শেষ মৃত পাখি – ২০

২০

তুমিই দাঁড়াও তাই 
বেলেল্লা রাস্তার মোড়ে 
অন্ধতার বিষ ঢেলে চোখে 
কেননা এ আত্মরক্তপাত 
ঘূর্ণি তোলে অঘ্রাণেও 
জ্বলে যায় প্রত্যাশী খামার 
সিংহাসনে ক্লীব আর 
শুতে গেছে যুবারা শ্মশানে 

—জয়া মিত্র 

.

‘তাহলে, আজই শেষ রাত?’ 

‘হ্যাঁ।’ আমি হাসলাম। ‘কাল দুপুরবেলা বেরিয়ে যাব। এমনিতেও যা স্টোরি পাবার, সব হয়ে গিয়েছে। সকালবেলা একবার শুধু আপনার বাড়িতে যাব। আপনার বাবামায়ের একটা সাক্ষাৎকার নেব। তাহলে এখানকার কাজ শেষ। এরপর দিল্লি ফিরে লিখতে বসতে হবে।’ 

অরুণের বাড়ি থেকে বেরোবার পরেই অফিসের ফোন এসেছিল। শহর ছাড়ার অনুমতিপত্র চলে এসেছে। হোটেলের রিসেপশনে রাখা আছে। সেটা নিয়ে প্রথমে থানা এবং তার পরে সদর কোর্টে গিয়ে সই করিয়ে আনতে হবে। পুলিশ সহযোগিতাই করল। রামবীরের মতো এক অজ্ঞাতকুলশীল গরিব মানুষের মৃত্যু নিয়ে আর কতই বা মাথা ঘামাবে? তার ওপর নামকরা সাংবাদিককে কেউই ঘাঁটাতে চায় না। আদালতের কাজ মিটিয়ে একবার গেলাম আনন্দ পাঠকের বাড়ি। তাঁকে ধন্যবাদ জানাবার ছিল। প্রচুর সাহায্য করেছেন ভদ্রলোক। সেখান থেকে বেরিয়ে সিদ্ধার্থর সঙ্গে দেখা করলাম। তখন বিকেল হয়ে গেছে। অফিস থেকে প্লেনের টিকিট কেটে দিয়েছে। কাল সন্ধেবেলায় ফ্লাইট। আজ আর বিশেষ কিছু করবার নেই। হোটেলের বাইরে একটা বেঞ্চিতে দুজন পাশাপাশি বসেছিলাম। ওকে গল্পটা বলতে হবে। 

‘আপনার কাকা অনুমতি দিয়েছেন। আপনাকে বলা যায় এখন। কিন্তু বাইরে কাউকে বলবেন না। আমাকেও তো এটাকে বেচতে হবে বাজারে!’ সিদ্ধার্থকে পুরো গল্পটা বলে গেলাম। 

‘তাহলে রামবীরকে খুন … 

‘ড্যানিয়েল করেছেন। সম্ভবত গিরিরাজ আমাদের অনুসরণ করে এসে জানিয়েছিল যে বাড়িটার সন্ধান পেয়েছি। রামবীরকে ড্যানিয়েলের অল্প বয়সের ছবি দেখালে চিনতে পারার সম্ভাবনা ছিল। হয়তো এখানে ঘটে যাওয়া অনেক গোপন কথাই ফাঁস করে দিতে পারত। তাই মুখ বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। উপত্যকা দিয়ে যে ঘুরপথে উঠে এসে খুন করে আবার নেমে গিয়েছিলেন, সেই রাস্তা সত্তর দশক থেকেই তাঁর চেনা। আমার আরও আগে বোঝা উচিত ছিল। এই রাস্তা ব্যবহার করতো মূলত পুলিশই। তাহলে আজ সেই রাস্তা দিয়ে যদি হত্যাকারী আসে, তার পুলিশ হবার সম্ভাবনাই সবথেকে বেশি থাকে। ড্যানিয়েল গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। গিরিরাজ চালিয়ে এনেছিল।’ 

অনেকক্ষণ আমরা বসে থাকলাম বেঞ্চে। বৃষ্টি এখন পড়ছে না। কিন্তু ভেজা ভাব চারদিকে। কালচে অন্ধকার নিজের ডানা প্রসারিত করে দিচ্ছে। টুপটাপ ফুটে উঠছে পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মতো আলো। আমার মনের ভেতরে খচখচ করছে কাঁটার মতো। যতই অন্ধকার নামছে, ভার হয়ে চেপে বসছে অনেকগুলো অস্বস্তি। বুঝতে পারছি না সেগুলো কী। কিন্তু তবুও মাথা থেকে নামানো যাচ্ছে না। খালি মনে হচ্ছে, অনেকগুলো প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর এখনও মিলছে না। 

‘কিছু ভাবছেন? এত গম্ভীর কেন?’ প্রশ্ন করল সিদ্ধার্থ। 

‘নাহ। খালি মনে হচ্ছে, অমিতাভকে চিনত এমন কারোর সঙ্গে কথা বলা হলো না। বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে অমিতাভর চরিত্রটা আলাদা আলাদা দিক ফুটে উঠলে স্টোরি হিসেবে ইন্টারেস্টিং হতো। একমাত্র আপনার কাকার বয়ানের ওপরেই নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে।’ 

বৃষ্টি থামবার পর আস্তে আস্তে সন্ধের ফূর্তি বাড়ছে। আলোর মালায় সেজে উঠেছে কাছে-দূরের পাহাড়, যেগুলো আপাতত ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়েছে কুয়াশার চাদর। আমাদের হোটেলের সামনের কাদামাখা জায়গাটায় সেই বাচ্চা ছেলেটা, যাকে ড্যানিয়েল ধমকেছিলেন, সে মহা ফূর্তিতে লাফালাফি করছে। তার মা তাকে বকছেন। বকতে বকতে কাদার মধ্যে দিয়েই তার পেছনে ছুটেছেন, আর ছেলেটি মায়ের হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছে দূরে দূরে। বাচ্চাটা একবার লাফালে, খানিকটা কাদা ছিটকে লাগল মায়ের সালোয়ার কামিজে। মা কোমরে হাত দিয়ে ছেলেটির জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন এবং কান ধরে মুলে দিলেন আচ্ছা করে। ছেলের কোনো বিকার নেই। হি হি করে হাসতে হাসতে ছোটাছুটি করছে। ছেলের বাবাকে দেখলাম বারান্দায় বেরিয়ে এসে হিপপকেট থেকে পার্স বার করলেন। তার ফাঁকে গোঁজা চিরুনি। পাতলা চুলের ফাঁকে চিরুনি চালাতে চালাতে বউ ছেলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। এবার সবাই ঘুরতে বেরোবে, শুধু আমারই কোনো অবসর নেই। হঠাৎ সিদ্ধার্থ একটা পাকানো সিগারেট এগিয়ে দিল আমার দিকে। দেখলাম, একটা দুষ্প্রাপ্য হাসি ওর ঠোঁটের কোণায় ঝুলছে। ভুল দেখছি না তো? ‘কালকের পর আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না, তাই না?’ 

আকস্মিক তুমি সম্বোধনে হকচকিয়ে গিয়েও সামলে নিলাম। ‘সম্ভবত না। আবার হতেও পারে, যদি তুমি দিল্লি আসো।’ হাসলাম আমিও। ওর হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে জ্বালালাম না, ব্যাগের ভেতর একটা লুকানো চেনের খাপে সাবধানে রেখে দিলাম। 

‘হয়তো কখনও। অন্য কোনো দিন। অন্য কোনো সময়ে।’ সিদ্ধার্থর হাসির মধ্যে কোনো জড়তা নেই। এইরকম সহজ রূপে ওকে প্রথম দেখছি। হয়ত অরুণকে সন্দেহমুক্ত দেখে মন খুলে কথা বলতে পারছে এখন। চোখ সরিয়ে নিলাম ওর চোখ থেকে। এবং আবার সেই অস্বস্তিটা গলায় কাঁটা ফোটার মতো খচখচ করে উঠল। 

‘তুমি কাল কেন জানতে চাইছিলে, আমি তোমার কাকার কাছে ঋষি রোডের বাড়ির ডেসক্রিপশন দিয়েছি কিনা?’ 

সিদ্ধার্থ মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘সামান্য ব্যাপার। কতরকম ভাবনা আসে মনে! সে যাক। আজ তুমি ডিনার ট্রিট দাও। কাল চলে যাবে, তার আগে তোমার ঘাড় ভাঙবার এই সুযোগ ছাড়ছি না!’ 

‘তোমার হলো কী? সব রাগ বিদ্বেষ ভুলে গেলে, যেই শুনলে চলে যাচ্ছি? নাকি হাঁফ ছেড়ে বাঁচছো?’ ঠোঁট টিপে একটা রহস্যময় হেসে মাথাটা একদিকে ঝুঁকিয়ে দিল সিদ্ধার্থ। ওর হাতে হালকা চাপ দিলাম, ‘তুমি না থাকলে এতদূর আসতে পারতাম না সিদ্ধার্থ। এই গল্প যতটা আমার, তোমার তার থেকে একটুও কম নয়।’ 

একটা রেস্তোরাঁয় এসে বিরিয়ানি আর কাবাব অর্ডার দিলাম। অনেকদিন পর মশলাদার ভারতীয় খাবার খেতে ইচ্ছে করছে। সিদ্ধার্থ নিল তন্দুরি আর রেজালা। 

যদি এই গল্প আমারও হয়ে থাকে, তুমি যেমন বললে, তাহলে তোমার স্টোরিতে আমার কথা লিখবে?’ 

‘লিখব তো? জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্টের ব্যাপারটা তুমি না থাকলে বুঝতাম‍ই না। আবার সেই রাতে যখন গিরিরাজের জিপ আমাদের পিছু নিয়েছিল, খেয়ে ফেরার রাস্তায়, সেই থ্রিলটা— এগুলোই তো গল্প হয়ে থাকবে আমাদের!’ 

‘আমি যে ভীতু, বুঝেছিলাম সেদিন। তোমার হাত চেপে ধরেছিলাম।’ 

‘চেপে নয়। খিমচে! কী অবস্থা করেছিলে কবজিটার! নখ বসে গিয়েছিল।’ কাবাবের খণ্ড কাসুন্দিতে ডোবালাম। 

‘সরি! চমকে উঠেছিলাম। নখ কাটার কথা মনেই থাকে না সবসময়ে।’ 

আকাশ আর পৃথিবীটা এতক্ষণ খাপে খাপ হচ্ছিল না কিছুতেই। এবার আকাশের ঢাকনা আলতো ঘুরে গেল, আর খুট করে মিলে গেল একে অপরের সঙ্গে। আমার চোখ পলকের জন্য অন্ধকার হয়ে গেল। মুহূর্ত খানেক পরে যখন চেতনা ফিরল, নিজেকে অনেক শান্ত, ধীর ও সুস্থির লাগছিল। মনে হচ্ছিল, পেরিয়ে আসা রাস্তা যদি পুরোটাই ভুল হয়, সামনের রাস্তাটুকুকে ঠিক করে বানাবো। বুকের ভেতর ওঠাপড়া করছিল না। হাত পা-ও কাঁপছিল না। বস্তুত, নিজেকে এত শান্ত দেখে আমার নিজেরই অবাক লাগছিল। 

কাঁটাচামচে গাঁথা কাবাব নামিয়ে রাখলাম। ‘কাল আমার প্লেন ধরা হবে না সিদ্ধার্থ।’ 

‘কেন?’ হালকা ভাবে জিজ্ঞাসা করল সিদ্ধার্থ, দার্জিলিংকে ভালোবেসে ফেলেছো?’ 

আমিও হাসলাম। তারপর শান্ত গলায় বললাম, এতদিন ধরে যে গল্পটায় এসে পৌঁছেছি, পুরোটাই ভুল। এবং মিথ্যে। এই ভুলটাকে ঠিক করতে হবে সবার আগে।’ 

সিদ্ধার্থ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ফিসফিস করে বলল, ‘সব ভুল?’ ‘সব। পুরোটাই। একটা বিশাল মিথ্যে আমাদের সামনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।’ সিদ্ধার্থ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ নীচু করলো। 

‘তোমাকে দেখে অবাক হওনি বলেই মনে হচ্ছে। কেন?’ 

‘আমি ভয় পাচ্ছিলাম, তনয়া, যে তুমি ধরতে পারবে। এই গল্পের আরও কত লেয়ার থাকবে, জানি না।’ মাথা তুললো না সিদ্ধার্থ। 

‘মানে? তুমি জানতে?’ 

‘না। সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু সেটার কথা পরে বলবো। তুমি বলো, কী থেকে মনে হলো তোমার? ত 

‘এক্ষুণি বললাম, আমার হাত তুমি খিমচে দিয়েছো বড়ো নখ দিয়ে। তোমার মনে আছে, যে রাতে অমিতাভ খুন হয়েছিলেন, অরুণ চৌধুরীর হাতে আঁচড়ের দাগ ছিল?’ 

‘হ্যাঁ, অমিতাভর সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে হয়েছিল।’ 

‘কী বোকা আমি!’ হতাশায় মাথা নাড়লাম। ‘বারবার ড্যানিয়েল এই দিকটা দেখাতে চাইলেও বুঝিনি। কিছুতেই একটা সহজ সত্যি মাথায় এল না যে অমিতাভ কিছুতেই অরুণকে আঁচড়াতে পারেন না। অমিতাভর মুদ্রাদোষ ছিল নখ খাওয়া। সারাদিন ধরে নখ খেয়ে যেতেন। অরুণ বলেছেন। মৃত্যুঞ্জয়ও বলেছেন। এতই নখ খেতেন যে হাতের চামড়া মাংস বেরিয়ে এসেছিল। তাঁর হাতে কোনো নখই থাকবার কথা নয়, যাতে আঁচড় দিতে পারেন।’ 

‘অমিতাভ তাহলে কাকাকে আঁচড়ে দেয়নি?’ 

না।’ তাসের ঘরের মতো হুড়মুড় করে নিজের আখ্যানকে ভেঙে যেতে দেখছিলাম চোখের সামনে। ‘এটা খুব ছোটো একটা মিথ্যে। কিন্তু যে মানুষ একটা মিথ্যে বলবেন, তিনি শুধু এই একটাতে থামবেন না। এই গল্পের পুরোটাই বানানো।’ 

দুজনেই মাথা নীচু করে বসেছিলাম। খাবার ইচ্ছে ছিল না আর। ক্লান্ত লাগছিল। ‘তোমার সন্দেহটা বলো।’ 

‘তনয়া, আমি চেয়েছিলাম কাকা যেন নির্দোষ হয়। তাই তুমি যখন ড্যানিয়েলকে দোষী সাব্যস্ত করলে, মনে হয়েছিল এর থেকে সুবিধেজনক সমাধান কিছুই হতে পারে না। তাই নিজের সন্দেহটা খুলে বলিনি। নিজেকে বুঝিয়েছিলাম যে বেশি ভাবছি। 

‘এখন আর আমাদের হাতে অন্য তাস নেই সিদ্ধার্থ। সব সন্দেহ, যত ছোটোই হোক না কেন, বলো আমাকে।’ 

‘যেদিন আমরা কাকার বাড়ি ডিনার করছিলাম, কাকিমা জানতে চেয়েছিল, ঋষি রোডের বাড়ির ভেতরের ডেসক্রিপশন কীরকম। গথিক কারুকার্য নিয়ে কাকিমার উৎসাহের কথা বলেছিল। কিন্তু তুমি উত্তর দেবার আগেই কাকা একটা অন্য প্রশ্ন করে। তারপর আর ওই প্রসঙ্গে ফেরা হয়নি। তারপর আমি কাকিমাকে বা তুমি কাকাকে আর ওই বাড়ির ভেতরের কথা জানাইনি। মানে ভেতরটা কেমন দেখতে ছিল, ঘর কীরকম। ঠিক? এমনকী তোমরা যখন রামবীরের মৃতদেহ আবিষ্কার করলে, তখনও ওই ঘরের ভেতরে পা দেবার সুযোগ ছিল না। ঘর তালাবন্ধ ছিল। নিজেই বলেছো।’ 

‘হ্যাঁ, ঠিক। তোমার বক্তব্যটা কী?’ 

‘সেদিন, মানে রামবীরের বডি পাওয়ার দিন, থানা থেকে বেরিয়ে আমরা কফি খেতে গেলাম। আমি, তুমি, কাকা। কথা প্রসঙ্গে কাকা বলল যে ব্যাপারটা সিম্পল। ডাকাতি হতেই পারে। কী বলেছিল, মনে আছে? ‘বাড়িটায় দামি জিনিসের তো অভাব ছিল না! বার্মাটিকের ওই খাট বলুন অথবা বেলজিয়ান কাচ, কোনোটারই দাম কম নয়।’ যদি কাকা ওই ঘরে নাই ঢোকে, বার্মাটিকের খাট সম্বন্ধে জানল কী করে?’ 

‘এটা তো সোজা! তুমি কি ভালো করে শোনোনি? তোমার কাকা তো স্বীকারই করেছেন যে ওই বাড়িটা তিনি খুঁজে বার করেছিলেন পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পাবার পর। তখন গিয়ে দেখে এসেছেন। দেওয়ালে আঁকা ছবিটাও দেখেছেন। 

‘তুমি ধরতেই পারলে না এখনও! কাকা বলেছে যে ১৯৭৫ সালের পর আর ওই বাড়িতে পা দেয়নি কারণ অমিতাভর স্মৃতি তাকে তাড়া করতো। কিন্তু তনয়া, ১৯৭৫ সালে তো ওই ঘরে বার্মাটিকের খাট ছিল না! মনে নেই, ধিংড়া সাহেবের মেয়ের বার্ণিশের রঙে অ্যালার্জি ছিল বলে সবকিছু ছিল স্টিলের খাট। এসব ফার্নিচার বানানো হয় ধিংড়ার মৃত্যুর বছরখানেক আগে। ধিংড়া মারা গেছেন পঁচিশ বছর হলো, রামবীর বলেছিলেন। তাহলে, ১৯৯৩ সালে এই খাট আনা হয়েছিল। কাকা যদি না গিয়ে থাকে, এবং তুমি যদি না বলে থাকো, তাহলে বার্মাটিকের খাট বিষয়ে জানল কী করে?’ 

স্তব্ধ হয়ে দুই চোখ বুজে ফেললাম আমি 

‘আমি চাইনি বলতে।’ মাথা নীচু করে বিড়বিড় করল সিদ্ধার্থ। ‘বারবার মনে হয়েছে, কিছু কিছু সন্দেহ চাপা থাক। কাকার হাতে যেন দাগ না লাগে। আমি কী করতাম, তনয়া? ভুল করলাম কী?’ 

উত্তর না দিয়ে মহেশের নম্বরে ডায়াল করলাম। বেশ অনেকবার রিং হবার পর ব্যস্ত মহেশ উত্তর দিল, ‘তনয়া, সবে বাড়ি ফিরলাম, এখনই কি তোমাকে নিজের আইডিয়া সব বলতে হবে?’ 

পাত্তা না দিয়ে বললাম, ‘আমার ফেরার ফ্লাইট বাতিল করতে হবে মহেশ। 

মাঝে মাঝে মনে হয়, মহেশ আর পারবে না। সহ্যশক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়ে আমাকে হয় স্যাক করবে, আর নাহয় সামনাসামনি থাকলে সটান থাপ্পড় বসিয়ে দেবে। আজও সেটাই মনে হলো, যে আজই শেষদিন। কিন্তু মহেশ বরাবরের মতোই একটা বিশাল বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, ‘তুমি তো সব জানোই, কী কী করতে হবে। আমাকে আর এইচআর কে মেইল পাঠিয়ে রাখো এক্ষুনি।’ 

‘জিজ্ঞাসা করলে না কেন প্ল্যানের বদল করলাম?’ 

‘নতুন কোনো লিড পেয়েছ, যার ফলে তোমার গল্পে অভাবনীয় মোচড় আসবে। জানি।’ ভাবলেশহীন গলায় উত্তর দিল মহেশ। 

‘মহেশ, কী বলব জানি না। কলকাতা থেকে তোমার পছন্দের রাবড়ি এক কেজি কিনে নিয়ে যাবো, কথা দিলাম।’ 

‘সেসব পরে হবে। আমি কি দয়া করে এখন রেস্ট নিতে পারি, তনয়া? আমার স্ত্রী তোমার এই হুটহাট ফোনগুলোর জন্যেই ডিভোর্স দেবে এবার।’ 

‘আজ উঠি। বুঝলে?’ কিছুটা পর বলল সিদ্ধার্থ। 

অনেকটা খাবার নষ্ট হলো। কারোরই আর খাবার মতো মনের অবস্থা নয়। দুজনে মুখে না বললেও মনে মনে জানি, হৃদয় খুঁড়ে এবার অনেক বেদনা জাগাবার সময় আসন্ন! 

বেয়ারাকে বিল আনতে বললাম। ফোন বেজে উঠল। অচেনা নম্বর 

‘তনয়া ভট্টচার্য? আপনি আমাকে ফোন করেছিলেন। বাড়ির নম্বরে। আমি শহরে ছিলাম না। একটু আগে ফিরেছি। আমার নাম বিনয়েন্দ্র মুস্তাফি।’

‘ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি আপনার নম্বর পেয়েছি আনন্দ পাঠকের কাছ থেকে। পুলিশের অফিসার মিস্টার পাঠক। কিছু কথা বলবার ছিল।’ 

‘আপনি কি সাংবাদিক তনয়া ভট্টাচার্য? আপনার লেখা আমি পড়েছি।’ 

‘ধন্যবাদ। মিস্টার মুস্তাফি, আমি আপনাকে অরুণ চৌধুরী আর অমিতাভ মিত্রর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতাম। এই স্টোরিটা করবার জন্যই দার্জিলিং এসেছি। দুজনেই আপনার স্কুলের বন্ধু ছিলেন, তাই না?’ ইশারায় সিদ্ধার্থকে বললাম আমার ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বার করে দিতে। 

অপরপ্রান্তে নীরবতা। তারপর বিরক্তি মেশানো গলায় উত্তর এল, ‘এতদিন পরে এসে আবার পুরোনো কাদা ঘাঁটতে চাইছেন? কেন?’ 

নরম গলায় পুরোটা বোঝালাম। আসার উদ্দেশ্য, গল্পের সিরিজ, সবটুকু। কিন্তু বুঝলাম, বিনয়েন্দ্র বিরক্ত। বললেন, ‘আমার এসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আপনি নিজের ফোন নম্বর বাড়ির লোকের কাছে দিয়েছিলেন বলে ফোন করলাম। ভেবেছিলাম কোনো সিরিয়াস বিষয়ে দরকার আছে। কিন্তু পুরানো লেবু আবার কচলাবেন, বুঝতে পারিনি। এসব ব্যাপারে আমাকে জড়াবেন না প্লিজ। নিজের ব্যবসা নিয়ে থাকি, ফালতু জিনিসে মাথা ঘামাবার সময় নেই।’ ‘কিন্তু অরুণ আর অমিতাভ দুজনেই তো স্কুলে আপনার…. ‘ 

‘বন্ধু নয়। সিনিয়র ছিল তিন বছরের। আনন্দ পাঠক আর সেসব কী জানবে! দেখেছে এক স্কুল, নাম দিয়ে দিয়েছে। হুঁ, সে যাকগে। চিনতাম দুজনকেই। লায়েক ছিল খুব। ছোটো বয়সেই ডানা গজিয়েছিল দুজনেরই। দুজনের কেন বলছি, ওই তিনজনেরই গজিয়েছিল; সাহিত্য করবে! নিজেদের মিলটন শেকসপিয়র এসব ভাবতো মনে হয়। তবে অমিতাভ খুন হবার দুই বছর আগে আমি আমেরিকা চলে গিয়েছিলাম। ফিরেছি ১৯৯২ সালে। কাজেই আমার জানাটুকুও সব এর ওর মুখে শুনেই। তখন তো আর ইন্টারনেট ছিল না, আর বাংলা কাগজও পড়বার সুযোগ ছিল না। আমার কাছ থেকে এর বেশি আর কিছু জানতে পারবেন না।’ 

‘এক মিনিট। তিন বন্ধু মানে? আর একজন কে? 

‘আরে ওই তো ছিল, কে একটা। স্কলে তিনজন সবসময়ে একসঙ্গে। তিনজনেই নাকি সাহিত্যিক হবে! এসব সাহিত্য-ফাহিত্য করা আমাদের মতো সাধারণ মানুষজনের সাজে না, বুঝলেন মশায়? দেখলেন তো, মরলো কে? গরিব ছিল যে, সে-ই।’ 

‘কিন্তু তৃতীয়জন কে? নাম মনে আছে? তাহলে তিনি বেঁচে থাকলে একটা সাক্ষাৎকার নিতাম।’ 

‘নাম-ফাম মনে নেই। ঊনসত্তর কমপ্লিট করলাম এই এপ্রিলে। স্মৃতি সব ধূসর। শুনেছি তিনজনের সেই মক্কেল সাহিত্যের বাজারে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। পরে খবরের কাগজে চলে গিয়েছিল।’ 

‘তিনি কি বেঁচে আছেন?’ 

‘আমি কী করে জানব?’ এবার খেঁকিয়ে উঠলেন বিনয়েন্দ্র মুস্তাফি। সবার সব খবরের ঠেকা নিয়ে বসে আছি নাকি আমি?’ 

‘এই বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায়…’ শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রশ্ন করলাম।

‘জানি না। বলতে পারব না। এমনিও ইন্টারেস্ট নেই, আর অরুণ অমিতাভরা আমার বন্ধুও ছিল না। স্কুলে দূর থেকে দেখতাম, ব্যাস। অন্য ছেলেটির মুখটুকুই যা মনে আছে। নাম ঠিকানা এসব মনে রাখা অসম্ভব। সম্ভবত তন্ময় বা ওরকম কিছু নাম ছিল। আর কিছু? দেখুন আমি এসব কবি সাহিত্যিক ব্র্যান্ডটাকেই পছন্দ করি না। না সমাজের কোনো উপকারে লাগে, না নিজেদের উপকারে লাগে। দার্জিলিং-এ কোনো ইনভেনস্টমেন্ট নেই, ছেলেদের চাকরি নেই, ইন্ডাস্ট্রি নেই, আর বাবুরা চললেন সাহিত্য করতে! যাকগে, কিছু মনে করবেন না। হয়তো রুড হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই ব্যাপারে সত্যিই সাহায্য করতে পারবো না। আমি তখন দেশ থেকে বহু দূরে।’ 

ফোন রেখে ভুরু কুঁচকে খাতার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মৃত্যুঞ্জয় সোমও বলেছিলেন অরুণ আর অমিতাভর সঙ্গে আর এক বন্ধু আদালতে আসত। সে- ই কি তাহলে এই ছেলেটি? তন্ময়? যে পরে খবরের কাগজে গিয়েছিল? তন্ময়! এই নামের কেউ… 

জলের গ্লাসটা মুখে তুলতে গিয়ে হাত কেঁপে গেল। থরথর করে গ্লাস নামিয়ে রাখলাম, নাহলে হাত থেকে পড়েও যেতে পারত। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে খাতার লেখা ‘তন্ময়’ নামটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। 

সিদ্ধার্থ প্রশ্ন করলো, ‘কী হলো?’ 

আমি ভূতগ্রস্তের মতো ওর দিকে তাকিয়ে ছুঁড়ে দিলাম একটা ছোট্ট শব্দ, ‘সঞ্জয়’। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *