দ্বাদশ অধ্যায় – ছন্দঃশাস্ত্র

দ্বাদশ অধ্যায় – ছন্দঃশাস্ত্র

প্রাচীন সাহিত্যের প্রাচীনতমরূপ ছিল পদ্য। সুতরাং খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই সমস্ত পদ্য ছন্দোবদ্ধ পদ্যেই রচিত হত। গদ্যের ভাগ ছিল কর্ম। বৈদিক সাহিত্যে সকল মন্ত্রই ছিল ছন্দোবদ্ধ পদ। কেবলমাত্র যজুর্বেদের অংশ গদ্যে রচিত ছিল, সেই গদ্যের মধ্যেও কিন্তু ছন্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে খুব সাবলীল ভঙ্গিতে। সংস্কৃত শাস্ত্রে ছন্দের ইতিহাস অতি প্রাচীন। ছন্দতত্ত্ব বিষয়ে প্রাচীন বৈদিক কবি ও পণ্ডিতেরা বহু পূর্বেই আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। বৈদিক যুগে ছন্দের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। বেদাঙ্গ বলতে বেদ রূপ পুরুষের ছয়টি অঙ্গ বিশেষকে বুঝায়। শিক্ষা, কল্প, নিরুক্ত, ব্যাকরণ, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ। বলা হয়ে থাকে পদহীন পুরুষ যেরূপ গমনে অসমর্থ, ছন্দহীন বেদও তেমনি অচল, অর্থহীন হয়ে পড়ে। অতএব ছন্দঃ হলো বেদপুরুষের পাদস্বরূপ। বৈয়াকরণদের মতে ছন্দঃ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল যা মনকে আনন্দ দান করে তাই ছন্দ।’

ছন্দকে মূলতঃ দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) বৈদিক ও (২) লৌকিক। বৈদিক ছন্দ মূলতঃ অক্ষর ( Syllable) গণনার মাধ্যমে নিরূপিত হয়। অতএব এগুলি অক্ষরছন্দঃ। সাতটি বৈদিক ছন্দ হল যথাক্রমে—গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পঙ্ক্তি, ত্রিষ্টুপ ও জগতী। বৈদিক ত্রিপদী বা চতুস্পদী এক একটি মন্ত্র ঋক্ নামে অভিহিত। এবং ন্যূনতম তিনটি ঋক্ নিয়ে একটি সূক্ত। সাধারণতঃ প্রতি সুক্তে একাধিক ছন্দের প্রয়োগ ছিল। তবে মৌলিক ছন্দের অপেক্ষায় বৈদিকছন্দ প্রয়োগের নিয়ম অনেকাংশে লঘু ছিল, অর্থাৎ সংস্কৃত ছন্দের ন্যায় কঠোর পদ্ধতি ছিল না। প্রয়োজন বোধে পদের পরিবর্তন মেনে নেওয়া হত। যে কারণে প্রধান ছন্দগুলিকে ভেঙে ভেঙে বহু উপছন্দের সৃষ্টি হত।

কতিপয় বৈদিক ছন্দের উদাহরণ :—

গায়ত্রীঃ—উপত্বাগ্নে দিবেদিবে/দোষাবস্তুর ধিয়াবয়ম্
নমো ভরন্ত এমসি॥ ঋ বে. ১।১।৭

জগতীঃ— আনঃ প্রজাং জনয়তু প্রজাপতির/আজরমায়সমনমা।
অদুমঙ্গলীঃ পতিলোকমা বিশ/শংনো ভব দ্বিপদেশ চতুস্পদ।।

ঋ.বে.১০।৮৫।৪৩

বৈদিক ছন্দের বিস্তারিত আলোচনা পিঙ্গলাচার্যের ছন্দঃসূত্র নামক প্রাচীনতম গ্রন্থে পাওয়া যায়। তাঁর গ্রন্থে বৈদিক ও লৌকিক উভয় প্রকার ছন্দেরই আলোচনা করেছেন। ছন্দঃসূত্রের উপরে হলায়ুধ বৃত্তি রচনা করেছেন, সেখানে তিনি ছন্দকে গণ, মাত্রা, অক্ষরে বিভক্ত করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এতদ্ব্যতীত সামবেদীয় নিদানসূত্র, কাত্যায়নের অনুক্রমণী, ঋগ্বেদ প্রাতিশাখ্য, শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র, যাস্কের নিরুক্তে বৈদিক ছন্দের আলোচনা দৃষ্ট হয়।

লৌকিক বা সংস্কৃত ছন্দের উপর বৈদিক ছন্দের প্রভাব তেমন প্রকট নয়। সংস্কৃত ছন্দের পদ্য হয় চতুস্পদী।` বৈদিক ছন্দের মধ্যে একমাত্র অনুষ্টুপ ছন্দ সংস্কৃততে বক্তৃ নামে সরাসরি গৃহীত। সংস্কৃত ছন্দে জাতি, মাত্রা ও বৃত্ত এই তিনটি প্রধানভাগ। হ্রস্বস্বরের একমাত্রা, দীর্ঘস্বরের দুইটি মাত্রাও প্লুতস্বরের তিনমাত্রা নির্দিষ্ট। জাতিছন্দ কেবলমাত্র নির্দিষ্ট সংখ্যক মাত্রার দ্বারাই নির্ধারিত হয়। বৃত্তছন্দ যথাক্রমে লঘু ও গুরু অক্ষরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মাত্রার আবার তিনটি বিভাগ—আর্যা, বৈতালীয, মাত্রা এইভাবে বৃত্ত ছন্দও সমবৃত্ত, অর্ধসমবৃত্ত ও বিষমবৃত্তে বিভক্ত। কেদারভট্ট, গঙ্গাদাস প্রভৃতি ছন্দকারের মতে গণ ও মাত্রাছন্দ মূলত এক এবং উভয়ই মাত্রাবৃত্তের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু হলায়ুধ ছন্দকে যথাক্রমে গণছন্দ, মাত্রাছন্দ ও অক্ষর ছন্দে বিভক্ত করেছেন। প্রাকৃত কবিতায় মাত্রাছন্দের প্রয়োগ অধিক দৃষ্ট হয়। জয়দেবের গীতগোবিন্দ এই মাত্রা ছন্দে রচিত। রামায়ণের শ্লোকগুলিতে অনষ্টুপের অধিক ব্যবহার দৃষ্ট হয়। তবে এতদ্ব্যতীত ইন্দ্ৰবজ্রা, উপেন্দ্রবজ্রা, বংশস্থবিল, প্রহর্ষিণী, রুচিরা, বসন্ততিলক, সুন্দরী প্রভৃতির নমুনা মেলে। মহাভারতে রামায়ণের ছন্দ ব্যতীত রথোদ্ধতা, শালিনী, দ্রুত বিলম্বিত ও পঞ্চচামরের ব্যবহার দৃষ্ট হয়। তবে পরবর্তীকালে কবিদের মধ্যে যার যার নিজস্ব লেখার রীতিতে নির্দিষ্ট ছন্দের প্রভাব বিশেষ লক্ষ্যণীয়। যেমন- কালিদাসের মন্দাক্রান্তা, পাণিনির উপজাতি, অভিনন্দের অনুষ্টুপ, ভারবি ও শ্রীহর্ষের বংশস্থবিল, ভবভূতির শিখরিণী, রাজশেখরের শর্দূলবিক্রীড়িত, ইত্যাদি। আবার বিশেষ বিশেষ অবস্থায় বিশেষ বিশেষ ছন্দের ব্যবহার কবিদের নিকট গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে যেমন বর্ষা বা প্রবাসের বর্ণনা করতে গিয়ে মন্দাক্রান্তা। প্রকৃতির নিসর্গচিত্রের বর্ণনায় উপজাতি, বিরহে বিয়োগিণী, শৃঙ্গারে স্বাগতা ও মালিনী। এক্ষণে বলা যায় কবির মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম যদি হয় ভাষা তবে ছন্দ হল তার একান্ত উপযোগী উপাদান যা ভাষার সাবলীল প্রকাশের পথ সুগম করে পাঠক চিত্তে অনাবিল আনন্দ দান করতে সক্ষম হয়। ছন্দোবদ্ধ পদ পাঠককে পাঠ গ্রহণে আগ্রহী করে তোলে এবং কবিকে সার্থকতার শিখরে পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়। আলঙ্কারিক দণ্ডীর মতে সুগভীর কাব্যরূপ যে সমুদ্র তা ছন্দরূপ নৌকার দ্বারাই পারাপার করা সম্ভব।

পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে—পিঙ্গলাচার্যের ছন্দঃ সূত্রে বৈদিক ও লৌকিক দুই প্রকার ছন্দেরই আলোচনা পাওয়া যায়। তবে বৈদিকের অপেক্ষা লৌকিকের আলোচনাই বেশী। ছন্দসূত্রের পাঁচটি টীকার উল্লেখ রয়েছে। টীকাকার গণ যথাক্রমে হলেন, দামোদর, লক্ষ্মীনাথ, হলায়ুধ, যাদবপ্রকাশ ও শ্রীহর্ষবর্মা। ভরতের নাট্যশাস্ত্রেও শেষ পর্বে অর্থাৎ পঞ্চদশ ও ষোড়শ অধ্যায়ে ছন্দবিচিতি নামে ছন্দশাস্ত্রের আলোচনা লক্ষ্যনীয়। অগ্নিপুরাণেও অলংকার শাস্ত্রের পাশাপাশি ছন্দশাস্ত্র বিশেষ ভাবে আলোচিত হয়েছে। অতঃপর সংস্কৃত ছন্দে কালিদাসকৃত শ্রুতবোধের অবদান অপরিসীম। ভিন্নমতানুযায়ী বররুচি এই গ্রন্থের প্রণেতা। শ্রুতবোধের ছন্দ নির্ণয় পদ্ধতি ছন্দোমঞ্জরী অপেক্ষা ভিন্ন, কিন্তু সুধী-পাঠক সমাজে গ্রন্থটি সমাদর লাভ করেছিল। একাদশ শতকে রচিত ক্ষেমেন্দ্রের সুবৃত্তিতিলক। হেমচন্দ্রের ছন্দোহনুশাসন ছন্দশাস্ত্রে সংকলনগ্রন্থ হিসাবে খ্যাত। নবম শতকে কেদারভট্ট রচনা করলেন বৃত্তরত্নাকর। ১৩৬টি ছন্দের আলোচনা সমৃদ্ধ এটি একটি বৃহৎ আকারের গ্রন্থ। এছাড়া বাণীভূষণ গ্রন্থরচনা করেছেন। দামোদর মিশ্র, রামদয়ালের বৃত্তচন্দ্রিকা, ছন্দোশাস্ত্রকে কমবেশী সমৃদ্ধ করেছে। সর্বোপরি গঙ্গাদাস কৃত ছন্দোমঞ্জরী হলো সর্বজনগ্রাহ্য একটি গ্রন্থ। পিতা গোপালদাস ও মাতা সন্তোষ। ২৮০টি ছন্দ সম্বলিত আলোচ্যগ্রন্থে অত্যন্ত সুচারু রূপে এবং সুকৌশলে কবি তার বক্তব্য উপস্থাপিত করেছেন। যে কারণে ছন্দোমঞ্জরী পাঠকের বিশেষত শিক্ষার্থীদের নিকট অধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। মাত্রা, জাতি, বৃত্ত, গুরু ও লবর্ণের আলোচনার পাশাপাশি যতি স্থানের উপস্থাপনা ছন্দোমঞ্জরীকে বিশেষ অভিনবত্ব দান করেছে। কোন কোন ছন্দের লক্ষণটিই উক্ত ছন্দের উদাহরণ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। এইভাবে ছন্দোমঞ্জরী নিজবৈশিষ্ট্যে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।

পাদটীকা – ছন্দঃশাস্ত্র

১. চদ্ (বা-ছদ্) + অসুন্। চন্দয়তি আহ্লাদয়তি ইতি ছন্দঃ। চন্দেরাশ্চেছঃ-ছন্দঃ। এই অর্থে প্রধানতঃ যা আনন্দ দেয়, তাই ছন্দঃ। ছদ্ আহ্লাদনে সংবরণে চ।

২. ‘পদ্যং চতুস্পদী তচ্চ বৃত্তং জাতিরিতি দ্বিধা,
বৃত্তমক্ষর সংখ্যাতং জাতিৰ্মাত্ৰাকৃতা ভবেৎ।।’

৩. “ছন্দোবিচিত্যাং সকলস্তৎ প্রপজ্ঞো নিদর্শিতঃ।
সা বিদ্যা নৌ স্তিতীনাং গম্ভীরং কাব্যসাগরম্।।” ১।১২

৪. এই বিষয়ে Dr. keith বলেছেন— ‘The Srutobodha is attributed to kalidasa, but there is no ground for the ascription.”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *