২১
পরের দিন। সন্ধে নেমে এসেছে ম্যালের উপর। আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। সিদ্ধার্থ থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু অনেক আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি ওকে। একলা হতে চাইছিলাম। শান্ত হয়ে বসে থাকাটা এখন দরকার। নাহলে জট ছাড়ানো সম্ভব নয়।
আজ সকালবেলাই সিদ্ধার্থকে নিয়ে ছুটেছিলাম। আনন্দ পাঠকের বাড়ি। তাঁকে হাতে পায়ে ধরেছিলাম, যেন একবার আমাকে ঋষি রোডের বাড়িতে ঢুকবার অনুমতি দেওয়া হয়। অদ্ভুত ধৈর্য আনন্দ পাঠকের। এত কিছুর পরেও বিরক্ত হলেন না। মন দিয়ে আমার কথা শুনলেন। তারপর আমাকে নিয়ে গেলেন থানায়। কী বোঝালেন জানি না। একজন কনস্টেবলকে দেওয়া হলো, সঙ্গে যাবে। গোটা রাস্তা কারোর সঙ্গে একটাও কথা বললাম না। মাথার মধ্যে ঢং ঢং করে বাজছিল শুধু বিনয়েন্দ্র মুস্তাফির উক্তি, ‘দেখলেন তো, মরলো কে? গরিব ছিল যে, সে-ই।’
বাড়ির চারদিক পুলিশের হলুদ ফিতে দিয়ে আটকানো। বাগানে এবং দরজার সামনেও হলুদ টেপ। তালা খুলে ভেতরে ঢোকা হলো। সিঁড়ির মুখের ঘরটার ও খোলা হলো তালা। ভেতরটা আগের দিনের মতোই। যেমন ছিল, সব তেমন। কনস্টেবলের দিকে ফিরলাম। ‘খাটটা সরাতে চাই। সাহায্য করবেন?’
তিনজনে মিলে খাট সরিয়ে গোটা দেয়াল আবার চোখ চালালাম। বেশিক্ষণ লাগল না। ওপরের ছবিটার ফুটদেড়েক নীচেই আর একটা ছবি। একটা চার পা-ওয়ালা লেজ বার করা জন্তু। হাতি ঘোড়া কুকুর বেড়াল যা খুশি হতে পারে। খাট দিয়ে দেয়ালটা আড়াল করা ছিল বলে দেখা যায়নি। সেই একই রং দিয়ে আঁকা, যে রঙে ওপরের মনুষ্যমূর্তিগুলির ছবি আঁকা হয়েছে। শুধু ওপরের ছবিতে টুপি আর অমিতাভর নামটা অন্য রঙের।
দেখা হয়ে গিয়েছিল। উঠে দাঁড়ালাম, ‘এবার যেতে পারি।’
সিদ্ধার্থ কাল থেকে অস্বাভাবিক নির্বাক। আমারও কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। একটা হালকা আলোর রেখা দেখতে পেয়েছি। জানি না সেটা মরীচিকা কি না।
দার্জিলিং-এ ফিরে আবার পুলিশ লাইব্রেরিতে ছুটলাম। প্রচুর প্রয়োজনীয় তথ্য যাচাই করে নেবার ছিল। যে সত্যিটা এখন মোটামুটি দেখতে পাচ্ছি, সেটাকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হবে। কিছু তথ্যের জন্য কলকাতায় কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধুকে ফোন করতে হলো। সেসব কাজ মিটিয়ে বেরোলাম যখন, দুপুর পেরিয়ে গেছে। সিদ্ধার্থকে আগেই বিদায় দিয়েছিলাম, কারণ একা থাকবার দরকার পড়ছিল বেশি করে। হোটেলে ফিরলাম। বিশ্রাম প্রয়োজন। পর পর দু-দিন ঘুম হয়নি রাত্রে। ঘরে ঢুকে বালিশে মাথা রেখে হাত পড়লো অমিতাভর পাণ্ডুলিপির ওপর।
যদি বাস্তবের এই সমস্ত ঘটনাই মিথ্যে হয়, যদি পুরোটাই ভুল করে থাকি, তাহলে এই উপন্যাসের সিদ্ধান্তও কি ভুল? নাকি সেখানেও এক বিরাট মিথ্যে? বাস্তব কি সত্যিই উপন্যাসকে এতটাই নকল করতে পারে? তাহলে আনিসুরের হত্যারহস্যের আর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে?
উপন্যাসটার পাতা ওলটাতে ওলটাতে হঠাৎ কী একটা মনে হলো। তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নিয়ে গুগল খুললাম। এবং কয়েক মুহূর্তের জন্য হৃদস্পন্দন মনে হচ্ছে বন্ধ হয়ে গেল আমার। হ্যাঁ, গল্পটা, এবার সম্ভবত প্রায় পুরোটাই দেখতে পাচ্ছি। ছোটোখাটো কিছু ফাঁক বাদ দিয়ে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়াল ছিল না। চোখ মেললাম, তখন সন্ধে ছ-টা বেজে গেছে। মুখে চোখে জল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে বসলাম ম্যালের রাস্তায়। সেই থেকে বসেই আছি। চোখে পড়ল, গতকালকের দেখা সেই বাচ্চা ছেলেটি আজ বাবা মায়ের সঙ্গে বেরিয়েছে। স্বভাবশত লাফালাফি করছে এখনও। টাইট ড্রেস পরা মা নিজের পোশাক সামলাতে, মূলত হাঁটু ঢাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার মধ্যে ধমকাচ্ছেন ছেলেকে। বাবা উদাসীন ভাবে নীচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে। সেই দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল গতকালকের দৃশ্য— ছেলেটির লাফালাফি, মায়ের রেগে যাওয়া, হিপপকেটের পার্স বার করে বাবার চুল আঁচড়ানো। চোখ বন্ধ করলাম। একে একে সব জট খুলে যাচ্ছে।
রাত হয়ে আসছিল। ম্যাল থেকে হাঁটা লাগাতে যাচ্ছি, চমকে উঠলাম। দেখি, আধো অন্ধকার কুয়াশার মধ্যে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন ড্যানিয়েল লামা। তাঁর পেছনে প্রহরীর মতো খাড়া গিরিরাজ।
ড্যানিয়েলের দিকে এগিয়ে গেলাম। এখন আর ভয় লাগছে না। সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আপনাকে ফোন করেছিলাম। ধরেননি, তাই মেসেজ পাঠিয়েছিলাম। এটাই বলতে যে গল্পটা আমি এখন জানি। পুরোটাই।’
ড্যানিয়েল নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বললাম, ‘যেদিন এই শহরে আমি পা দিলাম, গিরিরাজের কাছ থেকেই আপনি খবরটা পেয়েছিলেন, তাই না? আমার নামটা গিরিরাজ মদনের কাছ থেকে জেনেছিল। আপনারও আমার নাম জানা ছিল, আমার ম্যাগাজিনের সূত্রে। বুঝেছিলেন, কেন এখানে আসছি। নজর রাখবার জন্য সেদিন জলাপাহাড়ের ধারে রেইনকোট পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেদিন রাত্রেও হোটেলের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আপনিই। প্রথমে ভেবেছিলাম গিরিরাজ। কিন্তু দায়টা আপনারই ছিল। গিরিরাজের নয়।
গিরিরাজের দিকে তাকালাম আমি। গিরিরাজ অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে নিল। ‘শুধু এক রাত্রে, আমি আর সিদ্ধার্থ ডিনার করে হোটেলে যখন ফিরছিলাম, সেদিন গিরিরাজ গাড়ি চালিয়ে আমাদের অনুসরণ করছিল, আপনি কি সেই গাড়িতে ছিলেন? আমার ধারণা, ছিলেন।’
ড্যানিয়েল ধীরে ধীরে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসলেন। গিরিরাজকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন। সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ড্যানিয়েল আমাকে ইঙ্গিত করলেন, তাঁর পাশে এসে বসতে।
‘আজ আপনার চলে যাবার কথা ছিল না?’ পাইপে টান দিয়ে ড্যানিয়েল বললেন।
‘সত্যিটার খোঁজ আমি পেয়েছি, মিস্টার লামা। অরুণ চৌধুরীর হাতের আঁচড়ের ব্যাখ্যাও।’
‘ঋষি রোডের বাড়ির দেয়ালের ছবিটা আঁকতে দুটো আলাদা রং কেন ব্যবহার হয়েছিল, সেটাও বুঝতে পেরেছেন কি?’
হাসলাম। ‘ওই ছবিটার আপনাকে ভাবাবে, স্বাভাবিক ব্যাপার। হ্যাঁ, বুঝেছি।’
অন্ধকার পাহাড় গয়না পড়েছে সর্বাঙ্গে, মিটমিটে হলুদাভ আলোর দল আকাশ ছুঁতে চাইছে। সেদিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললাম, ‘প্রশ্নটা হলো, এই সত্যিগুলো কি আপনি এই বয়সে হ্যান্ডেল করতে পারবেন? আমি কিন্তু গল্পটা লিখব।’
‘আপনার কি মনে হয়, আমি আর কেয়ার করি? আমি যা করেছি, বেশ করেছি। নিজের ডিউটি ছিল, তাই করেছি। কিন্তু অন্যের পাপের বোঝা আমি বহন করব না। নেভার!’
‘আমি ভেবেছিলাম, আপনি আর গিরিরাজ আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। অনুসরণ করছেন, যাতে বিপদে ফেলা যায়। এখন বুঝতে পারছি, আপনি প্রথম থেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন আমার সুরক্ষা নিয়ে। দেখতে চাইছিলেন, আমি কোথায় যাই। আপনার মনে হয়েছিল, যদি এতদিনকার লুকিয়ে রাখা সত্যটাকে খুঁজে বার করেই ফেলি, তাহলে আমার বিপদ হতে পারে। তাই আমাকে কভার করতে চেয়েছিলেন। কারণ আমিই ছিলাম আপনার শেষ ঘোড়া।’
ড্যানিয়েল চোখ বন্ধ করলেন। এই প্রথম দেখতে পেলাম এক ক্লান্ত অবসন্ন বৃদ্ধের জরাগ্রস্ত অবয়ব। আমাকেও নিজের কিছু কথা বলতে হতো। মিস্টার লামা, আপনি ভেবেছিলেন আমাকে ব্যবহার করবেন। আর তাই নিজে অদৃশ্য থেকে ম্যানিপুলেট করে গিয়েছেন আমায়। যখন দেখলেন ভুল রাস্তায় চলেছি, তখন মরিয়া হয়ে অরুণ চৌধুরীর হাতে আঁচড়ের দাগের কথা মনে করিয়ে দিতে চাইলেন। মনে করাতে চাইলেন নিজের নার্ভের সমস্যার কথা। এই ক্লুগুলো আমার মাথায় হয়তো এভাবেই গজাল মেরে ঢোকাতে হতো। ঠিকই বলেছিলেন, আমি নিজেকে অত্যন্ত বেশি ওভারএস্টিমেট করা শার্লক হোমস।’
‘যা করেছি, সারাজীবনে যা করেছি, তার জন্য আমার একফোঁটাও অনুতাপ নেই। শাস্তি পেতে হলে পাব। কিন্তু আজ আপনার কাছে এসেছিলাম সম্পূর্ণ অন্য কারণে। শুধু এটা বলতে যে আমি নিজের শাস্তিটুকুই নেব। অন্যেরটা নয়।’ উত্তর দিলেন ড্যানিয়েল।
ড্যানিয়েলের কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা জরুরি প্রশ্ন মাথায় এল, যেটা করা হয়নি এতক্ষণ। ‘আপনার বাড়িতে দেখেছি, অনেক নাটকের বই। ঊনবিংশ শতকের ব্রিটিশ আর আমেরিকান নাট্যকারদেরই মূলত আধিক্য সেখানে। আপনি তাহলে এই সময়টার নাটক অবসর সময়ে পড়তে ভালোবাসেন, তাই তো?’
ড্যানিয়েল উত্তর না দিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকলেন। আবার মুখ খুললাম, ‘এবার কি আপনার ভার্সনটা আমাকে বলবেন, মিস্টার লামা?’
.
তারপর বেশ অনেকটা সময় দুজন পাশাপাশি বসেছিলাম। ঘন বৃষ্টির দল আমাদের ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা নিচ্ছিল, কিন্তু চক্রবুহ্য নিয়ে আমার তখন আর কিছুই এসে যেত না।