সপ্তম অধ্যায় – খুশরু শাহের উপর হুসাইন মির্জার আক্রমণ
১৪৯৫ ঈসায়ী সনের শরৎ ঋতুর প্রারম্ভেই সৈয়দ সুলতান হুসাইন মির্জার সেনা খুরাসান থেকে বেরিয়ে হিসারের রাস্তা ধরে তিমরিজ পৌছে গেল। খুশরু শাহেরও অত্যন্ত শক্তিশালী বাহিনী ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর ছোট ভাই মাসুদ মির্জার কাছ থেকে সাহায্য নিলেন। দুই বাহিনী এ পার ওপার—দুই পারে অবস্থান নিল। প্রচণ্ড শীতের কারণে কোনো বাহিনী নদী পার হতে সাহস পেল না। কিছু দিন যাবৎ যুদ্ধ ছাড়াই দু’পক্ষের সেনা নিজ—নিজ স্থানেই পড়ে রইল। হুসাইন মির্জা খুবই বিচক্ষণ এবং যুদ্ধাভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নদীর এমন অংশ খুঁজে নিলেন যেখানে পানি কম ছিল। তিনি তাঁর বাহিনীকে নদী পার হওয়ার আদেশ দিলেন। ঐ স্থান থেকে কুন্দুজ এলাকাটি নিকটবর্তী ছিল। কুন্দুজ মাসুদ মির্জার এলাকা ছিল। হুসাইন মির্জা জানতেন নিজের এলাকা রক্ষার জন্য মাসুদ মির্জা সসৈন্যে কুন্দুজ অভিমুখে চলে আসবেন।
মাসুদ মির্জা যখন কুন্দুজ অভিযানের খবর পেলেন তখন তিনি আবদুল লতিফ বখশির নেতৃত্বে পাঁচ ছ’শ সৈন্যকে হুসাইন মির্জার বাহিনীকে আটকানোর জন্য পাঠিয়ে দিলেন।
কিন্তু হুসাইন মির্জার অগ্রবর্তী সেনাকে আবদুল লতিফ বখশির সৈন্যরা রুখতে পারল না। মারামারি—হানাহানি করতে করতে তিনি হিসার পর্যন্ত অধিকার করে চললেন। নিজের এলাকার পতনের খবর শুনতেই মাসুদ মির্জা তাঁর ভাইয়ের সঙ্গ ত্যাগ করে কমরিদ উপত্যকায় নেমে গেলেন। তিনি উপত্যকার রাস্তা ধরে ছোট ভাই বাইসুঘর মির্জার কাছে নিরাপদে পৌঁছানোর পথ বেছে নিলেন।
তরপর শোনা গেল মাসুদ মির্জাকে শায়বানির কাছে পৌঁছে চাকরি নিতে হয়েছে।
হুসাইন মির্জার সেনার সামনে খুশরু শাহ ছাড়া অন্য ছোট—ছোট রাজ্যের সামনে মির্জা আর টিকতে পারেননি। এক—এক করে তাঁকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়।
আন্দিজানে যাওয়ার পথে আমার কাছে হুসাইন মির্জার অগ্রবর্তী হওয়ার খবর আসতে থাকে। আমি আমার বাহিনীকে সমরখন্দে রওনা করিয়ে দিই। খুশুরু শাহ আমার কাছে এসে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। আমি আরো মির্জাকে একত্রিত করলাম। সবার শক্তি একত্রিত করে আমি যুদ্ধের জন্য সেনা প্রস্তুত করলাম। সকলেই নিজেদের মধ্যেকার পারস্পরিক বিবাদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আবুল করিম নামক স্থানে হুসাইন মির্জার সঙ্গে আমাদের বাহিনীর সংঘর্ষ হলো। এই সংঘর্ষে হুসাইন মির্জা বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। ভয়াবহ সংঘর্ষে নাস্তানাবুদ হুসাইন মির্জাকে অবশেষে খুরাসানে গিয়ে আশ্রয় নিতে হলো।
এখানে আমার সমরখন্দ অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার উত্তম সুযোগ ছিল। আমি মির্জাদের পূর্ণ সামরিক সহযোগিতা লাভ করেছিলাম। গরম পড়া শুরু হতেই আমি সমরখন্দ জয়ের জন্য অভিযান শুরু করি। আমি তুলুন খাজার নেতৃত্বে তিনশো সাহসী সৈনিককে অগ্রবর্তী হওয়ার আদেশ দিই। তারা ইয়ারইলাক অবধি পৌঁছাল।
সমরখন্দ অভিযানের শুরুয়াত
বাইসুঘর মির্জা আমার আক্রমণের খবর পাওয়ামাত্রই নিজের গদি ছেড়ে দিলেন। বড় কোনো বাধা ছাড়াই আমার সেনা ইয়ারইলাক গিয়ে পৌঁছায়। ওই দিন রাতে আমার সৈন্যদের হাতে প্রচুর পরিমাণে লুটের সামগ্রী এসে গিয়েছিল।
দু’দিন পর আমার সেনা সিরাজে প্রবেশ করল। সেখানে কাশিম বেগ দুলদাইয়ের শাসন ছিল। সিরাজে নিযুক্ত কাশিম বেগ দুলদাইয়ের দারোগা মোকাবিলার সাহস পেলেন না। তিনি তৎক্ষণাৎ আত্মসমর্পণ করলেন।
পরদিন ফজরের নামাজের পর আমি আমার বাহিনীকে অগ্রবর্তী হওয়ার আদেশ দিলাম। এবার সমরখন্দে প্রবিষ্ট হওয়ার জন্য জার আফসাঁ নামক নদী পার হওয়ার প্রয়োজন পড়ল। কুরা পুলাকের পথ ধরে আমরা নদী পার হলাম। এবার আমাদের ফৌজের কড়া মোকাবিলা করতে হলো। এই যুদ্ধে আমার কয়েকজন বিশ্বস্ত সাথিকে হারাতে হলো। তবে বিজয় আমার পক্ষে এল।
যেইমাত্র আমার বাহিনী ইয়ামে প্রবেশ করল—অমনি সেখানকার সমস্ত সওদাগর এক জোট হয়ে আমার বাহিনীকে স্বাগত জানাল। ইয়াম ছিল একটি বিশাল বাণিজ্যিক ক্ষেত্র। সেখানকার সওদাগররা এই আশ্বাস পেতে চাচ্ছিলেন যে, আমাদের সৈন্যদের দ্বারা সেখানকার বাজারগুলো যেন লুট হয়ে না যায়। আমি তাদের আশ্বাস দিলাম। কিন্তু এ খবর আমার সৈনকদের নিকট সময়মতো পৌঁছাতে পারল না। বিজয়—মদ—মত্তে আমার সৈনিকেরা সারা রাত ধরে ইয়ামের বাজার লুট করল। খবর পাওয়া মাত্রই আমি আমার সৈনিকদের মধ্যে প্রবেশ করে জানিয়ে দিলাম যে, সওদাগরদের আমি বাজার লুট না করার ওয়াদা দিয়েছিলাম। আমি আমার সাথিদের বললাম যে, তাদের দ্বারা এমনটা হওয়ার কারণে আমি ইয়ামবাসীদের কাছে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন হয়ে যাব। আমার কথা শোনামাত্রই আমার সৈনিকেরা যে অনুশাসনের পরিচয় দিল তা অতুলনীয়। ওই দিন প্রথম প্রহরে আমার সৈনিকেরা যে মাল যেখান থেকে লুটেছিল সেই—সেই মাল তারা সেখানে গিয়েই রেখে এল। তারা সবকিছু ফিরিয়ে দিয়েছিল। একটা সুঁই—সুতোও পর্যন্ত তারা নিজেদের কাছে রাখেনি। সবকিছুই ওই সওদাগরদের কাছে পৌঁছে গেল যে যার মালিক ছিলেন।
এই সময়ে আরেকটি ঘটনা আমার কানে আসে যে, আবুল করিমের কিছু ঘোড়া বাইসুঘর মির্জার দলের কিছু লোক চুরি করেছিল। তারা ধরা পড়েছে। আবুল করিমের সেনা—প্রধানরা তাদের কয়েকজনকে হত্যা করেছিল এবং অবশিষ্ট কয়েকজনকে ধরে আবুল করিমের সামনে পেশ করেছিল। চুরির অভিযোগে তাদের বেদম মার দেওয়া হলো এবং শহর থেকে বের করে দেওয়া হলো।
এই ঘটনাকে মির্জা ঘরানার লোকেরা নিজেদের জন্য খুব অপমানজনক বলে মনে করলেন। এই অপমানের জ্বালা তখনও নিবারণ হয়নি, এমন সময় আবুল করিম সমরখন্দে মির্জা রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে সেনা পাঠিয়ে তাদের রাজ্য খালি করে দেওয়ার অভিযান চালিয়ে দিলেন। মির্জা রাজ্যগুলোর সরদাররা একজোট হয়েও কিছু করতে পারলেন না। তাঁরা একের পর এক পরাজিত হতে থাকলেন।
সমরখন্দ বিজয়ের রাস্তা সাফ
তাঁরা সবাই আমার পক্ষে এসে গেলেন। আমাকে নিয়ে তাঁরা আশায় বুক বাঁধছিলেন। তাঁরা আমার পক্ষে এসে যাওয়াতে আমার শক্তি বেড়ে গেল। আমি আমার সমরখন্দ বিজয়ের সংকল্প আরো মজবুত করে নিলাম। কয়েক দিন বাদেই আমি আরো অগ্রসর হয়ে সমরখন্দ অবরোধ করলাম।
পিছন থেকে আরো মির্জা আমার দলে এসে ভিড়তে লাগল। তাদের মধ্যে বদিউজ্জামান মির্জা নামে একজন ছিলেন, যাঁর কাছ থেকে অস্তারাবাদ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। মির্জাদের আরামপ্রিয়তা তাদের দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা সোনা—রুপার পাত্রে শরাব পান করত। নিজেদের আরাম—আয়েশের প্রতি তারা সবচেয়ে বেশি মনোযোগী থাকত। সামরিক শক্তির ব্যাপারে তারা পুরোপুরি গাফিল থাকত। এ সকল দুর্বলতার কারণে তাদের উপর মুসিবতের পাহাড় ভেঙে পড়ছিল। তারা পরাজিত হয়ে আমার কাছে আসছিল। আমার সামরিক—শক্তি বেড়ে চলেছিল। সবাই আমার উপর এই আশায় বুক বেঁধেছিল যে, আমি একটা অলৌকিক কিছু করে দেখাব। তাদের হৃত রাজ্যগুলোকে পুনরুদ্ধার করিয়ে দেব।
আমার দলে শামিল হওয়া মির্জাদের পক্ষের সামরিক শক্তির বলে দিনের পর দিন আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেড়ে চলেছিল। সমরখন্দ বিজয়াভিযান যেকোনো দিন, আজ, কাল, পরশুতে পুরো হতে পারত। আমার লক্ষ্য ছিল খাজা দিদারের কেল্লা। আমার সেনা ওই দিকে এগিয়ে চলেছিল। মাঝের পথ বিশাল চারণক্ষেত্র রূপে বিরাজ করছিল। আমি অগ্রবর্তী হয়ে সৈনিকদের শিবির গেড়ে দিয়েছিলাম।
সমরখন্দের শাসক বাইসুঘর মির্জা, যিনি আমার ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি দেখে চিন্তিত ছিলেন, তিনি শায়বানি খাঁ-র কাছে সাহায্য চাইলেন।
শায়বানি খাঁ-র কাছ থেকে সাহায্য আসুক বা না আসুক, তার পরোয়া না করেই আমি খাজা দিদারে দাখিল হওয়ার হুকুম দিয়ে দিলাম।
আমার সেনাদলে কিছু খবুদের, কিছু শাহরজের এবং কিছু আলাদা—আলাদা রাজ্যের সৈনিক ছিল, যার কারণে তাদের লড়াই, চিন্তাভাবনা এবং হামলা করার নিয়ম—কানুন আলাদা—আলাদা ছিল। তা সত্ত্বেও আমি তাদের সাহসিকতার সাথে কাজ করাতে সফল ছিলাম।
সমরখন্দের লোকেরা ছিল রূঢ়িবাদী। কেল্লার দেওয়াল যথেষ্ট মজবুত এবং মোটা ছিল। কেল্লায় বিশাল লোহার গেট ছিল। কেল্লার কাছেই একজন বিখ্যাত সাধকের কবর ছিল, যাকে ‘শাহে—জিন্দা’ বলা হতো। কেল্লার দেওয়াল ৪০ ফুটের চেয়েও বেশি উঁচু এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ ফুট ছিল।
পূর্বে তুর্কি এবং মোগলদের দ্বারা সমরখন্দ বিজিত হয়েছিল। তাইমুর বেগ তাকে তাঁর রাজধানী বানিয়েছিলেন। সমরখন্দের সৈনিকেরা নিজেদের কেল্লার মধ্যে সুরক্ষিত করে নিয়েছিল। ‘রূঢ়িবাদী’ [ধর্মবিশ্বাসী] হওয়ার ফলে তাদের বিশ্বাস ছিল যে, ‘শাহে-জিন্দা’ ও আল্লাহতায়ালা তাদের রক্ষা করবেন। তারা রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে সামনা—সামনি যুদ্ধ করতে ভয় পাচ্ছিল। আমার সৈনিকেরা কেল্লার চারিধার ঘিরে রেখেছিল। কেল্লার মধ্যে নিজেদের নিরাপদ বলে মনে করা সৈনিকেরা বেশি সময় যাবৎ টিকে থাকতে পারল না। কেল্লার উপরে কমন্দ ফেলে দিয়ে আমার সাথে আমার অনেক সৈনিকের উপরে চড়ে ভিতরে লাফ দিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পরেই তারা অস্ত্র সমর্পণ করল। কেল্লা দখলের পর আমাদের সৈনিকেরা দৌড়ে গিয়ে কেল্লার ফাটক খুলে দিল। বাইরের সমস্ত সৈন্য ভিতরে ঢুকে পড়ল। এখন কেল্লা পুরোপুরি আমাদের দখলে।
আল্লাহর কৃপায় কেল্লা এখন আমাদের অধিকারে।
সমরখন্দের প্রাকৃতিক এবং ঐতিহাসিক বর্ণনা
সমরখন্দ খুব সুন্দর নগর। এর পূর্ব দিকে কোহিক নদী বয়ে চলেছে। কোহিক পাহাড় থেকে এই নদী বেরিয়ে এসেছে, অতএব ওই পাহাড়ের নামে এই নদীর নামকরণ হয়েছে। এই নদী থেকে অসংখ্য নহর বেরিয়ে এসেছে, যা থেকে সেচের কাজের সাধন হচ্ছে। এই নহরের পানি বাগিচাগুলো পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যার কারণে সমরখন্দের মাটি উর্বর ও ফসল-সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এই নদী বুখারা অবধি বয়ে গিয়ে তাকে সুজলা-সুফলা করে তুলেছে।
কুসকুল নামক আর একটি নদীও সমরখন্দ দিয়ে বয়ে গিয়েছে। এ নদী খুব বড় নয়, তবে বছরে তিন-চার বার বড়ই উথাল-পাথাল হয়ে ওঠে। তার পানি বুখারা অবধি পৌঁছায় না। সমরখন্দের আঙুর, তরমুজ, আপেল ইত্যাদি চাষের জন্য সেচের সাধনও এই নদীর উপর নির্ভরশীল। সমরখন্দের এই সকল ফলের মধ্যে আপেল ও আনার তো জগৎ-প্রসিদ্ধ। শীতকালে এখানে খুব ঠান্ডা পড়ে। গরমের দিনগুলোতে এখানকার আবহাওয়া কাবুলের মতোই মধুর থাকে।
সমরখন্দের উপনগরগুলোতে অনেক সুন্দর ইমারত রয়েছে। এ সকল ইমারত ও সুন্দর বাগিচাগুলো তাইমুর বেগ ও ঔলংগবেগ মির্জা নির্মাণ করিয়েছিলেন।
এর আর এক উপনগর গিলক সরাইয়ে তাইমুর বেগ তাঁর কেল্লা বানিয়েছিলেন। এটি চারটি বিশাল তোরণ সমৃদ্ধ দুর্গ। নগরটি চারদিক দিয়ে প্রাচীর বেষ্টিত। প্রধান দ্বারটি লোহার গেট রূপে রয়ে গেছে। জুমআর নামাজের জন্য বিশাল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এ মসজিদ সম্পূর্ণ রূপে পাথরের তৈরি। এর পাথরগুলো অতি উত্তম রূপে খোদাই করা হয়েছে। এর পাথর খোদাইকারী শিল্পীদের হিঁদুস্তান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এর গম্বুজ মেহরাববিশিষ্ট। এতে অত্যন্ত উজ্জ্বল হরফে পবিত্র কুরআনের লিপি খোদাই করা রয়েছে। এর লিপিগুলো এতটাই স্পষ্ট যে, দু’মাইল দূর থেকেও তা পড়া যায়। নগরীর পূর্ব দিকে দুটি বাগিচা রয়েছে। দূরবর্তী বাগিচাটি বাগে-বুলন্দী ও নিকটবর্তী বাগিচাকে বাগে-দিলকুশা বলা হয়। বাগিচায় তাইমুর বেগের ভারত-যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত চিত্রকলা রয়েছে।
তাইমুর বেগের আমলের চিহ্নসমূহ
তাইমুর বেগের আমলে নকশে জাঁহা নামে আরো একটি বাগিচা নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি কোহিক পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত ছিল। তবে, যখন আমি সেটি দেখি তখন সেটি ধ্বংসোন্মুখ হয়ে পড়েছিল। অবশ্যই, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তার এই পরিণতি ঘটেছিল। এখন তা নামে মাত্রই রয়ে গিয়েছিল।
শহরের দক্ষিণ দিকে রয়েছে বাগে-চিনার এবং উত্তর দিকে বাগে-ইসমাঈল ও বাগে বেহিশত (স্বর্গোদ্যান)।
ওখানে সেই সকল ব্যক্তির মকবরা রয়েছে যাঁরা একদা সমরখন্দের শাসক ছিলেন। সমরখন্দে উঁচু প্রাচীর ঘেরা একটি মাদ্রাসাও রয়েছে যেটি নির্মাণ করিয়েছিলেন মুহম্মদ সুলতান মির্জার পুত্র তাইমুর বেগ, তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর মির্জা। সেখানে একটি মকবরার কাছে গম্বুজ সমৃদ্ধ এক সুন্দর ইমারতের মধ্যে একটি হাম্মাম (স্নানঘর) রয়েছে যা ‘মির্জা হাম্মামখানা’ নামে অভিহিত। এটি ছোট ছোট রঙ-বেরঙের পাথর দ্বারা সজ্জিত।
ঔলংগ মির্জা বিনির্মিত আরেকটি বিখ্যাত বাগে-ময়দান রয়েছে যার অর্থ হলো সমতল বাগান। এর মধ্যে চল্লিশ স্তম্ভ বিশিষ্ট একটি ইমারত রয়েছে। এতে নকশাদার পাথরে নির্মিত চারটি মিনার চার কোণে অবস্থিত। এই ইমারতে ব্যবহৃত পাথর সম্পর্কে কথিত আছে যে, এগুলো দূর-দূরান্ত থেকে বয়ে আনা হয়েছিল। এখানে একটি মসজিদও রয়েছে, যেটি মসজিদে-লকলকা নামে পরিচিত। এর বাস্তুশিল্পের বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এতে আওয়াজ গুঞ্জরিত হয়। এর গম্বুজের নিচে দাঁড়িয়ে কেউ পায়ের থাপ দিলে সেই হাল্কা থাপের ধ্বনিও গম্বুজের প্রতিটি অংশে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে শোনা যায়। এটি কেমন করে হয় এ রহস্যের উন্মোচন আজও অবধি হয়নি।
সমরখন্দ তার নিজের কিছু শ্রেষ্ঠত্বের জন্য অন্য নগরগুলোর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এখানকার ময়দানগুলোতে বসা হাটবাজারগুলোতে খুব ভিড় হয়। বাজারগুলো সুসজ্জিত। এখানে তন্দুরগুলিতে রুটি সেঁকা হয়। রসুইগুলোতে সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত হয়। এখানে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো কাগজ উৎপাদিত হয়। কাগজ উৎপাদনে ব্যবহৃত সামগ্রী খান-এ-গিল ও আব-এ-রহমত থেকে নিয়ে আসা হয়। এখানকার বাজারগুলোতে বিক্রীত মখমলগুলো দেখলে যেন মনে হয় তারা নিজেরাই কথা বলছে।
সমরখন্দের ভৌগোলিক বর্ণনা
সমরখন্দের সুলতান এখানে বছরে একবার এসে দু-এক মাসের জন্য তাঁবু ফেলে কাটিয়ে যাওয়াটা বেশ পছন্দ করতেন। যেখানে তাঁবু ফেলা হতো সেটি চার মাইল বিস্তৃত বর্গাকার এলাকা।
সমরখন্দের সবচেয়ে বড় নগর বুখারা। এ নগর যেখানে সুন্দর নগরগুলোর অন্যতম, সেখানে এখানকার তরমুজ এতই সুস্বাদু যে, তার কোনো তুলনা হয় না। বুখারার কুলও অতুলনীয়। এই কুল পেকে গেলে শুকিয়ে নেওয়া হয়। দূর-দূরান্ত অবধি এই শুকনো কুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ওষুধ তৈরিতে এর খুবই উপযোগিতা রয়েছে। বুখারার শরাব তীব্র নেশা উৎপন্নকারী বস্তু।
সমরখন্দের উত্তর দিকে ‘কে কেশ’ নামে অন্য একটি নগরী রয়েছে। এখান পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য রয়েছে সড়ক পথ। কেশ নগরকে ‘শহর-এ-সব্জ্’ অর্থাৎ সবুজনগরী বলে অভিহিত করা হয়। এটি ছিল তাইমুর বেগের জন্মস্থান। এটিকে নিজের রাজধানী বানানোর জন্য তাইমুর বেগ কঠিন পরিশ্রম করেন। তিনি তাঁর নিজের আরামের জন্য আদর্শ ইমারত নির্মাণ করান। এখানে তিনি তাঁর দরবার বসাতেন। এতে মেহরাবযুক্ত পরকোট রয়েছে।
এখানে, নগর থেকে চার মাইল দূরে একটি তরণ তাল (সেতু) রয়েছে। এই সেতু খুব বড় এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং গভীর। এটি ‘কিল-ইমাগহ” নামে পরিচিত। কুলবা গ্রামে এরকমই আরো একটি নগর রয়েছে।
সমরখন্দে করশুল নামে আরো একটি নগর রয়েছে। করশুল একটি মোগল শব্দ। সম্ভবত, চেঙ্গিস খানের শাসনামলের পরে শহরটি এই নামে পরিচিত হয়। করশুলে পানি প্রাপ্তির সাধন সীমিত কিন্তু বসন্ত ঋতুতে এর শোভা বড়ই মনোহর। এখানে প্রচুর খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়। এখানে অসংখ্য রকমের ছোট-ছোট পাখি দেখা যায়।
এখানে খোবর ও খুরামান নামে আরো দুটি নগর রয়েছে যা সমরখন্দ ও বুখারার মধ্যে পড়ে। এই ক্ষেত্রের সকল গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান খুবই উর্বর। অবশ্যই এখানকার উর্বর ভূমিই ছিল প্রধান কারণ, যা তাইমুর বেগকে সমরখন্দকে নিজের রাজধানী বানানোর জন্য আকৃষ্ট করেছিল।