ভূমিকা – মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস

ভূমিকা 

পাক ভারত—বাংলা উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত মুসলিমদের রাজনৈতিক অভিযানগুলোকে আমি রাজনৈতিক মিশন বলে অভিহিত করে থাকি। অষ্টম শতাব্দীর শুরুর প্রথম দশকের দ্বিতীয় পাদে অর্থাৎ ৭১২ ঈসায়ী মনে মুহম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানটি ছিল ভারতে মুসলিমদের প্রথম রাজনৈতিক মিশন। বিপক্ষে ছিলেন সিন্ধুর হিন্দু রাজা দাহির। তাঁর পরাজয় ও মুহম্মদের বিজয় ছিল ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রথম আধুনিক ঘটনা। কেননা, সদ্য পৌত্তলিকতামুক্ত আরববাসী পৌত্তলিক ভারতবাসীর জীবনে ইসলামের আলোকবার্তা বয়ে এনেছিলেন। সেই আলোর সংস্পর্শে পৌত্তলিক সিন্ধুবাসী হিন্দুরা আলোকিত হয়ে ওঠে। পর্যায়ক্রমে উত্তর—পশ্চিম সীমান্ত প্ৰদেশ, পঞ্জাব, বেলুচিস্তান কেউই বাদ যায়নি। তারা সবাই আলোক্কাত ও মুসলিম হয়ে ওঠেন 

মুসলিমদের দ্বিতীয় বিজয়াভিযান পরিচালিত হয় সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে। তৃতীয় বিজয়াভিযান পরিচালিত হয় মুহম্মদ ঘুরির নেতৃত্বে এবং তাঁর নেতৃত্বেই ভারতের দিল্লিতে প্রথম মুসলিম সালতানাত কায়েম হয়। বিপক্ষে ছিলেন অহঙ্কারী দাম্ভিক পৃথ্বিরাজ চৌহান। তাঁর দম্ভ চূর্ণ করে দিয়ে দিল্লিতে মুসলিম সালতানাত কায়েম করে এদেশে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন মুহম্মদ ঘুরি। অবশিষ্ট পৌত্তলিক ভারত ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে থাকে। চতুর্থ অভিযান পরিচালিত হয় জহির—উদ—দিন মুহম্মদ বাবুরের নেতৃত্বে। প্রতিপক্ষ ছিলেন ইব্রাহীম লোদি। তারপরের প্রতিপক্ষ ছিলেন রাজা সাঙ্গা। বাবুরকে পরাজিত করে তিনি দিল্লি সালতানাত দখলের দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন। বাবুর তা চূর্ণ—বিচূর্ণ করে দিয়ে দিল্লিতে মোগল সালতানাত কায়েম করেন পরবর্তী প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের জন্য। এই বিজয়ের ধারাবাহিক বর্ণনা এই ভূমিকায় প্রদত্ত হয়েছে। ‘বাবরনামা’ গ্রন্থের পাঠকদের জন্য তা খুবই প্রাসঙ্গিক। 

এক. 

বিশ্বনবি হজরত মুহম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব মানব জাতি ও মানব—সভ্যতার ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। তাঁর আবির্ভাবের সাথে সাথে নবুয়ত ও রিসালাতের ধারা একদিকে যেমন শেষ হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি মানুষের যুগযুগান্তরের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাধনা পূর্ণতালাভ করেছিল। পবিত্র মহানবির (স) উপর মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআন অবতরণের সাথে—সাথে যেমন আসমানি কিতাবের ধারা পূর্ণতা লাভ করেছিল, অন্যদিকে তেমনি পবিত্র কুরআনে ‘তোমাদের দ্বীনকে পুরা করলাম’ এবং ‘ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম’—ঘোষণার সাথে সাথেই মহানবি (স) ত্রিকালশ্রেষ্ঠ ও ত্রিকালদর্শী মহাপুরুষরূপে জগতে চিরপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন। এ কোনো অতিশয়োক্তি নয় যে, তিনিই জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ, ত্রিকালশ্রেষ্ঠ এবং ইহপরকালের অবিসংবাদিত নেতা। তাই তাঁর উপর অবতীর্ণ পবিত্র মহাগ্রন্থ আল—কুরআন যেমন সকল কালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, মানবজাতির চিরকালের মহাসনদ; তেমনই সেই পবিত্র কুরআনের প্রতিবিম্ব মহানবির জীবন ও বাণী বিশ্বমানবের চিরকালীন ও চিরন্তন আদর্শ। মহানবি (স) বিদায় হজ্বের ভাষণে তাই স্পষ্টতই বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কিতাব ও রসুলের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে থাকবে—তাহলে কেউ তোমাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না।’ মহানবি (স)—এর পবিত্র মুখনিঃসৃত এ বাণী বিশ্বমুসলিমের চিরকালীন—চিরকালের পথপ্রদর্শকের বাণী—স্পষ্টতই, একথা যুগে যুগে কালে কালে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে যে, মহানবির এ বাণী অজর—অমর—অব্যয়—অক্ষয়; তার লয় নেই, তার ক্ষয় নেই; মহাপ্রলয়কালাবধি মহাকাল—সাগরে তা আলোকবর্তিকার ন্যায় পথহারা পথিককে আলোর সন্ধান দিয়ে যাবে—ন্যায়হারা, সত্যহারা, পথহারা জাতিকে সঠিক সত্যের দিশা দিয়ে যাবে। 

বড়ই সৌভাগ্যবান ঐ আরবজাহান, যে জাহানে, যে মরুর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন পবিত্র মহানবি—যিনি আল্লাহর খলিল হজরত ইব্রাহিমের দ্বীনকে আরবদেশের বুকে পুনরুজ্জীবিত করে—কাবাকেন্দ্রিক অধ্যাত্মিক মহাজগৎ সৃষ্টি করে বিশ্বমানবের জন্য অমিয়সুধার মহাভাণ্ডার সুরক্ষিত করে গেলেন। এ এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার; এবং আরো অদ্ভুত এবং আরো সুন্দর একটি ব্যাপার হলো যে, ইসলামের মহানবি আবির্ভূত হয়েছিলেন পৃথিবীর একেবারেই মধ্যভাগে—মধ্যস্থলে—একেবারেই মক্কা—মহানগরে; যা জেদ্দা বন্দরের অনতিদূরেই অবস্থিত। আদিমানব আদম ও হাওয়ার পদস্পর্শধন্য জেদ্দা—অনতিদূরেই যুগযুগান্তরের নবি—রসুলদের পদস্পর্শধন্য মক্কানগরী—সে মক্কানগর—যেখানে সুরক্ষিত রয়েছে পবিত্র স্বর্গীয় পাথর ‘হাজরে আসওয়াদ’, সে পবিত্র কাবাগৃহ—যাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল ইব্রাহিমি দ্বীনের আধ্যাত্মিক জগৎ—সে কাবানগরী মক্কায় মহানবির আবির্ভাব বিশ্বমানবের জন্য আরেক তাৎপর্যময় মহাঘটনারূপে চিরস্মরণীয় হয়ে রইল। একেবারে আদিমানব ও আদিনবি আদম থেকে শুরু করে আখেরী নবি মুহম্মদের (স) আবির্ভাব—সেমিটিক ধর্মজগতের এক যুগান্তকারী ঘটনারূপে ত্রি—জগতে অজর অমর—অব্যয়—অক্ষয় হয়ে রইল। 

মহানবি মুহম্মদ (স) নিজের জীবন ও সাধনা দিয়ে অশিক্ষিত, অজ্ঞ আরব জনগণকে যে মহামন্ত্র ও মহাসত্যের সন্ধান দিয়েছিলেন, সে মন্ত্র, সে আলোকিত সত্য তাদের যুগযুগান্তরের অন্ধকার ও অজ্ঞতাকে দূরীভূত করে দিয়ে এক আলোকিত ও সম্ভাবনাময় জান্নাতি জাতিরূপে জগতে তাদের চিরমহিয়ান হওয়ার মহামর্যাদায় বিভূষিত করল। সদ্য আলোকিত জাতি, সেদিন সুসভ্য ও মহিমান্বিত জাতিসত্তায় রূপান্তরিত হয়েছিল। তাদের চোখের সামনেকার সকল অন্ধকার বিদূরিত হয়ে গিয়েছিল। সেদিন তাঁরা অনুভব করেছিলেন, যে মহিমান্বিত মহাসত্যের সন্ধান তারা পেয়েছেন যে মহাসত্য তা শুধু তাদের জন্য নয়; তা এসেছে বিশ্বমানবের জন্য। আলোকিত আরবজাহানের বাইরের অনালোকিত জগতকে সে সত্যের আলোয় আলোকিত করার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বের দিগদিগন্তে তা ছড়িয়ে দেওয়ার এক স্বর্গীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা কখনো বা দিগ্বজয়ীর বেশে, কখনো বা চিরত্যাগী চির সন্ন্যাসীর বেশে দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়লেন। বিশ্বমানবের দরবারে সে মহাসত্যের বাণী পৌঁছে দেওয়ার যে আধ্যাত্মিক মাদকতা তাঁরা সেদিন অনুভব করে জীবন—মরণ—পণ করে বিশ্বের দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, তা কি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব? এটা কোন মহাশক্তি আর কোন মহামন্ত্রবলে সম্ভব হলো? নিশ্চয়ই তার সামনে জগতের আর সব ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, বৈশ্বিক সমস্ত ধ্যানধারণাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল। পবিত্র ইসলামের আলোকিত জীবন—দর্শনের সামনে ইরানের মানিকীবাদ (Manikism) নিশ্চয়ই বড় অসহায় ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। খোদ আরবের পৌত্তলিকতাবাদ, তার প্রতিবেশী আরো দুই ধর্মীয় মতবাদ খ্রিস্টীয় ও ইহুদিবাদ—নিঃসন্দেহে তার সামনে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিল। নতুবা ইসলামের আলোকিত সৌন্দর্য ও আলোকিত জীবনবাদের সংস্পর্শে আসার ফলে তারা এ নবীন জীবনবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ময়দান ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো কেন? যে ইজম বা যে বাদটাই ছিল পুরোমাত্রায় ভাববাদ, এবং সে বাদ বা ইজমকে কেন্দ্র করে যে মানবতাবাদ বা মানবজীবনবাদ গড়ে উঠল—আর তার সংস্পর্শে অন্যান্য ইজম বা বাদ ময়দান ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো কোন মহাশক্তি আর কোন মহামন্ত্রবলে? সে কি তরবারির জোরে? প্রাচ্যের ও পাশ্চত্যের ইসলাম—বিরোধী নিন্দুকদের ইসলামের বিরুদ্ধে ও জঘন্য অপবাদ সুস্থ ও সুকুমারবুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষদের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য হয়নি—হবেও না কোনোদিন। এভাবেই ইসলাম তার অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তির বলে একদা যেদিন পৃথিবীর মধ্যস্থলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মহানবির তিরোধানের মাত্র একশো বছরের মধ্যে তা পশ্চিমে স্পেন ও পূর্বে ভারত উপমহাদেশের সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। 

দুই. 

ইসলামের পবিত্র মহানবির (স) তিরোধানের পর পর্যায়ক্রমে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ অতিবাহিত হয়ে হজরত আবু বকর, হজরত উমর, হজরত উসমান ও হজরত আলীর (রা) পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলাম জগতে দুর্যোগের যে ঘনঘটা নেমে আসে, তা ছিল মূলত রাজনৈতিক। ইসলামের বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শ, ইসলামের আর্থসামাজিক ও আধ্যাত্মিক জগৎ তখনও পর্যন্ত একই ঐক্যসূত্রে গ্রোথিত ছিল। এবং তখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত মহাদেশীয় ভূখণ্ডগুলোতে ইসলামের বিজয়াভিযান অব্যাহত ছিল। অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছিল—ইসলামের অগ্রাভিযান। সে অভিযান একদিকে ছিল যেমন রাজনৈতিক, অন্যদিকে তেমনই ছিল আর্থসামাজিক ও আধ্যাত্মিক। এর পুরো বিষয়টিকে এক কথায় মিশন (Mission) বলে অভিহিত করাটাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। যেমন—রাজনৈতিক মিশন, সামাজিক মিশন, আধ্যাত্মিক মিশন, অর্থনৈতিক মিশন ইত্যাদি। আমরা এর সমস্তটিকে একত্রিত করে—বোঝার সুবিধার্থে ‘মুহম্মদী মিশন’ বলে অভিহিত করব। তাতে বিষয়টি বুঝতে আরও সুবিধা হবে। 

ইসলামের এ মিশন বা মুহম্মদী মিশন অতীত পৃথিবীর সমস্ত মিশনকে নস্যাৎ করতে—করতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এ ব্যাপারে আমিরুল মুমিনিন হজরত উমর ফারুক রাজিআল্লাহুতায়ালা আনহুর অবদান যেন সবচেয়ে বেশি বলে প্রতীত হয়। মহানবি মুহম্মদের (স) সেই জগদ্বিখ্যাত উক্তি—‘আমার পরে নবি হলে উমর হতেন নবি’—এ যে কোনো অতিশয়োক্তি নয় ইসলামের ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সে কথার সততা আমাদের চোখের সামনে সূর্যসত্য হয়ে ফুটে ওঠে। 

তাঁর উপর সর্বশক্তিমান আল্লাহর অপার করুণা বর্ষিত হোক। সেই মহান খলিফার হাত দিয়ে তৎকালীন বিশ্বের যে সকল দেশে মুহম্মদী মিশন পরিচালিত হয়েছিল তা আশ্চর্যরকমভাবে সার্থক হয়ে উঠেছিল। ইসলাম জগতের সেই মহান সন্তানের মধ্যে আল্লাহ যেন ‘নবুয়তি বরকত দান করেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ মিশনই হয়েছিল সফল ও সার্থক। এবং আরও সুখ ও আনন্দের বিষয় যে, তাঁর আমলে বিজিত প্রায় সমস্ত ভূখণ্ডেই আজও ইসলামের পতাকা সমুন্নত রয়েছে। 

তাঁর হাতেই বিজিত হয়েছিল মিশর ও ইরানের মতো দুটি প্রাচীন সভ্য দেশ ও সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশই এসেছিল ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। আজকের উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান প্রভৃতি ভূখণ্ড ছিল তারই খিলাফতকালের বিজয়ের স্মারক। একথা ভেবে আজ আমাদের শোকের অন্ত নেই যে, সে মহান খলিফা অত্যল্পকালের মধ্যেই ইসলামের ইতিহাসে যে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করে গিয়েছেন, তার দৃষ্টান্ত শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়; সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে সুদুর্লভ। তবে এর চেয়েও শোকাবহ ঘটনা যে, মহান খলিফার অপঘাতে শাহাদতের ঘটনায় সেদিনকার মুসলিম বিশ্ব যেমন বিমূঢ় ও মুহ্যমান হয়েছিল, আজকের মুসলিম বিশ্ব সমভাবে তার অংশীদার। তাঁর মতো অতি দ্রুত গতিতে ও অতি দ্রুত পদচারণায় বিশ্বের অন্যান্য ভূখণ্ডে তাঁর মতো করে আর ইসলাম প্রচারিত হতে পারল না এবং মর্তপৃথিবী ঐভাবে সুগঠিত হতে পারল না। সত্যি, এ দুঃখ রাখার জায়গা নেই। 

তিন.

ঐতিহাসিকভবে একথা সত্য যে, হজরত উমরের খিলাফতকালে তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে দু—একটি মিশন পরিচালিত হয়েছিল। তবে তা ততটা ফলপ্রসূ হয়নি। এ না হওয়ার মূলে ছিল হজরত উমরের সীমাহীন দূরদর্শিতা। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে যতগুলো অভিযান প্রেরিত হয়েছিল তার সবকটিতেই তাঁর এ দূরদর্শিতা সক্রিয় ছিল। তাঁর দেশবিজয়ের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, বিজিত ভূখণ্ডগুলোতে তিনি নিরঙ্কুশ শাসন কায়েম করতেন। তাঁর প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ছিল অসাধারণ। সে বিশাল ব্যক্তিত্বের খিলাফতাধীনে কোনো প্রাদেশিক শাসনকর্তার পক্ষে তাঁর নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব ছিল না। খলিফা উমরের শুধু দূরদর্শিতা নয়; দূরদৃষ্টিও ছিল অসাধারণ। মদিনা মুনাওয়ারা থেকে বহুদূরস্থিত প্রদেশগুলোর প্রশাসন ব্যবস্থাকে তিনি যেন সেই দূরদৃষ্টি দিয়ে প্রত্যক্ষ করতেন। কোনো প্রশাসকের পক্ষে সম্ভব ছিল না তাঁর আদেশ অমান্য করা, আর কোনো প্রজার পক্ষে সম্ভব ছিল না প্রশাসনিক নিয়ম ও আইনকানুনকে ভঙ্গ করা। তাঁর খিলাফতাধীনে এভাবেই গড়ে উঠেছিল এক শৃঙ্খলাবদ্ধ শাসনব্যবস্থা। বলাবাহুল্য, বিজিত এলাকাগুলোতে এভাবে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা আনয়ন না করা পর্যন্ত তিনি নতুন নতুন এলাকায় মিশন পাঠানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। সেজন্য তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে মিশন পাঠানোর ব্যাপারে তাঁর কিছুটা দ্বিধা ছিল। তবুও একথা ঠিক যে, পূর্ণ জীবন লাভ করলে তাঁর নবুয়তি—বরকতময় হাতের কল্যাণে মুহম্মদী মিশন তৎকালীন বিশ্বের আরও কত এলাকা যে বিজিত হয়ে সেখানে চিরস্থায়ী ইসলামি ব্যবস্থা কায়েম হতো তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। আল্লাহ সেই পবিত্রাত্মা মহাপুরুষের কল্যাণময় আত্মাকে জান্নাতে চিরশান্তিতে রাখুন। 

পবিত্র খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর ইসলাম জগতে জয়ের ধারা বদলে যায় এবং মুহাম্মদী মিশন প্রেরণের ধারা নতুন নতুন গতি লাভ করে। প্রাথমিক যুগে ইসলাম যেখানে নিজেদের মধ্যেকার মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে এক মহিমান্বিত জীবনব্যবস্থারূপে তাঁর পরিচয় অব্যাহত রেখে অবলীলাক্রমে অমুসলিম বিশ্বের পানে প্রধাবিত ছিল, পরবর্তী যুগে সেখানে তা সঙ্কুচিত হয়ে নিজেদের মধ্যেকার মতপার্থক্যকে প্রবলতর করে তুলে আত্মঘাতী ও ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ প্রণোদনাকে অনিবার্য করে তুলল। এভাবে মুসলিম বিশ্ব নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ল, পূর্বের বিজয়ের ধারা শ্লথ হয়ে পড়ল, এবং এক—একটি এলাকায় বংশগত খিলাফতের ধারা প্রযুক্ত হলো। রাজনৈতিক মতপার্থক্য পর্যায়ক্রমে আধ্যাত্মিক মতপার্থক্যের রূপ পরিগ্রহ করল। ইসলামের শত্রুরা নব—নব ছদ্মবেশে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করল এবং ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা—হাঙ্গামায় ইন্ধন যোগাতে লাগল। এভাবে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মুসলিম নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ল, বংশগত খিলাফত কায়েম হয়ে পড়ল এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে মিশন প্রেরিত হতে লাগল। ভিন্ন ভিন্ন পথে হলেও তা ছিল মুহাম্মদী মিশন। তা ছিল মুহম্মদেরই শিক্ষা প্রসারের প্রচেষ্টা। এ মিশন শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবেও প্রেরিত হতে লাগল এবং পর্যায়ক্রমে বিজিত অঞ্চলগুলোতে বসবাসরত মানুষদের হৃদয়—মন—প্রাণ জয় করে নিতে লাগল। এ বিজয়ের ধারায় হিঁদুস্তান বিজয়ের পরিকল্পনা ছিল ইসলামি ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা। 

চার. 

মহানবি মুহম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রচারিত জীবনবাদ পৃথিবীর দিগ—দিগন্তে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত মানবজাতির মহান সন্তানেরা সামান্যতম অলসতাকেও প্রশ্রয় দেননি। মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী—এ সৌভাগ্য ও সম্মান তাঁরা ত্যাগ করতে মোটেও রাজি ছিলেন না। তাই জীবনমরণ পণ করে তাঁরা পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন। বিশ্বমানবের দরবারে তাঁরা পৌঁছে দিয়েছেন সেই স্বর্গীয় বাণী—স্বর্গীয় জীবনবাদ। এ ছিল স্পষ্টতই মিশনারি কর্মসাধনা। তা ছিল নিজেদের জীবনের বিনিময়ে মহানবির মিশনকে বিশ্বমানবের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার সাধনা। এ মিশন প্রেরণ মূলত তিনটি পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়েছিল। দিগ্বিজয়ীদের মারফত, ধর্মপ্রচারক—সুফি—সন্তদের মারফত এবং বণিকদের মারফত। সন্দেহ নেই, এ সুসংস্কৃত ও পরিশীলিত ধর্ম ও সংস্কৃতি পথভ্রান্ত, পথহারা ও অন্ধকারের যাত্রীদের প্রকৃতই পথ দেখাতে সমর্থ হয়েছিল। আলোকিত ধর্ম, আলোকিত সংস্কৃতি অনালোকিত ধর্ম ও সংস্কৃতির জগতে অতি দ্রুত স্থান করে নিতে সমর্থ হয়েছিল। দিগ্বিজয়ী, সুফি—সন্ত ও বণিকরা—প্রকৃতপক্ষেই মিশনারির ভূমিকা পালন করে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। তৎকালীন আবিষ্কৃত মহাদেশ ও ভূখণ্ডগুলোতে আরব বণিকদের ছিল অবাধ যাতায়াত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিগ্বিজয়ী মিশনারিদের দিগ্বিজয়ী মিশন পরিচালনার বহুকাল পূর্বেই পৃথিবীর বহু ভূখণ্ডে ইসলাম পৌঁছে গিয়েছিল। যেমন—দক্ষিণ ভারতীয় সমুদ্রোপকূলবর্তী এলাকাসহ শ্রীলঙ্কা, জাভা, সুমাত্রা ইত্যাদি ভূখণ্ড—যেগুলো আজ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ মালদ্বীপ প্রভৃতি নামে পরিচিত—যে স্থানগুলো সহ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, চীন প্রভৃতি ভূখণ্ডে তো প্রথমেই বণিকদের মারফত ইসলাম পৌঁছে গিয়েছিল। এ দেশগুলোর অধিকাংশতেই তো মুসলমানদের রাজনৈতিক মিশন পরিচালিতই হয়নি; তা সত্ত্বেও ঐ ভূখণ্ডগুলোতে বণিক ও ইসলাম ধর্ম প্রচারকদের মারফত অতি দ্রুত ইসলাম পৌঁছে গিয়েছে। তৎকালীন বিশ্বের অনেক ভূখণ্ডই ছিল অন্ধকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সে সব এলাকায় অতি দ্রুত ইসলাম তার জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়। 

ঐ সময়ে রাজনৈতিক অভিযান প্রেরণের বহু পূর্বেই তৎকালীন ভারতবর্ষের দক্ষিণ—পশ্চিম সমুদ্রোপকূল সহ শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ইত্যাদি ভূখণ্ডগুলোতে আরব বণিকদের অবাধ পদচারণা ছিল। এবং ব্যবসা—বাণিজ্য সংক্রান্ত বিবাদের সূত্র ধরেই অবশেষে ভারত ভূখণ্ডে বড় রকমের দিগ্বিজয়ী মিশন পরিচালিত হয়। 

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, খলিফা উমরের শাসনামলে হিঁদুস্তানে রাজনৈতিক মিশন প্রেরণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু যে কারণেই হোক, সে মিশন তেমন সফলতা অর্জনে সমর্থ হয়নি। ইতোমধ্যেই মহাত্মা খলিফা উমর শাহাদত বরণ করেন। তারপর, বহুকাল যাবত আর তেমন কোনো ফলপ্রসূ রাজনৈতিক মিশন প্রেরণের সংবাদ পাওয়া যায় না। 

ইতোমধ্যে মুসলিম জগতে অনেক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন দেখা দেয়। সময় প্রবাহের সাথে সাথে খোলাফায়ে রাশেদীনদের যুগ অতিক্রান্ত হয়ে যায়। তারপরের ইতিহাস তো ইতিহাসের মনোযোগী পাঠকমাত্রের অজানা নয়। এরপরে, ভিন্ন ভিন্ন পথ ও পদ্ধতিতে পৃথিবীর একপ্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায় ইসলামের মিশন। 

পাঁচ. 

খলিফা হজরত উমর (রা)—এর স্বপ্ন অনেক কাল পরে সফল হয় এক সপ্তদশবর্ষীয় আরব তরুণের দ্বারা। আর সেই সাথে একথাও অতীব শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় যে, আরবদের সিন্ধু বিজয় শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাসে নয়; সমগ্র বিশ্ব—ইসলামের ইতিহাসের এক স্মরণীয় ঘটনা। খলিফা হজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাইপো ও জামাতা সপ্তদশবর্ষীয় তরুণ মুহম্মদ ইবনে কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু বিজয় ভারত ইতিহাসের একটি স্মরণীয় ঘটনা। প্রকৃতপক্ষে, এ বিজয়ের দ্বারাই ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। আর সেই যে সিন্ধু বিজয় সম্পন্ন হয়েছিল—বিচ্ছিন্নভাবে হলেও সে বিজয় ছিল এক চিরস্থায়ী বিজয়। বাস্তবিকই এ ছিল ইসলামের এক সার্থক রাজনৈতিক মিশনের সাফল্য। সাফল্যের এ পথ বেয়েই একদিন সমস্ত হিঁদুস্তান ইসলামের অধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিল। উপায় ছিল না; কারণ সমগ্র হিঁদুস্তান তখন পৌত্তলিকতার অন্ধকার গহ্বরে হাবুডুবু খাচ্ছিল। পটভূমিটি তুলনামূলক আলোচনার অবকাশ রাখে। একই অবস্থা ছিল আরবেও। পবিত্র মক্কা নগরীতে হজরত ইব্রাহিম ও তাঁর পুত্র ইসমাইল কাবা—শরীফ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে যে একেশ্বরবাদী পবিত্র জীবনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, তাঁদের তিরোধানের পরে পৌত্তলিকতাবাদীরা পুতুল—প্রতিমা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই পবিত্র মক্কাভূমিকে অপবিত্র করে ফেলেছিল। পবিত্র কাবাগৃহে ছবি ও মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে সে গৃহের পবিত্রতা নষ্ট করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, একেশ্বরবাদী আরবভূমি অপবিত্র পৌত্তলিকতার অন্ধকার গহ্বরে হাবুডুবু খাচ্ছিল। তারপর পবিত্র দ্বীনের নবি মুহম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লালামের আজীবন প্রচেষ্টা ও সাধনার মাধ্যমে পাপপঙ্কিল আরবভূমি একেশ্বরবাদী পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল। একই অবস্থা ছিল ভারতবর্ষেও। সেখানেও পৌত্তলিকতার অভিশাপদগ্ধ জনজীবন সমাজের একদল সুবিধাবাদী পৌত্তলিক—পুরোহিত—নৃপতিদের জালে আবদ্ধ হয়ে ছটফট করছিল—মানবতার নাভিশ্বাস উঠছিল। সপ্তদশ বর্ষীয় তরুণ মুজাহিদ, প্রথমে গাজী ও পরে শহীদ, মুহম্মদ বিন কাশিমের নেতৃত্বে সিন্ধুভূমিতে ইসলাম কায়েম হওয়ার পর পৌত্তলিকতার অভিশাপ থেকে সেখানকার জনগণ মুক্তির নিশ্বাস নিতে থাকে। এক উন্নত সংস্কৃতি ও পবিত্রতম জীবনব্যবস্থার সংস্পর্শে আসার পর সেখানকার মানবচিত্তের পৌত্তলিকতাদগ্ধ ঘোর অন্ধকার বিদূরিত হতে থাকে এবং একটি অত্যুন্নত ও পরিশীলিত জীবনবাদ ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে তাদের মনোজগতে বিপুল পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। এদের মধ্যে বহুসংখ্যক পৌত্তলিক মানসিক পরিবর্তনের সাথে সাথে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে ধন্য হয়। সদ্যাগত আরবদের সাথে ভ্রাত্বত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় একটি সুসংস্কৃত ও সুপরিশীলিত সুন্দর সমাজব্যবস্থা। ইসলাম আরব—হিঁদুস্তানের ভৌগোলিক ব্যবধানকে ঘুচিয়ে দিয়ে তাদের মধ্যে এক সুসংহত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলে। 

এভাবে কেটে যায় প্রায় তিনশো বছর। এই সুদীর্ঘ তিনশো বছরে ইসলাম বৃহত্তর সিন্ধু এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। এর মূল কারণ ছিল বাগদাদকেন্দ্রিক তৎকালীন খিলাফত ব্যবস্থার মধ্যে ঐক্যের নিদারুণ অভাব। অগণিত রাজনৈতিক মতবাদদীর্ণ ভ্রান্ত ও ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষজাত ধ্যান—ধারণার কারণে পরবর্তীকালে অবশিষ্ট হিঁদুস্তান অভিমুখে বড় কোনো রাজনৈতিক মিশন পরিচালিত হতে পারল না। ফলে, আরব মুসলমানরা বৃহত্তর সিন্ধু উপকূলেই দিন অতিবাহিত করতে লাগল। 

হিঁদুস্তানের মাটি ও আহাওয়ার নিজস্ব একটি বৈশিষ্ট্য আছে। সে বৈশিষ্ট্য ও সে প্রভাব থেকে আরব মুসলমানরা নিজদের মুক্ত রাখতে পারল না। সর্বোপরি, স্বল্প পরিশ্রমে পর্যাপ্ত জীবনোপকরণের পরম্পরাগত ধারা তাদের অলস, কুঁড়ে ও অপদার্থ জাতিসত্তায় পরিণত করল। ভোগবিলাসের স্পৃহা ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগত শিথিলতা তাদের আরব—ভূমিজাত বীরত্ব ও দিগ্বিজয়গত স্পৃহাকে ধূলিমলিন করে দিল। ফলে, ইসলামের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক মিশন সিন্ধু উপত্যকা অতিক্রম করে বৃহত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারল না। এর জন্য আরো তিনশো বছর অপেক্ষা করতে হলো। 

ছয়. 

ভারতে ইসলামের বিজয়াভিযানের ধারায় অবশেষে যুক্ত হলো ইরানের গজনীর শাসকদের উত্থান। ইরানের সামানী বংশীয় পঞ্চম রাজা আবদুল মালিকের প্রভুভক্ত ক্রীতদাস আলপ্তগীন নিজ কর্মগুণের দ্বারা যে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন, ইতিহাসে তা গজনবীবংশ রূপে অক্ষয়—অব্যয় হয়ে আছে। ইরানের রাজবংশজাত সবুক্তগীন ভাগ্যদোষে ক্রীতদাসরূপে আলপ্তগীনের নিকটে বিক্রীত হন বটে, কিন্তু ধমনিতে প্রবাহিত রাজরক্ত ও উন্নত ললাটের অধিকারী সৌভাগ্যবান সবুক্তগীন অচিরেই গজনীর সালতানাত লাভ করেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী সবুক্তগীন ইরান ও আফগানিস্তানের পাহাড়ি উপত্যকা অতিক্রম করে ভারতের উদ্দেশে রাজনৈতিক অভিযান প্রেরণ করেন। আরবদের প্রায় পৌনে তিনশো বছর পর সবুক্তগীনের নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ তুর্কি মুসলিমদের সফল রাজনৈতিক মিশন পরিচালিত হয়। জয়পালের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত পৌত্তলিক বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। 

এরপরে, গজনী বংশের মহান সন্তান গাজী বীর সলতান মাহমুদের উত্থান। এ মহান সন্তানের নেতৃত্বে হিঁদুস্তানের উদ্দেশ্যে পর পর আঠারোটি শান্তি মিশন পরিচালিত হয়। এ মিশনগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষের মাটিতে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। মহাবীর গাজী সুলতান মাহমুদের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো যে, তিনি কখনো কোনো যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেননি। বিশ্বের সমরেতিহাসে এ এক আশ্চর্যজনক দৃষ্টান্ত। 

১০০০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের উদ্দেশ্যে সুলতান মাহমুদের প্রথম সামরিক মিশন পরিচালিত হয় এবং ১০২৬ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাট ও সোমনাথে সর্বশেষ অষ্টাদশতম মিশন সার্থকভাবে পরিচালনার মাধ্যমে তাঁর হিঁদুস্তান অভিযান সমাপ্ত হয়। এভাবে গাজী বীর সুলতান মাহমুদ পুনঃপুনঃ সমর মিশন পরিচালনার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে মুসলমানদের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার কায়েমের পথ সুপ্রশস্ত করেন। 

১০৩০ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদের ইন্তিকালের পর তাঁর দুর্বল উত্তরাধিকারীরা তাঁর মিশনের ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হন। 

ইতিহাসের ধারাবাহিকতার একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, যখন কোনো প্রবল ব্যক্তিত্বের উত্তরাধিকারীরা পূর্বের প্রবলত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন তার অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের পরাজিত করে সে স্থান দখল করে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নিজেদের নতুন করে সংযোজন করে তার ধারা রক্ষা করে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আলোকিত ও প্রবল প্রতাপান্বিত গজনী বংশ দুর্বল হয়ে পড়লে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ঘুরি বংশ সে স্থান দখল করে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষায় অগ্রণী হলো। 

গজনী বংশের যেমন সুলতান মাহমুদ, ঘুরি বংশের তেমনই মুহম্মদ বিন সাম। ‘মুঈনউদ্দীন’ ও ‘শিহাবুদ্দীন’ তাঁর উপাধি। ইনিই ভারতবর্ষের ইতিহাসে শিহাবউদ্দীন মুহম্মদ ঘুরি নামে সুপরিচিত। সুলতান মাহমুদ গজনবীর ভারত—মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই বোধ করি শিহাবউদ্দীন মুহম্মদ ঘুরির আবির্ভাব হয়েছিল। 

সবকিছু দেখেশুনে মনে হয় সুলতান মাহমুদের অসমাপ্ত মিশনকে সমাপ্ত করার জন্য বিধাতা তাঁকে হিঁদুস্তানে প্রেরণ করেছিলেন। 

পৌত্তলিক নৃপতিদের বিরুদ্ধে সুলতান মাহমুদের যে ভূমিকা ছিল, মুহম্মদ ঘুরিও হিঁদুস্তানে সে ভূমিকাই পালন করে গিয়েছেন। পঞ্জাব, মুলতান, গুজরাট, কনৌজ, দিল্লি, আজমীর, বুন্দেলখণ্ড, বাংলা, বিহার সর্বত্রই তিনি শান্তি মিশন পরিচালনা করেছিলেন। এসব মিশন পরিচালনা ভারতের ইতিহাসে তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি বলে স্বীকৃতিলাভ করেছে। বিশেষ করে, আজমীর বিজয় তাঁর জীবনের এক অক্ষয় কীর্তি বলে পরিগণিত হবে। আর তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর কুতুবউদ্দীন আইবকের আরেক বিশ্বস্ত অনুচর ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বিহার ও বঙ্গবিজয়—ভারত—ভূখণ্ডে ইসলামের অবিস্মরণীয় বিজয় বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবে একথাও সত্য যে, সুলতান মাহমুদ ও ঘুরির দেশ—বিজয়ের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। সুলতান মাহমুদ ছিলেন অপরাজিত বীর——মুজাহিদ ও গাজী; কিন্তু ঘুরি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরাজয় বরণ করেছিলেন কিন্তু সে পরাজয় ছিল তাঁর জয়ের পূর্ব—লক্ষণ। পিছিয়ে এসে দীর্ঘ লাফ দেয়ার সাথেই তার তুলনা করা যায়। মুহম্মদ ঘুরি তাই—ই করেছিলেন। 

ঘুরির ভারত অভিযানের—বলাবাহুল্য, শান্তি মিশন পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো তরাইনের যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে সমরাভিযান। তরাইনের প্রথম যুদ্ধে রাজপুত বাহিনীর বিরুদ্ধে পরাজয় ছিল প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় যুদ্ধে তাঁর বিজয়েরই আলামত। বাস্তবিকই তাই হয়েছিল—তিনি যেমনটি আশা করেছিলেন। তারপর মীরাট, কোল, দিল্লি, কনৌজ, কালিঞ্জর ইত্যাদি বিজয়—প্রকৃতপক্ষে, ভারতে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ পদক্ষেপ ব্যর্থ হবার কথা ছিল না—হবারও নয়। কারণ, এ যুগের কবির কথায়—‘আল্লাতে যার পূর্ণ ইমান কোথা সে মুসলমান।’ বলাবাহুল্য, তাঁরা ছিলেন পূর্ণ ইমানের অধিকারী সাচ্চা মুসলমান। বাতিলপন্থীদের যত সামরিক ক্ষমতাই থাকুক না কেন, ইসলামের শান্তি মিশনের সাথে সংঘর্ষে পর্যুদস্ত হওয়াটাই ছিল প্রাকৃতিক বিধিবিধানের অংশ। 

এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় একটু সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করা একান্ত আবশ্যক। এ পর্যন্ত ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার কায়েমের ক্ষেত্রেও তিন বীর মুজাহিদের অবদান কারও চেয়ে খাটো করতে চাই না। প্রকৃতপক্ষে, এ ছিল বিজয়ের ধারাবাহিকতায় তিনটি মনজিল। প্রথম মনজিলে ছিলেন মহাত্মা গাজী মুহম্মদ বিন কাসিম, দ্বিতীয় মনজিলে ছিলেন মহাত্মা গাজী সুলতান মাহমুদ আর তৃতীয় মনজিলে ছিলেন মহাত্মা গাজী শিহাবউদ্দীন মুহম্মদ ঘুরি। প্রথম জন ছিলেন আরব, পরবর্তী দু’জন তুর্কি—বলাবাহুল্য তরুণ তুর্কি। এ মহাত্মাদের বিপুল বিজয়াভিযান সিঁদুস্তান ভূখণ্ডে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার যেমন কায়েম করে, তেমনই পৌত্তলিক ভারতে ইসলামের বিজয় পতাকাতলে ইসলামের সুশীতল শান্তিবাতাস প্রবাহের পথ প্রশস্ত করে, মুসলমানদের বসবাসের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। এভাবে এ ভূখণ্ডে ইসলামের এক দীর্ঘস্থায়ী বিজয় সূচিত হয়। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য যে, মুহম্মদ বিন কাসিম ও সুলতান মাহমুদ ভারতে ধারাবাহিক ও স্থায়ী মুসলিম শাসনব্যবস্থা ঠিক পুরোপুরি কায়েম করে যেতে পারেননি; সে কাজটি সম্পন্ন করেন মুহম্মদ ঘুরি। বাস্তবিকই ভারতে স্থায়ী মুসলিম রাজ কায়েমের মধ্য দিয়ে ভারত—ইতিহাসে তিনি তিনি চিরস্থায়ী সম্মানের অধিকারী হয়ে গেলেন। 

সাত. 

মুহম্মদ শিহাবউদ্দীন ঘুরির ভারত বিজয়ের সাথে, ভারতে ইসলামের আধ্যাত্মিক মিশন পরিচালনার ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মুহম্মদ ঘুরির ভারতাভিযানের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমান আধ্যাত্মিক মিশনারিরা ইসলাম প্রচারে বাতিলপন্থীদের দ্বারা বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিলেন। অতীতে যেমন হয়েছিলেন—ইসলামের নবি—রসুলেরা! পৌত্তলিকতার অন্যতম ও শক্তিশালী ঘাঁটি ভারতে নায়েবে রসুলেরা ইসলাম প্রচারে প্রাণঘাতী বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আর এ বাধ্য অপসারণ করে ইসলামের শান্তির ধারাকে নিষ্কণ্টক করার জন্য ভারতে বারবার সমর—মিশন পরিচালনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। তখনও পর্যন্ত এ সমর—মিশন পরিচালনার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছিলেন ইসলামের উপর্যুক্ত তিন বীর মুজাহিদ। 

শিহাবউদ্দীন মুহম্মদ ঘুরির সাথে ভারতে ইসলামের আধ্যাত্মিক মিশন পরিচালনার ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে ঘুরির বিজয় প্রকৃতপক্ষে এ ভূখণ্ডে ইসলামের আধ্যাত্মিক বিজয়ের পথকেও সুগম করেছিল। এ বিজয়ের মধ্য দিয়েই রাজস্থান প্রদেশের আজমীরে ইসলামি আধ্যাত্মিক মিশনের শান্তির বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন সুলতানুল হিন্দু খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি সঞ্জরী রহমাতুল্লাহ আলাইহে। বলাবাহুল্য, তৎকালীন আজমীর এলাকার শাসক পৃথ্বিরাজ চৌহান তাঁর আধ্যাত্মিক মিশনকে বারবার বাধাগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ যাঁর ললাটে হিঁদুস্তানের আধ্যাত্মিক সম্রাট হওয়ার সৌভাগ্যচিহ্ন অঙ্কন করে দিয়েছিলেন, সেখানে হিঁদুস্তানের একজন প্রাদেশিক শাসকের ঔদ্ধত্য কীভাবে টিকে থাকতে পারে? পর্যুদস্ত ও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলেন পৃথ্বিরাজ চৌহান। সেই আজমীর আজ পৃথ্বিরাজ চৌহানের জন্য নয়, খাজা মঈনউদ্দীন চিশতির কারণেই পুণ্যতীর্থক্ষেত্রে পরিণত বিগত হাজার বছর ধরে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ সে পুণ্যতীর্থক্ষেত্রে এসে সেই মহাসাধকের স্পর্শপদ—ধন্য—ধূলিকণা মাথায় করে নিয়ে যায়। 

এ প্রসঙ্গে হিঁদুস্তানে ইসলামের আধ্যাত্মিক মিশন পরিচালনার ধারায় চার মহাপুরুষের নাম অতীব শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে। এঁরা হলেন খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি, খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকি, খাজা ফরীদউদীন মাসউদ গঞ্জশকর ও হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া রহমাতুল্লাহ আলাইহে। 

হিঁদুস্তানে মুসলমানদের রাজনৈতিক মিশনের সাথে—সাথেই আধ্যাত্মিক মিশনের ধারা এ মহাপুরুষেরা সুযোগ্য নেতৃত্বের দ্বারা এগিয়ে নিয়ে চলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ওই রাজনৈতিক পটভূমিকায় এ মহাপুরুষদের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত আলোচনা করা হবে। এর ফলে, তৎকালীন হিঁদুস্তানের রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক পটভূমি, পরিবেশ ও পরিস্থিতি বুঝতে সহজ হবে। 

চিশতিয়া তরিকার পীর, মহান বুজুর্গ ও ইসলামের নৈতিক—আধ্যাত্মিক দর্শনের মহান প্রচারক খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি ১১৪২ খ্রিষ্টাব্দে সাজিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন প্রসিদ্ধ সাধক খাজা গিয়াসউদ্দীন হাসান চিশতি। তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে মহানবির (স) দৌহিত্র হজরত ইমাম হুসেনের (রা) বংশধর। মহাত্মা খাজা বিদ্যাশিক্ষা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে অনেক দেশ ভ্রমণ করেন। তবে প্রথমে গিয়েছিলেন সমরখন্দে। সেখানে তিনি পবিত্র কুরআন মজীদের ত্রিশ পারা সম্পূর্ণ মুখস্ত করে নেন এবং ইসলামি জ্ঞানার্জনের সাধনায় নিয়োজিত হন। তারপর তিনি প্রসিদ্ধ সাধক হজরত খাজা উসমান হারুনীর (র) শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সেখান থেকে নিজ পীরের সাথে তিনি দামিশক সফর করেন। সেখানে ইসলামের আধ্যাত্মিক সাধকদের বড় একটি জামাতের সাথে তাঁর দেখা হয়ে যায়। তাঁরা সকলেই আল্লাহর ধ্যানে এমনভাবে মশগুল ছিলেন যে, তা দেখে তাঁর হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়। বলাবাহুল্য, তা থেকে তিনি আল্লাহ প্রেমের এক গভীর মাদকতা অনুভব করেন এবং উপযুক্ত সুফল লাভে সমর্থ হন। সেখান থেকে তিনি মক্কা মুআজ্জমা ও মদিনা মুনাওয়ারার উদ্দেশে রওনা হন। সে সময়েও তাঁর পীর খাজা উসমান (র) তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। তাঁর পীর খাজা উসমান আধ্যাত্মিক শিক্ষালাভে পাকা—পোক্ত করে দিয়ে তাঁকে হিঁদুস্তানের উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিক মিশন পরিচালনার জন্য পাঠিয়ে দেন। মঈনউদ্দীন পীরের আদেশপ্রাপ্ত হওয়ার পর প্রথমে মাতৃভূমি সাজিস্তান এবং সেখান থেকে একটি আধ্যাত্মিক দল নিয়ে হিরাট, বলখ ও গজনী হয়ে হিঁদুস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং অচিরেই দিল্লি এসে পৌঁছান। 

দিল্লি থেকে ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ৪০ জন সাথি নিয়ে তিনি আজমীরের নিকটবর্তী স্থানে এসে পৌঁছান। রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানের রাজকর্মচারীদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেখানেই কিছুকাল অবস্থান করেন। কিন্তু এ আধ্যাত্মিক দলের সন্তোষজনক আচরণে খুশি ও নিঃসন্দেহ হয়ে তাঁদের ছেড়ে দিলে তাঁরা আজমীরে এসে পৌঁছান। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাঁরা একটি আশ্রয়—শিবির গড়তে চাইলে বারবার বাধার সম্মুখীন হতে থাকেন। 

এসব বাধাই অবশেষে পৃথ্বিরাজ চৌহানের কাল হয়ে দাঁড়ায়। রাজস্থানের আজমীরের মাটিতে হিঁদুস্তানের যে সুলতান তাঁর আধ্যাত্মিক শান্তির ছত্র ধরতে চেয়েছিলেন, তাই বাস্তবায়িত হলো কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল পৃথ্বিরাজের ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কার। একইভাবে, সেখানে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক অধিকার যেমন কাযেম হলো, তেমনি কায়েম হলো মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। 

খাজা মঈনউদ্দীন চিশতির (র) আধ্যাত্মিক উত্তাধিকারের দায়িত্ব অর্পিত হয় তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য ও অনুচর খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর (র) উপর। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত আলোচনার পূর্বে আবারও আমরা হিঁদুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করব। 

মুঈজউদ্দীন বিন সাম বা মুহম্মদ ঘুরি ভারতে পাকাপোক্তভাবে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার কায়েম করার পর তার উত্তর—দায়িত্বের ভার তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর ও দাস সেনাপতি কুতুবউদ্দীন আইবকের হস্তে অর্পণ করে আপন রাজ্যে ফিরে যান—সেই সাথে তাঁকে দাসত্বের শৃঙ্খল হতে মুক্তির সনদ দিয়ে যান। সুযোগ্য সেনাপতি ও বিশ্বস্ত অনুচর কুতুবউদ্দীন আইবক অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে সে সাম্রাজ্যের হাল ধরেন এবং অনিতিবিলম্বেই দিল্লিতে মুসলিম রাজত্বের গোড়াপত্তন করে তাকে রাজধানীর মর্যাদায় উন্নীত করেন। এক মহিমান্বিত সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী রূপেও দিল্লিতে মুসলিম—রাজ্যের রাজধানী কায়েম তাঁর জীবনের একটি অতীব উজ্জ্বল ও মহৎ কীর্তি। মুহম্মদ ঘুরি যাঁকে দাসত্বমুক্তির সনদ দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরই দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ দুর্ভাগ্যক্রমে ইতিহাসে দাসবংশ রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কিন্তু নির্ভুল ও নির্মোহ ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে সে বংশকে দাসবংশ বলে মেনে নেওয়া যায় না। কুতুবউদ্দীন আইবক ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে যে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ইতিহাসে তা দাসবংশরূপে সুপরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল একজন স্বাধীন নৃপতি কর্তৃক এক স্বাধীন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা। সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবকের অমর কীর্তি হলো নূর কুতুবুল আলম খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর নামে নামাঙ্কিত কুতুবমিনার প্রতিষ্ঠা। প্রকৃতপক্ষে, এ কুতুব মিনার হলো মুসলমানদের দিল্লি বিজয়ের স্মারক। মহাত্মা কুতুবউদ্দীনের নামে তা উৎসর্গিত ও নামাঙ্কিত করা হয়। 

এখন মহান সাধক খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা আবশ্যক। কারণ খাজা মুঈনউদ্দীন চিশতির (র) খলিফা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর বৃত্তান্ত এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, রাজনৈতিক মিশনের সাথে সাথেই হিঁদুস্তানের মাটিতে ইসলামের আধ্যাত্মিক মিশন সমভাবে কার্যকর ছিল। 

খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (র) মাওরাউন নহর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। দেড় বছর বয়সে পিতৃহীন হলে তাঁর মা তাঁকে শিক্ষিত করে তোলেন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মওলানা আবু হাফস ওশীর অধীনে তিনি শিক্ষা সমাপন করে বাগদাদে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন তারপর তাঁর পীর—মুর্শিদের নির্দেশে হিঁদুস্তানে গমন করে দিল্লিতে এসে আধ্যাত্মিক শিবির স্থাপন করেন। সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন; তা সত্ত্বেও রাজদরবার ও রাজনীতির সাথে তিনি কোনো রকমের সম্পর্ক রেখে চলেননি। দিল্লি মহানগরের কিলোঘরী নাম স্থানে মালিক ইজজুদ্দীনের নামে নামাঙ্কিত মসজিদের নিকটে তিনি ত্যাগী ফকিরের ন্যায় জীবন অতিবাহিত করেন কিন্তু কোনো দিন কোনো অবস্থাতেই সুলতানের দরবারের হাজিরির খেয়াল তার মনে কখনো আসেনি; কিন্তু সুলতান আলতামাশ তাঁর খানকাহ দরবারে নিয়মিত হাজিরা দিতেন। 

মহত্মা খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর দিল্লি আগমনের কয়েক দিন পরেই দিল্লির প্রসিদ্ধ সাধক শায়খ—উল—ইসলাম মওলানা জামালউদ্দীন বুস্তামির (র) ইন্তিকাল হয়ে যায়। মওলানা বুস্তামির ইন্তিকালের পর সুলতান আলতামাশ ‘শায়খ—উল—ইসলাম’ খেতাব খাজা বখতিয়ার কাকীকে (র) দিতে চাইলে তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। পরে দিল্লির আরেক মহান সাধক শেখ নজমউদ্দীন সুগরাকে (র) ঐ খেতাব দিয়ে সম্মানিত করা হয়। 

খাজা বখতিয়ার কাকী দিল্লিতে অবস্থান করেই তাঁর আধ্যাত্মিক মিশন জারি রাখেন। একদা মহাত্মা খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি যে আধ্যাত্মিক শিক্ষার শান্তিবৃক্ষ আজমীরে রোপণ করেন তাঁর উপযুক্ত শিষ্যসামন্তদের দ্বারা তা হিন্দুস্ত ানের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছায়াদার শান্তিবৃক্ষের ন্যায় ছায়া প্ৰদান করতে থাকল। 

মহাত্মা খাজা বখতিয়ার কাকীর নাম হিঁদুস্তানের ইসলামি আধ্যাত্মিক মিশন পরিচালনার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর সেই মহান সাধকের নামে নামাঙ্কিত মুসলমানদের হিঁদুস্তান বিজয়ের স্মারক রূপে কুতুবমিনার নাম ধারণ করে জগতে অক্ষয় হয়ে অবস্থান করবে। 

আট. 

হজরত খাজা মুঈনউদ্দীন চিশতি (র) আজমীর শরীফে চিশতিয়া তরিকার আধ্যাত্মিক সাধনার সিংহাসন প্রতিষ্ঠা করে হিঁদুস্তানের মাটিতে তাঁর আধ্যাত্মিক সালতানাত কায়েম করে হিঁদুস্তানের জনগণের হৃদয়ের উপর তাঁর অলৌকিক আধ্যাত্মিক শাসন জারি করেছিলেন। জাতি—ধর্ম—নির্বিশেষে আজমীর আধ্যাত্মিক সাধনার এক মহান তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়ে যায়। মহাত্মা খাজা তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার ও শিক্ষার উত্তর—দায়িত্ব অর্পণ করেন খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর (র) উপর। এ মহাত্মা দিল্লিতে তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষার খানকাহ—রূপ সিংহাসন স্থাপন করে সেখানে ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করে দেন। এভাবে দিল্লি মুসলমানদের রাজনৈতিক রাজধানীর মর্যাদা লাভের সাথে সাথে আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্ররূপে তার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করল। 

এদিকে দিল্লিতে আধ্যাত্মিক শিক্ষাক্রম জারি রইল আর ওদিকে রাজনৈতিক পালাবদলের কাজ সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলল। দিল্লিতে মুসলিম রাজ প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দীন আইবেকের ইন্তিকাল হওয়ার পর তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল চলল কিছুকাল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ—যা দাসবংশ রূপে পরিচিত হয়ে আছে; সুলতান কুতুবউদ্দীনের ইন্তিকালের পর তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে কিছুদিন টালমাটাল চলে; কিন্তু এর অল্পকাল পরেই বদায়ুনের প্রশাসক ও তাঁর জামাতা শামসুদ্দীন আলতামাশ অনতিবিলম্বেই দিল্লির রাজনৈতিক উত্তরাধিকার গ্রহণ করেন। সুযোগ্য, জ্ঞানী, দূরদর্শী, অসাধারণ সাহসী—সর্বোপরি প্রাজ্ঞ কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদ আলতামাশ দিল্লি—কেন্দ্রিক মুসলিম সাম্রাজ্যকে সুগঠিত করেন, সার্থক অর্থনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা কায়েম করে রাজ্যের অধিবাসীদের সুখশান্তি সুনিশ্চিত করেন। সে সময়ে ভারতের উত্তর—পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে বারবারই মোঙ্গলদের ঝটিকা আক্রমণের তুফান আসছিল। সে সব ভয়াবহ আশঙ্কা থেকে ভারতকে মুক্ত রেখে তিনি দেশের জনগণের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেন। সুলতান আলতামাশের বঙ্গবিজয় সে সময়কার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনার পরে বঙ্গদেশ দিল্লির অধিকারে আসে এবং সেখানকার পৌত্তলিক সমাজ ও বাতিলপন্থী শাসকদের কবল থেকে বঙ্গ—ভূখণ্ডের এক—একটি এলাকা অধিকার করে সেখানে ইসলামের বিজয়—পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করে—আধ্যাত্মিক শান্তিসুধার সুশীতল বারি সিঞ্চনের ব্যবস্থা করে তাদের ইহপরকালের মুক্তির পথ প্রদর্শন—এসব বিজয়কে মহিমান্বিত করে। 

উল্লেখ্য যে, ভারতের রাজপুত রাজা ও প্রজারা মুসলমান শাসক ও প্রশাসকদের সাথে বারবারই বেয়াদপি, বিদ্রোহ ও ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে থাকলে, তাদের সে বেয়াদপি ও বর্বরতার উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য তাদের উদ্দেশে বারবার সামরিক মিশন পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আলতামাশের পূর্ববর্তী শাসকদের যেমন—তেমনই সুলতান আলতামাশেরও তাদের বিরুদ্ধে সামরিক মিশন পরিচালনা করতে হয় উচ্ছৃঙ্খল ও বর্বর রাজপুতদের দমন করে সেখানে শান্তি ও সুস্থিতি প্রতিষ্ঠাকল্পে। সে উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করে তিনি রণথম্ভোর, গোয়ালিয়র ও মালব অধিকার করেন। 

সামরিক তেজস্বিতা, দুর্নিবার সাহস ও অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী সুলতান সামসুদ্দীন আলতামাশ ভারতে একটি সুসংগঠিত ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মুসলমান জনগোষ্ঠী গড়ে তুলে এ উপমহাদেশে তাদের শান্তিতে বসবাস করার ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে গিয়েছেন। উপমহাদেশের ইতিহাসে তাঁর অবদান অনেক। তিনি ছিলেন ধার্মিক, দয়ালু, বিচক্ষণ শাসক; বিদ্যোৎসাহী ও স্থাপত্যশিল্পের অনুরাগী। ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রথম স্থপতি কুতুবউদ্দীন আইবক দিল্লির প্রসিদ্ধ সাধক কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর নামে নামাঙ্কিত যে বিজয়—স্মারক বা কীর্তিস্তম্ভ—যা কুতুবমিনার নামে পরিচিত—তা নির্মাণের কাজ শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেননি; তা সম্পন্ন করেন মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্যতম সার্থক উত্তরসূরি সুলতান শাসুদ্দীন আলতামাশ। আজমীরের অপূর্ব সুন্দর মসজিদ—যা ইসলামি স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন, তা তাঁরই অমর কীর্তি। তিনিই প্রথম মুসলমান শাসক যিনি ভারতীয় মুদ্রা—ব্যবস্থায় প্রথম আধুনিকতা আনয়ন করেছিলেন, স্বর্ণমুদ্রায় আরবি হরফে পবিত্র কলেমা খচিত মুদ্রাব্যবস্থা তাঁর অমর কীর্তি। সুলতান আলতামাশের শাসনকালকে ভারতের প্রাথমিক যুগের তুর্কি শাসনের শ্রেষ্ঠ কাল বলে অভিহিত করা হয়। 

সময়ের চলমান ধারায় একের পর এক পালাবদলের পালা আসে। সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ সময়ের চলমান ধারায় অন্তর্হিত হলে তাঁর স্থলে এলেন রুকনউদ্দীন ফিরোজ শাহ। কিন্তু তিনি অপসারিত হলেন। পরে এলেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা সুলতানা রাজিয়া। কিন্তু অপ্রিয় হলেও একথা সত্য যে, রাজনৈতিক ক্ষমতার রাজপথ জগতে কোনো কালেও কুসুমাস্তীর্ণ থাকেনি; সব সময়েই তা কণ্টকাকীর্ণ। সে কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে পদদ্বয় স্বতই হয় ক্ষতবিক্ষত—হৃদয় হয় রক্তাক্ত; কিন্তু সে পথ অতিক্রম করে নিজেদের যারা আসীন রাখতে সমর্থ হন—তাঁরা হন অসাধারণ বীর বীরভোগ্যা বসুন্ধরা তাদেরই পদানত হয়। 

প্রবল প্রতাপান্বিত সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ—এর ইন্তিকালের পর তাঁর সমকক্ষ উত্তরাধিকারী না থাকায় দিল্লির রাজনৈতিক রাজপথ আবার কণ্টকাকীর্ণ হলো এবং হৃদয় রক্তাক্ত হলো। এভাবে তাঁর ইন্তিকালের ত্রিশ বছরের মধ্যে চারজন সুলতানের ক্রম অতিবাহিত হয়ে গেল। 

এদিকে দিল্লিতে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের ক্রম জারি রইল, অন্যদিকে হিঁদুস্তানের মাটিতে ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার ক্রমও সমভাবে জারি রইল। এঁরা উভয়েই সম্রাট। কেউ কায়েম করেন রাজনৈতিক শাসন, কেউ কায়েম করেন আধ্যাত্মিক শাসন। উভয়ই শাসক; তবে একে অন্যের পরিপূরক। 

দিল্লিতে মুসলমানদের রাজনৈতিক রাজধানী স্থাপনের সাথে সাথেই সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল। নূর—কুতুবুল আলম কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর নামে উৎসর্গিত কুতুবমিনার সে রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিজয়ের স্মারকরূপে ইসলামের মর্যাদা সমুন্নত রাখল। এভাবেই সেখানে রাজনৈতিক উত্থান—পতনের সাথে সাথে আধ্যাত্মিক পরম্পরাও সমভাবে জারি রইল। 

সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশের তিরোধানের পর প্রায় ৩০ বছর ধরে রাজনৈতিক ছত্র উড্ডীন রাখার পর রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে গেল গিয়াসউদ্দীন বলবনের উপর। তিনি ২১ বছর তাঁর শাসন কায়েম রাখেন। তুর্কি বংশোদ্ভূত সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন পূর্বের স্বনামধন্য সুলতানদের রবদবা ও তাঁদের সামরিক মিশন পরিচালনার ধারা অব্যাহত রাখতে সমর্থ হন এবং একটি সুস্থিত কেন্দ্রীয় শাসন কায়েমের পথে সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর একুশ বছরের শাসনব্যবস্থার অন্যতম উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো স্বদেশীয় বিদ্রোহীদের দমন ও মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহতকরণ। এভাবেই তিনি এ দেশের জনগণকে সুস্থ ও স্বাধীনভাবে বাঁচার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এদিকে দিল্লিতে যখন এই রাজনৈতিক ক্রমধারা বিরাজমান, অন্যদিকে তেমনি আধ্যাত্মিক ক্রমধারা অতিদ্রুত সমস্ত হিঁদুস্তানের হৃদয় জয় করার পথে অগ্রসরমান। 

ন্যায়বিচারক, সুদক্ষ শাসক, জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ও ধার্মিক সুলতান বলবনের হাতে এদেশে মুসলমানদের রাজনৈতিক শক্তি আরও সুসংহত হয়ে ওঠে 

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন যে, সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১২৬৬—১২৭৭ খ্রি.) বিরাট ছত্র ধরে দিল্লিতে ২০ বছর যাবত তাঁর শাসনকার্য অব্যাহত রাখেন। তারপরেই ক্ষমতাসীন হন সুলতান গিয়াউদ্দীন বলবন ( ১২৬৬—১২৮৭ খ্রি.)। এ সময়কালের মধ্যে ইসলামের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির ধারাবাহিক ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করা একান্ত আবশ্যক। 

নয়.

হজরত খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী রহমাতুল্লাহি আলাইহে তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও সাধনার খিলাফত বা উত্তরাধিকার মনোনীত করে যান হজরত খাজা ফরীদউদ্দীন গঞ্জশকর রহমাতুল্লাহ আলাইহেকে 

ইনি ছিলেন পরবর্তী ভারতের আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার পীর বা আধ্যাত্মিক আচার্য। আলোচ্য গ্রন্থে তাঁর প্রসঙ্গ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লিখিত হলেও তা হবে খুবই কিঞ্চিৎ। এখানে তাঁর জীবন ও সাধনা বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা একান্ত আবশ্যক। লক্ষণীয় যে, চিশতিয়া পরম্পরার পীর খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি তাঁর উত্তরাধিকার মনোনীত করেছিলেন খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীকে (র), তিনি উত্তরাধিকার মনোনীত করেন খাজা ফরীদউদ্দীন গঞ্জশকরকে (র), তিনি উত্তরাধিকার মনোনীত করেন খাজা নিজামউদ্দীন আউলিয়াকে (র)। 

মহাত্মা খাজা ফরীদউদ্দীন ৫৬৯ হিজরি মোতাবেক ১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দাদা কাজী শুয়াইব তাতারী আক্রমণের ডামাডোলের মধ্যে মাতৃভূমি কাবুল ত্যাগ করে পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোরে এসে বসতি স্থাপন করেন। সেখানেই তিনি একটি জায়গর লাভ করেন। খুব ছোট বয়সে শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তৎকালের বিখ্যাত ইলমি শিক্ষাকেন্দ্র মুলতানে চলে যান। সেখানকার দ্বীনি—মারকাজে থেকে সেখানকার বড় বড় উস্তাদদের কাছে তিনি দ্বীনি—শিক্ষা হাসিল করেন। তিনি মওলানা মিনহাজউদ্দীন তিরমিজির কাছে ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ওখানেই তিনি ৫৮৪ হিজরি সনে খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর (র) দর্শন লাভ করেন এবং ওখানেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তারপর শুরু হয় তাঁর কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনার জীবন। হিঁদুস্তান ও তার বাইরে থেকে তিনি শিক্ষা সমাপন শেষে নিজ আধ্যাত্মিক আচার্যের সেবায় দিল্লি এসে উপস্থিত হন। সেখানে গজনৈর দরওয়াজার কাছে একটি স্থান নির্বাচন করে তিনি গভীর আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত হন। এ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার পর তাঁর পীর খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী (র) তাঁকে তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেন। গুরুর আদেশে তিনি হাঁসী অভিমুখে রওনা দেন। ইতোমধ্যেই শেখের ইন্তিকাল হয়ে গেলে তিন দিনের মাথায় তিনি দিল্লি ফিরে এসে তাঁর মাজারে ফাতিহা পাঠ করেন। কাজী হামিদুদ্দীন নাগৌরী (র) শেখের অসিয়ত মোতাবেক তাঁকে খিরকা ও উত্তরদায়িত্বের আমানত প্রদান করেন। কৃতজ্ঞতাসূচক নফল নামাজ পড়ে শেখের সাধনার উত্তরাধিকারীরূপে তিনি তাঁর স্থানে সমাসীন হন। তারপর তিনি পুনরায় হাঁসী অভিমুখে রওনা দেন। সেখান থেকে রওনা দেন অযোধানে—যার বর্তমান নাম পাকপত্তন। এটি এখন পাকিস্তানের পঞ্জাবের মন্টোগোমারী জেলার অন্তর্গত একটি বিখ্যাত স্থান। এখানে রয়েছে তাঁর মাজার ও খানকাহ শরীফ—যেটি আজমীর ও দিল্লির মতো এক আধ্যাত্মিক তীর্থক্ষেত্ররূপে তার মর্যাদা সমুন্নত রেখেছে। হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া (র) হলেন সেই মহাত্মারই আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি। আর তাঁর শিষ্য ছিলেন সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক। মুহম্মদ তুগলক খাজা ফরীদউদ্দীন গঞ্চশকরের মাজারে সুদৃশ্য গম্বুজ বানিয়ে দেন। 

এসব পর্যালোচনায় দেখা গেল যে, খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি হিঁদুস্তানের মাটিতে ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার যে ধারা শুরু করেছিলেন, শিষ্য পরম্পরা তা শেখ নিজামউদ্দীন আউলিয়া পর্যন্ত প্রসারিত হলো। তারপর, তাঁর ও নানা শিষ্য—পরম্পরায় প্রায় হাজার বছর ধরে হিঁদুস্তানের মাটিতে তার ধারা অব্যাহত রয়ে গেল। 

দশ. 

১২৪৬ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের সিংহাসনারোহণের পর তিনটি রাজবংশের আট জন সুলতান দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তাঁদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ অব্যাহত রাখেন। হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের আমলে দিল্লিতে আসেন এবং ১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ বিন তুগলকের সিংহাসনারোহণের প্রথম মাস পর্যন্ত তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষার ধারা অব্যাহত রাখেন। নিজামউদ্দীন আউলিয়া দিল্লিতে পঞ্চাশ বছর অবস্থান করেন এবং এসব রাজাবাদশাহদের আগমন—নির্গমনের ধারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন—কিন্তু মনের ভুলেও রাজ্য ও রাজনীতির প্রতি চোখ তুলেও তাকাননি। এখন আমরা সংক্ষেপে দিল্লির রাজনৈতিক উত্থান—পতন নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হব। 

হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার তিরোধানের বেশ কয়েক বছর পর বিখ্যাত আরব পর্যটক ইবনে বতুতা দিল্লিতে আসেন। তিনি হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার শিষ্য মুহম্মদ বিন তুগলকের শাসনাধীনে দিল্লিতে প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেন। এখানে তিনি আট বছরেরও অধিককাল অবস্থান করে রাজসেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তাঁর জীবনের এ সময়কার কথা বিশ্ববিখ্যাত ‘সফরনামা’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। তিনি সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবক থেকে শুরু করে মুহম্মদ বিন তুগলক পর্যন্ত ধারাবাহিক রাজনৈতিক ইতিহাস তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। সে গ্রন্থটি ঐ যুগের ইতিহাসের এখানা বিশ্বস্ত দলিল বলে স্বীকৃত। আমি পরম আগ্রহভরে সে গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ সম্পন্ন করি। ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার বৃত্তান্ত অত্যন্ত সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। মূল গ্রন্থ থেকে তা এখানে উদ্ধৃত করছি—‘দিল্লিতে ওলী (হজরত) নিজামউদ্দীন বাদায়ুনী বসবাস করতেন। জুনাহ খাঁ সর্বদাই এই মহাপুরুষের সেবায় উপস্থিত থেকে তাঁর আশীর্বাদের অভিলাষে দিন অতিবাহিত করতেন। একদিন তিনি হজরতের সেবকদের বললেন, তিনি যখন আল্লাহর উপাসনায় গভীরভাবে নিমগ্ন থাকবেন তখন তা আমাকে জানাবে। একদিন হজরতকে এ অবস্থায় দেখে তারা যুবরাজকে তা জানিয়ে দিলেন। সংবাদ পেয়েই তিনি অতিদ্রুত হজরতের সেবায় উপস্থিত হলেন। শেখ তাঁকে দেখামাত্রই বললেন, ‘আমরা তোমাকে সাম্রাজ্য প্রদান করলাম। এ সময়ের মধ্যে শেখের তিরোধানও হয়ে গেল। তাঁর মৃতদেহ যুবরাজও নিজ স্কন্ধে বহন করলেন।’ 

ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে সে সময়কাল হিঁদুস্তানের অনেক প্রসিদ্ধ সাধকের কথা বর্ণনা করে গিয়েছেন। হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার পীর হজরত খাজা ফরীদউদ্দীন গঞ্জশকরের কথাও তিনি তাঁর গ্রন্থে লিখে গিয়েছেন। তাঁর সাথে ইবনে বতুতার সাক্ষাৎও হয়েছিল। ইবনে বতুতা তাঁর সম্পর্কে অত্যন্ত সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন—‘এটি (অযোধন—বর্তমান নাম পাকপট্টন) শেখ ফরীদউদ্দীনের (বদায়ুনী) স্মৃতিবিজড়িত একটি ছোট্ট অথচ সুন্দর এক নগর। শেখ বুরহানউদ্দীন ইসকান্দারী (আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসী) আমাকে বলেছিলেন, তোমার চলার পথে শেখ ফরীদউদ্দীনের সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে। আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ যে, সত্যিই এখানে তাঁর সাথে আমর সাক্ষাৎ হয়। ইনি ভারত—সম্রাটের পীর। এবং সদাশয় সম্রাট এ নগরটি তাঁকে প্রদান করেছেন। শেখ মহোদয় খুবই সংশয়ী মানুষ; সেজন্য তিনি অপরিচিত কারো সথে মোসাফাহ করেন না; এবং কারো কাছে এসে বসেনও না। কারো বস্ত্র পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেললে হাত ধুয়ে ফেলেন। আমি তাঁর দীওয়ানখানায় এসে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে শেখ বুরহানউদ্দীনের সালাম পৌঁছে দিতেই তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন—‘হয়তো অন্য কাউকে দিয়ে থাকবেন।’ আমি এঁর দু’পুত্রের সাথেও সাক্ষাৎ করলাম। এঁরাও খুবই বিদ্বান ছিলেন। এঁদের নাম ছিল মুঈজউদ্দীন ও ইলমউদ্দীন। মুঈজউদ্দীন ছিলেন জ্যেষ্ঠ এবং পিতার মৃত্যুর পর তিনি সাজ্জাদানশীন হন। এঁদের দাদা শেখ ফরীদউদ্দীন বদায়ুনীর সমাধিতে গিয়েও জিয়ারত সম্পন্ন করি। বদায়ুন সম্ভল নামক এলাকায় অবস্থিত। ওখান থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় ইলমুদ্দীন আমাকে তাঁর পিতার সাথে সাক্ষাৎ করতে বলেন। সে সময়ে তিনি শ্বেতবস্ত্র পরিধান করে ছাদের সবচেয়ে উচ্চস্থানে অবস্থান করছিলেন এবং তাঁর মাথায় বাঁধা পাগড়ির একটা অংশ তাঁর শরীরের একপাশে ঝুলছিল। তিনি আমার জন্য দোয়া করলেন এবং বাতাসা ও মিছরি আমাকে তাবারুক স্বরূপ পাঠিয়ে দিলেন।’ 

তৎকালীন যুগের উপমহাদেশের ইতিহাসের এক আকরগ্রস্থ ও ‘সফরনামা’য় দিল্লির রাজনৈতিক উত্থান—পতনের এক ধারাবাহিক ও রোচক বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ হয়েছে। সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবকের দিল্লিবিজয় থেকে শুরু করে মুহম্মদ বিন তুগলকের রাজত্বকাল পর্যন্ত ধারাবাহিক রাজবৃত্তান্ত তিনি তাতে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। আমরা এখানে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন থেকে মুহম্মদ বিন তুগলক পর্যন্ত শাসকদের ধারাবাহিক বৃত্তান্ত অতি সংক্ষেপে পেশ করার প্রয়াস চালাব। 

ইতোপূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন দিল্লি সাম্রাজ্যকে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল অবস্থায় আনয়ন করেছিলেন, অত্যন্ত ধার্মিক ও বিচক্ষণ সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র কায়কোবাদকে তাঁর উত্তরাধিকারী (১২৮৭ খ্রি.) মনোনীত করে যান। সুলতান বলবন তাঁর পুত্র কায়কোবাদকে দিল্লির সিংহাসনের উপযুক্ত উত্তরাধিকারীরূপেই গড়ে তুলেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, তিনি শাসনকার্যে উপযুক্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন। তাঁর সম্পর্কে ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন—‘মুআজউদ্দীন (কায়কোবাদ) মাত্র চার বছর রাজত্ব করেন। তাঁর আমলের দিনগুলো ঈদ—উৎসবের মতো এবং রাতগুলো শবে—বরাতের মতো ছিল। এ সম্রাট অত্যন্ত দানশীল এবং দয়ালু ছিলেন। তাঁর আমলের যেসব লোকেরা স্বচক্ষে তাঁকে দেখেছিলেন, তাঁরা আমার সাথেও সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা সম্রাটের ধর্মভীরুতা ও দানশীলতার ভুরি ভুরি প্রশংসা করতেন। দিল্লির সুবিখ্যাত জামে মসজিদ—যার মিনার ছিল জগতের অদ্বিতীয়—তিনিই নির্মাণ করান। বিষয়বিত্ত ভোগের সাথে—সাথে অতিমাত্রায় মদিরা পানের কারণে তিনি পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। অনেক হাকিম—বৈদ্য তা নিরাময়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সম্রাটের এ দুরবস্থার সুযোগে নায়েব জালালউদ্দীন ফিরোজ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং নগরের বাইরে ‘কুবা—এ—জায়শানী’ নামক টিলার কাছে শিবির স্থাপন করলেন। এখানে শুধু এতটুকু উল্লেখ করা যথেষ্ট হবে যে, এরপর জালালউদ্দীন সম্রাট হলেন।’ 

এগারো. 

১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে সত্তর বছর বয়সে দিল্লির সিংহানের আরোহণ করেন সুলতান জালালউদ্দীন খিলজি। ঐ বয়সে ক্ষমতাসীন হওয়া এবং শক্ত হাতে সাম্রাজ্যের হাল ধরা অতীব কঠিন কাজ। তা সত্ত্বেও তিনি দিল্লিতে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরদায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের প্রয়াস চালান। তাঁর সিংহাসনে আরোহণ করার পর কতকগুলো উল্লেখযোগ্য ঘটনা সে সময় ঘটে। তিনি রণথম্ভোরে অভিযান পরিচালনা করে সেখানে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে মজবুত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, কেউ তাঁকে এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেন এই বলে যে, তাতে দুর্গমূল্য অপেক্ষা মূল্যবান মানবজীবন বেশি বিনষ্ট হবে। তাঁর রাজত্বকালে তিনি আরও একটি কাজ করেছিলেন, যা শুধু তাঁর জন্য নয়; ভারতের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি তার দ্বারা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মহাত্মা খাজা ফরীদউদ্দীন গঞ্জশকরের বিখ্যাত শিষ্য সে সময়ে ভারতে এসেছিলেন। তুর্কি অমাত্যদের সঙ্গে সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে তাঁকে প্রথমে বন্দী ও পরে হত্যা করা হয়। 

তাঁর রাজত্বকালের আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ১২৯১ খ্রিষ্টাব্দে হালাকু খানের পৌত্র আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ভারত আক্রমণ। বৃদ্ধ সুলতান জালালউদ্দীন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে মোঙ্গলদের ঝটিকাবহ্নিকে নির্বাপিত করে দিয়েছিলেন। পরাজিত অধিকাংশ মোঙ্গল ভারত ত্যাগ করে চলে যায় কিন্তু চেঙ্গিস খানের পুত্র উলুগ খান তাঁর অসংখ্য সমর্থক সহ পবিত্র ইসলাম গ্রহণ করে ভারতেই থেকে যান এবং মুসলমানদের সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে থাকেন। ইতিহাসে এঁরা নও মুসলিম’ নামে সুপরিচিত। দিল্লির উপকণ্ঠে তাঁদের বসবাস করার অনুমতি প্রদান করা হয়। পরবর্তীকালে ঐ এলাকাটি ‘মোগলপুরা’ নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। 

সুলতান জালালউদ্দীন খিলজি সম্পর্কে ইবনে বতুতা লিখেছেন—‘ইনি (জালালউদ্দীন) অত্যন্ত বিদ্বান এবং সহিষ্ণু সম্রাট ছিলেন। এ সহিষ্ণুতার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। … সম্রাটের রুকনউদ্দীন নামে এক পুত্র ও আলাউদ্দীন নামে এক ভাইপো ছিলেন। ইনি সম্রাটের জামাতাও ছিলেন। সম্রাট তাঁকে কড়ামানক পুরের হাকিম (গভর্নর) নিযুক্ত করেছিলেন। ভারতবর্ষে এ এলাকাটিকে অত্যন্ত উর্বর বলে মনে করা হতো।… আলাউদ্দীন অত্যন্ত সাহসী ও বীরপুরুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর পর্যাপ্ত ধন—সম্পদ ছিল না। ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে সম্রাট জালালউদ্দীন খিলজির নিহত হওয়ার বৃত্তান্তটিও বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন—‘একবার তিনি (আলাউদ্দীন) মালব ও মহারাষ্ট্রের রাজধানী দেবগিরিতে আক্রমণ চালালেন। এখানকার হিদুরাজাদের সব রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হতো। অভিযান চালাকালে আলাউদ্দীনের ঘোড়ার পা একস্থানে মাটিতে দেবে যায় এবং সে সাথে ‘টং’ করে আওয়াজ হয়। স্থানটি খোঁড়া হলে সেখানে বহু ধনসম্পদ পাওয়া গেল। এ বিপুল সম্পদ সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হলো। দেবগিরিতে পৌঁছালে সেখানকার রাজা বিনা যুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করে প্রচুর ধন—সম্পদ দিয়ে তাঁকে বিদায় দিলেন। ‘কড়া’য় ফিরে আসার পর আলাউদ্দীন এ সম্পদ সম্রাটের কাছে পাঠালেন না। অমাত্যদের ভয় দেখিয়ে সম্রাট তাঁকে ডেকে পাঠালেন তবু তিনি গেলেন না। পুত্রের চেয়েও প্রিয় হওয়ার কারণে নিজেই তার সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই মতো তিনি সুসজ্জিত হয়ে সসৈন্য ‘কড়া’ অভিমুখে রওনা হলেন। নদীর কিনারে যেখানে মুআজউদ্দীন শিবির স্থাপন করেছিলেন তিনিও সেখানেই শিবির স্থাপন করে নৌকায় চড়ে ভাইপো—র প্রতি অগ্রসর হলেন। 

আলাউদ্দীন অন্য প্রান্ত হতে নৌকায় করে এলেন। তিনি পূর্বেই তাঁর ভৃত্যদের সংকেত দিয়ে রেখেছিলেন। সেই মতো তিনি সম্রাটের সাথে গলা মিলিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় তাঁর ভৃত্যরা পূর্ব—পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁকে হত্যা করল। সম্রাটের কিছু সৈন্য আলাউদ্দীনের পক্ষাবলম্বন করল এবং কিছু সৈন্য দিল্লি অভিমুখে পালিয়ে গেল। সৈন্যরা দিল্লি ফিরে এসে সম্রাটের পুত্র রুকনউদ্দীনকে সিংহাসনে বসিয়ে তাঁকেই সম্রাট বলে ঘোষণা করল কিন্তু এ নবীন সম্রাট তখন আলাউদ্দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন তখন এরাও বিপক্ষীয় বাহিনীতে গিয়ে যোগ দিল। বেচারা রুকনউদ্দীন নিরুপায় হয়ে সিন্ধু অভিমুখে পালিয়ে গেলেন। 

এভাবে খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা জালালউদ্দীন খিলজির জীবনাবসান হলো। তারপর ইতিহাসের গতিধারা আপন পথেই এগিয়ে চলল। ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’—র ভোগী তারাই, যারা তার উপযুক্ত—অসাধারণ এবং প্রবল। রাজনৈতিক পালাবদলের বিচিত্র গতিপথ পেরিয়ে আলাউদ্দীন খিলজি দিল্লির সিংহাসন অধিকার করলেন। এদিকে যখন দিল্লির শাহী—তখতের এ পালাবদল চলছে, ওদিকে দিল্লির সন্নিকটবর্তী স্থানে গিয়াসপুরে হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার আধ্যাত্মিক সিংহাসন স্বমহিমায় বিরাজমান থেকে হিঁদুস্তানের হৃদয় জয় করার মহান সাধনায় নিয়োজিত। 

বারো. 

১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দীন খিলজি দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করার পর অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে কুড়ি বছর দেশ শাসন করলেন। সম্রাট আলাউদ্দীনের জীবন, রাজ্যজয় ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে অত্যন্ত বিশ্বস্ত বিবরণ পেশ করেছেন ইবনে বতুতা। তিনি লিখেছেন—‘রাজধানীতে প্রবেশ করে আলাউদ্দীন বড়ই যোগ্যতার সাথে কুড়ি বছর দেশ শাসন করলেন। তাঁকে এদেশের শ্রেষ্ঠ সম্রাটদের অন্যতম বলে গণ্য করা হয়। হিদুরাও পর্যন্ত তাঁর প্রশংসা করেন। তিনি রাজকার্য স্বয়ং পরিচালনা করতেন। মুহতাসিব নামক কর্মকর্তা—যাঁকে এদেশে ‘রঈস’ বলা হয়—তিনি সম্রাটকে প্রত্যহ এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য সরবরাহ করতেন।’ 

সুলতান আলাউদ্দীনের শাসনামলে ১২৯৬ হতে ১৩০৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট সাত বার মোঙ্গল আক্রমণ সংঘটিত হয়। সম্রাটের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব যে, মোঙ্গলদের এ আক্রমণকে তিনি বারবার পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হন এবং মোঙ্গলদের এমনভাবে পরাজিত করেন যে, তাঁদের দিল্লি অধিকারের স্বপ্ন চিরকালের জন্য ধূলিসাৎ হয়ে যায়। সম্রাট আলাউদ্দীনের সুযোগ্য সেনাপতিদের নেতৃত্বে মোঙ্গলবাহিনী এভাবেই বিধ্বস্ত হয়। সুলতান আলাউদ্দীনের মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধের ঘটনা এ দেশের অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। 

অত্যন্ত সাবধানী, অত্যন্ত হিসেবি ও অত্যন্ত সংশয়ী ব্যক্তি ছিলেন সুলতান আলাউদ্দীন। নিরঙ্কুশ শাসন কায়েম ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েমের জন্য সারা দেশে তিনি গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির শাসক ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রে নিরঙ্কুশ ও দুর্নীতিমুক্ত শাসন কায়েমের জন্য আইন মোতাবেক মৃত্যুদণ্ড দিতেও কুণ্ঠিত হতেন না। সে সময়ে তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য শাসন—সংস্কার ছিল সারাদেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর আইন জারি করেছিলেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণজনিত বিধি ও তজ্জনিত শাস্তির বিধান তিনি শরিয়ত মোতাবেক কার্যকর করতেন। এর ফলে, দেশে একটা ক্রম জারি হয়ে যায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ইবনে বতুতা একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন তাঁর গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন—‘সম্রাট মুহতাসিব—এর কাছে একদিন মাংসের দরবৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলেন। এর জবাবে মুহতাসিব জানালেন যে, মাংসের উপর জাকাত (কর—বিশেষ) আরোপ করার জন্য এমনটি হচ্ছে। সম্রাট ঐদিন এ ধরনের সমস্ত কর প্রত্যাহার করলেন এবং ব্যবসায়ীদের ডেকে রাজকোষ থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ঋণ—স্বরূপ প্রদান করলেন বাজার থেকে গরু—ছাগল ইত্যাদি কেনার জন্য। এ শর্তে তাদের ঋণ দেওয়া হলো যে, বিক্রির পরে কৃতঋণ তারা রাজকোষে জমা দেবে। ব্যবসায়ীদেরও তাদের পারিশ্রমিক বাবদ কিছু বেতন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো। একই প্রকারে দৌলতাবাদ থেকে নিয়ে আসা বস্ত্রাদিও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন। 

খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্রাটের নির্দেশে সরকারি গুদাম খুলে দেওয়া হলো। ফলে, মূল্যবৃদ্ধি রোধ হয়ে গেল। সম্রাট ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী তা বেচাকেনার আদেশ দিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সে আদেশ মানতে অস্বীকার করল। এর ফলে, তিনি সরকারি গুদাম খুলে দিয়ে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ করে দিলেন এবং ছয় মাস যাবত সরকারি মূল্যে খাদ্যশস্য ক্রয়বিক্রয়ের ক্রম জারি রাখলেন। স্বার্থপর ব্যবসায়ীরা তাদের খাদ্যশস্য অবিক্রীত ও নষ্ট হতে দেখে সরকার—নির্ধারিত মূল্যে খাদ্যশস্য ক্রয়বিক্রয়ের জন্য সম্রাটের কাছে প্রার্থনা জানাল। এভাবে সরকার নির্ধারিত মূল্য মেনে নিতে তারা বাধ্য হলো।’ 

ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে সম্রাট আলাউদ্দীনের ধর্মপরায়ণতার এক রোচক বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন—‘সম্রাট কখনো কোনো কিছুতে সওয়ার না হয়ে বাইরে বেরুতেন না; কিন্তু শুক্রবার ও ঈদের দিনগুলোতে তিনি নিজেই পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়তেন।’ 

অত্যন্ত সাবধানী ও সংশয়ী ব্যক্তি ছিলেন সুলতান আলাউদ্দীন। তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় ভাইপো—র আক্রমণে নিহত হতে হতে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁর এ জীবনলাভ শুধু তাঁর জন্য নয়; দেশ ও জাতির জন্যও হয়েছিল মঙ্গলজনক। 

ভারতের মুসলিম শাসনের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘ভারতবর্ষে মুসলিম—প্রভুত্বের স্বপ্নদ্রষ্টা।’ তিনি তাঁর সময়কাল পর্যন্ত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরবর্তীকাল পর্যন্ত শাসক হিসেবে অন্যান্য সুলতানদেরও অতিক্রম করে দিয়েছেন। তিনি নিজে ছিলেন খাঁটি ও গোঁড়া মুসলমান। ভারতীয় মুসলিম মিল্লাতের জন্য জীবন—পণ করা সংগ্ৰামী সুলতান আলাউদ্দীনের নাম ইতিহাস কোনোদিন ভুলতে পারবে না। 

সুলতান আলাউদ্দীন যখন দিল্লির শাসনকর্তারূপে এদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে পাকাপোক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েচ্ছিলেন, সুলতানুল আউলিয়া, আউলিয়াকুলের সম্রাট হজরত নিজাউদ্দীন বদায়ুনী তখন সেখানে তাঁর আধ্যাত্মিক সালতানাতের ছত্র ধরে খ্যাতি ও সাধনার মধ্য গগনে অবস্থান করছিলেন। সুলতান আলাউদ্দীনের রাজসভা অন্যান্য সুলতানদের রাজসভার অন্যতম সভাসদ মহাকবি আমির খসরু তখন হজরত নিজামউদ্দীনের শিষ্যরূপে দিল্লিতে তাঁর কবি—খ্যাতি ও অন্যান্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটানোর সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। তৎকালীন দিল্লির দু’প্রান্তে দুটি দরবার বসত। একটি দরবার ছিল রাজনৈতিক—তার রাজনৈতিক অভিভাবক, সর্বেসর্বা ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর রূপে সম্রাট আলাউদ্দীন সে মসনদ আলো করে অবস্থান করছিলেন; আর অন্যদিকে—দিল্লির অনতিদূরেই গিয়াসপুরে তাঁর দীওয়ানখানায় আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাটরূপে বিরাট ছত্র ধরে সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশভাবে তাঁর আসন অধিকার করে আধ্যাত্মিক সিংহাসনে সমাসীন ছিলেন মানুষের হৃদয়ের চিকিৎসক, আউলিয়াকুলের সম্রাট হজরত নিজামউদ্দীন। কেউ কারো অধীনে ছিলেন না; এবং কেউ কাউকে বিরক্ত ও বিব্রত করেননি। সর্বোপরি, সুলতান আলাউদ্দীন ছিলেন যথার্থ ধার্মিক এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি। হজরত নিজামউদ্দীনকে জানার, বোঝার এবং তাঁকে মর্যাদা দেওয়ার মতো যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্ব তাঁর ছিল, সেজন্য কুচক্রী সভাসদদের কুমন্ত্রণা সত্ত্বেও তিনি নিজামউদ্দীনকে কখনো বিরক্ত করেননি। এভাবে দুটি মসনদ দিল্লির দু’প্রান্তে সসম্মানে সমাসীন ছিল। 

সম্রাট আলাউদ্দীনের পুত্র খিজির খাঁ ছিলেন হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার বিশ্বস্ত শিষ্য ও নিবেদিতপ্রাণ অনুচর। খিজির খাঁ ও দেবলা দেবীর প্রেম ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। মহাকবি আমির খসরু ‘দেবলা দেবী ও খিজির খাঁ’ নামে যে কাব্য লিখেছেন, জগতের প্রেম কাব্যের ইতিহাসে তা অমর হয়ে আছে। এ কাব্যে মানব—মানবীর প্রেমের আড়ালে সুফি ভাবধারা কেন্দ্রিক আশেক—মাশুকের এক মহৎ আধ্যাত্মিক ভাব ফুটে উঠেছে—সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। 

সম্রাট আলাউদ্দীন দুর্ভাগ্যবশত, খিজির খাঁ—এর প্রতি খুবই নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলেন। যার ফলে, খিজির খাঁ—এর জীবন এক অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক ট্রাজেডি বরণ করে। সুলতান আলাউদ্দীন শেষ জীবনে তা অনুভব ও উপলব্ধিও করেন কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না। ওদিকে খিজির খাঁ—এরও মৃত্যু হয়, এদিকে সুলতানও মৃত্যুবরণ করেন (১৩১৬ খ্রি.)। নইলে সুলতান আলাউদ্দীনের পরে তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারীরূপে খিজির খাঁ দিল্লির সিংহাসন অলংকৃত করতে পারতেন। কিন্তু বিধাতার অভিপ্রায় বোধ হয় ছিল ভিন্ন—তাই তাঁর ভালে হয়তো এরকম দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি সংঘটিত হয়েছিল। ইবনে বতুতা এ বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন—‘সম্রাট বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রধান রাজমহিষী ও খিজির খাঁর মাতা মাহক তাঁর পুত্রকে (খিজিরকে রাজসিংহাসনে বসানোর প্রচেষ্টা চালানোর জন্য তাঁর ভাই সনজরকে (অলপ খাঁ) ডেকে আনালেন এবং এ কথা বলে শপথ করালেন যে, সম্রাটের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রকে সিংহাসনে বসানোর জন্য সব রকমের প্রয়াস চালাবেন।’ 

‘সম্রাটের নায়েব মালিক আলফী (অর্থাৎ মালিক কাফুর) এ প্রতিজ্ঞার কথা জানতে পেরেই তা সম্রাটকে জানিয়ে দিলেন। একথা শুনেই তিনি (সম্রাট) তাঁর দাসদের আদেশ দিলেন যে, সনজর এসে সম্রাট প্রদত্ত খিলআত ইত্যাদি পরিধান করতে শুরু করা মাত্রই.. তাকে যেন হত্যা করা হয়। সম্রাটের আদেশানুসারে তা—ই করা হলো। খিজির খাঁ ঐদিন দিল্লি থেকে কুড়ি মাইল দূরে সনদপ্ত নামক স্থানে ধর্মাত্মা—মহাপুরুষদের কবর জিয়ারতে গিয়েছিলেন। এ পথ হেঁটে গিয়ে সেখানে তিনি তাঁর অসুস্থ পিতার আরোগ্য লাভের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে মানত করেছিলেন। পিতা কর্তৃক তাঁর মামার হত্যাকাণ্ডের এ খবর শুনে তিনি শোকাবেগে তাঁর পরনের বস্ত্র ফেড়ে ফেললেন। এ খবর সম্রাটের কাছে খুব খারাপ প্রতীয়মান হলো। খিজির খাঁ তাঁর পিতার কাছে উপস্থিত হলে তিনি তাঁকে খুব ভর্ৎসনা করলেন এবং সেই সাথে বন্দী করে তাঁকে নায়েবের কাছে পাঠিয়ে গোলালিয়র দুর্গে বন্দী করে রাখার আদেশ দিলেন। এ মজবুত দুর্গটি দিল্লি থেকে দুশো মাইল দূরে হিদুদের রাজ্যগুলোর মধ্যে অবস্থিত। খিজির খাঁ—কে সে দুর্গের রক্ষকের হাতে তুলে দিয়ে আদেশ দেওয়া হলো যে, তাঁর সাথে রাজপুত্রের মতো ব্যবহার না করে যেন বন্দী—শত্রুর মতো ব্যবহার করা হয়। 

সম্রাটের রোগ দিনের পর দিন বেড়ে চলল। তিনি যুবরাজ হিসেবে অভিষেক করার জন্য খিজির খাঁ—কে নিয়ে আসতে চাইলেনও… কিন্তু নায়েব (মালিক কাফুর) ‘হাঁ’ সূচক জবাব দিয়ে তাঁকে আনাতে অযথা বিলম্ব করলেন; এবং সম্রাট তার খবর জিজ্ঞাসা করলে তাঁকে জানানো হলো যে, তিনি (খিজির খাঁ) এখুনি এসে পড়বেন। ইতোমধ্যে সম্রাটের জীবনাবসান হয়ে গেল।’ 

সম্রাট আলাউদ্দীনের ইচ্ছা মোতাবেক খিজির খাঁকে যুবরাজ মনোনীত করা গেল না। মালিক আলফী বা মালিক কাফুরের ষড়যন্ত্রে খিজির খাঁ নিহত হন। খিজির খাঁ—এর হত্যাকাণ্ডের বৃত্তান্তটি খুব মর্মপীড়াদায়ক। ইবনে বতুতা বর্ণনা করেছেন—‘গোয়ালিয়রের কাজী জৈনুদ্দীন মুবারক আমাকে বলেছিলেন, মালিক শাহের ওখানে (গোয়ালিয়র দুর্গে, যেখানে খিজির খাঁ—কে বন্দী করে রাখা হয়েছিল) পৌঁছানোর সময় আমি স্বয়ং খিজির খাঁ—এর কাছে বসেছিলাম। এ আমীরের আগমনের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই ভয়ে তাঁর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মালিক শাহ সেখানে পৌঁছালে খিজির খাঁ সেখানে তার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন—‘আখবন্দে আলম (জগতের প্রভু)। আমি প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সম্পন্ন করার জন্য এখানে এসেছি।’ একথা শুনে খিজির খাঁ জিজ্ঞাসা করলেন—‘আমার জীবন নিরাপদ তো?’ তিনি উত্তর দিলেন ‘হাঁ।’ 

এরপর তিনি কোতয়ালকে হাঁকলেন এবং আমাকে সহ তিনশ’ দুর্গরক্ষককে সাক্ষী করে সবাইকে সম্রাটের আদেশ পড়ে শোনালেন। তারপর তিনি শিহাবুদ্দীনের কাছে গিয়ে তাকে হত্যা করলেন। এ কাজ সমাধা করার সময় তাঁর মধ্যে ভয় দ্বিধা—সংকোচ কোনো কিছুই লক্ষ করা যায়নি। এরপর শাদী খাঁ ও আকবর খাঁ—র পালা এল। তিনি যথাপূর্ব তাদের ঘাড় থেকে মাথা নামিয়ে দিলেন। কিন্তু যখন খিজির খাঁ—র পালা এল তখন তিনি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। সে সময় তাঁদের মাতাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। … এরপরে, খিজির খাঁ—কে হত্যা করা হলো।… তাঁর মাকে ৭২৮ হিজরি সনে আমি মক্কা শরীফে দেখেছিলাম। 

খিজির খাঁ—এর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ঐতিহাসিক বদায়ুনী লিখেছেন—‘৭১৮ হিজরির প্রথম দিকে খিজির খাঁ—কে হত্যার পরে দেবলা দেবীকে রণিবাসে নিয়ে আসার জন্য শাদী খাঁ—কে পাঠানো হয়। প্রসিদ্ধ কবি আমির খসরু তাঁর ‘দেবলা দেবী ও খিজির খাঁ’ নামক কাব্যে এ বৃত্তান্ত এভাবে লিখেছেন : মুবারক শাহ (খিলজি) (দেবলা দেবীকে পাওয়ার জন্য) এ কথা লিখে (খিজির খাঁ—কে) পাঠিয়েছিল যে, যদি তুমি তোমার ভার্যাকে আমাকে দিয়ে দাও তাহলে আমি তোমাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে কোনো একটি রাজ্যের শাসনকর্তা বানিয়ে দেবো। কিন্তু খিজির খাঁ সে অঙ্গীকার করতে রাজি হননি। মহাকবি আমির খসরুর 

ভাষায় : 

‘চো বামন হাম সরন্তই ইয়রে জানী। 
সরে মন দূর জুম জাঁ জস পদানী ॥’ 

অর্থাৎ ‘প্রাণ—প্রিয়া যদি এ হৃদের সাথে করে মধু—আচরণ। 
তাহলে আমার প্রাণ—বধ ছাড়া কর যাহা চায় মন ॥’ 

তাঁর এ জবাব সম্রাটের কাছে খুব খারাপ লাগে এবং বলেন :

‘ব তুন্দী সর্ সলাহীরা তলব কর্দ ॥ 
কে বায়দ সদ্ কিরো ইরোজ শবকদ্ ॥
রো অন্দর গালিয়োর ইমম্ ন বসদের। 
সরে সেয়াং মলক আপগান ব শামশের ॥’ 

এর তাৎপর্য হলো : সক্রোধে অস্ত্রাধ্যক্ষকে ডেকে একশো ক্রোশ দূরত্বের রাস্তা এক রাতেই অতিক্রম করে গোয়ালিয়রে গিয়ে তাকে হত্যা কর। ঐতিহাসিক ফিরিশতা লিখেছেন—‘চোখ সেলাই করা অবস্থায় খিজির খাঁ—কে হত্যা করার পর তাঁর পত্নীকে (দেবলা দেবীকে) রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসা হলো।’ 

বলাবাহুল্য, খিজির খাঁ খুব গভীরভাবে রাজনৈতিক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। এভাবে, সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির ভাবী উত্তরাধিকারীকে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। এ প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং মর্মপীড়াদায়ক। 

সম্রাট কুতুবউদ্দীন মুবারক শাহ—ইতিহাসে যিনি মুবারক খিলজি নামে পরিচিত তাঁর সহোদর ভাইদের প্রতি এ নিষ্ঠুর আচরণজনিত পাপের পরিণাম ফল তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছিল। ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করার পর তিনি অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী হয়ে পড়েন। সুলতান আলাউদ্দীন যেমন মালিক কাফুরের পাতা ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে পারেনি; তেমনি মুবারক খিলজিও পারেননি নীচু জাতের হিদু থেকে ধর্মান্তরগ্রহণকারী খসরু খাঁ—র পাতা ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে। অতীতে কৃত তাঁর এ পাপকর্মফল বুমেরাং হয়ে ফিরে এসে তাঁকেই আঘাত করে শেষ পর্যন্ত ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে দুনিয়ার বুক থেকে তাঁকে চিরকালের জন্য সরিয়ে দেয়। এখানে একটা বৃত্তান্ত সবিশেষ উল্লেখ করা একান্ত প্ৰয়োজন। 

আউলিয়া—কুলের সম্রাট হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়া হিঁদুস্তানের জনগণের হৃদয়ে অলৌকিক শাসন সমানে জারি রেখেছিলেন। স্বৈরাচারী, বিলাসী ও স্বেচ্ছাচারী মুবারক খিলজি দুর্ভাগ্যবশত, স্বকপোলকল্পিত এক আশঙ্কার বশবর্তী হয়ে হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার সাথে অকারণে এক বিবাদে খাড়া করেন। কোনো আমির বা অমাত্য তাঁকে নিজামউদ্দীন সম্পর্কে সম্ভবত ভুল বুঝিয়ে থাকবেন। অদূরদর্শী ও বলদর্পে অন্ধ মুবারক খিলজি নিজামউদ্দীনকে তাঁর মসনদ থেকে অন্যায়ভাবে সরিয়েও দিতে চেয়েছিলেন; চেষ্টাও কম করেননি; কিন্তু আল্লাহর রাজত্বে কার মসনদ থেকে কে কাকে সরিয়ে দেয়? অবশেষে, মুবারক খিলজির মাথা হাজার স্তম্ভের প্রাসাদ থেকে নিচে পড়ে গড়াগড়ি খেল। আউলিয়াকুলের সম্রাট নিজামউদ্দীন তাঁর মসনদে আসীন থেকে সমানে রাজত্ব চালিয়ে গেলেন। 

মুবারক খিলজি তাঁর প্রিয়পাত্র খসরু খাঁ—র হাতে কীভাবে নিহত হয়েছিলেন, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইবনে বতুতা লিখেছেন—‘কুতুবউদ্দীনের (মুবারক খিলজি) আমিরদের মধ্যে খসরু নামক অত্যন্ত সুন্দর ও সাহসী এক বীরপুরুষ ছিলেন। দাক্ষিণাত্যের চান্দেরি ও মেরার রাজ্য দুটি ইনিই জয় করেছিলেন। সম্রাট খসরু খাঁর সাথে অত্যন্ত বন্ধুত্ব সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। 

সম্রাটের শিক্ষক কাজী খাঁ (আসল নাম মওলানা জিয়াউদ্দীন বিন মওলানা শিহাবুদ্দীন খাতাত) সে সময়ে ‘সদরে জাহাঁ’ ছিলেন। তাঁকে আজিমউশ্শানও (মহান ঐশ্বর্যশালী) বলা হতো। 

কাজী খাঁ মালিক খসরুকে (খসরু খান) অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতেন। বাস্তবিকই তিনি ছিলেন হিদু এবং তিনি হিদুদের ব্যাপারে পক্ষপাতমূলক আচরণ করতেন। এজন্য তিনি কাজী সাহেবের ক্রোধের পাত্রে পরিণত হন। ইনি সম্রাটকে খসরুর ব্যাপারে বারবারই সাবধান করে দিতেন কিন্তু সম্রাট তাঁর কথায় কোনও গুরুত্ব না দিয়ে তা অমূলক বলে উড়িয়ে দিতেন। আল্লাহ তো তাঁর মৃত্যু তার হাতেই লিখেছিলেন, তা কে খণ্ডাতে পারে? কারণ এটাই ছিল যে, সম্রাট তাঁর পরম শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা কানে পর্যন্ত তোলেননি। 

একদিন খসরু খাঁ সম্রাটের কাছে নিবেদন করলেন—কিছু হিদু মুসলমান হতে চাচ্ছেন। সে যুগের প্রথানুসারে হিদুরা মুসলমান হতে চাইলে সম্রাটের উপস্থিতি আবশ্যক বলে গণ্য হতো। এবং সম্রাটের পক্ষ হতে খিলআত ও স্বর্ণকঙ্কন পারিতোকিরূপে প্রদান করা হতো। প্রথানুসারে সম্রাটও ঐ সব লোকেদের রাজদরবারের ভিতরে আসার জন্য বললেন; খসরু খান বললেন, তারা তাদের স্বজাতীয়দের কাছে লজ্জিত ও ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কারণে, রাতের বেলায় আসতে চাইছে। সম্রাট সে অনুমতিই দিলেন। 

এবার মালিক খসরু (খসরু খান) বেশ কয়েকজন লম্বা—তাগড়া হিদু যুবককে ঠিক করে তার নিজের ভাইকেও সে দলে ভিড়িয়ে নিলেন। গরমের দিন ছিল। সম্রাটও উঁচু ছাদের উপরে ছিলেন। কয়েক জন দাস ছাড়া আর কেউ তাঁর আশপাশে ছিল না। এ লোকেরা চতুর্থ দরজা পেরিয়ে পঞ্চম দরজায় পৌঁছালে তাদের সশস্ত্র অবস্থায় দেখে কাজী খাঁ সন্দিহান হয়ে তাদের পথ রোধ করলেন এবং আখবন্দে আলম (জগতের প্রভু) সম্রাটের অনুমতি চাইতে বললেন। একথা বলতেই তারা কাজী সাহেবকে ঘিরে ফেলে হত্যা করল। সঙ্গে সঙ্গে কোলাহল শুরু হয়ে গেল। সম্রাট এর কারণ জানতে চাইলে মালিক খসরু বললেন, কাজী সাহেব হিদুদের ভিতরে আসতে দিচ্ছেন না বলে ঝগড়া—ঝামেলা হচ্ছে। সম্রাট এবার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে অগ্রসর হলেন দরজা বন্ধ ছিল। তিনি দরজায় আঘাত দিতে দিতেই খসরু খাঁ তাঁকে এসে আক্রমণ করল। কিন্তু সম্রাট ছিলেন খুবই বলশালী। শত্রুকে দাবিয়ে রাখতে তাঁর কিছুমাত্রও বিলম্ব হলো না। কিন্তু ইতোমধ্যেই অন্য হিদুরাও সেখানে এসে গেল। খসরু চিৎকার করে বললেন, সম্রাট আমাকে দাবিয়ে রেখেছেন। একথা শুনতেই হিদুরা সম্রাটকে হত্যা করে তাঁর মাথাটা হাজার স্তম্ভের রাজপ্রাসাদের উপর থেকে নিচে ফেলে দিল।’ 

মুবারক খিলজির হত্যাকাণ্ডের ভিতর দিয়ে ভারতের সুলতানি আমলের খিলজি শাহী বংশের অবসান ঘটল। তারপরেই নিবর্ণের হিদু থেকে আগত খসরু খাঁ—ইবনে বতুতার বর্ণনানুসারে, মনেপ্রাণে যিনি হিদু ছিলেন, এবার দিল্লির রাজসিংহাসনে তিনিই আসীন হলেন। 

তেরো. 

কোনো রাজবংশের সাথে সম্পর্কবিহীন এক ব্যক্তি, যার শিরা ও ধমনিতে প্রবাহিত ছিল না রাজরক্ত, নিবর্ণের পৌত্তলিক সমাজ হতে আগত, নামেমাত্র ইসলামগ্রহণকারী এক ব্যক্তি, মনে—প্রাণে তিনি আদৌ মুসলমান ছিলেন কি—না সন্দেহ, সম্পূর্ণ ছলনা, কপটতা ও বিশ্বাঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে নিজপ্রভুকে হত্যার মাধ্যমে দিল্লির মসনদে সমাসীন হয়ে মুসলমান দণ্ডধারী হয়ে মুসলমানদের উপর চণ্ড—পীড়ন চালাতে শুরু করলেন। অনতিবিলম্বেই তাঁর জাতিপরিচয়গত বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর আচরণে সুপরিস্ফুট হয়ে উঠতে লাগল। তাঁর চণ্ডশাসনে মুসলিম জনমনে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠতে লাগল। যদিও তিনি কূটনৈতিক চাতুরতার আশ্রয় নিয়ে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, আলেম—ওলামা ও পীর—মাশায়েখদের সর্বপ্রকারে খুশি রেখে নিজের চণ্ডক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখার জন্য সর্বপ্রকারের প্রয়াস চালিয়ে গেলেন। সিংহাসনে আসীন হয়েই প্রচুর অর্থ ও ধন—সম্পদ ব্যয় করলেন সমাজের অভিজাতদের সমর্থন ও শুভেচ্ছা আদায়ের জন্য। দিল্লির আধ্যাত্মিক মসনদে সমাসীন হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়াকেও দেওয়া হয় পাঁচ লক্ষ মুদ্ৰা। মহাত্মা নিজামউদ্দীন তা গণীমতের মাল বিবেচনা করে দিল্লির নিঃস্ব ও গরিবদুঃখীদের মধ্যে অনতিবিলম্বেই বিলিয়ে দিলেন। 

খসরুর চণ্ডশাসনের মুসলিম সমাজের সর্বত্রই ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল। তাই এসব বদান্যতা তার কৃত পাপ থেকে তাকে রক্ষা করতে পারল না। মুসলমানদের প্রতি খসরু খাঁ—র নিষ্ঠুর ও বর্বর আচরণের বর্ণনা দিয়েছেন ইবনে বতুতা। তিনি লিখেছেন—‘খসরু মালিক (খসরু খাঁ) ক্ষমতাসীন হয়েই গো—হত্যার বিরুদ্ধে আদেশ জারি করলেন। গো—হত্যাকারীকে গরুর চামড়া দিয়ে সেলাই করে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দিতে লাগলেন। এ জাতির (হিন্দু) লোকেরা গরুকে পূজা করে। ধর্ম ও ঔষধীয় জ্ঞানে তারা গো—মূত্র পান করে এবং তার মল দিয়ে গৃহ ও প্রাচীর—আদি লেপন করে থাকে। খসরু খাঁ—র বড় খাহেশ ছিল যে, মুসলমানরাও এমনটিই করুক। এর ফরে, জনগণ (মুসলমানরা) তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে তুগলক শাহের (গিয়াসউদ্দীন তুগলক) পক্ষ অবলম্বন করল।’ 

সম্রাট পদে আসীন হওয়ার পর খসরু খাঁ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাজ—ফরমান পাঠালেন। এ ফরমান যখন গিয়াসউদ্দীন তুগলকের কাছে গিয়ে পৌঁছাল, তখন তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তা পা দিয়ে দলে দিয়ে চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করলেন। বস্তুত, বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এবং যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। ইবনে বতুতা—র বর্ণনা—‘সম্রাজ্যের উপর তুগলকের এ আক্রমণের ফলে ভয়ানক যুদ্ধ হলো। যখন সম্রাটের সমস্ত সৈন্য পালিয়ে গেল এবং সম্রাটের কাছে আর কেউ রইল না, তখন তিনি অশ্বপৃষ্ঠ হতে অবতরণ করে রাজপোশাক ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে ভারতবর্ষের সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো মাথার চুল পিছনের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে এক বনের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। খসরু খাঁ তিনদিন যাবত সেই বনেই পালিয়ে রইলেন। 

গাজী মালিক ‘গিয়াসউদ্দীন’ উপাধি ধারণ করে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে অসীন হলেন এবং সুদৃঢ় মনোবল ও বিচক্ষণতার দরুন অনতিবিলম্বেই তিনি সাম্রাজ্যের শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হলেন। ওদিকে জঙ্গলে খসরু খাঁ—র সন্ধান পাওয়া গেল।’ ইবনে বতুতার বর্ণনা থেকে—‘তুগলক খসরু খাঁ—কে ধরার জন্য তাঁর পুত্রকে পাঠিয়ে দিলেন। খসরু খাঁ—কে এভাবে ধরে ফেলা হলো। জুনাহ খাঁ যখন তাঁকে ঘোড়ার গাড়িতে করে সম্রাটের সামনে নিয়ে এলেন, তখন তিনি সম্রাটকে বললেন—‘আমি ক্ষুধার্ত। একথা শুনে সম্রাট তাঁর জন্য খাদ্য ও শরবত আনালেন। 

তুগলক যখন তাঁকে পান—শরবতাদি খাইয়ে দিলেন তখন খসরু সম্রাটকে বললেন—‘এভাবে ভর্ৎসনা না করে আমার সাথে সম্রাটের মতো আচরণ করা হোক। একথা শুনে তুলগক বললেন—‘আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য।’ একথা বলার পর তিনি (সম্রাট তুগলক) আদেশ দিলেন—‘কুতুবউদ্দীনকে (মুবারক খিলজিকে) যেখানে ফেলে সে হত্যা করেছিল, সেখানে নিয়ে গিয়ে সেভাবেই হত্যা করে তার মাথাটাকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দাও।’ যথাযথভাবে সে আদেশই পালন করে মৃতদেহকে স্নান ও কাফন পরিয়ে কুতুবউদ্দীনের সমাধিক্ষেত্রেই সমাধিস্থ করা হলো।’ 

দিল্লির সিংহাসনে সমাসীন হওয়ার পর সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুগলক হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার সাথে এক অযথা মনোমালিন্যের অবতারণা করেন। তাঁর মতো সর্বত্যাগী, সাধক মহাপুরুষের সাথে অযথা মনোমালিন্য ও অশান্তি সৃষ্টি করে তিনি নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলেছিলেন। সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদের আমল থেকে তৎকালীন সময় পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ব্যাপী দিল্লির অদূরেই গিয়াসপুরে নিজের দীওয়ানখানায় বসে যিনি হিঁদুস্তানবাসীর হৃদয়ের চিকিৎসকরূপে তাঁদের উপর এক অলৌকিক আধ্যাত্মিক শাসন কায়েম রেখে চলেছিলেন, কিন্তু মনের ভুলেও দিল্লির রাজনৈতিক অঙ্গনের পানে চোখ তুলে তাকাননি; সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ থেকে মুহম্মদ বিন তুগলক পর্যন্ত সুদীর্ঘ অর্ধশতাধিক বর্ষের দিল্লি রাজনৈতিক উত্থান—পতনের তিনি ছিলেন নীরব সাক্ষী; তিনি কখনই রাজ্য ও রাজনীতির প্রতি কোনো প্রকারের আগ্রহ প্রকাশ করেননি; কাউকে বিব্রতও করেননি; নিজেও বিব্রত হননি; কিন্তু দু’জন সুলতান তাঁর প্রতি অযথা 

অন্যায় আচরণ করেছেন; কিন্তু সবকিছু তিনি নীরবে মুখ বুজে সয়ে গিয়েছেন। দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, তাঁদের দুঃখজনক পরিণতিরও তিনি জীবন্ত সাক্ষী ছিলেন—কিন্তু নীরব সাক্ষী। কারো প্রতি সামান্য কটাক্ষ ও সামান্যতম মন্ত ব্যও করেননি। 

সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি খুবই বিচক্ষণ শাসক ছিলেন। হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার এ নীরব সাধনার গুরুত্ব উপলব্ধি করার মতো বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা তাঁর ছিল; তাই তাঁকে সামান্য একটু ঘা দিয়ে নিজে নীরব হয়ে গিয়েছিলেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুগলকের গুণও ছিল কিন্তু তার সাথে ছিল দুর্বল এক রাজনৈতিক স্খলন। দিল্লির সুলতানরা বিশাল ভারতবর্ষ শাসন করেছেন, কিন্তু দিল্লির অদূরেই ত্যাগী—সন্ন্যাসী—সাধকপীর নিজামউদ্দীন আউলিয়ার গিয়াসপুর কখনোই দিল্লির সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি; দিল্লির সম্রাটদের শাহী—ফরমান সেখানে চলত না। কী করে তা সম্ভব? যেখানে আউলিয়া—কুলের সম্রাট হজরত নিজামউদ্দীন তাঁর আধ্যাত্মিক সিংহাসনে সমাসীন থেকে সমগ্র হিন্দুস্থানের উপরে তাঁর নৈতিক শাসন জারি রেখেছেন, সেখানে দিল্লির কোন সম্রাটের সাধ্য যে সেখানে রাজনৈতিক ফরমান জারি করেন? বাস্তবিকই কেউ তা পারেনি। তা পারার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছিলেন মুবারক খিলজি ও গিয়াসউদ্দীন তুগলক। তাঁদের দুঃখজনক পরিণতির কথা তো ইতিহাস পাঠকের অনবগত থাকার কথা নয়!—‘রে শিয়াল, তুই তোর নিজের জায়গা ছেড়ে বাঘের সাথে লড়াই করতে এসেছিস? তাহলে তার মজা দেখে নে’ এবং ‘হনুজ দিল্লি দূর্ অস্ত্’– অর্থাৎ দিল্লি এখনও অনেক দূর—এ দুটি উক্তির মধ্যে ইতিহাসের দুই নৃপতির দুঃখজনক পরিণতির কথা ইতিহাসে চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে গেছে। সম্রাট গিয়াসউদ্দীন তুগলক দিগ্বিজয় শেষে দিল্লিতে ফিরে আসার আগেই শাহী ফরমান জারি করেছিলেন—তাঁর দিল্লিতে আগমনের পূর্বেই যেন নিজামউদ্দীন দিল্লি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান। এ কথার জবাবে হজরত নিজামউদ্দীনের প্রতিক্রিয়া ঐ একটি কথাতেই চিরস্মরণীয় হয়ে আছে—‘হনুজ দিল্লি দূর—অস্ত্’—অর্থাৎ দিল্লি এখনও অনেক দূর। 

সম্রাট গিয়াসউদ্দীন তুগলক দিগ্বিজয় শেষে দিল্লিতে ফিরছিলেন। এর পরের বর্ণনা উদ্ধৃত করছি ইবনে বতুতার গ্রন্থ থেকে—‘রাজধানীর নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছানোর পর সম্রাট তাঁর পুত্র জুনাহ খাঁ—কে আফগানপুরে তাঁর জন্য এক নতুন প্রাসাদ নির্মাণের আদেশ দিলেন। জুনাহ খাঁ তিনদিনের মধ্যেই প্রাসাদ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করলেন। মাটিতে কাঠের খাম্বা স্থাপন করে তার উপরে প্রাসাদ নির্মাণ করা হলো। সেখানে প্রয়োজনীয় পরিমাণ কাষ্ঠফলকও লাগানো হয়েছিল। সম্রাটের মনোনীত ও ‘খাজা জাঁহা’ উপাধিপ্রাপ্ত বাস্তুবিদ্যাবিশারদ আহমদ ইবনে আয়াযের প্রদত্ত নকশা অনুযায়ী এ প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল। এ প্রাসাদের স্থান—বিশেষে হাতির পায়ের চাপ পড়তেই পুরো ভবনটি ধসে পড়ে।’—এভাবেই সম্রাটের অকস্মাৎ মৃত্যবরণ করতে হয়। 

গিয়াসউদ্দীন তুগলক বাংলা থেকে নিজামউদ্দীন আউলিয়ার উদ্দেশে ফরমান পাঠিয়েছিলেন এই বলে—‘ইয়া শায়খ আনজা বাশদ ইয়া মন’—অর্থাৎ আপনি এখানে আসুন নতুবা আমি ওখানে যাই। এর জবাবে হজরত নিজামউদ্দীন বলেছিলেন—‘হনুজ দিল্লি দূর অস্ত’—দিল্লি এখনও অনেক দূর। 

দিল্লি পৌঁছানোর পূর্বেই সম্রাট মৃত্যুমুখে পতিত হন—এবং তিনিও। সম্রাট আলাউদ্দীনের পুত্র খিজির খাঁ তাঁর শিষ্য ছিলেন এবং তিনিই শেখের জীবতকালেই তাঁর জন্য সমাধি নির্মাণ করিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তিনি তাঁর মৃতদেহ দাফন করার অনুমতি দিয়ে যাননি। বর্তমান সমাধি ভবনটি সম্রাট আকবরের আমলে ফওয়াইদু খাঁ নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং সম্রাট শাহজাহানের আমলে শাহজাহানপুরের হাকিম (গভর্নর) খলিলুল্লাহ এর চারিপাশে লাল পাথরের গোলাকার প্রাচীর নির্মাণ করিয়ে দিয়েছিলেন। 

.

এখানে ইতিহাসের সামান্য পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন। 

মুহম্মদ ঘুরির মুক্ত দাস কুতুবউদ্দীন আইবক ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে ঘুরি—সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার লাভ করেন তথা তুর্কি সাম্রাজ্য বা দাস বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব প্রান্তে বঙ্গ—বিজয়ী বখতিয়ার খিলজি বাংলা ও বিহারে মুসলমানদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেলেন। কুতুবউদ্দীন আইবক ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করলে ইলতুতমিশ দিল্লির সুলতান হলেন (১২১০ খ্রি.)। সালতানাত লাভের পরই তিনি উত্তর—পশ্চিম ভারতসহ বাংলা ও বিহারের প্রতি মনোেযাগী হন। এরপর দীর্ঘ ২৬ বছর রাজত্বের পর ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল—মে মাসে ইলতুতমিশের পুত্র রুকনউদ্দীন ফিরোজ সিংহাসনারোহণ করেন। কিন্তু তিনি অযোগ্য সাব্যস্ত হওয়ার পর ইলতুতমিশের সুযোগ্য কন্যা রাজিয়া সুলতানা ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ নভেম্বর ক্ষমতাসীন হন। ১২৩৬ এর ১৯ নভেম্বর থেকে ১২৪০ এর ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত তিন বছর অবধি রাজত্ব করার পর রাজিয়া সুলতানা নিহত হন। তারপর মুইজউদ্দীন বাহরাম শাহ ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এপ্রিল ক্ষমতাসীন হন। ১২৪২ খ্রিষ্টাব্দে ১০ মে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে আলাউদ্দীন মাসউদকে দিল্লির সিংহাসনে বসানো হয়। ১২৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে পদচ্যুত করে সুলতান নাসিরউদ্দীন মাহমুদকে সিংহাসনে বসানো হয়। তিনি ছিলেন শামসী যুগের শেষ সুলতান। দিল্লির সিংহাসনে তিনি ২০ বছর আসীন ছিলেন। ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান হয়। এ ২০ বছরের সময়কালে দিল্লি সালতানাতের রাজনৈতিক ক্ষমতা মূলত তাঁর মন্ত্রী বলবনের হাতেই ছিল। ঐ সময়ে ভারতের উত্তর—পশ্চিম সীমান্তে মঙ্গোলদের খুব বাড়বাড়ন্ত চলছিল। মঙ্গোলদের আতঙ্কিত করার জন্য বলবন ১২৪৬—৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধু অভিমুখে রওনা হন কিন্তু সোদরা নদীর তট থেকে ১৫ মার্চ দিল্লিতে ফিরে আসেন। ঐ বছরেই তিনি যমুনা ও কালিঞ্জরের মধ্যবর্তী এলাকার হিদু বিদ্রোহী দলাকিমলাকীদের নির্মূল করে তিনি তাঁর রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন ১২৬৬ থেকে ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কুশল নেতৃত্ব দিয়ে দিল্লিকে মঙ্গোল আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন। তাঁর রাজত্বকালে দিল্লি সালতানাতের সীমা উত্তর—পশ্চিমে সিন্ধুনদ, পূর্বে বাংলা, পশ্চিমে গোয়ালিয়র, বিয়ানা ও চান্দেরি এবং দক্ষিণ—পূর্বে কালিঞ্জর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। 

তাঁর জীবতকালেই খিলজি তুর্কিদের উত্থান ঘটে এবং তাঁর মৃত্যুর পর দিল্লির সালতানাত থেকে বলবন—বংশীয়দের উৎখাত করে ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুন সুলতান জালাউদ্দীন ফিরোজশাহ দিল্লির সিংহাসনে বসেন এবং দিল্লির সালতানাতে খিলজি বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এর দু’বছর পর সুলতানের ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা আলালউদ্দীন খিলজি তাঁর পতন ঘটিয়ে ১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুলাই দিল্লির সিংহাসনে বসেন। পাক—ভারত—বাংলা উপমহাদেশের ইতিহাসে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির ন্যায় প্রতিভাবান ও সুযোগ্য শাসক খুব বেশি আসেননি। ১২৯৬ হতে ১৩০৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে সর্বমোট সাত বার মোঙ্গল আক্রমণ সংঘটিত হয়। সুলতান আলাউদ্দীন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাদের প্রত্যেকটি আক্রমণ ব্যর্থ করে দেন। তিনি সর্বমোট ২০ বছর দেশ শাসন করার পর ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর ক্ষমতাসীন হন তাঁর পুত্র কুতুবউদ্দীন মুবারক শাহ (১৩১৬)। ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি অত্যন্ত স্বৈচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন এবং আপন ভাইদের প্রতি তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর আচরণ করে একে একে তাঁদের হত্যা করান এবং তাঁরই একদা বিশ্বাসী পাত্রের হাতে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজেও নিহত হন। এভাবে খিলজি বংশের পতন ঘটে যায়। 

কুতুবউদ্দীন মুবারক শাহের হত্যাকারী খসরু খাঁ আসলে নিবর্ণের হিন্দু থেকে আগত ধর্মান্তরিত মুসলমান। ইসলাম ধর্মের স্বাভাবিক উদারতার কারণেই মুসলমানও উদার হয়ে থাকে। এজন্য কেউ নামে মাত্র ইসলাম গ্রহণ করলেও মুসলমানরা তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখেন না। খসরু খাঁ মুসলমানদের এই উদারতার সুযোগ নিয়ে কুতুবউদ্দীনকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন (১৩২০ খ্রি.) মুসলমানদের উপর চণ্ডশাসন কায়েম করেন। ঐ সময়কার আরব—পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন—‘খসরু মালিক ক্ষমতাসীন হয়ে গো—হত্যার বিরুদ্ধ আদেশ জারি করলেন। গো—হত্যাকারীকে গরুর চামড়া দিয়ে সেলাই করে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দিতে লাগলেন। এ জাতির লোকেরা গরু পুজো করে। ধর্ম ও ঔষধীয় জ্ঞানে তারা গো—মূত্র পান করে এবং এবং গো—মল দিয়ে গৃহ—প্রাচীর ইত্যাদি লেপন করে থাকে। খসরু খাঁ—র বড় খাহেশ ছিল যে, মুসলমানরাও এমনটিই করুক। এর ফলে, জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করে তুগলক শাহের পক্ষ অবলম্বন করল।’*

[* মুহাম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস অনূদিত ‘ইবনে বতুতার সফরনামা’, কামিয়াব, প্রা. লি. ২০০৪ ইং ঢাকা।] 

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গিয়াসউদ্দীন তুগলক তাঁকে যমালয়ে পাঠিয়ে দিয়ে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসলেন। এভাবে দিল্লির সালতানাতে তুগলকশাহী বংশের উত্থান ঘটল। 

অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন ও করিৎকর্মা সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুগলক অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে পাঁচ বছর শাসন (১৩২০—২৫ খ্রি.) করার পর দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পর ক্ষমতায় আসেন তাঁর সর্বগুণসম্পন্ন পুত্র উলুগ খাঁ—জুনা খাঁ, ইতিহাসে যিনি মুহম্মদ বিন তুগলক (তুগলকের পুত্র মুহম্মদ) নামে জগৎ—প্রসিদ্ধ। ১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সিংহাসনারোহণের সাথে সাথে ভারতের ইতিহাসে এক নয়া যুগের উত্থান ঘটে। তাঁর মতো প্রতিভাবান এবং সর্বগুণসম্পন্ন সুলতান তাঁর আগে এবং পরে আর কেউ আসেননি। তবে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক যোগ্যতা ও প্রজ্ঞা ব্যতীত। তিনি দীর্ঘ ২৬ বছর রাজত্ব করে ১৩১৫ খ্রিষ্টাব্দে পীড়াগ্রস্ত হয়ে অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পরে ক্ষমতাসীন হন সুলতান ফিরোজশাহ তুগলক (১৩৫১)। তিনি ৩৭ বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন। সুলতান ফিরোজশাহ তুগলক তাঁর জীবৎকালে তাঁর পুত্র মুহম্মদ শাহকে ১৩৮৭ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসিয়ে দেন। কিন্তু তাঁর দাস দলপতিরা মুহম্মদ শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে পরলোকগত ফতেহ খাঁ—র পুত্র তুগলক শাহকে সিংহাসনে বসাতে তাঁকে বাধ্য করেন। সুলতান মুহম্মদ শাহ তিনবার সিংহাসনচ্যুত হন এবং তিনবারই সিংহাসন অধিকার করতে সমর্থ হন। কিন্তু তিনি বেশি দিন রাজত্ব করতে পারেননি। রাজনৈতিক ডামাডোল ও বিদ্রোহ—অশান্তির মধ্যে অকস্মাৎ তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়। তখন তাঁর পুত্র হুমায়ু খাঁ সুলতান আলাউদ্দীন সিকান্দারশাহ পদবি গ্রহণ করে হিংহাসনে বসে যান। এক মাস পনেরো দিন শাসন করার পর তিনিও মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁর মৃত্যুর পর দু’সপ্তাহ যাবত দিল্লি সিংহাসন খালি পড়ে থাকে। এর পর খাজা জাঁহার—র পরামর্শে পরলোকগত সুলতানের পুত্র মাহমুদকে, সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ পদবিসহ সিংহাসনে বসানো হয়। তাঁর শাসনকালেই জৌনপুর ১৩৯৪ খ্রিষ্টাব্দে জৌনপুর তথা শর্কীরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ সময়ে দিল্লি সালতানাতের ভাঙন ধরে। বিভিন্ন রাজ্য স্বাধীন হয়ে যেতে থাকে। নতুন নতুন রাজ্যের উদ্ভব ঘটতে থকে। দিল্লিতে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন না থাকাতে চারদিকে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের অধীনে দিল্লি থেকে পালম গাঁও অবধি প্রদেশ মাত্র রয়ে যায়। ওদিকে সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ গোয়ালিয়র পুনরাধিকার করার জন্য রাজধানী দিল্লি ত্যাগ করলে তাঁর বিরোধী আমিররা ফতেহ খাঁ—র পুত্র নুসরত খাঁকে মেওয়াত থেকে ডেকে নিয়ে ১৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে সুলতান নাসিরুদ্দীন নুসরাত শাহ উপাধি দিয়ে ফিরোজাবাদের সিংহাসনে বসিয়ে দেন। ফলে দুই সুলতানের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে। অন্য দিকে দীপালপুরের শাসক সারঙ্গখান ও মুলতানের শাসক খিজির খাঁ—র মধ্যে ১৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। সারঙ্গখান তাঁর ভাই মলু ইকবাল খাঁ—র সহায়তায় মুলতান ছিনিয়ে নেন এবং শায়খা খোকর ইরানে চলে যান এবং তিনি আমির তাইমুরকে ভারত আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানন। তিনি তাঁর পথ প্রদর্শন করেন এবং সংক্ষিপ্ত পথ ধরে হিঁদুস্তান অভিমুখে অগ্রসর হন। সমরকন্দ থেকে রওনা হওয়ার পূর্বে আমির তাইমূর তাঁর পৌত্র পীর মুহম্মদকে অগ্রবর্তী দলের নেতৃত্ব দিয়ে হিঁদুস্তান অভিমুখে পাঠিয়েছিলেন। পীর মুহম্মদ ১৩৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধু নদী পেরিয়ে উছ অবরোধ করেন। ৫ মার্চ ১৩৯৭ খ্রিষ্টাব্দে পীর মুহম্মদ মুলতান অধিকার করে নেন। আর ওদিকে আমির তাইমূর ১০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ঝড়ের বেগে এসে উপস্থিত হন এবং ২৪ সেপ্টেম্বর ১৩৯৮ এ সিন্ধু নদী অতিক্রম করেন। তারপর তিনি পথের সমস্ত বাধা অতিক্রম করে দিল্লি পৌঁছে ইকবাল খাঁ এবং সুলতান নাসিরুদ্দীনের সৈন্যদের পরাজিত করেন। ইকবাল খাঁ ও সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ পালিয়ে গেলেন। তাইমুরের বীভৎস আক্রমণ ও দিল্লি জয়ের ফলে দিল্লিতে তুগলকশাহী বংশের পতন ঘটে গেল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার যে, তাইমূর দিল্লি জয় করেও নিজেকে দিল্লি তথা হিঁদুস্তানের সম্রাট ঘোষণা করলেন না। বিপুল যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিয়ে তিনি তাঁর আপন মাতৃভূমি ও তাঁর স্বপ্নের রাজধানী সমরকন্দে ফিরে গেলেন। আর তাঁর চতুর্থ অধস্তন পুরষ জাহিরউদ্দীন মুহম্মদ জালালউদ্দীন বাবুরের জন্য মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ পরিষ্কার করে গেলেন! 

তাইমুরের প্রস্থানের পর যুযুধান পক্ষগুলো দিল্লিতে আবার ফিরে এলেন। ইতোমধ্যে দিল্লি সালতানাত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মহু ইকবাল খাঁ, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহকে মালব থেকে ডেকে এনে পুনরায় দিল্লির সিংহাসনে বসিয়ে দেন। কিন্তু তিনি তাঁর উপর অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়ে কনৌজ চলে যান। মলু ইকবাল খাঁ—র মৃত্যুর পর তিনি ১৪০৫ খ্রিষ্টাব্দে আবার দিল্লি ফিরে আসেন এবং ১৪০৫ থেকে ১৪১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি দিল্লির সিংহাসনে আসীন থাকেন। ১৪১২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। তুগলক বংশের শেষ শাসক সুলতান মাহমুদের মৃত্যু (১৪১২ খ্রি.)—র পর সমস্ত আমির দৌলত খাঁ লোদির প্রতি তাঁদের সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং তাঁকে সুলতান বলে মেনে নেন। কিন্তু খিজির খাঁ, দৌলত খাঁ লোদিকে বন্দী করে হিসার—ফিরোজায় পাঠিয়ে দিয়ে ১৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে তিনি সৈয়দশাহী বংশের প্রতিষ্ঠা করেন এবং সুলতান রূপে শাসনকার্য শুরু করে দেন। দীর্ঘ ৭ বছর শাসন করার পর তিনি ২০ মার্চ ১৪২১ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর উত্তরাধিকারী মুবারক শাহ ১৪২১ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন এবং ১৩ বছর যাবত শাসনকার্য চালান। তিনি ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৪৩৪ খ্রিষ্টাব্দে মারা গেলে আমিররা তাঁর দত্তক পুত্র মুহম্মদ শাহকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু তাঁর সিংহাসন নিষ্কণ্টক ছিল না। এদিকে শর্কী শাসক ইব্রাহীম শর্কী দিল্লি সালতানাতকে কর পাঠানো বন্ধ করে দেন। ফলে কেন্দ্র আবারও ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। এদিকে দিল্লির আমির এর উলেমারা মালবের শাসক মাহমুদ খিলজিকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানালে তিনি তৎক্ষণাৎ দিল্লির উপকণ্ঠে এসে তাঁর শিবির ফেলেন। এর ফলে সুলতান মাহমুদ সামানা থেকে বাহলুল লোদিকে দিল্লিতে ডেকে নেন। ফলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। কিন্তু এক সন্ধির মধ্য দিয়ে এ সংকটের অবসান ঘটল। ১৪৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ শাহ মৃত্যুবরণ করলেন। এরপর তাঁর পুত্র আলাউদ্দীন আলম শাহ সিংহাসনে বসলেন কিন্তু দিল্লির রাজনীতির প্রতি বিরক্ত হয়ে তিনি বদায়ুনে চলে গেলেন এর তাঁর উজির হুসাম খাঁ প্রশাসনের দেখভাল করতে লাগলেন। অবশেষে দিল্লির জনগণ বাহলুল লোদিকে দিল্লির সিহাসনে বসার জন্য আহ্বান জানালেন। সুলতান আলাউদ্দীন কোনো আপত্তি করলেন না এবং তিনি আমৃত্যু বদায়ুনেই ১৪৭৬ অবধি রয়ে গেলেন। 

বাহলুল লোদি দিল্লি এসে পৌঁছালেন এবং ১৯ এপ্রিল ১৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে বসলেন। এ সময় অবধি দিল্লি সালতানাতের সীমা দিল্লি থেকে পালমগাঁও অবধি মাত্র রয়ে গিয়েছিল। তাঁর সামনে ছিল দিল্লি সালতানাতকে পুনর্গঠন করার সমস্যা। সমস্ত হৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করা আর জাতি—ধর্ম—নির্বিশেষে সমস্ত বিদ্রোহী শাসক ও রাজা—জমিদারদের দিল্লির অধীনতা স্বীকারে বাধ্য করা। সেই মতোই নতুনভাবে নতুন পদক্ষেপ শুরু করলেন বাহলুল লোদি। ব্যাপক যুদ্ধবিগ্রহ ও সংস্কারকর্মের মধ্য দিয়ে বাহলুল লোদি ৩৮ বছর যাবত শাসনকার্য চালানোর পর ১৪৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ইটাওয়া থেকে দিল্লি ফেরার পথে রোগগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। দিল্লির সকল সুলতানদের মধ্যে বাহলুল লোদির নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। 

১৬ জুলাই ১৪৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান সিকান্দর লোদি দিল্লির সিংহাসনে বসেন। বাহলুল লোদির অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব অবশেষে তাঁকেই গ্রহণ করতে হয়। দিল্লি সালতানাতের পুনর্গঠনে তিনিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সাম্রাজ্যের অনেক হৃত এলাকা তাঁকে পুনরুদ্ধার করতে হয়। দীর্ঘ ২৮ বছর যাবত তিনি দিল্লি শাসন করেন। তারপর ২১ নভেম্বর ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 

সিকান্দর লোদির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইব্রাহীম লোদি ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তাঁর যুগ দীর্ঘ হয়নি। ইব্রাহীম লোদির মধ্যে কিছুটা ক্ষমতার দম্ভ ছিল আর ছিল কিছু হঠকারিতা। এসব তাঁর জন্য কাল হয়েছিল। তাঁর নিজের ভাইয়েরা এবং তাঁর আমিররা তাঁর প্রতি বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁর পতন কামনা করছিলেন। অবশেষে, তাঁর ভাই আলম খাঁ লোদি আমির তাইমূরের চতুর্থ অধঃস্তন কাবুলের শাসক জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবুরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানালেন। অনন্তর, বাবুর কাবুল থেকে হিঁদুস্তানের উদ্দেশে প্রস্থান করলেন এবং ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত ও নিহত করে ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। 

প্রথম পর্যায়ে অষ্টম শতাব্দীতে মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়, দ্বিতীয় পর্যায়ে একাদশ শতাব্দীতে (১০০০—১০২৬ খ্রি.) সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে পুনঃপুনঃ ভারত অভিযান এবং তৃতীয় পর্যায়ে মুহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযান (১১৭৫—১২০৬ খ্রি.) এবং কুতুবউদ্দীন আইবক কর্তৃক দিল্লিতে মুসলিম রাজ কায়েম পর্যন্ত সময় কালের মধ্যে ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, মুসলিম বিজয়ের ধারাবাহিকতায় এ ৩২০ বছরটি হলো সুলতানি ভারতের সুসংহত বিজয় ও শাসনের যুগ। এ সময়কালটি ইসলামের ইতিহাসে সুলতানি আমল নামে পরিচিত। তার আর্থ—সামাজিক—রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাস উপমহাদেশের জনজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। 

১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৩২০ বছর সময় উপমহাদশের ইতিহাসের উত্থান—পতননের নীরব সাক্ষী। এই ৩২০ বছরের ইতিহাসে উপমহাদেশ অনেক ভাঙা—গড়া—উত্থান—পতন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও 

ভাঙা—গড়া—উত্থান—পতন, প্রশাসনিক পরিবর্তন দেখেছে। এ ৩২০ বছরে দিল্লিার রাজনৈতিক মঞ্চে যত শাসকের আবির্ভাব ঘটেছে তাঁদের একটি তালিকা এখানে প্রদত্ত হলো : 

কুতুবউদ্দীন আইবক 

ইলতুতমিশ 

রুকনউদ্দীন ফিরোজশাহ 

সুলতানা রাজিয়া 

মুঈজউদ্দীন বাহরাম 

আলাউদ্দীন মাসুদশাহ

নাসিরুদ্দীন মাহমুদ

গিয়াসউদ্দীন বলবন

কায়কোবাদ 

জালাল উদ্দীন ফিরোজশাহ 

রুকনউদ্দীন ইব্রাহীমশাহ

আলাউদ্দীন খিলজি 

শিহাবউদ্দীন উমর 

কুতুবউদ্দীন মুবারকশাহ

খসরু খাঁ 

গিয়াসউদ্দীন তুগলক 

ফিরোজশাহ 

ফিরোজশাহ ও ফতেহ খাঁ 

ফিরোজশাহ ও জাফর খাঁ 

তুগলক শাহ 

আবুবকর শাহ 

মুহম্মদ শাহ 

মাহমুদ শাহ 

নুসরত শাহ 

মুবারক শাহ 

মুহম্মদ 

আলমশাহ 

বাহলুল 

সিকান্দর লোদি 

ইব্রাহীম লোদি 

১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ অবধি দীর্ঘ ৩২০ বছরের ইতিহাসে শাসক এসেছেন ২৯ জন। এঁদের সকলেই সমান উজ্জ্বল ছিলেন না। এঁদের মধ্যে সর্বাধিক গুণসম্পন্ন ও অসাধারণ যোগ্য শাসক হলেন দু’জন—আলাউদ্দীন খিলজি ও মুহম্মদ বিন তুগলক। অন্যান্যদের মধ্যে অনেকেই এঁদের চেয়ে অনেক বেশিদিন রাজত্ব করেছেন কিন্তু প্রশাসনিক সংস্কারে এঁরা দুজন ছিলেন সর্বাগ্রগণ্য। এঁদের প্রবর্তিত ও সুসংস্কৃত অনেক কিছুই পাক—ভারত—বাংলা উপমহাদেশ আজও ভোগ করছে। এঁদের মধ্যে আর যাঁরা আছেন তাঁদের অনেকেরই কিছু—না—কিছু অবদান নিশ্চয়ই আছে—যেমনটি রয়েছে তাঁদের অখণ্ড উপমহাদেশে সংগঠনের কার্যক্রম। সে ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান কম বেশি অবশ্যই স্মরণীয়। 

মুসলমানরা এদেশে এসেছিলেন উন্নততর ধর্ম, সংস্কৃতি ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে। ইসলামের মহান নবির শিক্ষা ছিল ‘জ্ঞান মুসলমানের হারানো নিধি’ তাকে যেখানেই পাওয়া যায় সেখানেই তা তার গ্রহণ করার অধিকার আছে, এ জন্য মুসলমান জাতি যে জ্ঞান ইসলামের সাথে দ্বন্দ্বপূর্ণ নয়—সে জ্ঞান অমুসলিমদের কাছ থেকে গ্রহণ করতে আপত্তি করেনি। আর এ জন্যই আবির্ভাবের এত অল্পকাল মধ্যেই ইসলাম অতি—দ্রুত দুনিয়া জয় করতে সমর্থ হয়েছিল। এসব বিজয়ের ধারাবাহিকতায় তৎকালীন ভারতও ইসলামি জগতের মধ্যে এসে গিয়েছিল। 

এদেশে মুসলমানরা এনেছিলেন উন্নততর ধর্ম, সংস্কৃতি ও সুসংহত শাসনব্যবস্থা। প্রাচীন সমৃদ্ধ দেশ ভারতে তখন কোনো কেন্দ্রীয় শাসন—ব্যবস্থা ছিল না। মুসলমানরা দিল্লি অধিকার করার পর তাঁদের শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন কিন্তু এদেশে প্রচলিত কালের সংঘাতে যা টিকতে পারেনি এবং যুগের সাথে যা চলতে পারেনি তার অবসান ঘটিয়েছেন। ভারতে ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার পর নানা উত্থান—পতনের মধ্য দিয়ে ১৫২৬ অবধি ৩২০ বছর কাল অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এই সময় কালের মধ্যে ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন বহু ওজস্বী নায়ক। রাষ্ট্রের নয়া—নয়া সংস্কারের মাধ্যমে এদেশে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে তাঁরা সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। আর এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, মুসলমানদের শাসন ছিল কল্যাণকর রাষ্ট্র শাসন। দুনিয়ার অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর ন্যায় তাঁরা এদেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেননি; বরং তাঁরা এ দেশকে নিজেদের মাতৃভূমির মতো দেখেছেন, শাসন করেছেন এবং এদেশের সমাহিত হয়েছেন। রাজনৈতিক ডামাডোল, হানাহানি, খুনোখুনি সে ছিল ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ’। দেশের প্রজা সাধারণ তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এভাবেই ভারতে মুসলিম রাজ কায়েম (১২০৬) হওয়ার পর ৩২০ বছর কেটে যায় (১৫২৬)। এবং পরিপূর্ণ রূপে সুলতানি যুগ শেষ হয়ে যায়। এরপরে আসে মোগল যুগ। 

ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের সূচনা ও প্রতিষ্ঠা করেন আমির তাইমুরের চতুর্থ অধঃস্তন জহির—উদ—দিন মুহম্মদ জালাল—উদ—দিন বাবুর। 

নাম ও পরিচয় 

আল—সুলতান আল—আজম ওয়াল খাকান আল—কুকারাম পাদশাহ (বাদশাহ) গাজী জহির উদ্—দিন মুহম্মদ জালাল উদ—দিন বাবুর, বাদশাহ গাজী যিনি প্রধানত ‘বাবর’ নামে পরিচিত, তিনি ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা—সম্রাট ছিলেন। যদিও এখানে আমরা তাঁর নামের বানান ও উচ্চারণ বাবুর লিখব। বারবনামার ইংরেজি সংস্করণগুলোতে তাঁর নামের বানান ‘বাবুর’ (Babur ) লেখা হয়। বাংলার বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী বাবরনামা সংক্রান্ত আলোচনায় তাঁর নাম ‘বাবুর’ লিখেছেন। এ বাবদে তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ সর্বপ্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমরাও এখানে ‘বাবুর’ লিখব, এই গ্রন্থের সর্বত্রই ‘বাবুর’ লেখা হয়েছে। 

পারিবারিক প্রতিকৃতি 

বাবুরের পিতা ছিলেন উমর শেখ মির্জা। তিনি ছিলেন ফারগানার আমির, যেটি বর্তমানে মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। তিনি পিতার দিক দিয়ে দিগ্বিজয়ী বীর আমির তাইমুর বা তাইমুর লঙের চতুর্থ অধস্তন এবং মায়ের দিক দিয়ে চেঙ্গিস খানের চতুর্দশ অধঃস্তন। তাঁর মায়ের নাম ছিল কুতলুক নিগার খানম। তাইমুরি রাজবংশের এ মহান সন্তান ফারগানা থেকে কাবুল হয়ে রাজনৈতিক বিজয়ের গৌরবময় যাত্রা অক্ষুণ্ণ রেখে ভারতের তৎকালীন আফগান সম্রাট ইব্রাহীম লোদিকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে ভারত জয়ী সম্রাট বা মোগল সম্রাট রূপে নিজের এবং তাঁর বংশধরদের স্থান পোক্ত করে দিয়ে যান। বাবুর ভারত—জয়ের পর মাত্র পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন। ৩০ এপ্রিল ১৫২৬ ঈসায়ীতে দিল্লিতে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন এবং তাঁর যুগ শেষ হয় ৫ জানুয়ারি ১৫৩১ এ। মাত্র ৪৭ বছরের জীবৎকালে তিনি যে কীর্তি রেখে গেলেন জগতে তার ইতিহাস সোনার হরফে লেখা হয়েছে। 

বাবুরের মাতৃভাষা ছিল চুগতাই তুর্কি, যা অধিক ফার্সি মিশ্রিত একটি পৃথক ভাষা। ওই ভাষাতেই রচনা করেন তাঁর জগদ্‌বিখ্যাত আত্মজীবনী ‘তুজুক—ই—বাবরী’ যার ফার্সি নাম ‘বাবরনামা’। তাঁর পৌত্র জালালউদ্দীন মুহম্মদ আকবর বৈরাম খাঁ—র যশস্বী পুত্র আবদুর রহিম খান—ই—খানানকে দিয়ে বইটির ফার্সি অনুবাদ করান। এই ফার্সি অনুবাদ থেকেই পরবর্তীকালে গ্রন্থটি ইংরেজির মাধ্যমে জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করে। 

বাবুরের ব্যক্তিজীবন ছিল মূলত সামরিক জীবন। আশ্চর্য ক্ষিপ্র গতিতে অতিবাহিত হয়েছে তাঁর জীবন। মাত্র ৪৭ বছরের এই জীবনে তিনি সম্পূর্ণরূপে নিজের প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে যা করে গিয়েছেন তা বিস্ময়কর। ফারগানা থেকে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে দিল্লি অধিকার এই ক্ষিপ্রগতিময় জীবন তাঁর নামকে সার্থক করে। ‘বাবর’ শব্দের অর্থ লিওপার্ড, যা চিতাবাঘ এবং তার ক্ষিপ্রতাকেই নির্দেশ করে। এই জীবন ছিল একদিকে সামরিক জীবন আরেক দিকে ছিল কবি এবং সাহিত্যিকের জীবন। একহাতে অসি তো অন্য হাতে মসি। উভয়ভাবেই সার্থক তাঁর জীবন। এই জীবনের প্রতিকৃতিও বৈচিত্র্যময়, বিশাল, ব্যাপক এবং বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। 

পারিবারিক জীবনে তিনি যেমন দায়িত্বশীল পতি, তেমনি তাঁর ছিল একাধিক পত্নী। তিনি ছিলেন তাঁর সন্তানদের দায়িত্বশীল পিতা এবং বহু সন্তানের জনক। তাঁর সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি হন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হুমায়ূন। তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানদের নাম এখানে তুলে ধরলে তাঁর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতি তুলে ধরা সম্ভব হবে। 

বাবুর বিরচিত ‘বাবরনামা’ ও তাঁর কন্যা গুলবদন বেগম বিরচিত ‘হুমায়ূননামা’য় বাবুরের নয় স্ত্রী ও সন্তানদের কথা উল্লেখিত হয়েছে। তাঁর নয় স্ত্রী ও তাঁর সন্তানদের নাম—পরিচয় এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে : 

১. আয়েশা সুলতানা বেগম : তিনি ছিলেন বাবুরের চাচা আহমদ মির্জার কন্যা। বাবুরের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তাঁর সঙ্গে বাগদান সম্পন্ন হয় এবং খোজন্দে ১৫০০ ঈসায়ী সনে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৫০১ ঈসায়ীতে তিনি এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন কিন্তু এক মাসের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। 

২. জয়নব সুলতানা বেগম : ইনি সুলতান মাহমুদ মির্জার কন্যা ছিলেন। ১৫০৪ ঈসায়ী সনে তাঁর বিয়ে হয়। এবং দুর্ভাগ্যবশত, দু’বছর পরেই তিনি মারা যান। 

৩. মাসুমা সুলতানা বেগম : ইনি সুলতান আহমেদ মির্জার কন্যা ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল হাবিবা সুলতান বেগম আরগুন। ইনি বাবুরের প্রথমা পত্নী আয়েশা সুলতানার সৎ—বোন ছিলেন। এটি ছিল একটি প্রেম—বিবাহ, যা ১৫০৭ সনে সম্পন্ন হয়েছিল। দু’বছর পরে এক পুত্র সন্তান জন্মের সময়ে তিনি মারা যান। তাঁর নামেই বাবুরের এক কন্যার নাম রাখা হয় মাসুমা সুলতানা বেগম। 

৪.মাহম বেগম : ইনি খুব উচ্চবংশজাত ছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে জানা যায় যে, তিনি খুরাসানের প্রসিদ্ধ সাধক শেখ আবু নসর আহমদ জামের বংশজাত ছিলেন। ১৫০৬ ঈসায়ী সনে হেরাতে বাবুরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি পাঁচ সন্তানের জননী ছিলেন। বারবুল মির্জা, মেহের জাহাঁ, এশান দৌলত বেগম, ফারুক মির্জা ও হুমায়ূন মির্জা। তাঁদের প্রথম চার সন্তান শৈশবেই মারা যান। বাবুরের পরে দিল্লির বাদশাহ হন হুমায়ূন মির্জা। 

৫. গুলরুখ বেগম : এঁর বংশ পরিচয় জানার মতো তথ্য আমাদের হাতে নেই। ১৫০৮ ঈসায়ী সনে বাবুরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এর পাঁচ পুত্ৰ সন্তানের মধ্যে কামরান ও আসকারি হুমায়ূনের রাজত্বকাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন এবং তাঁর দুর্ভাগ্যের কারণ বনে যান। 

৬. দিলদার আগাচাহ : ইনি বাবুরের দ্বিতীয় পত্নী জয়নব বেগমের বোন ছিলেন। ১৫০৯ অথবা এর কিছু পরে বাবুরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। এর গর্ভে ছয় সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গুলরুখ, গুলরংগ, গুলচেহেরা, হিন্দাল, গুলবদন ও আলওয়ার। এঁদের মধ্যে দু’জন বিখ্যাত ছিলেন—হিন্দাল মির্জা (১৫১৮—৫১ ঈ.) ও গুলবদন বেগম। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এঁরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

৭. মুবারিকা বিবি : ইনি শাহ মনসুর ইউসুফজাঈয়ের কন্যা ছিলেন। বাবুর কেহরামে ১৫১৯ ঈসায়ী সনের ৩০ জানুয়ারি এঁর সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। এটি ছিল একটি কূটনৈতিক বিবাহ। ইউসুফজাঈ আফগানদের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে তোলাই ছিল এ বিয়ের উদ্দেশ্য। তাঁর কোনো সন্তান ছিলেন না। কোনো কোনো গ্রন্থে এরকম উল্লেখ আছে যে, সম্ভবত বাবুরের অন্য পত্নীরা তাঁকে এমন কোনো ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন, যে জন্য তাঁর কোনো সন্তানাদি হয়নি। 

৮. গুলনার আগাচাহ ও ৯. নারগুল আগাচাহ : এঁদের বংশ পরিচয় সম্বন্ধে স্পষ্ট তথ্য ‘হুমায়ূননামা’ ও ‘আকবরনামা’য় মেলে না। সম্ভবত এঁরা দাসী ছিলেন। ইরানের বাদশাহ শাহ তহমাস্প ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে এঁদের বাবুরকে উপহার স্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। প্রথমে এঁরা দাসী থাকলেও পরে রাজভবনের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের মধ্যে এঁরা স্থান লাভ করেন। গুলবদনের বর্ণনায় কয়েকটি উৎসব ও পারিবারিক পরামর্শ সভায় এঁদের অংশগ্রহণের কথা জানা যায়। গুলনার হিন্দালের বিবাহোৎসবে উপস্থিত ছিলেন এবং গুলবদন বেগমের সঙ্গে ১৫৭৫ ঈসায়ী সনে হজে গিয়েছিলেন। গুলবদন লিখেছেন, বাবুর তাঁর জীবনের অন্তিম দিনগুলোতে এঁদের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। 

এই নয় পত্নী ছাড়াও ‘তারিখ—এ—শাহরুখ’ গ্রন্থের লেখক নিয়াজ মুহম্মদ খুকন্দি সায়িদা আফাক নামক দশম পত্নীর নামও উল্লেখ করেছেন। বেগা বেগম নামে তাঁর আরো এক স্ত্রী ছিলেন। এই দশের অতিরিক্ত কেউ কেউ বাবুরের আরো পত্নী ও দাসীর কথা অনুমান করেছেন কিন্তু তথ্য দিতে পারেননি। 

গুলবদন বেগম বাবুরের ১৯ সন্তানের কথা উল্লেখ করলেও তিনি কেবল ১৮ জনের নাম উল্লেখ করেছেন। তবে, হুমায়ূনের রাজত্বকাল অবধি কেবল তিন সৎ ভাই ও চার সৎ বোন জীবিত ছিলেন। 

এখানে বাবুরের সন্তান—সন্ততিদের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে : 

পুত্রগণ 

১. হুমায়ূন মির্জা 

২. কামরান মির্জা

৩. আসকারি মির্জা 

৪. হিন্দাল মির্জা 

৫. আহমদ মির্জা 

৬. শাহরুখ মির্জা 

৭. কিদা মির্জা 

৮. বারবুল মির্জা 

৯. আলোয়ার মির্জা 

১০. ফারুক মির্জা 

কন্যাগণ 

১১. ফখর—উন—নিসা বেগম

১২. ইশান দৌলত বেগম 

১৩. মেহের জাহান বেগম

১৪. মাসুমা সুলতান বেগম 

১৫. গুলজার বেগম 

১৬. গুলরংগ বেগম 

১৭. গুলবদন বেগম 

১৮. গুলচেহেরা বেগম 

১৯. গুলবর্গ বেগম 

২০. আলতুন বিশিক 

এখানে বাবুরের এগারো স্ত্রী ও কুড়ি সন্তানের নাম দেওয়া গেল। তবে আগেই বলা হয়েছে যে, হুমায়ূনের প্রথম রাজত্বকাল অবধি তাঁর তিন সৎভাই ও চার সৎ বোন জীবিত ছিলেন। তবে হুমায়ূনের দ্বিতীয় দফার রাজত্বকালে এবং দিল্লির সিংহাসন পুনরাধিকার কালে তাঁর সৎ ভাইদের মধ্যেকার কেউ আর বেঁচে ছিলেন না। 

বাবুরের জন্ম ও বংশ পরিচয় 

জহির—উদ—দিন মুহম্মদ জালাল—উদ—দিন বাবুর, সংক্ষেপে ‘বাবুর’ নামেই পরিচিত। পিতা উমর শেখ মির্জা, ফারগানা, বর্তমান উজবেকিস্তান রাজ্যের শাসক ছিলেন। মাতা কুতলুক নিগার খানম। পিতার দিক দিয়ে বাবুর মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত বিজেতা এবং ভারত জয়ী বীর আমির তাইমুরের চতুর্থতম অধঃস্তন এবং মায়ের দিক দিয়ে মোগল বীল চেঙ্গিস খানের চতুর্দশ অধঃস্তন ছিলেন। তাইমুর বংশীয় এই মহান সন্তান পূর্ব—পুরুষ আমির তাইমুরের সূত্রে ভারতকে তাঁর উত্তরাধিকার বলে বিবেচনা করতেন। সেই আকাঙ্ক্ষা ও পূর্ব পৌরুষেয় আবেগ তাঁকে ভারত—বিজয়ে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি কাবুল থেকে সসৈন্যে এসে ভারতের পানিপথের যুদ্ধে দিল্লি সালতানাতের শেষ প্রদীপ ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন তথা তাঁর পূর্ব—পুরুষ তাইমুরের রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। এইভাবে তিনি তাঁর স্বপ্ন সাকার করেন। 

বাবুর জন্মেছিলেন তৎকালীন মধ্য এশিয়ার ফারগানা রাজ্যের আন্দিজান শহরে ১৪৮৩ ঈসায়ী সনের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে। ফারগানা এখন উজবেকিস্তান নামে পরিচিত। তৎকালীন ফারগানা রাজ্যের শাসক উমর শেখ মির্জার জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন বাবুর। উমর শেখ মির্জার স্ত্রী, অর্থাৎ বাবুরের মা কুতলুক নিগার খানম ছিলেন চেঙ্গিসি উত্তরাধিকারী ইউনুস খানের কন্যা। পিতা এবং মাতা উভয় দিককার বিবেচনায় মঙ্গোলদের থেকে উদ্ভূত বারলাস উপজাতিতে বেড়ে ওঠা বাবুরের জাতি—পরিচয়ের মধ্যে তুর্কি ও পারস্য সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছিল। এই অঞ্চলগুলো পরবর্তীতে ইসলামি জাতিতে পরিণত হয় এবং খোরাসান ও তুর্কিস্তান নামে পরিচিতি লাভ করে। বাবুরের মাতৃভাষা ছিল চুগতাই। ওই ভাষা তাঁর কাছে তুর্কি ভাষা নামে পরিচিত ছিল। সেজন্য বাবুরের মাতৃভাষাকে চুগতাই তুর্কি ভাষা বলা হয়। ওই ছাড়া ওই যুগে তাইমুরি বিত্তবান ও সংস্কৃতিবানদের প্রধান ভাষা ফার্সিও তাঁর দখলে ছিল। ফলে তিনি চুগতাই তুর্কি ও ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত হয়ে উঠেছিলেন। আর ওই রকমই একটি সমৃদ্ধ ভাষা হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া চুগচাই তুর্কিতে তিনি লিখেছিলেন তাঁর প্রসিদ্ধ আত্মজীবনী ‘তুজুক—ই—বাবরী’ যা ফারসিতে অনূদিত হয়ে ‘বাবরনামা’ নামে জগদ্‌বিখ্যাত হয়ে ওঠে। চুগতাই তুর্কির ভাষা ফার্সির মতোই আরবি লিপিতে লেখা হয় এবং সে ভাষা, তার গঠনশৈলী, যেমন শব্দগঠন, বাক্যগঠন, ব্যাকরণ প্রায় সবটাই ফার্সির অনুসারী। 

আন্দিজানিরা সকলেই তুর্কি ছিলেন। শহর, বাজার, জনবসতি, লোকালয়—এক কথায় সকলেই তুর্কি নামে পরিচিত ছিলেন। সাহিত্যের ভাষা মানুষের কথ্য ভাষাকেই গ্রহণ করেছিল। যেমন মির আলী শের নাওয়াইয়ের লেখা, যদিও তিনি ‘হিন’ বা হেরাতে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন, তা সত্ত্বেও তা এগুলোরই একটি উপভাষা। সুন্দর চেহারার মানুষ সেখানে খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিল। বিখ্যাত সংগীত শিল্পী খাজা ইউসুফ ছিলেন একজন আন্দিজানি। 

বাবুর একজন মোঙ্গলীয় হওয়া সত্ত্বেও মধ্য এশিয়ায় তুর্কি এবং ইরানিদের কাছ থেকে ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছিলেন। বাবুর তাঁর সেনা গঠন করেছিলেন বিভিন্ন জাতির মানুষদের সমন্বয়ে। তাঁর সেনাদলে ইরানি, তুর্কি, পাঠান, আরবীয়, নানা উপজাতীয় আফগান সবাই ছিল। সে হিসেবে তাঁর সেনা ছিল সৰ্ববাদীসম্মত জাতীয় বাহিনী। সবাইকে নিয়ে চলার, সবার মধ্যে নিজের ব্যক্তিত্বের প্রভাব বিস্তার করার, সবাইকে একই নেতৃত্বে নিয়ে আসার যে অসাধারণ যোগ্যতা বাবুরের ছিল তাই তাঁকে অবলীলাক্রমে দিগ্বিজয়ী বাদশাহ রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। তিনি ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বটে, কিন্তু বৃহত্তর অর্থে তিনি সমগ্র মধ্য এশিয়ার বাদশাহ। 

ব্যক্তি—জীবনে তিনি ছিলেন হানাফি মজহাবভুক্ত গোঁড়া সুন্নি মুসলমান। কিন্তু এটা ছিল তঁর ব্যক্তিগত বোধের জায়গায় সুদৃঢ় এবং সুপ্রতিষ্ঠিত। তা সত্ত্বেও শিয়া এবং সুফিদের তিনি মোটেও উপেক্ষা করেননি। সেটা করলে তিনি ইরানি সুলতান ইসমাঈল সফভির নৈতিক সমর্থন ও সামরিক সহযোগিতা পেতে ব্যর্থ হতেন। এক অতি উচ্চ পর্যায়ের সামরিক প্রতিভাও যেমন তাঁর ছিল তেমনি ছিল কূটনৈতিক প্রতিভাও। এর অন্যতম উজ্জ্বল প্রমাণ পাওয়া যায় বেয়াড়া আফগান উপজাতিদের তাঁর প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা প্ৰদৰ্শনে। 

বাবুর ছিলেন অত্যন্ত সুগঠিত শরীর ও স্বাস্থ্যের অধিকারী। তিনি কেবল ব্যায়ামের জন্য দু’কাঁধে দুজন মানুষকে বসিয়ে নিয়ে ঢাল বেয়ে দৌড়ে নামতেন। কিংবদন্তি আছে চলার পথে বাবুর তাঁর সামনে পড়া সকল নদী সাঁতরে পার হতেন এবং ভারতের গঙ্গা নদী তিনি দু’বার সাঁতরে পার হয়েছিলেন। সুদৃঢ় মানসিক শক্তি ও স্পৃহার অধিকারী ছিলেন তিনি। প্রথমা স্ত্রী সুলতান বেগমের কাছে বাবুর অত্যন্ত লাজুক ছিলেন এবং পরে তিনি তাঁর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে কিশোর বয়সের কামনা বাবুরী নামে এক বালকের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। 

তুর্ক মঙ্গোলীয় ও ইরানি সংস্কৃতি 

ট্রান্স অক্সিয়ানা ও খোরাসানে তুর্ক মঙ্গোলীয় এবং ইরানি জনগণ পাশাপাশি বসবাস করতেন। এঁরা নৃতাত্ত্বিক জাতিতাত্ত্বিকভাবে বিভক্ত হলেও কালের ধারাবাহিকতায় অনিবার্যভাবে এদের জীবনে ইসলাম এসে গিয়েছিল। ধর্মতাত্ত্বিক তথা ধর্ম বিশ্বাসের দিক দিয়ে তাঁরা মুসলিম হয়ে গেলেও যুগ—যুগান্তরের দৈশিক—আঞ্চলিক সংস্কৃতির অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বাদ পড়ে যেতে থাকে। যেমন সাগ্নিক—পৌত্তলিক ধারার ধ্যান—ধারণা উপজাত বিশ্বাস—এ সব তাদের সাংস্কৃতিক জীবনে অপসাংস্কৃতিক অপবাদ বলে বিবেচিত হতে শুরু করে। ইসলাম তাদের সংস্কৃতিবান করে তুলতে থাকে। একই কথা মঙ্গোলীয়দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমনটি বাবুরের নিকটাত্মীয় মির্জা হায়দার লিখেছেন—‘চুগতাইয়ের আমল (মোঙ্গল বা মোগল সম্প্রদায় চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় পুত্র চুগতাই খান থেকে উদ্ভূত) ছিল নিষ্ঠুর এবং কুরুচিপূর্ণ এবং বর্তমান সময়ের মতো শিক্ষিত ছিল না। বোঝা যায় যে, অসংস্কৃত নামা জাতি—গোষ্ঠী ইসলামের সংস্পর্শে এসে সুসংস্কৃত হয়ে ওঠে। তুর্ক—মঙ্গোলীয়—ইরানি সকলের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য। ইসলাম তাদের সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠার শিক্ষা স্বরূপ তাদের মসজিদ দিয়েছে—যেখানে ছোট—বড়—ধনী—দরিদ্রের কোনো ভেদ নেই। সে জন্য অঞ্চলগতভাবে সংস্কৃতির নাম ভিন্ন—ভিন্ন হলেও তারা যখন ইসলামের আদলে সুসংস্কৃত হয়ে ওঠে তখন হয়ে যায় মুসলিম। অতএব তুর্ক—মঙ্গোলীয়—ইরানিরা ইসলাম গ্রহণের পর রাতারাতি একট সুসংস্কৃত জাতি ও শাসকগোষ্ঠী হয়ে উঠল। এখানে জেনে রাখা দরকার যে, তুর্ক মঙ্গোলীয়রা ছিল প্রধানত সামরিক পেশার মানুষ এবং ইরানিরা ছিল বেসামরিক মানুষ। ইরানিদের মধ্যে প্রচলিত ছিল ফার্সি ভাষা এবং তুর্ক—মঙ্গোলীয়দের মধ্যে প্রচলিত চুগতাই ভাষা। মধ্য এশিয়ায় তৃণভূমি প্রধান বৃক্ষহীন প্রান্তরে চেঙ্গিস খানের পৃষ্ঠপোষকতার তুর্ক—মঙ্গোলরা একটি রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। অত্যন্ত প্রভাবশালী ভাষা রূপে বিরাজমান ফার্সি ছিল এদের প্রধান ভাষা, তাজিক ভাষা ছিল এদের মাতৃভাষা এবং সমস্ত শিক্ষিত ও শহুরে মানুষের ভাষা ছিল ফার্সি ভাষা। আমির তাইমুরের সরকারি তথা রাজভাষাও ছিল ফার্সি, এই ভাষায় তাঁর প্রশাসন চলত। তাঁর রাজ্যের ইতিহাস, কাব্য—কবিতা ও সাহিত্য—সংস্কৃতি এই ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু আমির তাইমুরের পরিবার ও গৃহ পরিবেশে চুগতাই তুর্কি ভাষা প্রচলিত ছিল। ওই যুগে আরবি ছিল জ্ঞান—বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব তথা উৎকর্ষমূলক বিষয়াবলি ও উচ্চ ভাবধারা প্রকাশের ভাষা। 

বাবর বা বাবুর—নাম ও পদবি 

জহির উদ—দিন মুহম্মদ তাঁর নাম, কিন্তু তিনি ডাকনাম বাবর বা বাবুর নামেই পরিচিত হয়ে গেলেন। বাবর নামটি একটি লোমশ জন্তু ইন্দো—ইয়োরোপীয় শব্দ ‘বিভার’—রাশিয়ান ‘ববর’, তুর্কি শব্দ ‘বাবর’—বাবুর, ইরানি—তুর্ক উচ্চারণ ‘বাহ—বর’, অবশেষে তার উচ্চারণ দাঁড়িয়ে গেল বাবর বা বাবুর। মির্জা মুহম্মদ হায়দার লিখেছেন—‘চুগতাই এর আমল (মোঙ্গল সম্প্রদায় চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় পুত্র চুগতাই খান থেকে উদ্ভূত) ছিল নিষ্ঠুর এবং কুরুচিপূর্ণ এবং বর্তমান সময়ের মতো শিক্ষিত ছিলেন না। তাঁরা দেখল এ নামটা উচ্চারণ করা, সুকঠিন। সে জন্য তাঁরা তাঁর নাম দিলেন ‘বাবর’। উল্লেখ্য যে, চুগতাই খানের নামানুযায়ী যেমন ‘মোগল’ ‘মোঙ্গল’ বা ‘মুঘল’ শব্দটি এসেছে, তেমনই তাঁর নামানুসারে তাদের ভাষার নাম হয়েছে চুগতাই তুর্কি। বাবুরের মাতৃভাষা ‘চুগতাই তুর্কি’ নামে পরিচিত। এবং তিনি সেই ভাষাতেই লেখেন তাঁর আত্মজীবনী ‘তুজুক—ই—বাবরী, যা তাঁর পৌত্র আকবর ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করিয়ে তা সংরক্ষণ করেছিলেন। 

সামরিক জীবন 

১৫৯৪ ঈসায়ী সনে মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবুর তাঁর পিতৃরাজ্য ফারগানার শাসনভার গ্রহণ করেন। মধ্য এশিয়ার রাজ্য ফারগানা এখন উজবেকিস্তান নামে সুপরিচিত। তাঁর সিংহাসন নিষ্কণ্টক হতে দেননি তাঁর নিজের চাচা ও আত্মীয়—স্বজনেরা। এর বাইরেও আরো অনেক শত্রু ছিল তাঁর। এক সময়ে শত্রুদের ষড়যন্ত্র সফল হয়। বাবুর ক্ষমতাচ্যুত হন এবং কিছুকাল ধরে তিনি আশ্রয়হীন হয়ে যাযাবরের মতো জীবন—যাপনে বাধ্য হন। এ সময়ে তাঁর কয়েক বন্ধু এবং এলাকার কৃষকদের সঙ্গেই শুধুমাত্র তাঁর যোগাযোগ ছিল। যাযাবর জীবনের মধ্য থেকেই তিনি শক্তি সঞ্চয় করেন এবং ১৪৯৭ সনে সমরখন্দের উজবেক শহরে আক্রমণ চালান এবং সাত মাস পরে তিনি শহর দখলে সমর্থন হন। ইতোমধ্যে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে ফারগানায় কিছু অভিজাতের বিদ্রোহের কারণে স্থানটি তাঁকে হারাতে হয়। এদিকে ফারগানা পুনরুদ্ধারের জন্য অগ্রসর হলে রাতের অন্ধকারে তাঁর বাহিনীর লোকেরা তাঁকে ফেলে চলে যায়, ফলে তাঁকে সমরখন্দ ও ফারগানা দুটিই হারাতে হয়। বাবুর এ প্রসঙ্গে ‘বাবরনামা’য় সখেদে লিখেছেন—‘আমার হাত থেকে সমরখন্দও চলে গেল, ফারগানাও। এখন আমার আর জানা ছিল না যে, আমি কোথায় যাচ্ছি, আর আমার মনজিল কোথায়।’ 

১৫০১ ঈসায়ী সনে আবার সমরখন্দ পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি নেন। তবে পূর্বের মতোই তাঁর শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মুহম্মদ শায়বানি খানের কাছে আবারও পরাজিত হতে হয়। ফলে তিনি তাঁর কিছু বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। এরপর বাবুর একটি শক্তিশালী সেনা গঠনে তৎপর হন এবং তাতে তাজিক ও বাদাখশানিদেরও অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তুষারাবৃত অঞ্চল হিন্দুকুশ অতিক্রম করেন এবং কাবুল অধিকার করেন। কাবুল অধিকার তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। একদিকে তিনি যেমন আত্মীয়—কণ্টক—মুক্ত ধনী রাজ্য লাভ করেন তেমনই কিছুটা শান্তি—স্বস্তি লাভ করেন এবং বৃহত্তর সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা করতে থাকেন। এই সময়ে তিনি ‘পাদশাহ’ (বাদশাহ) উপাধি গ্রহণ করেন। ১৫০৬ ঈসায়ী সনে হুসাইন বাইকারার অকালমৃত্যু তাঁর পরবর্তী অভিযানকে বিলম্বিত করে। ওই সময়ে বাবুর তাঁর মিত্রপক্ষের শহর হেরাতে দু’মাসের জন্য অবস্থান করেন এবং সম্পদের অভাবে তিনি এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এর মধ্যেও  তিনি এই রাজ্যকে প্রাচর্যমণ্ডিত করেছেন। হেরাতের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের আধিক্যে তিনি চমৎকৃত হন। তিনি অহিগুরের কবি মির আলী শির নাওয়াইয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। নওয়াইয়ের সাহিত্যের ভাষা ছিল চুগতাই তুর্কি। তিনি বাবুরের প্রতিভার বহুমুখিনতায় মুগ্ধ হন এবং তাঁকে তাঁর মাতৃভাষা চুগতাই তুর্কিতে আত্মজীবনী লিখতে উৎসাহিত করেন। 

এদিকে কাবুলে বিদ্রোহ ঘনায়িত হচ্ছিল। সংবাদ পওয়ামাত্রই তিনি তৎক্ষণাৎ কাবুলে ফিরে এসে অত্যন্ত কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করেন। এর দু—বছর পর আরো একটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয় এবং কিছু শীর্ষ স্থানীয় নেতা তাঁকে কাবুল থেকে বিতাড়িত করেন। কিছু সঙ্গীসহ বাবুর কাবুল থেকে চলে গেলেও তিনি পুনরাক্রমণ করে কাবুল দখল করেন এবং বিদ্রোহীদের নিজের অধীনে নিয়ে আসেন। 

এদিকে ১৫১০ ঈসায়ী সনে উজবেক নেতা শায়বানি খান পারস্য, বর্তমান ইরানের শাসনকর্তা ইসমাঈল সফভির সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। ইনি ছিলেন বাবুরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু। বাবুর তাঁর সঙ্গে সরাসরি ময়দানে হাতাহাতি যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। ইসমাঈলের হাতে মৃত্যুর খবরে বাবুর এই ভেবে হতাশ হন যে, তাঁর সঙ্গে তাঁর সরাসরি হাতাহাতির সুযোগ আর হলো না, তবে, বাবুর এই সুযোগে তাঁর পূর্বপুরুষের তাইমুরি রাজ্য পুনরুদ্ধারের কাজে নেমে পড়েন। কয়েক বছর যাবত বাবুর ইরানি শাসক ইসমাঈলের সঙ্গে যোগসাজশে মধ্য এশিয়া অধিকারের জন্য মিলিত হন। বাবুর সফভিকে তাঁর রাজ্যের সার্বভৌম রাজা বলার অনুমতি দেন। শায়বানি খাঁ নিহত হলে তাঁর অন্তঃপুর থেকে বাবুরের বোন খানজাদা বেগমকে উদ্ধার করে ইসমাঈল বাবুরের কাছে ফিরিয়ে দেন। উল্লেখ্য যে, শায়বানি বাবুরের আত্মীয়—পরিজনদের নিজের পক্ষে টানার জন্য খানজাদাকে জোর করে বিয়ে করেন। ইসমাঈল বাবুরকে সামরিক সাহায্যসহ অনেক ধনসম্পদ সরবরাহ করেছিলেন, বাবুর প্রতিদানে তাঁকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যি সুবিধা দিয়েছিলেন। 

শাহ—এর পারস্য ওই সময়ে শিয়াদের দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়। তিনি নিজেকে সপ্তম শিয়া ইমাম মূসা আল—কাজিমের বংশধর বলে দাবি করতেন। সে সময়ে তাঁর নামে মুদ্রা চালু করা হয় এবং তাঁর নামে মসজিদে খুৎবা দেওয়া হতো। এদিকে কাবুলেও বাবুরের নামে মুদ্রা ও খুৎবা প্রচলিত ছিল। পরে বাবুর বুখারার দিকে রওনা হন এবং সেখানে তাঁর বাহিনীকে স্বাধীনতার সৈনিক হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। তাইমুর বংশীয় বলে এ ক্ষেত্রে তাঁর খুব সমর্থন ছিল। শহর ও গ্রামের লোকেরা তাঁকে ও তাঁর বাহিনীকে সর্বস্ব উজাড় করে দিতেও পিছপা হতো না। বাবুর এ ক্ষেত্রে পারস্যের শাহের সহযোগিতা ফিরিয়ে দেন শুধু এই হিসেবে যে, এখন আর তাঁর সাহায্যের আর ততটা প্রয়োজন নেই। ১৫১১ ঈসায়ী সনের অক্টোবরে বাবুর সমরখন্দে পুনঃপ্রবেশে সমর্থ হন। সমরখন্দ এতদিনে একটি সুসমৃদ্ধ শহরে পরিণত হয়ে উঠেছিল এবং সেখানকার জনগণ তাকে তাদের মুক্তিদাতা রূপে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। বাবুর শিয়া পোশাকে সুন্নিদের সামনে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। বাবুরের আত্মীয় মির্জা হায়দায় লিখেছেন—“বাবুর একটু ভীত ছিলেন পারস্যের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে। পারস্যের শাহকে খুশি করার জন্য যেমন সুন্নি সম্প্রদায়কে লাঞ্ছিত করেননি; তেমনই শাহের সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক হাতটিও সরিয়ে দেননি। এর ফলে, আট মাস পরে তিনি উজবেকদের উপর পুনরায় জয়লাভে সমর্থ হন।’ 

উত্তর ভারত জয় 

বাবুর তাঁর আত্মকথার একস্থানে সমরখন্দ পুনরুদ্ধার সম্পর্কে লিখেছেন—‘সমরখন্দ পুনরুদ্ধার ছিল আল্লাহর দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার।’ এরপর বাবুরের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ফারগানা পুনরাধিকার করা। এদিকে পশ্চিম দিক থেকে উজবেকদের আক্রমণের ভয় ছিল। তা ছাড়া বাবুরের আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল ভারত জয় করা। তিনি তাইমুরি ধারাবাহিকতায় ভারতকে উত্তরাধিকার বিবেচনা করতেন। 

বাবুর মনে করতেন, দিল্লি সালতানাতে পুনরায় তাইমুর বংশীয়দের শাসন কায়েম হওয়া উচিত। তিনি নিজে তাইমুরবংশীয় হওয়ার কারণে দিল্লি সালতান অধিকার করতে চাইতেন। তাইমুরের দিল্লি অধিকার প্রসঙ্গে দু—একটি কথা এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন। দিল্লি সালতানাতে খিলজি রাজবংশের পতনের পর একটা অরাজক অবস্থা চলে আসছিল। তাইমুর লঙ্গ—এর দিল্লি আক্রমণের পর সৈয়দেরা অবস্থার সুযোগ নিয়ে দিল্লির ক্ষমতা অধিকার করেন। তাইমুর লঙ্গের দ্বারা পঞ্জাবের শাসক নিযুক্তির পর খিজির খান এই বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। পরে, লোদি রাজবংশের আফগানরা সৈয়দদের হারিয়ে দিল্লি সালতানাত অধিকার করেন। 

এদিকে এ যুগে বাবুর নিজেকে সৈয়দ বংশের সত্যিকারের শাসনকর্তা হিসেবে দাবি করেন। লোদিদের হাতে বেদখল হয়ে যাওয়া সৈয়দ বংশের প্রকৃত শাসনকর্তা হিসেবে দিল্লি সালতানাতের দাবিদার বাবুর ইব্রাহীম লোদিকে একটি বার্তা পাঠান, তাতে তিনি যে দেশগুলো প্রাচীনকাল থেকে তুর্কিদের উপর নির্ভরশীল, সেগুলোর উপর নিজের অধিকার দাবি করেন। ইব্রাহীম লোদির জবাব না আসায় তিনি ছোট ছোট রাজ্যগুলোর উপর আক্রমণ শুরু করে দেন। সর্বপ্রথম তিনি কান্দাহার অধিকার করে নেন। তিনি কাবুলের পশ্চিম দিক থেকে ভারত আক্রমণের রণকৌশল ঠিক করেন। কান্দাহার বন্ধ করে দেওয়ার ফলে তাঁর ভারত আক্রমণ অপেক্ষাকৃত বিলম্বে সংঘটিত হয়। বাবুরের কান্দাহার দুর্গ দখল ও আরো ছোটখাটো কিছু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ সব যুদ্ধ তাঁর পরবর্তীতে ভারত আক্রমণে সফল হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। 

ইতোমধ্যে আর একটি ঘটনা ঘটে। এই সময়ের কথা বাবরনামায় নেই। এটি হয় তিনি লেখেননি, নতুবা লিখেছিলেন তবে নষ্ট হয়ে যায়। এই সময় ইরানের শাহ ইসমাঈল সফভি একটি চরম দুঃসময় কাটান। তাঁর বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অটোমান রাজা প্রথম সেলিম এর বিরুদ্ধে চালদিরাম যুদ্ধে। ওই যুদ্ধে অটোমান তুর্কিরা সর্বপ্রথম কামান ব্যবহার করে। ইসমাঈলের সহযোদ্ধা সঙ্গী বাবুর দু’জনেই সামরিক প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং বাবুর তাঁর বাহিনীকে কামান যন্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতে একজন অটোমান তুর্কি উস্তাদ আলী কুলী খাঁকে আমন্ত্রণ জানান। উস্তাদ তখন ‘কামান—মানব’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাবুরের একথা মনে ছিল যে, তাঁর বিরোধীরা এ ধরনের অস্ত্র তাঁর না থাকার জন্য তাঁকে বিদ্রুপ করত। এই যন্ত্রগুলো থেকে বিকট আওয়াজ বেরুত এবং তা থেকে কোনো বর্ষা বা তীর নিক্ষিপ্ত হতো না। এই অস্ত্রগুলো স্বল্পসংখ্যক সৈন্যদের হাতে দেওয়া হয় শত্রুদের উপর কর্তৃত্ব করার জন্য। ভারত জয়ের পথে অগ্রসর হওয়ার সময় বাবুর সঙ্গে কামান নেন এবং চলার পথে এগুলোর ব্যবহার হয় প্রধানত ক্ষুদ্র—ক্ষুদ্র শত্রুদলের শক্তি, অবস্থান ও কৌশল জানার জন্য। কাবুল ও কান্দাহার ছিল বাবুরের দুটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ও নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র। বাবুর ওই দুটি এলাকার মানুষদের সঙ্গে বড়ই আন্তরিক ব্যবহার করতেন এবং তাদের স্থানীয় সংস্কৃতি প্রতিপালনের সঙ্গে সঙ্গে বিধবা ও এতিমদের সাহায্য করে তাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। 

ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে যুদ্ধ 

ইব্রাহীম লোদি তাঁর কিছু ভ্রান্ত আচরণের জন্য তাঁর আমির—ওমরাহদের কাছে খুবই অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এই আমিররা তাঁর হঠকারিতা ও ভ্রান্তির কবল থেকে মুক্তির জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। বাবুর ভারত জয়ের পথে তাঁর আমিরদের একাংশের বড়ই আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছিলেন। এদিকে বাবুর ১২,০০০ সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং লোদির আমিরদেরও তাঁর পক্ষে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পানিপথের যুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার পথে বাবুরের সৈন্যসংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছিল, সেই সঙ্গে স্থানীয় অনেকেই তাঁর বাহিনীতে যোগ দিচ্ছিল। দুই পক্ষের মধ্যে প্রথম বড় সংঘর্ষ হয় বাবুর পুত্র হুমায়ূনের নেতৃত্বে, ১৫২৬ ঈসায়ী সনের ফেব্রুয়ারি মাসে। হুমায়ূনের বয়স তখন ১৭। হুমায়ূন এই যুদ্ধে অসাধারণ সামরিক যোগ্যতার পরিচয় দিতে সমর্থ হন। তিনি ইব্রাহীম লোদির উন্নত বাহিনীর সঙ্গে শুধু যুদ্ধই করেননি বরং তাদের হস্তিবাহিনীর কিছু হাতি ও সৈন্যকে বন্দি করে নিয়ে আসেন। এই যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়নি। হুমায়ূনের আদেশে তাদের তোপের মুখে উড়িয়ে দেওয়া হয়। বাবুর লিখেছেন—‘উস্তাদ আলী কুলী খাঁকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল তাদের তোপের মুখে উড়িয়ে দিতে। এটা ছিল হুমায়ূনের প্রথম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা …।’ 

ইব্রাহীম লোদি প্রায় লক্ষাধিক সৈন্য ও শতাধিক হাতির একটি বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। বাবুরের সৈন্যসংখ্যা ছিল লোদির চার ভাগের এক ভাগ। ১৫২৬ ঈসায়ী সনের ২১ এপ্রিলে সংঘটিত এই যুদ্ধটি পানিপথের প্রথম যুদ্ধ নামে খ্যাত। এই যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদি অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে মাটিতে নেমে আসেন এবং বীরগতি প্রাপ্ত হন। লোদির মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এই যুদ্ধের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তৎকালীন গুজরাটের শাসক বাহাদুর শাহ। তিনি বলেছিলেন—‘এটি ছিল কাচ ও পাথরের যুদ্ধ।’ উল্লেখ্য যে, এখানে কাচ বলতে ইব্রাহীম লোদির বাহিনীকে বোঝানো হয়েছে এবং পাথর বলতে বাবুর বাহিনীকে। অর্থাৎ পাথর যেমন কাচকে চূর্ণ—বিচূর্ণ করে দেয়, বাবুরের বাহিনী তেমনই ইব্রাহীম লোদির বাহিনীকে চূর্ণ—বিচূর্ণ করে দিয়েছিল। বাবুর ভারতের মাটিতে পানিপথের যুদ্ধে সর্বপ্রথম কামান ব্যবহার করেছিলেন। আর তার পরিচালক ছিলেন উস্তাদ আলী কুলী খাঁ। তৎকালীন যুগ পর্যন্ত ভারতবাসী সম্ভবত এর চেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ আর কখনো দেখেনি। যুদ্ধ জয়ের পর বাবুর অতি দ্রুত দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করে নিয়েছিলেন। ওই দিনই বাবুর হুমায়ূনকে দ্রুত আগ্রা রওনা করিয়ে দেন যাতে রাজকোষ লুটপাট না হতে পারে। হুমায়ূন আগ্রায় গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমাজিতের পরিবারকে পেয়ে যান। রাজা যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। এ পরিবার আগ্রা দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পথে হুমায়ূনের হাতে ধরা পড়ে যান। তিনি তাদের সসম্মানে আগ্রা দুর্গে নিয়ে আসেন। রাজপরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মূল্যবান হিরে জহরাতাদি উদ্ধার হয়। তার মধ্যে ‘কোহিনূর’ নামে একটি মণি পাওয়া যায়। যার অর্থ ‘আলোর পর্বত।’ হুমায়ূন এটি বাবুরকে উপহার দেন, বাবুর পুনরায় এটি হুমায়ূনকে উপহার দেন। কালানুক্রমে এই মণিটি চলে যায় ইংল্যান্ডের রাজ দরবারে। সেটি এখন সেখানেই মজুত রয়েছে। বাবুর তাঁর স্মৃতিকথায় এর মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন—‘এর মূল্য সমগ্র জগদবাসীর আড়াই দিনের পানাহারের মূল্যের সমান।’ 

বাবুর বিজয়ের তৃতীয় দিনে দিল্লি পৌঁছান। সেখানে পৌঁছেই তিনি সুলতানুল আউলিয়া হজরত নিজামউদ্দীনের দরগায় হাজিরা দেন। তারপর, হজরত কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর মাজারে। উল্লেখ্য যে, তাইমুর লঙ্গও দিল্লি জয়ের পর নিজামউদ্দীনের দরগায় হাজিরা দিয়েছিলেন। কথিত আছে, হজরত নিজামউদ্দীন তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং তাঁকে দিল্লি ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন। বলাবাহুল্য, সেই নির্দেশ শিরোধার্য করে তাইমুর লঙ্গ দিল্লি ছেড়ে চলে যান। বিজিত ভূমি তার নিজের জায়গাতেই গড়ে থাকে। বাবুরের দিল্লি বিজয় ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। বাবুর দিল্লির সালতানাতকে তাঁর উত্তরাধিকার বলে মনে করতেন। হজরত নিজামউদ্দীন তাঁকে ফিরে যাবার নির্দেশ দেননি। দিল্লির মানুষ তাঁকে খুব আপন করেই গ্রহণ করেছিলেন। দিল্লির পুরাতন রাজধানী যমুনার তীরে তাঁর উপস্থিতি উদযাপন করা হয় এবং তা শুক্রবার পর্যন্ত স্থায়ী করা হয়। মুসলমানরা শোকরানা নামাজ আদায় করেন, দিল্লির তৎকালীন জামে মসজিদে তাঁর নামে খুৎবা পাঠ হয়। পরে তিনি আগ্রা রওনা হয়ে যান পুত্র হুমায়ূনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। পরে ওই কোহিনূর মণির প্রসঙ্গ আসে। যা জগতের একটি অতি মূল্যবান বস্তু। 

রাজপুতদের সঙ্গে যুদ্ধ 

ভারতে মুসলিম রাজ কায়েম হওয়ার সাথে সাথেই পৌত্তলিক সমাজ তথা নেতৃত্ব যে তা মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, এমনটা কখনোই নয়। মুহম্মদ বিন কাশিমের বিরুদ্ধে দাহির, মুহম্মদ ঘুরির বিরুদ্ধে পৃথ্বিরাজ, বাবুরের বিরুদ্ধে রাণা সাঙ্গা সকলেই মুসলিমদের বিতাড়িত করে দিল্লি—রাজ কায়েমের স্বপ্নে মশগুল ছিলেন। প্রতি পদেই তারা ব্যর্থ ও পরাজিত হন। মুহম্মদ বিন কাশিম থেকে বাবুর আটশো বছরের সুদীর্ঘ পথ। এই পথে দিল্লির সালতানাত কায়েমে বাধা হয়ে দিল্লি রাজের স্বপ্ন দেখা রাণা সাঙ্গার নেতৃত্বে রাজপুতেরা আবারও সংগঠিত হয়ে উঠেছিল। রাজা বিক্রমাজিত ইব্রাহীম লোদির পক্ষে পানিপথের যুদ্ধে লড়ে নিহত হয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল ক্ষমতার অলিন্দ পেরিয়ে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করবেন। তা—ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এবার রাণা সাঙ্গার পালা, তিনি বাবুরকে পরাজিত করে দিল্লি রাজ কায়েমের স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রচুর সৈন্য ছিল রাজপুতদের, বাবুরের সৈন্য সংখ্যা তার অর্ধেকও ছিল না। যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। অবশেষে ১৫২৭—এর মার্চে বাবুর ও রাজপুতদের মধ্যে খানুয়ায় যুদ্ধ হলো। রাজপুতরা ভালোই যুদ্ধ করছিল। বাবুরের সৈন্যরা পিছু হটছিল। তারপর, বাবুরের সংরক্ষিত সেনা অগ্রগামী রাজপুতদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখনও বিজয়ের মূলমন্ত্র বাবুরের হাতেই ছিল। উস্তাদ আলী কুলী খাঁ—র কামান গর্জে উঠল। তাঁর গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল রাজপুত বাহিনী। রাজা সাঙ্গা পালিয়ে গেলেন। তবুও বাঁচতে পারলেন না। শোনা যায় তাঁর কোনো মন্ত্রী তাঁকে বিষ খাইয়েছিলেন। তাতেই মারা যান রানা সাঙ্গা। বাবুর মধ্য এশিয়া থেকে পূর্ব পুরুষের রাজ্য উদ্ধার করতে এসেছিলেন। করলেনও। অবিসংবাদিত বাদশাহ রূপে প্রতিষ্ঠিত হলো মোগল সাম্রাজ্য। যা তাঁর পরবর্তী ৩০০ বছর যাবত স্থায়ী হয়ে রয়ে গেল। 

মৃত্যু 

কথিত হয়েছে, আল্লাহ বাবুরের জীবন কবুল করে হুমায়ূনের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ১৫৩০ ঈসায়ী সনে ৪৭ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল তাঁকে কাবুলে দাফন করা হোক। কিন্তু প্রথমে আগ্রায় এবং তার ন’ বছর পরে শেরশাহ সূরী তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেন এবং কাবুলে দাফন করেন। 

সিংহাবলোকন 

কারো কারো প্রসঙ্গে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি সোনার বা রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন। কিন্তু বাবুরের ক্ষেত্রে কী বলা হবে? 

নিঃসন্দেহে তিনি একহাতে অসি ও আরেক হাতে মসি নিয়ে জন্মেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের দৃষ্টান্ত দু—একটা দেখা গেছে। বাবুর হলেন সেই দৃষ্টান্ত, যিনি একাধারে লেখক এবং কবি তো আরেক দিকে তিনি সৈনিক, সেনাপতি, বাদশাহ। বাবুর শুধু ভারতের নন, বরং তিনি সমগ্র মধ্য এশিয়ার সম্রাট। জন্মেছিলেন বর্তমান উজবেকিস্তানের ফারগানা নামক রাজ্যের আন্দিজান শহরে, একাদশ বছর বয়সে পিতৃহারা বালক বাবুর তাঁর পিতার রেখে যাওয়া রাজ্যের অধীশ্বর হয়েছেন। কিন্তু সেই রাজ্য হাতছাড়া হতে তাঁর খুব বেশি দেরি হয়নি। আত্মীয়—স্বজনদেরই ষড়যন্ত্রে তাঁকে রাজ্য হারাতে হয়েছে, জীবন নিয়ে প্রাসাদ ছাড়তে হয়েছে। নিঃস্ব—অসহায়ের মতো পথে পথে ঘুরতে হয়েছে। 

ফারগানা তাঁর রাজ্য, আন্দিজান তাঁর জন্মভূমি। তাঁর মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা তাঁকে করতে হয়েছে। করেছেনও কিন্তু হারাতে তাঁর বিলম্ব হয়নি। কী অসাধারণ সৈনিক প্রতিভা ও মনোবল নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন তা ভাবতে অবাক লাগে। যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন কিন্তু পুনঃপুনঃ ভাগ্য—পরীক্ষায় বারবারই অবতীর্ণ হয়েছেন। একদিকে শত্রুর বিরুদ্ধে ভূমি অধিকারের লড়াই, আবার অন্যদিকে তাঁর কবি—আত্মা, কবিমন, পরম শান্তিতে আত্মজীবনী লিখছেন, কাব্য—কবিতা লিখছেন, নিজের মাতৃভাষার লিপি সংস্কার করছেন। তাঁর রচনাবলি, তাঁকে ভূগোলবিদ, ইতিহাসবিদ, কাব্য ও সাহিত্যবিদ, সংগীতজ্ঞ ও লিপিবিশারদ বলে প্রতিষ্ঠা দেয়। এ এক বিস্ময়কর মনীষা। 

তাঁর জন্মস্থান ফারগানা উপত্যকায় অবস্থিত আন্দিজান। তাঁর আত্মকথায় তিনি সেই আন্দিজানের ভূ—প্রকৃতি, আবহাওয়া, ফলমূল, জীবন জীবিকা ও সাংস্কৃতিক জীবনের অপূর্ব বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেন—‘আন্দিজানের বাজার ও লোকালয়গুলোতে তুর্কি জাতির লোকেদেরই দেখা যায়। তাদের কথন এবং লিখনশৈলী সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ। … বলাবাহুল্য, ভাষার কথন ও লিখনশৈলীর মূল্যায়ন করতে গেলে সে বিষয়ে তাঁকে মাহির হতে হয়। বাবুর তা—ই ছিলেন। তিনি সেখানকার মানুষদের ধার্মিক বলে অভিহিত করেছেন। সেখানকার বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ইউসুফের কথাও লিখেছেন। যিনি আন্দিজানে জন্মানোর জন্য নিজেকে গর্বিত মনে করতেন। সেখানকার আবহাওয়ারও প্রশংসা করেছেন বাবুর। সেখানকার দুটি প্রধান ঋতুর তিনি বড়ই প্রশংসা করেছেন। শরৎ ও বসন্ত। আবহাওয়া যে মানুষের রীতি রেওয়াজ ও সাংস্কৃতিক জীবনকেও প্রভাবিত করে একথাও বলতে এবং লিখতে ভোলেননি বাবুর। 

আন্দিজানের বাগ—বাগিচা ও ফলমূলেরও বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। সেখানকার পাহাড় বেষ্টিত বাগ—বাগিচায় নানা ফুলেরও যেমন বর্ণনা দিয়েছেন তেমনই দিঘি ও পুকুরগুলোতে ফুটে থাকা নীল বর্ণের ঘণ্টাকৃতির ফুলের বর্ণনাও দিয়েছেন, রঙ—বেরঙের ফুলের মধ্যে বিশিষ্ট ফুল রূপে গোলাপের বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি। এখানকার সুস্বাদু ও রসালো ফলগুলোর মধ্যে তিনি বিশেষ করে আনার ও খুবানি ফলের কথাও উল্লেখ করেছেন। 

আন্দিজানের প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক বর্ণনাও দিয়েছেন বাবুর। এখানকার ঐতিহাসিক বর্ণনা প্রসঙ্গে এসেছে সমরখন্দ ও বুখারার কথা। যা তাঁর পূর্বপুরুষ আমির আইমুর নিজহাতে গড়ে গিয়েছেন। এখানকার একশ্রেণির মানুষের পশুপাখি শিকার করার শখের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। সমরখন্দ ও বুখারার মানুষদের ভাষারূপে তিনি ফার্সি ভাষার উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন—‘এখানকার সকল মানষই ফার্সি ভাষা ব্যবহার করেন।’ তিনি সমরখন্দের পাহাড়ি এলাকায় এখন একটি উজ্জ্বল পাথরের বর্ণনা দিয়েছেন, ইংরেজিতে যাকে ‘মিরর স্টোন’ বলা হয়, বাংলায় বলে, ‘আয়না পাথর’। তাতে সবকিছুই আয়নার মতোই প্রতিফলিত হয়। তিনি এখানকার ফলমূলের মধ্যে বাদামের নামই বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য ফলের প্রাচুর্যের কথাও আছে। 

সমরখন্দ থেকে সড়ক পথে ‘খুজন্দ’ নামক একটি শহরের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। এখানকার কৃষির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে নানাবিধ ফলের মধ্যে আনারের কথা বিশেষ করে লিখেছেন। খুজন্দের উত্তর দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া ‘শাইহুন’ নদীর কথা তিনি এক অপূর্ব উপমা খচিত ভাষায় বর্ণনা করেছেন—‘শাইহুন নদী কিছু দূর থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের মতো বয়ে গেছে। এখানে অনেক মূল্যবান পাথরের খনির কথা তিনি লোকমুখে জানতে পারেন। সেই সঙ্গে তিনি এখানে সাপের উপদ্রবের কথাও লিখেছেন এবং এও লিখেছেন যে কিষাণ ও খরগোশ অতিমাত্রায় দেখা যায়। এখানকার আবহাওয়া তেমন মধুর নয়, দূষিত। ফলে, মানুষ নানা রোগ—পীড়া এবং বিশেষত জ্বরে আক্রান্ত হয়। কথিত আছে যে, এখানে জ্বরের জীবাণু প্রধানত পার্বত্য এলাকাগুলো থেকে উড়ে আসা পাখিরা বয়ে আনে। 

বাবুর ফারগানা রাজ্যের অধীনস্ত কিছু নগর—মহানগরের বর্ণনা দেওয়ার পর তাঁর পূর্ব—পুরুষদের বর্ণনা দিয়েছেন অতি—সংক্ষেপে। এখানে লেখক তাঁর পিতা উমর শেখ মির্জার অকাল মৃত্যুর কথা অত্যন্ত সংক্ষেপে অথচ সুন্দর আলঙ্কারিক ভাষায় লিখেছেন—‘সোমবারের দিন রমজান মাসের, মোতাবেক জুন মাসের ৮ তারিখে উমর শেখ মির্জা তাঁর সমস্ত কবুতর উড়িয়ে দিলেন এবং নিজে বাজ হয়ে গেলেন (অর্থাৎ তাঁর মৃত্য হয়ে গেল)।’ বাবুর এখানে তাঁর বংশাবলির বর্ণনা দিয়েছেন এবং নিজেকে তাইমুর বংশের চতুর্থ প্রজন্মের ওয়ারিশ হওয়ার তথ্য দিয়েছেন। উমর শেখ মির্জা হানাফি মজহাবভুক্ত সুন্নি মুসলিম ছিলেন। তিনি ছিলেন সাচ্চা মুসলিম, নামাজি এবং পরহেজগার। বাবুরও তাই ছিলেন। বাবুর তাঁর পিতা সম্পর্কে লিখেছেন—‘তিনি ছিলেন প্রাকৃতিক কলাপ্রেমী, সৌখিন এবং অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন মানুষ। লেখক তাঁর পিতৃকুলের মতোই মাতুল কুলের পরিচয়ও লিপিবদ্ধ করেছেন। সেখানকার পরিচয় থেকে জানা যায় যে, তিনি মাতুল কুলের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের চতুর্দশতম অধঃস্তন পুরুষ। 

পিতা উমর শেখ মির্জার অকালমৃত্যু বালক বাবুরের জীবনে ভয়াবহ বিড়ম্বনা বয়ে আনে। কিন্তু তাঁর মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও প্রতিভাবান বালক ছিলেন প্রকৃতপক্ষে অতিপ্রাকৃত কিংবা অপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী। সীমাহীন উদ্যম ও অসাধারণ কর্মক্ষমতা, প্রকৃতপক্ষে তাঁকে অতিপ্রাকৃত করেই তুলেছিল। এ সব ছাড়াও তিনি ছিলেন অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। মানুষ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিত। ‘হয় মারব না হয় মরব’ বলে তাঁর দলে এসে ভিড়ত, মরণ—পণ যুদ্ধ করত আর তাঁকে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছ দিত। বাবুর যে কখনো—কখনো হারের মুখ দেখতেন না, তা নয়। তিনি বরং জয়—পরাজয়কে একই মুদ্রার এপিঠ—ওপিঠ বলেই গণ্য করতেন। এ সব স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার মতো অতিপ্রাকৃত মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতা তাঁর ছিল। 

প্রসঙ্গত, তাঁর সমরখন্দ অভিযানের কথা। সমরখন্দ তিনি প্রথমবার জয় করলেন। সমস্ত বাধা—বিপত্তি অতিক্রম করে তিনি সমরখন্দ জয় করলেন। বিজয়মদমত্তে সৈন্যরা তাল হারিয়ে ফেলল। লুটপাট চালাল। অথচ তিনি আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন যেন লুটপাট না হয়। ইয়াম নামক শহরের বাজারে সৈন্যরা লুটপাট চালায়, অথচ তিনি ইয়ামবাসীদের আশ্বাস দিয়েছিলেন লুটপাট হবে না। সৈন্যরা এটা করে ফেলাতে তিনি অত্যন্ত বিব্রতবোধ করলেন। ওয়াদা ভঙ্গের দায়ে বিবেকের দংশনে পড়লেন। কিন্তু তিনি কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করতেন না। বাধ্য হয়ে তিনি সৈন্যদের মাঝখানে গিয়ে বিষয়টির উল্লেখ করলেন। সৈন্যরা অনুগত ও বাধ্য বালকের মতো লুটের সমস্ত মাল তাদের ফিরিয়ে দিল। বাবুর লিখেছেন—‘আমার কথা শুনতেই সৈনিকেরা যে অনুশাসনের পরিচয় দিল তা অতুলনীয়। ওই দিন প্রথম প্রহরে আমার সৈনিকেরা যে মাল যেখান থেকে লুটেছিল সেখানেই নিয়ে রেখে এল। তারা সবকিছু ফিরিয়ে দিয়েছিল। এক টুকরো সুতো পর্যন্তও, এমনকি ভেঙে যাওয়া সুচটিও পর্যন্ত নিজেদের কাছে রাখল না। সবকিছুই বণিকদের কাছে পৌছে গেল, যারা যার মালিক ছিল। 

লেখক সমরখন্দের যে প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক বর্ণনা দিয়েছেন তা বড়ই আকর্ষণীয়। বাবুরের ভাষায়—‘সমরখন্দ খুব সুন্দর শহর। এর পূর্বে কোহিক নদী প্রবহমান। এ নদী কোহিক পাহাড় থেকে বয়ে এসেছে বলে এর এই নাম। এই নদী থেকে অনেক নহর বের করে আনা হয়েছে। যা সেচের সাধন হয়েছে। বাগিচা পর্যন্ত নহরের পানি পৌঁছে যায়, যার কারণে সমরখন্দে ফসল উৎপন্ন হয়। এই নদী বুখারা পর্যন্ত রয়ে গিয়ে তাকে শস্য—শ্যামল করে তুলেছে।’ 

এখানে অন্য নদীর বর্ণনাও এসেছে। সমরখন্দের উৎপাদিত ফল—ফসলের মধ্যে আঙুর, তরমুজ, আপেল এবং আনারের কথা বিশেষভাবে এসেছে। তিনি এ—ও লিখেছেন, ‘সমরখন্দের আপেল ও আঙুর জগদ্বিখ্যাত। প্রাকৃতিক অবস্থার কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন—‘এখানে খুব ঠান্ডা পড়ে, তবে কাবুলের মতো নয়। 

বাবুর সমরখন্দের ঐতিহাসিকতার কথা অত্যন্ত মহিমান্বিত ভাষায় বর্ণনা করেছেন। প্রকৃত সত্য হলো—সমরখন্দ তো আমির তাইমুরের হাতে গড়া শহর। এই শহরের বর্ণনায় বাবুর লিখেছেন—‘সমরখন্দের উপনগরগুলোতে অনেক সুন্দর সব ইমারত রয়েছে। এ সকল ইমারত ও এখানকার সুন্দর বাগিচাগুলো তাইমুর বেগ ও ঔলংগ বেগ মির্জা নির্মাণ করিয়েছিলেন।… এর এক উপনগর সিল্ক সরাইয়ে—তাইমুর বেগ যেখানে নিজের দুর্গ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এটি চার দরজাবিশিষ্ট বিশাল দুর্গ। নগর চারদিক থেকে প্রাচীর বেষ্টিত। মুখ্য দ্বার লৌহ দরওয়াজা রূপে রয়ে গিয়েছে। নামাজে জুমআর জন্য এখানে একটি বিশাল মসজিদ নির্মিত হয়। এ মসজিদ প্রস্তর নির্মিত। এতে পাথর খুদে নকশা করা হয়। পাথর শিল্পীদের হিঁদুস্তান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এর গম্বুজ মেহরাব—বিশিষ্ট। এতে আলোকিত লিপি অংকিত আছে যেগুলো কুরআনের আয়াত। লিপি এত স্পষ্ট যে, দু’মাইল দূর থেকেও তা পড়া যায়।’… এ ছাড়া আরো ঐতিহাসিক বর্ণনা এ প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন বাবুর। লেখক এখানে ঐতিহাসিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। 

সমরখন্দের ভৌগোলিক বর্ণনা প্রসঙ্গে বাবুর লিখেছেন—‘সমরখন্দের সবচেয়ে বড় নগর বুখারা। এই নগর যেখানে সুন্দর নগরগুলোর অন্যতম সেখানে এখানকার তরমুজ এতই সুস্বাদু যে তার কোনো তুলনা করা যায় না। বুখারার কুলেরও কোনো তুলনা হয় না।….’ 

সমরখন্দ শহরের ভৌগোলিক অবস্থান, তার ঋতুকালীন বৈচিত্র্য, খাদ্য—পানীয়ের সাধন, নদী—নালা, উর্বর ভূমি ও উচ্চ স্তরের কৃষি উৎপাদন এ সব বিবেচনা করেই যে আমির তাইমুর সমরখন্দকে তাঁর রাজধানী করেছিলেন, সে কথাও লিখতে ভোলেননি তাঁর চতুর্থ অধঃস্তন বাবুর। তিনি লিখেছেন—‘অবশ্যই এখানকার উর্বর ভূমির কারণেই তাইমুর বেগ সমরখন্দকে তাঁর রাজধানী করার জন্য আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ‘ 

সমরখন্দের পর বাবুর তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি আন্দিজান উদ্ধারে অভিযান চালান এবং তা অধিকারও করে নেন। আন্দিজানের পর বাবুর তাশখন্দ অভিযানে রওনা হয়ে যান। বুখারা, সমরখন্দ ও তাশখন্দ আমির তাইমুরের নিজহাতে গড়া শহর। বাবুর ওই শহরগুলোকে তাঁর উত্তরাধিকার বলে বিবেচনা করতেন। 

সেনানায়ক ও সম্রাট হিসেবে বাবুরের জীবনে জয়—পরাজয়ের ঘটনা পুনঃপুনঃ সংঘটিত হয়েছে। যে সমরখন্দকে তিনি পরম আপনার বলে বিবেচনা করতেন, যা নিয়ে তাঁর এতই গর্ব ছিল, সেই সমরখন্দ বেশিদিন তাঁর অধিকারে থাকতে পারেনি। উজবেকদের সহায়তায় শায়বানি খানের নেতৃত্বে সংঘটিত যুদ্ধে বাবুর পরাজিত হন এবং সমরখন্দ তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে তাঁর স্বপ্নের ফারগানাও। 

সমরখন্দ ও ফারগানা হারানোর পর বাবুর তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন—‘আমার হাত থেকে সমরখন্দও বেরিয়ে গেল এবং ফারগানাও। 

তার পরের অবস্থা সম্বন্ধে বলছেন—‘এবার আমার জানা ছিল না যে, আমি কোথায় যাচ্ছি, আমার মনজিল কোথায়।’ তারপর, এক অবিস্মরণীয় কষ্টদায়ক যাত্রার বিবরণ দিয়েছেন বাবুর। এক এবড়ো—খেবড়ো ভয়ংকর পার্বত্য পথ। পদে—পদে বিপদ। পাহাড়ি খাদ। পা পিছলালে মানুষ পড়ে গেলে কোথায় যে হারিয়ে যাবে তার কোনো ঠিক—ঠিকানা থাকবে না। সেই পথ পেরিয়ে তিনি এক সুন্দর ঝিলের কিনারে এসে পৌঁছালেন। তিনি শ্রান্ত সৈনিক কিন্তু তাঁর সৌন্দর্য দৃষ্টির তুলনা হয় না। কারণ, তিনি লেখক—কবি শিল্পী। তিনি সেই সুন্দর ঝিলের পাড়ে যাত্রা বিরতি করলেন ক্লান্তি নিবারণের জন্য। 

কিন্তু বীর—সৈনিকের জীবনে অলসতার জায়গা নেই। তিনি যে কর্মবীর। তিনি বাদশাহী লাভ করবেন, পৃথিবীর এক বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রের। একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই সামাজ্যের কোটি কোটি মানুষের তিনি ভাগ্য বিধাতা হবেন। তাই আর বিলম্ব নয়। চলে প্রস্তুতি। পুনঃ সমরখন্দ বিজয়ের প্রস্তুতি। 

পদে পদে চলতে থাকেন। এ চলার যেন শেষ নেই। অবিরাম পথ চলা। চলার পথে যেখানেই নামাজের সময় হয়েছে, সেখানেই নামাজ পড়ে নিয়েছেন। তিনি যে মুসলিম। যে আল্লাহর বাধ্য, সে মুসলিম। আর মুসলিম পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নামাজ। সেই নামাজ তাই ছুটে যেতে পারে না। বলাবাহুল্য, এ যাত্রায় বাবুর সমরখন্দ অতি সহজে জয় করে নিলেন। 

৭ জুন ১৫০২ ঈসায়ী থেকে ২৬ জুন ১৫০৩ ঈসায়ী তক সময়ের মধ্যে সমরখন্দ ফারগানার লালসায় হাতছাড়া হয়ে গেল। বাবুর তাঁর এই বিপর্যয়ের কথা অতি সংক্ষেপে লিখেছেন : ‘আন্দিজান অবধি আমার সেনা পৌঁছাতে পেরেছিল তখন কোথাও থেকে আমার সৈনিকদের কাছে খবর পৌঁছাল যে, খানেদের সমর্থন আমার পক্ষে আর নেই। … এ খবর যখন পৌঁছাল তখন আমি গন্তব্যে পৌঁছাতে অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছিলাম, তখন রাতের অন্ধকারে আমার অধিকাংশ সৈন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেল।’ 

বলাবাহুল্য, ফারগানার লালসায় সমরখন্দ বাবুরের হাতছাড়া হয়ে গেল। 

তারপর আসে বাবুরের কাবুল বিজয়ের কথা। এক দীর্ঘকালীন উত্থানপতন ও দীর্ঘ সংগ্রামের পর বাবুর একটি সুগঠিত ও স্থায়ী রাজ্য লাভ করেন, যার নাম কাবুল। কাবুলকে ঘিরেই বাবুরের হিঁদুস্তান বিজয়ের স্বপ্ন যেমন সফল হয়েছিল তেমনই কাবুল তাঁকে পারিবারিক শান্তি—সুখের মুখ দেখিয়েছিল। এ রাজ্যে তাঁর বংশের আর কারো কোনো অধিকার ছিল না। একমাত্র বহিঃশত্রু ছাড়া ঘরশত্রুদের উৎপাতের কোনো সুযোগ এখানে আর ছিল না। বাবুর কাবুলের বাদশাহ হয়ে বসেন। তিনি সেখানকার মানুষের আপনজন হয়ে যান এবং তাঁরাও তাঁর আপনজন হয়ে যান। হয়ে যায় ‘বসুধৈব কুটুম্বকম।’ বাবুর তাঁর কাবুল বিজয় সম্পর্কে একস্থানে লিখেছেন—‘আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে কাবুল ও গজনীর প্রতি ইঞ্চি ভূমি আমার অধিকারে এসে গেল।’ 

ফারগানা রাজ্য ও আন্দিজান ছিল বাবুরের মাতৃপিতৃভূমি। যে ভূমিতে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারেননি তিনি। দীর্ঘ সংগ্রামদীর্ণ পথ পেরিয়ে তিনি নতুন ভূমি পেয়েছিলেন—কাবুল ও গজনী। এ তাঁর মাতৃপিতৃভূমির মতোই যেন তাঁকে আপন করে নিয়েছিল। 

কাবুলকে তিনি বড় আপন করে পেয়েছিলেন। সেই কাবুলের ভৌগোলিক বর্ণনা তিনি দিয়েছেন একজন ভূ—তত্ত্ববিদ পণ্ডিতের মতো, সেখানকার আবহাওয়া, ভূ—প্রকৃতি ও মাটি—মানুষের প্রতিটি তথ্য যেন তাঁর নখদর্পণে। 

তিনি যেমন দিয়েছেন কাবুলের নগরীয় বর্ণনা, তেমনি দিয়েছেন এই পর্বতবেষ্টিত নগরীর জীবনযাত্রার নির্ভরযোগ্য তথ্য। কাবুলের বাণিজ্য নগরীর বর্ণনা পড়লে মনে হবে একজন প্রবীণ সাহিত্যিকের কলমের অনর্গল বাক্য—প্রবাহ। এখানে তাঁর লেখনী যেন স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ধারাপ্রবাহ হয়ে বয়ে গেছে। কাবুলের আবহাওয়া ও উৎপন্ন ফসলাদির বর্ণনা দিয়েছেন তিনি আবহাওয়া বিশারদ পণ্ডিতের মতো। সেখানকার ফলমূলের মধ্যে বিশেষ করে নাম করেছেন আঙুর, আনার, চেরি, আলুবুখারা, নাশপাতি ইত্যাদির। গ্রীষ্মকালের জনপ্রিয় পানীয়ের মধ্যে তিনি লেবু পানি ও আখের রসের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এখানে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক মধু উৎপন্নের কথাও বলেছেন। মৌমাছিরা এখানে বড় বড় চাকে মধু ভরে রাখে। এছাড়া নানা ফলমূল থেকে যে প্রচুর শরাব উৎপন্ন হয় সে কথাও লিখতে তিনি ভোলেননি। তিনি এখানকার মধুর আবহাওয়ার কথাও লিখেছেন। তবে খাদ্য—শস্য উৎপাদন যে তেমন হয় না, তার জন্য যে তাদের অন্য দেশের মুখাপেক্ষী থাকতে হয় একথা তিনি একজন দায়িত্বশীল বাদশাহর মতো অনুভব করেছেন এবং একজন দায়িত্বশীল লেখকের মতো সে কথা লিখেছেন। 

কাবুলের বাদশাহ ও পণ্ডিত, বাবুর কাবুলের কোনো বর্ণনাই প্ৰায় বাদ দেননি। তিনি কাবুলের গৃহপালিত পশুদের চারণক্ষেত্র বা তৃণভূমির বর্ণনা দিতেও ভোলেননি। 

তিনি কাবুলের পার্বত্যাঞ্চলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশ্ববিখ্যাত হিন্দুকুশ পর্বতামালার অত্যন্ত আকর্ষণীয় বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর লেখনীতে। তিনি এখান থেকে উদ্ভূত পার্বত্য পথগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। কোন ঋতুতে কোন পথ কেমন, কীভাবে তা অতিক্রম করা হয় তার কোনোটাই বাদ যায়নি তাঁর লেখনী থেকে। কাবুল থেকে হিঁদুস্তানে যাওয়ার পথের বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। বিশেষ করে উল্লেখ করেছেন খাইবার গিরিপথের কথা। তাঁর রচনায় বিভিন্ন সময় হিঁদুস্তানের কথা এসেছে। আমি লক্ষ করি, হিঁদুস্তান শব্দটি উচ্চারণের সময় তাঁর মধ্যে একটা সম্ভ্রম এবং শ্রদ্ধা ভাবের প্রকাশ ঘটে। এ এক অদ্ভুত দুর্বলতা। বোঝা যায়, এদেশ দেখার বা জয় করার আগে এ দেশকে তিনি বড় ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তাকে জায়গা দিয়েছিলেন অন্তরের অন্তঃস্তলে। 

বাবুর তাঁর কাবুল বিষয়ক লেখায় সেখানকার বাসিন্দাদের জাতি ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগত পরিচয় দিয়েছেন একজন নৃবিজ্ঞান বিশারদ পণ্ডিতের মতো। তিনি এখানকার বাসিন্দাদের জাতিগত পরিচয় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে উল্লেখ করেছেন। বলাবাহুল্য, বাবুরের আত্মকথায় কাবুলের বর্ণনা সবচেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে বিদ্যমান রয়েছে। 

বাবুর কাবুলের মানব ও প্রাকৃতিক সাধনের বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ করতে গিয়ে সেখানকার জ্বালানি কাঠেরও বর্ণনা দিয়েছেন। তা ছাড়া ফসলপাতি উৎপাদনে পানিসেচ ও তার সাধনের কথাও সবিস্তার উল্লেখ করেছেন। তিনি সেখানকার ব্যাধ পেশার লোক ও মৎস্যজীবী পেশার মানুষদের কথাও সবিস্তারে লিখেছেন। 

আগেই বলা হয়েছে, বাবুর হিঁদুস্তান বিজয়ের স্বপ্ন আজীবন দেখে এসেছেন। তবে, কাবুলই হয়েছিল তার হিঁদুস্তান বিজয়ের সবচেয়ে বড় আর্থিক—সামরিক ও ভৌগোলিক সহায়। ভারত বিজয়ের জন্য বাবুরের যে আজীবন প্রস্তুতি ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর ভারত বিজয়ের পথে সামরিক—আর্থিক—মানবিক—সামরিক—ভৗগোলিক—প্রাকৃতিক বহু সহায় একযোগে তাঁর সহযোগী হয়েছিল। তাঁর ভারত বিজয় ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। 

জীবনের নানা উত্থান—পতন আর বন্ধুর পথ অতিক্রম করে বাবুর অবশেষে হিঁদুস্তান বিজয়ে সফল হলেন। বলা চলে, বাবুর ভারত জয় করেছিলেন মানে দেশ হারিয়ে দেশ পেয়েছিলেন। ফারগানা তাঁর পিতৃরাজ্য আন্দিজান তাঁর জন্মভূমি—কোথাও তিনি শান্তি স্বস্তি ঠাঁই পাননি। কখনো বিজয়ীর মতো কখনো যাযাবরের মতো, কখনো অসহায় আতুরের মতো, আর কখনো বা জীবন রক্ষায় পলায়নপর পরাজিত সৈনিকের মতো মধ্য এশিয়ার পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’ অবশেষে বীরের কাছেই ধরা দিল। বাবুর জন্মেছিলেন আন্দিজানে, শাসক হয়েছিলেন ফারগানার, তারপর কত উত্থান, কত পতন, দুর্গম কণ্টকাকীর্ণ প্রস্তর—বেষ্টিত পথ, কখনো বা কাঁটাদার মরুভূমি, কখনো বা সমতলভূমি, উপত্যকা অধিত্যকা পেরিয়ে এক এতিম, অথচ প্রতিভাধর বালক, যার এক হাতে ছিল অসি, আরেক হাতে মসি – তাই দিয়ে তিনি বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড জয় করলেন। অসির জোরে হলেন বিজিত ভূখণ্ডের বাদশাহ, মসির জোরে হলেন জগদ্বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক। মানব জাতি ও মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ এক বিস্ময়কর উদাহরণ। 

বাবুর ভারত জয় করলেন। এ ছিল তাঁর চিরস্থায়ী বিজয়। মাতৃভূমি ফারগানা ও আন্দিজান তাঁকে জন্ম দিয়েছিল, প্রতিষ্ঠা দেয়নি, উপেক্ষা দিয়েছিল ভূখণ্ড দেয়নি। এক প্রতিভাবান বালক পথেই কিশোর হয়েছেন, পথেই যুবক হয়েছেন। তারপর দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাদশাহ হয়েছেন। জীবনের এই পতন—অভ্যুদয় বন্ধুর পথ পেরিয়ে সন্তান—সন্ততির জনক হয়েছেন। নিজের জন্মভূমি তিনি তাদের দেখাতে পারেননি, তা সত্ত্বেও তিনি তাদের স্থায়ী ভূমি দিয়েছেন, স্থায়ী ঠাঁই দিয়েছেন, স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার পথ দেখিয়েছেন। 

তিনি ভারত জয় করেছেন, ভারত তাঁর জন্মভূমি হয়নি, কিন্তু মৃত্যুভূমি হয়েছে, তাঁর জীবন এবং মৃত্যুকে ঠাঁই দিয়েছে ভারতের ভূমি। ভারত শুধু তাঁর নয়, তাঁর জন্ম, কর্ম ও সাধনার বলে তাঁর উত্তর পুরুষদের চিরকালের ঠিকানা হয়ে গেছে! আন্দিজান থেকে দিল্লি, ফারগানা থেকে লালকেল্লা সুদীর্ঘ পথ। এই পথ ছিল তাঁরই আঁকা পদচিহ্নের স্বরূপ। তাঁর আত্মজীবনীর কল্যাণে বিশ্বসাহিত্য তাঁকে কোনোদিন ভুলতে পারবে না আর ফারগানা থেকে দিল্লি বিজয়ের রাজনৈতিক ইতিহাস কেউ কোনো দিন মুছে ফেলতে পারবে না। সেই ধারাবাহিকতার কেউ অস্বীকার করবে না ভারতবর্ষের আর্থ—সামাজিক ও রাজনৈতিক—সংস্কৃতির ইতিহাস, কেউ অস্বীকার করতে পারবে না স্থাপত্যকলা ও শিল্প—সংস্কৃতির ইতিহাস। শিল্প—সংস্কৃতির সঙ্গে লেখা হয়ে গেছে সাহিত্যের ইতিহাসও। কে ভুলতে পারে এই গৌরবময় ইতিহাসের ধারা, কে ভুলতে পারে বাবুর থেকে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের অবধিকার সেই সোনালি শৃঙ্খলকে, যা ভারতবর্ষের মাটিতে চিরকালের জন্য অমর হয়ে রয়ে গেছে!! 

‘তুজুক—ই—বাবরী’র ফার্সি অনুবাদ থেকে ইংরেজি অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন মিসেস বেভারিজ। ‘মেমোরিজ অব বাবুর’ নামে এই গ্রন্থ সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। ভারতীয় লেখক সৈয়দ আবিদ রিজভি এ গ্রন্থের উর্দু ও ইংরেজি অনুবাদ থেকে একটি হিন্দি সংস্করণ প্রস্তুত করেন। এ গ্রন্থ এরই বঙ্গানুবাদ। 

মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস 
চৈতা বিশ্বাসবাড়ি 
বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত 
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ঈসায়ী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *