শেষ মৃত পাখি – ৫

বনের কাছে 
বারুদজ্বলা মাটি 
মাটিতে কার নাম রেখেছিল পুরনো বন্ধুরা। 
চিতাবাঘের 
থাবায় ছেঁড়া পাথর 
পাথরে বুক পেতেছিল পুরনো বন্ধুরা। 

—অমিতাভ গুপ্ত 

.

হোটেলে ফিরে অমিতাভর লেখাটা পড়তে পড়তে চোখ ধরে এসেছিল বলে আলো জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাঝরাতে জানলার কাচে বৃষ্টির চটাপট শব্দে চমকে উঠে বসলাম। পাহাড়ি বৃষ্টির আওয়াজ এবং গন্ধ অন্যরকম হয়। অন্যরকম, এবং শহুরে কানের পক্ষে তীব্র। মোবাইল বলল, রাত চারটে। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বাতি নিভিয়ে বিছানায় এসে খেয়াল করলাম, জানলার বাইরে থেকে ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পিছলে যাচ্ছে বিছানায়। আবার উঠতে হলো, এবং পর্দা টানতে গিয়ে থমকালাম। 

রাস্তার উলটোদিকে ল্যাম্পপোস্টের নীচে রেনকোট পরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছায়ামূর্তি। আমার জানালার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। আলোর উৎসের দিকে পিঠ, তাই মুখ দেখা যাচ্ছে না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। দুজনেই একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছি। চৌধুরী ভিলা যাবার সময়েও একটা ছায়ামূর্তিকে দেখেছি। একইভাবে আমাকে লক্ষ করে যাচ্ছিল। দুজনেই কি এক লোক? বুঝতে পারছিলাম, পা আমাকে ইঞ্জিনের মতো টানছে। দরজা খুলে বাইরে, সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে লাউঞ্জ, এবং রাস্তা পেরিয়ে ল্যাম্পপোস্টের নীচে। চাইছে, মুর্তিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। হাত মুঠো করলাম নিজের অজান্তে। তারপর পর্দাটা টেনে দিলাম। ঘুমোতে হবে। যদি আজকের রাত না ঘুমোই, কাল থেকে কাজ শুরু করতে পারব না। 

যখন আবার চোখ মেললাম, সাড়ে ছটা বেজে গেছে। পর্দার বাইরে আবছা একটা আলো ফুটেছে, আর ঝির ঝির করে বৃষ্টি। ভারী কুয়াশার কম্বল বিছিয়ে আছে রাস্তা, বাড়ি, পাহাড়ের গায়ে। ল্যাম্পপোস্টের আলো তখনো জ্বলছে। নীচে কেউ নেই। 

কালকের ঘটনা, এবং ছায়ামূর্তিকে নিয়ে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এতই আনমনা ছিলাম যে লাউঞ্জে ব্রেকফাস্ট করবার সময়ে সামনে যে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে, এবং ‘এক্সকিউজ মি’ বলেছে দু-বার, তা খেয়াল করিনি। টেবিলের উপর আঙুলের ঠকঠক শব্দে চটকা ভাঙল। 

লম্বাটে এবং রোগা এক তরুণ। বয়েস মেরেকেটে তিরিশ। খোঁচাখোঁচা দাড়িতে ছেয়ে আছে চোয়াল। ভাঙা নাক। একমাথা এলোমেলো চুল। চোখদুটো উজ্জ্বল। বাম গালের পাশে একটা কাটা দাগ। গায়ে ওভারকোট, গলায় মাফলার। হাতে ধরা লম্বা ছাতা থেকে জল পড়ছে টপটপ করে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে, দেখে মনে হলো কিছুটা বিরক্তও, কারণ আমি সাড়া দিতে দেরি করেছি। 

‘আমার নাম সিদ্ধার্থ। আমার কাকা, মানে অরুণ চৌধুরী কাল রাত্রে আমাকে ফোন করে আপনার কথা জানিয়েছিলেন। বললেন, আমি যেন পারলে একবার দেখা করি, কারণ আপনার স্টোরির জন্য যদি দরকার পড়ে, তাহলে লোকাল হিসেবে হয়তো সাহায্য করতে পারব। অবশ্যই আপনার যদি দরকার মনে হয়।’ ছেলেটা গম্ভীর, এমনকি সৌজন্যের হাসিটুকুও নেই। বাইরে তাকালাম। কুয়াশার চাদর পাতলা হয়েছে। 

বর্ষাতে দার্জিলিং-এ এমনিতেই কম টুরিস্ট হয়। লাউঞ্জে আমি বাদে আর একজন বিদেশী বয়স্ক মহিলা বসে আছেন। আর আছে এক বাঙালি দম্পতি। তাদের বাচ্চাটা খেলে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। মহিলা পৃথুলা। মাথায় সিঁদুর, হাতে শাঁখা-পলা, এবং পরনে চোখে লাগার মতো টাইট জিন্স। এই পরিবারটা অনাবশ্যক নিজেদের মধ্যে বাঙালি টানে ইংরেজিতে কথা বলছে। এমনকি বাচ্চাটাকেও তার মা বলছে, ‘বুবুন, সিট হিয়ার। ডোন্ট বি নটি।’ আর বাচ্চাটা বাংলাতে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। ভদ্রলোকের চেহারা ভালোমানুষের মতো। শীর্ণকায়, মাথার সামনের দিকে একটা ছোট্ট টাক। লোমশ থাই চেপে বসা হাফপ্যান্ট। বাচ্চাটা খেলতে খেলতে এদিকে চলে এসেছিল, ধাক্কা খেল সিদ্ধার্থর হাঁটুতে সিদ্ধার্থ ফিরেও তাকাল না, শুধু আলতো সরে গেল। রোবট নাকি? না জন্মগত খিটখিটে? 

‘আচ্ছা, আমি জানতাম না আপনার কথা’, হাত বাড়িয়ে দিলাম। অরুণ চৌধুরীর দুই দাদা আছে জানতাম, যাঁদের একজন বিদেশে, অপরজন চা বাগানের ব্যবসা সামলান। তাঁদের ছেলেপুলের ব্যাপারে খবর নিইনি। 

‘আমি এখানে থাকি না। ছুটিতে এসেছি। আমার বাবার বাড়ি ম্যালের কাছে, তবে ছুটির বেশিরভাগ সময় কাকার বাড়িতেই থাকি।’ 

‘আপনি কি কলকাতায় থাকেন?’ 

‘না। ডাবলিন। কিন্তু আমার কথা থাক এখন।’ সিদ্ধার্থ তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো আমার দিকে। পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটছি বলে অরুণ চৌধুরীর পরিবার চটে আছে। ছেলেটা তখনও দাঁড়িয়ে। এবার সচেতন হয়ে উঠলাম, ‘বসুন।’ উলটোদিকের চেয়ারের দিকে ইশারা করলাম। সিদ্ধার্থ ইতস্তত করছিল, তারপর বসল, ‘আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছিলাম স্টোরির খাতিরেই, কারণ আপনাদের সবাইকেই ইন্টারভিউ দিতে হবে।’ 

তামাকের পাউচ বার করল সিদ্ধার্থ, সিগারেটের কাগজের ভেতর তামাক পুরে পাকাতে লাগল নীরবে। তারপর কী মনে হতে সৌজন্যের ঠোঁট টিপে বলল, ‘আশা করি আপনার ব্রেকফাস্টে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছি না?’ 

‘না না একদমই না। একটা কফি নিন?’ 

‘চা। থ্যাঙ্ক ইউ।’ 

‘ডাবলিন আমার প্রিয় শহর। যদিও যাইনি কখনও। জেমস জয়েস, শেমাস হিনি…’ 

সিদ্ধার্থ মাথা নাড়ল, ‘ট্রিনিটি কলেজের যে বিল্ডিং-এ আমার অফিস, তার নাম জেমস জয়েস লাইব্রেরি। ওটা বহু বছর আগে, একটা পাব ছিল, জয়েস সেখানে মদ খেতে আসতেন। জয়েস ওদের জাতীয় অহংকার বলতে পারেন।’ 

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সিদ্ধার্থকে ভালো করে দেখলাম আবার। অরুণ চৌধুরীর বংশের সবাই বেশ সুপুরুষ, মানতেই হবে। 

‘আমি আপনার ভার্সনটাও শুনতে আগ্রহী, সিদ্ধার্থ। মানে আপনি কীভাবে কাকাকে দেখেছেন, ঘটনাটাকেও। যদিও, মনে হয় আপনি তখনো জন্মাননি।’ 

‘আমি ছোটোবেলা থেকে কাকা আর কাকিমার খুব কাছের। বেশিরভাগ দিন ওদের বাড়িতেই কাটাতাম। এখনও ছুটিতে এসে ওখানেই থাকছি অনেকটা সময়। কাকিমার প্রভাবে অঙ্কের প্রতি উৎসাহ হয়েছিল। আর তাই পিএইচডি- তে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বেছে নেওয়া। কাকা আমাকে বই পড়াত। শুধুই রহস্য গল্প না। দেশবিদেশের সাহিত্য, ইতিহাস আর সিনেমা সংক্রান্ত বই। দেখেছেন হয়তো, বিশাল কালেকশন। 

‘আপনি কি একমাত্র সন্তান? কিছু মনে করবেন না, এগুলো স্টোরিতে লাগবে।’ 

‘আরও দুই দাদা আছে, যারা আমার থেকে বয়সে অনেকটা বড়ো। কেউই এখানে নেই, একজন কলকাতা আরেকজন হায়দ্রাবাদ। তবে হয়তো আমিই কাকার বেশি কাছের, ছোটোবেলা থেকেই। যদিও জানি না, আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কীভাবে আপনার গল্পে কাজে লাগবে।’ 

ঠোঁট কামড়ালাম। একটা খড়খড়ে ভাব, ফাটছে। সকালবেলা লিপগ্লস লাগাতে ভুলে গিয়েছি, এত অন্যমনস্ক ছিলাম। সিদ্ধার্থ যদি আমাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকে, সরাসরি কথা বলে নেওয়াই ভালো.. ‘কিছু মনে করবেন না। একটা প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি। আমার ওপর কোনো কারণে আপনি বা আপনারা বিরক্ত? অথবা, এমনটা কি হয়েছে যে আমার আসাতে খুশি নন? 

‘আপনি নিজের কাজ করতে এসেছেন। আমার আর কী বলার থাকতে পারে।’ 

‘আপনার কাকার অনুমতি নিয়েই এসেছি।’ 

‘তাহলে তো মিটেই গেল।’ 

‘কিন্তু তবুও, সিদ্ধার্থ, যদি কোনো কিছু আপনার মনে হয়, আমাকে স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। আমি পেশাদার সাংবাদিক’, অল্প হাসলাম, ‘কিছুই মনে করব না, এমনকি যদি মনে হয় এখানে ওয়েলকাম নই, তাতেও কিছু সমস্যা নেই। শুধু আগে থেকে জেনে রাখলে ভালো হয়।’ 

পাকানো সিগারেট হাতে চায়ে চুমুক দিল সিদ্ধার্থ। মুখ থেকে থমথমে ভাব কাটছে না। ‘আমি, কাকিমা, আমরা কেউ চাইনি, আপনি আসুন। কারণ যা ঘটে গিয়েছে, যার জন্য চুয়াল্লিশ বছর ধরে একটা মানুষ সাফার করেছে, তার যন্ত্রণা আমরা আর বাড়াতে চাইনি। অতীত খুঁড়তে কেউ ভালোবাসে না মিস ভটচাজ! কাকা আমাদের কথা মেনে নিয়েছিল, বারণও করেছিল আসতে। কিন্তু তারপর নিজেই মত পালটালো, জানি না কেন! আপনার ওপর রাগ বা অসূয়া নেই আমার। যদি সেরকম কিছু ব্যবহারে প্রকাশ পেয়ে থাকে, দুঃখিত। আমি বিরক্ত এই গোটা ব্যাপারটা নিয়েই।’ 

চুপ করে থাকলাম। কী-ই বা বলার থাকতে পারে এক্ষেত্রে। 

‘আপনি যে রহস্যের সন্ধানে এসেছেন, সেটা সারাজীবন কাকাকে তাড়া করে বেরিয়েছে। রাত্রে ঘুমোয় না ভালো করে। বহু রাত আচমকা ঘুম ভেঙে দেখেছি কাকার ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরে ঢুকে দেখেছি কাকা জেগে বসে আছে। বাগানের দিকে তাকিয়ে। এত চুপচাপ, মনে হতো ধ্যান করছে। পা টিপে টিপে ঘরে ফিরে এসেছি। কোনো কোনো রাতে দেখেছি, পুরোনো খবরের কাগজের কাটিং জমানো ফাইলগুলো বার করে পড়ছে।’ মাথা নাড়ল নিজের মনে, ‘অনর্থক, এই বারবার অতীতে ফিরে যাওয়া। কী লাভ এতে!’ 

সিদ্ধার্থর দেখাটা মূল্যবান। লেখার কাজে লাগবে। 

‘আমি বেশ কিছুদিন এই টাউনের বাইরে। মাস্টার্স করতে ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে চলে যাই। এক বছর চাকরিও করেছিলাম। তারপর ওখান থেকেই পিএইচডি-র ডাক পেয়ে ডাবলিন। প্রায় সাত বছর হয়ে গেল দার্জিলিং ছাড়া। এখন ছুটিছাটায় আসি। কিন্তু প্রত্যেকবার যখন দার্জিলিং-এ পা দিই, ভয় লাগে। মনে হয় এমন কিছু ঘটে গেছে এর মধ্যেই, জানি না, হয়তো আবার কিছু নতুন করে আবিষ্কার হয়েছে, সেটা এতই শকিং যে আমাদের বাড়িটা আবার একটা না বলা শোক, ভয় আর আশঙ্কার ভেতর ডুবে গিয়েছে। আমার জন্মের কত আগেকার ঘটনা, সেটা যদি আমাকেই এভাবে তাড়া করে, তাহলে কাকাকে কী করছে। আপনার এখানে আসা একটা ভাবেই অর্থবহ হতে পারে, যদি কোনো সমাধান দিতে পারেন।’ 

‘আমি তো সমাধান করতে আসিনি। একটা স্টোরি করতে এসেছি।’ 

সিদ্ধার্থ হাতের পাকানো সিগারেট ঘোরাতে লাগল অন্যমনস্কভাবে। বাড়িতে মাঝে মাঝে এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা উঠতো, ছোটোবেলায় তো আরও বেশি। কাকা কোনো মন্তব্য করত না। শুধু একবার কী একটা কথার সূত্রে জিজ্ঞাসা করে ফেলেছিলাম, ‘এখনও কি তুমি এই ঘটনাটা নিয়ে ভাবো?’ কাকা অনেকক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিয়েছিল, ‘ওল্ড সিনস্ হ্যাভ লং শ্যাডোজ। পাপ পুরোনো হলে তার ছায়া দীর্ঘ হয়।’ মেঘ আর কুয়াশার যুগলবন্দী সকালটার ওপর আবছা অন্ধকার ঝামরে দিয়েছে। ম্যাল রোডে টুপটাপ জোনাকির মতো ফুটে উঠছে পথচারীর দল। চুয়াল্লিশ বছরও কি যথেষ্ট দীর্ঘ ছায়া নয়, মিস ভটচাজ?’ 

‘কিন্তু যদি একদিন আবিষ্কার করেন যে, আপনার কাকাই হত্যাকারী? সেই সত্যি কি আপনি দেখতে চান?’ 

সিদ্ধার্থ স্থির চোখে আমার দিকে তাকাল। চোখ দুটো অরুণের মতোই। হারিয়ে যাওয়া, ভাসা ভাসা। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আপনি হয়তো বুঝছেন না, আমাদের পরিবারে কী ঘটে গেছে এতগুলো বছরে, অথবা আমরা এগুলো নিয়ে কী ভাবি। আপনার কি মনে হয় এই সম্ভাবনা আমার মাথাতে নেই? আমাদের কারোর মাথাতে নেই? কিন্তু তাতেও, হয়তো কাকার প্রতি একটা বায়াস আমার থেকেই যাবে। শেষ দিন পর্যন্ত। আমার তো বড়ো হওয়া কাকার হাত ধরে। কাকাই সেই মানুষ যে আমাকে প্রথম বলেছিল, মনের জানালাগুলো সব খুলে রাখবি। খুলে ফেলতে পারলে দেখবি তোর জন্য সারা পৃথিবী অপেক্ষা করছে। হেমিংওয়ে অপেক্ষা করছে। টুরিং টেস্ট আছে। গডেলের উপপাদ্য আছে। পিজি উডহাউস আছে। নেভিল কার্ডাস আছে। অত ছোটো বয়সে আমাকে তো কেউ এগুলো বলেনি! বাবা মা-ও নয়। আমি গডেলের নাম জেনে গেছি তার কাজ বুঝবার দশ বছর আগেই। কাকা কাফকা পড়তে দিয়েছিল, দ্য ট্রায়াল। তখন আমি পনেরো। এই লোকটা যদি খুনি হয়ও, আমি কতটা নির্দয় হতে পারব? ঠিক জানি না, মাঝে মাঝে নিজেরই সন্দেহ হয়, আমিও তখন অপরাধীর পক্ষ নিয়ে ফেলব না তো?’ 

অজান্তেই আমার আঙুল আবার ডান হাতের পোড়া দাগটার ওপর চলে গিয়েছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘আর অমিতাভ মিত্র? তাঁর সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য নেই?’ 

‘কী করে থাকবে? আমি কি লোকটাকে দেখেছি?’ 

‘কিন্তু আমার স্টোরিতে অমিতাভকে খোঁজাটাও যে একটা জরুরি অধ্যায়। আবার মনে পড়ল কেবল সাহেবের কথা। দাজির্লিং নিয়ে পাতার পর পাতা কবিতা চন্দনের ফোঁটার মতো সেই কবে আমার কপালে সাজিয়ে দিয়েছিলেন এক অজ্ঞাত কবি। আপাতত পোড়া ব্রিটিশ বাংলো, গথিক ছাদের মিনার, লোহার রেলিং, আর্দ্র পাইনের চামড়া, পাহাড়ের গায়ে শ্যাওলা ধরা সিঁড়ির স্মৃতিতে যে ভেজা দার্জিলিং আটকে আছে, সেটুকুও কি জন কেবল নয়? অথবা, অমিতাভ মিত্র? 

সম্ভবত কবিতা বা অমিতাভ কারও প্রতিই সিদ্ধার্থর উৎসাহ নেই। ভুল ভেবেছিলাম। ও ঠিক আমার প্রতি অসূয়া পোষণ করছে না। স্বভাবটাই গম্ভীর, আত্মনিমগ্ন টাইপ। কঠিন কঠিন অঙ্ক করে করে বোধহয় স্বাভাবিক উচ্ছ্বলতা মরে গেছে। ঘড়ি দেখলাম। এবার বেরোতে হবে। কিন্তু আগে তো চৌধুরী ভিলা যাবো না। আগে যাবো পাশের কটেজে। ‘মিসেস বাসু বেঁচে আছেন কি?’ ‘ভীষণ খিটখিটে মহিলা ছিলেন।’ সিদ্ধার্থ মাথা নাড়ল, ‘বেঁচে নেই। আমার ছোটোবেলাতেই মারা গিয়েছেন। তবে তাঁর ছেলে এখনও আছেন।’ ইতস্তত করে বলল, ‘আপনি চাইলে আমি থাকতে পারি। আমাকে চেনেন। 

উত্তর দিতে সময় লাগল। মনে মনে ভেবে নিচ্ছিলাম সিদ্ধার্থ সঙ্গে থাকার সুবিধে-অসুবিধেগুলো। মদনদা আছেন ঠিকই। স্থানীয় মানুষ তিনিও। কিন্তু তিনি এতকিছু জানবেন বলে মনে হয় না। অন্যদিকে সিদ্ধার্থ ছোটোবেলা থেকে এই রহস্যের সঙ্গে বড়ো হয়েছে। তার ওপর সে এই শহরেরই ছেলে। দেখার একটা অন্য চোখ থাকলে আমার গল্পে কিছু বৈচিত্র্য আসতে পারে। তবে সমস্যাটা হল, একটি মেয়েকে অযথা পেট্রনাইজ করবার প্রবণতা আছে অধিকাংশ পুরুষের। বিশেষ করে এই সদাবিরক্ত খিটখিটে টাইপটার। সারাক্ষণ আমার কাজের খুঁত ধরতে পারে, অথবা গম্ভীর মুখে হয়তো এমন তাকালো, মনে হলো আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোকা। সে অসহ্য হবে। কিন্তু একটা সুযোগ দিয়ে দেখাই যায়। 

‘ভালোই হবে আপনি থাকলে। আজ বাদেও, সামনের কয়েকদিন অনেকগুলো জায়গাতে যেতে হবে। আপনি হয়তো চিনবেন সেগুলো। যদি থাকেন, আমারই উপকার হয়।’ 

মদনদা বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। গাড়িতে সিদ্ধার্থকে বললাম, ‘আমার তালিকায় মিসেস বাসু ছাড়াও কয়েকজন আছেন যাঁদের কাছে যেতে হবে। একজন হলেন প্রশান্ত গুরুং।’ 

‘নাম শুনেছি অনেক। কিন্তু লাভ নেই। বহু আগে দার্জিলিং ছেড়ে পরিবার নিয়ে চলে গেছেন। এখন সম্ভবত দেশের বাইরে।’ 

‘পুলিশের রিপোর্টে দুজনের নাম পাচ্ছি। একজন, তখনকার চকবাজার থানার ওসি, ড্যানিয়েল লামা। আর অন্যজন, সাব ইন্সপেক্টর ধনরাজ গম্বু।’ 

‘ধনরাজ গম্বুকে ছোটোবেলায় দেখেছি। শেষের দিকে ডিএসপি হয়েছিলেন। জনপ্রিয় ছিলেন এই টাউনে। ইনিও মারা গেছেন। কিন্তু আর একটা যে নাম বললেন, এটা চেনা লাগছে না। কাকাকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন।’ 

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এত পুরোনো ঘটনা, প্রত্যক্ষদর্শীরা বেশিরভাগই আর নেই। কী স্টোরি দাঁড় করাব? 

‘সিদ্ধার্থ, যেটা সমস্যা লাগছে, খটকা বলতে পারেন, সেটা পুলিশ রেকর্ড নিয়ে আমি দিল্লি থেকে সোজাসুজি নয়, কলকাতা হয়ে আসছি। আসার আগে কলকাতায় রাজ্য পুলিশের আর্কাইভ থেকে কিছু নথি জোগাড় করেছিলাম। বাকিটা সদর পুলিশের লাইব্রেরি থেকে মিলবে, বলা হয়েছিল। তো, যেটুকু পেয়েছিলাম, তাতে যা দেখছি, ড্যানিয়েল লামা ঘটনাটার তদন্তকারী অফিসার ছিলেন। এই মাপের কেস তাঁরই হ্যান্ডেল করবার কথা। পুলিশ রিপোর্টও তাঁর লেখার কথা। সেটাই প্রথম কয়েকদিন হয়েছিল। কিন্তু ২৩ জুনের পর থেকে দেখছি, সব রিপোর্ট লিখছেন ধনরাজ গম্বু। তাহলে কি কেস হ্যান্ডওভার হলো? হলে, কেন? ড্যানিয়েল লামাকে সরিয়ে দেওয়া হলো কেন? রিপোর্টে সেসব কিছুর উল্লেখ নেই। এমনকি ড্যানিয়েল লামা সম্বন্ধে আর একটা শব্দও কোথাও লেখা হয়নি।’ 

সিদ্ধার্থ কাঁধ ঝাঁকাল, ‘এই নামটাই প্রথম শুনছি। সঞ্জয় অধিকারীকে জিজ্ঞাসা করেননি এই বিষয়ে? মানে সেই সাংবাদিক, যিনি এই নিয়ে এত লিখে গেছেন? খবরটা তো তিনিই ব্রেক করেছিলেন।’ 

ম্লান হাসলাম। ‘সঞ্জয় অধিকারীও দুই বছর আগে মারা গিয়েছেন।’ 

ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে গাড়ি সাবধানে উঠে এল জলাপাহাড়ের ধাপে দুরে মিসেস বাসুর বাড়ি। 

.

মিসেস বাসুর ছেলে বীরেশ্বর বাসুর বয়েস প্রায় পঁয়ষট্টি। খিটখিটে মেজাজ। গাল তুবড়ে গেছে। মাথায় চুল নেই বললেই চলে। রোগা হাড়সার শরীরের ওপর এই সকালবেলা কল্কাদার পাঞ্জাবি চড়িয়েছেন, যেন বিয়েবাড়ি যাবেন। 

‘এতদিন আগেকার কথা, মনে থাকে নাকি?’ খিঁচিয়ে বললেন বীরেশ্বর। আমরা বসে আছি বাড়ির লাউঞ্জে। শোকেসের কাচে ধুলোর আস্তরণ। সোফায় বসবার পর ক্যাঁচ করে আর্তনাদ করে উঠল। একটা জানলার কাচ ভাঙা। তার ওপর তাপ্পি মারা হয়েছে কাগজের। 

‘আপনি তখন কি বাড়িতেই ছিলেন?’ 

‘নাহ। আমি কলকাতায় গোয়েঙ্কা কলেজে কমার্স নিয়ে পড়ছিলাম। দেখুন, মা- কে আপনারা বেঁচে থাকতে অনেক জ্বালিয়েছেন। পুলিশ, প্রেস, উটকো লোক হুটহাট করে বাড়ি ঢুকে পড়ত। মা শেষদিকে এতই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল যে অচেনা কারোর সঙ্গে দেখাই করত না। আমারও সময় নেই ফালতু ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার। নিজের ব্যবসা নিয়ে থাকি। অরুণ চৌধুরীরা তো এলিট! শিক্ষিত, উন্নাসিক। আমাদের সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেন না। মিথ্যে বলব না, অভদ্রতা করেননি কোনোদিন। কিন্তু শিক্ষার অহংকার বোঝেন? শিক্ষার অহংকারে মটমট করছে! এসব এলিট সমাজের কেচ্ছা নিয়ে আমি কোথা থেকে জানব?’ 

সিদ্ধার্থকে আড়চোখে দেখলাম, প্রাণপণে মনোযোগ দিয়ে টিভির গায়ে লাইন করে হাঁটা পিঁপড়ের সারি দেখছে। বীরেশ্বরবাবুও এত খিটখিটে মেজাজে আছেন যে সিদ্ধার্থর কথা তাঁর মনেও নেই। শুরুতে একবার ভালো তো?’ বলা ছাড়া ওর দিকে ফিরেও তাকাননি। আবার চেষ্টা করলাম, ‘মা কিছু বলতেন না? মানে, এই ধরুন ঘরোয়া আড্ডায়, বা খাবার টেবিলে? যা দেখেছিলেন সেই নিয়ে কিছু?’ 

‘কী আর নতুন করে বলবে! পুলিশকেই তো যা জানার জানিয়ে দিয়েছিল। আর অত পুরোনো ঘটনা, মনেও নেই।’ 

‘না, মানে শেষবয়সে এসে তো অনেকে অতীতের স্মৃতিচারণ করতেন। বা আপনার বাবাকে জানিয়ে যেতে পারতেন কিছু। সেরকম কিছু জানেন?’ অজান্তে গলার স্বরে একটা ব্যগ্রতা চলে এসেছিল আমার। 

‘এটা কি জেরা হচ্ছে?’ খেঁকিয়ে উঠলেন বীরেশ্বর। 

ভুল রাস্তায় চলেছি। গলা নরম করে বললাম, ‘আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ। জানি, অতীতের স্মৃতি নিয়ে আবার নাড়াচাড়া করলে আপনার ভালো লাগবে না। আমি একদমই জেরা করছি না। শুধু অনুরোধ করছি, যদি কিছু মনে পড়ে আপনার।’ 

এবার নরম হলেন বীরেশ্বর। মাথা নাড়িয়ে হুঁ বলে চিন্তা করলেন একটু। তারপর বললেন, ‘নাহ্, কিছুই মনে নেই। মা-ও পরে আর এগুলো নিয়ে বিশেষ কথা বলেনি। আমার আগ্রহ ছিল না। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আমার ভাই, সে বহুদিন আগেই অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। তাকে কিছু বলে থাকলে, জানি না। কিন্তু আমাদের মধ্যে এসব নিয়ে কথা হতো না।’ বলে আনমনা হয়ে গেলেন। 

এরপর আর কিছু বলার থাকে না। ব্যাগের ভেতর খাতা পেন পুরে সিদ্ধার্থকে চোখের ইশারা করলাম। ‘ধন্যবাদ মিস্টার বাসু। আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম।’ 

দরজার বাইরে পা ফেলেছি, মিস্টার বাসু নিজের মনেই বললেন, ‘অরুণ কিছু খুঁজছিল।’ 

আমি পিছু ফিরলাম, ‘কিছু বলছেন?’ 

‘মা বলেছিল, অমিতাভ মিত্র বেরিয়ে যাবার পর, বাগানের মাটিতে ঝুঁকে পড়ে অরুণ চৌধুরী কিছু একটা খুঁজছিল। অল্প সময়ের জন্য। তারপর বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। এটুকুই। আর কিছু মনে পড়ছে না।’ 

কী খুঁজছিল? মা কিছু বলেছিলেন?’ 

‘উঁহু, মা শুধু দেখেছিল অরুণ মাথা নীচু করে খুঁজছে। কী, সেটা বুঝতে পারেনি।’ 

.

কাল সন্ধের অন্ধকারে খেয়াল করিনি। আজ দেখলাম, অরুণ চৌধুরীর বাড়ির যেদিকে গেস্টহাউস, তার উল্টোদিকে একটা বারান্দা আছে। চারপাশে রেলিং দিয়ে ঘেরা, উপরে টালি। অরুণ চৌধুরী সেখানে বসে দাবা খেলছেন। নিজের সঙ্গে নিজে। গভীরভাবে তাকিয়ে আছেন বোর্ডের দিকে। আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, বাবা আমাকে দাবা খেলা শিখিয়েছিল। কিন্তু বারবার হেরে যেতাম। বাবা মূলত বিভিন্ন ধরনের চাল শেখাত। বারবার হেরে গেলে যাতে মনখারাপ করে খেলাটা ছেড়ে না দিই, তার জন্যে বাবা নিজেও অনেকসময়ে ইচ্ছে করে হেরে যেত। অরুণ কি প্রতিদিন নিজেকেই হারাবার সংকল্প নিয়ে ঘুম থেকে ওঠেন? 

‘কাকা!’ 

আমি আর সিদ্ধার্থ বড়ো ছাতাটার নীচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অরুণ মুখ তুলে আমাদের দেখে হাসলেন। 

সিদ্ধার্থ হাতের ছাতা গোটাতে গোটাতে বলল, ‘কাকিমার ওষুধটা এনেছি। আজ কেমন আছে?’ 

‘সকাল থেকে অনেকটা ভালো। যা গিয়ে দেখা করে আয়। ঘরে শুয়ে আছে।’ 

অরুণের দিকে ফিরলাম, ‘কাল আপনাকে বলেছিলাম, আজ সকালবেলা আসবো। তার কারণ গোটা জায়গাটা একবার ঘুরে দেখতে চাই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে, কিছু ছবি তুলব। আমার ফটোগ্রাফার আগামীকাল শিলিগুড়ি থেকে আসবেন। আসার আগে তাঁর কাছে সম্ভাব্য সমস্ত ফটোর স্যাম্পেল এবং তাদের লোকেশান পাঠাতে হবে। সেই ফটোগুলোর মধ্যে আপনার বাড়ির ছবিও আছে। সম্ভাব্য ক্রাইম স্পটের ছবি তো, ওটা থাকতেই হবে গল্পের সঙ্গে।’ 

‘আপত্তি নেই। আসুন।’ অরুণ হাত বাড়ালেন। 

বাড়িটার পেছনে অনেকখানি বাগান। ঢালু হতে হতে নীচে নেমে গেছে। সেই নীচু জায়গাটায় একটা সরু পায়ে চলা পথ, আর বাকিটা ঝোপঝাড়ে ভর্তি। সেটা পেরিয়ে পাহাড়ের আর একটা শিরা, যার ওপর আবার বেশ কিছু বাড়ি। চৌধুরী ভিলার গেস্টহাউসটা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বাড়ি বলা যায়। ভেতরে কিচেন, ছোটো বাথরুম, একটা বেডরুম। কিচেন দিয়ে লাগোয়া স্টোররুমে যাওয়া যায়। স্টোররুমের আর একটা দরজা পেছনের বাগানের দিকে মুখ করে। স্টোররুমের ভেতর দেখলাম, অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে রাশি রাশি পুরোনো ম্যাগাজিন, ছেঁড়া বইখাতা। ইতিউতি ঘুরতে গিয়ে কয়েকটা খাতায় চোখ পড়ল। জটিল গাণিতিক ফর্মুলাতে ভর্তি। অনন্যা চৌধুরী এই বয়সে এসেও সক্রিয়! 

মুল বাড়ির অন্যপ্রান্তে বাইরে দিয়ে বাহারি ঘোরানো সিঁড়ি দোতলার ব্যালকনিতে উঠে গেছে। দোতলায় উঠিনি কাল, তবে চোখের হিসেব দিয়ে মনে হলো, প্রায় দেড় হাজার স্কোয়ার ফিটের বাড়ি। ওপরে খান তিনেক ঘর থাকার কথা। নীচের তলাটা শুধুই কিচেন, ডাইনিং রুম এবং লাউঞ্জ। 

‘আমরা বেশ কয়েক পুরুষ আগে মুর্শিদাবাদ থাকতাম। আমার প্রপিতামহ স্বৰ্গীয় অনাদিচরণ চৌধুরী ছিলেন কুচবিহারের রাজবাড়ির ব্যক্তিগত চিকিৎসক। সেই সময়ে তিনি পরিবার নিয়ে রাজপ্রাসাদে থাকতেন। একবার ছোটো রাজকুমারের লিভারের জটিল অসুখ সারিয়ে দেওয়ার পর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মহারাজা তাঁকে কিছু ধনসম্পদ উপহার দিয়েছিলেন। অনাদিচরণ ছিলেন দূরদর্শী পুরুষ। আর উত্তরবঙ্গ তাঁর ততদিনে ভালো লেগে গিয়েছিল। তিনি মুর্শিদাবাদ ফিরলেন না। 

নিজের সম্পদ বিনিয়োগ করলেন দার্জিলিং-এ। দার্জিলিং তখন ব্রিটিশ ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। ঐশ্বর্য ও রাজকীয়তার স্নায়ুকেন্দ্র। অনাদিচরণ দুটি চা- বাগানের শেয়ার কিনলেন। অংশীদারিত্বে ব্যবসা শুরু হলো। তারপর দার্জিলিং- এ কিছু জমি কিনে সেখানে থিতু হলেন। আমাদের যে মূল বাড়ি, সেটা অনাদিচরণেরই বানানো। সেটা ছিল ফুলবাড়িতে। ১৯০৫ সালে বানানো হয়েছিল। সে ছিল প্রায় প্রাসাদের মতো বাড়ি। বাবা একমাত্র সন্তান ছিলেন। অত বড়ো বাড়ি দেখভাল করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি সেই বাড়ি বিক্রি করে দিলেন এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীকে, এবং তার পরিবর্তে এক এক করে তিনখানা ছোটো কটেজ আমাদের তিন ভাইয়ের জন্য বানালেন। বড়দা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন। আর ফেরেননি। আমিও আমার চা-বাগানের শেয়ার অন্য দাদা, মানে সিদ্ধার্থর বাবার কাছে বিক্রি করে দিলাম। বর্তমানে বড়ো ভাইয়ের কটেজটা বিক্রি হয়ে গেছে। দাদার ছেলেমেয়েরাও ফিরতে চায় না দেশে। আছি আমি আর মেজদা। এই বাড়ি বাবা বানিয়েছিলেন ১৯৫৫ সালে। আমি তখন আট।’ 

অরুণ কথা থামিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। খেয়াল করিনি। নিজের মনে ঘুরছিলাম। তারপর একসময়ে দেখি অরুণ নেই। পেছন ফিরলাম। অরুণ দূরের পাহাড়ের দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে অচঞ্চল দাঁড়িয়ে আছেন। 

‘হয়ে গেছে। ধন্যবাদ।’ 

অরুণ ঘাড় ঘোরালেন। ‘বাগানে গিয়ে বসি তাহলে?’ 

বাগানের ধারের বারান্দায় বসে বললাম, ‘আপনার কথামতো অমিতাভর উপন্যাস ধরেছি। কিন্তু আপাতত ওটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। পুরোটা পড়তেও সময় লাগবে। আমি অন্য ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই। কিছু কনট্যাক্ট যদি দেন, যাঁরা এই কেসের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন।’ 

কনট্যাক্টের ব্যাপারটার সরাসরি উত্তর দিলেন না অরুণ। পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘কী মনে হল লেখাটা পড়ে?’ 

‘লেখা খুবই সোজাসুজি। সম্ভবত পয়লা অথবা দোসরা জুন থেকে লেখা শুরু হয়েছিল। মানে অমিতাভর মৃত্যুর দিন দশেক আগে থেকে। হত্যারহস্য নিয়েই মূলত চর্চা করেছে। লকড রুম মার্ডার, বা বন্ধ ঘরের মধ্যে খুন এই নিয়ে এত বেশি লেখা হয়েছে যে এখানে হয়তো নতুন কিছু পাব না। তবে হ্যাঁ, মিল একটা আছেই। মাধব আর আনিসুর একভাবে দেখতে গেলে আপনি আর অমিতাভর রূপক। একজন খুন হলো, অপরজনের ঘাড়ে সন্দেহের ছায়া পড়ল। পড়তে ইন্টারেস্টিং লাগছে, এটুকুই। হনকাকু গোত্রের লেখা। 

‘এটা কি ব্যাকরণগতভাবে ঠিক বললেন? হনকাকু ঘরানা এসেছে ১৯৮১ সালে সোজি শিমাদার টোকিও জোডিয়াক মার্ডার্স বইটা প্রকাশের পর থেকে। সেখানে এই উপন্যাস তো ১৯৭৫ সালের।’ 

‘তাহলে অমিতাভকে এদের পূর্বসূরী বলতে হয়, কারণ গোয়েন্দা গল্পের মধ্যে ধাঁধা, লকড রুম রহস্য, একলা বাড়ির ভেতর খুন, এরকম নানাবিধ দুরূহ সমস্যা এনে প্রায় অঙ্কের নিয়ম সাজিয়ে সাজিয়ে সমাধান, যেখানে সাহিত্য কম বরং সমাধানের মজা বেশি, সেই ব্যাপারগুলোই তো এই উপন্যাসে ভর্তি।’ 

‘হুঁ, চরিত্রে খুবই অর্থোডক্স। সে যাই হোক, ব্যক্তিগতভাবে আমি এই গোত্ৰ নিয়ে আগ্রহ পাই না, কারণ মানুষের মন, তার সমাজ, তার পারিপার্শ্বিক, এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ভাষা ও শৈলী। এগুলোকে বাদ দিলে বুদ্ধিদীপ্ত ধাঁধা বানানো যায় অনেক, কিন্তু ধাঁধা আর সাহিত্য এক জিনিস নয়। জাপানে একসময়ে ওসব ঢেউ প্রচুর এসেছিল, বটে, শিন-হনকাকু নাম দিয়েছিল আবার, নিউ অর্থোডক্স, তবে সাহিত্য না থাকলে শুকনো মগজের খেলা কতদিন আর ভালো লাগে মানুষের। ওরা তো বলত সাহিত্যের চাপে ডিটেকটিভ গল্প তার রোমাঞ্চ ও বুদ্ধির খেলা হারিয়েছে, তাই ওরা আবার ফিরে যেতে চায় অর্থোডক্স ঘরানার গল্পে। কিন্তু পেছনদিকে হেঁটে লাভ কী! এক নদীতে দুবার স্নান করা যায় না। হনকাকুতে যেন একজন জাদুকর জাদুবিদ্যা দেখিয়ে খুন করছে আর গোয়েন্দাকে সমাধান করতে হচ্ছে সেই ম্যাজিকের পেছনের কারসাজির। ওরা যতই বলুক যে হনকাকু ছিল ডিটেকটিভ সাহিত্যের হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণযুগের প্রতি প্রেমপত্র, মোদ্দা কথাটা হলো সেই স্বর্ণযুগের আগাথা ক্রিস্টি বলুন বা জন ডিকসন কার, এমনকি জাপানের গোয়েন্দা গল্পের যিনি প্রথম পুরুষ, এডোগাওয়া র‍্যাম্পো, এদের সবারই লেখায় একটা ভালো সাহিত্য খুঁজে পাওয়া যেত। আর আপনি শিন-হনকাকু গোত্রের নামকরা বইগুলো দেখুন, অ্যালিস অ্যাকারাগুয়ার মোয়াই আইল্যান্ড পাজল বলুন বা ইউকিতো আয়াতসুজির ডেকাগন হাউস মার্ডারস, মানে যে বইগুলো ওই ঘরানার গ্রাউন্ডবেকিং হিসেবে গণ্য করা হয়। হ্যাঁ রহস্য আর সমাধান হিসেবে অসামান্য মানছি। কিন্তু সাহিত্য?’ 

‘আপনার লেখাতেও মনস্তত্ত্ব, সমাজ, মানুষের চালচিত্র এগুলো কোথাও কোথাও রহস্যকে ছাপিয়ে গিয়েছে। ওই যে বিখ্যাত বই আপনার, চার্বাকের সময়, সেটায় তো আপনি অপারেশন সানশাইনের পরিপ্রেক্ষিতে একটা হত্যাকাহিনীকে সামনে রেখে কলকাতার ভবঘুরেদের জীবনকে তন্ন তন্ন করে ঘেঁটেছেন বলা যায়।’ 

‘আর কীভাবে লিখব? আমাদের লিখতে শিখিয়েছেন দেবেশদা, অমিয়ভূষণ, মতি নন্দী। এঁদের লেখাপত্র শিকারি বেড়ালের মতো অনুসরণ করে গিয়েছে আমাদের প্রজন্ম। আমি ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখলেও নিজস্ব অর্জনটুকু ফেলে দেব কী করে! ওই, অমিতাভ যেরকম লিখেছে, ওতে তো আর সাহিত্য নেই। ওভাবে লিখে আজকাল আপনি পাত্তাও পাবেন না। হনকাকু মৃত, তার সময় অনেকদিন আগেই চলে গিয়েছে।’ 

‘আমারও যে উপন্যাসটা সাহিত্যগুণে পড়তে ভালো লাগছে, এমনটা না। তবে রহস্য সমাধানের আগ্রহটুকু আছে। অমিতাভ বেঁচে থাকলেও মনে হয় না ঔপন্যসিক হিসেবে সুবিধা করতে পারতেন। কবিতাই ওঁর জায়গা ছিল। এই লেখা লিখতে এসে স্বধর্ম খুইয়েছেন।’ 

‘সমাধানটা খুঁজে বার করবার আগ্রহ পাচ্ছেন না?’ 

‘এখনো অনেক বাকি। তবে, মাধব খুন করেছেন এটাই আপাতত মনে হচ্ছে। সেই যে, ব্যোমকেশ বক্সীর একটা গল্প ছিল না? একজন লোক ভয় পেয়েছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বী তাকে হত্যা করবে। তাই সে ব্যোমকেশকে চিঠি লিখেছিল। বাস্তবে দেখা গেল, তার প্রতিদ্বন্দ্বীই খুন হয়েছে। এবং খুন করেছে এই লোকটিই। ব্যোমকেশকে চিঠিটা লিখেছিল সন্দেহ থেকে বাঁচবার জন্য। এই সূত্র মেনে এগোলে এখানে মাধব খুন করতেই পারেন।’ অরুণের চোখে চোখ রাখলাম, ‘ঠিক যেমন গতকাল স্বীকার করলেন যে আপনিই খুন করেছিলেন অমিতাভকে।’ 

‘আর অ্যালিবাই?’ 

‘আরও কিছুটা না পড়লে বুঝতে পারব না। কিন্তু আমার যে অন্য প্রশ্ন আছে!’ 

‘বলুন, কী জানতে চান।’ 

‘অমিতাভ কেমন ছিলেন? তাঁর চরিত্র কী ছিল? মানুষ হিসেবে কীরকম? আপনি তাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন বহু বছর। স্টোরিতে এই মানবিক স্পর্শটা লাগবে। আর অমিতাভর কোনো ছবি। ক্যানডিড হলে ভালো হয়। 

অরুণ ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢাললেন দুজনের জন্য। হাতে কফির মগ ধরিয়ে বললেন, ‘বহুদিন আগের কথা। আমারও যেন ঝাপসা হয়ে আসছে স্মৃতি। অমিতাভ পাগলাটে ছিল ছোটোবেলা থেকেই। কিন্তু কলমে জোর ছিল। কবিতা লিখত অসাধারণ। স্কুলে পড়বার সময়ে একটা কবিতা লিখেছিল, ‘কার্শিয়াঙের মেঘ আমি কখনো দেখিনি।’ কী অসামান্য চিত্রকল্প! আমি কিছুটা মণীন্দ্র গুপ্তর কবিতার সঙ্গে মিল পেতাম ওর লেখার ধরনের। ‘বনে আজ কনচের্টো’- পড়েননি, না? অমিতাভ ওই ধরনের লিখত।’ 

কী মনে হয়, বেঁচে থাকলে বড়ো কবি হতেন? 

‘ঠিক জানি না, বড়ো বলতে আপনি কী বোঝেন। পুরস্কার অথবা অমরত্ব, এসবকে অমিতাভ গ্রাহ্যও করত না। সেই সময়কার একটা পঙক্তি ও পোস্টার বানিয়ে নিজের কাছে রেখেছিল, ‘পুরস্কার গ্রহণ করা যায় একমাত্র শয়তান অথবা ঈশ্বরের হাত থেকেই। ভোটে জেতা মানুষের নোংরা হাত থেকে কোন্ শিল্পী পুরস্কার গ্রহণ করবে?’ বাজারকে সে পাত্তা দিত না। কিন্তু আবার আমার উপন্যাস বেরোবার খবরে ওভাবে রিঅ্যাক্ট করল। হয়তো ভেতরে ভেতরে রেকগনিশনের প্রত্যাশা ছিলই। তবে বাংলা কবিতার বাজারে তখন ও একা নয়, বলতে পারেন জোয়ার এসেছিল। বাইসন বলে একটা কাগজ বার করত মৃদুল দাশগুপ্ত। অসাধারণ সব কবিতা। আমার বন্ধু ছিল শামসের, শামসের আনোয়ার। কলকাতায় পড়তে গিয়ে ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ‘খোলা ব্লেড দেখলে তৃষ্ণায় আমার গলা জ্বলে/ পাখার হুক দেখলে মনে পড়ে যায় সোনালি ফাঁসের কথা। ক্রুদ্ধ, শোকার্ত, হাহাকারময়, অথচ হাংরিদের থেকে কত আলাদা! আধুনিক, হয়তো পশ্চিমি ঢঙেই আধুনিক। কিন্তু সে কি আমরাও নই? তখন সব কবিতা পড়তে গেলেই অস্বস্তি হতো, মনে হতো কাঁটার মতো প্রশ্নচিহ্ন উঁচিয়ে আছে আমাদের দিকে তাকিয়ে। কৃত্তিবাস, শতভিষার মতো পত্রিকারা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জেলা ও গ্রামগঞ্জ থেকে স্রোতের মতো উঠে আসছিল লিটল ম্যাগাজিনের বাহিনী। আদ্রা থেকে বেরোনো কেতকী, বর্ধমান থেকে বেরোনো বাল্মীকী, আসানসোল থেকে কবিকণ্ঠ, নবদ্বীপ থেকে অজ্ঞাতবাস আর কত বলব! অমিতাভকে আমি যখন ভাবতে যাই আজকাল, এই কবিদের, এই পত্রিকাগুলোর থেকে আলাদা করে ভাবতে পারি না। এদের কেউ কেউ এখন প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে, আবার অনেককেই আমাদের আগামী প্রজন্ম মনে রাখবে না। কাউকে আগে ভুলবে, কাউকে কিছুদিন পর। কিন্তু অমিতাভ তো এরাই! এই সব টুকরো টুকরো সাতের দশকের কবিতাগুলো নিয়েই তো ও, ওর দার্জিলিং, আমাদের বন্ধুত্ব।’ 

‘কবিতার প্রতি আপনার এই তীব্র প্রেম, এদিকে লিখলেন গোয়েন্দা গল্প। কেন?’ 

অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকালেন অরুণ। ‘আমি যে কবিতা লিখতে পারি না টিনা। কোনোদিনও পারিনি। শুধু হিংসে করে গিয়েছি অমিতাভদের। 

হাসি পেল। বললাম, ‘চেষ্টা করুন, এখনও হতে পারে।’ 

অরুণের স্বর নিবিড় হয়ে এল, ‘কবিতা না থাকলে অমিতাভর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটাই থাকত না। ওর ওই প্যাশন, পাগলামি — দিনরাত আমরা দার্জিলিং- এর জঙ্গল, পাহাড়, চা-বাগান উপত্যকায় একসঙ্গে হেঁটেছি মাইলের পর মাইল। স্টেপ অ্যাসাইড, লোয়ার টুংসুং ধরে হাঁটতে শুরু করে চক্কর খেয়েছি গোটা শহর। অমিতাভর মাথায় হঠাৎ করে কোনো কবিতার লাইন এসেছে, এদিকে সঙ্গে কাগজ-কলম নেই। ও কাঠি দিয়ে মাটির ওপর লিখে ফেলেছে সেই লাইন। তখন নকশাল আন্দোলন আস্তে আস্তে শুরু হচ্ছে। হুটহাট করে রাতবিরেতে এখানে ওখানে চলে যাওয়া উচিত নয়। এমনকি, অমিতাভর বড়ি যেখানে মিলেছিল, সেই সেমেট্রির মাটিতে তার আগেও এরকম গুলি খাওয়া লাশ পড়ে থেকেছে। কিন্তু আমরা ছিলাম অকুতোভয়- আমরা দুজন কোথায় না গিয়েছি। এসবই দুজনের রাস্তা আলাদা হবার আগের ঘটনা। কিছুদিন পরে আমি কলকাতায় চলে যাই দুই বছরের জন্য। মাস্টার্স করতে। তখন ছেদ পড়বে, স্বাভাবিক। ফিরে আসবার পর কাজকর্ম, পরিবার এসবেও জড়িয়ে গেছি। থিতু হয়েছি আস্তে আস্তে। কিন্তু অমিতাভ পালটায়নি।’ 

‘আচ্ছা, অমিতাভর প্রথম দিককার আর শেষের দিককার কবিতায় একটা বাঁকবদল লক্ষ করেছিলেন কি? মানে, আমি যেটুকু এখান ওখান থেকে সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম আর কী— শুরুর দিকে মেঘ, কুয়াশা, মিরিক, একলা জিপগাড়ি, ভাঙা শহর, নির্জন দেবতার মূর্তি— পরের দিকে বারবার লাশ, রক্ত, হুটার, পাগলি ঘণ্টি। পাহাড় বলে কোনো কিছুরই অস্তিত্বই নেই আর।’ 

অরুণ মাথা নাড়লেন, ‘গতকালকেই বলেছিলাম, সময়টার একটা প্রভাব থাকেই। যারা সেই অর্থে কমিটেড নয় তাদের লেখাতেও নকশালবাড়ির ছায়া পড়েছে। তার ওপর অমিতাভ তো উত্তরবঙ্গেরই। সত্তরের ইম্পর্ট্যান্ট কবি ছিলেন অজয় নাগ। মূলত আত্মমগ্ন স্বরের অধিকারী, নীচু গলায় প্রেম আর যন্ত্রণার কথা বলতেন। সেই তিনিও লিখেছেন— ‘লাল আগুন সমস্ত দিগন্ত পুড়িয়ে ডাকছে/সাজানো জীবন ছেড়ে কাঁটাপথে তুমি কি আমার সঙ্গী হবে?’ গৌতম বসু, আর এক বড়ো মাপের কবি, তিনিও অন্তর্লোক থেকে উঠে আসা কবিতা লিখতে লিখতেই রাজনৈতিক বাক্য উচ্চারণ করে দিয়েছেন। আবার উল্টোটাও আছে। শম্ভু রক্ষিতের মতো কবি এখনও কমই এসেছেন আমাদের দেশে। যদি শম্ভুর কবিতা পড়তে যান, দেখবেন, পরাবাস্তব অজস্র দৃশ্যের একত্র সমীকরণে এমন একটা শব্দবিশ্ব তৈরি করেন শম্ভু, যেখানে উচ্চারণ ভেঙে যায়। মনে হয় সবই অসংলগ্ন। অবচেতনে বোধের অভিজ্ঞতার আভাস পাওয়া যায় শুধু। এই কবিতার ভেতর আপনি মাথা খুঁড়লেও রাজনীতি পাবেন না। শম্ভুর কোনো কবিতাতেই পাবেন না, এবং আপনি ভাববেন শম্ভু রক্ষিত একজন অরাজনৈতিক কবি। তারপর আমি আপনাকে জানাব, শম্ভু ছিল সম্ভবত একমাত্র বাঙালি কবি যে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে লিখে জেল খেটেছিল।’ এটুকু বলে নিমগ্ন দৃষ্টিতে বাগানের দিকে তাকালেন অরুণ। নরম হাসলেন আপনমনে, অস্ফুটে বললেন, শম্ভু! বারুদের গোলা!’ তারপর মুখ ফেরালেন আমার দিকে, ‘এস্টাব্লিশমেন্টের কাগজে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের কথা বলছি না। কিন্তু তার বাইরে যে বিরাট কবিদের দল, তাঁরা অনেকেই ওই সময়টাকে অস্বীকার করতে পারেননি। 

‘আপনি ছাড়া অমিতাভর অন্য কোনো বন্ধু…’ 

‘ছিল অনেকে। তবে দার্জিলিং-এ আমি বাদে বিশেষ কেউ ছিল না।… বেশিরভাগই কলকাতায়, অন্যান্য জেলারও, কুচবিহারের অনেকে। মূলত লেখালেখির সূত্রেই বন্ধুত্ব। অনেকের বাড়ি গিয়ে থেকেও এসেছে। তবে আদতে ও ছিল সোসিওপ্যাথ। নিঃসঙ্গ থাকতে পছন্দ করত। শুধু আমাকে ভালোবাসতো খুব। স্কুলে, পরে কলেজে পড়বার সময়েও ও ছিল প্রতিভাবান, কিছুটা একলা। আপনমনে ঘুরে বেড়াত এখানে ওখানে। মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেত। আবার ফিরে আসতো কয়েকদিন বাদে। কোথায় গিয়েছিল, জিজ্ঞাসা করলে হাসতো। বলত, ‘আমার কি ঘুরতে যাবার জায়গার অভাব আছে রে শালা? অতুল্যমামা হাত ধরে সাধাসাধি করছে, ওর সঙ্গে একবার দিল্লিটা ঘুরে আসতে। ইন্দিরাদি নাকি আমি গেলেই স্পেশাল সুক্তোটা বানাবে।’ এসব হাবিজাবি বলত। তারপর জানা যেত কলকাতায় গিয়ে পার্ক সার্কাসের বস্তিতে কোনো এক কবি বন্ধুর সঙ্গে পনেরো দিন কাটিয়ে এসেছে। কখনো জানতে পারতাম, চন্দননগরে গিয়ে গঙ্গার ঘাটে টানা তিনরাত শুয়ে বসে কাটিয়েছে। এরকম আর কী! পড়াশোনা সেরে কলকাতা থেকে ফিরে দেখলাম ওর এই পাগলামি বেড়ে গিয়েছে। একবার তো বেশ কিছুদিন পরে ফিরল, একাত্তরের মাঝামাঝি, যতদূর মনে পড়ে। ভয় পেয়ে পুলিশে ডায়রিও করেছিলাম। ফিরল যখন, জামা প্যান্ট নোংরা, অবিন্যস্ত। তার ওপর মদের শুকনো দাগ। মুখ থেকে অনাহারের দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। ঘন দাড়ি রাখত। সারাদিন ধরে, যখন লিখছে না, আপনমনে নখ খেতে খেতে ভেবে যাচ্ছে, এরকম স্বভাব ছিল। আঙুলের চামড়া মাংস অবধি খেয়ে ফেলছে বলে মনে হতো মাঝে মাঝে, এত নখ খেত। আমাদের মধ্যে যখন আড্ডা হতো, মাঝে মাঝেই কথা বলতে বলতে চুপ করে যেত দুম করে। আর ওকে খুঁজে পাওয়া যেত না, পুরো হারিয়ে যাওয়া চোখ। আমরা বলতাম, এবার নির্বাণ লাভের সময় হয়েছে। তখন ও কলেজ পাস করে গেছে। একটা চাকরি পেয়েছিল, কিছুদিন পর সেটাও ছেড়ে দিয়েছে। এখানে ওখানে ছুটকো টিউশনি, কোনো প্রেসে প্রুফ দেখার কাজ এসব করে নিজের খরচ চালায়। একটা ছোট্ট ঘরে পিজি নিয়ে থাকে। সেখান থেকে তো নীচে গ্রামের দিকে চলে গেল। ওখানে নাকি ওর লেখা হবে। দার্জিলিং-এ এত টুরিস্ট বেড়ে চলেছে যে মনোযোগ দিতে পারছে না, অবসাদ চলে আসছে। আমিই সন্ধান করে একটা ছোটো ঘরের ব্যবস্থা করে দিলাম, গ্রামটার ধারে। মাসে মাসে কিছু টাকার ব্যবস্থা আমাদের কোম্পানির একটা সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের ট্রাস্ট আছে, সেখান থেকে এটা ওটা বলে, কমিটিকে বুঝিয়ে সামান্য কিছু অনুদান ওর জন্যে। কিন্তু মাঝে মাঝেই বিরক্ত লাগত। আর কতদিন একটা ছেলে এভাবে বাউণ্ডুলে হয়ে ঘুরবে? কী খায় তার ঠিক নেই। কোথায় থাকে তার ঠিক নেই। তার ওপর লিভারের একটা সমস্যায় ভুগছিল। লেখা বেরোচ্ছে টুকটাক, তা ঠিক। আবার গল্পও লিখতে শুরু করল। সেটাও খারাপ লিখছিল না। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে এত বিভ্রান্ত, তার ওপর এত নেশা করত যে আমার মনে হতো ও একটা বেলাইন হয়ে যাওয়া রেলগাড়ি, যা খাদে ঝাঁপ দেবে যে কোনো সময়ে।’ 

‘কিন্তু আপনার সঙ্গে এই ঝগড়া, বা আপনার নামে অভিযোগ, এটার কারণ কী?’

‘আমিও জানি না। ওর মাথায় ভূত চেপেছিল তখন।’ অরুণ আরেকটু কফি ঢাললেন। সামান্য চলকে পড়ল টেবিলে। টিস্যু দিয়ে সাবধানে মুছে যত্নের সঙ্গে চারভাঁজ করে সেটাকে রেখে দিলেন একপাশে। 

‘আমি ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় জলপাইগুড়ির একটা কবি সম্মেলনে এসেছিলেন একবার। কথায় কথায় বলেছিলেন, অমিতাভ মিত্র ইম্পরট্যান্ট কবি। সেটা ৭৩ সাল। অমিতাভর সঙ্গে তখন আলাপ হয়েছিল, আড্ডাও হয়েছিল অনেকটা সময়। শক্তিদা বড়ো হৃদয়ের মানুষ, আমাদের দুজনকেই ভালোবাসতেন। যখন অমিতাভকে বোঝাতে গিয়েছিলাম, এটুকুই বলেছিলাম যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় যাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তার এসব পেটি ব্যাপারে থাকা সাজে না। তাতে উলটে অমিতাভ বলল যে ওর জেহাদ নাকি বাজারি কাগজগুলো সাহিত্যের যেরকম পণ্যায়ন ঘটাচ্ছে তার বিরুদ্ধে। শম্ভু রক্ষিতের কথা বললাম আপনাকে একটু আগে। তখন মেদিনীপুরের বিরিঞ্চি রোড থেকে শম্ভুর লিটল ম্যগাজিন মহাপৃথিবী বেরচ্ছে। সেখানে অমিতাভর একগুচ্ছ কবিতা বেরিয়েছিল। সেই সংখ্যাটা আমার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল আমি সারাজীবন বড়ো পত্রিকাতে লিখলেও অথবা থান ইটের মতো উপন্যাস বার করলেও ওই একগোছার ধারে দাঁড়াবার ক্ষমতা হবে না। কিছু মনে করিনি, কারণ জানি ও পাগল, কিন্তু সন্দেহ হয়েছিল, ওর মাথা ঘুরে যাচ্ছে। পুরোটাই যে ব্যক্তিগত ক্ষোভ তা বলছি না। নীতিগত অবস্থান অনেকের মতো ওরও ছিল। কিন্তু ব্যালেন্সের অভাব দেখেছি, মনে হয়েছে একটা অবস্থান নিতে নিতে ও সেটাকেই পার্সোনালি নিয়ে ফেলেছে। ফলত যারা বাণিজ্যিক কাগজে লিখেছে সবাই ওর ব্যক্তিগত শত্রু, কথাবার্তা শুনে এরকম মনে হয়েছিল। যদিও ব্যাপারগুলো তো কখনোই এত সরল ছিল না। বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখলে সে বিক্রীত আর লিটল ম্যাগে লিখলেই আপোষহীন, এরকম সরল বিভাজন শুনতে রোমান্টিক লাগলেও সাহিত্য বলুন না এস্টাব্লিশমেন্ট, কোনোটাই ওভাবে সরলরেখায় চলে না। সে যাই হোক। তবে একটা কথা ঠিক, তখন অমিতাভকে ধুয়ো দেবার লোকেরও অভাব ছিল না। সঞ্জয় অধিকারীর সেই সময়কার লেখাগুলো আপনি পড়েছিলেন? 

‘কয়েকটা পড়েছি। সঞ্জয় সুকৌশলে আপনাদের দুজনকে লড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। 

‘সেটায় দোষ দেব না, কারণ ওঁকেও তো লেখা বিক্রি করাতে হবে। সেনসেশন না থাকলে সাংবাদিক বাঁচে না।’ 

‘হ্যাঁ, সেনসেশন তৈরিতে সঞ্জয় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ওঁর অন্য ইস্যুতেও কিছু রিপোর্ট পড়েছি। বাংলাদেশে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়ে এখানকার নকশালপন্থী তরুণেরা সীমান্তে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র-ট্রেনিং দিয়েছিল, সেই রকম একটা ক্যাম্পে গিয়ে সঞ্জয় খবর করেছিলেন। ভারতীয় প্রশাসন নাকি জানতো, কিন্তু বিশেষ ঘাঁটায়নি সেই তরুণদের। উলটে পুলিশ আর সীমান্তরক্ষীরা অনেক জায়গায় সহায়তাও করেছে। তারপর তসলিমা নাসরিন যখন বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন, দিনের পর দিন তাঁকে নিয়ে লিখে গেছেন। হুমায়ুন আজাদের রহস্যময় মৃত্যু নিয়ে সেনসেশনাল লেখা লিখেছেন। এগুলোর কিছু কিছু আমি পড়েছি। চমকপ্রদ স্টাইলে লিখতেন ভদ্রলোক।’ 

‘তবে সঞ্জয় যদি অমিতাভকে এই সময়ের অন্যতম সেরা প্রতিশ্রুতিবান কবি ইত্যাদি বিশেষণে অভিহিত না করতেন, তাহলে ওর হয়তো মাথাটা ঘুরত না। ওই খবরটাই কাল হলো। এমনিতেই ওর ভারসাম্যের অভাব ছিল। সেটাকেই খুঁচিয়ে দেওয়া হলো এই খবরগুলো করে।’ 

‘সঞ্জয় অধিকারী কিন্তু অমিতাভ মিত্র-র হত্যারহস্য নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখে গিয়েছেন।’ 

‘হ্যাঁ, যতদিন মানুষের কৌতূহল ছিল আর কী! যতদূর জানতাম সঞ্জয় নিজে তখন উঠতি সাংবাদিক। একটা স্কপ দরকার ছিল। অমিতাভ মরে গিয়ে সঞ্জয়ের কেরিয়ার তৈরি করে দিয়ে গেল।’ 

‘আপনারও কি দেয়নি?’ 

অরুণ আমার দিকে তাকালেন। 

‘অমিতাভ খুন হবার বছরেই, ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আপনার তৃতীয় বই বেরোয়। এবং সুপারহিট হয়। এক বছরে বারোটা এডিশন করতে হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে সিনেমা হয় বইটা থেকে। সেটাও বাণিজ্যসফল ছিল। যে লেখকের আগের দুটো বই বাংলা সাহিত্যে ঢেউ কেন, বুদবুদও তোলেনি, তার তৃতীয় বই এরকম সাফল্য পাবার পেছনে কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?’ মাপা গলায় প্রশ্ন করলাম। 

অরুণের ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল। তারপর একটা হালকা হাসির আভাস দেখা দিল। হয়তো সামান্য তিক্ততাও মিশে ছিল তার মধ্যে। ‘একটা পারফেক্ট মার্ডার করে পুলিশকে বোকা বানানো অপরাধীর লেখা রহস্য-কাহিনী পড়বার আগ্রহ মানুষের মধ্যে থাকবে, সেটা স্বাভাবিক না?’ 

হাসির মধ্যে কোথাও একটা হালকা বিদ্রুপ ছিল। সম্ভবত নিজের প্রতিই। ‘এর পরেও বলবেন, অমিতাভকে হত্যা করবার কোনো মোটিভ আমার ছিল না? সেনসেশন তৈরি করে ফ্লপ লেখকের বিখ্যাত হবার লোভ কি ঈর্ষার তুলনায় কম শক্তিশালী, টিনা?’ 

আমি মাথা নীচু করে হাতের কাগজ ওলটাতে থাকলাম। সময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘অমিতাভ কি ড্রাগের নেশা করতেন? তাঁর হাতে কয়েকটা সুঁচ ফোটাবার দাগ ছিল।’ 

‘পুলিশ জিজ্ঞাসা করেছিল আমাকে। আমি ঠিক জানতাম না। কিন্তু শেষের দিকে ওর উন্মাদনা, অপ্রকৃতস্থ ভাব, নিজের মনে বিড়বিড় করা— এগুলো দেখে আমারও মনে হতো যে ও অন্য কিছুর নেশা করে। জিজ্ঞাসা করে উত্তর পাইনি। তবে মদ তো খেতই অত্যন্ত বেশি পরিমাণে। মদ না খেলে কবিতা লেখা যায় না, এরকম ভুল ধারণা বুকে নিয়ে কত ছেলে যে তলিয়ে গেছে।’ 

‘আমি একজনকে পাচ্ছি না। ড্যানিয়েল লামা। এই কেসের তদন্তকারী অফিসার ছিলেন। আপনি কোনো সন্ধান দিতে পারেন? 

অরুণ দূরের দিকে তাকিয়ে আছেন। দেখলাম, তাঁর গালের একটা পেশি কাঁপছে হালকা। 

প্রায় আধ মিনিট পর মুখ ফেরালেন, ‘ড্যানিয়েল বেঁচে আছে কিনা জানি না। কিন্তু বেঁচে থাকলেও বহুদিন হয়ে গেল সে লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছে।’ 

‘এঁর ঠিকানা জোগাড় করে নিতে পারব। অফিস থেকে এখানকার পুলিশের একজন কনট্যাক্ট পেয়েছি। তাঁর সঙ্গে দেখা করে ঠিকানা পেয়ে যাব। আমি যেটা জানতে চাইছি, সেটা হলো, ড্যানিয়েলকে কি আপনি চিনতেন তার আগে বা পরে? কারণ সিদ্ধার্থ আমাকে বলল যে ড্যানিয়েলের নাম শোনেনি। কিন্তু অন্য অফিসার, ধনরাজ গম্বুর নাম জানে। তাই অবাক লাগল। হতে পারে সিদ্ধার্থর জন্ম অনেক পরে। কিন্তু বাড়িতে তো আলোচনা হয়েছে এই নিয়ে অনেকবার। সেখানে পুলিশ অফিসারের নাম আসেনি?’ 

‘ড্যানিয়েল স্থানীয় মানুষ। তাকে আমি কেন, অনেকেই চিনত।’ 

‘কিন্তু ডানিয়েলকে কেস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেন? 

কিছুক্ষণ চুপ থেকে অরুণ উত্তর দিলেন, ‘এটা তো আমার জানার কথা নয়! পুলিশের ভেতরের ব্যাপার।’

‘বেশ। তবে ড্যানিয়েলকে লাগবেই। তিনি কথা না বলতে চাইলে তাঁর পেছনে পড়ে থাকতে হবে। যেহেতু ধনরাজ মারা গেছেন, ড্যানিয়েলই এই কেসে আমার একমাত্র সহায়।’ 

‘ড্যানিয়েল দক্ষ পুলিশ অফিসার ছিল। তার দাপটে টাউনে অপরাধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা কম ছিল। কিন্তু ও পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দিল। কেন, তা জানি না। তারপর থেকে শুনেছিলাম লোকজন এড়িয়ে চলে। তবে আমিও বিশেষ খোঁজ রাখিনি। ব্যস্ত হয়ে পড়েছি নিজের জীবন নিয়ে। আর আমার ওপর থেকে সব অভিযোগ পুলিশ ততদিনে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ফলে ড্যানিয়েলের খবর রাখার দরকার ছিল না আর।’ দাবার বোর্ডের ওপর থেকে একটা কালো ঘোড়া তুলে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে তার গায়ে আঙুল বোলালেন অরুণ। 

‘আপনি কেন খোলাখুলি পুরোটা বলছেন না মিস্টার চৌধুরী? কেন খুন করলেন, কীভাবেই বা করলেন? আর কীভাবে এতগুলো অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর মেলালেন? আপনি যদি না চান যে সত্যিটা বাইরে বেরোক, তাহলে আমার কাছে স্বীকারোক্তি দিলেন কেন?’ 

অরুণ ঘোড়াকে নিজের জায়গাতে রাখলেন। আমি চাই, আপনি নিজে খুঁজে বার করুন। আমার মুখে শুনলে বিশ্বাস করবেন না, আগেও বলেছি। আপনাকে একটা গল্প লিখতে হবে। সেই গল্পটা তখনই লিখতে পারবেন, যখন নিজে গল্পটাকে খুঁড়ে বার করে আনবেন। 

অদ্ভুত জেদি লোক। মাঝে মাঝে সন্দেহ হচ্ছে, মরীচিকার পেছনে ছুটছি। কয়েকদিন পর আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। 

উঠে পড়লাম। ‘ভেবেছিলাম আজকেই আপনার সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখব। কিন্তু এখন ছুটতে হবে অন্য জায়গাতে। সাক্ষাৎকার রেকর্ড করতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। কাল সন্ধেবেলা কি ফাঁকা আছেন?’ 

সিদ্ধার্থ বলে দিয়েছিল যে, তাকে নিয়ে যেন বেরোই। দারোয়ান গেল সিদ্ধার্থকে খবর দিতে। আমি অরুণের বাগান দেখছিলাম। 

‘এটা কি সর্পগন্ধা? পাতাগুলো অন্যরকম লাগছে না?’ 

‘সর্পগন্ধাই। কিন্তু দুষ্প্রাপ্য একটা প্রজাতির। কম দেখতে পাওয়া যায়।’ 

‘এত অদ্ভুত আর নানা ধরনের গাছ, পুরো পূর্ব হিমালয়ের একটা মিনিয়েচার তুলে এনেছেন মনে হয়।’ 

‘বাগানের নেশা আমাকে ধরিয়েছিল বাবলা। বর্ধমানের ছেলে। এখানে কাজের সন্ধানে ঘুরছিল। আমিই ওকে ধরে মালির কাজ দিই। জাদু ছিল ওর হাতে। আমাকে ধরে ধরে মাটি চিনিয়েছে, সার চিনিয়েছে, গাছের স্বভাব, তাকে কীভাবে আঙুলের স্পর্শে বড়ো করতে হয়, সব শিখিয়েছে।’ অরুণের গলার স্বর অদ্ভুত নরম হয়ে এল। গাছগুলোকে কথা দিয়ে আদর করছেন। 

‘আমার বাবার বাগানের শখ ছিল।’ মুখ দিয়ে হঠাৎ করে কথাটা কেন বেরিয়ে গেল, জানি না। অরুণ চোখ সরিয়ে আবার দূরের দিকে তাকালেন। 

এরপর আর কী নিয়ে কথা চালাব, বুঝলাম না। অরুণ নিজেও আজ অন্যরকম। মাঝে মাঝে অনেকটা কথা বলছেন, আবার দীর্ঘ সময় নির্বাক। মনে হয় গভীরভাবে কিছু ভাবছেন। অথবা হয়তো মানুষটা মূলগতভাবে এইরকমই। নির্জন, গম্ভীর, শাস্ত। 

সিদ্ধার্থ আসছে। চলে যাবার জন্য পা বাড়াচ্ছি, কথাটা মনে পড়ল। ‘আচ্ছা, এটা মনে হয় তুচ্ছ ব্যাপার। তবু জিজ্ঞাসা করছি। মিসেস বাসুর ছেলে বীরেশ্বরবাবু জানালেন যে তাঁর মা বলেছিলেন সেই রাত্রে আপনি বাগানের মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজছিলেন। কিন্তু এই কথাটা আমি আমি প্রথম শুনছি। পুলিশের রিপোর্টেও ছিল না কিছু।’ 

অরুণ ভুরু কুঁচকে তাকালেন। ‘বুঝলাম না! খুঁজছি? কী খুঁজব?’ 

‘সেটাই আমারও প্রশ্ন। কী খুঁজছিলেন?’ 

অরুণের মুখে হালকা হাসির আভাস দেখা গেল। ‘সেই রাত্রে অমিতাভ যে আসেইনি, আমার এই সরকারি বক্তব্য নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাননি?’ 

***

১০/০৩/১৯৭০ 

প্রিয় ঘেণ্টুদা, 

আমার দ্বারা লেখাফেখা হবে না আর। ও বুঝে গেছি। আমি মরে যাচ্ছি ঘেন্টুদা, তলপেটের পেনটা কমছে না কিছুতেই। অরুণ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল। সে বালের ডাক্তার। বলে মদ ছাড়তে হবে। যেন এ দুনিয়ায় সমস্ত প্রবলেমের মূলে ওই একটাই জিনিস, মদ। মনে আছে, ঊনসত্তরে এই সময়ে আমি কলকাতায়, অরুণের মেসবাড়িতে সারারাত ধরে আড্ডা চলছে, আর বইয়ের ভেতরে উইপোকাদের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে বর্ধমানের সুব্রত। পার্ক সার্কাস থেকে মাংস নিয়ে এল সামশের, কষিয়ে ঝাল গরগরে রান্না করল অরুণ, বাংলা জোগাড় করে রেখেছিল আগেই, এদিকে নিজে কিন্তু খায় না একফোঁটা। ভাস্কর সেই রাত্রেই বলল, ‘সামশের, তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব একটা বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্বের মতো।’ সামশের আবার বলল, এখনও মনে আছে, ‘আমার পছন্দ, সাদা ফটফটে বিছানায় শুয়ে মুঠো মুঠো স্লিপিং পিল খেয়ে, ধীরে ধীরে মৃত্যু উপভোগ করতে করতে নিঃশব্দে চলে যাব।’ কিন্তু আমার সেদিন ভালো লাগছিল না। মনে হচ্ছিল এরাও যেন কত কত আগেকার কবি লেখক, যাদের সময় চলে গেছে। ওদের কবিতাও ভালো লাগল না, মনে হলো এ আমার সময়ের আগে। বিষণ্ণ লাগছিল, মনে হচ্ছিল পালিয়ে যাই। ভোর হতেই বেরিয়ে পড়লাম, অন্যেরা তখনো বিছানায় মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে এলোমেলো, এদিকে রাস্তাঘাটও ভালো চিনি না। শেষে বাসে উঠে কলেজস্ট্রীট চলে এলাম তারপর কফিহাউসের সিঁড়িতে বসে দেওয়াল মাথা রেখে ঘুমাচ্ছি তো ঘুমাচ্ছিই, কাঁধে কড়া ঝাঁকানি খেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা চোখ মেললাম। দেখি দেবারতি। অবাক হয়ে বলছে, ‘এখানে এভাবে ঘুমিয়ে আছ? তুমি তো কলকাতা কিছুই চেনো না। এখানে আসলে কী করে?’ আমি কিছুই বলিনি, কিন্তু ওকে দেখে হাসলাম, খুব আনন্দ হলো। দেবারতি আমাকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে কবিরাজি আর ইনফিউশন খাওয়াল, হাতে বাস ভাড়ার টাকা দিয়ে বলল, ‘শেয়ালদা গিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করবে, শ্যামবাজারের বাস কোথায় মিলবে।’ আমি বললাম, ‘কী লিখছ? আমাকে পড়াবে?’ উত্তর না দিয়ে সুন্দর করে হাসল। আমি ওর ভেতর একটা শান্ত ধ্যান দেখতে পেলাম। আমার মনে পড়ল অরণির কথা। কতদিন দেখিনি ওকে! একটা দলা পাকানো কষ্ট গলার ভেতর আলুসেদ্ধর মতো আটকে থাকল। তুমি অরণি পড়েছ? 

.

প্রবন্ধ লিখতে ভালো 
লাগে না ঘেন্টুদা।
তোমায় কবিতা পাঠাই? 

.

প্রথমে পাথর ছুঁড়ে মারি আয়নায়, তারপর 
টুকরো টুকরো কাঁচ ছড়িয়ে দি ঘরের ভিতর ও বাইরে
কাগজ, কবিতা আর হিসেবের খাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে 
জ্বালাই আগুন। ভাল লাগে না, কিছুই ভাল লাগে না আমার। 

ঠিক ওটাই আমার হচ্ছিল, অরণি কীভাবে যেন বহু দূরে থেকেও সেই ভালো না লাগা, কবিতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে জ্বালিয়ে দেবার ইচ্ছাটুকু পড়ে ফেলেছে। আর এখন আবার সেই মন খারাপ। কিন্তু ভালো তো হতেই হবে। অনেক লেখা বাকি। মদটা ছেড়ে দিলে কেমন হয়? অরুণকে বললে ও তো আনন্দে লাফাবে! আমাকে ওর মতো আমিও ভালবাসি না, বুঝলে? যতদিন ও কলকাতায় ছিল, আমার পাঁজরের হাড় খুলে দিয়েছিল ঘেণ্টুদা! ভেবেছিলাম, আর লিখতে পারব না কিচ্ছু। কিন্তু অরুণ ফিরে এল, তার পরেও কেন লিখতে পারছি না? অরুণেশদার কাগজে গুচ্ছ কবিতা পাঠিয়েছি। কিন্তু এই যে তুমি বললে, সত্তর দশকের কবিতা কোন রাস্তায় হাঁটবে তাই নিয়ে অনুমানধর্মী একটা গদ্য, গত সাতদিন চেষ্টা করেও পারিনি। হয়তো আমার প্রবন্ধ লিখতে ভালো লাগছে না, সেটাও হতে পারে। হতেই পারে। ভালো কথা, অরুণ বলছে ও ক্রাইম লিখবে। হাঃ! শুনে মজা লেগেছে কিন্তু! 

ভাবছি দার্জিলিং থেকে পালাব কিছুদিনের জন্যে। আবার ফিরে আসব যখন, গোখরোর খোলসের মতো পেছনে ফেলে আসব মনখারাপ, ক্রনিক পেন, লিখতে না পারার সমস্ত গ্লানি। তখন স্যাঁৎলা ধরা রোকড় দাঁত হাসিতে ঝিলকে উঠবে হা হা হা, আর কাজললতার মতো মেঘ দেখলে আমি খুঁট থেকে বিড়ি বার করে ধরাব। 

.

না সত্যি ভাবছি, কৃষ্ণনগরে আচার্যবাটি থেকে কয়েকদিন ঘুরে আসি, বুঝলে! দেখব কীভাবে ও কাজললতার মেঘ দেখলে বিড়ি ধরায়। পৃথিবীর ফুসফুসকে অপারেশান থিয়েটারে আনার পর ওর পাশাপাশি বসে বলব, একটি দামামা দাও হে একটি দামামা। হা হা হা হা হা হা… 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *