দ্বাদশ অধ্যায় – কাবুলের বর্ণনা
কাবুল চার ঋতুর দেশ (শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ও বসন্ত ঋতু)। এখানকার ভূমি উর্বর। এখানে পূর্বে লামঘানাত, পেশোয়ার, হনগর ও হিঁদুস্তানের কিছু অংশ আছে। পশ্চিমে পবর্তমালা রয়েছে যেখানে হাজারা ও নিকুদারি উপজাতির বসতি রয়েছে। উত্তরে হিন্দুকুশ পবর্তমালা একে অন্য দেশগুলোর সীমানা থেকে পৃথক করেছে। এখানে কুন্দুজ ও অন্দর-আব দেশ রয়েছে। দক্ষিণে ফার্মুল নগজ, বান ও আফগানিস্তান।
কাবুলের নগরীয় বর্ণনা
কাবুল নগরের আবাদি ছোট তবে এটি বিস্তৃত ক্ষেত্রে পূর্ব থেকে পশ্চিম অবধি বিস্তৃত। এটি চারদিক থেকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। এই পাহাড়গুলো নগরীয় আবাদিকে একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। এখানকার অবতল ক্ষেত্রের একটি এলাকা শাহ-কাবুল নামে পরিচিত। সেখানকার সম্পর্কে বলা হয় যে, হিঁদুস্তানের কোনো শাহ এখানে তাঁর রিহাইশগাহ (আবাসগৃহ) নির্মাণ করিয়েছিলেন। এটি চার মাইল ব্যাসের একটি ঘেরা এলাকা। এখানে বাগিচা আছে, নহর আছে যা পাহাড় কেটে বের করে আনা হয়েছে। শাহ কাবুলের দক্ষিণে উঁচু প্রাচীর আছে, যা দু’মাইল বিস্তৃত একটি তরনতাল (পুল বা সেতু)।
কাবুল নগর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত খাজা শাকুর মকবরা (দরগাহ)। সেখান থেকে কিছুটা উঁচুতে খাজা খিজিরের কদমগাহ রয়েছে, একটি তৃতীয় প্রসিদ্ধ স্থান, যা আরো উপরে অবস্থিত, খাজা রৌশানাল নামে পরিচিত। এখানকার একটি পাহাড়কে সিয়াহি সংগ (কালা পাহাড়) বলে। পাহাড়ে উঠে দেখলে চারদিকে অত্যন্ত সুন্দর হরিৎ-ক্ষেত্রের দৃশ্য নজরে পড়ে। এখানে প্রবাহমান উত্তুরে হাওয়া তাদের জন্য বড় সুখদায়ক অনুভূতি বয়ে আনে, যাদের ঘরের জানালা উত্তর দিকে অবস্থিত।
বাণিজ্যিক নগর রূপে কাবুল
কাবুল ও কান্দাহার থেকে দুটি বাণিজ্যিক হাঁটা-পথ রয়েছে-একটি হিঁদুস্তান ও অপরটি খুরাসান মুখী। কাবুলে কাশগড়, ফারগানা, তুর্কিস্তান, সমরখন্দ, বুখারা, বলখ, হিসার ও বাদাখশান থেকে সওদাগরি কাফেলা আসে। কান্দাহারে খুরাসানের সওদাগরও আসে।
কাবুলকে একটি উমদা (অতুলনীয়) বাণিজ্য কেন্দ্র বলে গণ্য করা হয়। এখানে আসা সওদাগররা খুব বেশি মুনাফা নেন না। কাবুলে প্রতি বছর ৭ থেকে ১০ হাজার ঘোড়া বিক্রির জন্য আনা হয়। এখানে হিঁদুস্তান থেকে আগত বাণিজ্যিক কাফেলার সংখ্যা ১০ থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে। হিঁদুস্তান থেকে আগত সওদাগররা সাদা কাপড়, আখ ও জড়ি-বুটি নিয়ে আসেন।
কাবুলের জলবায়ু ও উৎপাদনের বর্ণনা
কাবুলের আশপাশে গ্রীষ্ম ও শীতপ্রধান রাজ্য রয়েছে। একদিনের সফরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া যায়। কাবুলে কোথাও কোথাও তুষারপাতও হয়।
এখানে শীত ও গ্রীষ্মকালে ফল মূল নগর বসতির কাছাকাছিই পাওয়া যায়। শীতকালের প্রধান ফল হলো-আঙুর, আনার, আলুচা, আপেল, নাশপাতি ও গুদেদার ফল। আলু-বালুও (বাবুর সম্ভবত চেরি ফল কিংবা এরকমই কোনো গুদেদার ফলকে বুঝিয়ে থাকবেন, কিংবা আলু বুখারা?) সহজে উৎপাদন করা যায়। গ্রীষ্মকালে লোকেরা নগরে লেবু ও আখ বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। পাহাড় এলাকায় প্রচুর পরিমাণে মধু পাওয়া যায়। মৌমাছিরা বড় বড় চাক তৈরি করে। এখানে তো আঙুরের বাহার লেগে যায়। কয়েক প্রকারের আঙুর তো এখানেই উৎপাদিত হয়। এখানে আব-এ-আঙুর* নামেও এক প্রকারে আঙুর পাওয়া যায়।
[* ইংরজিতে Water-Grape লেখা হয়েছে।—অনুবাদক]
কাবুলে প্রচুর পরিমাণে শরাবও উৎপাদিত হয়। অবশ্যই এখানকার শরাব একটু কড়া হয়। নেশা দ্রুত চড়ে যায় এবং বহুক্ষণ পর্যন্ত তার প্রভাব থাকে।
কাবুল খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য বেশি উর্বর নয়। অবশ্য এখানে অত্যন্ত উন্নত মানের তরমুজ হয়। তবে, খুরাসানের তরমুজের বীজ এখানে বপন করলে তার স্বাদ বদলে যায়।
এখানকার ঋতুগুলো অত্যন্ত মনোরম হয়। এখানকার মতো ঋতু দুনিয়ার আর কোথাও আছে কিনা আমি বলতে পারব না। এমনকি, গরমের সময়েও ফারকোট ছাড়া রাতের বেলা কেউ ঘুমাতে পারে না। শীতকাল কষ্টদায়ক হয় না। কাবুলের আবহাওয়া সমরখন্দ ও তবরেজের মতো।
কাবুলের চারণক্ষেত্রের বর্ণনা
কাবুলের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিশাল বিশাল সবুজ চারণ ভূমি। এগুলোর মধ্যে সংগ-কুরঘান ভারি সুন্দর। এটি উত্তর-পূর্বে চার মাইল জুড়ে বিস্তৃত। এই চারণক্ষেত্রটি ঘোড়া চারণের ভূমি বলে খুবই প্রসিদ্ধ। তবে, এখানে খুব মশাও হয়। উত্তর-পশ্চিম দিকে চেলাক নামক চারণ ক্ষেত্রটি দুই মাইল জুড়ে বিস্তৃত। এখানে মশা ভর্তি। তারা আকারে কিছু বড় হয়। ঘাস খাওয়ার জন্য চরতে আসা ঘোড়াদের জন্য এই মশারা বড়ই কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে। পশ্চিমে দুররিন নামে একটি চারণক্ষেত্র আছে। এর দুটি নাম দেওয়া হয়েছে-একটি টিপা ও অন্যটি কুশনাদির। এ দুটিই একে অন্যকে ছুঁয়ে রয়েছে। এরকম পাঁচটি চারণক্ষেত্র আছে যেগুলো দুই-দুই মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। এই চারণক্ষেত্রেগুলো জনবসতি থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত। কিছু চারণক্ষেত্র আছে সেখানে মশা গুনগুন করে না। এখানকার ঘাস ঘোড়াদের খুব পছন্দ।
কাবুলের পাহাড়-পর্বতের বর্ণনা
কাবুলের জীবন বিদেশি লোকেদের, এখানকার পাহাড়ি পথের চড়াই-উৎরাইয়ের কারণে পছন্দনীয় হতো না। পাহাড়ি চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে অজানা ব্যক্তির পথ হারানোর সমস্যাও থাকত।
বিশ্ববিখ্যাত হিন্দুকুশ পর্বতমালা বলখ, কুন্দল ও বাদাখশান থেকে কাবুলকে পৃথক করেছে। এগুলোর মধ্য থেকে তিনটি পথ পজ্-শির অভিমুখে চলে গেছে-একটি খাবক, দ্বিতীয়টি বজারক এবং তৃতীয়টি তুল-এর দিকে। তুলের পথটি সবচেয়ে ভালো। এটি সোজা সড়ক। স্থানীয় লোকেরা একে প্রধান হাঁটা পথ রূপে গুরুত্ব দেয়। অন্য একটি সড়ক অন্দর-আবের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এটি অত্যন্ত কষ্টদায়ক পথ। অন্দর-আব, সুখ-আব-য়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এটি একটি সুন্দর পথ। এর তৃতীয় পথটি শির্-তু-র সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই রাস্তায় বামলান এবং মারখান নগর পড়ে। এই দুই নগরে পৌঁছানোর রাস্তা শীতকালে বদলে যায়, লোকেরা আব-এ-দারা-র পথ ধরে।
শীতকালে হিন্দুকুশ পর্বতমালা তিন-চার মাসের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এর কারণ হলো ওই উপত্যকার উপর বয়ে আসা বারিধারার কারণে ঐ পথ অতিক্রম করা যায় না। কেউ যদি হিন্দুকুশ পাহাড় ধরে শীতকালে পাহাড়ি উপত্যকায় পৌঁছানোর চেষ্টা করে তাহলে তাকে কঠিন অবস্থার মোকাবিলা করতে হবে। এটি পার হওয়ার উত্তম সময় হলো পাতা ঝরার কাল, তা সামনে-পিছনের তিন-চার মাসের হয়, এমন মৌসুমে পাহাড়ের উপর বরফ থাকে না এবং পানির স্তর নিচে নেমে যায়।
কাবুল থেকে খুরাসান যাওয়ার জন্য কান্দাহারের পথই উত্তম। এখানকার রাস্তা সমতল। কোনো মোড়ও নেই।
হিঁদুস্তান থেকে চারটি রাস্তা কাবুলের সঙ্গে মিশেছে। একটি নিচু পথ খাইবার পাস হয়ে যায়। দ্বিতীয়টি বংগস তৃতীয়টি নজ্ এবং চতুর্থটি ফারমুল হয়ে। উপরোক্ত তিনটি পথও নিচু রাস্তার। এই পথগুলো সিন্ধু হয়ে চলে গেছে।
কাবুলের বাসিন্দাদের বর্ণনা
কাবুল দেশে আলাদা-আলাদা জাতির লোকেরা বসবাস করে। উপত্যকা এবং সমতলে তুর্কি ও আরবরা বসবাস করে। নগরীয় আবাদির সঙ্গে সেখানে গ্রামীণ বসতিও আছে। কিছু বিখ্যাত গ্রামের নাম হলো-পশাই, পারাজি, বিরকুল, যেগুলোতে আফগান জাতির লোকেরা বসবাস করে। পশ্চিম পাহাড়ি এলাকায় হাজারা ও নিকদারি জাতিদের বাস, এদের মধ্যেকার কিছু লোক মোগলাই ভাষায় কথা বলে। উত্তর-পূর্ব পাহাড় অঞ্চলে কাফির[১] ও কিটুর জাতির লোকেদের বসতি রয়েছে। দক্ষিণে আফগান জাতিদের।
[টীকা-১, উত্তর-পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলে কাফিরদের সম্পর্কে বলা যায় যে, এরা কুরআনে বর্ণিত কাফিরই, এরা কাফির অর্থ ধারণ করে, যার স্থানীয় অর্থ নাস্তিক। ঈশ্বরের কোনো রূপকে যারা মূর্তি রূপে স্বীকার করে না এবং এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে তারা মুসলিম। কাবুলে এগারো-বারোটি ভাষা প্রচলিত আছে। যথা-আরবি, তুর্কি, মোগলাই, হিন্দি, আফগানি, পাশাই, পারাজি, শিগরি, বিরকি, নামঘানী ইত্যাদি। অন্য কোনো দেশও এমন আছে কি-না আমার জানা নেই যেখানে এত জাতি এবং এত ভাষাভাষী মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে।—অনুবাদক ]
কাবুলের বিভাজন ক্ষেত্রের বর্ণনা
কাবুল দেশটি চোদ্দটি ক্ষেত্রে বিভক্ত। বাজৌর, সাবাদ এবং হালনগরের কোনো কালে হয়তো স্বাধীন অস্তিত্ব ছিল, তবে তাদের পৃথক-পৃথক অস্তিত্বের চিহ্ন আজ আর নেই। এগুলো উর্বর এলাকা। আফগানরা এদের এখানে মেহনত-মজদুরির কাজ করে।
পূর্বে লামঘানাত নগরের পাঁচটি উপনগর এবং দুটি কসবা আছে। এখানকার ভূমি উৎপাদক। এখানকার নগরাহার এলাকা কাবুল পৌঁছানোর জন্য কষ্টদায়ক এবং ক্লান্তিকর। সড়ক তিন-চারটি পাহাড় অতিক্রম করে গিয়েছে। রাস্তা নির্জন দীর্ঘ। ভূমি শুষ্ক ও অনুর্বর। খিরচিকি ও অন্য আফগানরা, চুরি-ডাকাতিকে যারা নিজেদের পেশা করে রেখেছে, তারা এই পথটি লুট-তরাজ চালানোর জন্য ব্যবহার করে। কিন্তু আমি এখানে আসার পর এই পথ নিরাপদ হয়ে গেছে। আমি একে কারাতুল ও কুরুকসালের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি। সেখানকার লোকেদের যাতায়াতের ফলে এখন এই সড়ক আগের মতো চোর-ডাকাতদের জন্য বিরান হয়ে রয়ে যায়নি।
এই সড়কের মোড়ে-মোড়ে ঠান্ডা এবং গরমের অনুভূতি আলাদা আলাদাভাবে অনুভব করা যায়, হাওয়া যখন ঝরনার দিক থেকে বয়ে যায়।
এই সড়ক অতিক্রম কালে বিভিন্ন রকমের গাছ, উদ্ভিদ, ঘাস, পশুপাখি, সভ্যতা ও রীতি-রেওয়াজের দেখা মেলে।
নিংনহরের উত্তরে বরফ সাদা পাহাড়ি পথ, একে বংশ থেকে পৃথক করে। এই পথ কোনো সওয়ারিতে বসে অতিক্রম করা যায় না। সাদা বরফের কারণে এই এলাকাকে সফেদ কোহ (সফেদ-সাদা, কোহ-পর্বত, সাদা পাহাড়) বলা হয়। এখানে জমে থাকা বরফ কখনো গলে না এবং এর নিচু অংশও ভেঙে কখনো উপত্যকায় পড়ে না। এই বরফ ঢাকা এলাকা অতিক্রম করতে অর্ধেক দিন লেগে যায়।
সফেদ কোহ এলাকা ছাড়াও জলবায়ুর দৃষ্টিতে অন্য কিছু এলাকা যথেষ্ট প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এখানকার পানি এত ঠান্ডা হয় যে, তাতে আর বরফ মেশানোর প্রয়োজন হয় না।
উত্তরে আলী সংগ তুমান নামক একটি এলাকা আছে। এখানে খাঁড়া পাহাড় রয়েছে যা হিন্দুকুশ পর্বতমালার সঙ্গে মিশেছে। এখানে বসবাসকারী লোকেদের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এদের কাফির বলা হয়। এদের বসতি কাফিরিস্তান নামে পরিচিত। এখানে মহান নাম-এর কবর রয়েছে। যাঁর রক্তধারা পয়গম্বর নূহের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে কথিত আছে। আলনাগার নামক অন্য একটি এলাকা কাফিরিস্তানের একটি অংশ, এটি গওয়ার নগরের নিকটে অবস্থিত। গওয়ার থেকে বয়ে যাওয়া পানির স্রোত আলী শাংগ-এ গিয়ে মিশে যায়।
লামঘানে অবস্থিত নূর উপত্যকা তাঁর নিজের নামেই অদ্বিতীয়। এখানে পাহাড়ের মাথায় কেল্লা রয়েছে। এই এলাকায় প্রচুর পরিমাণে খেজুর উৎপন্ন হয়। উপত্যকায় দুই প্রকারের আঙুর জন্মায়। এ সবের দ্বারা প্রস্তুত শরাব লামঘানের প্রসিদ্ধির কারণ বনে গিয়েছে। এখানে উৎপন্ন এক প্রকারের আঙুর থেকে হলুদ রঙের শরাব তৈরি হয় তো অন্য প্রকারের আঙুর থেকে লাল রঙের শরাব। প্রথম প্রকারেরটি বেশি সুস্বাদু হয়।
আরেকটি কসবা এলাকা, চগন সরাই নামে পরিচিত। এটি এই এলাকার একমাত্র গ্রামীণ বসতি। এটি কাফিরিস্তানের পার্বত্য এলাকার একটি ছোট খণ্ডের উপর অবস্থিত। এখানকার লোকেরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী, তবে তারা কাফিরদের সঙ্গে এমনই মিলে-মিশে থাকে যে, তারা তাদের রীতি-রেওয়াজ ও পরম্পরার মধ্যে নিজেদের শামিল করে রাখে। এলাকার লোকেরা শরাব পানে খুবই অভ্যস্ত। এই গ্রামীণ বসতিতে শরাব উৎপাদনের কোনো সাধন নেই। এরা কাফিরিস্তান থেকে হলুদ রঙের শরাব নিয়ে আসে এবং পান করে।
আমি যখন ঐ গ্রাম (চগন সরাই)-এ পৌঁছাই তখন কাফিরিস্তানের মূল বাসিন্দারা, গ্রামীণ লোকেদের সাহায্য করতে আসে। তারা সঙ্গে করে হলুদ রঙের শরাব নিয়ে এল। আমি সেখানে পৌঁছানোর পর জানতে পারি যে, কাফিস্তানের লোকেরা শরাব পানে এতটাই অভ্যস্ত যে, প্রত্যেক ব্যক্তি গলায় শরারের পাত্র ঝুলিয়ে রাখে। এই পাত্রকে ওরা খিগ বলে। এরা এক খিগভর্তি শরাব পানির বিকল্প হিসেবে পান করে।
তিমানের এক নগর বসতির নাম নিজরৌ। এটি কাবুলের উত্তরে কোহিস্তানে অবস্থিত। পাহাড়ি পথ ধরে এটি কাফিরদের এলাকার সঙ্গে মিশেছে। এখানকার লোক শান্ত স্বভাবের। এরা আঙুর ও অন্যান্য ফল উৎপাদন করে। আঙুর থেকে শরাব তৈরি করে। তবে, এদের শরাব তৈরির ঢঙ একটু অন্য রকমের। এরা আঙুর সিদ্ধ করে শরাব তৈরি করে। তারা কোনো ধর্মের উপর আস্থা রাখে না। কোনো প্রার্থনা করে না। তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, জীবন-যাপনের ঢঙ সবটাই কাফিরদের মতো, যদিও তারা নিজেদের হজরত মুহম্মদ (সা)-এর অনুসারী বলে পরিচয় দেয়।
নিজেরৌ, চারদিক দিয়ে পাহাড় বেষ্টিত জনবসতি, এখানে এমন একটি বৃক্ষ পাওয়া যায় ডাল আলো দেওয়ার জন্য বাতি হিসেবে জ্বালানো হয়।
এখানকার পাহাড় এলাকায় উড়ন্ত গিরগিটি পাওয়া যায়।[১] এখানে চামবাদুড়ের চেয়ে আকারে কিছুটা বড় এমন একটা জন্তু পাওয়া যায়, যা পরদা-বেষ্টিত পাখার সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই পাখা বাহু ও পায়ের মধ্যে থাকে। আমি এমন জন্তু এর আগে আর কখনো দেখিনি। সেখানকার লোকেরা তাদের মধ্যে থেকে একটিকে আমার সামনে নিয়ে আসে। আমি কৌতূহলী হয়ে তা দেখলাম।
লোকেরা বলল, এটি এক গাছ থেকে আরেক গাছে উড়ে যায়। লোকেরা তাঁর বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বলল যে, এটি গাছে রেখে দিলে গিজ[২]-এর মতো সোজা উড়ে গিয়ে অন্য গাছে গিয়ে বসে। লোকেরা গাছের গিয়ে পৌঁছালে সেটি তার পাখা ছড়িয়ে দিয়ে নিচে নেমে আসে। যেহেতু তার কারো দ্বারা ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা থাকে না সেহেতু সে তাদের কাছে এসে যায়।
[১. উড়ন্ত গিরগিটিদের লাফ কিংবা উড়ান সাধারণভাবে ৬০ গজ বলে গণ্য করা হয়। এর সর্বোচ্চ লাফ ৮০ গজ বলে জানা যায়।—অনুবাদক
২. গিজ পাখির উড়ান ছোট হয়। ছোট পাখিদের শিকার করার জন্য লোকে এদের পালন করে।—অনুবাদক]
নিজরৌ পাহাড়ি এলাকায় আমি অদ্ভুত রকমের একটি পাখিও দেখতে আসি। এটি লকা নামে পরিচিত। এর মাথা থেকে পাখনা পর্যন্ত চার-পাঁচটি রঙের পাখনা দেখা যায়। এর রঙ-বেরঙের পাখনার কারণে একে খুব আকর্ষণীয় বলে মনে করা হয়। এর আকৃতি কবুতরের মতো। কিছু বিশেষ জাতের কবুতরের গলায় চাঁর-পাঁচ রঙের পাখনা থাকে, এই রকম পাখনাই লকা পাখির মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত দেখা যায়।
নিজরৌ-এর অন্য একটি পাখির সম্পর্কে লোকেরা আমাকে বলে যে, তার পাখা বৃত্তাকারের হয়। এদের শুধু শরৎ ঋতুতেই দেখা যায়। ওরা দীর্ঘক্ষণ ধরে উড়তে পারে না, এ জন্য তারা মানুষের মধ্যে মিলে-মিশে থাকে।
এক অদ্ভুত প্রজাতির ইঁদুরের কথাও তারা আমাকে বলে। তাকে কস্তুরি ইঁদুর বলা হয়। ওই ইঁদুর থেকে কস্তুরির মতো সুগন্ধ বেরুতে থাকে। তবে এই কস্তুরি ইঁদুরকে আমি দেখিনি।
পন্ন্জশর নামক অন্য একটি ছোট মনুষ্য বসতি আমি কাফিরিস্তানে দেখতে পাই। এটি রাস্তার ধারে অবস্থিত। এখানকার লোকেরা, পাহাড় থেকে নিচু এলাকায় থাকার কারণে, প্রায়শই, এরা মানুষের কাছ থেকে কর উসুলের কাজে লেগে থাকত। এটাই এখানকা লোকেদের আয়ের সাধন ছিল। এরা মানুষের উপর লুটতরাজও চালাত। যখন থেকে আমি এখানে আসি, তাদের এই অপকর্মকে আমি কঠোরভাবে দমন করি।
এখানে ঘুরবন্দ নামে অন্য একটি বসতি আছে। এখানকার লোকেরা ‘বন্দ’ শব্দের অর্থ করে ‘কোহ’ বা পাহাড়, আর ‘ঘুর’ শব্দের অর্থ অতিক্রম করা রাস্তা। এখানকার একের পর এক আবাদি পাহাড়ের মধ্যে মধ্যে অবস্থিত। এখানকার ছোট-ছোট বস্তিগুলিতে পৌঁছানোর জন্যও পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে হয়, সে জন্য এই এলাকার নাম হয়েছে ঘুরবন্দ।
এই বসতি এলাকার হাজারা নামক জনবসতিটি উপত্যকার সবচেয়ে উঁচু স্থানে অবস্থিত। এখানকার বাসিন্দাদের জিম্মায় রাজস্ব উসুলের কাজ ছিল, যা থেকে তাদের দিন গুজরান হতো। তবে, শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের পর এখন তাদের ওই কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারা আমার আদেশের প্রতীক্ষায় ছিল। এ জন্য আমি তাদের মধ্যে গেলাম। তাদের আর্থিক দুরবস্থা শোধরানোর জন্য অন্য উপায় বের করা হলো।
কথিত আছে যে, সেখানকার লপিজ-লাজুলি পাহাড় এলাকায় রুপোর খনি রয়েছে। আমি ঘুরবন্দ শাসনের খরচের জন্য রুপোর খনির সন্ধানের কাজে লোক লাগিয়ে দিলাম।
আমি, হিন্দুকুশ পর্বতমালার পরিবেষ্টিত গ্রামীণ বস্তিগুলোর মধেকার অন্যতম লোকালয় মিতা-কচ্চায়ও গেলাম। পর-য়ান নামক এলাকাটি এই লোকালয়ের শীর্ষে অবস্থিত। এই গ্রামে ১২-১৩ টি বস্তি পর্বতমালার নিচে অবস্থিত। এখানকার লোকেদের আয়ের মূল উৎস হলো শরাব উৎপাদন। এখানে প্রস্তুতকৃত শরাবের শ্রেষ্ঠত্ব সবাই স্বীকার করে। গ্রামে কিছু লোক কর আদায় করে শরাব উৎপাদনের কাজ করে, তবে সবাই এমনটি করে এ কথা বলা যায় না। লোকেরা এমন-এমন বীহড় পাহাড় এলাকার মধ্যে বাস করে যে, কর উসুলের কাজে নিয়োজিত লোকেরা তাদের নিকট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।
এখানকার পাহাড়ি উপত্যকা-ঘেরা পথকে হাঁটা পথ বলে।* তা এ জন্যই বলে যে, সেখানে কোনো সওয়ারি ছাড়াই মানুষ সহজে চড়াই-উত্রাই পার হতে পারে। পাহাড় থেকে নেমে আসা বারিধারা নিচে সমতল ক্ষেত্রকে সিঞ্চিত করতে থাকে। যে সকল এলাকা বারিধারায় সিঞ্চিত হতে থাকে তাদের নাম কিরাত-জিয়ান ও দাস্তে-শেখ। সবুজ ঘাস ও মক্কা চাষ এই সমতল এলাকার প্রধান উৎপাদন। এখানকার এই উৎপাদনে তুর্কি ও মোগলদের একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে।
[* ইংরেজিতে Foothills লেখা হয়ছে।—অনুবাদক ]
এই হাঁটা-পথে (টিউলিপ-নলিনী, চমকদার ফুলের গাছ) রঙ-বেরঙের নলিনী ফুলের বাহার দেখার মতো। এখানে এরকমই বহু-রঙের ফুল দেখা যায়। এই স্থান অতিক্রম করার সময় আমি ৩২-৩৩ পর্যন্ত রঙের ফুল গুনতে পেরেছিলাম। আমি এক রকমের নলিনী ফুলের নাম দিলাম ‘গোলাপি সুগন্ধিযুক্ত’। কারণ ছিল ওই ফুল দেখতে ছিল লাল গোলাপের মতো, তা থেকে লাল গোলাপের মতো সুঘ্রাণ ভেসে আসত। এখানে নলিনী ফুলের চাষ করা হয় না। দাস্তে-শেখের সমভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে হয়, দূর-দূরান্ত পর্যন্ত রঙ-বেরঙের ছটা বিচ্ছুরিত হয়।
পুরো ঘুরবন্দ এলাকায় শত শত জায়গায় নলিনী ফুটতে দেখা যায়। সকল জায়গায় প্রাকৃতিকভাবে ফোটে। এদের চাষ করা হয় না। নলিনী ফুলের বাহারের কারণেই ঘুরবন্দের পাহাড়ি এলাকাটি পর্যটকদের কাছে বড়ই আকর্ষণীয় হয়ে রয়ে গেছে।
একটি ছোট পাহাড়ি ভূমির নিচে অবস্থিত বিশাল সমতল এলাকাটিকে খাজা-এ-রিগরাবান বলা হয়। এই সমতল ক্ষেত্রটি দুই ভাগে বিভক্ত-একটি সমতল উর্বর ভূমি তো অপরটি মালভূমি। এই মালভূমিটিতে সবুজ অপেক্ষাকৃত কম। এই এলাকায় প্রচণ্ড গরম পড়ে।
কাবুলের দক্ষিণ-পশ্চিমে এমন নগর আছে যা বরফ-আবৃত পাহাড়ি ক্ষেত্র। কথিত আছে, এখানে কোনো কালে তুষায় পড়ত। তবে এটি ‘কোনো কালে’র কথামাত্র, ‘এখন’-কার কথা নয়। প্রাকৃতিক পরিবর্তন তো সর্বত্রই হয়ে থাকে। এখন সেখানে কঠিন বরফাবৃত পাহাড় দেখা যায়, কোনো করল এখানে তুষারপাত হয়ে থাকলেও তা অস্বীকার করা যায় না। কখনো প্রাকৃতিক পরিবর্তন হলে, এখানে আবারও বরফ পড়তে দেখা যাবে, এ সম্ভাবনাও উপেক্ষা করা যায় না।
এখানে কঠিন বরফাবৃত পাহাড় বারো মাইল পর্যন্ত দেখা যায়। এই বরফাবৃত পাহাড়ের কারণে এখানকার লোকেরা পান করার জন্য খুব ঠান্ডা পানি সহজে পেয়ে যায়। সে কারণে এই এলাকার লোকেদের বরফ জমানোর সাধনের, বামিয়ান এলাকার লোকেদের মতোই, প্রয়োজন পড়ে না।
এখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা দ্রুতগতিসম্পন্ন। এখানকার প্রধান নদী হরমন্দ, সিন্ধু, কন্দালের দুঘাব এবং বলখ্-আব-এই চার নদী দূর-দূরান্ত অবধি বয়ে যায় না। এই চারটির মধ্যে দূরত্ব এতটুকুই যে, কোনো ব্যক্তি সাফরে বেরোলে একদিনের সফরেই এই চার নদীর পানির স্বাদ নিতে পারবে।
পামঘান পর্বত পরিবেষ্টিত এলাকার নিচে কাবুলের যে গ্রামগুলো রয়েছে, ওখানকার লোকেরা প্রধানত আঙুরের চাষ করে। আঙুর ছাড়া অন্য ফলও তারা ফলায়, তবে আঙুর উৎপাদনের প্রতি তারা বেশি আকর্ষণ অনুভব করে, কেননা, এখানকার আঙুরে দ্রুত পাক ধরে।
আসতারাগচের অধিবাসীরা এখানকার বাসিন্দাদের মতো একই প্রজাতির নয়। ঔলংগ বেগ মির্জা (বাবুরের পূর্বপুরুষ)-ও এদের পৃথক-পৃথক বর্ণনা দিয়েছেন। কমপক্ষে দুটি দেশের লোকেদের বাহুল্য তো আছেই একটি খুরাসানের অন্যটি সমরখন্দের। এরা নিজেদের, খুরাসানি ও সমরখন্দি রূপে আলাদা-আলাদা পরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।
পামঘান কাবুলের অন্য এলাকার সঙ্গে এই অর্থেও পৃথক যে, এখানে বেশি রকমের আঙুরের চাষ হয় না। এখানে একই রকমের আঙুর ফলানো হয় এবং এটা খুব সুস্বাদু হয়। এখানকার আঙুর এত সুস্বাদু হওয়ার মূল কারণ হলো এখানকার উত্তম আবহাওয়া।
‘পামঘানের পর্বতমালা বরফাবৃত। এখানকার গ্রামীণেরা তাদের আঙুর বাগিচাগুলোকে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। তারা বাগিচাগুলোকে কিছুটা এমন ধরনের লতাপাতা দিয়ে সাজিয়ে রাখে যে, তা অপূর্ব শোভা ধারণ করে। বাগিচার দু’দিক থেকে পর্বতের পানি-স্রোত বের করে নিয়ে এসে তারা তাকে সেচের কাজে ব্যবহার করে।
পাহাড় থেকে বয়ে আসা পানি বড়ই শীতল, শুদ্ধ ও স্বচ্ছ হয়। এখানকার আঙুর বাগিচাকে পছন্দ করে ঔলংগ বেগ মির্জা তা অধিকার করে নিয়েছিলেন। আমি ওই বাগিচাগুলোতে চলে গেলাম। ঔলংগ বেগ মির্জার পছন্দের বাগিচাগুলো আমি স্বচক্ষে দেখলাম। প্রকৃতপক্ষে, ওই সকল বাগিচা ও সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা করা সহজ নয়। স্মরণীয় করে রাখার জন্য ঔলংগ বেগ মির্জা সেগুলোকে পছন্দ করেছিলেন, আমি ওই বাগিচাগুলোর মালিকদের কাছ থেকে তাদের চাওয়া মূল্যের বিনিময়ে সেগুলোকে খরিদ করে নিলাম।
এই বাগিচাগুলো এমনই ছাতার মতো যে, তার নিচের ভূমিতে রোদ পৌঁছায় না। নিচে বেশ লম্বা-চওড়া বিশ্রামস্থল বানানো রয়েছে। ভূমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সবুজালিযুক্ত, ছায়াদার এবং মনোরঞ্জক।
বাগিচার চারদিকে সেচকার্যের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়। এখানে সারিসারি আঙুর গাছ লাগানো হয়। গাছগুলো সারিতে এমনভাবে লাগানো হতো যে, তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা তৈরি করা যেত না। সারির লতাগুলো একে অন্যের সঙ্গে ঘন-সন্নিবিষ্টভাবে এমনভাবে জড়িয়ে থাকত যে, তা এক-একটি দেওয়ালের মতো হয়ে যেত। বাগিচার মধ্যে সমতল স্থানে পৌঁছানোর জন্য তাদের তৈরি করা রাস্তা ব্যবস্থার করা যেত। ওই রাস্তাগুলো তাদের নিজেদের জন্য তৈরি। এগুলো ভিতরে যাওয়ার রাস্তার দ্বার-স্বরূপ ছিল। তাদের সজ্জাও ছিল দ্বারের মতো।
এই বাগিচাগুলো গ্রামসমূহের মধ্যে নিয়ে অথবা উপত্যকার শীর্ষে গিয়ে দেখলেও ভারি সুন্দর দেখাত।
এখানে খাজা-সহ্-ইয়ারান (বা তিনবন্ধু) নামে একটি এলাকা আছে। এটি একটি বৃত্তাকার ক্ষেত্র। এই এলাকায় আমি তিন রকমের ছোট-ছোট গাছ লাগাই। এদের গোলাকার রূপ দেওয়ার জন্য শুধুমাত্র তিন রকমেরই গাছ যাতে জন্মাতে পারে, সে জন্য এখানে বিশেষভাবে প্রয়াস করা হয়েছে। গাছের প্রকারেরও ক্রম দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে পিছনে বা প্রথমে গোলাকার পংক্তিতে বড় গাছের শৃঙ্খল রয়েছে, তারপর তার চেয়ে কিছু ছোট গাছ এবং তৃতীয় ক্রম তার চেয়েও ছোট গাছের।
এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে এ কথা প্রচলিত আছে যে, এই তিনটি আলাদা-আলাদা রকমের ছোট গাছের এই শৃঙ্খলা তিন ফকিরের দোয়া-র পরিণাম। তিনজন ফকির এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা যেমন বড়, মধ্য ও কনিষ্ঠ বয়সের ছিলেন। তেমনই গাছগুলোকেও সেখানকার বাসিন্দারা ‘খাজা-সহ-ইয়ারান’ বাগ বানিয়েছিলেন।
ওখানকার অধিবাসীদের বিশ্বাস যে তিন ফকিরের দোয়া এখনও সেখানে কায়েম রয়েছে। যাঁরা সেখানে দোয়া চাইতে আসেন, তাঁদের দোয়া কবুল হয়।
‘খাজা-সহ-ইয়ারান’ অবলোকন করার পর আমি এতই প্রভাবিত হলাম যে, আমি কারিগরদের আদেশ দিলাম যে, দশ ফুট লম্বা ও দশফুট চওড়া পাথরের চবুতরা বানিয়ে দেওয়া হোক। এ সকল চবুতরা আমি বসন্তঋতু আসার আগে প্রস্তুত করে চারটি স্থানে তাদের নির্মাণ কাজ পূর্ণ করার আদেশ দিলাম।
আমি এ আদেশও দিলাম যে, চবুতরায় এসে বিশ্রামকারী মানুষদের জন্য শীতল পানিরও ব্যবস্থা করা হোক। এ জন্য পাহাড়ের মধ্য দিয়ে নহর কেটে বাগিচার মধ্যে পানি নিয়ে আসারও আদেশ দিলাম। একথাও বললাম যে, চবুতরাগুলোর দুই দিকে হৌজ বানিয়ে দেওয়া হোক। হৌজে যেন সব সময় খাবার পানি ভর্তি থকে। এ সকল ব্যবস্থার আদেশ আমি এই ভেবে দিলাম যে, সেখানে এসে চবুতরায় উপবেশনকারীরা যেন পানির জন্য পেরেশান না থাকে। পাহাড় থেকে নহর কেটে আনায় কাজে লোক ওই দিনেই লেগে গেল।
কাবুলের আরো একটি কসবা আছে-যার নাম লুহুগুর। এখানে চিখ নামে একটি বড় গ্রাম আছে। এই গ্রামেও অনেক বাগিচা আছে, লুহুগুরের অন্য গ্রামে বাগিচা দেখা হয়নি। এখানকার অধিবাসীদের ঔঘনশাল বলে। কাবুলের জাতিগুলোর মধ্যে এদের বেশ মান্যতা আছে। কাবুলের অন্য এলাকায় লোকেরা ঔঘনশালের উচ্চারণ করে উঘনসার।
গজনীর একটি স্থানের নাম বিলায়াত। গজনীর এই স্থানটি সম্পর্কে বলা হয় যে, সবুক্তগীন, মাহমুদ ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের আমলে এই জায়গাটি রাজধানী রূপে ব্যবহৃত হয়েছিল। এ-ও বলা হয় যে, শিহাবউদ্দীন মুহম্মদ ঘুরি ক্ষমতা লাভ করার পরই এই স্থানকে রাজধানী বানিয়েছিলেন। তবে বিলায়াত নামটি এখানকার মানুষদের মুখে জায়গা পায়নি। বিলায়াতের পরিবর্তে লোকেরা গজনীকেই মনে রেখেছে।
গজনীকে ‘জবুলিস্তান’ও বলা হয়েছে। এখানে তিনটি ঋতু আছে। কিছু লোক মনে করেন কান্দাহারও গজনীর একটি অংশ। এটি কান্দাহারের দক্ষিণে কিছু দূরে এবং কাবুলের পশ্চিম দিকে অবস্থিত। কোনো ব্যক্তি যদি পায়ে হেঁটে কান্দাহার থেকে দ্রুতপদে হাঁটতে থাকে তাহলে দুপুর এক দু’ঘটিকার মধ্যে কাবুল পৌঁছাতে পারে।
আদিনাপুর কাবুল থেকে যত দূরে অবস্থিত, তা সত্ত্বেও তার কাবুল থেকে আদিনাপুরগামী রাস্তাটি এত অসমতল যে, পুরো একদিনেও ওই পর্যন্ত যাত্রা পুরো করা যায় না।
গজনীর ভূমি আশপাশের এলাকায় ভূমির চেয়ে অপেক্ষাকৃত অধিক উর্বর। এখান থেকে পাহাড়ি নদীগুলোর চার-পাঁচটি স্রোত বয়ে যায়। নহরের রূপে সেচের পানি পাঁচটি গ্রামে পৌঁছায়, সেখানে খুব ভালো ফসল ফলে।
কাবুল অপেক্ষা গজনীর আঙুর অধিক সুস্বাদু হয়। এখানকার তরমুজও আকারে বড় এবং সুস্বাদু, আপেলও সুন্দর এবং রসালো হয়। হিঁদুস্তানে এখানকার ফলের খুব চাহিদা আছে। সওদাগর আসে এবং এগুলো কিনে নিয়ে যায়।
গজনীতে চাষবাস করা কঠিন পরিশ্রমের কাজ। এর কারণ হলো এখানকার ভূমি খুবই রুক্ষ। প্রত্যেক বছর এখানকার চাষের জমি পাল্টাতে হয়। তবে এটা করে ভালো ফসলও লাভ করা যায়। কাবুলের চেয়ে বেশি খাদ্যশস্য এখানে উৎপন্ন হয়। কাবুল অপেক্ষা গজনীতে জিনিসপত্র সস্তা। মানুষ ইমানদার। সৎকর্মে বিশ্বাস রাখে। ইসলাম ধর্ম কঠোরতার সঙ্গে পালন করে। কিছু লোক তিন মাস রোজা রাখে।
গজনীতে মোল্লা আবদুর রহমান নামক একজন ব্যক্তির খুব মান্যতা আছে। তিনি মস্ত বড় পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর বিদ্যাত্তার কথা গজনীর মানুষ খুব গর্বের সঙ্গে প্রচার করে। এখানে মাহমুদের কবর রয়েছে, লোকে যাকে রওজা বলে। গজনীতে বহু মকবরা আছে। এগুলো খুব প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের। প্রত্যেকেরই মান্যতা রয়েছে।
কাবুল ও গজনী জয় করার পর আমি কোহাত অভিমুখে রওনা হই। এটি সমতল এলাকা। এখানে আফগান জাতির লোকেরা বসবাস করে।
গজনীর দল্ এবং আবিস্তাদা নামক স্থানেও আমি যাই। সেখানকার লোকেরা জানায় যে, এখানে একটি পাকা কবর আছে। ওই কবরে প্রতিদিন অলৌকিক দৃশ্য দেখা যায়। অলৌকিক এটাই যে, লোক সেখানে গিয়ে মানত করে ও নিজেদের কামনা-বাসনা জানায়, তখনই কবর নড়ে ওঠে এবং ঘুরে যায়। অলৌলিককত্বের ঔসুক্য আমাকে ওই কবরস্থানে নিয়ে গেল।
আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম, লোকেরা মানত করছে। মানত-প্রার্থনার একটা নির্দিষ্ট সময় ছিল। মানত-প্রার্থনাকারীদের সংখ্যা ছিল অনেক। আমি দেখলাম কবর নড়ে উঠল… এবং কিছুটা ঘুরে গেল। লোকেদের ভক্তি-ভাবের সীমা-পরিসীমা রইল না। যে যে লোকেরা ওখানে মানত-প্রার্থনা করছিল। যখন কবর ঘুরছিল তখন প্রসন্নতার তারা আবেগের টগবগ করছিল। বিশ্বাস মতে, ওই সময়ে সকল কামনা-বাসনা অবশ্যই পুরো হয়ে যাবার কথা ছিল।
কবরে এসে মানত-কামনাকারীদের ভিড় কমে যাওয়ার পর আমি তৎক্ষণাৎ এই উপসংহারে পৌঁছে গেলাম যে, কবর ঘোরানোর জন্য তার সেবকদের ধন-কামানোর যুক্তি কাজ করে। তারা কবরের নিচে এমন একটি চবুতরা বসিয়ে রেখেছিল যে, তাতে চাপ পড়লে কবর কিছুটা ঘুরে যেত। চাপ সরে গেলে কবর আবার যথাস্থানে ফিরে আসত। এই যুক্তি ওই সেবকেরাই ব্যবহার করত। এটা হওয়ার সাথে-সাথে শ্রদ্ধানবত লোকেরা ধন, সম্পদ, ফলমূল, খাদ্য-বস্ত্রসহ নানা সামগ্রী সেখানে ঢেলে দিত যার প্রত্যক্ষ লাভ ও সুবিধা ওই কবর-সেবকরা ভোগ করত।
এটা ছিল সহজ-সরল মানুষদের ভক্তি-শ্রদ্ধার সুযোগে তাদের সঙ্গে প্রতারণার মামলা। লোকেদের ভক্তিভাবের সঙ্গে ওই সেবকরা ধোঁকাবাজি করছিল। আমি তৎক্ষণাৎ কবরটিকে ভেঙে দেওয়ার এবং নিচের বিশেষ চবুতরাটিকে হটিয়ে দেয়ার কাজ করালাম। কবর পুনঃনির্মাণ করালাম। কবরের সেবকদের কঠোরভাবে সতর্ক করে দিলাম যে, ভবিষ্যতে তারা এরকম কিছু করলে কঠিন সাজা ভোগ করতে হবে।
তারপর কবর ঘোরার কথা আর শোনা যায়নি।
গজনী খুব প্রসিদ্ধ নগর। এখানকার বিষয়ে এ সংযোগও আছে যে, সেখানকার শাসনক্ষমতা যাদের হাতে থাকে তারা হয় হিঁদুস্তানি নতুবা খুরাসানি। এরা সবাই গজনীকে তাদের রাজধানী করেন।
সুলতান মাহমুদের শাসনামলে সেখানে তিনটি বাঁধ নির্মাণ করানো হয়। উত্তর দিকের বাঁধটি ৪০-৫০ গজ উঁচু এবং ৩০০ গজ লম্বা করে নির্মাণ করানো হয়। ওই বাঁধে পানি ধরে রাখা হতো। প্রয়োজন মোতাবেক ছাড়া হতো। এই বাঁধ ১১৫২ ঈসায়ী সনে আলাউদ্দীন জহাঁসোস ঘুরি তাঁর আক্রমণ ও বিজয়ের সময় ভেঙে দেন। তিনি সুলতান মাহমুদ গজনবীর শাসনামলে বিনির্মিত অনেক মকবরা উপড়ে দেন, নগরে অগ্নিসংযোগ করেন। হত্যা ও বলাৎকারের বাজার গরম করে দেন।
তিনি যতদিন যাবৎ গজনী শাসন করেন, ততদিন যাবৎ সুলতান মাহমুদের জামানায় নির্মিত বাঁধ খণ্ডহর হয়ে পড়ে থাকে। আল্লাহতায়ালার অনুকম্পায় তার ধ্বংসাবশেষ মাত্র ছিল। আমি আশা করতাম যে, সেগুলো পুনঃনির্মাণ করানো যেতে পারে। তবে, তার জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন ছিল।[১]
[১. ১৫২৬ ঈসায়ী সনে, হিঁদুস্তান বিজয়ের পর বাবুর খাজা কলার হাতে গজনীর ওই বাঁধ পুনঃনির্মাণ কাজ করার জন্য প্রচুর পরিমাণে ধন পাঠিয়েছিলেন।—অনুবাদক]
সমরখন্দের পূর্ব দিকেও আরো দু-তিনটি ছোট বাঁধ রয়েছে। এগুলো খণ্ডহর। এগুলোরও পুনঃনির্মাণের প্রয়োজন রয়েছে। সার্-এ-দিহ্-তে একটি বাঁধ ওই সময়ে ভালো অবস্থায় পানি সরবরাহের কাজ করে যাচ্ছিল। এ বাঁধটি সার্-এ-দিহ্ গ্রামের উঁচুতে অবস্থিত।
আমি কোনো একটি বইতে গজনী প্রসঙ্গে পড়েছিলাম যে, সেখানে বসন্ত ঋতুতে দুর্গন্ধযুক্ত ধুলো উড়ে আসে। এ বিবরণ সবুক্তগীনের শাসনামলে লেখা হয়েছিল। আমি বসন্ত ঋতু আসার পর গজনীর বিষয়ে লেখা উক্ত বিবরণের সত্য-মিথ্যার খবর নিলাম। সমস্ত প্রকারের খোঁজ-খবর ও লোকেদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদের পর জানতে পারলাম যে, লিখিত বিবরণ ভুল ছিল। যদি ভুল না হয় তবে সংযোগবশত এই ধূলিঝড় গজনীতে এসে থেকে থাকবে, যে বছর ওই বিবরণ লেখা হয়েছিল। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের নিয়ম দৃষ্টে এ ধরনের পরিবর্তন প্রায়শ সামনে এসে যায়। এ ধরনের পরিবর্তন বিচ্ছিন্নভাবে সংযোগবশত ঘটে থাকে। তাকে স্থায়ী বলা যায় না।
গজনী ও খোয়ারিজমে ঠান্ডার দাপট সুলতানিয়া ও তবরিজের মতোই হতে থাকে। এ মামলায় ইরাক এবং আজারবাইজানের মধ্যেও সমতা রয়েছে।
কাবুল থেকে দক্ষিণ ও গজনী থেকে দক্ষিণ-পূর্বে জুর্মত নামক একটি জনবসতি আছে। সেখানে গিরদিজের দারোগার প্রধান কার্যালয় রয়েছে। ওখানকার বাড়ি-ঘর তিন-চারতলা বিশিষ্ট ওখানকার লোক শক্ত-পোক্ত ও সুগঠিত দেহের অধিকারী হয়। তারা ওই সময়ে নাসির মির্জার বাহিনীর সঙ্গে অত্যন্ত জোরালো মোকাবিলা করে, যখন তিনি সেখানে আধিপত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তারা নাসির মির্জার বাহিনীকে তাদের উপর জয়ী হতে দেয়নি। ওখানকার বাসিন্দাদের ওঘন-শাল বলে। তারা মক্কার চাষ করে। সেখানে বাগিচা দেখা যায় না। এখানে শায়খ মুহম্মদ মুসালমানের মাজার রয়েছে। যে পাহাড়ের উপর তাঁর মাজার অবস্থিত সেটি বরকিস্তান নামে পরিচিত।
অন্য একটি কসবা ফারমুল নাম পরিচিত। এটিও ধর্মবিশ্বাসের একটি পবিত্র স্থান। এখানে খুব উত্তম জাতের আপেল জন্মায়। এই আপেল হিঁদুস্তান বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। এখানকার লোকেরা শেখজাদা বলে অভিহিত হন। এরা নিজেদের শায়খ মুহম্মদ মুসালমানের বংশধর বলে পরিচয় দেন। আফগানরা যখন হিঁদুস্তান আক্রমণ করেছিল, তখন এখানকার বাহাদুর বাসিন্দারা আফগান বাহিনীতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
বংগস নামে অন্য একটি কসবাই জনবসতি রয়েছে। আফগান জাতির সকল লোক এখানে বসবাস করে-খুগলানী, খিরিচাল, তুর্ল এবং লানদার এদের মধ্যে প্রধান। এরা সবাই চলাচলকারী রাস্তার বাইরের বস্তিতে বসবাস করে। এখানকার লোকেরা একরোখা, জেদী ও লড়াকু প্রকৃতির। এরা সন্তুষ্ট চিত্তে সহজে রাজস্ব দেওয়া পছন্দ করে না। অবশ্যই চাপ দিয়ে আদায় করতে হয়। এরা রাজসত্তার প্রতি পূর্ণরূপে অনুগত হয় না। সেনা শক্তির ভয়ই তাদের অনুগত করে রাখে।
এ রকম স্বভাববিশিষ্ট লোকেদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কান্দাহার, বলখ, বাদাখশানে সমানভাবে থেকে যায়। আল্লাহর রহমতে, যখনই আমার প্রয়োজন পড়েছে যে, এরকম স্বভাব বিশিষ্ট লোকেদের দাবিয়ে রাখা জরুরি, তখনই আমি তাতে পূর্ণরূপে সাফল্য পেয়েছি।
আমাকে, এই হঠকারী লোকেদের পথে আনার জন্য কঠোরভাবে সামরিক শক্তি দেখাতে হয়েছে। বংগসের চোর-ডাকাতদের দমনেও আমি সফল হই।
কাবুলের পূর্বে ৪-৬ মাইল দূরে নিজেরৌ নামে একটি এলাকা আছে সেখানকার জন্য সোজা সড়ক চলে গেছে। এখানে দুটি মোড়ে ছোট-ছোট বসতি রয়েছে। দুই বসতির বিশেষত্ব হলো এই যে, সেখানে আলাদা-আলাদা মৌসুমের আভাস দেওয়া হয়। যদিও বসতিগুলোর মধ্যে দূরত্ব বেশি নয়, তা সত্ত্বেও সেখানকার পার্বত্য এলাকার আলাদা-আলাদা বিশেষত্ব থাকার কারণে বসতিগুলোর একটিতে গরম মৌসুমের আভাস হয় তো অন্য বসতিতে শীতের।
এই বসতিগুলোতে ছোট ছোট পাখি ভরে রয়েছে। তারা সকাল বেলা দলে-দলে ঋতু-অনুকূলতার কারণে এক বসতিতে পৌঁছে যায় তো দুপুরের সময় অন্য বসতিতে। এইভাবে পাখিদের প্রবাসের জন্য খুব কম দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়।
তারা পাখি-শিকারিদের থেকে খুব সতর্ক থাকে। শিকারিদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য তাদের খুব কুশলী হতে হয়, যারা তাদের ক্ষতি করতে পারে। তারা এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য খুব দ্রুত উড়ে চলে। প্রয়োজন পড়লে তারা দলে-দলে পাহাড়তলিতে বেলে মাটি ও পাথরের উপর গিয়ে বসে।
তবে, সকাল-সন্ধ্যার প্রবাসী পাখিদের শিকারের লোভে বসে থাকা শিকারিরা উৎকণ্ঠায় থাকে। তারা তাদের ধরার জন্য গোপন জায়গায় জাল পেতে রাখে। তিন-চার গজ দূরে-দূরে জালকে বাঁশের খাপচির সাহায্যে বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখে।
লুকিয়ে থাকা শিকারিরা এই আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে যে, কখন পাখিদের দল এই জালে এসে পড়বে। পাখিদের দল সেখানে পৌঁছানোর সাথে-সাথেই জাল উপর থেকে নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়। পাখিরা আওয়াজ শুনতেই ফুরফুর করে ওড়া মাত্রই ওদের জালে আটকে যায়। শিকারিদের জাল থেকে পাখি ছাড়ানোই যা সময়। তারপর তাদের খাদ্য বানিয়ে ফেলে।
নিজরৌ থেকে কিছু দূরে আলাসা এলাকার বসতি। এখানে আনার ফলে। তবে এ আনার কোনো বিশেষ জাতের নয়। তার চাহিদা স্থানীয় ক্ষেত্রেই সীমিত থাকে। হিঁদুস্তানের বাজারেও বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। সস্তা হওয়ার কারণে তার চাহিদা থেকেই যায়। এখানে আঙুর উৎপাদনও হয়। আঙুরের প্রশংসাও করা যায় না, তবে সস্তা হওয়ার কারণে বাজারে তার ভালো চাহিদা আছে। আঙুর নগদ বিক্রি থেকে বেঁচে গেলে তা দিয়ে শরাব তৈরি করা হয়। নিজরৌয়ের শরাবের মোকাবিলায় এখানকার তৈরি আঙুরের শরাব দ্রুত নেশা ধরায় এবং স্বাদে উমদা হয়।
বদরৌ আলাসাল সংলগ্ন একটি এলাকা। এখানকার অধিবাসীদের কাফির বলা হয়। এখানে ফল জন্মায় না। তারা মক্কার চাষ করে তারই উপর জীবিকা নির্বাহ করে। পার্বত্য বসতিগুলোতে বসবাসকারীরা হাজারা উপজাতির লোক বলে পরিচিত।
কাবুলে পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর প্রায় আট লক্ষ লোক রাজস্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে।
কাবুলের পার্বত্য ক্ষেত্রে ওই রকমই শৃঙ্খলাযুক্ত খাড়া এবং বীহড় রয়েছে যেমনটি হিসার, খুতলাম ও ফারগানা, সমরখন্দ ও মোগলিস্তান উপত্যকা। সকল পর্বতমালায় খাড়া পাহাড়ও আছে এবং সমতলও।
নিজরৌ, লামঘানাত ও সওয়াদের পাহাড়ি ক্ষেত্র কিছুটা ভিন্ন রকমের। এগুলো অপেক্ষাকৃত বেশি উঁচু নয়। এখানে সায়প্রাস ও দেবদারু এবং জায়তুন বৃক্ষের আধিক্য দেখা যায়। এখানে জন্মানো ঘাস শক্ত ও লম্বা হয়। এখানে জন্মানো ঘাস না ঘোড়া চরার কাজে আসে, আর না ভেড়ার।
এখানকার পাহাড় খাড়া না হয়ে ঢালু হয়। এই পাহাড়গুলোর কঠিন পাথরের হয়। তা ভেঙে পড়ে না। এই পাহাড়গুলোতে প্রচুর চামবাদুড়ের বাস। এখানে হিঁদুস্তানি পাখিদের দেখা মেলে-তোতা, ময়না, ময়ূর, লুজা ইত্যাদি নামে এরা পরিচিত। লেংগুর, নীলগাইও এখানে হিঁদুস্তান থেকে এসে যায়। এক বিশেষ রকমের হরিণও এখানে পাওয়া যায়। এদের পশম হয় ভেড়ার মতো, উচ্চতাও ভেড়ায় মতো। এর নাম দেওয়া হয়েছে পাহাড়ি হরিণ। এই পাহাড়ি হরিণ হিঁদুস্তানে পাওয়া যায় না।
কাবুলের পশ্চিমে জিন্দান-ভ্যালির মতো বিপজ্জনক উপত্যকা রয়েছে। এগুলোর নাম গর্জওয়ানও ঘরজিস্তান। সে সবের নিচে বিস্তৃত তৃণভূমি রয়েছে। এখানকার ঘাস শুধু ময়দানেই নয়, পাহাড়ের উপর পর্যন্ত জন্মায়। পাহাড়গুলোতে সবুজ গাছপালা জন্মায়। এখানকার ঘাস ঘোড়ার খুব পছন্দ। উপত্যকার উপরে চতুর্দিকে সমতল এলাকায় ভালো চাষবাস হয়। চতুর্দিকের সমতল এলাকার বাসিন্দারা প্রধানত ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ঘোড়া ও ভেড়া পালন করে। এই দুই পশুকে সকাল হলেই খোলা ময়দানে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরা দিনভর সবুজ খাস খেয়ে উপরপূর্তি করে সন্ধ্যায় সেই আলয়ে ফিরে আসে। এদের দেখ-ভালের জন্য রাখালেরও বিশেষ দরকার পড়ে না।
কাবুলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে খাজা ইসমাঈল দাস্ত-র পাহাড় রয়েছে। এ পাহাড়গুলো ছোট-ছোট। এই পার্বত্য-ভূমি সবুজ-বিহীন, এখানে পানির অভাব রয়েছে। গাছের দেখা মেলে না। এই পাহাড়গুলো এবড়ো-খেবড়ো এবং কুরূপ। কোনো কাজে আসে না।
দুনিয়ায় এমন দেশ খুব কমই হবে যেখানে এরকম ব্যর্থ পাহাড় শ্রেণি থেকে থাকবে। যা কোনো ভাবে মানুষের জন্য উপযোগী নয়।
কাবুলের জ্বালানি কাঠ
কাবুলে যেসকল এলাকায় প্রচুর তুষারপাত হয়, ওই সকল এলাকায় সৌভাগ্য বশত সেখানকার আশপাশেই খুবই উত্তম প্রকারের জ্বালানি কাঠও পাওয়া যায়। এই কাঠগুলো খনজক, বিসুত, বাদামচা ও কারকন্দের হয়। এগুলোর মধ্যে খনজক কাঠ সবচেয়ে উমদা হয়। এটি আগুনের শিখা হয়ে জ্বলে এবং তার সুগন্ধিও খুব সুন্দর হয়। পুড়ে শেষ হয়ে যাবার পর তার ছাই বহুক্ষণ পর্যন্ত গরম থাকে।
বিলুতও খুব ভালো জ্বালানি কাঠ। এর শিখা তো কম হয়, তবে তা অনেকক্ষণ পর্যন্ত জ্বলে, এর ছাইও বহুক্ষণ যাবৎ গরম থাকে। ছোট জায়গার জন্য এই কাঠ সবচেয়ে উপযোগী বলেই সিদ্ধ হয়, তবে বড় জায়গায় জ্বালানোর জন্য খনজক কাঠই ভালো। বিলুতের সুগন্ধও ভালো হয়। বিলুত গাছের কাঠের একটা বিশেষত্ব বিশেষভাবে আমার নজরে পড়ে তা হলো এর শুকনো ডালে যদি পাতা সমেত আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তা জ্বলার সময়ে আশ্চর্য রকমভাবে নানা রকমের আওয়াজ করে জ্বলতে জ্বলতে উপর থেকে নিচের দিকে আসে। জ্বলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার আওয়াজ বন্ধ হয় না। লোকে এগুলো এভাবেই জ্বালাতে খুব আনন্দ পায়।
এখানে বাদামচা জন্মায়। এর কাঠ খুব মেলে। সাধারণভাবে এর কাঠ জ্বালানি রূপে এবং তুষারপাতের দিনগুলোতে সাধারণত বাড়িঘর গরম রাখার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। তবে তা দ্রুত পুড়ে শেষ হয়ে যায়।
কুরকন্দ কাঠ কাঁটাদার এবং ঘন ঝাড়রূপে পাওয়া যায়। এটি খুব ভালোমতো শুকিয়ে নেওয়ার পর তবে জ্বালানো হয়। এ কাঠ বিশেষ করে গজনী এলাকায় জন্মায়, এ কাঠ গজনীবাসীদের জ্বালানি।
কাবুলে সেচের সাধন
কাবুলের ফল ও কৃষি উৎপাদক এলাকা প্রধানত পার্বত্য এলাকার নিচেই অবস্থিত। এই এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে সেচের জন্য পাহাড় থেকেই পানি পাওয়া যেতে থাকে। পাহাড়ের নিচে পার্বত্য ক্ষেত্র হোক কিংবা সমতল এলাকা, সকল জায়গাতেই ছোট-বড় লোকালয়ের রূপে লোকেরা বসতি গড়ে তুলেছে। প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ি বাঁধের কাজ করে যাওয়া পর্বতগুলোর মধ্যে কিয়িক এবং অহিল-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
এই পাহাড়ি উপত্যকার প্রান্তে বসবাসকারী লোকেরা শীত ও গ্রীষ্মকালের জন্য আলাদা-আলাদা ঠিকানা বানিয়ে রেখেছে। তারা গ্রীষ্মকালে উঁচু স্থানে নির্মিত ঠিকানায় গিয়ে বসবাস করতে থাকে এবং শীতকালে নিচের সমতল এলাকায় এসে যায়। এরা বড় পশম ওয়ালা ভেড়া পালন করে, যা থেকে প্রচুর পরিমাণে পশম পাওয়া যায়, বাজারে যা ভালো দামে বিকোয়।
কিছু পাহাড়ি প্রজাতির মানুষ জন্মগতভাবে সাহসী ও বাহাদুর হয়। এরা চাষবাস বা পশু পালনের উপর নির্ভরশীল না থেকে ঘুরে ঘুরে শিকারি জীবন যাপন করাকেই প্রাধান্য দেয়। কেউ-কেউ শিকারি পাখি ও শিকারি কুকুর পালন করে। শিকারি পাখিদের এরা শিখিয়ে রাখে। তারা তাদের জন্য পালিত হয়ে যায়। পালিত পাখি তার মালিকের ইশারায় আকাশে উড়ে যায় এবং শিকার রূপে তার মালিককে পাখি ধরে এনে দেয়।
এরকম শিকারি প্রজাতির লোকেরা নিজেদের কুকুর ও শিকারি পাখিদের সঙ্গে নিয়ে খুর্দ-কাবুল (ছোট কাবুল) ও সুর্খ-রুদর দিকে শিকারের জন্য বেরিয়ে যায়। ওই এলাকার দুর্গম চরণ-ক্ষেত্রে দলে-দলে বুনো গাধাদের তারা পেয়ে যায়।
গ্রীষ্মকালে কাবুলের সমতল এলাকায় স্থায়ী রূপে বসবাসকারীদের মধ্যে খুব ভিড়-ভাড় হয়ে ওঠে। প্রবাসী পাখি বারান তটে এসে বিচরণ করে। এখানকার সৈকত এ জন্যই পছন্দ যে, এই নদীর আশপাশ, পূর্ব-পশ্চিমে কোথাও পাহাড় নেই। কেবলমাত্র হিন্দুকুশ পর্বতমালার প্রান্ত ভূমিটিই সেখানে রয়েছে। এই এলাকায় না আছে কোনো জনবসতি আর না আছে কোনো চারণ-ক্ষেত্র। অতএব, এখানে আগত প্রবাসী পাখিরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারে। ওই সময় পর্যন্ত তারা সেখানে ডেরা বেঁধে থাকে যতদিন পর্যন্ত না উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করে কিংবা হিন্দুকুশ পাহাড়ে আবার মেঘের গর্জন শোনা যায়। পাখি শিকারিদের জন্য বিস্তৃত ক্ষেত্রে প্রবাহিত বারান নদীর দুই তট প্রবাসী প্রজাতির পাখিদের শিকারের জন্য খুবই আকৃষ্ট করে। শিকারিরা এই দুই তটে মালার্দ প্রজাতির পাখিদের শিকার করতে খুব পছন্দ করে। কেননা তারা খুব বড়-বড় ও স্বাস্থ্যবান হয়। এখানে সারস ও বগুলার মতো বড় পাখিদের দলও ঝাঁকে ঝাঁকে আসে।
পাখি শিকারিদের আকর্ষণীয় ফন্দি
কাবুলের পাখি শিকারিদের পাখি শিকারের ফন্দি-ফিকিরও বেশ আকর্ষণীয়। এরা অনেক দূর পর্যন্ত ছুড়ে দেওয়া তীর ফাঁদ রূপে সুতোয় বেঁধে ব্যবহার করে। নিক্ষিপ্ত তীরের পিছনের অংশে ফাঁদ পাতা সুতোর একটি মুখ বাঁধা থাকে। হাওয়ার অভিমুখ দেখে তীরকে নদীর মধ্য ভাগে নিক্ষেপ করা হয়। মধ্য ধারায় পাখিদের দল সাঁতার দিতে থাকে। তীর ওদের মাঝখানে কোথাও গিয়ে পড়ে। শিকারির উদ্দেশ্য তীর দিয়ে পাখিদের জখম করা নয়, বরং তার পিছনে বাঁধা ফাঁদে ফেলা।
নিক্ষিপ্ত তীর নিজেদের মধ্যে পড়ার আওয়াজ শুনতেই পাখিরা ফুরফুর করে উড়তে শুরু করে, তখনই বেঁধে দেওয়া ফাঁদে তাদের পাখা বা গলা আটকে যায়। পাখি যতই ফরফর করে ততই তারা আটকা পড়ে। ফাঁদের বাঁধন কিছুটা এই রকমের হয় যে, জালে আটকে গিয়ে বেশি নড়াচড়া করলে তাদের বাঁধন আরো কসে যায়।
ফাঁদে আটকা পড়া পাখিরা অসহায় হয়ে পড়ে তখন তাদের ধীরে-ধীরে কিনারায় টেনে আনা হয়। এক-একবার কয়েকটা করে পাখি ফাঁদে পড়ে চলে আসে।
তারপর কিনারে টেনে এনে ফাঁদ ঢিলা করে পাখিদের ধরে নেওয়া হয়।
এ ধরনের শিকার শুধু দিনে নয়; বরং রাতেও হয়। তা সে রাত আলো হোক আর আঁধারি হোক উভয়তেই শিকারিরা তাদের কাজ করে যায়। আঁধার রাত বরং কিছুটা লাভজনক হয়… তাতে পাখিদের বাঁচার রাস্তা কম থাকে, অতএব, তারা অধিক সংখ্যায় ফাঁদে পড়ে যায়।
আমি একদিন রাতে বারান নদীর তটে গিয়ে এরকমের তীর ও ফাঁদ পেতে শিকারের ঢং দেখলাম।
এখানে ক্রীতদাস শিকারিদের শিকারের কাজ বাধ্যতামূলক, তাদের কেবল তাদের মালিকদের সঙ্গে শিকারের কাজে লাগানো হয়। ওই এলাকায় ক্রীতদাসদের বস্তি রয়েছে। দু-তিন হাজার পরিবারের সেখানে বসবাস। ওখানে যারা বসবাস করে তাদের সম্বন্ধে কথিত আছে যে, তাইমুর বেগের মুলতান আক্রমণের সময় তারা মুলতান থেকে পালিয়ে এসে বারান নদীর তটে এসে বসত গড়ে তুলেছিল। পাখি ধরা তাদের বংশগত পেশা।
শিকারি পেশার কিছু লোক তাদের বস্তি থেকে বাইরে গিয়ে ছোট-ছোট পুকুর কেটে ৫-৬ টি পালিত পাখি তাতে ছেড়ে দিয়ে রেখে দেয়। ওই পুকুরগুলোতে সাঁতাররত পাখিদের দেখে প্রবাসী পাখিরাও সেখানে নেমে আসে। তাদের নেমে আসার পর জাল ফেলে তাদের সহজে ধরে ফেলা হয়।
শুধু পেশাদার শিকারিরাই পাখি ধরার কাজ করে না, বারান নদীর বসবাসকারী সকল লোকেরাই পাখি ধরার শখ রাখে। শিকারিদের শিকার করার এই ধারাবাহিকতা বসন্ত ঋতু পর্যন্ত চলতে থাকে।
বারান নদীর তটে বসবাসকারী লোকেরা পাখি শিকারের সাথে সাথে ওই নদীতে মাছ শিকারও করে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই যে, তারা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। মাছ ধরার জন্যও পাখি ধরার যুক্তি অবলম্বন করা হয়, এ যুক্তি সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয়ে থাকে।
যখন প্রবাসী পাখিদের শিকার করার মওসুম না থাকে তখন অবশিষ্ট দিনগুলোতে পেশাদার আজন্ম শিকারিরা, সুতো গিয়ে জাল বোনার কাজে লিপ্ত থাকে। তারা শিকার মওসুমে এতটা কামিয়ে নেয় যে, খালি এবং আগামী মওসুমের প্রস্তুতি পর্যন্তকার দিনগুলো খুব ভালোমতেই গুজরান করে নেয়।
পাখিদের পাখনা সাজানো রঙিন টুপির কাজে লাগানোর জন্য রফতানি হয়। পাখনাওয়ালা টুপি তৈরির কেন্দ্র হলো হিঁদুস্তান। সেখানে গিয়ে পাখনা বেচলে ভালোমতোই ধন মিলে যায়।
বসন্ত মৌসুমে মাছ শিকারের যুক্তি
পাহাড়ি উপজাতিরা বসন্ত মৌসুমে মাছ শিকারের পক্ষে অদ্ভুত যুক্তি দেখায়, যা আমি কাবুলেই দেখেছি।
বসন্ত ঋতু আসা পর্যন্ত কিছু বিশেষ রকমের উদ্ভিদ এতই মোটা হয়ে যায় যে, তারা ‘বুনো গাধার লেজ’ বলে অভিহিত হয়ে গেছে। ওই সময়ে তারা পূর্ণ বিকশিত অবস্থায় পৌছে যায়। তারা ফুল ও বীজ দেওয়া শুরু করে দেয়। লোকেরা এমন উদ্ভিদ বা গাছপালাগুলো ১০-২০ বোঝা করে কেটে নেয়। এ ছাড়া ২০-৩০ বোঝা করে, শায়বাক গাছের ডাল কেটে বাড়ি নিয়ে আসে।
ডালগুলো এক সঙ্গে বেঁধে, তার উপর গাধার লেজওয়ালা ঘাস বিছিয়ে তাকে গাদার রূপ দেয়। এগুলো তখন ছাতার মতো দেখায়। এগুলো আসলে ঘর-ছাওয়ার ছাদ নয়; বরং নদীর পানিতে শিকার করা মাছেদের বিছানা হয়। এগুলো শুকিয়ে আসা নদীর কম গভীরতা বিশিষ্ট এলাকা থেকে কিংবা কর্দমময় ভূমিতে ওই বিছানার সাহায্যে আগে চলে যাওয়া হয়। তারা এমন স্থানে পৌঁছায় যেখানে নদীর পানি শুকিয়ে যায়। মাটি পরিষ্কার হওয়ার পর কঠিন হয়ে যায়। তারা এমন ভূমিতে আঙুল দিয়ে গর্ত করে তাতে পানি ঢেলে দেয়। পানিতে বুদবুদ সৃষ্টি হলেই তারা বুঝতে পারে নিচে মাছ আছে। মাছের অস্তিত্ব টের পেতেই তারা সেখানে গর্ত করে তাদের ধরে নেয়।
এইভাবে ধরা মাছগুলো বড় হয়। পানি শুকিয়ে গেলে কর্দমাক্ত ভূমির নিচে গিয়ে তারা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। নদীতে পানি ভরে গেলে তারা পুনরায় মুক্ত পানিতে জীবন গুজরাতে থাকে।
নদীর নরম ভূমিতে গিয়ে তারা তাদের কবল থেকে বেঁচে থাকে, তবে শিকারিদের হাতে তারা কিছু শিকারও হয়ে যায়।
এই ধরনের মাছ শিকারে গুলবাহার ও পরওয়ান ক্ষেত্রের লোকেরা সিদ্ধহস্ত হয়।
লামঘানাতের লোকেরা শীতের মৌসুমে, মাছ প্রাপ্তির জন্য অদ্ভুত উপায় অবলম্বন করে। এরা ঘরের মধ্যে গভীর গর্ত করে রাখে। গর্ত পর্যন্ত পানিস্রোত পৌঁছানোর ব্যবস্থা রাখে। গর্তের নিচের স্তরে ছোট-বড় মাঝারি আকৃতির পাথর বিছিয়ে দেয়। দেওয়াল পাথর দিয়ে আটকে দেয়। দেওয়াল পাথর দিয়ে ঘেরা থাকায় মাছ সুড়ঙ্গ করে কোনো দিকে যেতে পারে না, তবে নিচে পাথর বিছানোর ফলে তারা পাথরের গর্তের ফাঁকে গিয়ে প্রয়োজনে বিশ্রাম নিতে পারে, তারপর উপরে এসে যায়।
ছোট মাছ পুকুর-রূপী গর্তে পালন করে। শীতকালে প্রয়োজন মতো ত্রিশ-চল্লিশটা করে মাছ সেখান থেকে ধরা হয়। মাছ কতটা বড় হয় বা হয়েছে পালনকারীরা তা ভালোমতোই জানে। প্রয়োজন হলে তারা সব মাছই ধরে নেয়।
বিশ্বস্ত মুকিম ফিরে যাবার জন্য বাবুরের কাছ থেকে অনুমতি নিলেন
আমার কাবুল বিজয়ের কিছু বিশেষ ঘটনার মধ্যে একটি স্মরণীয় ঘটনা আছে-আমার এক বিশ্বস্ত জানবাজ, মুকিম নামক ব্যক্তির আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার অনুমতি নেওয়া। আমার দুঃখ-কষ্টের দিনগুলোতে সব সময় সে আমার সঙ্গে ছিল।
মুকিম এসে আমাকে বলল—
‘আমি কিছুদিনের জন্য আমার বাপ, বড় ভাই ও আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাই…। কাবুলে আমার মন লাগে না।’
‘মন না লাগে তো তোমাকে কান্দাহারের প্রশাসক করে পাঠিয়ে দিই…।’
আমি তার সামনে প্রস্তাব রাখলাম-‘সেখানে তুমি তোমার সব মূল্যবান জিনিসপত্র সঙ্গে করে নিয়ে বসে যেতে পারো।’
তবু সে কাবুল দেশ থেকে চলে যাবার কথার উপর অনড় রইল। আমাকে তার চলে যাবার অনুমতি দিতে হলো।
পরে আমি খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারি যে, আফগান ও কাবুলবাসীদের সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিল না, যেখানে দুনিয়া-জাহানের আরাম-আয়েশ তাকে পেয়ে বসেছিল। সে মির্জাদের মধ্যে, মির্জাদের নগরীতে গিয়ে সুখ-শান্তিতে বাস করতে চাচ্ছিল। সে আমার পুরনো কর্মচারী ছিল। আন্দিজানের দিনগুলোতে সে আমার সাথি ছিল। তাকে যেতে দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আমি এও ভাবছিলাম যে, মুকিম চলে যাবার পর লোকে আমার বিষয়ে ভাববে যে, আমি আমার দুর্দিনের সাথিকে পুরো সুখ-সান্ত্বনা দিতে পারিনি, যার কারণে সে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। লোকেদের মধ্যে এ বার্তাও যাবে যে, আমি আমার পুরাতন সেবককে খুশি রাখতে পারিনি।
তাছাড়া তাকে জোর করে নিজের কাছে রেখে দেওয়াটা না-ইনসাফি ছিল। তার আমার সঙ্গ ছেড়ে যাবার পর আমি অনুভব করছিলাম যে, আমার দুশমনেরা না-জানি কত কথা তৈরি করবে।
একটি তুর্কি প্রবাদের কথা আমার স্মরণে আসছিল—‘দুশমনেরা পিছনে যত ক্ষতি করে, তা তো স্বপ্নেও ভাবা যায় না।’
ফারসি প্রবাদও আমার মনে আসছিল—
‘নগরের দ্বার তো বন্ধ করা যেতে পারে, তবে দুশমনের মুখ কখনো বন্ধ করা যায় না।’
আমার বিশ্বস্ত পুরাতন ভৃত্য মুকিম আমাকে কাবুলের শাহী ও শান্তিপ্রদ দিনগুলোতে কেন ছেড়ে চলে গেল? এ কথা কখনোই আমার বোধগম্য হলো না। মনের সান্ত্বনার জন্য এ কথা ভাবাই যথেষ্ট ছিল যে, এখানকার আবহাওয়া তার পছন্দ হয়নি অথবা তার পরিবার-পরিজনদের জন্য সে কষ্ট পাচ্ছিল।।
পরিবার-পরিজনদের জন্য কষ্টের কথাটিই বেশি মজবুত ছিল।
রাজস্ব উসুলের কথা
কাবুলে শাসন কায়েমের পর আমি রাজস্ব উসুলের জন্য নতুন নিয়ম তৈরি করলাম। কাবুলে আমি সমরখন্দ, কুন্দুজ ও হিসারে বাণিজ্য করতে আসা জাতিগত ঘোড়সওয়ারদের উপরও আনাজের রূপে রাজস্ব উসুলের আদেশ দিয়ে দিলাম।
আনাজ (খাদ্যশস্য) উৎপাদনের জন্য ওই সময়ে কাবুলের অবস্থা অন্য খাদ্যোৎপাদক এলাকাগুলোর তুলনায় অনেক দুর্বল দিল। আগত বণিকেরা রাজস্ব রূপে খাদ্য-শস্যের বস্তা নিজেদের সঙ্গে করে নিয়ে আসতে লাগলেন। এর ফলে কাবুলবাসীদের অনেক স্বস্তি মিলল। কাবুলবাসীরা ‘তলওয়ার’-এর উপর বেশি মনোযোগ দেয়, চাষ-বাসের দিকে কম। এমনিতেই তো ফল এবং অন্যান্য ফসল অধিক হয় তবে খাদ্য-শস্য উৎপাদনের মামলায় তারা সম্পূর্ণরূপে ব্যবসায়ের উপর নির্ভরশীল থাকে। খাদ্য শস্য কিনে নিয়ে আসা খুব সহজ কাজ ছিল না। তবে রাজস্ব রূপে খাদ্য পণ্য গ্রহণ অনেক সহজ ছিল, একে আগতদের দিতেও সুবিধা হতো এবং ঘরে বসে কাবুলের লোকেদের প্রয়োজনের পূর্তিও হতো। আমার এই ব্যবস্থার পর রাজস্ব রূপে প্রথম বর্ষেই ৩০,০০০ ঘোড়ার বোঝার সমান খাদ্যশস্য কাবুল, গজনী ও অন্যান্য ছোট ক্ষেত্র থেকে পাওয়ার গেল।
ওই সময়ে গ্রামে খাদ্য প্রাপ্তির সাধন কাবুলবাসীদের জন্য দুষ্কর ছিল। তারা নিজেরা খাদ্য-শস্যের চাষ করতে পারত না। গিয়ে অন্য দেশ থেকে কিনে আনার উপর নির্ভরশীল ছিল, যা দুষ্কর ছিল। তবে এখন তার প্রাপ্তি সহজ হয়ে গেল।