শেষ মৃত পাখি – ১৩

১৩

শ্মশানবন্ধুরা জানে কতটা সময় নেবে তোমার শরীরটুকু পুড়ে ছাই হতে।
চিরবিদায়ের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে 
চরাচর জুড়ে তার লেলিহান আক্রমণে কত দ্রুত পুড়ে যায় 
তোমার শরীরজোড়া গৃহস্থালি, গান, মাটি, পূর্ণ ভালোবাসা 

—রণজিৎ দাশ 

.

অমিতাভর উপন্যাস 

লতিকা হাতের কাজ সেরে আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে খাটের ধারে এসে বসল। ‘গরমে আর পারা যাচ্ছে না মা গো!’ 

প্রণবেশ উপুড় হয়ে শুয়ে বুকে বালিশ রেখে সিগারেট টানছে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে। লতিকা তার ঠোঁট থেকে সিগারেট টেনে অ্যাশট্রেতে ফেলে দিল, ‘সারা ঘর চিমনি করে রেখেছো। আর একটাও খাবে না আজ। এখন তুমি গল্পটা বলবে আমাকে। একদম শুরুর দিন থেকে, যেদিন চিঠি পেলে।’ 

প্রণবেশ ঘাড় ঘুরিয়ে বউকে দেখল কয়েক মুহূর্ত। আবার ঠিক দেখছেও না, যেন দুরের কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে আছে। ‘আচ্ছা, একটা লোকের যদি সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে রাত এগারোটা চল্লিশ পর্যন্ত অ্যালিবাই থাকে, মানে তাকে এই সময়কালের মধ্যে কেউ না কেউ দেখেছে, তাহলে সে কি সম্পূর্ণ অন্য একটা জায়গাতে গিয়ে খুন করতে পারে?’ প্রণবেশের মনে হচ্ছে, এ ধাঁধার সমাধান শুদ্ধ বা সে করতে পারবে না। তাদের দৌড় শেষ। 

‘না। পারে না। কিন্তু তুমি আমাকে গল্পটা না বলে এরকম উদ্ভট প্রশ্ন করতে পারবে না আর!’ 

প্রণবেশ প্রথম থেকে পুরোটা বলে গেল। লতিকা হাঁটুতে মুখ গুঁজে নীরবে শুনলো। একটা প্রশ্নও করল না প্রণবেশের কথার মধ্যে। প্রণবেশের কথা থামলে তারপর বলল, ‘বিমল সমাদ্দার কি মাধববাবু বা আনিসুর, কাউকে আগে থেকে চিনতেন?’ 

‘এ আবার কেমনধারা প্রশ্ন?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল প্রণবেশ। 

‘আহ্, বলোই না বাপু!’ 

‘না তো। সেরকম কিছু হলে উল্লেখ করতেন। কিন্তু কেন এই প্রশ্ন করছ?’ 

‘তাহলে ওভাবে বলছিলেন কেন?’ 

‘কীভাবে?’ 

‘মাধব করেছে’, আনিসুর বলেছে’ এরকম? এমনকি মাধববাবু বলেও সম্বোধন করছিলেন না। এদিকে তোমরা যখন এই দুজনের সম্বন্ধে আলোচনা করছিলে বলছিলে ‘মাধববাবু বলেছেন’, ‘আনিসুর করেছেন’ এরকম। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ তোমরা ওদের চেনো না। কিন্তু বিমলবাবু ওভাবে কথা বলছিলেন কেন? আগে থেকেই কি দুজনকে চিনতেন?’ 

প্রণবেশ বজ্রাহতের মতো বসে থাকল কিছুক্ষণ। ‘হ্যাঁ, বিমলবাবু ঠিক এভাবেই কথা বলছিলেন।’ ধীরে ধীরে, যেন নিজের মনে বলছে। 

‘তোমাদের সামনেই তো বলেছিলেন। কেন, সে কথা মনে হয়নি শুদ্ধদার বা তোমার?’ 

‘শুদ্ধ কী ভেবেছে জানি না। কিন্তু আমার মাথাতেই আসেনি।’ 

লতিকা মুখ টিপে হাসল, ‘জানি তো! তোমার বুদ্ধি বরাবরই কম।’ 

‘সে জানি।’ প্রণবেশ ব্যাজারমুখে বলল। কিন্তু শুদ্ধর এত বুদ্ধি নিয়েও এটা মাথায় আসেনি কেন, ভাবছি।’ 

‘আমার কি মনে হয় জানো, বিমলবাবু আনিসুর বা মাধববাবুকে চিনতেন আগে থেকেই।’ 

‘কী থেকে মনে হল তোমার?’ 

‘মনে করে দেখো, মাধববাবু মিলিটারিতে টেন্ডার পাবার কাজে ঘোরাঘুরি করছিলেন। বিমলবাবুও একসময়ে মিলিটারিতে ছিলেন। দুজনের সেই সময়ে যোগাযোগ হওয়া কি অস্বাভাবিক? আর মাধববাবুর সূত্রেই হয়তো আনিসুরের সঙ্গেও বিমলবাবুর যোগাযোগ হয়েছিল? শুদ্ধদা বিমলবাবুকে মিলিটারির ব্যাপারে প্রশ্ন করল, আর দুইয়ে দুইয়ে চার করল না, এটা হতেই পারে না।’ 

প্রণবেশ অস্থির ভাবে সিগারেট বার করল আর একটা। আমার মাথায় কেন আসেনি এগুলো?’ 

লতিকা সিগারেট কেড়ে নিল। ‘আগে প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও, তার আগে ধরাতে পারবে না।’ 

‘অগত্যা! বলো।’ ব্যাজার হলো প্রণবেশ। 

এই যে, অমিতাদেবী। বাংলাদেশে থাকেন। তাঁকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না শুনি?’ 

‘সেটা তো পুলিশ বলবে। তারা ঢাকার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তবেই সন্ধান পাবার কথা।’

‘পুলিশ কেন বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি এখনও, সেই প্ৰশ্ন মনে আসেনি তোমাদের?’ 

‘বাবা! তুমি তো দেখছি রীতিমতো উকিলের মতো জেরা শুরু করছো!’ 

‘থামো! পরের প্রশ্ন হলো, মাধব রক্ষিত প্রথমদিন, মানে যেদিন তোমরা আনিসুর রহমানের হোটেলে তাঁকে দেখেছিলে, সেদিন কি জুতো পরে এসেছিলেন না সাধারণ চটি?’ 

‘জুতো মনে হয়। খেয়াল করিনি। তবে সাফারি সুট পরেছিলেন যখন, পায়ে জুতোই থাকার কথা। কেন এই কথা জিজ্ঞাসা করছ?’ 

‘যদি মাধব রক্ষিত খুন করে পালাতে যাবার সময়ে পায়ে চোট পেয়ে থাকেন, আর পা তখন থেকেই ফুলে থাকে, তাহলে জুতো পরবেন না। খোলামেলা চটি পরবেন। যাকগে, দেখোনি যখন, কী আর করা যাবে! তাহলে তোমার সন্দেহও মাধব রক্ষিতের ওপর?’ 

‘গোয়েন্দা গল্পে পড়োনি, একজন গোয়েন্দা সকলকেই সন্দেহ করে?’ 

‘আমার বদলে তুমিই শুদ্ধ-র অ্যাসিসটেন্ট হয়ে যাও, বুঝলে?’ লতিকা ঠোঁট উলটে উত্তর দিল, ‘শুদ্ধদা এত বুদ্ধিমতী মেয়েকে সহ্যই করতে পারবে না। এমনিতেও ও মেয়েদের পছন্দ করে না, আমি দেখেছি। দূরে দূরে থাকে। চট করে সহজ হতে চায় না।’ 

‘ধুর, এসব তোমার মেয়েলি কল্পনা। স্কটিশে শুদ্ধর কত মহিলা অনুরাগী ছিল তুমি জানো?’ 

‘সেগুলো তো সবই একতরফা প্রেম। আর স্কটিশে আমিও পড়েছি মশাই! যদিও আমার থেকে অনেকটাই সিনিয়র ছিল, কিন্তু ওকে দেখলেও কিছুতেই প্রেমে পড়তাম না। অত কাঠখোট্টা লোকের সঙ্গে প্রেম হয় না। এমনিতেই ওর মনে হয় জন্ম থেকেই মাথার চুল কাঁচাপাকা ওরকম বুড়ো মানুষ দেখলেই আমি পালাই। তার ওপর নস্যি নেয়, ম্যা গো! 

‘আচ্ছা, তুমি আনিসুরের ঘর নিয়ে কিছু বলবে না? চেয়ার কেন সরানো ছিল? পর্দা কেন গোটানো ছিল? ঘর বন্ধই বা ছিল কী করে?’ 

‘অত শত জানি না! তবে একটা জিনিস বুঝেছি। খুনি সাইলেন্সার লাগানো বন্দুক ব্যবহার করেছিল, যাতে ঘর বাইরে থেকে বন্ধ করবার সময় পায়। সে যেভাবেই করুক না কেন। মানে, ছিটকিনিতে সুতো টেনেই করুক বা খুন করে জানালা দিয়ে পালিয়ে যাক। সাইলেন্সার ব্যবহার করবার উদ্দেশ্য ছিল নিঃশব্দে কাজ করা নয়। নিজের জন্য কিছুটা সময় বার করতে পারা। যাতে ঘরটাকে লকড রুমের চেহারা দেওয়া যায়। এবার, কেন লকড রুম বানাতে চেয়েছে, সেটা বলতে পারবো না। তোমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করো গে।’ 

‘নিঃশব্দে কাজ সারা উদ্দেশ্য ছিল না বলছ?’ 

‘তাহলে তো খুন করেই চলে যেতে পারত। ঘর ওভাবে বন্ধ করল কেন?’ 

‘হয়তো পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। খেলতে চেয়েছিল পুলিশের সঙ্গে।’ 

‘মজা করবার জন্য প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ঘর বন্ধ করবে এভাবে? তার মধ্যে তো কারেন্ট চলেও আসতে পারত। যদি কেউ আগেই আবিষ্কার করত যে মেইন সুইচ অফ আছে, আর গিয়ে অন করে দিত? অথবা যদি পাশের ঘরের বোর্ডার বেরিয়ে আসতো? নাহ্। শুধুমাত্র পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করবার জন্য এই কাজ করেনি। অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে এটার পেছনে।’ 

‘হুঁ,’ প্রণবেশ চিন্তা করল কিছুক্ষণ। উদ্দেশ্য কি এটা হতে পারে যে কিছুটা সময় চেয়েছিল পালাবার? হয়তো বাংলাদেশের লোক। যতক্ষণে বডি আবিষ্কার হবে, ততক্ষণে সে পগার পার হয়ে নিজের দেশে চলে গেছে। এরকম কিছু কি? 

‘হতেই পারে। বললাম তো, এত কিছু জানি না। তবে এটাও হতে পারে, হয়তো কিছু লুকোতে চেয়েছিল। এমন কোনো ব্লু, যেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যায়।’ 

‘সেটা আবার কীরকম? আমার তো এমন কিছু মাথাতেই আসছে না, যা সময় গেলে উবে যায়। এ কি বরফ নাকি, যে জল হবে, তারপর বাষ্প? ধুর, কীসব বলছ!’ 

আমার মাথাতে আর খেলবে না বাপু! অনেকগুলো প্রশ্ন করেছি। এবার খাবে চলো। রাত কত হলো খেয়াল আছে?’ 

প্রণবেশ একটা হাত বেড় দিয়ে লতিকার ঘাড়ের কাছে এনে তাকে ঝটকা মেরে নিজের বুকের ওপর ফেলেছে। ‘না, খেয়াল নেই।’ 

‘ধ্যাত, ছাড়ো তো!’ লতিকা মুখে বলছে বটে, কিন্তু ওঠবার কোনো রকম চেষ্টা করছে না। প্রণবেশের বুকে থুতনি ঠেকিয়ে ভাবছে। ‘আচ্ছা তোমার মনে হচ্ছে না, এই গোটাটাই কেমন যেন সাজানো? যেন একটা সুন্দর ছিমছাম নাটক চোখের সামনে অভিনয় হয়ে যাচ্ছে?’ 

‘একটা জলজ্যান্ত লোক খুন হয়ে গেল, আর তুমি সেটাকে সাজানো নাটক বলছ?’ 

‘কী জানি! আমার কাছে পুরোটাই অবাস্তব লাগছে। যেন কী একটা হারিয়ে গেছে। সেটা যতক্ষণ না খুঁজে পাওয়া যাবে, ব্যাপারটা একটা গল্প হয়েই থেকে যাবে। 

‘নিখোঁজ তো অনেক কিছুই। হত্যাকারী নিখোঁজ। খুনের অস্ত্র নিখোঁজ। খুনের একজ্যাক্ট সময়টুকু নিখোঁজ। আর আপাতত আমার বউয়ের আমার প্রতি প্রেমটুকুও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘পাবেও না।’লতিকা কটাক্ষ হানল। ‘তোমার বউ গোয়েন্দা গল্পের পোকা, সেটা প্রেম করবার সময়ে জানতে না বুঝি? যতক্ষণ না সমাধান সামনে আসে, সে আর অন্য কোনোদিকে মন দেবে না বলে ঠিক করেছে। 

‘সেজন্যই তো বলছি। কাল থেকেই শুদ্ধর সঙ্গে লেগে পড়ো। আমিও তাহলে চেম্বারে মন দিতে পারি।’ 

‘নাহ। অত রোদের মধ্যে ঘুরতে পারি না। আমি মাইক্রফট্ হোমসের মতো। ঘরে বসে শুধু ভেবে যাই।’ লতিকা থামলো। ভুরু হালকা কুঁচকে গেছে। ‘মাধব রক্ষিত চিঠিটা ডাকে কেন ফেললেন না বলো তো?’ 

‘বললাম তো। মাধববাবু নিজেই জানিয়েছেন। তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।’ 

‘তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে চেয়েছিলেন, এদিকে নিজে দেখা করতে এলেন না। ব্যাপারটা অদ্ভুত নয়? 

‘কলামন্দিরে গিয়েছিলেন, শুনলে না?’ আলস্যের হাই উঠছে প্রণবেশের। 

‘আচ্ছা আর একটা জিনিস ভেবে দেখেছো? খুনির কাঁধে লম্বা ব্যাগ থাকতে হবে। নাহলে বড়ো রাইফেল হাতে নিয়ে হোটেলে ঢুকছে, রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, সেটা হয় নাকি?’ 

প্রণবেশ সচকিত হয়ে উঠল। ‘তাহলে তো আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে হয়, ওইদিন বড়ো ব্যাগ কাঁধে হোটেলে থেকে কাউকে বেরোতে দেখেছে কিনা!’ 

‘তোমার কী বুদ্ধি! হোটেলে তো লোকে থাকতেই আসে কয়েকদিনের জন্য। তাদের অনেকের কাছেই বড়ো ব্যাগ, সুটকেস, ট্রাঙ্ক এসব থাকে। এই লোকটাকে আলাদা করে কারোর চোখে পড়বে কেন শুনি? আগের বছর মেজপিসিমাকে নিয়ে কাশী বৃন্দাবন গেলাম যখন, মনে নেই তোমার? তুমি একটা নীল রঙের লম্বাটে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘুরছিলে!’ 

‘ওহ!’ হতাশ গলায় উত্তর দিল প্রণবেশ। ‘এই কারণেই আমার আর গোয়েন্দা হওয়া হলো না। বাড়িতে এত বুদ্ধিমতী বউ থাকলে আমি একদিন হীনমন্যতাতেই মরে যাব।’ 

‘ইয়ার্কি মেরো না। আরও একটা ব্যাপার। দেখো, অপরাধী সে-ই হতে পারে, ওখানে মাটিতে যার পায়ের ছাপ থাকবে। মানে আনিসুরের ঘরে। এবার আনিসুরের ঘরে কার কার পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে?’ ‘আনিসুরের নিজের, মাধবের, আর হোটেলে কাজ করে একটা ছেলে, যে সন্ধেবেলা জল দিতে গিয়েছিল, তার। আর যারা ঘর ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল। মানে সত্যি বলতে কী, বহু লোকের। 

‘আর-একটা পায়ের ছাপ ভুলে যাচ্ছো। পুলিশের। 

‘পুলিশ?’ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল প্রণবেশ। 

‘কেন নয়? ঘরে তো পুলিশও ঢুকেছিল।’ 

‘সে তো পরে।’ 

‘সে তো ঘর ভেঙে যারা ঢুকেছিল তারাও পরে ঢুকেছিল। তাদের মধ্যেও খুনি লুকিয়ে থাকতে পারে। হয়তো সেই কারণেই ঢুকেছিল, যাতে মেঝেতে তার পায়ের ছাপ পড়ে। খুনের সময়ে যখন ঢুকেছিল, তখন পায়ের ছাপ ছিল। পরে আবার যখন ঢুকবে, তখন আবার পায়ের ছাপ পড়বে। ফলে আগের ছাপগুলোকেও এখনকার ছাপ বলেই মনে হবে। পুলিশের ক্ষেত্রেও তো একই কথা খাটে।’ 

‘দাঁড়াও, গুলিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ কেন আনিসুরকে খুন করতে যাবে?’ ‘কেন যাবে, কী করে বলব? শুধু মনে হলো, যাদের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে, খুনি তাদের মধ্যেই আছে। আগের ছাপকে ঢাকা দিতে আবার ঘরে ঢুকেছে। এই সম্ভাবনা কি থাকতে পারে না?’ 

‘তা পারে।’ প্রণবেশ আবার ভাবতে শুরু করল। 

লতিকা উঠে পড়ল। ‘শোনো, ভেটকি মাছের পাতুরি করেছি। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর কিন্তু গরম করে দিতে পারব না। এবার তুমি না উঠলে আমি খেয়ে নিচ্ছি। তুমি শুদ্ধদাকে ধ্যান করতে করতে রাত কাটিয়ে দিও।’ 

প্রণবেশ উঠে পড়ল। খিদে পাচ্ছে। 

‘আর হ্যাঁ। শুদ্ধদাকে একদিন আসতে বলো। অনেকদিন আসেনি। রাত্রে খেতে বলবে। ওর মুখ থেকে শুনতে চাই, কী ভাবছে। বুঝলে? বলে দেবে, লতিকা জরুরি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে, কাম শার্প লিখে!’ 

.

মাঝে দিন তিনেক ব্যস্ততার দরুণ শুদ্ধসত্ত্বের বাড়ি যাওয়া হয়নি প্রণবেশের। রুগীর চাপ সামলে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই রাত দশটা বেজে যাচ্ছিল। আজ মঙ্গলবার। চেম্বার বন্ধ থাকে। লতিকাও গেছে আহিরীটোলাতে বাপের বাড়ি। প্রণবেশ শুদ্ধর ঘরে ঢুকে দেখল, ইজিচেয়ারে টানটান হয়ে মড়ার মতো শুয়ে আছে। মুখের ওপর একটা বই পাতা খোলা অবস্থায় উপুড় করে রাখা। প্রণবেশের পায়ের শব্দেও ভাবান্তর হচ্ছে না। প্রণবেশ উলটোদিকের চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘বেঁচে আছো?’ 

‘হুঁ।’ ছোট্ট করে উত্তর দিল শুদ্ধ। 

‘তাহলে বলো, এই তিনদিনে কতটা এগোলো।’ 

‘তোমাকে ফোন করিনি মানে বুঝতেই পারছ, গন্তব্যে এখনও পৌঁছোইনি।’ বই মুখে একইভাবে শুয়ে থাকল শুদ্ধ। 

‘তোমার তলব পড়েছে। আমাদের বাড়িতে নৈশাহারের। লতিকা নিৰ্দেশ দিয়েছে, যেন অতি শীঘ্রই তোমাকে তার কাছে নিয়ে আসি। তোমার মুখ থেকে সে গল্প শুনতে চায়।’ 

মুখ থেকে বই সরিয়ে শুদ্ধসত্ত্ব উঠে বসল এবার। হাত বাড়িয়ে প্রণবেশের কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাল। যাওয়াই যায়। কাল। না কাল নয়, পরশু যাব। আমাকে তুলে নিয়ে যেও।’ 

‘লতিকা আমার মুখ থেকে বিবরণ শুনে অনেক কিছু প্রশ্ন করেছে। আমি নিজেও এতটা ভাবিনি।’ 

‘বলো শুনি। কী প্রশ্ন।’ 

প্রণবেশ বলে গেল। শুনতে শুনতে শুদ্ধর মুখে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠছিল। প্রণবেশ শেষ করবার পর শুদ্ধ সিগারেট জোরে টান মেরে অ্যাশট্রেতে ফেলে বলল, ‘লতিকা সত্যিই মাইক্রফট্ হোমস। ঘরে বসে অর্ধেক সমাধান করে ফেলেছে।’ 

‘তুমি তাহলে একমত হচ্ছো ওর সঙ্গে?’ 

‘বিমলবাবুর মাধব আর আনিসুর নিয়ে বলা কথাগুলোর ভঙ্গিতে আমারও সন্দেহ হয়েছিল। সেই কারণে আমার বাড়ি থেকে বিমলবাবু বেরিয়ে যাবার পর বলেছিলাম যে একটা খটকা লাগছে। কিন্তু দু তরফের সংযোগটা এখনও প্রমাণ করতে পারিনি।’ 

‘জিজ্ঞাসা করলেই হয়। 

‘গিয়েছিলাম থানায়। মুখ তো খুললেনই না, উলটে ঠাণ্ডা ব্যবহার করলেন। আমার ধারণা, সেদিন যে আমরা তাঁর অসাক্ষাতে ভবানীবাবুর সঙ্গে কথা বলেছি, তাতে চটে গিয়েছেন।’ 

‘আর কিছু সূত্র পেলে?’ 

‘আনিসুরের হোটেলে পরপর দু-দিন গেছি। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করেছি। একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। সেই রাত্রে হোটেলের সামনের গলিতে কাউকে এরকম দেখা যায়নি, যে ছুটতে ছুটতে বড়ো রাস্তার দিকে গেছে। ছুটতে ছুটতে তো দূরের কথা, জোরেও হাঁটেনি। অন্তত কেউই তেমন কিছু মনে করতে পারেনি। ওখানে অষ্টপ্রহর বসে থাকে এক স্থানীয় বিহারি ছাতুওয়ালা। সে রামজির দিব্যি কেটে বলেছে, কাউকে ছুটে যেতে বা দ্রুত হেঁটে যেতে দেখেনি। দেখলে নাকি তার মনে থাকত। ওই গলিতে একটা বদমেজাজি কুকুর থাকে। কেউ ছুটলে বা জোরে হাঁটলেই তার দিকে তেড়ে যায়। কুকুরটা সেদিন একবারও কাউকে ধাওয়া করেনি। যদিও কারোর বয়ানই পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। মানে, হতেই পারে যে কারোর চোখে পড়েনি। তবুও এই ক্লু-টাকে আমি নম্বর দিকে বাধ্য হচ্ছি।’ 

‘এ আবার কেমনধারা ক্লু?’ 

‘বুঝতে পারছো না? আনিসুর যে সময়তেই খুন হোক না কেন, ন-টা থেকে এগারোটা পনেরোর মধ্যে হোক অথবা এগারোটা পঁচিশ থেকে এগারোটা চল্লিশ, এই দুই সময়ের মধ্যে যে কোনো স্লটেই, যে খুন করবে তার মনের মধ্যে ধরা পড়বার ভয় থাকবে। আমরা এক্ষেত্রে ধরে নিচ্ছি যে অপরাধী সিঁড়ি দিয়ে উঠে আনিসুরের ঘরে ঢুকেছে এবং সেই জন্য মেইন সুইচ অফ করেছে, যদি এগারোটা পঁচিশের পরে খুন হয়। আর যদি আগের স্লটে খুন হয়, তাহলেও অপরাধীকে সিঁড়ি দিয়েই ওঠানামা করতে হয়েছে বলে ধরে নিচ্ছি। কারণ জানালার ফাঁক গলে অপরাধীর ছাদে উঠে যাওয়াটা ভারি কঠিন সমাধান লাগছে। সেক্ষেত্রে সবসময়েই এই ঝুঁকি থেকে যায় যে আশেপাশের লোকজন বেরিয়ে আসবে। সন্দেহ না করলেও হয়তো অপরাধীর মুখ দেখবে। অথবা এটুকু দেখবে যে আনিসুরের ঘর থেকে কেউ একজন বেরোচ্ছে, যার কাঁধে একটা ঢাউস ব্যাগ। পরে পুলিশের কাছে তারা বলে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে তুমি হলে কী করতে? খুন করে যত দ্রুত সম্ভব নীচে নেমে বেরিয়ে যেতে। বেরিয়ে যাবার পরেও মনে ভয় থাকতো যে এক্ষুণি বুঝি হইচই শুরু হলো তোমার পেছনে। তুমি সেক্ষেত্রে হয় দৌড়তে, বা দ্রুত হনহন করে হেঁটে যেতে। কেন? কারণ তুমি চাইতে যেন বড়ো রাস্তায় উঠে দ্রুত ভিড়ে মিশে যেতে পারো। এবার, এই অনুমানটা রাত ন-টার আশেপাশে খুন হলে সত্যি। কারণ তখন রাস্তায় ভিড় থাকে। কিন্তু সাড়ে এগারোটায় রাস্তাঘাট শুনশান। সেখানে ভিড়ে মিশে যাবার প্রশ্ন আসে না। সেক্ষেত্রে তুমি দৌড়বে একটাই কারণে। কী কারণ?’ 

প্রণবেশ ভাবল। তারপর উদ্ভাসিত মুখে উত্তর দিল, ‘যদি বড়ো রাস্তায় আমার মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে হনহন করে হেঁটে গাড়িতে উঠে বেরিয়ে যাব।’ 

‘একদম।’ ঝকমক করে উঠল শুদ্ধসত্ত্বর চোখ। ‘তাহলে, যদি এগারোটা পঁচিশের পরে খুন হয়, তাহলে অপরাধী দৌড়য়নি, তার একটাই কারণ হতে পারে। সে জানে তার দৌড়বার দরকার নেই। অথবা দৌড়ে লাভ নেই।’ 

‘কিন্তু তার কারণ এটাও হতে পারে যে সে ঘরটাকে এমন কারিকুরি করেছে যে ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই, সে জানে যে বডি এখন আবিষ্কার হবে না। তাই নিশ্চিন্তমনে হেঁটে গিয়েছে।’ 

‘খুন করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে কারিকুরি করে, সে সুতো দিয়ে ছিটকিনি তুলেই হোক, বা অন্য কিছু সেটা করতে গিয়ে এমনিতেই কিছুটা সময় তার নষ্ট হয়েছে। সে জানে সময় এক্ষেত্রে মূল্যবান, কারণ কিছুতেই তার মুখ দেখানো চলবে না। তো, এই যে খুনি কিছুটা লেট করল, তার পরেও সে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল? সে তো চাইবেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জায়গাটা থেকে বেরিয়ে যেতে, কারণ তার সময় চলে যাচ্ছে।’ 

‘হয়তো দৌড়য়নি, কারণ দৌড়লে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করত!’ 

‘সেটা করলেই বা কী এমন ক্ষতি হতো? লোকে দেখতো যে অন্ধকারে একজন দৌড়ে গলি দিয়ে বেরিয়ে গেল। তুচ্ছ ব্যাপার, কেউ মনেও রাখত না। বড়ি পরের দিন সকালের আগে বেরোতো না। ততক্ষণে তো অপরাধী পগার পার! ‘ 

‘এখানে একটা প্রশ্ন আছে। ধরে নিচ্ছি খুন হয়েছে এগারোটা পঁচিশের পরে। যদিও তোমার ধারণা খুন আগের স্লটে হয়েছে, তবু ধরে নাও। খুনি সেক্ষেত্রে তোমার যুক্তি অনুসারে রাস্তার লোকের দেখা নিয়ে চিন্তিত নয়। কিন্তু হোটেলের লোকের তাকে দেখতে পাওয়া নিয়ে চিন্তিত। কেন? হোটেলের লোকে যদি দেখত আনিসুরের ঘর থেকে একজন বেরোচ্ছে, বা সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে, তাতেই বা কী ক্ষতি হতো? বডি বেরোবার পর লোকে যদি পুলিশের কাছে এই নিয়ে মুখ খুলতও, খুনি তো ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে। তাহলে মেইন সুইচ অফ করে নিজেকে লুকোতে গেল কেন?’ 

‘এক্সাক্টলি!’ শুদ্ধ সহর্ষে হাত ঘষতে লাগল। ‘এটা দ্বিতীয় পয়েন্ট। রাস্তায় লোকে তাকে দূর থেকে দেখতো। যদি কোনোভাবে মুখ আড়াল করে থাকত, অতটা বুঝতে পারতো না। কিন্তু হোটেলের লোক তাকে দেখতো সামনে থেকে। তার মানে, কাছাকাছি দূরত্বে নিজের মুখ দেখানোয় খুনির সমস্যা ছিল। এগারোটা পঁচিশের পর খুন করলে ওই কারণেই মেইন সুইচ অফ করে রেখেছিল!’ 

‘তার মানে, খুনিকে হোটেলের লোক চিনত? 

‘চিনত, অথবা পরে চিনবে। যদি মাধব খুন করে থাকেন, আর তাঁকে কেউ দেখে থাকে, পরের দিন হোটেলে ঢুকলেই তো শনাক্ত হয়ে যাবেন। তাই না?’ 

‘আর রাস্তা দিয়ে দৌড়ল না, কারণ…’ 

‘খুনির কাছে মোটরগাড়ি ছিল না। জানতো, দৌড়ে লাভ নেই। তবে এটা হতে পারে তখনই, যদি এগারোটা পঁচিশের পরে খুন হয়। তার আগের স্লটে খুন হলে, না দৌড়বার অনেক কারণ থাকতে পারে।’ 

‘কিন্তু, মাধবের কাছে গাড়ি ছিল।’ 

‘তাহলে এগারোটা পঁচিশের পরে খুন হলে, খুনি মাধব নাও হতে পারেন।’ 

‘নাহ। গাড়ি না থাকার ব্যাখ্যা বিশ্বাসযোগ্য ঠেকছে না হে! না দৌড়নোর অন্য অনেক কারণও থাকতে পারে।’ প্রণবেশ মাথা নাড়ল। 

‘আরও একটা কারণ থেকে অনুমান করছি, খুনির কাছে গাড়ি ছিল না।’ 

‘কী সেটা?’ 

‘যে সময়তেই খুন হোক না কেন, খুনি আনিসুরের চেনা ছিল এটুকু বলতে পারি। না হলে আনিসুর তাকে ঘরের মধ্যে ঢোকাতেন না। বিশেষ করে অত রাত্রে। নিজের বাইরে বেরিয়ে আসতেন। চেনা পরিচিতি থাকলে খুনির পক্ষে অনেক সহজ কাজ ছিল আনিসুরকে বাইরে বার করে এনে নিজের গাড়িতে তোলা। তারপর রাত্রের কলকাতার কোনো নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে খুন করা। আনিসুরকে কেউ চিনত না, ফলে তাঁর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে ভাবিত হতো না কেউ। একটা নিয়মমাফিক পুলিশে ডায়ারি করে রাখত। আজকাল এই রাজনৈতিক অস্থিরতার বাজারে এমনিই কলকাতার রাস্তায় কত ছেলে খুন হয়ে যাচ্ছে। এক অপরিচিত বাংলাদেশীর খুন নিয়ে কেউ মাথাও ঘামাত না। কিন্তু তা না করে খুনি কঠিন রাস্তাটা বেছে নিল। জনবহুল হোটেলের ঘরে খুন করল, যেখানে তার ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। কেন? কারণ কি এটা হতে পারে যে, আনিসুরকে হোটেলের বাইরে বার করে নিয়ে দূরে কোথাও যেতে হলে একটা নিজস্ব মোটরগাড়ি লাগত? ট্যাক্সি বা ভাড়াগাড়ি নয়। এমনকি ড্রাইভার দিয়েও চালানো গাড়ি নয়। কারণ প্রত্যক্ষদর্শী না রাখতে চাওয়াই স্বাভাবিক। নিজের চালানো মোটর। সেটা কি তাহলে খুনির ছিল না?’ 

‘গাড়ি ভাড়া করে এল না কেন?’ 

‘ঠিক। সেটা করতেই পারতো। কিন্তু নিজেকে চালাতে হতো, অচেনা ড্রাইভার চালালে চলবে না। খুনি যখন সেটা করেনি, তাহলে বুঝতে হবে যে সে গাড়ি চালাতে পারতো না। হ্যাঁ, এটাই ঠিক সমাধান।’ শুদ্ধ উৎফুল্ল হয়ে নস্যির কৌটোর দিকে হাত বাড়াল। ‘খুনির কাছে গাড়ি থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা ড্রাইভার চালাচ্ছিল। এবং খুনি নিজে গাড়ি চালাতে পারে না।’ 

‘কিন্তু খুনি তো গাড়ি না থাকলেও অন্যভাবেও আনিসুরকে বাইরে বার করে আনতে পারতো। হয়তো রাত্রিবেলা কোথাও দেখা করতে বলত…’ 

‘না, পারতো না। মনে রেখো, আনিসুর ক্যান্সারের রুগি। বেশি পরিশ্রম করতে পারে না। খুনি যদি তাকে কোথাও আসতে বলত রাত্রে, আনিসুর উলটে প্রস্তাব দিতেন যে সেই দেখা করাটা তাঁর হোটেলেই হোক, যাতে তাঁর পরিশ্রম বাঁচে। আনিসুরকে একমাত্র বার করা যেতে পারতো যদি তাঁকে গাড়ি চালিয়ে, মানে তাঁর পরিশ্রম না ঘটিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো কোথাও।’ 

প্রণবেশ আর কোনো প্রশ্ন করতে না পেরে প্রসঙ্গ বদলাল। ‘আচ্ছা, তাহলে চেয়ারের সমস্যাটার কী হলো?’ 

‘এটাও ভেবেছি। আনিসুরের ঘরে আবার গিয়েছিলাম। পুলিশ এখনও সিল করে রেখেছে, কিন্তু বলে কয়ে ঘর খুলিয়েছিলাম। যেটা দেখে এলাম, তা হলো টেবিলের সামনের মেঝেতে চারটে গোল গোল দাগ। বহুদিন ওখানে চেয়ারটা একই জায়গাতে রাখা ছিল বোঝা যায়। তার মানে চেয়ারটাকে সম্প্রতি সরানো হয়েছিল। কে সরিয়েছিল সেটা বোঝা আর সম্ভব নয়। এত লোক ওই ঘরে ঢুকেছে আর এত পায়ের ছাপ যে সব গোলমাল হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ধারণা, আনিসুর নিজে সরিয়েছেন। কারণ খুনির কাঁধে যদি ঢাউস ব্যাগ থাকে, তাহলে চেয়ার সরাতে গেলে সেই ব্যাগকে মাটিতে বা অন্য কোথাও রাখতে হবে, তারপর চেয়ার সরিয়ে সেই জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসল, ব্যাগ নিজের কোলে তুলল, রাইফেল বার করল এবং গুলি চালাল। পুরো সময়টা আনিসুর কী করছিলেন? তার থেকে এটা ভাবা হয়তো অনেক সহজ যে আনিসুর যেই সময় চেয়ার সরাচ্ছিলেন, সেই সময়টায় তার পেছনে দাঁড়িয়ে খুনি সন্তর্পণে ব্যাগের চেন খুলে রাইফেল বার করছিল।’ 

‘কিন্তু আনিসুর চেয়ার সরালেন কেন?’ 

‘এটার একটা ইন্টারেস্টিং অনুমান আছে আমার কাছে,’ শুদ্ধ সশব্দে নস্যি নিয়ে রক্তাভ চোখে তাকাল। কিন্তু সেটা খাটতে পারে একমাত্র যদি এগারোটা পঁচিশের পরে খুন হয়। ওই কারণেই আগের স্লটে সত্যিই খুন হয়েছিল কিনা তাই নিয়ে আমি এই মুহূর্তে দ্বিধায়।’ 

‘ধরে নাও পরের স্লটেই হয়েছিল। তাহলে চেয়ার সরাবে কেন?’ 

‘ধরো তোমার বাড়িতে লোডশেডিং। এক অতিথি এসেছেন। ধরে নাও তুমি সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি, আর অতিথি তোমার বড়োবাবু, যাঁর ওপর এ মুহূর্তে তোমার চাকরি থাকা না থাকা নির্ভর করছে। তুমি কী করবে? তোমার প্রথম প্রতিক্রিয়াই হবে, বড়োবাবুর বসবার চেয়ারের ব্যবস্থা করা। এত বড়ো মানুষকে তো আর বিছানায় বসতে বলা যায় না। কিন্তু চেয়ারটা এখন এমন জায়গায় রাখা আছে, যেখানে অন্ধকার। তাহলে তুমি কী করবে?’ 

‘চেয়ারটাকে নিজের হাতে তুলে আলোর জায়গায় এনে রেখে বড়োবাবুকে বসতে অনুরোধ করব।’ 

ঠিক। আর তুমি নিজে অনুগ্রহপ্রার্থীর মতো হাত কচলে হেঁ হেঁ মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে তাঁর সামনে, যতক্ষণ না তিনি বসতে বলেন।’ 

‘এখানে তার মানে আলোর জায়গা…’ 

‘জানালার পাশে। ওখান দিয়েই বাইরের অলো আসছিল।’ 

‘কিন্তু তাহলে কে সেই লোক, যার সামনে আনিসুর এত বিনয়-বিগলিত হয়ে যাবেন? মাধব?’ 

‘না। মাধব তাঁর বাল্যবন্ধু। তার ওপর মাধবকে তিনি ব্ল্যাকমেইল করছেন। মাধবের সামনে তিনি এইরকম ব্যবহার করবেন না। অন্য কেউ, যিনি পদমর্যাদায় ভারী। হয়তো যাঁকে আনিসুর ভয় পেতেন। যাঁর হাতে ক্ষমতা ছিল। এমন কেউ।’ 

দুজনেই কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকল। প্রণবেশ তারপর বলল, ‘আর ঘরটাকে কষ্ট করে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল কেন? লতিকার অবশ্য বক্তব্য যে অপরাধী সময় বাড়াতে চাইছিল। হয়তো কিছু লুকোতে।’ শুদ্ধ প্রণবেশের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল একটুক্ষণ। তারপর বলল, ‘খুনের দিন বিমলবাবু বাড়ি চলে গিয়েছিলেন সন্ধেবেলা। তাঁর ডিউটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। নাইট ডিউটিতে ছিলেন সেকেন্ড অফিসার। বিমলবাবুর ডিউটি আবার শুরু হতো পরদিন বেলা এগারোটা থেকে। 

‘এর সঙ্গে আমার প্রশ্নের কী সম্পর্ক? 

‘তার মানে, যদি লকড রুম না হতো, তাহলে সেদিন রাত বা পরের দিন সকালবেলাই বডি আবিষ্কার হবার সম্ভাবনা থেকে যেত। আর সেক্ষেত্রে তদন্তকারী অফিসার হতেন বিমলবাবু নয়, সেকেন্ড অফিসার। তাই না?’ 

‘তোমার বক্তব্য কী? মানে, তুমি আর লতিকা দুজনেই একই লাইনে ভাবছ দেখছি!’ 

‘শুধু তাই নয়, একই লোককে সন্দেহ করছি।’ মৃদু হেসে উত্তর দিল শুদ্ধসত্ত্ব। 

‘মানে, পুরোটা বুঝে ফেলেছো?’ 

‘উঁহু! সেটা বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। মূলত মোটিভ, আর জোড়া চিঠির রহস্য। সেটুকু বুঝলেই কাজ শেষ। 

প্রেশার কুকারের সিটির সঙ্গে মনকাড়া মাংসের সুবাস আসছে রান্নাঘর থেকে। শুদ্ধ চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। গলায় গুনগুন গান। প্রণবেশ তার মুখোমুখি বসে আড়মোড়া ভাঙল, ‘কী ব্যাপার? আজ এত খুশি যে?’ 

‘এভারেস্টের চূড়ায় উঠবে উঠবে করছেন, এরকম সময়ে নোরগেও মনে হয় ফূর্তিতেই ছিলেন। 

‘তার মানে সমাধান পেয়ে গেছো?’ 

‘উঁহু! এখনও দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পাইনি।’ 

লতিকা রান্নাঘর থেকে উঁকি দিল। ‘শুদ্ধদা, আমার প্রশ্নগুলো তাহলে রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছে। ঠিক কিনা বলো?’ 

ঠিক, ঠিক। একদম ঠিক! তুই স্কটিশের মেয়ে। আমার কলেজের ছেলেমেয়ের বুদ্ধির দৌড় খাসাই হয়। এ কি আর মেডিকেল কলেজের ছাগলচাষের কারবার রে বাপু?’ 

‘যখন অহরহ ইনফ্লুয়েঞ্জা বাধাও কি হাঁপের টান ওঠে, তখন তো ফোনটা এই ছাগলের কাছেই আসে!’ প্রণবেশ মিচকি হাসল। 

লতিকা বেরিয়ে এসে বলল, ‘আজ তোমার জন্য পরোটা আর রেওয়াজি খাসির ঝোল হচ্ছে। শেষপাতে লবঙ্গলতিকা আর আইসক্রিম। এরপরেও যদি মুখ বন্ধ রাখো, তাহলে বাড়ি থেকে বার করে দেবো কিছু না খাইয়ে।’ 

‘তুই তো অনেকটাই সমাধান করে দিয়েছিস রে! নিজেই ভাবলে বুঝতে পারবি, সত্যিটা কী!’

‘মাধব তাহলে খুন করেননি, তাই তো?’ 

‘সম্ভবত না।’ 

‘আর জোড়া চিঠি? দ্বিতীয় চিঠি কেন এল?’ 

‘ওটাই একটা খটকার জায়গা। ওটুকু কিছুতেই বুঝতে পারছি না। তাই খচখচ করছে।’ ভুরু কুঁচকে আপনমনে বলল শুদ্ধ। 

‘বন্ধ ঘরের রহস্যটা ঠিকঠাক বুঝেছো?’ 

‘নাহ্! ওদিকে আর মন দেওয়া হয়নি। মানে, কেন ঘর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সেটা বুঝেছি। কিন্তু কীভাবে হলো, এখনও জানি না। হয়তো অপরাধীর মুখ থেকেই জানতে পারব।’ 

‘অপরাধী কে?’ প্রণবেশ অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ‘তোমাদের কথা শুনে মাথায় তো একটাই নাম আসছে।’ 

শুদ্ধ প্রণবেশের দিকে ঘুরে উত্তর দিল, ‘আচ্ছা প্রণবেশ, যে রাত্রে আনিসুর খুন হয়েছিলেন, সেই রাত্রেই বিমল দারোগা থানায় এসে বার বার হাত পা ধুচ্ছিলেন। তাঁর পরনে ছিল চটি। কেন জুতো নয়, চটি কেন, এই প্রশ্ন মনে আসেনি?’

‘না আসেনি। আমার সঙ্গে যেন ধাঁধার খেলা খেলছো বলে মনে হচ্ছে। খোলসা করে বলবে?’ 

‘বলব বলব। আগে পরোটা মাংস আসুক।’ শুদ্ধসত্ত্ব ছদ্ম গাম্ভীর্যে চোখ বন্ধ করল। 

লতিকা আবার উঠে রান্নাঘরে গেল। প্রণবেশ রেডিয়ো চালিয়ে দিল। রোজ সাড়ে সাতটায় আকাশবাণীর খবর শোনা তার অভ্যেস। 

‘আজকের বিশেষ বিশেষ খবর কী?’ শুদ্ধ চোখ না খুলেই প্রশ্ন করল। 

‘কত কী আছে! স্পেনের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী খুন হয়েছেন। গ্রিস ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হবার আবেদন জানিয়েছে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইন্দিরা গান্ধির অপসারণের পক্ষে রায় দিয়েছেন। রকফেলার কমিশন সিআইএ-র বিরুদ্ধে আনা আইন বহির্ভূত কাজকর্মের রিপোর্ট পেশ করেছে…’ 

‘ধুর ধুর রাজনীতির খবর জেনে কী করব! ইন্টারেস্টিং কিছু থাকলে বলো।’ 

‘সেসব আর কী-ই বা থাকবে! বিকেল সাড়ে পাঁচটায় খবর শুনেছিলাম। তখন এগুলোই ছিল। এখন নতুন কিছু থাকতে পারে। ও হ্যাঁ, পার্ক স্ট্রিট থেকে নাকি কোকেন চক্রের একটা গ্যাংকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তদের কাছে দেড় কেজি কোকেন পাওয়া গেছে।’ 

শুদ্ধর চোখ খুলে গেছে। সটান বসে বলল, ‘এই খবরটা এতক্ষণ পরে বললে? আরে এটাই তো আজকের সংবাদ! তুমি নিজে বুঝতেও পারছ না, এটার গুরুত্ব কতখানি।’ 

‘মানে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল প্রণবেশ। 

শুদ্ধ উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তখন লতিকা বেরিয়ে এসে বলল, ‘এত গরম পড়েছে, জানালাটা খুলে দাও না গো! হাওয়া বাতাস খেলুক ঘরে।’ 

‘উফফ, এই এক গরম হয়েছে! আষাঢ় আসতে চলল, এদিকে বৃষ্টির নামগন্ধ নেই।’ বিরক্ত স্বরে বলে উঠল প্রণবেশ। 

ভ্যাপসা গরমে সত্যিই কুলকুল করে ঘাম হচ্ছে। প্রণবেশ জানালা খুলে এসে খাটের ওপর বসেছে। তখন দেখল, শুদ্ধসত্ত্ব বিস্ফারিত চোখে বসে। তার মুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে নিখাদ বিস্ময়। প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী, কোকেন চক্র বিষয়ে কিছু মনে পড়েছে নাকি?’ 

শুদ্ধ ভূতগ্রস্তের মতো প্রণবেশের দিকে তাকালো। তারপর তাকালো লতিকার দিকে। বিড়বিড় করে বলল, ‘সব ভুল। সব।’ বলে দুড়দাড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে তিনলাফে সিঁড়ি ডিঙিয়ে রাস্তায় নেমে গেল। 

লতিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকাল হতভম্ব প্রণবেশের দিকে। ‘এটা কী হলো?’ 

প্রণবেশ বোকার মতো মাথা নাড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় সে এতই হকচকিয়ে গিয়েছে যে…… 

এখানেই অমিতাভর ছিন্নোপন্যাসের ইতি 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *