ষষ্ঠ অধ্যায় – মাহমুদ মির্জার জীবনাবসান

ষষ্ঠ অধ্যায় – মাহমুদ মির্জার জীবনাবসান 

১৪৯৪ ঈসায়ী সনের জানুয়ারি মাসে মাহমুদ মির্জা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছয়দিন অসুস্থতার পর তিনি ইন্তেকাল হয়ে যান। এ সময়ে তাঁর বয়স ছিল ৪১ বছর। 

মাহমুদ মির্জার জন্ম ও পরিচয় 

১৪৫৩ ঈসায়ী সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আবু সঈফ মির্জার তৃতীয় পুত্র ও আহমদ মির্জার সহোদর ভাই ছিলেন। 

তিনি বেঁটে ও মজবুত কাঠামোর মানুষ ছিলেন। তিনি চাপদাড়ি রাখতেন। এটি তাঁর ব্যক্তিত্বের পক্ষে আকর্ষণীয় ছিল না। সেই সঙ্গে তাঁর আচরণ অনেক কঠিন ছিল। তিনি নিয়মানুবর্তী মানুষ ছিলেন। হিসাব—কিতাবে খুব দক্ষ ছিলেন। রাজস্বের পুরো হিসেবের উপর তিনি দৃষ্টি রাখতেন। কর্মচারীদের বেতনও তিনি প্রদান করতেন। তাঁর জন্য যা উপহার আসত তা তিনি সবার সামনে সাজিয়ে রাখতেন। তিনি সম্পূর্ণরূপে নিয়মানুবর্তী ছিলেন। কৃষক ও সৈনিকদের মধ্যে তিনি কখনো পার্থক্য করতেন না। নিজের কর্তব্যের প্রতি যেখানে তিনি পূর্ণ নিষ্ঠাবান ছিলেন সেখানে তাঁর চরিত্রেও অনেক দোষ ছিল, তিনি বাজ পাখি পালন করে তা দ্বারা শিকার করাতেন। তিনি জবরদস্ত শরাবি ছিলেন, ছেলেদের নিজের কাছে রাখতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি শায়রী খুব পছন্দ করতেন, তবে তাঁর শায়রী হতো উত্থান—পতন বিহীন এবং নীরস। তাঁর শায়রী এমনটাই মনে হতো যেন কেউ লিখিত কাব্য পাঠ করছেন। খাজা উবাইদুল্লাহর প্রতি তাঁর খুব শ্রদ্ধা ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্ব যতটা এবড়ো—খেবড়ো ছিল, দরাবরেও ঠিক তেমন মন্দ ভাষাই ব্যবহার করতেন। তাঁর ব্যবহার দ্বারা তিনি কাউকে খুশি করতে পারতেন না। 

যুদ্ধবিগ্রহ 

মাহমুদ মির্জা, হুসাইন মির্জার সঙ্গে দুটি যুদ্ধ করেন। প্রথম যুদ্ধ করেন অস্ত ারাবাদে, দ্বিতীয়টি চিকমন—এ। দুটি যুদ্ধেই তিনি পরাজিত হন। তারপরে তিনি বদাখশানের দক্ষিণে গিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করেন এবং মুহম্মদ গাজী নাম ধারণ করেন। 

মুহম্মদ মির্জার প্রাপ্ত রাজ্য 

তাঁর রাজত্বের জন্য আবু সঈদ মির্জা কর্তৃক তাঁকে অস্তারাবাদ রাজ্যটি দেওয়া হয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর অংশে খোরাসানও আসে। 

পিতার মৃত্যুর পর আমার সংরক্ষক ও বিশ্বস্তদের যে সাহায্য—সহযোগিতা আমি লাভ করি তাকে আমার উপর আল্লাহর রহমত বলেই আমি বিশ্বাস করি। 

আমার দ্বারা আমার পিতার শাহী—তকে সামলে নেওয়ার পর, কেল্লার আশপাশকে মজবুত করে পরিবেষ্টিত করে নেওয়া হয়। প্রাচীর উঁচু করে তোলা হয়। আমার চাচা আহমদ মির্জার পক্ষ থেকে আমার কাছ থেকে ফারগানা রাজ্য কেড়ে নেওয়ার এবং আমাকে বিতাড়িত করার ভয় আমার উপর সর্বদাই বিরাজ করতে থাকে। এরকম ভয় আমার সংরক্ষক ও বিশ্বস্তদেরও ছিল। ঐ সময়কালকে একটি সন্ধিক্ষণের কাল বলে অভিহিত করা যেতে পারে। 

ফারগানার বাইরের এলাকার মৌসম (বর্ষা) ও জানোয়ারদের মড়ক আমার নিরাপত্তা প্রস্তুতির পূর্ণ অবসর দিয়ে দিয়েছিল। 

আধিকারিক রূপে বাবুরের রাজ্য প্রাপ্তি 

কিছুকাল পরে মাহমুদ খানের শাহরুখিয়া আসার ফলে আমি সান্ত্বনা লাভ করি। (মাহমুদ খান খানেদের মধ্যে সবচেয়ে ‘বড় খান’ বা তাদের নেতা ছিলেন। তাঁর ইশারায় ছোট ছোট রাজ্যের মালিকদের তাজ ও তখত্ উল্টে যেত।) আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে পরামর্শ দিলেন, তাঁর সামনে আমাকে হাজিরা দেওয়া উচিত। 

[টীকা : যেহেতু, ‘তুজুক—ই—বারবী’ বা ‘বাবরনামা’ বাবুর কর্তৃক লিখিত ‘আত্মকথা’ সেহেতু তা লেখার সময়ে বাবুর কোথাও—কোথাও কয়েক বছর আগের ঘটনার উল্লেখ করে দিয়েছেন তো কোথাও—কোথাও নিজের বংশধর, পরিবার, শায়বানি তথা আশপাশের রাজ্যের মালিকদের তাদের আচার—ব্যবহার, স্বভাব—প্রকৃতি ও চারিত্র্য বিবরণও দিয়েছেন। এরপর, তিনি পুনরায় তাঁর পিতার মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পরবর্তী বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন—অনুবাদক।] 

আমি ওই স্থানে পৌঁছে গেলাম যেখানে তিনি অবস্থান করছিলেন। তিনি শাহরুখিয়ার বাইরের অংশে অবস্থিত হায়দর বাগে অবস্থান করছিলেন। বাগে একটি বিশাল তাঁবু খাটানো হয়েছিল। তিনি যে তাঁবুতে ছিলেন, সেটি চারটি দ্বার বিশিষ্ট তাঁবু ছিল। তাঁবুর মধ্যে তিনি সিংহাসনে আসীন ছিলেন। 

আমি তাঁর সামনে হাজির হলাম, হাঁটু গেড়ে তাঁর সামনে ঝুঁকে পড়ে আমি তাঁকে তিনবার সালাম করলাম। তাঁর প্রতি সম্মান ব্যক্ত করার এটাই রীতি ছিল। তিনি আমার প্রতি এক নজর দেখলেন। আমাকে তাঁর কাছে ডাকলেন, স্নেহভরে তিনি আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। পিতার অকাল মৃত্যুতে আফসোস প্রকাশ করলেন। 

এই সাক্ষাতের দু—তিন দিন বাদেই আমার সুফল মিলল। অকশা ও আন্দিজানের সেই ক্ষেত্র, যা আগে আমার পিতার অধীনে ছিল, খান (মাহমুদ খান)—র দ্বারা আমাকে প্রদান করা হলো। 

এই সুসংবাদটি শোনার পর আমি আমার পিতার মকবরায় গেলাম। সেদিন ছিল শুক্রবার। আমি আল্লাহর ইবাদতে এক ঘণ্টা সময় কাটালাম, তারপর বন্দেসালারের পথ ধরে আন্দিজানের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আমি সেখানে সন্ধ্যার মুখোমুখি সময়ে পৌঁছে গেলাম। 

বাবুরের বিচক্ষণতা প্রদর্শনের প্রারম্ভিক দিনগুলো 

আন্দিজানের জিকরাকে জংলি উপজাতিদের বসবাস। কাশগড় ও ফারগানার পার্বত্য এলাকায় ছ’হাজার বস্তিতে এরা বসবাস করে। এরা ঘোড়া, ভেড়া ও ইয়াক পালন করে। এই পার্বত্য উপজাতির লোকেরা ইয়াককেও অন্যান্য গৃহপালিত পশুর মতো পালন করে। এরা এতই উদ্ধত যে, বাইরের দুনিয়ার কোনো মানুষকেই এরা সম্মান প্রদর্শনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না। ওই এলাকাটি খানের দ্বারা আমাকে উপহার স্বরূপ দেওয়া হয়েছে, ঐ ক্ষেত্রটি যখন আমার অধিকারে, তখন এই কথাটা বলার জন্য সৈয়দ কাসিম বেগের নেতৃত্বে আমি সেনা পাঠালাম। তাদের বলা হলো যে, এবার থেকে তাদের রাজস্ব আদায় করতে হবে। তাদের কাছ থেকে রাজস্ব বাবদ আমার সৈনিকেরা দু’হাজার ভেড়া ও পনেরোশো ঘোড়া নিয়ে এল। ভেড়া ও ঘোড়াগুলোকে আমি আমার সৈনিক, সংরক্ষক ও বিশ্বস্তদের মধ্যে বণ্টন করে দিলাম। 

এরপর জিকরাল থেকে ফিরে এসে সৈনিকেরা ঔরাটিয়ার দিকে অগ্রসর হলো। ওই এলাকাটি আমার পিতার আমলে কিছুদিন তাদের অধিকারে ছিল। পরে তাঁর জীবনাবসানের পর কিছুদিনের জন্য ঔরাটিয়া সৈয়দ আলী মির্জার অধিকারে চলে গিয়েছিল। তার উপর তখনও পর্যন্ত সৈয়দ আলী মির্জার বড় ভাই বাইসংঘার মির্জার অধিকার ছিল। আলী মির্জা সসৈন্যে আমার ওই দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা শুনে তিনি মচাহিলের দিকে চলে গেলেন। তিনি তাঁর অবর্তমানে শেখ জয়নুলকে সেখানকার হাকিম নিযুক্ত করে দেন। আমি খুজন্দ ও ঔরাটিয়া সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে ছিলাম, তখন শেখ জয়নুল তাঁর দূতকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। 

দূত রূপে আমার কাছে আগত ব্যক্তি, আমার সঙ্গে মূর্খতাপূর্ণ কথাবার্তা বলার ফলে কোনো সমাধান বের করতে পারলেন না। পরিণামে, তাঁকে খালি হাতে ফিরে যেতে হলো। শেখ জয়নুল অসন্তুষ্ট হয়ে ঐ দূতকে কল্ করার হুকুম দিলেন। কিন্তু তাঁর হুকুম পালন হতে পারল না। এর কারণ ছিল, হুকুম পালনকারী ব্যক্তি শেখ জয়নুলকে হুকুম দেওয়ার যোগ্য ব্যক্তি বলে মনে করতেন না। ঐ দূত ওখান থেকে পালিয়ে দু-তিন দিন পরে আমার কাছে এসে উপস্থিত হয়। 

ঔরাটিয়া পর্যন্ত পৌঁছানো সড়কটি ছিল অত্যন্ত কষ্টদায়ক। তা সত্ত্বেও আমি সেখানে পৌঁছে, ওই এলাকাকে নিজ অধিকারভুক্ত করতে সমর্থ হলাম। শরৎ ঋতুর আগমন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওখানকার কৃষকরা ক্ষেতে মক্কা ও চারা বোনার কাজে নেমে পড়েছিল। কয়েক দিনের সফরের পর আমরা সেখান থেকে ফিরে এসে আন্দিজানে পৌঁছে গেলাম। সৈয়দ মির্জা দ্বারা ঔরাটিয়ার অধিকার ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই এলাকা, আমার ফারগানা থেকে পলায়নের পর, যেমনটি আমি শুনেছিলাম ‘খান’* ঔরাটিয়া মুহম্মদ হুসাইন নামক ব্যক্তিকে প্ৰদান করেছিলেন। ১৫০৫ ঈসায়ী পর্যন্ত তা তাঁর অধিকারে থাকে। 

[* খান অর্থ খানেদের দলপতি, বড় খান, মাহমুদ মির্জা। তাঁর সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি একটি বড় বাদশাহীর মালিক ছিলেন।—অনুবাদক ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *