শেষ মৃত পাখি – ১২

১২

দেয়াল-ফাটলে মাথা খোদাইয়ের, পট পৃথিবীর
অসংরক্ষিত তারকাপ্রহার; শুকনো রক্তে, কালো শার্টের
বোতামে কোনও কৃষ্ণ আগুনের দিন ওঠে জ্বলে
এখানে ঋতু সংগ্রহের দিন, কারও মুখে হাসি নেই 
দেয়ালে খড়ির দাগ, চায়ের মদের পরে 
শোভাবাজারের দিকে শ্রাবণসন্ত্রাস নেমে এলে 
উত্তরবাংলার যে সব নীল শপথের মুখ বহে যায় 
রূপনারায়ণে, গঙ্গায়… 

—অনুরাধা মহাপাত্র 

.

গতকাল রাত্রে আমি আবার স্বপ্ন দেখেছি, সল্ট লেকের বন্ধ ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়েছি। দরজার তালা খুলে ক্যাঁচ শব্দে ভেতরে প্রবেশ করে দেখেছি, মাকড়সার জাল আমার পথরোধ করতে এগিয়ে আসছে। আধো অন্ধকার ঘর, ডাইনিং টেবিল, তার ওপর রাজ্যের ওষুধ, অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েল, প্লাস্টিক, মাদার ডেয়ারির বাতিল কার্ড, ভাঙা থার্মোমিটার, ধুলোর স্তরে সাদা সোফা, ওলটানো চেয়ার, কোথা থেকে ভাঙা সূর্যালোক ম্লান হলদে জন্ডিস রুগীর চোখের মতো, ঠিকরে আসছে বুঝছি না। এগিয়ে যাচ্ছি বাবার ঘরের দিকে। বন্ধ দরজা, অন্ধকারে হাতড়ে নব ঠেলছি। একটা অকস্মাৎ হাওয়াতে সরে যাচ্ছে টেবিলের ধুলো, যে বাতাস ঝাপটা মারছে দরজা খোলার কারণে। ঘরের ভেতর মিটমিটে ল্যাম্প, নিঃসঙ্গ বিছানা। এগিয়ে যাচ্ছি, বাবাকে দেখব বলে। বিছনায় শুয়ে আছে, কেমো নেবার পর সব চুল ওঠা। আবছা আলোয় হলুদ আভা, কিন্তু বেশিটাই অন্ধকারে ঢাকা। ঐ তো, এলোমেলো দাড়ি, দুচোখ খোলা। কিন্তু বাবার দাড়ি ছিল না। ঝুঁকে পড়ে সে মুখের কাছে মুখ নিয়ে যাচ্ছি, আঙুল দিয়ে খুঁড়ে দেখছি একলঘেঁড়ে কপাল, রুগ্ন চোয়াল, অবাধ্য ভুরু, কারণ আমি জানি, শুয়ে আছে বাবা নয়, অমিতাভ! 

.

‘হ্যালো, তনয়া? কী খবর? কাজ কদ্দুর এগোলো?’ 

‘আরও কয়েকদিন থাকতে হতে পারে।’ 

‘কতদিন? একজ্যাক্ট সংখ্যাটা বলো।’ 

‘জানি না এখনও। দুদিন হতে পারে। পাঁচদিনও হতে পারে। 

‘মুশকিল। এইচআর থেকে বাজেট দেবে না।’ 

‘আরে অনেকটা এগিয়েছি, এখন ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে আসা যায় নাকি?’ 

‘কিন্তু আমাকে তো জাস্টিফাই করতে হবে! 

‘আমার পক্ষে সম্ভব না এভাবে বেরিয়ে আসা। সরি।’ 

‘তনয়া, তুমি এবার আমাকে বিপদে ফেলছ।’ 

‘তাহলে একটা কাজ করছি। কাল থেকে ছুটির আবেদন করে দিচ্ছি। তারপর এখানে নিজের পয়সাতে থেকে যাচ্ছি?’ 

‘না না পাগল নাকি! ওসব করতে যেও না। আচ্ছা দেখছি কী করা যায়। তুমি আমার ই-মেলে একটা মেল পাঠিয়ে দাও। সেখানে বিশদে লেখো কেন তোমার আরো সময় লাগবে। এইচআর-কে কপি করবে। বাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।’ 

‘থ্যাংক ইউ মহেশ। ইউ আর আ সুইটহার্ট।’ 

‘তনয়া!’ 

‘বলো।’ 

‘তুমি নিশ্চিত তো, আমরা একটা টানটান স্টোরি দিয়ে সিরিজ শেষ করতে পারবো?’ 

‘আমার ওপর ভরসা করতে পারছো না?’ 

‘উফ, সে কথা বলছি না। কিন্তু পুরো ঘটনাটা নিয়েই সন্দেহ লাগছে। এতদিন আগেকার ব্যাপার, সেটাকে খুঁড়ে বার করে আনা তো সহজ কাজ নয়! 

‘পারব। আর কয়েকটা দিন শুধু সময় দাও।’ 

ফোনটা রেখে দিয়ে নিজের মনে হাসলাম। মহেশ এরকমই। প্রতিবার টেনশন করে। বাজেট নিয়ে চিৎকার করে। মাথার চুল ছেঁড়ে। তখন ওর কয়েকটা সুক্ষ্ম তন্ত্রীতে মৃদু ঘা দিতে হয়। তার মধ্যে একটা হলো আমার নিজের পয়সায় গল্পের পেছনে ছুটব, সেটা বলা। ব্যাস, আর দেখতে হবে না। মহেশ তখন জান লড়িয়ে দেবে। দরকার পড়লে ম্যানেজমেন্টকে ইস্তফা দেবার হুমকিও দিয়ে দেবে। তার অধস্তন সাংবাদিককে নিজের পয়সা খরচ করতে হবে, এটা মহেশের কাছে প্রায় মৃত্যুসম। নার্ভাস, প্রচণ্ড চিৎকার করে, তারকাটা, রেগে গেলে বিশ্রী বকাবকি করে, কিন্তু দরকারে আমাদের যে কারোর জন্য জীবন দিয়ে দেবে— মহেশ হলো সেরকম সম্পাদক। 

ঘাড় ঘুরিয়ে অরুণকে দেখতে পেলাম না। প্রকৃতি এখন কিছুটা শান্ত। বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু আকাশে কালো গম্ভীর মেঘ চাপ হয়ে ঝুলে রয়েছে। সামান্য খোঁচা পেলেই ফেটে পড়বে। আজ কুয়াশাও কিছুটা কম। অন্তত দৃষ্টি চালানো যাচ্ছে খানিকটা দুর পর্যন্ত। সামনেই খাড়া সবুজ পাহাড়, যার মাথা আপাতত মেঘের ভেতর ঢাকা পড়ে আছে। অপরদিকে ঢালু খাদ হাঁ করে তাকিয়ে। পাইন বার্চের গা থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে কুয়াশা। বাড়ি আর পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায় গম্ভীর অরণ্য, যার মাথার উপর দিয়ে ধীরে ধীরে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে আসছে ধূসর মেঘের দল। মনে হচ্ছিল অরণ্যের কাছে গিয়ে কান পাতলে হিংস্র কেউটের ফোঁসফোঁস শুনতে পাব। টুপটুপে কুয়াশার মধ্যে আধো আবছা ঋষি রোডের বাড়িটাকে এখন দূর থেকে জলরঙে আঁকা অসম্পূর্ণ ছবির মতন লাগছে। 

উপত্যকার দিকে এগিয়ে চোখে পড়ল, অরুণ পকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে নীচের অরণ্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। শরীরের একটা পেশিও নড়ছে না। দেখে মনে হচ্ছে প্রস্তরমূর্তি। দুইবার নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দিলেন না। এগিয়ে গিয়ে গায়ে হাত দিতে সামান্য চমকে উঠলেন। একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দুঃখিত। অতীতে চলে গিয়েছিলাম।’ 

‘এই জায়গাটা আপনি চেনেন?’ 

‘ওই যে জঙ্গল’, আঙুল তুললেন অরুণ, ‘ওটা সম্ভবত দার্জিলিং-এর বহু পুরোনো বাসিন্দাই চিনবে।’ 

‘কেন?’ 

‘সত্তরের দশকের বহু তরুণের লাশ ওই অরণ্যের ভেতর লুকিয়ে আছে। দার্জিলিং, মিরিক, কালিম্পং, আশেপাশের গ্রামগুলো— সব জায়গা থেকে নকশালপন্থী সন্দেহে ধৃত তরুণদের নিয়ে আসা হতো এখানে। এই উপত্যকায় নেমে যাবার একটা রাস্তা আছে পেছন দিক দিয়ে। জিপ নেমে যেত। ছেলেগুলোকে বার করে আনা হতো। হাতকড়া খুলে দিয়ে পুলিশ বলত, ‘যা ছেড়ে দিলাম।’ দৌড়তে শুরু করলেই পেছন থেকে গুলি। মাটিতে পুঁতে দিত, অথবা এমনিই ফেলে রাখত। পরে শেয়াল বা অন্য জানোয়ার এসে টেনে নিয়ে যেত। এতদিন হয়তো সেই সব কঙ্কালরা ধুলো হয়ে গিয়েছে। 

‘ড্যানিয়েল লামা।’ আস্তে বললাম। 

অরুণ হালকা মাথা ঝোঁকালেন। ‘শুধু একা ড্যানিয়েল কেন, অনেকেই ছিল তখন। হয়তো ড্যানিয়েল সবথেকে বেশি নিষ্ঠুর ছিল। কিন্তু গোটা সিস্টেমটা একজনের ওপর সব দায় চাপিয়ে হাত কীভাবেই বা ঝেড়ে ফেলতে পারে?’ উপত্যকার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। নীচের দিকটা অন্ধকার। একটা জংলি পোকার টিরিরি টিরিরি করে ডাক ভেসে আসছে। উপত্যকার বাম দিক মেঘের আচ্ছাদনে ঢেকে আছে। যে অংশটুকু দেখা যাচ্ছে, তার কালচে সবুজ একটা স্যাঁতসেঁতে জলীয় ভাপ ছুড়ে দিচ্ছে ওপরের দিকে। 

অরুণ ঘুরলেন। ‘বাড়ির ভেতরে যাব না?’ 

এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কেঁপে গেল কি বুকটা? সেই কালো ঘোড়া। উপত্যকার জঙ্গলের এক ধারে দাঁড়িয়ে। একই ঘোড়া হওয়া অসম্ভব। কিন্তু অবিকল একরকম দেখতে। এই ঘোড়াটাও নিস্পন্দ হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওপর থেকে দেখতে পেলাম। হয়তো স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তবুও অস্বস্তি হচ্ছে। ভয় লাগছে। অরুণকে দেখলাম, পাশে দাঁড়িয়ে একই দিকে তাকিয়ে। কিন্তু তিনি কি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না? নাকি দেখেও পাত্তা দিচ্ছেন না? আমার তাহলে কেন এই অমূলক অস্বস্তি? পিছু ফিরলাম। আর দেখতে চাই না। 

গলা খাঁকরালাম। ‘একটা ছবি তুলব?’ 

অরুণ উত্তর দিলেন না। মোবাইল বার করলাম। এই ধরনের ক্যান্ডিড ছবির দাম পাঠকমহলে অনেক। 

‘ওদের সময়ের মধ্যে ও মনে হয় সবথেকে বেশি প্রকৃতির সংলগ্ন ছিল।’ আনমনে বললেন অরুণ। টুপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টি অথবা কুয়াশা, ঝরে গেল। আমাদের সময়কার কবি অরণি বসুর বিখ্যাত লাইন ছিল একটা, ‘আমাদের গ্রীষ্মকালীন দার্জিলিং নেই, গাড়িবারান্দা নেই, জলতরঙ্গ আছে।’ অমিতাভ থাকলে বলত, ওর আর কিচ্ছু নেই, শুধু সারাজীবনের দার্জিলিং আছে।’ 

খাদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম দুজন। মাথার ভেতর ছেঁড়া ছেঁড়া ভাসছে এক বিস্মৃত কবির প্রোফাইল। তাকে খুঁজতে গেলে কলকাতায় গিয়ে হয়তো সেই সময়কার কবিতাও কিছু পড়তে হবে। কিন্তু এই কাজটা আমি পারব। যেটা এখনও পারব না, সেই কবির হত্যাকারীর প্রোফাইলিং। অরুণ চৌধুরীকে এখনও পুরোটা ধরতে পারছি না। কোথাও গিয়ে একটা ফাঁক থেকেই যাচ্ছে। বারবার হাত থেকে পিছলে যাচ্ছে আসল মানুষটা। 

‘অমিতাভ কি বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি খুন হবেন?’

‘সম্ভবত। ওর উপন্যাস পড়ে সেটাই মনে হয়েছিল। চলুন, বাড়িটা দেখে আসি।’ 

বাড়ির সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। দরজা খোলা। রামবীর কি তাহলে ভেতরে কাজ করছেন? 

শুনেছি অপ্রত্যাশিতভাবে চমকালে মানুষের হাত কেঁপে যায়। বুক ধড়াস করে ওঠে। অনেকেরই নাকি মাথা ঘুরে যায়। আবিষ্কার করলাম, আমার এসব কিছুই হয় না। আমি স্থাণু হয়ে যাই। দরজার কাছে গড়িয়ে আসা রক্তের ধারা দেখেও প্রথমে বুঝতে পারিনি। যখন আমার চোখ রক্তের উৎপত্তি খুঁজতে খুঁজতে এগোচ্ছিল, মস্তিষ্ক ক্রমে অসাড় হয়ে যাচ্ছিল। চোখ যখন স্থির হলো ঘরের মাঝে শুয়ে থাকা রামবীরের দেহটার ওপর, পুরোপুরি স্থবির দাঁড়িয়ে থাকলাম। মনে হচ্ছিল, গতরাতের দেখা স্বপ্নদৃশ্যের ভেতরেই এখনও থেকে গিয়েছি। এবং সামনে রামবীর নয়, অমিতাভর দেহ। বুঝতে পারছিলাম, অরুণও বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছেন। 

দরজার দিকে মাথা আর উল্টোদিকে দুই পা ছড়িয়ে রামবীর পড়ে অছেন। রক্তাক্ত শরীর। ধুলোমাখা রক্ত এখানে ওখানে ইতস্তত। প্রথমে সামলে নিলেন অরুণই। ছুটে গিয়ে রামবীরের পাশে বসে পড়লেন। মাথা উঁচু করলেন যখন, ফ্যাকাশে মুখ দেখে যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। মনে হচ্ছিল, এ স্থবিরতা কাটবে না। কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তি আমার পা-কে ছুটিয়ে নিয়ে আছড়ে ফেলল রামবীরের শরীরের ওপর। যে শরীরটা এখন পড়ে আছে অরুণের কোলে। তাঁর বুকের বামদিকে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। রামবীরের হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে কিছু বলতে গেলাম, কিন্তু স্বর ফুটল না। 

রামবীরের চোখ খোলা, নিস্পন্দ। মুখ অল্প হাঁ হয়ে আছে। অরুণকে দেখলাম, মড়ার মতো সাদা মুখে তাকিয়ে আছেন রামবীরের দিকে। সেই মুখে আতঙ্ক, অবিশ্বাস, সন্দেহ— সব কটা রং একে অন্যের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। ওপরে তাকালাম। সিঁড়ির মুখের ঘরটা তালাবন্ধ। 

বুঝতে পারছিলাম অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে কথা বলছি। কিন্তু নিজেকে থামাতে পারছি না। অরুণকে বললাম, ‘ডাক্তার। এক্ষুনি। নাহলে হাসপাতাল। অ্যাম্বুলেন্স।’ বাক্যগুলোও সম্পূর্ণ করতে পারছিলাম না। অনিয়ন্ত্রিত অশ্রু এসে ঝাপসা করে দিচ্ছিল আমার দৃষ্টি। 

অরুণ মাথা নাড়লেন। 

মুখে হাতচাপা দিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। মনে হচ্ছিল, চারপাশ দুলছে। অরুণ ছাদের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। চোখ বন্ধ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ খুললেন। কাঁপা গলায় বললেন, ‘টিনা, এখন ভেঙে পড়বার সময় নয়। পুলিশকে ফোন করতে হবে।’ 

বিভ্রান্তের মতো অরুণের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মাথা কাজ করছে না। 

‘আমরা একটা ক্রাইম স্পটে দাঁড়িয়ে আছি।’ অরুণ অস্থিরভাবে বললেন আবার। ‘এই মুহূর্তে পুলিশকে জানাতে হবে। যত দেরি হবে, অপরাধী তত বেশি করে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। ছেড়ে দিন, আমি যা করবার করছি।’ উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বার করলেন। 

থানা থেকে ছাড়া পেতে সন্ধে পেরিয়ে গেল। সারাদিন ধরে অজস্র ফোন এসেছে। মহেশ সম্ভবত নিজের মাথার চুল সবকটাই ছিঁড়ে ফেলেছে এতক্ষণে। আমার পরিচিতি প্রমাণ করবার জন্য শিলিগুড়ি থেকে আমাদের ম্যাগাজিনের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট চলে এসেছেন সন্ধেবেলা। পুলিশের কাজে যা হয়! আমাকে এবং অরুণকেও সন্দেহের বাইরে রাখেনি। জিজ্ঞাসাবাদ করেছে অনেক। আততায়ীর পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি। মার্ডার ওয়েপনও নিখোঁজ। পুলিশ যদিও প্রথমেই বুঝেছিল যে আমরা খুন করিনি। কিন্তু আমাদের সঙ্গে ওই বাড়ির কী যোগাযোগ ছিল, সেটা জানবার জন্য দিনভর প্রশ্ন করে গিয়েছে। আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে পুলিশকে বলব না সত্যিটা। কারণ এটা আমার গল্প। গল্প লেখার আগে সব বেরিয়ে গেলে পেশাগত ক্ষতি হয়ে যাবে। বলেছি যে লেপচাজগতে ঘুরতে এসে এরকম পুরোনো একটা বাড়ি দেখে কৌতূহলী হয়ে ভেতরে ঢুকেছিলাম। অরুণ চৌধুরী দার্জিলিং-এ আমার কনট্যাক্ট, যাঁকে নিয়ে আমি খবর করছি। এই জায়গাটায় অমিতাভ মিত্রর হত্যা রহস্য নিয়ে বলতেই হয়েছে কারণ এতদিনে আনন্দ পাঠক, লালবাহাদুর রাই সহ অনেকেই জেনে গেছেন আমার আসার উদ্দেশ্য। কাজেই এটাকে চেপে রাখার মানে হয় না। পুলিশ বেশি ঘাঁটায়নি। কিন্তু ঋষি রোডের বাড়ি তল্লাশি চালিয়েছে। যদিও পায়নি কিছুই। ওই ঘর বা দেয়ালের আঁকা ছবি দেখে কিছু বোঝেনি, মাথাও ঘামায়নি। অরুণও আমার বক্তব্যে সায় দিয়ে গিয়েছেন। 

সারাদিন থানাতে ছিল সিদ্ধার্থ। অনন্যা দুবার এসে ফিরে গিয়েছেন, কারণ তাঁর হাঁপানির কষ্টটা বেড়েছে। বিকেলে দিকে খবর পেয়ে এসেছিলেন আনন্দ পাঠক। তিনিও থানাতে থেকে গেছেন। সেটাই একদিক দিয়ে আমাদের পক্ষে লাভ হয়েছে কারণ আনন্দ পাঠকের এখনও যথেষ্ট প্রভাব এখানে। তিনি অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের হয়ে। প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করলেও আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি পুলিশ। তার একটা কারণ অরুণ চৌধুরী, যাঁকে এই শহর সম্ভ্রমের চোখে দেখে। দ্বিতীয় কারণ হলো, আনন্দ পাঠকের হস্তক্ষেপ। তৃতীয় কারণ সম্ভবত আমার সাংবাদিক পরিচয়। নামি মিডিয়া-হাউজের সঙ্গে যুক্ত পেশাদারকে ঘাঁটাতে কেউই চায় না। বিশেষত সেই পেশাদার নিজে যদি ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম বা ক্রাইম রিপোর্টিং জগতের কেউ হয়। পুলিশ আমাদের স্টেটমেন্ট নেবার পর শুধু একটাই নির্দেশ দিয়েছে। যেন শহর ছেড়ে না যাই আগামী কয়েকদিন। 

‘এটা কী করে সম্ভব?’ উদ্বিগ্ন স্বরে আনন্দ পাঠককে জিজ্ঞাসা করলাম। আমাকে তো অফিসে যোগ দিতে হবে!’ 

‘আপনি রাজ্য পুলিশের থেকে বিশেষ অনুমতিপত্র আনাবার ব্যবস্থা করুন অফিসের সঙ্গে কথা বলে, নাহলে কিন্তু শহরের বাইরে বেরোনো মুশকিল আছে।’ 

থানা থেকে বেরিয়ে দেখলাম, মদনদা দাঁড়িয়ে। আমার দিকে এগিয়ে এলেন, ‘ম্যাডাম, ঘুম উড়ে গিয়েছিল আপনার জন্য। এতদিন গাড়ি চালাচ্ছি, এরকম দেখিনি। আপনি ঠিক আছেন তো?’ 

পুলিশকে ফোন করে বাইরে বেরিয়ে মদনদাকে ডেকে এনেছিলাম। অরুণ আর মদনদা দুজনেই বাড়ির এখান ওখানে ঘোরাঘুরি করলেন, যদি কিছু চোখে পড়ে কিছু দেখতে পাননি। 

থানার বাইরে একপাশে অরুণ দাঁড়িয়ে, অন্য পাশে সিদ্ধার্থ। অরুণ এমনিতেই কম কথা বলেন, আর আজ অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ। গুম মেরে আছেন। মাঝে শুধু একবার বললেন, ‘আমাদের চোখের সামনে দিয়ে খুনি বেরিয়ে গেল।’ 

এতক্ষণে অনেকটা ধাতস্থ হয়েছি। অরুণের দিকে ফিরলাম, ‘রামবীরের খুনের সঙ্গে কি অমিতাভ মিত্রর খুনের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে? অথবা আমার খবর করতে আসার সম্পর্ক? কী মনে হয় আপনার?’ 

‘জানি না। আমাকে একা ভাবতে হবে।’ অরুণ গম্ভীরভাবে বললেন। সকালে রামবীরের দেহ কোলে নিয়ে যে অরুণকে দেখেছিলাম, তিনি ক্ষণিকের ভুল। কিছুক্ষণ পরেই সামলে নিয়ে নিজের গর্তে ঢুকে গিয়েছেন আবার। আবারও ফিরে এসেছে ধ্যানী বুদ্ধের চেহারা। 

‘মিস্টার পাঠক। আপনি শুধু আমাকে বলুন, পুলিশ লাইব্রেরির কার্ড কাল দিতে পারবেন কিনা। গতকাল হাতে পাবার কথা ছিল, কিন্তু পাইনি।’ 

সম্ভবত আমার গলায় এমন কিছু ছিল যাতে অরুণ, সিদ্ধার্থ এবং আনন্দ পাঠক তিনজনেই সচকিত হয়ে তাকালেন। আনন্দ পাঠক গলা খাঁকরালেন, ‘কার্ড হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি বিশ্রাম করুন এখন। সারাদিন অনেক টেনশন নিয়েছেন। 

হতাশায় মাথা ঝাঁকালাম। ‘আপনারা আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। এদিকে একজন বুড়ো মানুষ মরে গেলেন কিছু না করেই। খুনি হয়তো এই শহরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেটা নিয়ে ভাবছেন না।’

‘সেটা পুলিশের দায়িত্ব। কিন্তু আপনার কাজ তো তদন্ত করা নয়। যে কাজ নিয়ে এসেছেন, সেটা করতে পারবেন না এই অস্থির অবস্থায়।’ আনন্দ বললেন। 

ম্যালের কাছে এসে আনন্দ বিদায় নিলেন। আমি কাল একবার আপনার হোটেলে এসে খোঁজ নিয়ে যাব। তার মধ্যে সামলে নিন। আর যে-কোনো দরকারে ফোন লাগাবেন আমাকে।’লম্বা শরীরটা কুঁজো হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল কুয়াশার মধ্যে। 

সিদ্ধার্থ অনেকক্ষণ চুপ ছিল। এবার মুখ খুলল। ‘কফি খেলে হয় না?’ 

সারাদিন প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি। ম্যালের একটা ছোট্ট নির্জন ক্যাফেতে বসলাম তিনজন। নিজের জন্য স্যান্ডউইচ আর কফি বলে অরুণের দিকে ফিরলাম, ‘যদি এই হত্যার সঙ্গে অমিতাভর হত্যার সম্পর্ক থাকে, তাহলে অনুরোধ করছি আপনাকে, এবার মুখ খুলুন। আর সবকিছু চেপে রাখবেন না।’ 

অরুণ সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন ধীরে ধীরে। ‘অমিতাভর উপন্যাসটা আপনি এখনও শেষ করেননি! 

‘হ্যাং ইওর উপন্যাস!’ বিরক্তিতে হাতের ব্যাগ ছুড়ে ফেললাম মাটির ওপর। সিদ্ধার্থ চমকে উঠল। সারাদিনের উত্তেজনা, উদ্বেগ এবং হতাশা এবার তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল আমার মধ্যে। চুয়াল্লিশ বছর আগে একজন মানুষ খুন হয়েছেন। আজ খুন হলেন আর একজন। একটাও রহস্যের জট আমরা কেউ খুলতে পারিনি। উলটে এমন একটা বাড়ির সন্ধান পেয়েছি যেটা রহস্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। আপনার কি মনে হয় একটা কাঁচা লিখনশৈলীর বস্তাপচা রহস্যগল্পের মধ্যে এই সবকিছুর উত্তর পাব?’ 

‘তনয়া, এর বেশি কিছু আপনাকে বলতে পারব না। কারণটা হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন।’ 

‘জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্ট’, সিদ্ধার্থ বলল। 

অরুণ সিদ্ধার্থর দিকে তাকালেন। সিদ্ধার্থ নীচু গলায় উত্তর দিল, ‘আমি জানি।’ 

‘সব কারণ খুলে বলব, কথা দিচ্ছি। শুধু আপনি আগে উত্তরটা খুঁজে বার করুন। আর উত্তর আছে উপন্যাসের মধ্যে। এই উত্তর ধনরাজ পেয়েছিলেন। আপনি অবশ্যই পাবেন। জানি, আপনি পারবেন।’ 

‘কিন্তু সেটা নিজের মুখে কেন বলছেন না?’ 

‘বললে বিশ্বাস করবেন না। কেউ করেনি। আপনার কি ধারণা আমি বুদ্ধির পরীক্ষা নিচ্ছি? না। একদমই তা নয়। আমি চাইছি, আপনার গল্পের স্বার্থে। সত্যিটা বাইরে আসার স্বার্থেই, আপনি নিজে সেই উত্তর বার করুন। আমার মুখে শুনলে আপনি কনভিন্সড হবেন না।’ 

‘জানি না, কী করব। গল্পের সন্ধানে এসে নিজে একটা বিশ্রী ব্যাপারে জড়িয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, কেন এলাম এখানে।’ 

কলেজে পড়বার সময়ে বাবা আর আমি দুজন রাত্রিবেলা করে ডেভিড সুশে অভিনীত বিবিসি-র এরক্যুল পোয়ারো সিরিজের একটা করে এপিসোড দেখে ঘুমোতে যেতাম। সেই সময়ে মাঝে মাঝেই সিনেমা থামিয়ে দুজন আলোচনা করতাম, এই রহস্যগুলোর বিকল্প সমাধান কী কী হতে পারত। এক একটা গল্পের চার-পাঁচটা করে বিকল্প সমাধান বার করতাম দুজনে মিলে। সেই ডিডাকশন পদ্ধতি, সেরকম লজিকাল রিজনিং, যেগুলো তখন ব্যবহার করতাম, এখনও পারব কি? 

কফিতে চুমুক দিয়ে সিদ্ধার্থ বলল, ‘যেদিন আমরা বাড়ির সন্ধান পেলাম, তার পর দিনেই রামবীর খুন হলেন। এটাকে কাকতলীয় লাগছে না? তাহলে কি হত্যাকারীই মেসেজ পাঠিয়েছিল? চাইছিল, যাতে আপনি ওই বাড়িতে যান? যাতে সন্দেহ আপনার ওপর পড়ে?’ 

‘তাহলে প্রথম দিনেই খুন করল না কেন? দ্বিতীয় দিন যে যাবো সেরকম নিশ্চয়তা কোথায় ছিল? আর দ্বিতীয় দিন যাবার কথা জানতই বা কে? আপনি জানতেন, আপনার কাকা জানতেন। ব্যাস। মদনদাও তো আজ সকালে জেনেছেন।’ 

‘আচ্ছা। বাড়ির ভেতর কিছু সন্দেহজনক লেগেছিল? মানে, হয়তো চোখে পড়বার মতো কিছু না, কিন্তু সামান্য কিছু, আলাদা?’ 

ভাবার চেষ্টা করলাম। রামবীর খুন হবার পরেও বাড়ির ভেতর ঢুকেছি। কিন্তু কিছু কি ভুলভাল দেখেছি? না তো! প্রথমদিনের মতোই লেগেছিল সবকিছু। ‘অন্য কারোর উপস্থিতি? হয়তো দেখেননি, কিন্তু অনুভব করতে পারছিলেন কি?’ 

‘নাহ। আর কাজ সারবার পর হত্যাকারী সেখানে থাকবেই বা কেন? মদনদাও বললেন তো, গেট দিয়ে তিনি কাউকে বেরোতে দেখেননি।’ 

‘না, হত্যাকারী গেট দিয়ে বেরোয়নি।’ অরুণ বললেন। 

‘কী করে বলছেন এই কথা?’ 

‘কারণ, তাহলে বাগানের মাটিতে তার পায়ের ছাপ পড়ত। পুলিশ পরীক্ষা করে দেখেছে। আমি, আপনি, রামবীর এবং মদন ছাড়া পঞ্চম কোনো পায়ের ছাপ নেই।’ 

‘কিন্তু এমন কি হতে পারে যে খুনি গতরাত থেকেই সেখানে ছিল? কাল রাতে প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টিতে হয়তো পায়ের ছাপ মুছে গেছে।’ 

‘কেন থাকবে? আপনি খুনি হলে সারারাত ওখানে থাকতেন? কীসের আশায়? রামবীর তো দুপুর হলেই বাড়ি ফিরে যায়।’ 

‘তাহলে? খুনি এল কোথা থেকে?’ 

‘সমাধান সহজ। আপনিও ভাবলে পারবেন।’ 

‘আমার মাথা কাজ করছে না, দুঃখিত।’ 

‘আজ সকালে বলেছিলাম। উপত্যকায় নেমে যাবার একটা রাস্তা আছে, পেছন দিক দিয়ে। সত্তর দশকে পুলিশের জিপ ওখানে নেমে গিয়ে লাশ ফেলত।’ 

‘তার মানে’, উত্তেজিত গলায় বললাম, ‘খুনি ওখানে গিয়ে গাড়ি রেখেছে। তারপর উপত্যকার খাড়াই অংশ বেয়ে উঠে এসে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে ঢুকেছে।’ 

অরুণ মাথা নাড়লেন। 

‘কিন্তু তাহলেও তো বাড়িতে তার পায়ের ছাপ থাকবে। বা পেছনের জায়গাটায়, যেখানে দিয়ে উঠে এল।’ 

‘থাকবে না। কারণ যেখান দিয়ে উঠে এসেছে তার পুরোটাই ঝোপঝাড়। ঝোপ হয়তো দুমড়ে গেছে, কিন্তু সেটা পুলিশ খেয়াল নাও করতে পারে, যদি তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে পায়ের ছাপ খোঁজার দিকে। আর বাড়ির ভেতর ঢোকার দরকার পড়বে না। পেছনের জানালা দিয়েই গুলি ছুঁড়তে পারে। জানালার কাচ তো ভাঙা ছিল। মনে রাখবেন, রামবীরের মাথা ছিল দরজার দিকে, আর পা অপর প্রান্তের জানালার দিকে। মানে দরজার দিকে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন। জানালা দিয়ে গুলি ছুড়লে সোজা বুকে এসেই বিধবে।’ 

‘আপনি এটা পুলিশকে বললেন না কেন?’ 

‘বিকেলবেলা বলেছি। পুলিশ কাল খুঁজে দেখবে। বুলেটের ফাঁকা খোল কোথায় পড়েছিল সেটা খুঁজে পেলেই বোঝা যাবে কোথা থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে। এটা প্রথমে মাথায় আসেনি। উত্তেজিত ছিলাম ভেতরে ভেতরে। পরে শান্ত মনে ভেবে দেখলাম। এটাই পায়ের ছাপ না থাকার একমাত্র ব্যাখ্যা।’ 

‘কিন্তু দেয়ালের ওই ছবি, আর আজকের খুন— এই দুটোর মধ্যে সম্পর্ক কোথায়? সব গুলিয়ে যাচ্ছে। নাকি কিছুই সম্পর্ক নেই?’ 

জানি না। হয়তো কোনোই সম্পর্ক নেই। হয়তো সাধারণ ডাকাতির কেস। বাড়িটায় দামি জিনিসের তো অভাব ছিল না! বামাটিকের ওই খাট বলুন অথবা বেলজিয়ান কাচ, কোনোটারই দাম কম নয়। হয়তো আমাদের ঠিক ওই সময়টায় ওখানে যাওয়া, পুরোটাই কাকতালীয়।’ 

‘এই পৃথিবীতে কাকতালীয় বলে কিছু হয় না মিস্টার চৌধুরী!’ 

‘একটা অন্য কথা বলি।’ টেবিলের ওপর অবিন্যস্ত ছড়িয়ে থাকা চিনির ছেঁড়া স্যাশেগুলো সাবধানে জড়ো করে এক জায়গায় গুছিয়ে রাখলেন অরুণ। ‘অমিতাভর হত্যারহস্যে দুটো রাইফেল ব্যবহার প্রসঙ্গে আপনার অনুমান সঠিক দাদার বাড়িতে একজোড়া রাইফেল ছিল। একই কোম্পানির, মেক আর মডেলও এক। দাদুর আমলের। ১৯৭২ সালে সেই বাড়িতে একটা চুরির ব্যাপার ঘটে। কিছু টাকাপয়সা, পুরোনো দিনের বাসন ইত্যাদি চুরি যায়। একটা রাইফেলও নিখোঁজ হয়ে যায় তখনই। পুলিশে রিপোর্টও করেছিলাম। তারপর অন্য রাইফেলটা আমি জলাপাহাড় রোডের বাড়িতে নিয়ে আসি। দাদুর স্মৃতি, তাই হাতছাড়া হোক চাইনি। পুলিশ সেই রিপোর্ট খুঁজে বার করে। তারপর তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে আমার বাড়িতে যে রাইফেল থেকে গুলি চলেছে সেটা অমিতাভর হাতে গুলি চালানোটার যমজ। তাই ব্যালিস্টিক রিপোর্টে পার্থক্য ধরা যায়নি। পুলিশের রিপোর্ট যদি এখানকার লাইব্রেরি থেকে খুঁটিয়ে পড়েন, তাহলে মনে হয় এর উল্লেখ পাবেন। তবে আপনার পক্ষে এতদিন পরে এসে এর সম্বন্ধে না জানাটাই স্বাভাবিক। কারণ সংবাদমাধ্যমের কাছে পুলিশ এই বিষয়ে মুখ খোলেনি। সঞ্জয় অধিকারীও তাই আর এ ব্যাপারে কিছু লেখেননি।’ 

কয়েক হাজারের মধ্যে অন্তত একটা রহস্যের সমাধান হলো। কিন্তু তবুও সন্তুষ্ট হলাম না। ‘তিন বছর আগে চুরি যাওয়া রাইফেল কীভাবে ফেরত আসে? আর একই দিনে দুটো রাইফেল থেকেই কী করে গুলি ছোটে? কাকতালীয়?’ 

‘তিন বছর পর কীভাবে ফেরত এল তা বলতে পারব না। তবে গুলি চালানোটা ইচ্ছাকৃত। ওইদিন গুলি চালাতে বাধ্য করা হয়েছিল।’ 

‘কে করেছিল?’ 

অরুণ ভুরু কোঁচকালেন। ‘আপনি কি সত্যিই এখনও কিছুই বুঝতে পারছেন না?’ 

‘না। আপনার মুখ থেকে পুরোটা শুনবার জন্য অপেক্ষা করে আছি।’

‘সবটুকু, সব সত্যি আপনার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। আপনি দেখতে চাইছেন না। ভাবুন, টিনা? আপনার কলমের ওপরেই সত্যিটা দাঁড়িয়ে আছে।’

‘সত্যি নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমি একটা গল্প চাই।’ 

‘আর সেই গল্পটা আমি আপনাকে দিচ্ছি। রাস্তাটা দেখিয়ে দিচ্ছি। শুধু হেঁটে যেতে হবে আপনাকে।’ 

এই চাপান-উতোরে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম ভেতরে ভেতরে। ক্লান্তও লাগছিল। আলোচনা শেষ করবার জন্য বললাম, ‘আগে আজ উপন্যাসটা শেষ করি। তারপর এই নিয়ে কথা বলব।’ 

অরুণ উঠে পড়লেন। ‘বাড়ি যাই এবার। কাল কথা হবে।’ পিছু ফিরে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলেন। 

অরুণের অপস্রিয়মাণ মূর্তির দিকে তাকিয়ে সিদ্ধার্থ নীচু গলায় বলল, ‘ঠিক এই কারণেই চাইছিলাম না, আপনি আসুন। আবার নতুন সমস্যা, আবার খুন। আবারও সেই মিথ্যে খোঁজা। কাকা এই বয়েসে এসে এতটা নাও নিতে পারত।’ 

‘আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে যে আজকের ব্যাপারটার সঙ্গে চুয়াল্লিশ বছর আগেকার একটা ভুলে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের যোগ আছেই?’ 

তীব্র অথচ চাপাস্বরে সিদ্ধার্থ বলল, ‘আমি জানি না, কেয়ারও করি না। যদি যোগ নাও তাকে, যদি এমন হয়েও থাকে যে রামবীর অন্য কারণে খুন হয়েছেন, তাহলেও, কাকাকে সেই দৃশ্য দেখতে হয়েছে। হয়েছে, কারণ আপনি নিয়ে গিয়েছিলেন আপনার স্টোরির স্বার্থে। এটুকু সত্যি, খুব তেতো লাগলেও, গিলে নিন মিস ভট্টচাজ!’ 

বুঝতে পারছি, সারাদিনের ঝামেলার পর মাথা আমারও নিয়ন্ত্রণে নেই। সামনে ঝুঁকে কেটে কেটে বললাম, ‘আপনার কাছে অরুণ চৌধুরী খুবই ভালোবাসার মানুষ, স্বাভাবিক। কিন্তু আমি একটা কাজে এসেছি, এবং আপনার কাকার অনুমতি নিয়েই। সেই জায়গাটায় আমি নৈর্ব্যক্তিক। পছন্দ না হলে আমার অফিসে অভিযোগ জানান। দরকারে পুলিশে জানান। কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে চারবার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবেন না কেন এলাম। এসেছি পেশার তাগিদে। আপনার কাছে সেটা তুচ্ছ মনে হলেও আমার কাছে নয়।’ 

অনেক কিছু বলবার প্রস্তুতি নিয়ে মুখ খুললে মানুষকে যেরকম দেখতে লাগে, বা সাদা বাংলায় কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে যাওয়া লোকের মুখ, সিদ্ধার্থকে সেরকম লাগছিল। কিছু বলতেও গেল, কিন্তু কী ভেবে চেপে গেল দেখলাম। ঠোঁট ওলটালো, আপনি বুঝবেন না। 

‘কী বুঝব না? অনেকবার এই কথাটা বলেছেন।’ 

‘বুঝবেন না, আমার কাকার ভেতরে কী চলে সারাক্ষণ। প্রথমদিনেই বলেছি এটা। আপনি চেনেন না, আমি চিনি। তাই ভয় লাগে, সব অনুভূতি চেপে রাখতে রাখতে ব্রেকডাউন না হয়ে যায়। আর এটা কাকার বরাবরের। গল্প শুনেছি তো অনেক 

‘হতে পারে, কিন্তু আমি কী করব বলতে পারেন? কাজ গুটিয়ে ফিরে যাব? অযৌক্তিক কিছু দাবি করবেন না প্লিজ! 

‘সেটা আমার এক্তিয়ারে নয়।’ বিরক্তমুখে সিদ্ধার্থ সিগারেট পাকাতে লাগল। আগুন জ্বালিয়ে তাকালো আমার দিকে, ‘আমি আমার কথাটুকু বলেছি মাত্র। কাকাকে যেরকম দেখেছি, আমার সেই দেখাও আপনার কাজে লাগবে বলেছেন। তো, সেই দেখার ভিত্তিতে যদি কোনো সিদ্ধান্তে আসি, বা ছোটবেলা থেকে যেসব গল্প শুনেছি তার ভিত্তিতে, সেটাও আপনার শোনা কাজ, তাই না?’ 

‘দেখুন, আপনার কাকার বাড়ির মালি চলে গিয়েছিল বলে তিনি দুদিন খাননি, এটা বোঝায় যে অরুণ চৌধুরী খুব সেনসিটিভ একজন মানুষ। সেটা অবশ্যই লেখায় আসবে। কিন্তু তার বাইরে যেটুকু জাজমেন্ট আপনি দিচ্ছেন…’ 

‘আপনি জানেনই না কী ঘটেছিল। আমি কিছুই বলিনি।’ সিদ্ধার্থ প্রায় আক্ত সিগারেট মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে জোরে পিষে দিল। 

‘আমি কিছুই জানি না সিদ্ধার্থ, এবং আপনার কাকা সব জানেন। সমস্যা হলো, তিনি কিছুই বলবেন না।’ 

‘বাবলাকে কাকা ছোটোভাইয়ের মতো দেখত, আগেই বলেছি।’ আমাকে অগ্রাহ্য করে বলে চলল সিদ্ধার্থ। তখনও সিগারেটটা পিষে যাচ্ছে। ‘আমি যদিও ওকে দেখিনি। বাবলা খুব মদ খেত। কাকার বাড়ির বাগান ওর হাতে। কাকা আর বাবলা, দুজনেই দুজনকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। কীরকম জানেন? কাকার ঊনত্রিশতম জন্মদিনে বাবলা কী উপহার দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে তো গরিব, তার কাছে টাকা নেই যে কিছু দামি কিনে দিতে পারবে। তাই রাত্রিবেলা বটানিকাল গার্ডেনের ভেতরে ঢুকে একটা দুষ্প্রাপ্য সর্পগন্ধার চারা চুরি করে নিয়ে এসেছিল। কাকা জেনে প্রচুর বকাবকি করেছিল, কারণ লোকে জানতে পারলে দুজনেরই জেল হবে। কিন্তু বাবলা গোঁয়ারের মতো বলে গিয়েছিল, হয় চারা নেবে, আর নাহলে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। শেষে কাকা বাধ্য হয়েছিল নিতে। তো, বাবলার তিনকুলে কেউ ছিল না। ছিল শুধু একটা পোষা নেড়ি কুকুর। বাগানের একপাশে ঘর করে দুজন থাকত। বাবলা প্রতি রাত্রিবেলা মদ খেয়ে কুকুরটার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদত। কুকুরটাও ছিল বাবলার ছায়াসঙ্গী। একদিন সেই কুকুরের হলো চর্মরোগ। রাস্তার কুকুর, যেখানে সেখানে যায়। অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে বেড়ায়। বীভৎস ঘা, পচা গন্ধ ছাড়ছে, আর মাছির দল ভনভন করছে। কাকা বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে এসে দেখালো। পশু হাসপাতালেও নিয়ে গেল। যথাসাধ্য করল। কিন্তু সব ডাক্তারই মাথা নেড়ে জানালেন যে কিছু করবার নেই। একে বাঁচানো অসম্ভব, এবং এর থেকেও বেশি যন্ত্রণা পেয়ে মরবে। কাকা বাধ্য হয়ে বাবলাকে জিজ্ঞাসা করল যে সে কী চায়? কুকুরটা কি যন্ত্রণা পাবে, নাকি তার কষ্টের নিরসন ঘটানো হবে? হাউ হাউ করে নাকি কেঁদেছিল বাবলা। কাকা বাবলাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, বাবলা যা চায় সেটাই হবে। কিন্তু বাবলাও আর কুকুরটার বীভৎস অবস্থা দেখতে পারছিল না। যারা তখন ওখানে উপস্থিত ছিল তাদের মুখে শুনেছি, কাকা ঘর থেকে বন্দুক এনে নাকি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। তারপর বাবলার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, ‘আমার হাতে উঠবে না। পারব না। তুই যা করবার কর। ঘরের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। বাবলার হাত কাঁপছিল। সেই অবস্থাতেই বন্দুক তুলল। কুকুরটা তখন বাগানের একটা বোগেনভেলিয়া গাছের নীচে শুয়ে আছে। তার চোখ বাবলার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকানো। একবার হালকা ‘ঘেউ’করে আদরের ডাক ডেকে উঠল। বাবলা গুলি ছুঁড়ল। কুকুরটার মাথায় গিয়ে লাগলো সোজা। বন্দুক ফেলে দিয়ে বাবলা কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল। পরে অন্য লোক ডেকে এনে বাগান পরিষ্কার করতে হয়েছিল। বাবলা সেই যে গেল, আর ফিরে এল না। শহর ছেড়েই চলে গিয়েছিল।’ 

আরেকটা সিগারেট পাকিয়ে ধরালো সিদ্ধার্থ। কয়েকটা টান মেরে বলল, ‘ওই গাছটার নীচেই কাকা দুই রাত বসেছিল।’ 

ঝট করে মুখে কোনো উত্তর আসছিল না। কী বলব ভেবে না পেয়ে মৃদুস্বরে বললাম, ‘সরি।’ 

উত্তর না পেয়ে অপেক্ষা করে করে আবার বললাম, ‘ঋষি রোডের বাড়িতে মিস্টার চৌধুরী নিজে থেকে যেতে চেয়েছিলেন। আমার মাথাতেও আসেনি নিয়ে যাবার কথা। কিন্তু আপনিই ঠিক, আমার জন্যই এত কিছু হলো।’ 

‘আপনার ব্যাপারটা বুঝছি। কিন্তু পুরোনো পাপের ছায়া এতই দীর্ঘ যে আমরা কেউ তার থেকে শত চেষ্টাতেও বেরিয়ে আসতে পারছি না।’ 

‘মজাটা কোথায় বলুন তো? এমনকি এটাও জানি না যে পাপটা আদতে কার!’ 

সিদ্ধার্থ উত্তর দিল না। 

.

ঘরে ঢুকে অমিতাভর উপন্যাসটা হাতে নিলাম। আজ এটাকে শেষ করতেই হবে। সমাধান যদি সত্যিই এর মধ্যে থাকে, তাহলে অন্তত সামান্য মনোযোগ দাবি করে এই লেখা। এরপর আমার নিজের লেখাও বাকি আছে। কিন্তু তার আগে এটা শেষ করব। দরকার হলে ঘুমোতে দেরি হবে। হলে হোক। এমনিই রাত্রে ভালো ঘুম হয় না। পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। ব্যালকনির দিকে চোখ গেল। ব্যালকনির বাইরে বাগান। তার ওপাশ থেকে শুরু হচ্ছে পাহাড়। অনেকটা ঋষি রোডের বাড়ির মতোই। অন্ধকার গম্ভীর পর্বতের সানুদেশের দিকে তাকিয়ে আবার মনে পড়ে গেল রামবীরের মৃতদেহ। 

He wasn’t there again today 
I wish, I wish he’d go away 

একজন পাগলাটে মানুষ, যে জানালার অদৃশ্য কাচ মুছে দিন গুজরান করত, সে দুম করে নেই হয়ে গেল। অথবা হয়তো ছিলই না কখনও! 

সিগারেট টান মেরে পাণ্ডুলিপি খুলে বসলাম। আর তখনই ফোনটা এল। একটা অচেনা নম্বর। 

বিশুদ্ধ ব্রিটিশ ইংরেজি টানে, খসখসে গম্ভীর স্বরে ওপার থেকে জবাব এল, ‘আমার নাম ড্যানিয়েল লামা।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *