একাদশ অধ্যায় – বাবুর কর্তৃক কাবুল বিজয়

একাদশ অধ্যায় – বাবুর কর্তৃক কাবুল বিজয় 

আমি পরবর্তী শিবির স্থাপন করলাম আক-সরাই উপত্যকা অতিক্রম করার পর কারাবাগ নামক স্থানে। 

এই শিবিরে আমি আমার কিছু বিশ্বাস্ত সাথি ও সেনাপতির মৃত্যুর খবর পেলাম। 

প্রকৃতপক্ষে, চারদিক থেকে পাহাড়ি উপত্যকা অতিক্রম করার অভিযান চালিয়ে কারাবাগে শিবির স্থাপনের পরিকল্পনা আমিই করেছিলাম। সেখানকার ভৌগোলিক অবস্থা এবং পাহাড়ি উপজাতির যোদ্ধাদের ঐক্য নষ্ট করার জন্য এই পরিকল্পনাই সঠিক ছিল। 

যদি আমাদের পুরো সেনা শক্তি একজোট হয়ে একই রাস্তা দিয়ে এগুতে থাকত তাহলে উপজাতি যোদ্ধাদের একতাবদ্ধতা একই স্থানেই রয়ে যেত। তারা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত তাহলে আমাদের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো। 

দুশমনদের আকস্মিক আক্রমণকালে হানাহানি ও ছোটাছুটি শুরু হলে বহু সৈনিকের গভীর পাহাড়ি খাদে পড়ে গিয়েও জীবন-হানির আশঙ্কা ছিল। এই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য এই পকিল্পনাই ছিল যে, পাহাড়ি উপত্যকার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, বিশাল ঘেরা বানিয়ে এগিয়ে যাওয়া হোক এবং অবশেষে এসে একত্রিত হওয়া হোক। 

বাবুর বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি 

ঘেরাও করে পাহাড়ি উপত্যকা অতিক্রম করতে গিয়ে আমার বাহিনীকে পাহাড়ি উপজাতিদের দ্বারা পরিচালিত গেরিলা যুদ্ধের কবলে পড়তে হলো। যাতে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হলো। 

কারাবাগে এসে একত্রিত হওয়ার পর তাদের গণনা করা হলো। গণনার পর আমি ভীষণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। একবার তো আমার এমনও মনে হলো যে, আমার অগ্রবর্তী বাহিনীর এত বীরযোদ্ধা মারা গেল যে, আমার শক্তি খুব ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। আমার উপর ঘটে যাওয়া দু’দুবারের খারাপ দিনগুলোতে এতটা হতাশ আমি আর কখনো হইনি যেমনটি ওই সময়ে কিছুক্ষণের জন্য হয়েছিল। একবার তো আমার মনে হলো যে, কাবুল বিজয় অভিযান ত্যাগ করে আমি আবার পিছনের দিকে ফিরে যাই এবং আমি আমার ওই সৈনিকদের পূর্ব পুরুষদের বিজিত রাজ্যগুলোতে গিয়ে নিযুক্ত করে দিই…। 

এই চিন্তা মনে জাগার পর আমি আমার উচ্চ পদস্থ সেনানায়কদের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। এ থেকে যে পরামর্শ তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এল, তা হলো আমার পদস্থ সেনানায়ক ও সৈনিকেরা মোটেও পর্যুদস্ত নন। তাঁরা এই মর্মে উৎসাহিত ছিলেন যে, তাঁরা যতদূর পর্যন্ত এসেছেন, ওই পর্যন্তকার সমস্ত এলাকা তাঁরা জয় করতে-করতেই এসেছেন। তাঁরা তাঁদের সৈনিক ও সাথিদের হারিয়েছেন বটে কিন্তু পাহাড়ি উপজাতিদের তাঁরা চিরকালের জন্য ঠান্ডা করে দিয়ে এসেছেন। 

সৈয়দ ইউসুফসহ অন্য কিছু সিপাহসালার তাঁদের উদ্যম ব্যক্ত করতে গিয়ে বললেন—

‘আমাদের এক মুহূর্তও থেমে থাকা উচিত নয়, শরৎ ঋতু শুরু হতে চলেছে, তার আগেই আমাদের লামঘান পৌঁছে যাওয়া উচিত। সেখানকার সমতল এলাকার যুদ্ধে বিজয় সম্পূর্ণ আমাদের পক্ষে আসবে। আমরা নিজেদের কাবুল বিজেতা বলে অভিহিত করতে চাই বাদশাহ…।’ 

সৈনিক ও সিপাহসালারদের এ উদ্যম আমাকে নয়া উৎসাহে পরিপূর্ণ করে তুলল। আমি ফৌজকে শিবির গুটিয়ে নেওয়ার আদেশ দিলাম। আমরা আবা-কুরুকের পাহাড়ি উপত্যকা জয়ের উৎসাহে এগিয়ে চললাম। 

আবা কুরুকে নয়া উৎসাহ 

আমার মা-জননী, যাঁকে আমি ‘কাহমদ’-কে তাঁর জন্য সুরক্ষিত স্থান মনে করে রেখে এসেছিলাম, তিনি আবা-কুরুক-এ আমার কাছে এসে পুনরায় মিলিত হলেন। তিনি আমার কাছে আসার কারণ স্বরূপ বললেন—

‘কাহমর্দ-এ আমার জন্য বিপদ বড়ই বেড়ে গিয়েছিল। শোরিম তগাই যেইমাত্র জানতে পারল যে, খুসরো শাহ খুরাসানের পথে রয়েছে, তখন সে তাকে তার পক্ষে টেনে নেওয়ার জন্য রওনা হয়ে যায়। এই কাজের জন্য খুসরো শাহের ভাগ্নে আহমদী কাসিমকে সে তার সঙ্গে করেও নিয়ে যায়। খুসরো শাহ, তগাইয়ের মিত্রতার অধীনে এসে যেতে পারে, এটা বুঝে নেওয়ার পর আমার মনে হলো এখন আমার আর কাহমর্দে থাকাটা ঠিক হবে না। আমি লশকরদের সঙ্গে নিয়ে সেখান থেকে এখানকার উদ্দেশে চলে এসেছি।’ 

আমি আমার মায়ের কথা ও সম্ভাবনার কথা চিন্তা করার পর বুঝতে পারলাম যে, মায়ের এই পদক্ষেপ সঠিক ছিল। যেমনটি আমি পূর্বে লিখেছি। খুসরো শাহ এমন ব্যক্তি ছিলেন যিনি স্বভাবগতভাবে কাপুরুষ ছিলেন; রঙ বদলাতে তাঁর বিন্দুমাত্রও বিলম্ব হতো না। 

আবা-করুক পাহাড়ি উপত্যকায় রাত্রি যাপনের পর, আমাদের সেনা আবা-কুরুক উপত্যকা বিজয় অভিযানে অগ্রসর হয়ে গেল। 

আমি সেনার একটি অংশকে হায়দার তকী বাগ এবং কুল্ বায়জিদ মকবরা অতিক্রম করার জন্য রওনা করিয়ে দিলাম। জাহাঙ্গীর মির্জার নেতৃত্বে দ্বিতীয় দলটি চারবাগ বিজয়াভিযানে পাঠালাম। তৃতীয় দলটি কতলক কদম মকবরা অতিক্রম করার জন্য রওনা করিয়ে দিলাম। চতুর্থ দলটির সঙ্গে আমি নিজে সুড়ঙ্গ বিশিষ্ট পাহাড়ি উপত্যকা অতিক্রম করার জন্য অগ্রসর হলাম। 

আমি আগ বাড়িয়ে পৌঁছে যাওয়ার পর জানতে পারলাম, কতলক কদম মকবরা এলাকায় অগ্রসরমান আমার বাহিনী কতলক কদম পুল পার হতে বাধা পাচ্ছে। 

আমি মির্জা জাহাঙ্গীরের দলকে সাহায্য করার জন্য দ্রুত রওনা হয়ে গেলাম। ঘটনা ছিল, জাহাঙ্গীর মির্জার এবং অন্য সেনাদল নিজেদের অভিযান সফল করে সমতল ভূমিতে এসে আমার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। আর তৃতীয় দলটি রয়ে গিয়েছিল। তাদের ফেঁসে যাওয়ার কারণ ছিল, কাবুলের দিক থেকে সেখানকার বাসিন্দাদের বড় একটা ভিড় সেখানে এসে জুটে গিয়েছিল। কাবুলবাসী জেনে গিয়েছিল যে, তাদের দেশ আক্রান্ত হয়েছে। তারা তাদের স্বাধীনতার জন্য সেখানে দৌড়ে এসেছিল। তারা কতলক কদমের পুলটি ভেঙে দিয়েছিল। ওই পুল পার হওয়া ছাড়া আমার আটকা পড়া তৃতীয় দলীটি অগ্রসর হতে পারছিল না। 

জাহাঙ্গীর মির্জার নেতৃত্বে পৌঁছানো সেনাদলটি একটি পাহাড়-বেষ্টিত রাস্তা পেরিয়ে, আটকে পাড়া সৈনিকদের সাহায্যের জন্য অগ্রসর হলো। কাবুলবাসীদের বিরোধকে তরবারির জোরে ঠান্ডা করে দেওয়া হলো। আমাদের সৈন্যরা কিছু সময় বাদে কাবুলের প্রধান নগরে প্রবেশ করল। 

কাবুল ও গজনী আমার অধিকারে এসে গিয়েছিল। কাবুলের প্রধান নগর দ্বারে আমাদের হালকা বিরোধের মোকাবিলা করতে হলো। তারা নগরদ্বারের রক্ষক ছিল। নগরদ্বার রক্ষা করাটা তাদের কর্তব্য ছিল। রাস্তা থেকে তাদের সরে যেতে না দেখে ঘোড়া থেকে আমাকে নেমে পড়তে হলো। আমি অগ্রসর হয়ে তাদের রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দিলাম। তবে তারা ডেটে রয়ে যাওয়াতে আমাকে তরবারির সাহায্য নিতে হলো। তাদের শরীরগুলোকে টুকরো করার পরই আমার সৈন্যরা কাবুল দরওয়াজা পার হতে পারল। 

কাবুলের শাসক মুকিম, তাঁর পরিবারের সকল সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত লোকেরই জীবন-দানের আদেশ আমি আমার সেনাকে দিয়ে দিলাম। তাদের সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতিও আমি দিলাম। 

পরে আমি মুকিম, তাঁর পরিবারের সকল সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের গজনীতে পাঠিয়ে দিলাম। এবার আমার কাবুল বিজয়ের অভিলাষ পূর্ণ হয়ে গেল। পরবর্তী দশ দিন, বিনা যুদ্ধে, বিশেষ কোনো প্রয়াস ছাড়াই কাবুল ও গজনীর জনপদগুলোতে ঘুরে-ঘুরে তাদের আস্থা অর্জনের কাজে লাগিয়ে দিলাম। 

পরম করুণাময় আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে কাবুল ও গজনীর প্রতি ইঞ্চি ভূমি আমার অধিকার-ক্ষেত্রে এসে গিয়েছিল। * 

[* কাবুলে বিজয়াভিযান, বাবুরের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বলে প্রমাণ হয়েছিল। কেননা, কাবুল অভিযানই তাঁর জন্য সাম্রাজ্য বিস্তারের নতুন দ্বার খুলে দেয়। তিনি যদি কাবুল জয়ের পরিকল্পনা ত্যাগ করে নিজের মনোযোগ সমরখন্দ, বুখারা, ফারগানা ও সেখানকার আশপাশের গোত্রগুলোর উপর নিবদ্ধ করতেন তাহলে হার আর জিতের মধ্যেই তাঁর জীবন কেটে যেত। তিনি তাঁর পরবর্তী বংশধরদের জন্য এক বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করতে পারতেন না। 

সমরখন্দ ও তার আশপাশের গোত্রগুলোতে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন শায়বানি খান তো অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে ছিলেন তাঁর নিজের বংশের লোকেরা। যাঁরা নিজেরা শাসন ও ছোট ছোট রাজ্যগুলোর জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকতেন, তারা তাদের অধীনস্ত কোনো এলাকা জয় করতে দিতেন না। পরবর্তী অবস্থাও একথাই সিদ্ধ করে যে, বাবুরের কাবুল বিজয়াভিযান ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় বিচক্ষণতার পরিচায়ক। সেখানে তাঁর বংশের আর কেউ তার দাবিদার ছিলেন না। ওই এলাকাকে তাঁর নিজের শক্তি ও বুদ্ধিবলেই বাবুর তাঁর নিজের উদ্যোগে জয় করে নিয়েছিলেন।—অনুবাদক]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *