শেষ মৃত পাখি – ৪

ঐ দ্যাখ নীচু হয়ে আসে ধূর্ত চিল, 
গ্রাম-শকুনের দল মাথার ওপর 
চক্রাকারে উড়ে উড়ে বেড় দেয় সুখে 
তোমার সংকল্প ওরা খাবে বলে ঠিক 
নিচু হয়ে নেমে আসে মেধার ওপর। 

—কৃষ্ণা বসু 

সম্ভবত অমিতাভ মিত্র নিজে সামনে এসে দাঁড়ালে এতটা হতভম্ব হতাম না। ফ্যালফেলিয়ে হাতের জিনিসটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘এটার মানে কী?’

অরুণ কিছু বলতে যাবেন, কিন্তু বাধা পড়ল। সিঁড়ির মুখ থেকে এক মহিলা ডাক দিলেন, ‘অরুণ।’

তথ্য বলছে, অনন্যা চৌধুরীর বয়স সত্তর। দেখেও সেটাই মনে হয়। অরুণের থেকে বড়ো লাগে। কিন্তু একটা আলগা সৌন্দর্য বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পরিণতি পেয়েছে, ঝলসে উঠছে ঘন কালো চোখের ভেতর, গালের দুই পাশের ভাঁজে এবং মাথার ধবধবে সাদা চুলের মধ্যে থেকে। হাউসকোট পরে আছেন। রোগা, ছোটোখাটো চেহারা। মুখের মধ্যে এমন কিছু আছে যেটা, বয়সকে সঙ্গে নিয়েই চোখ ফেরাতে দেয় না। অনন্যা সেন্ট পলস্ কলেজে অঙ্কের অধ্যাপিকা ছিলেন। বছর দশেক হলো অবসর নিয়েছেন। ক্রনিক হাঁপানির সমস্যা ছোটোবেলা থেকে। একটা সাক্ষাৎকারে অরুণ নিজেই জানিয়েছিলেন। 

‘তুমি আবার নামতে গেলে কেন। সিঁড়িটা না ভাঙলেই তো পারতে আজ।’ 

ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন অনন্যা। অরুণ হাত ধরে তাঁকে সাবধানে বসিয়ে দিলেন সোফায়। অন্যন্য একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলে হাসলেন, ‘বিরক্ত করছি না তো? আমার নিজেরই ইচ্ছে করল, প্রশ্নোত্তর পর্ব কেমন চলছে সেটা দেখে আসি একবার।’ 

অরুণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেন। অনন্যা আমার দিকে কালো চোখ মেলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তখনও আমার অমিতাভর পাণ্ডুলিপি বিষয়ে স্তম্ভিত ভাব কাটেনি। কোনোরকমে নিজেকে সামলে পরিচয় দিলাম। 

‘আমি জানি। সব শুনেছি আপনার সম্বন্ধে। তবে আপনার লেখাগুলো সব পড়া হয়নি। আপনি কি পারবেন সত্যিটা বাইরে আনতে?’ 

‘আমি তো গোয়েন্দা নই! আর সত্যিটা বাইরে আনা আমার কাজও নয়। আমি শুধু কিছু প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই পাঠকের সামনে। তবে হ্যাঁ, মিস্টার চৌধুরী সঠিকভাবে ধরতে পেরেছেন যে আমি রহস্য কাহিনীর ভক্ত। সেই হিসেবে পেশার বাইরেও এই ঘটনার প্রতি অন্যরকম একটা আকর্ষণ ছোটোবেলা থেকেই আছে।’ হালকা গলায় উত্তর দিলাম। 

‘আপনার কি কলকাতাতেই জন্ম?’ 

‘হ্যাঁ। যদিও কলকাতায় আজকাল কম যাওয়া হয়। আপনি এসেছেন, একদিক থেকে ভালো হয়েছে। যদি কিছু মনে না করেন, থাকতে অনুরোধ করব।’ 

অনন্যা হাসলেন, ‘রহস্য কাহিনী বিষয়ে আমার জ্ঞান আগাথা ক্রিস্টির বাইরে এগোয়নি। ওটা অরুণের ডিপার্টমেন্ট। আমার আগ্রহও নেই বেশি। জটিল অঙ্কের ফর্মুলা আমাকে যত টানে, অপরাধ বিজ্ঞান তত নয়।’ 

হাতের ফাইলটা টেবিলে নামিয়ে রাখলাম। অনন্যার সামনে এই বিষয়ে কথা বলব না। অরুণের স্বীকারোক্তি নিয়েও মুখ খুলব না। কিছু ধাঁধার সমাধান একলাই করতে হবে। 

‘আমি ধরেই নিচ্ছি যে অমিতাভ মিত্রর ঘটনাটা আপনি পুঙ্খানুপুঙ্খ জানেন। আমার নিজের বেশ কিছু প্রশ্ন আছে। যার উত্তর পুলিশ ফাইল থেকে পাইনি। এবার সেখানে সমস্যা হলো, আমি এবং আপনার স্বামী, দুজনেই এই কেসটায় ভীষণ বেশি রকম ইনভলভড্ হয়ে পড়েছি। মিস্টার চৌধুরী একজন সন্দেহভাজন হিসেবে জীবনের চল্লিশটা বছর এর মধ্যে থেকেছেন। আর আমি শেষ কিছুদিন ধরে শুধু এটা নিয়ে পড়ে আছি। তাই হয়তো নিরপেক্ষভাবে ঘটনাটাকে দেখার জায়গাতে আমরা কেউ নেই। আপনি এই কাহিনী জানলেও, অনুমান করতে পারি যে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন। তাই হয়তো আমাদের থেকে বেশি নৈর্ব্যক্তিক ভাবে দেখতেও পারেন। আমি যদি আপনাদের দুজনের সামনে এই প্রশ্নগুলো রাখি, তাহলে কি আপনি অস্বস্তিতে পড়বেন? 

অরুণ অপরাধী হলেও যদি সোজাসুজি প্রশ্নের উত্তর না দেন, তার বদলে একটা রহস্য কাহিনী হাতে ধরিয়ে দিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন, সেই ফাঁদে পা দেব না। আমাকে চলতে হবে নিজের মতো করে। গোয়েন্দা গল্পের শেষটুকু অনুমান করা আমার কাজ নয়। আমার কাজ নিজের গল্পটাকে দাঁড় করানো। মাথার ওপর ডেডলাইনের খাঁড়া ঝুলছে। 

অরুণ কফি বানাচ্ছেন নতুন করে। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, বৃষ্টি এখন আর পড়ছে না, কিন্তু কুয়াশায় সব কিছু ঢাকা। বাগানের আবছা আলোটুকু বাদে আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। 

‘কিন্তু আমি কি পারব?’ অনন্যা মনে হলো নিজেকেই প্রশ্ন করলেন। তাহলে তো এতদিনেই পেরে যেতাম। বেশ, আপনি প্রশ্ন করুন।’

একটা বড়ো নিশ্বাস নিলাম। তারপর নিজের খাতা বার করে প্রশ্নের তালিকাগুলো দেখে নিয়ে বলতে শুরু করলাম পর পর। 

‘প্রথম খটকা যেটা। পুলিশ অরুণ চৌধুরীকে ছেড়ে দিয়েছিল কারণ তাঁর নাকি অ্যালিবাই আছে। কীরকম সেই অ্যালিবাই? পোস্টমর্টেম অনুসারে, অমিতাভ খুন হয়েছিল এগারোই জুন রাত বারোটা থেকে বারোই জুন ভোর ছটার মধ্যে। সেই সময়টায় অরুণ পুলিশ স্টেশনে বসেছিলেন। কিন্তু অরুণের যে কোনো সহকারী ছিল না, সেই বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত হলো কী করে?’ 

‘দ্বিতীয় ধাঁধা প্রশান্ত গুরুংকে নিয়ে। পুলিশ প্রশান্ত গুরুং-এর খোঁজ চালিয়েছিল, কিন্তু সেই রাত্রে প্রশান্ত নিজের ঘরে ফেরেননি। ফিরেছিলেন পরের দিন। প্রশান্তর দাবি অনুসারে, সেই রাত তিনি শহরের একটি নিষিদ্ধপল্লিতে কাটিয়েছিলেন। যাই হোক, প্রশান্তর বয়ান অনুযায়ী, তিনি সত্যিই অরুণের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। নটা দশ নাগাদ এসেছিলেন, এবং পৌনে দশটায় বেরিয়ে যান। প্রশান্তর বক্তব্য অনুসারে, অরুণের বাড়িতে তিনি অমিতাভকে দেখেননি। হ্যাঁ, অরুণের সঙ্গে তাঁর কথা কাটাকাটি হয়েছিল, এবং রাইফেল নিয়ে ধস্তাধস্তিতে গুলি বেরিয়ে যায়। কিন্তু তখন অরুণ একাই ছিলেন। তাহলে প্রশ্ন হল দুটো। মিসেস বাসু অরুণ এবং অমিতাভকে দেখেছিলেন সাড়ে নটার সময়ে। কিন্তু তখন প্রশান্ত অরুণের বাড়িতে, এবং তিনি কিছু দেখতে পাননি। তাহলে কে মিথ্যে বলছেন? প্রশান্ত না মিসেস বাসু? 

প্রশান্ত এবং মিসেস বাসুর বয়ান অনুযায়ী আমি এই গল্পের তিনটে সম্ভাব্য ছবি তৈরি করেছি। সেগুলোর টাইমলাইন এরকম- 

১. মিসেস বাসুর বয়ান সত্যি, প্রশান্তর বয়ান মিথ্যে 

সন্ধেবেলা অমিতাভ আসেন অরুণের বাড়ি। 

দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। 

দুজন বাগানে বেরিয়ে আসেন। তখন রাত সাড়ে নটা। অরুণের হাতে রাইফেল ছিল। 

অরুণ গুলি করেন। অমিতাভর হাতে সেই গুলি লাগে। গোটাটাই ঘটে বাগানে। মিসেস বাসু গুলির আওয়াজ শুনতে পান। 

অরুণ আর অমিতাভ ছুটতে ছুটতে গেট অবধি আসেন। অমিতাভ বেরিয়ে যান। অরুণ বাড়ির দিকে ফিরে যান। 

২. প্রশান্তর বয়ান সত্যি, মিসেস বাসুর বয়ান মিথ্যে 

নটা দশ নাগাদ প্রশান্ত অরুণের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। 

পৌনে দশটার আগে, সম্ভবত সাড়ে নয়টা নাগাদ প্রশান্ত আর অরুণের মধ্যে উত্তেজিত কথা কাটাকাটি হলো। 

অরুণ বাড়ির একটা রাইফেল থেকে ঘরের ভেতর গুলি ছুড়লেন। 

পৌনে দশটা নাগাদ প্রশান্ত বেরিয়ে গেলেন। একাই। 

৩. মিসেস বাসুর বয়ান সত্যি, প্রশান্তর বয়ান আংশিক সত্যি। 

অমিতাভ অরুণের বাড়িতে সন্ধেবেলা এলেন। প্রশান্ত এলেন নটা দশ নাগাদ। 

অমিতাভ বাগানে বেরিয়ে এলেন সাড়ে নটার সময়ে। তাঁর পেছনে অরুণ, অথবা অরুণ এবং প্রশান্ত দুজনেই। অরুণের হাতে রাইফেল। 

বাগানে দাঁড়িয়ে অমিতাভকে গুলি করলেন অরুণ। অথবা প্রশান্ত। মিসেস বাসু সেই গুলির শব্দ পেলেন। প্রশান্ত যদি বাগানে থেকেও থাকেন, মিসেস বাসুর দৃষ্টির আড়ালে ছিলেন। 

অমিতাভ বেরিয়ে গেলেন। 

অরুণ (অথবা অরুণ ও প্রশান্ত) ফিরে এলেন। 

প্রশান্ত রাত পৌনে দশটায় বেরিয়ে গেলেন। 

.

‘প্রথম সম্ভাবনা দেখা যাক। ধরে নিলাম মিসেস বাসু সত্যি বলছেন এবং প্রশান্ত মিথ্যে বলছেন। বলতেই পারেন, কারণ হতে পারে যে অরুণ প্রশান্তকে টাকা দিয়ে মিথ্যে বলিয়েছেন। যদিও পুলিশ সেই প্রমাণ পায়নি, বরং প্রশান্তর সঙ্গে অরুণের শত্রুতার কথাই সকলে জানত। তাও, আমরা তর্কের খাতিরে মেনে নিচ্ছি যে শত্রুতা হয়তো লোকদেখানো ছিল। হয়তো ভেতরে ভেতরে টাকাপয়সার ব্যাপার ছিল। কিন্তু পুলিশ বাগানে প্রশান্তর পায়ের ছাপ পেয়েছিল। একজোড়া জুতো, একবার বাগান থেকে বাড়িতে এসেছে, পরে আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানে গেছে। তার মানে, প্রশান্ত এসেছিলেন। এদিকে, মিসেস বাসুর মতে গুলি ছুটেছিল বাগানে। অরুণের হাতে রাইফেল দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু বাগানে কোনো বুলেট বা কার্তুজের খোল মেলেনি। মিলেছে অরুণের ঘরের মধ্যে। কাতুর্জের খোলও ঘরের মধ্যেই পড়েছিল। কার্বন প্রিন্ট আর খোলের অবস্থান মিলিয়ে পুলিশের গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন যে গুলি ঘরের বাইরে চালানো হয়নি। তাহলে কি মিসেস বাসু মিথ্যে বলছেন? 

‘এবার মিসেস বাসু মিথ্যে কথা বলছেন যদি ধরে নিই, তাহলে অমিতাভকে তিনি দেখেননি। কিন্তু তাহলে বাগানের রক্ত অমিতাভর রক্তের সঙ্গে মিলল কী করে? অরুণের হাতে আঁচড়ের দাগই বা এল কোথা থেকে? প্রশান্ত গুরুঙের সঙ্গে তাঁর কোনো প্রকার ধস্তাধস্তি হয়নি, সেটা অরুণ এবং গুরুং দুজনেই স্বীকার করেছেন। ফরেনসিক গুরুঙের নখ পরীক্ষা করে দেখেছে, সেখানে অরুণের চামড়ার কোনো টিস্যু নেই। অরুণ তাঁর হাতের আঁচড়ের কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। বলেছেন, তাঁর মনে নেই কীভাবে হলো। 

‘এবার তৃতীয় বিকল্প। ধরে নিলাম মিসেস বাসু পুরোটা সত্যি বলছেন। এবং প্রশান্ত আংশিক সত্যি বলছেন। মানে, প্রশান্ত এসেছিলেন। কিন্তু অমিতাভও এসেছিলেন এবং প্রশান্ত তাঁকে দেখেছিলেন। তাহলে হিসেব মতো অমিতাভকে গুলি করেন প্রশান্ত অথবা অরুণ। অরুণ নিজে স্বীকার করেছেন যে, গুলি তাঁর হাত থেকেই বেরিয়েছে। মুশকিলটা হলো, আগেও বলেছি, সেই গুলিটা চালানো হয়েছে ঘরের ভেতর, যার বুলেটটাও পাওয়া গিয়েছে। আলমারির ওপর রাখা একটা কাচের জারকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে বুলেট একপাশে পড়েছিল। কার্তুজের খোলও পাওয়া দিয়েছে ঘরের মধ্যেই। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে সেই বুলেট মানবশরীরের সংস্পর্শে আসেনি। আবার ব্যালিস্টিক রিপোর্ট এটাও বলছে যে রাইফেল থেকে একটামাত্র গুলিই করা হয়েছিল। তাহলে অমিতাভর হাত থেকে রক্ত ঝরা, অথবা তার মৃতদেহের বাম হাতে যে গুলি লেগেছিল, সেটা কীভাবে সম্ভব হলো? ব্যালিস্টিক অনুসারে, অমিতাভর হাতে লেগে থাকা গুলিটাও সেই একই রাইফেল থেকে এসেছে। এদিকে মিসেস বাসু জোর দিয়ে বলছেন তিনি একটাই গুলির আওয়াজ শুনেছেন। এখানে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে যে মিসেস বাসু এবং প্রশান্ত দুজনে একই সঙ্গে সম্পূর্ণ সত্যি বলতে পারেন না। কারণ প্রশান্ত ছিলেন পৌনে দশটা পর্যন্ত এবং মিসেস বাসু সাড়ে নটার সময়ে অমিতাভকে দেখেছেন। 

‘এবার আসি রাইফেল প্রসঙ্গে। রাইফেল থেকে একটাই গুলি ছোঁড়া হয়েছে, এবং ছুঁড়েছিলেন অরুণ। কিন্তু ট্রিগারে এবং রাইফেলের বাঁটে অরুণ ছাড়াও অমিতাভর হাতের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। তার মানে সেই রাত্রে অমিতাভ সত্যিই এসেছিলেন। তিনি যদি রাইফেল ব্যবহার করে থাকেন, কেন? কীসের উদ্দেশ্যে? কার প্রতি? 

‘এবার তৃতীয় রহস্য। বাগানের মাটিতে পায়ের ছাপ। কিছু ছাপ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বৃষ্টিতে। কিন্তু পুলিশ ছাউনি খাটিয়ে অনেকটাই বাঁচাতে পেরেছিল। সেগুলোর মধ্যে থেকে অরুণ, অমিতাভ এবং প্রশান্তর জুতোর ছাপ আলাদা করে পাওয়া গেছে। অরুণ একবার দৌড়ে বাগানের দিকে গেছেন। সেই পদক্ষেপগুলোয় পায়ের ছাপ একটা অপরটার থেকে দূরে দূরে এবং গভীর। আবার উত্তেজিতভাবে বাড়ির দিকে ফিরে এসেছেন। সেই পদক্ষেপগুলোও মাটিতে গভীরভাবে প্রোথিত। প্রশান্ত গুরুঙের পায়ের ছাপও পাওয়া গেছে, যার কথা আগেই বলেছি। কিন্তু অমিতাভর জুতোর ছাপ পাওয়া গেছে শুধু একবারই, যেটা বাড়ি থেকে বাগানের দিকে চলে গিয়েছে। বাগান থেকে বাড়ির দিকে আসার ফুটপ্রিন্ট মেলেনি। কেন? এর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে যে অমিতাভ যখন এসেছিলেন, তার পরে একপ্রস্থ মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে তাঁর পায়ের ছাপ ধুয়ে যায়। কিন্তু প্রশান্ত গুরুঙের পায়ের ছাপ ছিল, দুইদিকেরই। এই থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে অমিতাভ এলেও প্রশান্ত গুরুঙের বেশ কিছুটা সময় আগে এসেছেন। মানে সন্ধে নাগাদ। কিন্তু তাহলে একটা অন্য প্রশ্নের ব্যাখ্যা মেলে না।’ 

এই পর্যন্ত বলে থামলাম। অরুণ সামনে কফির কাপ কখন রেখে গেছেন খেয়াল করিনি। উলটোদিকে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে হালকা হাসলেন। বুঝতে পারছি, এই প্রশ্নগুলো তাঁকে আগেও বহুবার করা হয়েছে। 

অনন্যা নিমীলিত চোখে শুনছিলেন। এবার আমার দিকে চোখ তুললেন। ‘এই?’ 

‘না। আরও আছে। ইনফ্যাক্ট, এই কেসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এত খটকা, এবং পরস্পরবিরোধী সূত্র ছড়িয়ে আছে যে আমি জানি না কীভাবে এর সমাধান সম্ভব।’ 

‘তবুও আপনি আমার কাছে সমাধান চাইছেন? 

‘সমাধান চাইছি না। আপনার কী মনে হয় জানতে চাইছি।’ 

‘অরুণের সঙ্গে আমার আলাপ ১৯৭৭ সালে। ১৯৮০ সালে আমরা বিয়ে করি। আমি নিজের গবেষণা আর কলেজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি সারা জীবন। আর অরুণ তার লেখালেখি নিয়ে। ওকে নিয়ে এই যে সেনসেশন, সেটাকে কোনোদিনই গুরুত্ব দিইনি। আমার কাছে ওটা একটা তুচ্ছ অতীত। তুচ্ছ, কারণ আমার স্বভাবের সঙ্গে ওটা যায় না।’ কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলেন অনন্যা। 

‘আপনার কি সত্যিই কোনো ইন্টারেস্ট নেই?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমি। 

‘নেই। কারণ আমি অঙ্কের মানুষ। কাঁচা আবেগের ব্যাপার বুঝি না। সেটা হয়তো আমারই অক্ষমতা। লেখালেখির জগতে রেষারেষি থেকে একজন আর- একজনকে খুন করবে, এটা আমার কাছে চূড়ান্ত অপচয়ের একটা উদাহরণ। সময়, শক্তি এবং ভাবনার অপচয়।’ 

‘মানুষ কি খুন করতে পারে না? এটা কিন্তু অদ্ভুত কথা বলছেন।’ 

‘অবশ্যই পারে। কিন্তু আমার কাছে সেই পারাটা যুক্তিহীন। কারও জীবন নিয়ে নেবার মানে হচ্ছে আইনের চোখে নিজে ভালনারেবল হয়ে যাওয়া। এই বিনিময়মূল্য এতটাই বেশি যে এটাকে কোনোরকম স্থিতাবস্থাতেই ফেলা যায় না। আমি স্থিতাবস্থাকেই সবথেকে যুক্তিপূর্ণ অবস্থান মনে করি।’ 

‘কিন্তু, ভাবুন একবার’, অনন্যার আগ্রহ ধরে রাখার জন্য পালটা যুক্তি দিতেই হবে। অথবা এমন প্রশ্ন করতে হবে যেখানে তাঁর যুক্তি ভেঙে যায়, ‘আপনি যদি অরুণের জায়গায় থাকতেন আর আপনার সারা জীবনের কাজ, হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো পেপার, অমিতাভর জন্য প্রত্যাখ্যাত হতো, আপনার কি রাগ হতো না?’ 

‘হতো।’ 

‘তাহলে সেই রাগ বাড়তে বাড়তে কি কেউ খুন করতে পারে না?’ 

‘আমি করতাম না।’ 

‘আপনি কী করতেন?’

‘টাকা দিয়ে অমিতাভকে কিনে নিতাম।’ অনন্যার গলা ঠাণ্ডা। 

অরুণ নিস্পন্দ বসে আছেন। মুখে ভাবান্তর নেই। 

‘আপনি যেটা বুঝতে পারছেন না তনয়া, আমার বাঁচার নিয়ম হলো সবথেকে কম ঝুঁকি নিয়ে যতটা পারা যায় লাভ করবার অঙ্ক। অমিতাভকে মেরে আমি পুলিশের কাছে সন্দেহভাজন হয়ে যেতাম। হয়তো গ্রেপ্তার হতাম, এবং দোষী ও সাব্যস্ত হতাম। পথের কাঁটাকে দূর করবার জন্য এতখানি ঝুঁকি নেব কেন? তার থেকে ঢের সহজ রাস্তা বাছব। অমিতাভর সঙ্গে চুক্তিতে যাব। তার মুখ বন্ধ করে দেব। হ্যাঁ, অমিতাভ নুইসেন্স হয়ে বেঁচে থাকবে। হয়তো বারে বারে টাকা চাইবে। সেই নিয়ে দরাদরিও হবে। কিন্তু নিজের জীবন এবং কাজকে সুতোর ওপর ঝুলিয়ে দেওয়া, নাকি একটা নুইসেন্সকে সহ্য করে নিজের কাজটুকু করে যাওয়া, কোনটা বেশি লাভজনক?’ 

হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করল। গলার স্কার্ফটা পেঁচিয়ে নিলাম। অনন্যা ঋজ হয়ে বসে আছেন। স্পষ্ট তাকিয়ে আছেন চোখের পলক না ফেলে। বিন্দুমাত্র জড়তা নেই। দেখে মনে হচ্ছে মোমের মূর্তি। যার অন্তঃস্থল পর্যন্ত খুঁড়ে গেলেও একফোঁটা রক্ত বেরোবে না। 

‘আপনার কাছে কি সবকিছুই লাভ-ক্ষতি দিয়ে বিচার হয়? 

‘না। এখানে আপনি ভুল। আমি বিচার করছি যুক্তি দিয়ে। নাহলে যেখানে সবথেকে বেশি লাভ সেদিকে ছুটতাম। দেখতাম না তাতে ক্ষতির ঝুঁকি কতটা বেড়ে গেল। আমাকে ক্লাসে ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম পড়াতে হয়। এটুকু জানি, সবথেকে যুক্তিপূর্ণ অবস্থান কিছুতেই একজনকে মেরে ফেলা হতে পারে না। অমিতাভকে যে-ই মারুক না কেন, সে ইরর‍্যাশেনাল আর ইরর‍্যাশেনালিটি আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগে না।’ 

‘কিন্তু যদি এরকম ঘটে, মানে কিছু মনে করবেন না, আমি সম্ভাবনার কথা বলছি, যে দেখলেন অমিতাভকে খুন করেছেন আপনার স্বামীই?’ 

‘আমাদের বিয়ের চল্লিশ বছর তো হতে চলল। আপনার কি মনে হয় সে সম্ভাবনা মাথায় কখনো আসেনি?’ অনন্যা অরুণের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, অরুণ দেখলাম আলতোভাবে একটা আঙ্গুল দিয়ে অন্যমনস্কের মতো অনন্যাকে ছুঁয়ে আছেন। ‘কিন্তু এই সমস্ত যা কিছু হতে পারে বা হতে পারত, এগুলো মেনে নিয়েই তো অরুণের সঙ্গে আছি। যেটা ঘটে গেছে তা অতীত, ও নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।’ 

এবার বেশ জোরে হেসে ফেললেন অনন্যা। ‘হয়তো আপনাকে বোর করছি; আমাদের বয়েসে পৌঁছে কথা বলবার মানুষ বেশি পাওয়া যায় না। আমাদের মতো নিঃসন্তান দম্পতির তো আরোই নয়। তাই, যখন কাউকে দেখি, নিজের অজান্তে বকবক করে ফেলি। ছাত্র পড়াতাম তো, তাই জ্ঞান দেবার অভ্যেসটা যায়নি। খারাপ অভ্যেস। আপনি বলুন। এখন থেকে আর একটা কথাও বলব না।’ 

আমি হাসতে পারলাম না। ঠিক খারাপ লাগা নয়। অনন্যা চৌধুরী খারাপ লাগার মতো একটা কথাও বলেননি। কিন্তু কথাগুলো এতটাই অন্যরকম যে আমার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল স্বাভাবিক হতে। অস্বস্তি চাপা দেবার জন্য মাথা নামিয়ে হাতের কাগজপত্র ওলটাতে লাগলাম। 

‘পায়ের ছাপ নিয়ে জটিলতায় শেষ করেছিলাম। এখানে পরের জটিলতার শুরু। বাড়ির বারান্দার সামনে একজোড়া বুটের ছাপ। বাগান থেকে হেঁটে এসেছে। অনেকক্ষণ এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে আবার হেঁটে গেছে বাগানের দিকে। এই বুট না অরুণের, না অমিতাভর, না প্রশান্তর। তাহলে এক রহস্যময় চতুর্থ ব্যক্তির উপস্থিতির সম্ভাবনা জোরালো হয়ে ওঠে। তিনি কে?’ লক্ষ করলাম, অরুণ এই প্রথম অস্বস্তিতে উসখুস করে উঠলেন। নাকি ভয়? 

তাহলে এ বাড়ির ঘটনার খটকাগুলো কী দাঁড়াল? যদি মিসেস বাসু সত্যি বলে থাকেন, তাহলে প্রশান্ত মিথ্যে বলছেন। গুলি বাগানে চলেছিল না ঘরের মধ্যে? আবার যদি প্রশান্ত গুরুং সত্যি বলে থাকেন, মানে অমিতাভ আসেননি, তাহলে বাগানে অমিতাভর রক্ত পাওয়া গেল কী করে? রাইফেলের ট্রিগারেই বা তাঁর আঙুলের ছাপ এল কিভাবে? আবার প্রশান্ত যদি মিথ্যে বলে থাকেন, মানে যদি সত্যিই অমিতাভ এসে থাকেন, তাহলে সেই বুলেটের সমস্যাতেই ফিরে যেতে হচ্ছে। শুধু সেটাই না, যদি রাইফেল থেকে ছোঁড়া একটিমাত্র বুলেট মানবশরীরের স্পর্শ না পায়, তাহলে অমিতাভর মৃতদেহের বাম হাতে গেঁথে থাকা বুলেট এল কোন রাইফেল থেকে? বাগানের ধারেই বা মিলিটারি বুট পরে কে দাঁড়িয়েছিলেন? তিনিই কি অমিতাভর হত্যাকারী? 

‘এবার সেমেট্রির ভেতর, যেখানে অমিতাভর বডি পাওয়া গেছিল, সেখানকার খটকায় আসি। পোস্টমর্টেম বলছে, অমিতাভকে কাছ থেকে বুকে আর পেটে গুলি করা হয়েছিল, এবং অমিতাভের শরীরে ডিফেন্সিভ বা প্রতিরোধসূচক কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর সময়ে তাঁর হৃৎপিণ্ডের গতি ছিল স্বাভাবিক। তার মানে, আকস্মিক উত্তেজনার কারণ ঘটেনি। অর্থাৎ হত্যাকারী ঘনিষ্ঠ দূরত্বে দাঁড়িয়েছিলেন, অমিতাভ তাঁর হাতে বন্দুক দেখতে পাচ্ছিলেন, এবং তবুও তিনি শান্ত ছিলেন। হতে পারে যে তিনি বাধা দেবার সুযোগ পাননি। হয়তো আচমকা বন্দুক বার করে গুলি চালানো হয়েছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে মিসেস বাসুর বয়ান অনুযায়ী তার আগে অমিতাভর হাতে গুলি লেগেছিল। সেক্ষেত্রে অমিতাভ অনুত্তেজিত ছিলেন কেন? থাকতে পারেন, যদি হত্যাকারী তাঁর চেনা হয়। অথবা এমন কেউ হয়, যাঁর হাতে বন্দুক দেখে অমিতাভ অভ্যস্ত। এই রোলে একমাত্র ফিট করছেন অরুণ, যিনি তখন থানায় বসে। 

‘দ্বিতীয়ত, ব্যালিস্টিক বলছে অমিতাভর পেটে আর বুকে গুলি করা হয়েছিল রাইফেল দিয়ে নয়। পিস্তল দিয়ে। সেই মার্ডার ওয়েপন এখনও নিখোঁজ। কিন্তু হাতের গুলি এসেছিল অরুণের রাইফেল থেকে। রাইফেল নিয়ে ধাঁধার কথা আগেই বলেছি। 

তৃতীয়ত, অমিতাভ পড়েছিলেন উপুড় হয়ে। বুকে গুলি করলে তার ধাক্কায় মানুষ চিত হয়ে পড়ে। উপুড় হয়ে থাকার অর্থ হলো গুলি করার পর তাঁকে হত্যাকারী উপুড় করে দিয়েছিলেন। কেন? 

চতুর্থত, এবং এটা আমার মতে সবথেকে ধাঁধালো জায়গা। পোস্টমর্টেমে অমিতাভর পেটে বেশ অনেকটা মদ পাওয়া গিয়েছিল। অরুণ মদ্যপান করেন না। অরুণের বাড়িতেও কোথাও মদের চিহ্ন পায়নি পুলিশ। তাহলে অমিতাভ মদ খেলেন কী করে? তিনি কি মদ খেয়ে অরুণের বাড়িতে এসেছিলেন? নাকি অরুণের বাড়িতে বসে খাচ্ছিলেন? সেটা সম্ভব নয়, কারণ পোস্ট-মর্টেম অনুসারে অমিতাভ মারা গিয়েছেন রাত বারোটা থেকে ভোর ছ-টার মধ্যে। তার মানে, রাত সাড়ে নটার আগে অমিতাভ মদ খেতে পারেন না। এদিকে আমরা আগেই সিদ্ধান্তে এসেছি যে অমিতাভ সন্ধের সময়ে অরুণের বাড়িতে চলে এসেছেন। মিসেস বাসুও অমিতাভকে দেখেছেন রাত সাড়ে নটার সময়েই। তখন অমিতাভর হাত থেকে রক্ত পড়ছিল। জলাপাহাড় রোড থেকে নেমে সবথেকে কাছের শুঁড়িখানা অথবা মদের দোকানের দূরত্ব, ছুটে গেলেও বারো মিনিট। পুলিশ নিজে পরীক্ষা করে দেখেছিল। তাহলে অমিতাভ ন-টা বিয়াল্লিশের আগে মদ খেতে পারেন না। যদি না, তাঁর পকেটে মদের বোতল থাকে। কিন্তু হাতে গুলি লাগা অবস্থার একজন মদ খেয়ে ছুটতে ছুটতে পাহাড় থেকে নামছে, এই দৃশ্য আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। আবার যদি দোকানের কথাই ধরি, আহত অমিতাভ ডাক্তার বা নিজের চেনা মানুষদের কাছে না গিয়ে মদের দোকানে গেলেন কেন? আর তখন প্রতিটা শুঁড়িখানাই লোকে গিজগিজ করছে। তাদের কেউ কি লক্ষ করল না তাঁর হাত থেকে রক্ত ঝরছে? 

‘তার মানে, অরুণের বাড়িতে অমিতাভ এলে, এবং গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ছুটে বেরিয়ে গেলে তাঁর পেটে মদ থাকার ব্যাখ্যা মেলে না। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হয় তিনি আদৌ অরুণের বাড়িতে আসেননি, অন্য কোথাও রাত্রিবেলা বসে মদ খাচ্ছিলেন। অর্থাৎ মিসেস বাসু মিথ্যে বলছেন। মানে আবারও ফিরে যেতে হচ্ছে কে সত্যি বলছেন আর কে মিথ্যে, সেই ধাঁধায়। প্রশান্ত, মিসেস বাসু, অরুণ কার বয়ান বিশ্বাস করব? 

‘পঞ্চমত, অমিতাভর ডান হাতের কবজিতে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল। লম্বা ছুরি অথবা ভোজালি দিয়ে জায়গাটা যেন কাটতে চেয়েছিল কেউ। সেই ক্ষত বাম হাতের রাইফেলের গুলির ক্ষতের আগে ঘটেছে না পরে, সেটার উত্তর মেলেনি। কিন্তু বুক ও মুখের ক্ষতের থেকে সে ক্ষত নিঃসন্দেহে পুরোনো। ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল কবজিতে। সেই ব্যান্ডেজের কাপড়ে রক্ত কতটা চুঁইয়ে ভেতরে ঢুকল, ফরেনসিকের মাধ্যমে সেটার পরীক্ষা করে এ ব্যপারে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। কেন? এর সঙ্গে কি তাঁর হত্যার কোনো যোগ আছে? 

‘তার মানে, একটা গল্প পাচ্ছি, মূল গল্প একটাই, কিন্তু যার হাজারটা বিকল্প ছবি। বিভিন্নজন তাদের নিজস্ব ভার্সন বলে যাচ্ছে। যা সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তারা পুরোপুরিভাবে কোনো ভার্সনের সঙ্গেই মিলছে না। আবার পুরোপুরিভাবে কোনো ভার্সনের সঙ্গে ডিসএগ্রিও করছে না। রশোমন সিনেমাটার মতো। সত্যিটা যে কী ছিল, সেটাই একসময়ে গিয়ে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে।’ 

বিরতি নিয়ে আবার শুরু করলাম। 

‘এ ছাড়াও আমি নিজে বারবার পড়ে আরও কিছু ধাঁধার সন্ধান পেয়েছি। কিন্তু আজ আর সেগুলো বলছি না। যখন ফর্মালি প্রশ্ন করা শুরু করব, তার আগে আপনাকে লিখিত আকারে সব কটা প্রশ্ন দিয়ে যাব। যেগুলোর উত্তর পারেন, দিয়ে দেবেন প্লিজ। বা আপনার যদি কিছু অনুমান, থাকে। সেগুলোও।’ শেষ কথাটা অরুণের দিকে তাকিয়ে বললাম। 

‘গত চুয়াল্লিশ বছর ধরে উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত।’ বললেন অরুণ।

অনন্যা উঠলেন, কফির কাপ বেসিনে রেখে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগোলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি এগুলো নিয়ে ভাবব। এক্ষুণি তো উত্তর দিতে পারব না। অন্তত একটা রাত দিন। তার পরেও উত্তর আসবে কি না জানি না। কিন্তু ভাবব।’ তারপর অল্প হেসে বললেন, ‘এখন হয়ত বলাই যায় এ কথা। আপনি আসুন, আমি চাইনি। অরুণকে বারণ করেছিলাম, আবার অতীত খুঁড়ে নিজেকে যন্ত্রণা দেবার অর্থ হয় না। কিন্তু যখন এসেছেনই, আমি চাইব সমাধান দিয়ে যান। অন্তত একটা গল্প দিন, যেটায় কোনো জীবিতপক্ষ আঘাত না পায়।’ 

‘সমাধান দেওয়া আমার কাজ নয়। কিন্তু আপনি চাইছেন একটা আখ্যান, যেখানে আপনার স্বামী নিরপরাধ প্রমাণিত হন। সেটাও তো আমার হাতে নেই। আমি তো গল্প বানাতে পারব না।’ 

‘নাহ, বানাবেনই বা কেন! আমি বলতে চাইছি, ‘৭৫ সালে যে ছেলেটা পুলিশ আর সমাজের চাপ সামলেছিল, ২০১৯-এ এসে সে হয়ত আর অতটা মানসিকভাবে দৃঢ় নেই। আপনার সমাধান তাকে যেন গুঁড়িয়ে না দেয়, সেটা চাওয়া আমার দিক থেকে অন্তত খুব অযৌক্তিক নয়।’ 

অনন্যা চলে যাবার পরে অরুণ নীরবে বসে ছিলেন। ওই সমাহিত চেহারার মধ্যে কীরকম ঝড় বয়ে চলেছে চুয়াল্লিশ বছর ধরে, সেটা বুঝবার ক্ষমতা আমার নেই। হাই পাওয়ারের চশমার কাচের আড়ালে নিমীলিত চোখ দুটো আপাতত দেখা যাচ্ছে না। ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে আটটা বেজে গেছে। 

‘আজ উঠি। কালকের জন্য কিছু কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। 

অরুণের চটকা ভাঙল। ভুরু সামান্য ওপরে তুলে বললেন, ‘তাহলে আপনি অমিতাভর লেখাটা পড়বেন?’ 

‘এই পাণ্ডুলিপি কোথা থেকে পেলেন?’ 

‘পুলিশ দিয়েছিল।’ 

‘পুলিশ?’ 

‘অমিতাভর ঘর থেকে তার লেখা শেষ উপন্যাস পেয়েছিল পুলিশ। সেটা আবার রহস্যকাহিনী। পড়তে গিয়ে শুরুতে মনে হয়েছিল যে ও কোথাও আমি হয়ে উঠতে চাইছিল। পুলিশ যখন আমাকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে ছেড়ে দেয়, তখন এই পাণ্ডুলিপিটা আমি উকিলকে দিয়ে চেয়ে আনিয়েছিলাম। তাতেও কম সমস্যা হয়নি। নানা সরকারি বাধাবিপত্তি পেরিয়ে প্রায় এক বছর সময় লেগেছিল হাতে পেতে। ততদিন পুলিশ এই কেসে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। তাই আর ঝামেলা করেনি। এটা চেয়েছিলাম, কারণ জানতে চাইছিলাম অমিতাভ ঠিক কীরকম লেখার দিকে এগোতে চাইছিল। কী ভাবছিল মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে। অনেকদিন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু ওর সংকল্প, ওর মেধা, ওর গোটা অস্তিত্বটাই এত তীব্র ছিল যে আমি বিচ্ছেদের পরেও না অস্বীকার করতে পেরেছি ওকে, না ওর মৃত্যুকে।’ 

‘ওকে জানতে চাইছিলেন, এদিকে ওকেই আপনি খুন করলেন?’ 

অরুণ উত্তর দিলেন না। 

অমিতাভ রহস্য উপন্যাস লিখতে গেলেন কেন?’ 

‘জানি না। প্রথমে ভেবেছিলাম পাগলের খেয়াল। অথবা হয়ত দেখিয়ে দিতে চায় যে আমার থেকে কম যায় না কোনো ফিল্ডেই। কিন্তু পরে বুঝেছি, এই লেখার পেছনে একটা উদ্দেশ্য ছিল।’ 

‘কী উদ্দেশ্য? আর এটা পড়ে আমার কী লাভ হবে?’ 

‘পড়লে বুঝতে পারবেন। অমিতাভর হত্যার সঙ্গে আমি কোথাও গিয়ে একটা মিল পেয়েছিলাম। যেন সে দেখতে পেয়েছিল কীভাবে সে নিহত হবে। কিন্তু লেখাটা শেষ করে যেতে পারেনি। সমাধানটুকু খুঁজে বার করবার দায়িত্ব আপনার।’ অরুণ টেবিলের উপর থেকে দ্বিতীয় ফাইলটা হাতে নিলেন। ‘এটা আসল পাণ্ডুলিপি। অমিতাভর হাতের লেখায়। আমি এটাকে বাংলায় টাইপ করিয়ে কয়েকটা কপি বানিয়েছি।’ 

আরেকটা ছোটো ফোল্ডার এগিয়ে দিলেন অরুণ, ‘এখানে আছে অমিতাভর কিছু চিঠিপত্র। পার্থপ্রতিম, অরুণেশদা, সঞ্জয় অধিকারী আরও নানা জনকে লেখা চিঠি। অনেকদিন ধরে অল্প অল্প করে এদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। অমিতাভর কিছু কাটাছেঁড়া লেখাও আছে। যেগুলো শেষ করেনি। হয়ত আপনার কাজে লাগতে পারে। তবে অরিজিনালগুলোর অবস্থা খারাপ। আপনাকে টাইপ করা কপিই দিতে পারব।’ 

উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে পাতা ওলটালাম। হলুদ, কিছুটা জীর্ণ পাতা। সম্ভবত কোনো রাসায়নিক দিয়ে সংরক্ষণ করেছিলেন অরুণ। না হলে এতদিনে পাতা ঝুরঝুর করে ভেঙে যেতে পারত। পাণ্ডুলিপির ভেতর ছোটো ছোটো অপরিচ্ছন্ন হাতের লেখা। অজস্র কাটাকুটি। মাঝে মাঝে মার্জিনে এলোমেলো ফুল পাতা মানুষের মুখের আঁকিবুকি। প্রথম পাতায় বড়ো হরফে লেখা, অমিতাভ মিত্র। কিন্তু উপন্যাসের নাম নেই। 

‘মৃত্যুর আগে অমিতাভ মিত্র একটা রহস্য উপন্যাস লিখছিলেন, এটাই একটা খবর। এতদিন যদি অপেক্ষাই করলেন, আর দুই মাস করে যান? এই উপন্যাসের খবরটা আমিই ব্রেক করি সবার আগে? স্টোরিটার সঙ্গে ডেট মিলিয়ে?’ বললাম আমি। 

অরুণ কিছু বললেন না। কিন্তু মুখ দেখে বুঝলাম, অরাজি নন। 

‘একটা প্রশ্ন আছে। আমি যে সমাধানই বার করি না কেন, সেটা যে সঠিক সমাধান, আপনি জানছেন কী করে?’ 

‘আমি তো… জানি, বাস্তবে অমিতাভ কী করে খুন হয়েছিল। তাই এটাও জানব, গল্পের কোন সমাধান বাস্তবের সবথেকে কাছাকাছি।’ আবার সেই গভীর দৃষ্টি, এবং আবারও কপালের কাছে চুল এসে পড়া। 

‘আপনি আমাকে সোজাসুজি কেন বলছেন না মিস্টার চৌধুরী?’ 

‘বললে বিশ্বাস করবেন না। তাই বলছি না। আমি কারণ ছাড়া কাউকে কোনো অনুরোধ করি না টিনা। পাণ্ডুলিপিটা পড়লে আপনারই লাভ হবে।’ 

হাল ছেড়ে দিলাম। ফাইল ব্যাগে ঢুকিয়ে বাইরে বেরোতে যাব, পেছন থেকে অরুণ ডাকলেন, ‘টিনা।’ 

পেছন ফিরলাম। 

‘আপনি ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট পড়েছেন?’ 

‘পড়েছি।’ 

‘অপরাধ না শাস্তি, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলতে পারেন? নাকি দুটোই আসলে এক?’ 

‘কেন এই প্রশ্ন করছেন?’ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। 

অরুণ শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হয়তো উত্তর দেবার দরকার ছিল না। 

***

০৯/০১/১৯৭১ 

নিশীথ, 

স্পষ্ট করে জেনে রাখ, অমিতাভ মিত্তির ভালো থাকলে ভালো, খারাপ হলে শুওরের বাচ্চা! অর্জুন চট্টোপাধ্যায় কে? কত বড়ো কবি? অরুণকে গিয়ে বলেছে যে আমি নেশা করছি, টাকা ধার করছি? আর বলেছে নাকি বন্ধুকৃত্য! ওই বন্ধুকৃত্যের মুখে আমি পেচ্ছাপ করে দি শালা! চাই না তোদের টাকা। চেয়েছি কোনোদিন, বলেছি আমাকে দাও বাবা, টাকাটা দাও? অরুণ এখন আমাকে চমকাবে দিনরাত, গালাগালি দেবে, ঠেক থেকে জোর করে তুলে আনবে। একবার বলেছে রিহ্যাবে পাঠাবে। ইয়ার্কি হচ্ছে বানচোদ? আমার নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু নেই নাকি? এবার কলকাতায় গিয়ে অর্জুনকে মারব, প্রচণ্ড মারব নিশীথ! ওর দুটো রিব ভাঙবই। তুই তো অর্জুনের বন্ধু। ওকে বলে দিবি, এপ্রিল মাসে অমিতাভ আসছে, ওকে মারবে! 

.

শোন, টাকা দিতে হবে না। অমিতাভ মিত্তির টাকা সম্মান পুরস্কারের ওপর মুতে দেয়। ডিলান টমাস আর ম্যাথু আর্নল্ডের দুটো বই ছিল, কলেজ লাইব্রেরি থেকে ঝাড়া। বেচে দিয়েছি। দার্জিলিঙ শহরে এসব বইয়ের কদর আছে এখনও। কলকাতার মতো আনপড় না। আজ থেকে তোদের সঙ্গে সব সম্পর্ক খতম, বুঝলি? খতম। 

.

আর শোন, কলেজ স্ট্রিট বাজারের উল্টোদিকে যে বাড়িটার দোতলায় তুই বসিস, কাজফাজের জন্য যাস, সেটা আমি চিনে নেব ঠিক। আমি আসব, তুই আমাকে নিয়ে মার্কেটের ভেতর যে ফিসফ্রাইটার দোকান আছে, ওখানে যাবি। আমার খুব খিদে পাবে সারারাত ট্রেন জার্নিতে, বুঝলি? খাওয়াবি পেট ভরে। ওখানে প্ল্যান করব, অর্জনকে কীভাবে কোথায় মারব। আর রণজিতের কবিতা পড়লাম। আমাদের লাজুক কবিতা, তুমি ফুটপাতে শুয়ে থাকো / কিছুকাল, তোমার লাজুক পেটে লাথি মেরে হেঁটে যাক বাজারের থলি হাতে বিষণ্ণ মানুষ— এসব লাইন আর কয়েকটা লিখলে ও অমর হয়ে যাবে শালা, অমর! ঈশ্বর ওর গেটে কুকুরের মতো বাঁধা থাকবে আর লেজ নাড়বে। তোর কবিতার মধ্যে আবার অত্যাশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম। কাব্যভাষা নির্গত হচ্ছে মনের অজ্ঞাত কোণ থেকে, এই অঞ্চলের উপর স্বয়ং কবিরও পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তোর যে নীচু তারে বাঁধা গভীরতার কণ্ঠস্বর, সেটা আগে তুই নিজে শুনেছিস, পরে শুনিয়েছিস অপরকে, তৈজসেরও দেখা পাইনি যেমন লিখেছিস, আর এটা করতে গিয়ে তোকে কোনো সঙ্ঘের শরণ নিতে হয়নি, শুধু চৈতন্যের উদ্ভাসের অপেক্ষা করতে হয়েছে, অদ্ভুত নিশীথ, অদ্ভুত! তোর বই তাড়াতাড়ি হওয়া দরকার। তুই পার্থর বইয়ের প্রকাশ করছিস খুব ভালো, কিন্তু নিজের বই করছিস না কেন? পার্থ ছাড়া আমাদের সময়ের এত অন্যরকম তুই ছাড়া কেউ নেই রে! মাইরি বলছি। কিন্তু অর্জুনকে মারবই। অরুণকেও মারব, কিন্তু পরে। ও শালার গায়ে সাংঘাতিক জোর। কয়েকদিন অগে খাবড়া মেরেছিল একটা এখনও বাঁ কানের নীচে কনকনাচ্ছে। 

অনেকগুলো কবিতা লেখা হল গত এক মাসে। দুটো পাঠালাম, কোথাও বার করে দে। নিত্যদা মাথা খেয়ে ফেলছে, গুচ্ছকবিতার একটা কালেকশনের জন্য। নর্থ বেঙ্গল আয়, ওর বাড়িতে তোকে নিয়ে যাব, কী অসামান্য সিম্পল থেকে চাঁদের কাছাকাছি ওরকম কবিতা লিখতে পারে একটা মানুষ, ভাবতে পারবি না। 

—অমিতাভ 

কিছু টাকা পাঠাতে পারবি? দে না! পাইন মারা যাচ্ছে। টিউশনিটাও ছাড়িয়ে দিয়েছে শালারা। অরুণের টাকাটা যে কীভাবে খরচা হল, বুঝতেই পারলাম না। এখন আবার চাইতে গেলেই ধরে রিহ্যাব নিয়ে যাবে।

০৩/০২/১৯৭১ 

অরুণেশদা, 

চারটে কবিতা আপাতত পাঠালাম। এর পরেও নিয়মিত পাঠাব, নিশ্চয়। কিন্তু শরীর ভালো যাচ্ছে না। পেটের ডানদিকে একটা ক্রনিক পেন সারাক্ষণ। যাই হোক, পত্রিকার নামের বিষয়ে আগের চিঠিতে লিখিনি কিছু। ভুলে গিয়েছিলাম। নামটা রোমাঞ্চকর, জিরাফ’। কেন এই নাম, জানি না, তবে মনে করে নিয়েছি যে জিরাফের গলার মতোই তুমি নিঃসঙ্গ, সবার থেকে উঁচুতে এসব হাবিজাবি। থাকগে এসব। আগের সংখ্যা সবে হাতে এসেছে, এখনও পড়িনি। আমি লিখতে চাইছি, অরুনেশদা। দৈনন্দিন বাস্তবের রুক্ষতা থাকুক, ওটুকু পেরিয়ে আমার কবিতা আসুক অন্য বাস্তবে, বাস্তবোত্তর বাস্তব, অথবা আমি ঠিক জানি না। কিন্তু বাইরের ঔজ্জ্বল্য, চালাকি, স্মার্টনেস ফিকে করে দিয়ে অন্তর্গত রক্তক্ষরণে শুদ্ধ হয়ে উঠবে সত্ত্বার গহন, মন কেমন করা বাতাস বইবে চরাচর জুড়ে, আর পড়ে থাকবে ভেতরের স্পন্দন, উচ্চারিত শব্দের ফাঁকে ঝিঁকিয়ে ওঠা অন্ধকার, এটুকু ছাড়া চাইবার কী আছে আমাদের। অমিতাভ গুপ্ত এরকম কবিতা লিখছে আজকাল, তুমি তো জানোই ওর কথা। আমিই এ পর্যন্ত চিনলাম না, কলকাতায় যেতে পারলে পাক্কা ধরে বেঁধে আলাপ করতাম। বলতাম, কী ভাবে লিখতে পারিস এসব শালা—তোমার উপেক্ষা দিয়ে আমাকে চিনিয়ে গেলে নীলিমায় নক্ষত্রের মন কীভাবে হারিয়ে থাকে। হার্মাদবাতাসে যেন চতুর্দিকে খুলে যায় সমস্ত দুয়ার। সমস্ত বন্দী আজ মুক্ত হয়ে বিশাল প্রান্তরে ছুটে আসে। অবিশ্রাম ঝড় প্রেক্ষাপট তুচ্ছ করে। এসব হল ভূতে পাওয়া লেখা। আমি তোমাকে বলছি অরুণেশদা এই ১৯৭০-এ এই যে দুটো বই বেরল, একটা পার্থর আরেকটা অমিতাভর, গোটা দশকটা, এদের দুজনকে দিয়ে চিহ্নিত হবে। মিলিয়ে নিও আমার কথা। 

আমি কি এদের তুলনায় খারাপ লিখি? আজকাল সন্দেহ হয়। মনে হয়, আমি আর বেশিদিন লিখব না। হয়ত আঙুল প্যারালিসিস হয়ে যাবে, অথবা একদিন সকালে উঠে দেখব সব ভুলে গিয়েছি, আর ভুলে যে গিয়েছি সেটুকু বোধও নেই। ভালো লাগে না, কুচবিহারে তোমার বাড়ি গিয়ে দুদিন থেকে আসব? তাড়িয়ে দেবে না তো? লেবু লংকা আর পেঁয়াজ দিয়ে চোলাই খাওয়াবে? সঙ্গে আদার কুচি আর বিটনুন? যদি লিখতে ভুলে যাই, যদি স্ট্রোক হয়, তবুও আমাকে খাওয়াবে তো, অরুণেশদা? 

—অমিতাভ 

***

পূর্ণতার ফোঁটা ফোঁটা অন্ধকার সান্দ্র সানুদেশে ঝড়ে পড়ে 
রাত্রি তিনপ্রহরে ডাকে মৃত্যুকাক 

—তুষার চৌধুরী 

.

অমিতাভর উপন্যাস 

প্রিয় শুদ্ধসত্ত্ববাবু, 

মৃত্যু নিশ্চিত আসিবেই, আজ অথবা কাল; সেটা জানিবার পরেও মানুষ নিরুদ্বিগ্ন জীবন যাপন করে। সেটিই বোধ করি জগতের সবথেকে বড়ো আশ্চর্য। অবগত আছি যে আমি খুন হইব, এবং শীঘ্র। কিন্তু তবুও অবিচলিত চিত্তে আপনাকে এ পত্র লিখিতেছি। আমার একদা সুহৃদ আনিসুর রহমান আমাকে খুন করিবেন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব নিজেকে বাঁচাইতে। কিন্তু আপনাকে এই পত্র প্রেরণের উদ্দেশ্য আতঙ্ক নহে। আমি চাই, মৃত্যুর পূর্বে অন্তত আপনাকে আমার জীবনের গোপন সত্যটি বলিয়া যাইতে। আমার মৃত্যু ঘটিলে অপরাধী যেন ধরা পড়ে। আনিসুর তাহার অপরাধের শাস্তি পায়। আপনি ভাবিতেই পারেন, পুলিশের নিকট কেন যাইলাম না। যাইলাম না, কারণ তাহাতে লাভ নাই। তাহারা এ কাহিনী বিশ্বাস করিবে না। এই কাহিনী এতই চমকপ্রদ যে, নিতান্ত ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য খাকি উর্দি ধারণ করিতে হয় যাহাদের, তাহারা হজম করিতে পারিবে না। একমাত্র আপনি, আপনিই পারেন আমার কাহিনীর মূল্য বিষয়ে অবগত হইতে। বিখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর শুদ্ধসত্ত্ব সান্যালকে এই পত্র আমি প্রেরণ করিব না। প্রেরণ করিব জটিল জীবনরহস্যের প্রাজ্ঞ অনুসন্ধানী শুদ্ধসত্ত্ব সান্যালকে, এরূপও সম্যক সিদ্ধান্ত করিতে পারেন। আমার ঠিকানা খামের উপরেই পাইবেন। কিন্তু আপনাকে এই স্থানে আগমনের অনুরোধ করিব না। জানি আপনি ব্যস্ত মানুষ। আমি এই পত্র প্রেরণ করিবার দুইদিন পর, মানে আগামী উনিশে জ্যৈষ্ঠ, অর্থাৎ তেসরা জুন, দ্বিপ্রহর দুই ঘটিকায় আপনার লেক মার্কেট সন্নিহিত গৃহে আসিব। প্রত্যাশামতো এইপত্র তন্মধ্যে আপনার নিকট পঁহুছিবে। যদি আপনি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন অথবা গৃহে অনুপস্থিত থাকেন, তাহাতেও অসুবিধা নাই। একটি পত্রভরতি খাম রাখিয়া আসিব, যাহার মধ্যে থাকিবে আমার স্বীকারোক্তি। আমি খুন হইবার পর সেই স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করিয়া আপনি যাহা উচিত মনে করিবেন, সেটিই করিবেন। আপনার বিচারবুদ্ধির উপর আমার পূর্ণ আস্থা বিদ্যমান। শুধু এটুকু স্মরণে রাখিবেন যে, মাধব রক্ষিত আপনার সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছে। মাধব রক্ষিতই, অপর কেহ নহে। 

ভবদীয়
মাধব রক্ষিত 
তাং: ০১/০৬/১৯৭৫ 

চিঠিটা উলটে পালটে দেখে ধনুক হয়ে গেল শুদ্ধসত্ত্বর ভুরু। মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে চিঠি ধরিয়ে দিল প্রণবেশের হাতে। ‘আজ ২ তারিখ। সকালের ডাক এখনও আসেনি। মানে কাল এসেছে চিঠিটা, রাত্রে। আজব তো।’ 

‘আজবের কী দেখলে আবার!’ 

‘মাধব রক্ষিত? নামটা শোনা শোনা লাগছে না?’ 

‘আমি যাকে ভাবছি, সে যদি হয়, তাহলে তো… সে বড়ো ব্যবসায়ী। সামনের ভোটে শুনছি টিকিট পাবে।’ 

‘ওহ্ সেই জন্যেই শোনা লাগছিল। তবে চিনি না, বলাই বাহুল্য।’ অলস ঔদাসীন্যে হাই তুলল শুদ্ধসত্ত্ব। ‘রাজনীতির মতো একঘেয়ে আর কিছু হয় না। তা ইনি কোন্ দল হে? ডান, না বাম? 

‘ইনি সব দলের হাতেই তামাক খেয়েছেন। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, জনসংঘ ঘুরে এসে এখন সম্ভবত গাইবাছুরের ল্যাজ ধরে বৈতরণী পার হবার চেষ্টায়, কিন্তু’, প্রণবেশের মুখ চিন্তিত, ‘ইনিই কি সেই মাধব রক্ষিত?’ 

‘সেটা জানা কঠিন নয়। বরানগরের ঠিকানা দেখছি। টেলিফোন ডায়রেক্টরি থেকে খামের ঠিকানা মিলিয়ে নিলেই বোঝা যাবে। আপাতত ভাবাচ্ছে চিঠির শেষ দুটো বাক্য।’ নিবিষ্ট চোখের উপর চিঠি তুলে ধরেছে শুদ্ধসত্ত্ব। 

‘কেন?’ 

‘মাধব রক্ষিতই আমার সাহায্য চেয়েছে, অন্য কেউ নয়, এর অর্থ কী? অপর কারও সাহায্য চাইবার কথা ছিল নাকি?’ শুদ্ধসত্ত্ব পাঞ্জাবির পকেট থেকে নস্যির কৌটো বার করে একটিপ টেনে নিয়েছে এই ফাঁকে। চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। 

‘চিঠি গোলমেলে মানছি। কিন্তু তোমার কাছে এরকম চিঠি নিত্যই আসে। সান্যালবাবু আমাকে বাঁচান আমি খুন হয়ে যাচ্ছি। সান্যালবাবু আমি আজ আমার স্ত্রীকে হত্যা করব। পারলে ঠেকান, চ্যালেঞ্জ করছি। মিস্টার সান্যাল, আমার বাড়ির লুকানো গুপ্তধন খুঁজে বার করে দিলে তার অর্ধেক আপনার। বেশিরভাগই ফালতু। নিষ্ফল আস্ফালন। আজ এই চিঠি তোমার চোখ টানছে কেন?’ 

ঝিম আসছে শুদ্ধসত্ত্বর। নস্যির ঝাঁঝে থম বসে থাকার পর রক্তাভ চোখ মেলল সে, ‘একটা সিগারেট দাও হে! বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া লাগবে।’ 

ব্যাজার মুখে চারমিনারের প্যাকেট বার করল প্রণবেশ, ‘এই নিয়ে এগারো হাজার তিনশো সাতান্নখানা ধার নিলে। হিসেব থাকছে সব।’ 

পাত্তা না দেবার ভঙ্গিতে সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে শুদ্ধসত্ত্ব বলল, ‘ব্যাপারটার মধ্যে আজব কিছু লাগছে না তোমার?’ 

চিঠি উলটে পালটে দেখে নিয়ে ঠোঁট ওলটাল প্রণবেশ, ‘বাংলায় টাইপ করা চিঠি। এরকম তো কতই হয়। নাহ, মনে হচ্ছে রজ্জুতে সর্পভ্রমই ঘটছে তোমার।’ 

‘আর কিছু দেখলে না?’ 

‘আর কী?’ 

‘খামের ওপর স্ট্যাম্প নেই। খেয়াল করে দেখো।’ 

এবার প্রণবেশ সচকিত হলো। খাম হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘আশ্চর্য!’ 

‘আশ্চর্যের কিছু নেই। ডাকবিভাগের ভরসায় না থেকে গতকাল নিজের হাতে আমার পোস্টবাক্সে ফেলে দিয়ে গেছে। প্রশ্নটা হলো’, শুদ্ধসত্ত্ব ঠোঁট গোল করে ধোঁয়ার রিং ছাড়ল কয়েকটা, ‘যে লোক হাতে না লিখে, চিঠি টাইপ করবার মতো সময়সাপেক্ষ কাজ করতে পারে, সে চিঠি পোস্ট করবার সময়ে তাড়াহুড়ো করে নিজের হাতে দিয়ে গেল কেন? আর দিয়েই যদি গেল, সশরীরে সাক্ষাৎ কেন করল না? কেন ৩ তারিখের ভরসায় বসে থাকলো? আবার আশা করছে যে ৩ তারিখের মধ্যে এই চিঠি আমার কাছে চলে আসবে। আশা করবার অর্থ, ডাকবিভাগ তাদের প্রবাদপ্রতিম অকর্মণ্যতার সাক্ষ্য দেবে না। তার মানে, লেখার সময়ে ভেবেছিল যে চিঠি ডাকেই ফেলবে।’ 

হুঁ, ৩ তারিখ দেখা করতে আসতে চেয়ে ১ তারিখ চিঠি পাঠাবে, এটাও কেমন না?’ 

‘লালমুখো জেন্টলম্যান হে! চিঠি লিখে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেখা করতে আসেন। কিন্তু লেখা শেষ হবার পর কী এমন ঘটল যে মত পরিবর্তন করতে হলো?’ ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে এলোমেলো আঙুল চালাল শুদ্ধ। ‘এটা ঠিক সাধারণ চিঠি নয়। কিছু একটা আছে।’ 

‘চিঠিটার ওপরে দেখো, কালির কয়েকটা হালকা ফোঁটা পড়েছে। আবার কাগজটাও বেশ পুরোনো। অন্য পাতায় হিজিবিজি আঁচড়। ত্রিভুজ, জিগজ্যাগ, বৃত্ত, তারপর সব কেটে দিয়েছে। কী মনে হয়?’ 

শুদ্ধ থম মেরে আছে। সিগারেটে টান দিচ্ছে। প্রণবেশ জবাব না পেয়ে অধৈর্য হল, ‘কী হলো? কথা বলছ না যে?’ 

‘আমাকে দেখে কী মনে হয়? শার্লক হোমস? চিঠির পেছনে ত্রিভুজ দেখে অপরাধীর খুড়শ্বশুরের বয়স অনুমান করে ফেলব? ওভাবে ডিটেকশন হয় না।’ 

‘হয় না মানে? হোমসকে অনুসরণ করে ব্রিটিশ পুলিশ তাদের ডিটেকশন পদ্ধতিতে পরিবর্তন করেছিল এটা জানো না?’ 

‘ব্রিটিশ পুলিশ গাধা, তাই করেছিল। একটা কোকেনখোরের কথাকে একমাত্র ওয়াটসনের মতো নির্বোধ ছাড়া কেউ বিশ্বাস করে? একটা লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে, তার ছড়ি ঘোরানোর ধরণ আর খুঁড়িয়ে হাঁটা দেখে হোমস বলে দিল যে, লোকটা নাকি মিলিটারিতে ছিল আর যুদ্ধে আহত হয়েছে। অথচ তার থেকেও সহজ আর একটা সমাধান ছিল— লোকটা ওভাবেই ছড়ি ঘোরায়, আর জন্ম থেকে তার পায়ে খুঁত। কিন্তু সেটা বললে তো আর কাপ্তেনি ফলাতে পারবে না। হোমসকে তো ওয়াটসনের কাছে নিজেকে হিরো প্রমাণ করতে হবে। তাই সবথেকে কঠিন সমাধানটা দিয়েছে। ওয়াটসনও বোকামির বিশ্বরেকর্ড করবার মনস্থির করেছে বলে এই সব গাঁজাখুরিকে ধ্রুব সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। আমি শুধু ভাবছি, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে লেস্ট্রেডরা ওয়াটসনকে নিয়ে কী পরিমাণ রসিকতা করত নিজেদের মধ্যে। কত বড়ো গাধা হলে একটা পাগল-ছাগলের কথাকে কেউ এরকম গুরুত্ব দেয়। আচ্ছা, ওয়াটসন কি ঘোড়ার ডাক্তার ছিল? ডয়েল সাহেব কিছু লিখে গেছেন? মানুষের ডাক্তারের ব্রেন এরকম নকুলদানার আয়তনের হয় কী করে?’ প্রণবেশ নিজেও ডাক্তার। তাই অপমানটা চামড়ার জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু মুখ খুললে আরও অপমান জুটবে বলে কিছু না বলে তুষ্ণীভাব অবলম্বন করাই শ্রেয় মনে করল। 

‘আরে বাবা, শুদ্ধসত্ত্ব সিগারেটে একটা টান মেরে সামনে ঝুঁকেছে ‘কাগজের ওপর কালির ফোঁটা কেন, তার সবথেকে সহজ উত্তর যেটা, সেটাই হবে! কাছেপিঠে কেউ একজন কলমের কালি ঝেড়েছিল। আর পেছনে হিজিবিজি কেন, কারণ অন্যমনস্কভাবে মাধব রক্ষিত আঁকিবুকি কেটেছেন। সবথেকে সহজ সমাধানটুকু বাদ দিয়ে কঠিনের পেছনে দৌড়লে কি গোয়েন্দার মান বাড়ে? তোমাদের কি ধারণা, সব খুনিরাই আইনস্টাইনের সমান মেধাবী হয়? এমনভাবে খুন করে, যাতে ধরা অসম্ভব হয়ে ওঠে? তোমাকে বলছি শোনো, নিরানব্বই শতাংশ খুন হয় ঝোঁকের মাথায়। অগোছালো ভাবে। কারণ খুন করে আততায়ী পালাবার ধান্দায় থাকে। সে সূত্র মুছবে, হাতের ছাপ ঢাকবে, পুলিশকে ফলস্ ক্লু দেবে, এসব ওই তোমার ডয়েল সাহেবের গল্পে হয়। আর কী যেন সব থিওরি আছে না, অপরাধী ক্রাইম স্পটে ফিরে ফিরে আসে? এর থেকে বড়ো ধাপ্পা আর কিছুতে নেই, শুনে রাখো। বেশিরভাগ মানুষ যারা খুন করেছে, তারা তাদের জীবনে প্রথমবার এরকম কাণ্ড ঘটিয়েছে। আর খুন করে এত ভয় পেয়ে গেছে যে এদের প্রথম ইন্সটিংক্টই হয় যত দূরে সম্ভব পালিয়ে যাওয়া। পুলিশ তাই এরকম ঘটনায় সবার আগে রেলস্টেশনগুলোতে নজরদারি বসায়। আরে বাবা তুমি যে রেশনের দোকানের আটা খাও, খুনিও সেই রেশনের আটাই খায়। সে এত বুদ্ধিমান, আর তুমি এত বোকা, এরকম হয় নাকি?’ একটানা অনেকটা কথা বলে শুদ্ধ আবার ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে চোখ বুজল। 

একতলায় প্রশস্ত ঘরটায় মরে আসছে দুপুরের আলো। পচা গরমে অস্থির লাগছে। ঘুম আসছে প্রণবেশের। সে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে জিজ্ঞাসা করল, ‘তাহলে চিঠিটা নিয়ে কী করবে?’ 

‘আপাতত কিছুই করব না। মাধব রক্ষিত কাল আসুন। তারপর যা হয় হবে।’ 

‘মাধব রক্ষিতকে ফোন করা যায় না? ঠিকানা তো দেওয়াই আছে।’ 

‘বেশি কৌতূহল দেখানো হয়ে যাবে হে। ভাববে, আমরা কেস নিতে উদগ্রীব। পর্বত মহম্মদের কাছে যাবে না। মহম্মদকেই পর্বতের কাছে আসতে হবে।’ চোখ বুজেই উত্তর দিচ্ছে শুদ্ধসত্ত্ব। প্রণবেশ জানে, শুদ্ধ এখন ঘণ্টাখানেক চোখ খুলবে না, মড়ার মতো শুয়ে থাকবে। লোকে ভাববে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু শুদ্ধ এই সময়টায় ভাববে। প্রণবেশকে একবার বলেছিল, হাতে কোনো কেস না থাকলে সে অর্থহীন আকাশপাতাল চিন্তা করে। প্রতিদিন নিয়ম করে, মগজে শান দেবার জন্য প্র্যাকটিস। প্রণবেশকে সন্ধেবেলা বাড়ির নীচে চেম্বারে বসতে হবে। তার ওপর শুদ্ধসত্ত্বর মতো একা মানুষ সে নয়। লতিকা গড়িয়াহাটের বাজার থেকে রংবাহারি পর্দা কিনে আনবার নির্দেশ দিয়েছে। ভুলে গেলে দক্ষযজ্ঞ বাধবে। 

কিন্তু পরদিন নির্ধারিত সময়ে মাধব রক্ষিত এলেন না। শুদ্ধসত্ত্ব টুকটাক কথার মধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। প্রণবেশ বুঝতে পারছে, শুদ্ধ মন থেকে অদ্ভুত চিঠির কথা কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। অবশেষে দুপুর তিনটে নাগাদ আর থাকতে না পেরে শুদ্ধসত্ত্ব বলল, ‘মাধব রক্ষিতের টেলিফোনে একটা ফোন করে দেখো তো!’ 

ডায়রেক্টরিতে ঠিকানা মিলিয়ে ফোন করল প্রণবেশ। ‘হ্যালো, এটা কি মাধববাবুর বাড়ি? হ্যাঁ হ্যাঁ, মানে শিল্পপতি মাধব রক্ষিত? আচ্ছা, মাধববাবুকে ফোন দেওয়া যাবে? বলুন, শুদ্ধসত্ত্ব সান্যালকে তিনি যে চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন, সেই ব্যাপারে কথা আছে। হ্যাঁ এটুকু বললেই হবে। কী? সে কী, কেন? আচ্ছা, ধরছি। আপনি জানান।’ 

ফোনের মুখে হাত চাপা দিয়ে শুদ্ধসত্ত্বকে ফিসফিস করে প্রণবেশ বলল, ‘ব্যবসায়ী মাধব রক্ষিতই। কিন্তু বাড়িতে পুলিশ এসেছে, তাই ব্যস্ত।’ 

‘পুলিশ? কেন? মাধববাবু কি এর মধ্যেই…’ 

‘না না। মাধববাবুর সেক্রেটারি ফোন ধরেছে। দাঁড়াও। হ্যাঁ বলুন। কে, মাধববাবু? এক মিনিট ধরুন একটু।’ ফোনের রিসিভার শুদ্ধর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে প্রণবেশ। শুদ্ধ একটুক্ষণ কথা বলল। ভুরুতে চিন্তার ছাপ। বলছে, ‘আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে আসছি।’ ফোন রেখে প্রণবেশকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার গাড়িটা আছে তো?’ 

‘তা আছে। কিন্তু যাব কোথায়? মাধববাবুর বাড়ি?’ 

‘না। ধর্মতলা। জুপিটার নামের একটি হোটেল। খুন হয়েছে। 

‘কে খুন হলো?’ 

‘আনিসুর রহমান।’ 

***

ডেকার্স লেনের এঁদো গলির মধ্যে হোটেল জুপিটার। সংকীর্ণ পথের দুই পাশে বাড়ির দল ঘেষাঘেঁষি দাঁড়িয়ে, যাদের অধিকাংশ জুপিটারের মতোই ওঁচা ও অপরিচ্ছন্ন। গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না, এতটা সরু গলি। হোটেলের সিঁড়ির নীচে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার পেতে ম্যানেজারের টেবিল বানানো হয়েছে। দিনমানেও আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। আপাতত সেখানে পুলিশের ভিড়। তালতলা থানার ওসি বিমল সমাদ্দার এগিয়ে এলেন। তিনি শুদ্ধসত্ত্বর চেনা। ‘আমি মাধব বাবুকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। আপনি যখন ফোন করেছিলেন তখন ওখানেই ছিলাম। কী বলব মশায়, এমন অদ্ভুত খুন বাপের জন্মে দেখিনি।’

‘অদ্ভুত কেন?’ 

‘আরে মশায় বন্ধ ঘরের মধ্যে খুন! ভেতর থেকে ছিটকিনি তোলা। জানালা বন্ধ। ঘরের মধ্যে অন্য কোনো গুপ্তপথ বা গলিপথ নেই। ওই কারণেই বডি আবিষ্কার হতে সময় লেগেছিল। হোটেলের ঠিকে ঝি ঘর পরিষ্কার করতে এসে দুইদিন দরজা বন্ধ দেখে ফিরে গেছে। আজ পচা গন্ধ পাওয়ায় তার সন্দেহ হয়। জানায় ম্যানেজারকে। ডাকাডাকি করলেও যখন কেউ দরজা খোলে না, ভাঙতে হলো। দরজা ভেঙে বডি দেখতে পায় সকলে। গরমে পচতে শুরু করছে।’ 

‘আত্মহত্যা?’ 

‘চারতলায় চলুন। ঘর দেখুন। তারপর বলছি।’ পেছনে এসে দাঁড়ালেন এক ব্যক্তি। খর্বকায়, গাট্টাগোট্টা চেহারা। তামাটে রং, কদমছাঁট চুল, হালকা কটা চোখ আর রুক্ষ পেশল মুখ, সমগ্রটার ভেতর একটা গোপন নিষ্ঠুরতার আভাস পাওয়া যায়। পরনে সাফারি স্যুট। গরমে বেশ ঘামছেন, এবং বারে বারে রুমাল দিয়ে মুখ মুছছেন। বিমল সমাদ্দার হাত বাড়ালেন, ‘আসুন মাধববাবু।’ 

শুদ্ধসত্ত্ব এগিয়ে গেছে। ‘আমি শুদ্ধসত্ত্ব সান্যাল। আপনি আমাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন।’ 

মাধব রক্ষিত কয়েক সেকেন্ড নীরবে শুদ্ধসত্ত্বকে জরিপ করার পর হাতজোড় করে নমস্কার করলেন, ‘আমি দুঃখিত, কথা দিয়েও আজ আসতে পারিনি বলে। দুপুর একটার সময়ে বাড়িতে পুলিশ এসে এই দুঃসংবাদটি দিল। এতই হতভম্ব হয়ে আছি যে আপনার বাড়ি যাবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সন্ধেবেলায় বাড়ি থাকবেন? তাহলে আসব। তখন কথা হতে পারে।’ 

বিমলবাবু জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছেন। শুদ্ধসত্ত্ব সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জানাল, ‘তেমন কিছুই নয়। একটা ব্যক্তিগত দরকারে আজ আসবেন বলেছিলেন। কিন্তু আপনারা এই কেসে মাধববাবুর বাড়ি কেন গিয়েছিলেন?’ 

‘ভিক্টিমের ডায়রিতে প্রথম নামটাই মাধব রক্ষিতের। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল মৃত্যুর দিনেই। মানে, আমরা ধরে নিচ্ছি খুন হয়েছে পয়লা জুন রাত থেকে পরের দিন সকালের মধ্যে। কারণ পয়লা জুন সন্ধেবেলা পর্যন্ত আনিসুর রহমানকে দেখা গিয়েছে। আবার দোসরা জুন সকাল থেকে তাঁর দরজা বন্ধ ছিল। ঘরের বাইরে বেরোননি। মাধব রক্ষিত নিজেও স্বীকার করেছেন যে, তিনি আনিসুরের সঙ্গে গত পরশু, মানে পয়লা জুন দেখা করেছেন। নিজেই জানিয়েছেন যে ভিক্টিম পুরোনো পরিচিত। অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময়মতো এই হোটেলেও এসেছিলেন। আমরা তাঁকে নিয়ে এসেছি, লাশ আর ক্রাইম স্পট শনাক্ত করবার জন্য। কিন্তু আপনি কেন?’ 

‘মাছের গন্ধ পেলে বেড়াল আসে, জানেন না?’ একপেশে হাসি ঝুলিয়ে উত্তর দিল শুদ্ধসত্ত্ব। তারপর আঙুল চালিয়ে টেনে টেনে মাথার চুলগুলো অবিন্যস্ত করে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই ঘরটা তো?’ 

ঘরের ভেতর খাট, একটা সস্তা কাঠের টেবিল আর টিনের চেয়ার। একটা সুটকেশ সরিয়ে রাখা একপাশে। মেঝের চার ফুট উঁচু থেকে শুরু হয়েছে জানালা, তিন ফুট লম্বা এবং দুই ফুট চওড়া। ভেতর থেকে বন্ধ টেবিল রাখা আছে খাটের মাথার কাছে, আর জানালার একপাশে চেয়ার। টেবিল থেকে কিছু দুরে মাটিতে চকের দাগ দিয়ে একটা গোলাকৃতি সীমানা এঁকে দেওয়া। সেই অঞ্চলটায় চাপ রক্ত। কালচে হয়ে আছে। মাছি উড়ছে কয়েকটা। সারা ঘরে পচা মাংসের গন্ধ। 

‘জানালাটা খুলুন না মশাই। ঘরে টেকা যাচ্ছে না।’ 

পুলিশের এক কনস্টেবল এগিয়ে এল। দুই কাচওয়ালা শিকবিহীন খিড়কি। জানালার ঊর্ধ্বাংশে একটা ভারী কাচের পাত। নীচের অর্ধাংশে আরেকটা কাচের পাত, যার গায়ে আংটা বসানো। আংটা ধরে নীচের কাচ ওপরে তুলে দিতে হয়। অনেকটা রেলগাড়ির জানালার মতো। কনস্টেবলটিকে কাচ তুলে জানালার ওপরের দিকের দুটো ছিটকিনি টেনে দিতে বেশ কসরত করতে হলো। অব্যবহারে জ্যাম হয়ে আছে হয়তো। জোরে টান দিতে আস্তে আস্তে উঠে গেল। 

‘বডি চলে গেছে মর্গে। মাধববাবু, আপনাকে শনাক্তকরণের জন্য আমাদের সঙ্গে সেখানে যেতে হবে। তার আগে বলুন, এই ঘরেই আপনি পরশু এসেছিলেন তো?’ 

মাধববাবু ইতিবাচক মাথা নাড়লেন। শুদ্ধসত্ত্ব বাথরুমের দরজা খুলল। নোংরা বাথরুম। একটা বালতি, মগ, এবং মেঝেতে শ্যাওলা পড়ে আছে। জানালা নেই। দুটো ঘুলঘুলি। হোটেলের মালিকও পুলিশের সঙ্গে ওপরে এসেছিলেন। ততক্ষণে ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করে দিয়েছেন। কত সুনাম তাঁর হোটেলের। কখনও এমনধারা উৎপাত নাকি হয়নি। এবার পুলিশের ছোঁয়া লেগেছে বলে তাঁকে পাততাড়ি গোটাতে হবে। হোটেলের নাম খারাপ হয়ে যাবে। 

বিমল সমাদ্দার ধমকে উঠলেন, ‘ধুর মশাই! থামুন তো! যা অভিযোগ আছে থানায় এসে করবেন।’ শুদ্ধসত্ত্বর দিকে ফিরে বললেন, ‘আগে বলুন তো, আপনি কোন ক্যাপাসিটিতে আছেন? মাধব রক্ষিত অথবা ভিক্টিম নিজে, কেউ কি নিয়োগ করেছেন? নাহলে তো আপনাকে অ্যালাউ করতে পারব না এখানে!’ 

শুদ্ধসত্ত্ব উত্তর দেবার আগেই মাধব রক্ষিত গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আমি মিস্টার স্যানালকে অ্যাপয়েন্ট করেছি। আমার অনুরোধেই তিনি এখানে এসেছেন।’ 

বিমল সমাদ্দার মাথা নাড়লেন। শুদ্ধসত্ত্বকে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না শুদ্ধবাবু। আপনাকে বহুদিন ধরে চিনি। তবুও বুঝতেই পারছেন, প্রোটোকল! একটাই অনুরোধ। সহযোগিতা করবেন! কোনো ক্লু পেলে আমাদের জানাবেন। 

শুদ্ধসত্ত্ব সাবধানে বুড়ো আঙুলে পায়ের ভর দিয়ে ব্যালে নাচের ভঙ্গিতে ঘরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মাথার ভেতর চুলে আঙুল ঢুকিয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর চোখ খুলে বলল, ‘ঘর ভেতর থেকে লক করা। জানালার কাচ জ্যাম হয়ে বসে আছে। বাথরুমে ছোট্ট দুটো ঘুলঘুলি। বেশ। এবার চলুন। বডি কীভাবে ছিল?’ 

‘চিত হয়ে শুয়ে। একটাই গুলি। বুকের বামদিকে হৃৎপিণ্ড ফুটো করে ভেতরেই থেকে গেছে। মার্ডার ওয়েপন নিখোঁজ।’

‘সময়?’ 

‘পোস্টমর্টেমের আগে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে পরশু রাতে হবার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। কারণ তো আগেই বললাম।’ 

‘আত্মহত্যা নয় কেন?’ প্রশ্ন ছুড়ল প্রণবেশ। 

‘কারণ বন্দুকটা পাওয়া যায়নি। নিজের হৃৎপিণ্ডের ওপর টিপ করে পিস্তল ধরতে গেলে পিস্তলকে বুকে ঠেকিয়ে অস্বস্তিকর পজিশনে রাখতে হবে ডান হাত। আর বাম হাতে ধরতে গেলে বুড়ো আঙুলকে ট্রিগারের ওপর রাখতে হবে। গুলি করবার পর হাত থেকে বন্দুক ওখানেই পড়ে যাবে। বন্দুক পাওয়া যাচ্ছে না মানে আত্মহত্যা নয়। খুন!’ শুদ্ধসত্ত্ব উত্তর দিল। তারপর কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে মুখব্যাদান করে তর্জনী দিয়ে দাঁতে টোকা দিল। ছয়ফুট লম্বা, রোগা, পাজামা- পাঞ্জাবি পরা এবং উসকো খুসকো চুলের কেউ যদি বড়ো রাস্তার মোড়ে এ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকত পাগলই ভাবত হয়তো সাধারণ মানুষ। কিন্তু বিমলবাবু এবং প্রণবেশ, দুজনেই শুদ্ধসত্ত্বের রকমসকমের সঙ্গে পরিচিত। আচমকা জিজ্ঞাসা করল, ‘চেয়ারটা জানালার পাশে কেন?’

হকচকিয়ে গেছেন বিমলবাবু। ‘মানে?’ 

‘টেবিল তো ঘরের অন্যদিকে। চেয়ার সেখানে থাকার কথা, কারণ টেবিলের ওপর কাগজপত্র রাখা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু চেয়ার এত দূরে কেন?’ 

‘আমি যখন এসেছিলাম, চেয়ার কিন্তু টেবিলের পাশেই ছিল। ওখানে বসেছিলাম আমি, আর আনিসুর ছিল বিছানার ওপর বসে!’ মাধববাবু মুখ খুললেন। 

চিন্তিত স্বরে শুদ্ধসত্ত্ব নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘একজন লোক চেয়ার কেন সরাবে? যদি টেবিলের নীচ থেকে কিছু বার করতে হয়। কিন্তু এতটা সরাবে না। তাহলে? রক্তের ছাপের সামনে উবু হয়ে বসে বিড়বিড় করল, ‘মৃত্যু তার মানে ইন্সট্যান্ট! কারণ রক্ত এক জায়গাতেই জমাট বেঁধে আছে। সেটাও অল্প। বডি নড়াচড়া করেনি। অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ! 

এক গুলিতেই কাজ হাসিল। যাক, তার মানে গুলি বুক দিয়ে ঢুকেছে। পিঠ দিয়ে নয়।’ 

‘কেন? পিঠ দিয়ে ঢুকে হার্ট ফুটো করতে পারে না?’ 

‘সেক্ষেত্রে বডি উপুড় হয়ে পড়বে।’ 

‘টেবিলের কাগজপত্র দেখবেন না?’ 

‘নাহ।’ দাঁড়িয়ে হাই তুলল শুদ্ধ। ওসব থানাতে দেখে নিলেও হবে, কারণ আপনারা তো সবই সিজ করবেন। আর ছবিও তুলে রাখবেন টেবিলের। একটা জিনিস বলুন তো, যখন দরজা ভাঙা হয়, ঘরে কি আলো পাখা চলছিল?’ 

‘হ্যাঁ দুটোই চলছিল। কিন্তু কেন?’ 

‘তার মানে ধরে নিতে পারি যে ভিক্টিম তখনও ঘুমোননি। তাই আলো জ্বলছিল। কিন্তু তাহলে, কী কাজ করছিলেন? খাটে শুয়ে কোনো বই পড়া বা লেখালেখি না। খাটে কিছু নেই। টেবিলের সামনে বসে কিছু করতে পারবেন না কারণ চেয়ার সরানো। বাথরুমে গিয়েছিলেন? হতেই পারে। হয়তো শুয়েছিলেন। বাথরুমে যাবার দরকার পড়ল। আলো জ্বালালেন। বাথরুমে গেলেন। ফিরে আসবার সময়ে গুলি খেলেন। নাহ্ মিলছে না। কারণ ঘরের দরজার মুখোমুখি জানালা। আর বাথরুম ঘরের বাম পাশে, খাট ঘরের ডানপাশে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে খাটের দিকে যেতে হলে জানলার দিকে বাম হাত থাকবে, মুখ থাকবে খাটের দিকে। সেক্ষেত্রে গুলি লাগলে যেভাবে পড়বে তাতে পা খাটের দিকে, মাথা বাথরুমের দিকে হবার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে মাথা দরজার দিকে আর পা জানালার দিকে। তার মানে, গুলি খাবার সময়ে ভিক্টিম ছিল দরজার দিকে পিঠ দিয়ে। অপরাধী কি চেয়ারে বসে ছিল? বা টেবিলের ওপর?’ 

‘জানালার কাচে ফুটো নেই। বাইরে থেকে গুলি করা হয়নি।’ বললেন বিমলবাবু। 

‘না! গুলি তার মানে চলেছে ভেতরেই। সেক্ষেত্রে গুলি লাগার ঠিক আগে ভিক্টিম দরজার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে ছিল কেন? কারও সঙ্গে কথা বলছিল কি? অথবা পায়চারি করছিল? তাহলে খুনি দাঁড়িয়েছিল জানালার দিকে পিঠ করে। কিন্তু ঘর যদি ভিক্টিমের হয় আর খুনি বাইরে থেকে আসে, সেক্ষেত্রে আততায়ী খুন করবার আগে ভিক্টিমের সঙ্গে কথা বলেছে। শুধু কথাই বলেনি, ঘরের একদম ভেতরে চলে এসেছে এবং জানালার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছে। মানে, ভিক্টিম আততায়ীকে চিনত। হয়তো কিছুটা বিশ্বাসও করত। নাহলে দুজনের পজিশন ওরকম হয় না।’ অস্থির লাগছে শুদ্ধসত্ত্বর। মাথার চুল ঘাঁটছে জোরে জোরে, ‘ঘরের মধ্যে গুলি চললে কার্তুজের খোল কই গেল? খুনি সেটা পকেটস্থ করেছে? কেন?’ 

কিন্তু খুনি গেল কোথায়? হাওয়াতে তো উবে যেতে পারে না বন্ধ ঘর থেকে?’ প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করল। 

‘আহা বন্ধ ঘরের সমস্যায় পরে আসব। ওটা এমন কিছু জটিল ব্যাপার নয়। আগে জানতে হবে, ভিক্টিমের চেনা পরিচিতের মধ্যে কারা কারা ছিল। আর তাদের অ্যালিবাই কী? চলুন বিমলবাবু, যা দেখার সব হয়ে গেছে।’ 

ঘর থেকে বেরোবার মুখে বিমলবাবুকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে শুদ্ধসত্ত্ব বলল, ‘মাধব রক্ষিত আমাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এই মর্মে যে আনিসুর তাঁকে খুন করতে পারে।’ 

সবিস্ময়ে বিমলবাবু বললেন, ‘তাহলে এই ব্যাপার! এদিকে আমরা মাধবকেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ রাখিনি!’ 

‘সে এখনও রাখবেন না। আনিসুর খুন করবেন এই আশঙ্কায় মাধব তাঁকে খুন করে দিলেন, এটা হতেই পারে। মাধবের অ্যালিবাই কী?’ 

‘সেদিন গ্রেট ইস্টার্নে ব্যবসায়ীদের পার্টিতে ছিল। সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে। রাত এগারোটায় কিছু পরে পার্টি ভেঙেছে। যদিও ভেরিফাই করা হয়নি, আশা করছি অনেকেই তাকে দেখে থাকবেন।’ 

হুঁ। আনিসুরের মারা যাওয়ার সময়টা জানা জরুরি। নাহলে অঙ্কের হিসেব কিছুই মিলবে না। আপাতত কয়েকদিন মাধববাবুর পেছনে টিকটিকি লাগিয়ে দিন।’ একটিপ নস্যি আঙুলের ডগায় নিয়ে বলল শুদ্ধ। 

‘আপনারা থানায় আসবেন তো?’ 

‘পরে। মাধববাবু জানিয়েছেন আজ সন্ধেবেলা আমার বাড়ি আসবেন। আগে কথা বলে দেখি, কিছু জানতে পারি কিনা। আপনার সঙ্গে কাল দেখা হবে।’ 

গাড়িতে উঠে শুদ্ধ বলল, ‘অনাদি চলো। মোগলাই পরোটা আর কষা মাংস না খেলে এই গরমে মাথায় আইডিয়া আসবে না।’ 

অনাদিতে বসে গরম মোগলাইয়ের গায়ে কাঁটা বিঁধিয়ে শুদ্ধসত্ত্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি ভোম্বল হয়ে আছ যে। কী ব্যাপার বলো তো?’ 

প্রণবেশ ভুরু কুঁচকে বলল, ‘খটকা লাগছে একটা।’ 

‘বলে ফেলো।’ মুখের ভেতর দুটো আলু ফেলে চিবোতে লাগল শুদ্ধ। 

‘লতিকা কাল আমাকে গড়িয়াহাটের মোড়ে পর্দা কিনতে পাঠিয়েছিল। নতুন পর্দা লাগাবে ঘরে। ব্যাপারটা মামুলি, কিন্তু আজ হোটেলের ঘরে ঢুকে অস্বস্তি হলো। জানালার পর্দা একপাশে গুটিয়ে রাখা। একজন লোক, যে হোটেলে থাকছে, ঢাকা থেকে এসে এখানে উঠেছে, সে রাত্রিবেলা পর্দা দিয়ে জানালা ঢাকবে না কেন? অত ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি, উল্টোদিকেও বিল্ডিং, সকলে তো ঘরের ভেতর দেখতে পাবে! এটুকু প্রাইভেসির বোধ নেই?’ 

শুদ্ধর চেবানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিবিষ্টভাবে প্রণবেশের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ওয়াটসনের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। পর্দার ব্যাপারটা আমার মাথাতেই আসেনি।’ 

‘কিন্তু এটা বড়ো ব্যাপার কিনা জানি না।’ 

‘অবশ্যই বড়ো ব্যাপার। এই কেসের সব খুঁটিনাটিই বড়ো ব্যাপার। কিন্তু এখন আর ভাবব না। মাথা পরিষ্কার রাখতে হবে।’ খাবারে মন দিল শুদ্ধ। 

‘আচ্ছা, হতে পারে অপরাধী খুন করে জানালা দিয়ে পালিয়ে গেছে? জানালার শিক ছিল না।’ 

‘সম্ভব না। জানলার দৈর্ঘ্য তিন ফুট। নীচের কাচটা ওপরে তুললে দেড় ফুট খোলা পাওয়া যায়। আবার প্রস্থ দুই ফুটের বেশি না। দেড় ফুট বাই দুই ফুট জায়গা দিয়ে কোনো মানুষের গলে যাওয়া সম্ভব নয়, যদি না সে একটা বাচ্চা ছেলে অথবা সার্কাসের জিমন্যাস্ট হয়। তার ওপর চারতলার ঘর। জানালার নীচে কোনো কার্নিশ নেই, জলের পাইপও নেই। মসৃণ দেয়াল। কাজেই লাফিয়ে মাটিতে পড়তে হবে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা আছে। হোটেলের গায়ে লাগোয়া চায়ের গুমটি। তার টিনের চাল এই ঘরের ঠিক নীচে। লাফিয়ে পড়তে হলে ওই চালের ওপর পড়তে হয়। আমি বেরোবার সময়ে পরীক্ষা করে এসেছি। চাল অক্ষত আছে।’ 

‘তাহলে খুনি পালাল কী করে? এ কি ম্যাজিক নাকি?’ 

‘আরে ওই নিয়ে এখন মাথা ঘামিও না। লকড রুম মার্ডারের সবথেকে সহজ সমাধান যেটা, সেটাই খাটে। সবসময়েই। সহজ করে ভাবলেই উত্তর মিলবে। বরং অনেক বেশি জরুরি এটা খুঁজে বার করা যে চেয়ারটা সরানো হয়েছিল কেন। আর পর্দা কেন গোটানো ছিল।’ 

তুমি তাহলে কেসটা হাতে নিচ্ছ?’ 

‘উলটো! কেসটা আমাকে হাতে নিয়েছে!’ অন্যমনস্কভাবে পরোটা চিবোতে লাগল শুদ্ধ, আঙুল দিয়ে এলোমেলো করে দিতে থাকল মাথার চুল। 

.

‘আনিসুর রহমান। ৫২ বছর বয়েস। উচ্চতা পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। ওজন ঊনপঞ্চাশ কেজি। ঢাকায় বাড়ি। ছোটোখাটো ব্যবসা আছে। কলকাতায় কেন এসেছিলেন জানা নেই। বছরে একবার করে আসতেন। হয়তো ব্যবসার কাজে। অবস্থাপন্ন বলে মনে হয় না। এটুকুই জেনেছি। এবার আপনার বলার পালা!’ শুদ্ধসত্ত্ব সামনে বসা মাধব রক্ষিতকে উদ্দেশ্য করে বলল। 

মাধবের আসতে রাত নটা বেজে গিয়েছিল। পুলিশের কাজে বেশ কিছুক্ষণ আটকে থাকতে হয়েছে বোঝা যায়। প্রণবেশ আজ চেম্বার বন্ধ রেখেছে। রহস্যের গন্ধে দুপুর থেকেই সে শুদ্ধর ছায়াসঙ্গী, এবং বেশ বুঝতে পারছে যে বাড়িতে আজকেও ফিরতে রাত হবে। লতিকা ফের ঘুমচোখে দরজা খুলে মুখ টিপে হেসে বলবে, ‘শুদ্ধদার প্রতি প্রেম কি বাড়িতে সুন্দরী বউয়ের হাতের ভাপা ইলিশের থেকেও বেশি তীব্র, ডাক্তারমশায়?’ 

মাধব রক্ষিত বললেন, ‘বলুন কী জানতে চান ‘ 

‘আনিসুর রহমান আর আপনার সামাজিক অবস্থানের মধ্যে বহু যোজন তফাত। তা সত্ত্বেও আপনি আনিসুরের সঙ্গে দেখা করতে ওই সম্ভার হোটেলে গেছেন। কেন? আপনি চিঠিতে লিখেছেন, আনিসুর আপনাকে হত্যা করতে চায়। কেন? আপনার জীবনের গোপন কথাটা কী, যা আমাকে জানাতে চেয়েছিলেন? চিঠিতে জোর দিয়ে কেন লিখলেন যে একমাত্র মাধব রক্ষিতই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়? চিঠি টাইপ করবার পর সেটা পোস্ট না করে নিজের হাতে আমার ডাকবাক্সে ফেলে দিলেন কেন? আর যদি দিলেনই তো তাহলে তখন আমার সঙ্গে দেখা করলেন না কেন?’ 

‘আনিসুর আমার বাল্যবন্ধু। বাংলাদেশের বগুড়াতে আমি আর ও একসঙ্গে বড়ো হয়েছি। একই স্কুলে পড়েছি। দেশভাগের পর আমি কলকাতায় চলে আসি। ও প্রতিবছর কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত। চিঠিতে জোর দিয়ে লিখেছি একমাত্র মাধব রক্ষিতই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়, তার কারণ আমার মনে হয়েছিল যে আমি যদি আপনার সঙ্গে দেখা হবার আগেই খুন হয়ে যাই, আপনি তবুও মৃতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই ঘটনায় তৎপর হবেন। তাই কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়েই হয়তো লিখে ফেলেছি ওই কথাটা। চিঠি টাইপ করবার পর যেহেতু সন্ধে হয়ে গিয়েছিল, ভাবলাম এখন পোস্ট করলে আগামীকাল আপনার কাছে না-ও পৌঁছতে পারে। তাই এক কর্মচারী মারফত আপনার বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলাম। আমি নিজে একটা মিটিং-এ ব্যস্ত বলে আসতে পারিনি।’ 

‘আনিসুর আপনাকে হত্যা করতে চায় কেন?’ 

‘আপনি অনুমান করতে পারছেন না?’ 

শুদ্ধ চোখ সরু করে মাধবের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর উত্তর দিল, ‘ব্ল্যাকমেল ঘটিত ব্যাপার কি?’ 

মাধব দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। ‘আপনি বুদ্ধিমান। আমার কোম্পানির বোর্ড অফ্ ডায়রেক্টরস-এর সদস্য হলো অশোক ঝুনঝুনওয়ালা। ওর বাড়ির একটা হিরে চুরির কেস আপনি সমাধান করেছিলেন। ওর মুখে আপনার আশ্চর্য প্রতিভার কথা বহুবার শুনেছি। ঠিক করেছিলাম, জীবন-সংশয় হলে আপনার কাছেই আসব।’ 

‘কিন্তু আমি যেটা বুঝছি না’, প্রণবেশ ঝুঁকল, ‘আনিসুর আর আপনার যা সামাজিক অবস্থান, তাতে আনিসুরের আপনাকে ব্ল্যাকমেল করবার কথা, উলটোটা নয়। তাহলে সে আপনাকে হত্যা করতে চাইবে কেন? বরং আপনি তাকে মারতে চাইতে পারেন।’ 

‘গল্পটা না বললে আপনারা বুঝবেন না।’ মাধব রক্ষিত টেবিলের ওপর রাখা গ্লাস থেকে জল খেলেন। ‘আমি লুকোব না কিছুই। অবশ্য লুকোবার কিছু নেই, কলকাতার ব্যবসায়ী মহলে কান পাতলেই আমার অতীত জানতে পারবেন। আমি নিষ্কলঙ্ক ছিলাম না মিস্টার স্যানাল। যৌবনে বেশ কিছু ভুল কাজ করেছি। তখন পূর্ব পাকিস্তান, ইয়ে বাংলাদেশে থাকি। ওখানেই জন্ম, বড়ো হওয়া। অপরাধী দলের সঙ্গে মিলে টুকটাক চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি ছিল। আনিসুর ছিল আমার সঙ্গী। দুজনেরই একদম নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। আনিসুর শৈশব থেকে অনাথ। এক বুড়ি পিসিমার কাছে মানুষ। আমার বাড়িতে ছিল সৎ মায়ের গঞ্জনা আর বাবার উদাসীনতা। তাই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক কিশোর বয়স থেকে ক্ষীণ হয়ে যায়। স্কুলের গণ্ডি পেরোবার পরে আমরা দুজনে পাকেচক্রে অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। কাস্তে দিয়ে ঘাস কাটতে কাটতেই একসময়ে গলাকাটার দক্ষতা আসে, মিস্টার সান্যাল। সেই সময়ে মানে ১৯৪৬ সালের কথা বলছি, কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে রেঙ্গুন পর্যন্ত একটি কোকেন পাচারকারী চক্র সক্রিয় ছিল। আনিসুর সেই চক্রে ঢুকে যায়। আমিও ঢুকতাম, কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অমিতা। অমিতা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত। ওর সঙ্গে প্রেম ছিল আমার। আমি যে খারাপ কাজে যুক্ত, সেটা জেনেও অমিতা আমাকে ছাড়েনি। কিন্তু কোকেন ব্যবসার কথা জানতে পেরে ভয়ানক কান্নাকাটি করেছিল। মাথার দিব্যি দিয়েছিল যে আমি এই কাজ করলে ও আত্মহত্যা করবে। ভদ্রবাড়ির মেয়ে তো, সংস্কার ছিল রক্তের ভেতরে। নেশার বস্তু বিক্রি করে ঘরে টাকা আসবে, এই ভাবনাটা মেনে নিতে পারেনি। আমি জানতাম, অমিতাকে বিয়ে করব। পিতৃমাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত জীবনে একমাত্র ভালোবাসার জায়গা ছিল অমিতা। তাই ইচ্ছে থাকলেও ওকে হারাবার সাহস করিনি। আনিসুরের দলে গিয়ে ভিড়তে পারিনি।’ 

এই পর্যন্ত বলে মাধববাবু থামলেন। তারপর ইতস্তত করে বললেন, ‘এর পরের অংশটা আপনাদের সামনে বলছি, কিন্তু গোপন থাকুক এটুকুই চাই। আমি ফ্যামিলিম্যান মিস্টার সান্যাল। সমাজে কিছু প্রতিপত্তি আছে। তাই অনুরোধ করছি, শেষ কথাটা প্রণবেশের দিকে তাকিয়ে বললেন। শুদ্ধসত্ত্ব নির্বিকার মুখে তাকিয়ে আছে মাধববাবুর দিকে। প্রণবেশ গলা খাঁকারি দিল, ‘আমি তাহলে ঘুরে আসছি। আপনারা কথা চালান।’ 

হাতের ইশারায় প্রণবেশকে বসতে বলে শুদ্ধ আবার মাধববাবুর দিকে ফিরল, ‘আপনি বলুন যা বলছিলেন।’ মাধববাবু প্রণবেশের দিকে তাকাচ্ছেন। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ালেন একবার। ‘বেশ। অমিতার সঙ্গে আমার সবরকম সম্পর্ক ছিল। আমি বাড়ি ফিরতাম না। বাবার সঙ্গে দেখা হতো না বেশি। কিন্তু প্রায়ই রাত্রে লুকিয়ে অমিতার বাড়ি চলে যেতাম। ও চুপিচুপি আমাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসত। খেতে দিত। ওর কাছেই ঘুমোতাম। ভোরবেলা বেরিয়ে যেতাম। যা হয়, আমাদের ব্যাপারটা অনেকদুর এগিয়েছিল। তাতেও সমস্যা ছিল না। ওকেই বিয়ে করতাম। তখন থেকে ব্যবসাপাতির ধান্দায় ঘুরছি। অপরাধ জগতের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় ক্ষীণ। এর আগে কয়েকটা ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তবে ইনফর্মারের কাজ, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে কোনো প্যাকেট ট্রান্সফার করা, এরকম। সেগুলোও সব ছেড়ে দিয়েছি ততদিনে। 

আনিসুরের সঙ্গেও সম্পর্ক কিছুটা আলগা। কিছুদিন রাজশাহীর ব্রিটিশ আর্মি রেজিমেন্টে ঘোরাঘুরি করলাম, যদি ওদের জিনিসপত্র সাপ্লাইয়ের টেন্ডার পাওয়া যায়। আর্মিতে অনেক টাকা, তাই লক্ষ্যটা সেদিকে ছিল। কিছুদিন একটা সিনেমা হলে প্রজেক্টর চালাবার কাজ করলাম। শেষমেষ কলকাতায় এসে কাঁচা সবজির সাপ্লায়ার হবার ধান্দায় ছিলাম। সুবিধে হচ্ছিল না কোনোটাতেই। কিন্তু অমিতাকে ঘরে আনতে গেলে কিছু কাজ করতেই হবে, নাহলে ওর বাবা মায়ের সামনে দাঁড়াতে পারব না। 

আর এই সময়েই ঘটল দেশভাগ। আমি তখন কলকাতায় কাঁচা সব্জির ফড়ের পেছন পেছন ঘুরছি। অমিতা বগুড়াতে। কলকাতায় আটকে গেলাম। দাঙ্গা বাধল দুই বাংলা জুড়ে। আনিসুরের খবর নেই। অমিতার খবর জানি না। আমার তখন পাগলের মতো অবস্থা। প্রচুর চেষ্টা করলাম রাজশাহী যাবার। কিন্তু তখন বর্ডার পেরানো বাস বা ট্রেনের ওপর খোলা তলোয়ার হাতে হামলা চালাচ্ছে দাঙ্গাবাজেরা। হিন্দু পরিচয় জানলে কেটেই ফেলত। ঠিক করলাম কিছুদিন যাক, উত্তেজনা থিতিয়ে গেলে যাব। 

‘যেতে পারলাম না। ওপার থেকে এক চেনা পরিবার এসেছিল কয়েকদিন পর। তাদের মুখে শুনলাম যে আমাদের বাড়ি, অমিতার বাড়ি সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার বাবা এবং সৎমা কেউ বেঁচে নেই। অমিতাদেরও সকলেই নিখোঁজ। নিজের বাবার কথা ভেবে বিশেষ অনুভূতি হলো না। কিন্তু অমিতার মুখ আমাকে ঘুমোতে দিত না রাতের পর রাত। 

তার পরের তিন বছর আমি কলকাতার জনস্রোতের ঢেউয়ে খড়কুটোর মতো ভেসে ছিলাম। কখনও বন্দরে কাজ, কখনও বা খবরের কাগজ ফেরি করা, আবার কিছুদিনের জন্য একটা স্কুলে নামমাত্র বেতনে মাস্টারি, এই করতে করতে শুধুমাত্র নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে গিয়েছি। এর মধ্যে একটা সওদাগরি আপিসে চাকরি পেয়ে গেলাম। কাজ করতে করতে নিতান্ত কপালজোরে চোখে পড়ে গেলাম কোম্পানির ডিরেক্টর অনিল মুখোপাধ্যায়ের। তিনি আমাকে কী চোখে দেখেছিলেন জানি না। তাঁর একমাত্র মেয়ের সঙ্গে আমার বিবাহ-প্রস্তাব আনলেন। আমি একজন নামগোত্রহীন ছেলে, যার জীবনে কিছুই ছিল না, সে এরকম বিরাট সম্পদশালী পরিবারের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হবে— এরকম প্রস্তাব পেয়ে মনের অবস্থাটা অনুমান করতে পারছেন? 

‘এর পরের ইতিহাস উত্থানের কাহিনী। শ্বশুরমশায়ের সম্পত্তি আর কোম্পানির কাজের অংশীদারিত্ব পেয়ে চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় ঢুকলাম। ব্যবসা সফল হলো। আস্তে আস্তে সমাজের উচ্চকোটিতে চলে গেলাম আমি। গত বাইশ বছর ধরে আর পেছনে ফিরে তাকাইনি। 

‘কিন্তু বিগত পাপের হিসেব সম্ভবত চুকিয়ে যেতে হয় এক জীবনেই। ১৯৬০ সালে আমার সঙ্গে আবার দেখা হল আনিসুরের। সে ততদিনে পূর্ব-পাকিস্তানে ছোটোখাটো ব্যবসা করছে। চোরাবাজারি ইত্যাদি তো আছেই। বেশি উন্নতি মনে হয় করতে পারেনি, কারণ অবস্থা বিশেষ ভালো নয় দেখলাম। আমি ততদিনে পূর্বের জীবনকে প্রায় মুছে ফেলেছি। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে সুখী দাম্পত্য। সেইসঙ্গে ব্যবসার কাজেও হিল্লি-দিল্লি ছুটতে হয়। আনিসুর আসা মানে আবার অতীত কাদা ঘাঁটা। কিন্তু আনিসুর যেটা বলল তা শুনে বুঝলাম, অতীত আমার পিছু ছাড়বে না। 

‘অমিতা বেঁচে আছে। শুধু সেটাই নয়, আমি যখন কলকাতায় এসেছিলাম, অমিতা আবিষ্কার করেছিল সে গর্ভবতী। দাঙ্গায় তার বাড়ির সকলে মারা গিয়েছিল। অমিতা গোপনে গর্ভপাত করাবার জন্য টাউনে এসেছিল সেদিন, তাই বেঁচে গিয়েছিল। দাঙ্গার ঝামেলার জন্য গর্ভপাত হয়নি। অমিতা 

তারপর ভাগ্যের সন্ধানে এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে ঢাকা চলে আসে। গারমেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ নেয়। বাচ্চাটা জন্মায়। মেয়ে। সেই মেয়ের ততদিনে তেরো বছর বয়েস হয়েছে। আনিসুরের সঙ্গে অমিতার যোগাযোগ ছিল। সে এতদিন আমার সন্ধান পায়নি। কিছুকাল আগে একটা ভারতীয় খবরের কাগজের পাতা তার হাতে আসে যেখানে তরুণ শিল্পপতি হিসেবে আমার ছবি বেরিয়েছিল। আনিসুরকে সেই ছবি দেখায়। আনিসুর আমার ঠিকানা জোগাড় করে তাই কলকাতায় এসেছে। 

শ্বশুরমশায় তখনও বেঁচে। তিনি আমার অতীত ইতিহাস কিছুই জানতেন না। এখন যদি জানেন যে আমার বিবাহপূর্ব একটি সন্তান আছে, আমাকে সমস্ত সম্পত্তি থেকে বাদ দিয়ে মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন। কোম্পানির পঞ্চাশ শতাংশ শেয়ার স্ত্রীর নামে। সেটা চলে গেলে আমি পথে বসব। এতদিন ধরে তিলতিল করে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে যে সাম্রাজ্য তৈরি করছি, এক লহমায় পুরোটা ধ্বসে যাবে চোখের সামনে। শুধু তাই নয়, স্ত্রী পুত্রদেরও হারাব। মনস্থির করে নিলাম, কিছুতেই এ হতে দেওয়া চলবে না। অমিতা অতীত। অতীতের একটা ভুলের মাশুল আমি সারা জীবন ধরে দিয়ে যেতে পারব না। আনিসুরকে জানালাম, যত টাকা লাগে দেব। কিন্তু অমিতার মুখ বন্ধ রাখতে হবে। 

‘সেই থেকে শুরু। প্রতি বছর কলকাতায় এসে আনিসুর আমার কাছ থেকে একটা মোটা টাকা নিয়ে যেত। মাঝে সন্দেহ করেছিলাম যে অমিতার ব্যাপারটা ও বানিয়ে বলছে। হয়তো সত্যিই কোনো সন্তান নেই। তেষট্টি সালে ঢাকায় শিল্পপতিদের একটা ডেলিগেশনে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম গোপনে। আনিসুর প্রতারক এবং ব্ল্যাকমেইলার হতে পারে, কিন্তু মিথ্যে বলেনি। অমিতা আছে। রমনা বাজারের কাছে একটা বস্তিতে মা-মেয়ে মিলে থাকে। আমার সাহস হয়নি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার। 

‘এই চলছিল। কিন্তু এই নিরন্তর ব্ল্যাকমেইলের শিকার হতে হতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে আনিসুর যত টাকা দাবি করছে তার একটা মোটা অংশ তার পকেটস্থ হচ্ছে। আর আমি যত ওপরে উঠছিলাম, ততই বেশি করে প্রয়োজন হয়ে পড়ছিল আনিসুরের মুখ বন্ধ রাখা। ও নিজেও সেটা বুঝছিল। তাই দাবির পরিমাণও বাড়ছিল। কিন্তু এর তো একটা শেষ আছে। আমি কি সারাজীবন ধরে এভাবে টাকা দিয়ে যাব? কতকাল আর নিজেকে দোহন করতে দিতে পারি? এতদিনে শ্বশুরমশায় মারা গিয়েছেন। সম্পত্তি আমার নামে। স্ত্রী-কে সব খুলে বললে হয়তো তিনি আমাকে ক্ষমা করবেন। চরম সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। সিদ্ধান্ত নিলাম, স্ত্রী-র কাছে মুখ খুলব। এবার যখন আনিসুর কলকাতায় এল, আমি গত পরশু তার হোটেলে গিয়ে স্পষ্ট বলে এলাম যে আর টাকা দেব না। তাতে যা হয় হোক। এটাও বললাম যে লোকলজ্জার ভয় আর এই বয়সে এসে করি না। স্ত্রীকে সব জানাব অতি দ্রুত। এবং পুলিশের কাছেও যাচ্ছি, আনিসুরের সমস্ত ব্ল্যাকমেলিং-এর ইতিহাস ও পূর্বের অপরাধ বলে দেবার জন্য। 

‘আনিসুর একটা কথাও বলল না। কিন্তু ওর চোখ দেখে বুঝলাম যে আমাকে ছাড়বে না। পুলিশের কাছে আমি যদি যাই, ও শেষ হয়ে যাবে। ওর অপরাধের যা তালিকা, সারাজীবন জেলে পচে মরতে হবে ওকে। ও সেটা হতে দেবে না। আমাকে আটকাবেই। ওর চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছিল। একরকম পালিয়েই বাড়ি ফিরে এলাম। তখন প্রায় বিকেল। জানতাম আনিসুর আমার হত্যার অ্যাটেম্পট নেবে। ঠিক করলাম, আপনাকে সব জানিয়ে যাব। যদি সত্যিই আমি না থাকি, তাতেও পরোয়া নেই। আনিসুর যেন শাস্তি পায়। আর আমার মেয়েটা, যার জন্য সারাজীবন কিছুই করতে পারিনি, সে যেন সম্পত্তির কিছুটা পায়। সেই মতন একটা উইলও করব বলে মনস্থির করছিলাম। অবশ্যই আপনার পরামর্শ নিয়ে। কিন্তু আপনার বাড়ি আসবার আগেই পুলিশ হাজির। খবর পেলাম, আনিসুর খুন হয়েছে। খুশি হব না দুঃখ পাব, ঠিক বুঝছি না মিস্টার সান্যাল।’ 

মাধববাবুর বুক কোনো এক উগ্র আবেগে ওঠাপড়া করছে। সেটাকে চাপা দেবার জন্য তিনি উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। রুমাল দিয়ে চোখ ঢাকলেন। শুদ্ধসত্ত্ব এতক্ষণ একটা কখাও বলেনি। এবার মুখ খুলল, ‘খুনের সময়ে আপনি গ্রেট ইস্টার্নে ছিলেন?’ 

চোখ থেকে রুমাল সরিয়ে মাধব রক্ষিত হালকা হাসলেন। ‘অ্যালিবাই খুঁজছেন? শহরের অন্তত পঞ্চাশজন নামী ব্যবসায়ী আমাকে দেখেছেন। সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে রাত এগারোটা। বিশিষ্ট শিল্পপতি স্যার ধীরেন ব্যানার্জির আশিতম জন্মবার্ষিকীর পার্টি ছিল।’ 

‘সেদিন দুপুরের পর থেকে আপনি কী কী করেছিলেন, আমার জানা দরকার।’ 

‘আনিসুরের হোটেলে গিয়েছিলাম দুপুর দুটো নাগাদ। দুপুর তিনটের সময়ে ওর হোটেল থেকে বেরিয়ে আসি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে পৌনে চারটে বেজে যায়। ঠিক করে রেখেছিলাম যে বাড়ি এসেই আপনাকে চিঠি লিখব। কারণ আপনার ফোন নম্বর টেলিফোন ডায়রেক্টরিতে নেই। সেইমতো চিঠি লিখতে বসলেও কী লিখব বুঝছিলাম না। আমরা তো কেজো মানুষ, কলমের মুখে কথা আটকে যায়। বারবার লিখে কেটে ফেলছিলাম। তাই লিখতে লিখতে বিকেল হয়ে যায়। শেষে টাইপ করি, কারণ টাইপিং-এ আমি বেশি স্বচ্ছন্দ, আর মাথাও তাড়াতাড়ি খেলে। সাড়ে পাঁচটায় কোম্পানির একটা মিটিং বসে, বাড়িতেই, শেষ হয় ছটার কিছু পর। সন্ধে সাড়ে ছয়টার সময়ে যাই কলামন্দিরে, ওখানে বন্যাত্রাণ উপলক্ষ্যে একটা চ্যারিটি শোয়ের আয়োজন করেছিল আমার ছোটোছেলে আর ওর বন্ধুরা। যাবার আগে আমার কর্মচারী নকুলকে চিঠি দিয়ে বলি আপনার ডাকবাক্সে যেন ফেলে আসে। ডাকে পাঠালে হয়তো ৩ তারিখের মধ্যে পৌঁছাতো না। কলামন্দিরে পৌঁছোই সাতটা বাজতে দশ নাগাদ। সেখানে আধ ঘণ্টা মতন থেকে তারপর গ্রেট ইস্টার্নে আসি। রাত এগারোটা, না না, মনে হয় এগারোটা পনেরো পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। ভুল বললাম, এগারোটা পঁচিশ। কারণ ঘড়ি দেখেছিলাম গাড়িতে ওঠার সময়ে, আর মনে মনে ভাবছিলাম বড়ো দেরি হয়ে গেল! রাত এগারোটা চল্লিশে বাড়ি ফিরি!’ 

‘আপনার ড্রাইভার নেই?’ 

‘আছে! কিন্তু সেদিন ও আগে থেকে বলে রেখেছিল আটটার মধ্যে ছুটি দিয়ে দিতে, কারণ ওর মেয়ের জ্বর। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চায়। আমাকে গ্রেট ইস্টার্নে পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছিল। রাত্রে নিজেই গাড়ি চালিয়ে ফিরেছিলাম।’ 

শুদ্ধসত্ত্ব কিছু একটা চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘আপনার বাড়ির ঠিকানাটা একবার লিখে দেবেন এই কাগজে? খামটা মনে হয় হারিয়েছি।’ 

মাধব ঠিকানা লিখলেন। তারপর বললেন, ‘আপনার যদি আর কোনো প্রশ্ন না থাকে, এবার বাড়ি ফিরতে চাই। ক্লান্ত বোধ করছি। মন চাইছে খানিক একা থাকতে। 

‘আপনি কি সত্যিই আমাকে এই কেসে রহস্যোদ্ঘাটনের জন্য অ্যাপয়েন্ট করছেন?’ 

‘করছি! আমি চাই আপনি হত্যাকারীকে খুঁজে বার করুন। নাহলে আমার ওপর সন্দেহ থেকেই যাবে। আপনার ফি-টা জানিয়ে দেবেন শুধু।’ 

‘বেশ। কাল জানাব। আর অ্যাডভান্সটাও কাল আপনার বাড়ি থেকে নেব। আপনি এখন বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিন।’ 

মাধব রক্ষিত বেরিয়ে যাবার পর শুদ্ধ একটা খাম বার করল টেবিলের তলা থেকে। প্রণবেশ অবাক হয়ে বলল, ‘এই যে বললে খাম হারিয়েছে?’ 

‘হাতের লেখা মেলাতে হতো না? নাহ্, দুটো হাতের লেখাই এক চিঠিটা যে মাধব রক্ষিতই পাঠিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই।’ 

‘গল্পটা কী বুঝলে?’ 

‘হৃদয়বিদারক।’ ইজিচেয়ারে টান টান হয়ে শুয়ে নস্যি কৌটো বার করল শুদ্ধ। তবে এই উচ্চশ্রেণীর লোকজনের নীতিবোধ আমাদের থেকে অন্যরকম হয়। তুমি বা আমি যেখানে বাচ্চাটাকে দেখবার জন্য ছুটে যেতাম, এরা সেখানে আগে নিজেদের সম্পত্তি বাঁচাবার চেষ্টায় উন্মুখ হয়ে উঠে। হয়তো অনেক কিছু হারাবার থাকে এদের!’ 

‘এই বয়সে এসে বিবেক জাগ্রত হয়েছে মনে হয়। উইলের কথাটা বলল দেখলে না?’ 

‘আগে বানাক! অন্য মক্কেল হলে আমি বাংলাদেশ চলে যাবার কথা ভাবতাম। অমিতা আর তাঁর সন্তানকে এখানে নিয়ে এলে ভালো হতো। কারণ আনিসুরের হত্যার বীজও সম্ভবত অতীতেই লুকিয়ে আছে। কিন্তু এই মক্কেল তা অনুমোদন করবেন বলে মনে হয় না। কিছুতেই চাইবেন না অমিতা এসে তাঁর পরিবারের সামনে দাঁড়ান। আর নিজের পয়সাতে বাংলাদেশ যাবার প্রশ্নই নেই। বাড়িতে বসে কচি পাঁঠার ঝোল খেতে খেতে মাথা খাটানোর মতো বেড়ে জিনিস আর হয় না। দাও একটা সিগারেট।’ 

সিগারেট দিয়ে উঠে পড়ল প্রণবেশ। তাকেও বেরোতে হবে। রাত প্রায় এগারোটা। কিন্তু দরজার দিকে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দরজার পাশের একটা টেবিলের ওপর ঝুড়িতে সেদিনের ডাকে আসা চিঠিপত্র রাখা থাকে। শুদ্ধর দিকে ফিরে বলল, ‘তুমি বিকেলের ডাকে আসা চিঠিগুলো দেখোনি?’ 

‘নাহ, সময় পেলাম কই! সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরেই তো ফোন নিয়ে বসতে হলো। কেন?’ 

একটা খাম হাতে তুলে দেখাল প্রণবেশ। প্রেরকের জায়গাতে নাম নেই, শুধু আনিসুরের হোটেলের ঠিকানা লেখা। 

এক লাফে এগিয়ে এসে খামটা ছিঁড়ে ফেলল শুদ্ধসত্ত্ব। তারপর ভেতরের কাগজ বার করে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকল। কাগজ পুরো সাদা। একটা কালির আঁচড় পর্যন্ত নেই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *