তৃতীয় অধ্যায় – বাবুরের জীবনবৃত্তান্ত
জহির—উদ—দিন মুহম্মদ বাবুর ফারগানা উপত্যকার আন্দিজান নামক স্থানে ১৪৮৩ ঈসায়ী সনের ১৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ফারগানা উপত্যকা বর্তমানে উজবেকিস্তানে অবস্থিত। তিনি ফারগানা উপত্যকার শাসক উমর শেখ মির্জার জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল কুতলক নিগার খানম, যিনি মোগলিস্ত ানের শাসক ইউনুস খাঁ-র কন্যা ছিলেন।
বাবুর বরলাস জাতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন, যারা মূলত মঙ্গোল ছিলেন। তাঁর পূর্ব পুরুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তুর্কি ও ইরানি সভ্যতাকে অবলম্বন করেছিলেন। তাঁরা তুর্কিস্তান ও খোরাসানে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন।
বাবুর নিজেকে মঙ্গোল বা মোগল বলে অভিহিত করেছেন। তুর্কি ও মঙ্গোল রক্তের মিশ্রণ হওয়ার কারণে চলমান সময়ে তিনি দুই জাতিরই সাহায্য লাভ করেন। তিনি সৌভাগ্যবশত ঐ সময়ে ইরানিদের সাহায্য লাভেও সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর সেনাবাহিনীতে এই তিন জাতিরই বীর সৈনিকেরা ছিলেন। মধ্য এশিয়ার বিজয় অভিযানে বেরুনোর সময়ে তাঁর বাহিনীতে পাখতুন, আরব, বরলাস, ও চুগতাই সৈনিকদের বিশাল একটি সংখ্যা সম্মিলিত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর সামরিক বাহিনীতে ‘কিজিলবাস’ নামক বীর যোদ্ধাদের একটি দল ছিল যাদের আজারবাইজানের শিয়া—সুন্নি বলে অভিহিত করা হতো। পরবর্তীকালে মোগল দরবারে আজারবাইজানের এই শিয়া যোদ্ধাদের বংশধররা গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করেন এবং তাঁরা প্রভাবশালী জোট রূপে সময় সময় সামনে আসতে থাকেন।
বাবুরের সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি শারীরিকভাবে অত্যন্ত বলশালী পুরুষ ছিলেন। তিনি দু’জন লোককে ডান ও বাম কাঁধে বসিয়ে খাড়া দেওয়ালে চড়ে দৌড় লাগাতেন। শরীরকে শক্ত—পোক্ত রাখার জন্য এই দিনচর্যাকে তিনি কসরত রূপে গ্রহণ করতেন।
বাবুরের সম্পর্কে একথাও প্রচলিত আছে যে, তিনি একজন দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। তিনি ক্ষুদ্র—বৃহৎ বিভিন্ন নদী সাঁতরে এপার—ওপার করতেন। এ কথাও প্রচলিত আছে যে, উত্তর ভারতের সুবিখ্যাত গঙ্গা নদীও তিনি দু’বার সাঁতরে পার হয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন। তাঁর প্রথম বিয়ে আয়েশা সুলতানা বেগমের সঙ্গে হয়েছিল। পরে তাঁর পত্নীদের সংখ্যার বিশেষ উন্নতি হয়।
প্রথম দিকে বাবুর সংকীর্ণচেতা সুন্নি মুসলমান ছিলেন। তবে পরে শিয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে নৈকট্য বাড়ানোর পর শিয়া বীর যোদ্ধারা তাঁর কাছে নিবেদিতপ্রাণ বলে প্রমাণিত হন। তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল একটি মহান এবং বিশাল সাম্রাজ্য লাভের প্রতি। অতএব ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে তিনি দূরে সরে যান। তাঁর ধর্মীয় সংকীর্ণতা ত্যাগ করতে দেখে তাঁর এক চাচা তাঁকে ‘দুরাকাঙ্ক্ষী মানুষ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর বাহিনীতে দাড়িবিহীন যুবা সৈনিকদের বড় একটি দল ছিল।
তিনি শরাব সেবনে অভ্যস্ত ছিলেন। তবে তিনি তাঁর মৃত্যুর দু’বছর আগে শরাব থেকে পুরো তওবা করে নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর দরবারিদেরও এমনটি করতে বলেছিলেন। শরাব সেবন না করার কসম তিনি যুদ্ধে জয়লাভ ও সৈনিকদের উৎসাহ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে করেছিলেন, যাতে তিনি সফল হয়েছিলেন।
বাবুরের সামরিক জীবন
১৪৯৪ ঈসায়ী সনে বাবুর তাঁর পিতার রেখে যাওয়া ফারগানা রাজ্যের শাসন ক্ষমতা লাভ করেন। ঐ সময়ে তাঁর বয়স ছিল মাত্র বারো বছর। তবে তাঁর চাচা কিছুদিন পরেই অত্যন্ত নির্দয়ভাবে ফারগানার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে তাঁকে নির্বাসিত জীবন যাপনে বাধ্য করেন। ফারগানা ছাড়ার পর তিনি অনেক দিন যাবৎ খানাবদোশ—এর মতো পথে পথে জীবন কাটাতে থাকেন। তাঁকে নিঃসন্দেহে ফারগানা রাজ্য থেকে বঞ্চিত করে খানাবদোশের জীবন—যাপনে বাধ্য করা হয়েছিল, তবে তাঁর পিতার আমলের বিশ্বস্ত ব্যক্তি ও কৃষকদের থেকে তিনি গোপনে সাহায্য—সহযোগিতা লাভ করতে থাকেন।
পিতার আমলের বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সহযোগিতার ১৪৯৭ ঈসায়ী সনে সৈনিক শক্তি জটিয়ে তিনি সমরখন্দের উজবেক নগরে আক্রমণ চালান। আক্রমণের সাত মাস পর তিনি সমরখন্দ বিজয়ে সফল হলেন। সমরখন্দ জয়ের পর তিনি ফারগানা অভিমুখে সসৈন্যে রওনা হয়ে যান। তবে ঐ সময়ে এটা তাঁর দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, যখন তিনি ফারগানা থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে ছিলেন তখনই তাঁর বিশ্বস্তরা তাঁর নজর এড়িয়ে রাতারাতি তাঁকে ছেড়ে চলে যান। ঐ সময়ে বাবুরের সেনাদল সমরখন্দের মরুভূমিতে আটকা পড়ে গিয়েছিল। বিশ্বস্ত দের অকস্মাৎ সঙ্গ ত্যাগ করার ফলে ফারগানা পুনরাধিকার করার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নমাত্রই রয়ে গেল না, বিজিত সমরখন্দও তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেল।
১৫০১ ঈসায়ী সনে তিনি আবারও সমরখন্দে আক্রমণ চালালেন। তবে তাঁর চির পরিচিত প্রতিদ্বন্দ্বী উজবেক শাসক মুহম্মদ শায়বানির কাছে তাঁকে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হলো। ঐ পরাজয়ের পর বাবুরের কাছে খুব কম সংখ্যক সৈনিক মাত্র বেঁচে ছিলেন। তবে যে অল্পসংখ্যক সৈনিক বেঁচে—বর্তে ছিলেন তাঁরা ছিলেন সন্দেহাতীতভাবে প্রভুভক্ত। তিনি তাঁদের সঙ্গে তিন বছর ধরে এদিক—ওদিক চলতে—চলতে তাজিক ও বাদাখশানের অধিবাসীদের নিজের বাহিনীতে ভর্তি করাতে সমর্থ হলেন। ১৫০৪ ঈসায়ী সনে বাবুর এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী সঙ্গে নিয়ে হিন্দুকুশ পবর্তমালা অতিক্রম করেন। তিনি কাবুল আক্রমণ করে তা বিজয়ে সমর্থ হলেন। তারপর কান্দাহার বিজয়েও তিনি সাফল্য পেলেন। কাবুল ও কান্দাহার বিজেতা রূপে বাবুর এক নতুন ও শক্তিশালী হুকুমতের মালিক হলেন। তিনি ১৫০৬ ঈসায়ীতে হেরাতের শাসক হুসাইন বাইকারার সঙ্গে মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করলেন। হুসাইন বাইকারা মুহম্মদ শায়বানির বিরোধী ছিলেন। তাঁর প্রতি মৈত্রীর হাত বাবুর মুহম্মদ শায়বানিকে হারানোর উদ্দেশ্যে বাড়িয়েছিলেন। তবে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনের কিছু কাল পরেই ১৫০৬ ঈসায়ীতেই বাইকারা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর হেরাত বাবুরের পূর্ণ অধিকারে এসে গেল। তবে, হেরাতের শাসক হওয়ার চেয়ে বাবুর মুহম্মদ শায়বানির উপর বিজয় লাভকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন।
হেরাতের ক্ষমতা পূর্ণরূপে হস্তগত হয়ে যাবার পর তিনি শায়বানির বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই খবর এল যে, কাবুলে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ হেরাত থেকে কাবুল গিয়ে পৌঁছালেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিদ্রোহ দমন হয়ে গেল।
দু’বছরের মধ্যেই তাঁর কিছু উচ্চপদস্থ সেনাবর্গ আরো একবার বিদ্রোহ করলেন, তা দমনেও তিনি সফল হলেন।
তবে ঐ সবের মধ্যে ব্যতিব্যস্ত থাকার কারণে উজবেক শাসক শায়বানিকে সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে পরাজিত করার স্বপ্ন বাবুরের থেকে চার বছর দূরে চলে গেল।
১৫১০ ঈসায়ী সনে পারস্যের শাসক শাহ ইসমাঈল শায়বানির উপর আক্রমণ চালিয়ে তাঁকে শুধু পরাজিতই করলেন না; বরং তাঁকে হত্যা করলেন। বাবুর পারস্যের শাসকের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেন। এই বন্ধুত্বের বলে তিনি তাঁর পূর্ব পুরুষদের ভূমি তাইমুরি সাম্রাজ্য পুনরাধিকার করতে চাচ্ছিলেন। শাহ ইসমাঈল শুধুমাত্র বাবুরের বন্ধুত্বই স্বীকার করলেন না; বরং নিজের বোনকে তিনি বাবুরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মৈত্রীর বন্ধনকে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করিয়ে নিলেন। এই বিবাহের সাথে সাথে বাবুর উপহারস্বরূপ একটি বড় দৌলত, আয়েশ—আরামের জন্য সাজ—সজ্জা ও সামরিক সাহায্য লাভ করলেন।
শাহ ইসমাঈলের প্রতি কৃতজ্ঞতা বশত বাবুর শিয়া মুসলিমদের রীতি রেওয়াজকে গ্রহণ করে নিলেন। এরপর বিপুল সামরিক শক্তি সহকারে তিনি বুখারা অভিমুখে রওনা হয়ে গেলেন। উল্লেখ্য যে, পথিমধ্যে শহর, নগর, গ্রাম—গঞ্জগুলোতে তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হলো। এবার বাবুরের বিজয় অভিযান এগিয়ে চলল।
সমরখন্দে তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হলো। ওই অভ্যর্থনাকে বাবুর ‘আল্লাহর উপহার’ নামে আখ্যায়িত করলেন। ওই সময়ে বাবুরের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এতই উচ্চে উঠে গিয়েছিল যে, ফারগানা বিজয়কে তাঁর কাছে বড় তুচ্ছ মনে হতে লাগল। তিনি তাঁর দৃষ্টি ভারতের প্রতি নিবদ্ধ করলেন।
ওই সময়ে ভারতে সৈয়দ বংশের শাসন কায়েম ছিল। বাবুর মনে করতেন যে, তিনি স্বয়ং ভারতের উপর শাসনকার্য চালানোর প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তিনি তাইমুরের বংশধর ছিলেন। তাইমুর পঞ্জাব জয় করেছিলেন। তাইমুর তাঁর দাস খিজির খাঁ-র হাতে সেখানকার শাসনভার ন্যস্ত করে গিয়েছিলেন। খিজির খাঁ দিল্লির সুলতান হয়ে সৈয়দ বংশের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইব্রাহীম লোদি সৈয়দ বংশের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। ইব্রাহীম লোদি ছিলেন গিজলাই আফগান। বাবুরের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেড়েই চলেছিল এ জন্য যে, তিনি নিজে ছিলেন তাইমুর লঙ্গের বংশধর, তিনি তাঁর বিজিত ভূখণ্ডের শাসক হবেন।
বাবুরের ভাগ্য তাঁর সহায় হলো। কথিত আছে, ইব্রাহীম লোদির কুলীন আফগান, যারা তাঁর অভিভাবক ছিলেন, তাঁর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে খুব ঘৃণার চোখে দেখতেন, তাঁরা ইব্রাহীম লোদির উপর আক্রমণ চালানোর জন্য বাবুরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
১৫২৬ ঈসায়ী সনের ফেব্রুয়ারি মাসে ১২,০০০ সুদক্ষ সৈন্য নিয়ে বাবুর ভারত আক্রমণের জন্য পানিপথের প্রান্তরে এসে অবস্থান নিলেন। ওই সময়ে তাঁর পুত্র হুমায়ূনও যুদ্ধক্ষেত্রে বাবুরের সঙ্গে ছিলেন। ঐ সময়ে হুমায়ূনের বয়স ছিল ১৭ বছর।
পানিপথের যুদ্ধে বাবুর জয়লাভ করলেন। এই বিজয়ের সঙ্গে—সঙ্গেই তিনি ভারতের প্রথম মোগল সম্রাট বলে অভিহিত হওয়ার অধিকার লাভ করলেন এবং ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রূপে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে গেলেন।
বাবুরের জীবন—পরিচয় ও সামরিক জীবনের এই সংক্ষিপ্ত জানকারির পর এবার তাঁর দ্বারা তাঁর মাতৃভাষা চুগতাই তুর্কি ভাষায় লিখিত ‘তুজুক—ই—বাবুরী’ যা তাঁর পৌত্র জালালউদ্দীন মুহম্মদ আকবরের নির্দেশে খান—ই—খানান আবদুর রহিম কর্তৃক ফার্সি ভাষায় অনূদিত ‘বাবরনামা’র প্রতি অগ্রসর হচ্ছি। যেমনটি আগেই বলা হয়েছে ‘বাবরনামা’ বাবুরের নিজের লেখা ঐতিহাসিক রচনা। একে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কয়েকখানি গুরুত্বপূর্ণ রচনার অন্যতম বলে গণ্য করা হয়।