শেষ মৃত পাখি – ৭

তুমি এসময় এসো না, আরো রাত্রি হোক, শহর
ঢুকে যাক জরায়ুর ভিতর, আলো নিভে যাক
রাত্তিরে শুয়ে থাকতে থাকতে আমি উঠে বসব যখন 
তুমি 
শান্তভাবে তোমার গত জীবনের ধর্ষণের কথা বলো আমাকে। 

—নিশীথ ভড় 

.

অমিতাভর উপন্যাস 

পচা গরমের অবসানে হালকা বৃষ্টি নামলেও গুমোট কাটছেই না। চেম্বার বন্ধ করে শুদ্ধসত্ত্বর বাসায় আসতে আসতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে প্রণবেশের। নতুন কেনা অ্যাম্বাসেডর প্রথম বৃষ্টি দেখেই গাঁইগুঁই করেছে। স্টার্ট নিতে চাইছিল না। মেকানিক ডাকতে হয়েছে শেষে। 

শুদ্ধসত্ত্বর বাসায় এসে দেখে বিমল সমাদ্দার বসে আছেন। শুদ্ধ নিজের ইজিচেয়ারে টানটান হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে বাক্য নেই। শুনে যাচ্ছে বিমলবাবুর কথা। 

প্রণবেশকে দেখে বিমলবাবু একগাল হাসলেন, ‘আসুন আসুন, আপনার জন্যেই বসে আছি। নতুন গাড়ি কিনেছেন শুনলাম। চলছে কেমন?’ 

‘আর চলা! আজকেই বেগড়বাঁই করছিল। আপনি বলুন, কী সংবাদ।’ 

‘এই শুদ্ধবাবুকে মাধব আর আনিসুরের বিষয়ে বলছিলাম আর কী। ওদের পূর্ব ইতিহাস।’ 

‘মাধব রক্ষিতকে তো কথা শুনে বেশ গেরামভারী লাগল মশায়। 

‘সুবিধের লোক লাগল কি? ওর পলিটিক্যাল কানেকশন প্রচুর। অতীত জীবনও সুবিধের নয়। বহুদিন ধরে কানাঘুষো শুনছি যে ও নাকি কোকেনের ব্যবসায় জড়িয়ে আছে।’ 

‘আর আনিসুর?’ 

‘আনিসুর রহমান কুখ্যাত সমাজবিরোধী ছিল এককালে। সেটা দেশভাগের আগের ঘটনা। আমি তখন সবে সবে পুলিশে ঢুকেছি। বনগাঁতে পোস্টিং ছিল। তখন থেকেই ওর নাম শুনতে পেতাম, বুঝলেন কিনা? দুই বাংলা জুড়ে দৌরাত্ম্য চালাত। কখনও মুসলিম লিগের গুণ্ডাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, আবার কখনও বা কংগ্রেসের নীচুতলার সঙ্গে বোঝাপড়া করে চোরাচালানের ব্যবসা চালিয়েছে! নটোরিয়াস এলিমেন্ট মশাই! মাধবও ছিল ওর সঙ্গে। ইদানীং ভব্যিযুক্ত হয়েছে। তবে পুরানো পাপ কি আর চাপা থাকে?’ 

‘আপনার কি মনে হয়, মাধবই খুন করেছেন? 

‘আর কে করবে? বেআইনি ব্যবসা চালাতে গিয়ে কীভাবে একে অন্যের হাতে খুন হয়, আপনি দেখেননি?’

‘কিন্তু অ্যালিবাই?’ 

‘গ্রেট ইস্টার্ন থেকে বেরিয়ে আনিসুরের হোটেলে গিয়ে খুন করে আবার ফিরে আসতে কতক্ষণ সময় লাগে? বিশেষত যদি সঙ্গে নিজের গাড়ি থাকে?’ 

‘উঁহু, কিছু একটা মিলছে না বিমলবাবু। ধরে নিচ্ছি মাধব রক্ষিত খুন করবেন বলে আমাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাহলে আনিসুরের কাছ থেকে সাদা কাগজ ভর্তি খাম এল কেন?’ 

‘আনিসুরই যে পাঠিয়েছে তার প্রমাণ?’ 

‘আপনি খামের ওপর ঠিকানার সঙ্গে আনিসুরের হাতের লেখা মিলিয়ে দেখুন। আমার ধারণা, একই লোকের হাতের লেখা হবে।’ 

‘তা বটে! এবার বলি, যে কারণে আপনার কাছে আসা। কথায় কথায় সেটাই এতক্ষণ বলা হয়নি। আনিসুরের শক্ত ব্যারাম ছিল। লিভার ক্যান্সারে ভুগছিল। পোস্ট-মর্টেম থেকে জানা গেছে। আয়ু বড়োজোর মাস ছয়েক ছিল আর।’ 

শুদ্ধসত্ত্ব সোজা হয়ে বসল। নস্যির কৌটো বার করেছিল, থেমে গেল সেটা হাতেই। অবাক হয়ে বলল, ‘আনিসুর জানতেন?’ 

‘জানত। ওর ঘরে আমরা মেডিক্যাল রিপোর্ট আর ওষুধের ফাইল পেয়েছি। ডায়রিতে অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেখা ছিল, পিজি হাসপাতালে।’ 

দাঁতে তর্জনী দিয়ে টোকা মারতে লাগল শুদ্ধ। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এটা কী করে সম্ভব? আনিসুর যদি জানেনই যে, তাঁর অসুখের নিরাময় নেই, তাহলে তিনি মাধববাবুকে মারতে যাবেন কেন? কেনই বা মাধববাবু আনিসুরের সত্য প্রকাশ করে দিলে আনিসুরের কিছু আসবে যাবে? অন্যদিকে, মাধববাবুই বা মারতে যাবেন কেন, যদি তিনি জানেনই যে আনিসুরের শেষ লগ্ন ঘনিয়ে আসছে? তাহলে কি আনিসুরের অসুখের খবর মাধববাবু জানতেন না?’ 

‘বলা মুশকিল। মাধব শক্ত লোক। ভাঙলেও মচকাবে না।’ 

‘আচ্ছা বন্ধ ঘরের মধ্যে খুন কীভাবে হলো তা নিয়ে আপনারা মুখে এরকম কুলুপ এঁটেছেন কেন?’ অধৈর্য হয়ে এবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল প্রণবেশ। 

শুদ্ধসত্ত্ব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বিমলবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার বন্ধুটি কাল থেকেই এই প্রশ্ন করে করে কানের পোকা খেয়ে নিচ্ছে মশায়। আছে কোনো উত্তর, আপনার কাছে?’ 

বিমল ভুরু কুঁচকে ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘অনেক রকম উত্তরই থাকতে পারে। সবথেকে সহজ সমাধানটাই আগে বলি। সেটা হলো মিথ্যে কথা। জুপিটারের মালিক বলেছেন যে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, আর তাঁরা বাধ্য হয়ে দরজা ভাঙেন। মালিক যে সত্যি বলছেন তার কী প্রমাণ আছে? হয়তো হত্যাকারী টাকাপয়সা দিয়ে তাঁর মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল? যদি সত্যিই বলেন, তার পরেও দরজার ছিটকিনিকে নানাভাবে ব্যবহার করা যায়, বুঝলেন কিনা? অনেক দরজার পাল্লায় মধ্যেই অল্প ফাঁক থাকে দেখবেন। কেউ যদি ছিটকিনির সঙ্গে একটা সরু কিন্তু শক্ত সুতো বেঁধে রাখে আগে থেকে, তারপর দরজা বন্ধ করলেও সেই সুতো বাইরে থেকে টেনে ছিটকিনিকে নিজের জায়গাতে বসিয়ে দেওয়া, কঠিন হলেও সম্ভব। তারপর সুতোর যে প্রান্ত বাইরে বেরিয়ে আছে সেটুকু কেটে দিলেই হলো। অনেকেই খেয়াল করবে না ছিটকিনির গায়ে সুতো বাঁধা কেন। খিলের ব্যবস্থা থাকলেও একই পদ্ধতি। তবে সেক্ষেত্রে সুতোটার অবস্থান আলাদা হতে হবে। তৃতীয় সমাধান হলো, জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। হ্যাঁ মশায়, মানছি’, শুদ্ধর প্রতিবাদকে বিমল দারোগা হাত তুলে রোধ করলেন, ‘ওটুকু জায়গা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভব নয়। রিং-এর মধ্যে দিয়ে কীভাবে শরীরটাকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে নিয়ে যায় সার্কাসের ছুঁড়িগুলো, দেখেননি? এবার আপনি বলবেন, নীচে গেল কী করে? নীচে নামতে হলে তো লাফিয়ে পড়তে হয় চায়ের গুমটির ছাদে। কিন্তু যদি নীচে না নামে? যদি আততায়ীর কোনো সহকারী ছাদ থেকে একটা দড়ি ঝুলিয়ে দেয়, যেটা বেয়ে ছাদে উঠে যেতে পারে? সেখান থেকে টপকে পাশের বাড়ির ছাদে যাওয়া তো জলভাত মশায়! চতুর্থত, একই উপায়ে আততায়ী নীচেও নামতে পারে, মানে দড়ি বেয়ে আলতো করে চায়ের গুমটির ঢালে নামল, সেখান থেকে লাফিয়ে নীচে। পঞ্চমত, আততায়ী খুন করে বাথরুমে লুকিয়ে থাকতে পারে। যারা দরজা ভেঙে বডি আবিষ্কার করেছিল, তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া কী হবে? চিৎকার চেঁচামেচি করে লোক জানানো। ঘরের ভেতর ভিড় হবে। সেই ভিড়ের সুযোগ নিয়ে টুক করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে আততায়ী লোকজনের মধ্যে মিশে যেতে পারে। তবে এটা কষ্টকল্পিত সমাধান। ষষ্ঠত, টেবিলের অবস্থানটা খেয়াল করুন। হয়তো বন্দুক ওখানে রাখা ছিল, আর তার ট্রিগারের সুতো জানালার কাচের ফাঁক দিয়ে বার করে ছাদ অবধি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বন্দুক হয়তো বাঁধা ছিল এমনভাবে যে নড়াচড়া করবার ক্ষমতা ছিল না। অথবা টেবিলের পায়ে প্লাস্টিক কি সেলোফেন পেপার দিয়ে শক্ত করে আটকানো ছিল। আনিসুর জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়াল, আততায়ী ছাদ থেকে সুতোয় টান দিল। গুলি ছুটল। এবার আপনারা বলবেন ছাদ থেকে আততায়ী জানল কী করে আনিসুর কখন কীভাবে দাঁড়াবে? মনে রাখবেন, চারতলার মাথাতেই ছাদ। সেখান থেকে কিনারায় ঝুঁকে চেষ্টা করলে এটা দেখা অসম্ভব নয়, কারণ নীচের কাচের জানালায় কেউ এসে দাঁড়াবার ছবি প্রতিফলিত হবে। তো, গুলি ছুটল, আনিসুর মরল, পিস্তল সেখানেই থাকল। বডি আবিষ্কার হবার পর ভিড়ের সুযোগ নিয়ে পিস্তল সরিয়ে ফেলা হল। এটা ঘটে থাকলে আততায়ীকে প্রথম লোক হতে হবে যে ঘরে ঢুকেছিল। নাহলে অন্যেরা এসে পড়লে কারোর না কারোর চোখ পিস্তলের দিকে যেতে পারত। আমরা হোটেলের কর্মচারীদের সেই জন্য জিজ্ঞাসাবাদও করছি। সপ্তমত..’ 

‘থাক থাক আর বলবেন না।’ হাত তুলল প্রণবেশ। ‘এটুকুতেই মাথা ঝিমঝিম করছে মশায়। এ তো অনন্ত সম্ভাবনার সমুদ্র।’ 

‘ওই জন্যই তোমাকে বলেছিলাম, বন্ধ ঘর নিয়ে বেশি মাথা ঘামিও না।’ ব্যাজার মুখে বলল শুদ্ধসত্ত্ব। ‘হাজার হাজার ব্যাখ্যা তোমার মাথা ঘুরিয়ে দেবে। লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দেবে, বুঝলে? বন্ধ ঘরের ভেতর খুন হয়েছে তো কী? খুন হলো, সেটাই বড়ো ব্যাপার। বন্ধ না হয়ে খোলা জায়গাতে খুন হলেও একই রকম বড়ো ব্যাপার থাকত।’ 

বিমলবাবু হৃষ্টচিত্তে চুমুক দিচ্ছেন। প্রণবেশকে তাক লাগিয়ে আমোদ পেয়েছেন স্পষ্ট। 

‘বিমলবাবু, সেদিন আনিসুরের গতিবিধি সম্পর্কে কী জেনেছেন শুনি?’ 

‘দুপুর দুটো নাগাদ মাধব এসেছিল আনিসুরের কাছে। তিনটে নাগাদ বেরিয়ে যায়। তাকে ওই সময়ে হোটেলের একাধিক লোক দেখেছে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে উঠতে। মিনিট পনেরো পর আনিসুরও বেরোয়। ফিরে আসে সন্ধেবেলা। সন্ধে থেকে নিজের ঘরেই ছিল। মাঝে একবার আটটা নাগাদ রাস্তার ধারের ঝুপড়িতে রাতের খাবার খেতে বেরিয়েছিল। স্থানীয় লোকেরা দেখেছে। আবার ফিরে আসে কিছুক্ষণ পর। সাড়ে আটটার পর আর বেরোয়নি। অন্তত বাইরে তাকে আর দেখা যায়নি। হোটেলের একটি ছেলেকে জল দিয়ে যাবার জন্য হাঁক পেড়েছিল। ছেলেটি ঘরে জল রেখে আসে। তার বয়ান অনুসারে সে বেরিয়ে যাবার পর আনিসুর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়।’ 

‘তখন কি ঘরে আলো জ্বলছিল?’ 

‘আলো থাকলে দ্বিতীয় ব্যক্তি আছে কিনা সেটা ধরা পড়বে সেই কারণে জিজ্ঞাসা করছেন তো?’ মুচকি হাসলেন বিমল দারোগা। ‘আমার মাথাতেও এই সম্ভাবনার কথা এসেছিল। জিজ্ঞাসা করেছি। জ্বলছিল।’ 

‘সেই রাত্রে কোনো ঘটনা ঘটেছিল, হয়তো আজব? সৃষ্টিছাড়া ধরনের?’ 

‘রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ একবার কারেন্ট চলে গিয়েছিল। সে মাঝে মাঝেই যায়। কিন্তু আশেপাশের বাড়িতে কারেন্ট ছিল। এই ধরনের হোটেলে যা হয়, মালিক তখন নিজের বাড়ি চলে গেছে। কর্মচারীগুলোও, তিনজন ছিল, ভেগে পড়েছে এখানে ওখানে। কিছুক্ষণ পরেও কারেন্ট না আসাতে হোটেলের লজাররা হইহট্টগোল শুরু করে। হোটেলের একটা ছেলে পাশের গলিতে তাসের আড্ডায় বসেছিল। তাকে খুঁজে পেতে ধরে আনা হয়। সে মিটারবক্সে গিয়ে দেখে, মেইন সুইচ কে অফ করে দিয়ে গেছে। বারোটার মধ্যে আবার কারেন্ট চলে আসে।’ 

‘লোডশেডিঙের মধ্যে কি আনিসুর বেরিয়েছিলেন?’ 

‘কেউ খেয়াল করেনি।’ 

‘হুঁ। আর আনিসুরের মৃত্যুর সময়?’ 

‘পোস্টমর্টেম অনুসারে, রাত নয়টা থেকে পরের দিন ভোর চারটের মধ্যে যে কোনো সময়ে।’ 

‘তাহলে কি এই মেইন সুইচ অফ করে দেবার সঙ্গে আনিসুরের মৃত্যুর কোনো যোগ থাকতে পারে? অপরাধী হয়তো অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আনিসুরের ঘরে ঢোকবার জন্য মেইন সুইচ অফ করে দিয়েছিল? তারপর গিয়ে আনিসুরের ঘরে টোকা মারল। আনিসুর দরজা খুললেন। গুলি চলল। অপরাধী বেরিয়ে গেল কোনোভাবে। আবার অন্ধকারের মধ্যেই।’ 

‘হতে পারে। তবে গুলির আওয়াজ কেউ শোনেনি। শুধু পাশের ঘরের লজার এক উড়িয়া ভদ্রলোক, সন্ন্যাসীচরণ মহাপাত্র, একটা জোরে হাঁচির আওয়াজ শুনেছিলেন। তখন লোডশেডিং ছিল।’ 

হ্যাঁ। সম্ভবত সাইলেন্সার লাগানো ছিল বন্দুকে। তার মানে হত্যার সময় আমরা রাত সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে রাখতে পারি। সম্ভবত বললাম, কারণ হতেও পারে যে সেই সময়ে সত্যিই কেউ হেঁচেছিল। আচ্ছা, ওই সময়টায় মাধববাবুর অ্যালিবাই কী?’ 

‘ওদের পার্টি ভেঙেছিল এগারোটা পনেরোতে। তারপরেও এখানে- ওখানে জটলা করে গল্পগুজব করেছিলেন কেউ কেউ। মাধবও এঁদের মধ্যে ছিল। এগারোটা পঁচিশে লোকজন দেখেছিল যে মাধব গাড়িতে উঠছে, ড্রাইভারের আসনে। তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীকে পেয়েছি যারা এই সাক্ষ্য দিয়েছে। মাধব তার বরানগরের বাসাতে ফিরেছে রাত এগারোটা চল্লিশ। নিজেই ড্রাইভ করে ফিরেছে। বাড়ির দারোয়ান জানিয়েছে যে সে ঘুমোচ্ছিল, গাড়ির হর্ন প্রথমে শুনতে পায়নি। মাধব তাকে বারবার হর্ন বাজিয়ে তুলেছে। দারোয়ান তারপর ঘড়ি দেখেছে। সত্যিই তখন এগারোটা চল্লিশ।’ 

‘পনেরো মিনিট গাড়ি চালিয়ে ধর্মতলা থেকে বরানগর এসেছেন। সেটা রাত্রের ফাঁকা কলকাতায় অবশ্যই সম্ভব। নাহ বিমলবাবু, যদি সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে আনিসুর সাহেব খুন হন, তাহলে মাধববাবু খুন করতে পারেন না। কারণ এই পনেরো মিনিটে হোটেলে গিয়ে মেইন সুইচ অফ করে খুন করে তারপর আবার গাড়ি চালিয়ে অতদূরের বাড়ি ফেরা বড়ো সহজ কম্মো নয়। আর যদি সত্যিই মাধব খুনি হন, তাহলে আনিসুর খুন হয়েছেন হয় সোয়া এগারোটার আগে, আর নয়তো এগারোটা পঞ্চান্নর পর। কারণ বরানগর থেকে আবার যদি একই গতিতে মাধব গাড়ি চালিয়ে আসেন, তাহলেও পনেরো মিনিট লাগবার কথা।’ 

মুশকিল হলো, পার্টির মধ্যে সকলে বলছেন মাধব গোটা সময় পার্টিতে ছিল। সকলের চোখের সামনে ঘুরে বেরিয়েছে। আর অন্যদিকে দারোয়ান বলছে যে মাধব বাড়ি ঢুকে যাবার পর আর বেরোয়নি। গেটের চাবি তার কাছে ছিল। বেরোতে গেলে তাকে উঠে গেট খুলে দিতে হবে।’ ‘যদি না মাধব পাঁচিল টপকে বেরিয়ে যান। সেক্ষেত্রে তাঁকে হেঁটে আসতে হবে আনিসুরের হোটেল পর্যন্ত, অথবা ট্যাক্সি বা আগে থেকে ঠিক করে রাখা কোনো গাড়ি নিতে হবে।’ 

‘হেঁটে আসাটা বাড়াবাড়ি নয়?’ প্রশ্ন করল প্রণবেশ। 

‘হ্যাঁ, অনেক সময় লাগবে। তার ওপর কেউ দেখে ফেলতে পারে। কলকাতায় রাতবিরেতে ট্যাক্সি পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। তাহলে যে সম্ভাবনাটা পড়ে থাকল সেটা হল মাধব আগের থেকে ঠিক করে রাখা কোনো গাড়ি ব্যবহার করেছিল।’ বললেন বিমলবাবু। 

‘তার থেকে অনেক সহজ সমাধান হলো অন্য কেউ খুন করেছে। সেটা আপনারা খতিয়ে দেখছেন না কেন শুনি?’ 

‘মোটিভ? অন্য কে আনিসুরকে কলকাতায় চিনবে? কলকাতায় আনিসুরের আর কোনো চেনা লোকের খোঁজ আমরা পাচ্ছি না। লোকটা এমনই ফেরেব্বাজ, বুঝলেন কিনা, যে ভদ্রসমাজের কারোর সঙ্গে চেনাজানাটুকু পর্যন্ত রাখেনি। সেক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষে তাকে খুঁজে বার করা চাট্টিখানি কথা নয়। 

শুদ্ধসত্ত্ব হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। দুই হাত দিয়ে মাথায় চুল ঘাঁটতে থাকল সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে। 

উঠে পড়েছেন বিমলবাবু। ‘আমরা আমাদের দিক থেকে যা জানাবার সব জানিয়ে গেলাম। আপনি যদি কিছু ক্ল পান, আমাদের জানাবেন একটু। 

বেরোবার সময়ে প্রণবেশের অ্যাম্বাসাডরের গায়ে হাত বুলিয়ে সপ্রশংস গলায় বিমলবাবু বললেন, ‘বেড়ে জিনিস মশায়! অনেকদিনের ইচ্ছে কিনি একটা, সেকেন্ড-হ্যান্ড। কিন্তু গিন্নির বাধা। এই মাগ্যি গণ্ডার বাজারে আবার ড্রাইভার রাখার খরচ জোগানো তো চাট্টিখানি কথা নয়! আপনারা আছেন ভালো। প্রাইভেট প্র্যাকটিসে দুই হাতে কামাচ্ছেন। আমাদের তো, বুঝতেই পারছেন, হেঁ হেঁ…।’ 

ঘরে ঢোকবার সময়ে প্রণবেশের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে শুদ্ধ বলল, ‘কী, গাড়ির প্রশংসা শুনে তো বাবুর হাসি আর ধরছে না মুখে! ‘উঁহু তা নয়। আমি ভাবছি, বিমলবাবুর কথা। দিব্য মানুষ কিন্তু। অন্য পুলিশ হলে একফোঁটাও সহযোগিতা করত না। বরং প্রাইভেট ডিটেকটিভ ক্ষীর খেয়ে যাবে ভয়ে বাগড়া দিত… বেশি করে।’ 

‘হ্যাঁ, ভালোমানুষ।’ শুদ্ধসত্ত্ব আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল। নস্যির কৌটো হাতের তালুতে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘একটা খটকা লাগছে। মেলাতে পারছি না কিছুতেই।’ 

.

বরানগরে মাধব রক্ষিতের পেল্লায় বাড়ির সামনে প্রণবেশের গাড়ি এসে থেমেছে সন্ধেবেলা। প্রায় সাত ফুট উঁচু পাঁচিল। দারোয়ান এসে গেট খুলে দিল। বাড়ির ভেতরে বড়ো বাগান পেরিয়ে গাড়িবারান্দা। 

মাধব রক্ষিত নীচের ঘরে বসে পায়ে মালিশ করাচ্ছিলেন এক ভৃত্যস্থানীয়কে দিয়ে। পা-টা ফুলে আছে। মুখে যন্ত্রণার ছাপ। শুদ্ধসত্ত্ব আর প্রণবেশকে দেখে ক্লিষ্ট হাসলেন। উঠতে পারলাম না। কিছু মনে করবেন না।’ 

‘হয়েছে আপনার পায়ে?’ বড়ো একটা চেয়ারে বসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল শুদ্ধ। 

‘অতীতের কর্মফল। প্রায় তিরিশ বছর অগে পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌড়াতে গিয়ে পা মচকেছিলাম। ডান পায়ের গোড়ালির হাড়টাই ভেঙে গেল। ঠিক করে জোড়া লাগেনি আর। এমনিতে অসুবিধে হয় না, তবে বেশি চাপ দিতে পারি না। অসহ্য যন্ত্রণা হয়। হাঁটাচলায় ক্ষতি নেই। কেউ দেখে বুঝবেও না। কিন্তু মাঝে-মাঝে অমাবস্যায় হাড়ের ভাঙা জায়গাটা ফুলে ওঠে। অনেক ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়েছি, লাভ হয়নি কিছু। এখন একটা কোবরেজি তেল পেয়েছি। সেটা মালিশ করালে কিছুটা আরাম পাই। আস্তে আস্তে ঘণ্টাখানেক পর ব্যথার উপশম হয়। ভৃত্যটি উঠে দাঁড়াল। সেলাম করে বেরিয়ে গেল ঘরের বাইরে। মাধব সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নকুল কুড়ি বছর ধরে আমার অনুচর। ওকে ছাড়া এই বাড়ি অচল। গিন্নির গেঁটে বাত। নীচে নামতে পারেন না। গোটা সংসারটাকে নকুল হাতের তালুতে ধরে রেখেছে।’ 

‘আমরা এলাম কয়েকটা প্রশ্ন করতে।’ 

‘হ্যাঁ, ফোনে তো সেরকমই বললেন। আপনার অ্যাডভান্সের টাকাটারও বন্দোবস্ত রেখেছি। বলুন, কী জানতে চান।’ 

‘আনিসুর সাহেব দুরারোগ্য ব্যারামে ভুগছিলেন। লিভার ক্যান্সার। আয়ু হয়তো মেরেকেটে কয়েক মাস ছিল আর। আপনি জানতেন? 

মাধবের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। স্তম্ভিতের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলেন, ‘না। জানতাম না।’ তারপর মৃদু স্বরে বিড়বিড় করলেন, ‘জন্ম থেকে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। চলে যাবার লগ্নেও বোধ করি ছাড়তে চাইছিল না আমাকে। নিয়ে যেতে চাইছিল।’ 

‘দ্বিতীয় প্রশ্ন। আনিসুরের কি কলকাতায় আপনি বাদে আর কোনো চেনা মানুষ ছিলেন, যার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেন?’ 

ক্যান্সারের খবর শোনার পর মাধববাবু আনমনা হয়ে ভাবছেন কিছুটা। শুদ্ধসত্ত্ব আবার জিজ্ঞাসা করাতে চমকে উঠে বললেন, ‘অ্যাঁ? ওহ্, না না, আমার জানামতে কেউ চেনা লোক ছিল না। 

‘তৃতীয় প্রশ্ন। আনিসুর সাহেবের টাকা পয়সার অবস্থা কীরকম ছিল?’ 

‘ভালো ছিল বলে তো মনে হয় না। হোটেলটার চেহারা দেখলেন না? কথায় বলে না, উৎপাতের টাকা চিৎপাত যায়? নাহলে কম টাকা তো সে নেয়নি আমার কাছ থেকে। তার পরেও এরকম ভিখিরির হাল কেন হবে বলুন?’ 

‘অমিতাদেবীর খোঁজ কি আপনি আর করেছেন?’ 

‘এই কয়েকদিন? নাহ। সব ঝামেলা মিটুক আগে। বাড়ির যিনি কর্ত্রী, তাঁকে জানাবার মতো সাহসটুকু জোগাড় করি।’ বিষণ্ণ হাসলেন মাধব রক্ষিত। ‘তারপর ভাবছি একবার বাংলাদেশে যাব।’ 

‘আনিসুরের কোনো নিকটাত্মীয় কেউ বাংলাদেশে আছেন? আপনি জানেন? 

‘না, ও অনাথ ছিল, বিয়ে থা-ও করেনি বলেই জানি। এর বাইরে কার সঙ্গে ওঠাবসা ছিল, বলতে পারবো না। শেষ বহু বছর ওর সঙ্গে সম্পর্ক বলতে শুধু টাকা দেওয়া-নেওয়া। আর কোনো খাতিরদারি কোনো তরফ থেকে ছিল না। বন্ধুত্ব বহুদিন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এইবার বরং এসে বেশ কিছুক্ষণ ওর হোটেলে বসেছিলাম। কারণ ওকে বলার দরকার ছিল যে আমি আর ওর দাবীর কাছে মাথা নোয়াচ্ছি না। ঢাকার পুলিশ হয়তো দিতে পারবে আত্মীয় পরিজনের খোঁজ।’ 

‘মিস্টার রক্ষিত, আনিসুর সাহেবও আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। দুঃখের বিষয় সেটা একটা সাদা কাগজ।’ 

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন মাধব রক্ষিত। আমি কিছু বুঝতে পারছি না এর মাথামুণ্ডু।’ 

‘বুঝতে আমিও পারছি না। তবু মনে হলো, আপনাকে জানিয়ে রাখি। মাধববাবু কষ্ট করে উঠলেন। সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গিয়ে ঘরের এককোণের দেরাজের ড্রয়ার টেনে একটা খাম বার করে ফিরে এসে শুদ্ধসত্ত্বের হাতে দিলেন। ‘আপনার অ্যাডভান্স গুনে নিন।’ 

শুদ্ধ টাকা গুনে খামটা পকেটে পুরে বলল, ‘ঠিক আছে। শেষ অনুরোধ। একবার আপনার বাগানটা ঘুরে দেখতে চাই।’ 

মাধব অবাক হলেও মুখে কিছু বললেন না। উত্তর দিলেন, ‘বেশ। নকুলকে বলে দিচ্ছি, আপনাদের ঘুরিয়ে দেখাবে। কিছু মনে করবেন না, আমি পা-টাকে আরও কিছুক্ষণ বিশ্রামে রাখতে চাই।’ 

দরজার বাইরে বেরিয়ে চারপাশ খুঁটিয়ে দেখছে শুদ্ধসত্ত্ব। সন্ধে সাতটা বাজতে চলেছে। চারপাশ অন্ধকার। কোথাও একটা রেডিও বেজে উঠল আকাশবাণীর বিশেষ বিশেষ খবর। শুদ্ধ বাইরে থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘গড়িবারান্দার বাতিটা জ্বালানো যায়? কিছু দেখা যাচ্ছে না এখানে।’ ‘বাল্বটা কয়েকদিন আগে কেটে গেছে। পালটানো হয়নি। নকুলকে বলছি, টর্চ নিয়ে আসবে।’ বাড়ির ভেতর আরামকেদারায় বসে গলা চড়িয়ে উত্তর দিলেন মাধব 

টর্চের আলোতে বাগান এবং বাড়ির চারিপাশ খুঁটিয়ে দেখে, এবং দারোয়ানকে সেই রাত্রি বিষয়ে টুকটাক প্রশ্ন করবার পর বেরিয়ে এসে প্রণবেশের গাড়িতে উঠতে উঠতে শুদ্ধসত্ত্ব বলল, ‘আজ আমি তোমাকে র‍্যালিসের কুলপি খাওয়াব। সেই সঙ্গে নিউ মার্কেটে আজিজের পানের দোকানের স্পেশাল মিঠেকড়া। খাসা বানায় ওটা। বহুদিন খাওয়া হয়নি।’ পকেটের খামের ওপর চাপড় মেরে বলল, ‘গরম লাগছে হে! টাকার গরম।’ 

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী মনে হয়? মাধব রক্ষিতই খুনি?’ নাকে একটিপ নস্যি নিয়ে জলভরা লাল চোখে সামনের বিটি রোডের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল শুদ্ধসত্ত্ব। তারপর বলল, ‘খুনি হতেই পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে আনিসুর খুন হয়েছেন রাত এগারোটা পঁচিশের আগে! অর্থাৎ, যখন পার্টি চলছে।’ 

‘কেন?’ 

‘দেখো, আনিসুরের খুন হবার সময়কালে, মানে পোস্টমর্টেমে যেটুকু এসেছে, সেটা কী? রাত নয়টা থেকে ভোর চারটে। এই সাত ঘণ্টাকে আমরা তিনটে আলাদা স্লটে ভাগ করে ফেলতে পারি। রাত নটা থেকে এগারোটা পঁচিশ। এগারোটা পঁচিশ থেকে এগারোটা পঞ্চান্ন। এগারোটা পঞ্চান্ন থেকে ভোর চারটে। এবার এগারোটা পঁচিশে মাধব গাড়িতে উঠেছেন, আর এগারোটা চল্লিশে বাড়ি এসেছেন। এই পনেরো মিনিট সময়ের মধ্যে খুন করে বাড়ি ফেরা সম্ভব না আগেও বলেছি। আবার এগারোটা চল্লিশ থেকে একই গতিতে গাড়ি চালিয়ে এগারোটা পঞ্চান্নর আগে ধর্মতলা আসা সম্ভব নয়। কিন্তু দারোয়ান দিব্যি করে বলেছে যে মাধব বাড়ি থেকে বেরোননি। তাহলে এগারোটা পঁচিশ থেকে এগারোটা পঞ্চান্ন এই স্লট বাতিল। এগারোটা পঞ্চান্ন থেকে ভোর চারটে, সেটাও অসম্ভব। কারণ হেঁটে বা গাড়িতে, যেভাবেই হোক মাধবের বাড়ি থেকে বেরোতে গেলেই দারোয়ানের ঘুম ভাঙিয়ে তাকে দিয়ে গেটের চাবি খোলাতে হবে। আমি ধরে নিচ্ছি দারোয়ান মিথ্যে বলছে না। যে কারণে বাড়ির চারপাশ আরও দেখলাম। গেট দিয়ে ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোবার দ্বিতীয় কোনো রাস্তা নেই।’ 

একটা দোতলা বাসকে সাবধানে পাশ কাটিয়ে প্রণবেশ বলল, ‘কিন্তু আমরা তো এই সম্ভাবনার কথাও ভেবেছিলাম যে মাধব পাঁচিল টপকাতে পারেন।’ 

‘পায়ের অবস্থা দেখেছ? কীভাবে ফুলে উঠেছিল, আর নীলচে শিরা বেরিয়েছিল গোড়ালির চামড়ায়? সাত ফুট উঁচু পাঁচিলের ওপর থেকে ওই পা নিয়ে লাফানো যায় না। পায়ের ওপর চাপ দেওয়া যায় না, মাধব নিজেই বলেছেন। অন্য কিছু কতটা সত্যি বলেছেন জানি না, কিন্তু পায়ের ব্যাপারটা সত্যি। হাড়ের বিভিন্ন ধরনের চিড় বিষয়ে কিছু পড়াশোনা করেছিলাম এককালে। তোমাকে আর নতুন কী বলব, তুমি তো ডাক্তার! ওই লক্ষণ আমার চেনা। মাধববাবুকে তাঁর পা মৃত্যু পর্যন্ত ভোগাবে।’ ‘তাহলে?’ 

‘তাহলে পড়ে থাকল প্রথম স্লট। রাত ন-টা থেকে এগারোটা পঁচিশ।’ 

‘যে সময়টায় অন্তত পঞ্চাশজন শিল্পপতি বুকে হাত দিয়ে বলবেন যে মাধববাবুকে তাঁরা সর্বক্ষণ গ্রেট ইস্টার্নের মধ্যে দেখেছেন।’ 

শুদ্ধ কিছুক্ষণ পর বলল, ‘নাহলে আর একটা সমাধান আছে, যেটা আরও সহজ। মাধববাবু খুন করেননি।’ 

‘সেটাই সম্ভব। কারণ একটা লোকের পুরো সময়টায় অ্যালিবাই আছে, এমন অ্যালিবাই যেটাকে ভাঙা যাচ্ছে না। অন্য কোনো রাস্তা ভাবো হে!’ 

‘আমাকে এই মুহূর্তে সবথেকে কী ভাবাচ্ছে জানো? দুটো চিঠির রহস্য। দুটো চিঠি কেন? একটা আসল, একটা সাদা, এরকম কেন? দুটোই আসল নয় কেন? অথবা একটা নয় কেন?’ 

‘প্রথম চিঠির ব্যাপারে তো মাধববাবুই যা জানবার জানিয়ে দিয়েছেন। পড়ে আছে শুধু দ্বিতীয় চিঠির রহস্য। সেটা যে কারণেই পাঠানো হোক না কেন, মাধববাবু যে নির্দোষ, তা কি চোখ বুজে বলে দেওয়া যায় না? যদি না একমাত্র দারোয়ান মিথ্যে বলে।’ 

‘হুঁ, নির্দোষ তো বটেই। কিন্তু এত বড়োলোক, নিজের গাড়িবারান্দার বাতি সারাবেন না?’ চিন্তিত প্রশ্ন করল শুদ্ধসত্ত্ব। 

‘কী সব অদ্ভুত ভাবনা! তুমি একটা বালব কিনে দিয়ে এসো বরং।’ 

‘র‍্যালিস যাবার অগে একবার আনিসুরের হোটেল চলো তো। কয়েকটা জিনিস দেখে আসি।’ 

হোটেল পৌঁছাতে গিয়েই প্রায় আটটা বেজে গেল। ডালহৌসি, কার্জন পার্ক, চাঁদনিচক ঘিরে ততক্ষণে মোটরগাড়ি, ট্রাম আর বাসের মেলা বসে গিয়েছে। বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসায় ফিরছে মানুষ। শুদ্ধ কথাবার্তা বন্ধ করে টানটান বসে আছে অ্যাম্বাসাডরের আসনে। দেখে মনে হচ্ছে ধ্যান করছে। প্রণবেশ জানে, এটাই এখন শুদ্ধর ভাবনা প্র্যাকটিসের সময়। বাড়িতে হয়নি। তাই মোটরের ভেতরে করে নিচ্ছে।

কিন্তু জুপিটারের মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করেও সন্তোষজনক কিছু পাওয়া গেল না। আনিসুর প্রতি বছর এসে এখানেই থাকতেন। মুখ চেনা হয়ে গিয়েছিল। এটুকুই। না, সেই রাত্রে তাঁরা কেউ সন্দেহজনক কিছু দেখেননি। 

‘কিন্তু মেইন সুইচ অফ করল কে?’ 

‘এই চত্বরে অনেক বদ ছোকরা থাকে স্যার। সারাদিন নেশা করে। মারামারি করে নিজেদের মধ্যে। ওদেরই কেউ করেছে। তক্কে তক্কে আছি। ঠ্যাঙানি না খেলে থামবে না। 

‘একবার মিটারবক্সটা দেখব।’ 

সিঁড়ির নীচে দেওয়ালের গায়ে একটা ছোট্ট অন্ধকার কুঠুরি। তার মধ্যে মিটারবক্স বসানো। 

‘তার মানে বাইরে থেকে এসে যে কেউ সুইচ অফ করে দিয়ে যেতে পারে?’ 

‘তা পারে, যদি না কেউ এখানে আমার জায়গায় বসে থাকে। তবে অত রাত্রে আর কে থাকবে স্যার। বউ ছেলে নিয়ে সংসার করি। ভদ্দরলোকের পাড়াতে থাকি। ঠিক সময়ে বাড়ি না ফিরলে তো ক্যারেক্টার নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেবে লোকে। প্রতিদিন এগারোটার মধ্যে বাড়ি চলে যাই। তিনটে ছোকরা কর্মচারী অছে। তারাও খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়ে, অথবা এদিক ওদিক ফূর্তি করতে বেরোয়। আমি ফ্যামিলিম্যান, কিন্তু এই ছেলেপুলেদের তো আর আটকনো যায় না স্যার। সারাদিন খাটাই, মৌজ করবার দরকার সবারই পড়ে।’ 

র‍্যালিসে কুলপির গায়ে চামচ বসিয়ে শুদ্ধসত্ত্ব প্রশ্ন ছুড়ল, ‘ডেকার্স লেনের হোটেল থেকে গ্রেট ইস্টার্নের দূরত্ব কত হতে পারে?’ 

‘কাছেই। কিন্তু তুমি যা ভাবছ, তা বড়ো সহজ সমাধান নয়। ওই গলিতে গাড়ি ঢুকবে না। বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে বেশ অনেকটা হেঁটে আসতে হবে। এবার, অত রাত্রে মাধব রক্ষিতের দামি মোটরগাড়ি যদি ওই গলিতে দাঁড়ায়, স্থানীয় লোকের চোখে পড়বে না?’ 

‘নাও পড়তে পারে। ধর্মতলা অঞ্চলে বহু দামি গাড়ি যাতায়াত করে। কিন্তু সেটা ভাবছি না। আমি ভাবছিলাম, প্রথম টাইম-স্লটের কথা। নটা থেকে এগারোটা পঁচিশ। যদি পার্টি চলাকালীন গাড়ি চালিয়ে এসে, গাড়ি রেখে আনিসুরকে খুন করে মাধববাবু আবার পার্টিতে ফেরত চলে যান?’ 

‘কিন্তু সবাই যে বলছেন মাধববাবুকে সারাক্ষণ চোখের সামনে দেখেছেন?’ 

‘পার্টির মধ্যমণি কিন্তু মাধব রক্ষিত ছিলেন না। যাঁর আশি বছরের জন্মদিন পালিত হচ্ছিল, সেই স্যার ধীরেন না বীরেন কী যেন নাম, তিনি ছিলেন। দশ কি পনেরো মিনিটের জন্য কি মাধববাবু বাইরে যেতে পারেন না? ‘ ‘কঠিন, ব্যাপারটা প্রায় ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেবার মতো। একবার ভাবো, যদি সব প্ল্যানমাফিক না ঘটত? যদি খুন করতে সময় লাগত, আর মাধববাবুর ফিরতে দেরি হতো? তাহলে তো লোকের চোখে পড়তই। এতটা ঝুঁকি কি মাধব রক্ষিত নেবার সাহস দেখাবেন?’ 

‘দেখাতেই পারেন, যদি রোখ চেপে যায়।’

‘যে লোক খুন করবার আগে তোমাকে চিঠি লিখে নিজের ওপর সন্দেহ দূর করবার চেষ্টা করে, সে মূলগতভাবে সাবধানী। কখনও চাইবে না ঝুঁকি নিতে। বিশেষত তার যদি কয়েক কোটি চাকার ব্যবাসায়িক সাম্রাজ্য হারাবার ভয় থাকে। 

‘ঠিক।’ মুখের ভেতর কুলপির টুকরো ফেলে জিভ দিয়ে ঘোরাচ্ছে শুদ্ধসত্ত্ব। আবেশে বুজে এসেছে চোখ। ‘তাহলে অপর কোনো খুনির সন্ধানেই নামতে হচ্ছে। তাই তো?’ 

‘সেটাই তো কঠিন কাজ! আমরা এমন কাউকে জানি না যে কলকাতায় আনিসুরের চেনাজানার মধ্যে ছিল। এই বিশাল শহরে কোথায় সেই আততায়ী লুকিয়ে আছে, সেটা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব!’ 

‘সেক্ষেত্রে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে। কাল সারাদিন থানায় বসে থাকবো ভাবছি। আনিসুরের ঘর থেকে যা যা পাওয়া গিয়েছে, খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে চাই। তুমি কী করবে?’ 

‘কাল আমি থাকব না। চেম্বার আছে। তারপর লতিকাকে নিয়ে ওর পিসির বাড়ি যেতে হবে। নিমন্ত্রণ আছে। বিয়ে থা তো করলে না, সংসারীদের জ্বালা আর তুমি কী বুঝবে!’ 

‘তোমার কালেকশনের শার্লক হোমসটা একবার দিয়ো তো। আজ রাত্রে ঘুমাতে যাবার আগে পড়ব।’ 

‘সেকী? একটা কোকেনখোরের গাঁজাখুরিকে এতটা পাত্তা দেবে?’ 

‘আহা গাঁজা হোক আর যাই হোক, সাহিত্য হে! অমন উৎকৃষ্ট মানের খাসা লিখনভঙ্গী আর কার আছে? দেখি একটা সিগারেট দাও তো! 

‘ভেতরে সিগারেট খেতে দেবে না ইডিয়ট! বাইরে গিয়ে ধরাও। আর এগারো হাজার তিনশো আশি পেরিয়ে গেল কিন্তু।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *