ত্রয়োবিংশ অধ্যায় – বাবুরের ইন্তেকাল
১৫৩০ ঈসায়ী সনের ২৪ ডিসেম্বর আগ্রা কেল্লায় বাবুর ইন্তেকাল করলেন।
এই বীরসেনানী, যোদ্ধা, বিদ্বান ও মোগল সামাজ্যেরে প্রতিষ্ঠাতার ইন্তেকালের বিষয়ে ঐতিহাসিকেরা এক আকর্ষণীয় বিবরণও দিয়েছেন। তবে এই বিবরণ থেকে পৃথকভাবে এ কথাও বলা হয় যে, ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মকালে হুমায়ূন বাদাখশান থেকে আগ্রায় এসেছিলেন। বাবুর তাঁর উপর বাদাখশানের শাসনভার অর্পণ করেছিলেন।
হুমায়ূনের বাদাখশান থেকে আগ্রা আসার মূল কারণ ছিল লাগাতার যুদ্ধে রত থাকার কারণে বাবুরের স্বাস্থ্য প্রায় এক বছর ধরে খারাপ চলছিল। তিনি কোনো যুদ্ধে না নেমে স্বাস্থ্যোদ্ধার করছিলেন। এমতাবস্থায় বাবুরের অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসতে দেখে, বাবুরের কিছু দরবারি গুপ্ত পরামর্শ করে বাবুরের পর তাঁর পুত্র হুমায়ূনের স্থলে বাবুরের ভগ্নিপতি মুহম্মদ মেহেদি খাজাকে রাজ-সিংহাসনে আসীন করার জন্য চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছিলেন।
হুমায়ূন যেইমাত্র এই খবর পেলেন, অমনি তিনি বাদাখশান থেকে আগ্রা চলে এলেন। ষড়যন্ত্রকারীদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। বাদাখশান থেকে ফেরার পর অন্তিম সময় পর্যন্ত হুমায়ূন পিতার কাছেই থাকেন। বাবুর তাঁর উপস্থিতিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার পূর্বে বাবুর হুমায়ূনকে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। বাবুর হুমায়ূনকে এ নসিহতও দেন যে, তিনি অন্য তিন ভাই কামরান, আসকারি ও হিন্দালের সঙ্গে যেন সর্বদাই ন্যায়াচার করেন।
আকর্ষণীয় বিবরণটি হলো এরকম—
১৫৩০ ঈসায়ী সনের গ্রীষ্মকালে হুমায়ূন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর অসুস্থতা বেড়ে চলল। বাবুর বেহদ চিন্তিত হলেন। কেননা, পুত্রের উপর কোনো ওষুধই কাজ করছিল না। তখন এক বুজুর্গ বলেন, হুমায়ূন তখনই সুস্থ হতে পারেন, যখন বাবুর তাঁর সর্বাধিক প্রিয় বস্তুটি আল্লাহর রাহে কুরবান করতে পারবেন।
বাবুর জানেন যে, পুত্রের জীবন রক্ষার জন্য তাঁর কাছে সবচেয়ে বহুমূল্য আর প্রিয় বস্তুটি হলো তাঁর জীবন। এ কথা ভেবেই বাবুর পুত্রের জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবন খোদার রাহে কুরবান করার জন্য সংকল্প করলেন। এই সংকল্পের কথা পুনরাবৃত্তি করে তিনি অসুস্থ হুমায়ূনের পালঙ্কের চারপাশে তিনবার প্রদক্ষিণ করলেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, তাঁর জীবনের বিনিময়ে হুমায়ূনের জীবন দান করা হোক।
বাবুরের এই প্রার্থনায় সাথে সাথেই হুমায়ূন সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। আর বাবুর রোগশয্যা নিলেন। তারপর, ওই রোগে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন।
উপসংহার
সম্ভবত, বাবুরের মৃত্যু সম্বন্ধে দুটি কথাই সঠিক। তবে এ কথা তো মানতেই হবে যে, হুমায়ূনের আগে থেকেই বাবুরের অসুস্থতা চলছিল। তিনি এক বছর আগে থেকে তাঁর আত্মকথা ‘তুজুক-ই-বাবরী’ (বাবরনামা) লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধের জন্য আর যুদ্ধক্ষেত্রে নামছিলেন না, যেখানে ভারতের বিশাল অংশ তার হাতে অবিজিত হয়ে পড়ে ছিল।
বাবুরের ন্যায় যোদ্ধার অসুস্থতা ব্যতীত, যুদ্ধক্ষেত্রে না নামা, বিস্ময়কর বলেই অভিহিত করা যেতে পারে।
তাঁর, হুমায়ূনের বদলে নিজের জীবন আল্লাহর রাহে দান করার বিষয়টি সঠিকভাবে জুড়ে যায়। যে কোনো পিতাই তাঁর পুত্রকে অনিরাময়যোগ্য রোগে আক্রান্ত, পালঙ্কে পড়ে থাকতে দেখে স্থির থাকতে পারেন না, তখন তিনি এই দোয়াই করতে পারেন যে, হে আল্লাহ আমার জীবনের বিনিময়ে আমার পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দাও…।
এই প্রসঙ্গটি আল্লাহর কাছে বাবুরের প্রার্থনা রূপেই দেখা উচিত। অলৌকিক কোনো ঘটনা রূপে দেখাটা বোধ হয় ঠিক হবে না।
অবশেষে ১৫৩০ ঈসায়ী সনের ২৪ ডিসেম্বর তারিখে এই নশ্বর সংসারকে আল-বিদা জানিয়ে বাবুর জান্নাতবাসী হলেন। তার পূর্বেই তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হুমায়ূনকে ভারত-সাম্রাজ্য অর্পণ করেন। বাবুর কর্তৃক ভারতে স্থাপিত সাম্রাজ্য মোগল সাম্রাজ্য নামে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। বাবুরের পর হুমায়ূন, তাঁর পর আকবর, তাঁর পর জাহাঙ্গীর, তাঁর পর শাহজাহাঁ এবং শাহজাহার পর ঔরঙ্গজেব অবধি মোগল সাম্রাজ্যের বিস্তারের ধারা অব্যাহত থাকে।
বাবুরের পর তাঁর পঞ্চম প্রজন্ম অবধি মোগল সাম্রাজ্যের গৌরবদীপ্ত ধারা অব্যাহত থাকে।
ঔরঙ্গজেবের পর সাম্রাজ্যের বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়ে যায় এবং অবশেষে সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ‘জাফর’ পর্যন্ত এসে তা নিঃশেষ হয়ে যায়। শেষ মোগল, বাহাদুর শাহ ‘জাফর’ নামমাত্র বাদশাহ ছিলেন। মোগল সাম্রাজ্যের সেই জৌলুস ও মর্যাদা আর ছিল না। তিনি বাস্তবিক ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের কৃপাপাত্র রূপে অবসরকালীন বেতনভুক রূপে দিল্লির বাদশাহ মাত্র রয়ে গিয়েছিলেন।
যদি, ১০ মে, ১৮৫৭ ঈসায়ী সনে সিপাহী বিদ্রোহের পতাকা উত্তর ভারতে উত্তোলিত না হতো এবং মিরাট ছাউনি থেকে বেরিয়ে আসা বিপ্লবীরা ১১ মে, ১৮৫৭ ঈসায়ীতে দিল্লি পৌঁছে বাহাদুর শাহকে নিজেদের নেতৃত্বে বরণ করে না নিতেন, তাহলে সম্ভবত মোগল বংশের এই শেষ প্রদীপটির নাম ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বড়ই কঠিনতার সঙ্গে সন্ধান করলেই তবে পাওয়া যেত।
***