অষ্টম অধ্যায় – বাবুরের আন্দিজান বিজয়াভিযান

অষ্টম অধ্যায় – বাবুরের আন্দিজান বিজয়াভিযান 

আন্দিজানের দক্ষিণ এলাকা অশপরী, তুরিকশর, চিচকরক এবং তার আশপাশের এলাকাগুলো বিজয়ের উদ্দেশ্যে আমি ইব্রাহীম সারু, ওয়াইশ লেঘারি এবং সাইয়িদি করাকোর নেতৃত্বে আমার সৈনিকদের রওয়ানা করিয়ে দিলাম। আমার জানা ছিল যে, সেখানকার বিজয়ের জন্য নদী এবং কিছু দুর্গম পথ অতিক্রম করার প্রয়োজন পড়বে। সকল সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আমি সেনাদলের উপযুক্ত সরদারদের পাঠিয়েছিলাম। ওই এলাকার প্রতি ইঞ্চি ভূমি আমার পরিচিত ছিল এবং সেখানকার লোকেরা শুধু আমাকেই চিনত না বরং আমিও তাদের ভালোমতোই চিনতাম। 

ওই এলাকার সরদার ওউজিন হাসান ও তাম্বোল আমার সৈনিকদের ওদিকে পৌঁছানোর খবর পেতেই, নিজেদের গোত্রের লোকেদের স্বাগত জানানোর জন্য এসে পৌঁছালেন। আমার সৈনিকদের স্বাগত জানাতে আসা লোকেদের মধ্যে আমার কিছু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মোগল সৈনিকও ছিল। তাঁরা সকলেই আন্দিজানে আমার সৈনিকদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। আমার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রমাণের জন্য সাইপন থেকে দু’মাইল দূরে তাঁবু ফেলে এবং আমাকে স্বয়ং আমন্ত্রণ জানানোর জন্য তাদের বার্তাবাহককে পাঠাল। 

আমার জন্য এই অবসরট ছিল খুবই আনন্দদায়ক। আমার পিতার জমানার এবং আমার কিশোর কালের লোকেরা আমার প্রতি কত-ই না বিশ্বস্ত ছিলেন! সেখানকার অভ্যর্থনা-সম্বর্ধনার সুখভোগের দু-একদিন বাদেই আমি মর্খিননের দিকে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করি। 

মর্খিননের দিকে অগ্রবর্তী হওয়ার সময় সেখানকার ঝোপঝাড়-ঘেরা এলাকায় কিছু ছোটখাটো সংঘর্ষ হলো। যাদের উপর আমি অতি সহজে জয়লাভ করি। এই ছোটখাটো এলাকা জয়ের পর আমি ফের আমার সৈনিকদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করি। 

কাসিম বেগ, ইব্রাহীম সারু এবং ওয়াইশ লেঘারির নেতৃত্বে তিন দিক দিয়ে সৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার আদেশ দিলাম। অবশিষ্ট সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে চতুর্থ বাহিনীর নেতৃত্ব হাতে নিয়ে আমি এগিয়ে চললাম। 

মর্খিননের শাসক ও সরদারদের কাছে এ খবর পৌঁছে গিয়েছিল যে, আমার সেনাদল এগিয়ে আসছে। 

বাগ-এ-খলিল পর্যন্ত পৌঁছাতে কোনো বেগ পেতে হলো না। সেখানে তিন সরদারের বাহিনী আমার কাছে এসে মিলিত হলো। এবার আমাদের দক্ষিণ আন্দিজানের পাহাড়ের উপর অবস্থিত কেল্লা পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। মাঝপথে প্রবল বেগে নদী বয়ে চলেছিল। ঔজিন হাসান ও তাম্বোল দিলেরির থেকে শত্রুবাহিনীর মোকাবিলা করতে করতে কেল্লার নিচে পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পৌঁছে গেলেন। 

ওই সময়ে দক্ষিণ আন্দিজানের পার্বত্য এলাকার শেষ প্রান্তে বসবাসকারী কিষানদের কাছে এ খবর দাবানলের মতো পৌঁছে গেল যে, আমার বাহিনী সেখানে এসে পৌঁছেছে, তারা দলে-দলে আমাদের দিকে আসতে লাগল। 

ইতোমধ্যে ইব্রাহীম সারু এবং ওয়াইশ লেঘারিও শত্রুবাহিনীর মোকাবিলা করতে করতে নদী পার হতে সমর্থ হলেন। 

অকশা প্রদেশের অধিবাসীরা আমার পক্ষের জোশ দেখার যোগ্য ছিল। তারা নিজেরা আক্রমণকারী লুটেরা বনে গিয়ে মহলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। 

আমার তিন সরদার অকশাবাসীদের উৎসাহকে পূর্ণ সম্মান দিয়ে যাচ্ছিলেন।

আমার সৈনিকেরা খরস্রোতা নদীর স্রোতের বুক চিরে একে একে তীরে পৌঁছে যাচ্ছিল। 

আন্দিজানের দক্ষিণে অবস্থিত ঐ কেল্লা, ‘কেল্লা কাশগড়ী’র উপর জয়লাভ করা আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। যদিও সেখানে আন্দিজানের বড় কোনো ফৌজ ছিল না, শুধুমাত্র কেল্লা রক্ষার জন্য রক্ষক নিযুক্ত ছিল, তবে তারা কেল্লা প্রাচীরের উপর উঠে আমাদের সৈনিকদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল, তাদের কেল্লা থেকে দূরে রাখতে তখনও আমাদের বাহিনী সফল হতে পারেনি। কেল্লায় তখনও পর্যন্ত আমার পক্ষের একজন সৈনিকও সফল হতে পারেনি। যুদ্ধ চলছিল। 

ইতোমধ্যে এক আজব ঘটনা ঘটল-কেল্লা কাশগড়ীর কিলেদার করবুচ্ বখশী কেল্লা প্রাচীরে উঠে মোগল বেগ ঘরানার এক যুবককে কাছে ডেকে নিল। দুই হাত দিয়ে সে তার গলা টিপে মেরে ফেলল এবং তারপর তাকে কেল্লায় দেওয়াল থেকে নিচে ফেলে দিল। 

সে কেন এমন করল, প্রথমে তো একথা একেবারেই বোধগম্য হয়নি। কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল যে, সে এটাই দেখাতে চাচ্ছিল যে, সে সমস্ত মোগল ও বেগ ঘরানার সৈনিকদের এইভাবে মেরে ফেলবে। 

কিলেদার করবুচ্ বখশী এবং কেল্লার অন্য রক্ষকদের সকল রকমের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তারা কাশগড়ী কেল্লা রক্ষা করতে পারল না। আমাদের সৈনিকেরা এক দিক থেকে কেল্লা প্রাচীরে উঠে পড়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। 

কিছু তো করবুকচ বখশীর দিকে তরবারি ঘোরাতে ঘোরাতে দৌড়ে গেল, কিছু খলিল দলবান এবং অন্যেরা আরেক দিকে, কেল্লা রক্ষকের সহায়ক কাজী গোলামের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা তাদের অন্য দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিল। 

তারপর, কেল্লা রক্ষকদের সকল প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে তাদের শমন ভবনে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। 

কেল্লা হাত থেকে বেরিয়ে গেল, এটা দেখার পর পরই অন্য রক্ষকেরা অস্ত্র সমর্পণ করল। ৭০-৮০ জনকে দাস বানিয়ে নেওয়া হলো। পাঁচ-ছজন পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল। অবশিষ্টদের পরলোকবাসী বানিয়ে দেওয়া হলো। 

তারপর, সেনা-অভিমুখ ছিল আন্দিজান নগরের প্রতি। সেখানে মোকাবিলার জন্য নাসির বেগ প্রস্তুত ছিলেন। 

আন্দিজানে ক্ষমতার পুনঃপ্রাপ্তি 

যেইমাত্র আমি আন্দিজান নগরে ভোর বেলায় আমার সৈনিকদের পৌঁছে যাবার খবর পাই, কালবিলম্ব না করে দুপুর বেলায় আমি স্বয়ং আন্দিজানে গিয়ে পৌঁছাই। 

ঐ সময়ের মধ্যে আমার সেনা আন্দিজান পুরোপুরি কবজা করে ফেলে। আন্দিজানে পৌঁছানোর পর আমি নাসির বেগ ও তার দুই পুত্র দোস্ত বেগ ও মরিম বেগকে আমার সেনাদের কাছে বন্দী রূপে পাই। তারা তাদের হাত তুলে রেখেছিল, যা আত্মসমর্পণ ও অধীনতা স্বীকারের প্রতীক ছিল। তারা এই ভেবে ভীতত্রস্ত ছিল যে, আমি সেখানে পৌঁছানো মাত্রই সাথে তাদের ধড় থেকে মাথা নামিয়ে দেবার আদেশ শুনিয়ে দেব, এই ভয়ের সাথে সাথে তাদের চোখে ভয় ও চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। তারা আমার কাছ থেকে দয়া পাওয়ার আশা করছিল। 

ঐ সময়টি আমি কীভাবে ভুলতে পারতাম যে সময়ে, আন্দিজানের ক্ষমতা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তখন আমি দু’বছর ধরে কীভাবে দুঃখ—কষ্ট ও যন্ত্রণাময় জীবন কাটিয়েছিলাম! 

আমি, দুশমনদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত, তেমনটাই করলাম। তারপর আমি উজকিন্ত কেল্লায় গেলাম। কিছুক্ষণ পর ঔজিন হাসান আমাকে জানিয়ে দিলেন, আন্দিজান হাতছাড়া হওয়ার খবর পাওয়ার পর অকশিতে কিছু সরদার একজোট হয়ে মাথা তুলছে এবং তারা বিদ্রোহ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। 

বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার খবর পাওয়ার পর আমি দ্রুত পদক্ষেপ নিলাম না। চার-পাঁচ দিন অপেক্ষা করলাম। এই অপেক্ষার পেছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল আর যে সকল বিদ্রোহীদের জোটার সম্ভাবনা আছে তারা সবাই একজোট হোক, যাতে তাদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা যেতে পারে। 

আমার রণনীতি সফল হলো। আমি অকশি কেল্লায় হামলা চালিয়ে তাদের সবাইকে একসঙ্গে সাফ করে দিলাম। 

বাহাদুর সাথিদের উপহার 

আন্দিজান থেকে ফেরার পর আমি তার দক্ষিণ দিকে এবং উত্তর এলাকার অধিকাংশ ভূ-ভাগ ওই সমস্ত মোগলদের উপহারস্বরূপ দিয়ে দিলাম, যারা আন্দিজান বিজয়াভিযানের মধ্যে রাস্তায় এসে আমার প্রতি বিশ্বস্ততা দেখিয়েছিল এবং আমার পক্ষে লড়াই চালিয়েছিল। 

ঔজিন হাসানকে আমি অকশা এলাকা প্রদান করে তাকে তার সন্তান-সন্ততি ও পরিবারবর্গকে সেখানে ডেকে এনে বসবাসের পরামর্শ দিলাম। ঔজিন হাসান, বেগ জাতিভুক্ত ছিলেন। 

অকশার এলাকা ঔজিনকে প্রদান করে আমি মোগলদের সাথে সাথে বেগদের আনুগত্যও লাভ করে নিয়েছিলাম। 

তারপর আমি তাশখন্দের দিকে রওনা হয়ে গেলাম। 

আহমদ কম্বোল মোগলের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান 

সময়খন্দে দু’বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরবর্তী দু’বছর যাবৎ আন্দিজান যাওয়ার সময় আমি আর পেলাম না। 

ইতোমধ্যে সেখানে পর-পর পাঁচ বার বিদ্রোহীরা মাথা তোলে, যাদের বিদ্রোহ দমনের জন্য সমরখন্দ থেকে বারবার সেনা পাঠাতে হয়। 

বিদ্রোহীদের প্রধান নেতা ছিল আহমদ কম্বোল মোগল; যে শেষবারের মতো মাথা তুলে পুরো জোশের সঙ্গে আন্দিজানের উপর পূর্ণ অধিকার কায়েমের চেষ্টা করছিল। তখন আমার অশ্বারোহীসহ পদাতিক বাহিনী পাঠানোর প্রয়োজন পড়ল। 

মোগল সৈন্যদের আয়ুশ নামক স্থানে আসার খবর পেয়ে আহমদ কম্বোল মোগল পালিয়ে গেল। মোগল ফৌজ আন্দিজানে পুরো এলাকায় যেখানে যেখানে সে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করল তাড়াতে থাকল। তার সমস্ত বিদ্রোহী সাথিদের খুঁজে বের করে করে ক করা হলো। আহমদ কম্বোল মোগল অবশেষে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। সে পার্বত্য এলাকায় গিয়ে পাহাড়ে চড়ে-চড়ে জান বাঁচানোর চেষ্টা করার সময় পা পিছলে পড়ে গেল, এবং মারা গেল। 

আহমদ কম্বোল মোগলের শেষ পরিণতির পর আন্দিজানে বিদ্রোহীদের সকল আশা ধুলোয় মিশে গেল। 

কম্বরদের দ্বারা বাবুবের বিরুদ্ধে শায়বানির সাহায্য 

১৫০০ ঈসায়ী সনের ১৭ জুলাই থেকে ১৫০১ সাল পর্যন্তকার সময়টি আমার জন্য বড়ই বিপত্তিকর বছর হয়ে রয়েই গেল। 

এ বিপত্তি মোগলকে সাজা দেওয়ার চক্করে পড়ে এই বিপত্তি আমার উপর এসে পড়ে। 

আহমদ কম্বোল মোগল ছিল ‘কম্বর’ উপজাতির লোক। বুখারা ও সমরখন্দের পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যে কম্বর উপজাতির লোকেদের সংখ্যা ও প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। জনবল, লড়াকু ও লুটেরা বৃত্তির কারণে তারা বুখারা ও সমরখন্দের চারদিকে নিজেদের দবদবা রাখত। 

নিজেদের গোত্রের সরদার আহমদ কম্বোল মোগলের পরাজয় ও মৃত্যুকে তারা ভুলতেও পারেনি, সইতেও পারেনি, তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা বেড়ে গেল। 

‘কম্বোর’রা একজোট হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, ‘লোহা দিয়ে লোহা কাটা’ প্রবাদবাক্যটিকে সার্থক করে তোলা উচিত 

তারা শায়বানির কাছে গিয়ে কাহিনি পাড়ল যে, আমার বাহিনী তার উপর আক্রমণ চালানোর জন্য বুখারার দিকে ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে। 

শায়বানির জোরদার প্রস্তুতি 

বুখারায় শায়বানির শক্তিশালী বাদশাহী ছিল। তিনি নিজেও বাহাদুর যোদ্ধা ছিলেন। আমার মতো বিরোধীদের তার দিকে ধেয়ে আসার সংবাদ তাকে জোরদার প্রস্তুতি গ্রহণে বাধ্য করে তুলল। 

তার সৌভাগ্য যে, ওই সময়ের সকল উজবেক সরদার তার পালে এসে জড়ো হলো। উজবেক সরদারদের মধ্যে জোহরা বেগী আগা নামক এক মহিলার যুব সম্মান ছিল। উজবেক জাতির সমস্ত সরদার তাঁকে ‘মা’য়ের মর্যাদা দিতেন। জোহরা বেগী আগার এক ইশারায় তারা নিজেদের জীবন দিয়ে দেওয়াকে গর্বের কাজ বলে মনে করতেন। 

জোহরা বেগী আগা স্বয়ং শায়বানির কাছে চলে এলেন। তিনি তাঁর সমর্থনের ঘোষণা দিলেন। 

এই ঘটনার পর শায়বানির পক্ষ অত্যন্ত মজবুত হয়ে উঠল। 

উজবেক সরদারদের মজবুত সহযোগিতা পাওয়ার পর আমার বাহিনীর বুখারা পর্যন্ত পৌঁছানোর অপেক্ষা না করেই স্বয়ং সমরখন্দ অভিযানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *