১৪
০১/১০/১৯৭৩
প্রিয় সঞ্জয়বাবু,
আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে ভালো লেগেছিল, চিঠি পেয়ে আরও ভালো লাগল। এপ্রিল মাসে যখন দার্জিলিং-এ এসেছিলেন, আলাপ হলো বিকাশের বাড়ি, তখনও জানতাম না ফাঁসিদেওয়ার কবিসম্মেলনে আপনি থাকবেন। আপনিও যে সাহিত্যপাগল মানুষ, জেনে ভালো লেগেছিল খুব। আপনাদের যেরকম কাজ, তাতে সুদূর মফস্বলের টিমটিমে কবিতামেলাকে গুরুত্ব দেবার দরকার পড়ে না। কিন্তু সেদিন সারারাত আড্ডা মেরে বুঝেছিলাম, আপনার মধ্যে যে মানুষটা লুকিয়ে আছে, তার ডাকনাম পাঠক।
এবার চিঠির প্রসঙ্গে আসি। আমাকে এবং আমাদের নিয়ে আপনি খবর করতে চাইছেন, খুব ভালো কথা। কিন্তু যেটা আশঙ্কার বিষয়, তা হলো একটা বাণিজ্যিক কাগজ আমাদের সাহিত্যপ্রয়াসকে কতটা সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখাতে পারবে। কারণ খুব স্পষ্ট ভাষায় বলছি, সত্তর দশকের প্রথম এই তিন বছরে বাংলা কবিতা যেটুকু লেখা হয়েছে তাদের যদি আলোচনা করতে যান, আপনি নকশাল আন্দোলনকে বাদ দিয়ে তা করতে পারেন না। কিন্তু বিগ হাউসের মুনাফাধন্য সংবাদমাধ্যম নকশাল আন্দোলনকে কতটা দেখাবে, রাষ্ট্রীয় অত্যাচারে নিহত অসংখ্য কর্মী, যাদের মধ্যে অনেক কবিও আছেন, তাদের চালচিত্রে কতটা আজকের কবিতাকে স্থাপিত করবে, আমার সন্দেহ আছে। আপনি কিছু মনে করবেন না, কারণ আপনাকে আঘাত দেবার উদ্দেশ্যে এ কথা বলিনি। কিন্তু যখন দেখতে পাচ্ছি তিমিরবরণ, মুরারি মুখোপাধ্যায়, অমিয় চট্টোপাধ্যায় বা দ্রোণাচার্যদের নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করছে না আমাদের বড় সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাধন্য কবি লেখকের দল, তখন সন্দেহ দৃঢ়তর হয়। তিমির বা মুরারি কত বড় কবি ছিল, সদ্যতরুণ তুষারকান্তি চৌধুরী বা অনন্য রায় বা জয় গোস্বামী (অনন্যসাধারণ কবিতা লিখছে তিনজনেই, বলার অপেক্ষা রাখে না, এবং প্রত্যেকরই খুব তাড়াতাড়ি বই হবে, এই আশা রাখি। শুধু তাই নয়, তুষারকান্তি এবং সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, দুজনে মিলে স্থানাংক নামের একটা উচ্চাঙ্গের লিটল ম্যাগাজিন বার করেছে এই বছরে, যার প্রথম সংখ্যা পড়ে আমার বিস্ময়ের অবধি থাকছে না), এদের তুলনায় তারা প্রতিভাবান নাকি শুধুই উচ্চকিত স্লোগানের কবিতা লিখে গিয়েছে এসব প্রশ্নই আজ অপ্রাসঙ্গিক, এবং প্রশ্নকর্তার অভিসন্ধি বিষয়ে সন্দিহান করে দেয়। চারজন কবি একটা আন্দোলন করতে গিয়ে আগে পরে নিহত হয়েছে, এবং তাদের সঙ্গে খুন হয়েছে আরও কয়েক হাজার যুবক, অথবা নিখোঁজ হয়েছে, এক কবি ও সম্পাদককে ময়দানে গলা কেটে খুন করা হয়েছে, খোদ আমার জেলাতে কৃষক ইউনিয়ন বা চা-বাগানে স্ট্রাইক করবার অপরাধে গুম করে দেওয়া হয়েছে একের পর এক রাজনৈতিক কর্মীদের। এদের প্রভাব যদি বাংলা কবিতায় সর্বাধিক না হয় তাহলে সে ভাষায় আমি লিখি না এবং লিখতেও চাই না। যদি সব্যসাচী দেব, সমীর রায়, নবারুণ ভট্টাচার্য অথবা পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতাকেও উড়িয়ে দিতে হয় যথেষ্ট কবিতা হলো না বলে, তাহলে আমিও কিছু লিখি না, পুরুলিয়ার সৈকত রক্ষিতও কিছু লেখে না, এমনকি গল্প লিখতে পারেন না সুবিমল মিশ্রও, এ কথা মানতেই হবে। আর যদি আমাদের লেখালেখিকে মান্যতা দিতেই হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে উপেক্ষা করলে চলবে না। প্রশ্ন হলো, আপনার কাগজ সেটা কতটা পারবে?
প্রশ্ন করছি কারণ আমরা দেখেছি ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং শরণার্থীর আগমন নিয়ে যত যত লেখা হয়েছে সংবাদপত্রে, লিখেছেন আমাদের প্রতিষ্ঠিত কবি লেখকরাই, তার সিকির সিকিও এই নিহত ছেলেমেয়েদের নিয়ে লেখা হয়নি। মাত্র কয়েকদিন আগে পাবলো নেরুদা মারা গেলেন, অথচ সংবাদপত্রগুলো নীরব। শুনতে পাই, ওদের দেশে নাকি নেরুদার শেষযাত্রা ব্যাপক একনায়কবিরোধী বিক্ষোভের রূপ নিয়েছে। কিন্তু অত বড় কবি হয়েও শুধুমাত্র কমিউনিস্ট হবার অপরাধে নেরুদাকে নিয়ে দায়সারা কয়েকটা লাইনের বেশি খরচ করে না আমাদের কাগজগুলো। এই যাদের দায়বদ্ধতা, তারা কতটা পারবে আমাদের লেখালেখিকে সৎভাবে তুলে ধরতে?
সত্যি বলতে কী, দিনে দিনে আমার এই বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছে যে লিখে ফিখে কিছু হয় না। নাহলে বড় কাগজের উল্টোদিকেই দাঁড়িয়ে অবাণিজ্যিক লিটল ম্যাগাজিনগুলো ভরে উঠেছে নিহত ভাই বন্ধু দের নিয়ে কবিতায়। শ্রীরামপুরের তরুণ কবি মৃদুল দাশগুপ্তর লেখা আপনি পড়েছেন? বিপুল চক্রবর্তী, অতনু চট্টোপাধ্যায়, সরোজলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তো নিয়মিত পাতার পর পাতা লিখে যাচ্ছেন লিটল ম্যাগাজিনে, এই বিষয় নিয়ে। বরানগর, কাশীপুর, সাঁইথিয়া, খড়িবাড়ি শুধু লাশ গুনতে গুনতে পচে যাচ্ছে আমাদের কবিজন্ম। তার মানে, কোনো কবিতা, কোনো সৎসাহিত্য বিন্দুমাত্রও কিছু পরিবর্তন করতে পারে না, সে যতই আমরা বিশ্বাস করতে ভালোবাসি না কেন। তাই সংকটটা দ্বিবিধ। সমসাময়িকতা না মানলে কবিতাকে ধরা যাবে না, এদিকে কবিতা দিয়ে সমসাময়িকতার কিছুমাত্র বদল হয় না। তাহলে তো আপনারা বলবেন জেনেরিক কবিতা লেখাই ভালো। মানে যার মধ্যে রাজনীতি সমাজ ইত্যাদি থাকলেও তা এতই ব্যাপ্ত যে যুগে যুগে সত্য। হতে পারে, আমি ঠিক জানি না। লিখে আদৌ কতটা কী হয়, জানি না।
তা বলে আবার আমাকে কমিউনিস্ট ভেবে বসবেন না যেন! এদের আন্দোলন, এদের দাবী, এগুলো আমি বুঝি না। যেটুকু বুঝি, একটা সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তি যেখানে অসংখ্য ছেলেমেয়েকে গায়ের জোরে খুন ও গুম করছে, তার বিরুদ্ধে কথা বলবার ক্ষমতা যদি নাও থাকে, অন্তত পক্ষে যেন কথা না বলি। অন্তত যেন নিজের অভিজাত নিরাপদ কোটরের মধ্যে ঢুকে শীলিত বাজারী গোয়েন্দা গল্প লিখে নিজের কেরিয়ার না বানাই। এটা বলবার জন্য আমাকে কমিউনিস্ট হতে হয় না। এমনকি কোনো ধরনের সংগঠিত রাজনীতিকেই আমি সন্দেহের চোখে দেখি। কিন্তু নর্দমার ধারে লাশ হয়ে শুয়ে থাকল আমার যে বন্ধু, তার স্মৃতি যদি আমাকে তাড়িত না করে, যদি তাকে অগ্রাহ্য করে প্রেম যৌনতা পরকীয়া ও ডিটেকটিভ গল্পের দো-আঁশলা মডেলে স্বমেহন করি আর বলে বেড়াই যে রাজনীতির কথা লিখতে আমার সতীত্বে নিউমোনিয়া ধরবে, তাহলে তার থেকে বড় অন্যায় এ মুহূর্তে আর কিছুতে নেই। সেটুকু মোহমায়া আমাকে যেন কখনো না ধরে। এর বাইরে, আপনি আমাকে যা খুশি প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু শর্ত হলো, আমি যা উত্তর দেব সেগুলোকে ছাপতে হবে। পারবেন? আপনার সদিচ্ছা নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন আপনার কাগজের পলিসি নিয়ে। ভুল বুঝবেন না। আমার ভালোই লাগছে যে এত বড় কাগজে আমাদের লেখালেখি আপনি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করবেন।
এদিকে আবার কবে আসছেন? এবার আপনাকে কালিম্পঙের গ্রামের সাইডে নিয়ে যাব। এখানকার দেশী মদ আর ঝাল মাংসের পিঠে খাওয়াবো। চলে আসুন তাড়াতাড়ি। পাহাড়ি গ্রামে কম্বল মুড়ি দিয়ে খাটিয়ার ওপর বসে মদ খেতে খেতে সারারাত আড্ডা আর কবিতা পড়ার সুযোগ যদি হাতছাড়া না করতে চান
—অমিতাভ মিত্র
ভালো কথা, জামশেদপুরের কমল চক্রবর্তীরা ‘কৌরব’নামের একটা লিটল ম্যাগাজিন বার করছে। ওরা চাইছিল সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা লেখা। আপনি লিখবেন? তাহলে ওদের বলবো আপনার সংগে কথা বলে নিতে।