১৫
অস্ত্র আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে বহুদিন নীরব
অস্ত্রের নীরবতায় অস্ত্রের গায়ে আমরা পেলাম মরচে
মরচে পড়া অস্ত্র নিয়ে আমরা এইবার ঘাস কাটি—
চলো
—নির্মল হালদার
.
বহুদিন জলে ডুবে থাকার পর দুম করে যদি মাছকে ডাঙায় তোলা হয় তাহলে অপ্রত্যাশিত সূর্যালোকে তার নাকি চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। জলের অভাবে নয়। আকস্মিক অভিঘাতে। সকালবেলা সিনক্লেয়ারের লাউঞ্জে বসে কফি খেতে খেতে মনে হচ্ছিল, অন্ধকার জলের নীচে কয়েক যুগ কাটাবার পরে হঠাৎ আমাকে মাটিতে আছড়ে ফেলা হয়েছে, আর আমার চোখের ওপর ঝলসাচ্ছে একটা হাজার ওয়াটের বাল্ব। নিজেকে বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, আমি কি এতটাই একচক্ষু যে অন্য কোনো সম্ভাবনা খুঁটিয়ে দেখবার কথা এতদিন মাথাতেও এল না?
কাল ড্যানিয়েল লামা ফোন রেখে দেবার পর উত্তেজনায় ঘুম আসছিল না। যে মানুষটা সমাজবিচ্ছিন্ন এক নিভৃতচারীর দিনযাপন করেন, কারোর সঙ্গে মেশেন না, বাড়ির বাইরে বেরোন না, সেই তিনিই আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছেন। তাঁর বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম। ড্যানিয়েল বললেন তিনি সকালবেলা সিনক্লেয়ারে আসবেন। ফোন রাখবার আগে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তাঁর এই মতপরিবর্তন। ড্যানিয়েল কড়াভাবে জানালেন যে আমার সঙ্গে তাঁর নিজস্ব বোঝাপড়া আছে।
ফোনের পর অমিতাভর উপন্যাসটা ধরে শেষ করলাম। আর অপ্রত্যাশিত আঘাতটা পেলাম তখনই। যে ধারণা মনের মধ্যে নিয়ে ঘুরছিলাম, যে মাধব রক্ষিতই খুন করেছেন, সেটা চুরমার হয়ে গেল। তারপর আবার প্রথম থেকে উপন্যাসটা পড়লাম। পরপর দুইবার। উপন্যাসের ভেতর পাতায় পাতায় যে এত ব্লু ছড়ানো, আমার অলস চোখ সেগুলোকে গত চারদিন ধরে এড়িয়ে গিয়েছিল কীভাবে? কীভাবেই বা গোটা গল্প থেকে বিমলবাবুকে ভুলে থাকলাম? গল্পটা তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, যা দেখাবার। বিমলবাবুই যে অপরাধী, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন নয়। কঠিন হলো, কীভাবে তিনি খুনটা করলেন, আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রহস্যগুলোর সমাধান। তাহলে কি এ পর্যন্ত যা যা ভেবে এসেছি, সব ভুল? আবার নতুন করে ভাবতে হবে? কারণ এই উপন্যাস আর বাস্তবের অপরাধ, এই দুটোর মধ্যে আশ্চর্য মিল! অমিতাভ মিত্র কি সত্যিই ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন? এই মিল কাকতলীয় হলেও, বড্ড বেশি চোখে পড়ার মতো।
মিল কি শুধুই মাধব আর আনিসুরের বিবরণে? অমিতাভ আর অরুণ, আনিসুর আর মাধব। একজনের খুনের দায় চাপল অন্যের ঘাড়ে, কিন্তু অ্যালিবাইকে ভাঙা গেল না। কিন্তু শুধু সেটুকুতেই তো মিল আবদ্ধ নেই! পাতায় পাতায় মিল। বাস্তব এই গল্পকে শিকারির মতো পিছু পিছু ধাওয়া করে গিয়েছে। হত্যাকারী কি অসমাপ্ত উপন্যাসটা পড়েছিল?
মোবাইল খুলে সময় দেখলাম। আটটা বাজতে পাঁচ। আর তখনই সিনক্লেয়ারের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন এমন একজন, যিনি নিজের পরিচয় না দিলেও গোটা পৃথিবী সুতীব্র চিৎকারে জানিয়ে দিতে পারে, ইনিই ড্যানিয়েল লামা।
রিপোর্ট অনুসারে, ড্যানিয়েলের বয়স এখন পঁচাশি। অমিতাভ-কাণ্ডে জীবিত সাক্ষীদের মধ্যে প্রবীণতম। সেই বয়স জানান দিচ্ছে মুখের কুঁচকে থাকা চামড়া, চোখের কোণার ভাঁজ, ধবধবে সাদা চুল ও গোঁফ, এবং হাতের লাঠি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার বাইরে যেটুকু পড়ে থাকে, সেটাকে বয়স দিয়ে মাপা যায় না। যখন হেঁটে আসছিলেন, মনে হচ্ছিল হোটেলের করিডর একটা স্টেজ, আর তার মধ্যে দিয়ে সম্রাটের ভূমিকায় অভিনেতা হাঁটছেন। নিখুঁত সাহেবি বহিরঙ্গে ছাই রঙের টি-শার্ট এবং আকাশি জিনস। হাতের লাঠিটা সম্ভবত শোভা বাড়াবার জন্যে, কারণ হাঁটাচলায় কোনোরকম বার্ধক্যের ছাপ চোখে পড়ল না। ঠোঁটের কোণ থেকে পাইপ ঝুলছে অবহেলায়। সেটা যে চব্বিশ ঘণ্টার সঙ্গী, ধরার কায়দা থেকে পরিষ্কার। ধবধবে ফর্সা গায়ের রং। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে দাঁড়িয়ে পড়লেন, এবং চোখের ভেতর বহুদিনের সযত্নলালিত অভ্যাসের চিহ্ন হিসেবে একটা ক্রূরতার ছাপ যে পাকাপাকি থেকে গিয়েছে, সেটা লুকোবার কোনো চেষ্টাই নেই।
লাউঞ্জে সেই দম্পতি বাচ্চা ছেলেটির সঙ্গে একপাশে বসে প্রাতরাশ করছিল। মহিলা মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিলেন আমার দিকে। এখন ড্যানিয়েলকে দেখে স্বামীকে কনুইয়ের খোঁচা মারলেন। ভদ্রলোক বেচারি শীর্ণ, টাকমাথা, নিতান্তই ভালোমানুষের মতো মুখ। তিনি কিছু না বুঝে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন আমাদের দিকে।
ডানিয়েল আমার দিকে এগিয়ে এলেন। সাহেবি উচ্চারণে ইংরেজিতে বললেন, ‘তনয়া ভট্টাচার্য, রাইট?’
উঠে করমর্দন করলাম। ড্যানিয়েলকে অনুরোধ করলাম ব্রেকফাস্ট করতে। ড্যানিয়েল হাত নেড়ে না জানালেন। নিজের জন্য অর্ডার দিলেন আর্ল গ্রে। তারপর ঠোঁটের পাইপ নামিয়ে আবার সরু চোখে তাকালেন, ‘আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন কেন?’
বিশদে নিজের আসার কারণ বললাম। গতকালের রামবীর হত্যার কথাও বাদ দিলাম না। শুধু বাড়িটার সঙ্গে অমিতাভর যে কোনো রকম সম্পর্ক ছিল, সেটা চেপে গেলাম। পুলিশকে এই কথা জানাইনি। কাজেই ড্যানিয়েলকে এখন বললে, যদি তিনি পুলিশকে বলে দেন, পুলিশের আবার নতুন করে সন্দেহ তৈরি হবে।
‘আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আপনার ভার্সনটা শুনতে চাই। তার থেকেও বড়ো কথা, যে জায়গাগুলোতে খটকা লাগছে, সেগুলো পরিষ্কার করতে চাই। যেমন, খুনের দিন রাত্রিবেলা আপনি থানায় গেলেন কেন। কেন ধনরাজ গম্বুর হাত থেকে তদন্ত নিয়ে নিলেন, আর দশ দিন পরে কেনই বা আপনাকে কেস থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।
আমি এসব ভুলে গিয়েছি। দিজ ড্যাম টাউন ডাজ নট ডিজার্ভ মি। আমিও তাই এদের সবাইকে পরিত্যাগ করেছি। এখন এসব প্রশ্নের কোনো মানে নেই আমার কাছে।’ গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন ড্যানিয়েল।
‘তাহলে আজ দেখা করতে এলেন কেন? কেনই বা বললেন যে আমার সঙ্গে আপনার কিছু বোঝাপড়া আছে?’ হাসার চেষ্টা করলাম।
‘এসেছি এটা দেখতে যে আপনি ভুল পথে কতদূর হেঁটে গিয়েছেন!’
‘মানে?’
মানে এটাই, নিজেকে যতই বুদ্ধিমান ভাবুন না কেন, আপনি স্টুপিড মহিলা। টিকটিকি সাজার অভিপ্রায় আপনার মতো বহু অকর্মণ্যের মধ্যে আমি এর আগেও দেখেছি। কিন্তু সত্যিটা হলো যে আপনি কিছু জানেন না, কিছুই বোঝেন না।’ পাইপে আবার অগ্নি-সংযোগ করতে করতে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো ছুঁড়ে দিলেন ড্যানিয়েল।
নিজেকে শান্ত করলাম। প্রথমেই উত্তেজিত হয়ে সংঘাতের রাস্তায় গেলে ড্যানিয়েলের মুখ থেকে কোনো কথাই বেরোবে না।
‘মিস্টার লামা। আমি আমার ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে একটা স্টোরি করতে এসেছি শুধু। আর কিছুই না। তদন্ত করছি না, গোয়েন্দাগিরিও না। আমার পাঠকের স্বার্থে কিছু প্রশ্ন করতে হয়েছে। এবার সেগুলোর উত্তর যদি না মেলে, আমাকে সেই প্রশ্নগুলোকেই খোলা অবস্থায় তাঁদের সামনে উপস্থিত করতে হবে। কিন্তু সেট করার আগে আমি তো চাইবই যতগুলোর সম্ভব যেন উত্তর পাওয়া যায়, তাই না? হতেই পারে আমি কিছু জানি না, এবং সম্পূর্ণ ভুল রাস্তায় হাঁটছি। সেক্ষেত্রে ঠিক রাস্তা দেখিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করতে পারি কি?’
ড্যানিয়েল আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর একটা হিমশীতল হাসি উপহার দিলেন, যেটা দেখে বুঝলাম কেন এই ভদ্রলোক সত্তর দশকের টেরর ছিলেন। দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে শ্বাপদের দাঁত বেরিয়ে এল, আর চোখদুটো সেই অনুপাতে সেজে উঠল নির্মম। যখন পুলিশে ছিলেন, সন্দেহ নেই এই হাসি দেখে সন্দেহভাজন অথবা অপরাধীদের মনের অবস্থা কীরকম হতো। আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা গুবরে পোকা হেঁটে হেঁটে ওপরের দিকে উঠছিল। সোজা চোখে মুখ একটুও বিকৃত না করে তাকিয়ে থাকলাম ড্যানিয়েলের দিকে।
‘আপনি ঋষি রোডে গিয়েছেন। একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকেছেন। সেখানে একটা ডেডবডি দেখেছেন। সেই মার্ডার আপনি নিজেও করতে পারেন। সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। কিন্তু চোখের সামনে রক্ত দেখার পরেও হাতে গল্প নেই বলছেন?’
‘নেই। আমার সামনে প্রশ্ন আছে। ধাঁধা আছে। জট আছে। কিন্তু সমাধান নেই। কিছুটা অন্তত সমাধান না থাকলে এই গল্প অসম্পূর্ণ।’
‘আপনারা সকলে গল্প খোঁজেন।’ আবার শ্বাপদের হাসি হেসে উঠলেন ড্যানিয়েল। ‘আর সেটা খুঁজতে খুঁজতে সত্যিটার থেকে দূরে চলে যান। যেমন এখন যাচ্ছেন।’
‘তাহলে আমাকে বলুন, সত্যিটা কী! অরুণ চৌধুরী বলেননি। ক্রমাগত ঘুরিয়ে যাচ্ছেন। আপনিও কি…
‘অরুণ চৌধুরী!’ অস্ফুটে বললেন ড্যানিয়েল। তাঁর হাসি মুছে গেল এবার। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল একটা তেতো ভাব। ঠোঁট বেঁকে গেল। ‘আশির দশকে যখন গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন থেকে আনরেস্ট ছড়ালো পাহাড়ে, প্রচুর বাঙালি পরিবার সমতলে নেমে গিয়েছিল। অরুণ যায়নি। হুমকির মুখেও বাড়ি ছাড়েনি। দ্যাট অরুণ! সেলিব্রেটেড রাইটার! আপনিও সেই বাইরের জৌলুশটা দেখেই মাথা ঘুরিয়ে ফেললেন। স্বাভাবিক। তবে শেষ দান এখনও বাকি।’
‘বুঝলাম না। আপনার দাবিটা কী, মিস্টার লামা?’
‘এই অমিতাভ মিত্রর হত্যা, বা পরের কোনো ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।’
‘আপনি তদন্তকারী অফিসার ছিলেন, আর আপনার সঙ্গে যোগাযোগ নেই বলছেন?’
‘না, নেই। আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’ ড্যানিয়েলের গলা নিজের অজান্তেই চড়ে গেল।
‘কিন্তু কেন? আপনার মতো এরকম দক্ষ অফিসারকে সরিয়ে অধস্তনের হাতে
কেন কেস তুলে দেওয়া হলো?’
‘সেটা ডিপার্টমেন্টকে প্রশ্ন করুন, কেন। কারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমাকে বলির পাঁঠা বানিয়েছিল, খোঁজ নিন। আমার হাতে যদি থাকতো, অরুণকে গুলি করে মারতাম। আমি জানি, খুনটা ও করেছে।’
তদন্তের আগেই মেরে দিতেন? যেরকম প্রচুর ছেলেকে মেরেছিলেন?’ না চাইলেও মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।
খুলে গেল চেপে রাখা আগ্নেয়গিরির মুখ। ড্যানিয়েল এতক্ষণ নিজেকে সংযত করছিলেন বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু এবার আর পারলেন না। আমার দিকে ঝুঁকে জ্বলন্ত চোখে হিসহিসে চাপা গলায় বললেন, ‘হাউ ডেয়ার ইউ! আপনার সাহস হয় কী করে আমার ডিউটি নিয়ে প্রশ্ন তোলবার?’
‘আমি…’
‘মিস ভট্টাচার্য, আপনি অলরেডি একটা খুনের মামলায় ফেঁসে আছেন। যদি এখান থেকে একটা আঙুল নাড়ি, আপনার কেরিয়ার বরবাদ করে দিতে পারি। আমার অতীত নিয়ে খোঁচা মারছিলেন না? হ্যাঁ, আমি মেরেছি। আমাকে আর্মস দেওয়া হয়েছিল মারবার জন্যই। যত দরকার ছিল, তার থেকে বেশিই মেরেছি। আর এখনও সেই… এই শাট আপ!’
শেষের কথাটা প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বললেন ড্যানিয়েল। চমকে উঠে দেখলাম, সেই দম্পতির বাচ্চাটা একটা খেলনা বন্দুক নিয়ে আমাদের টেবিলের কাছে এসে ক্যাড়ক্যাড় করে চালাচ্ছিল। ড্যানিয়েল তাকেই ধমকাচ্ছেন। এক লহমায় নিস্তব্ধ হয়ে গেল হোটেলের লাউঞ্জ। বাচ্চাটা ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে বোবা চোখে ড্যানিয়েলের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার মা তাড়াতাড়ি এসে ছেলেকে টেনে নিয়ে গেলেন। একবার পেছন ফিরে আমার দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা আর অভিযোগ। চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না, কারণ এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না।
লাউঞ্জের অন্যরা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ড্যানিয়েল নিজেও সম্ভবত বুঝেছেন যে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেছেন। পাইপটা বিরক্তভাবে টেবিলে ঠক করে নামিয়ে রাখলেন। ‘সরি। আমি একটানা যান্ত্রিক শব্দ নিতে পারি না ছোটোবেলা থেকেই। নার্ভের সমস্যা।’
এরকম অস্বস্তিকর একজন মানুষের সামনে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। নিজেকে সামলে নিয়ে ফোনের রেকর্ডার অন করলাম। ‘আপনাকে কি কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?’
ড্যানিয়েল আবার গম্ভীর হয়ে গিয়েছেন। সম্ভবত দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলবার জন্য নিজের উপরে কিছুটা বিরক্ত। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আমার যেটুকু কথা আছে, বলে চলে যাব। রেকর্ড করে লাভ নেই। নিজেই লিখে নিতে পারবেন। আমাকে কেস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কারণ আমি থাকলে অনেকের অসুবিধে হতে পারত। আর অরুণ চৌধুরীই এই খুনটা করেছে। আপনি কেস ফাইল পড়লেন, কিন্তু আসল খটকাগুলো হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে। চোখে পড়লে এতদিন এখানে বসেও থাকতেন না। সে যাই হোক। আপনার প্রোফাইল থেকে ভেবেছিলাম হয়তো সত্যিটা বার করতে পারবেন। কিন্তু আপনারই চোখের সামনে আর একটা হত্যা হয়ে গেল, এবং সম্ভবত আবারও নিরপরাধ একজন মানুষ তার জন্য শাস্তি পাবে। আপনি কিস্যু করতে পারবেন না। আজ শুধু এই কথাটা বলব বলেই এসেছিলাম, ইউ ডিজঅ্যাপয়েন্ট মি।’ শেষ কথাগুলো বলার সময়ে এক ধরনের হতাশা ঝরে পড়ল ড্যানিয়েলের গলা থেকে। ক্রোধ নয়, বিরক্তি নয়, নিখাদ হতাশা।
‘নিরপরাধ মানুষ শাস্তি পাবে, কেন এই কথা বলছেন মিস্টার লামা?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। ‘কেউ তো ধরাই পড়েনি এখনও।
ড্যানিয়েল উত্তর না দিয়ে উঠে পড়লেন। চেয়ার সরিয়ে বেরোতে যাবেন, তখন মনে পড়ল কথাটা। ‘মিস্টার লামা!’
ড্যানিয়েল ফিরে তাকালেন।
‘অমিতাভর খুনের রাত্রে আপনি যখন থানায় এসেছিলেন, আপনার পায়ে চটি ছিল কেন?’
ড্যানিয়েল ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, ‘আমি ভুল ভেবেছিলাম। আপনি কখনোই সেই শেষ ঘোড়া নন, যার ওপর সর্বস্ব বাজি রাখা যায়।’
হোটেল থেকে বেরিয়ে ড্যানিয়েল একটা জিপে উঠলেন। কাচের ওপাশ থেকে দেখতে পেলাম, জিপের চালকের আসনে বসে গিরিরাজ। সেই গিরিরাজ, যাকে আসার দিন সন্ধেবেলা শহরের বাইরে দেখেছি। সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে, এবং দৃষ্টি থেকে চুঁইয়ে পড়ছে ঘৃণা।
.
পুলিশ লাইব্রেরির কার্ড সকালবেলাই আনন্দ পাঠক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দুপুর পর্যন্ত কেটে গেল লাইব্রেরিতে। বিভিন্ন রিপোর্ট পড়লাম, নোটস নিলাম, ছবি তুললাম। যা যা অনুমান করেছিলাম, অনেক কিছু বাস্তব সাক্ষ্যপ্রমাণের সঙ্গে মিলে গেল। তারপর গেলাম থানাতে। আমাকে আর অরুণকে আলাদা আলাদা ভাবে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, সেই জন্য আজ সময় দেওয়া হয়েছিল। মাঝে অফিসে ফোন করে আবার বললাম, এই শহর ছাড়বার প্রয়োজনীয় অনুমতির যেন তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করা হয়। নাহলে এখানেই আটকে থাকতে হবে কতদিন কেউ জানে না। কিন্তু সমস্ত কাজের মধ্যেও মাথার পেছনে অস্বস্তিটা থেকেই গেল। ড্যানিয়েল লামা আমার ওপর বাজি রাখার প্রসঙ্গ তুললেন। কে বাজি রাখবে? তাঁকে সরিয়ে কাদের স্বার্থসিদ্ধি হয়েছিল? আর যেটা অস্বস্তিকর, আমি একবারও জানতে চাইনি অমিতাভকে কে মেরেছিল। ড্যানিয়েল একাধিকবার জোর দিয়ে অরুণ চৌধুরীর নাম করে গেলেন। তাহলে কি অমিতাভর উপন্যাসেই লুকিয়ে আছে সূত্র? যে সত্যিটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন অমিতাভ মিত্র, সেই একই সত্যি বাস্তব জীবনেও খেটে গিয়েছিল, এ প্রায় কাকতলীয় হয়ে যাচ্ছে। উপন্যাস, আর বাস্তব। অপরাধের যদি সাদৃশ্য থাকে, সমাধানের কেন থাকবে না? বিমলবাবু যদি অপরাধী হন, ড্যানিয়েলও কি অপরাধী? কিন্তু এতগুলো না মেলা প্রশ্নের উত্তর কী করে মেলালেন ড্যানিয়েল?
বামে কেভেন্টার্স ডানদিকে প্ল্যান্টার্স ক্লাবকে পিছনে ফেলে উঠে এলাম ম্যালের দিকে লাঞ্চ করতে। থানার জিজ্ঞাসাবাদ সুষ্ঠুভাবেই মিটেছে। পুলিশ এখনও পর্যন্ত ভদ্র ব্যবহার করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল সাবধানে কথা বলা দরকার। যেহেতু কিছু তথ্য চেপে গিয়েছি, তাই আগের বলা কথার সঙ্গে যেন সামঞ্জস্য থাকে।
.
আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। শেষ দুপুরে ম্যালে এখন রং-বেরঙের ছাতার মেলা। ভুটিয়া এবং নেপালি একঝাঁক উজ্জ্বল শিশু লাফালাফি করছে গোটা চত্বর জুড়ে। দূরে গভর্নর হাউস আধা কুয়াশার ভেতর দিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করছে উঁকি দেবার। একটা মনমরা আলো মেঘ ছিঁড়ে ফুটিফাটা হয়ে সারা ম্যাল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এরকম একটা দিনে হয়তো ভেবেছিলাম হাতের কাজ কমলে অক্সফোর্ড বুক শপে চলে যাব। সারি সারি পেপারব্যাক আর হলদে হয়ে আসা পুরোনো বইদের সঙ্গে কাটিয়ে দেব ঝিমধরা বিষণ্ণ দুপুর। কিন্তু লাঞ্চ করেই ছুটতে হবে মৃত্যুঞ্জয় সোমের বাড়ি। মৃত্যুঞ্জয় সোম, সদর আদালতের উকিল। অরুণ চৌধুরীর বন্ধু। আনন্দ পাঠক এঁর ফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছিলেন। আমাকে বিকেল পাঁচটায় সময় দিয়েছেন।
একটা ছোটো চাইনিজ রেস্তোরাঁতে বসে কী মনে হতে সিদ্ধার্থকে ফোন লাগালাম। একটা প্রশ্ন কাল থেকেই মনে উঁকি মারছে।
দুইবার রিং হতে তুলে নিল সিদ্ধার্থ। ‘বলুন।’
‘অপ্রাসঙ্গিক লাগতে পারে, তবু জিজ্ঞাসা করছি। আপনি বলেছিলেন, অরুণের ঊনত্রিশতম জন্মদিনে বাবলা-সর্পগন্ধার চারা এনে দিয়েছে। এটা কি ঊনত্রিশ বছরের জন্মদিন না কি ঊনত্রিশ থেকে তিরিশে পা রাখার দিন?’
‘দুটোয় তফাত কী?’ বিস্মিত স্বরে সিদ্ধার্থ জিজ্ঞাসা করল।
‘জন্মের দিন, মানে ১৯৪৭ সালের ১৮ মে প্রথম জন্মদিন হিসেবে গণ্য করা হয়। সেক্ষেত্রে ঊনত্রিশতম জন্মদিন হয় ১৯৭৫ এর ১৮ মে। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে জন্মদিন হয় ১৯৭৬-এ। আপনি কোনটা মিন করেছিলেন? আমরা দুটোকে খুব গুলিয়ে ফেলি।’
‘জানি না, কাকাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। এতদিন আগেকার কথা, তারও মনে থাকলে হয়! কিন্তু কেন?’
‘এমনিই। কোনো কারণ নেই। খুবই বোকা ব্যাপার। আচ্ছা, এই বাবলা, এর তারপর কী হলো? আর ফিরে আসেনি বলেছিলেন তো।’
‘অনেক পরে একবার এসেছিল। বাবলা চলে যাবার বেশ কিছুদিন পর কাকা ওর গ্রামে গেছিল। দেখা হয়নি। বাবলা ততদিনে কাজ জুটিয়ে আসানসোল চলে গেছে। কাকা কিছু টাকাপয়সা দিয়ে আসে ওর বাড়িতে। তারপর, সেটা মনে হয় দু-হাজার দুই কি তিন, আমি পুজোর ছুটিতে কাকিমার সঙ্গে এলাহাবাদ ঘুরতে গেছিলাম কাকিমার বাড়ি। দার্জিলিং ফিরে শুনলাম, বাবলা এসেছিল দেখা করতে। আসানসোলে থকে তখন। বয়স হয়ে গেছে, বিয়ে-থাও করেছে। তবুও কীসের এক টানে কাকাকে দেখতে আবার দাজিলিং এসেছিল। কুকুরটার ওপরেও টান থাকতে পারে হয়তো। বাগানে ওই গাছের নীচটায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। কাকা বলেছিল, বউ বাচ্চা নিয়ে চলে আয়, আমার কাছে থাকবি। তখন বাড়ির কাজ করত যে ছেত্রীদা, সে কাজ ছেড়ে চলে গেছিল। বাবলা ফিরে এলে সুবিধেই হতো। কিন্তু বাবলা থাকতে চায়নি। সংসারী হয়ে যাবার পর দুম করে ওভাবে শেকড় ওপড়ানো কঠিন।‘
‘ওহ, আচ্ছা ঠিক আছে।
‘কী ব্যাপার বলুন তো?’
‘কিছুই না। আজ সন্ধেবেলা ফ্রি থাকলে দেখা হবে। ড্যানিয়েল লামা এসেছিলেন, হোয়াটসঅ্যাপ করেছিলাম আপনাকে। কয়েকটা খটকা লাগল কথাবার্তা শুনে। একবার আলোচনা করে নিলে ভালো হতো। যদি হাতে কাজ না থাকে তো জানাবেন। এখন রাখি। লাঞ্চ করছি। আবার ছুটতে হবে।’
.
লেবঙের দিকে যাবার রাস্তায় মৃত্যুঞ্জয় সোমের বাড়ি। মদনদা সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, কারণ কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। পেছনের সিটে মাথা হেলিয়ে বসে ভাবছিলাম। যুক্তিকাঠামো বানাতে হবে। যা নিশ্ছিদ্র হয়। ফাঁকফোকর না থাকে।
বিমল এবং ড্যানিয়েল, দুজনেই যদি হত্যাকারী হন, তাহলেও অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। যদি সত্যিই আনিসুরের হত্যাকারী গাড়ি চড়ে না আসে, অমিতাভর হত্যাকারীও কি গাড়ি ব্যবহার করেনি? গাড়ি এত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর কীভাবে হয়ে উঠল? ড্যানিয়েল তো গাড়ি চালাতে পারেন না। বিমলবাবু তিনিও পারেন না। ঠিক! এটা এতক্ষণ মনে আসেনি তো! কিন্তু ড্যানিয়েল যদি খুন করেও থাকেন, মাঝখানের গল্পগুলোকে মেলাবো কী করে? তিনিও কি আর এতদিন পরে এসে কনফেস করবেন? চটি — ড্যানিয়েলের পায়ে ছিল চটি। কেন? কারণ বুট তাঁর কাছে ছিল না। কেন ছিল না? বুট ফেলে দিয়েছিলেন। কেন ফেললেন? কারণ বুট একটা এভিডেন্স। সাক্ষ্য লোপাট করলেন। কীসের এভিডেন্স? বুট মানে— পায়ের ছাপ। মানে, মানে…
হুড়মুড় করে একঝলক মেঘ জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে ভেঙে পড়ল মুখের ওপর। আকশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে নিশ্বাস নিলাম জোরে। দুই চোখ বুজে ফেললাম। এটাই কি তাহলে সেই সত্যি, যেটা গত চুয়াল্লিশ বছর ধরে লোকের চোখে ধুলো দিয়ে এসেছে? এত সহজ? এত সাধারণ? অনন্যা যেমন বলেছিলেন, ওকামস রেজর?