নবম অধ্যায় – সমরখন্দে বাবুরের পরাজয়
উজবেকদের ‘মা’ (জোহরা বেগী আগা)-য়ের সমর্থন পাওয়ার জন্য শায়বানির সমরখন্দে পৌঁছাতে বিলম্ব হলো না। তিনি এক বিশাল বাগিচায় তাঁর শিবির ফেললেন।
আমার অনুপস্থিতির কারণে সমরখন্দের মির্জা (মির্জা সরদার)-দের মধ্যে শায়বানি ভীতি ছেয়ে গেল। সময়টা ছিল দুপুর। মির্জারা দলে দলে, চারদিক থেকে এসে শায়বানির সামনে তাদের উপস্থিতির জানান দিল।
শায়বানি তাঁর আসন থেকে ওঠারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। তাঁর সামনে এসে মির্জাদের চরম অপমান সইতে হলো। আমার পিছনে সমরখন্দের প্রশাসক খাজা ইয়াহিয়া যখন মির্জাদের অপমানজনক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়ার খবর পেলেন তখন তিনি খুব দুঃখ পেলেন। তবে তাঁর আর কোনো উপায় ছিল না।
তাঁকেও বাধ্য হয়ে শায়বানির সামনে যেতে হলো। খাজা ইয়াহিয়ারও অপমানের জ্বালা সইতে হলো।
এর পরেও শায়বানি তাঁর ঘৃণ্য রূপটি প্রদর্শন করলেন। যদিও সমরখন্দে তাঁর বিরোধিতা করার কেউ ছিল না তা সত্ত্বেও শহরে তিনি লুট-তরাজ চালালেন। গণহত্যা চালিয়ে নিজের প্রতাপ দেখালেন। তিনি এমন এক মির্জাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলেন যিনি নগরবাসীর আত্মসমর্পণের জন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
আমি কেশ পার্বত্য এলাকার পথ ধরে সমরখন্দে পৌঁছাতে চাইলাম; কিন্তু ওই সময়কার অবস্থা পুরোপুরি আমার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। সমরখন্দ থেকে মির্জারা পালিয়ে যাচ্ছিল। তারা জান বাঁচানোর জন্য উপত্যকা, সেতু ও বিপজ্জনক রাস্তা ধরে সমরখন্দ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল।
ঐ সময়ে আমার বাহিনীর বহুসংখ্যক সাথি রাতের আঁধারে গোপনে আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
শায়বানির সেনার সাথে সরায়-পুল-এ আমি যুদ্ধ করলাম। যেখানে আমাকে পরাজয় বরণ করতে হলো।
সমরখন্দ পুনরাধিকার করা আমার জন্য স্বপ্ন হয়ে রয়ে গেল।
বাবুরের হাত থেকে সমরখন্দও বেরিয়ে গেল এবং ফারগানাও
শায়বানি বাহিনীর কাছে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণের পর ওই সময় আমাকে হার স্বীকার করতেই হলো।
আমি পিছু হটে এলাম। এবার আমার সামনের মঞ্জিল ছিল অজানা।
আমার হাত থেকে সমরখন্দও বেরিয়ে গেল এবং ফারগানাও। এবার আমার জানা ছিল না যে, আমি কোথায় যাচ্ছি আর কোথায় আমার গন্তব্য।
এবার আমার এ পরিকল্পনাও এল যে, আমি কুরাতিগিনের পথ ধরে খান দাদা আলাচা খানের কাছে পৌঁছে যাই। তবে ওই সময়ে এ ব্যবস্থাও হলো না। আমরা অন্য পথ কামতোরেতে উপত্যকা ধরলাম, যেখান থেকে ‘সরা-তকপাস’ অতিক্রম করে নিন্দক পর্যন্ত পৌঁছতে আমি সমর্থ হলাম।
এখান পর্যন্ত পৌঁছানোর পরিকল্পনা আমার জন্য সার্থক বলে প্রমাণ হলো। কেননা, সেখানে খুসরো শাহের এক নৌকর ৯ সুসজ্জিত ঘোড়া এবং ৯ পোশাকসহ আমাদের কাছে এল।
ওই সময়ে প্রাপ্য এ সাহায্য আমার জন্য খুব বড় সাহায্য বলে গণ্য হলো।
পরদিন শাহের ভাই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। কিছু বেগের সহযোগিতার আশ্বাসও আমি পেলাম। তারপর আমি হিসারের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলাম।
অবিস্মরণীয় কষ্টদায়ক যাত্ৰা
হিসার পৌঁছানোর জন্য নির্জন উপত্যকার পথ ধরলাম। তিন-চার দিন ধরে আমরা ঐ রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলাম। উপত্যকার রাস্তা এতটাই নির্জন, এতটাই বিপজ্জনক ছিল যে, আমি আগে তা কল্পনাও করিনি, দেখিওনি। ওই নির্জন উপত্যকার রাস্তা এতটাই বিপজ্জনক ছিল যে, সামান্য পদস্খলন ঘটলেই মানুষ এমন গভীর খাদের মধ্যে গিয়ে পড়বে যে, তার বাঁচার আর কোনো আশাই থাকবে না। পড়ার সময় হুলবিশিষ্ট ধারালো পাথরের সাথে টক্কর খেলে তার দেহ এতটাই ক্ষত-বিক্ষত হবে যে, তা গণনা করাও অসাধ্য হয়ে পড়বে।
এইভাবে এই কষ্টদায়ক ও বিপজ্জনক পথের সফর এক সময় শেষ হলো। আমরা ‘ফৈন’ নামক পাহাড়ি উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছাতে সমর্থ হলাম। সেখানে দু’মাইল বিস্তৃত সুন্দর একটি ঝিল ছিল। ঝিল পাড়ে পৌছেই ক্লান্তি নিবারণের জন্য বসে পড়লাম।
আমরা ‘ফৈন’ উপত্যকা অতিক্রম করে এসেছি, এ কথা ইব্রাহীম তরখান পর্যন্ত পৌঁছাতে বিলম্ব হলো না। সে সিরাজ কেল্লা অধিকার করে এলাকায় তার শাসন কায়েম করেছিল।
সেখানকার সরদারদের পক্ষ থেকে আমাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হলো। আমাকে নজরানা বাবদ ৭০-৮০টি ঘোড়া প্রদান করা হলো।
বাবুরের নতুন করে সমরখন্দ আক্রমণের প্রস্তুতি
এবার পরিস্থিতি আমার পক্ষে আসতে লাগল। সংগজার তখনও কম্বর আলী (সিকনর)-র অধিকারে ছিল। আবুল কাশিমের অধিকার ছিল কোহবরে। ইব্রাহীম তরখানের পূর্ণ আনুগত্য ছিল আমার পক্ষে। এদের সবার সৈনিক আমার শক্তিকে মজবুত করার জন্য এসে জুটেছিল।
আমরা আসফাদিক অভিমুখে অগ্রসর হলাম।
ওই সময়ে শায়বানি খান তিন-চার হাজার সৈনিক নিয়ে খাজা দিদার অধিকার করে রেখেছিলেন। তিনি সমরখন্দ রক্ষার ভার ‘জানে-ওয়াফা’ নামক ব্যক্তির দায়িত্বে দিয়ে রেখেছিলেন। জানে ওয়াফা কেল্লা রক্ষার জন্য ৫০০ থেকে ৬০০ সৈনিক মোতায়েন করে রেখেছিলেন। ‘হামজা’ ও ‘মেহেদী’ নামক কিলেদারদের জিম্মায় রেখেছিলেন কেল্লার বাইরের দিক রক্ষার ভার।
আমার বাহাদুর সঙ্গী-সাথি ও বেগ সরদারদের সঙ্গে আমি এ বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করি যে, শায়বানির কাছ থেকে সমরখন্দকে কীভাবে পুনরাধিকার করা যায়?
সর্বসম্মতিক্রমে একথাই সামনে এল যে, সমরখন্দবাসী শায়বানিকে মোটেও পছন্দ করে না। শায়বানি সেখানে যেভাবে লুটতরাজ ও গণহত্যা চালিয়েছিলেন, তাতে সমরখন্দবাসী তার উপর ক্ষোভে ঘৃণায় ফুঁসছে।
এ কথা নিশ্চিত ভাবে সামনে এল যে, আমাদের আক্রমণের সময় তারা যদি আমাদের সহযোগিতা না-ও করে তবে বিরোধিতাও করবে না। এটা হওয়াটাও আমাদের জন্য লাভদায়ক ছিল। একবার কেল্লা অধিকার হওয়ার পর সমরখন্দবাসী সম্পূর্ণভাবে আমাদের পক্ষে আসার কথা ছিল।
কী হবার ছিল তা আল্লাহ-ই জানেন। তবে হামলার হিম্মত করাটা আমাদের হাতে ছিল।
জোহরের নামাজের পর আমি আমার বাহিনীকে ইয়ার-ইয়ালাক অভিমুখে রওনা হওয়ার আদেশ দিলাম।
রাতের আঁধারে আমরা খান-ইয়ুর্তিতে পৌঁছে গেলাম। তবে সমরখন্দবাসী আমদের আসার খবর জেনে ফেলতে পারে, এই আশঙ্কায় আমরা জনবসতি থেকে দূরেই থাকলাম।
আমারা ‘কোহিক’ নদীর তটে শিবির ফেললাম। পরস্পরে আমরা খোলাখুলি
আলোচনা করলাম যে, আক্রমণ কি কীভাবে করা যাবে?
চৌদ্দ দিন আগের পুরনো কথা আমার স্মরণে আসছিল। আমরা ওই দিন আস-সাদিক কেল্লায় এক পারিবারিক দাওয়াতে বসে সলা-পরমার্শ করছিলাম। কেউ একজন প্রশ্ন করেছিল—‘আমরা সমরখন্দকে কবে ফিরে পাব?’
এক বাহাদুর সাথি বলেছিল—
‘আমরা গ্রীষ্মকালে সমরখন্দ ফিরে পাব…।’
‘পাতাঝরার কাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর’-অন্যজন বলেছিল।
‘এক মাসের মধ্যে…।’ তৃতীয় জন আশ্বাস দিয়ে বলেছিল।
‘চল্লিশ দিন লাগতে পারে…।’ চতুর্থ ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে বলেছিল।
‘বেশি হয়ে যাচ্ছে… কুড়ি দিনে…।’ অন্য একজন হিম্মত দেখিয়ে বলেছিল।
তখন নুয়ান কুকুলদাশ[১] পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে বলেছিল,
‘আমরা চৌদ্দ দিনে সমরখন্দ ফিরিয়ে নেব।’
[১. নুয়ান কুকুলদাশ সম্পর্কে কথিত আছে যে, তিনি ১০,০০০ সৈনিকের সরদার ছিলেন। ]
ওই সময় আমার নুয়ান কুকুলদাশের কথা মনে আসছিল। আল্লাহ তার মুখ-নিঃসৃত বাক্যকে সত্য করে দেখাতে যাচ্ছিলেন। আমরা ঠিক চৌদ্দ দিনে সমরখন্দ ফিরিয়ে নিতে যাচ্ছিলাম।
ওই সময়ে আমার এক অদ্ভুত স্বপ্নও স্মরণে আসছিল। একদিন আমি স্বপ্ন দেখলাম যে, খাজা উবাইদুল্লাহ আমার এখানে এসেছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে তাঁকে সালাম জানালাম। তিনি ভিতরে এলেন। আমার অধীনস্তদের মধ্যে একজন দৌড়ে গিয়ে মেজপোশ নিয়ে এল। তাঁর সামনে সেটি বিছিয়ে দেওয়া হলো। ওই সময়ে খাজা সাহেবের মুখের উপর আমি এক অলৌকিক নূরের ঝলক দেখি।
ওই সময়ে বাবা আমাকে একটি পত্র দিলেন। আমি সেটি পাঠ করলাম। তাতে লেখা ছিল—‘মেজপোশ বিছানোটা ত্রুটি পূর্ণ।’ (মোল্লা বাবা, বাবুরের স্বপ্নে দেখা ব্যক্তির নাম)।
খাজা সাহেবের কাছে কোনো বিষয় গোপন থাকার কথা ছিল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন—‘আমি তোমার ত্রুটি মার্জনা করে দিয়েছি।’
তারপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমি সসম্মানে তাঁকে বাহির পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য অগ্রসর হলাম।
তখন তিনি সেই দরবারে আমাকে হাত দিয়ে ধরে এতটা উপরে উঠিয়ে দিলেন যে, ফরাশ থেকে আমার পা সম্পূর্ণ রূপে উঠে গেল। (আমার স্মরণ নেই যে, তিনি আমার ডান বাহু ধরেছিলেন না বাম বাহু)।
আমার পদদ্বয়কে ফরাশ থেকে উঠিয়ে দেওয়ার পর তিনি তুর্কি ভাষায় বলেছিলেন—‘শেখ মসলহত তোমাকে দিয়ে দেওয়া হলো (সমরখন্দ)।’
বাস্তবিকই আমি কয়েক দিন বাদেই সমরখন্দ ফিরে পেয়েছিলাম।
সমরখন্দে সহজ বিজয়
আমরা পরিকল্পিতভাবে রাতের বেলায় নদী পার হলাম। আমার ৭০-৮০ জন জানবাজ সৈনিক নিজেরাই দায়িত্ব নিয়েছিল যে, তারা কেল্লার গুপ্ত সুড়ঙ্গ থেকে মইয়ের সাহায্যে কেল্লা প্রাচীরে উঠে গিয়ে ‘তুর্কিশ দরওয়াজা’ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। তারপর তারা কেল্লায় নিযুক্ত উজবেক রক্ষীদের উপর অতি দ্রুত হামলা চালিয়ে দেবে।
আমার বাহাদুর সৈনিকেরা নিজেরাই সিঁড়ি বানিয়ে নিল। নিচে যত সংখ্যক সৈনিক শক্ত পদে দাঁড়িয়ে ছিল, তার থেকে এক-দুজন কম সংখ্যায়, দ্বিতীয় দলটি প্রথম দলটির কাঁধের উপর দাঁড়িয়ে গেল। এইভাবে তৃতীয়টি… সবশেষে অন্তিম দলটি কাজ করল।
এইভাবে একে অন্যের কাঁধের সাহায্যে সিঁড়ি নির্মাণকারী সৈনিকদের দলে সবচেয়ে উপরে পৌঁছানোদের সংখ্যা দুই অথবা তিন রয়ে গিয়েছিল…। তাদের মধ্য থেকে একজন লাফ মেরে কেল্লার প্রাচীরে উঠে গেল, তারপর সে নিজে থেকে নিচে থাকাদের হাতের সাহায্যে উপরে টেনে নিল। তারপর নিচের লোকেরা দলের সংখ্যা এক-এক করে কমাতে কমাতে উপরে উঠে যাওয়ার ক্রম বানিয়ে নিল। প্রথম থেকে নিশ্চিত পরিকল্পনা অনুসারে অর্ধেক সংখ্যা নিচেই রয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তাদের চারদিক থেকে দলবদ্ধ করে আমার সঙ্গে ঐ সময়ে কেল্লার দ্বারে আক্রমণ করার কথা ছিল, যখন উপরে পৌঁছানো সৈনিকেরা নিজেদের কাজ সেরে ফেলবে।
উপর থেকে সংকেত পাওয়া মাত্রই, বাইরে মোতায়েন শত্রু-প্রহরীদের সজাগ হওয়ার আগেই আমার সৈনিকেরা কেল্লা-দ্বারে হামলা চালিয়ে দিল।
তারা প্রথম হামলাটি চালাল কেল্লা-রক্ষক ফাজিল তুরখানের[১] উপর। তাকে সহ তার সাথিদের হত্যা করা হলো। কুড়াল দিয়ে গেটের তালা ভেঙে সেটি ফেলে দেওয়া হলো। দরজা খুলতেই আমি লাফ দিয়ে ভিতরে পৌঁছে গেলাম।
[১. ফাজিল তুরখান সমরখন্দের তুরখানদের মধ্যেকার কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন তুর্কিস্তানের এক সওদাগর। তিনি তুর্কিস্তানে, শায়বানি খানের প্রতি তাঁর আনুগত্য পেশ করেছিলেন, যার পুরস্কার স্বরূপ তাকে সেখানকার কেল্লা রক্ষক নিযুক্ত করা হয়। তাঁকে ‘তুরখান’ পদবি শায়বানি খান কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছিল।—অনুবাদক ]
কেল্লার দ্বার খুলতেই প্রাচীরের রাস্তায় পৌঁছে আমার সৈনিকেরা, কেল্লার উজবেক সৈনিকদের উপর হামলা চালিয়ে মার-কাট শুরু করে দিয়েছিল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই সম্পূর্ণ রূপে কেল্লা আমার অধিকারে এসে গিয়েছিল। উত্তম রণনীতির কারণেই সমরখন্দের উপর আমার সহজ বিজয় বা পুনঃপ্রাপ্তি ঘটে গিয়েছিল।
সহযোগীদের বিবরণ, নগরাধিকার অভিযানের বিবরণ এই প্রকারের
সমরখন্দ পুনরাধিকার অভিযানে আবুল কাসিম কোহবর তাঁর ৩০-৪০ জন সৈনিককে তাঁর ছোট ভাই আহমদ কাসিমের নেতৃত্বে আমার সাথে পাঠিয়েছিলেন। এই রকমই ইব্রাহীম তুরখানও তাঁর ভাই আহমদ তুরখানের নেতৃত্বে কিছু সৈনিক পাঠিয়েছিলেন। এই সামরিক সাহায্য আমি কেল্লার অধিকার কায়েমের পর পেয়েছিলাম।
কেল্লা অধিকারের পর আমি আমার সেনা সহকারে বাইরে এসে নগরাভিমুখে রওনা হই। নগরে পৌঁছে আমি ঘোষণা করি যে, সেখানে এখন আর শায়বানির নয়, আমার হুকুমত কায়েম হয়েছে।
নগরবাসী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারা সহজে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার কিছুক্ষণ পর সওদাগররা দৌড়ে দৌড়ে আমার কাছে এল এবং আমাকে অভিনন্দন জানাতে লাগল।
আরো কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতে-না-হতেই পুরো নগরে, আমার সমরখন্দ পুনরাধিকারের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সকালের আলো ছড়িয়ে পড়েছিল। নগরবাসী আনন্দাতিশয্যে নৃত্য করতে শুরু করেছিল। আনন্দ করছিল। তখন নগরের বিভিন্ন অংশে মজুত উজবেক সৈন্যরাও প্রতিরোধের জন্য সামনে এসে গেল।
তাদের নিপাত করার জন্য আমার বা আমার সৈনিকদের প্রয়োজন পড়ল না। সমরখন্দের নগরবাসী নিজেরাই লাঠি-সোটা ইট-পাটকেল নিয়ে তাদের উপর এমনভাবে আক্রমণ চালাল মনে হবে যেন তারা পাগলা কুত্তা খেদানোর কাজে নেমে পড়েছে। এই হামলায় চার-পাঁচশো উজবেক সৈনিক মারা পড়ল।
সেখানকার প্রশাসক জানে-ওয়াফা যখন এ খবর পেলেন তখন তিনি খাজা ইয়াহিয়ার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। খবর পাওয়ামাত্রই তিনি পালিয়ে গেলেন। তিনি সোজা শায়বানির পদতলে গিয়ে শরণ নিলেন।
ওই দিন সন্ধায় তুর্কিক দরওয়াজা থেকে সোজা মাদরাসা ইমারতে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানকার গম্বুজের উপর অবস্থিত স্তম্ভে আমার হুকুমতের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিলাম।
সেখানকার লোকেরা খুবই ব্যস্ত-ত্রস্ত ছিল। এটা ছিল তাদের আনন্দাতিশয্যের দ্যোতক। তারা জয়ধ্বনি দিয়ে আমাকে স্বাগত জানাচ্ছিল। উজবেকদের জন্য মুর্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছিল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তা সমানে চলল।
সূর্যাস্তের পর নগরের কুলীন, ধনাঢ্য ও সওদাগর শ্রেণির লোকেদের আমার কাছে আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। তাঁরা সঙ্গে করে নজরানা নিয়ে আসছিলেন। কেউ বা রান্না করা সুস্বাদু ব্যঞ্জন নিয়ে এলেন তো কেউ বা নিয়ে এলেন রকমারি ফলের ভেট। আমার দীর্ঘায়ু কামনা করে আমার জন্য দোয়া করছিলেন। তাদের খুশির সীমা ছিল না।
পরদিন সকালে খবর এল যে, লোহা দরওয়াজার কাছে প্রায় ১৫-২০ জন উজবেক সৈনিক টাকাকড়ি কেড়ে নিয়ে লুটপাট চালাচ্ছে।
খবর পাওয়া মাত্রই আমি কিছু সৈনিক নিয়ে লোহা দরজার দিকে রওনা দিলাম।
কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই তারা লুটের মাল নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। অনেক দূর পর্যন্ত তাদের ধাওয়া করা হলো। কিন্তু তারা পাহাড় ও উপত্যকার দুর্গম রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হলো।
৭ জুন, ১৫০২ থেকে ২৬ জুন, ১৫০৩ পর্যন্তকার বিবরণ
এটি আমার জন্য খুব ব্যস্ত সময় ছিল। আমার মনে আমার পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধারের বাসনা খুব প্রবল হয়ে উঠেছিল। সমরখন্দের ক্ষমতা পুনরাধিকার করে সেখানকার প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সুগঠিত করে আমি খানেদের সমর্থন লাভের চেষ্টা শুরু করলাম।
ফারগানার লালসায় সমরখন্দও হাতছাড়া হয়ে গেল
আমি সসৈন্যে খেতাল অভিমুখে রওনা হয়ে গেলাম। এখন আমার প্রধান লক্ষ্য ফারগানা রাজ্য লাভ করা। এটা তখনই সম্ভব ছিল যখন বড় খান’-এর সমর্থন লাভ হতো।
খানেদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থন লাভ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বড় খানের ছোট ভাই আহমদের সাথে কাশগড়ে আমার সাক্ষাৎ হলো। তাঁর কাছ থেকে আমি এই আশ্বাস পেলাম যে, আয়ুশ-এ পৌঁছানোমাত্রই আমি অস্ত্রশস্ত্র ও লোকজনের সাহায্য পেয়ে যাব। কিন্তু বড় খানকে, তার বোন শাহ বেগম খানেদের মধ্যে যাঁর অত্যধিক সম্মান ছিল, আমার বিরুদ্ধে চলে গেলেন।
আন্দিজান অবধি আমার সৈন্যরা পৌঁছাতে পেরেছিল, তখন কোথাও থেকে খবর আমার আগে আমার সৈনিকদের কাছে পৌঁছে গেল যে, খানেদের সমর্থন আমার পক্ষে নেই। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হলো এই যে, তাদের সমর্থন ফারগানার শাসকের পক্ষে রয়েছে।
এই খবর চাউর হওয়ার মধ্যেই আমি আমার গন্তব্যের অর্ধেক পথে পৌঁছে যাই, তখন রাতের অন্ধকারে আমার অধিকাংশ সৈন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
এমন খবরও ছড়াল যে, আন্দিজানের তাম্বোলরা আমার বিরুদ্ধে আমার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শায়বানির সাহায্যও চেয়ে রেখেছে।
এমতাবস্থায় আমাকে আমার অবশিষ্ট ২০-৩০ জন বিশ্বস্ত সাথিকে নিয়ে আয়ুশ থেকেই পিছু হটতে হলো।
এই সময়টি আমার জন্য খুব কঠিন বলে প্রতিপন্ন হলো। আমার পিছনে সমরখন্দেও বিদ্রোহ হয়ে গিয়েছিল। আরো একটি ঘটনা ঘটে গেল, তা হলো, আমার আত্মীয়-স্বজনদের নিজের পক্ষে টানার জন্য শায়বানি খান আমার বোনকে বিয়ে করেছিল।
আমার আত্মীয়-স্বজনদের নিজের পক্ষে টেনে নেওয়ার পর সে সমরখন্দ পুনর্দখল করে নিয়েছিল।
এইভাবে, আমি না পারলাম ফারগানার শাসক হতে আর না পারলাম সমরখন্দকে নিজের অধিকারে রাখতে।
২০-৩০ জন বিশ্বস্ত সাথিকে সঙ্গে নিয়ে এই সময়ে আর বড় কোনো যুদ্ধের কথা ভাবতেই পারতাম না।*
——
[* ১৫০৩ থেকে ১৫০৪ ঈসায়ী সনের মধ্যেই বাবুর শায়বানির কাছে পরাজিত শাসক রূপে অবস্থান করছিলেন। তিনি অসফারা পাহাড়ি উপত্যকায় বিভ্রান্তের মতো ঘুরতে থাকেন এবং সীমাহীন দারিদ্র্য ও দুঃখকষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করতে থাকেন। তাঁর বংশের লোকেরাও শায়বানির পক্ষে চলে গিয়েছিলেন।
‘বাবুরনামা’ অনুসারে ১৫০৪-এ তিনি খুরাসান গিয়ে সেখানকার শাসক হুসাইন বাইকুরার কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তিনি খুরাসান অভিমুখে রওনাও হয়েছিলেন। তবে কিছুদিন বাদে তিনি ইচ্ছা বদল করেন। তিনি খুরাসান না গিয়ে কাবুল অভিমুখে অগ্রসর হতে শুরু করেন।—অনুবাদক]