শেষ মৃত পাখি – ৮

সে আবার ফিরে আসে ছেলেদের বাড়ির রোয়াকে
পুরানো বৃষ্টির শব্দে। ছেঁড়া-খোড়া কোটের পকেটে
মুমূর্ষু কিছু ভয়, সন্ধানী টর্চের মৃদু আলো
নিঃশব্দে ঘুরে যায় সবুজ জানলা, ভিজে ভিজে
দরোজায়, চৌকাঠে, বিবর্ণ নামের ফলকে 
শীর্ণ আঙুল রাখে, সাবধানে নাকের ওপরে 
পেতলের চশমাটি এঁটে নেয়, এদিক ওদিক 
ঘুরে আসে চুপিচুপি পরিচিত বাড়িটিকে দেখে। 

—বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় 

.

পাহাড়ে বৃষ্টি নিষ্ঠুরতা এবং নির্জনতার উদযাপন ঘটায়, বলেছিলেন কোনো এক কবি। দার্জিলিং-এর বর্ষাকালকে যদি এক কথায় ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে তার নাম অবিশ্রাম। বিরতিহীন বৃষ্টি। কখনও আস্তে এবং কখনও মুষলধারে। যখন বৃষ্টির বেগ কম, পাহাড়ের নীচ থেকে মেঘের দল উঠে এসে কুয়াশায় ঢেকে নিচ্ছে চরাচর, আমার ঘরের জানালার কাচ ভেপে উঠেছে। রাস্তাঘাটের স্যাঁতসেঁতে ভেজা অন্ধকার ভেদ করে মাঝে মাঝে ছিটকে আসছে একঝলক ছাতার রং অথবা বাহারি পোশাকের আঘ্রাণ। কম সংখ্যায় টুরিস্ট। ম্যাল, চৌরাস্তা, সব ফাঁকা ফাঁকা। সন্ধে হলে একদম নিঝঝুম হয়ে যায়। ঘরের দেয়াল ঘেমে ওঠে। আড্ডা জমায় অদ্ভুত দেখতে পাহাড়ি পোকার দল। খাদের ধারের পাইন, ইউক্যালিপ্‌টাস্, বার্চের ডাল থেকে সারাদিন টুপটাপ করে জল পড়বার আওয়াজ। ক্ষণিকের জন্য কুয়াশা কেটে গেলে আবছা জলরঙের মতো দেখা যায় নীচের দরিদ্র বস্তি। এই অবিরাম অবসাদের মতো বৃষ্টি মনকেও কীরকম বিকল করে দেয়। কাজ করতে ভালোলাগে না। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয় জানালার বাইরে ওই ছাইরঙা আকাশ আর ফ্যাকাশে জন্ডিস রুগির মতো সূর্যের আলোকে চেটে দেখি। এমনিতেই অনিদ্রাতে ভুগি। দিনের বেলা ঘুম পায়, চোখের পাতা বুজে আসে। এমন প্রকৃতি আমাকে আরোই বেশি করে কাজে ফাঁকি দেওয়াবার ষড়যন্ত্র করেছে। 

১৯০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ইংলিশম্যানকাগজে একটা লেখায় বলা হয়েছিল, ‘দার্জিলিঙ হ্যাজ অলমোস্ট বিকাম দ্য প্লে-গ্রাউন্ড অ্যান্ড নার্সারি অফ্ ক্যালকাটা’। স্বাভাবিক, সাম্রাজ্যবাদের চোখে দার্জিলিং-এর নিজের মূল্য কতটুকু, যদি না তা রাজধানীকে সার্ভ করে! কলকাতার নার্সারি হওয়াই এই শহরের ভবিতব্য ছিল হয়তো, যার তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল অসংখ্য নেটিভ কুলি, চা-বাগানের শ্রমিক, লেপচা-নেপালি-ভুটানি গোষ্ঠীদের আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা। এই বৃষ্টি, অবিরাম স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া আর অবিচ্ছিন্ন কুয়াশা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এটাই সম্ভবত আসল দার্জিলিং যার পেটের ভেতর লুকিয়ে থাকা রহস্যগুলোর সুলুকসন্ধান কোনোদিনই উপনিবেশের প্রভুরা নাগাল পাবে না। কাঞ্চনজঙ্ঘা, টাইগার হিলের সূর্যোদয়, অজস্র ফুলের সমারোহ, চিড়িয়াখানা, এসব পেরিয়ে গেলে যেটা পড়ে থাকে চিতাবাঘের মতো ঘাপটি মেরে থাকা সেই শহরের ইতিহাস এবং অস্তিত্বকে সম্ভবত অমিতাভ মিত্রর মতোই ভুলে গিয়েছে সবাই। অথবা, ভুলে গেছে কি? মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়। অমিতাভ কি বিশ্বাস করতেন? 

অরুণের কাছ থেকে অমিতাভর একটা ছবি ধার করে এনেছিলাম। বার করে দেখলাম আবার। হলদে, প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ফটো। বাদামি ছোপ ধরতে শুরু করেছে একধারে। রোগা। লম্বা নয়। এক অবিন্যস্ত দাড়িগোঁফওয়ালা তরুণ। মাথার চুল বড়ো বড়ো এবং উসকোখুসকো। একটা পাহাড়ি নদীকে পেছনে রেখে একখণ্ড পাথরের উপর বসে বাম দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি আবছা, এবং পুরোনো ছবিতে ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। তবে মনে হলো, বসে থাকার এবং তাকাবার ভঙ্গিটা উদাস। বিষণ্ণ। যেন তরুণ এ পৃথিবীর কেউ নয়। 

কেবল সাহেবের কবিতার বইটা অরুণকে দিয়ে এসেছি। বইয়ের ভেতরে কবির একটা ছবি ছিল। মোটা গোঁফওয়ালা মধ্যবয়স্ক ইউরোপিয়ান, সে সময়কার টিপিকাল সাহেবদের যেমন দেখতে হতো। এই দুটো ছবি, অমিতাভর আর কেবলের, পাশাপাশি বসিয়ে একটা কোলাজ বানানো যায় না? স্টোরির খাতিরেই। একশো বছরের ব্যবধানে দুই হারানো কবি, যাঁদের এক বিন্দুতে এনে দিয়েছে এক অমীমাংসিত রহস্য। দুজনের কেউই হয়তো অমরত্ব চাননি। চেয়েছিলেন, একটা ছোট্ট টাউনকে ভালোবেসে তার এলিজি রচনা করে যেতে। 

টুং করে দু-বার হোয়াটসঅ্যাপের আওয়াজ হলো। মাঝে মাঝে ভাবতে ভালো লাগে একান্তে। তখন মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এই সবকিছুর থেকে দূরে থাকতে ইচ্ছে করে। আজ সেরকম মেজাজে আছি। অবশেষে হোয়াটসঅ্যাপ যখন খুললাম, তার মধ্যে দশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। 

অচেনা নম্বর থেকে পাঠানো। একটা বাড়ির পুরোনো ছবি, সেটাকে স্ক্যান করে দেওয়া হয়েছে। ছবির নীচে ঠিকানা লেখা। দার্জিলিং-এর কোথাও, কিন্তু রাস্তার নাম দেখে বুঝলাম যে চিনি না। দ্বিতীয় মেসেজটাও একই নম্বর থেকে পাঠানো, কিন্তু সেটা আরও অদ্ভুত। চারলাইনের একটা কবিতা। 

Yesterday upon the stair 
I met a man who wasn’t there 
He wasn’t there again today 
I wish, I wish he’d go away 

ইংরেজির ছাত্রী হবার সুবাদে কবিতাটা আমি জানি। আমেরিকান কবি উইলিয়াম হিউজেন্স মেয়ান্স অ্যান্টিগোনিস নামের এই ছড়াটা লিখেছিলেন গত শতাব্দীর শুরুতে। এক ভুতুড়ে আত্মার উপস্থিতি বিষয়ক এই কবিতার প্রচুর প্যারডিও হয়েছে। কিন্তু আমাকে এটা পাঠাবার মানে কী? আর বাড়িটাই বা কী? ট্রুকলার অ্যাপ খুলে নম্বরটা সেখানে দিলাম। টুকলার জানাল, এই নামের কেউ তাদের ডেটাবেসে নেই। 

আজকেও সিদ্ধার্থ নীচে অপেক্ষা করছে। আমাকে নামতে দেখে এগিয়ে এল, ‘আজ রাত্রে কাকিমা আপনাকে ডিনারের নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। ঘুমোচ্ছেন ভেবে ফোন করেনি এতক্ষণ। জানতে চেয়েছে আপনার কোনো খাবারে অ্যালার্জি আছে কিনা। 

‘কাঁচা আনারস বাদে আর কোনো কিছুতে নেই। ভালোই হলো, এই সুযোগে আজ সন্ধেবেলাই দুজনের ইন্টারভিউটা রেকর্ড করে নেব। আচ্ছা সিদ্ধার্থ, এই ঠিকানাটা আপনি জানেন?’ ছবিটা দেখালাম। 

ভেবে নিয়ে সিদ্ধার্থ উত্তর দিল, হুঁ, ঋষি রোড। রাস্তাটা জানি। শহরের বাইরে বেরিয়ে গেছে। জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছে লেপচাজাতের আগে। একজ্যাক্ট ঠিকানা ওখানে গেলে জেনে যাব। কিন্তু কার বাড়ি এটা?’ 

কবিতাটা দেখালাম। ভুরু কুঁচকে গেল সিদ্ধার্থর। বিড়বিড় করে বলল, ‘আশ্চর্য! কেউ প্র্যাংক করছে না তো?’ 

‘মনে হচ্ছে একবার দেখে আসা দরকার।’ 

‘যাওয়াই যায়। যেতে আসতে বেশি হলে ঘণ্টা দুই পড়বে। নির্ভর করছে আপনার কাজের ওপর।’ 

‘আজ পুলিশ লাইব্রেরির কার্ড হাতে পেলে সেখানে যাব। তার আগে আনন্দ পাঠক অন্য যে পুলিশের কনটাক্ট দিয়েছেন, লালবাহাদুর রাই, তাঁর বাড়ি যাবার আছে। কাল ফোন করেছিলাম। সাড়ে এগারোটায় সময় দিয়েছেন। এরপর কার্ট রোডের সেই কবরখানার ছবি তুলতে যাব যেখানে অমিতাভর লাশ পাওয়া গিয়েছিল। দুপুরবেলা সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে শিলিগুড়ি থেকে আমার ফোটোগ্রাফার আসবেন। আমাদেরই এখানকার ব্যুরো অফিসের একজন ফ্রিলান্সার। তাঁকে নিয়ে আবার সমস্ত জায়গায় একবার করে ঢুঁ মারতে হবে, ছবির জন্য। তিনি সন্ধেবেলার মধ্যে আবার নেমে যাবেন নীচে। আর তারপর, যদি সত্যিই আপনার কাকিমা নিমন্ত্রণ করেন, তাহলে সেখানে। এর মধ্যে যদি সময় পাই, আর একবার ড্যানিয়েল লামার বাড়িতে নক করব, যদি সদয় হন।’ 

‘মানে ঠাসা শিডিউল। সেক্ষেত্রে এই বাড়িতে যাবেন কী করে।’ 

‘সময় অল্প, সিদ্ধার্থ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানকার কাজ মিটিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছি। লেখা শুরু করতেই অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ 

সিদ্ধার্থ মোবাইল বার করে সময় দেখল। ‘অবশ্য এখন ন-টা বাজে। আপনি চাইলে আমরা এই বাড়িটা ঘুরে এসে সাড়ে এগারোটায় লালবাহাদুর রাইয়ের বাড়ি চলে যেতে পারি। তবে বাড়িতে থাকা যাবে না বেশিক্ষণ।’ 

আমি দোনোমোনো করছিলাম। ভাবছিলাম, যদি এই সময়ের মধ্যে আর একবার ড্যানিয়েলের বাড়ি যাওয়া যায়। কিন্তু তাতেও কতটা কাজ হবে জানি না। হয়তো অকারণেই এই বাড়িটা দেখতে ইচ্ছে করছিল। এখানে এসে থেকে ঘোরা হচ্ছে না একটুও। কতক্ষণ আর বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে। ‘আপনি যাবেন? মানে, কাজের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছি না তো সেই কাল থেকেই?’ 

উত্তর না দিয়ে গলার মাফলার গোটাল সিদ্ধার্থ। অন্তত ভদ্রতা করেও যে বলবে, না না কোনো সমস্যা নেই, সেসবের বালাই নেই। হাসির কোটা সম্ভবত কাল রাত্রে পুরণ হয়ে গেছে। দিনে একবার করে হাসে। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পিছু ফিরে বলল, ‘গাড়িতে অপেক্ষা করছি।’ 

সিদ্ধার্থ যতটা দূর ভেবেছিল, তার অর্ধেকও নয়। মদনদা জায়গাটা চেনেন বললেন। আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে দিলেন। একে ওকে জিজ্ঞাসা করে, তারপর জিপিএস মিলিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম বাড়িটার সামনে। 

একদিকে খাদ নেমে গেছে, অন্যপাশে পাহাড়। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে একটা সরু রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে কিছুটা উঠে বাম দিকে বাঁক নিলে আচমকা চোখের সামনে শূন্য থেকে এসে উদয় হয় বাড়িটা। চারপাশে উঁচু গাছের জঙ্গল বলে রাস্তা থেকে দেখা যায় না। একটা বড়ো পাঁচিলঘেরা এলাকা। ভেতরে আগাছার জঙ্গল। সেগুলোকে পেরিয়ে যে পোড়ো বাড়িটা চোখে পড়ে, খুঁটিয়ে না দেখলে বোঝা যাবে না যে সেটাই ছবির বাড়ি। ছত্রাকে ঢেকে গিয়েছে বাড়ির নকশা। জানালার কাচ একটাও অবশিষ্ট নেই আর। দরজার কাঠ পচে খসে পড়ছে। এমনকি ঢোকার গেটটাও ভেঙে খুলে একদিকে ঝুলছে। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। 

বাড়ির পেছন আর ডান পাশ থেকে জমি ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে খাদের দিকে। বাড়িটা খাদের প্রান্তে দাঁড়িয়ে। খাদের কোলে ঘন জঙ্গল। এখন বৃষ্টি কম পড়ছে। তাই দেখতে পেলাম। সেই অরণ্যের গা বেয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসছে ভারী কুয়াশা। কিছুক্ষণ পরেই অস্বচ্ছ এক হিমাভ আলখাল্লা জায়গাটার দখল নিয়ে নেবে। 

সিদ্ধার্থ দেখলাম খাদের ধারে গিয়ে দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে হয়তো। অথবা প্রেমিকাকে মিস করছে। কিন্তু আমার তো এসব ভাবালুতার সময় নেই। হাতের এত কাজ ছেড়ে এতদূর এলাম একটা পোড়ো বাড়ি দেখতে, ভাবতেই এখন রাগ হচ্ছে নিজের ওপর 

‘আপকো ঘর চাহিয়ে কেয়া?’ 

পেছন ফিরে দেখি, এক থুরথুরে নেপালি বৃদ্ধ। পিঠ নুয়ে গেছে। হাতে লাঠি। একটা ছাতা মাথায় দিয়ে আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। 

‘না। ঘর চাই না। এমনি দেখতে এসেছি।’ 

‘চাইলেও পেতেন না। এই বাড়ি এখন আর ভাড়া দেওয়া হয় না। একা আর কত দিক সামলাব। পঁচাশি বছর বয়স হবে এই শীতে। আমি চোখ বুজলে বাড়িও তার সব রূপ হারাবে।’ 

যেন সত্যিই এখনও কত রূপবান! সিদ্ধার্থ দেখলাম এগিয়ে এসেছে গলার স্বর শুনে। তাকে নমস্কার করলেন বৃদ্ধ। নাম রামবীর দাহাল। এই বাড়ির কেয়ারটেকার হয়ে আছেন আজ প্রায় পঁয়ষট্টি বছর। লেপচাজগতে নিজের ঝুপড়িতে বউ ছেলে নাতি সব আছে। তাও প্রতিদিন এখানে আসা চাই। 

‘কেন আসব না? আমি না এলে তো লুটেপুটে খাবে সবাই। ভেতরের টেবিল চেয়ার আসলি ওককাঠের, জানেন? বেলজিয়াম কাচের আয়না। লোকের নজর নেই ভেবেছেন?’ 

‘কার বাড়ি এটা?’ জিজ্ঞাসা করল সিদ্ধার্থ। 

‘মদনমোহন ধিংড়া। দিল্লির বাসিন্দা। সুপ্রিম কোর্টের উকিল ছিলেন। বাড়িটা বানিয়েছিলেন ছুটিছাটায় আসবেন বলে। আমাকে বহাল করেছিলেন। প্রতিদিন সকালবেলা ছয়টার মধ্যে চলে আসি। দশটার মধ্যে ফিরে যাই। যখন সাহেবরা থাকতেন, তখন সারাদিন। না থাকলে, ওই তিন-চার ঘণ্টার জন্য। তবে আজকাল তো কাজ থাকেও না তেমন। ধিংড়া সাহেব চোখ বোজার আগেই একটা ট্রাস্ট বানিয়ে গিয়েছিলেন, যার থেকে বিভিন্ন এনজিও, সমাজসেবামূলক প্রকল্প ইত্যাদিতে অনুদান দেওয়া হতো। আমার মাইনে আসত সেই ট্রাস্ট থেকেই। দিব্যি চলছিল। কিন্তু সাহেব চোখ বুজবার পর কিছুদিন যেতে না যেতেই সম্পত্তির দখল নিয়ে ধিংড়ার তিন ছেলের মধ্যে লাগল লাঠালাঠি। সাহেব যেহেতু উইলে এই বাড়ি কোন ছেলের ভাগে পড়বে লিখে যাননি, তিনজনেই বলে এই বাড়ি তার। মাঝখান থেকে হল কী, বাড়ি ডিসপুটেড হয়ে গেল। কেউ তার রক্ষণাবেক্ষণ করে না। মেরামতির টাকা দেয় না। ইলেট্রিকের লাইন কেটে দিল। জল বন্ধ করে দিল। কিন্তু আইনের কী একটা মারপ্যাঁচে ট্রাস্টের টাকা আমার কাছে আসা আজও বন্ধ হয়নি। প্রতি মাসে নিয়ম করে ব্যাঙ্কে টাকা জমা পড়ে। ধিংড়া সাহেব ঝানু উকিল ছিলেন, এমন কলকব্জা করে গিয়েছিলেন যে ডিসপুটেড ল্যান্ডের কেয়ারটেকার এখনও মাইনে পায়। তাঁর মৃত্যুর পঁচিশ বছর পরেও। কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করলেন রামবীর। 

‘ভেতরটা দেখা যায়?’ 

‘চলুন। টুরিস্ট পার্টিরা আগে এসে থাকত এখানে। সাহেব ভাড়া দিতেন। আমি সকালবেলা এসে তাদের ফাই-ফরমাশ খেটে দুপুরে নিজের ডেরায় ফিরে যেতাম। ডিসপুট হবার পর থেকেই সব বন্ধ। তবে হ্যাঁ, দেখার মতো বাড়ি বানিয়েছিলেন বটে! জানালার কাচ প্রতিদিন পরিষ্কার করবার কঠোর নির্দেশ ছিল। যাতে কুয়াশা লেগে ঝাপসা না হয়ে যায়। সাহেবের শখ ছিল দামি কাচ দিয়ে বাড়ি সাজানো। একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘রামবীর, তোমার মাইনে জানালার কাচ পরিষ্কার করবার জন্যই আসে। ওটা মন দিয়ে করে যাও।’ আসুন, এইদিক দিয়ে। সাবধানে অসবেন, ঝোপে বড্ড কাঁটা।’ 

বাড়ির ভেতর বড়ো হলঘরটা, ড্রইং রুমই বলা চলে, ধ্বংসস্তূপ। ধুলোয় আচ্ছন্ন পরিবেশ। পেল্লায় সোফা উলটে আছে। মেঝের ওপর লুটোচ্ছে ভাঙা বাল্বের কাচ। দুটো ফ্যান ব্লেডবিহীন অবস্থায় একপাশে রেখে দেওয়া। শুধু কয়েকটা চেয়ার এখনও আস্ত আছে। সেগুলো একটা গোল টেবিলকে ঘিরে সাজানো। হলের যেদিকে দরজা তার ঠিক উলটোপ্রান্তে মুখোমুখি বড়ো জানালা। জানালার নীচ দিয়ে খাদ নেমে গেছে। কাচ ভেঙে ছড়িয়ে আছে এখানে ওখানে। মাঝখান থেকে উঠে গেছে সিঁড়ি। আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম। 

‘সাহেবের এক মেয়ে ছিল। অল্প বয়সে মারা যায়। বাবার নয়নের মণি ছিল সে। তার ঘরটা এই বাড়ির সেরা ঘর ছিল। সে চলে যাবার পর সাহেব ওই ফাঁকা ঘর সহ্য করতে পারতেন না। বলে দিতেন, টুরিস্ট পার্টি ভাড়া নিলে যেন ওই ঘরটায় রাখি। তাতে যদি মেয়ের সব স্মৃতি মুছে যায়, তাতেই সাহেব স্বস্তি পাবেন। এই যে, সেই ঘর।’ 

ঠিক সিঁড়ির মুখেই তালাবন্ধ দরজা। কোমর থেকে চাবির গোছা খুলে একরাশ চাবির মধ্যে থেকে বেছে বেছে বার করলেন রামবীর। ক্যাঁচ করে দরজা খুলে গেল। বড়ো ঘরের মধ্যে কিংসাইজ সেগুন কাঠের খাট। দুই দেয়াল ভর্তি টানা ওয়ার্ডরোব। দেখলে বোঝা যায়, সময়কালে জাঁকজমক ছিল এই ঘরের। দুটো বড়ো জানালা। অ্যাটাচড বাথরুম। বর্তমানে ধুলোয় ছেয়ে আছে সমস্তকিছুই। বাথরুমের দরজা জ্যাম হয়ে আছে। আয়নার কাচে কয়েক দশকের ঝুল পড়ে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দুটো উঁচু ফ্যান। পুরো জায়গাটার মধ্যেই একটা দমচাপা ভাব। সম্ভবত অনেকদিন বাদে দরজা খোলা হলো। 

‘সাহেবের মেয়ের ছিল বার্নিশের গন্ধে অ্যালার্জি। এই ঘরে কাঠ বলতে তখন কিছু ছিল না। সব স্টিলের। অনেক পরে সাহেব একবার ভেবেছিলেন বাড়ি বিক্রি করে দেবেন। তখন পাহাড়ে অশান্তি শুরু হয়েছে। অনেক ফ্যামিলি নীচে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুদিন পর যখন শান্ত হলো সবকিছু, মত বদলে ফেললেন। ঠিক করলেন রিটায়ারমেন্টের পর এখানেই মেয়ের স্মৃতি নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাবেন। এই খাট, ওয়ার্ডরোব, সব কিছু স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানালেন। ভাগ্যের ফের। এক বছরের মধ্যেই চলে গেলেন। কে আর ভোগ করবে এসব! ভূতের বাড়ি হয়ে গেল আস্তে আস্তে।’ 

সিদ্ধার্থ ফিসফিস করে বলল, ‘আর কতক্ষণ দাঁড়াবেন এখানে? আমার ডাস্ট অ্যালার্জি আছে। আপনার সময় লাগলে আমি নীচে গিয়ে অপেক্ষা করছি।’ 

‘যাচ্ছি।’ 

বেরোতে যাব, হঠাৎ খাটের পাশের দেয়ালটায় চোখ চলে গেল এবং স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। 

আমার মুখের অবস্থা দেখে ‘কী হয়েছে’বলে সিদ্ধার্থ আমার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে নির্বাক হয়ে গেল কয়েক মূহূর্তের জন্য। 

খাটের যে দিকটা মাথার দিক, তার দেয়ালে, খাটের সামান্য ওপরেই লাল আর কালো রং পেনসিল দিয়ে দুটো মূর্তি আঁকা। একটা মূর্তি দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে। আর একটা টুপি পরা মূর্তি তাকে গুলি করছে। তার হাতে বন্দুক। দুই হাত দাঁড়ানো মূর্তির মাথার ওপর ইংরেজিতে লেখা, ‘অমিতাভ’। 

কিছুক্ষণ দুজনেই কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। সম্বিত ফিরতে রামবীরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দাজু, এখানে এই ছবিটা কে এঁকেছে?’ 

রামবীর চোখ কুঁচকে ক্ষীণ দৃষ্টিকে যতটা পারা যায় তীব্র করবার চেষ্টা করলেন। দেখে-টেখে উদাসভাবে বললেন, ‘তা কত টুরিস্টই তো আসে। কেউ এঁকে থাকতে পারে।’ 

‘একবার ভালো করে মনে করে দেখবেন? ১৯৭৫ সালের জুন মাসে এখানে কেউ এসেছিলেন কিনা?’ 

‘ও বাবা। সে তো বহু আগের ব্যাপার। না না, অত মনে নেই,’ রামবীর ঘরের বাইরে পা বাড়ালেন। 

‘প্লিজ, মনে করবার চেষ্টা করুন। বড়ো দরকার।’ ব্যাকুল গলায় বললাম। রামবীর অনেকক্ষণ নিজের মনে বিড়বিড় করলেন। তারপর বললেন, ‘সেই যেবার সেবক রোডে বড়ো ধ্বস নামল? কে যেন একটা এসেছিল! একজন মাত্র লোক। গাড়ি চালিয়ে আসত। আমাকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দিত না। তালাবন্ধ করে রাখত বাড়ি। নিজেও বাইরে বেরোতে না বেশি। জোরে ইংরেজি গান বাজাত সারাক্ষণ। আমি বাড়ির কাজ সেরে সকাল সকাল নিজের বাসায় ফিরে যেতাম। তখনও ঘরের মধ্যে থাকত। বেরোতো না। আবার পরের দিন সকালবেলা এসে দেখতাম ঘুমোচ্ছে। ঘুম থেকে উঠেই জোরে গান বাজিয়ে দিত। অস্থির লাগত গোটা জায়গাটা!’ 

‘কে? নাম মনে আছে?’ 

‘নাহ্, অত কী আর মনে থাকে? সেসব খাতাপত্রও আর নেই। তার আগে- পরেও কত লোক এসেছে গেছে! একে মনে ছিল গান বাজাবার জন্য।’

‘কেমন দেখতে, মনে আছে?’ 

রামবীর ঘাড় নাড়লেন। মুখে বিভ্রান্ত দৃষ্টি। আর কোনো লাভ হবে না এঁকে দিয়ে। 

ঘর এবং দেওয়ালের কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে বাইরে বেরোলাম। বাইরে এসে রামবীরের হাতে কিছু টাকা দিলাম। বুড়ো ফোকলা মুখে হেসে বললেন, ‘আবার আসিবেন। কেউ তো আর আসে না! আমাকে একা একাই ঘরদোরের দেখভাল করতে হয়, জানালা পরিষ্কার রাখতে হয়।’ এই বলে কাঁধের গামছা হাতে নিয়ে ভাঙা জানালার অদৃশ্য কাচের গায়ে বোলাতে থাকলেন। একে মাথা কাজ করছিল না, তার ওপর এরকম অদ্ভুত আচরণ দেখে আমরা দুজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ‘আপনি কী মুছছেন? জানালার তো কাচ নেই।’ 

রামবীর মুচকি হেসে জবাব দিলেন, ‘আপনাদের কি মনে হয়, আমি সেটা জানি না? নাকি জানি না, এই বাড়ি ধ্বংসস্তূপ? কিন্তু ডিউটি হলো ডিউটি। আমার মাইনে আসে কাচ মোছবার জন্য, সাহেব বলেই গেছিলেন। কয়েক বছর আগে দার্জিলিং শহরে ব্যাঙ্কে গেছিলাম, যেখানে ট্রাস্ট থেকে এখনও টাকা আসে। ব্যাঙ্কের বড়োবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সাহেব, বাড়ি বলতে তো আর কিছু নেই। জানালার কাচও নেই তাহলে এই টাকা নিয়ে করব কী?’ বড়োবাবু উত্তর দিলেন, রামবীর, তুমি না চাইলেও টাকা আসবেই। তাহলে, টাকাই যদি আসে, আমাকে তো ডিউটি করেই যেতে হবে, তাই না? বাড়ি না থাকলেও বাড়ির খেয়াল রাখতে হবে। কাচ ভেঙে গেলেও প্রতিদিন কাচ পরিষ্কার রাখতে হবে। এই বলে হাতের গামছা দিয়ে জোরে জোরে শূন্যস্থানে ঘষতে লাগলেন। 

গাড়িতে উঠেও মাথা কাজ করছিল না কিছুক্ষণ। সিদ্ধার্থ আপনমনে বলল, ‘লোকটা পাগল?’ তারপর একটা পাকানো সিগারেট পকেট থেকে বার করে ধরালো। আমি বললাম, ‘সিদ্ধার্থ, আমাকে হয়তো আরও কয়েকদিন এই শহরে থেকে যেতে হবে, আমার মন বলছে। এই রহস্য যা ভেবেছিলাম তার থেকে অনেক বেশি জটিল।’ 

‘মাথায় কিছুই আসছে না। কী বলব, জানি না।’ 

‘এখন ভাবব না। তাহলে মাথা ঘেঁটে যাবে। আগে লালবাহাদুরের বাড়ি যাই।’ লালবাহাদুর রাইয়ের বাড়ি হরিদাস হাট্টা নামের একটা জায়গাতে, যেটা শহরের নীচের দিকে অবস্থিত। ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা মধ্যবিত্ত বাড়িঘর, সরু গলিপথ, হ্যাপি ভ্যালি চা-বাগানের উপত্যকা পাশ দিয়ে নেমে গেছে ঢালু হয়ে। লালবাহাদুরের বাসস্থান একটি একতলা ছোট্ট কাঠের বাড়ি। বাড়ির সামনে মুরগি চরছে কয়েকটা। টালির ছাদের ওপর গা এলিয়ে পড়ে আছে স্থানীয় সবজির মাচা। 

লালবাহাদুরের বয়স পঁয়ষট্টির কাছাকাছি হবে। ঘরের ভেতর কাঠের চেয়ারে আমাদের মুখোমুখি বসে ছোট্টখাট্ট রোগা চেহারার মানুষটি স্মৃতিচারণ করছিলেন। ভাঙা বাংলায়। 

‘আমি বাংলা জানি। পড়তে লিখতে পারি না, তবে বলতে পারি ভালোই। এই শহরে জন্ম থেকে বেড়ে উঠলে বাংলা আপনি নিজে থেকেই শিখে যাবেন। তো, যা বলছিলাম, বছরখানেক হলো কনস্টেবলের পদে ঢুকেছিলাম তখন। সেই রাত স্পষ্ট মনে আছে। ফোন পেয়ে ধনরাজ স্যার বেরিয়ে গেলেন। আমি থানায় ছিলাম। বারোটা নাগাদ ফিরে এলেন, সঙ্গে অরুণবাবু।’ 

‘ড্যানিয়েল লামাকে চিনতেন?’ 

‘চিনব না? বাঘের মতো ভয় পেতাম সকলে। রাজার মতো হাঁটাচলা করতেন। ড্যানিয়েল স্যারের দাপটে টাউনে কোনো অশান্তি ছিল না।’ 

‘ড্যানিয়েল লামার হাত থেকে কেস কেন ধনরাজের হাতে গেল?’ 

‘দেখুন, আমরা চুনোপুঁটি। ওপরের ব্যাপার অত ভালো জানতাম না। তবে এটা সবাই জানত যে ড্যানিয়েল স্যার আর ধনরাজ স্যার, দুজনের কেউ কাউকে পছন্দ করতেন না। একটা রেষারেষি বহুদিন ধরে ছিল। তো, ডিপার্টমেন্টের ভেতরের রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার অনেক রকম হয়। তারপর তো ড্যানিয়েল স্যার চাকরি ছেড়েই দিলেন।’ 

সিদ্ধার্থর দিকে তাকালাম। আনন্দ পাঠক কেন ড্যানিয়েলকে পছন্দ করেন না, বোঝা গেল এবার। 

‘কেন ছাড়লেন, কোনো কারণ জানেন?’ 

‘বলতে পারব না। আমরা সকলেই অবাক হয়েছিলাম। তখন স্যারের আর কতই বা বয়স, চল্লিশ হবে বড়োজোর! যা নামডাক ছিল স্যারের, আর যেরকম কর্মদক্ষতা, একদিন না একদিন ডিএসপি হয়ে যেতেন। পরে আমার মনে হয়েছিল, ভেতরের রাজনীতিতে ধনরাজ স্যারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেননি। 

‘আচ্ছা, অমিতাভ মিত্রর বডি আপনারা কেন পেলেন না? কেন পুলিশের কুকুর আনতে হয়েছিল?’ 

তুমুল বৃষ্টি পড়ছিল। দুইদিন ধরে সার্চ অপারেশন চালানো কঠিন ওরকম আবহাওয়াতে। আর তার থেকেও বড়ো কথা যেটা, তখনো তো আমরা জানতামই না যে অমিতাভ মিত্র খুন হয়েছেন। নিখোঁজ ধরে নিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছিলাম। আমাদের কাছে সূত্র ছিল সামান্যই। বাগানের ঘাসে রক্ত, অরুণবাবুর হাতে আঁচড়ের দাগ, আর গুলির আওয়াজ। অপরদিকে প্রশান্ত গুরুং যা বলেছিল, সেটা অরুণবাবুর কথাকেই সমর্থন করে। আমরা কী করে জানব বলুন, যে এটা মার্ডার কেস? নিয়মমাফিক পুলিশের কুকুর নিয়ে এসে রক্তের দাগের কাছে যাওয়া হয়েছিল। তারপর তো মৃতদেহ আবিষ্কার হলো এই তো কাছেই সেই জায়গাটা। পুরোনো কবরখানা। আমি নিজে ছিলাম, যখন বডি পাওয়া যায়।’ 

‘অরুণ চৌধুরীকে কি সেদিনই গ্রেপ্তার করেছিলেন?’ 

‘রাত্রের মধ্যেই, যখন বডি আইডেন্টিফাই করা হলো। অরুণবাবুর উকিল এলেন, মিডিয়া এল। আমরা তো স্থানীয় মানুষ। এর আগে জানতামই না অমিতাভ মিত্ৰ এত বিখ্যাত কেউ। তারপর দেখলাম, এই কেস প্রায় জাতীয় খবর হয়ে গিয়েছে।’ 

অরুণবাবুকে ছাড়া হল কীসের ভিত্তিতে?’ 

‘কিছুই তো প্রমাণ নেই। যখন খুন হয়েছে, অরুণবাবু থানায় বসে। আপনারা বলবেন, সহকারী ছিল কেউ। কিন্তু তাহলে সে কোথায় গেল? তাকে ধরা গেলেও তবু কেস সাজানো যেতে পারত। সেটাও হয়নি। আমরা জনে জনে তল্লাশি চালিয়েছি, যদি সন্দেহভাজন কাউকে মেলে। কিস্যু পাইনি। অন্যদিকে, অরুণবাবুর উকিল ধনরাজ স্যারকে হুমকি দিচ্ছিলেন যে মিডিয়ার কাছে মিস্টায়াল নিয়ে মুখ খুলবেন। প্লান্টার্স অ্যাসেসিয়েশন চাপ দিচ্ছিল। আমাদের কাছে যা সূত্র ছিল তা দিয়ে চার্জশিট বানানো সম্ভব নয়। এর থেকে বেশিদিন আটকে রাখলে মুখ পুড়ত আমাদের।’ 

‘ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত কার ছিল?’ 

‘ধনরাজ স্যারের। ঠিকই করেছিলেন। স্যার সবসময় সেই সিদ্ধান্তটাই নিতেন যাতে ডিপার্টমেন্টের ভাবমূর্তি অক্ষত থাকে। মনে আছে, অরুণবাবুকে যেদিন জামিনে ছাড়া হল, সেদিন স্যারের ঘরে বসে ছিলেন অরুণবাবুর উকিল। গুজরাতি ভদ্রলোক, নামটা ভুলে গেছি এখন। স্যার তাঁকে ইংরেজিতে কিছু বলছিলেন। অত ভালো ইংরেজি তো জানি না। যেটুকু বুঝেছিলাম, স্যার বলছিলেন, ভদ্রলোক যদি রাজি থাকেন, তাহলে সবদিক রক্ষা হয়। সম্ভবত অরুণবাবুর জামিন নিতে রাজি হবার কথা বলছিলেন। যদিও সবই আমার অনুমান মাত্র। ভুলও হতে পারি, কারণ অরুণবাবু জামিন নয়, বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন, যতদূর মনে পড়ে। সেদিন বিকেলবেলা মুক্তি পেলেন। তারপরেও কেস চলছিল, কিন্তু আমরা কোনো দিশা পাইনি কোনোদিকেই।’ 

‘সেই সময়টায় ড্যানিয়েল কোথায়?’ 

চিন্তা করে লালবাহাদুর উত্তর দিলেন, ‘এতদিন পরে সেটা আর ঠিকঠাক মনে পড়ছে না। যতদূর সম্ভব, ড্যানিয়েল স্যার মনে হয় ছুটিতে ছিলেন।’ 

ঋষি রোডের বাড়ির ছবি দেখালাম লালবাহাদুরকে। ‘এই বাড়িটা ঋষি রোডে। লেপচাজগৎ আর দার্জিলিং-এর মধ্যবিন্দুতে অবস্থিত। কেসের সঙ্গে কি এই বাড়ি কোনোভাবে জড়িয়ে? কিছু জানেন?’ 

‘না তো! এমন বাড়ি এই প্রথম দেখছি।’ 

আরও টুকটাক কিছু প্রশ্ন করে আমরা উঠে পড়লাম। লালবাহাদুর ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিলেন ওল্ড সেমেট্রির ঠিক কোন জায়গায় অমিতাভর লাশ পড়েছিল। বেরিয়ে আসতে গিয়ে হঠাৎ, কী মনে হলো, পেছন ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা যে রাত্রে অরুণবাবুকে থানায় নিয়ে আসা হয়, সেই রাতে তো ড্যানিয়েলের ডিউটি ছিল না। তবুও তিনি থানাতে এসেছিলেন। আপনার কি মনে আছে সেটা?’ 

‘হ্যাঁ, কেন থাকবে না? স্যার এসেছিলেন, রাত তখন আড়াইটে। চোখ লাল। অল্প খোঁড়াচ্ছিলেন।’ 

আমি থমকে গেলাম। খোঁড়াবার কথা তো আনন্দ পাঠক বললেন না! 

‘কেন এসেছিলেন?’

‘জানি না। খবর পেয়েছিলেন হয়তো।’ 

‘কিন্তু থানা থেকে তো কেউ ফোন করেনি! 

‘তা করেনি। কিন্তু ড্যানিয়েল স্যার তো নিজের চোখেও দেখে থাকতে পারেন। যদিও এটা একান্তই আমার নিজস্ব অনুমান। আশেপাশেই তো ছিলেন। 

‘আশেপাশে মানে?’ 

লালবাহাদুর আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ‘আপনি জানেন না? সেই রাত্রে তো ড্যানিয়েল স্যার জলাপাহাড় রোডেই ছিলেন। অনেকেই তাঁকে দেখেছে।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *