দ্বিতীয় অধ্যায় – বাবুরের সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মত

দ্বিতীয় অধ্যায় – বাবুরের সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মত 

ইউরোপীয় ঐতিহাসিক স্টিফেন ফ্রেডরিক ডেলকে-র মতে, ‘বাবুর পারসিক নাম, যার অর্থ বাবুর। বাবুরের ইংরেজি প্রতিশব্দ Leopard, বাংলায় যাকে বাঘ বলা হয়। মহাকবি ফেরদৌসির অমর কাব্য ‘শাহনামা’য়ও এই শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শব্দটি মধ্য এশিয়ার তুর্কি ভাষায় এসেছে। সংস্কৃত ভাষায় এই শব্দের অর্থ হলো ব্যাধ।’ 

বাবুরের চাচাতো ভাই মির্জা মুহম্মদ হায়দার বাবুরের ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করতে গিয়ে লিখেছেন—‘চেঙ্গিস খাঁ-র পর চুগতাই বংশের লোকেরা শুষ্ক স্বভাব ও অসভ্য ছিলেন। তাঁদের জন্য বাজারি শব্দের প্রয়োগ করা হতো। এই বংশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তি জহির-উদ্-দিন মুহম্মদের জন্য লোকে ‘বুজুর্গ’ বলে সম্বোধন করত।’ 

ঐতিহাসিক ভি. এ. স্মিথ (V. A. Smith)—এর মতে, ‘নিজের যুগে এশিয়ার শাহজাদা বাবুর বিচক্ষণ ব্যক্তিদের অন্যতম বলে গণ্য হতেন। তিনি একজন সুযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর যুগের শাসকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান লাভে সমর্থ হয়েছিলেন।’ 

ভারতীয় ঐতিহাসিক শ্রীনেত্র পাণ্ডে বাবুর প্রসঙ্গে লিখেছেন—‘বাবুর তুর্কি শব্দ, যার অর্থ হলো বাঘ।’ নিজের বীরত্ব ও নির্ভীকতার কারণেই তিনি এই নামে অভিহিত হতেন। তাঁর জন্মজাত নাম ছিল জহির-উদ-দিন মুহম্মদ। তাঁর পিতা উমর শেখ মির্জা, আমির তাইমুরের বংশধর ছিলেন, ফারগানার এক ক্ষুদ্র রাজ্যের শাসক ছিলেন, যেটি তিনি তাঁর পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন। বাবুরের মাতা কুতলুক নিগার খানম মঙ্গোল দলপতি ইউনুস খাঁ-র কন্যা ছিলেন, যিনি চেঙ্গিস খা-র বংশধর ছিলেন। এইভাবে বাবুরের ধমনিতে তুর্কি ও মঙ্গোল—উভয়েরই রক্তধারা প্রবাহিত ছিল এবং উভয় বীর জাতিরই গুণ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তাঁর মধ্যে তুর্কিদের ধৈর্য, বীর্যবত্তা ও দৃঢ়তার সাথে সাথে মঙ্গোলদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও নিষ্ঠুরতাও বিদ্যমান ছিল। বাবুর বড়ই সভ্য ও সুসংস্কৃত ব্যক্তি ছিলেন। 

বাবুরের বয়স পুরো বারো বছর হতে-না-হতেই তাঁর পিতা মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং ফারগানার ক্ষুদ্র একটা রাজ্যের শাসনভার তাঁর উপরে এসে পড়ে। যদিও বাবুরের বয়স খুব কম ছিল তা সত্যেও তাঁর পিতার রাজ্যভার বহন করার ক্ষমতা তাঁর মধ্যে পুরো মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। বাবুর বাল্যকাল থেকেই বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। অতএব, পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ক্ষুদ্র রাজ্য নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। ফলে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের দ্বারা বিজিত মধ্য এশিয়ায় বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিভূ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। সমরখন্দ, আমির তাইমুরের রাজধানী ছিল। অতএব, বাবুরের দৃষ্টি সমরখন্দের উপরে গিয়ে পড়ল এবং তিনি তাকে জেতার সংকল্প করলেন। যদিও বাবুর সমরখন্দের উপর দু’বার প্রভুত্ব স্থাপনে সফল হয়েছিলেন কিন্তু তা সত্ত্বেও, পরে তাঁকে সমরখন্দ ও ফারগানা দুই রাজ্য থেকেই তাকে বঞ্চিত হতে হয়। 

বাধ্য হয়ে তিনি আফগানিস্তানে চলে গেলেন এবং সেখানে আফগানদের পরাজিত করে তিনি কাবুল ও কান্দাহারে তাঁর প্রভুত্ব স্থাপন করলেন এবং সেখান থেকে ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করতে লাগলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *