১০
…এবং যেহেতু ভিরমি খাওয়া পথের
ওপর সমস্ত ধূলো ময়লা পরিষ্কার করার জন্য আমার গা শিউরে শিউরে উঠছে, খারাপভাবে জড়ো করা নানান বিস্ফোরক দিয়ে তৈরী হয়েছে আমার দেহাভিমান এবং সমস্ত বারণ অমান্য করে আমি আমার আত্মার কাছে যেতে চাইছি।’
—শম্ভু রক্ষিত
.
‘ঋষি রোডের বাড়ি? এরকম কিছু শুনিনি।’ অরুণ চৌধুরী উত্তর দিলেন।
রাত সোয়া আটটা। আমরা অরুণের ডাইনিং রুমে বসেছিলাম। আমি, অরুণ, সিদ্ধার্থ আর অনন্যা। পাস্তা, গ্রিলড পট্যাটো এবং বেকড স্যামন। সঙ্গে হোয়াইট ওয়াইন। অরুণের জন্য কফি। আমি খেতে খেতে সংক্ষেপে জানাচ্ছিলাম গত দুইদিনের বিবরণ। সত্যি বলতে কী, এত নতুন নতুন রহস্য সামনে এসে ভিড় করেছে যে বুঝতেই পারছিলাম না কীভাবে গল্পটা শুরু করব। মনে মনে ঠিক করে এসেছিলাম যে অরুণের সাহায্য চাইব দরকার হলে। রহস্যকাহিনীর প্রাজ্ঞ লেখক হিসেবে যদি এগোবার রাস্তাটা দেখিয়ে দেন। এর মধ্যে ফোটোগ্রাফার এসে সবকটা জায়গার এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ছবি তুলে আবার ফিরে গিয়েছেন ঘণ্টা দেড়েক আগে। তারপর এই বাড়িতে এসে আলাদা আলাদা ভাবে অরুণ আর অনন্যার সাক্ষাৎকার ফোনে তুলে নিয়েছি। ফলে কাজ অনেকটাই কম। হালকাও লাগছে কিছুটা। শুধু ড্যানিয়েল লামার বাড়িতে গিয়ে আবার নিরাশ হতে হয়েছে। গেট থেকে খালি হাতে ফিরেছি। মেলেনি পুলিশ লাইব্রেরির কার্ডও। তবে আনন্দ পাঠকের ছবি যখন তুলতে যাওয়া হয় তাঁর বাড়িতে, গিয়েছিলাম সঙ্গে। পাঠক অনেক গল্প করলেন, স্মৃতিচারণা করলেন এই শহরের। অ্যালবাম খুলে পুরোনো বহু ফটো দেখালেন, অনুমতি দিলেন তাদের ছবি তুলে রাখার। যখন স্টোরি করব, এই শহরটাকে ১৯৭৫ সাল অনুযায়ী নির্মাণ করে নিতে হবে। সেই কাজে আনন্দ পাঠকের বয়ান, এবং তাঁর সংগ্রহের ছবিগুলো অমূল্য সম্পদ।
অনন্যা ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাড়িটার ভেতরটা কেমন দেখতে? গথিক স্ট্রাকচার নিয়ে আমার বরাবরের কৌতূহল।’ উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই অরুণ অস্থিরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি মনে করেন, ওই বাড়িতে অমিতাভ ছিল?’
‘অমিতাভ, অথবা তাঁর হত্যাকারী, অথবা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, যে কেউ হতে পারে।’
‘অন্য কেউ ছিল কিনা তা নিয়ে আমার ইন্টারেস্ট নেই। অমিতাভ ছিল কিনা —কারণ পুলিশ আমাকে বলেছিল অমিতাভর নিজের ডেরায়, ওই গ্রামের ঘরে, ও নাকি অনেকদিন আসেনি। তাহলে এই দিনগুলো ও কোথায় ছিল? উপন্যাসটা কোথায় বসে লিখেছিল? কোনোদিন জানতে পারিনি।’
‘বাড়িটার কথা পুলিশকে জানাচ্ছেন না কেন?’ অনন্যা জিজ্ঞাসা করলেন।
‘এই কেস তামাদি হয়ে গিয়েছে। এখন কে আর সাধে নতুন করে পুরোনো ফাইল খুলবে?’
‘কিন্তু আপনি কি চান না সত্যিটা বেরিয়ে আসুক?’
‘সত্যি নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই।’ উত্তর দিলাম। ‘আমি স্টোরি করতে এসেছি। রহস্যের সমাধান করতে নয়। আজ যদি এই বাড়িটা আমার সামনে হাজির হয় এসে, সেটা আমার গল্পের উপাদান। গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু তার জন্য আমাকে পেছনের কাহিনীটা জানতে হবে।’
‘আর যে সন্দেহ গত চল্লিশ বছর ধরে অরুণের ঘাড়ে চেপে বসে আছে, সেটার নিরসন হবে না?’ অনন্যা আমার চোখে চোখ রাখলেন।
দৃষ্টি ফেরালাম না। ‘প্রত্যেককে নিজের ক্রুশকাঠ নিজেকেই বইতে হয়। আমি বিশ্বাস করি, এই রহস্যের সমাধান একমাত্র করতে পারেন মিস্টার চৌধুরী। তিনি না চাইলে করবেন না। কিন্তু আপনি কি সত্যিই এতটাই কৌতূহলী? কিছু মনে করবেন না। পরশুদিন কথা বলে কিন্তু মনে হয়েছিল মাথা ঘামাতে চান না। এমনকি আমি যে এখানে আসি, আপনি বা সিদ্ধার্থ কেউ চাননি।
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘খুনের রহস্যকে ধাঁধা হিসেবে অথবা আকর্ষক উপাদান হিসেবে দেখার ইচ্ছে আমার নেই।’ অরুণের হাতে হাত রাখলেন অনন্যা, ‘কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার স্বামী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অন্যের সন্দেহ থেকে মুক্তি পান। আমরা আগের বছর জয়পুর সাহিত্য উৎসব গিয়েছিলাম। সেখানে এতদিন পরেও যখন সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল অরুণের, সেই একই প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে এসেছে। ছাপা হয়েছে জাতীয় সংবাদপত্রগুলিতে। হেডলাইন ছিল খুনের সন্দেহভাজন থেকে মুক্ত হয়ে বেস্টসেলার লেখকে পরিণত হওয়া অরুণ চৌধুরী নিজের সাহিত্যকীর্তি বিষয়ে কথা বলছেন। গার্ডিয়ান থেকে অরুণের উপর ফিচার করবার জন্য যোগাযোগ করা হয়েছিল। কেন করেছিল? অরুণের লেখার জন্য নয়। চল্লিশ বছর আগেকার ঘটে যাওয়া একটা হত্যারহস্যের জন্য। কেন এতদিন পরে এসেও বারবার এই সন্দেহের সামনে আমাদের দাঁড়াতে হবে?’
কিছুক্ষণ সকলে নির্বাক। অরুণ খাওয়া থামিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন। সিদ্ধার্থ নীরবতা ভাঙল, ‘কাকিমা, তুমি চাইলে আমরা কোনো প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি।’
‘এত পুরোনো কেস নিয়ে কেউ কি উৎসাহী হবে আর?’ জিজ্ঞাসা করলাম। ‘পরশু আমাকে বসিয়ে যে যে প্রশ্নগুলো আপনি তুললেন, সবকটা নিয়ে ভেবেছি। কিন্তু কিছু মাথায় আসেনি। হয়তো ইন্টারেস্ট পাইনি বলেই। শুধু একটা কথা মনে হয়েছে। আপনি প্রশ্ন করেছিলেন, চোখের সামনে রাইফেল দেখেও অমিতাভর হৃৎস্পন্দন কেন বেড়ে যায়নি। কারণটা সম্ভবত মদের জন্য। অত্যধিক মাত্রায় নেশা করে অমিতাভ অসুস্থ বা অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন।’ বললেন অনন্যা।
অরুণ আমার দিকে তাকালেন। ‘আমিও ভেবেছি। নতুন করে। আর সেটা ভাবতে গিয়ে আবিষ্কার করছি, এই ঘটনার অনেকগুলো দিক আমি নিজেও জানি না। যেমন পুলিশ মহলে ড্যানিয়েল আর ধনরাজের পারস্পরিক রেষারেষি। অথবা, সেই রাত্রে মিসেস বাসু পুলিশের কাছে ঠিক কী বলেছিলেন। এগুলো আবার নতুন করে আমার সামনে ফিরে আসছে।’
‘কিন্তু সেই রাত্রে ড্যানিয়েল কেন থানায় এসেছিলেন বলে মনে হয়? ইন্টারভিউতে এই প্রশ্ন করেছিলাম আপনাকে। এড়িয়ে গেলেন। তাই আবার করছি।’
‘এড়িয়ে গেলাম, কারণ এর উত্তর একদমই জানা নেই। তবে ঘটনাটা মনে আছে। ড্যানিয়েলকে দেখে সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিল। একজন পুলিশ বলে উঠেছিল, ‘স্যার, এত রাতে?’ ড্যানিয়েল আমাকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক সেকেন্ড। তারপর ধনরাজ গম্বুকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে যায়। উত্তেজিত গলার স্বর শুনতে পাচ্ছিলাম। নিজেদের ভাষা আর ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছিল দুজন। বলছিল মূলত ড্যানিয়েলই। কথার বক্তব্য, এই কেস এখন থেকে তার। অন্য কেউ যেন সেখানে মাথা না ঘামায়। ধনরাজ থমথমে মুখে বেরিয়ে এসে থানার বাইরে চলে গেল। ড্যানিয়েল এসে বসল আমার টেবিলের উলটোদিকে। তার আগে পর্যন্ত রুটিন চেক-আপ, জিজ্ঞাসাবাদ এসব চলছিল। ড্যানিয়েল আসার পর ছবিটা পালটে গেল। ড্যানিয়েল নির্দেশ দিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অমিতাভ এবং প্রশান্ত গুরুং দুজনকেই থানায় এনে হাজির করতে। সেই ভোরেই দুজনের আস্তানায় হানা দিল পুলিশ। এর পরের ঘটনা তো আপনি জানেন।’
‘সেই রাতে ড্যানিয়েল কি খোঁড়াচ্ছিলেন? কেন?’
অরুণ মাথা নাড়লেন, ‘সেসব মনে নেই আর। এই কেনর উত্তরও আমার কাছে নেই।’
‘সঞ্জয় অধিকারীর সেই সময়কার রিপোর্ট সংগ্রহ করে যতটুকু জেনেছি, আপনাকে পরের ভোরবেলা ছেড়ে দেবার পর সারাদিন বাড়িতেই ছিলেন। সেদিন কি উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেছিল?’
‘না। বাড়িতে শুয়ে ছিলাম, আর ভাবার চেষ্টা করছিলাম আগের দিনের ঘটনাগুলো। দাদা খবর পেয়ে সকালবেলা উকিল নিয়ে এসেছিল। তখন তো একাই থাকতাম। চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করে যে ছেলেটি, সে ছুটি নিয়ে দেশের বাড়ি গিয়েছিল আগের সপ্তাহে। বাবলাও ততদিনে চলে গিয়েছে। দাদা জোরাজুরি করল, সে এখানে থাকবে। কিন্তু আমি একা থাকতে চাইছিলাম। কারোর সঙ্গ ভালো লাগছিল না। উকিল মিস্টার ভুলাভাই প্যাটেল বলছিলেন আগাম জামিনের আবেদন করতে। কারণ তিনি খবর পেয়েছিলেন যে অমিতাভকে পাওয়া যাচ্ছে না। যদি খারাপ কিছু ঘটে থাকে, পুলিশ গ্রেপ্তার করবে সবার আগে। এসব নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছিল। দাদারা বেলার দিকে চলে গেল। আমার এক বন্ধু এসেছিল তারপর। কিন্তু বাড়ির বাইরে বেরোইনি। আপনাকে ওয়াইন দি?’
‘অল্প করে। ধন্যবাদ। আপনি কি একেবারেই মদ খান না?’
‘কলেজবেলায় দু-একবার খেয়েছি। আর অনন্যার সঙ্গে বিদেশের কনফারেন্সে যেতাম যখন, রিসেপশনে ওর পাল্লায় পড়ে চেখে দেখেছি।’ অনন্যার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন অরুণ। অনন্যা ওয়াইনের ব্যপারে অসম্ভব নাকউঁচু। বিশেষ দেশের বিশেষ অঞ্চলের ওয়াইন না হলে ওর অসুবিধে হয়। কিন্তু আমি একেবারেই অরসিক। সকাল থেকে রাত অবধি কয়েক লিটার কফি আমার প্রিয় বন্ধু বলতে পারেন।’
‘আমরা হাসাহাসি করতাম নিজেদের মধ্যে। অরুণের রাত্রিবেলা ঘুম ভেঙে যায় মাঝেমাঝেই। আর লোকে যেমন জল খেয়ে আবার ঘুমোতে যায়, ও নাকি তেমনভাবেই কফি খেয়ে নেয় কয়েক ঢোঁক।’
আপনিও কি উত্তরবঙ্গের মানুষ?’ জিজ্ঞাসা করলাম অনন্যাকে।
‘না। আমরা প্রবাসী বাঙালি। আমার জন্ম এবং বড়ো হওয়া এলাহাবাদে। পড়াশোনা করতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসি। কয়েক বছর ব্রেবোর্নে পড়িয়েছি। একটা এক্সকারশনে দার্জিলিং এসে অরুণের সঙ্গে আলাপ। ১৯৭৭ সাল সেটা। বরাবর চাইতাম শহরের কোলাহল থেকে দূরে কোথাও বাড়ি করে থাকতে। অরুণের থেকেও আমাকে বেশি টেনেছিল তখন দার্জিলিং। এখন তো শহরটা বদলে গেছে অনেক। ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। নীচের দিকে বেড়েই চলেছে। পুজোর সময়ে এখানে ভিড় দেখলে মনে হবে আপনাদের গড়িয়াহাটে বসে আছেন। কিন্তু তখন এরকম ছিল না। যখন এসেছিলাম, অরুণ চৌধুরীর নাম সেই সময়ে ছোট্ট শহরটার ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। স্মল টাউন সিন্ড্রোম যা হয় আর কী! আজকের দার্জিলিং হলে মনে হয় না মানুষ এসব নিয়ে এত মাথা ঘামাতো।’
‘আর তবুও সেই রহস্য নিয়ে আপনি আকৃষ্ট হলেন না?’
‘না। আমি সোজা পথে চলি। আগের দিনেও বলেছি। সবথেকে সহজ যে সমাধান, সেটাই বাস্তব সমাধান মনে হয়।
‘এক্ষেত্রে সেটা কী?’
‘ভাবিনি। কিন্তু একটা জিনিসে বিশ্বাস করি। আমাদের অঙ্কে ওকামস্ রেজর নামে একটা তত্ত্ব চলে। মধ্যযুগের দার্শনিক উইলিয়াম অফ ওকামের নাম থেকে এই তত্ত্বের উদ্ভব। যদি কোনো ঘটনা ঘটে, যার একাধিক সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে, তাহলে যে কারণটা ভাবতে গেলে সবথেকে কম মাথা খাটাতে হয়, সেই সহজতম ব্যাখ্যাই নেওয়া উচিত। এটাই হলো ওকামস রেজরের মূলমন্ত্র। এই সমস্ত তথাকথিত রহস্যের আসল সমাধান সবথেকে সহজটাই।’
‘আপনি হয়তো নেম অফ দ্য রোজ উপন্যাসটা পড়েছেন। মধ্যযুগের একটি ক্রিশ্চান মঠে একের পর এক সন্ন্যাসীর খুন হয়ে যাওয়া নিয়ে লেখা গোয়েন্দাকাহিনী? সেই উপন্যাসের যে গোয়েন্দা চরিত্র, উইলিয়াম অফ বাস্কারভিল, সেই চরিত্রটির পেছনে মূল অনুপ্রেরণা ছিল উইলিয়াম অফ ওকামের জীবন।’ বললেন অরুণ।
আমাদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অনন্যা বললেন, ‘সিদ্ধার্থকে নিয়ে ওপরে যাব। আমার নতুন পেপারটা ওকে একবার পড়াতে চাই।’
অনন্যা আর সিদ্ধার্থ ওপরে উঠে যাবার পর আর একটা ওয়াইন নিলাম। হালকা নেশা হয়েছে, আর ভালো লাগছে বেশ। অরুণ কফির কাপ নিয়ে সামনে এসে বসলেন।
‘অমিতাভর উপন্যাস শেষ হল?’
‘না। বেশি সময় দিতে পারছি না। তবে এখনও মনে করি, খুন মাধবই করেছেন।’
‘কেন বলছেন এই কথা?’
‘কিছুটা যুক্তি, আর কিছুটা অনুমান। মাধবের পায়ে ব্যথাটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লু। দেখুন, গ্রেট ইস্টার্নের পার্টিতে মাধব মধ্যমণি ছিলেন না। সকলের চোখ মূলত ছিল স্যার ধীরেনের দিকে। মাধব সেই সুযোগে হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে আনিসুরের হোটেলে যান। আনিসুরকে খুন করেন। তারপর বেরিয়ে এসে আবার গ্রেট ইস্টার্নে ঢোকেন। এই ছোটাছুটিতে মাধবের পায়ের ব্যথা বেড়ে গিয়েছিল। এটা হতে পারে। অথবা হতে পারে যে পার্টি শেষ হবার পর আনিসুরের হোটেলে গিয়ে মেইন সুইচ অফ করে অন্ধকারের সুযোগে আনিসুরের ঘরে ঢুকেছিলেন। খুন করে বেরিয়ে এসে আবার গাড়িতে ওঠেন। পুরো কাজটাই তিন-চার মিনিটের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল। গাড়ি সম্ভবত দূরে পার্ক করেছিলেন যাতে লোকের নজরে না পড়ে। দৌড়তে দৌড়তে এসে গাড়িতে ওঠেন। সেই কারণেও ব্যথা চাগাড় দিয়ে উঠতে পারে।’
‘কিন্তু তাহলে আগের দিন যখন মাধবকে নিয়ে পুলিশ আনিসুরের হোটেলে যায়, অথবা মাধব যখন শুদ্ধসত্ত্বের বাড়ি আসেন, তখন পায়ের ব্যথাটা প্রসঙ্গে আসেনি কেন?’
‘মাধব চেপে গিয়েছিলেন। ব্যাথা নিয়েই হাঁটাচলা করছিলেন। নাহলে পুলিশের সন্দেহ বাড়ত।’
‘কিন্তু আনিসুর যদি পার্টি চলাকালীন খুন হয়ে থাকেন, তাহলে খুনের পরে মেইন সুইচ অফ করা হলো কেন?’
‘সেটা হয়তো সত্যিই স্থানীয় ছেলেপুলের বদমাইশি। খুনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আমার ধারণা আনিসুরকে খুন করা হয়েছিল পার্টির পরে। মেইন সুইচ অফ করে অন্ধকারে গা ঢাকা দেবার সুযোগ নেওয়া হয়েছিল।’
‘আর বন্ধ ঘরের রহস্য?’
‘বিমল দারোগা অনেকগুলো ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, সেদিন দুপুরবেলা মাধব আনিসুরের ঘরে এসেছিলেন। তিনি আনিসুরের অজান্তে ছিটকানির সঙ্গে সুতো বেঁধে দরজার ফাঁক দিয়ে বার করে রাখতেই পারতেন। বাকি কাজটা মাখনের মধ্যে দিয়ে ছুরি চালাবার মতো করে হয়ে গিয়েছিল।’
‘পর্দা এবং চেয়ারের রহস্য?’
‘আপনি এভাবে পরপর প্রশ্ন করে যেতে থাকলে তো মুশকিল। এখনও সবটা পড়িনি। হতে পারে যে মাধবই চেয়ারটাকে একপাশে সরিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ওই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে তাঁর গুলি করতে সুবিধে হয়। আর পর্দার ব্যাপারটা নিয়ে এখনও ভাবিনি। আরও কিছুটা পড়তে হবে।’
‘দ্বিতীয় চিঠি নিয়েও ভাবেননি, বুঝতেই পারছি।’
‘মিস্টার চৌধুরী, অমিতাভ মিত্রর উপন্যাসের ঐতিহাসিক মূল্য আছে। আগেই বলেছি, হনকাকুর সমাধান করতে যে মাথা খেলাতে হয়, সেটাও আকর্ষণীয়। কিন্তু আমার গল্পটা তো আমাকেই লিখতে হবে। আজ সকালেও সম্পাদক ফোন করে কাজের প্রগ্রেস জানতে চেয়েছেন। তাই আমি একটা ডেডলাইনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আপনার কি মনে হয় না, অমিতাভর উপন্যাস এই মুহূর্তে আমার কাছে এতটাও গুরুত্বপূর্ণ না হতেই পারে?
অরুণ কাপের গায়ে হাত বোলাতে থাকলেন। গতকালের দাবার বোর্ড একপাশে রাখা। খেলা এখনও শেষ হয়নি। আপাতত দুই পক্ষেই সমান সমান ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
আপনার উকিল, মিস্টার প্যাটেলের সঙ্গে পুলিশের কী জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্ট হয়েছিল, মিস্টার চৌধুরী?’ মৃদু গলায় জিজ্ঞাসা করলাম।
এই প্রথম অরুণ চমকালেন। দেখতে পেলাম, দুর্ভেদ্য বুহ্যে চুলের মতো সরু একটা ফাটল দেখা দিচ্ছে। অরুণ প্রাণপণ চেষ্টায় স্বাভাবিক হতে চাইছিলেন। তাঁর হাত কাঁপছিল। কোনোমতে কফির কাপ রেখে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। চোখ নীচু করে কয়েক মুহূর্ত কিছু ভেবে নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। ‘আপনাকে কে বলল এরকম কথা?’
‘তার মানে অনুমানটা সত্যি? কিছু একটা চুক্তি হয়েছিল?’
অরুণ উত্তর না দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
‘আপনার প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝতে পারছি, চুক্তিটা গোপনীয়তা বজায় রাখার। সেই জন্য আপনি নিজের মুখে কিছু বলছেন না। নিজের অপরাধ স্বীকার করবার পরেও তার বিশদ বিবরণে যেতে পারছেন না। এবং সেই কারণেই আমাকে অমিতাভ মিত্রর উপন্যাসটা দিয়েছেন যেখান থেকে কিছু সূত্র পেতে পারি। তাই তো?’
অরুণ এখনও নীরব। যখন সিদ্ধান্ত নেন যে কথা বলবেন না, পৃথিবীর কেউ মনে হয় এঁকে মুখ খোলাতে পারবে না।
‘আমার সেটা মানতেও কোনো অসুবিধে নেই। যদি সত্যিই গোপনীয়তা চুক্তি হয়ে থাকে, তাহলে আপনি মুখ খুলবেন না সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, এখানে একটা বড়ো কিন্তু আছে যার উত্তর নেই— একটা হত্যারহস্যের মধ্যে কী এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জড়িয়ে যার জন্য পুলিশ আপনার সঙ্গে এই চুক্তিতে যেতে বাধ্য হলো?’
অরুণ হাসলেন। শান্ত গম্ভীর্য ছড়িয়ে পড়ল চোখে। ‘আপনি কিছুটা বুঝেছেন টিনা। কিন্তু অনেকটাই এখনও না বোঝা। সেটুকুর জন্যেই অমিতাভর উপন্যাসটা আপনাকে শেষ করতে হবে। এবং খুঁজে বার করতে হবে সমাধান। উপন্যাসের শেষে গেলে দেখতে পাবেন, অদ্ভুত মিল বাস্তবের ঘটনার সঙ্গে। অমিতাভ যেন দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেয়েছিল।’
‘পড়ব। কিন্তু আমি যে সিদ্ধান্তে এসেছিলাম, সেটা কি আপনি শুনবেন একবার?’
বুকশেল্ফ থেকে সারসার বই নীরবে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। মনে হলো, সেগুলো জীবন্ত। কেঠো কোষের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রেখেছে চুয়াল্লিশ বছর আগেকার স্মৃতি— সেই সব দৃশ্য, যেগুলো অজস্রবার অনুমান, বির্নিমাণ আর কাটছেঁড়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে চিবানো ডাঁটার মতো নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। টেবিলে একটা বই ওলটানো। চমস্কির ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট
‘অমিতাভ হত্যার দায় আপনারই। অমিতাভর উপন্যাস পড়তে গিয়ে যেমন মাধবের ওপর আমার সন্দেহ হচ্ছে, ঠিক তেমনই হচ্ছে আপনার ওপর। সন্দেহ বলা ভুল, কারণ আপনি নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেই স্বীকারোক্তিকে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি বলতে পারেন। আর বলতে বাধা নেই, এই বিশ্বাসে কিছুটা সহায়ক হয়েছে অমিতাভর উপন্যাস। সেই খুন আপনি নিজের হাতে করতে পারেননি। কোনো সহকারী ছিল। অমিতাভকে আপনার বাড়ি থেকে ধাওয়া করে সে গিয়ে পাকড়াও করে। তাকে মদ খাওয়ায়, মাতাল করে দেয়, এবং ভুলিয়ে ভালিয়ে কবরখানায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। পুরো ব্যাপারটা ঘটে যখন, আপনি তখন থানায় বসে। স্বাভাবিকভাবেই আপনাকে অভিযুক্ত করা যায়নি। আপনার সহকারী সম্ভবত এমন কেউ, যাকে পুলিশ বা স্থানীয় কেউ চেনে না। হয়তো ভাড়াটে খুনি। কাজেই তাকে ধরাও অসম্ভব ছিল। একটা পারফেক্ট মার্ডার, নিখুঁত খুন। এটা একমাত্র সম্ভব হয় কোনো রহস্যকাহিনীর লেখকের দ্বারাই।’
‘কিন্তু তাতে কি এই কেসের সঙ্গে এতদিন জড়িয়ে থাকা এতগুলো খটকার সমাধান হয়ে যায়?’
‘যায়। অঙ্কের উত্তর জানা থাকলে মাঝের স্টেপগুলোর অসংগতিকে সেই উত্তরের আদলে সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া সম্ভব। যেমন ধরুন, একটা রাইফেল, যার থেকে একটাই গুলি ছুটেছে। কিন্তু বুলেট মিলছে দুটো। কীভাবে সম্ভব? যদি বলি, রাইফেল আসলে দুটো? একই ধরনের একই মডেলের? ২০১৯ সালের ব্যালিস্টিক বিশ্লেষণ অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে একই কোম্পানির একই মডেলের যমজ রাইফেলের মধ্যে তফাত করা সম্ভব ছিল না। একটা রাইফেল ছিল আপনার বাড়িতে। আর একটা রাইফেল আততায়ীর হাতে।’
‘প্রশান্ত গুরুং আর মিসেস বাসুর পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্য?’
‘আপনি গুরুং-কে টাকা খাইয়েছিলেন। সেটা কি একেবারেই অসম্ভব?’ কিছুটা সময় পর আবার বললাম।
অরুণ মাথা নাড়লেন, ‘এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।’
‘রাইফেলের ট্রিগারে অমিতাভর আঙুলের ছাপ মুছতে আপনি ভুলে গিয়েছিলেন। সম্ভবত ঘাসের ওপর রক্তও খেয়াল করেননি। করলে মুছে দেবার ব্যবস্থা করতেন। আর আপনার হাতে আঁচড়ের দাগটা কি এখনও বলে দিতে হবে? সেটা তো পুলিশই জেনে গিয়েছে। অমিতাভর সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে আপনার হাত ছড়ে গিয়েছিল।’
ওয়াইনে চুমুক দিলাম। তারপর হাসলাম হালকা, ‘অনন্যা ওকামস রেজর নিয়ে বলছিলেন। আমিও সবথেকে সহজ সমাধানের দিকেই এগোচ্ছি।’
‘সুডোকু ভালোবাসে যে মানুষ, তার চিন্তাগুলো সরলরেখায় চলে, আগেও দেখেছি।’ ক্ষীণ হাসির রেখা অরুণের ঠোঁটের গোড়ায় ফুটে উঠল।
‘নাহ, সব ব্যাখ্যা মেলেনি এখনও। তবে সেটা নিয়ে ভাবার থেকেও আর একটা জিনিস বেশি ভাবাচ্ছে। অমিতাভ মিত্রর প্রোফাইলিং করা সমস্যার লাগছে একটু।’
‘সেটা স্বাভাবিক। কারণ ওই সময়টাকে না চিনলে আপনি অমিতাভকে বুঝতে পারবেন না।’
‘সেই চেনাটাই, মানে ভাবছি, কীভাবে চিনব। আপনার দেওয়া অমিতাভর চিঠিপত্র, লেখালেখি কাটাকুটি কাগজগুলো কিছু দেখলাম। সেগুলো ইন্টারেস্টিং কিন্তু অমিতাভকে ঐ সময়ের মানচিত্রে প্রোথিত করে যদি লিখতে হয়, তাহলে ওটুকুই যথেষ্ট নয়।’
‘না, যথেষ্ট নয়। কারণ একা অমিতাভকে চিনলে হবে না। আগেও বলেছি, এই সুযোগে আরও কিছুটা বাংলা কবিতা পড়ে নিন। সত্তরের কবিতায় কীভাবে দিকবদল এসেছিল, কীভাবে বীতশোক ভট্টাচার্য বা তুষার চৌধুরীর মতো কবিরা অন্য ভারতীয়ত্বের সন্ধান করছিলেন, যেভাবে প্রবন্ধের মেজাজে মেধাবী কাব্যভাষার নির্মাণ করছিলেন, উল্টোদিকে বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, রমা ঘোষ— আমাদের সময়ের ইম্পর্ট্যান্ট কবি এরা সবাই। শ্রুতি, হাঙরি, শাস্ত্রবিরোধী, এই সমস্ত ধারার যে কালমিনেশন ঘটেছিল সত্তরের শুরু বা ষাটের শেষের দিকটায়, অমিতাভ সেটার প্রতিনিধি হয়েও কিছুটা নির্জনে দাঁড়িয়েছিল। ওর যাত্রাপথটা পুরোপুরি বাইরের দিকে ছিল না, অনেকটাই নিজের শুদ্ধ আত্মার খোঁজ— কিন্তু সেটুকু থেকেও সরে এসেছিল এক সময়ে। সময়টা আগুন ঝরানো, ওর লেখাও সেই আঁচে নিজেকে ঝলসে নিল।’
‘সমস্যাটা কী জানেন, আমার পাঠক বাংলা কবিতা নিয়ে আগ্রহী হবে না।
‘কিন্তু ষোলোহাজার শব্দের মধ্যে যদি অমিতাভর চরিত্রকে পাঁচশো শব্দও দেন, সেটার মধ্যে তো অন্তত তিনশো শব্দই কবিতায় চলে যাবে টিনা। আমি যখন ক্রাইম লিখি, অপরাধীর প্রোফাইলিং করতে গেলে তার সমাজ, সময়, অর্থনীতি এগুলোকে ভুলে যদি লিখতে যাই তাহলে তো চরিত্রটাই গ্রাউন্ডেড হবে না। তার মনস্তত্ত্ব— কোন প্রবৃত্তি তাকে দিয়ে খুনটা করাচ্ছে, সেটা বুঝতে গেলে তার ইতিহাস, অর্থনীতি আর পারিপার্শ্বিক ভুলে থাকা অসম্ভব। কারণ অপরাধপ্রবৃত্তি আকাশ থেকে পড়ে না। এবার, যখন লিখব, হয়তো ওই বিশাল ইনফর্মেশন থেকে দুটো কি তিনটে লাইনই নেব। সেটুকুই ব্যাকগ্রাউন্ড। কিন্তু বোঝাটা কমপ্লিট থাকতে হবে, নাহলে চরিত্রের প্রতি সৎ থাকা যায় না।’
‘এই যে ব্যাকগ্রাউন্ড স্টাডি বারবার করতে বলছেন, এক্ষেত্রে সেটা কী?’
‘ওই সময়ের রাজনীতি, আর তা থেকে উঠে আসা কবিতা। তখন জেনারেল ট্রেন্ডই ছিল সরাসরি রাষ্ট্রদ্রোহের আহ্বান। অরাজনৈতিক লেখক কবিরাও পুরোটা প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল ওই কারণেই একবার রেগেমেগে লিখেছিল যে ১৯৭২ এর পর থেকে অমিতাভ গুপ্ত, ১৯৭৬ এর পর থেকে নিশীথ ভড়, সকলেই পা হড়কেছেন বাম রাজনীতির মোহে পড়ে নিম্নবিত্তের ডায়ালেক্ট আনতে গিয়ে, এমনকি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মহা শক্তিশালী কবিও। কিন্তু আমি একমত হতে পারি না। আমার বারেবারেই কী মনে হয় জানেন তো, প্রত্যেকটা দশকের কবিতা মানে সেই দশকের তরুণদের লেখা কবিতা। চোয়ালচাপা রাগী যুবকদের কবিতা। যে যুবক নির্জনে, সেও তো ক্রুদ্ধ! আর কিছু না হলেও অন্তত ভাষা নিয়ে ক্রুদ্ধ। ওই হিসেবেই ষাটের দশক যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বেলাল চৌধুরীর, সত্তর হলো মৃদুল দাশগুপ্ত, অমিতাভ মিত্রর। পা হড়কানোর হিসেবটা মুলতুবি রাখার পক্ষপাতী আমি, কারণ ভাষা নিয়ে এদের ক্রোধ আসলেই সৎ। এরাই হয়তো আশির দশকে গিয়ে মূল্যহীন হয়ে যাবে, কারণ আর তরুণ থাকবে না। নতুন দল আসবে। সে যাই হোক। যেটা বলতে চাইছি, অমিতাভকে লিখতে গেলে ওকে ওই সময়টার থেকে আলাদা করতে পারবেন না। ওর কবিতা থেকেও না। করা উচিতও নয়।’
‘রাজনীতিকে লেখায় খুব বেশি আনতে পারব না, পলিসিতে আটকাবে। কবিতার কথা আগেই বলেছি, পাঠক উৎসাহী হবে না। কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে, যেটা আমার নিজের। আমি এর আগে বাংলা কবিতা খুব বেশি পড়েছি এমনটা নয়। আপনার সঙ্গে কথা হবার পর ইন্টারনেট ঘেঁটে কিছু পেয়েছি। আজ ডিনারের আগে আপনার কালেকশন যা দেখলাম, ঈর্ষণীয়। আমার জ্ঞান তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। তবে দিল্লি যাবার আগে কলেজস্ট্রিট ঢুঁ মেরে কিছু বই তুলে নেব। কিন্তু তাতেও আমার জানা খুবই ওপর ওপর থাকবে। ব্যাপারটা আয়রনিক, কারণ প্রথমদিন বলেছিলাম যে ভুলে যাওয়া কবি লেখকদের প্রতি আকর্ষণ আছে। আপনি ভাবছেন সেটা কথার কথা। তা নয়। কিন্তু আমার বেড়ে ওঠার পরিমণ্ডলে বাংলা কবিতা, লিটল ম্যাগ এগুলো নিয়ে চর্চা হয়নি বলেই ঠিক ধরতে পারছি না।’
‘কিন্তু অমিতাভকে এক্সপ্লোর করতে হলে সেই সময়কার রাজনীতি, ভিন্নধারার সাহিত্য যা বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকার লেখালেখি বা পুজোসংখ্যার থেকে চরিত্রে আলাদা, সংবাদপত্র-শাসিত সাহিত্যের প্রতি অমিতাভদের কেন ক্ষোভ ছিল, সেখান থেকেই আমার প্রতি অভিযোগ এসেছিল কিনা, না কি ব্যক্তিগত রাগ, এগুলোর সম্ভাবনাও যদি দেখাতে হয়, তাহলে আপনার পাঠককে সেই সময়কার প্রেক্ষাপট কিছুটা হলেও বলতেই হবে। নাহলে কানেক্ট করতে পারবেন না।
আবার বুকশেল্ফের দিকে চোখ গেল। সারি সারি বাংলা কবিতার বই। অজস্র, জীবন্ত। পেটের কাছে কোন রহস্য ছুরির মতো উঁচিয়ে রেখেছে, জানি না।
‘শুধু রাজনীতি না, প্রতিশোধও একটা থিম, যেটা আপনাকে এক্সপ্লোর করতে হবে।’
‘প্রতিশোধ?’
‘বন্ধুবান্ধব রাজনীতি করতে গিয়ে খুন হয়ে যাচ্ছে, তার প্রতিশোধ কবিতায় ঘোষণা হবে না? ‘আমার বোনের বুকে বেঁধে নখ, তিনশ বছর আগে হেঁশেল ঘরের মধ্যে, লুকিয়ে দেখেছি সব, দাঁতে দাঁত, সেবার বাঁচিনি, আজ জানি, ভয় পাও বলে তুমি পুষেছ বন্দুক, ঐ দেখো ক্রমশ এগিয়ে আসছে ঘোলাজল, হেতালের গরাণের বন।’ গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার ডাক। এই প্রতিশোধের থিম ঘুরে ঘুরে এসেছে তখন।’
‘এ তো অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা’, হেসে ফেললাম এবার। ‘বোনকে ধর্ষণ করছে ভিলেন, হাত পা বাঁধা অবস্থায় ভাই দাঁতে দাঁত চেপে সে জিনিস দেখেছে, হয়তো খুনও হয়ে গেছে। তারপর পুনর্জন্ম হয়ে প্রতিশোধ নিতে এসেছে।’
বুঝলাম, অরুণ বিশেষ সন্তষ্ট হলেন না। ‘এত লঘু ভাবনা আজ পেছন ফিরে দেখলে মনে আসতে পারে, কিন্তু ওই সময়টা আপনারা দেখেননি, তাই হয়তো বুঝবেন না। মৃদুল আমাদের সময়কার মহত্তম কবি, শুধুমাত্র কাব্যভাষা বা শৈলীর জন্য নয়। ওই সময়ের ক্রোধ বেদনা আর উথালপাথাল, শোককে ওর মতো আর কেউ ধরেনি, এমনকি ওর থেকে প্রতিভায় উচ্চতর মানের কবিরাও। ‘আছি বাতাসের মতো, ও আমার মিষ্টি মা-মণি/আছি তোমার দু চোখে আজও কঠিন শীতল/ মানো না যে মরে গেছি, বোকা মেয়ে, এখনও মানোনি/তাই জেগে বসে থাকো, ভাবো এলো পলাশের দল’, এই চারলাইনের সমতুল্য কটা কবিতা লেখা হয়েছিল তখন? জানি, ওরা তখন কী ভাবত। ভাবত, প্রতিশোধ নেবার কথা। লিখত শোক, মৃত সন্তানের উদ্দেশ্যে পিতার তর্পণ লিখত। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, ওই সময় নিয়ে আমার কোনও উপন্যাস নেই অথচ নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জমজমাট মার্ডার মিস্ট্রি লিখতে পারতাম না কি? কিন্তু হাত ওঠেনি। ওই রাগ, ওই বেদনা, ওই হাহাকারকে কমার্সিয়ালাইজ করতে পারতাম না।’
‘তিনদিনের কথাবার্তায় যেটুকু দেখলাম, আপনি এই মুভমেন্টটা নিয়ে সহানভূতিশীল।’
‘হয়তো, কারণ আমাদেরই বন্ধুবান্ধবরা জড়িয়েছিল। কিন্তু আদর্শগত কোনো সংযোগ অনুভব করিনি। আমি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক মানুষ। রাজনীতি ততক্ষণ ইন্টারেস্টিং যতক্ষণ আমার লেখার উপাদান। তার বাইরে, ডান অথবা বাম কারোর সঙ্গেই আত্মিক বন্ধন নেই। কিন্তু ওই সময়কার অনুভূতি, আমার বন্ধুরা, তাদের প্রতি তো মায়া থাকবেই। মায়া রহিয়াই যায়।’ হালকা হাসলেন অরুণ।
‘এই কবিতাগুলো পড়ব। কিছুটা শুরুও করেছি। তবে আমার স্টোরিতে সেগুলো পেছনে থাকবে, বুঝতেই পারছেন। সামনে থাকবে হত্যারহস্য। কবিতার প্রসঙ্গ নানা রেফারেন্সে আসবে। ইংরেজি পাঠক এর থেকে বেশি হজম করতে পারবে না।’
‘যেটা মনে হচ্ছে,’আবার মুখ খুললাম, ‘আমাদের বাইরে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি পুরো ঘটনাটা জানে। সে চায় আমি এটার সমাধান খুঁজে বার করি। আপনাকে বলিনি। গতকাল রাত্রে আমাদের একটা জিপ অনুসরণ করছিল। তার আগের রাত্রে হোটেলের উলটোদিকের ল্যাম্পপোস্টের নীচে এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল আমার ঘরের দিকে তাকিয়ে। বলিনি, কারণ ব্যাপারটা বোকাবোকা শোনায় হয়তো আমিই ঝোপেঝাড়ে বাঘ দেখছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই রহস্যময় ব্যক্তি আমাকে মেসেজ করেছে।’
অরুণের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। ‘আমি জানতামই না এসব। বলেননি কেন? টিনা, আপনি চাইলে আমার গেস্টহাউসে এসে থাকতে পারেন। এবার চিন্তা হচ্ছে আপনার নিরাপত্তা নিয়ে।’
‘চিন্তা করবার কারণ কিছু ঘটেনি এখনও। কাজের সূত্রে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়াই। এর আগেও নানা ধরনের উটকো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। ঘাবড়াচ্ছি না। শুধু ভাবছি। কে হতে পারে এই রহস্যময় ছায়ামূর্তি? সে কি একা, না একাধিক
‘আপনার ড্রাইভার সঙ্গে থাকে না? সে কি বিশ্বাসী?’
‘বিশ্বাসী বলেই তো মনে হয়। কালকের পর আর ঝুঁকি নিইনি। আজ ওকে সঙ্গে রেখেছি।’ অরুণ সামান্য সময় ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘একবার ঋষি রোডের বাড়িটা দেখতে যেতে চাই। কবে যাবেন বলুন।’
‘কাল সকালবেলাই হতে পারে। আপনাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাব। ধরুন সাড়ে আটটা নাগাদ?’
‘বেশ। প্রস্তুত থাকব।’
সিদ্ধার্থ নেমে এসেছে। উঠে পড়লাম। বিদায় নিয়ে দরজা খুলে বাগানে এসে চমকে উঠলাম দুজন। বাইরে ঝড় হচ্ছে বুঝতেই পারিনি। সেই সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। একটা বড়ো গাছের ডাল ভেঙে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বাগানের একধারে। অরুণ পেছনে পেছনে আসছিলেন। ডাল দেখে তাঁর মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল, ‘একটা ডাল ভেঙে পড়া মানে গাছের সৌন্দর্য পুরো নষ্ট হয়ে গেল।’
‘এত ঝড় হচ্ছে, কিছুই বুঝিনি।’
‘মোটা কাচের ফ্রেঞ্চ উইন্ডো লাগিয়েছিলেন বাবা। আর বাকি দেয়ালের দুই ধারে ফোম লাগানো। পর্দা টেনে দিলে বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।’
কোনোমতে বৃষ্টি বাঁচিয়ে আমরা গাড়িতে উঠে পড়লাম। সিদ্ধার্থ নিজের বাড়ি যাবে। মদনদাকে বলে দিলাম, আমাকে হোটেলে ছেড়ে ওকে যেন ড্রপ করে দিয়ে আসে।
তুমুল বৃষ্টি, আর সেই সঙ্গে ঘন ঘন বজ্রপাত। আমাদের গাড়িটা সাবধানে পিচ্ছিল পথ দিয়ে নেমে এল নীচে। হোটেলে যখন পৌঁছালাম, চারপাশে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। সবে রাত নটা, কিন্তু শুনশান জনহীন শহরটা মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে কয়েক ঘণ্টায়। হোটেলের লাউঞ্জও প্রায় ফাঁকা। শুধু সেই বুড়ি মেমসাহেব বসে টিভিতে কার্টুন দেখছেন। আর সেই দম্পতির বাচ্চাটা একা একা খেলে বেড়াচ্ছে লাউঞ্জে। বাবা মা-কে দেখলাম না কোথাও।
‘একটু বসে যাবেন?’ একসঙ্গে ভাবলে জটগুলো ছাড়াতে সুবিধে হয়।
লাউঞ্জে বসে কফির অর্ডার দিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম মনে মনে। জটগুলো আস্তে আস্তে মাথার ভেতর ফিরে আসছে। সিদ্ধার্থ, ঋষি রোডের বাড়ির ছবিগুলো একবার দেখবেন? আপনার কী মনে হচ্ছে জানতে চাই।’
ফোন খুলে ছবিগুলো দেখালাম ওকে। সিদ্ধার্থ মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেয়ালের আঁকাটা দেখতে লাগল। প্রথম প্রশ্ন যেটা করল, ‘রংপেনসিল পেল কোথায়?’
‘মালিকের মেয়ের ঘর ছিল তো। হয়তো তার ব্যবহার করা রংপেনসিল এখানে ওখানে পড়ে ছিল তখনও।’
‘হুঁ।’ সিদ্ধার্থ আবার ছবিটা দেখতে লাগল। ‘একটা জিনিস দেখুন, অমিতাভ লেখাটা আর টুপির ছবি একই রং-এর, আর বাকি ফিগারগুলো অন্য রঙের। কেন?’
জানি না। আর টুপিটাই বা মাথার ওপর দিয়ে এভাবে আঁকা হয়েছে কেন? টুপির ভেতর দিয়ে মাথা দেখা যাচ্ছে।’
‘যে এঁকেছে, কাঁচা হাতের কাজ। আর একটা জিনিস খেয়াল করুন, মেঝে থেকে ছবির উচ্চতা তিন ফুটের বেশি নয়। মানুষ যখন দেয়ালে কিছু লেখে, নিজের চোখের উচ্চতায় লেখে। তাহলে এটা কি কোনো বাচ্চার কাজ?’
‘নাহ। ওই বাড়িতে বাচ্চা ছিল না। আর অমিতাভর ঘটনায় কোনো বাচ্চার প্রসঙ্গই ছিল না।’
‘তাহলে, একটাই বিকল্প পড়ে থাকে।
‘সেটা হলো, কেউ খাটের ওপর শুয়ে শুয়ে এঁকেছে। সাধারণ খাটের উচ্চতা দুই থেকে তিনফুটের বেশি হয় না।’
‘কেন? অন্তত বসে আঁকল না কেন?’
‘অসুস্থ ছিল?’
‘অমিতাভকে তাহলে বাদ দিতে হয়। অন্তত কোনো রিপোর্টেই অমিতাভর অসুস্থতা বিষয়ে কিছু পড়িনি।’
‘অমিতাভর হত্যাকারীকেও বাদ দিতে হয়। এত অসুস্থ যে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না, এদিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দার্জিলিং গিয়ে অমিতাভকে এতবার গুলি করবে, তার মৃতদেহ উপুড় করে দেবে, এবং তারপর অদৃশ্য হয়ে যাবে, এটা প্রায় অসম্ভব।’
‘যদি না এই ছবি অমিতাভর হত্যার বেশ কিছুদিন আগে আঁকা হয়ে থাকে। অথবা কিছুদিন পর।’
‘তার মানে, এই হত্যা পূর্বপরিকল্পিত হতে পারে। অথবা অমিতাভ যদি এঁকে থাকেন, তাহলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে খুন হবেন।’
‘সেই জন্যেই কি অমিতাভ উপন্যাসটা লিখতে শুরু করেছিলেন? কোনো সাংকেতিক বার্তা দেবার উদ্দেশ্যে? যাতে না থাকলেও এই লেখা পড়ে অপরাধীকে ধরা যায়?’
‘পুরোটা না পড়লে বোঝা সম্ভব নয়। আচ্ছা, যে মূর্তিটা গুলি করছে, তার এক হাতে বন্দুক, অন্য হাতে কী?’
‘বুঝতে পারছি না। দেখে মনে হচ্ছে বোতল।’
‘মদের বোতল? সেক্ষেত্রে আপনার কাকাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে হয়। তিনি মদ খান না।’
যদি কোনো প্রত্যক্ষদর্শী এই ছবি এঁকে থাকে, তাহলে বলতে হবে, টুপি পরা কোনো লোক মদ খেতে খেতে অমিতাভকে গুলি করেছে।’
‘সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল। কেউ রেনকোট পরে থাকতে পারে। তার মাথায় রেনকোটের হুড থাকতে পারে। ছাতাও থাকতে পারে। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে টুপি কেন পরে থাকবে? তাও আবার এরকম হ্যাট?’
‘তাহলে কি এটা হতে পারে যে এই বাড়ির ভেতরে কেউ এভাবে অমিতাভকে ভয় দেখিয়েছিল?’
‘কিন্তু তাহলে অমিতাভ থানায় গেলেন না কেন? পুলিশকে কেন জানালেন না?’
‘আরও একটা বড়ো প্রশ্ন, যেটা আমরা ভুলে যাচ্ছি। অমিতাভর নিজের আস্তানা ছিল। তিনি দুম করে এই বাড়িতে আসতে যাবেন কেন?’
‘আপনার কাকাই হয়তো ঠিক। সূত্র লুকিয়ে আছে অমিতাভর উপন্যাসে’, ভাবতে ভাবতে বললাম।
সিদ্ধার্থ উঠে পড়ল। ‘আমি বাড়ি গেলাম। দরকার পড়লে জানাবেন। কাল সকালবেলা হবে না, কিছু কাজ আছে। বিকেলবেলা ফাঁকা থাকব।’
‘কাল সকালে আপনার কাকাকে নিয়ে ঋষি রোডে যাচ্ছি।’
সিদ্ধার্থ উঠতে গিয়ে থেমে গেল। ‘কাকা যদি অমিতাভর হত্যাকারী হয়, তাহলে এই বাড়ির ব্যাপারে জানবে। জানবেই।’
‘কিন্তু বললেন যে জানেন না।’
‘তাহলে হয় কাকা হত্যা করেনি, আপনাকে তখন মিথ্যে বলেছিল। আর নয়তো…’
‘এখন মিথ্যে বলছেন।’ বাইরের কুয়াশার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় উত্তর দিলাম।
‘যদি কাকা হত্যাকারী হয়, তার মানে বুঝতে পারছেন? আপনি অপরাধীকে নিয়ে যাচ্ছেন সম্ভাব্য ক্রাইম স্পটের কাছে।’
‘জানি। আর এখনও বিশ্বাস করি, অরুণ চৌধুরীই হত্যাকারী।’