শেষ মৃত পাখি – ৩

সে কি রাত্রির শেষ মৃত পাখি, যার স্মৃতি আঁচড়াল 
মৃত্যুর ঘন ছায়ায় দেবযান 
ভয়ের মতন মৃদুসঞ্চারী স্বপ্নের পিছু নিতে? 
স্বপ্নের মত আয়ু চলে যায়, কখনো বা দ্রুত, কখনো বিলম্বিতে। 

—পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল

বছর ষাটেকের এক ভৃত্যস্থানীয় এসে দরজা খুলে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। পুরানো আমলের ড্রইংরুম। ওক কাঠের টেবিল। সোফাতে বসলে কয়েক ইঞ্চি ভেতরে ডুবে যাওয়ার অনুভূতি হয়। ইতিউতি গাঢ় রঙের ল্যাম্পশেড। ঘরের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে। দেওয়ালজোড়া সিলিংছোঁয়া আলমারি ঠাসা বই। উঠে গিয়ে বইগুলো দেখলাম। দুটো আলমারি ভর্তি ক্রাইমকাহিনী। শুধুমাত্র আগাথা ক্রিস্টি বা জন ডিকসন কারের মতো ধ্রুপদি লেখক নন। এমনকি ২০১৭ সালে প্রকাশিত ফরাসি বেস্টসেলার রহস্যোপন্যাসটিরও এক কপি সেখানে রাখা আছে। অর্থাৎ অরুণ চৌধুরী শুধুমাত্র গোল্ডেন এজ অফ ডিটেকটিভ ফিকশনেই আবদ্ধ নেই, সমসময়ে কী কী ঘটছে সেটাও তাঁর প্রখর চোখের বাইরে নেই। অন্য আলমারিগুলোতে বইগুলো বিষয় এবং অঞ্চলভিত্তিক সাজানো। ইংরেজি, আফ্রিকান এবং লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের তিনখানা আলাদা সারি। একটা আলাদা আলমারিতে শুধু বাংলা উপন্যাস। পরেরটায় বাংলা কবিতা। বাঁধানো লিটল ম্যাগাজিনের সারি। মনস্তত্ত্ব, সংগীত, অপরাধবিজ্ঞান, ইতিহাস, বৌদ্ধ দর্শন— লোকটা এত এত পড়ে, তাহলে লেখে কখন? 

ড্রইংরুমের প্রশস্ত ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর বাইরে ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া বাগান। দূরে গেট, সিকিউরিটির ঘর, যেখানে এখন টিমটিমে আলো জ্বলছে। কতখানি জায়গা নিয়ে এমন বাড়ি বানানো হয়, সামনে পেছনে কতটা ছাড়া হয়, বিশেষত যাকে প্যাটিও বলে, সেগুলো নিয়ে আমার বরাবরের কৌতূহল। সল্টলেকে কলেজ থেকে ফেরবার সময়ে এরকম অভিজাত একটি বাড়ির সামনে আমার গায়ের গতি শ্লথ হয়ে যেত। হাঁ করে বাড়িটার সাজানো ব্যালকনি, তার সুদৃশ্য টব, সামনের আলোকিত বাগান, বাহারি টালির দিকে তাকিয়ে ভাববার চেষ্টা করতাম কারা থাকে এরকম বাড়ির ভেতর। তারা কি খুব বড়োলোক হয়? পরে দিল্লিতে গিয়ে এই শ্রেণীটার সঙ্গে পেশাগত সূত্রে ওঠাবসা করতে করতে সেই বিহ্বল ভাবটা কেটেছে। এরকম বাড়িতেও প্রচুর গিয়েছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা লুকানো ইচ্ছে হয়তো মনের ভেতর থেকেই গিয়েছে, যে আমারও একদিন এরকম একটা বাড়ি হবে। 

.

‘এতক্ষণ ধরে জার্নি করবার পরে নিশ্চয়ই ক্লান্ত? কফি খাবেন?’ 

মৃদু গলায় বললেন কেউ। পেছনে ফিরে দেখি, সোফার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আকাশি জিন্স আর খাদির পাঞ্জাবি পরা এক প্রৌঢ়। ছবিতে বহুবার দেখলেও সামনে থেকে মুখের বলিরেখাগুলো বেশি স্পষ্ট বোঝা যায়। তথ্য অনুসারে, অরুণ চৌধুরীর জন্মদিন আঠোরোই মে, ১৯৪৭। কিন্তু বাহাত্তর বছর বয়েস সত্ত্বেও বৃদ্ধ না বলে প্রৌঢ় বললাম, কারণ দেখে ষাটের বেশি মনে হয় না কিছুতেই। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। শীর্ণ চেহারা। বিশেষ লম্বা নন, দোহারা। খাড়া নাক, পুরু ঠোঁট, গালে বহুকাল আগে হওয়া বসন্তের দাগ এখনও বিদ্যমান। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। দৃষ্টিতে একপ্রকার বিষণ্ণতা। অরুণ আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হাসি চোখ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। 

মুখোমুখি বসলাম। একটানা বসে থাকাকে যদি ধকল বলেন, তা কিছুটা গেছে। আমার কালো, দুধ চিনি কিছু চলে না। 

‘আমার স্ত্রী আজ সামান্য অসুস্থ, তাই নীচে এলেন না। কফিটা বানিয়ে ফেলি, তারপর বাকি কথা হবে। অমাদের বাড়িতে যে ছেলেটি সারাক্ষণের ফাইফরমাশ খাটে, সে এখনও কফিমেকার নামক বস্তুটির খুঁটিনাটি শিখে উঠতে পারেনি।’ 

ড্রইংরুমের পাশে খোলা রান্নাঘর। ড্রইংরুম আর রান্নাঘরকে অর্ধেকটা ভাগ করেছে একটা পাথরের স্ল্যাব। তার উপর কফিমেকার বসানো। দেখলাম, অরুণ তাড়াহুড়ো না করে সময় নিয়ে কফির মাপ নিলেন। জল ঢাললেন। মনে হচ্ছে, গভীর কিছু চিন্তা করছেন। সময় দিচ্ছেন নিজেকে। এই ধরনের মানুষ ঠিক কম কথা বলেন এমনটা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও, যত কথাই বলুন না কেন, এত মেপে মেপে এবং শান্ত স্বরে বলেন যে শেষমেষ মনে হয় অপরপক্ষই সবকিছু বলে গেল, আর তিনি শুনে গেলেন। পাশে সার সার কাপ রাখা। উঠে দুটো কাপ অরুণের হাতে দিলাম। অরুণ ভুরু কোঁচকালেন— ‘দুটো কাপের গড়ন এক নয়। একটা গোল, আর একটা চৌকো। বার বার বলেছিলাম গোবৰ্ধনকে, যেন না মিশিয়ে ফেলে। গোল কাপে কালো কফি ঢাললে একই আকারের চৌকো কাপের তুলনায় তাপ বিকিরণের মাত্রা বেশি হয়। ফলে কফি ঠাণ্ডা হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। দাঁড়ান, কাপ বার করছি।’ 

আমি অরুণকে নিজের কার্ড দিলাম। অরুণ কার্ডটা উলটে-পালটে দেখে মুখ তুললেন। 

‘আজকাল ফেসবুক বা লিঙ্কডইনের যুগে কারও সম্বন্ধে তো তথ্য জোগাড় করা কঠিন কিছু নয়। আমি হয়তো আপনার অনুমতি ছাড়াই কিছু জেনে ফেলেছি। সেগুলোর কিছুটা দরকারি, আবার সামান্য কিছুটা আপনার ব্যক্তিগত জীবন। সেই ব্যক্তিগত অংশটা জানবার দরকার ছিল না। কিন্তু চোখে পড়ে গিয়েছে। আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার বাড়িতে যিনি এতদিনের পুরোনো একটা ঘটনার তদন্ত করতে আসবেন, তাঁকে নিয়ে মনের মধ্যে একটা কৌতূহল ছিলই। আপনার আগের লেখাগুলোও পড়েছি। ইন্টারেস্টিং, ভালো লেগেছে।’ 

‘কী জেনেছেন আমার সম্বন্ধে?’ হেসে ফেললাম। ফেসবুকে স্টক করবার জন্য কাউকে এরকম ক্ষমা চাইতে দেখিনি এর আগে। 

‘তনয়া ভট্টাচার্য। ডাক নাম টিনা, যেটা বন্ধুমহলে বেশি প্রচলিত। বত্রিশ বছর বয়েস। ফেসবুকে জন্মসাল লেখা আছে। সম্ভবত একমাত্র সন্তান। বাবা-মা দুজনেই মারা গিয়েছেন। বাবা সম্ভবত বছর দুই আগে। এটা ঠিক বললাম কি? সল্টলেকে বাড়ি, যদিও ছোটোবেলার কিছুকাল কেটেছে বালিগঞ্জে। ছোটোবেলার দুই একটা ছবি ফেসবুকে পেয়েছি। সঙ্গে মন্তব্য। সেখানেই জানলাম, আপনার নেশা হলো সুডোকু আর পাজল সলভিং। এরপর লিঙ্কডইন। পড়াশোনা প্রেসিডেন্সি, তারপর জেএনইউ। বিষয় ইংরেজি। জেএনইউ থেকে বেরিয়ে কিছুকাল টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে সাংবাদিকতা করেছেন। তারপর এই ম্যাগাজিনে। গত বছর একটা পুরস্কার পেয়েছেন দেশের অমীমাংসিত রহস্যকাহিনীগুলো নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখে যাবার জন্য। ও হ্যাঁ, সম্পর্কের স্টেটাস ফেসবুকে আপনিই লিখে রেখেছেন, কমপ্লিকেটেড। ওটুকু বাদে, বলতেই হবে যে তনয়া ভট্টচার্য নিজের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে প্রাইভেট।’ 

কাপে সাবধানে কফি ঢাললেন অরুণ। একটা ফোঁটাও যেন বাইরে না পড়ে। লক্ষ করে দেখলাম, দুটো কাপে কফির পরিমাণ নিক্তিতে মিলিয়ে সমান। 

আপনি সোশাল মিডিয়ার ব্যাপারে বেশ উৎসাহী। এটা কিন্তু ইন্টারেস্টিং।’ কফির কাপে চুমুক দিলাম আমি। 

‘কেন? আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে উৎসাহী না হওয়াটাই কি বেশি অদ্ভুত ছিল না?’ 

‘না, মানে…’ 

‘বুঝেছি।’ মৃদু হাসলেন অরুণ, ‘আপনি হয়তো বয়েসের দিকে ইঙ্গিত করছেন। এই বয়সে এসে টিভি দেখা অথবা বই পড়া যত স্বাভাবিক, ফেসবুক করা ততটা না।’ 

‘না না…’ এবার সত্যিই লজ্জা পেলাম আমি। কারণ ইঙ্গিতটা বয়েসের দিকেই ছিল। 

‘লজ্জা পাবেন না তনয়া! আপনিই হয়তো ঠিক। আপনাদের মনে হয়, এই পৃথিবীতে বৃদ্ধরা আপনাদের সাজানো বাগানে অনুপ্রবেশ করছে। সম্ভবত সেটাই করছে। কিন্তু কী করব বলুন! আমাকে তো মানবচরিত্র সম্বন্ধে লিখতে হয়। একজায়গায় জড়ো হয়েছে এত হাজার হাজার বিভিন্ন চরিত্রের মানুষ, এরকম আর কোথায় পাব?’ গলায় একফোঁটাও তিক্ততা না মিশিয়ে, স্মিত মুখে বললেন অরুণ। 

আমার কী মনে হল, জানি না। বলে ফেললাম, ‘আপনি আমাকে টিনা বলে ডাকতে পারেন।’ 

‘বেশ। এবার তাহলে কাজের কথা হোক? আপনিই শুরু করুন।’ 

আপনি জানেন আমি কেন এসেছি।’ সোফায় বসে উত্তর দিলাম। 

‘অমিতাভ মিত্র হত্যারহস্যে মূল সন্দেহভাজনের বক্তব্য শুনতে চান, তাই তো?’ 

‘হ্যাঁ। একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই। তবে শুধু আপনিই না। এই কেসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন যে কেউ, যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের সঙ্গেও কথা বলতে চাই। কয়েকজনের নাম পেয়েছি। এর বাইরে আপনি যদি কারও কথা জানেন, তাহলে তাঁদের সঙ্গেও দেখা করতে চাই।’ 

অরুণ মাথা নীচু করে অন্যমনস্কভাবে কফির কাপে চামচ নাড়ালেন কিছুক্ষণ। কয়েক মুহূর্ত পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ তুললেন, ‘আপনার কাজ কমিয়ে দিতে পারি। আমি কনফেস করছি। অমিতাভকে আমিই খুন করেছিলাম।’ 

কয়েক সেকেন্ড দুজনেই চুপ। টিকটিক করে শুধু ঘড়ির কাঁটার শব্দ চলছে। চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, ঘরের ডানপাশে কাচের অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছের দল নিঃশব্দে সাঁতার কেটে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে বুদবুদ ছাড়ল একটা মাছ। বিজকুড়ি কেটে বুদবুদ ওপরে উঠছে। একটা ফাটল। অরুণ পুরু কাচের মোটা কালো ফ্রেমের চশমার আড়াল থেকে আমাকে লক্ষ করে যাচ্ছেন শান্ত চোখে। 

‘এটা তো ফোনেই বলতে পারতেন। আমাকে এখানে ডাকলেন কেন?’ 

‘পারতাম। কিন্তু তাতে কি আপনার সুবিধে হতো? শুধু আমি খুন করেছি, এটাই শুনবেন?’ হাসলেন অরুণ। ‘কীভাবে করলাম, কীভাবে পুলিশকে ধোঁকা দিলাম, সেটা শুনবেন না? আপনি তো আর পুলিশ নন যে অপরাধীকে প্রেপ্তার করলে দায়িত্ব শেষ। আপনাকে একটা গল্প বলতে হবে। তাই না? সেটা কি শুনতে চান না?’ 

‘এখন স্বীকার করছেন কেন? এতদিন পরে?’ অজান্তেই আমার হাত ফোনের রেকর্ডার অন করল। 

‘এখন ওটা থাক প্লিজ!’ আঙুল তুললেন অরুণ। আঙুল বাদে শরীরের একটা পেশিও কাঁপেনি তাঁর। গলার স্বর একইরকম মৃদু তারে বাঁধা, এবং ভঙ্গিটাও অনুরোধেরই। কিন্তু তবুও সেই আঙুল আর বলার ভঙ্গির ভেতর কোথাও একটা কাঠিন্য একঝলক দেখা দিয়েই— নিজেকে লুকিয়ে ফেলল আবার। রেকর্ডার অফ করে দিলাম। 

‘আগে বলুন, আপনি কতটুকু জানেন এই কেস নিয়ে।’ অরুণ চোখ বন্ধ করলেন। 

বাইরে কুয়াশা ঘন হয়ে এসেছে। এখন আর বাগানের গেট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কফিতে চুমুক দিয়ে উত্তর দিলাম, ‘যেটুকু জেনেছি, পুরোনো খবরের কাগজের কাটিং, আর পুলিশ আর্কাইভ থেকে।’ 

চোখ বুজেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন অরুণ। তারপর বাম হাত বুকের উপর আড়াআড়ি রেখে, তার উপর অন্য হাত দাঁড় করিয়ে গালের ভর দিলেন ডান হাতের মুঠোর উপর। 

‘অরুণ চৌধুরী আর অমিতাভ মিত্র, দুই ছোটোবেলার বন্ধু। অরুণ বড়োলোকের সন্তান। তাঁর পরিবারের চা বাগান আছে। অমিতাভ অনাথ। শিলিগুড়ির এক স্থানীয় গির্জার টাকায় চলা অনাথ-আশ্রমে মানুষ হয়েছিলেন। দুজনের আলাপ দার্জিলিং-এর সেন্ট পলস্ স্কুলে পড়তে এসে। অমিতাভ চার্চের কল্যাণে, বলা যায় কোটার সুবিধাতে, সেই স্কুলে চান্স পেয়েছিলেন। কাগজের প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের সূত্রপাত তখন থেকেই। স্কুলের পর অমিতাভ চলে যান সেন্ট জোশেফ’স্ কলেজে কমার্স পড়তে। অরুণ দার্জিলিং সরকারি কলেজে ইংরেজি নিয়ে ভর্তি হন। তখনও দুজনের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। অমিতাভ ছিলেন অন্তর্মুখী, পাগলাটে স্বভাবের। স্কুলজীবন থেকে কবিতা লিখতেন। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে অরুণ ছিলেন প্রিয়তম। সম্ভবত অমিতাভের প্রভাবেই অরুণ লেখালেখিতে আকৃষ্ট হন। কিন্তু অমিতাভ লিখতেন কবিতা, আর অরুণের ঝোঁক ছিল গোয়েন্দাকাহিনীর প্রতি। এসবই পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি সাল নাগাদ। অমিতাভর কবিতা তখন বাংলার অনেক লিটল ম্যাগাজিনেই প্রকাশিত হচ্ছে। সেই সুত্রে সেই সময়কার কবি-সাহিত্যিক মহলেও কিছুটা পরিচিত নাম হয়ে উঠছেন। আমি গবেষণার কাজে কয়েকটা বহু পুরোনো ম্যাগাজিনের কপি সংগ্রহ করেছিলাম সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগ লাইব্রেরিতে গিয়ে। দেখলাম, অমিতাভর রেঞ্জ বেশ বড়ো। কুচবিহারের ত্রিবৃত্ত পত্রিকা থেকে শুরু করে আসানসোলের কবিকণ্ঠবা কলকাতার ইমন, প্রায় গোটা বাংলা জুড়ে অমিতাভর কবিতা বিভিন্ন কাগজে বেরিয়েছে। বাংলা কবিতা বেশি বুঝি না, কিন্তু অদীক্ষিত চোখেও মনে হয়েছে যে অমিতাভ অন্যরকম কবিতা লিখতেন। অথবা এটাও হতে পারে যে সত্তর দশকের কবিতার মেজাজের সঙ্গে অমিতাভর চরিত্র মানানসই ছিল। 

‘এর মধ্যে দুজনেই কলেজ পাশ করেছেন। অমিতাভ পাশ করে বেরিয়ে দার্জিলিং- এর একটি হোটেলে কিছুকাল অ্যাকাউন্টের কাজ করেছিলেন, পরে ছেড়ে দেন। এমনিতেই তাঁর নানারকম পাগলাটে স্বভাবের কারণে পৃথিবীতে কোনো চাকরিই তাঁর জন্য বিশুদ্ধ ছিল না। এখানে ওখানে টিউশন পড়াতেন। আমার নিজের ধারণা যে বেশ কিছুকাল অরুণ অমিতাভকে অর্থসাহায্য করেছেন। অরুণ কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন দুবছরের জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাস করে দার্জিলিং ফিরে আসেন এবং পারিবারিক ব্যবসায় কিছুকাল জড়িয়ে পড়েন। সেটা ১৯৭০ সাল। অমিতাভ তখন পুরোদস্তুর কবিতায় মজে আছেন। ও হ্যাঁ, অরুণ যখন কলকাতায় পড়াশোনা করছেন, অমিতাভ সেই সময়কালে বেশ কয়েকবার কলকাতায় গিয়েছেন, অরুণের মেসে থেকেছেন, অন্যান্য কবিবন্ধুদের মেসেও। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয় সেই সময়কার তরুণ কবিদের। তাঁদের স্মৃতিচারণা বেরিয়েছে অনেক পত্র-পত্রিকায়, সেগুলোও বিভিন্ন সূত্রে জোগাড় করেছি। এঁদের সঙ্গে অরুণের বন্ধুত্ব ছিল কিনা, সেটা অবশ্য জানি না। ডিটেকটিভ গল্প-লেখককে কি লিটল ম্যাগাজিনের রাগী তরুণদের প্রজন্ম ব্রাত্যই করে রেখেছিল? 

‘যাই হোক, অরুণ পঁচিশ বছর বয়সে পৌঁছাবার আগেই একটি উপন্যাস লেখেন। ক্রাইমকাহিনী। একজন ছোটো প্রকাশকও পেয়ে যান। দুঃখের বিষয়, বইটি জনপ্রিয় হয়নি। বাংলা কোনো কাগজে আমি অন্তত এই বই নিয়ে আলোচনার কাটিং দেখতে পাইনি। এমনকি অরুণের নিজস্ব ওয়েবসাইটেও এই বইটার নামটুকুই মাত্র আছে। গল্পের সংক্ষিপ্তসারটুকুও নেই। হয়তো অরুণ বইটার কথা ভুলে যেতে চান। যাই হোক, বই বিক্রি কত হয়েছিল, জানি না। কিন্তু এরপর অরুণ দ্বিতীয় একটি বই বার করেন। সেটাও ফ্লপ করে। প্রসঙ্গত, এই দ্বিতীয় বইটা যে অরুণের নিজের টাকায় বেরিয়েছিল, সেটা তিনি নিজেই পরে নানা সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন। মোদ্দা কথা, গোয়েন্দা গল্পকার হিসেবে অরুণের জায়গা তখনও নড়বড়ে। এদিকে অমিতাভর কোনো বই তখনও না বেরোলেও টুকটাক কবিতা অথবা ছোটোগল্প এখানে ওখানে বেরোচ্ছিল। সবটাই অবাণিজ্যিক পত্রিকায় যদিও। দুজনের লেখার জগৎ ছিল বিপরীতমুখী। একজন নিরীক্ষকমূলক ভিন্নধর্মী কবিতা চর্চা করতে চাইছিলেন। অপরজন চাইছিলেন বাণিজ্যিক এবং বুদ্ধিদীপ্ত গোয়েন্দাগল্প লিখতে। 

‘১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলার একটি কাগজে তখনকার প্রতিশ্রুতিবান নতুন কবি ও লেখকদের একটা তালিকা আর তাঁদের সম্বন্ধে দু-চার কথা বেরিয়েছিল। সেখানে অমিতাভ-র নাম ছিল। কিন্তু অরুণের নাম ছিল না। সেটাই দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের চিড় ধরাবার প্রথম সূত্র কিনা, জানি না। হতেও পারে, কারণ সাহিত্য ছিল দুজনেরই ধ্যান-জ্ঞান। এই তালিকা যিনি প্রস্তুত করেছিলেন, বিখ্যাত সাংবাদিক সঞ্জয় অধিকারী, তিনি অমিতাভর পরিচিতির পাশে এটাও জানিয়েছিলেন যে কৃত্তিবাসের কবিকুলের পরের প্রজন্মের যে কয়েকজন শক্তিশালী কবি বাংলা সাহিত্যে এসেছেন, দেবারতি মিত্র, মৃদুল দাশগুপ্ত অথবা রণজিৎ দাশ— অমিতাভ মিত্র-র নাম তাঁদের পাশে থাকবার মতো শক্তিশালী। 

‘এই তালিকা নিয়ে কতখানি হইচই হয়েছিল সেটা আজ আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে এর পরেই অমিতাভর কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা এবং দুটি ছোটোগল্প প্রকাশিত হয়েছিল। তালিকায় পাচ্ছি কবিপত্র এবং ধানসিড়ির মতো লিটল ম্যাগাজিনের নাম। প্রথমটি কলকাতা থেকে বেরোতো, পরেরটি পশ্চিম মেদিনীপুর। এর আগেও অমিতাভর কবিতা অনেক পত্রিকাতে বেরিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কবিপত্রর মতো নামকরা কাগজের একমাত্র দীর্ঘ কবিতাটি অমিতাভ মিত্রর, এরকম আগে কখনো হয়নি। ভিড়ের অন্যতম মুখ থেকে তার মানে আস্তে আস্তে একক পরিচিতির জায়গা করে নিচ্ছেন। অনুমান করতে পারি, গোয়েন্দা- সাহিত্যকে সিরিয়াস সাহিত্য হিসেবে গণ্য না করবার প্রবণতা অরুণকে এই তালিকায় জায়গা দেয়নি। সাহিত্যিক অসাফল্য তো ছিলই।’ 

অনেকটা কথা বলবার পর গলা শুকিয়ে গেছে। কফির কাপ তুলে চুমুক দিলাম। অরুণ চোখ খুললেন। ‘আপনি সিগারেট ধরাতে পারেন যদি চান।’ 

‘আমার সিগারেট খাবার কোনো ছবি বা তথ্য ইন্টারনেটে নেই! 

অরুণ আবার হাসলেন, এবং আবারও চোখ অবধি ছড়িয়ে গেল হাসি। আঙুলের পাশের হলদে দাগ, কফি খাবার সময়ে নিজের অজান্তেই তর্জনি আর মধ্যমা একসঙ্গে করে ফেলা, বুড়ো আঙুল দিয়ে অন্য দুটোর ওপর বারে বারে ঘষা, এগুলোকে লুকোবেন কী করে! অস্বস্তি হচ্ছে সে তো বুঝতেই পারছি। আর আপনি ধরালে, আমিও একটা খেতে পারি। ডাক্তারের বারণ সত্ত্বেও ছাড়া কঠিন। 

সিগারেট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে সোজাসুজি তাকালাম অরুণের চোখের দিকে— ‘একটা ছোট্ট অবজার্ভেশন আছে। আপনি যেমন আমাকে লক্ষ করেছেন, আমিও করছি। যতক্ষণ কথা বলে গেছি, আপনার শরীরের একটা পেশিও কাঁপেনি। অথচ অল্প আগেই আপনি একটা খুনের স্বীকারোক্তি করেছেন। তার পরেও স্থির বসে গভীর মনোযোগ নিয়ে গল্পটা শুনে গেছেন, যদিও আপনার নতুন করে শোনবার কিছু নেই। এটা জেনেই শুনে গেছেন যে আমি এখান থেকে বেরিয়ে পুলিশে ফোন করতে পারি। এই শান্তভাব নিয়ে অমিতাভকে খুন করলেন কী করে? 

সাবধানে ছাই ঝাড়লেন অরুণ, অ্যাশট্রের ওপর লেগে থাকা ছাইয়ের গুঁড়ো আঙুল দিয়ে পরিস্কার করতে করতে উত্তর দিলেন, ‘এর আগে ভেবে দেখিনি। এখন চিন্তা করতে গেলে মনে হচ্ছে, মনটাকে ধ্যানী বুদ্ধের মতো শান্ত স্তরে নিয়ে যেতে না পারলে জটিল অপরাধ বোনা সম্ভব হয় না।’ তারপর আমার দিকে আবার গভীর দৃষ্টি মেললেন, ‘কেন জানি না মনে হচ্ছে আপনিও ক্রাইম- কাহিনীর পোকা।’ 

কী দেখে মনে হলো? পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা?’ 

‘না। আপনি যেটুকু দেখেছেন, সেটা সাধারণ একটা দেখা। প্রশ্নটাও যে কারও মাথাতেই আসতে পারত। কথাটা মনে হলো আপনার লেখাগুলো পড়ে, এবং এখন এতক্ষণ কথা বলে। ভুলও হতে পারি, কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে আপনি ইন্টারেস্টিং।ইন্টারেস্টিং, কারণ রহস্য-কাহিনীর ভক্তরা সকলেই আমার কাছে খুঁড়ে খুঁড়ে স্টাডি করবার মতো ইন্টারেস্টিং।’ 

হালকা হাসলাম, ‘ভুল। আমি খুবই বোরিং।’ 

অরুণ মাথা নাড়ালেন। ‘সেটাও ঠিক। বোরিং। বেশি হাসেন না। ড্রাই হিউমার আছে একটা। অল্পতেই ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেন। ভেতরে ভেতরে সিনিক। আবার অন্যদিকে সুডোকুর ভক্ত। একজন খুনির মুখোমুখি বসেও আপনার গলার স্বরের ওঠানামা হয় না। আপাতত এটুকুই আমার কাছে যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং।’চশমার ওপর দিয়ে শান্ত চোখ দুটো আমার দিকে নিবদ্ধ করলেন, আর এক গোছা নুন-মরিচ চুল ঝুলে পড়ল তাঁর কপালের ওপর। বুকের ভেতরটা শিরশির করে উঠল। বাবার এরকম চুল ছিল। 

‘কিন্তু আপনার গল্পটা আগে শেষ হোক। তারপর বাকি কথা।’ 

সিগারেটে আর একটা টান মেরে বলতে শুরু করলাম, ‘১৯৭৪ সালের পুজো সংখ্যাতে অরুণকে উপন্যাস লেখবার জন্য যোগাযোগ করে বাংলার একটি ছোটোখাটো মানের বাণিজ্যিক পত্রিকা। ব্যাপারটা অদ্ভুত, কারণ অরুণের বই বিক্রি হয়নি। প্রশংসাও পায়নি। অরুণ নিজেও, বাংলার বুদ্ধিজীবীদের বিচারে, সিরিয়াস সাহিত্য করেন না। তার পরেও এরকম একটা পত্রিকাতে সুযোগ পাওয়া, সে যতই বিক্রির হিসেব ছোটোখাটো হোক না কেন, এর মানে অন্তত অরুণের কাছে বেশ বড়ো ব্যাপার। এপ্রিল মাসে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোলো, কারা কারা লিখছেন। সেখানে অরুণের নামও ছিল। আর মে মাসের শুরুতে অমিতাভ মিত্র একটা বিস্ফোরক দাবি করলেন সঞ্জয় অধিকারীর কাগজে— অরুণের মতো বাজারি সাহিত্যিকেরা টাকা খাইয়ে পুজো সংখ্যাতে লেখার বরাত পায়। 

‘অরুণ যে পত্রিকায় লেখার বরাত পেয়েছিলেন, সেই পত্রিকাটি একটি কাগজের গ্রুপের অধীনে ছিল। সঞ্জয়ের কাগজ ছিল তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। সঞ্জয় তখন অন্যান্য খবরের পাশাপাশি সাহিত্যের পাতাও দেখতেন। একটা খবর করেছিলেন, যার বিষয়বস্তু ছিল- বাণিজ্যিক পত্রিকার ফরমায়েশি সাহিত্য লিটল ম্যাগাজিনের সিরিয়াস লেখাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয় না, এই অভিযোগের সারবত্তা কতখানি। সেখানে বিখ্যাত এবং অবিখ্যাত নানা সাহিত্যিকের মতামত ছিল। লিটল ম্যাগাজিনের তরুণ প্রজন্ম রাগী গলায় কথা বলবে সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু অমিতাভ যেটা করলেন সেটা কেউই ভাবতে পারেনি। অমিতাভ একেবারে অরুণের নাম করে অভিযোগ করলেন। সঞ্জয়ের প্রতিবেদনে রার্বের মধ্যে বড়ো হরফে প্রকাশিত হলো অমিতাভর সেই উক্তি। 

‘আমি লিটল ম্যাগাজিন জগৎ সম্পর্কে যতটুকু জানি… এখানে অন্যধারার সাহিত্য যাঁরা করেন, তাঁদের অনেকেই বাণিজ্যিক পত্রিকার বিগ হাউজ সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন। সেটার কারণ কিছুটা নীতিগত, আবার কিছুটা ব্যক্তিগতও বটে— তাঁদের লেখা ছাপানো হয় না সেটাই হয়তো ব্যক্তিগত রাগের একটা কারণ থাকে। সবার লেখাই তো সমান বাজারজাত হয় না। অমিতাভর ক্ষোভটা এই দ্বিতীয় সারিতে থাকবে। কারণ তিনি সরাসরি বলেছিলেন যে ক্ষমতাবান সাহিত্যিক হয়েও তিনি কখনও ডাক পান না। আর অরুণ চৌধুরী অর্থ, এবং অন্যান্য উপঢৌকনের বিনিময়ে নিজের অন্তঃসারশূন্য সাহিত্যকে বিশাল সংখ্যক পাঠকের বাজারে তুলে ধরতে পারেন। এই অভিযোগটা সিরিয়াস, এবং লিটল ম্যাগাজিনের এ যাবৎকাল চলে আসা অভিযোগগুলোর তুলনায় চরিত্রগতভাবে আলাদা। কারণ এখানে সাহিত্যের নীতি নয়, প্রশ্ন তোলা হচ্ছে কর্পোরেট হাউজের স্বচ্ছতা নিয়েই। কাজেই এটা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা হইচই হতোই। এবং হলো। অমিতাভর এই অভিযোগ বাংলা সাহিত্যের পানাপুকুরে সুনামি আনতে পারেনি, তবে কয়েকটা ছোটোখাটো ঢেউ তুলেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অন্নদাশংকর রায়, অনেক সাহিত্যিকই অমিতাভর পক্ষে বিপক্ষে নানা রকম মতামত রাখলেন। সঞ্জয় অধিকারী অমিতাভর ছবি সহ একটা সাক্ষাৎকার নিলেন। অরুণের যেটা লাভ হলো, তাঁকে এতদিন পাঠকমহলে প্রায় কেউই চিনত না, এবার অনেকেই চিনে গেল। আর যেটা ক্ষতি হলো, সাহিত্যপত্রিকাটি কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘোষণা করে দিল যে অরুণ চৌধুরী এবং অমিতাভ মিত্র, কারও লেখাই তারা আর ছাপাবে না, যতদিন না এই বিতর্কের পূর্ণ মীমাংসা হচ্ছে। 

‘অনুমান করতে পারি, অরুণের তখনকার মনের অবস্থাটা। যে-সাফল্য এতদিন ধরে তাঁর অনাঘ্রাত ছিল, সেটা যখন হাতের মুঠোয় আসব আসব করছে, এক অজ্ঞাতকুলশীল কবির অভিযোগে সারাজীবনের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেল। সেই সময়ে অরুণকে বেশ কিছুদিন নাকি জনসমক্ষে দেখা যায়নি। নিজের বাড়ি থেকে বেরোননি। আর এর মধ্যেই প্রকাশিত হলো অমিতাভর লেখা একটি ছোটো উপন্যাস। শোনা যায়, বাংলার এক নামকরা প্রকাশক নাকি দার্জিলিং-এ গিয়ে অমিতাভর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। চেয়েছিলেন চুক্তিপত্র করতে। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায়নি মনে হয়। কারণ উপন্যাসের প্রকাশক হিসেবে অন্য একটা নাম পাচ্ছি, ছোটো পাবলিশিং হাউজ। সরাসরি পাণ্ডুলিপি থেকে উপন্যাস। প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে, পুজোর আগে আগে। ব্যাপারটা বেশ আয়রনিক। অরুণের উপন্যাস বেরবার কথা ছিল, তার বদলে বেরল অমিতাভর উপন্যাস। শুধু সেটাই নয়, উপন্যাসটা কিছুটা প্রশংসাও পেয়েছিল। কয়েকটা ম্যাগাজিনে আলোচনা হলো বইটা নিয়ে। যদিও আমার ধারণা, অমিতাভ এই বিতর্কটা তৈরি না করলে নতুন লেখকের প্রথম বইয়ের দিকে কেউ ফিরেও তাকাতো না। সে যত ভালো লেখাই হোক না কেন। 

‘১৯৭৫ সালের জুন মাসে ঘটল সেই ঘটনা।’ 

আমি চারপাশে তাকালাম। এই বাড়িতে। হয়তো এই ঘরে, যেখানে বসে আছি সেই জায়গাটাতেই। অরুণ চৌধুরী পাথর। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না কী ভাবনা চলছে ভেতরে। 

‘অরুণ আর অমিতাভ — একজন অবহেলিত অবস্থা থেকে উঠে এসে বাংলা সাহিত্যের নতুন আবিষ্কার। অপরজন প্রচুর স্ট্রাগল করেও আস্তে আস্তে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন। অমিতাভর উত্থান দেখে অরুণ মনে মনে কী ভাবতেন, সেটা আজ আর জানা যাবে না। কিন্তু অরুণ নাকি ঘনিষ্ঠমহলে বলেছিলেন যে তিনি লেখা ছেড়ে দেবেন। অপরদিকে, শোনা যাচ্ছিল অমিতাভর সঙ্গে পরপর তিনটি বইয়ের চুক্তি করেছে তাঁর প্রকাশক। সেটার সত্যি মিথ্যে অবশ্য জানি না। কিন্তু জুন মাসের এগারো তারিখে অরুণ কেন অমিতাভকে তাঁর এই বাড়িতে ডেকেছিলেন, সেটার কারণ অজ্ঞাত। আর কেনই বা রাত সাড়ে নটার সময়ে বাড়ি থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এল, সেটারও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। 

‘অরুণের পুলিশি জবানবন্দি অনুযায়ী সেদিন তাঁর বাড়িতে অমিতাভ আসেনইনি। এসেছিলেন চা-বাগানের এক শ্রমিক নেতা, প্রশান্ত গুরুং। বাগানের শ্রমিক অসন্তোষ বিষয়ে কথা বলতে। গুলি ছোটার ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেছিলেন যে লেবার আনরেস্ট বিষয়ে উত্তেজিত তর্ক-বিতর্ক করবার ফাঁকে অরুণ হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিলেন এবং গুলি ছুটে যায়। এবার, এই প্রশান্ত গুরুং-এর জায়গাটা জটিল, এবং পুলিশ এটা নিয়ে এখনো ধাঁধায়। এই বিষয়ে পরে আসছি। গল্পের খাতিরে আপাতত ধরে নিচ্ছি যে অমিতাভই এসেছিলেন অরুণের সঙ্গে দেখা করতে। কিছুদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল, এবং সেই রাত্রেই একটা ল্যান্ডস্লাইড হয়। দার্জিলিং বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সমতলের থেকে। কিন্তু তার আগেই অরুণের বাড়ি থেকে গুলির শব্দ শোনা গিয়েছিল। জলাপাহাড় রোডে এই বাড়ির লাগোয়া যে কটেজটি আছে, তার বাসিন্দা মিসেস বাসুর বিবরণ অনুযায়ী, অমিতাভ ছুটতে ছুটতে অরুণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন এবং নীচের দিকে নামতে থাকেন। তাঁর হাত থেকে রক্ত পড়ছিল। পেছন পেছন আসেন অরুণ। তাঁর হাতে একটা রাইফেল ঝুলছে। অরুণ কয়েকবার অমিতাভর নাম ধরে চিৎকার করেন। কিন্তু অমিতাভ পেছন না ফিরে নীচে নেমে যান। অরুণ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার ফিরে এসে গেট বন্ধ করে দেন। 

‘সেদিন মাঝে মাঝেই বৃষ্টি পড়ছিল। কখনও হালকা, কখনও মুষলধারে। যখন গুলি চলে সেই সময়ে মুষলধারে না হলেও ভালোই বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই বৃষ্টির মধ্যে অমিতাভর রক্তপাত দূর থেকে দেখতে পাবার কথা নয়। কিন্তু মিসেস বাসু দেখতে পেয়েছিলেন কারণ ওই সময়টায় তিনি বারান্দায় বসে থাকতেন নৈশাহারের পর। আর তখন বাগানের আলো উজ্জ্বলভাবে জ্বলছিল। মিসেস বাসু শেষদিন পর্যন্ত দাবি করেছেন যে অরুশ অমিতাভর নাম ধরে চিৎকার করছিলেন, এবং প্রশাস্ত গুরুং নামের কোনো নেপালি মানুষকে তিনি দেখেননি। যার হাত দিয়ে রক্ত পড়ছিল, তার বাঙালি চেহারা। এটাও বলেছিলেন যে অরুণের হাতে রাইফেল ছিল। সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে প্রশান্ত গুরুং আসার ঘটনাটা মিথ্যে। আপাতত ধরে নিচ্ছি যে অমিতাভর হাত থেকে রক্ত পড়ছিল। বাগানের গেটের আলো অমিতাভর মুখের ওপর এসে পড়ছিল, তাঁর পেছন পেছন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন অরুণ। অমিতাভর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে। অমিতাভ সাড়া না দিয়ে এক হাত দিয়ে অন্য হাত চেপে ধরে ছুটে গেলেন। অরুণ ভেতরে চলে এলেন। তখন রাত সাড়ে নয়। ন-টা পঁয়ত্রিশে থানায় ফোন করলেন মিসেস বাসু। পুলিশ এল দশটা নাগাদ। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে। অরুণ পুলিশকে দেখে অবাক হননি। কিন্তু অমিতাভর নাম শুনে অবাক হয়ে যান। কারণ তিনি ভেবেছিলেন প্রশান্ত গুরুং-এর ঘটনায় তাঁর বাড়িতে পুলিশ এসেছে। অরুণ জানালেন যে কথা কাটাকাটি থেকে ধস্তাধ্বস্তিতে গুলি বেরিয়ে গেছে কিন্তু কেউ আহত হয়নি। অমিতাভ আসেনইনি। আর অরুণও অমিতাভর পেছন পেছন ছোটেননি। তাহলে কি মিসেস বাসু মিথ্যে বলছেন? সামান্য প্রাথমিক তদন্তের পরেই কিন্তু পুলিশ বাগানের ঘাসের ওপর কিছু পায়ের ছাপ আর রক্ত খুঁজে পেল। রক্তের রেখা চলে গেছে গেট অবধি, তারপর বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। এ ছাড়াও অরুণের হাতে দুটো টাটকা আঁচড়ের দাগ পেল তারা। যেন ধস্তাধস্তিতে আঁচড়া-আঁচড়ি হয়েছে। যদিও অরুণের কথামতো গুলি চলেছিল বাড়ির ভেতর, এবং তাতে কেউ আহত হয়নি। পরে প্রশান্ত গুরুং-ও সেই বক্তব্যকে সমর্থন করেন। তাহলে বাগানের ঘাসে রক্ত আর অরুণের হাতে আঁচড়ের দাগ? পুলিশ অরুণকে আটক করল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। বৃষ্টিতে পায়ের ছাপ যাতে ধুয়ে না যায়, তার জন্য থানা থেকে একটা ছাউনি নিয়ে এসে বাগানের উপর টাঙিয়ে দেওয়া হল। অরুণের কথাবার্তার মধ্যে আরও নানা অসংগতি খুঁজে পেল পুলিশ। তারা সিদ্ধান্ত নিল, অমিতাভকে খুঁজে বার করবে। সেই সঙ্গে প্রশান্তকেও। কিন্তু সেই রাত্রেই প্রবল বৃষ্টিতে ল্যান্ডস্লাইড হলো। অমিতাভ বা প্রশান্ত গুরুং কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারল না পুলিশ। শেষরাতে অরুণকে পুলিশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। পরের দুইদিন ধরে অমিতাভর খোঁজ পাওয়া গেল না। সে বেশ কিছুদিন আগেই শহর ছেড়ে দিয়েছিল। থাকত একটি স্থানীয় গ্রামে ঝুপড়ি ভাড়া করে। সেখানে কখনও থাকত, কখনও থাকত না। রাত্রিবেলা আকণ্ঠ মাতাল হয়ে ঘরে ফিরত। গ্রামবাসীদের সঙ্গেও আলাপ পরিচিতি ছিল না, কারণ সারা দিন ধরে ঘুরে বেড়াত এখানে ওখানে, উদ্দেশ্যহীনভাবে। সন্ধেবেলায় হয় কোনো সস্তা মদের ঠেকে পড়ে থাকতো, আর নাহলে ঘরের দরজা বন্ধ করে পাগলের মতো লিখতো। গ্রামে গিয়ে দেখা গেল ঝুপড়িতে তালা দেওয়া। ছবি দেখানো হলো এদিক- ওদিক। কেউ কিছু বলতে পারল না। তখন সমতল থেকে পুলিশের কুকুর আনতে হতো। হিলকার্ট রোড পরিষ্কার হতে গোটা একদিন লেগে গেল। তার আগে কিছুই করা গেল না। 

‘দু-দিন পরে তেরোই জুন পুলিশের কুকুর এল। আধবেলার মধ্যেই পাওয়া গেল অমিতাভর লাশ। কার্ট রোডে সাহেবদের পুরোনো গোরস্থানের পেছন দিকটায় একটা বড়ো পাথরের ফলকওয়ালা সমাধির পেছনে পড়েছিল অমিতাভ। মুখ বলে কিছু ছিল না। ব্যালিস্টিক রিপোর্ট বলছে, কাছ থেকে মুখে দুবার গুলি করা হয়েছিল। আর একটা গুলি লেগেছিল বুকে। ফুসফুস ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। আর চতুর্থটা বাম হাতে। সময়ের হিসেবে দেখলে অবশ্য বাম হাতের গুলিটাই প্রথম গুলি। কারণ মিসেস বাসুর জবানবন্দি অনুযায়ী সেটা অরুণের বাড়িতে লেগেছিল এবং সে গুলি লাগার পরেও অমিতাভ জীবিত ছিল। অমিতাভর রক্তের সঙ্গে অরুণের বাগানের ঘাসে পড়ে থাকা রক্ত মিলে গেল। যেহেতু মুখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, লাশ সত্যি অমিতাভর কিনা তা নিয়ে ধন্দে ছিল পুলিশ। প্যান্টের হিপ-পকেটে কিছু হাবিজাবি কাগজ বাদে আর কিছু মেলেনি। সেই কাগজগুলো আবার বাংলায় লেখা। কয়েকটা আধখ্যাচড়া কবিতার খসড়া, ধোপার বিল, প্রকাশকের কাছে পাওনা টাকার হিসেব। নাম ধাম কিছু ছিল না। ফোর্সের মধ্যে বাংলা পড়তে পারে এমন পুলিশ ছিল। সম্ভবত একজন অফিসার, তাঁর নাম রিপোর্টে উল্লেখ নেই, তাঁর ওই কবিতার খসড়াগুলো দেখে সন্দেহ হয়েছিল লাশ অমিতাভর হতেও পারে। কারণ তিনি অরুণকে জেরায় জেনেছিলেন যে অমিতাভ কবি। পুলিশ অরুণকে থানায় নিয়ে এল আবার। অরুণ বলেন যে তিনি নিশ্চিত নন, কারণ মুখ বলে কিছু ছিল না। তবে অমিতাভ হবার সম্ভাবনাই বেশি। সেই রাত্রে জেলা হাসপাতালের মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করলেন সঞ্জয় অধিকারী। তিনি খবর পেয়ে ঘটনাটা কভার করতে সেইদিনেই দার্জিলিং চলে এসেছিলেন। এ ছাড়াও অমিতাভ যে অনাথ-আশ্রমে মানুষ হয়েছিল, তার যাজক ফাদার স্যামুয়েলসও শনাক্ত করলেন। অমিতাভর ডেরাতেও হানা দিল পুলিশ। সেখনে পড়ে থাকা চিঠিপাত্র, লেখালেখি এবং অমিতাভর পকেট থেকে পাওয়া কাগজের হাতের লেখা মেলানো হলো। লাশের ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে অমিতাভর ঘরে ছড়িয়ে থাকা হাতের ছাপও মিলে গেল, এবং আর সংশয় থাকলো না। 

‘তুমুল হইচই পড়ে গেল চারদিকে। প্রতিদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় তখন এই খবর। সাহিত্যিক খুন, তাও আবার প্রতিশ্রুতিবান তরুণ কবি, মাত্ৰ ঊনত্রিশ বছর বয়েসে খুন হলেন, হয়তো নিজের বন্ধুর হাতে, ব্যাপারটা এতই অভিনব যে বাংলার কাগজগুলোতে তখন এই খবর হটকেকের মতো বিক্রি হয়েছিল। যে অমিতাভকে একটা নির্দিষ্ট ছোট্ট বৃত্তের বাইরে কেউ চিনত না, তিনি ধীরে ধীরে কাল্ট হয়ে উঠলেন। তাঁর পসথুমাস কবিতা ছাপল পরমার মতো কাগজ, ১৯৭৯ সালে তাঁকে নিয়ে ক্রোড়পত্র করল কুচবিহারের কবি স্বপনকুমার রায়ের অন্যস্বর পত্রিকা। এমনকি নাকি এটাও ঘটেছিল যে ১৯৭৬ সালের ১১ই জুন, অমিতাভর মৃত্যুদিন উদযাপন করতে কলকাতা থেকে দার্জিলিং এসেছিলেন তাঁর কিছু সাহিত্যিক বন্ধু এবং কবরখানায় মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁরা অমিতাভকে স্মরণ করেছিলেন। এই ঘটনাটা সত্যি কিনা আপনি কনফার্ম করতে পারবেন। যাই হোক, এসবই পরের দিককার ঘটনা, যখন আসল রহস্যের উত্তেজনা থিতিয়ে এসেছে। তার আগে, ৭৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে যে চাঞ্চল্য ছিল, তার চরিত্র সাহিত্যগত যত না, তার থেকে বেশি ক্রাইমকাহিনীর রোমাঞ্চের সঙ্গে সংপৃক্ত। সঞ্জয় অধিকারী টাটকা এবং সেনসেশনাল রিপোর্ট পাঠাবার সূত্রে তখন ঘরে ঘরে পরিচিত নাম হয়ে উঠছিলেন। পুলিশ প্রথমে বুঝতেই পারছিল না, কাকে গ্রেপ্তার করবে। কারণ অরুণের মোটিভ কী, সেটা তারা তখনও জানত না। সঞ্জয়ই পুলিশকে অরুণ আর অমিতাভর সাম্প্রতিক শত্ৰুতা, এবং অমিতাভর কারণে অরুণের লেখালেখিতে ক্ষতি হয়ে যাবার ব্যাপারে জানালেন। বদলা নেবার যথেষ্ট শক্তিশালী মোটিভ থাকার কারণে অরুণকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। কিন্তু অরুণ অটল থাকলেন এই বক্তব্যে যে তিনি নির্দোষ তাঁর বাড়িতে অমিতাভ আসেননি। বারো দিনের মাথায়, মানে ২৪ জুন, অরুণকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো পুলিশ। কারণ হিসেবে বলা হলো, অরুণের বিরুদ্ধে এমন কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যার ভিত্তিতে চার্জশিট বানানো যাবে।’ 

আর একটা সিগারেট ধরালাম। ‘এই জায়গাটা অস্পষ্ট। অরুণকে পুলিশ কেন ছেড়ে দিল। বলা হয়েছিল যে অরুণের অ্যালিবাই আছে। ময়নাতদন্তে খুন হবার যে সময়টা শনাক্ত করা হয়েছে, তখন অরুণ থানায় বসে ছিলেন। আমার কাছে অস্তত এই অ্যালিবাই ভাসাভাসা। সেই সময়ে অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন যে এর পেছনে প্লান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং অর্থের কিছু চাপ থেকে থাকবে, যেহেতু অরুণের পারিবারিক চা বাগানের ব্যবসা ছিল। কিন্তু এখনও অরুণকে বহু মানুষ অমিতাভর খুনি হিসেবেই বিশ্বাস করেন। 

কথা শেষ হবার পরেও অরুণ নীরব থাকলেন বেশ কিছুটা সময়। তারপর লম্বা নিশ্বাস ছাড়লেন, ‘আপনি ভালোই গবেষণা চালিয়েছেন। কোনো খাতা বা বই 

না দেখে যেভাবে গড়গড় করে বলে গেলেন, বোঝা যাচ্ছে বহুবার পড়েছেন। এতদিন আগেকার ঘটনা এভাবে খুঁড়ে বার করে আনা সহজ কাজ নয়। কিন্তু তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?’ 

‘এসেছি, কারণ আপনার ভার্সন আমি শুনতে চাই। যদি আপনি সত্যিই খুন করে থাকেন, তাহলে সেটা কেন, আর কীভাবে, সেই নিয়ে জানতে চাই। দ্বিতীয়ত, পুলিশের রিপোর্টের ওপর আমার ভরসা নেই। মোটিভ এবং অ্যালিবাই সম্বন্ধে যা যা বলেছে, তার কোনোটাই বিশ্বাসযোগ্য কি? আপনি পেশাগত ঈর্ষা থেকে খুন করতেই পারতেন। কিন্তু এই তত্ত্ব বেশ দুর্বল। এছাড়াও এই গল্পে বহু প্রশ্নের উত্তর পাইনি, এবং পুলিশও অদ্ভুতভাবে সেগুলো পারস্যু না করেই ছেড়ে দিয়েছে। এক এক করে সেগুলো তুলে ধরব, এবং আপনি যতটা জানেন উত্তর দেবেন। এই প্রশ্নগুলোর ওপরে লেখার ভিত দাঁড়িয়ে আছে।’ 

‘মোটিভ দুর্বল, কেন বলছেন?’ 

‘কারণ আপনার সারা জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়নি। আর অমিতাভও বিরাট বড়ো লেখকে পরিণত হননি। অমিতাভর উক্তি এবং তারপর সাহিত্যজগতে একঘরে হওয়াটা সাময়িক সেটব্যাক ছিল মাত্র। হয়তো হতাশার চোটে বন্ধুবান্ধবকে বলে থাকবেন যে আর লিখবেন না। সে আমরাও অফিসে বসের কাছে বকা খেয়ে হামেশাই বলি যে চাকরি ছেড়ে দেব। কিন্তু আপনি চাইলে লিখতেই পারতেন। বইও বার করতে পারতেন। আপনার আগের বইগুলোও ফ্লপ ছিল। তার থেকে আর কত খারাপই বা হতে পারত? দ্বিতীয়ত, ঈর্ষা হতে পারত যদি অমিতাভ অনেক উঁচুতে উঠে যেতেন। কিন্তু তিনি তখনও নতুন লেখক। একটাই উপন্যাস সবে বেরিয়েছে। হয়তো কিছু প্রশংসাও পেয়েছে। তাতে কি তাঁকে ঈর্ষা করবার মতো কিছু হয়ে গেল? তাহলে তো আপনার সম্পদশালী পরিবারকে অনাথ অজ্ঞাত অমিতাভর দশ বার খুন করবার কথা। আর তার থেকেও বড়ো যেটা ব্যাপার, আমরা ভাবি খুন করা অতীব সহজ। প্রফেশনাল ঈর্ষা হলেই সঙ্গে সঙ্গে কেউ কাউকে খুন করে দিতে পারে। একটা জীবন্ত বস্তুকে মেরে ফেলা অতটা মুখের কথা নাকি? মানুষ ছেড়ে দিন। একটা সাপকে পিটিয়ে মারতে পারবেন?’ 

‘পারব না।’ বলে কিছু চিন্তা করলেন। তারপর যোগ করলেন, ‘একটা সাপ বা একটা কুকুর, এদের গুলি করা সোজা নয়, কারণ এদের অসহায়তা আমাদের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে কি সেই যুক্তি খাটে?’ 

‘আমার সিরিজের তৃতীয় গল্পটা যদি পড়েন, নাসিকের শিভালকর পরিবারের জোড়া হত্যা রহস্য। একই পরিবারের কুড়ি বছর বয়সি মাধুরী শিভালকর এবং তার মা খুন হয়েছিল। অপরাধী অজ্ঞাত। ঘটনাটা অষ্টআশি সালে ঘটেছিল। পুলিশ প্রথমে আটক করেছিল প্রতিবেশী পরিবারের এক যুবককে। কারণ সেই যুবক, শংকর কুণ্ডে, তার সঙ্গে মাধুরীর প্রেম ছিল। মাধুরীর মা এই প্রেমে বাধা দেন এবং মাধুরীর বিয়ে ঠিক করেন এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। শংকর বেকার ছিল। তাই মাধুরীও বিয়েতে শেষমেষ মত দেয়। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের তত্ত্ব ছিল যে ঈর্ষাজনিত কারণে শংকর মাধুরী ও মাধুরীর মা-কে খুন করেছিল। যাই হোক, শংকরকে পুলিশ পরে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, কারণ তার জোরালো অ্যালিবাই প্রমাণ করা গিয়েছিল।’ 

‘শংকর কুণ্ডে এখনও বেঁচে আছেন। আমি তাঁর ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। একটা জায়গায় অদ্ভুত একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি খুন করতে চেয়েছিলাম। আর তার জন্য চেয়েছিলাম আমার ঈর্ষা, হিংসে, ঘেন্না যতটা পারা যায় বেশি হোক। প্রতিদিন রাত্রে নিজের খোলিতে শুয়ে শুয়ে মনের ভেতর নানাভাবে নিজের অবস্থার সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারের অবস্থার তুলনা করতাম। আস্তে আস্তে রাগ হতো। ভয়ংকর ঈর্ষায় অবশ হয়ে যেত মন। তখন দেখতে পেতাম, মাধুরীর ওপর আমি অত্যাচার করছি। ওর মায়ের শরীর টুকরো টুকরো করে কাটছি। এই দেখাটার জন্যই ভেতরের হিংসেটাকে আমাকে জাগিয়ে তুলতে হতো প্রতি রাতে।’ জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তারপর?’ ‘তারপর আর! ঘুমিয়ে পড়তাম। আবার সকাল হতো। আবার নতুন একটা দিন। আবার রাত আসত। আবার নিজেকে জাগাতে হতো।’ ‘তাহলে খুনটা করলেন না কেন?’ কী করে করব? প্রতি রাত্রে অপেক্ষা করতাম যে ভয়ংকর ঈর্ষা আমাকে চালিয়ে নিয়ে যাক। বাইরে বার করুক। হাতে একটা চাকু তুলে দিক। কিন্তু এতটাই অবশ আর অবসন্ন লাগত যে সেই পর্যায় অবধি হিংসে পৌঁছতই না।’ 

একটা টান দিলাম সিগারেটে— ‘খুন করবার মতো ঈর্ষা গাছের পাকা আম নয় মিস্টার চৌধুরী, যে চাইলেই টুপ করে পেড়ে আনবেন। তার জন্য দীর্ঘ সময় আর পরিস্থিতি লাগে। আপনি কোনোটাই পাননি। 

অরুণ বাগানের দিকে মুখ ফিরিয়ে কিছু ভাবছিলেন। আবার বললাম, ‘কিন্তু শুধু আপনার ভার্সনটাই নয়। আমার স্টোরির মাধ্যমে আরও একটা জিনিস করতে চাই। বাংলার একজন ভুলে যাওয়া কবিকে নতুন করে আবিষ্কার। অকালপ্রয়াত এক কবিকে যদি পুনরুদ্ধার করা যায়, সেটা লেখার ক্ষেত্রে কতটা কাজে লাগবে জানি না। ইংরেজি পাঠকের স্বাভাবিকভাবেই এসব নিয়ে উৎসাহ থাকবার কথা নয়। কিন্তু তবুও, কেন জানি না মনে হচ্ছে এটা করা উচিত।’ 

‘কেন? আপনি তো বাংলা কবিতা বিষয়ে ইন্টারেস্টেড নন বলেই মনে হলো।’ মুখ ফেরালেন অরুণ। ‘তাহলে কী উদ্দেশ্যে করবেন? 

ব্যাগ থেকে বইটা বার করলাম। ছিন্ন হলুদ মলাট, পোকায় খাওয়া পাতা, স্পাইন ভেঙে গেছে। পুরোনো দিনের ক্যালিগ্রাফিতে সোনার হরফে বইয়ের ওপর লেখা ‘দার্জিলিঙ ডিটিস অ্যান্ড আদার পোয়েমস্’। লেখকের নাম জে এ কেবল। বইটা এগিয়ে দিলাম, ‘চিনতে পারেন?’ 

হাতে নিয়ে পাতা উল্টে অরুণের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। ‘এটা তো অমিতাভর কপি! আপনার কাছে কীভাবে এল?’ 

‘বলতে পারেন, নিয়তির যোগাযোগ।’ অল্প হাসলাম আমি। ‘আজকের বই নয়। বহুদিন আগে, তখন কলেজে পড়ি, কলেজ স্ট্রিটে পুরোনো বইয়ের ফুটপাতে বইটা পাই। অমিতাভ মিত্রর নাম লেখা ছিল। সঙ্গে দার্জিলিং-এর ঠিকানা। ততদিনে অমিতাভর গল্প আমার জানা হয়ে গিয়েছে। তাও বুঝতে পারছিলাম না, এটা সত্যিই অমিতাভর কপি কিনা। কী মনে হতে বইটা কিনে নিই। বাড়ি ফিরে ওলটাতে গিয়ে শেষ পাতায় আগের পাতায় মার্জিনে দেখি—’ 

‘জানি। অমিতাভ মার্জিনে কবিতা লিখত। এই বই ওর কাছে আমিই দেখেছি। কবিতা কী লিখেছে তা যদিও মনে নেই।’ 

বিজনবাড়ির একলা ঘোড়ার কেশর থেকে বৃষ্টির মতো সময় ঝরে যাচ্ছে, এই থিমে একটা কবিতা। অদ্ভুত লেখা। বাংলা কবিতা এরকম আগে পড়িনি।’ ‘সিগনেচার অমিতাভ। আপনি পড়েননি, কারণ হয়তো বাংলা কবিতা অত পড়েন না। কিন্তু আমাদের উত্তরবঙ্গে অন্তত ম্যাজিকাল কিছু কবিতা একসময়ে লেখা হয়েছে। তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণেশ ঘোষ, বিজয় দে, নিত্য মালাকার— সবাই উত্তরবঙ্গেই। নিত্য মালাকার লিখেছিলেন একবার, ‘হাওয়ায় হারপুন ও কুডুল ভেসে আসে।’ সেই লাইন পড়ে আমাদের অনেকেরই শিরদাঁড়া ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। আমি সারাজীবন ক্রাইমকাহিনী লিখেও এর সমতুল্য একটা লাইন লিখতে পারিনি। অরুনেশদা লিখেছিলেন— ‘নিরাশ্রয় যে তার দিকে তাকিয়ে হাসি/চল তোকেও সেখানে রেখে আসি / যেখানে স্বপ্ন, আগুন আর কুয়াশা/আমার সঙ্গী এক ভিখারি বালিকা/ আমার সঙ্গী এক পথের গণিকা/আমার সঙ্গী এক ব্যর্থ বিপ্লবী/যার সামনে দাঁড়িয়ে এই স্তব্ধ নমস্কার।’ এঁরাই ছিলেন আমাদের এই ছোট্ট শহরটার লেখালিখি করা যুবকদের ঈশ্বর। সমীর চট্টোপাধ্যায়, সুজয় বিশ্বাসের মতো নিভৃতচারী অসামান্য সব কবির দল। যদিও আমি সারাজীবন গোয়েন্দাকাহিনী লিখে গেছি যা চরিত্রে এইসব লেখালেখির থেকে যোজন দূর, কিন্তু এঁদের কাছে রেখে আসা ঋণ কি আর অস্বীকার করা যায়? আরও অনেকে ছিলেন, হারিয়ে গিয়েছেন। মানুষ ভুলে গিয়েছে তাঁদের লেখা। অমিতাভ সেই ধারারই হয়তো শেষ প্রতিনিধি ছিল।’ তারপর নিজের মনে বললেন, ‘আর তার সংগ্রহের বই আপনার হাতে। কী অদ্ভুত সমাপতন।’

‘সমাপতন বলব না। বইটা আমার কাছে বহুদিন ধরেই ছিল। সেই তখন থেকে, আজ থেকে ধরুন বারো বছর আগে, যখন এই স্টোরি করবার কোনো প্ল্যান আমার নেই। আপনাদের বিষয়ে আমজনতার যতটুকু কৌতূহল, তার বেশি কিছু আমার ছিল না তখন। কিন্তু অমিতাভর কপি বলেই ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং, তেমন নয়। এই বইটা যার লেখা, জে এ কেবল, তিনিও ঊনবিংশ শতকের আরেক হারিয়ে যাওয়া কবি। মাল্টায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একসময়কার ক্যাপ্টেন। পরে হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেটের ম্যানেজার পদে যোগ দেন। এই শহরে থাকার সময়ে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দার্জিলিং এবং তার জীবনযাপনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু কবিতা লেখেন, যা স্থানীয় বিদ্বজ্জন ও বিশিষ্টদের উৎসাহে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। আমার কাছে যেটা, ১৯১২ সালের দ্বিতীয় সংস্করণ। মনে হয় না তার পরে আর কোনো এডিশন বেরিয়েছিল। কেবল কবে কোথায় মারা যান সেটাও জানি না। কবিতাগুলো উচ্চমার্গের নয়। কেবল নিজে সেটা দাবিও করেননি। ১৮৭০ সালের একটি শহরকে ঔপনিবেশিক চোখ থেকে কেমন ভাবে দেখা যেতে পারে, সেই সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বাইরে এই বই আর কেউ কখনও পড়বে না। কেবল কালের নিয়মে হারিয়েই গিয়েছেন। ঠিক যেমন হারিয়ে গিয়েছেন অমিতাভ। আর এই হারিয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া কবি লেখকদের নিয়ে আমার একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। ঠিক যেভাবে ক্রাইমকাহিনীতে অপরাধীকে খুঁজে খুঁজে বের করা হয়, তেমনভাবেই ইচ্ছে করে হারানো কবিদের খুঁড়ে চলতে। এখানে একজন না, দুজন হারানো কবি। দুজনের মধ্যে সময়ের ব্যবধান একশো বছর। একজনের বই রেখে দিয়েছিলেন অন্যজন। কে জানে, হয়তো অমিতাভ কেবল সাহেবকে খুঁজে গিয়েছিলেন। রোমান্টিক লাগতে পারে, তবে ভাবতে দোষ কী? হয়তো কেবলের চোখ দিয়ে দার্জিলিংকে খুঁজেছিলেন অমিতাভ। আর সেই বই হাতফেরতা হয়ে আমার কাছে। আমি খুঁজছি অমিতাভর সেই খোঁজাটুকুকে। মানুষ অমিতাভকে। এভাবেই শুরু করতে চাই। একটা বৃষ্টিভেজা দিনে কলেজফেরতা আমি ফুটপাত থেকে তুলে নিচ্ছি অমিতাভ মিত্রর সংগ্রহের একটা হারানো কবিতার বই। ব্যাপারটা কি ছেলেমানুষি হয়ে যাচ্ছে, মিস্টার চৌধুরী?’ 

অরুণ মাথা নাড়লেন, ‘অমিতাভ নেশা করবার জন্য নিজের সংগ্রহের সব বইপত্র বেচে দিত। সেভাবেই হয়ত… বইটা আমাকে দেবেন? কয়েকদিনের জন্য রাখব তাহলে নিজের কাছে।’ 

অপেক্ষা করে আবার মুখ খুললাম, ‘বাংলা কবিতা নিয়ে কিছুই জানি না হয়তো আপনার সংগ্রহের কবিতার বইয়ের কালেকশন ঈর্ষণীয়। তবে এখানে আসবার আগে কিছুটা পড়াশোনা করেছি। সামান্য কিছু কবিতাও… অমিতাভদের আবিষ্কার করতে গেলে একদম অজ্ঞ থাকলে চলে না। এই গল্প যেমন আপনার গল্প, তেমনই অমিতাভরও গল্প হবে। আর আমাকে সেই গল্প বলবেন আপনি 

বইয়ের গায়ে মমতার হাত বোলাতে লাগলেন অরুণ। ‘তাহলে হয়তো কিছুটা বুঝবেন, অমিতাভরা সবাই, ওই সময়ে, কবিতা লেখা ওদের কাছে নিছক শিল্প ছিল না। যাপন ছিল। বেশিরভাগ কবিই তখন কলকাতা নয় জেলা থেকে আসতেন। হাজার হাজার কবিতার ম্যাগাজিন বেরোতো তখন। জিরাফ বার করতেন অরুণেশদা। অমিতাভর কিছু কবিতা ওখানেই। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের কবিকুল মধ্যরাতের কলকাতা শাসন করতেন। আর সত্তর দশকের কবিকুল, যাদের অনেকের সঙ্গেই কলকাতার তেমন যোগ ছিল না, ইতিউতি মাথা তুলছে যেখানে বীরভূম, বাঁশবেড়ে, মাথাভাঙা বা চাকদার মতো বিদ্রোহের স্তম্ভগুলো, সটান বলে দিল যে তারা আরব গেরিলাদের সমর্থন করে। এই বদলটা, হ্যাঁ এটার সঙ্গে রাজনীতি ইত্যাদির যোগ তো ছিলই, এটাকে যদি না ধরতে পারেন, অমিতাভকে প্রোফাইল করতে পারবেন না। ওর গোটা জীবনটাই ছিল যেন কবিতার জন্য বাঁচা। শুধু ওর কেন, অনেকেরই।’

‘মানে, আমি তো জানতাম অমিতাভ অরাজনৈতিক ছিলেন। তাহলে রাজনীতির প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে?’ 

‘আসছে, কারণ রাজনীতি বাদ দিয়ে সত্তরের কবিতা হয় না। ধরুণ, একটা উদাহরণ দিচ্ছি। সত্তর শুরুই হল বলা যায় দুজন তরুণ কবির বই দিয়ে, আর বিস্ফোরণ ঘটল বাংলা কবিতায়। অমিতাভ গুপ্তর ‘আলো’ আর পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের ‘দেবী’। মনে হলো, বাংলা কবিতায় যেন নতুন স্বরের শঙ্খধ্বনি ঘটালো এই দুজন। পার্থ স্কটিশে পড়ত, আর অমিতাভর সঙ্গে ওর ছিল ভালো বন্ধুত্ব, মানে অমিতাভ মিত্রর কথা বলছি। সেসবের ইতিহাস দীর্ঘ। সে যাক। অমিতাভ গুপ্ত নকশালপন্থী ছিলেন, কিন্তু ওখানেই আবদ্ধ না থেকে তাঁর কবিতায় উত্তর আধুনিকতার কনসেপ্ট নিয়ে এলেন। আর পার্থপ্রতিম আনল মন্ত্রতন্ত্র পুরাণের গোপন বীজের আখরে গ্রিক ভাস্কর্যের মতো পাথরে খোদাই গড়ন। আনল ক্লাসিকাল আবহ। কিন্তু সেই পার্থও যখন লেখে— ‘তোমার ও রক্তবর্ণ আনন ফেরাও, হে দারুণা, তুমি খড়গ তোলো/অস্ত্র উপচারে তুমি পূজা করো এই রোগগ্রস্ত মানুষের তখন/ও লেখা সত্তরের গর্জন ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। এবার অমিতাভ এই দুজন কবিকে নিয়ে ১৯৭১-এ কবিতা লিখেছিল, ‘দেবীর আলো’। অমিতাভ গুপ্ত আর পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের দুটো বইয়ের প্রতি ট্রিবিউট সেখানে এরকম পঙক্তি আছে। উগ্রাপ্রহরণে/সৌম্যমূর্তিতে/অবিশ্রাম ঝড়/তুচ্ছ করেছিল/প্রেক্ষাপটটিও। এই গোটা লাইনটাই দুটো বইয়ের দুটো কবিতার পঙক্তিকে জুড়ে অদ্ভুত জাক্সটাপোজিশান করেছে অমিতাভ। তো, আপনি যখন অমিতাভর কবিতা পড়বেন, ওই প্রেক্ষিতটা না জানলে তো ধরতে পারবেন না। 

‘আর অমিতাভর মৃত্যু? সেটাও কি সৎ সাহিত্যের জন্যই?’ 

অরুণ চোখ বুজে অনেকটা নিজের মনেই অস্ফুটে বললেন, ‘সকল রৌদ্রের মতো ব্যপ্ত আশা যদি গোলকধাঁধায় ঘুরে আবার প্রথম স্থানে ফিরে আসে, শ্রীজ্ঞান কী তবে চেয়েছিল?’ 

চোখ খুলে মৃদু হাসলেন কয়েক মুহূর্ত পর, ‘আমার প্রিয় কবিতা। অমিতাভরও প্রিয় ছিল। জীবনানন্দ। মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়… সূর্য যদি কেবলই দিনের জন্ম দিয়ে যায়, রাত্রি যদি শুধু নক্ষত্রের, মানুষ কেবলই যদি সমাজের জন্ম দেয়, সমাজ অস্পষ্ট বিপ্লবের, বিপ্লব নির্মম আবেশের, তা হলে শ্রীজ্ঞান কিছু চেয়েছিল? মাঝে মাঝে নিজের মনে কথাগুলো বলে ফেলি।’ 

‘অদ্ভুতভাবে আপনার অনেক উপন্যাসেই এই অ্যাবসার্ডিটি ঘুরে ফিরে আসে। ক্রাইম আর তার সমাধান এই দুইয়ের অর্থহীনতা…’

‘আমি তো কবিই হতে চেয়েছিলাম। লিখতে পারতাম না। অমিতাভ বলত, তোর দ্বারা অক্ষরবৃত্তের বেশি ওঠা হবে না। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে কবিতার সবথেকে কাছাকাছি যেটা, সেটাতেই গেছি। ক্রাইম কাহিনী।’ 

‘মানে রহস্যের সমাধান আর কবিতার অর্থ খুঁজে বার করা আসলে একই বলছেন?’ তরল গলায় বললাম। বাংলা কবিতা নিয়ে এরকম আলোচনা আমার পরিমণ্ডলে হয়নি এর আগে। যেটা মজা লাগছিল, অরুণ যখন কথা বলেন, ধরেই নেন যে আমি সব বুঝে যাব। যেসব কবির নাম কখনো শুনিনি তাঁদের ব্যাখ্যাও। 

‘পার্থপ্রতিম কী বলেছিল জানেন না? বলেছিল, কবিরা অতীব লঘু, বজ্রমণির মতোই লঘু, গুরুত্ব ফুরুত্বের মতো শব্দকে এরা পায়ে পায়ে কুকুরের মতো খেলিয়ে বেড়ায়। কবিরা হলো নির্বাসিত যুধিষ্ঠির ও ব্যোমকেশ। যুধিষ্ঠিরের মতো লঘু। ব্যোমকেশের মতো যশহীন। কারণ তাদের কাজই হলো ভ্রমণ ও গোয়েন্দাবৃত্তি। হ্যাঁ, কঠিন কবিতার মানে খুঁজে বার করবার আনন্দ তো অপরাধীকে শনাক্ত করবার থেকে কম নয়। 

‘আর অমিতাভকে হত্যার মতো একটা পারফেক্ট মার্ডার তাহলে কীরকম ছিল? মনে হয়েছিল কি, একটা দুরূহ অবোধ্য কবিতা আপনি ছুড়ে দিয়েছেন সবার সামনে, যার প্রকৃত অর্থ ভেদ করবার চ্যালেঞ্জ কেউ শেষমেশ নিল না?’ 

অরুণ আর একটা সিগারেট ধরালেন, ‘আপনি আমার লেখা কতগুলো বই পড়েছেন?’ 

‘প্রায় দশ-বারোটা তো বটেই।’ 

‘কী মনে হয়েছিল বইগুলো পড়ে?’ 

‘অন্যরকম লেগেছিল।’ 

‘কীরকম?’ 

‘আপনার লেখায় অপরাধীরা ধরা পড়ে না।’ 

চশমার ভারী কাচের আড়ালে দুটো স্ফুলিঙ্গ চমকে উঠল, ‘সেটা কেন বলে আপনার মনে হয়?’ 

‘জানি না। হয়তো অপরাধ আর শাস্তি বিষয়ের চিরাচরিত ধারণাটাকেই আঘাত করতে চান। অথবা ন্যায়, বিচার এবং সমাজ বিষয়ে আপনি নৈরাজ্যবাদী। অথবা, যেটা বললাম অপরাধ বা সমাধান, সবই আপনার কাছে অ্যাবসার্ড, মিনিংলেস। আর এখন মনে হচ্ছে,’সামনে ঝুঁকে স্পষ্ট চোখ রাখলাম অরুণের দিকে ‘যেহেতু আপনি নিজে ধরা পড়েননি, তাই প্রতিটা বইতে নিজের অপরাধকেই সেলিব্রেট করে চলেছেন।’ 

অরুণও আমার দিকে স্থির চোখ মেললেন। আমরা দুজনে দুজনের মুখোমুখি। যেন দাবার বোর্ডের দুপাশে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। একটা অস্পর্শ বিদ্যুৎপ্রবাহ ঘরের মধ্যে বয়ে চলেছে। এই প্রথম আমি অরুণ চৌধুরীর চেখের ভেতর একটা ইস্পাতের তলোয়ার ঝিকিয়ে উঠতে দেখলাম। 

‘অথচ আপনি যদি আমার প্রথমে দুটো ফ্লপ বই পড়তেন, তাহলে দেখতেন সেখানে অপরাধী ধরা পড়েছে।’ 

‘সেটা আমার থিওরিকেই প্রমাণ করে’, মাথা নাড়ালাম। 

‘অথবা এটা প্রমাণ করে যে আমি অপেক্ষা করে আছি ভবিষ্যতের সেই সত্যান্বেষীর দিকে তাকিয়ে, যে অপরাধীর মেধার সঙ্গে পাল্লা দেবে।’ 

‘অপরাধীর মেধা? নাকি আপনার মেধা?’ 

‘আমারই মেধা। কারণ আমার গল্পের শেষ আজ অবধি কোনো ডিটেকটিভ ধরতে পারেনি।’ 

আপনি মেগালোম্যানিয়াক।’ 

‘অথবা, বাকি পৃথিবী মিডিওকার।’ 

দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কয়েক মুহূর্ত। অরুণ চোখ বুজলেন। বড়ো নিঃশ্বাস নিলেন একটা। আবার সেই স্মিত মানুষটা ফিরে এল। কয়েক মুহূর্ত পর উঠে দুটো ফাইল বার করে আনলেন বইয়ের আলমারির পেছন থেকে। 

‘আপনাকে একটা টাস্ক দেব বলেছিলাম। এটাই সেই টাস্ক। একটা গোয়েন্দা কাহিনী। বলা ভালো, একটা মার্ডার মিস্ট্রি। কিন্তু শেষটা নেই। এটার সমাধান যদি করতে পারেন, তাহলে সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। কেন অমিতাভকে মেরেছিলাম, আর কীভাবেই বা মেরেছিলাম।’ একটা ফাইল টেবিলের উপর রেখে অন্যটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। 

অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে ফাইলটা হাতে নিলাম, ‘আমাকে এখন বসে বসে ধাঁধার সমাধান করতে হবে? আমি তো একটা কাজে এসেছি।’ 

‘আমি জানি টিনা। সময় আপনার কাছে মূল্যবান। দুঃখিত, কিন্তু এটাই আমার শর্ত। আমি জানি, আপনি পারবেন।’ 

‘কেন মনে হলো, পারব?’ 

‘আপনার সিরিজের অন্তত দুটো স্টোরিতে নিজের ডিডাকশন প্রয়োগ করে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, প্রকৃত অপরাধী কে হতে পারত। সেটা পড়ে মনে হয়েছিল, আপনার যুক্তিকাঠামো অঙ্কের মতো নিখুঁত রেখায় চলে। সিদ্ধান্তের অনিশ্চয়তাগুলোকে একদম মিনিমাম লেভেলে নামিয়ে আনে। সাধে কি আপনাকে ইন্টারেসস্টিং বলেছিলাম?’ হাসলেন অরুণ। 

‘এটা কি সম্ভব? আপনি নিজে ভেবে দেখুন। আমি তো অনির্দিষ্টকালের জন্য এখানে থাকতে আসিনি। দুদিন পরেই অফিস থেকে তাড়া আসবে, কবে ফিরতে পারব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শেষ করে এখান থেকে চলে যেতে হবে আমাকে। তার আগে এতগুলো জায়গায় যাওয়া, ইন্টারভিউ…’ 

‘নিশ্চয়ই। কিন্তু আপনিও ভেবে দেখুন, আমি তো চাইলেই সমাধানটা বলে দিতে পারি। সেটা না করে যেহেতু এই ফাইলটা দিচ্ছি, তার হয়তো কোনো কারণ থাকতে পারে, তাই না?’ একটুক্ষণ থেমে আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। ‘আচ্ছা বেশ। আপনি চাইছেন না বুঝতে পারছি। সেক্ষেত্রে এই মিটিং আর চালিয়ে লাভ নেই।’ অরুণ ফাইলটা ফিরিয়ে নিতে গেলেন। 

‘না’, ফাইল খামচে ধরলাম। ‘এটাই যদি আপনার শর্ত হয়, যদি শর্ত হয় যে বুদ্ধির খেলায় আপনাকে পাল্লা দেব, তাহলে সেই চ্যালেঞ্জ আমি রাখতে পারব না। এই বয়সে এসে কারও কাছে নিজেকে প্রমাণ করবার তাগিদ আমার নেই। আগেও বলেছিলাম, আমি বোরিং। কোনো রকম থ্রিল পছন্দ নয়।’ 

‘তাহলে ফাইলটা চান কেন?’ 

আপনি বুঝতে পারছেন না?’ 

‘এটুকু বুঝছি, নিজেকে বোরিং বলাটা আপনার অভ্যেস। নিজেও জানেন যে আপনি বোরিং নন। আর তাই…’ 

‘আর তাই…?’

‘তাই, এই রহস্যটার সমাধান আপনি করবেন।’ আমার হাতে ফাইলটা ধরিয়ে দিলেন অরুণ। 

‘ভুল হলো। আপনার ছেলেমানুষিতে আমি থাকব না আগেও বলেছি। এটা আপনার শখ হতে পারে, কিন্তু আমার চাকরি। আমাকে গল্পটা লিখতে হবে। ফাইলটা চাই, কারণ আপনার লেখা একটা উপন্যাস প্রকাশিত হবার আগেই পড়তে পারা আমার কাছে রোমাঞ্চকর।’ 

‘কিন্তু এটা তো আমার লেখা নয়। 

‘মানে? তাহলে কার লেখা?’ 

‘অমিতাভর।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *