ষোড়শ অধ্যায় – প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ বা চিকিৎসাশাস্ত্ৰ এবং রসায়নশাস্ত্র
প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদের বীজনিহিত রয়েছে বৈদিক-সাহিত্যে। ঋগ্বেদ, যজুঃবেদ ও অথর্ববেদের মধ্যে প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা শাস্ত্রের মূল বক্তব্যগুলি গ্রথিত হয়েছে। ঋকবেদে ও যজুর্বেদে সাধারণতঃ রোগ, রোগী, চিকিৎসা পদ্ধতি ও চিকিৎসকের বর্ণনা দৃষ্ট হয়। কিন্তু সেই আলোচনা অথর্ববেদের মত এত দীর্ঘ ও বিস্তৃত নয়। ঋকবেদের (১।১১৬।১৫ এবং ১।১১৬।১৬) মন্ত্র অনুযায়ী অশ্বিদ্বয় বৃষগিরের পুত্র- ঋজাশ্বের অন্ধত্ব নিবারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং খেলের স্ত্রী বিলাকে লৌহময়জঙ্খা সংযোগ পূর্বক গমনক্ষম করেছিলেন। জরাগ্রস্থ চবন ঋষির যৌবন প্রাপ্ত হওয়ার ঘটনাও আমাদের বিস্মিত করে। ঋকবেদে রোগমুক্তির উপায়স্বরূপ বহু উদ্ভিজ্জের বিবরণ পাওয়া যায়। এমন কি কুষ্ঠরোগ নিবারণ, মাতৃগর্ভ থেকে সন্তান প্রসব করানোর দৃষ্টান্তও ঋক্বেদে দৃষ্ট হয়। অন্যান্য সকল শাস্ত্রের অনুরূপ এই শাস্ত্রে বিশারদদের নাম পাওয়া যায়— ভরদ্বাজ, আত্রেয়, অগ্নিবেশ, জাতুকৰ্ণ, ভেল, হারীত, ক্ষারপাণি, ধন্বন্তরি প্রমুখ। দুই অশ্বিনীকুমার ব্যতীত পৌরাণিক ব্রহ্মা, বিষ্ণু, নারায়ণ, শিব ইত্যাদি। সূর্য ও রুদ্র দেবতাগণ রোগনিরাময়ের অধিকারী বলে বিবেচিত হত। পূর্বে গাছগাছড়ার বিবিধ অংশের প্রয়োগ অর্থাৎস্বাদ, গন্ধ, ক্রিয়া- বিক্রিয়ার দ্বারা নানা রোগ ব্যধির চিকিৎসা করা হত। ব্যধির প্রতিষেধকরূপে লতাগুল্ম ও জলকেও ভেষজরূপে ব্যবহার করা হতো। মন্ত্রে তাদের কার্যকরী শক্তির কথাও- বলা হয়েছে। রোগ ব্যধির প্রকোপ দূর করার যে মন্ত্র তাকে ভৈষজ্যমন্ত্র বলা হয়। পরবর্তীকালে যে উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আমরা পাই তার মূল নিহিত রয়েছে ঐ সমস্ত ভেষজমন্ত্র সমূহে। অতঃপর কালক্রমে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ চিকিৎসার উদ্ভব ঘটে। এবং তদ্বিষয়ে বহু চিকিৎসা গ্রন্থেরও উদ্ভব হয়। আয়ুর্বেদশাস্ত্রকে অথর্ববেদের উপাঙ্গ স্বরূপ বলা হয়ে থাকে। অতএব এই অথর্ববেদের অবদান চিকিৎসা শাস্ত্রে অপূরণীয়, অবর্ণনীয়। প্রতিটি-চিকিৎসকের উচিৎ এই আদি প্রামান্য বিষয়ের প্রতি অবগত থাকা ও দায়বদ্ধ হওয়া। আয়ুর্বেদ কথার অর্থ হল বিদ্ ধাতুর অর্থ জ্ঞান বা জানা, অতএব যে বিদ্যার দ্বারা আমরা সুস্বাস্থ্য বা সুন্দর জীবন সম্পর্কে সুষ্ঠুভাবে জ্ঞান অর্জন করতে পারি তাই হল আয়ুর্বেদ শাস্ত্র। শরীর অপটু হলে জীবনের কোন উদ্দেশ্যই চরিতার্থ হয় না।
আয়ুর্বেদ মনে করে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম এই পঞ্চভূতের সাথে মন বা চেতনার সাম্য হল সুস্বাস্থ্য আবার এই দু’এর বৈষম্যই হল ব্যাধি। এতদ্ব্যতীত রোগের অপর প্রধান কারণ হিসাবে আয়ুর্বেদে বলা হয়েছে যে মানবশরীরে বায়ু, পিত্ত ও কফ বা শ্লেষা রয়েছে, এই তিন এর বৈষম্যে ব্যধি। আর সাম্যে সুস্বাস্থ্য নির্দেশ করে। শরীরে যদি বায়ু, পিত্ত ও কফের সুসামঞ্জস্য বজায় থাকে তাহলে বহিরাগত জীবানুর আক্রমণকে প্রাচীন চিকিৎসকগণ রোগের মূল কারণ বলে মনে করেন না। অতএব এই বায়ুপিত্ত কফের সুসানকে সামঞ্জস্য কী করে বজায় রাখা যাবে? উত্তরে বলা হয়েছে অসাত্ম্য বিষয় ভোগ থেকে বিরত থাকা উচিত। অর্থাৎ সমস্ত রোগের মূল কারণ এই অসাত্ম্য বিষয়ভোগ। আমাদের প্রাচীন ধর্মশাস্ত্ৰ সমূহে এবং আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, খাদ্যাখাদ্য রীতির উপর মানবদেহের স্বাস্থ্য ও অস্বাস্থ্য নির্ভর করে থাকে।
আয়ুর্বেদের প্রধান ৮টি অঙ্গ হল — শল্যতন্ত্র (Major Surgery), শালাক্য তন্ত্র (Minor Surgery), কায়চিকিৎসা (Therapeutics), ভূতবিদ্যা (Demonology), কুমারভৃত্য (Paediatris), অগদতন্ত্র (Toxicology), রসায়ন (Elixin) বাজীকরণ (Aphrodisiacs)। আলোচ্য শাখাগুলিতে পারদর্শী প্রাচীন চিকিৎসকগণ নিজ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের দ্বারাই রোগ নির্ণয়, রোগ নিরাময় ইত্যাদি দক্ষতার সাথে করতেন। দুঃখের বিষয় এই যে সেই সমস্ত প্রাচীন আচার্যগণের নিজস্ব রচনাগুলি অধুনা বিলুপ্ত। শুধুমাত্র গ্রন্থের নাম সমূহ পুরাণ ইত্যাদিতে দৃষ্ট হয়। তন্মধ্যে ধন্বন্তরির চিকিৎসা তত্ত্ববিজ্ঞান, নকুল প্রণীত বৈদ্যকসর্বস্ব, কাশীরাজের চিকিৎসা কৌমুদী উল্লেখ্য। পরবর্তীকালে এই সমস্ত প্রাচীন আচার্যদের ধ্যান ধারণা, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করা হয়। এই ধরনের সংকলন গ্রন্থগুলিতে সেই সমস্ত মূল্যবান মতামত সংরক্ষিত আছে। তন্মধ্যে চরকসংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতা উল্লেখযোগ্য। চরক কর্তৃক সংকলিত এই গ্রন্থ আনুমানিক খ্রিঃ ১ম শতকে এবং সুশ্রুত কর্তৃক সংকলিত সুশ্ৰুত সংহিতা আনুমানিক খ্রিঃ ৫ম অথবা ৬ষ্ঠ শতকে রচিত হয়।
চরকসংহিতা শাস্ত্রবিধি অনুসারে লিখিত এবং ন্যায়ানুমোদিত। মূল চরকসংহিতা চরকের পরবর্তীকালের কোন আচার্য দৃঢ়বল চরক নামে দ্বিতীয় চরক বর্তমান ছিলেন। অনেকে অনুমান করেন এই দ্বিতীয় চরকই চরকসংহিতার পরিশোধিত রূপ দান করেন। সুপ্রাচীনকালে ঋষি আত্রেয় তার শিষ্য অগ্নিবেশকে চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞান দান করেন, সেই সমস্ত আলোচনা গুরু শিষ্যের আলোচনা রূপে ছিল। চরক অগ্নিবেশ তন্ত্রকেই নুতন করে রূপদান করেছিলেন। চরককে যজুর্বেদের চরক শাখার দ্রষ্টাঋষির বংশোদ্ভূত বলে মনে করা হয়। আলোচ্য চরকসংহিতায় আটটি বিভাগ ও ত্রিশটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথমতঃ—সূত্রস্থান :— খনিজ, উদ্ভিজ ও প্রাণিজ ভেদে তিনপ্রকার। দ্বিতীয়তঃ—নিদানস্থানঃ—বিবিধ ব্যাধির আলোচনা, রোগের কারণ নির্ণয়, সংক্রমণ জনিত বিষয় আলোচিত হয়েছে। তৃতীয়তঃ—বিমানস্থানঃ—দেহতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব একত্রে আলোচিত হয়েছে। প্রকৃতির উপর দেহমনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি উক্ত হয়েছে। চতুর্থতঃ—শারীরস্থানঃ—মানবদেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিবরণ ও বৈশিষ্ট্য (Anatomy and physiology) পঞ্চমতঃ—ইন্দ্রিয়স্থানঃ—মানবদেহ ও মনের নানাবিধ লক্ষণের বিচার বিশ্লেষণ পূর্বক ভবিষ্যতের আশঙ্কা ও তার ফলাফল অনুমান করা। ষষ্ঠতঃ— চিকিৎসাবস্থান :—মানবদেহের বিবিধ রোগ ব্যাধির উপশম ভেষজ চিকিৎসার উপাদান, প্রস্তুত প্রণালী, ভৈষজ্য ও ধাতব উপাদানের মিশ্রণের বিবরণাদি বর্ণিত হয়েছে। শেষতঃ-কল্পস্থান এবং সিদ্ধিস্থানঃ—যেখানে চিকিৎসকগণের দায়িত্ব, কর্তব্যের বিস্তারিত আলোচনা দৃষ্ট হয়।
মহর্ষি পতঞ্জলি চরকের ভাষ্য রচনা করেছেন। চরকের বহু টীকা রচিত হয়েছে; কেজ্জেট কৃত নিরম্ভর পদব্যাখ্যা, চক্রপাণিদত্ত প্রণীত টীকা, বাংলার শিবদাস সেন কৃত চরকতত্ত্বদীপিকা, গঙ্গাধর কৃত জল্পকল্পতরু সর্বোপরি বাঙালী টীকাকার দুর্গামোহন ভট্টাচার্য কৃত টীকাটি সর্বাধুনিক। পরবর্তীকালের সকল আয়ুর্বেদ গ্রন্থে চরকের বচন প্রামাণ্য সিদ্ধান্তরূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। আরবী ও ফরাসী ভাষাতে চরক সংহিতা অনূদিত হয়েছে। Medical-Ethics বা চিকিৎসকদের অনুসরণীয় নৈতিক আদর্শ আলোচ্য গ্রন্থে এমন নিপুণ ভাবে দক্ষতার সাথে আলোচিত হয়েছে যা কিনা সর্বকালের সর্বদেশের চিকিৎসকদের অবশ্য পালনীয় রূপে গৃহীত হয়ে আসছে। চরকের সময় সুনির্দিষ্ট করা না গেলেও অনুমান করা যায় যে গৌতমবুদ্ধের আবির্ভাবের পূর্বে ঋষি আত্রেয় তার শিষ্য অগ্নিবেশকে জ্ঞান দান করলে সেই জ্ঞান অগ্নিবেশ চরককে দান করেন। আবার পতঞ্জলি চরকের ভাষ্য রচনা করেছেন। অতএব পতঞ্জলির (১৮৪–১৪৮খ্রিঃ পূর্বাব্দ) পূর্বে চরককে স্থাপন করা যায়। পতঞ্জলি তাঁর মহাভাষ্যে বৈদ্যকশাস্ত্রের উল্লেখ করেছেন। চীন দেশীয় ত্রিপিটকে কণিষ্কের সময় চরক বিদ্যমান ছিলেন, এরূপ তথ্য পাওয়া যায়। কণিষ্কের পত্নীকে চরক দূরারোগ্য ব্যাধির হাত থেকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। অতএব খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে কণিষ্কের সময়ে তাঁকে স্থাপন করা চলে। পঞ্চনদ দেশেই কণিষ্কের রাজত্বকালে চরক, দৃঢ়বল প্রমুখ বিদ্যমান ছিলেন এরূপ অনুমানকরা অসঙ্গত নহে।
মহামতি সুশ্ৰুত ছিলেন ধন্বন্তরির শিষ্য। গার্গ্য ও গালব এই দুই চিকিৎসকও ধন্বন্তরির শিষ্য ছিলেন। মহাভারতে শুশ্রুতের উল্লেখ রয়েছে। আবার পাণিনির পূর্বে গার্গ্য-গালব বর্তমান ছিলেন। খ্রিঃ পূঃ—৪র্থ শতাব্দীতে কাত্যায়নের বার্ত্তিকসূত্রে সুশ্রুতের উল্লেখ রয়েছে। সুশ্রুত বৌদ্ধযুগের পূর্ববর্তী একথা বলা যায়। শল্যচিকিৎসা পদ্ধতির প্রবর্তক শল্য আয়ুর্বেদিক ধন্বন্তরি কর্তৃক যে সম্প্রদায়ের জন্ম তাদের প্রামাণ্য সংকলনই হল সুশ্রুত সংহিতা। কাশীরাজ দিবোদাসের শিষ্য সুশ্রুত এই গ্রন্থের সংকলক। কিন্তু বর্তমান যে সংস্করণ প্রাপ্ত হয় সেটি নাগার্জুণ দ্বারা পরিমার্জিত ও সংশোধিত রূপ। নাগার্জুন ছিলেন বৌদ্ধতান্ত্রিক এবং প্রাচীন সুশ্রুতের সংস্কর্তা। সুশ্রুত সংহিতার ৬টি অধ্যায়। যথাক্রমে— প্রথমতঃ সূত্রস্থান-শল্য চিকিৎসাবিষয়ক শব্দবাজীর অর্থ নির্ণয় ও ভেষজের শ্রেণি নির্ণয়। দ্বিতীয়তঃ নিদানস্থান রোগের কারণ ও লক্ষণ নির্ণয়। তৃতীয়তঃ শারীরস্থান—মানবদেহের বিবরণ ও ভ্রুণতত্ত্ব, চতুর্থতঃ চিকিৎসা স্থান রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি। পঞ্চমতঃ কল্পস্থান বিবিধ বিষ ও তাদের প্রতিক্রিয়া, চিকিৎসা, শেষতঃ উত্তরতন্ত্র,—পরবর্তী কালের রচনা। এই অংশে নানাবিধ বিষয় স্থান পেয়েছে। সুশ্রুত মানবদেহের সুস্বাস্থ্য বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণার অধিকারী ছিলেন। তাঁর মতে রোগ নিরাময় করাই চিকিৎসকের কাজ নয়। তার বড় কাজ হল রোগ যাতে না হয় তার প্রতি, দৃষ্টি দেওয়া। অর্থাৎ ‘Prevention better than ceure কথাটির ধারণা তিনিই বহুপূর্বে দিয়েছিলেন।
সুশ্রুত মনে করতেন শল্যচিকিৎসার দ্বারা মানব দেহ পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়, ও দীর্ঘায়ুলাভ করতে সক্ষম হয়। এই প্রক্রিয়া ৭টি ভাগে বিভক্ত। ছেদন-(ampu- tation), ভেদন (excision ) লেখন (scrapping), ত্রযান (probing) আহরণ (extracting) বিস্রবণ (drainage), ও সীবন (stiching)। Plastic surgery (অঙ্গ সংস্থান) এবং ত্বক অধিরোপন (Skingrafting) ইত্যাদির আলোচনাও স্থান পেয়েছে।
চরকের ন্যায় সুশ্রুত সংহিতারও বহু টীকা বর্তমান। তন্মধ্যে ভানুমতী নামে চক্রপানিদত্ত রচিত টীকা মূল্যবান। জৈয়ট ও গয়দাস প্রাচীন টীকাকার বলে সমধিক সমাদৃত। ডম্বণ-এর ‘নিবন্ধসংগ্রহ’ নামক টীকা, ইনি চক্রপানিদত্তের পূর্ববর্তী। ‘নানীতক’ বলে একটি গ্রন্থ পাওয়া যায় সেখানে আত্রেয়, হারীত, ও সুশ্রুত এই তিন চিকিৎসকের নামে ‘বৃষ্যযোগ’ (Prescription of Tonic) বিষয়ে আলোচনা দৃষ্ট হয়।
‘বাগভট’ হলেন চরক ও সুশ্রুতের পরবর্তীকালের আয়ুর্বেদ বিদ্। মূলতঃ চরক ও সুশ্রুতের সারাংশেরই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর লেখা অষ্টাঙ্গহৃদয’ গ্রন্থে। দুইজন বাগভট্ ছিলেন বলে মনে করা হয়। প্রথমজন বৃদ্ধ বা প্রথমবাট ও দ্বিতীয়জন হলেন দ্বিতীয় বাগভট, তাঁর প্রণীত গ্রন্থ ‘অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ’, খ্রিঃ ষষ্ঠ শতকে প্রথম বাটের কাল ধরা হয়। তিনি প্রথমে ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং পরে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। অষ্টাঙ্গ হৃদয়ের উপরে টীকা লিখেছেন অরুণদত্ত, নাম সর্বাঙ্গ সুন্দরা ( ১২শ শতকে) এবং হেমাদ্রি লিখেছেন অষ্টাঙ্গহৃদয়টীকা (১৩শ শতকে)। দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে অষ্টাঙ্গহৃদয় সংহিতার ব্যাপক পঠন পাঠন লক্ষ্যণীয়।
বুদ্ধের সমসাময়িক অপর এক চিকিৎসক ছিলেন জীবক, কায় চিকিৎসায় পারদর্শী এই বৈদ্য রাজা বিম্বিসারের গৃহচিকিৎসক ছিলেন। তিনি কেবলমাত্র কায়চিকিৎসাই নয়, শল্য ও কৌমার ভৃত্যেও সমান দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। বাভটের পূর্বে ভেল ও হারীত আয়ুর্বেদ চিকিৎসক হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু তাদের রচিত গ্রন্থ কালক্রমে লুপ্ত হয়ে যায়। আনন্দের বিষয় এই যে ভেল রচিত পুস্তকের একটি আধুনিক সংস্করণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভেলসংহিতা নামে প্রকাশিত হয়েছে।
বিখ্যাত বৌদ্ধ চিকিৎসক নাগার্জুন চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। পতঞ্জলির সম্প্রদায়ভুক্ত এই সুপণ্ডিত ব্যক্তিটিই সর্বপ্রথম ঔষধে ধাতব পদার্থ যেমন, পারদ, লোহা প্রভৃতির ব্যবহার শেখান। গোঁড়ার দিকে কেবলমাত্র উদ্ভিদ, খনিজ, পদার্থের দ্বারা ঔষধ তৈরী হত। তিনিই দেখান যে Black sulphide of mercury বা কজ্জলী তৈরীর, পদ্ধতি। তৎপ্রবর্তিত চিকিৎসা পদ্ধতি ‘রসবৈদ্য সম্প্রদায়’ বা সিদ্ধসম্প্রদায নামে খ্যাত ছিল। তাঁর রচিত ‘রসরত্নাকর’ রসায়নশাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ। রসপ্রয়োগ কর্তা বলে তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। কায়চিকিৎসা বিষয়ে নাগার্জুন কৃত যোগশতক বা যোগসার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তিনি বৌদ্ধ ছিলেন। ইতিহাসের বিচারে খ্রিষ্টের প্রথম শতাব্দীই তাঁর কাল বলে চিহ্নিত হয়।
সপ্তম শতাব্দীর শেষাংশে মাধবকরের আবির্ভাব কাল। তাঁর ‘নিদান সংগ্রহ’ মূলতঃ চরক, সুশ্রুত বাগভট প্রভৃতির পাঠে সমৃদ্ধ, অষ্টম শতকে আরবদেশে উক্ত গ্রন্থের অনুবাদ হয়। নিদান শাস্ত্রে মাধবগ্রন্থটি প্রামাণ্য স্বরূপ। বিজয় রক্ষিতের ব্যাখ্যান, মধুকোষ বিখ্যাত। এই বিষয়ে ধন্বন্তরির ‘চিকিৎসাসংগ্রহ’ গ্রন্থটিও উল্লেখযোগ্য।
‘বৃন্দ’ নামে যে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ছিলেন তিনি চক্রপাণিদত্তের পূর্ববর্তী এবং মাধবকরের পরবর্তী বলে মনে করা হয়। খ্রিঃ নবম শতকে বিদ্যমান ছিলেন। বৃন্দ কর্তৃক রচিত সিদ্ধযোগ উল্লেখযোগ্য। শ্রীকণ্ঠ উক্ত গ্রন্থের টীকাকার, তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘ব্যাখ্যাকুসুমাবলী’। এছাড়া বৃন্দটিপ্পনী নামে আর একখানি টীকা উপলব্ধ।
খ্রিষ্টীয় ১০৬০ শতকে চক্রপাণি দত্ত ছিলেন ‘চক্রদত্ত’ গ্রন্থের রচয়িতা। এছাড়া তিনি চরক ও সুশ্রুতের বিখ্যাত টীকাকার ছিলেন। ইনি নাগার্জুন, বৃন্দ প্রমুখের নাম উল্লেখ করেছেন। বীরভূম জেলার অধিবাসী ছিলেন। গৌড়রাজ মহীপালের উত্তরাধিকারী নয়পালের রাজত্বে পাকশালাধ্যক্ষ ছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। গৌড়রাজের সভাসদ ও ছিলেন। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভানুদত্ত। তৎকর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চক্রপাণীম্বর শিব এখনও বিদ্যমান। ভৈষজ্য তত্ত্বে বিশেষ ব্যুৎপত্তি বশতঃ তিনি ‘দ্রব্যগুণ সংগ্রহ’ নামে গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। বিশেষতঃ এই গ্রন্থে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের বিবিধ গুণাবলী সন্নিবেশিত রয়েছে। রাজা যে খাদ্যের গুণ জিজ্ঞাসা করতেন, তিনি তাই ব্যাখ্যা করে বলতেন। কায়চিকিৎসার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- ‘চিকিৎসা সারসংগ্রহ’ উল্লেখের দাবী রাখে।
‘রসরত্নসমুচ্চয়’ নামে রাসায়নিক গ্রন্থের রচয়িতা বাগভটও বিখ্যাত ছিলেন। অষ্টাঙ্গহৃদয় গ্রন্থের রচয়িতাই এই বাগভট কিনা এই বিষয়ে বহু মতানৈক্য রয়েছে। সোমদেব কৃত রসেন্দ্রচূড়ামণি গ্রন্থ অবলম্বনে আলোচ্য গ্রন্থটি নাগার্জুনের রসরত্নাকরের ন্যায় শুধুমাত্র রাসায়নিক গ্রন্থই নয়, বরঞ্চ এই গ্রন্থে রসায়নশাস্ত্রের সাথে তৎ সম্বন্ধীয় চিকিৎসার মেলবন্ধন ঘটেছে বলা যায়। ফলে গ্রন্থটি চিকিৎসাশাস্ত্রের অতি মূল্যবান গ্রন্থ হিসাবেই বিবেচিত হয়ে আসছে।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন চিকিৎসক ও গ্রন্থকারেরা তাদের পারদর্শীতার সাক্ষ্য রেখেছেন। কৌমার ভৃত্যে দুটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ছিল প্রথমতঃ’কুমারভৃত্য’, দ্বিতীয়তঃ বালচিকিৎসা। স্বাস্থতত্ত্ব বিষয়ে গঙ্গারামদাস প্রণীত শরীর নিশ্চয়াধিকার ও গোবিন্দরায়কৃত—স্বাস্থ্যতত্ত, বিখ্যাত। সুষেণকৃত অন্নপান বিধি ও রঘুনাথ কৃত ‘পথ্যাপথ্যনিঘন্ট’, বিশ্বনাথ সেনকৃত ‘পথ্যাপথ্যবিনিশ্চয়’ পথ্যতত্ত্বের অন্যতম গ্রন্থ। স্বাস্থ্যতত্ত্ব ও পথ্যতত্ত্ব বিষয়ক রচনাগুলি নিতান্তই অর্বাচীন কালের রচনা। প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসার ক্ষেত্রে নাড়ী পরীক্ষার দ্বারা রোগ নির্ণয় ছিল অতি পরিচিত ঘটনা। সেই নাড়ী বিজ্ঞান বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ পাওয়া যায়, তন্মধ্যে কুনাদপ্রণীত নাড়ীবিজ্ঞান, গঙ্গাধর কবিরাজ প্রণীত নাড়ীপরীক্ষা, শঙ্করসেনের নাড়ীপরীক্ষা উল্লেখযোগ্য।
মানবদেহের চিকিৎসার পাশাপাশি পশুচিকিৎসা সে যুগে এক যুগান্তকারী চর্চার বিষয় ছিল। রাজতন্ত্র বশতঃ অশ্ব, হস্তি তো ছিলই সেই সাথে গবাদি পশুরও বিশেষ স্থান ছিল। তাদের স্বাস্থ্যও রক্ষিত হত। পুরাণ প্রসিদ্ধ পশুচিকিৎসকেরা হলেন শালিহোত্র, নকুনল ও পালকাপ্য। পালকাপ্য রচিত মূলগ্রন্থ লুপ্ত, পরবর্তীকালে অশ্বচিকিৎসায় শালিহোত্র রচিত মূলগ্রন্থও পাওয়া যায় না। গজায়ুর্বেদে হাতির কেবল চিকিৎসাই নয়, হাতি ধরার কৌশলও উক্ত হয়েছে। অশ্বায়ুর্বেদ শাস্ত্রে অশ্ব চিকিৎসা ব্যতীত অশ্বের প্রজননের উপরে আলোচনা দৃষ্ট হয়। গজায়ুর্বেদের গ্রন্থ যেমন-নীলকণ্ঠ ও নারায়ণ রচিত মাতঙ্গলীলা, নারায়ণ দীক্ষিতের ভাজগ্রহণ প্রকাব, অশ্বায়ুবেদের গ্রন্থ যথাক্রমে অশ্বশাস্ত্র, অশ্বতন্ত্র, হয লীলাবতী গ্রন্থের গ্রন্থকারের নাম অজ্ঞাত। কিন্তু জয়দত্তসুরি ও দীপঙ্কর রচিত অশ্ববৈদ্যক, শাঙ্গধর প্রণীত তুরঙ্গপরীক্ষা ও বাজিচিকিৎসা, উল্লেখযোগ্য। প্রাচীনকালের গবাদিপশুবিষয়ক কোনগ্রন্থ বর্তমানে উপলব্ধ নয়। তবে পুরানাদিতে এই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা দৃষ্ট হয়।
সুদূর প্রাচীন কালের বৈদিক সাহিত্যে যে চিকিৎসাশাস্ত্রের যাত্রাপথ শুরু হয়েছিল সভ্যতার বর্তমান ধাপে পা দিয়ে তার জয়মাত্রা অব্যাহত রয়েছে। নব নব আবিষ্কারে সমৃদ্ধ হয়ে বর্তমান চিকিৎসা শাস্ত্র বহু উন্নত হয়েছে। তবে একথা উল্লেখ্য যে— নানাকালে নানাদেশে আমাদের এই প্রাচীন সভ্যতা ও আবিষ্কার প্রভাব বিস্তর করেছে। আরব ও পারস্যদেশের মাধ্যমে গ্রীস দেশে এই আয়ুর্বেদ শাস্ত্র প্রভাব বিস্তার করছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে প্রাচ্যের শাস্ত্র মর্যাদার সাথে গৃহীত ও বহুল পরিমাণে চর্চিত বলা যায়।