈয়ায়ি কেরা বস্তুবাদী এবং বস্তুবাদ অনুযায়ী বিভিন্নবস্তুর জ্ঞাননিরপেক্ষ অস্তিত্ত্ব স্বীকৃত। ন্যায়মতে জ্ঞানের কাজ হল বস্তুর স্বরূপকে প্রকাশ করা। তাঁদের মতে একটি বিশেষ কার্যের একটিই বিশেষ কারণ বর্তমান।

দর্শনশাস্ত্রের ভূমিকাতেই আমরা জেনেছি যে ভারতীয় দর্শনের চরম লক্ষ্য হল মোক্ষলাভ। সকল দর্শন শাস্ত্রগুলি তাদের প্রদর্শিত পথকেই মুক্তির উপায় স্বরূপ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। ন্যায়মতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিই মুক্তি বা অপবর্গ। ‘বাধলক্ষণং দুঃখম’,—১।১।২১, আবার ‘তদত্যন্ত বিমোক্ষোহপবর্গঃ’ ১।১। ২২ এখানে প্রমাণ গুলি দ্বারা জ্ঞান হলে, সেই জ্ঞান যখন বস্তুর স্বরূপকে প্রকাশিত করতে সক্ষম হয়, তখনই অত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা জীবের মোক্ষলাভ সম্ভব। ন্যায়-দর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাসী। আবার আত্মা হল একটি দ্রব্য যা শাশ্বত। সর্বব্যাপী জীবাত্মা বহু যা প্রতি শরীরে বর্তমান, কিন্তু পরমাত্মা এক। জ্ঞানের অধিকরণকে আত্মা বলা হয়েছে। ঈশ্বর এই জগৎকে সৃষ্টি করেছেন কিন্তু তিনি হলেন জীবের কর্মফল দাতা, ও র্যাৎ জীব যে কর্ম করে সেই কর্মফল, পাপ-পূণ্য ইত্যাদির ভোগ ঈশ্বরই নির্দিষ্ট করে থাকেন, বা তিনিই জীবের কর্মফলদাতা। জীবের মঙ্গলের জন্যই ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর মূল্যবান উপস্থিতিই মানবশৃঙ্খলকে প্রেম ও শাসনে বদ্ধ করে তাঁদের তত্ত্বজ্ঞান জন্মাতে সাহায্য করে এবং এই ভাবেই মুক্তি বা নির্বাণ লাভ ন্যায় দর্শনের উদ্দেশ্য।

গৌতম প্রণীত ন্যায়সূত্রের ৫টি অধ্যায়, প্রতি অধ্যায়ে ২টি আহ্নিক, সূত্ৰ সংখ্যা ৫২৮-৫৩৮। বাৎস্যায়ন রচিত বাৎস্যায়ন ভাষ্যই ন্যায় সূত্রের প্রাচীনতম ভাষ্য। আনুমানিক খ্রিঃ তৃতীয় শতকে। ন্যায়সূত্র—ভাষ্যের টীকা রচনা করেছেন উদ্যোতকর, তার নাম ন্যায়বার্তিক। ন্যায়বার্তিক ন্যায়শাস্ত্রের একটি উল্লেখ যোগ্য প্রাচীনতম গ্রন্থ। ন্যায়বার্তিকের উপরে টীকা রচনা করেছেন আচার্য বাচস্পতি মিশ্র খ্রিঃ নবম শতকে ন্যায়বার্ত্তিক তাৎপর্য নামে। এছাড়াও ন্যায়সূচীনিবন্ধ, ন্যায় সূত্রোদ্বার ও তত্ত্ববিন্দু নামক গ্রন্থগুলি বাচস্পতি মিশ্র মহাশয়ের সর্ববিদ্যায় পরদর্শিতা ও সুগভীর পাণ্ডিত্যের নিদর্শন বহন করে। কাশ্মীরী পণ্ডিত ও নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের রচনা ন্যায়মঞ্জরী এক অনন্যসাধারণ গ্রন্থ। কথিত আছে কারাবাসে থেকে তিনি এই গ্রন্থ রচনাকরেন। ৯৯১ খ্রিঃ বঙ্গ দেশীয় নৈয়ায়িক শ্রীধর আচার্য ন্যায়কন্দলী রচনা করেন। শ্রীধরাচার্য বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত দর্শনেরও গ্রন্থ প্রণেতা। মিথিলার উদয়ন আচার্যের বিখ্যাত গ্রন্থ ন্যায়কুসুমাঞ্জলি। এই গ্রন্থে তিনি সুচারুরূপে নাস্তিক মত খণ্ডন পূর্বক ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত করেছেন।

উদয়ন আচার্যের আরও বহু গ্রন্থ যেমন-কিরণাবলী, আত্মতত্ত্ববিবেক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিপুল আয়তনের ন্যায়শাস্ত্রকে প্রাচীন ন্যায় ও নব্য ন্যায় দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক্ষণে নব্যনৈয়ায়িকদিগের মধ্যে আদি আচার্যরূপে মৈথিলী গঙ্গেশ উপাধ্যায়কে গুরু মান্য করা হয়। তাঁর তত্ত্বচিন্তামণি এক নবযুগের সূচনা করেছিল বললে অত্যুক্তি হয় না। আলোচ্য গ্রন্থের টীকাকারগণের মধ্যে তৎপুত্র বর্ধমান উপাধ্যায। বহু টীকা তিনি রচনা করেছেন। যেমন মণিপ্রকাশ, কুসুমাঞ্জলি প্রকাশ, লীলাবতী প্রকাশ, ন্যায়-পরিশিষ্ট ইত্যাদি। গঙ্গেশের তত্ত্বচিত্তামণি তৎপরবর্তীকালের কয়েকশতক বাংলাদেশ ও মিথিলার নব্যনৈয়ায়িকদের নিকট ন্যায় চর্চার আকরগ্রন্থ হিসাবে সমাদৃত ছিল। এছাড়াও শঙ্করমিশ্র, পক্ষধর মিশ্র, ভগীরথঠক্কুর, যজ্ঞপতি উপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস সার্বভৌম, নরহরি উপাধ্যায় রুচিদত্ত মিশ্র, বাসুদেব সার্বভৌম, . রঘুনাথ শিরোমণি প্রমুখেরা ন্যায়শাস্ত্রের চর্চাকে পণ্ডিতদিগের সমক্ষে দক্ষতার সাথে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিশ্বনাথের ন্যায়কারিকা ও সিদ্ধান্ত মুক্তাবলী সহ ভাষা পরিচ্ছেদ বহুল পঠিত একটি গ্রন্থ। অন্নংভট্টের তর্কসংগ্রহ তর্কশাস্ত্রের একটি আকরগ্রন্থ। একথা স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই যে-নব্য ন্যায়ের চর্চার আলোকে প্রাচীন ন্যায় অনেকাংশে মলিন হয়ে পড়েছিল।

বৈশেষিক দর্শন

বৈশেষিক দর্শনের প্রবক্তা মহর্ষি কণাদ। ক্ষুৎকণা সংগ্রহ করে জীবন নির্বাহ করতেন বলে তাঁর এই নাম। মহর্ষি কণাদের প্রকৃত নাম উলুক, সেই কারণে উক্ত দর্শনশাস্ত্র ঔলুক্যদর্শন নাম পরিচিত। মহর্ষি প্রণীত বৈশেষিক সূত্র এই দর্শনের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ। ৩৭০টি সূত্র সম্বলিত গ্রন্থটি ২০টি আহ্নিকে ও ১০টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। বৈশষিক দর্শন আরম্ভবাদী। ন্যায় বৈশেষিক দর্শনে পরস্পর সমানতন্ত্রতা লক্ষ্যণীয়। বহু ক্ষেত্রেই এই দুই দর্শন একমত, দু’একটি বিষয়ের ধারণাব্যতীত। উভয়েরই লক্ষ্য জীবের মুক্তি। উভয়েই মনে করেন অজ্ঞানই হল জীবের দুঃখের কারণ বা বন্ধন। এবং তত্ত্বজ্ঞানই মুক্তি লাভের একমাত্র উপায়।

প্রাচীন ন্যায় দর্শনে ষোলটি পদার্থ স্বীকৃত হলেও বৈশেষিকগণ মাত্র সাতটি পদার্থে বিশ্বাসী। যথাক্রমে—দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব। ‘বিশেষ’কে একটি স্বতন্ত্র পদার্থরূপে স্বীকার করে তদ্বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হেতু আলোচ্য দর্শনের নাম বৈশেষিক দর্শন। সূত্রে অভাবের উল্লেখ না করলেও মহর্ষি অভাবের আলোচনা করেছেন অন্যত্র, অতএব মহর্ষিকে সপ্তপদার্থী বলাই শ্রেয়।১° দ্রব্য নামক পদার্থটি আবার নয়টি—ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম, কাল দিক, আত্মা (দেহী, মন। বৈশেষিক দর্শনের আলোচনায় পরমাণুতত্ত্ব বিশেষ ভাবে স্থান পেয়েছে। অবিভক্ত বা অবিভাজ্য ক্ষুদ্রতম জড়কণাকে বলে পরমাণু, কিন্তু পরমাণু নিজে অকারণ অনুগুলি অনাদি ও শাশ্বত। আকাশ, দিক, কাল, শাশ্বত ও সর্বব্যাপী। মন সর্বব্যাপী নয় কিন্তু অনুবৎ সূক্ষ্ম। মনের সাহায্যে আত্মা সম্বন্ধীয় জ্ঞান জন্মায়। অণুসকল পরস্পর সংশ্লিষ্ট হয়ে পৃথিবীর সৃষ্টি করেছে। আবার বিশ্লিষ্ট হলে পরস্পর ধ্বংস হবে। বৈশেষিকদের মতে এই সংশ্লিষ্ট বা বিশ্লিষ্ট কোন ক্রিয়াই ঈশ্বরের ইচ্ছা ব্যতীত সম্ভব হয় না। জীবের অদৃষ্টে যেরূপ কর্ম ফল সঞ্চিত হয় তার উপরে ঈশ্বরের সৃজনমুখী প্ৰক্ৰিয়া নির্ভর করে। বৈশেষিকেরা জগৎসৃষ্টির কারণ রূপে ঈশ্বরকে অনুমান করে নিয়েছেন। মহর্ষি কণাদ তাঁর বৈশেষিক সূত্রে ঈশ্বর সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ আলোচনা করলেও, তিনি বেদকে অস্বীকার করেন নি। শঙ্কর মিশ্র আবার বেদের রচয়িতারূপে ঈশ্বরকে সমর্থন করেছেন।

বৈশেষিক দর্শনের আকরগ্রন্থ বৈশেষিক সূত্রের উপরে প্রশস্ত পাদাচার্যের পদার্থ ধর্ম্ম সংগ্রহ ভাষ্য রয়েছে। খুবসম্ভব খ্রিঃ ৬ষ্ঠ শতকের গ্রন্থ। অতঃপর ব্যোমশিবাচার্য্যের প্রশস্ত পাদাচার্য্য দশম শতাব্দীতে। উদয়নাচার্যই বৈশেষিক দর্শনকে বিশদ ভাবে ব্যাখ্যাকরেছেন। কিরণাবলী প্রকাশ বর্ধমানোপাধ্যায়ের, আবার দশম শতাব্দীতে রচিত শিবাদিত্যের সপ্তপদার্থী, উল্লেখযোগ্য। বঙ্গদেশীয় আচার্য শ্রীধর প্রশস্ত পাদাচার্য এর উপরে ন্যায়কন্দলী রচনা করেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজশেখর এই গ্রন্থের টীকা প্রণয়ন করেন ন্যায়কন্দলী পঞ্জিকা নামে। নবদ্বীপে ন্যায় ও বৈশেষিক উভয় দর্শনের চর্চাই হত। রঘুনাথ শিরোমণির “পদার্থখণ্ডন” অনন্যসাধারণ গ্রন্থ। জগদীশ তর্কালঙ্কার রচনা করেন প্রশস্ত পাদাচার্যের ‘সূক্তি’ নামক টিপ্পনী। বৈশেষিক ও ন্যায়দর্শনের মধ্যে অধিকাংশ মিল থাকায় বহুগ্রন্থে ন্যায় ও বৈশেষিকের একত্র আলোচনা স্থান পেয়েছে।

মীমাংসা দর্শন

বেদ মূলতঃ দুইটি ভাগে বিভক্ত। কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড। মহর্ষি জৈমিনি প্রতিষ্ঠিত মীমাংসা দর্শন বেদের কর্মকাণ্ডের উপরে প্রতিষ্ঠিত। কর্মকাণ্ডে বেদবিহিত যাগযজ্ঞাদি কর্মের নিয়ম কানুন বলা আছে। বেদের শেষ ভাগ আরণ্যক ও উপনিষদের বিষয় আলোচনা জ্ঞানকাণ্ডের বিষয়। মীমাংসা দর্শন দুটি ভাগে বিভক্ত। পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা। মীমাংসা কথার অর্থ উৎকৃষ্ট বিচার। শ্রুতি ও স্মৃতিবাক্যের মধ্যে পরস্পর অর্থ বিরোধ ঘটলে মীমাংসা দ্বারা তার সমাধান সম্ভব। বেদের ক্রিয়াকাণ্ডকে সমর্থন করাই জৈমিনীয় দর্শন বা পূর্বমীমাংসার কাজ। অর্থাৎ ‘মীমাংসাদর্শন’ বলতে বুঝায় বেদবিহিত কর্ম ও বেদ প্রতিপাদিত জ্ঞানের বিচার মূলক উৎকৃষ্ট শাস্ত্র। বেদের পূর্বভাগ অর্থাৎ—মন্ত্র, ঋক্, যজুঃ, সামন্। এই পূর্বভাগের দর্শনই পূর্বমীমাংসা। মন্ত্ৰ ব্রাহ্মণাত্মক বেদে প্রধানতঃ যাগযজ্ঞ প্রধান অগ্নি-উপাসনা মূলক কাজকর্মের আলোচনা পরিস্ফুট করাও এই দর্শনের কাজ। প্রাচীন ভারতীয় রাজতন্ত্র মূলক শাসনব্যবস্থায় ক্ষত্রিয় রাজন্যবর্গের উপর ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের প্রভাব ছিল লক্ষ্যণীয়। সেকালের পুরোহিতগণ যাগযজ্ঞাদি কর্মের মধ্য দিয়ে জীবের দুঃখ দুর্দশা রোধ করে স্বর্গপ্রাপ্তির কথা প্রচার করতেন। ক্রমে এই ধারণাই মীমাংসাদর্শনের জন্ম দেয়।

মীমাংসা দর্শন বেদের উপরে প্রতিষ্ঠিত হলেও ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে বা জগৎসৃষ্টির কর্তা হিসাবে ঈশ্বরের আস্তিত্ব মানে না। তাদের মতে বেদ হল অনাদি, অপৌরুষেয় ও অভ্রান্ত। এবং বেদবিহিত কর্ম হল ধর্ম, বেদ নিষিদ্ধ কর্ম হল অধর্ম। ধর্ম আচরণই যদি জীবের লক্ষণ হয় তাহলে বেদের বিধি মেনে চলাই জীবের একমাত্র কর্তব্য। মীমাংসা দর্শনেরও মূল লক্ষ্য জীবের সকলপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি। মীমাংসাদৰ্শনে বলা হয়েছে বেদের অনুসারী কাজকর্ম করতে হবে কোনরূপ ফলের আশা না করেই, শুধুমাত্র নিস্কাম ভাবে বেদের অনুসরণ করে গেলে জীব কর্ম বন্ধন থেকে মুক্তি পায় বা মোক্ষলাভ করে। আত্মা সম্পর্কে তাঁদের ধারণা হল যে-আত্মা নিত্য ও শাশ্বত কিন্তু আত্মা চেতনা যুক্ত নয়। আত্মা যখন দেহকে আশ্রয় করে, তখন আত্মার সাথে ইন্দ্রিয় সংযোগ ঘটলে তবেই আত্মা চৈতন্যযুক্ত হয়।

মীমাংসা দর্শনের প্রভাকর প্রতিষ্ঠিত যে শাখা তা ব্যাসশিষ্য জৈমিনি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। তৎকৃত গ্রন্থ দ্বাদশ অধ্যায়ে বিভক্ত হেতু “দ্বাদশ লক্ষণী” নামেও পরিচিত। সূত্রসংখ্যা প্রায় ২৭০০টি। মীমাংসা শাস্ত্রে ‘ধর্ম’ কথাটি কোন্ অর্থে ব্যবহৃত এবং ধর্মের তত্ত্ব নির্ণয়ই মীমাংসকগণের উদ্দেশ্য। কারণ মীমাংসা দর্শনের প্রথম সূত্রই হল অথাতো ধর্ম জিজ্ঞাসা- ১।১।১। সাধারণ ভাবে ধর্ম কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত কিন্তু মীমাংসা দর্শন বেদবিহিত কর্মকেই ধর্ম বলে ব্যাখ্যা করেছেন। স্বর্গলাভই জীবের পরম আকাঙ্খিত বস্তু। ধর্মাচরণই স্বর্গপ্রাপ্তি বা মুক্তিলাভের সোপান স্বরূপ। আলোচ্য মীমাংসা সূত্র ব্যতীত অপর কোন প্রামান্য গ্রন্থ কিন্তু পাওয়া যায় না। শবরস্বামী প্রণিত মীমাংসাভাষ্য প্রথম থেকে তৃতীয় খ্রিঃ মধ্যে রচিত হয়েছিল। শবর ভাষ্যের টীকাকার আচার্য কুমারিল ভট্ট। পরবর্তীকালে কুমারিল ভট্টের শিষ্য প্রভাকর মিশ্র শবরভাষ্যের দুটি টীকা রচনা করেছেন যা পূর্ব মীমাংসার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। কিন্তু ক্রমে এই দুই ভাষ্যকার প্রভাকর মিশ্র ও কুমারিল ভট্টের মধ্যে তর্ক তুমুলে ওঠে এবং যার ফলে দুটি পৃথক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। একটি প্রভাকর সম্প্রদায়, অপরটি ভাট্ট সম্প্রদায়।

জৈমিনীয় মতে জ্ঞানের প্রমান স্বরূপ—প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান স্বীকৃত। শাব্দ প্রমাণ ছিল সর্বাগ্রে, যেহেতু বেদ ছিল শব্দ প্রামাণ্যের পরম নিদর্শন। কিন্তু প্রভাকর মতে প্রমাণ পাঁচ প্রকার—প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শাব্দ, অর্থাপত্তি। কিন্তু ভাট্টমতে উক্ত পাঁচপ্রকার ছাড়াও অনুপলব্ধি স্বীকার্য। প্রভাকরের প্রধান ব্যাখ্যাকার হলেন শালিকনাথ’। তিনি “ প্রকরণ পঞ্জিকা” নামে গ্রন্থ রচনা করেন। মীমাংসার অপর নাম ন্যায়। কারণ সকলশাস্ত্রের তাৎপর্য উপলব্ধি হেতু শাস্ত্র বাক্যের বিবক্ষিত অর্থ এই শাস্ত্রের দ্বারা উপলব্ধি হয়। মীমাংসাগ্রন্থের নাম সেই হেতু ‘ন্যায়মালা’, ‘ন্যায়রত্নমালা’, ‘ন্যায়কণিকা’, বলে অভিহিত হয়েছে।

বেদান্ত দর্শন

বেদান্ত দর্শনের অপর নাম উত্তরমীমাংসা বা ব্রহ্মমীমাংসা। পর্ব মীমাংসাতে বেদের কর্মকাণ্ডের আলোচনা রয়েছে, এক্ষণে জ্ঞানকাণ্ডের উপরে প্রতিষ্ঠিত উত্তর মীমাংসা বা বেদান্তদর্শন। একে জ্ঞানমীমাংসাও বলা হয়। ব্রাহ্মণের শেষ ভাগে আরণ্যক ও আরণ্যকের শেষভাগ উপনিষৎ নামে পরিচিত। উপনিষদের অংশই বেদান্ত নামে পরিচিত, বেদের অন্তভাগ বলে বেদান্ত। সেখানে চরমবস্তু বা ব্রহ্মনির্ণয় রয়েছে। তাকে কেন্দ্র করে যে সকল গভীর চিন্তা ও তাদের পারস্পরিক সমন্বয় ঘটিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানই উত্তর মীমাংসার উদ্দেশ্য। বদরায়ণ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ব্রহ্মসূত্র রচনা করেন। এই কারণে ব্রহ্মসূত্রকে বাদরায়ণ সূত্র বা ব্যাসসূত্র বলা হয়। এই বেদব্যাসই বেদ বিভাজনের কর্তা, মহাভারত ও অষ্টাদশ পুরাণেরও রচয়িতা। এই গ্রন্থে তিনি উপনিষদের শিক্ষাগুলিকে নতুনরূপ দান করেছেন। আলোচ্য গ্রন্থে ৪টি অধ্যায় ১৬টি পাদ এবং ৫৫৫টি সূত্র বর্তমান। তন্মধ্যে ১৯২টি সূত্র অধিকার সূত্র। অবশিষ্ট ৩৬৩টি সূত্র গৌণ সূত্র। ব্রহ্মজিজ্ঞাসা অর্থাৎ কে এই ব্রহ্ম? যাঁর দ্বারা বিশ্বজগৎ এর সৃষ্টি স্থিতি ও লয় সংঘটিত হয় তাই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম হল বেদান্তদর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তাঁদের মতে জীব ও ব্রহ্ম পরস্পর অভিন্ন। ব্রহ্ম হল নির্গুণ। নির্বিশেষ নিরাকার ও নিস্ক্রিয়। অতএব তাঁকে জগতের কর্তা বলে স্বীকার করা যায় না। সংহারকও বলা যায় না। অতএব এই জগৎ সৎ বস্তু নয় মিথ্যা অবভাস মাত্র। মায়াশক্তির প্রভাবে স্বয়ং ব্রহ্মই জগৎরূপে প্রতিভাত হন। অবিদ্যা বশতঃ জীব এই জগৎকে প্রত্যক্ষ করে মাত্র। অবিদ্যা দূর হয়ে যখন তত্ত্বজ্ঞান জন্মে, জীব ব্রহ্মকেই একমাত্র সত্য বলে অনুভব করে থাকে ও জগৎ মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়। ব্রহ্ম অনন্তশক্তিধর সর্বজ্ঞ ও সর্বব্যাপী। সেই ব্রহ্মই আত্মা। যে শক্তি বলে ঈশ্বর এক হয়েও এই বিবিধ বৈচিত্র্যময় বর্ণাঢ্য জগতের সৃষ্টি করেছেন তাকেই বলে ‘মায়া’। সৃষ্টির বৈচিত্র্য ও বহুত্ব সত্য নয়, ভ্রম মাত্র, অজ্ঞান প্রসূত যে ভ্রম, তা অজ্ঞানতাহেতু, সেহেতু অজ্ঞান বা অবিদ্যা দূরীভূত হলেই জীব আর দৃশ্যমান জগৎ এর উপরে আস্থা রাখতে পারে না তখনই ব্রহ্মের জ্ঞান হয়। তখন ঈশ্বরই সব এবং একমাত্র। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এই প্রতীতি জন্মে। শঙ্করের মতে যে গুণ যুক্ত হয়ে ঈশ্বর এই প্রাতিভাসিক জগৎ তৈরী করেছেন, তা হল ‘সগুণ ব্রহ্ম”। এবং জগৎকে মিথ্যা জ্ঞান করলে যে ঈশ্বর থাকেন তিনিই হলেন “নির্গুণ ব্রহ্ম’। অতএব উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় অবিদ্যা দূরীভূত হলেই নির্গুণব্রহ্মের জ্ঞান জন্মে। ইন্দ্ৰিয় সংযম, অনাসক্তি, অনিত্যতাবোধ এবং মোক্ষের জন্য একান্ত আগ্রহ এই সবই নির্গুণ ব্রহ্মের জ্ঞানের সহায়ক। নির্গুণব্রহ্মের সাথে জীব একাত্মতা অনুভব করলে এইরূপ অনুভূতি জন্মে যে ‘সোহহং ব্রহ্ম অর্থাৎ আমিই ব্ৰহ্ম।

ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তদর্শন শঙ্করের মতে বিবর্ত্তবাদী। ব্রহ্মসূত্র-সাংখ্যমতের খণ্ডন করেছে, সেই সাথে অন্যান্য মতও খণ্ডিত হয়েছে। অদ্বৈততত্ত্ব উপনিষদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলেও তার স্বরূপ সম্পর্কে বহু মতভেদ ছিল। সেইহেতু পরবর্তীকালে দ্বৈত, অদ্বৈত প্রভৃতি একাধিক সম্প্রদায় জন্ম নেয়। ব্রহ্মসূত্রের পর অদ্বৈত প্রস্থানের প্রাচীনগ্রন্থ গৌড়পাদ প্রণীত মাণ্ডুক্য কারিকা, যা হল খ্রিষ্টীয় ৮ম শতকের প্রথমার্ধে রচিত। গৌড়পাদ শঙ্করাচার্যের গুরু ছিলেন। অদ্বৈত বেদান্তের প্রধানও সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তা হলেন ভারতীয় দর্শনের প্রাণপুরুষ আচার্য শঙ্কর। কেরলে নম্বুদ্রিব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত শঙ্করাচার্য মাত্র ৩২ বছর জীবিত ছিলেন। বিদগ্ধ পণ্ডিত, জ্ঞানী গুণীজন এবং তার্কিক ব্যক্তিগণ একবাক্যে শঙ্করাচার্যের অদ্ভুত ক্ষমতায় মুগ্ধ। পরবর্তীকালে তাঁর প্রদর্শিত পথে ভারতীয় আধ্যাত্ম সাধনার ইতিহাস বিচিত্র উদ্দীপনায় বহুমুখী ধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তিনি তাঁর আদর্শকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেশের চার প্রান্তে চারটি মঠ তৈরী করেছিলেন। তিনিই প্রথম ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করেন। এই শঙ্করভাষ্যকে অবলম্বন করে পরবর্তী দীর্ঘ কয়েক বৎসর বহু দার্শনিক এর টীকা টীপ্পনি রচনায় ও আলোচনায় ব্যাপৃত ছিলেন। তন্মধ্যে বাচস্পতি মিশ্রের ‘ডামতী’ টাকা বিখ্যাত। এছাড়া আনন্দগিরির ‘ভাষ্য ন্যায়নির্ণয’, শ্রীহর্ষের খণ্ডনখণ্ডখাদ্য, মধুসূদন সরস্বতীর ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ প্রভৃতি অদ্বৈতবেদান্তের প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহ। শঙ্করাচার্যই অদ্বৈত মতের প্রধান আচার্য। তিনি জীব ও ব্রহ্মে কোন অভেদ স্বীকার করেন নি। ‘তত্ত্বমসি’ এই মহাবাক্যের অভেদপক্ষে ব্যাখ্যা করায় তাঁহার মত অদ্বৈতবাদ নামে অভিহিত। আত্ম জ্ঞানলাভ হেতু চতুর্বিধ সাধনের প্রয়োজন নির্দিষ্ট রয়েছে (১) নিত্যানিত্যবস্তু বিবেক, (২) ইহামৃত ফল ভোগ বিরাগ, (৩) শমদমাদি সাধনসম্পৎ এবং (৪) মুমুক্ষুত্ব বা মোক্ষাভিলাষী হওয়া।

আচার্য রামানুজ বিশিষ্টাদ্বৈত বাদের প্রবর্তক। ব্রহ্মকে তিনি সবিশেষ বা বিশেষগুণযুক্ত বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে জীব ও জগৎ উভয়েরই সত্ত্বা বিদ্যমান। জীব ব্রহ্মেরই অংশ। অতএব ব্রহ্ম ও জীব কখনই অভিন্ন নয়, উহা ভিন্ন ভিন্ন। ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিই জীবের মুক্তির উপায় স্বরূপ। ঈশ্বরের নিকট আত্মসমর্পণ ব্যাতীত অবিদ্যা দূর হবে না। মোক্ষ লাভও সম্ভব নয়। সেইহেতু সাধারণ ঈশ্বর বিশ্বাসী মানবসম্প্রদায়ের নিকট এই মত অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়। রামানুজের ‘শ্রীভাষ্য’, ‘বেদার্থ সংগ্রহ’, ‘বেদাত্ত প্রদীপ’, ‘বেদান্ত তত্ত্বসাব প্ৰসিদ্ধ গ্রন্থ।

ভাস্করাচার্য ভেদাভেদ বা দ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রধান আচার্য ছিলেন। বহুপ্রাচীন কালে ঔডুলোমী এই মতাবলম্বী ছিলেন। ব্রহ্মসূত্রে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। ভাস্করাচার্য ছিলেন বাচস্পতি মিশ্র ও উদয়নাচার্যের পূর্ববর্তী। বাচস্পতিমিশ্র ভাস্করের মত খণ্ডন করেছেন। উদয়নাচার্য ও তার মত উদ্ধৃত করেছেন। ভাস্করাচার্য মনে করতেন বদ্ধাবস্থায় ভেদ ও মুক্ত অবস্থায় জীব ও ব্রহ্মের অভেদ সম্ভব। কিন্তু ১১শ শতকের নিম্বার্ক বা নিয়মানন্দ দ্বৈতাদ্বৈতবাদীর মতে জীব ও ব্রহ্মের ভেদাভেদ স্বাভাবিক। সুতরাং, তা বদ্ধাবস্থাতে ও মুক্তাবস্থাতে একই ভাবে বিদ্যামান থাকে। নিম্বার্ক ভাষ্য বা বেদান্ত পারিজাত সৌরভও বিখ্যাত গ্রন্থ। ১৪৭৯ খ্রিঃ বল্লভাচার্য জন্মগ্রহণ করেন, ইনি রামানুজের ন্যায় বৈষ্ণব পন্থী। তাঁর মতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও অগ্নির ন্যায় জীব ব্রহ্মের একাংশ মাত্র। ভাগবদ্ ভক্তিই মোক্ষলাভের উপায় স্বরূপ। তিনি অনুভাষ্য রচনা করেন। বলদেব বিদ্যাভূষণও বঙ্গীয় বৈষ্ণব আচার্য ছিলেন। তিনি দ্বৈতাদ্বৈতবাদের সমর্থনে ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য রচনা করেন, তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘গোবিন্দ ভাষ্য’ নামে পরিচিত।

মীমাংসা দর্শন বেদের প্রামাণ্যে বিশ্বাসী। বেদ নিত্য ও শাশ্বত। জ্ঞানের প্রমাণ স্বরূপ সেখানে শাব্দ প্রমাণও স্বীকৃত। অতএব বেদ শাব্দ প্রমাণ। এইভাবে শব্দের নিত্যত্বও স্বীকৃত হয়েছে। পাণিনি তার ব্যাকরণে স্ফোটবাদের অঙ্গীকার করেছেন। যে শক্তি দ্বারা শব্দের অর্থ প্রতীতি জন্মে সেই শক্তিকেই ‘স্কোট’ বলা হয়। এই ‘স্ফোট’ বর্ণস্ফোট, পদস্ফোট ও বাক্যস্ফোট ভেদে তিন প্রকার। তন্মধ্যে বাক্যস্ফোটই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাক্যদ্বারা অর্থের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে। স্ফোট নামক নিত্যশব্দই ‘শব্দব্রহ্ম’ বলে পরিচিত। কারও কারও মতে স্ফোটায়ন মুনি এই মতের প্রবর্তক। স্ফোটায়ন পাণিনি পূর্ববর্তী। বর্ণস্ফোট এবং শব্দস্ফোটর উপস্থিতি নিয়ে তার্কিকদের মধ্যে বহু তর্কের অবতারণা হয়েছে। নিরুক্তকার যাস্কাচার্য ও বৈয়াকরণেরা স্ফোটবাদ স্বীকার করেছেন। মাধবাচার্য্য তাঁর সর্ব্বদর্শন সংগ্রহে স্ফোটবাদ ও পাণিনিদর্শনের মত আলোচনা করেছেন।

হিন্দুশাস্ত্রে উপনিষৎ, ব্রহ্মসূত্র ও ভাগবদ্‌গীতা “প্রস্থানত্রয়ী” নামে অভিহিত। উপনিষৎ ও ব্রহ্মসূত্রের বিষয় পূর্বে আলোচিত হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবদ্‌গীতা মুখ্যদর্শনের অন্তর্ভুক্ত নাহলেও দর্শনকল্প হিসাবে বিবেচিত হওয়ায় বাধা নেই। গীতাকে অবলম্বন করেও বহু ভাষ্য রচিত হয়েছে। শঙ্করাচার্যের গীতাভাষ্য, আচার্য রামানুজের গীতাভাষ্য, লোকমান্য তিলকের গীতারহস্য প্রভৃতি উল্লেখের দাবী রাখে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকল উপনিষদের সার বিষয় পার্থর নিকট উপদেশ আকারে ব্যক্ত করেন। তিনি জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, ও কর্ম্মযোগের সাথে বিভিন্ন দর্শনের সুসামঞ্জস্য বিধান করেছেন। সকল দর্শন সম্প্রদায় গুলিই মুক্তি বা মোক্ষ লাভের পথানুসন্ধানী। সেই পথের বিভিন্নতাহেতুই সম্প্রদায়ের বিভিন্নতা দৃষ্ট হয়। গীতার উদার ধর্মমতের সার কথাই হল —ফল লিপ্সাই কর্মের দোষাবহ অবস্থা। ফলের আশা ত্যাগ করে কেবল কর্তব্যবোধে ‘কর্মকর’। ভাষার সারল্যে ভাবের গাম্ভীর্যে এবং যুক্তির তীক্ষ্ণতায় গীতা জগৎবাসীর নিকট এক অমূল্য সম্পদ।

নাস্তিক দর্শন – চার্বাক

ভারতীয় দর্শনের ‘চার্বাক’ সম্প্রদায় নাস্তিক শিরোমণি। তারা বেদের প্রামাণ্যেও বিশ্বাস করে না, ঈশ্বরের অস্তিত্বেও বিশ্বাস করে না। চার্বাক কথার একটি অর্থ হল— ‘জড়বাদী’ (Materialist) অনেকে মনে করেন ‘বৃহস্পতি’ বা চার্বাক’ নামক ব্যাক্তি বিশেষই এই দর্শনের প্রবক্তা। যে ব্যক্তি জড়বাদের সমর্থক তাকেও চার্বাক নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। অনেকে মনে করেন—চারু=সুন্দর, বাক্‌=কথা অর্থাৎ সুন্দর সুন্দর কথা যা ভোগবাদী সাধারণ মানুষের মনোহরণ করত, এমন কথার প্রচারক হিসাবে এই সম্প্রদায় ‘চার্বাক’ নামে অভিহিত। বৃহস্পতিকে চার্বাক দর্শনের প্রবক্তা মনে করলেও আজও পর্যন্ত তাঁর কোন রচনা বা মৌলিক গ্রন্থ মেলে না। সুপ্রাচীন কাল থেকেই জড়বাদের নানান দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। বেদ থেকে শুরু করে রামায়ণ, মহাভারত, ও প্রাচীন বৌদ্ধসাহিত্যে ও সূত্রসাহিত্যে জড়বাদের অস্তিত্ব লক্ষ্যণীয়। পরবর্তীকালে বিরোধী সম্প্রদায়ের নানা গ্রন্থে চার্বাকদের মতবাদগুলি খণ্ডিত হয়েছে। সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনা বা ধ্যান ধারণা এখানে মূল্যহীন। কেবলমাত্র সাধারণ লোকের তাৎক্ষণিক আনন্দময় চিন্তা ও সুখবাদী ভাবধারা এই মতবাদের মূলভিত্তি ও প্রধান আকর্ষণ বলা যায়। সেই হেতু একে ‘লোকায়ত’ দৰ্শনও আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কালক্রমে জড়বাদী চিন্তাধারাগুলির একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। বলা যায় পণ্ডিতগণ চার্বাকদের নাস্তিকতার স্বপক্ষে যুক্তি সমূহকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। এইভাবেই চার্বাক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। এই প্রসঙ্গে F.W. Thomas-এর নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯২১খ্রিঃ বৃহস্পতি সূত্র নামে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেন।

গ্রন্থে চার্বাকদের মতবাদগুলি সূত্র-আকারে গ্রথিত আছে। চার্বাক দর্শনের সেরূপ কোন গ্রন্থ পাওয়া যায় না। তবে অধুনা জয় বা শিভট্ট কর্তৃক রচিত ‘তত্ত্বোপল্লবসিংহ নামে একটি গ্রন্থ আবিস্কৃত হয়েছে। দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয় বস্তুবাদের ইতিহাসকে বার্হস্পত্য, লোকায়ত, চার্বাক, ও নাস্তিক এই চারভাগে ভাগ করেছেন।

চার্বাক দর্শনে জ্ঞানের প্রমাণ হিসাবে একমাত্র প্রত্যক্ষকেই স্বীকার করা হয়েছে। অনুমান, শাব্দ ইত্যাদি তারা মানেন না কারণ তাঁদের মতে যা কিছু ইন্দ্রিয়সুখের কারণ তাই কেবল জ্ঞানের প্রমাণ স্বরূপ। তারা শ্রুতিবাক্য, শাস্ত্রবাক্য গ্রাহ্য করেন না। কারণ তাদের মতে, জনসাধারণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ভণ্ড ব্রাহ্মণ পুরোহিতেরা তাদের জীবিকা নির্বাহের নিমিত্ত যাগযজ্ঞাদির বিধান দিতেন। যে কারণে কোন স্মৃতি শ্রুতি যাগযজ্ঞের ফল তারা মানতেন না। কেবল বস্তুই চরম সত্য ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যহেতু প্রমাণ স্বরূপ, যেহেতু আত্মা, ঈশ্বর, পরলোক, অদৃষ্ট, ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, অনুমান নির্ভর সেইহেতু ঐ বিষয়গুলির কোন অস্তিত্ব তারা মানেন নি। ঈশ্বরকে বিশ্বজগতের স্রষ্টা হিসাবে মানার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাদের মতে চেতন ও অচেতন সকল বস্তুই পঞ্চভূত অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম্য এর সমন্বয়ে আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে। পঞ্চভূত পৃথক পৃথক ভাবে অচেতন হলেও যখন একত্রিত হয়ে জগৎসৃষ্টি করে তখন তাতে চৈতন্য থাকায় কোন বাধা নেই। যুক্তি স্বরূপ তারা বলেন পান, চুন, সুপারি, খয়ের এর একত্র মিশ্রণে যেরূপ লাল রঙ উৎপন্ন হয় তা কোন একটির পক্ষে সম্ভব নয়। ঠিক সেই নিয়মেই জড় পঞ্চভূতের সমন্বয়ে চেতন জগৎ এর সৃষ্টি সম্ভব। চার্বাকগণ আত্মা মানেন না। পরলোকও মানেন না। অতএব স্বর্গ, নরক বলেও কিছু নেই। তাঁদের মতে বৈদিক যুগের পণ্ডিতেরা ভণ্ড, ধূর্ত ও প্রবঞ্চক। এই সমস্ত ভণ্ড ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণ সাধারণ মানুষকে স্বর্গের প্রলোভন দেখিয়ে নরকের ভয় দেখিয়ে ব্যায়বহুল যাগ যজ্ঞাদি সম্পন্ন করাতেন এবং তাই দিয়ে তাদের জীবিকার সংস্থান করতেন। ভারতীয় সকল দর্শনই ‘মোক্ষ’ লাভে আগ্রহী কিন্তু চার্বাকদের মতে মোক্ষলাভ অসম্ভব। মৃত্যু ছাড়া আর কোনকিছুতেই সম্পূর্ণরূপে নিষ্কৃতি সম্ভব নয়। বৃহস্পতি সুত্রে বলা হয়েছে—মরণমেবাপবর্গঃ। সর্বোপরি বলা যায় চার্বাকগণ দেহসর্বস্ব জীবনেই বিশ্বাসী। দেহ যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ সুখ দুঃখ ভোগ করতে হয়, দেহ বিনষ্ট হলে, ইন্দ্রিয়সুখ বিনষ্ট হলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। যতক্ষণ বাঁচবে, সুখে বাঁচবে, ঋণ করেও ঘি খাবে। পরকাল বলে কিছু নেই। একবার দেহ ভস্মীভূত হলে আর পুনরায় আগমন সম্ভব নয়।

“যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।।”

পণ্ডিতগণ চার্বকদের মধ্যে আবার আদি চার্বাক, ধূর্ত চার্বাক ও শিক্ষিত চার্বাক বলে ভেদস্বীকার করেছেন। দেহজ কাম ও সুখভোগই যখন পরম পুরুষার্থ বলে স্বীকৃত তখন। ধূর্ত চার্বাকগণ পশুসুলভ আপাত ইন্দ্রিয় সুখ ভোগকেই চূড়ান্ত বলে মনে করেন। কিন্তু শিক্ষিত ও মার্জিত রুচি সম্পন্ন চার্বাকদের মতে—বাৎস্যায়নের কামসুত্রে যে নির্মল সুখবাদ ব্যাখ্যাত হয়েছে তাই মান্য বা গ্রহণীয়। তাঁরা মনে করেন দেহসর্বস্ব সুখভোগ চলতে থাকলে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। সমাজে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। অতএব একান্ত আত্মমুখে উন্মত্ত না হয়ে নিজস্ব সুখ অপরের সাথে বন্টন করে নিতে হবে, নতুবা সমাজব্যবস্থা সুস্থজীবনের পরিপন্থী হতে বাধ্য। বাৎস্যায়ন ধর্ম, অর্থ, কামকে পুরুষার্থ বললেও মার্জিত বুদ্ধি চার্বাকেরা ধর্মকে বাদ দিয়ে অর্থ ও কামকেই জীবনের পুরুষার্থ মনে করেন। সায়ন মাধবীয় সৰ্ব্বদর্শন সংগ্রহ নামক গ্রন্থে চার্বাকদের বহু মতবাদ সম্বলিত আলোচনা দৃষ্ট হয়। পরিশেষে বলা প্রয়োজন চার্বাক দর্শন জড়বাদী হলেও প্রাচীনত্ব হেতু উক্ত দর্শনের অবদান অসামান্য। পরবর্তী কালের ভারতীয় দর্শনগুলি চার্বাকদের মত খণ্ডন করে বহুগুণে সমৃদ্ধ হয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না।

বৌদ্ধ দর্শন

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠশতকে শাক্যবংশীয় রাজকুমার সিদ্ধার্থ জন্ম গ্রহণ করেন কপিলাবস্তু নগরে। এই সিদ্ধার্থের অপর নাম গৌতম। তিনিই পরবর্তীকালে গৌতমবুদ্ধ নামে পরিচিত হন। তাঁর প্রবর্তিত ধর্মই হল বৌদ্ধধর্ম। গৌতমবুদ্ধের উপদেশাবলী যথাক্রমে বিনয়পিটক, সুত্তপিটক ও অভিধর্মপিটক নামে তিনখানি গ্রন্থে বর্ণিত। সেই উপদেশাবলীকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বৌদ্ধদর্শন। ব্যাধি, শোক, জড়া, মৃত্যু প্রভৃতি দ্বারা প্রতিনিয়ত মানুষকে নিপীড়িত হতে দেখে বুদ্ধের মনে এর কারণ অন্বেষনের ইচ্ছা জাগে। তিনি মাত্র উনত্রিশ বৎসর বয়সে সংসার ও রাজঐশ্বর্য ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। দীর্ঘ তপস্যা ও সুদীর্ঘকাল সমাধিমগ্ন অবস্থায় থেকে বোধি বা নির্বাণ লাভ করেন। ‘বোধি” কথার অর্থ প্রজ্ঞা বা জ্ঞান। তখন থেকে তিনি ‘বুদ্ধ’ নামে পরিচিত হন। তিনি মুখে মুখে তাঁর মূল্যবান উপদেশগুলি বিতরণ করতেন। পরবর্তীকালে তাঁর সুযোগ্য শিষ্যগণ সেই সমস্ত উপদেশ গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন।

অর্জিত প্রজ্ঞার আলোকে যে চারটি সত্য ধরা পড়েছিল সেগুলি ‘চত্বারি আর্যসত্যানি’ বলে বৌদ্ধদর্শনে খ্যাত। এই চারটি সত্য যথাক্রমে—(ক) দুঃখ আছে, (খ) দুঃখের কারণ আছে, (গ) দুঃখের নিবৃত্তি আছে, (ঘ) দুঃখ নিবৃত্তি লাভের উপায়ও আছে।১১ সংসার অনিত্য, সেইহেতু দুঃখময়। মানুষের অবিদ্যাই হল সকল দুঃখের কারণ স্বরূপ। প্রত্যেক দর্শনই অল্পবিস্তার দুঃখবাদী কিন্তু গৌতমবুদ্ধ আনন্দের মধ্যে দুঃখকে খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর মতে এই জগৎ দুঃখময়। দুঃখ সর্বব্যাপক। আপাতদৃষ্টিতে যাকে আনন্দ বা সুখ বলে প্রতিভাত হয়, তিনি সেখানেও গভীরভাবে দুঃখ দেখতে পেয়েছেন। বৌদ্ধদর্শনের মতে জীবের জন্মই হল আসল বন্ধন। পার্থিব বিষয়ের প্রতি জীবের লোভ বা তৃষ্ণা থেকেই তাঁর জন্ম হয়। অতএব জ্ঞানই একমাত্র জীবের চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়ে জীবকে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ বা দুঃখ দুর্দশার হাত থেকে মুক্তি দিতে পারে। এই দুঃখ নিরোধ মার্গকে ‘অস্টাঙ্গিক মার্গ’ বলা হয়। যথাক্রমে- সম্যদৃষ্টি (Right Views) সম্যক্‌ সংকল্প (Right determination), সম্যক্‌ বাক (Right speech) সম্যক্ কর্মান্ত (Right conduct) সম্যক্ জীব (Right Liveli hood) সম্যক্ ব্যায়াম (Right effort ) সম্যক্‌ স্মৃতি (Right mind fulness), সম্যক সমাধি (Right concentration) এই আটটি মার্গ আবার প্রজ্ঞা, শীল ও সমাধি এই তিন স্কন্ধে বিভক্ত। বৌদ্ধদর্শনে আত্মা বা ঈশ্বর স্বীকৃত নয়। নাস্তিক দর্শন সম্প্রদায়ভুক্ত এই বৌদ্ধদর্শন দুঃখ থেকে নিষ্কৃতিকেই জীবের ‘নির্বাণ’ লাভের উপায় বলে মনে করে।

গৌতমবুদ্ধ জীবের দুঃখ দূর্দশা, জরা, ব্যাধি নিয়ে এত বেশী কারত ছিলেন যে তাঁর দর্শন শাস্ত্রে কোন অবাঞ্ছিত প্রশ্নের উত্তর তিনি খোঁজেননি। তাঁর মতে যেখানে জীবকূল দুঃখে কাতর সেখানে নানা তত্ত্ব আলোচনা যেমন—দেহ ও আত্মার পার্থক্য, জগৎ নিত্য না অনিত্য, জ্ঞান লাভের পরে পুনরায় জন্ম লাভ করতে হয় কিনা? ইত্যাদির উত্তর সন্ধানে বৃথা কালক্ষেপ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। বুদ্ধ মনে করতেন যে মানুষ তীরবিদ্ধ অবস্থায় যন্ত্রণাতে কাতর, তার সেবা শুশ্রূষা না করে কোথা থেকে তীর এল, কে ছুঁড়ল? তীরে বিষ মাখানো ছিল কিনা? এইসব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানো নিরর্থক।

পরবর্তীকালে বৌদ্ধমতাবলম্বীগণ বুদ্ধের দার্শনিক চিন্তাভাবনাগুলিকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেন। তন্মধ্যে (ক) মাধ্যমিক বা শূন্যবাদ সম্প্রদায়। (খ) যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদ। (গ) সৌত্রান্তিক সম্প্রদায়। (ঘ) বৈভাবিক সম্প্রদায উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধধর্ম দুইটি প্রধান শাখায় বিভক্ত ছিল হীনযান ও মহাযান। সিংহল, ব্রহ্মদেশ, শ্যামদেশ অর্থাৎ দক্ষিণ অঞ্চলে মূলতঃ হীনযান শাখার প্রাধান্য ছিল এবং উত্তরাঞ্চলে—তিব্বত, চীন ও জাপানে মহাযান শাখার প্রভাব অধিক লক্ষ্যণীয়। মাধ্যমিক ও যোগাচার শাখা মহাযান ধর্মের অনুসারী। এবং সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক শাখা দুটি হীনযান ধর্মের অনুসারী।

মাধ্যমিক বা শূন্যবাদ সম্প্রদায়ের মতে দৃশ্যমান জগৎ বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একটি মিথ্যাবিষয়। এর কোন পারমার্থিক সত্তা বা সত্যতা নেই। জড়বস্তুও যেমন নেই তেমন মনেরও কোন সত্তা নেই, সবই শূন্য। একে শূন্যবাদ বা (Nihilism) বলা হয়। জগৎ-এ কোথাও কোন সৎ বস্তু নেই। বুদ্ধের মতে এই জগৎ অনাদি ও অনন্ত। নাগার্জুনের মতে যা আদিতে নেই, অন্তেও নেই তা মধ্যে কিভাবে প্রতীয়মান হবে? অতএব জগৎ এর আদি, মধ্য, অন্ত যেমন নেই তেমনি জন্ম, স্থিতি, মৃত্যু অলীক কল্পনা মাত্র। তাঁদের মতে এই দৃশ্যমান জগৎ এর অন্তরালে এমন এক সত্তা বর্তমান। যার রূপময়তা নেই বলেই এঁকে শূন্য ভাবা হয়েছে। অর্থাৎ কোন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না বলেই তা শূন্য কথাটির মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। এই মতবাদের উপরে ভিত্তি করে মহামতি নাগার্জুন ‘শতসাহস্ৰিকা, প্রজ্ঞাপারমিতা’, বলে গ্রন্থ রচনা করেছেন। নাগার্জুনের ‘মাধ্যমিক কারিকা’ বা ‘মাধ্যমিক সূত্র’ এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই। ২৭টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত, ৪০০টি শ্লোকে বিন্যস্ত এই কারিকাতে শূণ্যবাদকেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদ সম্প্রদায়—এই মত অনুযায়ী মন বা চিত্ত ছাড়া বাকি সবই মিথ্যা। অর্থাৎ চেতনা বা বিজ্ঞান ব্যতীত কিছুই গ্রহণীয় নয়। ‘সর্বং বুদ্ধিময় জগৎ।’ এই মতবাদকে ‘আত্মাগত ভাববাদ’ ও বলা হয়ে থাকে। বসুবন্ধু, আসঙ্গ, দিগ্‌নাগ এই শাখার অন্যতম সমর্থক। যোগাভ্যাস ও সদাচার পালনের মধ্য দিয়েই এই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা তত্ত্বজ্ঞান অর্জন করেছিলেন বলেই এইরূপ নামকরণ হয়েছে। আসঙ্গের গুরু মৈত্রেয়নাথ এই সম্প্রদায়ের আদি ব্যক্তি। তাঁর রচিত যোগাচার ভূমি শাস্ত্র এই সম্প্রদায়ের দার্শনিক গ্রন্থ। বসুবন্ধু, আসঙ্গ রচিত ছয়শত শ্লোকসম্বলিত ‘অভিধর্মকোষ’ বৌদ্ধদর্শনের একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। এই মতের অনুগামীগণ হলেন দিনাগ, ধর্মপাল, শীলভদ্র প্রভৃতি। ধর্মকীর্তির ‘ন্যায়বিন্দ’, বৌদ্ধ ও ন্যায়- দর্শনের সম্মিলিত গ্রন্থ। এতদ্ব্যতীত দিাগের ন্যায়প্রবেশ শান্তরক্ষিত কর্তৃক রচিত ‘তত্ত্বসংগ্রহ,’ এর উপরে রচিত কমলশীলের টীকা ‘লঙ্কাবতার সূত্র’ উল্লেখযোগ্য।

বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক দর্শন সম্প্রদায় হীনযান সম্প্রদায়ভূক্ত। পালিভাষায় তাঁদের বক্তব্য লিখিত হত। ত্রিপিটকই ছিল তাঁদের নিকট মান্য গ্রন্থ। বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ই ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন। কিন্তু কর্মবাদে বিশ্বাসী। জীবের কর্মের ফলেই যত অনর্থ, কর্মফল ভোগ করতে হয়, কর্মফল কখনো বিনষ্ট হয় না এবং এই সঞ্চিত কর্মফল ভোগের নিমিত্তই পুনর্জন্ম সংঘটিত হয়। তাঁদের মতে সংসার ও সমাজ হল মায়াময়। সংসারী মানুষ মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ থাকার ফলে কখনো সঠিক পথের সন্ধান পায় না, মুক্তিও সম্ভব নয়। বুদ্ধদেবের মত ছিল ‘আত্মপদীপোভব’ অর্থাৎ নিজেই নিজেকে আলো দেখাও। সৌত্রান্তিক সম্প্রদায়ের মতবাদকে ‘বাহ্যানুমেয়বাদ’ বলা হয়। কারণ তাঁদের মতে বাহ্যবস্তু সমূহের জ্ঞান প্রত্যক্ষলব্ধ নয়, অনুমানলব্ধ। সূত্রপিটককে প্রামাণ্য রূপে সমর্থন করার কারণেই এঁদের সৌত্রান্তিক বলা হয়। এঁরা সর্বাস্তিবাদী। সকল বাহ্যবস্তুই ক্ষণিক, এবং সদা পরিবর্তনশীল। তক্ষশীলার কুমার লাভ বা কুমার লব্ধ এই সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। বসুবন্ধুর অভিধর্ম কোষ ও তার ব্যাখ্যা থেকে এই সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে বহু তথ্য জানা যায়। ধর্মোত্তর ও যশোমিত্র নামে দুই ব্যক্তিও এই সম্প্রদায়ের অনুগামী ছিলেন।

অপরদিকে বৈভাষিক মতাবলম্বীগণও মনে করেন যে মন এবং তৎঅতিরিক্ত সকলই সত্য, তবে সেই বাহ্য বস্তুসমূহের জ্ঞান প্রত্যক্ষলব্ধ। সেই হেতু তারা বাহ্যপ্রত্যক্ষবাদী। এঁরাও সর্বাস্তিবাদী। এঁরা পরমানুর অস্তিত্ত্বে বিশ্বাসী। সেইহেতু পরমানু অবিভাজ্য, অতীন্দ্রিয় অনাস্বাদিত এবং অবিনাশী ও অস্পর্শনীয় বলে তাঁরা মনে করেন। বৈভাষিক দিগের মতে নির্বান হল মনের এমন এক অবস্থা বা ভাবান্তর যাকে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অভিধর্মকোষ এর উপরে ‘বিভাষা’ নামে এক ভাষ্য রচিত হয়েছিল। সেই ভাষ্যকে অনুসরণ করেই এই বৈভাষিক দর্শন আত্মপ্রকাশ করেছিল। চৈনিক পরিব্রাজক ইৎ-সিং-এর মতে যাঁরা বোধিসত্ত্বাগণের পূজা করেন ও মহাযানসূত্র অধ্যয়ন করেন তাঁরা হলেন মহাযানপন্থী। যাঁরা সেইরূপ করেন না তাঁরা হলেন হীনযান পন্থী। হীনযানদের শুষ্ক বিচার বুদ্ধি ও অত্যন্ত কঠোর মনোভাবের প্রতি আস্থা হারিয়েই সাধারণ মানুষ ক্রমশঃ মহাযানপন্থা অবলম্বন করেছেন বা গড়ে তুলেছেন এরূপ মনে করাও অসংগত নয়। মহাযান সম্প্রদায় ভুক্তেরা কেবলমাত্র নিজের মুক্তির কথা চিন্তা না করে বিশ্বের সকল মানুষের মুক্তির কথা চিন্তা করতেন। স্বয়ং বুদ্ধও নিজ নির্বাণলাভের পরে সকলের মুক্তির প্রয়াসী ছিলেন। মহাযানীরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, সাধারণ মানুষও দুঃখযন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য ঈশ্বরকে আশ্রয় করে থাকেন, যদিও তাঁদের এই ঈশ্বর স্বয়ং বুদ্ধ। মহাযানীদের মতে আত্মা নিজে ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ হলেও পরমাত্মার অস্তিত্ত্ব বিরাট, অতীন্দ্রিয় ও সত্য, অর্থাৎ জীবাত্মা যেন পরমাত্মারই প্রকাশ। এই সব দিক দিয়ে বিচার করতে গেলে মহাযান সম্প্রদায়ের প্রতি সাধারণ মানুষ অনেক বেশী আস্থাশীল ছিলেন।

জৈন দর্শন

জৈনদর্শন সুদূর অতীতেই আত্মপ্রকাশ করেছিল। ২৪জন তীর্থঙ্কর দ্বারা প্রচারিত এই মতবাদের প্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন ঋষভদেব এবং শেষ ছিলেন মহাবীর। মহাবীরই জৈনধর্মের প্রবর্তক। মহাবীরের অপর নাম বর্ধমান। এবং এই বর্ধমানের (প্রায় ৩০ বৎসর পূর্বে) অব্যবহতি পূর্বেই বর্তমান ছিলেন পার্শ্বনাথ। জৈন দর্শন প্রচারে তাঁর অবদানও গুরুত্বপূর্ণ। মহাবীর গৌতমবুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন।

নাস্তিক দর্শনগুলির মধ্যে চার্বাক কেবলমাত্র প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু জৈন দর্শন প্রত্যক্ষ ব্যতিরেকে অনুমান ও আপ্তবাক্যকেও প্রমাণরূপে স্বীকার করেছেন। চার্বাকদের মতকে জৈন দর্শনে দৃঢ়ভাবে খণ্ডন করা হয়েছে। তাঁদের মতে অনুমান নির্ভর জ্ঞান যদি মিথ্যা হয় তাহলে প্রত্যক্ষ নির্ভর জ্ঞানও কখনও কখনও মিথ্যা হয়ে পড়বে। যেমন— ‘রজ্জুতে সর্পভ্রম।’ অর্থাৎ রজ্জুদেখে সর্প মনে হওয়ার যে বিষয়টি, সে তো প্রত্যক্ষেরই উদাহরণ, সেও তো ভ্রান্ত। চার্বাকরা যদি কয়েকটি অনুমান লব্ধ জ্ঞানের অসত্যতা দেখে সিদ্ধান্ত নেন যে অনুমান ব্ধ জ্ঞান অসত্য তবে তো বুঝতে হবে তারা অনুমানের উপরে নির্ভর করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপ্তবাক্য জৈনদের মতে অবশ্যই প্রমাণস্বরূপ কারণ—অতীন্দ্রিয় পদার্থের জ্ঞানলাভের পরিপন্থী হিসাবে জীবের ইন্দ্রিয়শক্তির সীমাবদ্ধতাকে দায়ীকরে তারা সর্বজ্ঞ মুক্তপুরুষের আপ্তবাক্যকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন। ব্রহ্মাণ্ডের চিন্তা ও চেতনাকে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জৈনরা প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আপ্তপ্রমাণকে আঁকড়ে ধরেছেন। দৃশ্যবস্তু বা matter এর জ্ঞান হয় প্রত্যক্ষের দ্বারা। আবার এই দৃশ্যবস্তু যে স্থানকে অবলম্বন করে থাকে তাকে বলে স্থান বা Space, অনুমান দ্বারা এই স্থানের জ্ঞান সম্ভব হয়। বস্তুসকল পরিবর্তনশীল, তার কারণে কালকে বা Time কে স্বীকার করতে হয় এবং তাও অনুমান নির্ভর। জৈন দর্শনে যে বিশেষ শক্তির দ্বারা বস্তুসমূহের স্থিতি বা Rest এবং গতি বা motion নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে ধর্ম ও অধর্ম আখ্যা দেওয়া হয়েছে। অতএব পঞ্চভূত আকাশ, কাল, ধর্ম ও অধর্ম জৈন দর্শনে স্বীকৃত। এতদ্ব্যতীত চেতনদেহে আত্মার অস্তিত্বও স্বীকৃত। তাদের মতে সকল চেতন পদার্থেই আত্মা বর্তমান। জৈন দর্শনে যে কর্ম স্বীকৃত, সেই কর্মই আত্মাকে বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে। তাঁদের মতে সূর্যের প্রখর তাপ ও আলো যেমন মেঘ আচ্ছন্ন করে রাখে, কর্মও সেইরূপ আত্মার শক্তিকে ব্যাহত করে মাত্র। কর্মকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেই আত্মা বন্ধনমুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ মাত্রায় বিকাশ লাভ করতে পারে। তাঁদের মতে প্রতিটি আত্মারই সমান অধিকার স্বীকৃত। কেবলমাত্র কর্মের তারতম্যের জন্যেই আত্মার পূর্ণতার বৈষম্য ঘটে। অহিংসধর্মকে অবলম্বন করে সকল জীবের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে, তাঁরা যথার্থ মানবতার পরিচয় দিতেন। স্বর্গের দেব দেবী নয়, মানুষই তাদের মুখ্য বিষয়।

জৈনদিগের যে মূল্যবান উপদেশাবলী, তার উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস বা আস্থা, তার সম্বন্ধে সম্যকজ্ঞান, অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, অনাসক্তি ইত্যাদি চারিত্রিক গুণাবলীই আত্মাকে শুদ্ধ করে পূর্ণতা প্রদান করে ও সেইরূপ অবস্থাই হল জৈনদর্শনের আকাঙ্খিত মোক্ষ বা নির্বাণ। তীর্থঙ্করগণই সেই রূপ সৎ চরিত্রের অধিকারী ও তাঁদের পুণ্যবান আত্মাই অনুরূপ আত্মার উদাহরণ। জৈনদর্শনেও ঈশ্বর স্বীকৃত নয়, এখানে তীর্থঙ্কর দিগকেই ভক্তগণ ঈশ্বররূপে জ্ঞান করে থাকেন। জৈন গণ সকল দর্শনের উপরেই শ্রদ্ধাশীল, তাঁরা মনে করেন যেহেতু মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি সীমিত সেহেতু কোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া কোন ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। জৈন তীর্থঙ্করগণ ‘জিন’ নামে অভিহিত হতেন। তাঁরা যোগাভ্যাসের দ্বারাই সব কামনাবাসনাকে জয় করতেন বলেই জিতেন্দ্রিয় হতে পারতেন। জিন কর্তৃক প্রচারিত ধর্মই হল জৈনধর্ম। এবং জিন কর্তৃক প্রবর্তিত দর্শন জৈনদর্শন নামে পরিচিত। কালক্রমে শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর নামে দুই শ্রেণিতে জৈনগণ বিভক্ত হয়ে পড়ে। উভয়ই তীর্থঙ্কর দিগের উপদেশাবলী মেনে চলতেন।

জৈন গ্রন্থকারগণের মধ্যে কুন্দ কুন্দ লিখিত সব কয়টি গ্রন্থই প্রাকৃত ভাষায় রচিত। শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর দুই গোষ্ঠীর নিকটই তিনি সম্মানিত ছিলেন। সংস্কৃত ভাষাতে রচিত গ্রন্থের গ্রন্থকার উমাপতি। গ্রন্থের নাম ‘তত্ত্বার্থ বিধগমসূত্র’। এছাড়াও সিদ্ধসেন, বিদ্যানন্দ, মাণিক্য নন্দী, প্রভাচন্দ্র, শুভচন্দ্র প্রমুখ দিগম্বর গোষ্ঠীর গ্রন্থ রচয়িতা ছিলেন। শ্বেতাম্বর জৈনদের মধ্যে হরিভদ্র তাঁর ন্যায় প্রবেশের ভাষ্য, এবং ‘ষড়দর্শন সমুচ্চয’, ‘ও লোকতত্ত্বনির্ণয়েব মধ্য দিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন। সর্বোপরি হেমচন্দ্রের প্রমাণমীমাংসা, দেবেন্দ্রসুরির ‘সিদ্ধ পঞ্চাশিকা’ বিখ্যাত।

পাদটীকা – দর্শনশাস্ত

১. সাংখ্যকারিকা আর্যাছন্দে রচিত ৭০টি শ্লোক সম্বলিত।

২. মহাভরতে বলা হয়েছে—’সংখ্যাজ্ঞানং প্রবক্ষামি পরিসংখ্যাদর্শনম্।

৩. নামান্তরে কপিলসূত্র —গ্রন্থটি ৬টি অধ্যায়ে রচিত, এতে ৫২৬টি সূত্র রয়েছে।

৪. ‘স্বত্ত্বরজস্তমসাং সাম্যাবস্থা প্রকৃতিঃ’।

৫. সাংখ্যমতে তিনটি জ্ঞানের প্রমাণ হল যথক্রমে—প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শাব্দ।

৬. যোগশ্চিত্তবৃত্তি নিরোধ :—-পতঞ্জলি।

৭. ৪টি পাদে বিভক্ত এবং ১৯৫টি সূত্র সম্বলিত।

৮. “অক্ষপাদো মহাযোগী গৌতমাখ্যো ভবন মুনিঃ।
গোদাবরীসমানেতা অহল্যায়াঃ পতিঃ প্রভুঃ।।”

৯. ‘প্রত্যক্ষানুমানোপমানশব্দাঃ প্রমাণানি।‘

১০. ‘দ্রব্যং গুণস্তথাকর্মসামান্যং সবিশেষকম্
সমবায়স্তথাভাবঃ পদার্থাঃ সপ্তকীর্তিতাঃ।। ভাষা পরিচ্ছেদ।

১১. দুঃখ, দুঃখ-সমুদায়, দুঃখ-নিরোধ, দুঃখ-নিরোধ-মার্গ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *