২
কার্শিয়াং পৌঁছে গেছে গাড়ি। হিলকার্ট রোডে এরপর থেকে যানজট শুরু হবে। গাড়ি উঠে পড়ল ওপরের বাইপাসে। পাহাড়ের গা বেয়ে কুয়াশা উঠে আসছে গুঁড়ি মেরে। পাইন ফার্ণের দল গা জড়াজড়ি করে দলা দলা অন্ধকার তৈরি করেছে রাস্তার ধারে। উঁচু উঁচু পাহাড়ের আবছায়া শিল্যুয়েট দেখতে পাচ্ছি। তারা কাছে আসার আগেই বৃষ্টির ছাট এসে আবছা করে দিচ্ছে সামনের কাচ।
‘মদনদা। প্রথমে জলপাহাড় রোড যাব। চৌধুরী ভিলা। আপনাকে বলে দেব ঠিক কোন্ জায়গাটায়।’ জিপিএস যদি কাজ না করে, ফোন করতে হবে অরুণ চৌধুরীকে।
আরও বেশ কিছুটা রাস্তা চলার পর পাহাড়ি ঝোরা চোখে পড়ল। কয়েকজন স্থানীয় মহিলা একটা পাথরের উপর ছাতা মাথায় বসে আছেন। উঁচু পাহাড়কে আর কুয়াশার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না, শুধু জেগে আছে নেসলে কোম্পানির একটা কুৎসিত সাইনবোর্ড। আর কুয়াশার চাদরের আঁশ ফুঁড়ে মাথা গলানো মিটমিটে আলোর দল। আশেপাশের পাহাড়ের গায়েও রিসর্ট আর হোটেলের ছোটোবড়ো বোর্ড। এগিয়ে গেলে কাঠচেরাইয়ের গুদাম। কয়েকটা সস্তা কেক পেস্ট্রির দোকান, চায়ের গুমটি, ধাবা, মোমো স্টল। আবছা অন্ধকারকে কিছুটা ঠেলে সরিয়ে রাখছে এখানে-ওখানে জ্বলে ওঠা আলো। রং-বেরঙের জামা পরা একটা ভুটিয়া মেয়ে একদল ছাগল নিয়ে গাড়ির সামনে রাস্তা পেরোচ্ছে। গাড়ি থেমে গেল।
‘প্রায় এসে গেছি। চা খাবেন নাকি ম্যাডাম?’
‘নাহ, আপনি খান।’
‘সে কী!’ অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকালেন মদনদা। চায়ের জায়গাতে এসে চা খাবেন না?’
‘চা খাই না।’ অল্প হেসে জানালাম।
বৃষ্টি এখন কম। পরনের বাদামি জিনস কী কারণে যেন নোংরা হয়ে গেছে। কালো কালো দাগ পড়েছে জিনসের গায়ে। গাড়ি থেকে নেমে মুখে হাত বোলালাম। একটা তেলতেলে ভাব, যার ওপর কুয়াশা এসে বসবার আগেই পিছলে যায়। আইলাইনার ধেবড়ে গেছে নিশ্চয়। এই চেহারা নিয়ে ওরকম সম্ভ্রান্ত পরিবেশে না যাওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু আমার হাতে তো সময় বেশি নেই। এমনকি লিপগ্লসটাও হ্যান্ড লাগেজে রেখেছিলাম কিনা মনে পড়ছে না।
মদনদা আয়েশ করে চা খাচ্ছেন। আমি একটা আড়মোড়া ভেঙে সামান্য হাঁটাহাঁটির জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। হঠাৎ চমকে দেখি, ঘন কুয়াশা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে আমার রাস্তা রোধ করে দাঁড়িয়েছে এক হাট্টাকাট্টা লোক। হয়তো কুয়াশা না থাকলে দূর থেকে দেখতে পেতাম, কিন্তু এখন মনে হলো লোকটা অদৃশ্য অবস্থা থেকে আবির্ভূত হয়েছে, আর তার জন্যই ধক করে উঠল বুকটা। রুক্ষ এবড়োখেবড়ো মুখ, গালের দুই পাশ দিয়ে ঝুলে পড়া গোঁফ এবং কুতকুতে চোখ মেলে আমার সর্বাঙ্গ ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মেপে নিল। দেশের মধ্যে নানা জায়গাতে গিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টির সম্মুখীন হওয়া আমার কাছে নতুন না হলেও, অবাঞ্ছিত চোখ এবং স্পর্শ বিষয়ে ভয়ংকর একটা অস্বস্তি এখনও মন থেকে তাড়াতে পারিনি।
‘হোটেল চাহিয়ে ম্যাডাম?’ কর্কশ স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল লোকটা।
মুখ খোলবার আগেই দেখি মদনদা আমার পাশে চলে এসেছেন। মদনদা নেপালি ভাষায় কিছু বললেন। আমার নাম আর কাগজের নাম, এই দুটো শব্দ শুনতে পেলাম। ‘চৌধুরী ভিলা’ শুনে লোকটা সচকিত হলো। আমাকে মাপলো আর একবার। ভুরু দুটো কুঁচকে গেল। তারপর প্রায় নিজের মনেই বলল, ‘জার্নালিস্ট? চৌধুরী ভিলা যাবেন? কেন?’
‘কাজে। আপনি চেনেন?’
লোকটা উত্তর না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল আর একবার। তারপর ঘন কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেল। যাবার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল আমাকে।
গাড়ি স্টার্ট করতে করতে মদনদা বললেন, ‘এখন অফ সিজন, টুরিস্টের আকাল। দার্জিলিং-এ এখন কেউ পা দেবার আগেই তাই দালালদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, কে কাকে নিয়ে কোনো হোটেলে পৌঁছে দিতে পারবে। তবে এই যে দেখলেন, গিরিরাজ, এ মহা ধুরন্ধর। এককালে অনেক গুণ্ডামি, মারামারি করেছে। লক আপেও গেছে কয়েকবার। এখানকার হোটেল আর জিপগুলোকে কেন্দ্র করে দালাল চক্র আছে কয়েকটা। তার মধ্যে এ একটার পাণ্ডা।’
‘কিন্তু চৌধুরী ভিলার কথা শুনে এরকম অবাক হলো কেন?’
‘চেনে হয়তো। ওদের বাড়ি জলাপাহাড়ের নীচের বস্তিতেই। ওর বাপ কাকারাও জলাপাহাড়ের বাড়ি, মালের হোটেল এসব জায়গাগুলোতে কাজ করে এসেছে সারাজীবন। ও এখানকার প্রায় সবাইকেই মুখে চেনে।’
খটকা লাগল। চেনা এক কথা। কিন্তু গিরিরাজ যেরকম প্রতিক্রিয়া দিল, সেটা শুধুমাত্র জানাচেনা থেকে আসে না।
শহরের বহির্ভাগ এগিয়ে আসছে। চারপাশে লোকজন কম। ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে শুধু আশেপাশের দোকানের আলো। কুয়াশার মধ্যে কোথাও কোথাও জটলা এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। বাকি জায়গাটা ফাঁকা এবং অস্বচ্ছ অন্ধকার। অনুমান করলাম, ভিড়ের জায়গাগুলো হোটেল, পাব অথবা রেস্তোরা। এই শহরে বর্ষার নির্জনতায় যখন রাত্রি নামে, নির্জন হোটেলদের ধ্বংসস্তূপ আর পলিথিনের কম্বলে ঘুমিয়ে থাকা জিপগাড়ির দল যখন গুটিয়ে ফেলে নিজেদের, তখন মনে হয় পাহাড়ের আদিম হিমশীতল জঙ্গল এসে দখল নিচ্ছে গোটা জায়গাটার। মনে হয়, এই অবিশ্রান্ত ছিপছিপে বৃষ্টির থেকে পরিত্রাণ নেই।
জলাপাহাড়ের রাস্তা দিয়ে সাবধানে গাড়ি উঠছে। কুয়াশা এখন কম। হয়তো ওপরে উঠতে সময় নিচ্ছে। আশেপাশে অভিজাত মহল্লা। জিপিএস খুলে দেখলাম, আর চারশো মিটার। অধিকাংশ বাড়ির সামনে বাগান। লনে আলো জ্বলছে। দু-একটা হোটেল। বাড়িগুলির গড়ন পুরোনো ব্রিটিশ উপন্যাসকে মনে করিয়ে দেয়। মদনদাকে জিপিএস দেখে রাস্তার নির্দেশ দিতে দিতেই চোখ তুলে দেখলাম, বৃষ্টিভেজা নির্জনতার মধ্যে একটা নিঃসঙ্গ ছায়ামূর্তি পাহাড়ের ওপরের ধাপে দাঁড়িয়ে আমার গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ চোখ কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার ওপর রেনকোট পরা। মাথায় হুড চাপানো। মূর্তিটা নিস্পন্দ ভাবে নীচের দিকে তাকিয়ে, কিন্তু বুঝতে পারছি তার দৃষ্টি অনুসরণ করছে গাড়িকে। গাড়িটা মূর্তির সমান ধাপে উঠল। মূর্তিটা আস্তে আস্তে মুখ তুলে গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকল। এখন গাড়ি আর মূর্তি একই সমতলে, পঞ্চাশ মিটার মতো দূরত্বে দাঁড়িয়ে। মুখ এখনও দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, তাই লোকটার পুরো চেহারাই কালো একটা অবয়বের মতো লাগছে। গাড়িটা আর একটা বাঁক ঘুরল। পেছন ফিরে তাকালাম। শুধু আবছা কুয়াশা। আর কিছু নেই।
মদনদা গাড়ি থামালেন। সামনে একটা বড়ো ফটক। তার গায়ে ইংরেজিতে লেখা ‘চৌধুরী ভিলা’।
এগিয়ে এসে চোখকে ধাতস্থ করতে হলো। ভেতরে প্রশস্ত বাগান পাহাড়ের গা বেয়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে। বাগানের ভেতর আলো জ্বলছে। গাড়ির শব্দ শুনে সিকিউরিটি এসে গেট খুলে দিচ্ছে। ঘড়ঘড় শব্দ করে দুই দিকে হাঁ হয়ে গেল পুরানো লোহার ফাটক। বাগানের ভেতর দিয়ে পায়ে হাঁটা-পথ এঁকে বেঁকে উঠে গিয়েছে একটা দোতলা বাড়ির কাচের দরজায়। দরজার পাশে প্রশস্ত ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। বাড়ির পুরোটাই কাঠের। তার ওপর পোড়ামাটির রঙের একটা এফেক্ট আনা হয়েছে। দোতলার মাথায় টালি। বিভিন্ন অর্কিড, লতাপাতা দিয়ে সাজানো। একটা চিমনি উঠে গেছে তার মধ্যে থেকে। বাড়ির একপাশে লাগোয়া আর একটা ছোটো টালির চালওয়ালা একতলা বাড়ি। সম্ভবত গেস্টহাউস। বাগানের ডানদিকে একটি ছাউনির নীচে গা এলিয়ে পড়ে আছে ঝকঝকে হণ্ডা সিটি। সম্পূর্ণ ভিক্টোরিয়ান পরিবেশের মধ্যে গাড়িটাই যা বেমামান। হয়তো মনে মনে আশা করেছিলাম যে পুরোনো দিনের ল্যান্ডরোভার বা নিদেনপক্ষে ফিয়াট দেখতে পাব।
এটাই সেই বাড়ি। বিখ্যাত লেখক অরুণ চৌধুরীর বাড়ি। এই বাড়ি থেকেই চুয়াল্লিশ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন প্রতিশ্রুতিবান সাহিত্যিক অমিতাভ মিত্র। দুই দিন পরে তাঁর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়। যে হত্যারহস্যের সমাধান আজও হয়নি।
***
২৭/০৯/১৯৬৯
ভাষা এসো সোনম প্রধানের শরীর ছুঁয়ে, এসো দিগ্বিদিক
প্রাণ এসো শেষ তুষারে পাইনের পা ভিজিয়ে
আর গাথা এসো জলচর শামুকের শাঁস যেভাবে নিংড়ে আনে প্রতিধ্বনি
আমাদের বিষাদনাভির গল্পে ছুটে আসুক পার্বত্য হরিণের দল
এসো স্বপ্নবিষ, হত্যাময় বরফ
আরও কয়েকটা
লাইন যাবে, এমন
হতে পারে যে
দশকের সঙ্গে কবিতাকে বেঁধে দেয় কোন শালা। সব অশিক্ষিত। তবু মনে হচ্ছে যেদিকে এগোচ্ছে ব্যাপারস্যাপার, বেশ কিছু রাগী চিৎকার শোনা যাবে। তারপর বলা হবে, এ দশক ক্রোধের দশক। হবেই। আমি শালা সমালোচক আর সাহিত্যবেত্তাদের হাড়ে হাড়ে চিনি। সবে এপ্রিল মাস, তার মধ্যেই এদিক ওদিক বলাবলি হচ্ছে, মুক্তির দশকে মুক্তির কবিতা এসব হাবিজাবি। ধুস! এদিক অনুকৃত আঙ্গিকের ওপর অধিকৃত আঙ্গিকের জয় ঘোষণার যে ব্যাপারগুলো আমরা ভেবেছিলাম, সেসব কই। সেই তো একই ধাঁচ, যেরকম পঞ্চাশের দশক থেকে চলে আসছে। সর্বনাশ করে দিয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তারও আগে জীবনানন্দ দাশ। ভয়ানক প্রতিভাবান কবি আসলে কবিতার সর্বনাশ করে। পরের কয়েক দশক জুড়ে উত্তরসূরি কবিরা সেই ভাষা আর সেই আঙ্গিকের প্রভাব থেকে বেরতে পারে না। এই সর্বনাশ মধুসূদন দত্ত করেছে, রবি ঠাকুর করেছে, আর তারপর এরা। কী ফ্রাস্ট্রেটিং। গদ্যে মনে হয় কমলবাবু এতটা করতে পারবে না, কারণ ও জিনিস নকল করা কঠিন। আর গদ্য ফদ্য অন্য জিনিস, মাথা না ঘামানোই ভাল। এদিকে উত্তরবঙ্গে কী সাংঘাতিক লেখাপত্র হচ্ছে, কলকাতা আর কবে জানবে। আগের মাসে একটা নতুন কাগজ বার করল অরুণদা। কবিতা চাইছে। কলকাতার কাগজে আর লিখব না শালা। কলোনির ইয়ে মারি। বেঁচে থাক আমার নর্থবেঙ্গল। অরুণটা যদি এসব বুঝত। ল্যাব্ল্যাড় করছে, কলকাতার কাগজে জায়গা পাবে বলে। এরকম গাণ্ডুমার্কা ভাবে কেন? পড়তে গিয়ে কলকাতা দেখে মাথা-ফাথা ঘুরে গেছে ওর। পাছায় ক্যাত ক্যাত করে দুটো লাথ কষিয়ে লেউড়েপনা বার করতে হয়।
.
শোন, কলকাতা থেকে কিছু ভালো লেখার কাগজ পাঠাস, আর ভালো তামাক। তোর টাকাপয়সার হাল কেমন? বাড়ি থেকে টাকা দেয়? নাহলে থাক। তবে ম্যাগাজিনগুলো পাঠাস মনে করে। ইমন যা কিছু পুরোনো কাগজ আছে, সব দিবি।
.
২৩/১০/১৯৭০
প্ৰিয় পার্থ,
চিঠির উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল অনেকটা। জানিসই তো, জুতোয় পেরেক ছিল। ‘আকাশ’ সেবার কলকাতায় গিয়ে পড়া হয়ে ওঠেনি, যাবার পথে জোগাড় করে এনেছিলাম। দিব্যি বার করছিলি তো, থামলি কেন দুম করে? তোর পাঠানো কবিতাটাও পড়লাম। কিন্তু এই এই যে লাইনগুলো— নীলোৎপল নাও, নাও এ কোমল হৃদয়ের তোমার রূপ দাও, তোমার জয় দাও অভয়ের- এখনও কাঁচা লাগছে কিছুটা। এ একরকম মন্ত্র-তন্ত্র আধারে তুই ক্লাসিক আবহ আনছিস, এতে উৎসাহ পাই না। প্রসাদে করো তারে যুধিষ্ঠির, উন্মোচিত হোক মহাতিমির— মানে, কেন? প্রার্থনার ফর্মে কবিতা লেখার নির্যাস তো আমাদের নয়, ছিল না। আবার রণপ্রণয় দাও আর্ত পৃথ্বীকে— তোকেও কি তিমিরবরণদের রোগে ধরল নাকি? কানুবাবুদের শহীদ মিনারের সভায় গেছিলি টেছিলি মনে হচ্ছে? সে যাক, যা ভাল বুঝবি করবি। এদিকে কবে আসছিস জানা। যদিও দার্জিলিং শহর দিনে দিনে অসহ্য হয়ে উঠছে, তবে তোকে নিয়ে নিবেদিতার সমাধি দেখতে যাব একবার।
ভাল কথা, সুব্রতর মেসের গদি নাকি সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে পুড়িয়ে এসেছি। শুনলাম খুব রাগারাগি করছে। ওকে পারলে কিছু দিস। আমার পকেট তো বুঝতেই পারছিস!
—অমিতাভ
অমিতাভ গুপ্তর কবিতা পড়েছিস? নাকি দারুণ লিখছে টিখছে? আমি কয়েকদিন আগে শুনলাম। পাঠাতে পারবি, কয়েকটা স্যাম্পল?
.
সমীক্ষা, অলিন্দ, এ সময়ের কবিতা, নক্ষত্র,
এই কাগজগুলো পাঠাবি
.
সাদা পাহাড়ের ঈশ্বর
উপত্যকায় অনেকক্ষণ বৃষ্টি হলো। অনেকটুকু ঝড়ও চামচে করে ঢেলে দিল। এখন আকাশ ভারমুক্ত। আর চূড়ায় উঠলে হাত দিয়ে আকাশের গায়ে টোকাও মারা যেতে পারে। ঠিক যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা ছুঁচালো ঠোঁট আকাশকে চুমু খায়। আমার শহরে একফালি মনাস্ট্রি। দরজায় বসে আছে আহত বালিকা। কবাট থেকে জল চুইয়ে পড়ছে। রাত্রির নির্জনতায় ওটুকু করুণ চোখের সেদ্ধজলে বেঁচে থাকা। শোঁ শোঁ ঝড়ের শব্দে পাথুরে হৃদয় জেগেছিল। এরপর তুষারপাত হবে। হিম জ্যোৎস্নায় শুয়ে থাকবে বিবর্ণ বালিকাজন্ম। কে তাকে দেখবে? মৃতের শহরে কেউ বেঁচে নেই। শুধু একপাল জিপগাড়ি মাথায় প্লাস্টিক চাপিয়ে ঘুমে। গাঢ় নির্জনতা। বালিকার পায়ের আঙুল মাটি খুঁজছে। কেঁচোর স্বপ্নে ফিরে আসে ভয়। জামা ভেসে যায় রক্তে। একান্তে লুটিয়ে থাকা একটি বোতাম, ছেঁড়া। শান্ত শ্বাস ফেলে। ওই, ওই যে আবার বৃষ্টি এসেছিল। ছোটো গাছেরা লম্বা হয়ে উঠেছিল। রক্তাক্ত জামার ভেতর মুখ গুঁজেছিল ভিতু কেঁচো। চোর স্বপ্নখনির গহ্বর নেমে গেছিল অন্ধকার পাতালে। সে জানেনি। এখন গোল পতঙ্গের নিঃশ্বাস বৃষ্টির মনাস্ট্রিকে ঘিরে। ঝাঁকে ঝাঁকে হলুদ প্রজাপতি উড়ে আসবে। মুখ গোঁজা আহত বালিকা চাখবে আমাদের গল্পকথা। উপত্যকায় চাঁদ উঠবে। জন্মদিনের পায়েসের থালার মতো। মৃত বাবার কপালে চন্দনের ফোঁটার মতো। কেঁচোদের দল সে পায়েস বুক ভরে দেখে নেবে। মুখ ভরে।
আর কতদূর বাকি আছে আমাদের সমবেত কবিজন্ম, হে সাদা পাহাড়ের ঈশ্বর?
.
১৯/১২/১৯৭০
পার্থ,
নতুন দশক তাহলে তোর কবিতার বই দিয়েই শুরু হলো, কী বল? এপ্রিলে কলকাতা যাবার ইচ্ছে আছে, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের শুওরের ঝোল খাওয়াবি, মনে থাকে যেন। তবে শুধু এটুকুতেই কি আর উদযাপন শেষ হবে আমাদের? আগেরবার মেটিয়াবুরুজের একটা বেশ্যাপট্টিতে প্রচুর ফূর্তিফার্তা হয়েছিল, ছিলিস না সেবার, স্বাভাবিক, তুই তো আর যাবি না ওসব জায়গাতে। টকটকে লাল মাংসের ঝোল আর মোটা মোটা পোড়া রুটি, সঙ্গে লংকার আচার, লেবুর রস দিয়ে বাংলা। তবে বাদ দে এসব। তোকে নিয়ে সারারাত তোদের গঙ্গার কীসের ঘাটগুলো আছে, বড়বাজারের দিকে, ওগুলোতে ঘুরব, আর চিৎকার করে করে তোর বইটা থেকে কবিতাগুলো পড়ব সারারাত, আর যারা জেগে থাকবে তাদের দেখিয়ে বলব— দেখুন শ্রদ্ধেয় বানচোদের দল, আমার বন্ধুর কবিতার বই দিয়ে দশক শুরু হলো। যারা ঘুমাবে, তাদের কানের কাছে গিয়ে তারস্বরে ফাটিয়ে বলব— পতনজাত ভয় রুদ্ধনিশ্চয় শঙ্কাশীল / লোল লেলিহান কৃষ্ণ খরশান রক্তাবিল — কী সব লিখেছিস শালা! এভাবে অন্য গ্রহের ভাষায় লিখতে পারে কেউ? বাকি কথা কলকাতা গিয়ে। দামী মদ খাবো তোর ঘাড় ভেঙে।
তিনটে কবিতা পাঠালাম। দরকার পড়লে এডিট করে নিস। জামশেদপুরের কমলকে দুটো পাঠাতে বলেছে, ওখানকার কাগজের জন্য। চমৎকার লিখছে ছেলেটা। ওর কালিমাটি রোড বলে একটা কবিতা পড়ে হাঁ হয়ে যাচ্ছি। আর শোন, অরুণকে আবার বলিস না তোর থেকে টাকা নিয়েছিলাম। ও শালা ফালতু গরম নেবে আমার ওপর। এমনিতেই হুমকির ওপর রেখেছে, মদ না কমালে বোতল ভেঙে পেটে ঢুকিয়ে দেবে। আমি কলকাতায় গিয়ে টাকাটা দিয়ে দেব।
.
কখনো মনে হয় স্ক্যাপরুমে দীর্ঘ বসে আছি, চারিদিকে নষ্ট যন্ত্রপাতি
ভাঙা লেড জং ধরা স্ক্যাংক ক্রাফট পড়ে
এদের এড়িয়ে গিয়ে অন্য কোনো শহরের কথা
আর ভাবা যায় না তেমন
–কমলের কালিমাটি রোড। যদি না পড়ে থাকিস। স্বদেশ সেনও জামশেদপুরের না? একে একদমই চিনি না, বয়েসে অনেক বড়ো শুনেছি। তোর আলাপ আছে?