শেষ মৃত পাখি – ২২

২২

সুষুপ্ত, একাকী, শান্তঃ তুমি যেন পোকাটিকে বিরক্ত কোরো না;
যা তার লালা বা জাল, মধু বিষ, মধু মোম,সমস্ত আবার
একত্র ভরেছে শূণ্য, তাকে বলে শাঁস, রস, ফল, হাহাকার, 
জড়ানো মাংসের মধ্যে স্বপ্নের দংশন, আরো স্বপ্নের করুণা;

–বীতশোক ভট্টাচার্য 

.

অনেকগুলো বছর পরে কর্ণেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যখন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর মনে এসেছিল বাবার সঙ্গে প্রথম বরফ দেখবার স্মৃতি। আমি জানি না, বহু বছর পরে নিজের মৃত্যুশয্যায় দার্জিলিং-এর কুয়াশা, হিমাভ স্যাঁতস্যাতে বাষ্প অথবা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে আসা মেঘেদের কথা আমার মনে পড়বে কিনা। কিন্তু একটা দৃশ্য সম্ভবত কখনও ভুলবো না। শেষদিন সকালবেলায় যখন অরুণের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, সেই কালো ঘোড়াকে আবার দেখেছিলাম জলাপাহাড় রোডে। সারা গায়ে শিশির মেখে আবছা নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে ছিল, আগের মতোই। ঘাস খাচ্ছিল না। শূন্যচোখে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে। একটা ধাতব মূর্তির মতো লাগছিল। অদ্ভুত দৃশ্য। মাথার ওপর উঠে গেছে গগনচুম্বি পাহাড়, যার চূড়া দেখা যায় না। থকথকে মেঘের দল পেছন থেকে গুঁড়ি মেরে ধেয়ে আসছে। ভেজা কালচে সবুজ থমথম করছে চড়াই-উৎরাই জুড়ে। আর সে-সবকে পেছনে পেলে নিশ্চল দাঁড়িয়ে অছে একটা ঘোড়া। শরীরের একটা পেশিও কাঁপছে না। নড়ছে না লেজ। একটা বিয়োগান্তক মহাকাব্যের অস্তিম দৃশ্য দেখছি মনে হলো। 

বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলাম, অরুণ আর অনন্যা বাগানে বসে আছেন। তাঁদের সামনে বসে সিদ্ধার্থ। আমিই তিনজকে ফোন করে জানিয়েছিলাম, আজ আসব। 

‘আজ চলে যাচ্ছি। তার আগে দেখা করে যাবার দরকার ছিল আপনাদের সকলের সঙ্গে। বাগানের চেয়ারে বসে বললাম। 

অরুণ স্মিত চোখে তাকালেন। অনন্যা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন কফির কাপ। কফিতে চুমুক মেরে বললাম, ‘দিল্লি ফিরে গল্পটা সম্পূর্ণ লিখে জানাবো। কিন্তু কাল রাত্রে গল্পের একটা আউটলাইন বানিয়ে সেটা কপি করে এনেছি আপনাকে দেবার জন্য।’ একটা কাগজ এগিয়ে দিলাম অরুণের দিকে। 

অরুণ মৃদু হেসে কাগজটার দিকে তাকালেন। আপনি নিজেই তো সবটা সাজাতে পেরেছেন। আমাকে না দেখালেও চলতো।’ 

‘চলতো। তবুও, আপনার গল্প, আশা করি একবার চোখ বোলাবেন।’ হাসলাম আমিও। তারপর আর এক প্রস্থ কাগজ বার করলাম, ‘আর এটাও আপনার দেখা উচিত। এটা একটা বিকল্প গল্প। প্রত্যেক সত্যির পেছনে যেমন একাধিক বিকল্প থাকে।’ 

অরুণ ভুরু কোঁচকালেন। সিদ্ধার্থকে দেখলাম, কঠিন মুখে বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে। অনন্যা বিস্মিত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিকল্প মানে?’ 

‘মানে, অন্য গল্পটাও সত্যি হতে পারে। সেটা যদিও মিস্টার চৌধুরীই ভালো বলতে পারবেন কারণ তাঁর কাছ থেকে আমি একটা গল্প শুনেছি। ভুল হলো। আমি নিজে একটা গল্প সাজিয়েছিলাম। সেটাকে খণ্ডন করে আপনার স্বামীর সাহায্যে আর এক একটা গল্পে উপনীত হয়েছিলাম। আর এইটা, হাতের কাগজ তুলে দেখালাম, ‘এইটা হলো তৃতীয় একটা গল্প। কোনটা সত্যি, সেটা কি আপনি বলবেন, মিস্টার চৌধুরী?’ 

‘তৃতীয় গল্পটা তো আমি এখনও জানি না।’ 

‘তাহলে আমিই বলি? আমার এবং আপনার সামনে দুটো আলাদা গল্প পড়ে আছে। আপনি আমাকে একটা গল্প বলেছেন, কিছু দৃশ্য দিয়েছেন। আমি আপনাকে এবার অন্যটা বলবো, সঙ্গে অনুমানের সাহায্যে জুড়ে দেব কিছু দৃশ্য। তারপর দেখা যাবে, কার দৃশ্য সত্যের কত কাছাকাছি।’ 

অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ নেমে এল বাগান জুড়ে। অরুণ স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। অনন্যার ভুরু কুঁচকে গেছে। একমাত্র সিদ্ধার্থকেই দেখলাম, এতক্ষণে একটা কথাও বলল না। 

‘আপনি এবং আমি গত পরশু সকালবেলায় যে গল্পটায় এসে পৌঁছেছিলাম, তাতে এমনিতে বিশেষ সমস্যা ছিল না। থাকার কথাও নয়। ড্যানিয়েল লামা, সত্তরের কুখ্যাত পুলিশ অফিসারই যে হত্যাকারী, এমন সিদ্ধান্ত আমাদের সকলের পক্ষেই স্বস্তিদায়ক। কিন্তু সফল গোয়েন্দাকাহিনীর লেখক হলেও সে গল্পে কিছু ফাঁক ছিল! যেমন ফাঁক ছিল অমিতাভর উপন্যাসেও। নাকি, একে অমিতাভর উপন্যাস বলাটা আর উচিত হবে না?’ 

অরুণের মুখে কোনো বিকার দেখা গেল না। শুধু দেখলাম তাঁর কপালের শিরাটা দপদপ করছে। 

‘এই গল্পের প্রথম লেয়ারে আমি ভেবেছিলাম, আপনি হত্যাকারী। তারপর ধীরে ধীরে পেঁয়াজের খোসা খুলবার মতো করে রহস্যের পরতগুলো তুলতে তুলতে যখন দ্বিতীয় লেয়ারে পৌঁছোলাম, সিদ্ধান্তে এলাম যে ড্যানিয়েলই আসল অপরাধী, একটা কথাই মনে হয়েছিল তখন। কী অসামান্য আখ্যান! কী অসামান্য বন্ধুত্ব! ‘ 

অরুণ একটাও কথা না বলে তাকিয়ে আছেন। সেই গভীর, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। 

‘আর তারপর বুঝতে পারলাম, কী অসামান্য ধোঁকাবাজি!’ কেটে কেটে উচ্চারণ করলাম। 

অনন্যাকে দেখলাম, শক্ত করে চেয়ারের হাতল চেপে ধরলেন। সিদ্ধার্থর মাথা ঝুঁকে গেল। দেখে মনে হলো, গভীর যন্ত্রণা চাপতে চাইছে। শুধু অরুণ একইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। 

‘অমিতাভ যে আপনার হাতে আঁচড়ে দিতে পারেন না, কারণ অবিরত নখ খাবার দরুণ তাঁর হাতে নখ ছিলই না কিছু, সেটা এই গল্পের প্রাথমিক ফাঁক। সেটাই খচখচ করছিল, কী একটা মিস করে যাচ্ছি। পরশু রাত্রে মনে পড়ল এই নখের ব্যাপারটা। বুঝলাম, আপনি মিথ্যে বলছেন। তারপর সিদ্ধার্থ আমাকে দেখিয়ে দিল চোখে আঙুল দিয়ে ঋষি রোডের বাড়িতে আপনি যে গত চল্লিশ বছরে যাননি বলেছিলেন, সেটাও মিথ্যে। কিন্তু শুধু এই দুটো মিথ্যেই যথেষ্ট ছিল না। আপনার তৈরি করা দৃশ্যগুলোকে ধ্বসিয়ে দেবার জন্য দরকার ছিল আরও কিছু। আরও শক্ত একটা প্রমাণ। সেটা দিল অমিতাভর উপন্যাস। কাল দুপুরবেলা হোটেলের ঘরে শুয়ে শুয়ে উপন্যাসটা আবার পড়তে গিয়ে দেখলাম, আপনার তৈরি করা গল্পটাকে এক লহমায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে ফেলা সম্ভব।’ 

‘আপনার দাবিটা ঠিক কী, তনয়া?’ এবার প্রশ্ন করলেন অনন্যা। 

অনন্যার দিকে দৃকপাত না করে অরুণের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। উপন্যাসটার শেষ পরিচ্ছেদে, যেখানে শুদ্ধসত্ত্ব গিয়েছিল প্রণবেশের বাড়ি, সেখানে প্রণবেশ রেডিয়ো চালিয়েছিল। আপনার মনে থাকবার কথা। সেখানে প্রণবেশ সেদিনকার বিশেষ বিশেষ খবরগুলো বলছিল, মনে আছে? তার মধ্যে একটা ছিল, এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ইন্দিরা গান্ধির অপসারণের পক্ষে রায় দিয়েছেন।’ ‘সমস্যাটা হলো, এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জাস্টিস জগমোহনলাল সিনহা ইন্দিরা গান্ধির বিরুদ্ধে এই রায় দিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের ১২ জুন। যে রায়ের ফলশ্রুতিতে কিছুদিন পর ভারতে জরুরি অবস্থা জারি হবে। তাহলে যে অমিতাভ মিত্র ১১ জুন খুন হয়েছেন, তিনি কী করে ১২ জুনের ঘটনা লিখে গেলেন?’ 

অরুণ এই প্রথম একটা বড়ো নিশ্বাস ফেললেন। তারপর চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লেন অনেকটা নিজের মনেই। 

‘তার মানে, এই উপন্যাসটা অমিতাভ লেখেননি। লিখেছেন আপনি, কারণ এরকম ডিটেকটিভ গল্প একমাত্র আপনিই লিখতে পারেন। অমিতাভ আপনার হাতে আঁচড় দেননি, এবং উপন্যাসটাও তিনি লেখেননি। তাহলে সত্যিটা কী? মনে হয়েছিল, আবার ফিরে যাওয়া যাক অসমাপ্ত উপন্যাসেই। এবং আবারও, উপন্যাসেরও মধ্যেই সন্ধান পেলাম আমার প্রশ্নের। কাকতলীয়ভাবেই হয়তো। উপন্যাসটা যদি নাও লেখা হতো, তাহলেও হয়তো উত্তর পেতাম। আমি না পেলেও কেউ না কেউ তো পেতই। তবে এই লেখাটা কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে। আর ব্যাপারটা তো কাকতালীয় ছিল না, তাই না? ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেটারই একটা রোডম্যাপ দিয়ে গিয়েছিলেন উপন্যাসের মধ্যে। 

‘আপনার মনে আছে তো, আমাদের সিদ্ধান্ত? বিমল সমাদ্দার আনিসুরকে খুন করেছিলেন। মাধব রক্ষিত করেননি। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল না। জোড়া চিঠির রহস্য তার মধ্যে একটা। মাধবের গাড়িবারান্দার লাইট কেন ভাঙা ছিল, সেটা দ্বিতীয় রহস্য। আর প্রণবেশের ঘরের জানালা খুলতে দেখে শুদ্ধসত্ত্ব কেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল উপন্যাসের শেষে, সেটারও সমাধান কেউ জানে না। কিন্তু আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ খটকা আছে, যেটার দিকে কেউ নজর দেয়নি। আমাদের সিদ্ধান্ত অনুসারে, মাধব গ্রেট ইস্টার্ন থেকে বেরিয়ে দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে নিজের বাড়িতে গিয়েছেন। এটা সম্ভব নয়। মাধব রক্ষিতের পায়ের যা অবস্থা, সেখানে ডাক্তার তাঁকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন যেন পায়ের পাতায় চাপ না পড়ে। এদিকে ধর্মতলা থেকে বরানগর, এই দশ কিলোমিটার রাস্তা গাড়ি চালিয়ে পনেরো মিনিটে যাবার অর্থ হলো অ্যাক্সিলারেটরে জোরে চাপ দিয়ে গাড়ি চালাতে হবে। মাধবের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু হোটেলের সকলেই দেখেছেন যে মাধব নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তাহলে? 

‘দ্বিতীয়ত, আনিসুর যদি রাত বারোটার আগে খুন হন, বিমল সমাদ্দার খুন করবার পরে রাত দেড়টায় থানায় এসেছিলেন। ডেকার্স লেন থেকে তালতলা থানা ধীর পায়ে হেঁটে এলেও আধ ঘণ্টার বেশি লাগে না। মাঝখানের সময়টার রাইফেলের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বিমল সমাদ্দার কী করছিলেন? ডেকার্স লেন এবং তাঁর বাড়ি, মানে পার্ক সার্কাস– এই দুইয়ের মাঝে পড়ে তালতলা থানা। সাধারণ বুদ্ধি বলে, বাড়ি যাবার আগেই তাহলে তিনি থানায় আসবেন। আর তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই যে তিনি বাড়িতেই গিয়েছিলেন, এবং সেখান থেকে আবার থানায় আসেন, তাহলে রাইফেলের ব্যাগ বাড়িতেই রেখে আসবেন। থানাতে নিয়ে আসবেন না। কিন্তু বিমলবাবু থানায় ব্যাগ নিয়ে এসেছেন। তাহলে তিনিই যদি খুন করেন, সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত করতে হবে যে ডেকার্স লেন থেকে বাড়ি ফেরেননি। সেক্ষেত্রে মাঝের সময়টায় কোথায় ছিলেন? এই ধাঁধাগুলো থাকেই না, যদি একটা বিকল্প সিদ্ধান্ত করা যায়। সেটা হলো, বিমলবাবু সন্ধেবেলা থানা থেকে বাড়ি গিয়েছেন। মাঝের সময়টার কোথাও বেরোননি। মাঝরাতে বাড়ি থেকেই থানায় এসেছেন, যেরকম মাঝে মাঝেই আসেন। এবং তাঁর ব্যাগে বন্দুক নয়, সত্যিকারের দরকারি কাগজপত্র ই রাখা ছিল। উচ্চ রক্তচাপের কারণে বাথরুমে ঢুকে বারে বারে ঘাড়ে এবং চোখে মুখে জল ছিটিয়েছেন। মানে, খুনটা তিনি করেননি। 

‘যখন এই প্রশ্ন মাথায় এল, বুঝলাম, উপন্যাসেও পুরোটাই এক মস্ত বড়ো ধোঁকাবাজি। আমাদের সামনে যে দৃশ্যগুলোকে হাজির করা হয়েছে, তাদের ফাঁকে-ফোঁকরে অজস্র অসংগতি, যেগুলো হয়তো বা চোখেই পড়ছে না। আর সেগুলোকে উত্তর দিতে দিতে যদি একটার সঙ্গে আর একটাকে মেলানো যায়, তাহলে আমরা উপস্থিত হব সম্পূর্ণ অন্য এক সত্যে। বাস্তবের মতোই। দুটো চিঠির সত্যি যেখানে উন্মোচিত হবে। 

‘জানি না, উপন্যাসের শেষটা আপনি এরকমই ভেবেছিলেন কিনা। কিন্তু আমার সমাধানটা ভেবে দেখতে পারেন। হয়তো আপনার স্বনির্মিত মিথ্যের আবরণটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলবার জন্য ওটাই আপাতত সবথেকে ধারালো। আমার গল্পের শুরু স্বাধীনতার আগে। যখন মাধব আর আনিসুর, দুই সমাজবিরোধী এবং কোকেনের চোরাচালানকারী, নেশার বিস্তৃত সাম্রাজ্য শুরু করতে যাচ্ছেন। ব্যবসার শুরুতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আনিসুর দেখবেন এপার বাংলার ব্যবসা, আর মাধব দেখবেন ওপার বাংলার। কারণ, এখানে আমি পোয়েটিক লাইসেন্স নিচ্ছি, আনিসুর আসলে মুর্শিদাবাদের মানুষ, তাই এপার বাংলার অপরাধজগতের আনাচ কানাচ তাঁর চেনা। মাধবও রাজশাহীর অন্ধকার জগতের সঙ্গে ওঠাবসা করতে করতে কিছুটা সেখানকার অলিগলি চিনেছেন। কিন্তু শুরুর আগেই তাঁরা দেখলেন, একটা বড়ো অসুবিধে থেকে যাচ্ছে। ততদিনে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং হয়ে গিয়েছে, তার রেশ ধরে এখানে ওখানে দাঙ্গা চলছে, এবং অন্যান্য ব্যবসার মতো অপরাধ জগতেও তীব্র হিন্দু-মুসলমান ভাগ। সেক্ষেত্রে আনিসুরের কলকাতা এবং মাধবের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তান অপারেট করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, অপরাধ জগতের নিজস্ব সমীকরণেই তাঁদের গ্রহণ করা হবে না। কিন্তু মাধব যদি কলকাতায় আসেন আর আনিসুর যান পূর্ব পাকিস্তানে, তাহলেও সম্ভব নয়। কারণ মাধব কলকাতার ঘাতঘোঁত কিছুই জানেন না, যেমন আনিসুর চেনেন না পূর্ব পাকিস্তানেক অন্ধকার জগৎকে। তাহলে উপায় একটাই। ব্যবসার অঞ্চল দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। পূর্ব পাকিস্তান আর ভারত। সেই সঙ্গে মাধব হয়ে গেলেন আনিসুর, আর আনিসুর হয়ে গেলেন মাধব। কিন্তু নাম বদলের পরে নকল আনিসুর তো আর বগুড়াতে থাকতে পারেন না, সেখানে তাঁকে সবাই মাধব বলে জানে। তিনি ঢাকায় চলে এসে ব্যবসা শুরু করলেন, সেখানে তিনি অপরিচিত। অপরদিকে আসল আনিসুর, মানে নকল মাধব, চলে গেলেন কলকাতায়, যেখানে তাঁকে কেউ না চিনলেও তিনি এখানকার জগৎ হাতের তালুর মতো চেনেন। আর এভাবেই দুজন ঢুকে গেলেন নিজের নিজের গোষ্ঠীর ভেতর, শুরু হলো বিস্তৃত ব্যবসা। হুট করে এরকম নাম বদলে ফেলা সহজ নয়। কিন্তু অন্ধকার জগতের মানুষদের কাছে খুব কঠিনও নয়, বিশেষত তারা যদি বাইরে খুব চেনা মুখ না হয়। হয়তো একদিনে হয়নি, বেশ কয়েক মাস ধরে এই প্রসেস চলেছিল, জানি না। এটা সম্ভব হয়েছিল ব্যবসা তখনো শুরু হয়নি বলেই। যদি শুরু হয়ে যেত, দুজনেই মুখচেনা হয়ে উঠতেন অনেকের, ফলত তখন নাম বদল সহজ হতো না। তবুও, কেউ কি জানতো না? তাঁদের কাছের লোকেরা সম্ভবত জানতো। হয়তো টাকাপয়সা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ রাখা হয়েছিল। যাই হোক, আমি এখন থেকে তাঁদের আসল নামেই ডাকব। এইভাবে চলল বহু বছর। কিন্তু মাধব, মানে নকল আনিসুর, তিনি ঢাকায় সুবিধে করতে পারলেন না। ব্যবসা মার খেল। তিনি আনিসুর, মানে নকল মাধবের কাছে এসে হাত পাতলেন। আনিসুর ততদিনে সমাজের উঁচুতলায় উঠছেন। তিনি মাধবের মুখ বন্ধ রাখার জন্য বছরের পর বছর টাকা দিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। 

‘১৯৭৫ সালে মাধবের ক্যান্সার ধরা পড়ল। হাতে আর বেশিদিন নেই। তিনি ঠিক করলেন, মৃত্যুর আগে এই মিথ্যের আবরণ ছিঁড়বেন। সব স্বীকার করে যাবেন পুলিশ অথবা অন্য কারোর কাছে। হয়তো অনুতাপ হয়েছিল তাঁর। হয়তো প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছিলেন। অথবা হয়তো বছরের পর বছর একটা অন্য নাম আর অন্য পরিচয় বহন করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ভেতরে ভেতরে। মোট কথা, কলকাতায় এসে আনিসুরকে তিনি জানালেন তাঁর সিদ্ধান্ত। এবং আনিসুরের চোখ দেখে বুঝলেন, আনিসুর তাঁকে ছাড়বেন না। এতদিন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সামাজিক সম্মান, ব্যাবসায়িক প্রতিপত্তি এবং সম্পদের পৃথিবী এক লহমায় ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে মাধবের জন্য, এটাকে আনিসুর কিছুতেই হতে দেবেন না। মাধব বুঝলেন, আনিসুর তাকে হত্যা করবেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, শুদ্ধসত্ত্বকে সব বলে যাবেন। সেই উদ্দেশ্যে চিঠি লিখলেন। লিভার ক্যান্সারের একটা স্টেজ পেরিয়ে গেলে হাত কাঁপে, লেখা যায় না। তাই চিঠি টাইপ করালেন অন্য কাউকে দিয়ে। সেই চিঠিতে স্পষ্ট করে লিখে দিলেন, মাধব রক্ষিত আপনার সাহায্য চেয়েছে। মাধব রক্ষিতই, অন্য কেউ নয়। তিনি জানতেন, লোকে তাঁকে শনাক্ত করবে আনিসুর বলে। কিন্তু তিনি তো মাধব। নিজের যে নামটাকে এতদিন ধরে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারেননি, শুদ্ধসত্ত্বের কাছে অধীর ব্যাকুলতায় বারবার লিখে গেলেন সেই নাম। সেদিন দুপুরবেলাই কোনো এক অছিলায় আনিসুর এলেন মাধবের হোটেলে। মাধব হয়তো বাথরুমে গিয়েছিলেন কথার ফাঁকে। আনিসুর দেখলেন টেবিলের উপর রাখা খাম, তাতে শুদ্ধসত্ত্বের নাম লেখা। এই নাম আনিসুরের অজানা ছিল না। তিনি বুঝে গেলেন, মাধব স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন। ত্বরিতগতিতে খাম থেকে চিঠি বার করে সেই খামের ভেতর একটা সাদা কাগজ পুরে ফেললেন আনিসুর। আর সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই রাতেই মাধবকে খুন করতে হবে। আর বাঁচিয়ে রাখা বিপজ্জনক। কারণ মাধব এরপর পুলিশের কাছে চলে যেতে পারেন। 

‘হোটেল থেকে বেরিয়ে বাড়ি এলেন আনিসুর। মাধবের চিঠিটা ফেলেই দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কী মনে হতে একবার পড়লেন। এবং দেখলেন, এই চিঠি নামবিভ্রাটের কারণে তাঁর পক্ষে বড়ো অস্ত্র হতে পারে। একটা খামে শুদ্ধর ঠিকানা লিখলেন। প্রেরকের জায়গাতে লিখলেন নিজের নাম ঠিকানা। খামের ভেতরে চিঠি পুরে নকুলকে বললেন যেন শুদ্ধসত্ত্বের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। ডাকবাক্সে না ফেলে নকুলের হাতে দেবার কারণ, চিঠি যেন তাড়াতাড়ি পৌঁছোয়। যে চিঠি আসল মাধবের পাঠাবার কথা ছিল, সেই চিঠিই দাঁড়িয়ে গেল নকল মাধবের পক্ষে। অপরদিকে, অসুস্থ মাধব টেবিলে রাখা খাম আর খুলে দেখলেন না। সাদা কাগজ ভর্তি খাম ফেলে এলেন ডাকবাক্সে। শুদ্ধসত্ত্ব প্রথম চিঠি পেল মাধবের লেখা, খামের উপরে আনিসুর মানে নকল মাধবের হাতের লেখায় বাড়ির ঠিকানা দেওয়া। দ্বিতীয় চিঠি পেল সাদা কাগজ, খামের উপরে মাধব মানে নকল আনিসুরের হাতের লেখায় হোটেলের ঠিকানা দেওয়া। চিঠি একটাই। একটা আসল, অপরটা জাল, মানে সাদা কাগজ।’

দেখলাম, অরুণের জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে। কপালের ওপর দেখা দিয়েছে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। স্থৈর্য ভাঙছে আস্তে আস্তে। সিদ্ধার্থ মাথা ঝুঁকিয়ে নিশ্চল বসে। অনন্যা স্তব্ধ হয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে। 

‘আপনি এটা বুঝলেন কী করে?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন অরুণ।

‘একদিন সিদ্ধার্থ আমাকে বলেছিল, ও ডাবলিন আর দার্জিলিং-এর মধ্যে তফাত করতে পারে না। নকল ডাবলিনে ফিরছে নাকি আসল দার্জিলিং ছেড়ে যাচ্ছে, এই সংশয় তার বারবার হয়। দুটো শহর, কিন্তু বস্তুত যেন একটাই। একটা আসল, আর অপরটা তার প্রতিলিপি। কথাটা মনে ছিল। কাল মনে হয়েছিল, শহরের মতো চিঠিও যদি এরকমই হয়? একটাই চিঠি, দুটো নয়? যদি সেটাই হয়, তাহলে দ্বিতীয় চিঠি পাঠানো হয়েছে এই ভেবে যে সেটাই আসল চিঠি। কিন্তু দ্বিতীয় চিঠি পাঠিয়েছেন আনিসুর। তিনি যদি সেটাকেই প্রথম চিঠি ভেবে পাঠান, তাহলে প্রথম চিঠিটা তিনি লিখেছেন। আর সেক্ষেত্রে, আনিসুর আসলে, আনিসুর নন। তিনি মাধব। এবং উল্টোদিকেও, মাধব আসলে আনিসুর।’ 

অরুণ শক্ত করে কপালের চুল চেপে ধরলেন। মাথা নাড়িয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, ‘আপনাকে আমি কেন আসতে বললাম এখানে? কেন?’ 

‘আর এই দুটো চিঠির রহস্যকে সমান্তরাল টেনে পৌঁছেছিলাম অমিতাভ মিত্রর রহস্যে। কিন্তু সেটায় পরে আসব। আগে এই গল্পটা শেষ করি।’ 

সিদ্ধার্থ উঠে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল। মাঝে বাগানের দিকে পা বাড়াল। তারপর কী ভেবে ফিরল আবার। অনন্যা তার দিকে তাকিয়ে নিজের মনে বললেন, ‘আমাকে কি শুনতেই হবে?’ 

‘আমি শুনব। যত অসুবিধেই হোক না কেন।’

‘মাধবের হোটেলের উলটোদিকে আছে আর একটা সস্তার হোটেল।’ আবার শুরু করলাম। ‘তার জানালা খুললে মাধবের ঘরের জানালার মুখোমুখি হয়। আনিসুর আগের দিনই সেই ঘরটা ভাড়া নিয়েছিলেন। রাইফেল তাঁর কাছেই ছিল। মনে রাখতে হবে, মিলিটারিতে টেন্ডারের কাজে তিনি কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। কাজটা যদিও ভড়ং ছিল। আসল উদ্দেশ্য সামরিক বাহিনীকে হাত করে চোরাচালানের পথ সুগম করা। যাই হোক, এই সূত্রে মিলিটারি লোকেদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, এবং রাইফেল চালানো সম্ভবত তাদের কাছ থেকেই শিখেছিলেন। আরও একটা কাজ করলেন আনিসুর। সেদিন বাড়ি থেকে বেরোবার আগে গাড়িবারান্দার আলো ভেঙে দিলেন। 

‘এবারে আসছি প্রথম প্রশ্নে। আনিসুর গাড়ি চালালেন কী করে, যদি তাঁর পায়ের অবস্থা ওরকম হয়? উত্তর একটাই। আনিসুরের গাড়িতে লুকিয়ে ছিল অন্য কেউ। আনিসুর গাড়ি নিয়ে এগিয়ে সকলের চোখের আড়ালে চলে এলেন, এবং ড্রাইভারের সিট ছেড়ে দিলেন সেই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে, যে সম্ভবত নকুল। দারোয়ান বলেছিল যে সেই রাত্রে নকুল একবার সন্ধে আটটার সময়ে বেরিয়ে নটা নাগাদ ফিরে আসে। এর আগেও নকুল একবার বরানগর থেকে দক্ষিণে এসে আনিসুরের চিঠি দিয়ে গিয়েছিল শুদ্ধসত্ত্বর বাড়ি। ছ-টা নাগাদ বেরোলে, চিঠি দিয়ে আবার বাস ধরে ফিরতে সাড়ে সাতটা থেকে আটটাই বাজবার কথা। তারপরে আবার বেরিয়ে ফিরে আসা সম্ভবত দারোয়ানকে বোঝানোর জন্য যে নকুল রাত ন-টা থেকে বাড়ির ভেতরেই ছিল। কিছুক্ষণ পরে নকুল পাঁচিল টপকে বেরিয়ে যায় এবং বাস ধরে গ্রেট ইস্টার্নের কাছে আসে। পার্টি শেষ হবার পর নকুল তীব্র বেগে গাড়ি চালিয়ে বরানগর চলে যায়। তাহলে আনিসুর কোথায় গেলেন? তিনি নেমে গেলেন ডেকার্স লেনে। হোটেলের কাছে গিয়ে মেইন সুইচ অফ করলেন। তারপর উলটোদিকের হোটেলে নিজের ঘরে ঢুকলেন। চাবি তাঁর কাছে আগেই ছিল।’ 

‘এক মিনিট।’সিদ্ধার্থ মুখ তুলল। যন্ত্রণাক্লিষ্ট, কিন্তু কঠিন। ‘অমিতাভর উপন্যাস কাল রাত্রে আমি শেষ করেছি। মেইন সুইচ বন্ধ করবার ব্যাপারটা জানি। কিন্তু সেটাকে অফ করা হয়েছিল অন্ধকারে গা ঢাকা দেবার উদ্দেশ্যে। আনিসুর যদি উলটোদিকের আলোওয়ালা হোটেলে ঢোকেন, তাহলে মাধবের হোটেলের মেইন সুইচ অফ করবার দরকারটা কী ছিল?’ 

‘মেইন সুইচ বন্ধ করবার উদ্দেশ্য অন্ধকার আনা ছিলই না। এখানেই আমরা সকলে ধোঁকা খেয়েছি।’ 

‘মানে?’ বিভ্রান্ত স্বরে বলল সিদ্ধার্থ। 

‘আগেই বলেছিলাম, এই গল্পের পুরোটাই ধোঁকা? উপন্যাসেও তাই। মৃদু হাসলাম। ‘সেদিন ভ্যাপসা গরম ছিল। দরজা-জানালার কবাট আঁটা বদ্ধ ঘরের ভেতর লোডশেডিং হলে মানুষ প্রথমেই কী করে? জানালা খুলে দেয়, যাতে কিছুটা হাওয়া আসে। আনিসুর উলটোদিকের হোটেলের ঘরে নিজের জানালায় রাইফেল হাতে প্রতীক্ষায় ছিলেন, মাধব কখন জানালা খুলবেন। প্রণবেশের ঘরে যখন লতিকা বলল যে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে জানালা খুললে হাওয়া আসবে, শুদ্ধসত্ত্ব এটা শুনে চমকে উঠেছিল। বুঝতে পেরেছিল খুনটা কীভাবে হয়েছে।’ 

কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘লোডশেডিং-এর উদ্দেশ্য আলো বন্ধ করা ছিল না। ছিল পাখা বন্ধ করা।’ 

‘মাই গড!’ এবার বিড়বিড় করলেন অনন্যা। 

‘মাধব কী করলেন? লোডশেডিং হলে কী করে মানুষ? তিনি বিছানায় শুয়েছিলেন। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করলেন। তারপর উঠে আলোর সুইচ টিপে দেখলেন সত্যিই কারেন্ট গেছে কিনা। হয়তো দরজা খুলে বাইরেও বেরিয়েছিলেন একটু, অন্যান্য ঘরে কারেন্ট আছে কিনা দেখবার জন্য। আবার ভেতরে ঢুকে অস্বস্তিতে পড়েছিলেন প্রচণ্ড গরমে। জানলার কাছে এলেন। পর্দা সরালেন। কিন্তু জানালার কাচ টেনে তুলতে পারলেন না। কারণ কাচ জ্যাম হয়ে আটকে ছিল। মাধবের উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, উপন্যাসেই বলা আছে। আর জানালার উচ্চতা? মেঝে থেকে চার ফুট উপর থেকে শুরু হচ্ছে, তিন ফুট উচ্চতার জানালা। মানে জানালার মাথা মাটি থেকে সাত ফুট। মাধব হাত উঁচু করেও সেই মাথা ছুঁতে পারবেন না। ফলে ওপরের কাচ টেনে নামাবার মতো প্রয়োজনীয় উচ্চতা তাঁর ছিল না। তিনি চেয়ার টেনে আনলেন। চেয়ারের উপর উঠে দেখতে গেলেন জানালার উপরের কাচ নামানো যায় কিনা। নামানো গেল না। চেয়ার সরিয়ে আবার নীচের কাচই তুলতে গেলেন। এবার কাচ উঠল। যখন মাধবের বডি আবিষ্কৃত হবার দিন দুপুরবেলা শুদ্ধসত্ত্বরা সেই ঘরে ঢুকেছিল, পুলিশের এক কনস্টেবল জানালা খুলতে গিয়ে প্রথমে পারেনি। তারপর টানাটানি করতে আস্তে আস্তে কাচ ওপরে উঠেছিল। সেই রাত্রেও সেটাই হয়েছিল। মাধব টানাটানি করছিলেন, কাচ আস্তে আস্তে ওপরে উঠছিল। জানালার অর্ধেকটা নীচের কাচ, মানে তার দৈর্ঘ্য দেড় ফুট। সেটা পুরোটা উপরে ওঠা মানে মাটি থেকে সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতায় কাচ ওঠা—ফাঁকা হয়ে যাওয়া মাঝখানের দেড়ফুট দৈর্ঘ্য। সেটা মাটি থেকে চারফুট ও সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার মাঝের অঞ্চলটুকু। মানে মোটামুটি মাধবের বুক থেকে মাথা পর্যন্ত। উলটোদিকের রাইফেল হাতে বসে ছিলেন আনিসুর। অনুমান করছি, মাধব কাচ পুরোপুরি তুলবার অবসর পাননি। তার আগেই, তাঁর বুক যখন উন্মুক্ত হয়েছিল, আনিসুর সাইলেন্সার লাগানো রাইফেল থেকে গুলি ছুড়লেন। আনিসুর সম্ভবত জানালার কবাট বা অন্য কোথাও একটা পেনসিল টর্চ রেখেছিলেন, যাতে অন্ধকারে নিশানা করতে পারেন। গুলির ধাক্কায় মাধব ঝাঁকুনি খেয়ে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে পড়ে গেলেন। জানালার কাচের নীচ থেকে হাত সরে গেল। কাচ দড়াম করে পড়ে গেল আবার। লকড রুম! চিচিং-ফাঁক আর চিচিং বন্ধ! ঠিক যেমনটি বলেছিলেন পুলিশের কনস্টেবল ভবানীবাবু। ঠিক এই কারণেই পিস্তল নয়, রাইফেলের ব্যবহার। কারণ ঘরের মধ্যে নয়, বরং ঘরের বাইরে বেশ খানিকটা দূরত্ব থেকে গুলি ছুঁড়তে হয়েছিল, যা মিড রেঞ্জ রাইফেল ছাড়া সম্ভব নয়। বুলেটের ফাঁকা খোলও এই কারণে মেলেনি। আর লকড রুম ভেবেচিন্তে করা হয়নি। হয়ে গিয়েছে দৈবাৎ। অপরদিকে নকুল গাড়ি চালিয়ে আনিসুরের বাড়ির সামনে পৌঁছল। হর্ন বাজিয়ে দারোয়ানকে তুলল। ঘুমচোখে দারোয়ান দেখল আনিসুরের গাড়ির জ্বলন্ত হেডলাইট। তীব্র আলোয় সারা বাগান ধাঁধিয়ে আছে। সেই হেডলাইটের পেছনে চালকের আসনে কে বসে আছে সে অত খুঁটিয়ে দেখল না। কারণ সে তো জানে যে আনিসুরের গাড়ি যখন, মালিক নিজেই চালাবেন। সে গেট খুলে দিল। গাড়ি গিয়ে গাড়িবারান্দার সামনে দাঁড়াল। গাড়িবারান্দার আলো ভাঙা হয়েছিল যাতে দারোয়ান দেখতে না পায় অন্ধকারে কে গাড়ি থেকে নামছে। অন্যদিকে আনিসুর খুন করে ধীরেসুস্থে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে বরানগর এলেন। নকুলের সাহায্যে বাগানের পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকলেন। ওই কারণেই ভবানীবাবু দেখেছিলেন যে বাগানের একটা দিকের ঘাস দলামোচড়া হয়ে আছে। আর সেই সঙ্গে আনিসুর ওরফে নকল মাধবের অ্যালিব্যাই হয়ে গেল দুর্ভেদ্য। একই সঙ্গে আনিসুর শুদ্ধসত্ত্বের সামনে অমিতা বলে এক কাল্পনিক নারীর আখ্যান হাজির করলেন, যাতে তাঁর গল্পটা শক্তিশালী হয়। 

‘বিমলবাবু কি মাধব আর আনিসুরকে আগে থেকে চিনতেন? সম্ভবত। সম্ভবত বহু দিন ধরে এদের স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। আনিসুর এমন ভাবে খুনটা করলেন, যাতে মনে হয় বিমলবাবু খুন করে আনিসুরের উপর দোষ চাপাচ্ছেন। এই হত্যার চমকটা এখানেই। শিকারি শিকার করল, এবং নিজের কিছু চিহ্ন ছড়িয়ে গেল শিকারের আশেপাশে, যেন তার নিজের উপর সন্দেহ পড়ে। তারপর সে অঙ্গুলিনির্দেশ করলো এক খড়ের মানুষের দিকে। স্টু-ম্যান! সারা বিশ্বকে দেখালো, সেই খড়ের মানুষই অপরাধী, যে শিকারিকে ফাঁসাচ্ছে। সত্যিটা হলো, খড়ের মানুষ ছিল শিকারির দ্বিতীয় শিকার।’ বিকৃত গলায় হিসহিসানি স্বরে অরুণ বললেন, ‘আপনার এই সমস্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তি কী?’ 

‘আপনি একটা গল্প বলেছেন। আমি তার উল্টোদিকে আর একটা বিকল্প গল্প বলছি। আর আপনিও মানবেন, এই গল্পটা পুরো কংক্রিট। কোনো ফাঁক নেই এতে। তাই না?’ হালকা গলায় উত্তর দিলাম। 

অরুণের মুখ আস্তে আস্তে পালটাচ্ছে। শান্ত স্থিতধী প্রতিবিম্ব ভেঙে বেরিয়ে আসছে একজন অস্থির হিংস্র মানুষ। ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে। চোখ হয়ে উঠছে লাল। হাত মুঠো করে নিজেকে সামলাচ্ছেন প্রাণপণে। 

নিস্পৃহভাবে অরুণের দিকে তাকালাম। আর এখানেও কী অদ্ভুত মিল উপন্যাসের সঙ্গে বাস্তবের! মাধবের যে সহকারী ছিল একজন, তেমনই বাস্তবে আপনারও ছিল একজন সহকারী। কিন্তু শুধু এটুকুই নয়। উপন্যাসে যেমন শিকারি একজন খড়ের মানুষ খাড়া করে দেখাতে চেয়েছিল যে সেই খড়ের মানুষ শিকারিকে ফাঁসাতে চাইছে, বাস্তবেও তাই। এখানে সেই স্ট্র-ম্যানের নাম ড্যানিয়েল লামা। আরও যে কত কত মিল! আপনি তো আমার থেকে অনেক ভালো জানবেন, কারণ লিখেছেন আপনিই। দুটো চিঠি, নাকি একটাই চিঠি? একটা মানুষ, নাকি দুটো আলাদা মানুষ? এই গল্পটা কি এবার বলবেন, মিস্টার চৌধুরী?’ 

অরুণকে দেখলাম, অবরুদ্ধ ক্রোধে অল্প অল্প কাঁপছেন। মুখ লাল হয়ে উঠেছে। আগেকার স্থির লোকটা অদৃশ্য। তার জায়গা নিয়েছে কোণঠাসা আহত এক জানোয়ার। চাপা গর্জন করে উঠলেন, ‘আমি চাইলে আপনি দার্জিলিং থেকে সারাজীবনের জন্য বাইরে বেরোতে পারবেন না টিনা! সামলে খেলুন।’ 

‘এই হুমকি ড্যানিয়েলও দিয়েছিলেন আলাপের প্রথম দিন। কী আশ্চর্য মিল দুজনের! কিন্তু আপনারা কেউই কিছুই করতে পারবেন না, সেটাই যা দুঃখের। দুই কাগুজে বাঘ বৃথাই একে অপরের বিরুদ্ধে এতদিন নখে শান দিয়ে গেলেন।’ সিদ্ধার্থ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, এই অরুণকে সে চেনে না। এবার কাকার হাত ধরতে গেল। অরুণ ফিরেও তাকালেন না। ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিলেন। 

‘আপনি যখন গল্পটা বলবেন না, আমিই বলছি।’ অরুণের চোখে সোজাসুজি দৃষ্টি মেললাম। কপালের ওপর এসে ঝামরে পড়া চুলের গোছা চোখেই পড়ল না এবার। ‘গতকাল পুলিশের লাইব্রেরিতে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে পুরোনো তথ্য, এফআইআর কপি এই সমস্ত কিছু জোগাড় করেছি। ফটো তুলেছি। আর সেখান থেকে গল্পটা দাঁড় করিয়েছি। প্রথমে বলি, যে গল্পটা আপনি সাজিয়েছিলেন, সেই গল্পের ফাঁকগুলো কোথায়। অমিতাভ আপনার হাতে আঁচড় কাটেননি, উপন্যাসটাও তাঁর লেখা নয়। এই দুটোর কথা আগেই বললাম। এ ছাড়াও, ঋষি রোডের বাড়িতে আঁকা ছবিতে দু-রকম রং কেন থাকবে সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। আর একটা প্রশ্ন আমার মনে এসেছিল যার উত্তর কিছুতেই পাচ্ছিলাম না। যে ড্যানিয়েল আপনাকে নাকি হুমকি দিয়েছিলেন যে অমিতাভর পায়ের ছাপ যেন বাগান থেকে মুছে দেন, তিনি নিজের পায়ের ছাপ মুছে দেবার ব্যাপারে এত উদাসীন ছিলেন কেন? আপনাকে তো অমিতাভর পায়ের ছাপ মুছতে বলেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর উচিত ছিল নিজের পায়ের ছাপও মুছে ফেলবার ব্যবস্থা করা। কবরখানায় কিন্তু ড্যানিয়েল সতর্ক ছিলেন, তাঁর পায়ের ছাপ যেন না বোঝা যায়, অথবা জুতোজোড়া খুঁজে না পাওয়া যায়। সেই জন্যই রেইনকোটের মধ্যে জুতো ভরে নিয়ে যাওয়া। কবরখানায় যিনি এত সতর্ক, অরুণের বাড়িতে পায়ের ছাপ লুকোনোয় তিনি এত অসাবধানী কেন? তিনি তো জানতেনই যে পুলিশ এসে পায়ের ছাপ দেখবে। আর যে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না— অমিতাভর লাশ উপুড় করা ছিল কেন। ড্যানিয়লের ঘৃণা, মুখ দেখতে চান না? নাটকীয় না? অন্য কোনো বিকল্প কি থাকতে পারে না? 

‘শেষ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। কাল দেখেছিলাম, হোটেলের এক ভদ্রলোক হিপ পকেট থেকে পার্স বার করছেন। দুম করে মনে পড়েছিল, অমিতাভর পরনে ছিল জিন্সের প্যান্ট। দার্জিলিং-এর বাজার তখন ছেয়ে গিয়েছিল হংকং থেকে চোরাপথে আসা জিন্সে। জিন্সের প্যান্টে দরকারি কাগজপত্র সাধারণত হিপ- পকেটে রাখা হয়। মৃতদেহ উপুড় করা ছিল কি তাহলে হিপ পকেটে সেই কাগজ ঢোকাবার জন্য? যদি সেটাই হয়, তার মানে সেই কাগজগুলো হিপ পকেটে গোড়া থেকেই ছিল না। কেন ছিল না? কারণ, যার পকেটে এই কাগজগুলো থাকার কথা, সে এই ব্যক্তি নয়। 

‘দ্বিতীয়ত, ড্যানিয়েলের পায়ের ছাপ নিয়ে ধাঁধা। আগের দিন যখন আমার সমাধান বলছিলাম, মানে যেখানে ড্যানিয়েলই হত্যাকারী, সেখানে গল্পটা এমন ছিল যে ড্যানিয়েল আর আপনি মিলে প্রশান্ত গুরুঙের পায়ের ছাপ তৈরি করেছেন। মানে, ড্যানিয়েল এসেছিলেন, প্রশান্ত গুরুং আসেননি। যদি একটা বিকল্প আখ্যানে ব্যাপারটা উলটে যায়, যদি এমন হয় যে প্রশান্ত গুরুং এসেছিলেন, কিন্তু ড্যানিয়েল আসেননি? এবং প্রশান্ত গুরুং-এর পায়ের ছাপ নয়, আপনি ড্যানিয়েলের পায়ের ছাপ বানিয়েছেন? আগের গল্পের একশো আশি ডিগ্রি উলটোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা এই আখ্যানের সুবিধেটা হলো, এর ফলে একটা প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাচ্ছি। ড্যানিয়েল এই বাড়িতে আসেননি, কিন্তু কবরখানায় গিয়েছিলেন, এবং নিজের পায়ের ছাপ লুকোতে সচেষ্ট ছিলেন। 

‘যদি ওপরের ব্যাখ্যাগুলো মেনে নিই, তাহলে কী দাঁড়ালো? অমিতাভ আপনার হাতে আঁচড়ে দেননি। অমিতাভ এই উপন্যাস লেখেননি। ড্যানিয়েল এই বাড়িতে আসেননি। এবং মৃতদেহটাও অমিতাভর নয়। তাহলে গোটা আখ্যানে অমিতাভর জায়গাটা কোথায়? অমিতাভ বলে কি সত্যিই কেউ আছেন? আমরা যা দেখছি, পুরোটাই কি ধোঁকা? আসল গল্পকে চাপা দেবার জন্য একটা কভার? সেটা জানবার জন্য আমাকে কাল সারাদিন ধরে অনেক কিছু ঘাঁটতে হয়েছে। এবং সত্যিটা আমি এখন জানি। অমিতাভ খুন হয়েছেন, এবং হননি। ঠিক যেমন আনিসুর খুন হয়েছেন, এবং হননি।’ 

কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কারোর সেদিকে মন ছিল না। ‘আমার সিদ্ধান্তটাকেই ব্যাখ্যা করে বলি?’ 

কেউ উত্তর দিল না। 

‘আপনারই প্রিয় কবিতা, মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়— জীবনানন্দ দাশ। এটাই আসল ক্ল, তাই তো? সমস্ত রহস্যের মূল সূত্র লুকিয়ে আছে ওই লাইনটাতেই। বারবার, জানেন, বারবার মাথার ভেতর ঘুরে ফিরে আসছিল লাইনটা। এই কয়েকদিনে। কাল বুঝলাম, এটার আসল মানে কী। আপনিও হয়তো কবিতাটা থেকেই প্ল্যান পেয়েছিলেন। তবে এ তো নতুন কিছু নয়। গর্জনতেল মাখানো দিদির মৃতদেহের ইমেজারি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আপনি একটা আস্ত রহস্যকাহিনী লিখেছেন। আগেই বোঝা উচিত ছিল, আপনার লেখালেখির অনেক রেফারেন্স কবিতা থেকে মিলবে। এমনকি বাস্তব জীবনের যে ক্রাইমটা করবেন, সেটাও আদিকবির সূত্র ধরেই।’ 

সিদ্ধার্থ সামনে ঝুঁকল। ‘তুমি বলতে কী চাইছ?’ 

‘অমিতাভ মিত্র, প্রতিশ্রুতিবান তরুণ কবি, ড্যানিয়েল লামার হাতে খুন হয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। আর ১৯৭৫ সালে অরুণ চৌধুরী এবং সঞ্জয় অধিকারী, বিশিষ্ট লেখক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক, এই দুজন মিলে খুন করেছেন অপর একজনকে। তাকে এখানে সকলেই নামে চেনে। বাবলা। আপনার বাগানের একসময়কার মালি।’ 

শান্ত ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও লোকে এত চমকাত না, যেমন চমকালেন অনন্যা ও সিদ্ধার্থ। অনন্যা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো থরথর করে কেঁপে উঠলেন। সিদ্ধার্থ ফ্যাকাশে মুখে একবার উচ্চারণ করল, ‘বাবলা?’ শুধু অরুণের কোনো ভাবান্তর হলো না। 

‘এই গল্পের শুরু ষাটের দশকে। অভিন্নহৃদয় তিন বন্ধু স্কুলজীবন থেকে লেখক হবার স্বপ্ন দেখতো। সবথেকে প্রতিভাবান যে, সে ছিল উন্মার্গগামী। প্রায় স্যোসিওপ্যাথ। তাকে আগলে রাখতো বাকি দুজন। এই তিনজনের ওঠা-বসা, ঘুরে বেড়ানো, দার্জিলিং-এর গলিখুঁজি উপত্যকা জঙ্গলের মধ্যে দিনযাপন- এই সমস্ত কিছুর চিহ্ন রেখে দিয়েছে সেই সময়কার কবিতা, লিটলম্যাগ, লেখালেখি, একসঙ্গে বাঁচার এবং লেখার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখবার যে যৌথ পরিবৃত্ত, সেই সমস্তকিছু। মধ্যরাতের দার্জিলিং শাসন করত তিনজন যুবক, এরকম বলাও হয়তো অত্যুক্তি হবে না। সেই যাপনের প্রতি তিন বন্ধুই আমৃত্যু অনুগত থেকে গিয়েছিলেন। একজনের সাহিত্যিক হবার স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে। তিনি চলে গেছেন কলকাতায়। একজন চলে গিয়েছেন নির্জনে। মরে গিয়ে ভুলে যাওয়া কবিদের কবরখানায় জায়গা পেয়েছেন। আর তৃতীয়জন, মানে আপনি, বিখ্যাত ক্রাইম লেখক অরুণ চৌধুরী, তিনি ক্রমে সাফল্যের শীর্ষে উঠেছেন। কিন্তু একটা জায়গায় তিনজনেই এককাট্টা ছিলেন। সেটা বন্ধুত্বের প্রতি। ফেলে আসা দিনগুলোর প্রতি। অরুণ চৌধুরী। অমিতাভ মিত্র। সঞ্জয় অধিকারী। বিখ্যাত লেখক। ভুলে যাওয়া কবি। বিশিষ্ট সাংবাদিক। আর সেই আনুগত্য, নিখাদ কমিটমেন্ট, সেখান থেকেই এই গল্পের সূচনা বললে বাড়াবাড়ি হয়তো হবে না। 

‘স্বভাব পাগল অমিতাভ মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতেন। ফিরে আসতেন কয়েকদিন পরে। কিন্তু একবার গিয়ে আর ফিরলেন না। সেটা ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি। অরুণ এবং মৃত্যুঞ্জয় দুজনেই জানিয়েছেন যে একবার অমিতাভ পালিয়ে গেছিলেন এবং ফিরেছিলেন বহুদিন পর। সেবার অরুণ ভয় পেয়ে থানা পুলিশ করেন। বাস্তবটা হলো, অমিতাভ সেবারে আর ফেরেননি। ড্যানিয়েল লামা সম্ভবত নকশাল সন্দেহে আপনমনে ঘুরতে থাকা পাগলাটে কবিকে তুলে নিয়ে গিয়ে এনকাউন্টার করে দিয়েছিলেন। সেই সময়ে এরকম সন্দেহের বশে এনকাউন্টার ভুরি ভুরি হতো। অথবা এটাও হতে পারে যে অমিতাভ রাত্রের দার্জিলিঙের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে ড্যানিয়েলের কোনো হত্যাকাণ্ড দেখে ফেলেন। মাথায় গণ্ডগোল ছিল তাঁর। চিৎকার চেঁচামেচি করেন যে তিনি থানা-পুলিশ- আদালত করবেন। ড্যানিয়েলের কাছে বুলেট ছিল সস্তা। একজন পাগলকে কে অত বোঝাবে, যেখানে অসংখ্য লাশের ভিড়ে তার লাশ ঢুকিয়ে দেওয়া যায়? সম্ভবত ঋষি রোডের বাড়ির নীচে যে উপত্যকা, সেই জঙ্গলেই অমিতাভর লাশ ফেলে দিয়েছিলেন ড্যানিয়েল, আরও অন্যান্য মৃতদেহের সঙ্গে। অজ্ঞাতকুলশীল অনাথ যুবক অমিতাভর কথা সকলে ভুলে গেল। 

‘ভুললেন না দুজন। অরুণ আর সঞ্জয়। সঞ্জয় অধিকারী যে দার্জিলিং-এর স্কলে পড়েছেন, এটাই জানতাম না। ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে অরুণকে তিনি ছোটোবেলা থেকে চিনতে পারেন। প্রথম ইঙ্গিত পেলাম বিনয়েন্দ্র মুস্তাফির কাছ থেকে। কলকাতায় চেনা সাংবাদিকদের ফোন করে সঞ্জয়ের জন্ম সাল এবং কোন স্কুলে পড়েছেন, দুটো মিলিয়ে নেবার পর মনে হচ্ছিল, আমি কী করে এতদিন গোটা গল্পটা থেকে ব্যক্তি সঞ্জয়কে ভুলে গিয়েছিলাম? তবে শুধু আমি নই, পুলিশও একই ভুল করেছিল। একে একে সেইসব প্রসঙ্গে আসছি। অরুণ, অমিতাভ আর সঞ্জয়। তিন বন্ধু। মৃত্যুঞ্জয় সোম সঞ্জয়কেও দেখেছিলেন অরুণের সঙ্গে আদালতে আসতে। ওই সময়টায় সঞ্জয় সবে জুনিয়র সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেছেন কলকাতার কাগজে। সেই সময়ে তাঁর কাছে অরুণ খবর পাঠালেন, অমিতাভ বহুদিন ধরে নিখোঁজ। অরুণ সম্ভবত বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছিলেন যে অমিতাভকে পুলিশ মেরে দিয়েছে। অরুণ বহু থানা পুলিশ করলেন। কাল আমি সেইসব এফআইআর কপি দেখেছি, ৭১-এর জুলাই মাসের। সেটা দেখেই অনুমান করলাম যে অমিতাভ আর বেঁচে নেই। কারণ এফআইআরে অরুণ লিখেছিলেন যে তিনি ভয় পাচ্ছেন অমিতাভকে গুম করে দেওয়া হয়েছে। ড্যানিয়েলের সঙ্গেও দেখা করলেন। ড্যানিয়েল অরুণকে হুমকি দিলেন যে এই বিষয়ে বেশি খোঁচাতে গেলে তাঁর অবস্থাও অমিতাভর মতো হবে। সম্ভবত হেনস্থাও করেছিলেন কি? সেই সময়ে ড্যানিয়েল দার্জিলিং-এর মুকুটহীন রাজা। তাঁর চোখে চোখ রেখে কথা বলবে এমন হিম্মত কারোর ছিল না। তিনি চাইলে যে কাউকে গুম করে দেবেন বা ফলস্ কেসে ফাঁসিয়ে জেলে ঢুকিয়ে পচিয়ে মারবেন। অরুণের কিছু করবার ছিল না। তিনি চুপ করে দেখে গেলেন, ড্যানিয়েল কীভাবে তাঁর অবর্ণনীয় সন্ত্রাস এবং নিষ্ঠুরতা দিয়ে একটা জেলার নাভিমূল অবধি আতঙ্কে বরফ করে দিচ্ছেন। কিন্তু খেলা তখনও বাকি ছিল। এক দান, এক দান, এবং তার পরে আরও এক দান। 

‘ড্যানিয়েল অরুণকে দাবিয়ে রাখলেন ঠিকই। কিন্তু অরুণের মনে জন্ম নেওয়া প্রবল আক্রোশ আর ঘৃণার সন্ধান পেলেন না। সেটা শীতঘুমে কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকা একটা সাপের মতো ঘাপটি মেরে থেকেই গেল অরুণের মনে। তিনি দেখলেন, একজন পুলিশ অফিসার শুধুমাত্র নিজের পদাধিকার এবং ক্ষমতার বলে একটার পর একটা অন্যায় করে যাচ্ছেন, এবং হয়ে উঠছেন একচ্ছত্র সম্রাট। অরুণকে শুধুমাত্র হুমকি দিয়ে গলা টিপে ধরেছেন, এবং তাতে কারোর কিছু আসছে যাচ্ছে না। অরুণের আত্মসম্মানকে দশ টাকা দরে খোলা বাজারে বেচে দিচ্ছেন ড্যানিয়েল। এতখানি গ্রহণ করতে অরুণের মতো মেগালোম্যানিয়াক প্রস্তুত ছিলেন না। তীব্র ঘৃণার বশে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ড্যানিয়েলকে শেষ করতে হবে। সঙ্গে পেলেন সঞ্জয়কে। কারণ সঞ্জয়ও অমিতাভ হত্যার বিচার চাইছিলেন। আইনি পথে না হলে আইন-বহির্ভূত উপায়ে। শুরু হলো প্রতিশোধ নেবার প্ল্যান। ধীর, কিন্তু অব্যর্থ। সময় নিয়ে দুজনের মাথাব্যথা ছিল না। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্ল্যানকে বাস্তবায়িত করবার জন্য বেশ কিছু বছর ধরে ধীরে ধীরে গল্পটাকে পাকিয়ে তুলতে হবে। 

‘কীভাবে এই প্রতিশোধ নেওয়া যাবে? ড্যানিয়েলকে হত্যা করে? না। কারণ হত্যা করলে তো হিসেব মিটেই গেল। আর তাতে ঝুঁকিও অনেক। ড্যানিয়েলকে সারাজীবন ধরে দগ্ধে দগ্ধে মারতে হবে। শেষ আঘাত হতেই হবে কালান্তক। তাহলে প্রতিশোধের ধরণ কীরকম হবে? উত্তরটা সহজ। জাত লেখক অরুণই হয়তো সেই উত্তরটা দিয়েছিলেন। একটা গল্প বানানো হবে। জন্ম দেওয়া হবে দৃশ্যের। ড্যানিয়েল অমিতাভকে খুন করেছিলেন, যার বিচার হয়নি। জন্ম নেওয়া দৃশ্যেরা এবার দেখাবে যে ড্যানিয়েল আবার অমিতাভকে খুন করলেন। এবং এবার তাঁর বিচার হবে। মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়। অমিতাভর মৃত্যু হয়েছে, তবুও তাকে থেকে যেতে হবে। বাঁচিয়ে তুলতে হবে অমিতাভকে, যাকে ড্যানিয়েল আবার খুন করতে পারেন। কিন্তু খুন করবার জন্য একটা বড়ি লাগে। যেখানে বডি নেই, বডি জোগাড় করো। অর্থাৎ, বলি দেবার জন্য প্রস্তুত করো এমন কাউকে, যাকে অমিতাভ বলে চিহ্নিত করা যায়।’ 

অনন্যা উঠে দাঁড়ালেন। বাগানে নামতে যাচ্ছিলেন, সিদ্ধার্থ ডাকল, ‘কাকিমা!’ 

অনন্যা পেছন ফিরে সিদ্ধার্থর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন দুই দিকে। ‘ডাকিস না।’ তারপর সটান হেঁটে কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। সিদ্ধার্থকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কি যাবে? না হলে কিন্তু আরও অনেক কিছুই সহ্য করতে হবে। সিদ্ধার্থ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি শুনতে চাই। পুরোটো।’ 

অরুণ এতক্ষণ রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমার কথা শুনছিলেন। হঠাৎ ভেঙে পড়লেন এবার। সিদ্ধার্থকে ছেলেমানুষের মতো জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অনন্যা কোথায় গেল?’ সিদ্ধার্থ উত্তর দিল না। অরুণ দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে বসে রইলেন। 

সেদিকে দৃকপাত না করে আবার বলতে শুরু করলাম, ‘অরুণ এবং সঞ্জয় মিলে পরিকল্পনা করলেন— অনেকটা সময় নিয়ে খুব যত্নে অমিতাভকে বাঁচিয়ে তুলতে হবে আবার। তারপর খুন করতে হবে এমনভাবে যাতে অরুণের ওপর প্রাথমিক সন্দেহ আসে। কিন্তু সেই সন্দেহের ভিত্তি জোরালো হওয়া চলবে না। নানা পরস্পরবিরোধী ক্ল দিয়ে ঘেঁটে দিতে হবে পুলিশকে। যাতে পুলিশ মন দিয়ে রহস্যের গভীরে প্রবেশ করে। এবং প্রবেশ করবার পর বুঝতে পারে, ড্যানিয়েল খুন করে অরুণের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। সোজাপথে না গিয়ে কেন এরকম জটিল ভাবনা? সম্ভবত ধনরাজ গম্বর কথা মাথায় রেখে। আনন্দ পাঠক বলেছিলেন, দোষীর ছাড়া পাবার থেকেও ধনরাজের কাছে বেশি অসহনীয় ছিল নির্দোষের শাস্তি পাওয়া। এই মনস্তাত্ত্বিক জায়গাটায় ঘা দিতে হবে। 

‘টোকারেভ বুলেট জোগাড় করেছিলেন সঞ্জয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এখানকার নকশালপন্থী তরুণেরা সীমান্তে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র-ট্রেনিং দিয়েছেন, সেইরকম একটা ক্যাম্পে গিয়ে সঞ্জয় খবর করেছিলেন। সেই রিপোর্ট আমি পড়েছি, আগেই বলেছিলাম। যখন টোকারেভ বুলেট কোথা থেকে সংগ্রহ হলো, সেটা নিয়ে ভাবছিলাম, মাথায় এল এই ক্যাম্পের কথা। এসব ক্যাম্পে পুলিশ ও বিএসএফ সহযোগিতা করত। নিজেদের অস্ত্র এবং বুলেটেও ধার দিত। সঞ্জয় কয়েকটা বুলেট এখান থেকে সংগ্রহ করলেন। অরুণের দাদার বাড়িতে এক রাতে একটা ভুয়ো চুরি ঘটানো হলো, যাতে নিখোঁজ হয়ে গেল একটা রাইফেল। রাইফেলটা সঞ্জয়ের কাছেই ছিল। আর সবশেষে বাবলা। অমিতাভর আকৃতি এবং উচ্চতার একজন ভবঘুরে বাঙালি মাতালকে দার্জিলিং শহরে খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধে হবার কথা না। সজাগ চোখ রেখে কিছুদিন অপেক্ষা করলেই পাওয়া যায়, এত বড়ো শহর আর এত লোকসংখ্যা যেখানে। অরুণ বাবলাকে তুলে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখলেন। নিজের বাগানের দায়িত্ব তুলে দিলেন বাবলার হাতে। সারা পৃথিবী দেখল, এক দরিদ্র ভবঘুরেকে অরুণ চৌধুরী নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসছেন। শুধু দুজন জানলেন, বাবলা ছিল বলির পশু। 

‘এবার কাজ, অমিতাভকে বাঁচিয়ে তোলা। সেটার প্ল্যানও অনুমান করছি অনেকদিন ধরে খুব নিখুঁতভাবে ছকা হয়েছিল। যেহেতু অমিতাভ মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যেতেন এবং তাঁর মৃত্যু সংবাদ পরিচিতদের মধ্যে কেউ জানত না, তাই অমিতাভকে আবার তিন মাস পরে দার্জিলিং-এ ফিরিয়ে আনা হলো। কিন্তু তিনি চলে গেলেন গ্রামে, যাতে শহরের পরিচিতরা তাঁর নাগাল না পান। গ্রামের ঠিকানায় কি দার্জিলিং-এর বন্ধুরা ধাওয়া করেননি? সম্ভবত না। কারণ দার্জিলিং-এ অমিতাভর বন্ধু তেমন কেউ ছিলেন না, অরুণ আর সঞ্জয় বাদে। বাকিদের সঙ্গে, অন্যান্য জেলার যারা, সম্পর্ক মূলত লেখালেখির মাধ্যমেই সেই লেখালেখি যতক্ষণ অব্যাহত থাকছে, পেছনের মানুষটার খোঁজ না পেলেও চলে। এটাও মনে রাখতে হবে যে উত্তরবঙ্গে অমিতাভর লেখালেখির পরিচিতরাও প্রায় কেউই দার্জিলিং জেলায় থাকতেন না। থাকতেন কুচবিহার, শিলিগুড়ি, দিনাজপুর এসব জায়গাতে, আর নাহলে গ্রামের দিকে। তাই প্রার্থিত আড়ালটুকু জোগাড় করা সম্ভব হয়েছিল, যেহেতু ওসব জায়গা থেকে হুট করে কেউ দার্জিলিং আসবেন না, অমিতাভর খোঁজে তো আরোই নয়। অরুণ কয়েকটা কবিতা আর গল্প লিখে অমিতাভর নামে এখানে ওখানে পাঠালেন। যতই বারবার বলুন না কেন তিনি কবিতা লিখতে পারেন না, অরুণ কবিতাটা খারাপ লিখতেন না। তার নমুনা নকল অমিতাভর লেখাপত্রে পেয়েছি। কিছু লেখাপত্র ছাপা হলো। সঞ্জয় অমিতাভকে নিজের কাগজে আখ্যা দিলেন প্রতিশ্রুতিবান কবি ও লেখক হিসেবে। এর মধ্যে অরুণের নিজের বই ফ্লপ করল। আস্তে আস্তে অমিতাভর নাম উঠে আসছিল বাংলার পাঠক মহলে। পুরো ব্যাপারটাই তিন- চার বছর ধরে ঘটছিল। অমিতাভর সাক্ষাৎকার, তাঁর ছবি ইত্যাদি ব্যবহার করে তৈরি করা হলো একজন জ্যান্ত মানুষকে। ফোনে কি কথা বলানো হয়েছিল কলকাতার কোনো কবি, অথবা লেখক, বা পত্রিকার সম্পাদক অথবা প্রকাশকের সঙ্গে? সেটাও সম্ভব। মোদ্দা কথা, অমিতাভ তখন বেঁচে উঠেছেন ভরপুর। তাঁকে কলকাতার কেউ দেখেনি কারণ তিনি দার্জিলিং-এ থাকতেন। তাতে সুবিধে যেটা, চট করে কেউ কলকাতা থেকে এত দূরে আসবে না। হুগলি বা বীরভূম হলে ব্যাপারটা এত সহজ হতো না। যেটা আমার মাথায় আসা উচিত ছিল, ১৯৭১ সালের পর অরুণ ছাড়া অমিতাভকে এমন কেউ দেখেননি যিনি এখনও বেঁচে আছেন। এমনকী মৃত্যুঞ্জয় সোমও অমিতাভকে দেখেছিলেন ১৯৭১ পর্যন্তই। এমনিতেই অমিতাভর আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধব ছিল না। সেটাকেই ব্যবহার করা হলো এবার। সঞ্জয় এমনভাবে রিপোর্ট লিখলেন যা পড়ে মনে হয় দার্জিলিং-এ অমিতাভ চেনা একজন মানুষ। অরুণও পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর অমিতাভর গল্প করেছেন আমার কাছে। বহুকাল আগে শক্তি মারা গিয়েছেন, তাই তিনি এই বক্তব্য আর খণ্ডন করতে পারবেন না। অমিতাভর মৃত্যুর বহু বছর পরে, ২০০৭ সালে সঞ্জয় স্মৃতিচারণামূলক একটা লেখা লিখেছিলেন সেখানেও একই কায়দা দেখলাম। সমরেশ বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়দের নাম এবং অমিতাভর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাতের বিবরণ। যাঁরা সকলেই তখন মারা গিয়েছেন। ড্যানিয়েল যেহেতু বাংলা বইপত্রের খোঁজ রাখেন না, তিনি এসব জানতেও পারলেন না। যেটা আর এক জায়গায় খটকা লেগেছিল, অমিতাভ ১৯৭১ সালের আগে কবিতা ছাড়া কিছু লেখেননি। তিনি দুম করে গল্প লিখতে শুরু করলেন কীভাবে? তাঁর প্রথম বই তো কবিতা হবার কথা ছিল, কিন্তু হয়ে গেল উপন্যাস। ব্যাপারটা অদ্ভুত। কিন্তু এই প্রশ্নগুলো তখন বড়ো হয়ে দেখা দেয়নি। পরে মেলাতে বসলাম যখন একটার পর একটা খটকার সমাধান, তখন দেখলাম, এই ধাঁধাটার সমাধান হয়ে যায় একইভাবে, যেভাবে অসমাপ্ত উপন্যাসের খটকার সমাধান হয়েছে। অমিতাভ লেখেননি, অমিতাভর নাম নিয়ে লিখেছেন অরুণ। 

‘যাই হোক, যেটা বলছিলাম। সঞ্জয় অমিতাভর নামে অরুণের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক বক্তব্য ছাপালেন। পরের ঘটনা সবারই জানা। তারপরেও কি দার্জিলিং-এর সাহিত্যজগতের কেউ অমিতাভর সঙ্গে দেখা করতে আসেননি? হয়তো চেয়েছিলেন, কিন্তু কয়েক বছরের চেষ্টায় অরুণ এই কথাটা ততদিনে রটিয়ে দিতে পেরেছেন যে অমিতাভ স্যোসিওপ্যাথ হয়ে গেছে। গ্রামে চলে গেছে, কারোর সাথে দেখা করে না, শুধু নিজের লেখা নিয়ে থাকে। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু না হলে এটুকু শুনে মুখোমুখি হবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। সে যাই হোক, অরুণ আর সঞ্জয় মিলে গল্প রটাতেন, কোনো এক বড়ো প্রকাশক অমিতাভর সঙ্গে বইয়ের চুক্তি করেছেন দার্জিলিং এসে। বাস্তবে, অমিতাভর বইটা বেরিয়েছিল কোনো বড়ো প্রকাশকের ঘর থেকে নয়। এক ছোটো সংস্থা থেকেই। সম্ভবত সঞ্জয় নিজের যোগাযোগ দিয়ে বইটা ছাপিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে কয়েকটা ছোটো বড়ো পত্রিকায় রিভিউ। বই ছাপানোর টাকা অরুণ দিয়েছিলেন ধরে নিচ্ছি। উদ্দেশ্য একটাই, ড্যানিয়েল লামার চোখে যেন পড়ে। সেই কারণেই উপন্যাসের বিষয় ছিল ওরকম, উত্তরবঙ্গে নকশাল আন্দোলনে পুলিশের নিষ্ঠুরতা। অরুণকে একটা কাগজ কীভাবে তাদের শারদ সংখ্যাতে লেখার জন্য যোগাযোগ করেছিল, সেটা আজ আর বলতে পারব না। কাকতালীয় বলে মনে হয় না। হয়তো কলকাতার কবি-সাহিত্যিক মহলে সঞ্জয় নিজের কিছুটা প্রভাব খাটিয়েছিলেন। পুরোটাই করতে হলো ড্যানিয়েল লামাকে টোপ দেবার উদ্দেশ্যে, এবং এই লক্ষ্য মাথায় রেখে যাতে অরুণের অপরাধের একটা ছদ্ম-মোটিভ পাওয়া যায়। কারণ অরুণকে গ্রেপ্তার হতেই হবে। নাহলে শুধু যে অ্যালিবাই তৈরি হবে না, সেটুকুই নয়। এটাও দেখানো যাবে না যে ড্যানিয়েল অরুণকে ফাঁসাতে চাইছেন। ধনরাজকে ড্যানিয়েলের বিরুদ্ধে চালনা করবার জন্য নিরপরাধকে ফাঁসাবার আখ্যান অত্যন্ত জরুরি একটা উপাদান। 

‘এর পরের কিছুটা গল্প গতকাল ম্যালে ড্যানিয়েলের মুখ থেকে শুনেছি। ড্যানিয়েল প্রমাদ গুনেছিলেন। অমিতাভ মিত্রর নামটা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন এতদিন। কিন্তু অরুণ চৌধুরীর সঙ্গে কানেক্ট করে তাঁর মনে পড়লো। তিনি এই ছেলেটিকে এনকাউন্টার করেছেন। এদিকে এখন দেখা যাচ্ছে সে বেঁচে উঠে ড্যানিয়েলের কুকীর্তি ফাঁস করে দিচ্ছে। ড্যানিয়েল বুঝলেন এটা তাঁকে ফাঁসাবার একটা চাল। এদিকে অমিতাভকে তিনি যে হত্যা করেছেন সেটা বাইরে প্রকাশ করা যায় না। তিনি ভাবলেন, কিল খেয়ে আপাতত কিল হজম করবেন। কিন্তু অমিতাভর নাম নিয়ে অরুণ দ্বিতীয় আঘাত হানলেন একটি মানবাধিকার সংস্থার সাহায্যে জনস্বার্থ মামলা। এর আগেও ড্যানিয়েলের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে, সেরকমই একটি মামলা দেখিয়ে পরে ড্যানিয়েলকে বসিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এবারের জনস্বার্থ মামলা অন্যরকম, কারণ এর সঙ্গে অমিতাভ জড়িয়ে, যিনি ড্যানিয়েলের রক্ত দেখতে চান। মামলার পেছনেও অরুণদের উদ্দেশ্য সেই একই। ড্যানিয়েলকে প্রোভোক করা। ফাঁদে টেনে নিয়ে আসা। ভুয়ো সংস্থাটি, তার নাম ঠিকানা ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নম্বর সহ, পুরোটাই সম্ভবত সঞ্জয়ের বানানো ছিল। অরুণের পক্ষে কঠিন ছিল কারণ তিনি বসে আছেন দার্জিলিং-এ। এগুলো সহজে বানাতে গেলে কলকাতায় থাকা দরকার, তার ওপর সঞ্জয় সাংবাদিক হবার কারণে বাড়তি সুবিধে পাচ্ছেন। এবার এই জনস্বার্থ মামলায় ড্যানিয়েল প্রমাদ গুণলেন। প্র্যাঙ্কটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তিনি অরুণের সঙ্গে দেখা করে হুমকি দিলেন। অরুণ জোর দিয়ে বললেন যে অমিতাভ বেঁচে আছে। এবার, ড্যানিয়েলকে যদি এই দাবি অস্বীকার করতে হয়, তাহলে মেনে নিতে হবে যে অমিতাভকে তিনিই খুন করেছেন। ড্যানিয়েল পালটা চাল চাললেন। তিনি অরুণকে বললেন, অমিতাভর সঙ্গে দেখা করতে চান। অরুণ প্রস্তাব দিলেন, নিউট্রাল জায়গায় সাক্ষাৎ করতে হবে, যাতে ড্যানিয়েল অথবা অরুণ কেউ নিজেদের ক্ষমতা খাটাবার সুযোগ না পান। স্থির হলো, ১১ জুন রাত সাড়ে বারোটায় পুরোনো গোরস্থানে তিনজন আসবেন। নাটকের শেষ অঙ্কের প্লট রচনা হলো। 

‘এর মধ্যে আরও একটা কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে থেকে। যে আখ্যান অরুণ আর সঞ্জয় মিলে রচনা করছেন, তার একটা সমান্তরাল দ্বিতীয় প্রতিলিপি নির্মাণ। একদম পাক্কা পশ্চিমী মিডিয়ার কায়দায় সম্মতি নির্মাণ যাকে বলে। কাহিনী দিয়ে। আখ্যান বানিয়ে। কিন্তু অরুণ পারফেকশানিস্ট। তাঁর কাজ এবং পরিপার্শ্বে যেন নিখুঁত সমতা থাকে, তিনি সে বিষয়ে খুঁতখুঁতে। তাই এই কাহিনী, যেটা অরুণ লিখবেন, সেটাকেও দাঁড়িয়ে থাকতে হবে সূক্ষ্ম তারের ওপর, একচুল এদিক-ওদিক হলে চলবে না। সম্মতি নির্মাণ হবে, কিন্তু এমনভাবে যাতে নির্মাণকে বোঝা না যায়। অমিতাভকে ড্যানিয়েল খুন করবেন এটা দেখাতে হবে, কিন্তু শুধু দেখালেই হবে না। পুলিশকে বিশ্বাস করতে হবে যে ড্যানিয়েল খুনি। তখনই দুজনের নজর ঘুরে গিয়েছিল ধনরাজ গম্বুর দিকে। পুলিশের সৎ ও জনপ্রিয় অফিসার, এবং নীতিগত কারণেই হোক বা ডিপার্টমেন্টের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের ফলে, ড্যানিয়েলের বিরুদ্ধে। ধনরাজই হতে পারেন অরুণ সঞ্জয়ের ভরসার খুঁটি। কিন্তু ধনরাজকে বিশ্বাস করাতে হবে যে ড্যানিয়েল হত্যাকারী। এক ধরনের বিশ্বাস আসতে পারে পারিপার্শ্বিক প্রমাণ থেকে। কিন্তু সেটাও যথেষ্ট নয়, যদি না ধনরাজের মনের ভেতরে ড্যানিয়েলের অপরাধ নিয়ে পাকাপোক্ত বিশ্বাস তৈরি করে দেওয়া যেতে পারে। আনন্দ পাঠক আমাকে প্রথম দিনের সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পুলিশের কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো সিক্সথ সেন্স। এই সিক্সথ সেন্সকেও নির্মাণ করা সম্ভব। দরকার শুধু বিশ্বাসের একটা বীজ পুঁতে দেওয়া। তার জন্য উপযুক্ত মাটি ছিল ধনরাজের মন, যা আগে থেকেই ড্যানিয়েলের প্রতি বৈরি। কিন্তু বীজ পোঁতবার উপকরণ কী হবে? অমিতাভ কি চিঠি লিখবেন, যে চিঠিতে তিনি জানিয়ে যাবেন যে ড্যানিয়েল তাঁকে খুন করতে পারেন? সেটা সম্ভব নয়, কারণ এই শহরে অমিতাভ চিঠি লিখতে পারেন একমাত্র অরুণকে। অরুণকেই তিনি চিনতেন। কিন্তু অরুণ আর অমিতাভর মুখ দেখাদেখি যেখানে বন্ধ, সেই পরিবেশে অমিতাভ চিঠি লিখছেন, সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। উল্টে ধনরাজ সন্দেহ করতে পারেন যে পুরোটা সাজানো। সুক্ষ্মভাবে ধনরাজকে বিশ্বাস করাতে হবে, যাতে ধনরাজ না বোঝেন যে এটার পেছনে অন্য কেউ জড়িত। উপন্যাসের আইডিয়া সম্ভবত অরুণের মাথা থেকে বেরিয়েছিল। শেষটুকু দেখালে চলবে না। সেটাকে ধনরাজের নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধির উপর ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু এমনভাবে জিনিসটাকে রাখতে হবে, যাতে সত্যিটা চোখের সামনে থাকে। ওই কারণেই আমি যখন উপন্যাসটা পড়েছিলাম, মনে হয়েছিল বড্ড বেশি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটুকু ধনরাজের জন্য। সেই কারণেই পুলিশের ওসিকে খুনি বানানো। যাতে সেটা পড়ে, এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে চমকে ওঠার মতো মিলগুলো দেখে ধনরাজের মনে হয় যে বাস্তবেও পুলিশের দারোগাই খুনি হতে পারেন। প্রথম থেকে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, অমিতাভ এভাবে ভবিষ্যৎ কী করে দেখতে পেলেন। এটাই বুঝিনি যে অরুণ আর সঞ্জয় আগে থেকে নিখুঁত প্ল্যান করে রেখেছিলেন, খুন কীভাবে ঘটবে। উপন্যাসে সেটুকুই মিলিয়ে মিলিয়ে লিখেছেন। এমনকি, ড্যানিয়েল যে সেই রাত্রে থানায় আসবেন সেটাও দুইয়ে দুইয়ে চার করে অভ্রান্ত বুঝতে পেরেছিলেন তাঁরা। সেই কারণেই বিমলবাবুকে রাত্রে থানায় টেনে আনা। পাণ্ডুলিপিটাকে রেখে আসা হলো অমিতাভর আস্তানা নাম দিয়ে যে ঘরটাকে অরুণ ভাড়া করেছিলেন, সেখানে। সেই ঘরে মাঝেই মাঝেই অরুণ রাত্রিবেলা যেতেন। হয়তো সঞ্জয়ও যেতেন কখনও। অভিনয় করতেন মাতালের। গ্রামের মানুষ দূর থেকে দেখে ভাবতো যে মাতাল অমিতাভ ঘরে ঢুকছেন। পুলিশ কি অমিতাভর হাতের লেখা মিলিয়ে দেখেনি? অবশ্যই দেখেছে। পুলিশ রিপোর্টেও পেয়েছি তার উল্লেখ। কিন্তু কোন নমুনার সঙ্গে মেলাবে? সেই ঘরে পাওয়া অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে। সেগুলো তো সব অরুণেরই লেখা। কারণ ঘর আর তার ভেতরের সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ, কাগজ, চিঠিপত্র, সবই অরুণের হাতের লেখা। তাই উপন্যাসের হাতের লেখাও মিলে গিয়েছিল নমুনার সঙ্গে। অরুণ যখন অমিতাভর নাম নিয়ে লিখতেন, নিজের স্বাভাবিক হস্তাক্ষর পালটে ফেলতেন। পুলিশ তাই ধরতে পারেনি।’ 

এবার চোখে পড়ল, অরুণের সামনে টেবিলের ওপর রাখা কেবল সাহেবের কবিতার বই। নিজের মনেই হাসলাম। বইটা হাতে তুলে নিয়ে বললাম, ‘এক হারানো কবির প্রতি আগ্রহবশত, বা অমিতাভর কথা ভেবে বইটা আপনি নিজের কাছে রাখেননি। বইটার ওপর অমিতাভর হস্তাক্ষর ছিল। আর অমিতাভর যে পাণ্ডুলিপি আপনি দেখিয়েছিলেন, সেটা অমিতাভর নামে আপনার হাতের লেখা। সন্দেহের বশে আমি যেন মিলিয়ে না দেখতে যাই, তাই বইটা আগেই রেখে দিয়েছিলেন নিজের কাছে। ঠিক সেই কারণেই অমিতাভর কোনো লেখা বা চিঠির অরিজিনাল আমাকে দেননি, দিয়েছেন টাইপ কপি। কিন্তু এবার বইটা নিলাম। ভুলে যাওয়া কবিরা আপনার হাতে নিরাপদ নয় মিস্টার চৌধুরী!’ সিদ্ধার্থ দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছে। আবার অরুণের দিকে ফিরলাম। কিন্তু শত হলেও আপনি তো প্রকৃতই একজন লেখক। সেই লেখক-সত্তা হয়তো চাইছিল, সত্যিটা জানাতে। তাই আপনার অবচেতন আপনার কলমের সাহায্যে নানারকম সূত্র ছড়িয়ে রেখেছিল লেখাটার মধ্যে। ভাগ্যিস রেখেছিল, না হলে তো আমিও সত্যিটায় আসতে পারতাম না।’ 

অরুণ মুখ তুললেন না। 

‘হত্যার দিন ঠিক হয়েছিল, এগারোই জুন। তার বেশ কিছু আগে সঞ্জয় দার্জিলিং চলে এসেছিলেন। পরের কাজ হিসেবে, বাবলার কুকুরটাকে বিষ খাওয়ানো হলো, যাতে চর্মরোগ হয়। বাবলাকে দিয়ে গুলি করানো হল। উদ্দেশ্য, রাইফেলের ট্রিগারে বাবলার আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে রাখা। আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল।

‘বাবলা নিখোঁজ হয়ে যাবার পরে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে। তাই তার নিরুদ্দেশ হবার পেছনে একটা গল্প খাড়া করবার দরকার। আবারও, দৃশ্য তৈরি। কুকুরকে গুলি করা। শোকাহত বাবলা এবার কোথায় যাবে? কেন, মদের দোকানে? সেখান থেকে বাবলাকে পাকড়াও করলেন সঞ্জয়। 

‘প্রশ্ন উঠতে পারে, বাবলার কথা আমার কেন মনে হলো? সিদ্ধার্থকে বলেছিলাম খটকার কথা। বাবলা চলে গিয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৮ই মে আর ১১ জুনের মধ্যে কোনো এক দিন। বাবলার চলে যাওয়া আর অমিতাভর হত্যা, পিঠোপিঠি এই দুটো অস্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে কি তাহলে কোনো যোগ আছে? শুধু সেটাই নয়। বাড়ির অন্য কাজের ছেলেটিকে ছুটি দিয়ে বাড়ি কেন ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছিল, এটা নিয়ে সন্দেহ ছিল। তারপর সিদ্ধার্থ কথায় কথায় জানাল, অরুণ বাবলার খোঁজে তার বর্ধমানের গ্রামে গিয়েছিলেন। কিছু টাকাপয়সা দিয়ে এসেছেন। তারপর বাবলা এসেছিল একবার অরুণকে দেখতে। দুম করে মনে হলো, আরে, এখানেও তো অমিতাভর মতোই ব্যাপার! বাবলাকে ১৯৭৫-এর জুন মাসের পর থেকে অরুণ ছাড়া আর কেউ দেখেনি। অরুণ তার গ্রামে গিয়েছেন। আবার বাবলা ঠিক সেই সময়তেই দার্জিলিং-এ এসেছে যখন এই বাড়িতে সিদ্ধার্থ আর অনন্যা নেই, যারা বাবলাকে দেখতে পারে। শুধু সেটাই নয়, সারাক্ষণের কাজ করে যে ছেত্রীদা, সে-ও দেশে চলে গেছে। নাকি তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল? ফলে তখনও বাবলাকে দেখেছেন শুধুই অরুণ। অরুণ যদি এখানেও মিথ্যে বলেন? যদি অমিতাভর মতোই বাবলাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়? তার মানে কি অমিতাভ আর বাবলা কাছাকাছি সময়েই মরেছিল? এতটা সমাপতন? অবিশ্বাস্য না? এদিকে মৃতদেহটাও অমিতাভর নয়, অন্তত সেরকম একটা সম্ভাবনা সামনে আসছে। তাহলে কি সেটা বাবলার দেহ? দীর্ঘ সময় ধরে আপনাদের, আপনাকে আর সঞ্জয় দুজনকেই, নিজেদের ট্র্যাক করতে হয়েছিল। কারণ ধনরাজ গম্বু তখনও বেঁচে ছিলেন। সেই জন্যে বাবলা যে বেঁচে আছে, সেটাও কিছু সময়ের ব্যবধানের মাঝে মাঝে নিশ্চিত করে যাওয়া। বাবলার কথা আরও একটা ঘটনায় মনে এসেছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। 

‘সঞ্জয় বাবলাকে সম্ভবত মদ খাইয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেলেন ঋষি রোডের বাড়িতে। হ্যাঁ, এই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন সঞ্জয়। ড্যানিয়েল লামা নন। রামবীরের মনে পড়েছিল, লোকটা গাড়ি চালিয়ে আসত। একজন মাত্রই লোক ছিল। এটা মাথায় আসতে আমি নিঃসংশয় হলাম যে ড্যানিয়েল হতে পারেন না কারণ তিনি গাড়ি চালাতে পারেন না। তাহলে কি ড্যানিয়েল গাড়ির পেছনে লুকিয়ে থাকতেন? সেটা অসম্ভব। কারণ রামবীর বলেছিলেন যে লোকটা যতক্ষণ বাড়ির ভেতর থাকে, প্রচণ্ড জোরে ইংরেজি গান বাজে। ড্যানিয়েলের নার্ভের সমস্যা। জোরে আওয়াজ তিনি সহ্য করতে পারেন না। তার প্রমাণ আমিও পেয়েছি। 

‘সঞ্জয় বাবলাকে এখানে এনে বন্দি করে রেখেছিলেন। হয়তো হাত পা শিকল দিয়ে বাঁধা ছিল। বাবলাকে মদ খাইয়ে রাখতেন, আর দরকার পড়লে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। সেই জন্য তার মৃতদেহে অত ছুঁচের দাগ ছিল, আর আমরা ভেবেছিলাম অমিতাভ ড্রাগ নেন। জোরে গান বাজাবার দরকার ছিল, বাবলার আর্ত-চিৎকার চাপা দেবার উদ্দেশ্যে। কারণ রামবীর দুপুরের পর থেকে আর এই চত্বরে না থাকলেও সকালবেলা কয়েক ঘণ্টা বাগানের কাজ করেন। তাঁকে কিছুতেই বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেওয়া চলবে না, অথবা তাঁর কানে আসা চলবে না বাবলার চিৎকার। বাবলাকে কী খাওয়ানো হতো জানি না। তবে সে যাতে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে না পারে, তার জন্য মদ ও ইনজেকশনের আয়োজন। মদটা সম্ভবত বন্দুকের মুখে জোর করে খাওয়ানো হতো। যতই মাতাল হোক, একসময়ে মানুষের শরীর আর নিতে পারবে না। তখন বন্দুকের ব্যবহার। 

যখন গল্পটা সাজাচ্ছিলাম, তখন এতটা অসুবিধে হয়নি। কিন্তু বলতে গিয়ে এখন নিজের শরীরের মধ্যে অস্বস্তি লাগছিল। অত্যাচারের গ্রাফিক বর্ণনাগুলো লাফিয়ে উঠছিল চোখের সামনে। সিদ্ধার্থকেও দেখলাম, ফ্যাকাশে মুখে অরুণের দিকে তাকিয়ে। আজ যে কতগুলো বিশ্বাস আর সম্পর্ক নিজের হাতে নষ্ট করে দেব, নিজেও জানি না। 

‘আর দুটো জিনিস দরকার। অরুণের ওপর পুলিশের সন্দেহ ফেলবার জন্য একটা মাধ্যম, আর পুলিশকে বিভ্রান্ত করে দেবার জন্য আর একটা মাধ্যম। প্রথমজন হলেন মিসেস বাসু। দ্বিতীয়জন হলেন প্রশান্ত গুরুং। হ্যাঁ, প্রশান্ত গুরুংকে খবর পাঠিয়ে আসতে বলেছিলেন অরুণই। তাঁর সামনে বন্দুক চালিয়েছিলেন, এবং এমনভাবে ঘটনাগুলো সাজিয়েছিলেন যাতে পুলিশের মনে হয় ড্যানিয়েল প্রশান্তর গল্পটা বানিয়েছিলেন। মোদ্দা কথায়, যাতে দ্বিতীয় লেয়ারের গল্পটা পাকাপোক্ত হয়। 

‘১১ জুন এল। সঞ্জয় প্রথম যেটা করলেন, রাত আটটা নাগাদ বাবলার ডান হাতের কবজিতে ছুরি চালিয়ে গভীর ক্ষত তৈরি করলেন। প্রচুর রক্ত বেরোলো। সেই রক্ত তাঁর লাগবে, অরুণের বাগানে ছড়াবার জন্য। একটা শিশিতে রক্ত ঢাললেন। বাবলার হাতে ব্যান্ডেজ করে হয়তো কিছু ওষুধ খাইয়ে দিলেন। সময়টা আটটা নাগাদ ছিল বলছি এই কারণে যে তার আগে রক্ত সংগ্রহ করলে সেটা জমাট বেঁধে যাবার সম্ভাবনা ছিল। তারপর সঞ্জয় রাইফেল নিয়ে গুলি করলেন বাবলার বাম হাতে। বাবলা সম্ভবত তখন অচেতন। যন্ত্রণায়, ইনজেকশনে বা মদে। এই অবস্থায় তাকে বেঁধে রেখে সঞ্জয় রাইফেল আর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে দার্জিলিং এলেন। জলাপাহাড় রোডে অরুণের বাড়ি ঢুকলেন। কিন্তু সামনের রাস্তা দিয়ে নয়। অরুণের বাড়ি যখন আমি ঘুরে দেখছিলাম, গেস্টহাউসেও গেছিলাম। কিচেন দিয়ে লাগোয়া স্টোররুমে যাওয়া যায়। স্টোররুমের আর একটা দরজা পেছনের বাগানের দিকে মুখ করে। বাগান নেমে গেছে ঢালু হয়ে। সঞ্জয় ঘুরপথ হয়ে সেই বাগান দিয়ে উঠে এসেছিলেন। সেই কারণে বাগান থেকে বাড়ি অবধি তাঁর পায়ের ছাপ পড়েনি। সম্ভবত পুলিশ প্রথমবার এসে সামনের বাগানই দেখেছিল। পরের বার এসে যখন পেছনের বাগানে যায়, ততক্ষণে তাঁর পায়ের ছাপ ধুয়ে গিয়েছে বৃষ্টিতে। অথবা এটাও হতে পারে যে অরুণই পুলিশ আসার আগে পেছনের বাগানের পায়ের ছাপ জল ঢেলে বা অন্য কোনো কিছুর সাহায্যে মুছে দিয়েছিলেন। 

‘প্রশাস্ত গুরুং এলেন নির্ধারিত সময়ে। অরুণ আর প্রশান্ত ছিলেন বাড়ির ভেতর। আমি যেদিন এই বাড়িতে ডিনারে এসেছিলাম, নীচের ঘরে অরুণের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কথা শেষ করবার পর বেরোতে গিয়ে দেখি, বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, বজ্রপাতও। কিন্তু সেটা বুঝতে পারিনি, কারণ অরুণ বলেছিলেন যে এই বাড়িতে তাঁর বাবা মোটা কাচের ফ্রেঞ্চ উইন্ডো লাগিয়েছিলেন। আর বাকি দেওয়ালের দুই ধারে ফোম। তাই গেস্টহাউসের কাছ থেকে গুলির আওয়াজ ঘরের ভেতর বসে প্রশান্ত শুনতে পাননি। অরুণ কোনো সংকেত থেকে বুঝেছিলেন, এবার বাইরে বেরোবার সময়। সঞ্জয় ততক্ষণে বাগানের ঘাসে বাবলার রক্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন, আর কিছুটা নিজের হাতে। অরুণ কোনো এক অছিলায় প্ৰশান্তকে অপেক্ষা করতে বলে বাইরে বেরলেন। সঞ্জয় বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়লেন। উদ্দেশ্য, মিসেস বাসুর নজর আকর্ষণ করা। ওই সময়টায় মিসেস বাসু যে রোজ ওখানে বসে থাকতেন, সেটা জানা ছিল তাঁদের। তারপর সঞ্জয় দৌড়ে গেলেন গেটের কাছে। তাঁর পেছনে অরুণ। পুরোটাই ঘটল মিসেস বাসুর সামনে। সঞ্জয় বেরিয়ে গেলেন। অরুণ বুলেটের ফাঁকা খোল মাটি থেকে খুঁজে নিজের পকেটে পুরলেন। মিসেস বাসু অরুণকে ওই জন্যই দেখেছিলেন, ঝুঁকে পড়ে কিছু খুঁজতে। বাড়ির ভেতর ফিরে এসে কথায় কথায় উত্তেজিত হয়ে নিজের রাইফেল থেকে গুলি চালালেন। তারপর কি প্রশান্ত গুরুঙের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন? জানি না। কিন্তু নাটকটা ভালোই হয়েছিল। গুরুং বিশ্বাস করলেন। রাইফেলের ট্রিগারে আগেই বাবলার আঙুলের ছাপ ছিল। এবার পড়ল অরুণের আঙুলের ছাপ। প্রশান্ত বেরিয়ে গেলেন। বাগানের মাটিতে স্বাভাবিকভাবে তাঁর আসা এবং যাবার পদচিহ্ন পড়লো। অরুণ জানতেন পুলিশ আসবে। তিনি আর একটা কাজ করলেন। ড্যানিয়েল লামা যে ধরনের বুট পরতেন, সেই মডেলের বুট নিজের পায়ে পরে এক জায়গায় দাঁড়ালেন শক্ত করে। তারপর বাগানের দিকে গেলেন এবং ফিরে এলেন। সকলে ভাবলো, জুতোর মালিক গেট থেকে বাড়ির কাছে এসেছেন, তারপর আবার বাড়ি থেকে গেট অবধি গিয়ে বেরিয়ে গেছেন। বাস্তবে ঘটেছিল উলটো। বাড়ি থেকে গেট এবং গেট থেকে বাড়ি। এত কিছু করবার উদ্দেশ্য ছিল একটাই। অরুণ ফাঁসাচ্ছেন ড্যানিয়েলকে। আর সেটা করা সম্ভব যদি দেখানো যায় যে ড্যানিয়েল অরুণকে ফাঁসাতে চাইছেন। কীভাবে দেখাবেন? ঠিক সেই গল্পটা বলে, যেটা আমি এর আগে সাজিয়েছিলাম। মানে দ্বিতীয় লেয়ারে। ড্যানিয়েল এসেছিলেন, অরুণকে বলেছিলেন পায়ের ছাপ মুছে দিতে হবে, রাইফেল থেকে আঙুলের ছাপ মুছতে অরুণ ভুলে গেছিলেন ওটা ইচ্ছাকৃত, বাগানের রক্ত কারোর মাথায় ছিল না ইত্যাদি ইত্যাদি। এই রাবিশ গল্পটাই ছিল অরুণের লাইফলাইন। যাই হোক, সঞ্জয় বেরোলেন অরুণের বাড়ি থেকে। কাছাকাছি তাঁর গাড়িতে বা অন্য কোথাও হয়তো রেইনকোট, টুপি ইত্যাদি লুকানো ছিল। সেগুলো পরে নিলেন যাতে নিজের মুখ না দেখা যায়। আর ঠোঁটে ঝোলালেন একটা পাইপ। তারপর জলাপাহাড় রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। বৃষ্টির মধ্যে রেইনকোট গায়ে সঞ্জয়কে যারা দেখল, তারা মূলত খেয়াল করল মুখের পাইপটা। ড্যানিয়েলের সিগনেচার। লোকে বুঝল, ড্যানিয়েল রাত পৌনে দশটা নাগাদ জলাপাহাড় রোডে ছিলেন। কিছুটা হেঁটে নির্জন কোনো জায়গাতে গিয়ে সঞ্জয় রেইনকোট পাইপ ইত্যাদি নামিয়ে ফেললেন। তারপর সেগুলোকে হাতেই রেখে সাধারণ মানুষের মতো হেঁটে এসে গাড়িতে উঠলেন। কেউ ফিরেও তাকালো না। গাড়ি চালিয়ে ঋষি রোডের বাড়িতে এলেন। প্রথম কাজ যেটা করলেন, নিজের পোশাক বাবলাকে পরানো। জিন্স, শার্ট ইত্যাদি। তারপর অর্ধ-অচেতন বাবলাকে নিয়ে গাড়িতে বসালেন। গেলেন কার্ট রোডের কবরখানায়। বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালিয়ে ঋষি রোডের বাড়িতে যাওয়া, বাবলার পোশাক পালটানো, সম্ভবত বাড়ির অন্য কিছু কাজও, যেমন রক্ত পরিষ্কার করা ইত্যাদি, সেসবে সময় লেগেছিল। সেসব করে আবার বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালিয়ে ফিরে আসা, তাতে ঘণ্টা দুই লাগা স্বাভাবিক। কারণ সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল। কবরখানায় এসে বাবলাকে গুলি করলেন। বাবলাকে প্রচুর মদ খাইয়ে অর্ধ-অচেতন করে রাখা হয়েছিল। তাই পিস্তল দেখেও তার হৃদস্পন্দন বাড়েনি। মুখে গুলি করতে হতো, যাতে চিনতে না পারা যায়। বাবলা চিৎ হয়ে পড়ে গেল। কিন্তু যেহেতু মুখ বলে কিছু নেই, পুলিশ ভাবতেই পারে যে এটা অন্য কারও লাশ। তাহলে কি মানিব্যাগ বা আইডেন্টিটি কার্ড রাখতে হবে অমিতাভর সঙ্গে? না। অমিতাভর মতো আধা পাগল ভবঘুরে মানিব্যাগ ব্যবহার করছেন, সেটা বাড়াবাড়ি। আইডি কার্ড তো আরোই নয়, কারণ অপরাধকাহিনীর বস্তাপচা টেকনিক সেটা। যেই মুহূর্তে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হবে যে এই লাশ অমিতাভর, সেই মুহূর্তেই পুলিশ বুঝে যাবে যে এ অমিতাভ নয়— যেহেতু মুখ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে তাই আইডিকার্ডের দরকার পড়ছে অমিতাভকে চেনাবার জন্যে। একমাত্র হতে পারে কিছু হাবিজাবি কাগজ, আধা খ্যাচড়া কবিতার খসড়া, সেগুলোর হাতের লেখার সঙ্গে অমিতাভর ডেরা থেকে তুলে আনা কাগজের হস্তাক্ষরের মিল থাকবে। বাবলাকে উপুড় করে হিপ পকেটে ঢোকানো হল সেসব। আগে থেকে সেই কাগজ সঞ্জয় পকেটে রাখেননি কারণ বৃষ্টিতে ভিজে যাবার চান্স ছিল। সঞ্জয় তারপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ঋষি রোডের বাড়ির উদ্দেশ্যে। 

‘ড্যানিয়েল নির্ধারিত সময়ে কবরখানায় এসে দেখলেন একটা মৃতদেহ পড়ে আছে। তিনি বুঝলেন যে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। এবার, সেকেন্ড লেয়ারে যা যা বলেছিলাম, সেটাই করলেন ড্যানিয়েল। নিজের বাড়িতে গিয়ে পোশাক পালটে জুতো জামা ফেলে দিয়ে থানায় এলেন। এসে অরুণকে বসে থাকতে দেখে বুঝতে পারলেন তিনি বিশাল বড়ো চক্রান্তের শিকার। বাঁচবার জন্য কেস নিজের হাতে নিলেন, কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হলো না। এদিকে, অরুণ আর সঞ্জয়ের হিসেবমতো, পরের দিনেই অমিতাভর মৃতদেহ আবিষ্কার হয়ে যাবার কথা। কিন্তু সেই রাত্রে ল্যান্ডস্লাইড ঘটলো। অরুণ দেখলেন, তিনি আরও অন্তত একদিন হাতে সময় পাচ্ছেন। তাঁর মনে হলো, ড্যানিয়েলকে আরও কিছুটা কোণঠাসা করা সম্ভব। ড্যানিয়েলের পায়ে তিনি চটি দেখেছিলেন। তাঁর মনে পড়লো, উপন্যাসেও তিনি ক্যাজুয়ালি লিখেছিলেন যে বিমল সমাদ্দার থানায় সাধারণ জামা প্যান্ট চটি পরে এসেছিলেন। এই মিলটাকে ব্যবহার করতেই হবে। ধনরাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে যে ড্যানিয়েলের মতোই বিমল সমাদ্দারও থানায় চটি পরে এসেছিলেন, যাতে আরও সন্দেহ উসকে দেওয়া যায়। থানা থেকে বাড়ি এসে সঞ্জয়কে খবর পাঠালেন যে করেই হোক অমিতাভর আস্তানা থেকে পাণ্ডুলিপিটা আবার আনতে হবে। সঞ্জয় মনে হয় ভোরবেলায় আবার দার্জিলিং এসেছিলেন, এবং অরুণের বাড়িতেই আগে থেকে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁরা জানতেন যে অমিতাভর আস্তানায় পুলিশ যাবে। কিন্তু ঘরের তালা ভাঙবে না, যতক্ষণ না তার মৃতদেহ আবিষ্কার হচ্ছে। সঞ্জয় সেই ঘরের তালা খুলে পাণ্ডুলিপি নিয়ে এলেন। অরুণ নিজের বাড়িতে বসে শেষ অধ্যায়টি লিখলেন। মানে অসম্পূর্ণ অধ্যায়টা, যেখানে ধনরাজকে আবার মনে করিয়ে দেওয়া হলো যে বিমলবাবু চটি পরে এসেছিলেন। প্রাথমিক প্ল্যান অনুসারে, আগের অধ্যায় পর্যন্ত লিখে থেমে যাবার কথা ছিল। কিন্তু চটিটুকুর কথা লিখবার জন্য একটা নতুন অধ্যায় এখন না বানালেই চলছে না। শেষ করবার মতো সময় ছিল না, কারণ পাণ্ডুলিপি আবার সকলের চোখ এড়িয়ে সেই রাতের মধ্যে রেখে আসতে হতো। আর সেই তাড়াহুড়োতেই অরুণ তাঁর প্রথম ভুলটা করলেন। সম্ভবত বাড়িতে তখন রেডিয়ো চলছিল। রেডিয়ো শুনতে শুনতে অরুণ তাঁর লেখায় লিখে দিলেন যে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরা গান্ধিকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। সঞ্জয় আবার গিয়ে পাণ্ডুলিপি রেখে এলেন অমিতাভর আস্তানায়। এরপর যা ঘটলো, সবটাই আমাদের জানা। সেকেন্ড লেয়ারে সেগুলো বলা হয়েছে। ধনরাজ সন্দেহ করলেন ড্যানিয়েলকে। অরুণের সঙ্গে চুক্তি করলেন, দুই পক্ষই মুখ খুলবেন না। জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্ট হলো। ড্যানিয়েল তলিয়ে গেলেন বিস্মৃতির অতলে। অরুণ আর সঞ্জয় কি আরও নিষ্ঠুর কোনো শাস্তি চেয়েছিলেন? নাকি ধনরাজ গম্ব যে তাঁদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসবেন, এটা দুজনের হিসেবের মধ্যে ছিল না? জানি না। আমার প্রথমে অবাক লেগেছিল, ড্যানিয়েলকে এই দুজন আরও বড়ো কোনো আঘাত দিলেন না কেন। পরে মনে হলো, হয়তো চেয়েছিলেন। কিন্তু ওখানেই থেমে যেতে হয়েছিল। ওটুকুই হয়তো যথেষ্ট ছিল। ড্যানিয়েলের মতো প্রবল পুরুষের কাছে এ আঘাত মরণসম। ড্যানিয়েল সেই কারণেই এখনও প্রবল হতাশায় বলে চলেন যে এই শহর তাঁকে ডিজার্ভ করে না। এর থেকে বেশি প্রতিশোধ শুধু রুপোলি পর্দায় হয়। আর সেটা করতে গেলে অরুণ বা সঞ্জয়ের কেরিয়ার ক্ষতিগ্রস্তও হতে পারত। পুলিশও চলে যেত বিপক্ষে 

‘শুধু একটা জায়গা, যা অনেকদিন বুঝিনি। ঋষি রোডের বাড়ির দেয়ালে আঁকা ছবিতে দু-রকম রং ব্যবহার করা হয়েছিল কেন? পরে বুঝলাম, দুজন আলাদা মানুষ এঁকেছে। অত্যাচারে অর্ধ-অচেতন বাবলার হাত হয়তো কোনো এক সময়ে খুলে দেওয়া হয়েছিল। খাবার খাওয়ানো, বা টয়লেটে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে। অথবা এটাও হতে পারে, বাবলার একটা পা এবং একটা হাতেই হাতকড়া পরানো ছিল। অপর হাত খালি রেখে দেওয়া হয়েছিল। বাবলার হাতে পড়েছিল একটা কালো রংপেনসিল। সে লেখাপড়া জানতো না। যেটুকু জানতো, সেটাই করে গেছে। একজন লোক এক হাতে মদের গ্লাস আর অপর হাতে বন্দুক নিয়ে অন্য একজনকে ভয় দেখাচ্ছে। ঠিক যেরকম সঞ্জয় বন্দুকের মুখে তাকে মদ খেতে বাধ্য করতেন। সঞ্জয় যখন পরে ফিরে এসে বাড়ি পরিষ্কার করছিলেন, তাঁর চোখে পড়লো ছবিটা। মাটিতে তখন গড়াগড়ি যাচ্ছিল একটা লাল পেনসিল। সঞ্জয় পিস্তল হাতে মানুষের মাথায় টুপি এঁকে দিলেন। যাতে দেখে মনে হয় লোকটা একটা পুলিশ। আর অপর লোকের মাথায় নাম লিখে দিলেন, অমিতাভ। পরে যদি পুলিশ এই বাড়ির সন্ধানও পায়, যাতে ভুলপথে চালিত হয়। টুপিটা পরে আঁকা হয়েছিল বলে টুপির ভেতর দিয়ে মাথা দেখা যাচ্ছিল। 

‘কিন্তু সঞ্জয়ের চোখে আর একটা জিনিস পড়েনি। সম্ভবত তাড়াহুড়োয় ছিলেন বলে। বাবলা অপটু হাতে আরও একটা ছবি এঁকেছিল। দেয়ালের নীচের দিকে। নিজের প্রিয় কুকুরের ছবি। আমিও জানতাম না এটা। যখন বিনয়েন্দ্র মুস্তাফি বললেন, ‘দেখলেন তো, কে মরল? যে গরিব, সে-ই।’ আমার মাথায় হঠাৎ খেলে গেল বাবলার কথা। বাবলাও তো গরিব ছিল। তার অন্তর্ধান আর অমিতাভর মৃত্যু পাশাপাশি। তাহলে কি অমিতাভ নয়, মরেছে বাবলা, যেটা আগেও ভেবেছিলাম? ওয়াইল্ড গেস, সন্দেহ নেই। প্রশ্নটা তো বেসিক ছিল যখন লজিক বলছে যে সেই রাত্রে অমিতাভ খুন হননি, তাহলে খুন হলো কে? বডি কার ছিল? মনে হলো, আর একবার ওই বাড়িতে যাওয়া দরকার। যদি আর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাই? হয়তো এবার অনেক খোলা মনে দেখব; আর তাই আগে যেগুলো দেখে কিছুই মনে হয়নি, সেটা এখন গুরুত্বপূর্ণ লাগলেও লাগতে পারে? তাই আনন্দ পাঠককে ধরে আবার গেলাম সেই বাড়িতে। কুকুরের ছবিটা যখন দেখলাম, বুঝলাম, আমার অনুমান ঠিক 

‘যেদিন বাবলার বডি আবিষ্কৃত হয়, সেদিন বিকেলেই সঞ্জয় দার্জিলিং-এ আবার ঢুকলেন। এবার সাংবাদিক হয়ে। ভাবখানা এমন, তিনি আগের দিন কলকাতায় বসে ফোনে এই সংবাদ শুনেছেন। পুলিশ অরুণের সহযোগীর সন্ধানে চারপাশে তল্লাশি চালাল। কিন্তু আসল সহযোগী তাদের চোখের সামনে বসে ছিলেন সারাক্ষণ। সাংবাদিকের জুতো খুঁটিয়ে কেনই বা দেখবে পুলিশ? হয়তো প্ৰবল আত্মবিশ্বাসে সঞ্জয় খুনের রাতের জুতোই পরে এসেছিলেন। জানতেন, পুলিশ তাঁর দিকে ফিরেও তাকাবে না। 

‘এবার লাশ শনাক্তকরণ। অরুণ করেছেন, যদিও নিশ্চিত না হবার নাটকও করেছেন। তারপর সঞ্জয় শনাক্ত করলেন। এরপরে দুই বন্ধুর মাস্টারস্ট্রোক। তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে বাবলার লাশ অমিতাভর হিসেবে শনাক্ত করানো, যাতে পুলিশের মন থেকে শেষ সন্দেহটুকুও চলে যায়। সত্যি বলতে কি, অমিতাভ খুন হননি, লজিকালি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেও আমি একটা বড়ো সময় অবধি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, একটাই কারণে। ফাদার স্যামুয়েলস বডি আইডেন্টিফাই করলেন কীভাবে? তারপর বুঝলাম, মনস্তাত্ত্বিক চাল। সঞ্জয় ফাদারের অনাথশ্রমে গেলেন। গিয়ে ভেঙে পড়লেন কান্নায় এই বলে যে অমিতাভ আর নেই। তিনি লাশ শনাক্ত করে এসেছেন। পকেটের কাগজপত্র দেখে বুঝেছেন যে অমিতাভ আরও অনেক অসামান্য কবিতার খসড়া বানাচ্ছিলেন, মৃত্যু তাড়াতাড়ি কেড়ে নিল এসব হাবিজাবি অনেক কথা। দৃশ্যত শকড় ও বিভ্রান্ত ফাদারকে এবার সঞ্জয় নিয়ে এলেন দার্জিলিং। প্রথমে থানায় গেলেন। সেখানে গিয়ে ফাদার জানতে পারলেন যে অরুণ লাশ শনাক্ত করেছেন। অরুণ যে দ্বিধা দেখিয়েছেন সেটা সঞ্জয় ফাদারকে বলেননি। সঞ্জয় হয়তো কথায় কথায় এ-ও জানালেন যে ওই বীভৎস লাশ কোমলপ্রাণ ফাদার সহ্য করতে পারবেন না, তাই তিনি পুলিশকে অনুরোধ করছেন ব্যাপারটা যাতে তাড়াতাড়ি মিটিয়ে নেওয়া যায়। এরপর জেলা হাসপাতাল। মর্গের ঘরে স্যামুয়েলসেকে নিয়ে গেলেন সঞ্জয়, বয়স্ক অসুস্থ অভিভাবককে নিয়ে যাচ্ছেন এই ভান করে। পুলিশ বাধা দেবেই বা কেন! পুরো গল্প এমন সাজিয়েছিলেন যে স্যামুয়েলসর মনে হয়েছিল সকলেই জানে এই বডি অমিতাভর, তার ওপর অরুণও শনাক্ত করে ফেলেছেন। কাজেই তাঁর শনাক্তকরণটা একটা রুটিন চেকআপ মাত্র, কারণ সঞ্জয় জানিয়েছেন যে তিনি শনাক্ত না করা পর্যন্ত অমিতাভর শেষকৃত্য করা যাচ্ছে না, যা একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিকের কাছে খুব বড় ইস্যু। স্যামুয়েলস অমিতাভর আকৃতির আর একটা শরীরকে অমিতাভ হিসেবে শনাক্ত করে দিলেন, কারণ তিনি জানতেন যে শনাক্তকরণ আগেই হয়ে গিয়েছে। আর পুলিশ জানলো, লাশ শনাক্ত করেছেন অরুণ বাদেও অমিতাভর দুই ঘনিষ্ঠ পরিচিত। এই পুরো ঘটনাক্রমটা আমার বানানো। কিন্তু বিশ্বাস করি, বাস্তবে এর কাছাকাছিই কিছু ঘটেছিল। সাধারণত মর্গে যেতে সকলেই ভয় পায়, অস্বস্তিবোধ করে। চায় যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে আসা যায়। স্যামুয়েলসের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। তিনি রুটিন চেক করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন, অথবা তাঁকে তাড়াতাড়ি বার করে আনলেন সঞ্জয়। অমিতাভর পরিচিতি নিশ্চিত হলো। আসল অপরাধী পুলিশের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ালেন এতগুলো বছর। 

‘ঠিক এডগার অ্যালান পো-র গল্পটার মতো। যে চিঠির সন্ধানে সকলে মাথার চুল ছিঁড়ছে, তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেলছে গুপ্তস্থানগুলো, সেটা অতি অবহেলায় সকলের চোখের সামনেই টেবিলের উপর রাখা ছিল। কেউ ভাবেইনি অত গুরুত্বপূর্ণ চিঠিকে এত অসাবধানে রাখা হবে। তাই জটিলতার পথে গিয়েছিল। আবারও, ওকামস রেজর। আমিও ফার্স্ট লেয়ারে অরুণের সহকারীর কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি, সেটা কে হতে পারে। যখন বিনয়েদ্ৰ মুস্তাফি ইঙ্গিত দিলেন, প্রথম যে কথাটা মনে এসেছিল, তাহলে সঞ্জয়ই এতদিনকার সেই ইপ্সিত এবং অদৃশ্য সহযোগী।’ 

অরুণের দিকে তাকিয়ে হাসলাম, ‘অমিতাভ কতটা রাজনীতি সচেতন ছিলেন সেটা জানি না। কিন্তু তাঁর মৃত্যুকে এরকম ইনস্টলেশন আর্ট হিসেবে দেখাবার প্রয়াসটা আপনাদেরই ছিল, অমিতাভর নয়। শিল্পের চরম পর্যায় যাকে বলে। একটা মৃত্যুর রিকস্ট্রাকশন। তবে কবিতার প্রতি আপনার অনুরাগটা একদম সত্যি। প্রতিশোধের থিম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন— বন্ধুবান্ধব খুন হয়ে যাচ্ছে, তাই সত্তরের কবিতায় প্রতিশোধ ফিরে ফিরে আসছে। হয়তো অবচেতনে সত্যিটা বলে ফেলেছিলেন।’ 

অরুণকে দেখলাম, উন্মাদের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বিকৃত স্বরে বললেন, 

‘একটা চালচুলোহীন ভিখিরিকে নিয়ে আপনাদের এত মাথাব্যথা কেন?’ 

‘বাবলার মরে যাওয়াতে আপনার কি কিছুই এসে যায় না?’ 

‘না যায় না।’ অরুণ গর্জে উঠলেন। ‘এরা পৃথিবীর বোঝা বাড়াতে আসে। এদের সমাজে কিছুই কন্ট্রিবিউট করবার নেই। সত্যিটা বুঝুন! একটা কেন, দশটা ভিখিরি মরলেও কারোর কিচ্ছু এসে যায় না।’ 

‘রামবীর মরলেও যেমন কিছু এসে যায় না, তাই তো?’ 

অরুণ গনগনে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দাঁত চিপে বললেন, ‘ফাকিং ইডিয়ট!’ 

হ্যাঁ। রামবীরকেও মেরেছেন আপনিই। রামবীর প্রতিদিন সকাল ছ-টার মধ্যে চলে আসেন, বলেছিলাম আপনাকে। আপনি আগে থেকেই এসে অপেক্ষা করছিলেন। রামবীর আসার পর তাকে ভুলিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসেন। জানালার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে গুলি ছোঁড়েন। অপরাধীর পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি, সেটাও স্বাভাবিক। কারণ খুন করবার পর গাড়ি চালিয়ে ফিরে এসেছিলেন দার্জিলিং-এ। পুরো কাজ সেরে সহজেই সাড়ে সাতটার মধ্যে আবার দার্জিলিং ফিরে আসা যায়। তারপর আমার সঙ্গে আবার সাড়ে আটটায় বেরিয়ে এই বাড়িতে এসে এই জুতো পরেই ভেতরে ঢুকেছিলেন। আপনার আগের পায়ের ছাপ পরের ছাপের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। অত কম সময়ের ব্যবধানে দুটো ছাপকে নতুন আর পুরোনো বলে আলাদা করা সম্ভব নয়। আবারও, ঠিক উপন্যাসটার মতোই সেকেন্ড লেয়ারে সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল যে বিমলবাবু চটি পরে এসেছিলেন, যাতে হোটেলের ঘরের দরজা ভাঙবার পর সেই ছাপ অন্য অনেকের চটির ছাপের সঙ্গে মিশে যায়। ওখান থেকেই কি আইডিয়াটা এসেছিল? পুলিশ এসে আপনার, আমার আর মদনদার পায়ের ছাপ পেয়েছিল। অন্য কারোর ফুটপ্রিন্ট স্বাভাবিকভাবেই মেলেনি। আমার সঙ্গে আবার ওই বাড়ি গিয়েছিলেন সেই কারণেই। যাতে আগের পায়ের ছাপ পরের ছাপের ভিড়ে মিশিয়ে দিতে পারেন।’ 

অরুণ তীব্র ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারণ করলেন, ‘সব কিছু বুঝবার চেষ্টা করতে যাবেন না। আপনাদের মতো দুই আনার সাংবাদিকেরা সব বুঝবেও না।’ 

‘কিন্তু রামবীরকে মারতে গেলেন কেন? কারণ আপনি চাননি এই বাড়ির সন্ধান আমি পাই।’ 

অরুণ গর্জে উঠলেন। ‘স্টপ ইট! আমি আপনার কেরিয়ার শেষ করে দিতে পারি।’ কিন্তু এবার গর্জনটার মধ্যে একটা আর্ত ভয়ের সুর মিশে আছে মনে হলো। 

‘না, বাড়ির সন্ধান আপনি আমাকে দেননি। তাই যখন বলেছিলাম যে আপনি বাড়ির ঠিকানা দিয়ে মেসেজ করেছিলেন, চমকে উঠেছিলেন। তারপর বুঝেছিলেন যে এই ব্যাখ্যাতে আপনারই সুবিধে। কিন্তু বাড়ির সন্ধান দিয়েছিলেন ড্যানিয়েল, কারণ তিনি চাইছিলেন আমি এই কেস সমাধান করি। ড্যানিয়েল কাল আমার কাছে স্বীকার করেছেন, পুলিশের চাকরি থেকে বেরিয়ে বহুদিন ধরে খুঁজবার পর এই বাড়ির সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন। কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে এই অপরাধের একটা ডেন থাকতেই হবে। নিজের সোর্স খাটিয়ে, নানাবিধ অনুসন্ধান করে সম্ভাব্য বাড়িগুলোর তালিকা বানিয়েছিলেন। তারপর এক এক করে ঘুরেছিলেন সবকটায়। এই বাড়ির দেয়ালে আঁকা ছবি দেখে তিনি নিঃসন্দেহ হন। কিন্তু পুলিশকে জানিয়ে লাভ হতো না কিছুই। উলটে ছবি দেখে তাঁর ওপর সন্দেহ পড়ত। সেই তখন থেকে ড্যানিয়েল বাড়ি আগলে আছেন এই আশায় যে ভবিষ্যতে কেউ না কেউ এর খোঁজ পাবে। রামবীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারবে। হয়তো ছবি দেখলে রামবীর শনাক্ত করবেন। আর অরুণ এটাই চাইছিলেন না। তিনি আতঙ্কিত হয়েছিলেন, যে রামবীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে হয়তো সত্যিটা জেনে যাব। তাই তাঁর মুখ বন্ধ করতে হতো। 

‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে অরুণ যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, তাই তিনিই কবিতাটা পাঠিয়েছেন। কিন্তু ড্যানিয়েলের বাড়িতে থরে থরে সাজানো বিংশ শতাব্দীর আমেরিকান ও ইংরেজি নাটকের বই দেখেছিলাম। তখন বুঝিনি বুঝলাম পরে। আমেরিকান কবি উইলিয়াম হিউজেস মেয়ান্স অ্যান্টিগোনিস নামের এই ছড়াটা লিখেছিলেন গত শতাব্দীর শুরুতে। কিন্তু ছড়াটা ছিল ‘সাইকো- এড’ নামের একটা নাটকের অংশ। নাটকটা মেয়ার্স লিখেছিলেন হার্ভার্ডে নিজের ক্লাসে পড়াবার উদ্দেশ্যে। আমেরিকান নাটকের মনোযোগী পাঠক হিসেবে 

ড্যানিয়েলের কবিতাটা জানা ছিল। আর কী ব্যঞ্জনাময় কবিতা! 

Yesterday upon the stair 
I met a man who wasn’t there 
He wasn’t there again today 
I wish, I wish he’d go away 

গতকাল ড্যানিয়েলের কাছে যে মৃত ছিল, সেই অমিতাভ আবার জীবন্ত হয়ে আজ ফিরে এসেছে তাঁর সামনে। কিন্তু অমিতাভ তো নেই, তিনিও জানেন। আর তাই সেই নেই মানুষটা যেন তাঁর জীবন থেকে চলে যায়। যেন মুছে যায় পাকাপাকি।’ 

অরুণ তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠলেন, ‘সব মিথ্যে। আপনি কিছু প্রমাণ করতে পারবেন না।’ 

সিদ্ধার্থর দিকে তাকালাম। কিন্তু সিদ্ধার্থ ততক্ষণে উঠে বাগানের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অরুণের চিৎকারেও ফিরে তাকালো না। 

‘আর আমার উপস্থিতিতে যখন রামবীর খুন হলেন, ড্যানিয়েল বুঝলেন তাঁর শেষ আশাটুকুও চলে গেল। আমার ওপর ভরসা করেছিলেন। কিন্তু আমিও অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছি। সেই কারণেই হোটেলে দেখা করতে এসেছিলেন, নিজের হতাশাটুকু উগরে দেবার জন্য।’ 

অরুণ আবার বিকৃত গলায় চিৎকার করলেন, ‘ড্যানিয়েল একটা শয়তান! ও অমিতাভকে মেরেছে। আমি যা করেছি বেশ করেছি! জাস্টিস পাবার জন্য করেছি। অমিতাভ বেঁচে থাকলে বড়ো কবি হতো। আমার জাস্টিস দরকার ছিল, জাস্টিস।’ গলা চিরে চিৎকার করে ‘জাস্টিস’ শব্দটা বার বার উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন অরুণ। 

মুশকিলটা কী জানেন মিস্টার চৌধুরী? আপনাদের শ্রেণীর মানুষের কাছে জাস্টিসের ধারণাটা এমন যে সেটাকে পাবার জন্য বাবলা অথবা রামবীর সহজেই বলি হয়ে যেতে পারে। তাদের জাস্টিসের কানাকড়িও দাম আপনাদের কাছে নেই। কারণ তারা আপনার শ্রেণীর নয়। আপনাদের মেধারও সমকক্ষ নয়। আর তাই আপনাদের এই ন্যায়ের আখ্যান, অধিকারের দাবিতে সংগ্রাম, সামাজিক সমতার সমস্ত অতিকথা শেষমেশ ওই আলোকপ্রাপ্তির হাতেই কুক্ষিগত থেকে যায়। ঠিক এই জায়গাতে আপনার আর ড্যানিয়েলের মধ্যে কোনো তফাত নেই। ড্যানিয়েলের কাছে অমিতাভ একটা এক্সপেন্ডেবল শরীর মাত্র। আপনার কাছে বাবলা আর রামবীরও তাই। বাবলার কুকুরটাও তাই। আপনারা দুজনে একই কয়েনের দুই পিঠ।’ যতটা পারা যায়, চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম। 

অরুণ দুই হাতে মাথার চুল মুঠি করে চেপে ধরে চিৎকার করতে শুরু করলেন। একটা অসহনীয়, অর্থহীন, জান্তব চিৎকার। আগেকার সেই শান্ত স্থির মানুষটা যেন কোনোদিন ছিলই না। এই আহত পশুটাই আসল সত্যি। উঠে দাঁড়ালাম। 

‘আমার চলে যাবার সময় হয়ে এসেছে। এবার সমতলে নেমে যাব। বাবলা হত্যার কেস তামাদি হয়ে গেছে। তার বিচার কী হবে জানি না। ড্যানিয়েলও কী করবেন, জানাননি। আশা করব, নিজের অপরাধ এতদিন পরে এসে স্বীকার করবেন তিনি। আমি তো শুধু আশাই করতে পারি। কিন্তু রামবীরকে হত্যার বিচার যাতে হয়, সেটা আমি দেখবো। আনন্দ পাঠককে চিঠি লিখে সব জানিয়ে দিয়েছি। তাঁর বাড়িতে এতক্ষণে সে চিঠি হয়তো পৌঁছেও গিয়েছে।’ বাগানে নামতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। পেছন ফিরে বললাম, ‘ড্যানিয়েলকে শেষ করেও আপনার তৃপ্তি হয়নি। একটা শেষ আঘাত দিতে চাইছিলেন। আগের বার বাইরের পৃথিবী জানতে পারেনি ড্যানিয়েলের অপরাধ। তাই এবার যখন ফোন করলাম, আপনি কি রাগে ঘৃণায় পাগল হয়ে গেলেন? প্রথমে হয়তো অনন্যার কথায় আমাকে প্রত্যাখান করেছিলেন। কিন্তু তারপর কী মনে হয়েছিল, গোটা পৃথিবীর মুখে ছুঁড়ে মারবেন আপনার সাজানো গল্পটাকে? আমার বিশ্বাস যাতে শক্ত হয়, তার জন্যেই কি নিজেকে অপরাধী হিসেবে স্বীকারোক্তি দেবার প্রাথমিক নাটক? কী জানি! তবে একটা কথা ঠিক। আপনি ভেবেছিলেন, আমি সমাধানের দ্বিতীয় লেয়ার অবধিই পৌঁছোব। তার বেশি না। দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায় একে! অথবা! আপনারই কথা মতো, ওল্ড সিনস হ্যাভ লং শ্যাডোজ।’ 

অরুণ তখনও চেয়ারে বসে মাথার চুল আঁকড়ে ধরে উন্মাদের মতো চিৎকার করে যাচ্ছেন। লালা ঝরছে তাঁর ঠোঁট বেয়ে। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসবে মনে হচ্ছে। চোখে পড়ল, সেই দাবার বোর্ডের ঘুঁটিগুলো এলোমেলো হয়ে এখানে-ওখানে ছড়ানো। কয়েকটা পড়ে আছে মাটিতেও। শুধু একটা বোড়ে উলটেদিকের শেষ ঘর অবধি পৌঁছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। 

সিদ্ধার্থর দিকে তাকালাম আমি। তার চোখে জল টলটল করছে। ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়ে আছে বাগানের দিকে তাকিয়ে। অরুণ, আমি—কারোর দিকেই ফিরে তাকালো না। তার হাতে হাত রাখতে গিয়েও, কী ভেবে, সরিয়ে নিলাম। থাক বরং। এটুকুই। 

বাগানের গেটের সামনে অনন্যা স্তব্ধ হয়ে দূরের পাহড়ের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখলাম। কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে, চারপাশ, আবারও। বললাম, ‘চলি।’ 

অনন্যা উত্তর দিলেন না। 

‘আপনি এবং সিদ্ধার্থ দুজনেই প্রথম দিন থেকে চেয়ে এসেছেন, আমি যেন এখানে না আসি। যেন অতীত খুঁড়তে না যাই। কেন?’ 

অনন্যা তাকিয়েই থাকলেন পাহাড়ের দিকে। 

‘কারণ, আপনারা দুজনে প্রথম থেকেই মনের গভীরে সত্যিটা জানতেন। জানতেন যে আসল অপরাধী অরুণই।’

অনন্যা আমার দিকে ফিরে স্পষ্ট চোখে তাকালেন। আমাকে আবার এঁফোড় ওফোঁড় করে দিল তাঁর দৃষ্টি। ঠিক যেমন আপনিও জানতেন। আপনার মনের একদম গভীরে। প্রথমদিন থেকেই।’ 

আর কোনো উত্তর দিলাম না। কিছুক্ষণ দুজনে তাকিয়ে থাকলাম একে অন্যের দিকে। তারপর আমি ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম গেটের বাইরে। পেছনে তখনও অরুণের উন্মাদের মতো চিৎকার শোনা যাচ্ছে। 

সেই ঘোড়াটা উঠে এসেছে বাড়ির সামনে। তার কালো কেশর থেকে ঝরছে মুক্তোর মতো শিশির। নিশ্চল দাঁড়িয়ে সে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। পেছন 

থেকে আততায়ীর মতো ধেয়ে আসছে কুয়াশা। 

চোখ বুজলাম। মনে মনে বললাম, ‘এই সব, সব মিথ্যে। আমাকে যেতে হবে। এই মৃতের নগরী পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আমাকে।’ 

চোখ খুললাম। ঘোড়াটার সারা শরীর কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। আর দেখতে পাচ্ছি না তাকে ভালো করে। আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেল সাদা চাদরের তলায়। আমার আঙুল অজান্তে উঠে এল হাতের পোড়া দাগটার ওপর। 

দুরে গাড়িতে মদনদা বসে আছেন। আমাকে গাড়িতে উঠতে হবে। সমতলে একটা প্লেন অপেক্ষা করছে। আমাকে নিয়ে যাবে সল্টলেকের বাড়িতে। আমাকে ফিরতে হবে। বাবার কাছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *