শেষ মৃত পাখি – ১৮

১৮

ভেসে যাওয়া বাড়িগুলো যে ভয় থেকে কথা বলে কুয়াশাদের সঙ্গে 
সেই ভয় থেকেই 
দরজা খোলার শব্দে, রাত্রে 
বোবা মেয়েটি কামড়ে ধরে তার বেড়ালকে 
ঠিক সেই ভয়েই একটা দেয়াল ঘড়ি জড়ানো গলায় বলে চলে 
আড়াইটে বাজবে না আর কোনওদিনই 
জানলায় পর্দা লাগানো যাবে না সেই ভয়েই কোনওদিন। 
জানালার পর্দা লাগানো যাবে না। 

—অমিতাভ মৈত্র 

.

ফেরার পথে একটাও কথা বলিনি কেউ কারোর সঙ্গে। সিদ্ধার্থ নিজের ভাবনায় ডুবে ছিল। আর আমি ভাবছিলাম কীভাবে স্টোরিটাকে দাঁড় করাব। মাথার ভেতর মাঝেমাঝেই ঘুরছিল ড্যানিয়েলের কথাগুলো— অরুণ চৌধুরীর হাতে আঁচড়ের দাগ! আমি তো জানি, ড্যানিয়েলই অমিতাভ মিত্রকে হত্যা করেছেন। তার পরেও কেন তাঁর প্রলাপকে পাত্তা দিতে হবে? 

হোটেলে নেমে সিদ্ধার্থকে বিদায় দেব, তাকিয়ে দেখলাম ভুরু কুঁচকে আছে, চিন্তাচ্ছন্ন মুখ। ‘কী হলো আপনার?’ 

‘পরশু যেদিন কাকা আপনাকে ডিনারে ডাকলো, একটা সময়ের পর আমি কাকিমার সঙ্গে ওপরে উঠে গিয়েছিলাম, একটা পেপার পড়তে। মনে আছে?’ 

‘হ্যাঁ, কেন?’ 

‘আপনি তখন নীচে কাকার সঙ্গে ছিলেন। ঋষি রোডের বাড়ি নিয়ে, বাড়ির ডেসক্রিপশন নিয়ে কোনো কথা হয়েছিল?’ 

‘না তো!’ 

‘খুব ভালো করে ভেবে বলুন।’ 

‘স্পষ্ট মনে আছে, কোনো কথাই হয়নি। কিন্তু কেন?’ 

আমার সঙ্গেও কাকিমার আর কথা হয়নি ওই নিয়ে। পরের দিনও কাকাকে কিছু জানাননি? অথবা পুলিশ আপনাদের নিয়ে বাড়িটা ঘুরে দেখেছিল, এমন কিছু ঘটেছে কি?’ 

‘প্রশ্নই ওঠে না। হঠাৎ এই প্রসঙ্গ কীসের জন্য?’

‘এমনি। আগে আপনি বলুন, বাবলার কথা জানতে চাইছিলেন কেন। 

‘ঠিক জানি না, একটা খটকা লাগল। বাবলা অরুণের ঊনত্রিশতম জন্মদিনে সর্পগন্ধার চারা এনেছিল। সেটা তার মানে ১৯৭৫ সালের ১৮ই মে। ১৯৭৬ হতে পারে না। আর অমিতাভ নিখোঁজ হন ১১ জুন, মানে চব্বিশদিন বাদে। তখন বাবলা কোথায়?’ 

‘আমি তো জন্মাইনি তখন। তবে বাড়িতে এই ঊনত্রিশতম জন্মদিনের গল্পটা অনেক শুনেছি। বাবলা আর কোথায় বাড়িতেই থাকবে হয়তো!’ 

‘সেখানেই তো খটকা লাগছে। অরুণ চৌধুরী গত পরশু বললেন, থানা থেকে ফিরে এসে তিনি শুয়েছিলেন বাড়িতে। চব্বিশ ঘণ্টার কাজ করে যে ছেলেটি, সে দেশের বাড়ি গেছিল। বাবলাও চলে গেছে ততদিনে। মানে কুকুরের ব্যাপারটা ঘটেছিল ১৮ই মে আর ১১ই জুনের মধ্যিখানে কোনো একদিন। ব্যাপারটা অদ্ভুত না? ঠিক সেই সময়টাতেই বাড়ি ফাঁকা থাকতে হলো, যাতে কোনো সাক্ষী না থাকে? 

‘কিন্তু ঘটনাটা তো সত্যি! প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের মুখে শুনেছি। কাকা কুকুরটাকে মারতে পারেনি। বাবলা মেরেছিল, বাধ্য হয়ে 

চব্বিশদিনের মধ্যে তার মানে দুটো ঘটনা ঘটেছিল, পিঠোপিঠি। বেশ ঘটনাবহুল সময় ছিল তার মানে। 

‘কিন্তু ১৯৭৬ হতে পারে না কেন?’ 

‘আপনার কাকা নিজেই তো বলেছেন, অমিতাভ মারা যাবার দিনে বাড়িতে কেউ ছিল না, বাবলাও ততদিনে চলে গেছে। আর তো ফিরে আসেনি। তার মানে বাবলা ছিল ১৯৭৫ এর মে অথবা জুন অবধি। তাই না?’ 

সিদ্ধার্থ উত্তর না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল। ভাবটা এমন, এত তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি কেন। আমারও ক্লান্ত লাগছিল। একটা গোটা রাত্রি দরকার সমস্ত ফাঁকফোকরগুলো মেলাবার জন্যে। কথা না বাড়িয়ে বিদায় নিলাম। সমাধানটা জানি, এবার সেটাকে ধরে আগের স্টেপগুলো মেলাতে মেলাতে যেতে হবে। অনেকটা সময় একা একা বসে ভাবনা দরকার তার জন্য। 

গভীর রাত্রে যখন ব্যালকনিতে বসেছিলাম, ছিপছিপে বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। পোকাদের দল অধিকার করে নিচ্ছে এই শহরটা। মাঝে মাঝে জোলো হাওয়া পাহাড়ি শীতলতাকে কাঁধে করে ঝাপটে পড়ছে। শালটাকে ভালো করে মুড়ে নিলাম সর্বাঙ্গে। দুর্বল টনসিল কতদিন এই আবহাওয়া সহ্য করতে পারবে জানি না। 

অমিতাভকে বুঝতে হলে সত্তর দশকের কবিদের মেজাজ বুঝতে হবে, বলেছিলেন অরুণ। আবার ড্যানিয়েলও সত্তরের নৃশংসতার জন্য কুখ্যাত। তাহলে কী— কিন্তু অমিতাভ তো প্রত্যক্ষ রাজনীতি করতেন না! আজকাল কবিতা আন্দোলন, নিওলিট মুভমেন্ট, নিম সাহিত্য— যে যে ধারাগুলো পড়াশোনা করতে গিয়ে জেনেছি, তার কোনোটার মধ্যেই অমিতাভকে পুরোপুরি ধরা যায় না। আবার হাংরি আন্দোলনের প্রভাবও তাঁর মধ্যে পড়েনি। ‘নতুন জবার মতো যোনির সুস্থতা’ ও ‘কাচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্থতা’, মলয় রায়চৌধুরীর প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতায় যেরকম শব্দবন্ধ দেখা যায়, সেগুলো অমিতাভ ভাবতেও পারতেন না— যে কটা কবিতা পড়েছি তাতে মনে হয়েছে। তাঁর এমনকি শেষজীবনের রাজনৈতিক কবিতাগুলোও শব্দের ব্যবহারের দিক থেকে পুরোপুরি নাগরিক নয়। ‘হিমেল নাভিমূলে ঝাঁপ দেবে ঘাতক গুবরেপোকা’— নকশাল জমানায় পুলিশি অত্যাচারের আখ্যান হিসেবেও যদি ধরা হয়, তাহলেও ‘নাভি’-র বদলে নাভিমূল’ শব্দের প্রয়োগ অন্যরকম। শহুরে কাটাকাটা নয়, কিছুটা অতিকথন। রহস্য, পরাবাস্তব, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ— এগুলো দিয়েও পুরোটা ধরা যায় না। ঐতিহ্যের থেকে প্রেরণা? নাহ, বুঝতে পারছি না। 

হঠাৎ মনে পড়ল, অরুণ সেদিন কথায় কথায় সত্তরের একটা কবিতা বলছিলেন। ‘আশ্বিন, ধ্বংসবীজের মতো নীলরং আকাশের। নীচে/চালচিত্র, মুখের গর্জনতেল, মনে পড়ে দিদিকে মানাত।/আমরা কয়েকজন আনমনে দেখে নিই সবুজ অসুর/সাবর্ণ চৌধুরীর বাড়ি— কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো প্রতিমা / সবুজ রঙের অর্থ ঘৃণাঃ আমি আমার বন্ধুর কাছে দ্রুত/ জেনে নিই, ভরতের নাট্যশাস্ত্রে একরকমই লেখা আছে নাকি।/কেউ কি পেয়েছে টের, সবুজ থাবার নিচে রোগাবোকা দিদি/ বিবাহের উনিশ বছর ধরে ক্ষয়ে ঝরে, তারপরে শ্মশানে শুয়েছে।’ মিথ, পুরাণের উৎসস্রোত, ভারতচেতনা, সব একাকার। অমিতাভ গুপ্তর কবিতা। কিন্তু যেটা মনে পড়ে চমকে গেলাম, কাকতলীয় কিনা জানি না, অরুণের একটা উপন্যাসে বাড়ির পুজোর প্রতিমাকাঠামোর সিংহের থাবার নীচে শুইয়ে রাখা ছিল গর্জনতেল মাখানো কিশোরীর মৃতদেহ। সেখানেও মিথের ব্যবহার। আবার অমিতাভ মিত্রর একটা কবিতায় এখন দেখতে পাচ্ছি, ‘বুলেটের গর্জন। পোড়া ডিজেলের গন্ধ। সেজে ওঠো প্রতিমার মুখ। জেগে ওঠো ছিন্ন শরীর।’ আগে হলে অন্যরকমভাবে পড়তাম, নিছক প্রতিবাদের কবিতা। কিন্তু গর্জনতেল আর দুর্গাকাঠামো সম্পর্কিত তিনটে টেক্সটকে পাশাপাশি রাখলে কী দেখছি? মিথ, পুরাণ, সেখান থেকে সমসাময়িক। অরুণ, দুই অমিতাভ, আরও অন্যেরা, সবাই কি একে অন্যকে এভাবেই প্রভাবিত করছেন? একের টেক্সটে ঢুকে পড়ছেন অন্যেরা? ওইজন্যেই কি বারবার এই কবিতাগুলো পড়তে বলেছিলেন অরুণ? নাহ, মাথাকে শান্ত করা দরকার। সমাহিত অবস্থাতে একে একে সমাধানগুলো আসে আমার কাছে। 

আবার রাত্রে স্বপ্নে ফিরে এল অমিতাভ। অমিতাভ, না বাবা, নাকি রামবীরের শান্ত দেহ, বুঝিনি। কিন্তু ওই ধুলোভর্তি ঘর, টেবিলে ওষুধের স্ট্রিপ, মাদার ডেয়ারির কার্ড, আরশোলার জ্বলজ্বল চোখ— আমাকে ঘুমোতে দিল না। অনেকক্ষণ জেগে শুয়ে থাকলাম, বুঝছিলাম না, স্বপ্ন না বাস্তব। ধ্বংসবীজের মতো নীলরং আকাশের নীচে উনিশ বছর শ্মশানে শুয়েছে। শুতে গেছে যুবারা শ্মশানে। গর্জনতেল মাখা দিদি। সত্তরের গর্জন। সাবর্ণ। বর্ণ। সবুজ। গর্জন। তেল। ডিজেল….. 

.

পরদিন সকাল আটটায় অরুণ চৌধুরীর বাড়ির দরজায় টোকা দিলাম। অরুণ নিজেই দরজা খুললেন। জিনসের ওপর হালকা ক্রিম রঙের পুলওভার চাপিয়ে আছেন। দেখে মনে হলো, আমার জন্যেই বসে ছিলেন। মুখে কিছু বললেন না। 

‘বাগানে গিয়ে বসি?’ বললাম আমি। 

‘দাঁড়ান। কফি বানাই আগে।’ অরুণ কিচেনের দিকে গেলেন। কফিমেকারে মেপে কফি বসিয়ে চামচের পিঠ দিয়ে কফির গা সমান করে দিলেন একবার। তারপর জল ঢেলে কাপের দিকে তাকিয়ে আবার ভুরু কুঁচকে উঠল তাঁর। 

‘গোবর্ধনকে বহুবার বুঝিয়ে আর পারছি না, কাপ যেন না মেশায়। কিছুতেই শুনবেনা। বাঁদিকের তাক থেকে দুটো খয়েরি রঙের কাপ বার করে দেবেন প্লিজ?’ 

ফ্লাস্কে করে কফি আর কাপ নিয়ে বাগানের ধারের সেই বারান্দায় এসে বসলাম আমরা। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বাম পাশে পাইনের দুর্ভেদ্য জঙ্গল ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে কুয়াশাতে। টুপটাপ ভিজে নেতিয়ে আছে বাগানের ঘাস। অরুণ ভুরু উঁচিয়ে আমার দিকে তাকালেন। 

‘কাল সিদ্ধার্থ আপনাকে ফোনে সব জানিয়েছে, তাই না? আমি যে ড্যানিয়েল লামার বাড়ি গিয়েছিলাম, সে সব?’ 

অরুণ উত্তর দিলেন না। ‘অমিতাভ মিত্রর হত্যা-রহস্যের সমাধান আমি করেছি। আর সেটা করেছি উপন্যাসের সাহায্য নিয়েই। আপনি যেরকম বলেছিলেন।’

‘সিদ্ধার্থ কিছুটা জানিয়েছে আমাকে। বলুন। আমি শুনছি।’

‘মোটিভ এখনও জানি না। ঠিক যেমন জানি না আনিসুরকে হত্যার মোটিভ। সেটা তবু নিজের মতো করে বানিয়ে নিয়েছি। কিন্তু বাস্তবের মোটিভ তো বানানো যায় না, তাই সেটা আপনার মুখ থেকে শুনব। শুধু জানতে চাই, নিরপরাধ হয়েও আপনি কেন নিজেকে সন্দেহমুক্ত করতে গেলেন না।’ 

অরুণ নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকলেন। একটা দমকা হাওয়ায় তাঁর মাথার চুল এলোমেলো হয়ে গেল। মুখ নীচু করে কফির কাপে চুমুক দিলাম, যাতে দেখতে না হয়। সেভাবেই উত্তর দিলাম, ‘আগে অমিতাভর উপন্যাসে সমাধান আপনাকে বলব। তারপর বলব, সেখান থেকে কীভাবে বাস্তব সমাধানে পৌঁছলাম।’ 

‘বেশ। শুনছি।’ 

‘আনিসুরের হত্যায় প্রথম এবং স্বাভাবিক সন্দেহ পড়বে মাধবের ওপর। কিন্তু মাধব খুন করতে পারেন না। কারণ তাঁর অ্যালিবাই ভাঙা যাচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন হলো, আর কে? এমন কেউ, যাকে আনিসুর চিনতেন। আর তাই রাত্রিবেলা নিজের ঘরে ঢুকিয়েছেন। এমন কেউ, যাকে আনিসুর সম্ভ্রমের চোখে দেখতেন। তাই তাঁর জন্য চেয়ার পেতেছেন নিজের হাতে। পর্দা সরিয়ে আলোর ব্যবস্থা করেছেন। এবং তাঁর সামনে অনুগ্রহপ্রার্থীর মতো দাঁড়িয়েছেন। এমন একজন, যাঁর কাছে গাড়ি ছিল না। সবশেষে, এমন একজন, যিনি সতর্ক ছিলেন যেন তাঁর মুখ না দেখা যায়। কারণ হোটেলের বাসিন্দারা তাহলে পরবর্তীকালে তাঁকে চিহ্নিত করলেও করতে পারেন। 

‘কে হতে পারেন সেই ব্যক্তি? যিনি-ই হোন না কেন, তাঁর পায়ের ছাপ ছিল আনিসুরের ঘরে। অন্য অনেক ছাপের মধ্যে লুকিয়ে। সেটাই একটা কারণ, আনিসুরের ঘরকে ভেতরে থেকে বন্ধ করে রাখার। যদি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ না থাকত, যদি কেউ খোলা দরজা দিয়ে অথবা দরজার ঠেলা মেরে খুলে আনিসুরের মৃতদেহ আবিষ্কার করত, তাহলে সে প্রথমেই চেঁচামেচি করত। তাতে লোক জড়ো হতো। কিন্তু অনেকেই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো। কাছে যেতে সাহস করতো না। অপেক্ষা করতো পুলিশের। অপরদিকে, যদি ঘর বন্ধ থাকে, সেই ঘরকে খোলার জন্য স্বাভাবিকভাবে অনেক মানুষ জড়ো হবে। ঘর ভাঙার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া হবে অনেকে মিলে ভেতরে ঢোকা। বহুজনের নানারকম পায়ের ছাপ। চেষ্টারটনের ক্লাসিক রহস্যের মতো। একটা গাছের পাতাকে কোথায় লুকিয়ে রাখা যায়? গাছের মধ্যে। একটা গাছকে কোথায় লুকিয়ে রাখা যায়? জঙ্গলে। একটা পায়ের ছাপকে কোথায় লুকিয়ে রাখা যায়? বহু পায়ের ছাপের ভিড়ে। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ ছিল না। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।’ 

‘সেই ব্যাক্তি মাধব হতে পারেন না, কারণ মাধবের কাছে গাড়ি ছিল। মাধব গাড়িও চালাতে পারতেন। সে প্রসঙ্গ উপন্যাসেই আছে। দ্বিতীয়ত, মাধবের মুখ চেনবার প্রশ্নটাই অপ্রাসঙ্গিক। কারণ খুনের দুপুরেই তাঁকে হোটেলের সকলে দেখে নিয়েছে। আর তৃতীয়ত, মাধবের অ্যালিবাই।’ 

কফিতে চুমুক দিলাম। তারপর বললাম, ‘ওপরের ক্রাইটেরিয়া ফলো করেছেন একজনই।’ 

‘বিমল সমাদ্দার।’ ধীরে ধীরে বললেন অরুণ। 

‘বিমলবাবু মাধব আর আনিসুরকে যেভাবে সম্বোধন করেছেন, বোঝা যায় যে তাদের তিনি আগে থেকে চিনতেন। পুলিশের অফিসার হিসেবে আনিসুর তাঁকে সম্ভ্রমের চোখে দেখবেন, তাঁর জন্য চেয়ার জোগাড় করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন, স্বাভাবিক। বিমলবাবুকে কিছুতেই নিজের মুখ দেখানো চলত না। কারণ হত্যার তদন্ত করতে তাঁকেই আসতে হবে। কাজেই মুখ দেখালে চিহ্নিত হয়ে যাবেন তাড়াতাড়ি। সেই জন্যেই মেইন সুইচ অফ করতে হয়েছিল। আর সব শেষে, বিমলবাবু গাড়ি চালাতে পারতেন না। নিজের গাড়িও ছিল না তাঁর।’ 

অরুণ ভুরু তুললেন। 

‘প্রণবেশের অ্যাম্বাসাডর দেখে বিমলবাবু কী বলেছিলেন, সেটা আমি বারবার পড়ে এতক্ষণে প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছি। অনেকদিনের ইচ্ছে, কিনি একটা সেকেন্ড হ্যান্ড। কিন্তু গিন্নির বাধা। এই মাগ্নি-গণ্ডার বাজারে আবার ড্রাইভার রাখার খরচ জোগানো তো চাট্টিখানি কথা নয়? বিমলবাবু নিজে গাড়ি চালাতে পারলে ড্রাইভার কেন রাখবেন?’ 

অরুণের হাসি চওড়া হল। শাবাশ!’ 

‘আর ঠিক এই কারণেই, বিমলবাবু খুন করে হেঁটে হেঁটে থানায় এসেছিলেন। না, ট্যাক্সি ধরেননি। কারণ অত রাত্রে ঢাউস ব্যাগ নিয়ে কোনো ব্যক্তি যদি থানার সামনে নামতেন, ট্যাক্সিওয়ালা তাঁকে মনে রাখতো। সাবধানতা অবলম্বন করবার জন্য বিমলবাবু কোনো প্রত্যক্ষদর্শী চাননি। চটি পরে থানায় এসেছিলেন, কারণ আনিসুরের ঘরে পুলিশের জুতোর ছাপ থাকুক, সেটা চাননি। যদি দৈবাৎ এমন হতো যে ঘর ভাঙবার পরেও কেউ ঢুকলো না, আদর্শ নাগরিেেকর মতো ক্রাইম স্পটকে কনট্যামিনেট করল না, তাহলে পুলিশের জুতোর ছাপ পরীক্ষা করলেই জানা যাবে, কোন ছাপ কত পুরোনো। অপরদিকে, সাধারণ চটি পরে এলে সেই ভয় নেই। হোটেলের বহু বাসিন্দাই এই ধরনের চটি পরেন। যদি ঘর ভাঙার পর ভেতরে ঢোকেন, মিটেই গেল। যদি নাও ঢোকেন, কলকাতা শহরে এরকম চটি ব্যবহারকারী কয়েক লক্ষ মানুষ আছেন। পুলিশ কাকে ধরবে? ‘এবার প্রশ্ন, বিমলবাবু থানায় আসতে গেলেন কেন। এলেন, কারণ তিনি নিঃসন্দেহ হতে পারছিলেন না। যদি কোনোভাবে মৃতদেহ রাত্রের মধ্যেই আবিষ্কার হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে তদন্তের ভার পড়বে সেই সময়কার ডিউটি অফিসারের উপর। বিমলবাবু কোনোমতেই এই খুনের তদন্তভার অন্যের ওপর দিতে চাননি। সেটাও একটা বড়ো কারণ আনিসুরের ঘরকে ভেতর থেকে বন্ধ করে দেবার। ঘর ভাঙা হলে সকালবেলার আগে হবে না, এটা বিমলবাবুর হিসেবের মধ্যে ছিল। সেই সময়ে তিনি থানাতে থাকবেন। যদি কোনো গতিকে তার আগে, মানে রাত্রেই ভাঙা হয়ে যায়, সেটাকে ম্যানেজ করবার জন্য রাত্রে থানাতে এসেছিলেন। বারে বারে হাত পা ধুচ্ছিলেন কারণ আমার ধারণা রক্তের কিছু ছিটে তাঁর পায়ে এসে লেগেছিল। যাই হোক, বিমলবাবু যখন দেখলেন যে গভীর রাত অবধি কোনো ফোন আসেনি থানায়, নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন। 

‘বন্ধ ঘরের রহস্য নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছি না। কীভাবে বন্ধ করা হয়েছিল সেটা অপরাধের গৌণ অংশ। হয়তো অমিতাভ উপন্যাসটা শেষ করতে পারলে আমাদের থেকে ভালো কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে যেতেন।’ ভুরু কোঁচকালাম। শুধু দুটো জায়গা নিয়ে নিশ্চিত নই। বিমলবাবু কাছ থেকে গুলি করবার জন্য রাইফেল কেন ব্যবহার করলেন। আর জোড়া চিঠির রহস্যটা কী।’ 

‘আমি ভেবে কিছু ব্যাখ্যা বার করেছিলাম। বিমলবাবুকে খুন করতে হলে সার্ভিস রিভলভার ব্যবহার করা চলতো না। সেক্ষেত্রে ব্যালিস্টিক রিপোর্টে ধরা পড়ে যেত। সম্ভবত এই রাইফেলটা তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের। চাইলে চোরাপথে পিস্তল জোগাড় করতেই পারতেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে জানাজানি হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিল। আর হাতে বেশি সময়ও ছিল না। সম্ভবত আনিসুরের বাংলাদেশে ফিরে যাবার দিন এগিয়ে আসছিল। দ্বিতীয়ত, জোড়া চিঠির ক্ষেত্রে আমার যেটা মনে হয়েছে, মাধব প্রথম চিঠিটা সত্যিই পাঠিয়েছিলেন। তাঁর ভয় হয়েছিল আনিসুর তাঁকে হত্যা করতে পারেন। বিমলবাবু কোনোভাবে খুনের সন্ধেবেলা মাধবের কাছ থেকে সেটা জানতে পেরেছিলেন। বুঝেছিলেন যে শুদ্ধসত্ত্ব এবার জড়িয়ে পড়বেই। সে তিনি আনিসুরকে না মারলেও জড়াবে। তিনি যখন আনিসুরকে মারলেন, আনিসুরের টেবিলে একটা খাম দেখেছিলেন। শুদ্ধসত্ত্বর ঠিকানা লেখা। আনিসুর সম্ভবত বিমলবাবুর পর্দা ফাঁস করে দেবার উদ্দেশ্যে শুদ্ধসত্ত্বকে চিঠি লেখবার পরিকল্পনা করেছিলেন। বিমলবাবু বুঝতে পেরে খামের মধ্যে সাদা কাগজ পুরে পাঠিয়ে দেন। উদ্দেশ্য কিছুই না, গোয়েন্দাকে বিভ্রান্ত করা। শুদ্ধসত্ত্ব যখন জড়িয়েই পড়েছে, তাকে ঘেঁটে দেওয়া যাক।’ 

মাথা নাড়লাম। সম্ভব। 

‘কিন্তু খুনের মোটিভ? সেটা নিয়ে কি কিছু ভেবেছেন?’ অরুণ জিজ্ঞাসা করলেন। ‘মোটিভ কি এই উপন্যাসে জরুরি? অমিতাভ থাকলে সম্ভবত অনেক শক্তিশালী মোটিভ দিতে পারতেন। আমার যা মনে হয়েছে, বিমলবাবু যখন মিলিটারিতে ছিলেন, তাঁর সঙ্গে মাধবের পরিচয় হয়েছিল। মাধব থেকে আনিসুর। কোনোভাবে বিমলবাবুও কোকেন পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে যান। এখনও জড়িত ছিলেন কিনা জানি না, তবে আনিসুর সম্ভবত দুজনকেই ব্ল্যাকমেইল করতেন। এবার, আনিসুর যখন দেখলেন যে তাঁর মৃত্যু আসন্ন, ভাবলেন চিঠি লিখে বিমলবাবুর মুখোশ খুলে দিয়ে যাবেন। একরকম প্রায়শ্চিত্ত করবেন তাঁর পাপের। বিমলবাবু বুঝতে পেরে আনিসুরকে মেরে দেন। কিন্তু মোটিভ জরুরি নয় এই কারণে বলছি, এর বদলে অন্য কোনো মোটিভ হতেই পারত। হয়তো আনিসুরকে আইন ধরতে পারেনি কখনো, আর আজ সে মরে যাচ্ছে শাস্তি না পেয়েই। বিমলবাবু তাই তাকে আইন-বহির্ভূত শাক্তি দিলেন। অথবা হয়তো বিমলবাবু ফাঁসাতে চেয়েছিলেন মাধবকে। আনিসুর সেখানে তাঁর বোড়ে ছিল মাত্র। এটা তৃতীয় মোটিভ। এরকম আরও অনেক অনেক… ‘ 

‘বুঝেছি। আমিও যে মোটিভ নিয়ে বিশেষ ভেবেছিলাম এমনটা না! তবুও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলাম, কী ধরনের হতে পারে।’ 

এবার আমি কীভাবে এই উপন্যাস থেকে অমিতাভ মিত্রর হত্যা রহস্যে এলাম? ব্যাপারটা কাকতলীয়। কারণ উপন্যাস আর বাস্তবের মধ্যে এমন মিল তো এভাবে সম্ভব নয়, হয়তো এই দুটোর মধ্যে তেমন সম্পর্কও নেই। আপনি ওভাবে না বললে আমিও তলিয়ে পড়তাম না। কিন্তু হয়তো সম্পর্ক আছে, এটা ভেবে পড়েছি বলেই মিলগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আনিসুরের হত্যা আর অমিতাভ হত্যার মধ্যে অদ্ভুত মিল। অরুণ আর মাধবের ব্যাপারে আগেই বলেছি। দুজনেরই স্ট্রং অ্যালিবাই ছিল। দুই ক্ষেত্রেই পায়ের ছাপ নিয়ে একটা ধাঁধা ছিল। তদন্তকারী অফিসার দুই ক্ষেত্রেই খুনের রাত্রে থানায় এসেছিলেন, ডিউটি না থাকা সত্ত্বেও। দুজনের পায়েই ছিল চটি। ড্যানিয়েল যেমন বারবার বলে আসছিলেন যে অরুণ চৌধুরীই খুনি, বিমল সমাদ্দারও মাধবের দিকেই সন্দেহ নিয়ে যেতে চাইছিলেন। দুই ক্ষেত্রেই মৃতদেহ আবিষ্কার হয়েছিল দুই দিন পর, যার ফলে খুনের একজ্যাক্ট সময় বার করাটা দুই ক্ষেত্রেই একটা বড়ো সমস্যা। এ ছাড়াও মিল যেটা, তা হলো ড্যানিয়েলও বিমল সমাদ্দারের মতোই গাড়ি চালাতে পারেন না। আনন্দ পাঠক বলেছিলেন প্রথম দিনেই।’ 

‘এই মিলটাই আমাকে সবার প্রথমে ভাবিয়েছিল, যখন পাণ্ডুলিপিটা পড়ি।’ বললেন অরুণ। 

‘পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল, অমিতাভ মিত্র বড্ড বেশি করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, অপরাধী কে। বিমলবাবুর উপর জোর করে সন্দেহ এনে ফেলেছেন। এতে করে যা হয়, শুদ্ধসত্ত্বের মতো গোয়েন্দার সিদ্ধান্তে পৌঁছোবার রাস্তাটা ট্রিভিয়ালাইজড হয়। পাঠক অনেক আগে থেকেই সন্দেহ করতে শুরু করে দেয়। যাই হোক, সেটা লেখার দুর্বলতা। অমিতাভ তো আর পাকা রহস্য লিখিয়ে ছিলেন না। কিন্তু যখন থেকে আমি বিমলবাবুকে সন্দেহ করতে শুরু করলাম, মনে একটাই প্রশ্ন বারবার উঁকি দিচ্ছিল। সমস্যা যদি একই ধরনের হয়, সমাধানও কি একই ধরনের হবে না? বিমলবাবু যদি হত্যাকারী হন, ড্যানিয়েল লামাও কি তাহলে হত্যাকারী? 

‘এতদিন আমার সন্দেহের অভিমুখ ছিল স্বাভাবিকভাবেই আপনার দিকে। কিন্তু ড্যানিয়েল লামাকে যখন থেকে ভাবনার পরিসরে আনতে শুরু করলাম, জটগুলো কাটতে শুরু করল। বাগানে গামবুটের ছাপ। বাগানে ঢুকেছে, একপাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, তারপর বেরিয়ে গেছে। পুলিশের গামবুট। ড্যানিয়েল লামাকে সেদিন রাত পৌনে দশটার সময়ে জলাপাহাড় রোডে অনেকেই দেখেছে। আবার রাত একটা নাগাদ জলাপাহাড় রোড দিয়েই বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে তাঁকে হাঁটতে দেখেছেন আপনার পরিচিত বীরবিক্রম তামাং। ড্যানিয়েল আড়াইটের সময়ে থানায় এসেছেন। তাঁর পায়েও ছিল চটি। আর অদ্ভুতভাবে, কেস থেকে তাঁকে সরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। এর কয়েক মাসের মধ্যেই ড্যানিয়েল চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন।’ 

কফি ঢেলে নিলাম। সারারাত বসে ভেবেছি। এখন ক্লান্তি গুঁড়ি পায়ে এগোচ্ছে শরীর জুড়ে। 

‘আর একটা যেটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র, সেটা হলো বুলেটের ব্যবহার। গতকাল পুলিশের লাইব্রেরিতে গিয়ে বুলেটের রকম সম্বন্ধে জেনেছি, আর তারপর বাকিটা গুগল।’ অরুণকে বিশদে বললাম। অরুণ কোনো উত্তর দিলেন না। নিবিষ্টমনে শুনছিলেন। 

‘এই টুকরো টুকরো ঘটনাগুলোকে যদি সুতো দিয়ে বোনা যায়, তাহলে কীরকম ছবি পাওয়া যেতে পারে? ১১ জুন রাত্রিবেলা অমিতাভ আর ড্যানিয়েল দুজনেই আপনার বাড়ি এসেছিলেন। সেখানে দুজনের উত্তেজিত কথা কাটাকাটি হয়। ড্যানিয়েল বাগানে দাঁড়িয়েছিলেন। অমিতাভ আর আপনি লনে। তাই আপনাদের পায়ের ছাপ বাগানে পড়েনি, কিন্তু ড্যানিয়েলের পড়েছিল। অমিতাভ আপনার রাইফেল বার করে ড্যানিয়েলকে গুলি করতে যান। আপনি বাধা দেন। ধস্তাধস্তিতে আপনার হাত আঁচড়ে দেন অমিতাভ, আর রাইফেল থেকে গুলি বেরিয়ে গিয়ে অমিতাভর হাতে লাগে। অমিতাভ ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে যান। আপনি তাঁর পিছু পিছু গিয়েও থামাতে পারেননি। ড্যানিয়েল নিজের রেনকোটের ভেতর থেকে আপনার চুরি যাওয়া রাইফেলটা বার করেন। এবার প্রশ্ন হলো, ড্যানিয়েল সেটাকে পেলেন কী করে। তিন বছর আগে চুরি যাওয়া রাইফেল, ড্যানিয়েল সেটাকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন। এর আগে আপনাদের বাড়ি ড্যানিয়েল এসেছিলেন?’ 

‘হ্যাঁ। চা-বাগান সংক্রান্ত ঝামেলা মেটাতে বেশ কয়েকবার এসেছেন। দাদার বাড়িতে, আমার বাড়িতেও। এই রাইফেল চুরি যাবার কেসটাতেও এসেছিলেন।’ 

‘তার মানে তিনি জানতেন, জোড়ার একটা নেই। এই রাইফেল সম্বন্ধে আমি কিছু পড়াশোনা করেছিলাম। রেমিংটনের এই মডেলটা রেয়ার, যেটা জোড়ায় মিলত। এখন আর পাওয়াই যায় না। ড্যানিয়েলের শখ হলো আগ্নেয়াস্ত্র। নিয়মিত ক্যাটালগ দেখে নিজেকে আপডেটেড রাখেন। হয়তো চোরাবাজারে সন্ধান লাগিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে সেই রাইফেল তখনও ক্রেতার ঘরে গিয়ে ওঠেনি। ড্যানিয়েল সেটাকে নিজের জিম্মায় এনেছেন। এটা একটা সম্ভাবনা। আর একটা সম্ভাবনা হলো, পুলিশ চোরাবাজার থেকে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেছিল। ড্যানিয়েল তাদের মধ্যে থেকে আপনার রাইফেলের যমজটিকে চিনতে পেরে তুলে আনেন। হয়তো কালেকশনের শখ বলেই আপনাদের হাতে আর দেননি। নিজের কাছে রেখেছিলেন। যেটাই হোক না কেন, ড্যানিয়েল সেদিন রাইফেলটাকে নিয়ে এসেছিলেন আপনার ঘাড়ে দোষ চাপাবার জন্যে। হয়তো অমিতাভকে তিনি প্রোভোক করেছিলেন রাইফেল বিষয়ে কোনো খোঁচা মেরে। স্বভাব পাগল এবং উত্তেজিত অমিতাভ ঘরে টাঙানো রাইফেল হাতে নিয়ে ড্যানিয়েলকে মারতে যান। তারপর যেটা হলো আগেই বলেছি। অমিতাভ বেরিয়ে যাবার পর ড্যানিয়েল অন্য রাইফেলটি বার করে ঘরের ভেতর গুলি ছোঁড়েন। আলমারির ওপর রাখা কাচের জারটি ভেঙে যায়। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, দ্বিতীয় গুলির আওয়াজ মিসেস বাসু শুনতে পেলেন না কেন। সেদিন বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি পড়ছিল। ঘন ঘন বাজের আওয়াজের সঙ্গে গুলির আওয়াজ গুলিয়ে ফেলা স্বাভাবিক ছিল। তাহলে প্রথম গুলির আওয়াজ শুনতে পেলেন কী করে? কারণ সেই গুলিটা বাগানে চলেছিল। আর দ্বিতীয় গুলি আপনার বাড়ির ভেতরে, যখন মিসেস বাসুও নিজের ঘরে ঢুকে গিয়েছেন পুলিশকে ফোন করবেন বলে। তাঁর পক্ষে নিজের ঘর থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা আপনার বাড়ির ভেতর গুলির আওয়াজ ঘন ঘন বাজ পড়বার রাতে আলাদা করে চিনতে না পারারই কথা। ড্যানিয়েল গুলি করে বললেন, এই গুলিটা চালানো হলো অন্য গুলিকে ঢেকে দেবার জন্য। তারপর রাইফেলের নল আপনার দিকে ঘুরিয়ে হুমকি দিলেন, যদি এই ব্যাপারে মুখ খোলেন, তাহলে গুমখুন হতে আপনারও বেশি সময় লাগবে না। আর নির্দেশ দিলেন, এই বাড়িতে অমিতাভ যে এসেছিলেন, তার চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে। পায়ের ছাপ যেন পুলিশ আসার আগে মুছে দেন। আপনি ভয় পেয়েছিলেন। কেন, সেটা জানি না। কিন্তু এখানে একটা চাল চাললেন। ড্যানিয়েলের খুঁটি হবেন না ঠিক করলেন মনে মনে। ড্যানিয়েলের সামনে অমিতাভর আসার পায়ের ছাপ জল দিয়ে মুছে দিলেন। ড্যানিয়েল অত খেয়াল করলেন না, করলে দেখতে পেতেন যে অমিতাভর যাবার পায়ের ছাপ আপনি মোছেননি। আপনি হয়তো চাইছিলেন পুলিশ আবিষ্কার করুক যে অমিতাভ এই বাড়িতে এসেছিল। আরও যেটা ইচ্ছাকৃত ভুলে গেলেন, তা হলো ট্রিগার থেকে অমিতাভর আঙুলের ছাপ মুছতে। ড্যানিয়েল যাবার আগে আপনাকে একজোড়া জুতো দিয়ে বলে গিয়েছিলেন সেগুলো দিয়ে বাগানে নকল ছাপ বানাতে হবে। প্রশান্ত গুরুঙের জুতো সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিলেন ড্যানিয়েল। প্রশান্তকেও আগে থেকে গল্প তৈরি করে রাখবার নির্দেশ দেন। সেই গল্পটাই আপনাকে বলে গেলেন, যাতে দুজনের ভাষ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তার মানে, ড্যানিয়েল আগে থেকেই গল্প তৈরি করে রেখেছিলেন। অর্থাৎ এই খুন পূর্বপরিকল্পিত হবার সম্ভাবনাই বেশি। আমি প্রথম থেকে ভাবছিলাম যে প্রশান্ত গুরুংকে টাকা খাইয়েছেন আপনি। এটা ভাবিনি যে টাকার থেকে অনেক বড়ো অস্ত্র হলো পুলিশকে হুমকি। বিশেষ করে সেই পুলিশ যদি সত্তর দশকের নির্মম ড্যানিয়েল হয়। প্রশান্ত হুমকির মুখে ড্যানিয়েলের কথামতো কাজ করলেন। বলাই বাহুল্য, প্রশান্ত গুরুংকে ড্যানিয়েলের দরকার হয়েছিল প্রথম গুলির ব্যাখ্যার জন্য। আপনি ভয় পেয়েছিলেন, কিন্তু এটাও বুঝেছিলেন যে ড্যানিয়েল যেভাবে ঘরের ভেতর গুলি ছুঁড়ে গল্প সাজিয়েছেন, তাতে করে আপনি বেঁচে যাবেন। কাজেই প্রশান্ত গুরুংকে আপনিও আঁকড়ে ধরলেন। বাগানের ঘাসে রক্তটা মনে হয় খেয়ালে আসেনি আপনাদের কারোর। নাকি ওটাও ইচ্ছাকৃত? ড্যানিয়েলের ওপর আর একটা শেষ কিস্তি নিজে মারতে চেয়েছিলেন, তাই কি? ওটা মুছে দিলেই পুলিশ আপনাকে থানায় নিয়ে যেত না। কিন্তু ভাগ্যিস নিয়ে গিয়েছিল! নাহলে আপনার অ্যালিবাইটা তৈরি হতো না যে! নাকি অমিতাভ খুন হবেন, সেটা আন্দাজ করেই চিহ্নগুলো মোছেননি, যাতে থানায় গিয়ে আপনার অ্যলিবাই তৈরি হয়? ড্যানিয়েল জলপাহাড় রোড ধরে নেমে গেলেন। সেই সময়ে অনেকেই তাঁকে দেখেছে। এবার প্রশ্ন হলো, ড্যানিয়েল গেলেন কোথায়। অমিতাভই বা কোথায় গেলেন। অনুমান করছি, জলাপাহাড় রোডের কোনো এক প্রান্তে ড্যানিয়েলের গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। সঙ্গে ছিল চালক। ড্যানিয়েল গাড়িতে উঠে অমিতাভকে ধাওয়া করলেন। সেটা কঠিন ব্যাপার নয়। কারণ অমিতাভ যেদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছেন, তার পাঁচ মিনিট পরে বেরোলেও সঙ্গে গাড়ি থাকলে অমিতাভকে ধরে ফেলা সম্ভব। সম্ভবত অমিতাভ ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। হাত থেকেও রক্ত ঝরছিল। ড্যানিয়েল গাড়ি নিয়ে অমিতাভকে ধরে ফেলেন। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হলো, খুন হয়তো পূর্বিপরিকল্পিত ছিল না। ড্যানিয়েল তখনও হত্যা করবেন কিনা মনস্থির করতে পারেননি। তিনি অমিতাভকে ধাওয়া করবার বদলে নিজের বাড়ির দিকে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু অমিতাভ ড্যানিয়েলের বাড়ি এসে হাজির হন এবং হুমকি দেন যে তিনি থানায় ড্যানিয়েলের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করবেন। যে কারণেই হোক না কেন, অমিতাভর মুখ বন্ধ করা ড্যানিয়েলের পক্ষে জরুরি ছিল। কিন্তু আমার নিজের ধারণা হত্যা পরিকল্পিত। প্রশান্ত গুরুঙের জুতো সেই কারণেই ড্যানিয়েল সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। প্রশ্ন উঠবে, আপনার কাছেও তো সেই জুতো থাকতে পারতো। কিন্তু হত্যার পরিকল্পনা যদি আপনি না করেন, তাহলে প্রশান্ত গুরুঙের জুতো খামোখা আপনার কাছে থাকবে কেন? আর যদি আপনি হত্যার পরিকল্পনা করেন, নিজের বাগানে এরকম সিন ক্রিয়েট না করে অমিতাভকে গোপনে মেরে দিলেন না কেন? সেটা তো অনেক সহজ পন্থা হতো।’ 

‘ড্যানিয়েলই জুতো সঙ্গে করে এনেছিল। আপনার প্রথম অনুমান ঠিক। পুরোটা প্ল্যান করে হয়েছে। ওর উদ্দেশ্য ছিল হয় আমাকে, নাহলে প্রশান্তকে ফাঁসাবে। সেটা পরে বুঝেছি।’ 

বড়ো একটা নিশ্বাস ফেললাম। এই প্রথম অরুণ চৌধুরী স্বীকার করলেন, খুনটা ড্যানিয়েল লামা করেছেন। 

‘তাহলে, ড্যানিয়েল কোনোভাবে অমিতাভর সন্ধান পান। অবশ্য সন্ধান এমনিতেও পেতেন, কারণ অমিতাভকে আর কোথাও না পেলে তাঁর আস্তানাতেই মিলতো। অমিতাভর পকেটে মদের বোতল ছিল। হাতে গুলি খেয়ে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়েছেন, ব্যাথা ভুলতে মদ খাচ্ছিলেন। হয়তো জলাপাহাড় রোডের একপাশে দাঁড়িয়ে ব্যাথায় গোঙাতে গোঙাতে মদ ঢালছিলেন গলায়, যাতে অনুভূতিগুলো অসাড় হয়ে যায়। এটা অনেক বক্সার এবং রেসের মাঠের জকির পুরোনো অভ্যেস। শারীরিক ব্যথা ভুলতে অনেকটা কড়া রাম একসঙ্গে খেয়ে ফেলা যাতে স্নায়ু অবশ হয়ে যায়। যাই হোক, এই মদ খাবার সময়ে ড্যানিয়েল তাঁকে তোলেন। অমিতাভকে নিয়ে ওল্ড সেমেট্রিতে আসেন। গাড়ি ছেড়ে দেন কারণ সাক্ষী থাকলে চলবে না। ঝোড়ো বৃষ্টির রাত্রে সাবধানে গাড়ি চালালেও ওল্ড কার্ট রোডের কবরখানায় সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। তাহলে সাড়ে দশটা থেকে রাত অন্তত বারোটা, ড্যানিয়েল অমিতাভকে নিয়ে করলেনটা কী? এই জায়গাটায় আমি ধাঁধায়। আমার নিজের ধারণা, কিন্তু সেটা ভুলও হতে পারে, ড্যানিয়েল প্রথম অমিতাভকে জেরা করছিলেন— সে কতটা জানে পুলিশের কুকীর্তি। তারপর তাকে মারছিলেন। প্রচণ্ড আক্রোশে অমিতাভকে কিল চড় লাথি ঘুষি মারতে পারেন। অথবা অমিতাভর সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। সেই সময়েই কোনো ছুরি দিয়ে অমিতাভর হাতে আঘাত করতে পারেন। উদ্দেশ্য ছিল, যে হাত দিয়ে অমিতাভ লেখেন, সেটা কেটে ফেলা। সেই কারণে কবজির কাছে কাটা ছিল। কেন এমন করেছিলেন, সেটা জানি না। আপনি বলতে পারবেন হয়তো। কিন্তু সম্বিত ফেরবার পর ড্যানিয়েল দেখলেন, এতে সমস্যা বাড়বে। আগেই অমিতাভর হাতে গুলি লেগেছে, তার রক্তক্ষরণে অমিতাভ দুর্বল হয়ে গেছেন। এরপর আরও বেশি রক্তপাত যদি হয়, অমিতাভ তাতে অজ্ঞান হয়ে পড়বেন। মারাও যেতে পারেন। কিন্তু যদি অরুণের ঘাড়ে দোষ চাপাতে হয়, তাহলে এখনই অমিতাভ মারা গেলে অরুণ অ্যালিবাই পেয়ে যাবেন। ড্যানিয়েল জানতেন, অরুণের বাড়ি পুলিশ আসতে পারে। অন্তত ঘণ্টাখানেক থাকবে। কাজেই, অমিতাভকে বারোটার আশেপাশে মরতে হবে। কারণ হত্যা করতে গেলে পুলিশ চলে যাবার পর অরুণকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কার্ট রোডেআসতে হবে। পুলিশ যদি এগারোটার সময়ে বেরিয়ে যায়, তারপর অরুণকে এখানে আসতে আসতে এই ঝড় বৃষ্টির দিনে, বারোটাই বাজার কথা। কিন্তু এই পুরোটা আমার নিজের অনুমান। আপনি সত্যিটা জানলে বলুন।’ 

অরুণ জোরে নিশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। সেই অবস্থাতেই বললেন, ‘ভাবতে পারছি না! এতটা অত্যাচার! আমিও এ ব্যাপারে জানি না। অনেকবার ভাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এত নিখুঁত ভাবে আপনি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, মনে হচ্ছে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি পুরোটা।’ 

অমিতাভর কবজিতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে তাঁকে ফেলে রাখা হলো। ব্যান্ডেজ সম্ভবত ড্যানিয়েল নিয়েই বেরিয়েছিলেন। বাকি রক্ত বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেল। অমিতাভ ঝিমিয়ে গেলেন। ঘণ্টাখানেক কি ঘণ্টা দেড়েক পর, রাত বারোটার আশেপাশে অমিতাভকে গুলি করলেন ড্যানিয়েল। নিজের সংগ্রহের রিভলভার দিয়ে। কিন্তু বুলেট ছিল পুলিশের হেফাজত থেকে আনা। এখানেই ভুলটা করেছিলেন। মুখে গুলি করলেন, কারণ অমিতাভর প্রতি তাঁর ঘৃণা এতই তীব্র ছিল যে মুখটাকে নষ্ট করে দিতে চাইছিলেন। তারপর লাশ উপুড় করে দিলেন, যাতে মুখ দেখতে না হয়। এই ঘৃণার কারণ আমি জানি না। আপনি হয়তো জানেন। মুখে গুলি করার আর একটা কারণ হতে পারে, লাশ শনাক্ত করতে সময় লাগবে। যে কোনো কারণেই হোক, ড্যানিয়েল নিজের জন্য কিছুটা সময় চাইছিলেন। এরপর চিহ্ন লুকোবার পর্যায়। যেহেতু অরুণ মিসেস বাসুর সামনে অমিতাভর নাম ধরে ডেকেছেন, ড্যানিয়েল জানতেন অমিতাভর খোঁজ হবেই। হয়তো পুলিশ কুকুরও আনা হতে পারে। বড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে, আর কুকুর সেখান থেকে গামবুটের গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিকই পৌঁছে যাবে ড্যানিয়েলের বাড়ি। কাদায় ড্যানিয়েলের বুটের ছাপ পড়েছিল, কিন্তু সেটাকে ম্যানেজ দেওয়া যায়। কারণ যখন পুলিশ বড়ির সন্ধান পাবে, তাদের বুটের ছাপের মধ্যে মিলিয়ে দেওয়া যাবে নিজের জুতোর ছাপ। আবারও, অমিতাভর উপন্যাসের সঙ্গে মিল। আর ঠিক এই কারণেই, বিমলবাবু যেমন তদন্তের ভার অন্যের হাতে ছাড়তে চাননি, ড্যানিয়েলও চাননি। সেই কারণেই থানায় এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, তদন্ত নিজের হাতে নেওয়া। ক্রাইম স্পর্ট কন্টামিনেট করে দেওয়া। এবার, বুট পরে রাস্তা দিয়ে হাঁটা যাবে না। কুকুর সন্ধান পাবে। সঙ্গে গাড়ি নেই। ড্যানিয়েল গাড়িও চালাতে পারেন না। তাহলে উপায়? উপায় একটাই, বুট খুলে হাতে নেওয়া। কিন্তু রাস্তা দিয়ে এভাবে হেঁটে গেলে লোকের চোখে পড়বে। ড্যানিয়েল নিজের রেনকোট খুলে ফেললেন। সেটাকে বস্তা বানিয়ে ভেতরে বুট ভরে ফেললেন। মনে রাখতে হবে, বুটকে আশেপাশে কোথাও ফেললে চলবে না, কারণ পুলিশের কুকুর। ফেলতে হবে দূরে কোথাও। ড্যানিয়েল নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন। বাড়ি তাঁকে যেতেই হতো। কারণ জামা প্যান্টেও রক্ত লেগেছিল। সেগুলোকে খুলে ফেলে হাপিশ করতে হবে। বীরবিক্রম যখন ড্যানিয়েলের হাতে প্লাস্টিকের ঝোলা দেখেছেন, তখন ড্যানিয়েল নিজের বাড়ির দিকে খালি পায়ে হাঁটছেন। হাতের রেনকোটের ঝোলায় বুটজোড়া। বৃষ্টিতে ভিজছেন। বাড়ি এসে পোশাক পালটালেন। স্নান করলেন। তারপর থানায় বেরোবার জন্য তৈরি হলেন। থানায় আসার কারণ আগেই বলেছি। এই কেস নিজের হাতে নিতে হবে। কিন্তু পুলিশের গাড়ি নিলেন না। কারণ জামাকাপড় এবং জুতোজোড়াকে ফেলতে হবে। তার সাক্ষী রাখা চলবে না। হেঁটে থানায় এলেন। চটি পরেছিলেন, কারণ খালি পায়ে কার্ট রোড থেকে নিজের বাড়ি আসতে গিয়ে তাঁর পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। পায়ে সম্ভবত মলম লাগিয়ে সেটাতে হাওয়া লাগাতে চাইছিলেন। চাপা জুতোর মধ্যে ক্ষতবিক্ষত পায়ের পাতা ঢোকালে আরও বেশি যন্ত্রণা হতো। খোলামেলা চটি সেক্ষেত্রে অনেক বেশি সুবিধেজনক, বিশেষত যেখানে তাঁকে আবার বেশ খানিকটা রাস্তা হাঁটতে হবে। সেই জন্যই খোঁড়াচ্ছিলেন, কারণ পা কেটে গিয়েছিল। মাঝে কোনো এক নির্জন খাদের ধার দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিলেন অপরাধের চিহ্ন সমস্ত জামাকাপড়। কিন্তু থানায় এসে স্তম্ভিত হয়ে ড্যানিয়েল দেখলেন অরুণকে, মানে আপনাকে আটক করা হয়েছে। ব্যাপারটা তাঁর হিসেবের বাইরে ছিল কারণ বাগানের ঘাসে রক্তের দাগ তাঁর খেয়ালে আসেনি। এটাও বোঝেননি যে অরুণ তাঁকে পালটা চেকমেট করবেন। পুরো প্ল্যান ভেস্তে যাবার উপক্রম, কারণ আপনি অ্যালিবাই পেয়ে গেছেন। ঠিক এই জায়গা থেকেই গল্পের মোড় ঘুরে গেল। 

‘এতক্ষণ যা যা বললাম, তার মধ্যে ঋষি রোডের বাড়ি একটা অন্যতম জায়গা অধিকার করে আছে। ড্যানিয়েল নকশাল জমানার তরুণদের লাশ গায়েব করতেন এই বাড়ির আশেপাশের জঙ্গলে। তাই বাড়িটা তিনি চিনতেন। কিছুদিনের জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন, যাতে এখানে বসে পুরো প্ল্যান করতে পারেন। প্ল্যান মানে, বাজেয়াপ্ত রাইফেল, প্রশান্ত গুরুঙের জুতো, খুনের পিস্তল ইত্যাদি রেখে দেওয়া। শুধু সেটাই না, তাঁর অন্যান্য অপরাধের সাক্ষ্যগুলোকেও হয়তো রেখে দিতেন এখানেই। অথবা সন্দেহভাজনদের বাড়ির ভেতর ঢোকাতেন জেরা করবার জন্য। নকশাল জমানায় এরকম প্রচুর গোপন বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায় যেগুলোকে পুলিশ টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতো। আনন্দ পাঠকও বলেছিলেন যে ড্যানিয়েলের জিম্মায় এরকম কয়েকটা আস্তানা ছিল সেই সময়টায়। রামবীরের ওই কারণেই প্রবেশাধিকার ছিল না বাড়ির ভেতর। ড্যানিয়েল হয়তো ভেবেছিলেন অমিতাভকেও এখানেই মারবেন। কিন্তু তাহলে অরুণের ওপর সন্দেহ ফেলা মুশকিল ছিল। কোনো এক রাত্রে এখানে থাকবার সময়ে নিছক খেয়ালের বশে দেয়ালের গায়ে ছবিটা এঁকেছিলেন। ছবির মূর্তির মাথায় টুপিটা দেখেই সন্দেহ প্রথম হয়েছিল ড্যানিয়েলের উপর। সাধারণ মানুষ কেন টুপি পরবে খামোখা? টুপি পরে পুলিশ। ড্যানিয়েল নিজের পুলিশ-সত্তা নিয়ে এতই সচেতন ছিলেন যে ছবিতেও নিজেকে অজান্তে প্রকাশ করে গিয়েছেন। কেন ছবিটা এঁকেছিলেন, সেই কারণ আজ আর জানা যাবে না। সম্ভবত প্রবল ঘৃণা থেকে উদ্ভূত জিঘাংসা।’ 

অনেকটা বলার পর থামলাম। প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফির অবশিষ্টাংশ এক চুমুকে শেষ করে বললাম, ‘বাকি গল্পটা আপনি বলবেন। কী ছিল এই হত্যার মোটিভ। ড্যানিয়েলের ঘৃণার কারণ কী ছিল। আপনিই বা কেন মুখ খোলেননি। বরং নিজেকেই হত্যাকারী হিসেবে দাবি করেছিলেন। এবার আপনার বলার পালা। আর আমি শুনব।’ 

ঘন তন্দ্রায় ঢেকে আছে চারপাশ। টুপটাপ করে টালি থেকে কুয়াশা ঝরে পড়ছে। পাশের নির্জন ভৌতিক জঙ্গল স্তব্ধ। চরাচর জুড়ে এই অপার্থিব নির্জনতার মধ্যে অরুণকে দেখে মনে হচ্ছিল, নিঃসঙ্গ একটা পত্রহীন বৃক্ষ। আমার গল্পের সঙ্গে সঙ্গে অজান্তেই যার বয়স অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। অজস্র বলিরেখা দেখা দিয়েছে মুখ জুড়ে। ভেঙেচুরে যাচ্ছে পাথরখণ্ড। কপালের ওপর ঝুলে পড়া চুল থেকে প্রাণপণে চোখ সরিয়ে নিলাম। দেখবো না কিছুতেই।

বেশ অনেকটা সময় নীরব থাকার পর অরুণ বলতে শুরু করলেন। 

***

অনুষ্টুপের জন্য একটা গল্প লিখতে হতো।
তোমাকেও পাঠালাম এক কপি। পড়ে মতামত
দিও, তারপর ওদের জন্য ডাকে ফেলব। 

.

১৯/০৬/১৯৭৪ 

প্রিয় সঞ্জয়, 

আমার সাক্ষাৎকার বেরোবার পর কিছু প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি। সবটাই বিরূপ এমন না হলেও, বাঁকা চোখ চিহ্নিত করবার ক্ষমতা কিছুদিন সামান্য লেখালেখির সূত্রে আয়ত্ব হয়েছে। সেগুলোকে উপেক্ষা করাই যেত, তবে আমারও দায় থেকে যায় নিজের অবস্থান খোলাখুলি বলবার। কেন বড় কাগজে আমরা ডাক পাই না, সেই ক্ষোভেই যদি এমন অভিযোগ করে থাকি বলে কেউ কেউ মনে করে থাকেন, এবং তাদের মধ্যে যদি একজনও থাকেন যিনি অবাণিজ্যিক কাগজের তন্বিষ্ঠ পাঠক, তাহলে তাঁকে রিচ করা লেখকের কর্তব্য বলেই মনে করি। এর মধ্যে যেটা হয়েছে, উল্লিখিত সংবাদপত্র নাকি বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে আমার লেখা ছাপবে না। অরুণেরও নয়। ওর কী মনে হবে জানি না, কিন্তু এর ফলে যদি আমি খুব ভেঙে পড়েছি বলে ভাবা হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে নিজের অবস্থান আমিই স্পষ্ট করিনি, এ কথাও জোরের সঙ্গে বলতে পারিনি যে আমরা বড় কাগজের শারদীয়ার মুখ চেয়ে লেখালেখি করি না। আমি একটা লেখা পাঠালাম, যদি তুমি মনে করো তোমার কাগজে ছাপাতে পারবে, বার করে দিও। যেহেতু সাক্ষাৎকার তোমার কাগজে বেরিয়েছিল তাই রিজয়েন্ডার ওখানেই আসা উচিত। তবে আমার মনে হয় না এত ছোটো ব্যাপারকে তোমরা প্রকাশ করবে। যদি মনে হয় কাটছাঁট করে চিঠি আকারে প্রকাশ করতে পারবে, সেটাই করে দিও। তবে যা যা লিখেছি, সেগুলো সত্যিই প্রকাশ করবে কিনা তোমার কাগজ, যথেষ্ট সন্দেহ আছে। না করলেও তোমাকে ভুল বোঝার সম্ভাবনা এদিক থেকে নেই, কারণ এদের চরিত্র সম্পর্কে আমি সম্যক ওয়াকিবহাল। 

উপন্যাসের ব্যাপারে তোমাকে বলেছিলাম, ওটা হয়ে এসেছে। কম্পোজের জন্য পাঠিয়ে দিতে তাড়া দিচ্ছে ওরা। যদি এ বছর বেরোয়, তাহলে কলকাতা যাব হয়তো। তোমার জন্য এক কপি অবশ্যই তোলা থাকবে। দেখা হবে তখন। 

—অমিতাভ 

তোমার সত্যিই মনে হয় এ লেখা ছাপাতে পারবে? আমার মনে হয় না। তবুও পাঠালাম, অন্তত একটা ডকুমেন্টশন থাকুক। 

.

ছায়া ঘনাইছে বনে বনে 

আমি কারোর নাম নেব না। না কোথাও সংবাদপত্রের, না তাদের পোষা লেখক কবিদের। একেই মনে করা হচ্ছে আমি কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির খেলায় নেমেছি। সেটাকে আর বাড়তে দেব না। 

.

আমরা অনেকেই যখন আজ থেকে বছর দশেক আগে লিখতে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম পৃথিবী উলটে দেব। এখন দেখতে পাচ্ছি, ঘরের কোণা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করবার ক্ষমতাও লেখালেখি করার মাধ্যমে অর্জন হয় না। স্বভাবতই এই আত্ম-আবিষ্কার জরুরি হলেও বেদনাদায়ক। আবার স্বাভাবিকও বটে। সমাজ সাহিত্য ও সভ্যতার ঝোঁক যে এভাবে পাল্টানো যায় না সেটা উন্মোচিত হবার পর কেউ লেখা থামিয়ে দেয়, কেউ চলে যায় কনভেনশনের নিরাপদ পক্ষপুটের তলায়, আবার কেউ কেউ অভ্যাস অথবা জেদের বশেই নিজেকে পাল্টাতে পারে না। এরকম সব যুগেই হয় ও হয়ে চলেছে। 

কিন্তু এতটা স্বাভাবিককে গ্রহণ করে নেবার পরেও দু চারটে কথা থেকে যাচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অবশ্যই বিশ্বাস করি না যে অবস্কিওরিটি একজন লেখকের সাধনার মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। লেখার পর যদি কানেক্ট করতে না চায় তাহলে ছাপাবার দরকার থাকে না, লিখে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখলেই হয়। অখ্যাতি ও হা হা অন্ধকারের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে রাজপুত্রের তরবারি, এমন রোমান্টিকতাতেও সহমত পোষণ করি না। কিন্তু তারপরেও, ক্রমে ক্রমে একটা ভাষার সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে গুটিকয় সংবাদপত্র এবং তাদের অধীনে থাকা কিছু বাণিজ্যিক পত্রিকা, এই ঘটনাটাকে চোখে আঙুল দিয়ে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে যদি না দেওয়া যায়, এবং কীভাবে একজন কমিটেড লেখককে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে সেটাকে যদি চিহ্নিত না করা যায়, তাহলে অন্যধারার লেখালেখির পরিণতি সেটাই হতে পারে, পঞ্চাশের দশক থেকে যা হয়ে এসেছে। কেরিয়ারের শুরুতে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গা গরম ভাষণ শুনিয়ে তারপর যেই বিগ হাউসে লেখার সুযোগ মিলবে, মাথা নিচু করে সেই কনভেনশনের খোঁয়াড়ে ঢুকে পড়া। ব্যাপারটা এমন নয় যে আমি এগুলো প্রথম বলছি। আমার আগেও অনেকে বলেছেন, পরেও বলবেন। কিন্তু কয়েক দশক ধরে বৃহৎ পুঁজি এবং লগ্নিশাসিত যে সাহিত্যবাজার এখানে তৈরি হয়েছে, সেখানে লেখালেখি আর বাণিজ্যিকে তফাত করা যাচ্ছে না এই মুহূর্তে। এটুকুর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন ক্রোধ, চোয়ালচাপা রাগী প্রবন্ধ এবং লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠী তৈরি হওয়া বাদে আর কিছু হয়নি, হয়নি কোনো সম্মিলিত প্রতিরোধ। তাই আমাদের সত্যভাষণে নিজেদের ইগো সন্তুষ্ট হওয়া বাদে আর কিছুই হচ্ছে না। 

***

সত্যি বলতে কী, আমি তোমাকে বলছি সঞ্জয়, লিটল ম্যাগাজিনও দলাদলি আর ঈগোর চাপে শ্বাসরুদ্ধ হবে, আর নয়ত একদিন হয়ে উঠবে পাল্টা প্রতিষ্ঠান।

***

ফলত, যেটা ঘটছে, বিগ হাউসের মুনাফার চাপে বছরে চারটে করে উপন্যাস নামিয়ে যেতে হচ্ছে একজন সৃষ্টিশীল লেখককে। পুজো, পয়লা বৈশাখ ইত্যাদি উপলক্ষ্যে। বিনিময়ে অবশ্যই মোটা অর্থ, উপঢৌকন অথবা চাকরির নিরাপত্তা থাকছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশের লেখকের কথা আমি জানি না যাকে বছরে চারটে কি পাঁচটা উপন্যাস লিখতে হয়, নিয়ম করে বছরের একটা কি দুটো বিশেষ সময়ে লিখতে হয় গুচ্ছখানেক কবিতা এখানে হয়, কারণ এখানে প্রকাশনা ব্যবসা চালায় বৃহৎ সংবাদপত্র। এমনকি আমাদেরই বহু বন্ধু, যারা সূচনায় কমিটেড ছিল, নিরীক্ষামূলক লেখাপত্র লিখতেই লিখতেই কফিহাউসে বসে তারাও মনে মনে প্রত্যাশা করে চলে, বড় বাড়ি থেকে কবে আসবে সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত পুজোর চিঠি। আর এভাবেই প্রতিদিন হত্যা করা হয় একজন স্বপ্নদর্শী লেখক বা কবিকে। তার গলায় এস্টাব্লিশমেন্টের দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে পুরে দেওয়া হয় গোয়ালঘরে, যেখানে পরিচিতি, পুরস্কার, অর্থ ও সামাজিক সম্মানের খড় বোঝাই করা আছে। সেই গোয়ালঘর থেকে যে বস্তুগুলো বেরুচ্ছে ইদানীং তাদের অভিধা পরকীয়া প্রেম, নিষিদ্ধ যৌনতা, মধ্যবিত্তর পারিবারিক সংকট, এবং গোয়েন্দা ক্রাইমের অঞ্চল। পরিবেশ, পরিস্থিতি বিষয়ক লেখা এখানে ট্যাবু। ভাষা ও শৈলী বিষয়ক পরীক্ষা ব্রাত্য, যেহেতু তা প্রতিস্পর্ধার জন্ম দেয়। অবশ্য সেই প্রতিস্পর্ধাকেই আবার গ্রহণ করা হয়, যখন তার সময় পেরিয়ে গিয়েছে। পঞ্চাশের দশকের বিদ্রোহ যখন সত্তরে এসে গলিত ক্লীব, তাকে রঙচং মাখিয়ে নতুন যুগের নতুন শৈলী হিসেবে সামনে আনা হয়। ততদিনে নখ দাঁত হারিয়ে সেই প্ৰতিস্পর্ধা নির্বিষ বৃদ্ধে পরিণত হয়েছে। 

উল্টোটাও সমানভাবে সত্যি। নন-কনফর্মিস্ট লেখককে সহ্য করতে পারা কঠিন, যেহেতু সে রেজিন্টাস দিচ্ছে। তাই যেন তেন প্রকারেণ তাকে চেপে দাও, তাকে প্রচার করো ডিফিক্যান্ট হিসাবে, তাকে ঠেলতে ঠেলতে একটা কোণায় সরিয়ে দাও, যে অন্ধকারে পাঠকের চোখ যায় না। অমিয়ভূষণ মজুমদার অবস্কিওর কারণ তাঁর লেখা পাঠক পড়ে না। পাঠক পড়ে না কারণ বড় পাবলিশার ছাপায় না। বড় পাবলিশার ছাপায় না কারণ তিনি বড় কাগজে লিখতে পারেন না। বড় কাগজে লিখতে পারেন না কারণ তিনি ডিফিক্যান্ট। এবং তিনি ডিফিক্যান্ট কারণ তিনি অবস্কিওর! এই ভিসাস সার্কেল তৈরির পেছনে পাঠকের ক্যালাসনেস দায়ী তো বটেই কারণ তিনি বড় পাবলিশিং হাউস পেরিয়ে ছোটো প্রকাশনার দিকে তাকাতে চান না, কিন্তু একইসঙ্গে দায়ী আমাদের মতো তথাকথিত ভিন্নধারার লেখক ও লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা, যারা অমিয়ভূষণকে সংগঠিত দায়িত্ব এবং নিজেদের চেষ্টায় বৃহত্তর গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিল না। দিল না কারণ বৃহৎ পুঁজির বিপরীতে আমরা সঙ্ঘবদ্ধ নই, আমাদের ভেতরেও গোপনে লালিত হয়ে চলেছে বিগ হাউসে ডাক পাবার স্বপ্ন। তাই ভালো লেখককেও লিখতে হচ্ছে বাজার-চলতি গোয়েন্দা গল্প, কমিটেড বামপন্থী সাহিত্যিক রগরগে যৌনতায় ভরা আখ্যান লিখছেন, কবি হয়ে যাচ্ছেন পুজো সংখ্যায় চোলাই করা ঔপন্যাসিক, এবং এই গোটা প্রক্রিয়াটার মধ্যে দিয়ে ভাষাকে হত্যা করা হচ্ছে। এক মেদুর ভাষাহীনতায় গৌণ হয়ে যাচ্ছে আমাদের সাহিত্যজগৎ যেখানে একজনের লেখা থেকে অন্যজনেরটা আলাদা করা যাচ্ছে না। আর গোটাটাই করা হচ্ছে সাহিত্যপ্রসবের নামে কিন্তু পেছনে প্রায় অদৃশ্য ক্রিয়াশীল থাকছে মুনাফার অঙ্ক। 

তাই পুজোসংখ্যা, পয়লা বৈশাখ সংখ্যা, দোল সংখ্যা, ঈদ সংখ্যাতে লেখালেখির ডাক পেয়ে উল্লসিত হলে, আমি আবার দুঃখিত হবার মতো রোমান্টিকতারও পক্ষপাতী নই, বুঝতে হবে যে আমাদের এই প্রতিস্পর্ধা নামক অবাণিজ্যিক প্র্যাকটিসটার মধ্যেই গলদ লুকিয়ে আছে। বাণিজ্যিক পত্রিকাতে অর্থ ও উপঢৌকনের বিনিময়েও রদ্দি ডিটেকটিভ গল্প ছাপানো যায়, এবং উল্টোদিকে বছরের পর বছর সেসব জায়গাতে ডাক পান না জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী, অসীম রায়ের মতো সিরিয়াস কবি লেখক। শম্ভু রক্ষিত ব্রাত্য থাকে কারণ আবারো, সে ডিফিক্যান্ট। নিত্য মালাকার, নির্মল হালদার, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালদের নাম সুকৌশলে ভুলিয়ে দেওয়া হয় কারণ তারা সেই প্রতিস্পর্ধী স্বরটির প্রতিনিধিত্ব করে। এক সরল আপাত-স্মার্ট খুকুগদ্যকে আধুনিক সাহিত্যের নাম দিয়ে বেচে দেওয়া হয় বাংলা বাজারে, এবং সে কাজে প্রধান সহায়ক থাকেন এক সময়কার সিরিয়াস কবিলেখকের দল, যাঁরা পৃথিবী উলটে দেবার স্বপ্ন নিয়ে লিখতে এসে যখন দেখলেন যে তাঁদের ব্যক্তিগত ইচ্ছেপূরণের কোনো দায় বা শক্তি তাঁদের কলমের নেই, সেই ফ্রাস্টেশনকে সামাল দিতে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়লেন হাত কচলানোর রোল পাবার উদ্দেশ্যে। 

.

অবশ্য ভাসা ভাসা প্রতিষ্ঠান বিরোধী অনেক মাল তুমি পাবে, যাদেরকে এস্টাব্লিশমেন্ট পুষেও রাখে। দরকারে অদরকারে এদের কুমীরছানা দেখানোর মতো করে তুলে দেখিয়ে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করে।

তবু উল্টোদিকেও রেজিস্ট্যান্স থাকবেই। ভাষাকে ছেনে নিয়ে তার অভ্যন্তরের অন্ধকার মহাদেশ খুঁজে আনতে প্রাণপাত করলেন যে লেখক, খনির ভেতর থেকে দুর্মূল্য আকরিক তুলে আনার মতো শব্দ তুলে এনে ডিনামাইটের তার বিস্তার করলেন যে কবি, প্রচলিতকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তথাকথিত অবস্কিওরিটির থমথমে সিঁড়িতে পা রাখলেন যে তরুণ গল্পলেখক, তাঁদের জায়গা থেকে যাবে। তাঁরা জগৎ ওলটাতে না পারুন, তাঁদের লেখালেখি দিয়ে কারোর কিছু না যায় আসুক, তবুও সেগুলো থাকবে। মাত্র কয়েকদিন আগেই খবর পেলাম মণীন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত পরমায় তিনজন কবি শিরোনামে এই সময়কার প্রধান তিনজনের কবিতা নিয়ে বই প্রকাশ হচ্ছে, যাদের মধ্যে মাত্র তেইশ বছর বয়সে স্থান পেয়েছে মেদিনীপুরের বীতশোক ভট্টাচার্য। কবিতায় তার উজ্জ্বল উদ্ধার স্বীকৃতি পাচ্ছে এমন করেই। অঞ্জন সেন, নিশীথ ভড়, অমিত চক্রবর্ত্তী, কাঞ্চনকুন্তলা মুখোপাধ্যায়ের মত অসংখ্য তরুণ কবি ক্ষেত্রনির্মাণ করে চলেছে। এটাও জানি যে এদের মধ্যে অনেকেই আবার বড় সংবাদপত্রের ডাক পেয়ে চলে যাবে, সেখানে প্রথমে কয়েকটা ভালো কবিতা বেরোবার পর ভাববে বিগ হাউসে তার মানে নিরীক্ষাধর্মী লেখালেখি নিজের টার্মসেই করা যায়, এবং আস্তে আস্তে এস্টাব্লিশমেন্টের ভেতর ঢুকবে, খুব ধীরে নিজের ভেতরেই সিস্টেম তৈরি হবে যাতে মেনে নেওয়া যায় একের পর এক শর্ত, এবং এই প্রক্রিয়াতে স্বধর্ম খোয়াবে। এসবও হবে, এবং তার বিপরীতে ভিন্নধর্মী লেখালেখিও ধুঁকতে ধুঁকতে টিকে থাকবে। আমার বন্ধুরা অনেকে রাগ করবেন এসব পড়ে, অভিযোগ করবেন আমি অযথাই সিনিক হচ্ছি। কিন্তু দলবদ্ধ সংহতি যদি বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে তৈরি না করা যায়, আমি রাজনীতির কথা আনতে চাইনি কিন্তু এসেই যাচ্ছে, বিশেষত সেই সময়টায় যখন একটি প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক স্বরকে শুধুমাত্র সাইলেন্স দিয়ে বিগ হাউস স্তব্ধ করে দিতে যাচ্ছে তখন রাজনীতি বাদ দিয়ে এত কথা লেখা সম্ভব নয়, যদি না তৈরি করা যায় রেজিন্টান্সের দলগত স্বর, তাহলে ছায়া ঘনাতেই থাকবে, দীর্ঘ হবে, এবং রাত্রির কোনো তপস্যাই দিনের প্রস্তুতি আনতে পারবে না। 

.

একটা কথা তো বুঝছো, অরুণের বিরুদ্ধে আমার ক্ষোভ ব্যক্তিগত নয়। কিন্তু এই বিরাজনীতির আবহ, যেটা মুনাফার জন্য একজন লেখককে কচুর গাঁটি বিক্রেতার সঙ্গে একাসনে বসিয়ে দিতে পারে, সেটা আর নিতে পারি না সঞ্জয়। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *