একবিংশ অধ্যায় – পানিপথের ঐতিহাসিক যুদ্ধ
দুশমনদের পক্ষ থেকে হামলা হতে না দেখে ২০ এপ্রিল রাতে আমার চার-পাঁচ হাজার সৈনিককে ইব্রাহীম লোদির আফগান শিবিরে আক্রমণের আদেশ দিলাম।
আফগান সেনাও সচেতন ছিল তারা জবাবি কার্যক্রম চালাল। আমাদের সেনার কোনো প্রাপ্তি ছাড়াই ফিরে আসতে হলো।
২১ এপ্রিল ইব্রাহীম লোদিয় সৈন্য আগে বাড়ল। আমি বড় যোগ্যতার সঙ্গে আমার সেনাকে ব্যূহে খাড়া করে দিয়েছিলাম। হামলার জন্য আফগান সেনা এগিয়ে এল তো ওই অবসরে আমি দক্ষিণ এবং বাম দিক থেকে আমার সেনাদলকে ধাওয়া করার জন্য আদেশ দিলাম।
শত্রুসেনার অগ্রসর হতে গাড়িগুলোই বাধা হয়ে দাঁড়াল। আমার এই ধাওয়া করার ওই নীতি ছিল ‘তুলুগামা’।[১] তাতে ডাইনে-বামে সেনাকে ধাওয়া করা হয়, আর সামনে অবরোধ হয়। অবরোধের পিছনে আমার কামান বসানো ছিল। যেইমাত্র আফগান আক্রমণ শুরু হলো অমনি উস্তাদ আলী কুলি খাঁ কামানের মুখ খুলে দিলেন।
[১. তুলুগামা নীতি বাস্তবে ছিল তুর্কি আক্রমণের নীতি। বাবুরের সম্পর্ক ছিল তুর্কি বংশের সঙ্গে, অতএব, এই নীতি সম্পর্কে তাঁর ভালোমতো জ্ঞান ছিল। হিঁদুস্তানের লোক তুলুগামা ও কামানের সঙ্গে অপরিচিত ছিল। তুমুগামা নীতিকে ইংরেজিতে Ottoman Fashion লেখা হয়েছে। যার অর্থও তুর্কিদের যুদ্ধনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত।—অনুবাদক]
আফগান সেনা কামানোর মার সইতে পারল না। তাদের পা উপড়ে গেল।
এবার ভয়ংকর ময়দানি যুদ্ধ শুরু হলো। আমি ময়দানে নেমে পড়লাম। হুমায়ূন আমার দক্ষিণে ছিল, তার সাথে খাজা কলা, সুলতান মুহম্মদ, হিন্দু বেগ, প্রাচীরের মতো রক্ষাকবচ হয়ে শত্রুদের মুণ্ডুপাত করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল।
বাম দিকে মুহম্মদ মির্জা, মুহম্মদ খাজা, আদিল সুলতান শাহ, মীর হুসাইন, জুনাইদ, কুতলক কদম, জানী বেগ, মুহম্মদ ও শাহী হুসাইন ছিলেন।
ডান দিকে মাঝের নেতৃত্বে তুমুর সুলতান, সুলেমান মির্জা, মুহম্মদ কুকুলদাস, শাহ মনসুর, ইউনুস আলী দরবেশ, মুহম্মদ সরওয়ান ও আবদুল্লাহ ছিলেন।
মধ্য নেতৃত্বের বাম দিকে ছিলেন খলিফা খাজা মীর ইমরান আহমদী, তরদী বেগ, খলিফা মুহিব্বে ও মির্জা বেগ তরখান।
আগে-আগে খুসরো কুকুলদাস ও মুহম্মদ আলী জংগ ও আবদুল আজীজ যিনি অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন, এগিয়ে চলেছিলেন।
যুদ্ধের নির্ণায়ক ক্ষেত্রসমূহর ডান ব্যূহে মালিক কাসিম খুব দক্ষ নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, বাম দিক থেকে কারাকাজী ও আবদুল মুহম্মদ, শেখ জামাল, শেখ আলী মেহেদির দল শত্রুবাহিনীর ওপর দুর্ধর্ষ আক্রমণ চালাল।
যুদ্ধের এই ক্ষণটি যথেষ্ট নির্ণায়ক ছিল, তখন ডান দিক থেকে ইব্রাহীম লোদি নিজেই লড়তে—লড়তে নিজের যোদ্ধা সৈনিকদের সঙ্গে আমাদের সেনার সামনে এসে গেলেন।
তিনি অত্যন্ত ক্ষিপ্ততার সঙ্গে আমাদের দলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি আমাদের রক্ষা ব্যূহের যুদ্ধকলা সম্পর্কে কোনো ধারণা নিতে পারেননি। তিনি যুবা ছিলেন, অনভিজ্ঞ ছিলেন, আমাদের সামরিক ক্ষমতা সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও তিনি নিতে পারেননি। তিনি জানতেন না যে, ময়দানি যুদ্ধে কতক্ষণ বিরতি দেওয়া উচিত। কতক্ষণ পর এদিক-ওদিক হয়ে যাওয়া উচিত।
আমি আমার সেনাকে যুদ্ধনীতি দিয়ে রেখেছিলাম-হই-হল্লা করে দুশমনদের প্রতি একদম ঝাঁপিয়ে পড়ো এবং ছড়িয়ে পড়ো, পিছনে তীরন্দাজদের তীরন্দাজির সুযোগ দাও যে, এবার তোমরা জোশ দেখাও।
আমাদের তীরন্দাজ বাহিনী এমনভাবে তীর নিক্ষেপ করছিল যেন সত্যি-সত্যিই তীরের বর্ষণ হচ্ছে।
মেহেদি খাজা দুশমনদের হস্তীবাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হস্তীবাহিনীর গতি তীর বর্ষণের দ্বারা রোখা হচ্ছিল। এর জন্য কুজ বেগ ও তরদী বেগের নেতৃত্বে তীরন্দাজদের দলকে কাজে লাগানো হয়েছিল।
এই অবসরে উস্তাদ কুলী তোপচির বড় ভূমিকা ছিল। তিনি অগ্রসরমান শত্রুবাহিনীর উপর গোলার-পর-গোলা দাগছিলেন। কামানোর গোলার আঘাতে দিশেহারা হস্তীসেনা কিছুই করতে পারছিল না।
তোপচি সেনায় মুস্তাফা তোগচি মধ্যবর্তী নেতৃত্বের বাম দিককার নেতৃত্ব সামনে রেখেছিলেন।
আমাদের ডান-বাম দিককার সেনা দল শত্রুবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে চেপে রেখেছিল। তাদের তীর বর্ষণের গতি ছিল বেহদ উৎসাহব্যঞ্জক। দুশমনদের সৈনিকরা ঘোড়া থেকে, হাতি থেকে পড়ে ভূপাতিত হচ্ছিল।
দুশমনদের হস্তীবাহিনী তোপের মারে ভীতত্রস্ত হয়ে পিছু হটে নিজেদেরই সৈনিকদের পদদলিত করতে লাগল। তখন শত্রুবাহিনীতে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। যাতে বহু সৈনিক পদদলিত হয়ে মারা গেল।
এমন হতেই শত্রুবাহিনীর অবশিষ্ট সেনা কিছুক্ষণ পরে পলায়নপর হয়ে উঠেছিল। যার সুযোগ নিয়ে আমাদের সেনার বীরযোদ্ধারা বাজের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, শত্রুদের দেহ থেকে মাথা ফেলে দিতে লাগল।
দুপুরের সূর্য মধ্যাকাশে পৌঁছে গিয়েছিল। তখনও যুদ্ধ জারি ছিল।
তীর, তলোয়ার ও কামানের গোলার আঘাতে ইব্রাহীমের রক্ষাব্যূহ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেল। খোদ ইব্রাহীম লোদিও অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ভূপাতিত হয়ে বীরগতি লাভ করলেন।
সুলতানের মৃত্যুর খবরে হাহাকার পড়ে গেল। শত্রুবাহিনীর পায়ের তলায় মাটি সরে গেল।
আল্লাহতায়ালার প্রতি লক্ষ-কোটি শুকরিয়া যে, তাঁর রহমত আমার উপরে ছিল। এক কঠিন যুদ্ধের বিজয় সহজে আমার পক্ষে এসে গিয়েছিল।
আধা দিনেই যুদ্ধের জয়-পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।
আমি ওই জায়গায় পৌঁছালাম যেখানে তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল। রণভূমির ওই অংশে পাঁচ-ছ’হাজার সৈনিক মরে পড়ে ছিল, যারা ইব্রাহীমের সৈনিক ছিল। আমি রণভূমির অন্যান্য অংশ পরিদর্শন করলাম তো পনেরো-ষোলো হাজার সৈনিকের লাশ দেখলাম।
তবে, পরে আমি যখন আগ্রায় গেলাম তখন আমি জানতে পারলাম যে, হিঁদুস্তানি বাহিনীর চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজারের মতো সৈনিক ওই রণক্ষেত্রে নিহত হয়েছিল।
দিল্লি ও আগ্রা অধিকারের কার্য
ওই দিন (২১ এপ্রিল ১৫২৬) আমি অশ্বারোহী সেনাসহ হুমায়ূনকে আগ্রা অধিকারের জন্য পাঠিয়ে দিলাম। তার সঙ্গে খাজা কলা, মুহম্মদী, শাহ মনসুর, ইউনুস আলী, আবদুল্লাহ খাজাজ্ঞি ওলির সেনাদলকে রওনা করালাম।
মুহম্মদ খাজা, মুহম্মদ মির্জা, আদিল সুলতান, জুনাইদ বখশ ও কুতলক কদমকে সাজ-সরঞ্জামসহ দিল্লি অধিকারের জন্য ওই সময়ে পাঠিয়ে দিলাম। আমি তাদের এ বিষয়ে হেদায়েত দিলাম যাওয়ামাত্রই যেন দিল্লির রাজকোষ সাথে সাথে অধিকার করে নেওয়া হয়।
২১ এপ্রিল আমাদের সেনা রওনা হয়ে গেল।
২৪ এপ্রিল, মঙ্গলবার শায়খ নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মকবরায় আমি হাজিরা দিলাম।
ওই রাতে দিল্লির জন্য রওনা হয়ে আমরা পরের দিন দিল্লি কেল্লায় রাত কাটালাম।
২৫ এপ্রিল আমি খাজা কুতুবউদ্দীনের মকবরায় গেলাম। ওই স্থানটি এক সময় গিয়াসউদ্দীন বলবন ও আলাউদ্দীন খিলজির বাসস্থান ছিল।
আমি সেখানকার আশপাশের সকল দ্রষ্টব্য স্থান ভ্রমণ করলাম।
২৬ এপ্রিল আমি তুঘলকাবাদ পৌঁছে ওই স্থান ভ্রমণ করলাম।
বাবুরের জন্য দিল্লিতে খুৎবা
২৭ এপ্রিল মওলানা মাহমুদ ও শায়খ জেন কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে দিল্লি এলেন। আমার সালামতির জন্য দোয়া করলেন। আমার নামে খুৎবা পড়লেন। আমি দিল্লির রাজকোষের বড় একটি অংশ গরিব ও দীনদুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করে দিলাম।
২৮ এপ্রিল, শনিবার কিছু সেনা নিয়ে আগ্রার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলাম।
আমার আগে হুমায়ূন আগ্রা পৌঁছে সেখানকার শাসন-ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
বহুমূল্য হীরে লাভ
সুলতান ইব্রাহীম লোদির সঙ্গে যুদ্ধে গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমজিৎও যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন। বিক্রমজিতের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিরা ওই সময়ে আগ্রাতেই ছিলেন, যখন ইব্রাহীম লোদি পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন। হুমায়ূন যখন আগ্রায় পৌঁছান তার আগেই ইব্রাহীম লোদির পরাজয় ও মৃত্যু সংবাদ সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। বিক্রমজিতের পরিবার সেখান থেকে পলায়ন করার চেষ্টায় ছিল কিন্তু হুমায়ূনের সেনা তাদের পথেই আটক করে।
তাদের ফিরিয়ে আগ্রায় আনা হয়। আগ্রায় বিক্রমজিতের পরিবার-পরিজনদের কাছ থেকে বহুমূল্য হীরে জহরত জব্দ করা হয়। সেগুলোর মধ্যে এমনই একটি হীরাও ছিল যার মূল্য দিয়ে পুরো দুনিয়াবাসীর আড়াই দিনের আহার মিলতে পারত। (এটি ছিল জগদ্বিখ্যাত কোহিনূর হীরে)।
আমার আগ্রায় পৌঁছাতেই হুমায়ূন সেই বহুমূল্য হীরে আমার কাছে পেশ করে। আমি সেই হীরে হুমায়ূনকে উপহার দিই।
ইব্রাহীম লোদির মাতা ও নিকটস্থদের প্রতি বাবুরের দয়ালুতা
আগ্রা কেল্লায় পৌঁছানোর পর সেখানে যাদের পাওয়া যায় তাদের অন্যতম ছিলেন ইব্রাহীম লোদিয় মা। অন্যদের মধ্যে মালিকদাদ করঘানী, সিদুক ও ফিরোজ খাঁ মেওয়ারতী ছিলেন।
আমি ইব্রাহীম লোদির মাতার নামে সাত লক্ষ টাকা মূল্যের একটি পরগনা দিয়ে দিলাম। অন্য কিছু লোককেও আমি এই ধরনের পরগনা দিয়ে, কেল্লার বাইরে তাদের চাকর-বাকদের সাথে, আগ্রা থেকে দু’মাইল দূরে অবস্থিত এক স্থানে বসবাসের জন্য পাঠিয়ে দিলাম।
১০ মে, ১৫২৬-এ আমি সম্পূর্ণরূপে আগ্রা ও দিল্লির সালতানাত আমার অধীনে নিয়ে নিয়েছিলাম।
আমি কিছু সময় লাগালাম আমার সেনা ব্যবস্থাকে সুচারু করার কাজে। তারপর আধাআধি সেনা দিল্লি ও আগ্রায় রেখে দিল্লির তখত-এর শাসনভার নিয়ে নিলাম।
ইব্রাহীম লোদির পরাজয় ও তাঁর দিল্লি শাসনের অবসানের পর থেকে হিন্দুস্তানের শাসন নিষ্কণ্টক ছিল না। ভারতে রাজপুত রাজাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল।
ইতোমধ্যে বিয়ানার শাসকের উপর রাজপুত রাজা রানা সাংগা আক্রমণের পরিকল্পনা নিল।
বিয়ানার শাসক ছিলেন নিয়াজ খাঁ। তিনি রানা সাংগার সুগঠিত সেনার সামনে নিজেকে অসমর্থ দেখে সাহায্যের জন্য আমার কাছে এলেন।
আমি তাঁকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার সেনাকে তাঁর সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম। রানা সাংগা যখন দেখেন নিয়াজ খাঁ আমার সাহায্য পেয়ে গেছেন তখন বিয়ানায় নিয়াজ খাঁর শাসন সুরক্ষিত থাকতে দিল।
তবে, আমার সেনা যখন ফিরে এল তখন রানা সাংগা বিয়ানায় পুনরাক্রমণ চালিয়ে তা নিজের অধিকারে নিয়ে নিল।
যে মোগল সৈনিকেরা রাজপুতদের মোকাবিলায় রণক্ষেত্রে নেমেছিল তারা রাজপুতদের বীরত্বের বড়ই প্রশংসা করল।
ইতোমধ্যে হাসান খাঁ মেওয়াতি, রাজা সাংগার সাথে গিয়ে মিলিত হলো। প্রকৃতপক্ষে, পানিপথের যুদ্ধে হাসান খাঁ মেওয়াতির পুত্র, ইব্রাহীম লোদির পক্ষে নেমেছিল। যুদ্ধে পরাজয়ের পর আমি তাকে বন্দী করেছিলাম।
হাসান খাঁ মেওয়াতির কাছে তখনও মেওয়াত ক্ষেত্রের একটি বড় শক্তি ছিল। আমি মেওয়াতিকে রানা সাংগা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য, তার পুত্রকে মুক্তি দিয়ে দিই। তবে, এর পরেও মেওয়াতির উপর কোনো প্রভাব পড়ল না।
রানা সাংগার সেনা আমার সঙ্গে যুদ্ধে নামার জন্য বড়ই উদগ্রীব ছিল। রানা সাংগা হাসান মেওয়াতির সঙ্গে সসৈন্য আমার দিকে রওনা দিল।
আমিও সেনাকে ময়দানে নামার আদেশ দিলাম। তবে, ওই সময়ে আমার সৈনিকেরা লাগাতার যুদ্ধে লিপ্ত থাকার ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তার উপর, কাবুল থেকে আসা এক তথাকথিত জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করল, যার মধ্যে আমার পরাজয় এবং সেনাবাহিনীর নাশ হওয়ার অর্থ লুকিয়ে ছিল।
আমি আমার সৈনিকদের উৎসাহ বাড়ানোর জন্য মদ্যপানের বহুমূল্য পাত্রগুলোকে আনিয়ে নিয়ে তাদের সামনে ভেঙে ফেলার আদেশ দিলাম, ভবিষ্যতে মদ্যপান না করার শপথ নিলাম। ওই মদ্যপাত্রগুলোকে দীনদুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করিয়ে দিলাম।
আমি আমার সৈনিকদের এক মর্মস্পর্শী ভাষণ দিতে গিয়ে বললাম—
‘আমির এবং সৈনিকগণ! যে ব্যক্তি এই সংসারে আসে তার অন্ত অবশ্যই হয়। আমাদের সবারই মৃত্যু হবে এবং শুধু একমাত্র আল্লাহই থাকবেন। যারা জীবনের আনন্দ গ্রহণ করে তাদের মুত্যুভয় থাকা উচিত নয়।
এই সংসারে যে আসে তাকে এই দুঃখরূপী সংসার ছেড়ে একদিন-না-একদিন অবশ্যই যেতে হয়।
যখন এ সংসার থেকে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই যেতে হবে তখন তার চিন্তা করা উচিত যে, গৌরবের সাথেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, অপমানের সাথে জীবিত থাকার চেয়ে অনেক বেশি শ্রেয়।
আমার হার্দিক ইচ্ছা যে, আমার মৃত্যু সম্মানের সাথে হোক। আমার গৌরব লাভ হোক… আল্লাহর শোকর যে, এই যুদ্ধে যদি আমরা মৃত্যু লাভ করি তাহলে আমরা শহিদ হব আর যদি বেঁচে থাকি তাহলে গাজী হব। গাজী হয়েই আমরা জগৎ-সংসারের সমস্ত বস্তুকেই সুখ-শান্তির সঙ্গে উপভোগ করব।
আসুন, আমরা সবাই কুরআন শরিফের শপথ নিয়ে প্রতিজ্ঞা করি যে, আমরা সবাই ওই সময় পর্যন্ত যুদ্ধ করব, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের শরীরে প্রাণ আছে।’
আমার এই ভাষণ সৈনিকদের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করল। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে নামার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।
ওদিকে রানা সংগা পুরো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। সে তার সঙ্গে হিঁদুস্তানি শব্দ জুড়ে দিয়ে হিঁদুস্তানের কিছু মুসলিম আমির সরদার ও শাসককে জুড়ে দিয়েছিল।
খানুয়ার যুদ্ধ
১৫ আগস্ট ১৫২৭ খানুয়ার প্রান্তরে আমার ও রানা সাংগার সেনা মুখোমুখি হলো। আমি পানিপথের যুদ্ধের মতোই খানুয়াতেও যুদ্ধ ব্যূহ রচনা করলাম।
রাজপুতরা বেশ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করল। একবার তো আমার সেনার পিছু হটার মতো অবস্থা হয়েছিল। তবে সেনার পিছন থেকে নতুন দল এসে পিছ হটা সৈন্যদের সাহস বাড়িয়ে দিল। এখানেও আমি তুলুগামা নীতি গ্রহণ করলাম এবং কামানের প্রয়োগ উৎসাহবর্ধক ভূমিকা পালন করল। কামানের মুখ খোলায় পর রাজপুত বাহিনী আর ময়দানে দাঁড়াতে পারল না।
যুদ্ধে রানা সাংগা পরাজিত হলো। তবে, রাজ পুতানা এত বিশাল রাজ্য ছিল যে, তার উপর পূর্ণ অধিকার লাভ করা যথেষ্ট কঠিন কাজ ছিল।
১৫৩০ সালে আমি রাজপুতদের অধীনস্ত ভূ-ভাগে অবস্থিত চান্দেরি নামক দুর্গ অধিকারে সাফল্য পাই।