শেষ মৃত পাখি – ১৬

১৬

ফশাটনা উঁচিও না আর, ঢোঁড়া সাপকে মানায় না হে, তাছাড়া 
আমি বাখরগঞ্জ, গৈলাগ্রামে আমার পূর্বপুরুষ স্বপ্নাদেশে 
লিখেছিলেন মনসামঙ্গল, 
গরল আমি ডরাই না হে 
বিষে আমি ভয় পাই না 
আমি মৃদুল দাশগুপ্ত, আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি। 

—মৃদুল দাশগুপ্ত 

.

মৃতুঞ্জয় সোমের সাক্ষাৎকার 

অরুণ আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো। ওদের চা-বাগানের আইনি কেসগুলো মাঝে মাঝে আমার কাছে আসত। তখন আমি জুনিয়র অ্যাডভোকেট। সবে প্র্যাকটিস শুরু করেছি। পড়াশোনা শেষ করবার পর অরুণ পৈতৃক ব্যবসাতে কিছুকাল ঢুকেছিল, যদিও সুবিধে করতে পারেনি। তখন মাঝে মাঝেই কোর্টে আসত মামলাগুলোর সূত্রে। সেই থেকে ওর সঙ্গে আলাপ। হ্যাঁ, অমিতাভকেও দেখেছি তো! অরুণের সঙ্গে দু-একবার আদালত চত্বরে এসেছে কয়েকবার। ওই ১৯৭০/৭১ নাগাদ। অরুণ ততদিনে কলকাতা থেকে ফিরে এসেছে। খুব বন্ধু ছিল দুজন। আর একজনও আসতো মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে। তাকে আর মনে নেই এতদিন পরে। না না, অমিতাভ যে পাগলাটে, অন্যরকম, সে কথা কে না জানত? ওরকম বড়ো বড়ো দাড়িগোঁফ, অস্বাভাবিক দৃষ্টি, সারাক্ষণ নখ খেতে খেতে আপনমনে বিড়বিড় করছে, দেখলে বুঝবেন ঠিক সুস্থ মাথার নয়। মাঝে মাঝেই তো পালাতো। একবার কলকাতায় গিয়ে কোন কবি বন্ধুর সঙ্গে নাকি কিছুদিন কাটিয়ে এসেছিল। পরে জানলাম, মেটেবুরুজের ডক এলাকার বস্তিতে ছিল দুজন। আর একবার পালিয়ে গিয়ে ফিরল মাস দুই পর। অরুণ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল, থানা পুলিশও করেছিল, আর আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম যে অমিতাভ মুক্তিযোদ্ধাদের দলে ভিড়ে গিয়েছে। যাই হোক, অমিতাভ ফিরে আসবার পর অরুণ আমার কাছে দুঃখ করে বলেছিল, প্রতিভাবান বন্ধু থাকার অসুবিধেটা হলো সারাজীবন তোমাকে তার পেছন পেছন উপগ্রহের মতো ঘুরতে হয়, যাতে পাগলামি তাকে বিপদে না ফেলে। তবে আমিও নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম। অরুণের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হত। ওর মুখ থেকে অমিতাভর খবর পেতাম। দুজনের মধ্যে শত্রুতার খবরও শুনেছিলাম। আমি যদিও বাংলার শিল্পসাহিত্য নিয়ে অত খবর রাখতাম না। তবে অরুণ ভেঙে পড়েছিল। কাছের বন্ধুর কাছ থেকে ছুরি খাওয়াটা মানতে পারেনি মনে হয়। অমিতাভকে তো ছোটো ভাইয়ের মতন ভালোবাসত। আমি তো দেখেছি, কী না করেছে ওর জন্য? হ্যাঁ, ড্যানিয়েল লামাকে চিনতাম তো। সে বেঁচে আছে এখনও? আমি যদিও সিভিল লইয়ার ছিলাম, তবে অনেক সময়েই নানা মামলায় মুখোমুখি হতে হয়েছিল। থানাতেও যেতে হয়েছে। ড্যানিয়েলের কাজকর্ম সম্বন্ধে শুনেছেন নিশ্চয়? ও ছিল দার্জিলিঙের রুণু গুহনিয়োগী। তবে একটা কথা বেশি লোক জানে না। ওর একটা নার্ভের সমস্যা আছে। আর জোরে ছুটতে গেলে পা কাঁপে। না না, আমাকে কেন বলবে? আমার সঙ্গে কেন, কারোর সঙ্গেই ওর হৃদ্যতা ছিল না। ওর ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান আমার বাবার বাল্যবন্ধু ছিলেন। ছোটো থেকে দেখেছেন, যা হয় আর কী! একদিন কথায় কথায় বাবাকে দুঃখ করে বলেছিলেন, এই স্নায়ুর রোগই এত সম্ভাবনাময় পুলিশ অফিসারকে ওপরে উঠতে দেবে না। ওদের তো ফিটনেস চেক হয় প্রতি প্রমোশনের আগে। সে যাক, যা বলছিলাম। ড্যানিয়েলের সঙ্গে আলাপ তেমন ছিল না। ওই হাই হ্যালো। তবে ধনরাজ গম্বুর সঙ্গে ছিল। ভালো মানুষ, অনুভূতিপ্রবণ, ন্যায়নিষ্ঠ, ভদ্র। ড্যানিয়েলের ঠিক উল্টো। আর ডিপার্টমেন্টের সুনাম রক্ষা করা নিয়ে তেমনই সতর্ক। গোর্খাল্যান্ডের সময়ে আমরা বাঙালিরা ধনরাজের ভূমিকা সারাজীবন মনে রাখব। তিনি না থাকলে আমাদের সবাইকেই প্লেন এরিয়াতে নেমে যেতে হতো। সেই রাত? দাঁড়ান, ভাবি। মনে নেই বিশেষ। মনে হয় বাড়িতেই ছিলাম। বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন, ঘন ঘন বাজ পড়ছিল। এটুকু মনে আছে যে পরের দিন অরুণের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। চুপচাপ শুয়ে ছিল খাটের ওপর। কোনো কথা বলছিল না। সময়টা আর খেয়াল নেই। দুপুরের আগেই সম্ভবত। কারণ যদ্দুর মনে পড়ছে ওখান থেকে বেরিয়ে কোর্টে এসেছিলাম। ও হ্যাঁ, যখন অরুণের বাড়ি ঢুকছি, অরুণের দাদা আর ওদের উকিল মিস্টার প্যাটেল বেরোচ্ছেন। সে যাই হোক, তারপর তো অরুণ গ্রেপ্তার হলো। কিন্তু কী জানেন, আমার কখনও মনে হয়নি অরুণ খুন করতে পারে। অমিতাভকে ও কীরকম ভালোবাসতো আমি তো দেখেছি! নিজের ভাইয়ের জন্যও মানুষ এত করে না। তবে মানুষের মন, কখন কী ঘটে যায়, আমরা আর কতটুকু জানি। না সেসব বলতে পারব না। ড্যানিয়েল বা ধনরাজ, এদের পারস্পরিক সম্পর্ক, ড্যানিয়েল কেন কেস ছেড়ে দিল এগুলো ওদের ভেতরকার ব্যাপার। তবে এরকম হামেশাই ঘটতে দেখেছি। হ্যাঁ ড্যানিয়েলের চাকরি ছেড়ে দেবার খবর শুনে অবাক হয়েছিলাম বটে। এই ঘটনার পরপরই চাকরি ছেড়েছিল। কয়েক মাসের মধ্যেই। অরুণের সঙ্গে? তা আমিই তো শেষ অ্যাটাকটা হবার পর থেকে আর বাড়ির বাইরে বেরোই না। যোগাযোগ থাকা কি সহজ? অরুণ খবর পেয়ে দেখতে এসেছিল আমাকে। সেও বছর ছয়েক হয়ে গেল। এখন দিব্যি আছি। বাড়িতে থাকি। টিভি দেখি। অবসরে গান শুনি। আচ্ছা দাঁড়ান, আর একজনের কনট্যাক্ট দিচ্ছি। সে ওদের চা-বাগানের অ্যাকাউন্টান্ট ছিল এক সময়ে। অরুণকে চিনতো। বীরবিক্রম তামাং। এখন নিজের বড়ো ফার্ম খুলেছে। মস্ত বিজনেস। হ্যাঁ হ্যাঁ ভালো করেই চিনি। আমারই বয়সি হবে, দু-এক বছরের এদিক ওদিক হয়তো। ভিক্টোরিয়া ফলস রোড ধরে ওর বাড়ি যেতে হবে। বর্ধমান মহারাজার প্যালেসের কাছেপিঠে পড়বে। দাঁড়ান, আমিই ওকে ফোন করে কথা বলিয়ে দিচ্ছি আপনার সঙ্গে, আহা, এতে আবার এত ধন্যবাদের কী আছে? আমরা সবাই অরুশকে ভালোবাসতাম। আমিও তো চাই যে এত দিন হয়ে গেল, এবার সমাধানটা অন্তত বেরোক! 

বীরবিক্রম তামাঙের সাক্ষাৎকার 

আনন্দ পাঠককে হ্যালো বলে দেবেন। অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি ওর সঙ্গে। এককালে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। অরুণকে চিনব না কেন! একসঙ্গে কাজও তো করেছি। নাহ অমিতাভর নাম শুনেছি বটে, তবে চিনতাম না। তবে আমাদের ট্রাস্ট থেকে একটা মাসিক টাকা ওর জন্য অরুণ ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তার কাগজপত্র আমিই বানিয়েছি। অরুণও বেশিদিন ব্যবসার কাজে থাকেনি। ওর মধ্যে সেই উপাদানটাই ছিল না। লেখালেখির জগতের মানুষ, সেসব নিয়েই বুঁদ থাকত। ড্যানিয়েল লামা? মুখে চিনতাম। তবে সেসব স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এসেছে। অরুণকে যখন অ্যারেস্ট করেছিল, ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। চাপা ছেলে তো, ভেঙে পড়লেও মুখে প্রকাশ করেনি। সেই জার্নালিস্টও ছিলেন। কী নাম ভুলে গেছি। হ্যাঁ হ্যাঁ, সঞ্জয়। তিনি মনে হয় অরুণের সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিলেন, কিন্তু পুলিশ দেখা করতে দিচ্ছিল না। আমার মনে আছে সেই দৃশ্যটা। পুলিশ মনে হয় অমিতাভর ঘর ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল। সব মালপত্র থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। ড্যানিয়েল লামা বসে বসে সিজার লিস্ট মেলাচ্ছেন, আর পাশে ধনরাজ গম্ব দাঁড়িয়ে। না না, ড্যানিয়েল তদন্তের মাথা ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ধনরাজ তো টিমে ছিলেনই। তিনিই মনে হয় রেইড করেছিলেন। তা সেসব কী কী মালপত্র ছিল, অত কি মনে আছে আর? অনেক কাগজ ছিল, এটুকুই খালি স্মরণে আসছে। নাহ, অরুণের সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছিল সেসব আর মনে নেই। সাধারণ টুকটাক কথাই হবে হয়তো। খুনের দিনটা কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে। কারণ তার পরের দিন আমার জন্মদিন ছিল। স্ত্রী আর কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে স্থানীয় একটি পানশালায় ছিলাম, হ্যাঁ, ফেরবার সময়ে রাস্তায় ড্যানিয়েলকে দেখেছিলাম তো। জলাপাহাড় রোড ধরে হাঁটছিলেন। না না সেন্ট পলসের দিকে। মনে আছে কারণ আমার স্ত্রী হাত তুলে দেখিয়ে বলেছিল, ‘এত বড়ো পুলিশ অফিসার এদিকে নিজের গাড়ি নেই?’ তখন কটা হবে? ওই, একটা নাগাদ। হ্যাঁ, একটাই হবে, তার আগে নয়। মদ্যপান করতে করতে আমাদের রাতই হয়ে গিয়েছিল। ও হ্যাঁ, ড্যানিয়েলের হাতে একটা প্লাস্টিকের ঝোলা ছিল। কিন্তু ছাতা বা রেনকোট ছিল না। অল্প বৃষ্টি পড়ছিল। ভিজতে ভিজতে হাঁটছিলেন। ব্যাপারটা মনে আছে, কারণ দুদিন পর যখন অমিতাভ মিত্রর বডি পাওয়া গেল, শহর সরগরম হয়ে উঠল, ড্যানিয়েল আমাদের অফিসেও এসেছিলেন জিজ্ঞাসাবাদ করতে। তখন তাঁকে দেখে আমার সেদিনের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, ড্যানিয়েল যখন জলাপাহাড় রোডে, তাঁরই কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা খুন হয়ে গেল, এদিকে জানতেও পারলেন না— এই সব হাবিজাবি। এ আবার কী অদ্ভুত প্রশ্ন! ড্যানিয়েলের পায়ে তখন কী ছিল, দেখেছি নাকি? কী আবার থাকবে, জুতো ফুতোই ছিল হয়তো। দেখুন চটি না জুতো না গামবুট, অত দেখিনি। আর দেখলেও মনে নেই। অত দিন আগেকার ব্যাপার! অরুণের সঙ্গে এখনও ভালোই যোগাযোগ আছে। মাসখানেক আগেই ফোনে কথা হলো। ওর স্ত্রী আমার মেয়ের শিক্ষক ছিলেন, কলেজে। তার অবশ্য বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন। না, দেখুন, এসব ব্যাপারে আমার বিশেষ ইন্টারেস্ট নেই। অরুণ খুন করেনি বলেই আমার মনে হয়েছিল, এখনও সেটাই মনে হয়। আমরাও তো মানুষ চরিয়ে খাই! কে কেমন লোক সেটা বুঝি। এত বড়ো লেখক, এত বড়ো ফ্যামিলির ছেলে, সে এসব ক্রুড ব্যাপারে থাকবেই বা কেন! অমিতাভর ব্যাপারটা তো অন্য ছিল। মানে, ঠিক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ তো ছিল না! ভালোবাসা অন্ধ হয়। অরুণ সেইজন্য অমিতাভর চরিত্রের ত্রুটিগুলো দেখতে পেত না। নাহ, সেই সময়কার আর কে বেঁচে আছে, এগুলো ভালো জানবে… মনে হয় না আর কেউ। ফাদার স্যামুয়েলসও তো বহুদিন হলো মারা গেছেন। ইনি অমিতাভকে ছোটো থেকে দেখেছিলেন। অমিতাভর লাশও শনাক্ত করেছিলেন। আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাদের ফার্ম তাঁর অনাথ আশ্রমে অনুদানও দিয়েছে অনেক। ভালোমানুষ ছিলেন। আচ্ছা, আপনার নাম আমি শুনেছি। আমার নাতনি, কলকাতায় লোরেটোতে পড়ে, সে আপনার লেখার ভক্ত! আপনি তো একটা সিরিজ লিখছেন, তাই না? ও সেটার কথাই আমাকে বলেছে অনেকবার। নাকি প্রতি সপ্তাহে হাঁ করে আপনাদের ম্যাগাজিনটার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। যদি কিছু মনে না করেন, একটা অটোগ্রাফ দেবেন? ও নাহলে বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে আপনি এসেছিলেন। ওকে বলব আপনার কথা। আর পরে যদি কখনও নিছক ছুটি কাটাতে এখানে আসেন, জানাবেন। আরামে থাকা এবং ঘুরবার সব ব্যবস্থা করে দেব। আপনি হলেন আমাদের শহরের অতিথি। নাতনির মুখ চেয়ে এটুকু তো করতেই হবে! হাঃ হাঃ হাঃ…’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *