চতুর্দশ অধ্যায় – বাবুরের মা ও হুসাইন বাইকারার মৃত্যু
কাবুল প্রত্যাবর্তনের পর কাবুল ও কান্দাহারের প্রশাসনকে মজবুত করার জন্য আমি সবার আগে পাহাড়ি উপজাতি সেই আফগানদের বিদ্রোহ দমনের পর তাদের সরদারদের উচ্চ পদমর্যাদা প্রদান করে আমি আমার প্রতি তাদের বিশ্বস্ততা হাসিল করলাম। আমার কাবুলের শাসনকার্য ঠিকমতো সামলানোর জন্য আফগানদেরও নিজের প্রতি বিশ্বস্ত করে তোলার প্রয়োজন ছিল, যেমনটি বেগ ও তুর্কি সৈনিকেরা আমার প্রতি বিশ্বস্ত ছিল।
আমি আফগান যুবকদের আমার বাহিনীতে ব্যাপক সংখ্যায় ভর্তি করলাম। ভর্তিতে এই কথাই বিশেষভাবে মনে রাখলাম যে, যারা ঐতিহ্যগতভাবে লড়াকু প্রকৃতির এবং উপজাতির লোক তাদের প্রাধান্য দেওয়া হোক।
কাবুল-কান্দাহারের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় করে নেওয়ার জন্য দুটিই সুখ-সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ রাজ্য বনে গেল।
কাবুল ধনী ও সমৃদ্ধিশালী দেশগুলোর অন্যতম বলে গণ্য হতে লাগল।
আমার দৃষ্টি তখনও মধ্য এশিয়ার প্রতি নিবদ্ধ ছিল। আমি আমার পূর্ব পুরষদের রাজ্যের দিক থেকে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারি না।
আমি শুধু কাবুল ও কান্দাহারের শাসক হিসেবে তার উপর সন্তুষ্ট থাকতে পারি না।
আমি ওই সকল লোকেদের কীভাবে ভুলতে পারতাম যারা আমার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আমাকে দোরে দোরে আঘাত খেয়ে খেয়ে বেড়াতে বাধ্য করেছে! আমি সমরখন্দকেও ভুলতে পারতাম না। আর না চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শায়বানি খানকে। আমি হেরাতের শাসক হুসাইন বাইকারার প্রতি মিত্রতায় হাত বাড়ালাম। তারপর তাইমুর বংশীয় আপনজনদের সঙ্গেও মধুর সম্পর্ক স্থাপন করলাম।
এ সবের পিছনে আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল মুহম্মদ শায়বানি। তার কথা আমি ভুলতে পারছিলাম না। দিন-রাত আমার একটাই স্বপ্ন ছিল যে, আমি শায়বানীকে হারিয়ে সমরখন্দ আবার ফিরে পাব, আমার পরাজয়কে আমি বিজয়ে পরিণত করব। আমার কাবুল প্রত্যাবর্তনের কিছুদিন পর আমার মা রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। আমি তখন মাতৃশোক সামলে উঠতে পারিনি, তখনই খবর এল যে, ১৫০৬ ঈসায়ী সনে হুসাইন বাইকারার আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে।
হুসাইন বাইকারার মৃত্যুসংবাদ আমি তখনই পেলাম যখন আমি আমার বিশাল বাহিনী নিয়ে মধ্য এশিয়া বিজয়াভিযানের জন্য রওনা হয়েছিলাম।
আমার বাহিনীর অভিমুখ হেরাতের দিকেই ছিল। আমার ও হুসাইন বাইকারার মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, আমার এবং তার বাহিনীর যৌথ অভিযান শায়বানির বিরুদ্ধে চলবে। তবে হুসাইন বাইকারার অকালমৃত্যু কিছুক্ষণের জন্য আমাকে নিরাশার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল।
আমার পিছে-পিছে আমার সেনাও হেরাতে এসে প্রবেশ করল।
যেহেতু হুসাইন বাইকারার আকস্মিক মৃত্যু ঘটেছিল, যেহেতু হেরাতের জন্য তিনি তাঁর কোনো উত্তরাধিকার ঘোষণা করে যেতে পারেননি।
আমি হেরাতকে দুশমনদের রক্তপাতের মধ্যে চলে যেতে দিতে কখনোই পারতাম না। অতএব, নিজেকে হেরাতের শাসক ঘোষণা করে সেখানকার পুরো শাসনভার হাতে তুলে নিলাম। আমি আমার মিত্র হুসাইন বাইকারার অন্তিম সৎকার করলাম।
আমি সেনাবাহিনীর একটি দলকে নাসির মির্জার নেতৃত্বে বাদাখশান অভিমুখে রওনা করিয়ে দিলাম। পথে শায়বানির সেনাদলের সঙ্গে তার একটি বড় লড়াই হলো। ওই লড়াইয়ে শায়বানির সৈন্যদের পরাজয়ের মুখে পড়তে হলো। একথায় আমি খুবই সান্ত্বনা পেলাম যে, শায়বানিকে পরাজয়ের কথা শুনতে হয়েছে।
তারপর আমি জাহাঙ্গীর মির্জার হাতে হেরাতের শাসনভার অর্পণ করি। নিজে খোরাসানের মির্জাদের একত্রিত করার কাজে নেমে পড়লাম। আমার প্রয়াস সফল হতে শুরু করেছিল। আমি ওই সময় তুখান হাজারায় মির্জাদের সঙ্গে একটি বড় দাওয়াতে শামিল ছিলাম, তখন আমি কাবুলে বিদ্রোহের খবর পেলাম।
কষ্টদায়ক ঠান্ডার দিন ছিল। আমি তুষারাবৃত উপত্যকার রাস্তা ধরলাম। অতি দ্রুত কাবুলে পৌঁছে বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমন করলাম। আর বিদ্রোহের ষড়ন্ত্রকারীদের কঠোর সাজা দিলাম।
এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন আমার সামাজ্যকে ঘিরে ফেলেছিল। গজনী ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ল এবং তার ফলস্বরূপ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হলো তো অন্যদিকে কান্দাহারকে ভূমিকম্পে কাঁপতে হলো। ভূমিকম্প হাজার-হাজার মানব-জীবনকে গ্রাস করে নিল।
গজনী ও কান্দাহার তো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, এই সময়টিতে আমি চেয়েও দু’জায়গায় গিয়ে তাদের দুঃখ-কষ্টের অংশীদার হতে পারলাম না। কারণ ছিল, আমি নিজে এই সময়ে বড়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।
ভূ-কম্প পীড়িত কান্দাহার সম্পূর্ণভাবে অব্যবস্থিত হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তবে নিজের অসুস্থতার কারণে আমি ওদিকে যেতে অপারগ ছিলাম।
গজনীর কিছু আফগান বিদ্রোহী গাধাদের জন্য চারণক্ষেত্রের প্রশ্ন তুলে গজনীতে আমার দ্বারা নিয়োজিত প্রশাসককে সম্পূর্ণরূপে নাস্তানাবুদ করে তুলল। তারা এই বলে ধমকানি দিল যে, যদি তাদের গাধাদের জন্য তৃণভূমির স্বাধীনতা দেওয়া না হয় তাহলে তারা খোরাসানের দিকে চলে যাবে এবং শায়বানির সাহায্য নিতেও পিছপা হবে না।
এই সময়ে শায়বানি তার বাহিনীর পরাজয় নিয়ে সম্পূর্ণভাবে খিজলে ছিলেন।
গজনীয় আফগান বিদ্রোহীরা শুধুমাত্র হুমকি দিয়েছিল, আসলে তারা শায়বানিকে গজনী আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিল। তবে শায়বানি গজনীর লালসায় না ফেঁসে মধ্য এশিয়াতেই সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন এবং হেরাত আক্রমণ করেন।
হেরাতে জাহাঙ্গীর মির্জা শায়বানির আক্রমণকে রুখতে পারেনি। সে শায়বানির হাতে নিহত হলো। শায়বানি হেরাতের বাইকুরা-বংশীয় ওই দুই পুরষকেরও হত্যা করল, যারা হেরাতের শাসন ক্ষমতার দাবিদার হতে পারত।
হেরাতের শায়বানির অধিকারে চলে যাওয়ার খবর আমি যেভাবে পাই তা-ও আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। হয়েছিল কি, হেরাত থেকে সওদাগরদের একটি কাফেলা হিঁদুস্তানের দিকে যাচ্ছিল। ওই কাফেলা জাহাঙ্গীর মির্জার বিধবা এবং তার অবোধ শিশুকে খুবই দুরবস্থার মধ্যে রাস্তায় দেখেছিল। ওই কাফেলার লোকেরা আমার কাছ পর্যন্ত খবরটি পৌঁছে দিয়েছিল।
আমি আমার অসুস্থতা ভুলে, সেনা নিয়ে কাবুল থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আমি তখন কাবুল ত্যাগ করতেও পারিনি, এমন সময় খবর এল শায়বানি খান কান্দাহার দুর্গ অধিকারের জন্য সসৈন্যে এগিয়ে আসছেন। ওদিকে হেরাত থেকে আমার কাছে খবর এল যে, বাইকুরা ভাইদের অকারণে হত্যা করার ক্ষোভে তার বংশীয়রা আলাদা-আলাদা এলাকা থেকে প্রতিশোধের জন্য শায়বানির দিকে ধেয়ে আসছে।
তিনি (শায়বানি), দু’দিক থেকে অবরুদ্ধ হতে পারেন, সেদিকে দৃষ্টি রেখে শায়বানি কান্দাহার থেকে দিক বদল করলেন।
তবে তাঁর পশ্চাদ ভাগের সৈন্যরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এটা হওয়াতে শায়বানির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো। তবে তাঁর অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে আমার হাত থেকে বেঁচে পালিয়ে যেতে সমর্থ হলেন।
আমার মনে আরো একবার শায়বানির সঙ্গে সামনা-সামনি লড়াইয়ের সাধ রয়ে গেল। তার কাছে পরাজয়ের যন্ত্রণা আমি ভুলতে পারিনি। আমার সংকল্প ছিল তার সঙ্গে ময়দানি যুদ্ধে সামনা-সামনি অস্ত্রের মোকাবিলা করা। এ থেকেই শেষ ফায়সালা হয়ে যাক যে, সে বড় যোদ্ধা, না আমি।
এই শেষ ফয়সালায় এ-ও নির্দিষ্ট ছিল যে, তারপর দুনিয়ায় দুজনের মধ্যে একজনকেই বেঁচে থাকতে হবে।
আমি কান্দাহারে প্রবেশ করলাম।
কান্দাহার কেল্লায় পৌঁছে আমি দেখলাম যে, প্রধান রক্ষক শাহ বেগ, না ওখানে ছিল আর না মুকিমও। শাহ বেগের বিষয়ে খবর নিয়ে জানলাম, সে সেনাদল নিয়ে শাল ও কোয়েটার দিকে গিয়েছে। সেখানকার জন্য জামিনদাওয়ারে অবস্থানের জন্য পাঠানো হয়েছে।
ওখানকার কেল্লা রক্ষার ভার তরখানদের দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। হাতে তুলে নেওয়া দায়িত্ব তরখানরা পুরো সাহসিকতার সঙ্গে পালন করার জন্য কেল্লায় চারদিকে অবস্থান নিয়েছিল। তাদের সাহসিকতা ও বিশ্বস্ততা প্রশংসার যোগ্য ছিল।
আমার নগরে প্রবেশ করা মাত্রই মশকর দরওয়াজা খুলে দেওয়া হলো। তার দরওয়াজায় তঘাল ও শোরিম বেগ নিযুক্ত ছিল। সেখানকার সুরক্ষা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম যে, শায়বানি এখানে ঢুকলে তাকে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে, তবেই তিনি কান্দাহার কেল্লা কবজা করতে সফল হতে পারেন।
আমি কান্দাহার কেল্লার রাজকোষের খোঁজ-খবর নিলাম। কোষাগার থেকে ধনের এক বড় অংশ বের করিয়ে আমি ওই সমস্ত বিশ্বস্তদের বণ্টন করতে শুরু করলাম যাদের আমি কেল্লা রক্ষার জন্য সদা-সতর্ক পেয়েছিলাম। বিশ্বস্তদের ইনাম দিয়ে তাদের সম্মানিত করা আমার জন্য অবশ্যবর্তব্য ছিল। আমি আবদুর রজ্জাক মির্জা, দোস্ত নাসির বেগ, মুহম্মদ বখশী, খাজা মুহম্মদ ও তগাই শাহ বখশীকে ইনাম পাওয়ার উপযুক্ত রূপে পেয়েছিলাম।
ওই দিন রাতে আমি কান্দাহার কেল্লায় অবস্থান করলাম। পরদিন ফররুখজাদ বেগের ছাউনির দিকে গেলাম, যা চারবাগে অবস্থিত ছিল। সেখানকার সৈন্যদের তদন্ত করে উৎসাহিত করলাম।
কান্দাহার থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে আমি নাসির বেগকে সেখানকার শাসক নিযুক্ত করলাম। রওনার আগে আমি ফায়সালা করে নিয়েছিলাম যে, কান্দাহার কেল্লায় প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন-সম্পদ রয়েছে। প্রয়োজনমতো কোষ সেখানে রেখে অবশিষ্টটি উটের পিঠে চাপিয়ে আমি কাবুলের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেলাম। কাবুল পৌঁছানোর পর কান্দাহার থেকে নিয়ে আসা কোষকে উটের পিঠ থেকে নামানো হলো। সেগুলোকে বড় বড় থলিতে ভরে আনা হয়েছিল। থলি থেকে নামালে দেখা গেল মুদ্রার পাহাড় জমে উঠেছে। সেগুলোকে গুনে শেষ করা অসম্ভব ছিল। আমি তাদের ওজন করিয়ে কাবুলের কোষে জমা করে দেওয়ার আদেশ দিলাম।
বাবুরের মাসুমা সুলতানার সঙ্গে বিবাহ
কাবুল প্রত্যাবর্তনের পর আমি আহমদ মির্জার কন্যা মাসুমা সুলতান বেগমের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলাম। খুরাসানেই আমি মাসুমা সুলতানার কাছ থেকে সম্মতি নিয়ে নিয়েছিলাম। মাসুমা সুলতানকে নিয়ে আমার জন্য খুরাসানে আমি সওয়ারি পাঠাই এবং কাবুলে আসার পর আমি তাকে বিয়ে করি।
বিয়ের কিছুদিন পর আমি খবর পাই যে, সায়ক খান ও অন্য কিছু উজবেক সরদার আমার সেবায় আসতে চাইছে। তারা নাসির মির্জার মাধ্যমে আমার কাছে এই বার্তা পাঠিয়েছিল। আমার জন্য এটা সুসংবাদ ছিল। এতদিন পর্যন্ত উজবেকদের পুরো সমর্থন শায়বানির পক্ষেই ছিল। শায়বানি উজবেক সরদারদের ঐক্যবদ্ধভাবে পেয়ে শক্তিশালী শাসক বনে গিয়েছিলেন। তাদেরই শক্তিতে তিনি সমরখন্দ জয় করতে পেরেছিলেন। যদি উজবেক সরদারদের ঐক্যে ভাঙন ধরে তাহলে শায়বানির শক্তি খুবই দুর্বল হয়ে যেতে পারত। আমি উজবেক সরদারদের পক্ষ থেকে আগত বার্তায় মনোযোগ দিলাম। আমি তাদের সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানালাম।
তারা আমর সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। আমার প্রতি নিষ্ঠা স্বীকার করল। আমি তাদের এদের হিসাব থেকে কিছুটা বাড়িয়ে চড়িয়ে বাদাখশানের কিছু এলাকার আলাদা-আলাদা প্রশাসন তাদের দায়িত্বে তুলে দিলাম।
এখনও পর্যন্ত তারা শুধু নিজ-নিজ গোত্রের সরদারের পদমর্যাদা রাখত। আমার পক্ষ থেকে তদের বিভিন্ন এলাকার প্রশাসক বা সুবেদারি প্রদান করা, তাদের জন্য খুব বড় প্রাপ্তি ছিল। তাদের মর্যাদা বেড়ে গিয়েছিল, সেই সঙ্গে মান-সম্মানও।
তারপর, আমি সম্পূর্ণরূপে আশ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে, উজবেকদের ঐক্যজোট শায়বানির পক্ষ থেকে খান-খান হয়ে যাবে। তাইমুর এবং চেঙ্গিসের শাসনকালে উজবেকদের আনুগত্য তাঁদের পক্ষে ছিল।
কিছুদিন পর আমি কলাত এবং তুর্মিক রাজ্য দুটি জয়লাভ করে সেখানকার সুবেদারি আবদুর রজ্জাক মির্জার হাতে তুলে দিলাম। যতদূর পর্যন্ত বাদাখশানের কথা ছিল, বাদাখশানে ওই সময় পর্যন্ত কোনো শাসক বা উত্তরাধিকারী ছিল না। অবশ্য, এর পুরো এলাকা মির্জা বহুল তথা মির্জাদের ছিল। শাহ বেগমের নামে সেখানে হুকুমতও চলত।[১]
[১. শাহ বেগমের বাদাখশান শাসনের বিষয়ে ঐতিহাসিক মুহম্মদ হায়দার লিখেছেন-শাহ বেগমের বংশধররা তিন হাজার বছর ধরে বাদাখশান শাসন করে এসেছিলেন। বাবুরের শাসনামলে শাহ বেগম ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, এক মহিলা হওয়ার ফলে বাদাখশানের শাসন ঠিকমতো চালাতে পারছেন না। অতএব, তাঁর পৌত্র মির্জা খানকে সেখানকার শাসক নিযুক্ত করা হোক। উপর্যুক্ত বিবরণ থেকে এই উপসংহারে আসা যায় যে, বাদাখশানে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থায় ছিল। শাহ বেগমের নামে সেখানে শাসন চলত; তবে সেখানকার সুরক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্ব বাবুর নিজ হাতে রেখেছিলেন। তিনিও মির্জা বংশীয় ছিলেন এ জন্য এই দায়িত্ব পালন তার কর্তব্য ছিল। মির্জাদের মধ্য শাহ বেগমের সম্মান কিছুটা এরকম ছিল যে, তার শাসনকে বাবুরের মতো মানুষও নিজের শাসন বলার দাবি করতে পারতেন না।—অনুবাদক]
আমার খালা মেহের নিগার খানম, যিনি আমার সঙ্গে কাবুলে থাকতেন, তিনি তাঁর বোন (বাবুরের মা)-এর মৃত্যুর কিছুকাল পর বাদাখশানে গিয়ে বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমি তাতে সানন্দে অনুমতি দিয়ে দিয়েছিলাম। বাদাখশানে গিয়ে বসবাসের কোনো অসুবিধাই তাঁর ছিল না, কেননা, তিনিও মির্জা ঘরানার ছিলেন। মির্জাদের যে কারোর জন্য বাদাখশানের দ্বার সব সময় উন্মুক্ত ছিল।
হিঁদুস্তানের উদ্দেশে বাবুরের দ্বিতীয় অভিযানের প্রয়াস
হিঁদুস্তান অভিযানের দ্বিতীয় প্রয়াসে আমার সেনাবাহিনী কাবুল থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। এটা ছিল জমাদিউল আউয়াল মাস (সেপ্টেম্বর, ১৫০৭)। সড়ক পথে সুখ-রবাত হয়ে আমরা কুরসাল পৌঁছে গিয়েছিলাম।
কাবুল ও লামঘানের মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাসকারী উপজাতির লোকেরা তখনও পর্যন্ত স্ব-শাসন ভোগ করত। তারা ছোট-ছোট গোত্রে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক গোত্রের একজন করে মুখিয়া থাকত। তারা পরস্পরে সেখান পর্যন্তকার এলাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিত যেখান পর্যন্ত তারা নিজেদের শাসনাধীন বলে মনে করতেন। আমাদের সেনা যেইমাত্র লামঘান ক্ষেত্রে দাখিল হলো অমনি উত্তর পাহাড়ি ক্ষেত্রের তার পাহাড়ি গোত্রের তীরন্দাজ লড়াকুরা এসে অবস্থান নিল।
তাদের ক্ষেত্রেগুলোর নাম ছিল খিজির খায়েল, শিমু খায়েল, খিরিলচ এবং খুঘলানী। তারা অগ্রবর্তী সেনার পথ রোধ করেছিল। তারা নাকাড়া বাজিয়ে দূর-দূরান্তের লোকেদের সেখানে এসে জড়ো হওয়ার বার্তা দিচ্ছিল। কিছু লোকের হাতে তলোয়ার চমকাচ্ছিল। তীর-ধনুক নিয়ে তাদের মুখিয়াদের আদেশের অপেক্ষা করছিল। তারা পাহাড়ি উপত্যকার প্রত্যেকটি উঁচু পাথরের উপর মোতায়েন ছিল।
তখনও পর্যন্ত ওদের দিক থেকে একটি তীরও আমাদের সৈনিকদের উপর নিক্ষিপ্ত হয়নি।
আমি সেনাকে তাদের উপর আক্রমণের আদেশ দিলাম। আদেশ পেতেই সৈনিকেরা তাদের ধাওয়া করল।
আমি নিজে তাড়া করে এক তীর ধনুকধারীকে ধরে তাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম। তার গলায় তলোয়ায়ের নোক ধরলাম। সে মৃত্যু ভয়ে ছটফট করতে লাগল।
সৈনিকদের হামলায় গোত্রগুলোর মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। কিছু তীরন্দাজকে ধরে ফেলা হলো। সৈনিকেরা তাদের মুণ্ডু উড়িয়ে দিল। কিছুকে বন্দী করে আনা হলো। আমি তাদেরও মুণ্ডু উড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দিলাম। তাদের এই সাজায় প্রয়োজন ছিল। যাতে ভবিষ্যতে মৃত্যুভয় তাদের বংশধরদের বিদ্রোহী হওয়া থেকে বিরত রাখে।
আমি সৈনিকদের আদেশ দিলাম দূর-দূরান্ত পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকার ওই উপজাতিদের খালি করে দেওয়া হোক। এটা জরুরি ছিল, কেননা, ওই পথ দিয়ে যাতায়াতকারী পথিক ও কাফেলাদের মধ্যে তারা লুটতরাজ চালাত।
ওদিকে পাহাড়ি আদিবাসীদের কবল থেকে এলাকা খালি করার অভিযানে আমাকে কিছুদিন সেখানে শিবির ফেলে অবস্থান করতে হলো। আমি পরবর্তী কালের জন্যও এমন ব্যবস্থাই করতে চাচ্ছিলাম, কেননা, ওদিকে যেন ওরা আর নিজেদের ঠিকানা বানাতে না পারে।
উত্তর পাহাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করানোর পর আমি সেনাকে অগ্রবর্তী হওয়ায় আদেশ দিলাম।
সেনা শিবির ফেলতে তুলতে আমরা মিল-কাফির পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। ওখানে উত্তম জাতের চাল উৎপন্ন হয়। মণ্ডিগুলোতে ওই সময় প্রচুর পরিমাণে চালের সমারোহ দেখা যাচ্ছিল। আমি সেনাবাহিনীর জন্য প্রচুর পরিমাণে চাল খরিদ করালাম।
তবে বেশিদিন পর্যন্ত এ সফর জারি রাখতে পারলাম না। পথে আমি গুপ্তচর মারফত খবর পেলাম যে, আমার কাবুলে অনুপস্থিতির সুযোগে শায়বানি খান ফায়দা তোলার পরিকল্পনা করেছেন।
সঠিক খবর ছিল। এ আশঙ্কা অস্বীকার করা যেত না। অতএব, আমি হিঁদুস্ত ান অভিযানের পরিকল্পনা স্থগিত করে দিলাম। আমি পাশাগড়ের মোল্লা বাবার নেতৃত্বে ফৌজের একটি বড় অংশকে তৎক্ষণাৎ কাবুল অভিমুখে রওনা করিয়ে দিলাম। আমি নিজে মন্দখার, অতার এবং শেলাব এলাকার দিকে রওনা হয়ে গেলাম। এদিক থেকে ছোটখাটো উপদ্রবের খবর আসছিল। তা দমনের জন্য আমার নিজেরই যাওয়া প্রয়োজন পড়েছিল।
কাবুলে সেনা পৌঁছে যাবার পর আমার কাছে খবর এল যে, শায়বানির পরিকল্পনা মাঠে মারা গেছে। শরৎ ঋতুতে আমি নিজে কাবুল পৌঁছে গেলাম।
বাবুরের প্রথম পুত্র সন্তান লাভ
১৫০৮ ঈসায়ী সনের ৮ মার্চ, সূর্য যখন পশ্চিমাকাশে অস্ত যাচ্ছিল, তখন আমি কাবুল দুর্গে আমার পুত্র সন্তান লাভের সুসংবাদ পেলাম। মওলানা মসনাদ আমার নবজাত শিশুপুত্রের নাম রাখলেন হুমায়ূন। আমার এক দরবারি কবি, শাহ ফিরোজ কদর’ নাম রাখলেন।
‘হুমায়ূন’ নামটি আমার বেশি পছন্দ হলো।
হুমায়ূনের যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তাকে নিয়ে আমি চারবাগ গেলাম। সেখানে তার মাতুল কুলের সমস্ত ছোট-বড় বেগ একত্রিত হয়ে এক দাওয়াতের ব্যবস্থা করলেন। ওই দাওয়াতে হুমায়ূনকে হালকা এবং ভারী, দামি এবং সস্তা উপহার পেশ করা হলো। দাওয়াতের ব্যবস্থা এতটাই জাঁকজমক ছিল যে, আমি তাকে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দাওয়াত রূপে মনে রেখেছি।