একাদশ অধ্যায় – অলঙ্কার শাস্ত্র ও নাট্যশাস্ত্র
অলঙ্কার শাস্ত্র বলতে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ধারা ও তার সমালোচনা মূলক ইতিহাসকেই বোঝানো হয়ে থাকে। সুপ্রাচীন কাল থেকে এই শাস্ত্র চলে আসলেও সুদূর বৈদিক-যুগে বা বৈদিক সাহিত্যে এর কোনরূপ উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে এর ব্যাবহারিকরূপ বা প্রতিফলন সুস্পষ্ট। অতএব নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সাহিত্য সৃষ্টি কারীর অজ্ঞাতসারেই কাব্যসাহিত্যে অলঙ্কারের অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে। সেইহেতু আমরা ঋগ্বেদে উপমা অলঙ্কারের বহু নিদর্শন পাই, শতপথব্রাহ্মণে ও ছান্দোগ্য উপনিষদে, ঋগ্বেদে উপমা অলঙ্কার এর নমুনা পাওয়া যায়। রূপক, অতিশয়োক্তি, অনুপ্রাস, যমকাদি অলঙ্কারও দৃষ্ট হয়। যাস্ক তার নিরুক্তে উপমা ও রূপকের মধ্যে শ্রেণিভেদ প্রসঙ্গে গর্গের মত উল্লেখ করেছেন। নিরুক্তে উপমার শ্রেণিভেদ, ভূতোপমা, কর্ম্মোপমা, রূপোপমা, সিদ্ধোপমা, লুপ্তোপমা, প্ৰভৃতি যাস্ক ঋগ্বেদ থেকে দেখিয়েছেন। কিন্তু বৈদিক যুগে অলঙ্কারের ব্যবহার দেখা গেলেও কোন অলঙ্কার শাস্ত্র বিদ্যমান ছিল না। পরবর্তীকালে পাণিনি তার অষ্টাধ্যয়ীতে রূপক ও উপমা অলঙ্কারের ব্যবহার করেছেন। অতএব পাণিনি পূর্বযুগে অলঙ্কার শাস্ত্র বিদ্যমান ছিল। এমনকি পুরাণেও কাব্যের লক্ষণ সুস্পষ্ট। পুরাণে কাব্যের বিভাগ, রীতি, গুণ, দোষ প্রভৃতিও আলোচিত হয়েছে।
কাব্যের স্বরূপ ও উপাদান বিষয়ে আলঙ্কারিক দিগের মতান্তরের শেষ নেই। কেউ অলঙ্কারকে প্রধান বলেন, কেউ বা রীতিকে, আবার কারুর মতে রসই কাব্যের মূল বিষয়। কারুর মতে ধ্বনিই কাব্যে প্রধান বিষয়। অলম্ শব্দের অর্থ যদি হয় ভূষণ, তবে এক অর্থে অলঙ্কার কাব্য সৌন্দর্যকেই বোঝায়। আবার গৌণ অর্থে যমক, অনুপ্রাস ইত্যাদি শব্দালঙ্কার এবং উপমা, রূপকাদি অর্থালঙ্কারকে বুঝায়। এই শব্দালঙ্কাব ও অর্থালঙ্কার হল কাব্যের বহিরঙ্গ ধর্ম এবং শব্দগুণ ও অর্থগুণ হল কাব্যের অন্তরঙ্গ গুণ। শব্দ ও অর্থের সামঞ্জস্যে তৈরী যে কাব্যশরীর তার থেকে সৌন্দর্যকে পৃথক করা যায় না।
অলঙ্কার শাস্ত্রের উপর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং প্রামাণ্যগ্রন্থ হল ভরতের নাট্যশাস্ত্র। ভরতেরও পূর্ববর্তীকালে নন্দিকেশ্বর ও নারদ অলঙ্কার সাহিত্যে পারদর্শী ছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ২য় শতক থেকে খ্রিষ্টাব্দ ৩য় শতকের মধ্যে নাট্যশাস্ত্রের রচনাকাল বলে পণ্ডিতদের অভিমত, কালিদাস তার বিক্রমোর্বশীয়তে নাট্যশাস্ত্রের উল্লেখ করেছেন। ভরতের গ্রন্থ-মূলতঃ নাট্যতত্ত্ব সম্পর্কিত আলোচনা ও বিবিধ মতবাদের এক সংকলন। একে প্রাচীন ভারতীয় নাট্যকোষও বলা হয়ে থাকে। তবে এই গ্রন্থের কোন্ কোন্ অংশ মূল গ্রন্থকারের লেখা এবং কোন্ অংশ প্রক্ষিপ্ত তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব। নাট্যতত্ত্ব ব্যাতিরেকে রসতত্ত্ব, অলঙ্কার, ছন্দ, সঙ্গীত প্রভৃতি বহু বিষয় এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। সমগ্র গ্রন্থটি ৩৬টি অধ্যায়ে এবং ৫০০০ শ্লোকে বিবৃত। রসতত্ত্বের আলোচনা তার গ্রন্থে বিশেষ স্থান পেয়েছে। রসোৎপত্তি বিষয়ে তিনি বলেছেন—”বিভাবানুভাব ব্যাভিচারি সংসোগাদ রসনিস্পত্তিঃ।’ তাঁর ধারণা রস থেকেই কাব্যের উৎপত্তি এবং রসেই কাব্যের নিষ্পত্তি। ‘ন হি রসাদৃতে কশ্চিদর্থঃ প্রবর্ততে।’ তিনি আরও বলেছেন-
“যথা বীজাদ ভবেদ বৃক্ষো বৃক্ষাৎ পুস্পং ফলংতথা।
তথা মূলং রসাঃ সর্বে তেভ্যো ভাবাব্যবস্থিতাঃ।।”
অর্থাৎ বীজ থেকে বৃক্ষ হয়, বৃক্ষ থেকে পুষ্প এবং পুষ্প থেকে ফলের জন্ম, সেইরূপ বীজই যেমন সৃষ্টির মূলকারণ, রসই কাব্যের মূলীভূত তত্ত্ব, অন্যান্য ভাবসমূহ রসেই প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীকালে হর্ষ, উদ্ভট, শংকুক, ভট্ট নায়ক, মাতৃগুপ্ত প্রভৃতি আলঙ্কারিকেরা আলোচ্য গ্রন্থের উপর টীকা রচনা করেছেন। অভিনবগুপ্তের অভিনব ভারতী বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। নব্য আলঙ্কারিকদের মধ্যে মম্মট, বিশ্বনাথ কবিরাজ, জগন্নাথ বহুগ্রন্থ রচনা করেছেন। বিশ্বনাথ তার সাহিত্য দর্পণে বলেছেন- ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম’। ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে আলোচ্য আটপ্রকার রসের যেমন— শৃঙ্গার, বীর, করুণ হাস্য, রৌদ্র, ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভুত এর কথা বলেছেন পরবর্তীকালে মম্মটাচার্য নবম-রস হিসাবে শান্তরসকে তুলে ধরেছেন, বিশ্বনাথ আরও একটি রসের আলোচনা যোগ করেছেন, সেটি হল বাৎসল্য রস।
কাব্যের সৌন্দর্য ও উৎকর্ষ কিভাবে বৃদ্ধি পায় এবং কোন্ বিশেষ উপাদান কাব্যকে পূর্ণমাত্রায় সুষমামন্ডিত করে তোলে এই বিষয়ে পরবর্তীকালের আলঙ্কারিকগণের মধ্যে চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। এবং মতভেদেরও শেষ ছিল না। এইরূপ আলোচনার ফলস্বরূপ সময়ে সময়ে মত পার্থক্য বশতঃ ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছে, প্রধান যে মত চারটি দেখা যায় তা হল—(১) অলঙ্কার, (২) রীতি (৩) রস, ও (৪) ধ্বনি। এছাড়াও আরও চারটি মত মর্যাদা পেয়েছে সেগুলি যথাক্রমে (১) বক্রোক্তি (২) গুণ (৩) অনুমান (৪) ঔচিত্য।
এক্ষণে প্রধান প্রধান আলঙ্কারিক কর্তৃক প্রণীত গ্রন্থ সমূহের আলোচনা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল।
অলঙ্কার :—(ভামহ, উদ্ভট, রুদ্রট)—এই সম্প্রদায়ের মতে অলংকারই কাব্যের শোভা বর্ধনকারী বিষয়। রসের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা গৌণ বলেই বিবেচিত। কাব্যের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলতে যথাক্রমে শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার এই উভয়েরই প্রয়োজন। শব্দ ও অর্থের সমান গুরুত্ব স্বীকার করে ৭ম খ্রিস্টাব্দে ভামহ রচনা করলেন তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ কাব্যালঙ্কার। এই গ্রন্থ মোট ছয়টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। শ্লোকসংখ্যা ৪০০। কাব্যালঙ্কারে মোট ৩৮টি অলঙ্কার ও ১০টি কাব্যগুণ আলোচিত হয়েছে, যা প্রধান তিনটি (ওজঃ, মাধুর্য ও প্রসাদ) গুণেরই অন্তর্ভূক্ত। বক্রোক্তি মূলক অলঙ্কার সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। যা কুম্ভকের বক্রোক্তি জীবিত গ্রন্থে পূর্ণতালাভ করেছে।
সম্ভবতঃ ৮ম-৯ম শতকে অলঙ্কার প্রস্থানের অন্যতম অপর গ্রন্থকার আচার্য উদ্ভট। তাঁর গ্রন্থ অলঙ্কারসার সংগ্রহ। গ্রন্থটি ৬টি বর্গে বিভক্ত। ৭৯টি কারিকায় মোট ৪১টি অলঙ্কারের আলোচনা স্থান পেয়েছে। এবং প্রসঙ্গ ক্রমে ৯০টি উদাহরণ প্রদত্ত হয়েছে। পূর্বসূরী ভামহের সাথে প্রায় একশতাব্দীর ব্যাবধান থাকলেও মতের কিন্তু তেমন কোন অমিল ছিল না। উদ্ভটের মতে কাব্য রচনা শৈলী তিনপ্রকার——উপনাগরিকা, গ্রাম্যা, পুরুা। ভরতের পরে উদ্ভটই রসের প্রাধান্য মেনেছেন, এবং শান্তরসকে নবমরসে। স্থান দিয়েছেন। উদ্ভটের টীকাকার এর গ্রন্থ থেকে জানা যায় তিনি ভামহবিবরণ নামে আর একটি গ্রন্থেরও রচয়িতা। কলহনের মতে তিনি কাশ্মীররাজ জয়াপীড়ের সভা পণ্ডিত ছিলেন।
নবমশতকে অলঙ্কার সম্প্রদায়ভুক্ত রুদ্রট বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। তাঁর গ্রন্থ কাব্যালঙ্কার বা রুদ্রটালঙ্কার নামে পরিচিত। গ্রন্থটি ১৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত। ৭৩৪টি কারিকায় ৬৬টি অলঙ্কারের আলোচনা স্থান পেয়েছে। আর্যাছন্দে রচিত উদাহরণগুলি সবই তার নিজস্ব সৃষ্টি। অলঙ্কার সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও তিনি তাঁর গ্রন্থে সর্ববিষয়ের প্রতিই আলোকপাত করেছেন। নতুন নতুন অলঙ্কার সৃষ্টি করেছেন। রসের আলোচনা করলেও রস অপেক্ষা অলঙ্কারই বেশী মর্যাদা পেয়েছে। রীতির আলোচনা করলেও গুণ সম্পূর্ণ বর্জিত। তিনি পূর্বসূরীদের নবমরসের সাথে পুনরায় বাৎসল্য-রসের যোগ করেছেন। তাঁর রচনার অনেক টীকাকার থাকলেও নমিসাধুব নাম উল্লেখযোগ্য। নমিসাধুর গ্রন্থের নাম ষড়াবশ্যটীকা।
রীতি : (দণ্ডী, বামন) — রীতিকে অবলম্বন করে যে সম্প্রদায়ের উদ্ভব, তার পুরোধা হলেন আচার্য দণ্ডী। ভামহের ‘সমসাময়িক ৭ম খ্রিস্টাব্দে বিদ্যমান ছিলেন। তাহার গ্রন্থ ‘কাব্যাদর্শ’ অলঙ্কার শাস্ত্রে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। তিন পরিচ্ছেদে বিভক্ত এই গ্রন্থ মূলত বৈদভী ও গৌড়। রীতির আলোচনায় সমৃদ্ধ। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে অর্থালঙ্কার ও তৃতীয় পরিচ্ছেদে শব্দালঙ্কারেব আলোচনা রয়েছে। বহুক্ষেত্রে দণ্ডী ভামহের মত খণ্ডন করতে প্রয়াসী হয়েছেন। কাব্য সমালোচকদের বিচারে দণ্ডী হলেন অলংকার সম্মত রীতিবাদী। কাব্যাদর্শের টীকাকার হিসাবে তরুণ বাচস্পতির নাম করা যায়।
অষ্টমশতকের রীতিবাদী আলঙ্কারিক বামন সম্পূর্ণভাবে দণ্ডীর সমর্থক। এবং দণ্ডীকেই তিনি অনুসরণ করেছেন। তিনি কাশ্মীররাজ জয়াপীড়ের সভাকবি ছিলেন তিনি তাঁর গ্রন্থ কাব্যালংকার সূত্রবৃত্তি সূত্র ও বৃত্তির আকারে রচনা করেন। পাঁচ অধিকরণে বারো অধ্যায়ে বিভক্ত এই গ্রন্থে মোট ৩১৯টি সূত্র রয়েছে। গ্রন্থের সূত্র অংশে কাব্য প্রয়োজন, রীতি, অলংকার, দোষ গুণ শব্দশুদ্ধি প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে এবং বৃত্তি অংশে বিবিধ বিষয়ের উদাহরণ স্বরূপ প্রায় আড়াইশ শ্লোক উদ্ধৃত। বামনই সর্বপ্রথম কাব্যের আত্মার অনুসন্ধান করেছেন। তাঁর মতে কাব্যের আত্মা রীতি, আর রীতির আত্মা গুণ। “রীতিরাত্মা কাব্যস্য।” বৈদভী, গৌড়ী ও পাঞ্চালী এই তিন রীতির আলোচনা করলেও বামনের মতে বৈদভী রীতিই শ্রেষ্ঠ। ‘সমগ্ৰ গুণোপেতা- বৈদভী।’ বামনের পরবর্তী কালে আর কোনো রীতিবাদী আলঙ্কারিকের উল্লেখ পাওয়া যায় না। P.V. Kane এর মতে ‘Vamana is the foremost representative of the school. ‘
রস :—(লোল্লট, শঙ্কুক, ভট্টনায়ক)—উক্ত সম্প্রদায়ভুক্ত আলঙ্কারিকদিগের মতে রসই কাব্যসৌন্দর্যের জনক, তবে এই রসোপলব্ধি কাব্যে কিভাবে ঘটে, বা পাঠক পাঠিকা, অথবা দর্শকের হৃদয়ে কিভাবে সঞ্চারিত হয় এই নিয়ে বিস্তর মত পার্থক্য বর্তমান। লোন্নটের মতে নায়ক নায়িকাকে কেন্দ্র করেই এই রসের সৃষ্টি। শঙ্কুক মনে করেন অনুমানের উপর নির্ভর করে দর্শক হৃদয়ে রসের ভাব ঘটে। আবার ভট্টনায়ক এই দুই মতের উর্দ্ধে উঠে বলেন—রস কখনও সৃষ্টি করা যায় না। অভিনেতার অভিনয় দক্ষতার গুণে এবং শব্দের দ্বারা দর্শকের হৃদয়ে আপনিই সঞ্চারিত হয়ে থাকে। লোল্লটের সময় ৮ম শতক বলা যায়। তাঁর গ্রন্থের অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায় না, তবে অভিনব গুপ্তের অভিনব ভারতী এবং মম্মটের কাব্য প্রকাশে পুস্তকের বিবরণ মেলে। শঙ্কুকেরও কোন গ্রন্থের নিদর্শন পাওয়া যায় না, তবে তিনি প্রবলভাবে লোল্লটের মতের সমালোচক ছিলেন। ভট্টনায়ককে নবম খ্রিষ্টাব্দের শেষার্ধে স্থাপন করা যায়। তাঁর রচিত হৃদয়দর্পণ নামক গ্রন্থে তিনি লোল্লট ও শঙ্কুকের বহু মতের খণ্ডন করে নিজমত প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়েছেন। কীথের ভাষায়—”Sen- timent is a condition in the mind of the spectator of a drama, or, we may add the hearer or reader of a poem produced by the Emotions of the characters, and the emotions. Bhavas are excited by factors which may either be the object of the emotion, as the loved one in the case of love, or serve the heighten it, as does the spring season.”[৫]
ধ্বনি : (আনন্দবর্ধন ও অভিনব গুপ্ত) সম্প্রদায় : ধ্বনি প্রস্থানের প্রধান আধিকারিক হলেন আনন্দবর্ধন। ধ্বনিবাদী সম্প্রদায় ধ্বনিকেই কাব্যের সব কিছু বলে মনে করেন। নবম খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগে আনন্দধবন ধ্বন্যালোক রচনা করেন। কাশ্মীররাজ অবম্ভীবর্মনের রাজত্বকালে (৮৫৫-৮৮৩খ্রীঃ) তিনি বর্তমান ছিলেন। কারও কারও মতে এই গ্রন্থ সম্পূর্ণরূপে আনন্দবর্ধনের লেখা নয়, পূর্ববর্তী কোন গ্রন্থকারের গ্রন্থ উনি সম্পূর্ণ করেছেন মাত্র। ধ্বন্যালোকের টীকা রচনা করেছেন অভিনবগুপ্ত। অপর একটি টীকা চন্দ্রিকা নামে রয়েছে কিন্তু তার গ্রন্থকারের নামজানা যায় না। ধ্বনিবাদীদের মতে ধ্বনিই কাব্যের আত্মা। ‘কাব্যস্যাত্মাধ্বনিঃ। শব্দ অর্থকে প্রকাশ করে। অর্থপ্রকাশের শক্তি তিন প্রকার—অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা। যখন অভিধা শক্তির দ্বারা কাব্যার্থ প্রকাশ হয় না। তখন লক্ষণা শক্তির দ্বারা অর্থের বোধ হয়ে থাকে। যেখানে অভিধা শক্তির দ্বারা অর্থের বোধ ব্যতীত অন্য অর্থেরও বোধ সম্ভব হয় তখনই তা ব্যাঞ্জনাশক্তি বলে ধরা হয়। অর্থাৎ কাব্যে শব্দ ও অর্থ নিজেদের প্রাধান্য পরিত্যাগ করে যদি বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঙ্গ অর্থকে প্রকাশ করে তাহলেই তা ধ্বনি বলে বিবেচিত। ধ্বনি প্রস্থানে ব্যঞ্জনাধ্বনিই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। পূর্ববর্তী আলঙ্কারিকেরাও ব্যাঙ্গার্থ বিষয়ে অবহিত ছিলেন কিন্তু ধ্বনি প্রভৃতি ভাষার ব্যবহার করেন নি।
আনুমানিক দশম শতাব্দীর শেষ ভাগে অভিনবগুপ্ত আনন্দবর্ধনের ধ্বন্যালোকের উপর একখানি টীকা রচনা করেন। গ্রন্থটি লোচনটীকা বা ধ্বন্যালোকলোচন বলে পরিচিত টীকা হলেও এইটি স্বতন্ত্র গ্রন্থের মর্যাদা লাভে সমর্থ ছিল। এছাড়াও তিনি নাট্যাশাস্ত্রের উপরে অভিনব ভারতী নামে গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই গ্রন্থে নাট্যশাস্ত্রে সংকলিত নাট্য সম্পর্কীয় বহু সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা ও আলোচনার মধ্য দিয়ে নাট্যতত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর মতে নাট্য ও কাব্য একই অর্থে ব্যবহৃত। এই গ্রন্থ নাট্যশাস্ত্রের শুদ্ধপাঠেরও সহায়ক বলে পণ্ডিতদের অভিমত। লোচন টীকা পাঠক- পাঠিকার নিকট সত্যিই লোচন স্বরূপ। এই টীকা পাঠ করলে ধ্বন্যালোক গ্রন্থের পাঠ সহজ হয়। আনন্দবর্ধন তাঁর গ্রন্থে বস্তুধ্বনি, অলঙ্কারধ্বনি ও রসধ্বনি এই তিনটিকেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন কিন্তু অভিনবগুপ্ত কেবলমাত্র রসধ্বনির উপরেই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। স্ফোটবাদই ধ্বনিতত্ত্বের মূলকথা।
পরিশেষে বলাযায় আনন্দবর্ধনের দ্বারা প্রচারিত এবং অভিনবগুপ্তের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ধ্বনিতত্ত্ব সে যুগে কাব্য সমালোচনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেছিলেন কিন্তু ধ্বনিবিরোধী কোন কোন আলঙ্কারিক এই ধ্বনিবাদকে স্ব স্ব যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তন্মধ্যে কুম্ভক, শঙ্কুক, ও মহিমভট্ট উল্লেখযোগ্য।
বক্রোক্তি বাদ : (কুন্তক)—এই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অভিনবগুপ্তের ধ্বনিবাদকে বহুলাংশে খণ্ডন করে খ্রিঃ দশম শতকের শেষভাগে আলঙ্কারিক কুম্ভক রচনা করলেন রক্রোক্তিজীবিত নামক গ্রন্থ। আলোচ্য গ্রন্থটি ৪টি উন্মেষে বিভক্ত। কারিকা বৃত্তি ও উদাহরণ দ্বারা বিন্যস্ত। যার মূল কথাই হল বক্রোক্তি কাব্যের প্রাণ এবং কাব্য রচনার যে কোন শৈলীই বক্রোক্তির অন্তর্গত। বক্রোক্তিবাদ কুম্ভকের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচারিত হলেও এই ধারণা অলংকার সাহিত্যে সম্পূর্ণ নূতন নয়। বহু পূর্বেই ভামহ শব্দ ও অর্থের ‘বক্রতা’ বা চাতুর্যপূর্ণ প্রয়োগের দ্বারাই অলংকার সৃষ্টির কথা বলেছেন। দণ্ডী তার কাব্যসৃষ্টিকে দুটি প্রধান অলংকারে ভাগ করেছেন যেমন—বক্রোক্তি ও স্বভাবোক্তি বামনের কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তিতেও বক্রোক্তির আস্বাদ মেলে। অভিনবগুপ্তের মতে কাব্যের শব্দ এবং অভিধেয় অর্থ রসপরিণতি লাভ করে বক্রোক্তির দ্বারা। অতএব ‘সাহিত্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রাচীন ভামহ থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন আলঙ্কারিকেরা বক্রোক্তিকে অল্পবিস্তর গ্রহণ করেছেন কিন্তু বিবিধ অর্থে তা ব্যবহৃত হয়েছে। কুম্ভক ব্যতিরেকে কেউই কাব্য সৃষ্টির মূল যে চারটি বিষয় অর্থাৎ অলঙ্কার গুণ, রীতি, ও ধ্বনির অলঙ্কার বলেও বিবেচিত হয়।
অনুমানবাদ : (শঙ্কুক ও মহিমভট্ট)—এই মতানুযায়ী অনুমানের সাহায্যেই কাব্যের রসোপলব্ধি ঘটে থাকে। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের আলঙ্কারিক শঙ্কুক অবশ্য লোল্লটের মত রসের প্রত্যক্ষ উপলব্ধিতে বিশ্বাসী নন। তার মতে এই রসোপলব্ধি অনুমান নির্ভর। তিনি ধ্বনিবাদের তীব্র সমালোচক ছিলেন। তাঁর রচিত কোন গ্রন্থ পাওয়া যায় না। নাট্যশাস্ত্রের উপরে লিখিত অভিনব ভারতী নামক টীকায় শম্ভুক ভট্টনায়ক, লোপ্লট প্রভৃতি আলংকারিকদিগের রস সম্পর্কিত আলোচনা ও ব্যাখ্যা দৃষ্ট হয়।
পরবর্তী কালে খ্রিষ্টীয় ১১শতকে কাশ্মীরীয় আচার্য রাজানক মহিমভট্ট শঙ্কুকের অনুসরণে ধ্বনিবাদের কঠোর সমালোচনা পূর্বক অনুমানই রসোপলব্ধির উপায় বলে স্বীকার করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ব্যক্তিবিবেক তিনটি বিমর্শে বিভক্ত। রচনার অগ্রভাগে তিনি স্বীকারোক্তি করেছেন যে ধ্বনিকে অনুমানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করাই তাঁর রচনার মূল উদ্দেশ্য। তাঁর মতে—অর্থোপি দ্বিবিধো বাচ্যোনুমেয়াশ্চ।” ধ্বনিবাদ ও অনুমান বাদ উভয়ক্ষেত্রেই রস কাব্যের আত্মা। কিন্তু এই রসোপলব্ধির উপায় বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। ধ্বনিবাদের মতে শব্দের শক্তি হল অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা। কিন্তু মহিমভট্টের মতে একমাত্র অভিধা শক্তিই যথেষ্ট। কারণ সকল প্রকার ধ্বনি বা ব্যঙ্গার্থই অনুমানের দ্বারা উপলব্ধ হয়।
অতঃপর নব্য আলংকারিক দিগের আলোচনার পূর্বে আরও দু’জন আলঙ্কারিকের নাম স্মরণযোগ্য। তাঁরা হলেন—ধারাধিপতি ভোজরাজ ও হেমচন্দ্র। এঁরা বহুলাংশে পূর্বসূরীদের অনুসরণ করেছেন বা তাঁদের গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সংকলন করেছেন এরূপ বলা যায়। অলঙ্কার বিষয়ে চর্চা করলেও তাঁরা কোন নতুন ধারার প্রবর্তন করেন নি বা সংযোজন করেন নি। একাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ৫টি অধ্যায়ে বিবৃত সুবৃহৎ গ্রন্থ সরস্বতীকণ্ঠাভরণ এর প্রণেতা ধারাধিপতি ভোজরাজ। সুপ্রসিদ্ধ এই গ্রন্থে তিনি রীতিকে শব্দালঙ্কার মধ্যে পরিগণনা করেছেন। ভোজরাজের কিঞ্চিত পরবর্তীকালে হেমচন্দ্রের আবির্ভাব। তিনি পূর্বসূরীদের মত অবলম্বন করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজস্ব মতামতের উল্লেখ করেছেন। একাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কাব্যানুশাসন নামে মূলত সঙ্কলন গ্রন্থটি বিদগ্ধ পণ্ডিত সমাজে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। পূর্ববর্তী বিশেষ বিশেষ গ্রন্থ, যেমন ধ্বন্যালোক, কাব্যপ্রকাশ, কাব্যমীমাংসা প্রভৃতি গ্রন্থের সমন্বয় ঘটিয়েছেন বলা যায়। আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই গ্রন্থে সূত্র, বৃত্তি, ও টীকার আঙ্গিকেই বিষয় বস্তু আলোচিত হয়েছে।
এক্ষণে নব্য আলঙ্কারিক দিগের মধ্যে মম্মটভট্ট, বিশ্বনাথ কবিরাজ, রূপ গোস্বামী, জয়দেব, জগন্নাথ পণ্ডিত, অপ্পয্যদীক্ষিত, কেশবমিশ্র প্রমুখের নাম বিশেষ ভাবে স্মরণীয়।
মন্মটভট্ট :—আনুমানিক একাদশ শতকের শেষ ভাগে কাশ্মীরীয় পণ্ডিত রাজানক মন্মটের আবির্ভাব। কথিত আছে কাশ্মীরে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি লালিত পালিত হন বারাণসীতে। তাঁর রচিত কাব্য প্রকাশ সুধী সমাজে বিশেষ সমাদর লাভ করেছিল। কাব্যপ্রকাশ গ্রন্থে ভরত, পাণিনি, পতঞ্জলি, কালিদাস, বাণভট্ট শ্রীহর্ষ প্রভৃতি গ্রন্থকারের নাম উল্লেখ পূর্বক, লোল্লট, রুদ্রট, শঙ্কুক, ভট্টনায়ক, অভিনবগুপ্ত এমন কি ভরত সহ সকলের মতামত আলোচিত হয়েছে। অলংকার শাস্ত্রের সকলপ্রকার বিষয়ই সংক্ষেপে অথচ সুপরিকল্পিত উপায়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এক্ষণে বলা যায় যে মন্মটের কাব্যপ্রকাশ পূর্বসূরীদের কার্যকলাপের এক সুবিন্যস্ত সংকলন। সাহিত্য সমালোচনায় তাঁকে ধ্বনিবাদী বলাই শ্রেয়। তাঁর মতে অলংকার কাব্যের লক্ষণ নয়। কেবলমাত্র কাব্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধির সহায়ক অতএব ব্যঞ্জনাই কাব্যের মূল। তাঁর রচিত গ্রন্থ প্রায় সারাদেশে খ্যাতি লাভ করেছিল। কাব্যপ্রকাশ দশটি ‘উল্লাসে’ বিভক্ত। নবমে শব্দালঙ্কার ও দশমে অর্থালঙ্কার আলোচিত হয়েছে। এই গ্রন্থের বহু টীকা রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে মানিক্যচন্দ্রের সংকেত টীকা, গোবিন্দঠক্কুরের প্রদীপটীকা, জয়ন্তের ‘দীপিকা’ টীকা, এছাড়াও সরস্বতী তীর্থের ‘বালচিত্তানুরঞ্জিনী’ বিশ্বনাথ কবিরাজের ‘কাব্য প্ৰকাশ দর্পণ’ নাগেশভট্টের ‘উদ্দোত’ টীকা প্রসিদ্ধ। মম্মটভট্টই নব্য আলঙ্কারিক সম্প্রদায়ের পথিকৃৎ বলে সমালোচকদের অভিমত।
বিশ্বনাথ কবিরাজ :—চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত বিশ্বনাথ কবিরাজের গ্রন্থ ‘সাহিত্যদর্পণ’ বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর পূর্বপুরুষেরাও সুপণ্ডিত ছিলেন। তাঁকে উৎকলবাসী বলেই মনে করা হয়। কারণ তাঁর পিতা ছিলেন চন্দ্রশেখর, পিতামহ হলেন—নারায়ণদাস। যিনি কলিঙ্গরাজ নরসিংহ দেবের সভাসদ ছিলেন। এই গ্রন্থটিও কাব্য প্রকাশের ন্যায় সংকলন জাতীয় রচনা। লেখকের নিজস্বতা কতদূর ছিল সেই তর্কে না গিয়ে বলা যায় গ্রন্থটির সাহিত্য সমালোচনা বা নাট্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে এরূপ বিস্তারিত সম্পূর্ণ আলোচনা অপর কোন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে বলে মনে করা হয় না। মম্মটভট্টের কাব্যপ্রকাশে নাট্যশাস্ত্রের বিচার দেখা যায় না। কিন্তু বিশ্বনাথ কবিরাজের সাহিত্য দর্পণে নাট্যশাস্ত্রের বিচার বিশেষ লক্ষ্যনীয় বিষয়। বিশ্বনাথ কবিরাজের টীকা কাব্য প্রকাশ দর্পন এবং সাহিত্য দর্পণ উভয়ই অলংঙ্কার শাস্ত্রের অতি প্রসিদ্ধ দুই গ্রন্থ। সাহিত্যদর্পণ দশটি পরিচ্ছেদে সম্পূর্ণ দীর্ঘ আয়তনের গ্রন্থ। তাঁর মতেও রসই কাব্যের আত্মা। ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম। তিনি মূলতঃ ভরত, মম্মট ও অভিনব গুপ্তকেই অনুসরণ করেছেন। তিনিই প্রথম শ্রব্যকাব্যের পাশাপাশি দৃশ্য কাব্যের আলোচনা করেছেন। নাটককে কাব্যশরীরের অঙ্গহিসাবে আলোচনা করে গ্রন্থটিকে একটি পূর্ণরূপদান করেছেন বলা যায়। আলোচ্য গ্রন্থের টীকার মধ্যে রামচরণ তর্কবাগীশ প্রণীত সাহিত্য দর্পণ বিবৃতি এবং দূর্গাপ্রসাদ দ্বিবেদীর “সহিত্যদর্পণ ছায়া” নামক দুই খানি টীকা উল্লেখযোগ্য।
রূপগোস্বামী :—(১৪৯০–১৫৬৩) পঞ্চদশ শতকের বৈষ্ণব আলঙ্কারিক রূপগোস্বামী কর্তৃক রচিত দুইখানি গ্রন্থ যথাক্রমে ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ও উজ্জ্বল নীলমণি। গ্রন্থদ্বয় অলঙ্কার শাস্ত্র সম্পর্কিত। বৈষ্ণবধর্মের আচার্য পণ্ডিত প্রবর এই গ্রন্থকারিক তাঁর রচনায় সংস্কৃত রসতত্ত্বকে চৈতন্য প্রবর্তিত ভক্তিবাদের নিরিখে আলোচনা ও ব্যাখ্যা করেছেন। ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে মধুররসের প্রাধান্যকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় ভুক্ত আলঙ্কারিকদের আলোচনার ভিত্তিভূমি অন্যান্য আলঙ্কারিকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সমস্ত গ্রন্থে উজ্জ্বলরস অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণের প্রীতিরসের বিশ্লেষণ রয়েছে। ভক্তিরসাত্মক এই রচনার প্রতিটি উদাহরণ কৃষ্ণকে উপজীব্য করে দেওয়া হয়েছে। ভক্তিরস শৃঙ্গারেরই নামান্তর। এর অন্য নাম প্রেম। আলোচ্য গ্রন্থের টীকাকার হলেন কবির ভ্রাতুষ্পুত্র জীবগোস্বামী। তাঁর রচনা লোচনরোচনী এবং বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর আনন্দচন্দ্রিকা উল্লেখযোগ্য। রূপগোস্বামী ভরতের নাট্যশাস্ত্রের অনুসারে নাট্যতত্ত্বসম্পর্কে আলোচনা করেছেন তার নাটকচন্দ্রিকা নামকগ্রন্থে।
জয়দেব :(১২০০-১২৫০) অর্থাৎ দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রসন্নরাখব প্রণেতা আলঙ্কারিক জয়দেব রচনা করেন চন্দ্রালোক নামক গ্রন্থ। অলঙ্কার শাস্ত্রের অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ হিসাবে এই গ্রন্থ পাঠকসমাজে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেছিল। পীযূষবর্ষ এই উপাধিতে তিনি ভূষিত হয়েছিলেন। দশটি ময়ূখে বিভক্ত এই গ্রন্থে প্রায় ৩৫০টি শ্লোক দৃষ্ট হয়। কাব্যের অলংকার, গুণ, রীতি, ধ্বনি, রস প্রভৃতি সকল বিষয়ে আলোচনা ও ব্যাখ্যা করেছেন। বিদর্ভের অধিবাসী কবি জয়দেব কিন্তু গীতগোবিন্দের কবি জয়দেব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নব্যক্তি। আলোচ্য জয়দেব শুধু কবিই ছিলেন না, তিনি তার্কিক ও সুপণ্ডিত ছিলেন। চন্দ্রালোক গ্রন্থের টীকা রচনা করেছেন পণ্ডিত গাগাভট্ট। টীকার নাম রাকাগম।
জগন্নাথ পণ্ডিত :—(১৬২০—১৬৬০খ্রিঃ) সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত আলঙ্কারিক পণ্ডিত জগন্নাথ তৈলঙ্গদেশীয় ব্রাহ্মণ ছিলেন। পিতার নাম পেরুভট্ট ও মাতা লক্ষ্মীদেবী। তিনি সিদ্ধান্ত কৌমুদীর টীকাকার জ্ঞানেন্দ্রভিক্ষুর ছাত্র ছিলেন। দিল্লীর রাজা শাহজাহান তাঁকে পণ্ডিতরাজ উপাধি প্রদান করেন। কারিকা বৃত্তি ও উদাহরণ সহযোগে অলঙ্কার শাস্ত্রের অন্যতম গ্রন্থ রসগঙ্গাধব। রসগঙ্গাধর অলঙ্কার শাস্ত্রের মান্যগ্রন্থ। সহজ সরল রচনার ধারায় ছয় প্রকার কাব্যের ভেদ নিরূপণ করে রসবিচারে তিনি বিশেষ ধারার প্রবর্তন করেছেন। তারমতে রস প্রতীতিই কাব্যের কারণ। রসগঙ্গ।ধরে কবি এমনই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন যে পণ্ডিতমহলে তা বিশেষ সাড়া জাগিয়ে তুলেছে। তবে বলা হয় যে গ্রন্থটি তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেন নি। তিনি ভামিনী বিলাসেবও রচয়িতা। বৈয়াকরণ নাগেশভট্ট আলোচ্য গ্রন্থের গুরুমর্ম প্রকাশ নামক টীকা রচনা করেছেন।
অপ্পয্য দীক্ষিত :—(১৫৫৪–১৬২৬ খ্রিঃ) অপ্পয্য দীক্ষিত ষোড়শশতকে সংস্কৃত সাহিত্যে কেবল আলঙ্কারিকই ছিলেন না। একাধারে পণ্ডিত ও বৈয়াকরণও ছিলেন। তৎপ্রণীত অলঙ্কার শাস্ত্র সম্বন্ধীয় তিনটি গ্রন্থ যথাক্রমে কুবলয়ানন্দ, চিত্রমীমাংসা ও বৃত্তিবার্তিক। তিনি মাদ্রাজ প্রদেশের কাঞ্চীনগরের এক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ভরদ্বাজ বংশীয় ব্রাহ্মণ ছিলেন। প্রথমগ্রন্থে—কুবলয়ানন্দে আলঙ্কারিকের আলোচনা করেছেন। চিত্রমীমাংসা গ্রন্থে কাব্যের ভেদ নির্দেশ করে চিত্ররূপ অলঙ্কারের আলোচনা করেছেন। বহুক্ষেত্রে প্রাচীন আলঙ্কারিকদের মত খণ্ডন করে স্বীয় মত প্রতিষ্ঠা করেছেন। বৃত্তিবার্তিক গ্রন্থে শব্দের অভিধা ও লক্ষণা এই দুই বৃত্তির বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এছাড়াও বহুগ্রন্থের উপরে তাঁর রচিত টীকা টীপ্পনী রয়েছে।
কেশবমিশ্র :—আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীতে কেশবমিশ্র রচনা করলেন অলঙ্কাব শেখব। এই গ্রন্থে তিনি পূর্বসূরী দণ্ডী, আনন্দ বর্ধন, রাজশেখর ও মন্মটের মতামতের একটি সারসংকলন করলেন বলা যায়। গ্রন্থের ভূমিকাতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে আরও কয়েকটি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেগুলি বর্তমানে দুর্লভ। ঊনি প্রাচীন আলঙ্কারিক, না বৌদ্ধ আলঙ্কারিক এই বিষয়েও দ্বন্দ্ব বর্তমান।
বিদ্যাধর রচিত একাবলী; ভানুদত্তের রসতরঙ্গিনী ও রসমঞ্জরী, অলঙ্কার শাস্ত্রের মূল্যবান গ্রন্থ। পরমানন্দ দাস সেনও ছিলেন বৈষ্ণব কবি ও আলঙ্কারিক। তাঁর রচনা অলঙ্কার কৌস্তুভ। অলঙ্কার শাস্ত্র ও নাট্যশাস্ত্রের আলোচনায় বহু পণ্ডিত ও কবি তাঁদের মূল্যবান সময় ও শ্রম ব্যায় করেছেন। তন্মধ্যে যে সমস্ত গ্রন্থ সংস্কৃত সাহিত্যে বা বিদ্দ্বজ্জনের রুচিতে ও বিচারে স্থান পেয়েছে, সেই সমস্ত গ্রন্থের আলোচনার অবসরে বলা যায় ভরতের নাট্যশাস্ত্রই নাট্যশাস্ত্রের আদিগ্রন্থ। অভিনব গুপ্ত রচিত ‘অভিনবভারতী’ নামক টীকাও উল্লেখের দাবী রাখে। বিষ্ণুপুত্র ধনঞ্জয় ‘দশরূপক’ নামক নাট্যশাস্ত্রের প্রণেতা। এই গ্রন্থও ভরতের নাট্যশাস্ত্রের অনুসরণেই লিখিত। রূপকের প্রধান দশটি ভেদ (নাটক, প্রকরণ, ভান, ব্যায়োগ, সমবকার, ইহামৃগ, ডিম, অঙ্ক, বীথী ও প্রহসন) সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও নৃত্য, পাঁচসন্ধি, নায়ক-নায়িকা, পূর্বরঙ্গ রস, প্রস্তাবনা প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে। ওয়ারাঙ্গলের রাজা প্রতাপাদিত্যের সময়ে বিদ্যানাথ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ‘প্রতাপরুদ্রীয নামক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থটি নয়টি অধ্যায় সম্বলিত। দশরূপক ও কাব্য প্রকাশের মতকে অবলম্বন করেই গ্রন্থটি রচিত। মল্লিনাথের পুত্র কুমারস্বামী এই গ্রন্থের উপর রত্নাপন নামক টীকা রচনা করেছেন। এছাড়া বিশ্বনাথ কবিরাজের ‘সাহিত্য দর্পন’ তো নাট্যশাস্ত্রের বিচারেই সমৃদ্ধ। খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতকের শেষভাগে শারদাতনয় রচিত ভাবপ্রকাশন হল নাট্যশাস্ত্রের অপর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়াও রামচন্দ্র গুণচন্দ্র রচিত নাট্যদর্পণ প্রভ র ভট্টের রসপ্রদীপ, কেশব ভট্টের রসিক সঞ্জীবনী বাগভট্রালঙ্কারের কাব্যানুশাসন প্রমিশ্রের নাট্যপ্রদীপ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
পাদটীকা – অলংকারশাস্ত্র ও নাট্যশাস্ত্ৰ
১. “তদ্রূপঃ তদ্বর্ণঃ তদ্বৎ তথেত্যুপমা”। ৩।১৩। “অথাত উপমা।”
যদেতৎ তৎ সাদৃশিমিতি গার্গ্যঃ। ৩।২২।
“উপমিতং ব্যাঘ্রাদিভিঃ সামান্যা প্রয়োগে” ২।১।৫৬,
“উপমানানি সামান্যবচনৈঃ” ২।১।৫৫।
৩. “কাব্যং স্ফুরদলংকারং গুণবদ্দোষবর্জিতম্”।
৪. “কাব্যং গ্রাহ্যমলংকারাৎ।”
৫. Keith : History of sanskrit Literefure. pp ৩৭২-৭৩.
৬. P. V. Kane বলেছেন- “ Its greatest merit is that it presents in the compas of single work a full and complete treatment of the science of rhtoric in all its branches.