শেষ মৃত পাখি – ৯

পাইনের দল প্রহরীর মতো শ্যাওলামাখা কবরগুলোকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। নীচের রাস্তা থেকে তিরতির করে ভেসে আসছে গাড়ির হর্ন, অথবা উচ্ছল হাসির আওয়াজ। আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে ভালোমতন। সিদ্ধার্থর ছাতার নীচে দাঁড়িয়ে কবরখানার ভেতর জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে মনে হলো, এক ঝলক অতীত ঢুকে যাচ্ছে আমার ভেতর। কুয়াশার ভেতর দিয়ে চোখ চালালে যতদূর দেখা যায়, চারপাশে শুধু সাদা মার্বেলের এক একটা স্ল্যাব। তাদের মাথায় লুটিয়ে পড়েছে আগাছা। এপিটাফের পাথর ক্ষয়ে গেছে। ঘাসের ওপর পড়ে আছে সাপের ছেড়ে যাওয়া খোলস। 

কেবল সাহেবের বইটা অরুণের কাছে। কিন্তু কবিতাগুলো অনেক ক-টাই মুখস্থ একটা মনে পড়ে গেল। ‘ইন এ সেক্রেড গ্রিন গ্রেভ, অন দি গ্রাসি হিলসাইড/স্লিপস আ ফর্ম দ্যাট ওয়াজ জেন্টল অ্যান্ড ফেয়ার,—/ এ ডিভোটেড সুইট ওয়াইফ, ইন দ্য হেডেইজ অফ লাইফ/ দি অ্যাডোরড অফ মাই সোল’স হিডেন দেয়ার’। কেবলের স্ত্রী কি এখানেই সমাধিস্থ হয়েছিলেন? হয়ে থাকলে, অমিতাভ মিত্রর সঙ্গে কী আশ্চর্য সমাপতন! কেবলের পরিবার সম্বন্ধে কিছু‍ই নথিপত্র নেই। তবুও মনে হলো, সবকটা সমাধি খুঁজে খুঁজে দেখি। হয়তো রুগ্ন, যক্ষ্মা কি 

ফুসফুসের রোগে ভুগতে ভুগতে শেষ হয়ে যাওয়া এক ফ্যাকাশে ইংরেজ তরুণীর শ্যাওলাধরা কবরের ওপর বসেই কেবল এই কবিতা লিখেছিলেন! 

আমরা নির্ধারিত জায়গাটিতে এলাম। পুরো অঞ্চলটা সংস্কার করবার পরে ঝকঝকে হয়ে আছে। ১৯৭৫ সালে বোধ করি এমনটা ছিল না। অমিতাভর লাশ পড়েছিল একটা কবরের পেছনে, যার বড়ো এপিটাফের পাথর লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখেছিল মৃতদেহটিকে। কবরটি স্কটল্যান্ডের এক যুবকের, সুদূর ডান্ডি থেকে এই দেশে যিনি এসেছিলেন। হয়তো ভাগ্যান্বেষণে। এবং ১৮৪৮ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়েসে শেষ-নিশ্বাস ত্যাগ করেন। নাম অ্যালিস্টেয়ার ফিনলে। সম্ভবত ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর লেফটেনান্ট ছিলেন, যদিও শ্যাওলা ঢাকা এপিটাফের এই জায়গাটা অস্পষ্ট। জায়গাটার কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। ফোটোগ্রাফারকে নিয়ে আবার আসতে হবে এখানে। 

সিদ্ধার্থ বেশ অন্যমনস্ক। লালবাহাদুরের বাড়ি থেকে আসবার রাস্তায় একটা ও কথা বলেনি। বললাম, ‘আপনি যা ভাবছেন, আমিও সেটাই ভাবছি।’ 

সিদ্ধার্থ ঘাড় ফেরাল, ‘কী ভাবছি, জানছেন কী করে?’ 

‘এটাই ভাবছেন যে ড্যানিয়েল যদি সেই রাত্রে জলাপাহাড় রোডে থাকেন, সেটা আনন্দ পাঠক আমাদের বলেনি কেন। 

‘ভুল। আনন্দ পাঠক কেন বলেননি তার সহজ ব্যাখ্যা আছে। ভেবেছিলেন যে আমরা জানি। আপনার মনে আছে, ওঁর একজ্যাক্ট কথাগুলো? আমার হুবহু মনে আছে। বলেছিলেন, ‘প্রশ্নটা হলো, ড্যানিয়েল এরকম দাবি কেন করলেন? যদি পুলিশেরা সত্যিই বলে থাকে, আর যদি সত্যিই ড্যানিয়েল বাড়িতে থাকেন, যেরকম তিনি দাবি করেছিলেন, তাহলে ড্যানিয়েলকে ফোন করেছিল কে? আর সেই ফোনেই বা কী এমন ছিল যে অত রাত্রে ড্যানিয়েল থানায় এসেছিলেন? মনে, যদি সত্যিই ড্যানিয়েলের দাবি ঠিক হয় যে তিনি বাড়িতে ছিলেন, তাহলে তাঁকে ফোন কে করেছিল’— এটাই আনন্দ পাঠকের প্রশ্ন ছিল। কিন্তু ড্যানিয়েল যে বাড়িতেই ছিলেন সেরকম দাবি আনন্দ পাঠক করেননি। তাঁর অবাক লাগার জায়গাটা যেখানে ছিল, এবং যেটা তাঁর ধারণা আমরা জানতাম— ড্যানিয়েলকে তো জলাপাহাড়ে দেখা গিয়েছিল। তাহলে ড্যানিয়েল এরকম দাবি করলেন কেন? আর যদি তিনি সত্যি বলে থাকেন, তাহলে থানার ঘটনা বাড়িতে বসে কীভাবে জানলেন?’ 

সিদ্ধার্থর কথায় যুক্তি আছে। ড্যানিয়েলের বাড়ি জলাপাহাড় রোডের কাছেই। সেদিন ওই জায়গাতে তাঁর থাকা এতই সাধারণ একটা ঘটনা যে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। 

‘কিন্তু তাহলে আপনি এত অন্যমনস্ক কেন? কী এত ভাবছেন?’ 

সিদ্ধার্থ নীরব। তাকিয়ে ছিল দুরে। একটা কাঠবেড়ালি শ্যাওলা মেখে উড়ে গেল এক কবর থেকে অন্য অন্ধকারের দিকে। কুয়াশা নিবিড় হলো। চোখে পড়ল, ফিনলের কবরের একপাশে অনাদৃত ফুলের তবক, পড়ে আছে মাটিতে। আশ্চর্য, এত বছর পরেও কেউ মনে রেখেছে? নাকি স্কটল্যান্ড থেকে এসেছিল কেউ, পূর্বপুরুষের সমাধি খুঁজে বার করতে? আমিও সম্ভবত একইভাবে খুঁড়তে চাইছি। অমিতাভ মিত্রর হারানো সমাধি। শুধু, তেমন লাঙল নেই। কলম বাদে। 

‘এবার যেতে হবে।’ বললাম। 

‘ভাবছি, একটা অদ্ভুত জিনিস। হয়তো বোকা বোকা।’ আচমকা বলল সিদ্ধার্থ। 

‘বলতে পারেন। হয়তো আমার বোকা বোকা লাগবে না।’ 

‘একজন মানুষ যদি ভালো ইংরেজি না বোঝে, যদি শুধুমাত্র কয়েকটা শব্দের মানে বোঝে, তাহলে তার সামনে অন্য কেউ ইংরেজিতে কথা বললে সে কীভাবে মানে উদ্ধার করবে? 

‘এ আবার কেমনধারা প্রশ্ন?’ ভুরু কোঁচকালাম আমি। 

‘হেঁয়ালি নয়। ভাবছি। আপনার কী মনে হয়, কেমনভাবে সে অর্থ বুঝবে?’ 

‘কেমনভাবে আবার? সে তার জানা শব্দগুলোর মানে বার করবে, তারপর সেগুলোকে একটার পর একটা জুড়ে দিয়ে নিজের মনের ভেতরে কোনো একটা অর্থপূর্ণ বাক্য গঠনের চেষ্টা করবে।’ 

‘ঠিক।’ সিদ্ধার্থ মাথা নাড়ল। স্থির দৃষ্টি মেলল আমার চোখে। ‘যেদিন কাকাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, লালবাহাদুর রাই ধনরাজ গম্বুর ঘরে গিয়ে ইংরেজিতে কথোপকথন শুনেছিলেন। সেই কথাটা ছিল, তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ভদ্রলোক যদি রাজি থাকেন… ইত্যাদি ইত্যাদি।’ এবার বলুন লালবাহাদুর রাই ভালো ইংরেজি জানেন না। তিনি যদি পুরোটাই ভুল অর্থ করে থাকেন?’ 

মানে? এখনও বুঝলাম না।’ 

‘লালবাহাদুর তাঁর চেনা শব্দগুলো পরপর জুড়ে যদি একটা অন্য ব্যাখ্যায় যান? ভাবুন একবার। ভদ্রলোকের ইংরেজি কী? 

‘জেন্টলম্যান।’ 

‘আর রাজি হওয়া?’ 

‘এগ্রি।’ বলেই আমি স্তম্ভিত হয়ে নিজের মুখে হাত চাপা দিলাম। এই জিনিসটা মাথায় আসেনি কেন এতক্ষণ? 

জেন্টলম্যান’স এগ্রিমেন্ট। 

দুই পার্টির মধ্যে মৌখিক চুক্তি, যেটা পালন করতে দুই পক্ষই দায়বদ্ধ থাকবে। কোনো লেখাপড়ার ব্যাপার নেই এর মধ্যে। কিন্তু এমন এক দৃঢ় শর্ত আছে, যার ফলে উভয় পক্ষই সারা জীবন ধরে সেই অবস্থানকে মর্যাদা দেবে। 

‘ধনরাজ আর কাকার মধ্যে কী সেই চুক্তি ছিল, মিস ভটচাজ? পুলিশ কেন এরকম একটা বোঝাপড়ায় গেল? কাকাকে কি তার জন্যই ছেড়ে দিয়েছিল? ধনরাজ কেন বললেন যে এই চুক্তির ফলে সবদিক রক্ষা হবে? পুলিশের কি কিছু হারাবার ভয় ছিল?’ 

নাছোড় টুপটুপে কুয়াশার বুক চিড়ে একটা হা-ক্লান্ত ধূসর সূর্যালোক চুঁইয়ে পড়ছিল ফিনলের এপিটাফের মাথায়। কিন্তু সেদিকে আমাদের কারোরই তাকাবার অবসর ছিল না। 

***

এই শেষ। সম্পাদকমণ্ডলীতে আর নাম ফাম রাখা যাবে না। এভাবে লেখালেখি হয়? লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে দূর থেকে সম্পর্ক রাখাই ভালো। নাহলে সংগঠক হয়ে যেতে হবে, লেখক না। 

.

পরশু সপ্তমী। তবু আমার ছুটি নেই। পাহাড়ে আগমনী হয় না, শুধু বিসর্জন। 

.

সম্পাদকীয়র পরিবর্তে 

‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ দুটি সংখ্যা বেরিয়েছিল ১৯৬৮ সালের যথাক্রমে এপ্রিল ও ডিসেম্বর মাসে। তারপর দীর্ঘ (ছাব্বিশ) বাইশ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। সম্পাদকমন্ডলীর আন্তরিকতায় ঘাটতি ছিল না, ঘাটতি ছিল না উদ্যম ও পরিশ্রমের— ইচ্ছারও। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে মাঝের গোটা এক বছর প্রকাশ করতে পারা গেল না, তার কারণ সম্ভবত লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। যতক্ষণ তা অনিয়মিত, অনিশ্চিত এবং আর্থিকভাবে দুর্বল, ততক্ষণই লিটল, যখন নুন আনবার পরেও দেখা যাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ পান্তা আছে, বছরে চারটে অথবা দুটো মোটা সংখ্যা, বিদগ্ধ লেখকের দাম এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করা যাবে, তখন চরিত্রেও বড় পত্রিকা হাউস এবং বাজারজাত হবার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে। না, কবিতা পুর্বাশা অথবা শতভিষা হয়ে ওঠার কোনো ইচ্ছা আমাদের ছিল না, পর্যাপ্ত গুরুত্ব ও শ্রদ্ধা সত্ত্বেও। তবুও, পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারণ প্রকাশে সত্যিই অনেকদিন দেরি হয়ে গেল। ধূর্জটি চন্দ কবিতা পাঠায়নি। রাখা উচিত ছিল ওকে। 

.

শংকর চক্রবর্তী। অপূর্ব লেখে। আর অনন্য রায়। অনন্যকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া দরকার। পুরো অন্য ভাষা। বয়েস কত এর? 

.

দ্বিতীয় যে কথাটা বলার, এই সংখ্যার পরিকল্পনা আমাদের ছিল একবছর আগে থেকেই, অর্থাৎ ১৯৬৯ সাল। কিন্তু সেই পরিকল্পনার অনেকটা বাতিল করে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করতে বাধ্য হয়েছি, দেরির কারণও মূলত সেটাই, কারণ ১৯৭০ সালের শুরু থেকে আমরা লক্ষ্য করছি বাংলা কবিতার একটা উল্লেখযোগ্য বাঁকবদল ঘটেছে। এই বছরেই বেরিয়েছে পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের দেবী এবং অমিতাভ গুপ্তর আলো, এবং আমরা মনে করি এই দুটি কবিতার বই আগামী গোটা দশককে চিহ্নিত করবে। ভবিষ্যতেও, আজ থেকে হয়তো তিরিশ বছর পরে, যখন সত্তরের কবিতা নিয়ে আলোচনা হবে তখন তার প্রস্থানবিন্দু হবে এই দুটি বই, যদি বাংলা কবিতা সত্যভাষী হয়। এর পাশাপাশি আমরা রাখব দেবদাস আচার্যের কালক্রম ও প্রতিধ্বনি, যা প্রত্যক্ষে রাজনৈতিক না হয়েও কাব্যভাষায় নিম্নবিত্তের স্বরকে ঢুকিয়ে এক প্রকার অন্তর্ঘাত ঘটিয়েছে। ১৯৬৯ সালে পরিকল্পনায় ছিল যে পত্রিকার প্রবন্ধগুলোর বিষয় হবে ‘কেন বাংলা কবিতা সময়ের স্বরকে আত্মস্থ করতে পারল না’। স্বাভাবিকভাবেই সেই পরিকল্পনা আমরা ত্যাগ করেছি কারণ তারপর এই বইগুলো বেরিয়ে গেছে। শুধু এরাই নয়, আমরা সাগ্রহে লক্ষ্য করছি বাংলা কবিতায় নারীস্বরের এক শক্তিশালী বয়ান উঠে আসছে যেটা ১৯৫০-এর নবনীতা দেবসেন, কবিতা সিংহ এমন-কি ষাটের দশকের দেবারতি মিত্রদের থেকেও চরিত্রে কিছুটা আলাদা। সেই স্বরের মধ্যে শুধুই স্বাধীন প্রেম বা স্বাবলম্বনের প্রশ্ন নেই, বরং আছে হিংসা, আঘাত দেবার বাসনা, আছে বিবাহ-বর্হিভূত সম্পর্ক অথবা সমপ্রেমের মতো অস্বস্তিকর বিষয়গুলোও। কৃষ্ণা বসু, রমা ঘোষ, দেরাঞ্জলী মুখোপাধ্যায়, এঁদের কারও কবিতাই একে অপরের মতো নয়। কিন্তু প্রণয় আর বিষাদচিহ্ন, ক্রোধ আর লালসা, ক্ষয়িষ্ণুতা আর তীব্র সংরাগের চিত্রল আভাসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই কবিদের প্যালেট। এঁদের ভাষা পুরুষবিশ্বে অচেনা, এমনকি সমপ্রেমের মতো অদ্ভুত ব্যাপার ব্যক্তিগতভাবে আমরা যে সবাই মানতে পারব এমনটাও নয়। কিন্তু এঁদের স্বরকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়, এবং এঁদের কবিতাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া কর্তব্য হিসেবে আমাদের মনে হয়েছে। ১৯৬৯ সালের পরিকল্পনায় এই ভাবনা ছিল না। 

.

ছিল না মানে কী! এরা ‘৬৯ সালে লেখেনি? আসলে ইচ্ছের অভাব, চেষ্টীকৃত উদাসীনতা। 

.

কিন্তু কিছু লেখা ১৯৬৯ সালেই আমরা জোগাড় করেছিলাম, সেগুলো প্রকাশ না করলে লেখকের প্রতি সুবিচার হতো না। এই লেখাগুলো কয়েকটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, লেখকরা নিজেরাও তা মানেন। সুব্রত রুদ্রর এই বছরের পাঠ অভিজ্ঞতাকে সাম্প্রতিক বলা যাবে না। সুব্রতর মতো সংবেদনশীল মানুষ তা জানেন বলে নিজেই চেয়েছিলেন লেখাটি প্রত্যাহার করে নিতে। আমরা চাইনি, কারণ সুব্রতর মতো এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কবির শ্রম, মেধা ও পাঠাভ্যাসকে ডকুমেন্ট করে রাখা দায়িত্ব হিসেবে মনে করেছিলাম। আবার বীরভূমের তরুণ কবি একরাম আলি কয়েকটি গদ্য কবিতা পাঠিয়েছিল। পরবর্তীকালে তার মনে হয়েছে সেই গদ্য ১৯৭০-এর বইদের বিচারে আকাইক, তাই তার দাবী ছিল কবিতাগুলি যেন আমরা বাতিল করি। আমাদের মনে হয়েছে যে একরামের ভাষা লৌকিকতার কাছ থেকে পাওয়া এক আশ্চর্য আলোয় জারিত। ভূমণ্ডলে সঞ্চরমান সমস্ত প্রাণের সঙ্গে নিগূঢ় যোগ ঘটিয়ে দেয় এক নিভৃত আত্মিকতার মাধ্যমে, যা এই মুহূর্তে বাংলা কবিতার তীব্র নাগরিকতার চাপে বিরল। একরামের সমস্ত কবিতা একটা শব্দও না বদলিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এই সংখ্যায়, এবং ভাষা নিয়ে তার এই কনটেম্পোরারি থাকার দাবী আমরা স্বীকার করিনি। স্বাভাবিকভাবেই। 

.

প্রকল্পনা আন্দোলনের লোকজনের নামগুলো বেশ অদ্ভুত কিন্তু। ভট্টাচার্য চন্দন— এরকম করে কেন লেখে? উত্তর বসু— এটা কি ছদ্মনাম? 

.

আবার একইসঙ্গে অরুণ বসুর ‘ক্ষুধার্তের কৈফিয়ত’ লেখাটি সমসাময়িকতার ঊর্ধ্বে এক অনন্য থিওরিবয়ন, যে কোনো কালেই এমন লেখার প্রাসঙ্গিকতা পুরোমাত্রায় থাকবে। অরুণ বসুর কাছে আমাদের অভিযোগ ছিল, আমার দশক-এর মতো অত উচ্চমানের পত্রিকাটি তিনি বন্ধ করে দিলেন কেন। অজ্ঞাতবাস বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই সে অভিযোগ আমরা প্রত্যাহার করে নিয়েছি, এবং লিটল ম্যাগাজিনের জগতে অজ্ঞাতবাস যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করতে চলেছে, সে ভবিষ্যদ্বাণী করছি। না, অরুণ বসুর হাঙরি সংলগ্নতায় আমাদের সংহতি নেই, বরং এ জাতীয় দলবদ্ধ আন্দোলনকে কিছুটা সংশয়ের চোখেই দেখে এসেছি। ঠিক যেমন আগের বছরেই কবিসেনাও স্বতোৎসার পত্রিকাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া প্রকল্প সর্বাঙ্গীন কবিতা আন্দোলনকেও আমরা সংশয়াচ্ছন্ন দৃষ্টিতেই দেখছি। কিন্তু নিজের অবস্থানের সমর্থনে অরুণ যে তত্ত্বায়ন করেছেন দীর্ঘ এগারো পাতা জুড়ে, তাকে আগামীদিনেও রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের মনে হয়েছে অরুণকে পাঠকের কাছে নিয়ে আসা দরকার। 

.

অরুণ অনেক বই কিনে দিল পুজোতে। ফকনারের দুটো উপন্যাস, আফ্রিকান রাইটিং টুডে, অ্যান্টি পোয়েট্রি সংকলন- ফকনারের ভাষা লক্ষ্য করছি আর সমাজচেতনা। 

.

উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত, তাই উত্তরের কবিরা কিছুটা বেশি জায়গা পাবেন, স্বাভাবিক। ষাটের দশকের কবি সমীর চট্টোপাধ্যায় রণজিৎ দেবদের কবিতা আমরা নিয়েছি। সমান আগ্রহে নিয়েছি সমসমায়িক অনুভব সরকার, সন্তোষ সিংহদের কবিতাও। অরুণেশ ঘোষকে আমরা দশকের মধ্যে বাঁধতে চাই না, এবং মনে করি বর্তমান দশকেও অরুণেশ এক প্রধানতম স্বর হিসেবেই থেকে যাবেন। আমরা অমর চক্রবর্তী, কমল সাহা, সঞ্জয় দেবনাথের কবিতাকেও গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু শুধুই স্থানিক বেড়াজালে বন্দী থাকা তো উদ্দেশ্য ছিল না। বরং বীরভূমের একরাম, শান্তিপুরের অরুণ বসু, পুরুলিয়ার মুকুল চট্টোপাধ্যায়, অশোক দত্ত, রাণাঘাটের অনুপ মুখোপাধ্যায়, চব্বিশ পরগণার বাপী সমাদ্দারকে আমরা চেয়েছি পাঠকের বৃত্তে পৌঁছে দিতে। বরং এই অভিযোগ উঠতে পারে যে কলকাতার কবিদের বিষয়ে অশ্বমেধের ঘোড়া হয়তো কিঞ্চিৎ উদাসীন। সেটা অমূলক নয়, কিন্তু এই সময়কালের কবিতাচিহ্নকে যদি কোনো একটামাত্র দিকনির্দেশিকা দিয়ে নির্দেশ করতেই হয়, সেটা হল মফস্বল ও গ্রামের উত্থান। তাই ওটুকু পক্ষপাতিত্ব সচেতন সিদ্ধান্তই ছিল। 

এই সংখ্যা বার করতে খরচ পড়ল চারশো পঁচাত্তর টাকা। হিসেব করে দেখতে গেলে, বহু নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের চার মাসের খরচ এ টাকায় উঠে আসে। ভবিষ্যতে আবার যখন পত্রিকা বার করতে হবে, একইরকম ভাবে আর্থিক টানাটানির চাপ থাকবে। কিন্তু তার পরেও ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ বেরবে, ঠিক যেমন বেরবে আরও কয়েক হাজার লিটল ম্যাগাজিন, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অনিশ্চিত পদক্ষেপে। এটাই কনভেনশন। অথবা, তৃতীয় বিশ্বের একটি অবহেলিত ভাষার অবাণিজ্যিক নিরীক্ষামূলক সাহিত্যচর্চার ভবিতব্য। হতাশাও আসবে, মনে হবে যে এবার থেমে যাওয়াই ভালো, এবং তারপরেও পত্রিকা অনিয়মিতভাবে বেরবে। 

.

এতটা নাটকীয় হবার দরকার আছে? তারপর দেখা গেল, আর বেরলই না, এত বুক বাজিয়ে বলার পর। কিন্তু কী আসে যায়। কবিতা আমরা লিখবই। লিখেই যাব। যতদিন এ পৃথিবীতে একটাও লিটল ম্যাগ বেঁচে থাকবে, আমাদের লেখা কেউ আটকাতে পারবে না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *