ষষ্ঠ অধ্যায় – চম্পু কাব্য

ষষ্ঠ অধ্যায় – চম্পু কাব্য

সংস্কৃত সাহিত্যের চিরাচরিত পদ্যাশ্রয়ী কাব্য ও গদ্যাবলম্বনে রচিত গদ্য, কথা ও আখ্যায়িকা শ্রেণির রচনা ব্যতীত আর এক কাব্যরচনার প্রয়াস ঘটেছিল, যা নাকি গদ্য ও পদ্যের সংমিশ্রণে অভিনব রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। সপ্তমশতক কি তারও পূর্বে এই জাতীয় রচনার সৃষ্টি হলেও দশম শতক থেকে এই কাব্যের খানিক জনপ্রিয়তা গড়ে উঠেছিল. গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণে রচিত এই জাতীয় কাব্য ‘চম্পুকাব্য’ নামে প্রসিদ্ধ। সংস্কৃত আলঙ্কারিকগণের দৃষ্টিতে এই কাব্যের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছিল বটে কিন্তু তা নিয়ে বিশদ আলোচনা কোথাও চোখে পড়ে না। আলঙ্কারিক দণ্ডাচার্য্যের মতে’গদ্যপদ্যময়ী কাচিৎ চরিতাভিধীয়তে।’ ( ১।৩১ )

অর্থাৎ গদ্য, পদ্যের মিশ্রণে যে কাব্য তাই চম্পু নামে পরিচিত। সাহিত্য দর্পণকার বলেছেন—”গদ্যপদ্যময়ং কাব্যং চরিত্য-ভিধীয়তে।” (৬।৩১২) আলঙ্কা। একদিগের এইরূপ সংজ্ঞা থেকে চম্পুকাব্যে গদ্য-পদ্যের আনুপাতিক হার কি অথবা উৎকর্ষের বিচারে গদ্য অথবা পদ্যের হার কেমন হবে? অথবা সকল প্রকার গদ্য পদ্যময় কাব্যই চম্পু কি না? এই সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর মেলে না।

অতি প্রাচীন কাল থেকেই সংস্কৃত সাহিত্যের পথ চলা শুরু। প্রথম পদ্যের হাত ধরেই এই যাত্রা শুরু হয়। বৈদিক রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের যুগপার হয়ে সংস্কৃত কাব্য, নাটক তার যাত্রাকে অব্যাহত রেখেছিল। মধ্যে মধ্যে গদ্যেরও সংমিশ্রণ ঘটেছিল। কিন্তু সে গদ্য সম্পূর্ণ রূপে সাহিত্যের মর্যাদা পায়নি। পরবর্তীকালে দীর্ঘ অনুশীলনের ফলে ধীরে ধীরে সংস্কৃত গদ্য সাহিত্যও তার শৈল্পিক আদর্শকে পাঠক সমক্ষে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল। অতঃপর গদ্যপদ্য মিশ্রিত কাব্যের আনুষ্ঠানিক ভাবে সাড়ম্বরে আত্মপ্রকাশ ঘটল বিভিন্ন শিলালেখগুলিতে। ১৫০খ্রিঃ রুদ্রদামার গির্ণার প্রশস্তি, ৩৫০খ্রিঃ হরিসেনের সমুদ্রগুপ্ত প্রশস্তিতে চম্পুকাব্যের পূর্ণ প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালেও বহু চম্পকাব্য রচিত হয়েছে, কিন্তু চম্পুকারেরা কোন আদর্শকে সামনে রেখে বা নির্দিষ্ট কোন মাপকাঠিতে চম্পুরচনা করেন নি। ফলে চম্পুকাব্যের বিশেষত্ব গুলি ঠিক কি? তা নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে পড়ে। অতএব গদ্যের স্বচ্ছন্দরীতির সাথে ছন্দবদ্ধ পদ্যের গীতিধর্মিতা যুক্ত হয়েই চম্পুর সৃষ্টি হয়েছে বলা যায়। বিভিন্ন চম্পুকাব্য গুলি নিরীক্ষণ করে কাব্যসমালোচকেরা বলেন—চম্পুগুলি সাধারণতঃ রামায়ণ, মহাভারত অথবা পুরাণে বর্ণিত বিষয় অবলম্বনে রচিত। কখনো বা সুপ্রসিদ্ধ কোন কাহিনী অবম্বনেও রচিত হতে পারে। চম্পুকাব্যে গদ্য বা পদ্য কোনটিই অধিক প্রাধান্য পায় না। ভাব-ভাষা ও ঘটনার বর্ণনায় উভয়ের মূল্য সমান। চম্পুকারগণ গদ্যের পক্ষে অতিশয় যত্নবশতঃ ওজস্বিতা, দীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদ, অলঙ্কার ইত্যাদির ব্যবহার যেমন করতেন তেমনি ছন্দময় পদ্যকে যতখানি সম্ভব গীতিধর্মী করে তুলতে প্রয়াসী ছিলেন। সমালোচকদের মতে চম্পুকারগণের মৌলিকতার অভাব লক্ষ্যনীয়। পূর্ববর্তী সাহিত্যিকদের অনুকরণ বশতঃ তাদের স্ব স্ব প্রতিভা অনেকাংশে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। যে কারণে এই জাতীয় কাব্য কোন কালেই জন প্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেতে পারেনি।

তবে সাহিত্যের চুলচেরা বিচারে চম্পুর মূল্যহীনতা প্রমাণিত হলেও চমৎকারিত্বের প্রভাবে চম্পু পাঠক হৃদয়কে ক্ষণকালের জন্য বিমোহিত করত। ভোজরাজের মতে গীতবাদ্যের সমন্বয়ের ন্যায় গদ্যপদ্য মিশ্রিত চম্পুও সকল পাঠকের মনোহারী। হরিচন্দ্রের মতে বাল্য ও তারুণ্যের মধ্যবর্তিনী কান্তার মতো চম্পু রচনাও আনন্দদায়িনী।

দশমশতকের পূর্ববর্তী কোন চম্পু আমাদের হস্তগত হয়নি। তন্মধ্যে ত্রিবিক্রমভট্টের লেখা নলচম্প বা দময়ন্তীকথা সর্বাগে প্রাচীনতম। এই চম্পু মহাভারত আশ্রিত। বিখ্যাত নল- দময়ন্তী আখ্যানই এই চম্পুর মূলে। সাতটি উচ্ছ্বাসে সম্পূর্ণ। শান্ডিল্যগোত্রীয় শ্রীধরের পৌত্র এবং নেমাদিত্যের পুত্র ছিলেন কবি ত্রিবিক্রমভট্ট। রাজসভাকবি সরস্বতীর কৃপাধন্য আলোচ্য কবি নৌসারী শিলালেখরও রচয়িতা। তাঁর মতে যে কাব্য পাঠ করলে পাঠকের মাথা ঘোরায় না অথবা বুদ্ধি চমৎকৃত হয় না সেইরূপ কাব্যের কি প্রয়োজন? তিনি রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় ইন্দ্রের সভাকবি ছিলেন। অনেকে তাঁকে রাজশেখরের সমসাময়িক বলে ধারণা করেন। প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে যখন কবির পিতা রাজসভাকবি ছিলেন, সেই সময়ে একদিন একজন বিশিষ্ট কবি রাজসভায় এসে কবির পিতার দেখা না পেয়ে ত্রিবিক্রমের প্রতিদ্বন্দ্বাতাই কামনা করেন। উপযুক্ত সময়বুঝে সরস্বতীর বরধন্য কবি তখন নলচম্পু রচনা করে সেই প্রতিপক্ষের উপযুক্ত জবাব দিতে থাকেন। এমন সময়ে পিতার উপস্থিতিতে নলচম্পু অসম্পূর্ণই থেকে যায়।

কবির অসামান্য আত্মবিশ্বাসের ফলে আলোচ্য চম্পু স্থানে স্থানে অসামান্য কাব্যকৃতির ভারে (দীর্ঘ-সমাসবদ্ধ পদ প্রয়োগ, অলঙ্কার বাহুল্য, দীর্ঘ বিস্তারী বর্ণনা) কৃত্রিম ও দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। কথাকাব্যকার সুবন্ধুর অনুসারী এই কবি বৈদগ্ধ্য প্রদর্শনের প্রতি অধিক যত্নশীল ছিলেন। তবুও স্থানে স্থানে কবির যথাযথ কবিত্বশক্তির স্ফূরণ ঘটেছে, একথা অস্বীকার করা যায় না। একটি শ্লোকে প্রভাতের নৈসর্গিক বর্ণনায় কবি বলেছেন—উদয়গিরির চূড়ায় পাণ্ডুর আলোকরেখা ফুটে ওঠার পূর্বেই অস্তাচল চূড়ায় শরণ নিয়েছে অন্ধকার; এখন সমস্ত আকাশ ছেয়ে কেবল আলোর বিজয়—এ যেন গঙ্গা যমুনার দুটি ভিন্ন ধারার মিলন।` এইরূপ চমৎকার দৃষ্টান্তে চমৎকৃত হয়ে কোন এক সমালোচক তাঁকে ‘যমুনা-ত্রিবিক্রম’ আখ্যায় ভূষিত করেছেন। প্রতি উচ্ছ্বাসের শেষে ‘হরিচরণ সরোজ’ পদটি দৃষ্ট হয়, যে কারণে উক্ত চম্পু ‘হরিচরণ সরোজাঙ্ক’ নামে পরিচিত।

মার্কণ্ডেয় পুরাণের রাজা কুবলয়াশ্ব ও কুমারী মদালসার প্রণয় কাহিনী অবলম্বনে রচিত কবির আর একখানি চম্পু মদালসাচম্প। এই চম্প সহজ, সরল, ভাষা প্রয়োগে ও কবির সাবলীল রচনা বৈশিষ্ট্যে লিখিত তথাপি মহাভারত খ্যাত কাহিনীর উৎকর্ষতায়, জন প্রিয়তায় সর্বোপরি রচনা-নৈপুণ্যে ‘নলচম্পু’অনেক বেশী আকর্ষণীয় ও বিখ্যাত

মহাভারতের সম্পূর্ণ কাহিনীকে চম্পুর আঙ্গিকে রচনা করেন কবি অনন্তুভট্ট। এই কাব্য ‘ভারতচম্প’ নামে বিখ্যাত। সম্ভবতঃ তিনি দ্রাবিড়ের অধিবাসী ছিলেন, কবি নারায়ণ ভট্ট ষোড়শ শতকে অনন্তভট্টের উল্লেখ করায় বলা যায় তিনি পঞ্চদশ শতকে জীবিত ছিলেন। দ্বাদশ অধ্যায়ে সম্পূর্ণ এই কাব্যে মোট ১০৪১টি শ্লোক এবং দুইশতেরও বেশী গদ্যখণ্ড দেখা যায়। মহাভারতের দীর্ঘ কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘ভারতচম্পু’ রচনায় কবি তার পূর্বসূরীদের এবং সমসাময়িকদের এত বেশী অনুকরণ করেছেন যে কবিমনের নিরবিচ্ছিন্ন ভাব কল্পনা প্রকাশের বদলে তা এক প্রাণহীন আড়ম্বড় সর্বস্ব রচনায় পরিণত হয়েছে। সমালোচনা সত্ত্বেও এ ধরনের রচনা সে যুগের সাহিত্য ভান্ডারে এক অভিনব সংযোজন বলা যায়।

মহাভারতের দেব ও অসুরের যুদ্ধে সমুদ্র মন্থনের সুপ্রসিদ্ধ কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছিল নীলকণ্ঠ দীক্ষিতের নীলকণ্ঠ বিজয় চম্প। মহাভারতের নানা আখ্যান- উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে প্রায় ৩০টিরও বেশী চম্পু রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে চক্রকবির দ্রৌপদীপরিণয়, জানকী পরিণয়, পার্বতীপরিণয় ও রুক্মিণীপরিণয় উল্লেখযোগ্য। চক্রকবি রচিত চম্পুগুলি পাঠক সমাজে সুবোধ্য ও সুখপাঠ্য বলে বিশেষ সমাদৃত।

রামায়ণ কাহিনী অবলম্বনে রচিত চম্পুগুলির মধ্যে বিদর্ভরাজ ভোজের ‘রামায়ণচম্প’ সর্বপেক্ষা জনপ্রিয়। স্বয়ং ভোজ তাঁর রচনায় সুন্দরকাণ্ড পর্যন্ত্য কাহিনী বিবৃত করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে ঘনশ্যাম, কবি মুক্তীশ্বর দীক্ষিত, লক্ষ্মণ সুরি, রাজচূড়ামণি দীক্ষিত প্রমুখের পৃথক পৃথক সংযোজন চম্পূকাব্যটির কলেবর বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছেন। ভোজরাজ শুধুমাত্র পণ্ডিতব্যক্তিই ছিলেন না, তাঁর রসবোধ, শৈল্পিকচেতনা সর্বোপরি কবিসুলভ ভাবাবেগের পরিমিত বোধ তাঁর কাব্যকে অনন্যসাধারণ মাত্রাদান করেছে। রামচন্দ্র, নারায়ণ, ঘনশ্যাম প্রভৃতি টীকাকারগণ রামায়ণ চম্পুর টীকা প্রণয়ণ করেছেন।

হিন্দুদের রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী ব্যতীত দিগম্বর জৈন সোম প্রভসুরির যশক্তি তিলকচম্প বর্তমান। দশমশতকের কোন এক সময়ে চালুক্য বংশের রাজা অরিকেশরীর জ্যাষ্ঠপুত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় কবির এই রচনা। অবন্তীরাজ যশোধরের কাহিনীই কাব্যের মূলে। বহু উপকাহিনী কাব্যের মূল বিষয়ের সাথে সংযুক্ত হয়ে আছে। শেষ তিনটি-আশ্বাসে মূলতঃ জৈনধর্মের প্রচার কাহিনীই ব্যাখ্যাত হয়েছে। সোমদেব তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় ভবভূতি, ভারবি থেকে শুরু করে ময়ূখ, কালিদাস, মাঘ রাজশেখর সকল গ্রন্থকারের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। কাব্যরচনায় মূলতঃ তিনি বাণভট্টের অনুসারী হয়েছেন। আমরা জানি জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি প্রকারান্তরে প্রচার মূলক কাব্য তথাপি প্রচার ধর্মিতা ও ঐতিহাসিক মূল্যকে সময় সময় কবির রচনা নৈপুণ্য এবং কাব্যচেতনা যেন অতিক্রম করে গেছে। বিদগ্ধ জনেরা কবি সোমদেবের গদ্য

রচনাকে বাণের সাথে তুলনা করেছেন, পদ্যের ভাষা অশ্বঘোষের ন্যায় প্রাঞ্জল বলেছেন এবং মননে ও ভাবের প্রকাশে কালিদাসের সমতুল্য এই কবি ভর্তৃহরির ন্যায় রসবোধের অধিকারী বলে উল্লেখ করেছেন। কবির আত্মবিশ্বাস তাঁকে সংস্কৃত সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করেছে।

খ্রিষ্টীয় দশম শতকে হরিচন্দ্রের ‘জীবন্ধরচম্প’ গুণভদ্রের উত্তর পুরাণ নামক জৈন আগমকে অবলম্বন করে রচিত। কবি হরিচন্দ্র ‘বাদীভসিংহ’ বিশেষণে ভূষিত হয়েছিলেন। কবির অপর দুটি গ্রন্থ যথাক্রমে ‘গদ্যচূড়ামণি’ এবং ‘ক্ষত্রচূড়ামণি, এদের বিষয়বস্তু মূলতঃ একই ছিল। ধর্মীয় রচনারূপে অধিক আকর্ষণীয় হলেও আলোচ্য গ্রন্থ গদ্যরচনার বিচারে বাণ ও স্ত্রীর সমতুল্য। এতদ্ব্যতীত কেশবভট্টের ‘নৃসিংহচম্প’, শেষ কৃষ্ণ রচিত ‘পারিজাত হরণ চম্প’। কৃষ্ণকথা অবলম্বনে রঘুনাথদাসের ‘মুক্তচরি -তচম্প’। শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার আধারে রচিত কবিকর্ণ পুরের আনন্দবৃন্দাবনচম্প একাদশ শতাব্দীতে সোডঢল রচিত উদয়সুন্দরী চম্প’—বিখ্যাত। এইরূপ ছোট বড় বহু চম্পুই চম্পুকাব্যের জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র।

চম্পু – পাদটীকা

১. গদ্যানুবন্ধরসমিশ্রিত পদ্যসূক্তিঃ /হৃদ্যাপি পদ্যকলয়া কলিতেব গীতিঃ। তস্মান্দধাতু কবিমার্গ জুষাং সুখায় চম্পু প্রবন্ধ রচনাং রসনামদীয়া।। রামায়ণ চম্পু ১।৩

২. শ্লোকটি নিম্নরূপ :—

উদয়গিরিগতায়াং প্রাক্ প্রভা পাণ্ডুতনয়া-
মনুসরতি নিশীথে শৃঙ্গমস্তাচলস্য।
জয়তি কিমপি তেজঃ সাম্প্রতং ব্যোমমধে
সলিলমিব বিভিন্নং জাহ্নবং যামুনংচ।।

নলচম্পূ ৬/১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *