ত্রয়োদশ অধ্যায় – হিঁদুস্তান অভিমুখে বাবুর

ত্রয়োদশ অধ্যায় – হিঁদুস্তান অভিমুখে বাবুর 

কাবুলে আমার শাসনের শুরুআতির দিনগুলোতে আমি কিছু সংস্কারমূলক কাজ সম্পন্ন করি। লোকেদের সুদিন এল। কুসংস্কারগুলো নির্মূল করলাম। যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার দিকে মনোযোগ দিলাম। 

কাবুলের জনতার পূর্ণ বিশ্বাস লাভ করার পর আমি সেনা ভর্তি করলাম। কাবুলের প্রত্যেক ভূ-ভাগ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করলাম। সুসংহত সেনাবাহিনী গঠন করার পর সেনা কর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করলাম যে, এই সামরিক 

শক্তির ব্যবহার কোথায় করা উচিত? অধিকাংশের রায় ছিল—হিঁদুস্তান অভিমুখে চালনা করা উচিত। 

শাবান (আরবি মাস) মাসে, জানুয়ারি, ১৫০৫ এ আমি অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হলাম। আমার অশ্বারোহী সেনা তাদের ঘোড়াগুলো হিঁদুস্তান অভিমুখে চালিয়ে দিল। 

আমরা বাদাম চাশমা ও জগদলিকের সড়ক ধরলাম এবং ছ’দিনের পড়াওয়ের পর আদিনাপুর পৌঁছে গেলাম। 

ওই সময় পর্যন্ত আমি হিঁদুস্তানের কোনো গরম শহর দেখিনি। কাবুল হিদুস্ত ানের সীমান্ত ক্ষেত্র ছিল নিংগনহর। আমরা ওই পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম। এখন আমার সামনে এক নতুন দুনিয়া দেখার সুযোগ ছিল। সেখানকার তৃণভূমি, সেখানকার গাছপালা, পশুপাখি সবকিছু আমার দেখা দুনিয়া থেকে আলাদা ছিল। 

লোকেদের রীতি-রেওয়াজ আমার জন্য নতুন ছিল। উপজাতিদের, যাযাবার শ্রেণির লোকেদের দলগুলোর জীবনযাত্রার ঢং সম্পূর্ণ অন্য রকম ছিল। 

প্রতি পদে পদে আমাদের বিস্মিত হতে হচ্ছিল। প্রকৃত সত্য ছিল এই যে, ওখানকার ভূমিই ছিল বিস্ময়কর। 

ভারত-সীমায় বাবুরের প্রবেশ 

নাসির মির্জা, যে সেনাদলের সঙ্গে আমার আগে আদিনাপুর পৌঁছে গিয়েছিল, সেখানে সে যাত্রা বিরতি করে আমার জন্য প্রতীক্ষায় রইল। আমি সেখানে কিছুটা দেরিতে পৌঁছাতে পেরেছিলাম, এর কারণ হলো, আমার পিছনে পড়ে যাওয়া সৈনিকদের জন্য আমি যাত্রা-বিরতি করে অপেক্ষা করেছিলাম। তাদের সঙ্গে নিয়েই অগ্রসর হয়েছিলাম। 

সবাই এসে একত্রিত হবার পর আমি জুলশহলের তটবর্তী এলাকা পেরিয়ে এলাম। তারপর, কুশগম্বুজ পাহাড়ি উপত্যকায় উঠে গেলাম। 

ওখান থেকে নাসির মির্জা আমার পিছু ধরে অগ্রসর হওয়ার নীতি গ্রহণ করল। এর মূল কারণ ছিল, তার নেতৃত্বাধীন সেনা তার পিছনে ছিল। তাদের খাওয়া-দাওয়া ও তাদের উৎসাহিত করে অগ্রবর্তী হওয়ার কাজ সে নিপুণভাবে করতে পারত। তার নেতৃত্বাধীন সেনা সংখ্যা অনেক বড় ছিল। 

কুশগম্বুজ পাহাড়ি উপত্যকা পার হয়ে আসার পর আমরা গরম চশমা নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছালাম। ওই এলাকার মুখিয়া (প্রধান ব্যক্তি বা দলপতি) তার পুরো কাফেলা সহ আমার অধীনতা স্বীকার করে নিলেন। আমি তাকে পথ-প্রদর্শক রূপে আমার সঙ্গে নিলাম। 

১৫০৫ ঈসায়ী সনে খয়বর পায় হয়ে আমরা জাম পাহাড় পার হলাম। ওখানকার পরে গুর-খত্রী সম্পর্কে আমি কিছু কথা শুনে রেখেছিলাম। বলা হতো, ওই স্থানটি যোগী ও হিদুদের জন্য পবিত্র বিশ্বাসের ক্ষেত্র। লোকেরা দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে ওখানে তাদের দাড়ি ও মাথা কামাতে আসে। 

জামের চড়াই অতিক্রম করার পর আমরা বিলগ্রামে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে বিশাল বৃক্ষ ছিল, যার উপরে উঠে পুরো নগর দেখা যেতে পারত। 

আমি বিল খত্রীর বিষয়ে মুখিয়াকে প্রশ্ন করলাম। তার নাম ছিল মালিক বু-সাদ-কমর্ত। তিনি বিল খত্রী সম্পর্কে কিছু বলতে পারলেন না। আমি শিবির ফেললাম। আমি মালিক বু সাদ (পথ-প্রদর্শক)-এর সঙ্গে আরো একবার তাঁবুর পিছনোর অংশে গিয়ে মিলিত হলাম। সেখানকার বিষয়ে বিস্তারিতভাবে পুরো জানকারি নেওয়ার কাজ করতে লাগলাম। 

তিনি বিলগ্রামের খাজা মুহম্মদ আমীনের বিষয়ে কিছু তথ্য দিলেন, অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করলেন না। তথ্য প্রদান বাবদ তাঁর জ্ঞানের স্বল্পতার কারণ এটাই যে, তিনি যে গোত্রের মুখিয়া ছিলেন তারা শুধুমাত্র উপত্যকা, নির্জন পথ-ঘাট ও পাহাড়ি ক্ষেত্রগুলোতে বসবাস করত, সেখান থেকে কখনো সামনে এগোনোর চেষ্টা করেনি। তিনি খাজা আমীনের বিষয়ে বলেন যে, খাজা একদিন তাঁর কাছে এসেছিলেন। তাঁকে বেশি-কম বলেছিলাম, সোজা রাস্ত ার উপরে চলে গিয়েছিলেন। 

সৈন্যদের কোহাত অভিমুখে অগ্রযাত্রা 

আমাদের পঞ্চম সেনাদলের সেনাপতি ছিলেন বকী ছগানিয়ানী। ওই সময় তাঁর সেনাদল আগে আগে চলছিল। তাঁর সঙ্গে আমি পরামর্শ করলাম-‘আমাকে কী এখন সিন্ধুনদ পার হওয়া উচিত না-কি অন্য পথ ধরা উচিত? 

বকী আমার প্রশ্নের উত্তরে বলল—

‘অন্য একটি পথ আছে, সেখান দিয়ে গেলে সিন্ধুনদ পার হওয়া ছাড়াই সামনে এগুনো যাবে। সে বলল, ওই স্থানটি কোহাত নামে পরিচিত। এক রাতের দূরত্বে সেখানে পৌঁছানো যাবে।’ 

বকীর কথা শুনে আমি কোহাতের রাস্তা ধরার কথা চিন্তা করলাম। তবে সিন্ধু নদ পার হওয়া ছাড়াও ভারতে পৌঁছানোর আরো কয়েকটি স্থল পথও আছে একথা আমার শোনা ছিল না। এ জন্য প্রামাণিকতার জন্য আমি কিছু ঘোড়সওয়ারকে বকীর জানানো পথে দ্রুতগতিতে রওয়ানা করিয়ে দিলাম। 

তারা ফিরে এসে বকীর কথাকেই সমর্থন করল। 

তথ্য প্রমাণ হয়ে যাবার পর আমি সিন্ধু পার হওয়ার ইচ্ছা জ্ঞাপন করলাম।

ফৌজকে জামের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলার আদেশ দিলাম। 

বারাবফাতের (আরবি) মাস ছিল। মুহাম্মদ পার্বত্য এলাকা অতিক্রম করলাম। 

সমতল ক্ষেত্রে পৌঁছাতেই গাগলানী আফগানদের বস্তি পেলাম। এই স্থানটিকে পারাসাবার বলা হতো। আমার বিশাল বাহিনীকে পাহাড়ি উপত্যকা থেকে নামতে দেখে, পাগলানী আফগানরা স্ত্রী-পুত্র-পরিজনসহ নিজেদের বস্তি ছেড়ে পালাতে লাগল। তারা পাহাড়-বেষ্টিত এলাকার মধ্যে গিয়ে লুকাল। আমরা সেখানে শিবির ফেললাম। যখন তারা দেখল যে, আমাদের সৈন্যদের দ্বারা তাদের কোনো ক্ষতি করা হচ্ছে না তখন তাদের এক মুখিয়া ভীতসন্ত্রস্ত ভাবে আমাদের তাঁবুর মধ্যে এল। 

আমি তাকে, নির্ভয় হতে বললাম। তাকে বসিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। 

তার নাম ছিল মুহম্মদ ফাজ্জি। সে সন্তুষ্ট চিত্তে আমাদের পথ দেখাতে সানন্দে রাজি হয়ে গেল। 

ওখান থেকে সামনের পথ সম্পর্কে তার খুব ভালো জানা-শোনা ছিল। সে পরবর্তীর জন্য আমাদের পথ-প্রদর্শক হয়ে গেল। 

আমি মাঝরাতে শিবির তুলে নেওয়ার আদেশ দিলাম। ভোরের আলোয় আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছি। পুরো সকাল হয়ে যাবার পর আমরা কোহাতে প্রবেশ করলাম। 

অসংখ্য গরু-মহিষ দিয়ে ওখানকার অধিবাসীরা আমাদের সেনা চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দিল। সেখানকার অধিবাসীরা ছিল আফগান উপজাতির লোক। তারা বিরোধিতার জন্য তাদের গরু-মহিষদের পিছন পিছন হইচই ও শোরগোল তুলছিল। যদিও বিরোধিতার শক্তি তাদের ছিল না, তা সত্ত্বেও জানোয়ারদের দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে বিরোধিতার নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে বসেছিল। আমাদের সৈনিকেরা জানোয়ার ও মহিষসহ বিরোধ প্রদর্শনকারী আফগানদের সহজে কাবু করে ফেলল। 

তাদের সবাইকে একত্রিত করা হলো। তারা প্রাণভয়ে কাঁপছিল। আমি আমার প্রতি তাদের বিশ্বাস জন্মিয়ে দিতে গিয়ে বললাম যে, আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না। 

বিশ্বাস পাওয়ার পর তারা আমার অধীনতা স্বীকার করে নিল। আমি তাদের সবাইকে আজাদ করে দেওয়ার আদেশ দিলাম। 

আমি সেখানে সেনা-শিবির ফেললাম। তারপর, কোহাত ভ্রমণের জন্য বেরোলাম। 

সেখানকার লোকেরা সহায়-সম্পত্তি নিয়ে খুব অবস্থাপন্ন জীবন-যাপন করছিল। তাদের বাড়ি ঘরগুলোতে মক্কা গাদা দিয়ে রাখা ছিল। আমরা সেখান থেকে পরবর্তী সফরের জন্য খাদ্য-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে নিলাম। 

সেখানে আরো এক রাত শিবির ফেলে অবস্থান করলাম। আমি আমার সেনাকে পরবর্তী লোকেদের কাছ থেকে পরবর্তী রাস্তা ও প্রয়োজনীয় তথ্য-সামগ্রী জুটিয়ে আনতে বললাম। 

তারা পথের খোঁজ-খবর নিয়ে ফিরে এসেছিল। কোহাতে আমরা দু’রাত কাটিয়েছিলাম। সেখানকার বাসিন্দারা আমার বিশ্বস্ত হয়ে হয়ে গিয়েছিল। 

সামনের রাস্তার খবরাখবর নিয়ে ফিরে আসা লোকেদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক খবর মেলেনি। এমন কোনো পথের সন্ধান পাওয়ার গেল না যেখান থেকে দরিয়া-এ-সিন্দ পার হওয়া ছাড়া হিঁদুস্তান পৌঁছানো যেতে পারে। 

সেনাপতি বকী যে তথ্য দিয়েছিল, সেই মতো কাজ করতে দেখে সে লজ্জিত হলো। 

‘কোনো ব্যাপার নেই…।’ আমি আমার সেনাপতি বকীর কাঁধে হাত রাখলাম, তার পিঠ চাপড়ে বললাম-‘দুনিয়ায় রাস্তার সন্ধানে বেরিয়ে কত বড়-বড় বিখ্যাত লোক রাস্তা হারিয়ে ফেলে। তবে, রাস্তা হারানোর পরেও এমন প্রাপ্তি মিলে গেছে যে জগৎ তাতে চমৎকৃত হয়ে রয়ে গেছে।’ আমি বলতে থাকলাম-‘এমনও নয় যে, আমরা কিছু পাইনি। আমরা কোহাত নামক একটি নতুন প্রদেশ পেয়ে গেলাম। এখানকার লোকেরা সহজে আমাদের অধীনতা স্বীকার করে নিল। আমার কোহাত জয় করেছি। এমন একটা প্রদেশ আমরা পেয়েছি, যা ধন-সম্পদ ও সুখ-শান্তিতে ভরপুর। এখানে আমরা খাদ্য সামগ্রীর ভাণ্ডার পেয়ে গেছি, যা আমাদের দীর্ঘ সফরের জন্য পর্যাপ্ত…। হতে পারে যে আমরা কোহাত না পৌঁছালে এখানকার রাজ-ক্ষমতা বছরের পর বছর ধরে আমাদের হাত থেকে দূরে থেকে যেত। 

আমার যুক্তিপূর্ণ কথায় বকী সন্তুষ্ট হলো। তার বিবর্ণ চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে সন্তুষ্টি ও বিশ্বাসে পূর্ণ হয়ে উঠল, এমন এক বিশ্বাস যা সেনানায়কদের মধ্যে অবশ্যই বিদ্যমান থাকা উচিত। সেনানায়কই যদি হতাশার মধ্যে ডুবে থাকে তবে তো পুরো সেনাদলই নিরুৎসাহিত হয়ে যায়। 

বীর যোদ্ধাদের কথা আমার সদা-সর্বদা স্মরণ থাকে যে, ‘যুদ্ধ অস্ত্রবলে নয়, বুদ্ধিবলে জিততে হয়। 

আমি কঠিন হতেও-কঠিনতর পরিস্থিতিতে নিজের সেনানায়কদের উৎসাহ বাড়ানোর নিয়ম মেনে চলেছি। এর ফলে, আমি সাফল্য পাচ্ছি। এর প্রমাণ এই রূপে সামনে এল যে, যখন আমার সবচেয়ে কষ্টের দিনগুলো ছিল তখনও আমার বিশ্বস্ত সাথিরা আমাকে ত্যাগ করেনি। এমন লোকেরা বরাবরই আমার সঙ্গে রয়ে গেল যাদের এ চিন্তাও ছিল না যে, তাদের পরিবার-পরিজনদের আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়ে যেতে হবে। 

আমার উৎসাহী স্বভাবের কারণে আমার এমন সাথিদের হামেশাই এমন বিশ্বাস জন্মে যাচ্ছে যে, আমি অনতিবিলম্বেই একটি বিরাট সাম্রাজ্যের মালিক বনে যাব। 

কোহাত শিবিরের মধ্যে আমি আমার সেনানায়কদের সঙ্গে এই বিষয়ের জন্য পরামর্শ করলাম যে, আমাদের পরবর্তী সফল পদক্ষেপ কী হতে পারে? 

এই বিষয়েও আলোচনা হলো যে, বংগাশ আফগানদের উপর আক্রমণ করা হবে, না প্রতিবেশী রাজ্য বন্নুর উপর আক্রমণ করা হবে। কাবুলে ফেরার উপরেও আলোচনা হলো। ফারমুল সড়কের দিকে টোহি উপত্যকা থেকে অগ্রসর হওয়ার কথাও আলোচনা হলো। 

এ সব সলা-পরামর্শের মধ্যে ইয়ার হুসাইন, তিনি দরিয়া খাঁ-র পুত্র ছিলেন, আমার কাছে একটি লিখিত প্রস্তাব রাখলেন। 

এই প্রস্তাবে তিনি লিখেছিলেন—

‘যদি আমাকে এ বিষয়ে শাহী-আদেশনামা প্রদান করা হয় যে, দিলজক, ইউসুফ জক ও আফগানি সেনার ফৌজি টুকরি আমার আদেশ পালন করবে তাহলে আমি কথা দিচ্ছি যে, আপনার নামের তরবারির ছায়ায় আমরা সিন্ধুনদ পার হয়ে যাব।’ 

তার এই উদ্যম আমার পছন্দ হলো। আমি তাঁকে শাহী-ফরমাননামা লিখে দিলাম। তাকে এ অনুমতিও দেওয়া হলো যে, সে তার পছন্দমতো ফৌজি টুকরিকে বেছে নিয়ে নিজের নেতৃত্বে কোহাত থেকে সিন্ধু নদ পার হওয়ার জন্য দ্রুত অগ্রসর হয়ে যাক। 

থাই বা তিল অভিমুখে রওনা 

আমি কোহাত থেকে বংগাশের উদ্দেশে হংগু সড়ক ধরলাম। এই পথটি কোহাত ও হংগু উপত্যকা হয়ে যেত। এই উপত্যকার পথ দুই দিক থেকে উঁচু-উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা। 

আমরা যখন উপত্যকায় প্রবেশ করলাম তখন কোহাত পাহাড়ি এলাকার আফগান বাসিন্দারা দু’দিকের পাহাড় অবরোধ করে হইচই বাধিয়ে হামলার নীতি অবলম্বন করল। 

মালিক বুশাদ কমারী, যিনি ওই সময়, কোহাত থেকে আমাদের পথ-প্রদর্শক রূপে চলেছিলেন তাঁর অতি উৎসাহী যুবা এবং চপল যোদ্ধার গুণ ছিল। তিনি আমাকে সম্পূর্ণরূপে আশ্বস্ত করলেন যে, তাদের হইচই করে হামলার জন্য মোটেও বিচলিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তারা লড়াকু প্রকৃতির নয়। তাদের হরকত গাধা-বাঁদরদের মতো। তারা হইচই করে পাহাড়ি উপজাতিদের একত্র তো করতে পারে কিন্তু বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। 

মালিক রুশাদও এই রণনীতি গ্রহণ করলেন যে, কীভাবে তাদের কাবু করা যায়। তিনি উপত্যকার পথ ধরেই ডান দিককার পাহাড়ি পথে উঠে গেলেন। তারপর তার পিছু ধরে একটি বড় সেনাদলকে আসার জন্য ইশারা করলেন। উপরে পৌঁছে তিনি পাহাড়ি উপজাতিদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেললেন। তরবারির জোরে তাদের উপর থেকে উপত্যকার নিচে নেমে আসতে বাধ্য করলেন। 

উপর থেকে নিচে নেমে আসার পর আমি এক সেনাদলকে আদেশ দিলাম পাহাড়ি উপজাতিদের ঘাড় ধরে নিয়ে আসতে। 

সৈনিকেরা তাদের ঘাড় ধরল। তাদের ঘাড়ের উপর তরবারি রেখে তারা অগ্রসর হতে লাগল। দুই দিক থেকে পাহাড় বেষ্টিত আফগানরা তাদের লোকেদের ঘাড়ে তরবারি লটকাতে দেখে হিংস্র হয়ে উঠল এবং পাথর ছুড়তে লাগল। 

তখন আমি ধরে আফগানদের মুণ্ডু উড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দিলাম। আদেশের সাথে সাথে শত-শত মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেওয়া হলো। কাটা মাথাগুলো সৈনিকেরা উঁচু করে পাহাড়ি উপজাতিদের দেখাল, হামলা একেবারেই থেমে গেল। 

তারপর, এক বিস্ময়কর দৃশ্য সামনে এল। এ দৃশ্য বিস্ময়কর হওয়ার সাথে সাথেই কৌতূহলজনকও ছিল। তা ছিল সমস্ত আফগানের দল পঙ্গপালের মতো মাটিতে শুয়ে পড়ল। তারা তাদের মুখ ঘাসের সাথে রগড়াচ্ছিল আর কিছু ঘাস দাঁত দিয়ে কেটে-কেটে খাচ্ছিল। 

‘এটা কী হচ্ছে?’ আমি মালিক বুশাদকে প্রশ্ন করলাম। 

তারা বলছে—

‘আমরা আপনাদের গরু…।’ 

তারপর তিনি আরো বললেন—

‘এখানকার আফগান উপজাতিদের এইটাই পরম্পরাগত ঐতিহ্য যে, তারা কারো বিরুদ্ধে যখন বিরোধিতা ত্যাগ করে তখন তারা ঘাস ছিঁড়ে দাঁত দিয়ে কাটতে কাটতে তারা তাদের আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। তাদের এই পরম্পরা এ কথারও দ্যোতক যে পরেও তারা গরু হয়ে থাকবে। অর্থাৎ অধীনতা স্বীকার করে নেবে। 

আমাদের সৈন্যরা উপত্যকা থেকে পাহাড়ে গিয়ে কাটা মাথাগুলোকে স্তম্ভের রূপে খাড়া করে দিল। আফগানদের মাথাগুলোকে যেখানে স্তম্ভ বানানো হয়েছিল, তার পিছনে তাঁবু ফেলা হলো। 

কাটা মাথাগুলোর স্তম্ভ এ কথারই প্রতীক ছিল যে, পাহাড়ি আফগান উপজাতির লোকেরা তা দেখুক আর ভীতত্রস্ত থাকুক যে, এর পরে অধীনতা পাশ ছিন্ন করার চেষ্টা করা হলে তাদেরও ওই দশা হবে। 

এই যুক্তি ছিল মালিক বুশাদের দেওয়া। এই যুক্তি তিনি পাহাড়ি আফগানদের রীতি-রেওয়াজ ও সোচ-বিচারের সঙ্গে ভালোমতো পরিচিত থাকার ফলেই দিয়েছিলেন। 

যুক্তি সম্পূর্ণরূপে কার্যকর ছিল। ওই এলাকার সমস্ত আফগান উপজাতি অধীনতা স্বীকার করে ভবিষ্যতে ওই ধরনের হরকত না করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকল। 

পরদিন হাংগু পৌঁছানোর জন্য পাহাড়ি পথ অতিক্রম করলাম। 

ওখানকার পথে পড়া স্থানীয় আফগানরা সেনাদের সামনে বড়ই বিরোধ করল। তারা তাদের সংগুর এলাকা থেকে সেনাবাহিনীকে অতিক্রম করতে না দেওয়ার জন্য জীবন মরণ পণ করে ময়দানে নেমে এল। সংগুর এলাকার কথা এর আগে আমি কখনো শুনিনি। 

আমাকে অগ্রবর্তী একটি সেনাদলকে তাদের বিরুদ্ধে পাঠানো হলো। প্রথমে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। তারা জীবন-মরণ-পণ করেই ডেটে রইল তখন সৈনিকেরা অস্ত্র ব্যবহার করতে বাধ্য হলো এবং তাদের মুণ্ডু উড়িয়ে দিল। তাদের দু’-একশো সৈনিকের যখন মুণ্ডু গেল তখন তারা ঠান্ডা হলো। 

ওখানেও তাদের ছিন্ন-মস্তক দিয়ে স্তম্ভ খাড়া করে দেওয়া হলো। এই পরম্পরা নির্বাণের পরেই তারা অধীনতা স্বীকার করল। অবশ্য, এই এলাকার লোকেরা দাঁতে ঘাস কেটে নিজেদের ‘গো-রূপ’ প্রদর্শন করল না। 

হংগুতে এক রাতের অবস্থানের পর আমাদের সেনা থাই-য়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আমার লক্ষ্য ছিল থাই হয়ে বংশ পৌঁছানোর। ওই পথেও পাহাড়ি আগফানদের বিরোধিতার মোকাবিলা করতে হলো। সেনা আগ্রসর হয়ে তাদের বিরোধিতার জবাব দেওয়ার ইঙ্গিত করল। তবে তাদের সংখ্যা সংগুরের আফগানদের মতো ছিল না। বিরোধ প্রবল ছিল না। তারা সেনা-সংখ্যার শক্তি এবং তাদের আক্রমণের মনোভাব দেখে পালিয়ে গেল। 

বননু সড়কের সফর 

থাই বা তিল এলাকা পার হওয়ার পর অগ্রসর হওয়ার জন্য কোনো সড়ক পথ ছিল না। এবড়ো-খেবড়ো পাহাড় ও নির্জন উপত্যকা অতিক্রম করেই তবে অগ্রসর হওয়া যেতে পারত। 

বননু পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য এক রাতের বিশ্রামের পর যখন আমাদের সেনা সমতল এলাকায় প্রবেশ করল তখন আমার চোখের সামনে যেন পশুদের সাগর ভেসে উঠল। উটের লম্বা কাফেলা, ভেড়া ছাগলের পাল, ঘোড়াদের দল… কয়েক মাইল পর্যন্ত শুধু পশু-আর পশু …। আমি নানা রকমের পশুতে ভরা এত বড় ময়দান এর আগে আর কখনো দেখিনি। সমস্ত পথ পশুতে ভরে ছিল। একটি এলাকায় তো ভেড়াদের চারণ ক্ষেত্র নজরে আসছিল। ঘোড়ায় চড়া লোকেরা, যারা অবশ্যই মেষ-পালক ছিল, তারা ভেড়া হাঁকানো ও তাদের উপর রাখালির কাজে নিয়োজিত ছিল। 

মালিক বুশাদের নির্দেশে সেনাদল আগে বাড়ল। তিনি বাম দিকের রাস্তা ধরলেন। 

আমার সেনাবাহিনীকে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা দেওয়া হতে লাগল। পশুদের রাখলেরা সেনাবাহিনীকে অগ্রসর হতে দেখে দৌড়ে দৌড়ে নিজেদের পশুদের কিনারা করে দিতে লাগল। তাদের এই ব্যবহার দেখে বোঝা গেল যে, আমাদের সেনাদলের বিরোধিতা করার জন্য এসব পশু দিয়ে পথ অবরোধ করা হয়নি; বরং এটা তাদের পশু-চারণের ক্ষেত্রই। 

তাদের জন্য আমাদের সেনাদলের অগ্রবর্তী হওয়াটা কৌতূহলজনক অবশ্যই ছিল। তবে তারা কোনদিকে, কোন রাস্তায় যাচ্ছে, এ সবের সঙ্গে তাদের কোনো দরকার ছিল না। 

বননু ও ঈসা খায়েলের দেশ 

বননুর ওই বিশাল ময়দান বংগশ ও নেড়া পাহাড়ের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল। এটি উত্তর দিকে। বংগশে বর্ষার আগে পাহাড়ে তুষার পড়তেই সেখানকার অধিবাসীরা সমতল এলাকায় জমি চাষ করতে এবং ফসল ফলাতে এসে যায়। এরা দক্ষিণ এলাকার অধিবাসী। এদের এলাকা চৌপার নামে পরিচিত। চৌপায় সিন্ধু তটের একটি আবাদ ছিল। পশ্চিম ক্ষেত্রের নাম দিনকোট। পশ্চিমের সমতল ভাগকে দাস্ত বলে। সেখানে বাজার বসে। 

বননুর ভূমিকে কুরানী, সূর, ঈসা খায়েল এবং নলাপল আফগান উপজাতিরা উর্বর করে রেখেছিল। 

বননুর পাহাড়ি ক্ষেত্র পেরিয়ে আরো অগ্রসর হয়ে আমি জানতে পারি যে, পাহাড়ি উপজাতিদের বহুসংখ্যক লোক আমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য উত্তর পাহাড়ি এলাকায় এসে একত্রিত হচ্ছে। ওদের সঙ্গে আমাদের বড় টক্কর দেওয়া লাগবে। এ খবর পাওয়ামাত্রই আমরা জাহাঙ্গীর মির্জার নেতৃত্বে একটি বড় সেনাদলকে রওনা করিয়ে দিলাম। 

খবর সঠিক ছিল। 

উত্তর পাহাড়ির দিকে পৌঁছাতেই জাহাঙ্গীর মির্জার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর উপর আফগান উপজাতির লড়াকুরা হামলা চালিয়ে দিল। সেনাদলের উপর হামলা হতেই জাহাঙ্গীর মির্জা সোজা গণহত্যার হুকুম দিয়ে দিলেন। 

দেখতে দেখতেই সৈনিকেরা শত শত লড়াকুর মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দিল। কিছু সৈনিক এক হাতে কাটা মাথা ঝুলিয়ে রেখে আরেক হাত দিয়ে তরবারি চালাতে লাগল। 

সেখানেও কাটা মুণ্ডুগুলো দিয়ে স্তম্ভ খাড়া করে দেওয়া হলো। এটা করতেই লড়াকুরা কাবু হয়ে গেল। অনেক লড়াকুকে বন্দী করা হলো। তারা কিউরি উপজাতি গোষ্ঠীর লোক ছিল। তাদের মুখিয়া ছিলেন শাদুল খান নামক ব্যক্তি। তিনি তাঁর দাঁত দিয়ে ঘাস চেপে ধরে আমার সামনে এসে হাজির হলেন। তার দ্বারা আত্মসমর্পণ হতেই আমি তাঁর জীবন দানের ওয়াদা করলাম। বন্দীকৃত তাঁর সকল লোককেই মুক্ত করে দেওয়া হলো। 

কোহাত থেকে বংগশের মধ্যেই ভাবনা জাগতে লাগল আমার কাবুলে ফিরে যাওয়া উচিত। তবে বননু বিজয়ের পর সেখানকার সমতল এলাকা ভালো করে দেখার পর আমি অগ্রসর হওয়ার ক্রম জারি রাখলাম। 

পরদিন আমরা অগ্রসর হতে শুরু করলাম তো ঈসা খায়েল নামক একটি গ্রাম পড়ল। 

আমাদের অগ্রসর হতেই সেখানকার লোকেরা চৌপারা পাহাড়ের উপরে গিয়ে উঠল। 

তাদের মনোভাব খারাপ ছিল। আমি তাদের পিছনে আশ্বারোহী সৈনিকদের পাঠিয়ে দিলাম। 

সৈনিকরা পাহাড়কে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে তাদের নিচে নেমে আসতে বাধ্য করল। সকল ঈসা খায়েলবাসী তাদের ছাগল-ভেড়া ও কাপড়-চোপড়সহ আমাদের সামনে এসে হাজির হলো। 

তারা আতঙ্কিত ছিল, ভীতত্রস্ত ভাব তাদের চেহারাগুলোকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আমি তাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম। তারপর, তাদের নিজ নিজ বাড়ি-ঘরে ফিরে যেতে বললাম। তারা ফিরে গেল। তবুও তারা তাদের মন থেকে ভয় দূর করতে পারল না। আমি সেখানকার বিশাল ময়দানে শিবির ফেলার আদেশ দিলাম। সৈন্যরা ক্লান্ত ছিল। শিবিরের জায়গাটি বড় মনোরঞ্জক ছিল। 

ঈসা খায়েল গ্রামের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে না দেখে আমি অনুভব করলাম যে, তারা এখান আমার প্রতি ভীতসন্ত্রস্ত। উদ্বেগজনক অবস্থায় নানা রকমের ভুলভ্রান্তি হয়ে যায়। ভুলভ্রান্তির সময়ে পরিণামের কথা আর চিন্তায় আসে না। 

ঈসা খায়েলবাসীদের পক্ষ থেকে আমার আশঙ্কা ছিল। যদিও তারা সমতল ক্ষেত্রের বাসিন্দা ছিল, তা সত্ত্বেও পাহাড়ি উপজাতিদের স্বভাব-প্রকৃতি তাদের মধ্যে ছিল, নইলে আমাদের ফৌজকে দেখে তারা চৌপারা পাহাড়ের উপরে গিয়ে উঠত না। 

আরেকটি অসুবিধা ছিল, তা হলো ঈসা খায়েল গ্রামের কোনো প্রধান ব্যক্তি (মুখিয়া) আমার সামনে আসেননি, তাহলে আমি তাকে নির্ভয় হওয়ার জন্য আশ্বস্ত করতাম। যিনি আমার কথা গ্রামের প্রত্যেক মানুষের নিকট পর্যন্ত সহজে পৌঁছে দিতেন। 

ঈসা খায়েলবাসীদের মনোভাব আমার কাছে ঠিক বলে মনে হচ্ছিল না। এ জন্য রাতে আমি বিশেষ সতর্কতার পরিকল্পনা নিলাম। 

যেখানে শিবির ফেলা হয়েছিল, সেখানকার ব্যবস্থা এই ঢঙে করলাম যে, ঈসা খায়েলবাসী যদি নিজেদের জান বাজি রাখার দুঃসাহসও দেখায় তাহলে তারা আমার ফৌজের সামান্যতম ক্ষতিও যেন করতে না পারে। 

শিবিরের ডান-বাম দুই দিকে সশস্ত্র প্রহরীদের পাহারা বসিয়ে দিলাম। শিবিরের মধ্য ভাগেও এমন ব্যবস্থা করা হলো যে, যদি কেউ, কোনো দিক থেকে কাউকে পাহাড়ে চড়তে দেখে তাহলে তার গতিবিধি যেন লক্ষ করা যায়। শিবিরের পাহারাদারির কাজে লাগানো সৈনিকদের কয়েক ঘণ্টার জন্য নিযুক্ত করা হলো যাতে ক্লান্তি কিংবা নিদ্রার কারণে চোখ বন্ধ করার জন্যও গাফিল না হতে পারে। কিছু লোককে জ্বলন্ত মশালসহ নিযুক্ত করা হলো। 

আমি স্বয়ং, রাতের বেলা তাঁবুগুলোর চারদিকে, সময় সময় চক্কর লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। 

জাহাঙ্গীর মির্জার নেতৃত্বাধীন দলের তাঁবু, ডান দিককার ঘেরার মধ্যে ফেলা হলো। তার সঙ্গে বকী শেরিম তগফ, সৈয়দ হুসাইন আকবর এবং অন্য বেগদের টুকরিকে রাখা হলো। 

বামদিকে নির্মিত তাঁবুগুলোর জিম্মেদারি মির্জা খানের উপর রাখা হলো। তাঁর সঙ্গে আব্দুর রজ্জাক মির্জা, কাশিম বেগ এবং অন্য বেগদেরও সেনা টুকরি রাখা হলো। 

তাঁবুগুলোর মধ্য ভাগে পেশাদার যোদ্ধাদের পরিবর্তে সাধারণ সৈনিকদের এবং তাদের সঙ্গে আমার গুরুত্বপূর্ণ সাথিদের, পরামর্শকদের এবং বংশের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকেদের রাখার ব্যবস্থা করলাম। মধ্য অংশের সুরক্ষার নেতৃত্ব সৈয়দ কাশিমকে দেওয়া হলো। তার উপর দ্বার রক্ষকের ভার অর্পণ করা হলো। তার সঙ্গে বাবা ঔধুল্লা বিরদি এবং অন্য বিশ্বস্ত বেগদের রাখা হলো। পুরো সেনাদলকে ছয় ভাগে বিভক্ত করা হলো। প্রত্যেকের জন্য দিন ও রাতের পাহারাদারির ক্রম কেমন হবে, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার হলো। 

এই ব্যবস্থা শুধুমাত্র ওই দিনের জন্য নয়; বরং পরবর্তী সময়কার জন্যও নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো। আমি এই ব্যবস্থাকে ওই সময় পর্যন্ত চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম, যতদিন যাবৎ সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী হওয়ার এবং শিবির ফেলার প্রয়োজন ছিল। রাতে কোনো ঘটনা ঘটেনি। 

সকাল বেলা ওই পাহাড়ি ঘেরা থেকে শিবির তুলে নেওয়া হলো এবং পশ্চিম অভিমুখে অগ্রসরের প্রস্তুতি নেওয়া হলো। 

আমরা ওই পাহাড়ি উপত্যকা পার হলাম, যেখানে সমতল এলাকা শুকনো থাকে। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোথাও পানির দেখা মিলল না। ওখানকার পাহাড়ি এলাকাও শুষ্ক। সমতল এলাকা বর্ষার পানির উপর নির্ভরশীল থাকে। 

তখনও বননু ক্ষেত্রের মধ্যে আসা সমতল এলাকা অতিক্রম করছিলাম।

ওখান থেকে সৈনিকদের নিজেদের জন্য পানি প্রাপ্তির ব্যবস্থা করেও চলতে হচ্ছিল। 

ওই সমতল ক্ষেত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এক দেড় গজ মাটি খুঁড়লেই পানি-স্রোত পাওয়া যেত। এই পানি-স্রোতের বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে আমি সামনে গিয়ে জানতে পারি যে, পানি-প্রাপ্তির এই প্রাকৃতিক সাধনের ব্যবস্থা এ জন্য ছিল হিঁদুস্তানের কোনো একটি বড় নদী ওই এলাকা দিয়ে প্রবহমান ছিল। কখনো-কখনো তো দেড়-দু’হাত খুঁড়লেও পানি পাওয়া যেত। 

ওই এলাকায় আল্লাহর অসীম রহমত ছিল। ওখানে প্রবহমান নদী না থাকা সত্ত্বেও নদীর ভূমিগত পানি-স্রোতের ব্যবস্থা ছিল। 

ওখান থেকে ফারমুলের জন্য দুটি পথ ছিল—উত্তর দিক থেকে দরিয়া-এ-গজক পার হয়ে এবং পশ্চিম দিক থেকে শকবাদ উপত্যকা পার হয়ে পৌঁছে যাওয়া যেত। আমরা পরদিন সকালে শুষ্ক পথ ধরে ধরে (উপত্যকার রাস্তা) এলাকা অতিক্রম করলাম। দুপুরের মধ্যে আমরা সমতলে অবস্থিত গ্রামীণ ক্ষেত্র থেকে অতিক্রম করলাম। ওখানকার অধিবাসীরা সহজ-সরল ও শান্ত স্বভাবের ছিল। তারা দলে দলে আমাদের জন্য কাপড়, ঘোড়া ও পানাহারের বস্তু-সামগ্রী নিয়ে এল। তাদের আশা যে, তার বদলে তারা উপযুক্ত মূল্য লাভ করবে। 

আমার এবং আমার সৈনিকদের মাধ্যমে তাদের আশা পুরো করা হলো। আমি সেখানে শিবির ফেলার আদেশ দিলাম। প্রায় সন্ধ্যার মুখে শিবির ফেলা শেষ হলো। পরদিন সকাল এবং দুপুর পর্যন্ত আমরা সেখানে অবস্থান করলাম। গ্রামীণ লোকেরা ভেড়া এবং অন্য দুগ্ধবতী পশুদের নিয়ে আবারও সেখানে সকাল থেকেই এসে ভিড় করল। ওদের যেমন আশা ছিল যে, পশুর দুধের উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যাবে, তাদের এ আশাও পুরো হলো। 

পরবর্তী সফর জারি হলো তো পথিমধ্যে আফগান সওদাগরদের কাফেলা আসতে দেখা গেল। 

ওই কাফেলা হিঁদুস্তান থেকে ফিরে আসছিল। ওই কাফেলার সওদাগররা বস্ত্র, জড়ি-বুটি, চিনি ও অন্যান্য খাদ্যসমাগ্রী কিনে নিয়ে আসছিল। তাদের বহুসংখ্যক ঘোড়ার বাচ্চাও ছিল। যা বিক্রি করার জন্য তারা কিনে নিয়ে এসেছিল। 

আফগান সওদাগরদের কাফেলার সরদার খাজা খিজির সুহন্দ নামক আফগান বণিক খুব নামী-দামি ব্যক্তি ছিলেন। 

তিনি একজন নামী যোদ্ধাও ছিলেন। কাফেলার লোকেরা তাঁর উপরে ভরসা করে চলতে পছন্দ করত। রাস্তায় লুটেরাদের দ্বারা লুটপাট করার চেষ্টা হলে খাজা খিজির তাদের উপর বাজের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তিনি দুর্দান্তভাবে আক্রমণ চালিয়ে তরবারির আঘাত করতে করতে তাদের মুণ্ডুপাত করতে করতে এগিয়ে যেতেন। তার সঙ্গে একবার সামনা-সামনি হলে, লুটেরাদের অবস্থা এমনই কাহিল হয়ে পড়ত যে, তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মদেরও নসিহত করে যেত যে, কাফেলার সরদার খাজা খিজিরের সামনে পড়ে গেলে, তার কবল থেকে বাঁচতে দূরের রাস্তা ধরাই মঙ্গল। 

খাজা খিজির এরকমই এক লুটেরা দলের উপর তরবারি চালিয়েছিলেন। তাঁর হাতের একটি আঙুল কেটে গিয়েছিল, তবে তিনি লুটেরাদের এলাকা ছাড়া করেছিলেন এবং কাফেলা সওদাগরদের লুট হয়ে যাওয়া মাল ফিরিয়ে নিয়েই তবে পিছু ছেড়েছিলেন। আফগান খাজা খিজির যখন আমার সেনাদলকে আসতে দেখলেন তখন তিনি সাথে সাথে ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। তাঁর দেখাদেখি অন্য সওদাগররাও ঘোড়া থেকে নেমে এলেন। 

খাজা খিজিরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম এবং তিনিও আমাকে পাদশাহ (বাদশাহ) রূপে সম্মান করতেন। 

তিনি আমার কদমবুসির জন্য এগিয়ে এলেন। তাঁর দেখাদেখি কাফেলার অন্যান্যরাও তাই করলেন। 

তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমি হিঁদুস্তান যাওয়ার রাস্তার বিস্তারিত খোঁজ-খবর জানলাম। 

তাঁর হিঁদুস্তান যাত্রার বিবরণ থেকে যে তথ্য আমি জানলাম, তা হলো তিনি সঠিক মৌসুমে হিঁদুস্তান থেকে ফিরে এসেছেন এবং আমি ভুল মৌসুমে সেই পথে যাত্রা করছি। তাঁর দেওয়া তথ্যানুসারে নদী না পেরিয়ে হিঁদুস্তানে যাওয়াই যেতে পারে না। তিনি যখন এসেছিলেন তখন নদী শুকনো ছিল, আর আমি যখন যাব তখন আমাকে বিক্ষুব্ধ নদী পার হতে হবে। 

তাঁর কথায় দম ছিল। তিনি একজন কর্মকুশল কাফেলা সরদার ছিলেন। তাঁর কাফেলা এগিয়ে চলে গেল তো দূরে আর এক কাফেলার ঝলক দেখা গেল। কিছুক্ষণ পর দৃশ্য স্পষ্ট হতেই বোঝা গেল যে, সেটা কোনো কাফেলা নয়, আমার নিজেরই সেনাদল। সেই সেনাদল, ইয়ার হুসাইন যাদের বড় সাহসিকতার সাথে নিজের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। ইয়ার হুসাইন ফিরে এসেছিল। উল্লেখ্য যে, সে সামনে যাবার রাস্তা বদলে দিয়েছিল। সে ফিরে আসাতে আমি বড় খুশি হলাম। সে সামনের রাস্তার অভিজ্ঞতা লাভ করেই ফিরে এসেছিল। 

বাবুরের কাবুল প্রত্যাবর্তন 

আমি কাবুল-কান্দাহার, গজনীর এক বড় ভূ-ভাগ জয় করে নিয়েছিলাম। তার সামনে হিঁদুস্তানের সীমান্ত ছিল। 

আমি যতদূর পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিলাম সেখান থেকে গজনীর যাওয়ার জন্য দুটি রাস্তা ছিল। একটি তো সংখ-এ-সুর্খ হয়ে যা বিক্ গিয়ে ফারমুলের সঙ্গে মিলত। আর অন্যটি গোমাল হয়ে যেত। সেটিও ফারমুলে গিয়ে মিলত। ওই পথে বিক্ মাঝপথে পড়ত না। 

এই দিনগুলোতে আমাদের সেনাবাহিনী সমতল এলাকায় বিশ্রামের জন্য অভ্যন্ত হয়ে পড়েছিল। গোমালের রাস্তা এই দৃষ্টিতে কষ্টপ্রদ ছিল। ওই রাস্তায় উপত্যকা ও পাহাড়-পর্বত খুব বেশি পরিমাণে পড়ত। অন্য পথটি আপেক্ষাকৃত বেশি সমতল ছিল। 

আমি সেনানায়কদের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করলাম যাকে আমি অপেক্ষাকৃত উত্তম রাস্তা মনে করছিলাম, এ বিষয়ে বিচার-বিবেচনার পর এ কথাই সামনে এল যে, ওদিকে পানি স্রোতের মোকাবিলা করতে হবে। 

ওই দিন কোনো সিদ্ধান্ত হলো না। 

পরদিন শিবির তুলে নেওয়ার আদেশ দিলাম। এটি ঈদ-উল-ফিতরের দিন ছিল। রওনার প্রস্তুতি ছিল, তবে এখনও পথ ঠিক ছিল না। জাহাঙ্গীর মির্জাকে আমি দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, সকল মির্জা সরদারের মধ্যে বিষয়টি উত্থাপন কর। 

আমি যে পথটি নির্বাচন করেছিলাম সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রাহকদের মাধ্যমে যা জানা গেল তা হলো ওই পথ সুলেমান পর্বতমালায় কারণে যথেষ্ট দুর্গম। তখন গোমালের পথই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। আমাদের মধ্যেকার একজন ব্যক্তিও ওই পথ দেখেনি। পথ সম্পর্কে যা তথ্য ছিল তা ছিল শোনা কথা। 

ঈদের নামাজ গোমাল নদীর তটে আদায় করা হলো। সামান্য রাস্তা অতিক্রম করতেই গোমাল নদী পড়েছিল। তখন সিদ্ধান্ত হলো ঈদের খুশি ওখানেই উদযাপন করা হোক। 

ঈদের দিন ছিল। গোমাল তটে শিবির ফেলা হলো। নামাজ শেষে সবাই একে অন্যকে অভ্যর্থনা জানাতে লাগালেন। 

মুসলমানরা ঈদের আনন্দ তিন দিন যাবৎ উদযাপনে মুখর থাকেন। আমাদের সামনে কোনো যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল প্রত্যাবর্তনের সফর। সফরের পথ যেহেতু অজানা ছিল, সেহেতু এর জন্য দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করা হয়নি যে, কতদিনে কাবুলে পৌঁছানো যাবে। এমতাবস্থায় ঈদের আনন্দ উদযাপনের জন্য আমি তিন দিনের অবসর দিলাম। 

আমিও খুব আনন্দাপুত ছিলাম। ঈদের ওই মুবারক দিনে আমার মনে কাব্য-কবিতার লহর উঠছিল। আমি তুর্কি ভাষায় কবিতার কয়েকটি পঙক্তি লিখলাম। এই কাব্য-পঙক্তিগুলো কিছুটা একরম ছিল—

“ওগো ঈদের চাঁদ, সবার জন্য খুশির বার্তা আনো 
যারা তোমায় দেখে। 
তোমায় দেখার জন্য সবাই লালায়িত থাকে 
পরস্পরে কোলাকুলি ও শান্তি প্রকাশ করে। 
যারা তোমায় দেখে। 
তবু অনেকের হৃদয়-মনে শান্তি থাকে নাকো
আত্ম-স্বজন থেকে যারা অনেক দূরে থাকে
ভাবে তারা খুশির বার্তা দেব আমরা কাকে।।
ও বাবুর! স্বপ্ন তোমার ভাগ্য হয়ে থাকে
নয়া বছরের শান্তি-বার্তা দাও লোকেদের তুমি, 
কেননা, ঈদের চাঁদকে তুমিও দেখ, সে-ও তোমায় দেখে।।
কামনা করো, আজির মতো চলুক খুশির দিন 
ঈদের খুশির মতোই যেন জীবন চলতে থাকে ॥” 

ঈদের খুশি উদযাপনের পর আমি সসৈন্যে গোমাল নদীর পাহাড়ি জলাধার পার হলাম। পাহাড় পরিবেষ্টিত উপত্যকার নিচু জায়গা দিয়ে সফর শুরু করলাম। আমাদের সামনের গন্তব্য ছিল দক্ষিণ দিক। 

আমাদের অগ্রবর্তী সেনা দু-এক মাইল পথ যেতে-না-যেতেই দেখল, পাহাড়ি আফগানরা পাহাড়ের মাথায় একত্রিত হচ্ছে। তাদের আক্রমণমুখী বলে মনে হচ্ছিল। 

তাদের সবার মধ্যে নেতা গোছের এক আফগান একাই আলাদা একটি পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আমাদের বাহিনীকে অগ্রবর্তী না হওয়ার জন্য সতর্ক করছিল। 

সে ছিল একজন কান কাটা লোক। অবশ্যই সে একজন যুদ্ধবাজ লোক ছিল। কোনো যুদ্ধে শত্রুর তরবারির আঘাতে তার একটা কান কাটা গিয়েছিল। 

আমার সেনার অনুসন্ধানী দলের সাথিরা এরকম অবরোধ হটানোর কাজে বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছিল। তারা উঁচু পাহাড়ের চারদিক থেকে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে তাদের ঘিরে ফেলল এবং তরবারির জোরে তাদের নিচে নামিয়ে ফেলার কাজ করল। 

তারা পাহাড়ি গোত্রের আফগান ছিল। তাদের খুব দ্রুত একথা বোঝানোর পর তারা বুঝে গেল যে, আমি কাবুলের বাদশাহ। কাবুলের বাদশাহ হওয়ার পর কাবুল সীমান্তের সমস্ত ক্ষেত্রই আমার সাম্রাজ্য। ওই এলাকা আমারই যেখানে তারা বসবাস করছে। 

কানকাটা সরদারের মগজে আমার কথা ঢুকল। সে আর কোনো বিরোধিতা ছাড়াই আমার অধীনতা স্বীকার করে নিল। সামনে আমি ফেরার পথে পীর কামীর মকবরা জিয়ারত করলাম। এটি দীখী পাশাবত পথের উপরে অবস্থিত। গজনীর পথে আব-এ-আস্তাদার ঝরনা রয়েছে। 

গজনী থেকে সামনে কাবুলের পথে ভীষণ বন্যার মুখে পড়তে হলো। 

পূর্ণ মাত্রায় বর্ষার মৌসুম চলছিল। প্রবল বর্ষণে নদী-নালা সবই বিপদ সীমার উপর দিয়ে চলছিল। আমাকে দীর্ঘ সময় ধরে গজনীতে যাত্রাবিরতি করে আগে বাড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হলো। সেখানে যাত্রাবিরতির সময় আমার বোধগম্য হলো যে, এ সময়ে হিঁদুস্তানের দিকে না যাওয়াটা কতটা সমঝদারি ছিল। ওদিকে নদী তো আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। তরঙ্গ-সংকুল নদী ও পাহাড়ি ঢলের কারণে কাবুল পৌঁছাতে আমার চার মাস লেগে গেল। কাবুল পৌঁছানোর পর আমি জানতে পারলাম, দু’জন বেগ সেনাপতি অসন্তুষ্ট হয়ে ওখান থেকে চলে গেছে। জানা গেল যে, আমার পিছনে নাসির মির্জা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন। তারা বাদাখশান চলে গিয়েছিল। আরো একটি খবর পাওয়া গেল যে, খুসরো শাহ, যিনি এ সময়ে হেরাতে ছিলেন, নাসির শায়বানির সঙ্গে তার বিরোধী তুঙ্গে উঠেছিল। 

আমি সময়মতো কাবুলে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ক্ষমতা পূর্ণরূপে আমার হাতে তুলে নিয়ে আমি ওই সকল লোকেদের বিরুদ্ধে দ্রুতগতিতে পদক্ষেপ নিতে শুরু করলাম, যাদের বিদ্রোহের মাথা উঁচু হয়ে উঠছিল। 

আমি আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রকারীদের অতি দ্রুত দমন করে ফেললাম। বিদ্রোহীদের নির্মূল করে দেওয়া হলো। আমি নতুন করে সেনা ভর্তি শুরু করলাম। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *