সপ্তদশ অধ্যায় – স্মৃতিশাস্ত্র বা ধর্মশাস্ত্র
সূদূর বৈদিক যুগেও ধর্মীয় আচার, আচরণ, আইন-কানুন ইত্যাদির সুপরিকল্পিত অনুপ্রবেশ লক্ষ্যণীয়। বেদাঙ্গ বললে আমরা যে ছয়টি, বিষয়কে বুঝি তার অন্যতম হল কল্প বা কল্পসূত্র। এই কল্পসূত্রেরই একটি অংশ ধৰ্ম্মসূত্র বলা যায়। গদ্যে রচিত ঐ সূত্রগুলি বিদ্যমান ছিল বেদের যুগে, অতএব সহজেই অনুমেয় যে ঐ সূত্রসাহিত্যের পূর্বেও ঐ সমস্ত ধর্মসূত্রের কিছু গ্রন্থের অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব নয়। কিন্তু ঐ বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ফলে প্রমাণের অভাবে ঐরূপ ধারনার কোন ভিত্তি নেই।
বৈদিক যুগে যজ্ঞ প্রণালী ও ব্রাহ্মণ ভাগের বিপুলত্ত্ব হেতু তার সংক্ষিপ্তকরণের প্রয়োজন অনুভূত হয়, অতএব যজ্ঞপ্রণালী যাতে সহজে আয়ত্ত করা যায়, সেইহেতু প্রধান প্রধান ব্রাহ্মণগুলির কল্পসূত্র রচিত হয়। কল্পসূত্রগুলি যথাক্রমে শ্রৌতসূত্র, গৃহ্যসূত্র ও ধর্মসূত্র নামে পরিচিত ছিল। যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর সংহিতায় ধর্ম্মশাস্ত্রকার গণের নাম উল্লেখ করেছেন।’ মনু, অত্রি, বিষ্ণু, হারীত, অঙ্গিরা, আপস্তম্ভ, কাত্যায়ণ, বৃহস্পতি, পরাশর, ব্যাস, শাঙ্খায়ন, গৌতম, বশিষ্ঠ ইত্যাদির নাম পাওয়া যায়, কিন্তু এতদ্ব্যতীত বোধায়ণ, হিরণ্যকেশী, ভরদ্বাজ, বৈখানস, প্রভৃতিও ধর্মশাস্ত্রের রচয়িতা। আলোচ্য ধর্মশাস্ত্র সমূহ ‘স্মৃতি’ বা ‘সংহিতা’ নামে অভিহিত হত।
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫ম—৪র্থ শতাব্দীতে এই সূত্রসাহিত্যের আবির্ভাব। গৃহ্য ও ধর্মসূত্রগুলিতে ভারতীয় গৃহীর বিভিন্ন আশ্রম দশায় পালনীয় আচার আচারণ, উচিৎ-অনুচিৎ নির্দিষ্ট হয়েছে। মানুষের সামাজিক জীবন যাতে সুশৃঙ্খল ও আইনানুগ হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখে বিভিন্ন সূত্র সাহিত্যে গার্হস্থ্য নিয়মকানুনের পাশাপাশি ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি নিষেধের কথা বর্ণিত হয়েছে। গৃহ্যসূত্রে পারিবারিক প্রতিটি অনুষ্ঠান যেমন নবজাতকের নামকরণ থেকে শুরু করে অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, উপনয়ন, অধ্যয়ন, সমাবর্তন প্রভৃতি। এরপরে গার্হস্থ্য জীবন, পাণিগ্রহণ, গৃহনির্মাণ এমন কি বীজবপন, দারিদ্রমোচন, আরোগ্যলাভ প্রভৃতি সকল প্রকার কর্মের দিকদর্শনের মধ্য দিয়ে সামাজিক জীবন অনুষ্ঠান মুখর হয়ে থাকত। সেই সাথে সুন্দর সমাজজীবনে মানুষ প্রতিষ্ঠিত হত অনেক বেশী শৃঙ্খলিত উপায়ে। ধর্মসূত্র গুলিতে দীক্ষানুষ্ঠান, প্ৰায়শ্চিত্ত, শুদ্ধি করণের পাশাপাশি সন্ন্যাসী, বাণপ্রস্থী, ও গৃহস্থের জীবনের নানা নিয়মকানুনের আলোচনাও ছিল। রাজার কর্তব্য নির্ধারণ করা, দেওয়ানি, ফৌজদারী আইন, নারীর দায়িত্ব ও অধিকার সম্ভ্রান্ত বিষয় উত্তরাধিকার প্রাপ্তির বিষয় এই সবই ধর্মসূত্রের আলোচনার অন্তর্ভূক্ত ছিল। ভারতীয় সমাজ জীবনের আদর্শ কি হওয়া উচিৎ, এবং আচার আচরণ বিধির পাশাপাশি ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাহকও ছিল এই আলোচ্য ধর্মসূত্রগুলি। বর্তমান কালের যে ভারতীয় আইন ও দণ্ড সংক্রান্ত বিধি তা বহুলাংশে অতীতের ধর্মসূত্রগুলি দ্বারা প্রভাবিত একথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
মনুসংহিতা :—ভারতীয় সভ্যতার প্রথম সংস্কৃতি বা সাহিত্যই হল বেদ। এই বেদের অপর নাম ছিল শ্রুতি। কিন্তু কালক্রমে বেদের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা শিথিল হয়ে পড়লে শ্রুতিকে অবলম্বন করেই রচিত হল স্মৃতি বা ধর্মশাস্ত্র। যে কারণে শ্রুতির পরেই স্মৃতির স্থান চিহ্নিত হয়ে থাকে। ‘শ্রুতিস্তু বেদো বিজ্ঞেয়ো ধর্মশাস্ত্রস্ত বৈস্মৃতি।’ সমগ্র ভারতবর্ষের মূল নিহিতরয়েছে বেদে, যেহেতু মনুসংহিতা বেদকে আশ্রয় করেই রচিত সেহেতু তার অবদান অসামান্য এবং সর্বজনগ্রাহ্য। বহুপূর্বে “মানবধর্ম্মসূত্র” নামক একখানি ধর্ম্মসূত্র ছিল। অতঃপর কালক্রমে বিশ্বতোমুখ হওয়ার ফলে ঐ ধর্ম্মসূত্রই সর্বজনীনত্ব লাভ করে। এই মানবধর্ম্মসূত্রই মনুসংহিতার উৎসস্বরূপ বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করে থাকেন। তবে মনুসংহিতার সঠিক কাল নির্ণয়ে পণ্ডিতগণ ব্যর্থ, প্রাচীন ঋষিদের সাথে মনুর নাম ঋগ্বেদ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় সংহিতার সর্বত্র দৃষ্ট হয়। মহাভারত ও পুরাণের যুগেও তাঁর খ্যাতি প্রশস্ত। মহামতি মনুর ব্যক্তিত্ব ছিল সর্বকালে সর্বজন স্বীকৃত। এ-হেন ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদজ্জন কর্তৃক উল্লিখিত হয়েছেন, বশিষ্ঠ, সাংখ্যায়ন ও বৌধায়ন ধর্মসূত্রে মনু উল্লিখিত, যাস্কের নিরুক্তে মনুর উল্লেখ রয়েছে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস নিরূপনে শুধু মনোনিবেশই করেন নি, ঘটনাপরম্পরার সাথে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলা যায় স্যার উইলিয়াম জোন্সের মাত মনুসংহিতা খ্রি. পূ. ১৩শ শতকের রচনা, আবার শ্লেগেল মনুকে খ্রি. পূ. দশম শতকের বলে মনে করেন। এলফিনস্টোন খ্রি. পূ. নবম শতকে তাঁকে স্থাপন করেছেন। মনুসংহিতার টীকাকারগনের মধ্যে বীরস্বামী ভট্টের পুত্র মেধাতিথিব রচনাই সর্বপ্রথম মনে করা হয়। শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের পরে নবম শতাব্দী যদি ঐ টীকার রচনাকাল হয়, তবে নবমশতাব্দীর পূর্বে কোন এক সময়ে ‘মনুসংহিতার রচনাকাল বলা যেতে পারে। পরবর্তী কালে খ্রিষ্টীয় দশমশতকে গোবিন্দরাজের একখানি টীকা ছিল বলে মনে করা হয়। খ্রিঃ ১৫শ শতকে কুল্লুকভট্টের টীকা মন্বথমুক্তাবলী পূর্বের প্রসিদ্ধ সকল টীকাকেই অতিক্রম করে গেছে।
মনুসংহিতায় ১০০টি অধ্যায় এবং ৯০০,০০০ শ্লোক ছিল, এইরূপ নারদস্মৃতিতে উল্লিখিত আছে। কিন্তু বর্তমান যে মনুস্মৃতি রয়েছে তাতে ২৬৮৫টি শ্লোক দৃষ্ট হয়। একে লঘুমনুসংহিতা বলা হয়। মহাভারতে মনুস্মৃতির বহু শ্লোক প্রায় অবিকৃতভাবে গৃহীত হয়েছে।
মনুসংহিতার আলোচ্য বিষয়-বস্তু কেবলমাত্র তৎকালীন সমাজেরই উন্নতি বিধান করেনি, পরন্তু তৎপরবর্তী সকল কালেই এমন কি বর্তমান যুগেও সমাজ জীবনের বা হিন্দু সামাজিক জীবনের উপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। যখনি স্মৃতির ক্ষেত্রে কোন বিরোধ উপস্থিত হয়েছে, তখনি মনুস্মৃতিকে প্রামাণ্য মনে করে বিরোধের নিস্পত্তি প্রচলিত ছিল। হিন্দু সামাজিক জীবনের পালনীয় সকলপ্রকার ধর্ম-কর্ম, আচার-বিচার, নিয়ম-কানুন এমনকি রাজারধর্ম কীরূপ হওয়া উচিৎ, রাজার চালচলন ও কর্তব্য কীরূপ তাও নির্দিষ্ট রয়েছে। মানবজীবনের বহুবিধ সংস্কার, শিক্ষা-দীক্ষা, জীবিকা-নির্বাহ, বিবাহ সকল বিষয়েই যাবতীয় বিধিনিষেধ এবং পালনীয় কৰ্ত্তব্য বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। অতএব মানব জীবনে এই ধরনের স্মৃতি শাস্ত্রের ভূমিকা অপরিসীম একথা বলা বাহুল্য।
যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা :—যাজ্ঞবল্ক্য ছিলেন বিদেহরাজা জনকের পুরোহিত এবং শুক্লযজুর্বেদের স্রষ্টা। শুক্ল-যর্জুবেদের পারস্কর গৃহ্যসূত্রের অবলম্বনে আলোচ্য সংহিতার সৃষ্টি। খ্রিঃ পূঃ প্রথম শতক থেকে খ্রিষ্টীয় প্রথমশতকের কোন এক সময়ে এই সংহিতার রচনাকাল বলা যেতে পারে। কারণ বৌদ্ধভিক্ষু ও ভিক্ষুণী দিগের নাম উল্লেখ থাকায়, এই সংহিতা বৌদ্ধযুগের পূর্বে রচিত হয়েছিল এরূপ অনুমান যুক্তি সাপেক্ষ। মহামান্য মনু অপেক্ষা অর্বাচীন এই ঋষির রচনা অন্যান্য স্মৃতি শাস্ত্রকার অপেক্ষা প্রাচীন অর্থাৎ মনু ও অন্যান্য ধর্ম্মশাস্ত্র কারগণের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি বিদ্যমান ছিলেন। মনুসংহিতার পরেই যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার খ্যাতি ও সমাদর লক্ষ্যনীয়। পরবর্তীকালে এই যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা কোন কোন আলোচনার ক্ষেত্রে মনুসংহিতার খ্যাতি ও প্রতিপত্তিকেও অতিক্রম করে গিয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বঙ্গ দেশে জীমূতবাহনের দায়াধিকার প্রবল ভাবে সমর্থন লাভ করেছিল। এতদ্ব্যতীত কেবল ধর্ম্মাধিকরণেই নয় প্রায় সকল বিষয়ে যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতাই ভবিষ্যতে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিল। যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার শ্লোকসংখ্যা ১০০৯টি। তিনটি কাণ্ডে বিভক্ত। প্রথমকাণ্ড আচারকাণ্ড বলে প্রসিদ্ধ। মনুসংহিতার প্রথম সাত কাণ্ডের বিষয়াবলী এখানে বিধৃত হয়েছে। দ্বিতীয়টি হল ব্যবহার কাণ্ড, এই ভাগে দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন বিধি সন্নিবিষ্ট আছে। উভয়ের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু এক হলেও, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পার্থক্যও লক্ষ্যনীয়। — যেমন-মনুসংহিতায় উচ্চবর্ণের বা ব্রাহ্মণের পক্ষে শূদ্রা স্ত্রী গ্রহণে আপত্তি নেই। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য এই মতের বিরোধী ছিলেন। যাজ্ঞবল্ক্য ক্ষেত্রজ বিধি মেনে নিয়েছেন এবং বিধবা অপুত্রক পত্নীর দায়াধিকার সম্বন্ধে মনু নীরব থাকলেও যাজ্ঞবল্ক্য সরব হয়েছেন। সর্বশেষ বা তৃতীয় কাণ্ড হল প্রায়শ্চিত্য কাণ্ড। বিচারালয়ে সত্য মিথ্যা নিরূপণের জন্য তুলাদিব্য, অগ্নিদিব্য, জলদিব্য, বিষদিব্য, কোষদিব্য প্রভৃতি দিব্যপ্রকরণের আলোচনা যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মনুসংহিতার সাথে মূল বিষয়বস্তুর বহুলাংশে মিল থাকলেও এই প্রকরণের আলোচনা এস্থলে সম্পূর্ণ নূতন ও ভিন্ন। লেখা প্রমাণও এর আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্গত। সামাজিক ও আইনি বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে যাজ্ঞবলক্যসংহিতা মানবজীবনের এক অপরিহার্য বিষয়। মানব-জাতির বংশ পরম্পরায় প্রয়োজনের সাথে সাথে আলোচ্য বিষয়ের পরিবর্তন ঘটলেও তার মূলবীজ কিন্তু নিহিত রয়েছে এই সমস্ত স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতেই।
অতি প্রসিদ্ধ এই যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার অজস্রটীকাও রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে সম্ভবতঃ নবমশতকীয় বিশ্বরূপ কর্তৃক রচিত ‘বালক্রীড়া’ অতি প্রসিদ্ধ। পরবর্তী কালে এই বালক্রীড়াকে অবলম্বন করে বিভাবনা, অমৃত নিন্দসী এবং বচনমালা রচিত হয়েছে। উড়িষ্যা এবং কাশ্মীরে অপরাক রচিত টীকাও জনপ্রিয় ছিল। একাদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানেশ্বরের মিতাক্ষরা টীকা যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার বিখ্যাত টীকা। তবে বিশ্বরূপ কর্তৃক বালক্রীড়া তদপেক্ষা প্রায় ২০০ বৎসরের প্রাচীন বলে পণ্ডিতদের অভিমত, তবে বঙ্গ দেশে দায়াধিকরণে জীমূতবাহনের দায়ভাগ এই মিতাক্ষরা অপেক্ষায় অধিক সমাদৃত ছিল। বিজ্ঞানেশ্বর অনেককে বিজ্ঞানযোগী নামে অভিহিত করেছিলেন। মিতাক্ষরার দুটি বিখ্যাত টীকা যেমন—বিশ্বেশ্বর ভট্টকৃত সুবোধিনী এবং বালমভট্টকৃত বালমভট্টি নামকটীকা। শূলপাণি কৃত ‘দীপকলিকা’ যাজ্ঞবলক্য সংহিতার অপর এক প্রসিদ্ধ টীকা।
নারদ সংহিতা :—নারদস্মৃতি মূলতঃ মনুসংহিতারই অংশ বিশেষের সারসংকলন মাত্র। লক্ষাধিক শ্লোক সম্বলিত মনুগ্রন্থের ১২,০০০ শ্লোক চয়ন করে নারদ সংহিতা রচিত হয়েছে। একে নারদ ধর্ম্মশাস্ত্রও বলা হয়ে থাকে। মনুসংহিতা ও নারদসংহিতার বিষয়ে স্বভাবতই মিল রয়েছে। এই সংহিতার একখানি টীকা পাওয়া যায় অসহায় কর্তৃক রচিত। মনুসংহিতার আইন সংক্রান্ত পরিশিষ্টরূপে নারদ-সংহিতার পরিচিতি রয়েছে।
বৈষ্ণব ধৰ্ম্মশাস্ত্ৰ বা বিষ্ণু সংহিতা :— বিষ্ণু সংহিতার মূল নিহিত রয়েছে যজুর্ব্বেদীয় কাঠকশাখার ধর্ম্মসূত্র সমূহে। বিষ্ণু সংহিতার দু’প্রকার পাঠ দৃষ্ট হয়। অনুমেয় যে কিছু অংশ প্রাচীন ও কিছু অপেক্ষাকৃত অর্বাচীনকালের রচনা। এই সংহিতার টীকাকার নন্দপণ্ডিত। তার রচিত টীকা ‘বৈজয়ন্তী’ নামে প্রসিদ্ধ।
পরাশর সংহিতা বা পরাশরস্মৃতি :—কলিযুগে পরাশর সংহিতা লিখিত হয়েছিল, সেই অর্থে পরাশরসংহিতা অন্যান্য প্রচলিত বা মান্য সংহিতাগুলি অপেক্ষা নবীন। কলিযুগের উপযোগী ধর্ম ব্যবস্থাপিত হয়েছে আলোচ্য সংহিতায়। মাধবাচার্য পরাশরমাধবীয নামে টীকা রচনা করেছেন।
বঙ্গদেশীয় স্মৃতিশাস্ত্রকার জীমূতবাহন ‘ধর্ম্মরত্ন’ গ্রন্থের রচয়িতা। আলোচ্য গ্রন্থের দায়ভাগ অংশ বঙ্গদেশে অতিপ্রসিদ্ধ শাস্ত্র বলে পরিগণিত। তিনি অজয়নদের তীরবর্তী পরিগ্রাম নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পূর্বে আলোচিত মিতাক্ষরা প্রসঙ্গে জীমূতবাহনের দায়ভাগ এর আলোচনা করা হয়েছে। কেবলমাত্র বঙ্গদেশেই আলোচ্য দায়ভাগ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, অন্যথায় হিমালয় থেকে কুমারিকা সর্বত্রই মিতাক্ষরা শাস্ত্রই প্রমাণ্যরূপে প্রযুক্ত হত। তিনি শ্রীকরের পরবর্তী এবং শূলপানি ও রঘুনন্দনের পূর্ববর্তী অতএব ১১শ থেকে ১২শ শতকে জীমূতবাহনকে স্থাপন করা চলে। শ্ৰীনাথ আচার্য চূড়ামণির চূড়ামণি টীকা এই বিষয়ে সর্বপ্রাচীন ও প্রামাণ্য গ্রন্থ। পরবর্তীকালে শ্রাদ্ধ-বিবেক নামে টীকা রচনা করেন অচ্যুত চক্রবর্তী। দায়ভাগের উপরে শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কারের দায়ভাগ সুবোধিনী নামক টীকাও বিখ্যাত। তিনি দায়ক্রমসংগ্রহ নামক পৃথক গ্রন্থেরও রচয়িতা
অতঃপর বঙ্গদেশীয় স্মৃতিশাস্ত্রকার গণের মধ্যে রঘুনন্দন ও গোবিন্দ নন্দের নাম উল্লেখ করা যায়। স্মার্ত্তশিরোমণি রঘুনন্দন ছিলেন হরিহর ভট্টাচার্যের সুযোগ্য পুত্র। তিনি নবদ্বীপে চৈতন্যের সমসাময়িক ছিলেন। অতএব পঞ্চদশ শতকের শেষ থেকে ষোড়ষ শতকের প্রথমার্ধে বিদ্যমান ছিলেন এইরূপ বলা যায়। অষ্টাবিংশতিতত্ত্বের মধ্যে দায়তত্ত্বরচনা অধিক গ্রহণযোগ্য ছিল। বলাবাহুল্য বঙ্গদেশীয় স্মৃতিকারেরা জীমূতবাহনকেই অনুসরণ করে ধন্য হয়েছেন। তাঁর গ্রন্থে যা অনুক্ত ছিল, এখানে তা উক্ত হয়েছে, যা অসম্পূর্ণ ছিল, আলোচ্য গ্রন্থে তা সম্পূর্ণ রূপ লাভ করেছে। রঘুনন্দনের দায়তত্ত্বের উপরে কাশীরাম বাচস্পতি বিরচিত টীকা প্রসিদ্ধ। এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন রঘুনন্দন গোবিন্দানন্দের নাম উল্লেখ করেছেন। ইনি গণপতিভট্টের পুত্র। বাঁকুড়া জেলার অধিবাসী। তাঁর রচিত স্মৃতি গ্রন্থের খণ্ডগুলি কৌমুদী বলে পরিচিত ছিল। বর্ষক্রিয়া কৌমুদী, দানক্রিয়া-কৌমুদী, শ্রাদ্ধক্রিয়াকৌমুদী, শুদ্ধি কৌমুদী ও ক্রিয়াকৌমুদী। নামের মধ্য দিয়েই বিষয়ের আভাষ পরিস্ফুট। খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতকের অপর এক বঙ্গদেশীয় স্মৃতিকার হলেন হলায়ুধ। রাজা লক্ষণসেনের সময়ে তাঁর রাজকার্য পরিচালনার তাগিদে রচিত হয় ব্রাহ্মণ সর্বস্ব নামক স্মৃতিগ্রন্থ। কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ ধর্মের আলোচনাই নয়, এটি একটি আইনগ্রন্থও বটে।
এতদ্ব্যতীত দক্ষিণভারতীয় স্মৃতিগ্রন্থের মধ্যে স্মৃতিচন্দ্রিকা রচিত হয়েছিল ১৩শ শতাব্দীতে দেবানন্দভট্ট কর্তৃক। ঐ সময়েই দাক্ষিণাত্যে প্রতাপরুদ্রদেবের সরস্বতীবিলাস প্রসিদ্ধ। তবে সর্বাপেক্ষা পরিশ্রম পূর্বক সকল শাস্ত্রমন্থন করে অভূত পূৰ্ব গ্ৰন্থ রচনাকরলেন হেমাদ্রি, তাঁর রচিত গ্রন্থ চতুবর্গচিন্তামণিও ১৩শ শতকের শেষভাগে রচিত। তিনি দেবগিরি রাজসভায় বোপদেবের সাথে বিদ্যমান ছিলেন।
নীলকণ্ঠ রচিত ব্যবহার ময়ুখ সম্ভবতঃ ১৬শ শতাব্দীতে প্রকাশিত গ্রন্থ। এছাড়া কমলাকর ভট্টের নির্ণয়সিন্ধু ও মিত্রমিশ্র রচিত বীর মিত্রোদয় বোম্বাই প্রদেশে বা পশ্চিম ভারতের বহুল ব্যবহৃত গ্রন্থ।
মিথিলা সংস্কৃত শাস্ত্রের অন্যতম স্থান। মিথিলায় স্মার্ত বাচস্পতিমিশ্রের ‘বিবাদচিন্তামণি’ ও ব্যবহাব চিন্তামণি অতিশয় প্রসিদ্ধ দুটি গ্রন্থ। তিনি মিথিলা বাসীর মনে আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয়েছিলেন। বিখ্যাত নৈয়ায়িক বাচস্পতি মিশ্র থেকে পৃথক এই ব্যক্তি ১৫শ শতকে বর্তমান ছিলেন। এছাড়াও চণ্ডেশ্বরঠাকুর কৃত বিবাদ রত্নাকর এবং বিবাদ চন্দ্র নামে—দুটি গ্রন্থ রচিত হয় ১৪শ শতকে। এবং মদন পারিজাত নামে বীরেশ্বর ভট্টবিরচিত গ্রন্থও মিথিলায় অধিক সমাদৃত।
কথিত আছে রঘুমণি নামে কোন বঙ্গদেশীয় পণ্ডিত তাঁর প্রিয় ভূস্বামীর রাজকার্যের সুবিধার্তে ‘দত্তকচন্দ্রিকা’ নামে একখানি দত্তক নিবদ্ধ রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থের ইংরাজী অনুবাদ হেতু তা বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল। এছাড়া দত্তকমীমাংসা ১৬শ শতকের অপর এক দত্তকগ্রন্থ, নন্দপণ্ডিত কর্তৃক রচিত ছিল।
পাদটীকা – স্মৃতি বা ধৰ্ম্মশাস্ত্র—
১. মন্বত্রি-বিষ্ণু-হারীত-যাজ্ঞবন্ধ্যো শনোঽঙ্গিরাঃ।
যমাপস্তন্বসন্বৰ্ত্তাঃ কাত্যায়ন বৃহস্পতী।।
পরাশর-ব্যাস-শঙ্খ-লিখিতা দক্ষ-গৌতমৌ।
শতাতপো বশিষ্ঠশ্চ ধৰ্ম্মশাস্ত্র প্রয়োজকাঃ।।
যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা। ১।৪-৫
২. ‘বেদোহ খিলো ধর্মমূলম্’—নিখিলধর্মের মূল নিহিত রয়েছে বেদে।
৩. মনুর প্রামান্য স্বীকার করে বৃহস্পতি বলেছেন—
‘বেদার্থোপনি বন্ধুত্বাৎ প্রাধান্যং হিমনোঃস্মৃতেঃ।
মন্বর্থবিপরীতা থা সা স্মৃতির্ন প্রশস্যতে।।
৪. বালমভট্ট নাগেশভট্টের ছাত্র ছিলেন।
৫. জীমূতবাহন স্বপরিচয় প্রসঙ্গে বলেছেন-
‘পারিভাদ্র কুলোদ্ভূতঃ শ্রীমান্ জীমূত বাহনঃ।
দায়ভাগং চকারেমং বিদূষাং সংশয়চ্ছিদে।।’